তৃতীয় অধ্যায় – অধিবাসী
অধিবাসী :- ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারি অনুসারে ত্রিপুরা রাজ্যে ১৩৭৪৪২ জন লোকের বাস। কিন্তু গণনা সম্পূর্ণ (১৫) বিশুদ্ধ হইয়াছিল বলিয়া আমাদের বোধ হয় না। ত্রিপুরা রাজ্যে পশ্চিমাংশ— যাহা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিকটবর্ত্তী তাহাতেই অধিক লোকের বাস। ক্রমে পূর্বদিকে মনুষ্য বসতি বিরল।
ত্রিপুরারাজ্যবাসীদিগকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। প্রথমত বাঙ্গালী, দ্বিতীয়ত লৌহিত্য বংশজ।
বাঙ্গালি :- ইহাদিগকে তিন শাখায় বিভক্ত করা যাইতে পারে। যথা, হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান। মুসলমান প্রায় ৪০ হাজার এবং হিন্দু ১০ সহস্রের ন্যূন হইবে। খ্রিস্টান দুই শতের ন্যূন। ত্রিপুরা রাজ্যে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু মুসলমান নিতান্ত বিরল, নাই বলিলে নিতান্ত অত্যুক্তি হয় না। খ্রিস্টানগণ চট্টগ্রামের ফেরিঙ্গী বংশজ। ইহারা পূর্বে মহারাজের সামরিক বিভাগে কার্য্য করিত।
লৌহিত্যবংশ :- নরজাতিতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণ যাহাদিগকে “তিব্বতী ব্ৰহ্ম” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, আমরা তাহাদিগকে লৌহিত্য বংশ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছি। লৌহিত্য অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র (যারকিও- সাংপো) নদের তীর ভুমি ইহাদের প্রাচীন নিবাসস্থল। এই প্রবাদ হইতে ইহারা লৌহিত্যবংশ আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। লৌহিত্য বংশ তিন শ্রেণীতে (১৬) বিভক্ত যথা : – হিমালয়, পূর্বপ্রান্ত ও মগী।[১] ত্রিপুরা রাজ্যে পূর্বপ্রাপ্ত ও মগী শ্রেণীর সংমিশ্রণ দৃষ্ট হইতেছে।
তুইপ্রা বা তিপ্রা (ত্রিপুরা) গণ প্রধানত চারি শাখায় বিভক্ত যথা, (১) তিপ্ৰা, (২) জমাতিয়া (৩) নওয়াতিয়া, (৪) রিয়াং। এই সকল প্রধান শাখা বহুবিধ প্রশাখায় বিভক্ত।
তিপ্ৰা :- এই শাখা হইতে বর্ত্তমান রাজবংশের উদ্ভব। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ ইহা ঘোষণা করিতেছেন।[২] রেইনল্ড সাহেব লিখিয়াছেন, “আকৃতি দ্বারা তিপ্রাগণ খসিয়াদিগের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি বলিয়া বোধ হয়।”[৩] ইতিহাস লেখক (১৭) বিবেচনা করেন ইহারা শ্যানবংশরূপ বিশাল দ্রুমের একটি শাখা। তিপ্রা ও কাছাড়িগণ সেই শাখায় দুইটি প্রশাখা মাত্র। আমাদের প্রভু শব্দটি শ্যান ব্রহ্মা প্রভৃতি জ্ঞাতি দ্বারা “ফ্রা” রূপে অপভ্রংশত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। সেই সেই জাতীয় নরপতিগণ এই “ফ্রা” উপাধি ধারণ করিতেন। এই ফ্রা হইতে “ফা” শব্দের উদ্ভব। মাণিক্য উপাধি প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে ত্রিপুরা পতিগণ সকলেই “ফা” উপাধি ধারণ করিতেন। কল্যাণ মাণিক্যের অভিষেকের পূর্ব পর্য্যন্ত নরপতি ব্যতীত রাজ বংশজ অন্যান্য ব্যক্তিগণ সেই ফা আখ্যা দ্বারা পরিচিত হইতেন। ২৭০ বৎসর গত হইল মহারাজ কল্যাণমাণিক্য স্বীয় বংশধরদিগকে “ফা”র পরিবর্তে “ঠাকুর” আখ্যা প্রদান করেন।
ত্রিপুরাগণ নিম্নলিখিত প্রশাখা বা “দফায়” বিভক্ত যথা :- (১) তিপ্রা (ত্রিপুরা), (২) বাছাল, (৩) দৈত্যসিং, (৪) কুওয়াতিয়া, (৫) সিউক, (৬) ছত্ৰতিয়া, (৭) গালিম, (৮) আপাইয়াছা, (৯) (১০) ছিলটিয়া, (১১) সেনা। সর্বপ্রকার ত্রিপুরার সংখ্যা বোধ হয় ৪০ সহস্রের ন্যূন হইবে না।
জমাতীয়া :- ইহারা তিপ্রাবংশের একটি বিশুদ্ধ শাখা। প্রাচীন কালে ইহারা ত্রিপুরার প্রধান সৈন্য ছিল। ইহাদের সংখ্যা ৪/৫ সহস্রের ন্যূন হইবে না। ১২৭৩ ত্রিপুরাব্দে ইহারা রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ পূর্বক নিতান্ত ক্ষতিগ্রস্ত ও (১৮) দুর্বল হইয়া পড়ে।[৬] তদনন্তর জমাতীয়াগণ পার্বতীয় উগ্রভাব পরিহার পূর্বক ক্রমে নিরীহ বাঙ্গালি ভাব ধারণ করিতেছে। ইঁহারা জুম কৃষি পরিত্যাগ করত বাঙ্গালির ন্যায় ক্রমে গরুর দ্বারা হল কর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে।
নওয়াতীয়া :- বোধ হয় মগবংশের কতকগুলি লোক তিপ্রদিগের সহিত মিশ্রিত হইয়া নওয়াতীয়া বা নূতন তিপ্রা বলিয়া পরিচিত হইয়াছে। ইহাদের সংখ্যা ৩/৪ সহস্র হইবে। নওয়াতীয়াগণ নিরীহ প্রকৃতি সম্পন্ন।
রিয়াং :- ইহাদিগকে কুকিদিগের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি বলিয়া বোধ হয়। তিপ্রাদিগের মধ্যে ইহাদিগের প্রকৃতি সবর্বপেক্ষা উগ্র। রিয়াং দফার সংখ্যা বোধ হয় ৪ সহস্রের ন্যূন নহে। শারীরিক গঠন :- তিপ্রাগণ মধ্যমাকার, সবল শরীর, ঈষৎ গৌরবর্ণ, নাসিকা চাপা, চিবুক শ্মশ্রু হীন, বাহুযুগল মাংসল, পদগুচ্ছ মোটা, ও সুদৃঢ়। ইহাদিগকে দর্শন করিলেই লৌহিত্য বংশজ বলিয়া বোধ হয়।
স্বভাব :- তিপ্রা জাতির স্বভাব মধুর, সুন্দর ও সারল্যপূর্ণ। ইহারা দুর্দান্ত কুকিদিগের ন্যায় শ্বাপদ প্রকৃতি সম্পন্ন না হইলেও ভীরু নহে। পর দুঃখে ইহাদের হৃদয় গলিয়া যায়। কাপট্য ইহাদের নিকট স্থান প্রাপ্ত হয় না। ইহাদের (৯) হৃদয়ের প্রফুল্ল ভাব সর্বদা বদন মণ্ডলে প্রতিভাত হইয়া থাকে যে সকল কুপ্রবৃত্তি দ্বারা মনুষ্য ক্রুর ও পশুভাবাপন্ন হইয়া থাকে, ইহাদিগের মধ্যে সেই সকল কুপ্রবৃত্তি প্রায় দৃষ্ট হয় না। কোন বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করিলে, ইহারা তাহা প্রাণান্তেও লঙ্ঘন করে না। ইহারা স্বাবলম্বী, পরের গলগ্রহ হওয়া ইহাদের পক্ষে নিতান্ত কষ্টদায়ক। ইহাদের একতা বিশেষ প্রসংশনীয়। ইহারা আশুতুষ্ট ও আশুরুষ্ট জাতি, তদ্ব্যতীত ইহাদের প্রতি অন্য কোনরূপ দোষারোপ করা যাইতে পারে না। ইহা নিতান্ত দুঃখের বিষয় যে, ব্যবসায়ী ও রাজকর্মচারিগণের সংসর্গে তিপ্রাজাতির দেবতুল্য চরিত্র ক্রমে স্থলিত হইতেছে।
বাসস্থান :- পর্বতের সানুদেশে দ্বিতল কাঁচাগৃহ নির্মাণ করিয়া তিপ্রা জাতি বাস করে। নিম্নে তাহাদের পালিত পশু পক্ষী থাকে। মাচার উপরে বা দ্বিতল প্রকোষ্ঠে ইহারা সপরিবারে বাস করে। ইহাদের এক একটি বাড়ি, এক একখানি ক্ষুদ্র পল্লী সদৃশ, তাহাকে পাড়া বলে। অনেকগুলি পরিবার একত্রিত হইয়া তাহাতে বাস করে। প্রত্যেক বাটীর এক একজন সরদার আছেন, তাঁহারা রাজসরকার হইতে চৌধুরী কবরা, পোয়াং সেনাপতি প্রভৃতি উপাধি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। সরদারগণ সামন্ত নরপতি বিশেষ। সামান্য অপরাধ (২০) ও সামাজিক বিরোধের বিচারকার্য্য তাঁহাদের দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে। ইঁহারা স্ব স্ব বাটীর নিকট, পর্বতের নিম্নস্থিত নির্ঝর কিংবা ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীর পার্শ্বে ক্ষুদ্র কূপ খনন করে। সেই সকল কূপ সর্বদা নির্মল ও সুশীতল জল পরিপূর্ণ থাকে। তাহারা সেই জল পান করে।
জমুক্ষেত্র :- এক বাটী বা পাড়ার স্ত্রী পুরুষগণ একত্রিত হইয়া জুমক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অন্ধ আতুর ব্যতীত অন্য সকলেই তাহাতে কার্য্য করে। পৌষ মাঘ মাসে ক্ষেত্রের জন্য একটি বৃহদায়তন স্থান নির্ণয় করিয়া তাহার বন জঙ্গল কাটিয়া ফেলে। প্রায় একমাস কাল সূর্য্যের উত্তাপে সেই সকল শুষ্ক হইয়া যায়। চৈত্রমাসে তাহা অগ্নিদ্বারা দগ্ধ করে। বৈশাখ মাসে টাকুয়াল নামক “দা” দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত করিয়া তাহাতে ধান্য, কার্পাস, ফুটি, কাঁকুড়, তরমুজ, মরিচ, ভুট্টা, ও নানা প্রকার তরকারীর বীজ একত্র করিয়া বপন করে। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় মাসে জুম ক্ষেত্র বাছিয়া পরিষ্কার করিয়া দেয়। এই সময় ভুট্টা, ফুটি, কাঁকুড় প্রভৃতি সুপক্ক হইয়া থাকে। শ্রাবণ মাসে ধান্য বাহির হইতে থাকে। ভাদ্র আশ্বিন মাসে তাহা কাটা শেষ হয়। কার্ত্তিক মাসে কার্পাস ও তিল সংগ্রহ করা হয়। জুমক্ষেত্রে ত্রিপ্রাগণ নানা প্রকার কচু উৎপন্ন করিয়া থাকে, তাহা অতিশয় সুখাদ্য। দীর্ঘকাল কোন এক স্থানে জুমকৃষি করিলে প্রচুর পরিমাণে শস্য উৎপন্ন হয় না। এজন্য তাহারা (২১) ২/৩ বৎসর অন্তে বাসস্থান পরিত্যাগ পূর্বক নূতন স্থানে যাইয়া বাটী নির্মাণ করেও তাহার পার্শ্বে জুমক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
ব্যবসায় :- তিপ্রাগণ তাহাদের জুমক্ষেত্রের কার্পাস ও তিল এবং অরণ্যজাত কাষ্ঠ, বেত, ছন (খড়) ও জালানী কাষ্ঠ বিক্রয় করিয়া অর্থ সংগ্রহ করিয়া থাকে।
রাজকর :- ইহাদিগকে ভূমির কর দিতে হয় না। অন্ধ, আতুর, অবিবাহিত ও বিপত্নীক ব্যতীত অন্যেরা কর প্রদান করে। প্রতি দম্পতি বার্ষিক ৩ টাকা হইতে ৮ টাকা পর্য্যন্ত রাজকর প্রদান করিয়া থাকে।
বিবাহঃ- ইহাদের মধ্যে দুই প্রকার বিবাহ প্রচলিত আছে (১) হিক্ানানী, (২) কাইনানী।
হিনানানী :- স্ত্রী পুরুষের পরস্পর মনোমিলন দ্বারা এই বিবাহ সম্পন্ন হয়। ইহাই আদিম ও বিশুদ্ধ প্রথা। ইহাতে কোনরূপ ক্রিয়া কার্য কিম্বা কৃত্রিম উৎসবের প্রয়োজন নাই। পরস্পর “ত্বং মে পতি ত্বং মে ভার্যা” ইত্যাকার জ্ঞান বা স্বামী স্ত্রী এইরূপ স্বীকারই এ বিবাহের একমাত্র কার্য্য। এইরূপ বিবাহে সামাজিকদিগকে একটি ভোজ দিতে হয়। কিন্তু দরিদ্র কিংবা অক্ষম ব্যক্তি এরূপ ভোজ প্রদান করিতে বাধ্য নহে।
কাইজ্নানী :- অভিভাবকদিগের প্রস্তাব অনুসারে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। ইহাতে বরকে বিবাহের পূর্বে ন্যূনাধিক (২২) এক বৎসর কাল শ্বশুরের গৃহে থাকিয়া তাহার সাংসারিক কার্য্য নির্বাহ করিতে হয়। এই সময় বর কন্যা স্বামী স্ত্রীবৎ ব্যবহার করিয়া থাকে; ইহা তাহারা নিন্দনীয় কার্য্য বলিয়া বিবেচনা করে না। নির্দিষ্টকাল অতীত হইলে শূকর ও কুক্কুট প্রভৃতি বলিদান পূর্বক লামপ্রা নামক দেবতার পূজা প্রদান করত কন্যার মাতার প্রদত্ত একপাত্র মদিরা কন্যা অর্দ্ধাংশ পান করিয়া অপরার্দ্ধ বরকে পান করিতে দেয়, বর তাহা পান করিলেই বিবাহ সম্পন্ন হইল। আত্মীয় বর্গের পান ভোজন প্রভৃতি কাৰ্য্য প্রচুররূপে সম্পন্ন হইয়া থাকে। বিবাহের রাত্রি প্রভাত হওয়ার পূর্বে বর স্থানান্তর চলিয়া যায়। দুই দিবা এক রাত্রি তথায় অবস্থান পূর্বক বর পুনর্বার স্ত্রীর নিকট আগমণ করে।
আমাদের ব্রাহ্মণ ঠাকুরগণ নিবিড় অরণ্যবাসী প্রকৃতির পুত্র কন্যাগণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া এই “কাইজানী” বিবাহটিকে বাঙ্গালিদিগের বিবাহের ন্যায় করিবার জন্য উপায় করিয়া ফেলিয়াছেন। কন্যার পণ, যৌতুকের ব্যবস্থা,[৬] পুরোহিতের মন্ত্র পাঠ, কন্যা সম্প্রদান, পুরোহিতের প্রাপ্য, নাপিতের প্রাপ্য, ধোপার প্রাপ্য সকলই ঠিক হইয়া গিয়াছে। (২৩)
তিপ্রাদিগের মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। পরিত্যাগ প্রথা ইহাদের মধ্যে অপ্রচলিত নহে। পরিত্যাগের জন্য বিরোধ উপস্থিত হইলে গ্রাম্য পঞ্চাইতগণ তাহার বিচার করিয়া থাকেন। কোন পক্ষ ইহাতে অসম্মত হইলে সে ব্যক্তি রাজদ্বারে উপস্থিত হইতে পারে। পরিত্যক্ত স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করিতে পারে।
দেবতা :- তিপ্রাগণ নানা প্রকার দেব দেবীর পূজা করিয়া থাকে। চতুৰ্দ্দশটী দেবতা তাহাদের প্রধান উপাস্য। আমাদের ব্রাহ্মণ ঠাকুরগণ তাঁহাদিগকে কিরূপ হিন্দু আখ্যায় পরিচিত করিয়াছেন, তাহা পশ্চাৎ প্রদর্শিত হইবে। এই চতুৰ্দ্দশ দেবতা ব্যতীত আরও কয়েকটি দেবতা তাহাদের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন। তিপ্ৰাগণ ক্রমে ক্রমে হিন্দু সমাজে অনুপ্রবিষ্ট হইতেছে, সুতরাং হিন্দুর ৩৩ কোটি দেবতা তাহাদের পূজা ও উপাস্য হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু আমরা কেবল তাহাদের জাতীয় দেবতারই উল্লেখ করিব। তিপ্ৰা ভাষায় দেবতাকে মতই বলে।
মতইকতর :- মতই- দেব; কতর – মহা শ্রেষ্ঠ, বৃহৎ যৌগিক অর্থ মহাদেব। ইনি তিপ্রাদিগের প্রধান উপাস্য দেবতা। মহাদেব যে কিরাত জাতির প্রধান উপাস্য দেবতা (২৪) তাহা আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারগণও স্বীকার করিয়াছেন। লৌহিত্য বংশীয় অনাৰ্য্যদিগকে হস্তগত করিবার জন্য বৌদ্ধদ্রোহী ব্রাহ্মণগণ, তাহাদের প্রধান দেবতাটি আপনাদের দেবতা শ্রেণীতে সংস্থাপন করিয়াছেন কিনা তাহা বিশেষ বিবেচ্য।[৭] তিব্বতদেশ হইতে মহাদেব ও মহাদেবীর যে বর্ণনা ও চিত্রপট সংগৃহীত হইয়াছে, তদ্বারা এ সম্বন্ধে বিশেষ সন্দেহ উপস্থিত হইতেছে।[৮] মহাদেবের নিবাস ভূমি (কৈলাস) কিরাত জাতির সূতিকা গৃহ তিব্বতদেশ মধ্যে অবস্থিত। হস্তী (২৫) কিম্বা ব্যাঘ্র চর্ম তাঁহার বসন। তাঁহার পত্নী দুর্গা ও গঙ্গা উভয়ই কিরাত কন্যা।[৯] মহাবীর অর্জুন কিরাত বেশ ধারণ পূর্বক তপস্যা করত কিরাতরূপী ভগবান “বিরূপাক্ষের” দর্শন লাভ করিয়াছিলেন। ঋগ্বেদে হরগৌরীর উল্লেখ নাই। প্রথম মণ্ডলের ২৭ সূক্তের ১০ম ঋকে অগ্নিকেই রুদ্র বলিয়া সম্বোধন করা হইয়াছে।[১০] সামবেদীয়া কেনোপনিষদে আমরা প্রথমত হৈমবতী উমাদেবীর দর্শন পাইতেছি। কিন্তু তাহাতে তিনি শিবের পত্নী নহেন। ইন্দ্ৰকে ব্ৰহ্মতত্ত্ব উপদেশ প্রদান জন্য কেনোপনিষদে “অতি সৌন্দৰ্য্য শালিনী হৈমবতী উমার” প্রথম আবির্ভাব। এবপ্রকার বহুবিধ কারণে অনুমিত হইতেছে যে, কিরাত জাতির প্রধান উপাস্য দেব মতইকতর আমাদের পুরাণাদিতে “মহাদেব” রূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন।
লাম্প্রা :- খাব্ধি (আকাশ ও সমুদ্র) দুইটি দেবতা।[১১] সর্বপ্রকার মাঙ্গলিক কার্য্যে “লামপ্রা” পূজা হইয়া থাকে। (২৬)
সাংগ্ৰমা :- হিমাদ্রি। চতুৰ্দ্দশটি দেবতার মধ্যে সর্বতা লাপ্রা ও সাংগ্রমার পূজা হইয়া থাকে। অন্যান্য দেবতাগণ প্রায়ই নিদ্রিত থাকেন।
তুইমাঃ— গঙ্গা। অগ্রহায়ণ মাসে বিশেষরূপে তুইমা পূজা হইয়া থাকে। তদ্ব্যতীত সচরাচর সামান্য ভাবে তুইমা পূজা হয়। কাহারও কোন রোগ হইলে নিকটবর্ত্তী নদীতে তুইমার পূজা প্রদান পূর্বক ওঝাই (পুরোহিত) বলে, এই রোগীকে অমুক দেবতা আক্রমণ করিয়াছেন। অতএব সেই দেবতার পূজা দিতে হইবে। তদনুসারে ঐ দেবতার পূজা প্রদান করা হয়।
মাইলুমা :- ধান্যের দেবতা। তাঁহার কৃপাতে ধান্য উৎপন্ন হইয়া থাকে। তিনি বিমুখ হইলে ধান্য জন্মে না।
খুসমা :- কার্পাসের দেবতা। তাঁহার কৃপাতে কার্পাস জন্মে।
বুড়াছা :- রোগশান্তির জন্য প্রায়ই এই দেবতার পূজা হইয়া থাকে। বনিরাও এবং থনিরাও। ইহারা দুই ভ্রাতা বুড়াছার পুত্র।
বুড়িরক :-৭টি ভগিনী ৬ জনা বিবাহিতা তাঁহাদের স্বামী আছেন। সর্ব কনিষ্ঠা অবিবাহিতা তিনি মনুষ্য লইয়া ক্রীড়া করেন। কেহ ইহাদিগকে ডাকিনী, যোগিনী, কেহবা “৭ বইন পরী” বলিয়া থাকেন। (২৭)
গরাইয়া ও কালাইয়া :- ইহারা দুই ভাই। চৈত্র সংক্রান্তিতে আমাদের বারওয়ারি পূজার ন্যায়, বিশেষ ধুমধামের সহিত ইহাদের পূজা হইয়া থাকে। গ্রামের সকল লোক এই পূজায় যোগদান করে। তৎকালে ২/৩ দিন তিপ্রাগণ মদ্যপানে উন্মত্ত হইয়া নৃত্যগীতে অতিবাহিত করে। তাহারা মূলীবাঁশ পুঁতিয়া দেবতার পূজা করিয়া থাকেন। ত্রিপুরাগণ সকল দেবতা পূজাতেই দুইটী বাঁশের চুঙ্গি গ্রহণ করে। তাহার একটিতে জল অন্যটিতে মদ্য থাকে। তাহাদের জাতীয় ভাষায় মন্ত্র পাঠ করত সেই চুঙ্গি হস্তে লইয়া জল ও মদ্য দেবতাকে প্রদান করে। ইহারা মুরগির ও হাসের ছানা, শূকর, পাঠা প্রভৃতি বলিদান করত দেবতার পূজা করিয়া থাকে।
রাজকীয় পূজা
খার্চি পূজাঃ- আষাঢ় মাসে চতুৰ্দ্দশ দেবতার বাটীতে এই পূজা হইয়া থাকে। তৎকালে জীব রুধিরে স্রোত প্রবাহিত হয়। এই পূজায় অন্যূন ২/৩ শত ছাগ বলিদান করা হয়। পূর্বে এই খার্চি পূজায় নরবলি দেওয়া হইত।
কের পূজা :- খার্চি পূজার ১৪ দিন পরে চতুৰ্দ্দশ দেবতার বাটীতে এই পূজা হইয়া থাকে। এই পূজার সময় এক দিবা দুই রাত্রি ত্রিপুরাবাসিগণকে গৃহে আবদ্ধ থাকিতে হয়। এমন কি নৃপতিও গৃহের বাহির হইলে চতুৰ্দ্দশ দেবতার প্রধান পূজক চন্তাই তাঁহার অর্থ দণ্ড করিয়া থাকেন। (২৮)
পুরোহিতঃ- ত্রিপুরাদিগের জাতীয় পুরোহিতগণ “ওঝাই” বলিয়া পরিচিত। চতুৰ্দ্দশ দেবতার প্রধান পূজক চন্তাই আখ্যা প্রাপ্ত হন। ইনি ত্রিপুরা রাজ্যের “লর্ড বিশপ”। তাঁহার অধীন পূজকগণ গালিম নামে অভিহিত। পুরোহিতের পুত্র পুরোহিত হইবে, এইরূপ নিয়ম ত্রিপুরাদিগের মধ্যে নাই। মন্ত্রাদি শিক্ষা করিলে যে কোন ত্রিপুরা ওঝাই ও গালিম হইতে পারে। প্রধান গালিম চন্তাই হইয়া থাকেন।
ত্রিপুরাজাতি সকল বিষয়েই বাঙ্গালিদিগের অনুকরণ করিতেছে। ইহাদের ধর্ম, কর্ম, আচার, ব্যবহার, বসন, ভূষণ সকলই পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে।
ত্রিপুরাদিগের স্বতন্ত্র একটি ভাষা আছে। ইহা লিখিত ভাষা নহে। তাহাদিগের পার্শ্ববর্ত্তী অন্যান্য পার্বত্য জাতির ভাষার সহিত ইহার বিশেষ সংশ্রব রহিয়াছে। কিন্তু অবিকৃত ও বিকৃত বাঙ্গালা শব্দ ক্রমে এই ভাষায় প্রবেশ করিতেছে।
হালাম :- ইহারা কুকি ও ত্রিপুরার মধ্যবর্তী জাতি। আমাদের বিবেচনায় ইহারা মিশ্রজাতি : হালামগণ প্রধানত ত্ৰয়োদশ “দফা” (শাখায়) বিভক্ত, যথা— ১) রাংখল, ২) কাইপেং, ৩) মরছম, ৪) রুপনী, ৫) খুলং, ৬) দাপ, ৭) কলই, ৮) চড়াই, ৯) মছবাং, ১০) লঙ্গাই, ১১) বংশের, ১২) কর্বং, ১৩) মুতিলাংল। এই সকল শাখা অনেকগুলি প্রশাখায় বিভক্ত। ইহাদের ভাষা মূলত এক হইলেও (২৯) ভিন্ন ভিন্ন “দফা” দ্বারা এরূপ ভাবে ব্যবহৃত হয় যে, প্রত্যেক দফার এক একটি স্বতন্ত্র ভাষা বলিয়া বোধ হয়। হালামগণ কুকি বলিয়া পরিচিত হইবার জন্য লালায়িত। হালামদিগের বৃত্তান্ত অনবগত ব্যক্তিগণ তাহাদিগকে কুকি বলিয়া বিবেচনা করেন। ইহাদের সংখ্যা প্রায় দশ সহস্র হইবে।
কুকিঃ- ইহাদিগের বিবরণ পশ্চাৎ স্বতন্ত্র ভাবে লিখিত হইবে।[১২]
ত্রিপুরেশ্বরের অধীন কুকিগণ পূর্বে কোনরূপ কর প্রদান করিত না। বিশেষ বিশেষ কাৰ্য্য কিম্বা পবের্বাপলক্ষে রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া গজদন্ত উপঢৌকন প্রদান করিত। অধুনা পার্ব্বত্য জাতির নিয়মানুসারে কিঞ্চিৎ কর প্রদান করিতেছে। ইহাদের সংখ্যা বিশুদ্ধ ভাবে লিপিবদ্ধ করা দুরূহ।
মণিপুরী বা মেখ্লী :- প্রথম ব্রহ্ম যুদ্ধের সময় হইতে মণিপুরীগণ ত্রিপুরা রাজ্যে উপনিবেশ স্থাপন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। ত্রিপুররাজবংশে কন্যা সম্প্রদান করত ইঁহারা ধনবান ও সম্মানিত হইতেছে। ত্রিপুর রাজ্যে ইহাদের সংখ্যা ১০/১২ সহস্রের ন্যূন হইবে না।
আসামীঃ- মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুর আসামের “আহুম বংশীয়” রাজকন্যা বিবাহ করেন। সেই সূত্রে (৩০) কতকগুলি আসামদেশীয় মানব ত্রিপুর রাজ্যে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে।
চাক্ঙ্ক্ষাঃ- অল্পকাল মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী কতকগুলি চাকমা মগ ত্রিপুরায় উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে। “চীন লুসাই” অভিযান সময় “কুলিধরার” ভয়ে প্রায় দশ সহস্র চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিত্যাগ করিয়া ত্রিপুরায় উপনীত হইয়াছিল। ইহারা পুনর্বার চট্টগ্রাম গমন করিতেছে।
.
টীকা
১. হিমালয় শ্রেণী : ১) মেচ ২) কোচ ৩) লেপচা ৪) ভুটীয়া ৫) তিব্বতী। পূৰ্ব্বপ্রান্ত শ্রেণী : ১) গারো ২) ত্রিপুরা ৩) কাছাড়ি ৪) মণিপুরী ৫) নাগা ৬) কুকি ৭) খেয়ান।
মগী শ্রেণী : ১) আরাকানী ২) ব্রহ্মা ৩) শ্যান ৪) খশ ইত্যাদি।
২. Statiscal Account of Bengal Vol. VIP 482
Lewin’s Hill Tracts of Chittagong P. 79.
Dalton’s Ethnology of Bengal P. 109.
৩. Reynold’s Tribes of the Eastern Frontier (J.A.S.B. XXXII 407 )
৪. দুই শতাধিক জমাতিয়া মুণ্ড দ্বারা সেই বিদ্রোহনল নির্বাপিত হয়। (0. Donel’s Report 1863-64)
৫. এই পোয়াং শব্দটি আমাদিগকে শ্যান ইতিহাস স্মরণ করিয়া দিতেছে।
৬. যৌতুকের ব্যবস্থা অতি চমৎকার হইয়াছে যথা, পিতলের কলসী এক জোড়া, থালা এক জোড়া, বাটী এক জোড়া, ঘটি এক জোড়া, শৌল মৎস্য এক জোরা, পায়রা এক জোড়া, পাঠা এক জোড়া এবং মসল্যা ১২ প্রকার। ইহাই কন্যার পিতাকে দিতে হয়।
৭. His (Mahadeb ) residence in the far Kylasa, his braided hair, his obliqueeyes, his great proclivity for smoking, his reputed auther- ship of the Tantrika, nasal, monosyllabic Mantras, go far to prove him to be a Mongolian rather than of Arayan type. Rangalal Banerji’s Identification of Aboriginal Tribes (P.A.S.B. 1874. P. 10)
৮. শ্রীযুক্ত শরচ্চন্দ্র দাস মহাশয় তিব্বত দেশ হইতে এই তত্ত্ব ও চিত্রপট সংগ্রহ করিয়াছেন। See Journal and Text of the Buddhist Text Society of India Vol. I. Part III, আমাদের মহাদেবের বাহন বৃষ, কিন্তু তিব্বতিদিগের মতে তিনি মহিষ বাহন। আমাদের মহাদেব সংহারকারী, তিব্বতিগণও তাঁহাকে মৃত্যুপতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার গলদেশে নরমুণ্ডমালা বিলম্বিত; মস্তকে নরকপাল শোভিত মুকুট। তাঁহার পত্নী শ্রীমতী চামুণ্ডাদেবী ‘মহাপাত্র’ দ্বারা তাঁহাকে মদিনা পান করাইতেছেন। চামুণ্ডাদেবী উলঙ্গিনী, পৃষ্ঠে ব্যাঘ্রচর্ম্ম বিলম্বিত
৯. প্রাচীন কোষকারগণ ‘কিরাতি’ শব্দের অর্থস্থলে দুর্গা ও গঙ্গার নাম লিখিয়াছেন। এজন্য বোধহয় ইহারা কিরাত রাজকন্যা।
১০. ঋদ্বেদ সংহিতার অনুবাদক শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় ১ মণ্ডল ৪৩ সূত্র ১ ঋকের টীকায় বৈদিক রুদ্র সম্বন্ধে বিশেষরূপে আলোচনা করিয়াছেন। তদাবা আমাদের মত পোষণ করিতেছে।
১১. এ স্থলে প্রা অর্থ সমুদ্র। পাঠকগণ আমাদের পূবর্ব বর্ণনা স্মরণ করুন।
১২. তৃতীয় ভাগ ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।