দ্বিতীয় খণ্ড
০১.
কীর্তি কাঁপছে। অন্য কারও চোখে পড়ত না, কিন্তু শিপ্রার চোখ ভালোবাসার চোখ, সে তো সব দেখতে পায়।
কাঁপছ কেন?
কই আমি তো টের পাচ্ছিনে।
যাও, চান করে এসো, মাথার প্রত্যেকটি চুল পর্যন্ত ধুলোয় ধুলোয় সাদা, গেরুয়া।
কীর্তির যে যাবার ইচ্ছে নেই, শিপ্রা খুবই টের পেয়েছে। কিন্তু সে চুপ করে রইল। বলে কীর্তি বাধ্য হয়ে উঠল।
শিপ্রা হলঘরে এল। বাইরে রোদ তেতে উঠেছে বলে হাজি বসেছে খানের মুখোমুখি হয়ে। দুপুরের পূর্বেই কীর্তিরা ফিরে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের অল্প পূর্বে অপ্রত্যাশিত এই আগমন মনে যে কী আনন্দ দিয়েছিল সেটা সকলের কাছে এতই অকিঞ্চিৎ যে সে সেটা কাউকে খুলে বলতে পারবে না– হয়তো একমাত্র কীর্তিই তার সামান্য কিছুটা অংশের মূল্য হৃদয় দিয়ে নিতে পারবে, কাঞ্চন যতই অকিঞ্চিৎ হোক না কেন, সে কাঞ্চন। হলবাইনের ছবিতে উল্লসিত ব্যক্তির মুক্ত অট্টহাস্যের চেয়ে মোনালিসার মৃদু হাসি ঢের বেশি অর্থধারী, রহস্যময়। মোটরের শব্দ শুনেই সে তাই দ্রুতপদে গিয়েছিল বারান্দায়, যদিও প্রাণ চেয়েছিল ছুটে যেতে। কীর্তির ধূলিধূসরিত অঙ্গ-বস্ত্র দেখে সে যত না বিস্মিত হয়েছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি হল তার চেহারার আকস্মিক এক অজানা পরিবর্তন দেখে। ইতোমধ্যে আয়ার পত্রলেখার ভাগ্যগণনাজনিত খচখচানিটা এক মুহূর্তেই পেয়েছে লোপ– তার অজানাতে, এবং আবার ফিরে এসে পূর্বাসনে বসবার জন্য সেটাতে রুমাল বেঁধে রিজভড হক্কের ইস্টাম্বো মেরে যায়নি।
কী কী দেখলেন বলুন।
হাজি বললে, দেখার মতো খুব বেশি একটা কখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু এখন, আজ ক দিন যা দেখেছি সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে ভবিষ্যতের অদেখা অনেক কিছুর দিকে।
খান বিয়ারে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বিজ্ঞের মতো বললে, এ তো সবসময়ই হয়! অদেখা জিনিস তো কোনও ইঙ্গিত দিতে পারে না দেখা জিনিসই অদেখার ইঙ্গিত দেয়।
শিপ্রা বললে, যেমন সাহারার মাঝখানে দৃশ্যমান অন্তহীন বালুকা অদৃশ্য মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়, আষাড়ের ঘন বরিষণ অদেখা পাকা ধানের ইঙ্গিত দেয়।
হাজি বললে, একশো বার মানি। তুলনাহীনার অতুলনীয়া তুলনা দুটি শুনে আরও বেশি মানি। কিন্তু ব্যত্যয় এইখানে যে, দেখার জিনিসগুলো পরস্পর-বিরোধী অদেখার প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রতিপদে। একদিকে দেখুন ইমিগ্রেশন আইন মোটেই ঢিলে হয়নি; অন্যদিকে লক্ষ করবেন যেসব ফালতো লোক ইন্ডিয়ার দিকে আসছে– সবই হিন্দু তাদের কোনও চেক করা হচ্ছে না। এরা ঠিক রেফুজি নয়। এমনিতে হয়তো এ সময়টায় আগরতলায় মামাবাড়িতে আসত না, এখন জাস্ট টু বি অন্ দি সেফার সাইড়। আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই ইয়েহিয়ার বিস্তর গুপ্তচর কালো পথে এদিকে আসছে। ওদিকে দেখুন, ত্রিপুরা রক্ষা করার জন্য কী কী গোপন মিলিটারি ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিনে, কিন্তু পাবলিককে কি যথেষ্ট তৈরি করা হচ্ছে?
খান হেসে বললে, কিচ্ছু ভয় নেই, হাজি। অন্তত স্পাইদের নিয়ে চিন্তা নেই। পিণ্ডিতে আজ যা ঘটে দিল্লি কাল তা জেনে যায়। আমাদের খবর তারা জানতে পায় পরশু। স্টাইলটা একটু নবাবি কি না।
হাজি বললে, কিন্তু সব মিলিয়ে, ওভার অল পিকচার কারও আছে কি? এই যে আজ কীর্তিবাবু আমার সঙ্গে মোটরে গেলেন, এন্তের ক্ষেত চষলেন, দেখলেন কটুকুন? ত্রিপুরার তিন দিকে পা বর্ডার। বলতে গেলে পাকসমুদ্রের মাঝখানে যেন ইন্ডিয়া-দ্বীপাংশ। এর কতুটুকু দেখেছি আমিই-বা, আর কীর্তিবাবুই এক সকালে দেখবেন কতটুকু?
শিপ্রার কান পড়ে আছে কীর্তির পদধ্বনির তরে। এত দেরি কেন? ফ্যাশনেবল মেয়ের মতো তার কাছে বাথরুম ঠাকুরঘর, আর ঠাকুরঘর বাথরুম নয় তো।
হাজিকে সরাসরি শুধলে, কীর্তি এত উত্তেজিত– না, এত বিচলিত, জাস্ট, নট হিজ ওন সেলফ হল কেন?
আসমানের দিকে তাকিয়ে হাজি বললে, জানেন আল্লাপাক। আমাকে খান কতবার বলেছে, কীর্তির মতো হ্যাপি-গো-লাকি-ফেলো, হেল-ফেলা-উয়েল-মেট হয় না। দুনিয়ার হাল-হালত সম্বন্ধে আস্ত একটি পরমহংস। প্যাখনার উপর দুশ্চিন্তার ফোঁটাটি পর্যন্ত জিরিয়ে নেবার ফুরসত পায় না। আর আজ? বর্ডারে পৌঁছে কী হল, বুঝতে পারলুম না। আমি যা যা দেখেছি তিনিও ওইসব দেখেছেন, তবে হ্যাঁ, আমি যে অদৃশ্যের প্রতি অলক্ষ ইঙ্গিতের কথা বলছিলুম সেগুলোতে আমি, ওয়াটসন, দেখেছি চায়ের পিরিচ, উনি, হোস দেখেছেন ফ্লাইং সসার। তবে হ্যাঁ, মোটর মেরামতিতে আমি যখন ব্যস্ত তখন তিনি গামছা-পরা গামছা-কাঁধে কয়েকটা নিতান্ত দীনদুঃখীর সঙ্গে মিনিট কয়েক কথা কইলেন। কিন্তু কখন যে তার গায়ে অল্প অল্প কাঁপন লেগেছে সেও আমি বুঝতে পারিনি– মোটরের ঝাঁকুনিতে। কথা এমনিতেই তিনি বলেন কম, আর আমার নিজের বকর বকরের ঠেলায় নিজে আমি নিযুতি রাতে অন্য ঘরে গিয়েই শুই। কিন্তু এতে চিন্তিত হবার মতো কিছু নেই আয়েম শ্যোর। আর আপনাদের তো সবকিছু বলবেনই– একটু ঠাণ্ডা হলে পর। আমাকেও উনি কিছু পর ভাবেন না। আমাকেও বলবেন। নইলে আমাকেই-বা বেছে নিলেন কেন গাইড হিসেবে কোনওপ্রকারের লৌকিকতা না করে?
শিপ্রা বললে, এ কথাটা ঠিক। আপনাকে সে একটা অতি তালেবর খলিফে লোক ঠাউরেছে। আচ্ছা, আমি এখন উঠি। জয়েন ইউ লেটার– টা টা।
ঘরে গিয়ে খাটে শুতে না শুতেই চিরুনি নিয়ে আয়া হাজির। খানিকটে আঁচড়াবার পরই কীর্তি দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। আয়া বললে, একটু পরে আসছি মিসিবাবা।
কীর্তি সোজা ড্রেসিংটেবিলের টুলটা টেনে এনে বসল। শিপ্রার হাত-দুটি আপন দু হাতে তুলে নিয়ে বললে, তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
শিপ্রা তার হাত ছাড়িয়ে তুলে নিল কীর্তির হাত। তার উপর ভেজা চুমো খেয়ে বললে, আমার তিন তিন বারের সত্য তুমি ভুলে যাওনি আমি জানি। বল।
তুমি কালই শিলঙ চলে যাও। সেখানে আমি আসছি সপ্তাহখানেকের ভিতর। শিলচরে একদিনের জন্য নেমে করিমগঞ্জ বর্ডারটা দেখে নেব। তার পর শিলঙ এসে তোমাকে নিয়ে ডাউঁকি বর্ডার দেখতে যাব। কাল যাবে শিলঙ? এখন ওই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।
নিশ্চয়ই। কিন্তু নিরাপদ বলে নয়। তোমার ইচ্ছে, তাই।
শিপ্রা লক্ষ করল, এখন কীর্তি আগের মতো একটানা কাঁপছে না। মাঝে মাঝে, যেন অল্প নড়ে উঠে। শিপ্রা স্থির করেছে কীর্তিকে এখন কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে না। সে নিজের থেকেই বলবে, একটু পরে।
আমি প্লেনের টিকিটের কথা হাজিকে বলে এখখুনি আসছি।
ফিরে এসে বললে, যা। বাঁচালে। ওরা অন্তত এটুকুন বুঝেছে, তোমার চলে যাওয়াই ভালো।
যেই না ওই কথাটি বলেছে অমনি তার মনের দরজা কে যেন হঠাৎ লাথি মেরে খুলে দিল।
প্রথমটায় দ্রুতগতিতে, যেন পাঠশালে ছেলে পাখি সব আবৃত্তি করছে, কারণ কীভাবে তার সমস্ত বক্তব্যটা শিকে গুছিয়ে বলবে সেটা সে ঘণ্টা তিনেক ধরে মুশাবিদা করেছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার বার বাথরুমেও খসড়াটা আদালতি ইস্টয়োর কাঠামোতে ঢোকাতে গিয়ে বিস্তর ধস্তাধস্তি করতে হয়েছে। সেটারও প্রথম ইমপর্টেন্ট হাফ হয়ে গেল আদালতের প্রিমা ফাশিতে উট্রা ভিরেস। ব্রিজ খেলায় যাকে বলে ভিয়েনা গ্যামবিট। কীর্তি ধরে নিয়েছিল, শিপ্রা তাকে ফেলে শিলঙ যেতে রাজি হবে না এবং সেটাকে নাকচ করার জন্য তাকে সত্য এবং অর্ধসত্য যুক্তিতর্ক পেশ করতে হবে। পয়লা হাফ বিলকুল বরবাদ হয়ে গেল– কারণ শিপ্রা প্রস্তাবনার সঙ্গে সঙ্গেই কেতাবের ইনডেক পর্যন্ত মেনে নিল। এতে করে হয়ে গেল তার কুল্লে মুশাবিদা টালমাটাল। কিন্তু ধুয়োটা রইল ঠিক। সেটা পাঠক চেনেন। কীর্তিনাশ এস্থলে কীর্তিমান। শব্দটি অপদার্থ।
গড় গড় করে বলে যেতে লাগল, সবচেয়ে ভালো করে তুমি জানো, আমি অপদার্থ। আমি নিজেই জানি সেটা তোমার চেয়েও বেশি। আজ হঠাৎ, দয়াময়ের অসীম করুণায় দাঁড়াও ঠিক হল না, নিষ্ঠুর সম্মানসহ, এই অপদার্থের সামনে বিদ্যুল্লেখার সর্বোজ্জ্বল, আলোক উদ্ভাসিত করে দিলেন, এবং শিশু যেরকম মাকে খুঁজে পায় এ তুলনাটা তোমার কাছ থেকে শিখেছি, গুরু– অন্ধকারের শিশুর নৈসর্গিক জ্ঞান পন্থাসহ আমি সবকিছু স্বচক্ষে আলোকিত প্রকৃতির সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মাকে খুঁজে পেলুম এবং দেখে নিলুম।
কাল রাত্রে যেসব আলোচনা হচ্ছিল সেটা সম্পূর্ণ ভুল আশঙ্কা নিয়ে নয়। সেটার প্রধান এবং যার চেয়ে অধিক গুরুত্ব ধরে তার অসম্পূর্ণতা– সর্পকে তারা মানবিক বুদ্ধির অক্ষম চন্দ্রালোকে রজু বলে ভ্রম করেছে, স্বয়ং যমকে যমদূত বলে ধরে নিয়েছে এবং সেই সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধ থেকে যাত্রারম্ভ হয়েছে বলে তাদের আলোচনার দিক নির্ণয় করা হল যে সত্য স্বয়ং প্রত্যক্ষ তার সঙ্গে সমান্তরাল রেখা ধরে নয়, আলোচনার পথে চলে গেল টেজেনট-এ, কোণা কেটে এবং আলোচনা যতই অগ্রসর হতে লাগল তার দূরত্ব প্রত্যক্ষ সত্যের দৃঢ়ভূমি থেকে বাড়তে বাড়তে বাস্তবতাহীন অন্তরীক্ষে অদৃশ্য হল।
কারণ এরা যমকে যমদূত, মহামারীকে ছিটেফোঁটা পেটের ব্যামো, ইয়োরোপীয় ব্ল্যাক ডেথকে সাময়িক মূৰ্ছা বলে ধরে নিয়েছে।
শিপ্রা বললে, তোমার কাছে যেটা সত্যরূপে আবির্ভূত হয়েছে, তুমি সেটাকে স্বয়ং প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করেছ, সেটা আমি উপলব্ধি না করেও সর্বান্তকরণে স্বীকার করে নিচ্ছি– যে কর্ম ইতোপূর্বে আমি কখনও করিনি– কারণ এখন তোমার ধর্ম আমার ধর্ম। তোমার এ উপলব্ধি ধর্মজাত। সত্যকার কৌতূহলসহ উঠে বসে শুধাল, তোমার কথা থেকে মনে হল শুধু ইনসটিন বা ইনটুইশন দিয়ে তুমি তোমার সত্য উপলব্ধিতে পৌঁছওনি। খুলে বল অন্য কিছু আছে কি?
আছে। কিন্তু সেটা খুদ প্রত্যক্ষ উপলব্ধি নয়, কী যেন, কে যে আমাকে ধাক্কা মেরে সেই দিকে এগিয়ে দিল।
গামছা-পরা গামছা-কাঁধে আপাতদৃষ্টিতে গরিব দুটি চাষার সঙ্গে আজ আমার আলাপ হল।
শিপ্রা বললে, হাজি বলছিল বটে।
হাজি সত্যই সব কাজের, সন্ধিসুড়কের কাজী। কিন্তু আজ সে-ও ভুল করেছে– অবশ্য সেটা যমদূতে-যমে ঘুলিয়ে ফেলার মতো অতখানি দূর পার্থক্য ধরে না। ওরা দুজনাই উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপার্জনক্ষম শিক্ষিত যথেষ্ট সচ্ছল, শিক্ষিত ভদ্রসন্তান। একজন হিন্দু, অন্যজন তার প্রতিবেশী মুসলমান। রাজশাহী থেকে ওদের নামধাম বর্ণনাসহ মিলিটারি হুলিয়া বেরিয়েছে মোটা পুরস্কারের প্রলোভনসহ। যদিও মিলিটারি পুব বাঙলার পুলিশকে আর বিশ্বাস করে না– এ তত্ত্বটা এই আমি প্রথম শুনলুম– তাদের ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে ও ব্যত্যয় হিসেবে ওদের নামের হুলিয়া পাঠাচ্ছে। আর খুদ মিলিটারি তো জিপে করে ওদের সন্ধানে উত্তর বাঙলাটা চষে বেড়াচ্ছেই।
অপরাধ? কাল রাত্রে আমাদের পার্টিতে যে সিদ্ধান্ত স্বীকৃত হয়েছিল সেটা ঠিক। ছোট-বড় সব মিলিটারি ঘাঁটিতেই কমান্ডাটরা সেপাইদের ঠেকিয়ে রেখেছে লুটপাট, অবিচারে যাকে তাকে গুলি করে মেরে বাদবাকিজনদের হৃদয়-মনে আতঙ্কের বিভীষিকা সৃষ্টি করে তাদের ক্লীব করে দেওয়া, এবং নারীহরণ করে ঘাঁটির ভিতর এনে ব্রথেল নির্মাণ করা।
রাজশাহী একমাত্র ব্যত্যয়। কেন, সে কথা শুধোবার কথা মনে ছিল না।
এই মার্চের প্রথম সপ্তাহে সেখানে দিবাদ্বিপ্রহরে পাঞ্জাবি সেপাই তাদের ভদ্রলোক প্রতিবেশীর দুটি মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় ছাউনিতে, বাড়িতে ফেরত দেয় অন্যান্য অত্যাচার করার পর। এই দুই পলাতকের একজন তখন অন্যজনকে ডাক দেয়। একজন বাইসাইকেল চালাল, অন্যজনের হাতে মার্কিন ডিজপোজেলের ক্যাম্পকটের খোল– মোস্ট হামলেস লুকিং।
ভাবতে গায়ে কাঁটা দেয়, কী দুঃসাহস! এ তো সজ্ঞানে অবশ্য মৃত্যুর মুখের দিকে ধাবমান হওয়া। এগোলো ছাউনির দিকে, পুরো স্পিডে সেপাইগুলো যাচ্ছিল পয়দল। শিগগির দূর থেকে ওদের দেখতে পেল– সবসুদ্ধ ছ জন। যতখানি অনুমান হল, সংজ্ঞাহীন মেয়ে দুটিকে রিকশায় বসে ধরে রেখেছে দুজন সেপাই। রাজশাহীর প্রত্যেকটি গলি, প্রত্যেকটি কুঁড়েঘরও তারা চেনে আপন বসতবাড়ির গলির মতো। একটুখানি ঘুরতি পথে জোরসে সাইকেল চালিয়ে তারা একটা অতি সরু আঁকাবাঁকা গলির মুখে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করল। শয়তানগুলোর জন্য। কী আশ্চর্য! অবস্থার ফেরে দুই শতাধিক বৎসর ধরে সংগ্রামে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ শ্রেণিও কীরকম হঠাৎ ইনসটিকটিভলি সর্বোত্তম মিলিটারি টেকটিক এস্থলে কী হবে সেটা সরাসরি উপলব্ধি করে ফেলেছে।
রিকশা দুটোকে তো এগিয়ে যেতে দেবেই। তার পর গেল আরও কয়েকজন। সক্কলের পিছনের দুই না-পাকিকে এদের একজন দুটো কার্তুজ দিয়ে ঘায়েল করল। প্রথম দুজনকে গুলি করলে পিছনের সবাই গলিটার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে বলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যেত ফায়ারিং হয়েছে কোন জায়গা থেকে। কিন্তু এই কূট পদ্ধতির ফলে সামনের সবকটা সেপাইকে ঘাড় ফিরিয়ে, সন্ধান করতে হল, ফায়ারিং কোনও বাড়ি থেকে, পাঁচিলের আড়াল থেকে গলিটার এ মুখ থেকে, না রাস্তা ক্রস করার পর গলির ও-মুখ থেকে। ওরা সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকে গিয়েছে দুটো বাসাবাড়ির টাটির মাঝখানের মেথরের পথ দিয়ে, খাটা পাইখানা চড়ে উসপার হয়ে, আরেক আঁকাবাঁকা গলি দিয়ে ঢুকল একটা জীর্ণ বাসাবাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে।
গৃহস্বামী অর্ধপরিচিত। বুঝিয়ে বললে, আপনি যদি ঘুণাক্ষরেও স্বীকার করেন আপনি আমাদের দেখেছেন– কথা কয়েছেন বললে তো কথাই নেই তবে আপনিও নিস্তার পাবেন না। তার পর তাদের দামি পাতলুন বুশসার্ট বার্টার করে পেল তিনখানা গামছা– চারখানা ছিল না। উপদেশ দিল, জামা পাতলুন উপস্থিত বাসন মাজার ডোবাতে ডুবিয়ে রাখুন– যদিও তার খুব একটা দরকার নেই, কারণ আমরা যখন মেথরের পথে ঢুকি, তখনও বাকি খানগুলো পিছন ফিরে গলির মুখ অবধি পৌঁছয়নি।
বন্দুক তারা গোটাপাঁচেক খাটা পাইখানা পেরুবার সময় যেটা সবচেয়ে জঙ্গলে ভর্তি, নোংরা সেটাতে পুঁতে দিয়ে দ্বিতীয় গলিতে ঢোকে নিরস্ত্র নিরীহ নাগরিকের মতো।
তখন তাদের সামনে একমাত্র সমস্যা, রাত্রের মতো বা দু দিনের মতো আশ্রয় নেয় কোথায়? গামছা-পরা অবস্থায় সঙ্গের দশ টাকার একগুচ্ছ নোট রাখে কোথায়? ওদের কপাল ভালো, একটা বাড়ির সামনে দেখতে পেল কাটা মুরগির রক্ত। খোঁড়াতে বেড়াতে গিন্নিমার কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিল খানিকটে হলুদ চুন আর ন্যাকড়া। নোট কানা পায়ে সাজিয়ে তার উপর বাঁধল নোংরা ন্যাকড়ার বান্ডেজ। তার উপর মাখাল মুরগির রক্ত, কোনও জায়গায়-বা কিঞ্চিৎ হলুদ রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে করা হল পুঁজের সাব্সটিটুট। এমারজেনসির জন্য দু দুখানা দশ টাকার নোট ভাঁজ করে পিটে পিটে প্রায় কবচের সাইজে এনে, কলাপাতা দিয়ে মুড়ে, বেঁধে মাড়ি আর গালের মাঝখানে দুজনা দুটো গুজল।
রাত্রিটা কোথায় কাটানো যায়, এই তখন সমস্যা। এদের একজন উকিল। তিনি সঙ্গীকে বললেন, আদালতে সঞ্চিত তার অভিজ্ঞতা মতে ক্রিমিনাল মাত্রেরই একমাত্র ভরসা বেশ্যাবাড়ি। সেখানে যে কোনও লোক বনাফাইডি ক্লায়েন্টরূপে যেতে পারে। কোনও পুলিশ, সেপাই আর যা শুধোর শুধুক, এ প্রশ্নটা তুমি এখানে কেন?– সম্পূর্ণ অবান্তর। ক্রিমিনালকে লুকিয়ে রাখা, আশ্রয় দেওয়া ওদের একটা সাইড প্রফেশন। কিন্তু এই গামছা-পরা লোকদুটোকে আশ্রয় দেবে কি? দেবে। যদি আগাম টাকা ফেলা যায়। উকিল তাই বুদ্ধি করে কিছুটা গালে পুরে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। মেয়েদের পাড়ায় বরাতজোরে তারা আশ্রয় পেয়ে গেল। খেয়া পেরুবার সময় নৌকাডুবিতে ওদের জামাকাপড় ভেসে গেছে এ অজুহাত মেয়ে দুটো কতখানি বিশ্বাস করেছিল সেটা অবান্তর। রোক্কা দশটি টাকা সর্বঅজুহাতের চেয়ে বড় যুক্তি।
রাত্রে মেয়েগুলো আমাদের মিলিটারি সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা শোনাল। প্রথমেই আরম্ভ করল, বলে ওরা নাকি মুসলমান। ডোম-চাড়ালকেও ওরকম মেয়েমানুষ গিলতে আমরা কখনও শুনিনি। কোনওদিন আমাদের নিয়ে যেত ছাউনিতে সেখানে যা হত বলে কাজ নেই নীলাটা তো মারাই গেল। পালাতে পারলে তো বাঁচি। আশ্রয় দেবে কে আর রোজ ওই এক জিগির, ওদের সর্দার ভদ্রঘরের মেয়ে চান, আমরা জোগাড় করে দিলে মেলাই টাকা পাব। তার পর তারা প্রায়ই ঠা ঠা করে হেসে বলত, মাস খানেক পরে মুতেই পাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে খবর এলেই আমরা শুরু করব সব কুছু। একদিনেই স্কুল-কলেজ থেকে এক ঝাঁপটায় নিয়ে যাব সবকটা মেয়ে আর পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে।
কীর্তি দম নিয়ে বললে, দুই বন্ধু এ কথাগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি কিন্তু আমি করি।
সপ্তাহখানেক ওদের লেগেছিল পাবনা পৌঁছতে।
শিপ্রা শুধাল, ওরা অত দূরের পথ না নিয়ে পদ্মা পেরিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেল না কেন?
ওদের কপাল। ওরা ভুল খবর পেয়েছিল, চাঁপাই-নওয়াবগঞ্জ থেকে যশোর অবধি মিলিটারির কড়া পাহারা অবশ্য সে পাহারা মোতায়েন হয়েছে, সবে, সেদিন।
পাবনার পাশ দিয়ে যাবার সময় এক কনস্টেবল উকিলকে চিনে ফেলল। কিন্তু সে করল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আচরণ। ছুটে এসে তাকে কানে কানে বলল, উকিলের নামে হুলিয়া বেরিয়েছে।… তখন জানতে পারলেন, পুলিশ আর ফৌজে তখন রীতিমতো নিরস্ত্র লড়াই, পারলে ওদের আশ্রয় দেয়। পুলিশটাই দুজনাকে জেলেডিঙিতে তুলে দেবার সময় বলল, ওই একটামাত্র বাঁচওতা রয়েছে এখনও। খানরা পানি বড় ডরায়। নৌকো দূরে থাক, লঞ্চে পর্যন্ত উঠতে চায় না।
কীর্তি কথার মোড় ফিরিয়ে বললে, এদের হাতে এখন মাত্র দু মাস সময়। পুব বাঙলার এদিকটায় বিশেষ করে চেরাপুঞ্জির তলাকার সিলেটে বর্ষা নামে কলকাতার অনেক আগে। দু মাসেই কাজ গুটিয়ে নিতে হবে ওদের। তাই ওদের দণ্ড নেমে আসবে খুব শিগগিরই এ ধারণাটা কাল রাত্রেই আমার হয়েছিল; আজ এরা আপন অজানতে কনফার্ম করল।
আরেকটা কথা; এরা বললে, সেই দূর রাজশাহী অঞ্চল থেকে এই আগরতলা অবধি বহুলোকের সঙ্গে তাদের আলাপচারী হয়েছে। একজন লোকও পায়নি যার ধারণা আছে, এবারে যে মিলিটারি জুলুম আসছে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। ওরা ধরে নিয়েছে, পঁচিশ বছর ধরে নানা রাজা, নানাপ্রকারের খেল দেখিয়েছেন, এবারও সেটা হবে– বেশিরভাগেরই অবশ্যই উইশফুল থিঙ্কিং সমঝোতা হয়ে যাবে সেটারও প্রকৃতি হবে একইরকমের। উনিশ-বিশ হবে শুধু পরিমাণে।
কীর্তি বললে, ওদের দুজনাকে আমি তোমার কলকাতার ঠিকানা দিয়েছি।
শিপ্রা একটু চমকে বললে, তোমার প্রোগ্রাম কী?
যতটা বলেছি, ততখানি ঠিক আছে। আমি তোমাকে শিলঙে মিট করব। তার পর কলকাতা যাব। সেটার দিন স্থির করা তোমার হাতে। কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমার কী হবে, আমি কী করব সেটা আমার হাতে তো নয়ই, তোমার হাতেও নয়, খুব সম্ভব।
শিপ্রা বললে, ওদের দুজনার নাম দাও তো। আমি শিলঙ থেকে রামাকে জানাব, এঁরা যদি আমার কলকাতা ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তবে যেন ওদের কলকাতার ঠিকানা ঠিক ঠিক লিখে রাখে এবং বলে আমি ফিরে আসা মাত্রই ওদের সঙ্গে দেখা করব। ঠিক তো?
তোমাকে তো ককখনও অঠিক কাজ করতে দেখিনি। আয়াকে ডাকব তোমার খোঁপাটা বেঁধে দিক। আমাদের একবার হলে যাওয়া দরকার।
তার পর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে, দাঁড়িয়ে উঠে, মাথা নিচু করে শিপ্রার তরঙ্গে তরঙ্গে নেমে-আসা কুঞ্চিত কেশদামে মাথা গুঁজে দিয়ে পরিতৃপ্ত নিশ্বাসে বুকভরে নিল।
শিপ্রা এলোখোঁপায় পাক লাগাতে লাগাতে বলল, চলো, ডার্লিং। হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তা এতকাল ধরে তোমাকে অপদার্থ, অকর্মণ্য করে রাখেননি তিনি তোমার ব্যাটারি চার্জ করেছিলেন। এইবারে খেলো, খেলো, তব ভৈরবখেলা।
শিপ্রা লক্ষ করেছে, কীর্তির কম্পন সম্পূর্ণ থামেনি বটে, তবে যেটুকু আছে বাইরের লোকের চোখে পড়ার মতো নয়।
.
০২.
লাফ দিয়ে উঠল হাজি। খনে দু হাত দিয়ে কপালের রগ চেপে ধরে করুণ কণ্ঠে গোঙরায়, গেলুম, গেলুম, আমায় ধরে তো, পরমুহূর্তে দু হাতে বুক চেপে ধরে গভীর পরিতৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে বলে, আহ্ কী আরাম, এসো ক্ষুদিরাম।
শিপ্রা সোফাতে হাজির পাশের জায়গায় বসে মুচকি হেসে বললে, আমি একদম সোজা ঘোড়ার মুখ থেকে পাক্কায়েস্ট খবর পেয়েছি তা-ও যে-সে ঘোড়া নয়, উত্তম স্কচ জাতীয় হোয়াইট হর্স-এর মুখ থেকে, যে আপনি তিন বোতল হোয়াইট হর্স গেলার পরও ঘোরঘুটি অন্ধকারে পথ-বিপথ ঠাহর করে করে, কালোয় কালোয় বর্ডার ক্রস করতে পারেন। অতএব আপনি যে এই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রব্যগুণের প্রভাবে
বিষাদে হরিষ, ম্যাডাম হরিষে বিষাদ। এইমাত্র সেদিন আপনার আসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা আগরতলাটা আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠল। চোখ কচলালুম, দু চোখ ভরে আরও দেখব বলে, চোখ খুলতেই দেখি, গোধূলির ম্লান আলো। আপনি গোধূলির ধূলি না ছুঁয়ে আপন ধুলো-পায়েই ফিরতি পথ ধরেছেন। হবে না বিষাদ? আর আপনার সঙ্গসুখের আনন্দটাও কি বেআইনি ক্ষণস্থায়ী।
কিন্তু এ বিষাদেও, হর্ষ না হোক, আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছি। উপস্থিত যা হাল তাতে গোটা পূর্ব-পাকিস্তান এবং লাগোয়া আগরতলা কোনও প্রাণীর পক্ষে স্বাস্থ্যকর তো নয়ই বরঞ্চ আয়ুক্ষয়, এমনকি বায়ু নির্বাপণেরও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত সম্ভাবনা আছে।
শিপ্রা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পূর্ব পাকের আগুন আগরতলাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই তো আপনার আশঙ্কা? তবে বউবাচ্চাদের কথা ভাবছেন না কেন? দিন না পাঠিয়ে আমার সঙ্গে। ভাই খান, তুমি একটা কসম খেয়ে তাকে ভরসা দাও, প্লিজ, যে আমার বাড়িতে ওদের স্থানাভাব হবে না, আদরযত্নের ক্রটি হবে না। আমার মনে হয় আপনি এবং বাদবাকি বিবাহিত পুরুষের ৯৯% বড্ড ইরেসপনসি– ওই বিষয়টায় অন্তত।
হাতজোড় করে হাজি বিনীত কণ্ঠে বললে, আমি করজোড়ে স্বীকার করছি দারা-পুত্র সম্বন্ধে কোনও প্রকারের দুর্ভাবনা আমার সুখনিদ্রাটিকে কোনও কালেই রত্তিভর জখম করতে পারেনি কিন্তু ওদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আমি দশ বছর পূর্বেই একটা ফৈসালা করে রেখেছি। অবশ্য সবই ভগবানের হাতে। কিন্তু ইতোমধ্যে অর্থাৎ আজ ভোরে আমি অতি বিশ্বস্ত সূত্রে একটা ভয়াবহ সংবাদ পেয়েছি। কাহিনীটি প্রাচীন ও দীর্ঘ; আমি অতি, অতি সংক্ষেপে সারছি।
ইয়েহিয়া চায়, ভারতে একটা ক্যুনাল রায়েট লাগুক।
কম্যুনাল রায়েটের জন্য উত্তর ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের জমিন সবসময়েই তৈরি। উত্তর ভারতের উগ্রতম পন্থি কিছু হিন্দু আছেন, যারা পাকিস্তানের বিনাশ চান, এবং ভারতের মুসলমানদের নিতান্ত দায় পড়ে সহ্য করেন। এঁরা এই ইচ্ছেটা প্রকাশ করেন পলিটিকসের মুখোশ পরিয়ে (পাকিস্তান তৈরি হয়ে যাওয়া মাত্রই ভারত আক্রমণ করবে; তার পূর্বেই আমাদের আক্রমণ করা উচিত) এবং নিজেদের মনগড়া এক আজব হিন্দুধর্মের ঝাণ্ডা তুলে। আমি পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে বলছি, তাঁরা যা প্রাণ চায় সে পলিটিক্স করুন, কিন্তু সনাতন ধর্মের এরকম নীচ অবমাননা যেন না করেন– ধর্মে সইবে না।
আর ভারতের প্রতি বিশেষ করে বহু বহু পাঞ্জাবিদের ঘৃণা, বিদ্বেষ, নফরত, শত্রুতা এমনই প্রচণ্ড যে তার কোনও তুলনা নেই। এদেরও একটা আজব মনগড়া ইসলাম আছে যে ইসলাম বলে, অমুসলমান মাত্রই কাফির এবং ভারতের কাফিরকুল তন্মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট অমানুষ। এদের কতল করা ইসলামের (তাদের মনগড়া ইসলামের) আদেশ– দোষী-নির্দোষী উভয়কে সমভাবে। এবং এদের স্ত্রীজাতিকে লুণ্ঠন করা সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত। পাঠানদের রক্তে-মজ্জায় থাকে সবচেয়ে বড় যে রিপু সেটা– লোভ, গৃধুতা ও তজ্জনিত তঙ্করবৃত্তি। কাফিরদের প্রতি তাদের ঘৃণা পাঞ্জাবিদের মতো রিফাইনড মিন নয়। ফলে পিণ্ডিতে যে কোনও সরকারই রাজত্ব করুন না কেন, ভারত-বিদ্বেষনীতি তারা অবলম্বন করতে বাধ্য, এবং গোপনে সোসাহে বিশেষ করে পাঠানদের আপ্যায়িত করেন এই বলে, দাঁড়াও না, দিল্লি লুণ্ঠন করার ব্যবস্থা শিগগিরই হচ্ছে।
উত্তর ভারতে কট্টর অখণ্ড পাকিস্তানপন্থি, যাদের সঙ্গে অন্য কারুরই তুলনা হয় না বেহারি মুসলমান। এদের এক প্রভাবশালী অংশ কলকাতায় বাস করেন। তাঁদের পাকিস্তান-প্রীতি চৌদ্দ আনা পরিমাণ নিতান্ত হীন স্বার্থবশত। তাদের ভাই-বেরাদর, একদা যারা, কবিদের মতো ঈষৎ অতিশয়োক্তি করে বলছি, পাটনা স্টেশনে কুলির কাজ করত আজ তারা পূর্ব বাঙলায় ট্রাফিক ম্যানেজার, রেলওয়ে সেক্রেটারি। বাইরে তারা উর্দু কথাবার্তা বলে খানদানি মনিষ্যিরূপে পরিচিত, ভিতরে বলেন, ভোজপুরি মঘি বা মৈথিলি। বিদ্যাপতি নিশ্চয়ই আপনার প্রিয় কবি; সে ভাষা যদি উর্দু হয় বদ্ধমানের পদী পিসির কোঁদলের ভাষাও তা হলে উর্দু। এই বেহারিদের অর্ধশিক্ষিত সম্প্রদায় উর্দুর কল্যাণে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে একজোট হয়ে পুব বাঙলাকে শুষছেন, হীনতম কলোনির মতো। এরা এবং বেহার ও কলকাতার বেহারিগণ সূচ্যগ্র পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন পূর্ব বাঙলাকে দিতে রাজি নয়। এরই ওপর নির্ভর করছে তাদের পাকিস্তান-প্রীতি।
শিপ্রা জিগ্যেস করলে, এরা পার্টিশনের সময় পশ্চিম পাকিস্তান গেল না কেন? সেখানে তো অন্তত শিক্ষিত পাঞ্জাবিরা উর্দু বলে, অশিক্ষিতেরাও অনেকখানি বোঝে। বাঙলায় এল কেন?
হাজি বললে, ওই তো সরল রহস্য, ভদ্রে। পশ্চিম পাকিস্তানে ওই সময়ে গেল উত্তর প্রদেশ ও দিল্লি অঞ্চলের অনবদ্য উর্দুভাষী বিস্তর লোক। ওদের সামনে বেহারির উর্দু যেন রবীন্দ্রনাথের সামনে আমার কুমিল্লার খাজা বাঙলা! তদুপরি পাঞ্জাবিরাও রাইটলি অর রংলি দাবি করে তাদের উর্দু বেহারিদের উর্দুর চেয়ে বেহৃতর– যদিও লক্ষ্ণৌ দিল্লিবাসীদের মতে দুটোই একটা গাধার দুটো কান।
পুব বাঙলায় যেসব বেহারি আছে তারা পাঞ্জাবিদের চেয়ে নৃশংস পদ্ধতিতে লড়বে লীগের বিরুদ্ধে। পাঞ্জাবিরা অবস্থা মারাত্মক জানা মাত্রই ফিরে যাবে আপন দেশে, এরা যাবে কোথায়? দে হ্যাঁ বার্নট দ্যার বুল কার্টস।
এবং আছে আর একটা দল তামাম উত্তর ভারত জুড়ে। এবং পশ্চিম বাংলার মুসলমান বাঙালিও কিছু সংখ্যায় আছেন।
তিন কলকাতাগত জনের চোখের সামনে ভেসে উঠল মির্জার কুটিল মুখচ্ছবি।
তবে এদের অধিকাংশ মক্তব-মাদ্রাসার লোক।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই ধরনের মুসলমানদের পাকপ্রীতিও স্বার্থজাত। এরা ভাবে, কাল যদি ভারতে কমনাল রায়ট বাধে তবে আমরা যাব কোথায়? পুব বাঙলাই তো হাতের কাছে। সে-দেশটা যদি লীগের পন্থা অবলম্বন করে স্বাধীন হয়ে যায়, তবে তারা ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। তখন আমরা মুসলমান বলে তো কোনও আদর, প্রেফারেন্স পাব না। বেহারি মুসলমানরা আরও জানে, বাঙালি মুসলমান ভিতরের-বাইরের দু দল বেহারিকেই ধীরে ধীরে প্যাঁদাবে।
ইয়েহিয়া এজেন্ট জোগাড় করতে চায় এই পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতাবিরোধী, অতএব পশ্চিম পাকপ্রেমী দল থেকে। এবং সবচেয়ে বেশি চায় কলকাতায়। কলকাতাবাসীর পয়সা আছে, তাদের পক্ষে পুব বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করা খুবই স্বাভাবিক। তাদের বিস্তর হিন্দু ইনটেলেকচুয়েল সর্বদেশের স্বাধীনতা সগ্রাম মনেপ্রাণে সমর্থন করে। এই পশ্চিম বাঙালি সাহায্য করবেই করবে অন্তত ভাষা বাবদে তার বেরাদর পুব বাঙালিকে। বেতারযন্ত্রটা তার প্রধান অস্ত্র।
অতএব কলকাতায় একটা গণ্ডগোলের সৃষ্টি করতেই হবে। এবং সেটা আখেরে সাম্প্রদায়িক রূপ নেবেই নেবে। অবশ্য চেষ্টাটা দিতে হবে তাবৎ ভারতে আগুন জ্বালাতে।
খান বলল, কলকাতায় এসেছেন ওই মন্ত্রধারী একটা আস্ত ঘুঘু। তার কথা তোমাকে বলিনি। নাম লারি
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই হাজি হার হায় করছে আর মাথা থাবড়াচ্ছে। শেষটায় বলল, ওকে আমি চিনিনে? ব্যাটা কুমিল্লাতে এলে সুধা পান করে কেন্টনমেন্টে। আর আমার বাড়িতে। কিন্তু বেরাদর, ওকে আমি হাড়ে-হদ্দে চিনি। ব্যাটার কাছে পাকিস্তান হিন্দুস্তান মুসলমান কেরেস্থান সব বরাবর। মাত্র দুটি জিনিসের তরে সে সব করতে পারে। তার আপন স্বার্থের তরে। তার খাই প্রচণ্ড। মাতৃগর্ভে তার দাঁত ছিল না কেন, জানেন কীর্তিবাবু? মায়ের নাড়িভুড়ি খেয়ে ফেলত যে! সে চেনে দুটো জিনিস একটাও বলা যেতে পারে। রূপচাঁদ ঠাকুর– টাকা, টাকা; ওই দিয়ে মদ আর থাকগে। আপনি তো, কীর্তির্বাবু, গোঁড়া হিন্দু নন। ওকে দুইয়ে দিন কিঞ্চিৎ। টিকে গজিয়ে নামাবলি পরে না, বরঞ্চ তান্ত্রিক পন্থাই বেটা বেছে নেবে। ওর কথা অন্য মোকায় সবিস্তর বলবে।
শিপ্রার দিকে তাকিয়ে বললে, আমি জানি, ম্যাডাম, আমি জানি আপনার ডানার নিচে আমার বউবাচ্চা পাবে সর্বোত্তম প্রটেকশন। কিন্তু অপরাধ নেবেন না, দেবী, রায়টের সময় খুনখারাবি করে এ পাড়ার গুণ্ডা ও-পাড়ায় গিয়ে এবং ভাইস ভার্সা। এক দল অন্য দলকে লেটেষ্ট খবর দেয়, কার বাড়িতে সোনা দানা রুক্কা টাকা পাওয়া যাবে, কোন ব্যাচেলরের বাড়িতে পাওয়া যাবে না কিছুই। আমি রায়ট দেখেছি, ঢাকা-কলকাতা দুই শহরেই।
কিন্তু মুসলমান পুষেছেন এ কথাটা প্রকাশ পাবেই পাবে, এবং তখন হামলা হবেই হবে।
আপনার বাড়ি এমনিতে লুঠ হবে না। দারওয়ানের বন্দুক আছে, বরঞ্চ তার চেয়ে বেশি বন্দুক চালাবেন আপনি, জানি, বিলক্ষণ জানি। ফরাসিদের কাছ থেকে শুধু একাডেমিক মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি শিখেছেন আর ওরা আপনাকে আত্মরক্ষার্থে যেটুকু প্রয়োজন বলতে কী তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি বন্দুক-পিস্তল চালাতে শেখায়নি সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আপনার ভিতর দক্ষতা আছে, নৈপুণ্য আছে। সেটা লক্ষ করার পরও? প্রকৃত হুনুরি, সত্যকার আর্টিস্ট– তা তার আর্ট বন্দুক চালানোই হোক, আর ছবি আঁকাই হোক– সে উপযুক্ত পাত্র পেলে তার ভিতর আপন ইনুর, সাধনালব্ধ সম্পদ রাখবেই রাখবে। ম্যাডাম যদি বলতেন যে ফরাসি আপাশ সম্প্রদায়ের গুনিন পকেটমারদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, তা হলে কার নামে কিরে কাটব?– আপনারই সুন্দর নামে কাটি– বিচক্ষণ ব্যক্তির যা সর্বথা করা উচিত, আমি তাই করলুম– গলা কাট্যা ফেলাইলেও মানিব্যাগটা এখানে আনতুম না।
সিরিয়াসলি বলছি, কলকাতাতে দাঙ্গা লাগার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
সে অবস্থায় গোটাকয়েক মুসলমানের জিন্মেদারি আপনার স্কন্ধে চাপাই কোন বিবেকহীন বুদ্ধিতে?
শিপ্রা বললে, এ আপনার আদিখ্যাতা। প্রত্যেক দাঙ্গায় কত মুসলমান কত হিন্দুকে বাঁচিয়েছে, কত হিন্দু কত মুসলমানের প্রাণ রক্ষা করেছে, হাজি সাহেব।
খান বললে, শিপ্রাদি, প্রথমেই আমার একটা নিবেদন আছে। সবাই আমাকে হাজি বলে ডাকে, ব্যঙ্গ করে। একে তো হজ করিনি, অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান বাবদেও আমি গাফিল। প্রতিবারে আমাকে হাজি নামে ডেকে হয়তো ওঁদের ওই ব্যঙ্গ করার পিছনে আছে তাদের সদিচ্ছা, আমি যেন ধর্মপথে চলি। অবশ্য, আল্লার ডাক শুনতে পেলে আমি কে, আমার ঘাড় তখন যাবে মক্কায়। কিন্তু আপনি আমাকে এ নামে ডাকবেন না।
শিপ্রা বললে, আচ্ছা ডাকব না। কিন্তু আমারও সদিচ্ছা হয় না, আপনি ধর্মপথে চলুন। আমার বিশ্বাস আপনার পথ ধর্মপথে গিয়ে মিশবে।
হাজি আবেগভরে বললে, আমেন, আমেন। তাই হোক তাই হোক। মূল কথায় ফিরে গিয়ে হাজি বলল, দাঙ্গার ভিতরও আল্লা তাঁর করুণা প্রকাশ করেছেন, যেমন আমার মতো অপদার্থও তার দয়া পেয়েছে।
কীর্তি : দেখুন হাজি, আমার সঙ্গে কম্পিট করতে যাব না। অপদার্থ বলতে বোঝয় কীর্তি রায়!
হাজি সবিনয়, দাদা বয়সে অজস্র হলেও এ ব্যাপারে আমি আপনার অনুজ, বিশ্বস্ত অনুগামী।…
প্রতি দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান যখন একে অন্যকে বাঁচায়– তখনই দেখি, প্রতিবার, মানুষের মনুষ্যত্ব। স্বার্থপর পলিটিশিয়ানের প্রপাগান্ডা উপেক্ষা করে, পথভ্রষ্ট ধর্মযাজকদের অনুশাসনে কান না দিয়ে, সশস্ত্র গুণ্ডাদের ভীতি প্রদর্শনকে তুড়ি মেরে মানুষকে তখন সত্যের পথে, আর্তজনকে রক্ষার পথে চালায় কে?– সে তার মনুষ্যত্ব। বললে পেত্যয় যাবে না কেউ, আমার মতো অপদার্থ–সরি পাষণ্ডের ভিতরও খুব সম্ভব ওই ধাতুটির একটি ক্ষুদ্রতম কণার ক্ষীণতম ছায়া অতি কালে-কস্মিনে চিলিক মেরে যায়– নইলে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনারা দোহাই মনুষ্যত্বের– এতকাল ধরে বউ আমাকে বরদাস্ত করছে কী করে? হুঃ। কিন্তু ওই লারি সম্প্রদায়ের ভিতর মনুষ্যত্বের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাকে বিস্তর পরিশ্রম করতে হয়েছে মেহনত আমার সয় না।
কিন্তু, ম্যাডাম, আমার প্ল্যানটা আপনার সামনে পেশ করি।
আগরতলা বিপন্ন হলেই আমি বউবাচ্চা নিয়ে চলে যাব, কিছুটা মোটরে বা পুরোটাই হেঁটে চলে যাব পার্বত্য ত্রিপুরা অঞ্চলে, যার উপর দিয়ে আপনি প্লেনে উড়ে এলেন– সেখানকার পাহাড়িদের সঙ্গে আমার বিস্তর ভাবসাব আছে। সেখানে এখনও প্রায় ফি-বছর যাই শিকারে। প্রথমযৌবনে মেয়েগুলোর সঙ্গে নেচেছি, এদের তৈরি নেটিভ বিয়ার বিস্তর খেয়েছি। ইয়েহিয়ার বাপের সাধ্য নেই সেখানে নাক গলায়। আর ওরাও কারও সাতেপাঁচে নেই। এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আমার কল্পনার বাইরে।
আর আপনার নিজস্ব, আপন কলকাতা তো আমার হাতের পাঁচ নো–পাঁচ কোটি রইলই।
কীর্তির দিকে তাকিয়ে বললে, কই কীর্তিবাবু এ অধম গাইড যেটুকু পারে সে তো দেখাল। এবারে পাকেচক্রে কলকাতায় এলে বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাবেন তো?
কীর্তি কিছুমাত্র চিন্তা না করেই বললে, আল্লা করুন এবার যেন বাঙালরা পাঞ্জাবিদের হাইকোর্ট দেখিয়ে দেয়।
হাজি কার্পেটের উপর বসে পড়ে হাত দুটি উঁচু করে তুলে ধরল। আবেগভরা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, আমেন, আমেন।
.
০৩.
স্পষ্ট মনে আছে শিপ্রার, বারটা ছিল বৃহস্পতি।
যে বেয়ারা বিকেলের চা নিয়ে এল তার চেহারা-ছবি ধরনধারণ দেখে শিপ্রার ধারণা হল লোকটা বোধহয় সিলেটি। শুধাল, তোমার দেশ কোথায়?
বেয়ারা বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। শিপ্রার চেহারা, চাল-চলন, তার প্রসাধনের যে কটি কৌটো শিশি ড্রেসিংটেবিলে সাজানো ছিল সেগুলোর বাস বিলিতি টপ ঢং দেখে তার প্রত্যয় হয়েছিল, ইনি অতি খাঁটি মিসিবাবা, অর্থাৎ ইনি জানেন শুধু ইংরেজি, আর সে যে উর্দু-অহমিয়া-খাসিয়া-সিলেটি ভাষার লাবড়াকে হিন্দুস্তানি নামে চেনে, সেইটে বলতে পারেন চালে-কাঁকরে মিলিয়ে। তাঁর মুখে আচম্বিতে বিসুদ্দ বাঙলা ভাষা বেরিয়ে আসায় সে এমনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে যে তার মুখ থেকে, যেন রিলেক্স্ অ্যাকশনের মতো, বেরিয়ে গেল খাস সিলেটি, কিতা কইলা?
আদর করে শিপ্রা যে নামে ডাকে কীতা কখনও সে জুড়ে দেয় মিতা, এ কদিন দুশ্চিন্তার ভিতরে কবি এ শব্দের সঙ্গে যে মিল দিয়েছে তারই স্মরণে মনে মনে বলেছে, আমি কি বিস্মৃতা?
সিলেটি রহস্যময় কিতা শুনে তার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল।
ইতোমধ্যে বেয়ারা নিজেকে সামলে নিয়ে হোটেলের ভদ্রস্থ হিন্দুস্তানিতে একাধিকবার বলেছে, সিলেটি, মেমসাহেব, সি মুলুক, মেমসাব।
তুমি মুসলমান? না?
জরুর জরুর। হাম্রা নাম শেখ গাত্ৰু, মেমসায়েব। মনে মনে দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে, এই মিসিবাটি নিশ্চয়ই কেরামতি জানেন নইলে কোন দূরের মুল্লুক থেকে এসেই তাকে দেখে ধরে ফেলেছেন, সে এদেশেরই লোক নয় এবং সে মুসলমান। এবারে শিপ্রা যে প্রশ্ন শুধাল তাতে তার বিস্ময় পৌঁছল চরমে। একমাত্র তার সহকর্মী দেশ-ভাইদের দু একজন তাকে তার জিন্দেগিতে মাত্র দু একবার শুধিয়েছে।
এখনও কি মহরম মাস চলছে?
এর সঠিক নির্ভুল উত্তর শ্ৰৈহট্ট অর্থাৎ শ্রীহট্ট, সিলেট-সন্তান গা মিঞার দেওয়া সম্ভবপর নয়। অবশ্য মহরমের শুক্লা দশমীতে (হিন্দু গণনায় একাদশী বা দ্বাদশী) হয়ে গেল মহরমের পরব– তাজিয়া তাবুদের প্রসেশনসহ। তার পর যে কটা দিন গেছে সেটা গুনে যোগ করলেই মহরমের ক তারিখ, না পরের মাস সফর শুরু হয়ে গেছে ধরা পড়ে যায়। অবশ্য মিয়া গাফ্র কটা দিন গেছে আঙুল গুনে মোটামুটি খবরটা দিতে পারত কিন্তু এহেন বিদ্যাধরী মিসিবাবা যিনি কি না মহরম যে সুদু একটা পরব নয়, মাসও বটে, সে হেন খাস ইসলামি খবর রাখেন তাকে তো উল্টোপাল্টা মাস তারিখ দেওয়া সৎ গুনাহ্ হবে।
হন্তদন্ত হয়ে বললে, আমাদের মোল্লাজি বেয়ারাদের ঘরে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে ইসলামি পঞ্জিকা এখুনি নিয়ে আসছি। সব খবর পাবেন। হঠাৎ তার মনে ধোকা লাগল : এনা খানদানি মিসিবাবা, ইনি বাঙলা, না হয় বাঙলা বলতে পারেন, কিন্তু পড়তে পারেন কি? সভয়ে প্রশ্নটা শুধাল। শিপ্রা ঘাড়টি সামান্য বেঁকিয়ে মুচকি হাসল। গোস্তকির বিস্তর মাফ চেয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটল পাঁজি আনতে।
যবে থেকে শিপ্রা শিলঙ পৌঁছেছে সেই থেকে কীর্তি বা খানের কোনও খবর না পেয়ে আস্তে আস্তে সে অধীর হয়ে উঠেছে। এখন শঙ্কার চৌকাঠে পা দিয়েছে। ঘরের ভিতর ভীতি, বিভীষিকা।
সব কটা খবরের কাগজ লাইন-বাই-লাইন পড়েছে। সেগুলো এমনি বিস্ফোরক উত্তেজনায় ভরা যে সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয় পাছে না একটুখানি খোঁচা খেলেই বোমার মতো ফেটে ওঠে। ওদিকে বিটউইন দি লাইন্স্ পড়ে শিপ্রা ঠিক বুঝে ফেলে, অন্তত আগরতলা থেকে পাঠানো সংবাদ হয় অতিরঞ্জিত, নয় মৌনগুঞ্জিত। হাজি, মিঞাসাহেব–
মিঞাসাহেবের নাম মনে আসতেই সে যেন তাঁর শেষ কথা কটি আবার শুনতে পেল। ডিনার শেষে, গভীর রাত্রে, খাস করে তার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় একমাত্র তাকেই বলেছিলেন, যেন তাকে খানিকটে আশ্বস্ত করার জন্য, কিংবা পরিস্থিতির যে ছবিটা তর্কাতর্কি, লেটেস্ট সংবাদের অদলবদলের রঙ দিয়ে নিমন্ত্রিতেরা এঁকেছিলেন সেটাতে একটা অংশ ফাঁকা রয়ে গিয়েছে সেই ব্যক্তিনিরপেক্ষ তত্ত্বটির দিকে শিপ্রার নিছক দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য : পবিত্র মহরম মাসে কি কট্টর শিয়া ইয়েহিয়া খুন-খারাবি আরম্ভ করবে?
সেই গম্ভীর ইঙ্গিতভরা প্রশ্নরূপে প্রকাশিত তত্ত্বকথাটি শিপ্রার মনে আসতেই শিপ্রা কেমন যেন এক রকমের অকারণ অস্বস্তি অনুভব করেছিল। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে, এখনও মহরমের মাস চলছে কি? তাই চোখের সামনে যে পড়েছে তাকেই প্রশ্নটা জিগ্যেস করেছে।
হায় রে প্রখরা বুদ্ধিমতী রমণী শিপ্রা! তুমি সমস্ত প্রাণমন দিয়ে কামনা করছ, যে গ্রহনক্ষত্র বিশেষ করে শশীকলা লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে অলঙ্ নিয়মে যে বেগে চলেছে, পূর্ণিমা-অমাবস্যা এসেছে-গিয়েছে, এদের গতিবেগ যেন অকস্মাৎ মন্থর হয়ে যায়, এই মহরম মাসটা যেন বিলম্বিত হতে বিলম্বিততর হয়ে, ২৯/৩০ দিনের পরিবর্তে ২৯/৩০ মাস ধরে চলে। শুধু তার প্রিয়, তার বল্লভ কীর্তির চতুর্দিকে দাবানলের প্রজ্বলন নিরুদ্ধ করার জন্য। তার ফলে কার কীই-বা ক্ষতি হত? স্বয়ং যে রাজার রাজা মহারাজার কনিষ্ঠা-ইঙ্গিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে চলেছে তারই-বা কী ক্ষতি হত? তাই তো। হঠাৎ তার মনে এল একটি গীত। তারই এক বাল্যসখা উভয়ের কৈশোরে এ গীতটি তাকে উপহার দিয়েছিল। কবিতাটি শিপ্রা ছাপাতে কখনও দেখেনি কারণ কবিও বাংলা সাহিত্যে কণামাত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি। বাইবেলে বর্ণিত কিশোরী তার বল্লভের সন্ধানে যেরকম দোরে দোরে ঘা দিয়ে নিরাশ হয়েছিল, এ গীতি যে কাগজে লেখা সে-ও বহু সম্পাদকের টেবিলের উপর ফ্যানের হাওয়াতে কাঁপতে কাঁপতে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি। এমনকি তার প্রিয়া কালী পেঁচির দৃষ্টিও না।
মহরম দীর্ঘতর হলে সৃষ্টিকর্তার কীই-বা হত ক্ষতি। গানটার মোতিফ ছিল একই :
কী বা হত তোমার, রাজা,
একটু মোরে দিলে?
কীই বা ক্ষতি হত কাহার
বিরাট এ নিখিলে?
তোমার বিশ্ব বসুন্ধরা
অনন্ত বৈভবে ভরা;
কণাটুকু যেত না তো।
করুণা বর্ষিলে।
চন্দ্র সূর্য গ্রহে গ্রহে।
সাজাও আলিম্পন
তারায় তারায় বাঁধো, তুমি
অলখ আলিঙ্গন।
তোমার এ যে পূর্ণ ছবি।
মিথ্যা হত এর কী সব-ই।
প্রিয়ার চোখে আমার চোখে
যদি যেত মিলে।
শিপ্রার মনে আছে, কবিতা বা কবি কারওরই চোখের সামনে সেই ধুমসীর চোখ মেলেনি। অথচ আখেরে এ লক্ষ্মীছাড়িটা বিধির বিধানে পেয়েছিল কলাগাছ যে রকম কার্তিককে পায়। এবং সে ছোঁড়া ছিল কুবের কুলের পিদিম! বিধির অধর্ম কি কোনওদিন বিধির বিধি কোনও সর্বেশ্বর বিচার করবেন না? প্রলয়শেষে কিয়ামতের দিনে?
যখন কবিতাটি শিপ্রা প্রথমে পড়ে তখন মনে হয়েছিল এটা ইন্টার ক্লাস। তবু এক একটা নিতান্ত বাজে সুর যেরকম মানুষের পিছনে অষ্টপ্রহর লেগে থাকে, তাকে হট করে এটাও করেছিল তাই। সেই মেয়েটা এবং একঝাঁক সম্পাদকের এই কাব্যের উপেক্ষিতাকে আজ শিপ্রা–কবিগুরু যেরকম ঊর্মিলাকে তাঁর করুণাধারা দিয়ে অভিষিক্ত করেছিলেন সেইরকমই কবিতাটিকে তার হৃদয়-আসনে বসাল।
হঠাৎ ওই অনবদ্য প্রবন্ধটির আরেকটি অংশ স্মরণে আসতে তার সর্বচৈতন্য বিকল হয়ে গেল। অবশ্য শুধু ভাবার্থটুকু। শব্দে শব্দে আছে :
সলজ্জ নবপ্রেমে আমোদিত বিকচোখ হৃদয়-মুকুলটি লইয়া স্বামীর সহিত যখন প্রথমতম মধুরতম পরিচয়ের আরম্ভ সময় সেই মুহূর্তে লক্ষ্মণ… বনে গমন করিলেন!
কিছুতেই মনে আনতে পারল না শিপ্রা, আর্যপুত্র ঊর্মিলাবিলাসী বনগমনের পূর্বে কয়দিন নববধূ নির্জনে সঙ্গোপনে একান্ত আপন ভাবে আর্যপুত্রকে কণ্ঠাশ্লেষে আবদ্ধ রাখার অবসর পেয়েছিল। সে তুলনায় শিপ্রা কদিনের তরে কীর্তিকে? আর এখন সে কোথায়, কোন অবস্থায়।
চিন্তাধারা শিলাখণ্ডে বাধা পেল। ভালোই হল। জানালা দিয়ে দেখতে পেল, ঝঞ্ঝা-তাড়িত মেঘদূতের ন্যায় পবনবেগে আসছে গাব্ৰু শেখ। হাতে ঢাউস একখানা কেতাব, মুখে বিস্তৃত হাসি।
সাইজে এক্কেবারে যেন শুণ্ডপ্রেস পঞ্জিকা। ভিতরে ওই মতো ফুলকপি মুলোর বিজ্ঞাপন, এবং মুসলমান ধর্মের আচার অনুষ্ঠান, পালপরবের সবিস্তর বর্ণন। তার বিস্তর শব্দ তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং কোটেশনগুলো যে কোন ভাষা থেকে নেওয়া সে সম্বন্ধে তার সামান্যতম ধারণা নেই। এই বিরাট দণ্ডকারণ্যে কোথায় মহরমের সন্ধান? হঠাৎ লক্ষ করল পঞ্জিকার এক্কেবারে শেষপ্রান্তে ময়ূরপালকের বুক মার্ক সামান্য একটুখানি বেরিয়ে আছে। সেখানে কেতাব খুলতেই চোখে পড়ল আধপাতা জুড়ে বাংলা, মুসলমানি, শক, ইংরেজি, বিক্রম বহু অব্দের তারিখ গয়রহ দেওয়া আছে। হ্যাঁ, ২৫শে মার্চ, এখনও মহরম, থ্যাঙ্ক গড়।
মহরম মাসে শিয়া ইয়েহিয়া খুন-খারাবি করতে ইতস্তত করতে পারে। সেই নিছক চোরাবালির অনুমানের ওপর, দ্যাখ তো না দ্যাখ, শিপ্রা গড়ে তুলল, ইয়াব্বড়া পর্বতপ্রমাণ দেউল– কোণারকের মন্দির। যে খায় চিনি তারে যোগায় চিন্তামণি। সে চিনির তলায় ফাটা সাকি আছে, না মিং বংশীয় সর্বোৎকৃষ্ট পর্সেলিন– কোন মূর্খ করে তার বিচার?
বেয়ারা এতক্ষণে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে। শিলঙ শহরে বারো আনা লোকের মুখ চিন্তাকুল। এদের সক্কলেরই কেউ না কেউ আছে– সিলেট, কুমিল্লাদিতে। এই সর্বব্যাপী দুশ্চিন্তা উপস্থিত অন্য কোনও দুর্ভাবনাকে আমল দিচ্ছে না। মেমসায়েবের মুখে দুশ্চিন্তার আভাস সুস্পষ্ট। রিসেপশনিস্টের কাছে শুনেছে তিনি ডাক, তারের জন্য ব্যাকুল। অতএব তারই মতো অবশ্যই মেমসায়েবের কেউ না কেউ পুব-পাকে আছে। আপন অজানাতেই যেন মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেল, মেমসায়েব, আপনার পোশ কুটুম কি কেউ পাকিস্তানে আছে? সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি বার বার আপন বে-আদবির জন্য মাফ চাইল। শিপ্রা তার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, এতে মাফ চাইবার কী আছে! তোমার দিলে দরদ আছে। তাই শুধিয়েছ।
গাব্রু মিঞা কী করে শিপ্রাকে চিনবে? সে বেচারী চেনে দুই জাতের মেমসায়েব। চা-বাগানের ইংরেজের স্ত্রী মেমসায়েব এবং তাদের অনুকরণে গড়া দিশি মেমসায়েব। এ দু জাত দূরে থাক সে কোনও জাতেরই মেমসায়েব, গিন্নিমা, বেগম সায়েব কিছুই নয়। বিধাতা তাকে কোন কোন ধাতু দিয়ে নির্মাণ করেছেন, পঞ্চভূতের মশলা মেশাবার সময় যে-তৃতীয়টি তেজ প্রচুর পরিমাণে ঢেলেছেন– সে বিষয়ে অবশ্য কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই, সর্বোপরি তার স্বাধ্যায়, একাধিক। সমাজ-দেশের সঙ্গে তার কুণ্ঠাহীন হৃদ্যতা, তার বিচিত্র বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা তার জীবনদর্শন- এসব মিলিয়ে যে শিপ্রা, তাকে বিশ্লেষণ করবে কে? যার নির্মাণ, যার জীবন শিপ্রার চেয়েও বিচিত্র বৈভবে ভরা সে-ই তো? সে কোথায়? তবে কি না, ভালোবাসার সোনার কাঠির পরশ যার প্রাণে লেগেছে সে হয়তো পারে। কীর্তি হয়তো একদিন পারবে।
শিপ্রা বললে, আমার দুই আপনজন আগরতলায়।
এর উত্তরে গাব্রু যে মন্তব্য করেছিল তার জন্য সে মনে মনে নিজের গাল দুটোকে অকাতরে চড় মেরেছে। মোল্লাজির কাছে কাদো কাঁদো হয়ে সে-কাহিনী যখন শোনাল তখন তিনি মনে মনে না– সশব্দে তার দু গালে দুটো চড় কষিয়েছিলেন। একসারি কটু শব্দ বলে গিয়েছিলেন অল্পশিক্ষিত মোল্লাজি তার গুরুর কাছে যেগুলো শুনেছিলেন– আরবি ফারসি উর্দু, সিলেটি ভাষা-উপভাষায়, আহম্মক, নাদান, উলুকে পাট্টা থেকে সিলেটি আচাভুয়া হুমাভুতা পর্যন্ত।
গাব্রু সরাসরি অজানতে বলে ফেলেছিল, আখাউড়া আগরতলা তো বরাবর।
বলতে না বলতেই সে বুঝতে পেরেছিল, কী সর্বনেশে কথা কটি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। রাখালের মাসি যেরকম বুঝেছিল।
সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করেছে, মিসিবাবার মুখ যেন মলিন হয়ে গেল।
গাব্রু প্রথমটায় ছুট লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু থেমে গেল। একখানা আধা সেলাম অসমাপ্ত রেখে ধীরে ধীরে কোয়ার্টারে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
রাত্রে খাবার নিয়ে এল অন্য বেয়ারা। শিপ্রা শুধাল, সে বেয়ারার কী হল? আমি জানতে চেয়েছিলুম, সিলেটের খবর ঠিকমতো পায় কি না, তার পরিবার
এ বেয়ারা বৃদ্ধ, বহুদর্শী, নানা গেস্টের বহু উনুনে পোড় খেয়ে খেয়ে সে ঝামা হয়ে গিয়েছে। সে পর্যন্ত কুল্লে কায়দাকানুন ভুলে গিয়ে দু হাত দিয়ে হঠাৎ চোখমুখ ঢেকে ফেলল।
শিপ্রার প্রশ্নটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। কী হল– বলতে গিয়ে থেমে গেল। বুড়ো নিঃশব্দে কাঁদছে– তার দু হাতের কাঁপন থেকে বোঝা যাচ্ছে।
বুড়োকে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিয়ে শিপ্রা বলল, যাও তো মিঞা, মুখ ধুয়ে আসবার সময় মাস্টার্ড নিয়ে এসো।
মাস্টার্ডের কোনও প্রয়োজন ছিল না শিপ্রার। তার মাথার ভিতর একসঙ্গে বহু চিন্তা লড়ালড়ি করছে। কিন্তু অল্পক্ষণের ভিতরই সে কিছুটা শান্ত হয়ে কিছুটা মনস্থির করে ফেলেছে।
বুড়ো ফিরে এল।
শিপ্রা শুধাল, মিঞা তুমি নামাজ পড়ো?
জি মেমসায়েব।
রোজা রাখো।
জি, হ্যাঁ।
আচ্ছা তবে শোনো। এ সব তো করো আল্লার হুকুমে? না? আমি বুঝতে পেরেছি। তুমিও সিলেটি, তোমার বাল্-বাচ্চাও সেখানে? না?
বুড়ো ঘাড় নাড়ল।
তা হলে এবারে ভালো করে শোনো। সমস্ত জীবন ধরে নামাজ-রোজা সব করলে আল্লার হুকুমে। তার ওপর নিশ্চয়ই তোমার ভরসা ছিল, নইলে হুকুম মানলে কেন? তুমি আমার বাপের বয়েসী। অবশ্যই তোমার মাথার ওপর দিয়ে বহুত ঝড়-তুফান গিয়েছে। তারই ওপর ভরসা রেখে এসব বিপদ-আপদ কাটিয়েছ। এখন এই শেষ বয়সে সে ভরসা কম-জোর হয়ে গেল? তুমি ভেঙে পড়লে ওই অল্প-বয়সী বেয়ারাটাকে হিম্মত যোগাবে কে? উপরে মালিক সব দেখছেন।
আমার হাল তবে এবারে শোনো। আমি এখানে একা। তোমাদের তিনজন, ম্যানেজার-ট্যানেজার ওরা কাজের লোক, আপন কাজ নিয়ে থাকেন। ব্যস্। আমি মেয়েছেলে। আমার এক দোস্ত, আরেকজন তাকে আমি মহব্বত করি দুজনা আটকা পড়েছে আগরতলায়। হয়তো-বা বেরিয়ে আসতে পারবে, হয়তো-বা পারবে না। আমার বাপ নেই, ভাই নেই। এবারে যাও, মিয়া, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আর ওই আহাম্মক ছোকরাটাকে বল, সক্কলেরই দিল এখন কাতর। সে কী বলেছে, না বলেছে। তাতে কী যায়-আসে? ভাবনা বাড়বে? কমবে? তার কথায়? এখন যাও।
এই যে আল্লার নাম নিয়ে শিপ্রা বুড়োকে শান্ত করল সে নিজে কি ঈশ্বর মানে?
আর বহুলোকের মতো শিপ্রা ছিল ধর্ম বাবদে মোটামুটি উদাসীন। প্যারিসে টুরিসট গাইড তাকে সুদু একপাল মার্কিনকে নিয়ে গিয়েছিল বিরাট এক গির্জা দেখাতে। গির্জা তখন ফাঁকা। শিপ্রা বেরুবার সময় গাইডকে বলল, চমৎকার! ফুলদানিটা অতি সুন্দর। কিন্তু ফুল কোথায়? মানুষ উপাসনা করছে সে-ই তো গির্জার ফুল। তার পর সে মাঝে মাঝে গির্জায় যেত উপাসনার সময়। বিশেষ করে মমারৎর-এ পুরো শনির রাত হৈ-হুঁল্লোড় করে রবির ভোরে বাড়ি ফেরার মুখে। ক্যাথলিক গির্জার অর্গেন সঙ্গীত ধ্বনি-লোকের অপূর্ব গম্ভীর যেন বিরাট সিন্ধু। হাড়-পাকা নাস্তিকও সে সঙ্গীতে অবগাহন করে। পেচি নাস্তিক ওই সঙ্গীতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে গির্জাঘর এড়িয়ে চলে। শিপ্রার ভয় নেই, ভরসাও নেই।
একদা এক প্যারিসিনী তাকে শুধিয়েছিল, সে ঈশ্বর-বিশ্বাসী কি না?
যেন শব্দগুলো বাছাই করে করে শিপ্রা বলেছিল, ভগবান বাজারে বিক্রির রেডিমেড টমাটো কেচাপ নন– কিনে নিয়ে ব্যাগে পুরলেই হল। সমস্ত জীবন ধরে তাকে উপলব্ধি করতে হয়। অভিজ্ঞতার পর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে।
রোদন-ক্রন্দনের বিকৃত মুখ, দুশ্চিন্তার শোকে ভেঙে পড়ার বিকট ভঙ্গি শিপ্রা আগেও দেখেছে। কিন্তু আজকের মতো নয়।
কীর্তির সর্বাঙ্গ কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর্লোকের আকস্মিক পরিবর্তন শিপ্রার কাছে এক মুহূর্তে সরল স্বচ্ছ হয়ে গেল নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে রকম আগের দিনের কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান পেয়ে যায়।
শিপ্রা কোচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কটেজ ছেড়ে সুস্থ গতিতে হোটেলের মেন বিল্ডিঙে গিয়ে দাঁড়াল রিসেপশনিস্টের মুখোমুখি হয়ে। স্মিত হাস্য দিয়ে আপ্যায়িত করল গুড ইভনিং সহ। পুনরায় গুড় ইভনিং– এয়া-এর–
হন্তদন্ত হয়ে ছোকরা বললে, সরি, মিস রে– আমাকে উইলস বলে ডাকে সবাই জিমি উইলসন।
ছোকরা হকচকিয়ে গিয়েছে। এতদিন দু চারবার শিপ্রাকে যখনই দেখেছে, তখনই তার মনে হয়েছে, ইনি অন্যলোকের প্রাণী। আজ রাত এগারোটায় সেই নিরাসক্তা, গম্ভীরা এ কী রূপে দিল দরশন! তার মন বলছে, হাউ লাভলি! হাউ সুইট।
শিপ্রা সহজ সুরে শুধাল, এনি নিউজ?
আসলে এতদিন সে কোনও রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলেনি- পাছে কোনও অপ্রিয় গুজব, সংবাদ, ওয়ার্নিং ওরা দিয়ে ফেলে। বিশ্বময় ওই গোত্রের কর্মচারী অর্থাৎ রিসেপশনিস্টদের চোদ্দ আনা চ্যাটারবকস।
ছোকরা কাউন্টারের উপর একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললে– যদিও স্থানটা জনশূন্য উয়েল মিস রে, বলব কি বলব না, বুঝতে পারছিনে। আমার এক বন্ধু আছে এখানকার ট্রাঙ্ক-কল দফতরে। ওরা অনেক কিছু শুনতে পায়। এখখুনি সে আমায় ফোন করেছিল। তারই মতো আরেক ট্রাঙ্ককর্মী শুনতে পেয়েছে ইন্ডো-পাক বর্ডারের গারো না ডাউঁকি না যশোর কোথা থেকে কে যেন কাকে ট্রাঙ্ক-কল-এ বলেছে, আজ রাত্রেই নাকি ঢাকাতে ট্রাবৃল আরম্ভ হয়ে যেতে পারে। তা, তা, মিস রে, সে-ও যে খুব শ্যোর শুনেছে তা নয়।
গুজব হোক, খবর হো এইটেই যদি সে ঘণ্টাটাক পূর্বে শুনতে পেত তবে আপাদমস্তক মুষড়ে পড়ত। কিন্তু এখন তার বুকের ভিতর কে যেন একখানা টিন প্লেট বসিয়ে দিয়েছে।
স্বাভাবিক কণ্ঠে শুধাল, আর যশোর, কুমিল্লা, বাদবাকি বর্ডার?
ছোকরা উত্তর দিল, আজ, এখখুনি, তো আর কিছু বলেনি। তার পর খানিকক্ষণ ঘাড় চুলকে বললে, কিন্তু দিন পাঁচেক আগে বলেছিল, গোলমাল লাগলে সব জায়গায় একসঙ্গেই লাগবে। তবে সে শ্যোর ছিল না এটো। এখন কে শ্যোর হয়ে কী বলতে পারে?
শিপ্রা হাঁটুর কাছে কেমন যেন একটা দুর্বলতা অনুভব করল।
খানিকক্ষণ না জানি কোন দেবতার কৃপায় তার দুশ্চিন্তা-বর্ষার অবিরল বারিধারা সম্পূর্ণ থেমে গিয়েছিল, কিন্তু তার পরের ইলশেগুঁড়ি ক্ষণে আসে ক্ষণে যায়। তারই স্বচ্ছ যবনিকা যেন নেমে এল তার বুকের ভিতর।
তবু মুখে হাসির ক্ষীণ পরশ লাগিয়ে বললে, তোমার কথা খাঁটি, উইলসন। সব-কথা বিশ্বাস করলে কি আর মানুষ বাঁচতে পারে? থ্যাঙ্কয়ু, অল্ দ্য সেম। গুড নাইট শিপ্রা মনে মনে বললে, ছেলেটি দরদি, লক্ষ করল তার বুশ শার্টের বুকের কাটে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা ক্ৰস্। বললে, মাদার মেরি, তোমার মঙ্গল করুন। গুড নাইট ওলড ম্যান।
জিমি যদিও ছোকরা বেয়ারারের মতো ওরকম খুনিয়া ফো পা অর্থাৎ সাপের ন্যাজ মাড়ায়নি তবু শিপ্রার ভাব পরিবর্তন থেকে আমেজ করতে পেরেছিল সে বেসুরো কর্কশধ্বনি ছেড়ে বসেছে। এক ফো পা মেরামত করতে গিয়ে দুসরা কদম খাদে ফেলল না। কাউন্টার ঘুরে শিপ্রার পাশে পাশে, কিন্তু সম্মানার্থে আধ কদম পিছনে পা ফেলে তাকে কটেজে পৌঁছিয়ে দিতে সঙ্গে চলল। যেতে যেতে বলল, মাদার মেরি হেভেন্ আর্থের কুইন মেরি! তাকে আমার স্মরণে আনি আর নাই আনি, তাঁর করুণাধারা কখনও ক্ষান্ত হবে না।
শিপ্রা মৃদু কণ্ঠে দরদভরে বলল, আমেন।
সঙ্গে সঙ্গে বহুদিনের অনভ্যাস সত্ত্বেও, ফরাসিদেশের আর পাঁচজনের মতো অজানতেই ডান হাত দিয়ে বুকের উপর ক্রসচিহ্নের প্রতীক দেখাল।
উইলসন একটু লজ্জা পেল। বিধর্মী পালন করল সেই আচার– সে যেটা সমাজে পাঁচজনের অযথা দৃষ্টি আকর্ষণ না করার জন্য আপন সমাজের বাইরে এড়িয়ে যেত। কটেজের সামনে পৌঁছে বলল, গুড নাইট, ম্যাডাম। এনি থিং এলস্ আর কিছু?
এই অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতেও তার মনে পড়ল– প্রাচীন স্মৃতি নবীন পরিস্থিতির বিনা অনুমতিতেই উদয় হয় প্যারিসের রেস্তোরাঁতে ওয়েটার খানা অর্ডার দুফে দফে শেষ হওয়ার পর যখন জিগ্যেস করত, এনি থিং এলস্ মাদাম তখন তাদের মধ্যে বেপরোয়া মেয়ে বলে উঠত, হ্যাঁ, তোমার প্রেম!
শিপ্রা বললে, থ্যাঙ্ক ইউ, গুড নাইট, ইয়াং ম্যান্। মা মেরি তোমার মঙ্গল করুন।
কুটিরে ঢুকে শিপ্রা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভুলে গিয়েছে এর পর কী করতে হবে, তার পর কী, শুয়ে পড়বার আগে। মাথাটা যেন ভেকুয়াম। এবং সে বোধশক্তিও নেই। হাতমুখ ধোয়া, কাপড় ছাড়া, এসব নিত্য রাতের যান্ত্রিক রীতি– তবু–
এমন সময় কাঠের বারান্দায় দুমদাম করে পায়ের শব্দ হল। ছুটে আসছে কেউ। হঠাৎ একেবারে চুপ। আস্তে আস্তে দোরে টোকা। মৃদু কণ্ঠে মাদাম, টেলিগ্রাম।
তার হাত কেঁপেছিল কি না, পরে স্মরণ করতে পারেনি। শুধু একসপেরিমেন্ট করে দেখেছিল বারান্দার ক্ষীণালোকে টেলিগ্রামটা পড়া যায় কি না। তখন কিন্তু পেরেছিল।
বেচারা জিমি ঠায় দাঁড়িয়ে।
যেই দেখল, শিপ্রার মুখে হাসি ফুটেছে, ভদ্র হোটেলের বেবাক এটিকেট ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, গুড় নিউজ, ম্যাডাম?
থ্যাঙ্কু। হ্যাঁ। জিমির তিন লম্ফে পলায়ন।
শিলচর থেকে তার। সাতাশ তারিখে পৌঁছাচ্ছি। কী খান।
.
০৪.
শিলঙকে বলা হয়, হিল স্টেশনের রানি– রাজা কে? দার্জিলিং
রবীন্দ্রনাথ দুটো তুলনা করেছেন অতিশয় সঙ্কীর্ণ পরিসরে :
দার্জিলিঙের তুলনাতে ঠাণ্ডা হেথায় কম হবে,
একটা খদর চাদর হলেই শীত-ভাঙানো সম্ভবে।
কিন্তু দার্জিলিঙের সঙ্গে তুলনা না করে তার পর শিলঙের যে-বর্ণনা দিয়েছেন তাতে শিলঙের প্রায় কোনও মাধুরিমাই বাদ পড়েনি। যে পাইন বন শহরে পৌঁছুবার বহু আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় সেটাই শিলঙের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। রবীন্দ্র কবিতাতে দু দুবার তার উল্লেখ করেছেন।
খুব ভোরেই শিপ্রার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু এই পাইন বনের অকল্যাণে বিশেষ করে যেখানে বনটা নিবিড় ঘন– কবি বর্ণিত :
এখানে খুব লাগল ভালো গাছের ফাঁকে চন্দ্রোদয় সেই চন্দ্রোদয়, সূর্যোদয় শিলঙের বহু জায়গা থেকেই দেখা যায় না। তাই শিপ্রার চোখে পড়েছে, অনেকক্ষণ ধরে ঘন পাইনবনের ছাঁকনির ভিতর দিয়ে গলে আসা প্রদোষের আধ-আলোর কেমন যেন সবুজ সবুজ ভেজা ভেজা রেশের পরশ। কিন্তু কানে আসছিল যে–
বাতাস কেবল ঘুরে বেড়ায় পাইন বনের পল্লবে।
তারই ক্ষীণ ঝিরঝির মধুর, যেন কুচিৎ জাগরিত বিহঙ্গ-কাকলি। শিপ্রা কিন্তু পূর্ণ জাগরিত। নিত্য ঊষায় তার সদভ্যাস– প্রথম আলোর চরণধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সে প্রথম পদক্ষেপ করে শয্যা থেকে ভূমিতে কলকাতায় শেষের দু ভোরে করেছে পাদপীঠ পরে। কীর্তি সোনালি-নীলের গালায় আঁকা, ঢেউ খেলানো পা-ওলা বর্মা দেশের একটি পাদপীঠ তার অজানতে একদিন চুপিসাড়ে রেখে গেছে।
বেদনার উত্তেজনাতে মানুষ তবু কিছুটা কাজকর্ম করতে পারে, কিন্তু নির্ভাবনার প্রশান্তি আনে অবসাদ।
ছোট্ট জানালাটির শার্সির ভিতর দিয়ে সে তাকিয়ে আছে মাঝারি পাইনের শীর্ষ পল্লবের মৃদু আন্দোলনের দিকে, আর হেথা হোথা টুকরো টুকরো নীলাকাশের পানে। ততখানি উপরে উঠতে দেবতার ঢের সময় লাগে। টিলার সানুদেশ পাইনপাতার ছুঁচে আবরিত। এখানে-ওখানে সূর্যরশ্মির গোম্পদ। চিকচিক করে তার পিচ্ছিলতা। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন একটা সঁতসেঁতে ভাব মনটাকে প্রফুল্ল করে তোলে না।… একটি খাসিয়া মেয়ে পিছলে পাইনপাতার উপর পা টিপে টিপে সন্তর্পণে পাহাড়ে চড়ছে। মাঝে মাঝে পিছন পানে তাকাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে ওদিকে? ওখানে কাঠ কাটতে দেয় না। একটা ছোকরা এসে নিচের রাস্তা থেকে ডাকল ওকে। মেয়েটা কিছু উত্তর না দিয়ে সন্তর্পণতা বর্জন করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলল উপরের দিকে। কীই-বা করে ছোঁড়াটা! সে-ও ছুটল পিছনে। দুজনাই অদৃশ্য। অনেকক্ষণ পর নেমে এল দুজনা, হাত ধরাধরি করে, কিন্তু রাস্তায় নেমে একে অন্যের হাত ছেড়ে দিল। শিপ্রার মনে হল এদের রস আছে– নইলে এত সকালে লুকোচুরি খেলা!
বেয়ারা ভোরের চা নিয়ে এল। শিপ্রা বিছানা থেকেই বলল, বাইরের ঘরে রেখে যাও। সে সুসংবাদ পেয়েছে, ওকে মুখ দেখায় কী করে। কবির বিনু ছিল কমবয়সী তার চিত্তে উদয় হয়েছিল ভাব, বিশ্বসংসারের দুঃখ না ঘোচাতে পারলে তার সেই হঠাৎ-পাওয়া আপন আনন্দ সম্পূর্ণ হবে না। শিপ্রার সে সাধ হওয়ার কথা নয়, তবু চেনা জনের দুশ্চিন্তা, তার সামনে বেরোয় কোন মুখে।
আবার দুমদাম শব্দের সঙ্গে নিস্তব্ধতা, টোকা, কাম ইন্।
তিনবার গুড মর্নিং বলার পর উত্তেজনায় ফেটে চৌচির জিমি একরাশ খবর দিল। সেগুলো সংগ্রহ করেছে, কিছুটা বেতার থেকে, কিছু ট্রাঙ্কতারের বন্ধুর কাছ থেকে, কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সবজান্তাদের ফোন করে, ফোন পেয়ে।
সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান সংবাদ। ঢাকায় কাল রাত থেকে লেগে গেছে ধুন্ধুমার। অন্য কোন কোন জায়গায় সে খবর সঠিক কেউ বলতে পারেনি তবে খুব সম্ভব সব ক্যান্টনমেন্ট টাউনে। জোর দিয়ে বার বার বলল, শিলচর ইজ সেফ–পাকা খবর।
কী করে শ্যোর হলে জিমি?
গুড লর্ড! আমি আমার ট্রাঙ্ক-বন্ধুদের অতিষ্ঠ করে তুলিনি, সেই ভোরবেলা থেকে, শিলচরের খবর জানাতে? মুচকি হেসে বলল, ওরা হয়তো ভেবেছে আমার ফিয়াসে বুঝি শিলচরে।
আরেকটা ইমপর্টেন্ট খবর, মাই লেডি, পাক আর্মি ইন্ডিয়ান এলাকায় ঢুকবে না এইটেই ৯৯% রিপোর্টার স্বামীনাথন তো বলল, সে তার লাস্ট শার্ট বেট করতে রাজি আছে? অতএব শিলচর ভেরি সেফ।
সিলেটের খবর?
গলা নামিয়ে বললে, ভালো নয়, মন্দও নয়। তবে স্বামীনাথন জোর গলায় বলল, সে নিজে জানে সিলেটে পাঞ্জাবি পাঠান সেপাই অতি অল্প নেগলিজেবল!
শিপ্রা একটু চিন্তা করে বললে, দ্যাট ইট। বল তো, জিমি, এখানকার সবচেয়ে সরেস রেডিয়ো-ডিলার কে?
গুডনেস মি! সে তো আমার ইয়ার বরুয়া। নাইস চ্যাপ। কিন্তু ম্যাডাম আপনি টাকা দেবেন না। শুধু দামটা জিগ্যেস করবেন। তার পর দেখি তার দৌড় কদ্দূর।
টাকা না দিলে—
দেবে না? মানে? হেভেনস্। ন টার সময় দোকান খোলে যাকে বলে কারেক্ট টু দি গান।
কী দরকার দর-কষাকষি করে?
প্লিজ, ম্যাডাম। আমাকে অন্তত একটা চান্স দিন। আপনি এখন খুশি। লেট মি বি হ্যাপি ওলসো।
শিপ্রা এখন গুজব, খবর, ব্লা, প্রপাগান্ডা, সব শুনতেই রাজি।
কাঁটায় কাঁটায় ন টায় বরুয়ার দোকানে গেল ট্যাক্সি করে। সর্দারজি ঢাকা, কুমিল্লার যেসব রোমাঞ্চকর গুল্-ই-বাকলির কেচ্ছা শোনাল তার কাছে জিমির রিপোর্ট সরকারি ইশতেহারের মতো পানসে, বলে অনেক মিন করে নাথিং, যেন হাওয়ার কোমরে রশি বাঁধা। কোনওপ্রকারের উসকানি শিপ্রাকে দিতে হয়নি। সেদিন ডিকটেটর ইয়েহিয়ার কাহিনীই সকল কাহিনীর ডিকটেটর। এমনকি পুঁচকে ডিকটেটর ইয়েহিয়ার তুলনায় দানবকায় বড়া ডিকটেটর হিটলারের অতর্কিত রুশ আক্রমণের খবর তার দুশমন চার্চিল-রুজভেল্ট দুজনাই জানতেন ও স্তালিনকে মাসখানেক পূর্বে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মুসসোলিনির অতর্কিত গ্রিস আক্রমণের পূর্বাভাস হিটলার পাননি। আমাদের পুঁচকে ডিকটেটর হেইয়া সাব কিন্তু কুল্লে ডিকটেটরকে এ বাবদে ঘোল খাওয়ালেন। শেখের সঙ্গে সন্ধির কথাবার্তা দিনের পর দিন তিনি যখন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন পশ্চিম পাক থেকে তিনি আনাচ্ছেন টর্নেডো বেগে হাজার হাজার পাঠান-পাঞ্জাবি সঙ্গে সঙ্গে দিনের পর দিন। ২৫ মার্চের দুপুররাত পর্যন্ত ঢাকার অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করত, ইয়েহিয়া-মুজিবের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়ে গিয়েছে। সদর (শব্দার্থে চক্রবর্তী) ইয়েহিয়া দু একদিনের মধ্যেই ফৈসালার বিবরণ প্রকাশ করবেন। ২৬ মার্চ সকালে ইয়েহিয়া-ভুট্টো-মুজিবের সম্মিলিত হওয়ার পাক্কা এপয়েন্টমেন্ট। ২৫ মার্চ বিকেল পাঁচটায় ইয়েহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন মুজিব এমনকি তাঁর বামহস্ত ভুট্টোকে পর্যন্ত কোনও খবর না দিয়ে। সেদিন সে খবর জানতে পারল অতি অল্প লোকই। খোদ ঢাকা শহরেও। আর্মি অফিসার ইয়েহিয়া তাবৎ সিভিলিয়ান ডিকটেটরদের শিখিয়ে দিল একটি নবীন তত্ত্ব। আর্মি ডিসিপ্লিনে যে কোনও প্ল্যান গোপন রাখা অফিসারদের ধর্ম–সিভিলিয়ানের পক্ষে সেটা অস্ত্রমাত্র।
শিলঙ জানতে পেরেছে ২৬ মার্চ সকালে ধুন্ধুমারের খবর। যুদ্ধারম্ভের পূর্বেই ঢাকার রণাঙ্গন থেকে জঙ্গি লাটের পলায়ন- যথা, দুর্যোধনের হৃদয়ে সাহস দেবার জন্য শঙ্খ না বাজিয়ে পিতামহ ভীষ্ম যদি চুপিসাড়ে পুস্পক প্লেনে পলায়ন করতেন, তোবা! তোবা শুনলেও পাপ হয়– এ খবর হয় তো লাগে তাক না হয় তুঙ্কারূপে কোনও কোনও ফলিত জ্যোতিষী অনুমান করেছিলেন মাত্র। ড্রাইভার সর্দারজি হয়তো পূর্বজন্মে জ্যোতিষী ছিল।
শিপ্রার স্মরণে এসেছে, আগরতলায় মিঞা সাহেবের কথা।
তা হলে শিয়া ইয়েহিয়া শেষ পর্যন্ত মহররমের পবিত্রতা বিনষ্ট করে ওই মাসেই নরহত্যায় লিপ্ত হল।
ইসলামি পঞ্জিকা-খানাতে শিপ্রা শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হচ্ছিল বটে, কিন্তু ঠিক যে স্থলে সংক্ষেপে বলা হয়েছে, মুসলমানি হিসেবে দিবস আরম্ভ হয় সন্ধ্যা থেকে, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে, সে অবধি পৌঁছয়নি। ২৫ মার্চ দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে বিশ্ব মুসলিমের স্যাবাৎ পবিত্র জুম্মাবার, শুক্রবার। কট্টর শিয়া আরম্ভ করলেন তার নরহত্যা শিয়া-সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ের পবিত্র জুম্মাবার রাত এগারোটায়, সুন্নির কাছে পবিত্র, শিয়ার কাছে পবিত্রতম মুহরম মাসে!
শিপ্রা দোকানে ঢুকে বেছে নিল সবচেয়ে ভালো বেতারযন্ত্র– পরের মুখে ঝাল না খেয়ে সে স্বকর্ণে শুনতে চাইল ঢাকা, কলকাতা, পিভি, বিবিসি এবং জোরদার বিদেশি স্টেশনগুলো। দাম শুনে শুধাল সর্বোত্তম এরিয়ালের সরঞ্জাম বরুয়ার লোক হোটেলে ফিট করে দিয়ে আসতে পারবে কি না, তার চাই আজই, এখুনি। বলতে না বলতে জিমি এসে উপস্থিত। মাদামকে আরেক দফা সুপ্রভাত জানিয়ে তাকে বলল, আপনার সেট পছন্দ হয়েছে? গুড়। এবারে আপনি সেটটি সঙ্গে নিয়ে যান, আর এই লাগিয়ে দিচ্ছি ঘণ্টা দুয়েকের তরে মোস্ট টেম্পরারি একটা এরিয়েলের তার। তারের অন্য প্রান্তটা কোনও একটা জানালা দিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে দেবেন। দাঁড়ান, এই আমি ১৩ মিটারে লাগিয়ে দিচ্ছি। নিডলটা। ডাইনে-বাঁয়ে ওটাকে সামান্য নাড়লেই পেয়ে যাবেন এবিসি, আই মিন অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি না করপোরেশন কী যেন? মিনিট পনেরো পরেই পেয়ে যাবেন নিউজ বুলেটিন। ইন্ডো-পাক খবর বিতরণে এরা প্রায়ই বিবিসিকে কানা করে দেয়। টাকা? সে আপনি আমাকে বরুয়ার নামে চেক দিয়ে দেবেন অ্যাকাউন্ট পেয়ী। অবশ্য সেটা পছন্দ হলে। নইলে আজ বিকালে আমি বরুয়ার সেটটা– বেস ইন দি ইটা অব সুয়েজ, মাদাম। বলে সেট তুলে নিয়ে চলল মাদামকে আধ বোটের মতো পিছনে পিছনে টেনে।
প্যোরেস্ট অব দি প্যোর অহমসন্তান বড়য়া সমস্তক্ষণ দু কান-ছোঁয়া মৃদু হাস্য, তৎসহযোগে ঘাড় নেড়ে নেড়ে, অফ কোর্স, সার্টেনলি, টাকার কথা কে তুলেছে?– নট মি, বহক, ম্যাডাম, বহক, চেয়ারতায় বসূটে আজ্ঞা হোক মৃদু কণ্ঠে বলে যাচ্ছে তো বলেই যাচ্ছে। শিপ্রা দু একবার আপত্তি তোলবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।
প্লাগে কনেকট করতে আর তার লটকাতে ক মিনিট লাগে। নিডল একটু ছুঁতে না ছুঁতেই মেলবার্ন গাক গাঁ করে উঠল, এরিয়ালের উদ্বাহু, বামন বেতারের কল্যাণেই। ইতোমধ্যে দেখতে পেল এসে গেছে অহম দেশের গভীরতম অরণ্যের গগনচুম্বী বংশাবতংশদ্বয়। এ-হেন এরিয়েল দিয়ে কটকের চিউ চিউ মিউ মিউ থেকে টোকিয়োর গাক গাক শোনা যাবে পরিষ্কার– দাঁতমুখ খিঁচিয়ে স্পিকারে কান না সেঁটেও!
সমস্ত দিন কাটল শিপ্রার এ-স্টেশন ও-স্টেশন শুনে শুনে।
বিশেষ করে কলকাতার ডি সি বেতার রিসেপশন এতই পীড়াদায়ক যে, সে সেখানে তাদের যন্ত্রটাকে কয়েক মাস নাড়াচাড়া করে একদম তালাক দিয়েছিল।
এখানে কী লাক!
প্রথম সন্ধ্যাতেই, পিন্ডি থেকে নিডল একটু সরে যেতেই শিপ্রা শুনতে পেল পরিষ্কার যদিও ঈষৎ মৃদু কণ্ঠে, ইসি পারি, ইসি পারি। এখানে প্যারিস এখানে প্যারিস, মেমোয়েজেল, মেদাম–।
শিপ্রা মুহ্যমান! কত বর্ষ, কতকাল পরে সে শুনতে পেল সেই প্রাচীন যুগের নিত্যদিনের সঙ্গী ইসি পারি, ইসি পারি। সংবিৎ হারিয়ে প্যারিস দিচ্ছিল খবর- সে কথা কইতে লাগল প্যারিসের সঙ্গে উই উই– হা হা, মে সার্তেনমা– নিশ্চয় নিশ্চয় তার পর কী একটা অনিবার্য দুর্ঘটনার সংবাদে মে ক্য ভুলে ভু–আহা, তার আর কী করা যায়–ফ্রানসবাসী যে কোথাকার কোন এক কনফারেনসে তাদের ফরেন মিনিস্টার যাচ্ছেন না শুনে মোটেই বিচলিত হয়নি শুনে শিপ্রা ঘাড়-গর্দান ত্যাগ করে মুখ বেঁকিয়ে বলল, জ্য মা ফু অসি– আমো থোড়াই কেয়ার করি।
কে যেন দরজায় নক করল। শিপ্রা তখন প্যারিসে।
আঁত্রে, সিল ভু প্লে–ভিতরে আসুন প্লিজ। যেই দেখল ঢুকেছে সেই জোয়ান সিলেটি বেয়ারা, অমনি কোথায় মিলিয়ে গেল প্যারিস! একটা ফু-তে নিভে গেল পিদিমটি। অন্ধকার।
.
০৫.
শিপ্রা ইংরেজি, ফরাসিস, বাংলা বুঝতে পারে ভালো, কিছুটা হিন্দি।
সকালে মেলবার্ন হতে যাত্রা আরম্ভ করে পিন্ডি, দিল্লি হয়ে বিবিসি, দুপুরে জর্মনির কলোন, সন্ধ্যায় প্যারিস। সর্বশেষে চীন আর রাশা। ইতোমধ্যে হয়তো উটকো আজারবাইজান থেকে শুনল ফরাসিতে কিংবা ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বাংলাতে।
ফলে সবকিছু গেল ঘুলিয়ে। পরে কিছুতেই মনে পড়ল না স্বাধীন বাংলা বেতারের বাক্যস্ফূর্তি হয়েছিল কোন দিন, আর, ঢাকা বেতার লীগ-প্রেমীদের হাত থেকে খানরা ছিনিয়ে নিল কোন সময় ছাব্বিশের সকালে। বস্তৃত ঠিক সে সময় শিপ্রা বেতার কিনতে বাজারে গিয়েছে। তবে তার ভাসা ভাসা একটা ধারণা হয়েছিল, খানদের অমানুষিক অত্যাচার এবং পাশবিক বর্বরতার সর্বপ্রথম সংবাদ দেয় এবিসি।
শেষপর্যন্ত শিপ্রার হৃদয়ঙ্গম হল, বিস্তর স্টেশন শুনে বিশেষ কোনও লাভ হয় না। পঞ্চপাণ্ডবের চেহারা হুবহু এক রকমের হলে দ্রৌপদী নিশ্চয়ই আপত্তি জানাতেন। এস্থলে গোটা পাঁচ বিবিসি, মার্কিনি এবং গোটা দুত্তিন, একুনে ওকিবহাল পঞ্চ স্টেশন বিস্তর মেহনত ও দেদার পয়সা ঢেলে খবর সংগ্রহ করে; বাদবাকি কুল্লে দুনিয়ার বুড়ি বুড়ি স্টেশন এদের সঠিক সার্টিফিকেট প্রাপ্ত কার্বন নন বটে কিন্তু ওই পঞ্চপাণ্ডব প্রদত্ত সংবাদের বিভিন্ন রকমের ঘাট বানিয়ে বিতরণ করে। শিপ্রার এত প্যারা যে ইসি পারি তিনি পুব বাংলা বাবদে প্রায়শ উদাসীন কিন্তু যখন নিন্দে করতে চায় তখন বিবিসির মতো পিন-পিনিয়ে শ্যাম-কুল রক্ষা না করে, দ্যায় চুটিয়ে গালাগাল এবং মাঝে মাঝে একটা হুলো আর মেনী বেড়াল গালগল্পের মাঝখানে এমন সব বর্ডার-ছোঁয়া আদি-রসাত্মক মাল ছাড়ে যে আমাদের একস-প্যারিসিনী শিপ্রা ভিন্ন– মেয়ে নয়– যে কোনও পুরুষেরই পিলে চমকে উঠত।
লিবেরতে, লিবেরতে তুজুর লা লিবেরতে।
কোন বেতার কতখানি লিবেরতে উপভোগ করে সে প্রশ্নটা শিপ্রার মনে আবার উদয় হল। বছর কয়েক আগে সে পাক-ভারত লড়াইয়ের সময় বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আর-সবাই শুনতে চায় বলে সে-ও সঙ্গ দিয়ে কয়েকবার বিবিসি শুনেছিল। এখন মাত্র দু দিন অবশ্য বেশ বার-কয়েক–বিবিসি শুনে তার মনে হল দায়িত্ববোধ মাত্রাধিক বেড়ে যাওয়ার ফলে সে ক্লীব হয়ে যাচ্ছে। আধ-ফর্সা সুন্দরীর আপন ফর্সা বাঁচানো সম্বন্ধে দায়িত্ববোধ যখন বড্ড বেশি বেড়ে যায় তখন সে যেমন রোদ্দুরে বেরুতে চায়। চিন্তা করে শিপ্রা সিদ্ধান্ত করল, এখন বিবিসির মূল্য নেতিবাচক। অমূক গুরুত্বপূর্ণ নিউজ-আইটেমটা পুব পাকের প্রতিবেশী বর্মা বেতার দিয়েছিল সকালবেলা, সেদিন তো নয়ই, পরের দিনও বিবিসি সেটা উল্লেখ করল না, এমনকি বর্মার বরাত দিয়েও না। অতএব খবরটার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
ইতোমধ্যে পশ্চিম পাক বেতার যে একটাই রেকর্ড অনবরত, কিবা দিন কিবা রাত্রি, বাজিয়ে চলেছে তার ধুয়ো তামাম পূরব বাঙালময় অখণ্ড শান্তি, অপার নিরাপত্তা। ওইটা যে হবে সে তো নিতান্ত স্বাভাবিক। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রপাগান্ডা বিশারদ হের ডক্টর গ্যোবেও শেষপর্যন্ত আপন প্রপাগান্ডার হাড়কাঠে মুণ্ডটি হারালেন। বার্লিনের পতন কখনও হবে না, বার্লিন কস্মিনকালেও পরাজিত হতে পারে না এ জিগির তিনি শত শত বার শুনিয়েছেন বেতারে, বিশেষ বিশেষ বুলেটিনে, মার্চ ম্যাজিকের তেজীয়ান তালয়সহ, বলীয়ান রণদামামা সহযোগে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী বার্লিন নাগরিকদের আজ যে রকম হুবহু পৃথিবীতে শান্তি অন্তরীক্ষে শান্তি জিগির গাইছেন চোটা ডিকটেটর ইয়েহিয়া– বার্লিন পতনের পূর্ব মুহূর্তে সেই কাপ্তান গ্যোবেলস্ নিমজ্জমান বার্লিন-মানওয়ারি জাহাজ থেকে খালাসি-লস্করকে আপন আপন নসিবের হাতে সমর্পণ করে এক লাফে লাইফ-বোটে আশ্রয় নেবেন কী করে? সে তো অনেক দূরের কথা– ইয়েহিয়ার তরে, এখন। এখন তার জীবনপুঁথির নয়া পাতা সে উটিয়েছে মাত্র। কিংবা সে নব-বর। আতশবাজির ফাঁকা আতশ আগুন নয়, উৎসব-বহ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে, জ্বালাচ্ছে হাট-বাড়ি, মন্দির-মসজিদ। কাঁচা বাঁশের খুঁটি আগুনে তেতে উঠে যে বিকট শব্দে ফেটে উঠছে তার কাছে কোথায় লাগে পাঠানের বিয়েতে রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ? লোকে বলে ইয়েহিয়া পাঠান, আসলে সে শিয়া দারওয়ান গুষ্টির ছেলে, জাতে কিজিলবাশ, পাঠান কুত্রাচ শিয়া হয় না। বিয়ের বর্ণ লাল, লালে লাল, রক্ত লাল। আবির আর পিচকারি মারার তরে লাল রঙের কী প্রয়োজন? মোগল ছবিতে হোলির দিনে, বিয়ের সাঁঝে পাঠান মোগল হারেম-মহিলারা পিচকারি দিয়ে টকটকে সুগন্ধি লাল জল– সুখ-আ মারতেন একে অন্যের তনুদেহে- এন্তের মোগল তসবিরে আছে, মুসলিনের দু পাট্টা, সোনার চুমকিদার উড়িষ্যার ফিলিগিরি রুপোর তার আর রেশমি সুতোয় বোনা সদরিয়া ভেদ করে সিক্ত করে দিয়েছে শুভ্র ফেননিভ সিত কুঞ্চলিকা। নৃত্যের তালে নীবিবন্ধ শিথিল হতে শিথিলতর হয়ে উন্মোচিত করে দিয়েছে নাভিপদ্ম। লক্ষ্য ভেদ করো, মারো পিচকারি, হে হারেমরাজ নটবর ইয়েহিয়া মহরমের শুক্রের রাতে। কী? রক্তরাগরঞ্জিত বারি আর নেই!
কী ভাবনা তব ওহে সৈনিক,
হোয়ো নাকো ম্রিয়মাণ।
না, না, না– ফটিকাধার থেকে শিরাজের লাল পানি নিচ্ছ কেন, রসরাজ। যদি তুমি এখন ঢাকেশ্বরীর প্রসাদাৎ প্রাসাদে দুর্বার স্কন্ধাবার নির্মাণ করে থাক তবে আনাও না রক্ত, জোয়ানদের তাজা খুন, রমণীদের অঙ্গরক্ত। বুড়িগঙ্গার পানি তো ডুবে মরেছে উপরের রক্তস্রোতের চাপে। কোনও লাস্যবতী ন্যাকরা করে বলতে পারবে না, বঁধু রঙ দিয়ো না গায়।
তুমি তো দিচ্ছ রক্ত। ড্যাম ইয়োর রঙ।…
সাতাশে মার্চ শিপ্রা ধীরপদে গেল রাত এগারটায় হলঘরে। উইলসন মাস্টার ছোট্ট একটা কমজোর বালব ছাড়া, সবকটা আলো নিভিয়ে ঝিমুচ্ছে। যেন ঘিয়ের পিদিমের আলোতে একটা বাচ্চা ছেলে ঘুমুচ্ছে। কোনওপ্রকারের শব্দ হলেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে নিদ্রালু ভাব কাটবার আগের থেকেই জপ করতে আরম্ভ করে, ইয়েস্ প্লিজ! হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ। কিন্তু শিপ্রা এসেছে অতিশয় নিঃশব্দে। এবং তার পায়ে দিল্লির বিল্লি মোরান মহল্লার সেলিম-শাহি– এর সোল নাকি তৈরি হয় চামচিকের ডানা পিটে পিটে; সত্য নির্ণয় কঠিন। শিপ্রা দুই হাত আড়াআড়ি বিছিয়ে তার উপর বুকের ভর দিয়ে দিয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে রইল। দেখছিল, সরল কিশোরের তন্দ্রা তার মুখচ্ছবি কী মধুর আর সরলতর করে দিয়েছে। এরকম আদুরে আদুরে মুখ থাকলে কি কিশোর, কি যুবা, কি শিশু সবাইকে কন্টিনেন্টে বলে মাদার ডার্লিং মায়ের দুলাল।
একসময় জেগে উঠবেই। ধড়মড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুড়– সম্পূর্ণ করার পূর্বেই শিপ্রা শুধল, জিমি, সে, ইউ গট ব্র্যান্ডি, কন্যা–ফ্রেঞ্চ?
জিমি থ। ইনি অবশ্যই সোসাইটি লেডি। এর চতুর্দিকে যে আবহাওয়া সে তো সোসাইটি লেডিরই উপযুক্ত, এবং সে-ও ইলিয়ট রোডের প্রাচীন দিনের অ্যাংলো– মদ্যের সঙ্গে শিশু বয়েস থেকে তার পরিচয়– তবু এ লেডির সঙ্গে কন্যা কেন, ব্র্যান্ডির ফোঁটা পর্যন্ত খাপ খাওয়াতে পারল না। যেরকম তার ড্যাডি। পাল-পরব ভিন্ন তাকে সে কখনও সে পাশ মাড়াতে দেখেনি।
জিমি : সার্টেনলি, সঙ্গে সোডা, না প্লেন জল?
সোডা আর জল দুই-ই। আর দুটো ওয়াইন গ্লাস নিয়ে আসবে, সঙ্গে করে। কিন্তু বঁ দিয়ো ইয়াল্লা– কাউন্টার সামলাবে কে?
কী যে বলেন, মাদাম! বেয়ারা রেখে যাব। সে ডেকে দেবে। কিন্তু এখন তো বড় কিছু একটা কাজ থাকে না।
শিপ্রা কটেজের ড্রইংরুমে জিমিকে মুখোমুখি বসিয়ে হিয়ার ইজ লাক! বলে জিমির গেলাসে আপন গেলাসের সঙ্গে টক্কর লাগিয়ে টুং করে ধ্বনিতরঙ্গ জাগাল।
জিমির বয়স কম হলেও বড় হোটেলের রিসেপশনিস্ট্ররূপে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে বহু বিচিত্র এবং প্রচুর। সে তাগড়া জোয়ান, চেহারা মিষ্টি মিষ্টি, সব্বাইকে আপ্যায়িত করতে হামেহাল তৈরি। বিস্তর চা-বাগানের মেমসায়েব, নেটিভ মেমসায়েব, সোসাইটি লেডি, মার্কিন টুরিস্টিনী হিল স্টেশনে আসে নিছক যৌনক্ষুধা পরিতৃপ্ত করতে। তাদের ভিতর আবার গড় ড্যাম পার্ভার্ট। কলকাতায় পুরুষরা বড় বড় হোটেলে ঢলাঢলি করেন। শঙ্কর তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সে-নাটকের অত্যুত্তম বর্ণনা এবং নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতিতে যে রস সৃষ্টি করেছেন, সেটি গৌড়জন আনন্দে করিছে পান সুধা নিরবধি। অবশ্য ঢলাঢলির জন্য রমণী দরকার। অতএব তেনারাও আছেন, কিন্তু সেখানে তারা প্যাসিভ উপাদান মাত্র, যেমন হুইস্কি। কিন্তু বোম্বাই-কলকাতাতে যৌন-ক্ষুধাতুরা রমণীরা সক্রিয় স্বাধীন পদ্ধতিতে রতি-সখার সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য বড় বড় হোটেলের সদ্ব্যবহার করতে ঈষৎ কুণ্ঠিত হন। ফলে বংশানুক্রমে এঁরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সেটা বহুবিধ পথ আবিষ্কার করেছে। তার মধ্যে দুটি পন্থা উৎকৃষ্ট। জাহাজে করে দরিয়ায় দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে নব নব যৌনাভিজ্ঞতানন্দ সঞ্চয় অত্যুত্তম বটে, কিন্তু যদি অত্যধিক, সহ্যাতীত উৎকট উৎঙ্খলতার দরুন সঙ্কট দেখা দেয়– যদিও এস্থলে পরিষ্কার বলে রাখা ভালো, এসব টুরিস্ট জাহাজের অধিকাংশই ইহভুবনে সর্বজনবিদিত, সমর্থিত জলচর সোনাগাছি–সোনাগাছিকে অপমান করা এ পুস্তকের উদ্দেশ্য নয়– তখন কাপ্তেনের আদেশে কাট, আউট কেবিনে রুদ্ধাবস্থা থেকে সে রমণী মুক্তি পায় কী প্রকারে? অথচ প্রতি রাত্রে কোটিপতিনীর অসহ্য প্রয়োজন একটা তাগড়া জোয়ানের, কোনও কোনও স্থলে একাধিক। কথিত আছে, রাশার জারিনা কাতেরিনার জন্য প্রতিদিন নিত্যনতুন গার্ড অব অনার উপস্থিত রাখা হত, নিত্য নবীন বলিষ্ঠ প্রিয়দর্শন আর্মি-অফিসার দ্বারা নির্মিত। মহারানি ফাইলের সম্মুখ দিয়ে ধীরপদে যেতে যেতে যাকে সে-সন্ধ্যার নৰ্মসখারূপে উৎকৃষ্ট মনে হত তার দিকে এক মুহূর্তের শতাংশেক মাত্র চোখের একটি ঝলক বুলিয়ে দিতেন। মহারানির সহচর বয়স্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ক্ষুরধার অসিকে এক কটাক্ষে দ্বিখণ্ডিত করতে পারত। মানুষ মাত্রেরই ভ্রান্তি হয় এ প্রবাদটি বক্ষ্যমাণ বয়স্যের ক্ষেত্রে নিতান্ত অপ্রযোজ্য। যমরাজ সম্বন্ধে সুপ্রচলিত গল্পটির ট্র্যাজেডি অব এরর তিনি কুত্রাপি কদাচ ঘটাতে দেননি কিংবদন্তি সে-বিষয়ে সবিশেষ সোচ্চার।
কিন্তু মার্কিন কোটিধারিণীরা যা-ই করুন না কেন, জারের আর্মি অফিসারদের মতো বিশ্ববাছাই সুদর্শন যুবক সংগ্রহ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ জারের আর্মিতে বা রাজদরবারে প্রবেশ করার গৌরব তথা অর্থলাভার্থে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে বাছাই বাছাই সুদর্শন, দুঃসাহসী, দ্ৰাচরণসম্পন্ন যুবক আসত সেন্ট পিটারসবুর্গে, মস্কোতে। রুশের কালিদাস কবিসম্রাট পুশকিন্-এর মাতামহ মূলত ছিলেন আবিসিনিয়ার হাবশি– পিটার দি গ্রেটের ফৌজে তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আজ কি নিকসন, কি মাও সে তুং এ সম্মেলন করতে অক্ষম। ন্যাশনালিটি তার বিষফল পাসপোর্ট স্বদেশে আপন নাগরিকতা না হারিয়ে ভিন্ন দেশের ফৌজে ঢোকা আজকাল প্রায় অসম্ভব। শ্রীসুভাষের ফৌজ হিটলার বা মিকাডো-ফৌজের অঙ্গরূপে শপথ নেয়নি। এ তত্ত্বটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি, কারণ বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পূর্বে ও পরে এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
অতএব মার্কিন কোটিধারিণীরা বিশ্বপরিক্রমায় বেরোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সভ্য অসভ্য নানা সৌন্দর্য উপভোগ করতে। হিল স্টেশনে অর্ধসভ্য, পূর্ণ অসভ্য সর্বশ্রেণির মানুষ সুলভ। এঁদের অনেকেই অতিসভ্য ককটেল, মাত্রাধিক মার্জিত পুরুষসঙ্গ, সর্বাধুনিক নৃত্য অত্যধিক উপভোগ করার ফলে এ সবের তরে সোয়াদ রুচি হারিয়ে ফেলেন। তারা তখন বেরোন প্রকৃতির সন্ধানে। সভ্যতা দ্বারা অকলুষিত তরুণ-তরুণীর সন্ধানে যারা পূর্ণিমা রাতে গাঁয়ের ছোট্ট নদীটির পারে পারে বাঁশি বাজিয়ে প্রিয়াকে জানায় আহ্বান, প্রকৃতিদত্ত তার দেহটি মনুষ্যনির্মিত কোনও উপাদান দ্বারা কলঙ্কিত না করে তরুণী নিমজ্জিত করে আছে তার দেহবল্লরীটি ঝরনাধারার স্বপ্নমগ্ন বালুচরের উপর। পূর্ণচন্দ্রের উজ্জ্বল রৌপ্যালোক তার ঘনকৃষ্ণ চিকূণ মসৃণ চর্মে বার বার আঘাত হেনে চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
হিল স্টেশনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ : সমস্ত রাত ধরে পাহাড়িদের সঙ্গে নৃত্যগীতে টুরিস্ট মগ্ন হলেন, লুকোচুরি খেললেন, সমতলভূমি হলে ছোট্ট নদীটিতে জলকেলি করলেন, ওদের হোম মেড় বিয়ারে ধক্ অত্যল্প বলে বে-এক্তেয়ার হলেন না, ওদের আচার-ব্যবহার কায়দা-কেতায় খাপ খাইয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারলে ওরাই অতিথির (ঠিক শব্দ নয়, যেন ভিন্ গায়ের জাতভাই) নিঃসঙ্গতা সইবে না, গা ঘেঁষে বসে এমন এক বলা-না-বলার ভাষায় ভাবের আদান প্রদান করবে, আভাসে ইঙ্গিতে মৃদুহাস্যে লজ্জাবনত নয়নে কতনা না-বলা-বাণী দিয়ে ভিনদেশিকে সম্পূর্ণ আপন করে নেবে। সখীরা কখনও কাছে এসে, কখনও দূরের থেকে সাহসিকাকে গানে-গীতে সঙ্গ দেবে, আর কখনও-বা অশরীরিণীর মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।… পক্ষান্তরে তাঁতের ঘরে বলদ ঢোকার মতো রামপেঁচা গাড়লস্য গাড়ল কোনও কোনও টুরিস্ট ইডিয়টের মতো বেমক্কা জেব থেকে নোটের তাড়া বের করে সঙ্গিনীর হাতে ঠাস করে চড় খেয়েছে এ হেন বিপর্যয়ও অবিদিত নয়। এবং মাঝে-মধ্যে শ্রাদ্ধারম্ভ হয় সেখানেই। পরের দিন পাহাড়ি বেয়ারাদের ঠোঁট-কাটা-কোনও-একজন কাহিনীটি কীর্তন করে অন্য বেয়ারাদের কাছে এবং ক্রমে ক্রমে সেটা লেফাফা-দুরস্ত ক্লাবেও পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে মাঝদরিয়ার জাহাজ থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? হিল স্টেশনের সেই তো সুবিধে। চলে যাও অন্য কোনও স্টেশনে। বেটার লাক নেক্সট টাইম এট নেক্সট প্লেস, ওল্ড বয়, ও রভোয়া। রাত তো কাটল প্রকৃতির অকলুষ বাতাবরণে আনন্দঘন চৈতন্য থেকে চৈতন্যান্তরে।
দুপুরে টুরিস্ট ফের সভ্যতার উচ্চতম শিখায় আরোহণ করবে, অর্থাৎ ঝকঝকে চকচকে উচ্চ দণ্ডাসনে বসবে পেতল, স্টেনলেসের বার-এর সম্মুখে। বার-এর থাকে। থাকে স্ফটিক পাত্রে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নানা বর্ণের রশিচ্ছটা। বার-মেড় হেথায় মেড় অব্ লিপস্টিক, রুজ, ম্যাসকারা মাখানো আঁখিপল্লব; ভুরুর স্থলে দুটি বঙ্কিম রেখা যেন অনঙ্গ বিহঙ্গ এই এক্ষুনি দুটি বিস্তৃত পক্ষ সামান্যতম কম্পন লাগাতে না লাগাতেই বিলীন হয়ে যাবে দিকচক্রবালে। মাথায় প্রতিদিন নিত্য নবীন কবরী। কভু-বা বাবুই পাখির বাসা, কভু-বা ব্রোন্টের আঁকা বিদেশি সদাগরের পাগড়ি-পরা, কভু-বা মুণ্ডুটা যেন আস্ত একটা টি-পট– তার উপরে বসিয়ে দিয়েছে ভুটানি টি-কোজি।
উত্তম উত্তম পানীয়। দূর থেকে ভেসে আসছে বিলিতি বাদ্যির বাজনা। দু চক্কর শটিশে বা পেনশনারদের মতো মন্থরগতিতে সম্মুখপানে মর্নিং ওয়াক, মন্থরতর গতিতে প্রত্যাবর্তন– ল্যামবে ওয়াক।
কিন্তু বেচারী জিমি সভ্যতার এ প্যাটার্নের সঙ্গে নিজেকে কখনও খাপ খাওয়াতে পারেনি। চা বাগিচার রদ্দি থার্ড ক্লাস ইংরেজও যে ভিতরে ভিতরে তাকে অ্যাংলো বলে তাচ্ছিল্য করে সে সেটা আট বছর বয়সে প্রথম স্কুলে গিয়েই টের পেয়েছে, পরে অপমানিত বোধ করেছে, এখন অনেকটা সয়ে গিয়েছে। কারণ বিজনেস ইজ বিজনেস, খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করতেই হবে, হোক সে পাড় মাতাল, লম্পট ইংরেজ, হন তিনি মার্কিন লক্ষ ডলারের মালিক।
সেইখানেই তো সঙ্কট। সে বড় হয়েছে তার কট্টর পুরিটান পিতার হাতে। তার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না যে, হোটেল বার-এ যে সভ্যতার প্যাটার্ন বিরাজ করে সেটা খ্রিস্টানদের কলঙ্ক। কারণ এসব নারকীয় উচ্ছঙ্খলতা এদেশে প্রবর্তন করে ইংরেজ এবং তারা খ্রিস্টান।
তদুপরি জিমির চেহারাটি যেমন মধুর হাসলে দু পাটি দাঁত ঝলমলিয়ে ওঠে শরীরটাও তেমনি দড় মজবুত। সুন্দুমাত্র তার কব্জি কতটা চওড়া একবার তাকিয়ে দেখলেই হয়, বুকের পাটা থাক্। মার্কিন টুরিস্টিনীদের কেউ কেউ সর্বভুক, দূরের অনেককে নিকটতম বন্ধুরূপে পেতে চান। ঠেকাবে কী, কে? ডলার নেই?
একথা সত্য যে ম্যানেজার, প্রোপ্রাইটারের ইচ্ছা এটা নয় যে জিমি অনিচ্ছায় হোটেলের বেসরকারি জিগোলো–পুং বেশ্যা–রূপে মার্কিন মহিলাদের সঙ্গ দিক। অবশ্য এটাও সত্য, ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে গেলে হোটেলের কিছুটা বদনাম হবে। সেটা তাদের স্বার্থবিরুদ্ধ। পক্ষান্তরে জিমির অনমনীয়তায় ক্রুদ্ধ হয়ে কোনও মার্কিন যদি পরদিন জিমির বিরুদ্ধে উল্টোপাল্টা অভিযোগ আনেন সেটাও হোটেলের সুখ্যাতিকে ক্লিষ্ট করে আর জিমির পক্ষে ভয়াবহ সঙ্কট।
হোটেল-ম্যানেজারকুল উকিল ডাক্তারের চেয়েও বহুদর্শী। ম্যানেজার জানে অভিযোগ মিথ্যা।
তাই এহেন উভয়সঙ্কট ম্যানেজার মাত্রেরই মুখে মাত্র একটি বুলি, ট্যাট, জিমি, ট্যাফ্ট। একটুখানি ট্যাক্ট দিয়ে ম্যানেজ করো না কেন? তোমার কী দরকার, জানো, জিমি? আরেক আউন্স্ ট্যাক।
ব্যাপারটা ট্যাকটের সীমা ত্রিসীমানার ওপারে সেটা জিমি সবিস্তর বুঝিয়ে বলেনি ককখনও। তার যথেষ্ট ট্যাকট আছে বলেই সে জানে, বলাটা হবে ট্যাকটলেস। ম্যানেজারকে আহাম্মুক বানিয়ে তার লাভ? সব জেনে বুঝেও তাঁর আত্মসম্মানে লাগবে চোট। তাই সেটা হবে মোক্ষম ট্যাকটলেস। হুঁ: ট্যাকট? হিটলারকে বললেই হত, একটুখানি ট্যাকট খর্চা করলেই তো স্তালিনগ্রাদের লড়াইটা জিততে পারতে!
এবং ম্যানেজার সেটাও বুঝতে পারত, দু তিন দিন পরে অকারণ তার পিঠ চাপড়ে বলত, উয়েল, জিমি, জীবনটা কীরকম? হাও ইজ লাইফ?
.
এই হোটেলের চাকরিতে জিমির এরকম অভিজ্ঞতা পূর্বে কখনও হয়নি।
চাকরির দৈনন্দিন জীবনে আপিসে হোটেলে দোকানে চাকুরের ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ আছেই। এই যে ম্যানেজার অ্যাব্বড়া তনখা পায় তাকেও তো জাতাকলের ভিতর দিয়ে যেতে হয় প্রতিদিন। তবে হ্যাঁ, কারও কলটা বড্ড ভারী, কারওটা অপেক্ষাকৃত হালকা।
এরকম ধারা রাত এগারোটায় তাকে এতদিন কোনও টুরিস্ট দুটো গেলাসসহ আহ্বান জানানো মাত্রই বস্তুত জানানোর পূর্বেই সে গোঁফ দেখতে পেত জানানোর পর শিকারি-বিড়ালসুদ্ধ। ডিউটির সময় আমাদের ড্রিঙ্ক বারণ ৩২ নম্বর অপেক্ষা করছেন টোকিও থেকে একটা ট্রাঙ্ক-কল; আমাকেই কানেক্ট করতে হবে দুনিয়ার কুল্লে সত্য কারণ, মিথ্যে অজুহাত, দুটোর ককটেল অছিলা– এটা অবশ্য এখনও পরখ করে নেয়নি–আবহাওয়া দপ্তর এখখুনি খবর দিয়েছে, কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা দশে আমাদের হোটেলে দারুণ ভূমিকম্প হবে। সেটা সামলে নিয়ে, এই এলুম বলে, ম্যাডাম। প্রায় সবকটাই এস্তেমাল করেছে জিমি এখন তার রেস্তো তলানিতে খতম খতম করছে– এক কড়ির ফায়দা ওঠাতে পারেনি।
আজ এই তার জীবনে সর্বপ্রথম দুটো গেলাস সে নির্ভয়ে– না, নির্ভয়ে নয় বড় তৃপ্তি আর আশা পূরণের দৃঢ় আশ্বাস নিয়ে এসেছে। ডিউটিতে, বাইরে, বাড়িতে না, বাড়ি বলতে হতভাগার প্রায় কিছুই নেই, গৃহে মাতা নাস্তি এমনকি অপ্রিয়বাদিনী ভার্যা চ নেই তার জীবন বৈচিত্র্যহীন। প্রত্যেকটি দিন যেন অন্তহীন একটা মালগাড়ির ওয়াগন– সবকটা হুবহু একই ঢঙ একই বহরের। জন্মমুহূর্তে এঞ্জিনটা চলে গেছে পশ্চিম দিকে অস্তাচলের দেশে, এখন সে দেখছে, রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ওয়াগনের পর ওয়াগন চলেছে তো চলেছেই। অবশ্য কোনওটার রঙ-চটা, কোনওটা ডাইনে-বাঁয়ে দুলছে, কোনওটা-বা ঝাঁ চকচকে সদ্য বার্নিশ পালিশ করা। কিন্তু এ মালগাড়ির শেষ কোথায়? পূর্বাচলের দিকে তাকিয়ে দেখে গাড়ির শেষান্ত সেখানে বিলীন, ফের অস্তাচলের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রারম্ভাংশও সেখানে অদৃশ্য।
কী মহিমান্বিত, কী ডিগনিফাইড এই সুন্দরী। সামান্যতম অস্বস্তির চিহ্নমাত্র নেই তাঁর প্রশান্ত মুখচ্ছবিতে। আর কী সহজ সুরে বললেন, তোমাকে আমার বড় ভালো লেগেছে, জিমি। তোমার মুখটা খাঁটি মাদারস ডার্লিঙের মতো, কিন্তু দেহটা বাই অল দাট ইজ হোলি– কী মজবুত, ম্যাগনাম সাইজের হাড় দিয়ে তৈরি।… শোনো, তোমাকে ডেকে আনলুম, সেলিব্রেট করতে। স্টেশনটার কী নাম ধরতে পারিনি। বলল, রাশা নাকি অতি দৃঢ় ভাষায় ইয়েহিয়াকে বলেছে, রক্তারক্তি বন্ধ করতে। আমার মনটা যেন নাচছে।… কই তুমি খাচ্ছ না কেন? আমি কিন্তু, ভাই, কিছু মনে করো না, এক গেলাসের বেশি খাইনে। তুমি নির্ভয়ে খেয়ে যাও। বানচাল হবার বহু আগেই তোমার একটা চুলের অ্যাটুন কাঁপন দেখেই তোমাকে থামিয়ে দেব।
জিমি মনে মনে বললে, সে আবার বলতে! আস্ত বোতল গেলার মতো চিজ ইনি নন। গেলাসটা নাক অবধি তুলে ধরে একটু বাও করে বলল, আমাদের ভিতর সক্কলেই কোনও না কোনও দিক দিয়ে পুব বাঙলার সঙ্গে বিজড়িত। আমার মুরুব্বি মিস্টার সেন– হেম সেন– সিলেটে তাঁর বেশকিছু টাকা পড়ে আছে। ভিসা পাননি সেখানে গিয়ে তদ্বির করার জন্য। শেষটায় আমি যাই, সিলেটের চা-বাগান ম্যানেজার এক ইংরেজকে পটিয়ে। বাগাতে পারলুম সামান্যই এক বেহারির বাচ্চা খামোখা দিল বাগড়া পদে পদে। ওই বিচ্ছুগুলোই বি ইন দি অয়েন্টমেন্ট। আর এটা তো নিশ্চয়ই শুনেছেন, কোন এক মেজর জিয়া আজ সকালে চাটগাঁ বেতারে পুব বাঙলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন? কিন্তু ম্যাডাম, আপনার আনন্দে আমি পুরোপুরি যোগ দিতে পারছিনে। আমার ট্রাঙ্ককলের বন্ধু ঘণ্টাটাক আগে আমাকে জানাল সেই সুন্দরবন অঞ্চলের হাসনাবাদে, পশ্চিমে পদ্ম পেরিয়ে উত্তর বাগডোগরা অঞ্চলে আর এই আমাদের দক্ষিণের সিলেট বর্ডার পেরিয়ে দুটি-পাঁচটি রেফুজি আসতে আরম্ভ করেছে, অলরেডি
আর শিলচর?
যে দু পাঁচটি ওই পুব বর্ডারে ক্র করেছে, তারা নিশ্চয়ই করিমগঞ্জেই আশ্রয় নেবে। আমি রেফুজি দেখেছি অনেক। ওদের শরীরে কি কিছু আছে যে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে দূর শিলচরে যাবে!
আমার বন্ধুরা তা হলে কাল না-ও আসতে পারে?
আপনার অনুমতি নিয়ে, কেন?
ওরা বোধহয় রিফুজিদের সাহায্য করতে চাইবে।
জিমি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আপনারা তো কলকাতার লোক। অপরাধ নেবেন না, আমি কিই-বা জানি। তবু বলি, সাহায্য করতে পারে কলকাতা আর দিল্লি। ড্যাডি আমাকে বলেছিল, চল্লিশের দশকে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তখন সবচেয়ে বেশি সাহায্য আসে কলকাতা থেকে। কিন্তু কলকাতার খাস বাসিন্দারা তো অনেক পরে জানতে পারবে, তা-ও আপন চোখে দেখে নয়, ওদের কী মরণ-বচন হাল। করিমগঞ্জ, শিলচরে ভলান্টিয়ারের অভাব হবে না, আমি শ্যোর। আপনার বন্ধুরা ইনফিনিটলি বেশি সাহায্য করতে পারবেন, কলকাতাতে চাল-ডাল, ওষুধপত্র এবং টাকা- ইয়েস্ টাকা জোগাড় করে। ওঁরা তো আগরতলা, করিমগঞ্জ, শিলচরে যথেষ্ট দেখেশুনে ওয়াকিফ হয়ে গিয়েছেন। ওঁরাই পারবেন কলকাতায় পাবলিক ওপিনিয়ন ফর্ম করতে। স্যরি, ম্যাডাম।
.
০৬.
এবারে আর কম্পন শিহরণ নয়। এবারে কেমন যেন আড়ষ্ট আড়ষ্ট ভাব। খান তাকে সোজা নিয়ে গিয়েছে পাশের কটেজে। খাটে শুইয়ে বলল, তুমি শিপ্রার সঙ্গে কথা কও তো, ভায়া। কিন্তু দোহাই আল্লার, সবটা বোলা না কেটে-হেঁটে। আমার এখনও পিলে চমকাচ্ছে। আমি চললুম জিমিকে শুধোতে লেটেস্টটা কী? ওর গায়ের প্রত্যেকটা লোম বেতার এনটেনা।
শিপ্রা বললে, জিমি এখন অফফ ডিউটি।
ওই আনন্দেই থাকো। আমি আসছি জেনেও সে অফ হবে! পিপিং পিটারকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। শেয়ানা ছোকরা, আমাদের ত্রিমূর্তি-মিলনে চতুর বলেই চতুরানন হতে চায়নি ওয়ান– নো টু, টু-মেনি হতে যাবে কেন?
শিপ্রা খুশি মনে খানের বকর বকর শুনছে : ততক্ষণে কীর্তি জিরিয়ে নিক, মনের জট ছাড়াক। বলল, আমার ঘরে একটা বেতার আছে। মিনিট দশেক পরেই বিবিসি খবর।
আমাদের ত্রি-মূর্তির ওই একটামাত্র কমন পয়েন্ট। বেতারাসক্তি কারওরই নেই। শুনেছি, লেবাননের আরব চাষা হাল চালাবার সময় বলদের শিঙে ট্রানজিস্টার ঝুলিয়ে বেলি ডানসের তালে তালে হেলে-দুলে এগুতে থাকে। বেতার বটতলার মাল। এখন অগত্যা শুনি। কপাল!
বলদটাও তালে তালে পা ফেলে তো? তা হলে নিশ্চিন্ত মনে নটের গুরুর কাছে দীক্ষা নাও। তোমার তো, জানি, দুটোই বাঁ পা।
নো, মাদাম, ভূতের হয়। আমার চারটে।… তা কী হবে, কও (বার-এর কোন মদ্য খাবের পরিভাষা)? কীর্তি হোয়াট ইজ ইওর পয়জন? তোমার সর্বাঙ্গে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। কড়া বিষ খাও। চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
শিপ্রা বললে, ব্র্যান্ডি অ্যান্ড চেসার-ই ভালো। আর আমার জন্য আলাদা করে পাঠিয়ো না। আমি ওরই থেকে এক-আধ চুমুক নেবোখন। খান অন্তর্ধান।
.
শিপ্রা ঝুঁকে নিচু হয়ে কীর্তির কানের লতিতে চুমো খেয়ে কানে কানে বলল, কাপড় ছাড়বে না, কীতা?
মিতা, এখন তুমিই আমার সব। আমি সব সয়ে নিয়ে সব করতে পারব। আমি হৃদয় দিয়ে বলছি, শিপি, আমার সব অবশতা কেটে গিয়েছে। আগরতলাতে আমি সত্যি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলুম, কিন্তু করিমগঞ্জে আমার বিভ্রান্তি অন্তর্ধান করল। দাঁড়াও বুঝিয়ে বলি; আগরতলাতে যেন শীতের ছায়া-ঢাকা দুপুরে হঠাৎ কে আমায় পিছন থেকে ধাক্কা মেরে হিম-শীতল জলে ফেলে দিল আর আমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অবশ। এমন সময় দেখি, ওপারে বুড়ো গোছের লোক দিব্য সাঁতার কেটে কেটে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। ইতোমধ্যে আমার হাত-পা নিজের থেকেই একটু-আধটু নড়াচড়া আরম্ভ করে দিয়েছে– রক্ত সঞ্চরণের প্রয়োজনবশত। আমি ভালো সাঁতার জানি, ডুবে মরতুম না নিশ্চয়ই। এবং অবশ্যই পত্র-পাঠ ফের ডাঙায় ফিরে আসতুম, কিন্তু ঠাণ্ডা জলের প্রতি বুড়োটার ওই ন্যক্কার-ভরা তাচ্ছিল্যে যেন আমার অজানতেই সর্বাঙ্গের জড়ত্ব ডাঙাশ মেরে তল্লাট-ছাড়া করে দিয়েছে। আম্মো ততক্ষণে পাই পাই করে মাঝ পুকুরে চক্কর মারছি আর ডুবসাঁতারে পুকুরের এপার-ওপারে মাকু চালাচ্ছি। করিমগঞ্জে গিয়ে সে-বুড়োটার কাহিনী শুনলুম। কিন্তু তুমি কি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলে? খবর গুজব যতই ছড়াচ্ছিল ততই তোমার কথা ভাবছিলুম।
শিপ্রা সদয় মুচকি হেসে বললে, প্রথমদিনটা বড় খারাপ গেল। দু কান বন্ধ করে রইলুম পাছে খবর গুজব শুনে ফেলি। তার পর কী যেন হল জানিনে। নিজে যেচে খান যে-জিমির কথা বলছিল তার কাছে গেলুম। ও-রকম ছেলে হয় না। সে-ই আমার রয়টার, টাস্ এবং মাতাহারি।
মাতাহারি? স্পাই?
ইনটেলিজেন্স্ ম্যান। আমি জানতুম না ট্রাঙ্ককল কর্মীদের ভিতর এত দোস্তি সমঝোতা থাকে। কোথায় জলপাইগুড়ি, কোথায় বনগাঁ শিলচর শিলঙ একে অন্যকে কখনও দেখেনি কিন্তু গলা চেনে নাম জানে। ওরা যে অনেক কথাবার্তা শুনতে পায় সে তো জানা কথা। জিমির এক বন্ধু ট্রাঙ্কে কাজ করে। সে ইভো-পাক বর্ডারের যত সব তাজা খবর জিমিকে জানাত। তাই জিমি আমার মাতাহারি x ১০০ = ০০
শেষটায় যখন শুনলুম ঢাকায় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে শয়তানের কারবার হেলেট লুস তখন সব ভয় কেটে গেল।
পড়ল পড়ল ওই তো ভয়
পড়ে গেলে সব-ই সয় ॥
কীর্তি বলল, কী আশ্চর্য! আমার বুড়োর কাহিনী ওই ট্রাঙ্ককল অপারেটার দোস্তি নিয়েই শুরু। ২৫ মার্চ বিকেলের দিকেই ঢাকার ট্রাঙ্ক কর্মীরা জেনে যায়, রাত্রেই আর্মি ক্র্যাক ডাউন ঢাকা, চাটগাঁ, আরও অনেক টাউনে একইসঙ্গে আরম্ভ হবে। আর্মির আপন বেতার, জোরালো ট্রানমিটার আছে, কিন্তু কাজের চাপ সামলে উঠতে না পারলে ওরা সাধারণ ট্রাঙ্কেরই শরণ নেয়। নিশ্চয়ই টাপেটোপে এবং পাঞ্জাবি ডায়লেটে ঢাকা থেকে অফিসাররা অন্যান্য শহরের অফিসারদের ইনস্ট্রাকশনস্ দিচ্ছিল ক্র্যাকডাউন সম্বন্ধে। কিন্তু ট্রাঙ্কের লোক আড়ি না পেতেও আপন কাজের খাতিরেই কয়েকটা চালু ভাষা বেশ শিখে ফেলে– আর পাঞ্জাবি তো তারা শোনে নিত্যি নিত্যি, সিভিল মিলিটারি দুই-ই।
আমি যে-বুড়োর বাহাদুরির কথা বলছিলুম, তিনি আদৌ বুড়ো নন। এমনকি প্রৌঢ়ও বলা চলে না। বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসারদের একজন মেজর। তিনি কী করে খবর পেলেন সিলেটের হবিগঞ্জ টাউনে বসে, ২৫-এর সন্ধ্যায় যে, আজ রাত্রেই শুরু হবে বোঝাঁপড়া? ট্রাঙ্ক কর্মীর কল্যাণে। অবশ্য অন্য মাধ্যমও হয়তো ছিল।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের একমাত্র বাঙালি হিন্দু অফিসার মেজর দত্ত তখন ছুটিতে, হবিগঞ্জ থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিঠি পাঠালেন, সেই রাত্রেই, লোক মারফত, খবর জানিয়ে; তিনি পরদিনই না-পাক্ খানদের খতম করার জন্য সিলেটের দিকে রওনা হবেন। দত্ত যোগ দেবেন কি?
দত্ত উত্তরে জানালেন, কাল ভোরেই তাঁর কাছে পৌঁছবেন।
কীর্তি অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। চোখ মেলে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে, যেন স্মরণে আনতে পারছে না, ভুলে-যাওয়া কোনওকিছু। মাঝে মাঝে তাকায় শিপ্রার চোখের গভীরে যেন সেখানেই পাবে রহস্যের সন্ধান। শেষটায় প্রত্যেকটি শব্দ, মনে হল যেন বাছাই করে করে ধীরে ধীরে বলল, শিপ্রা, আমার বিস্ময়ের অবধি নেই, অত্যাশ্চর্য অলৌকিক এরকম একটা ব্যাপার যে আদৌ সম্ভবে তারই সামনে আমি দিশেহারা, সৃষ্টিরহস্যের চেয়েও ঘনতর রহস্য যেন সৃষ্টির এক নগণ্য অংশ, ওই ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র হবিগঞ্জে– যার নাম তুমি-আমি কেউই কখনও শুনিনি, শুনতুমও না– অকস্মাৎ কুয়াশার যবনিকায় বৃহত্তম, খুদ সৃষ্টিরহস্যকে ঢেকে ফেলতে পারে, এ যে সর্ব তর্কশাস্ত্রে, ন্যায় মীমাংসাকে অর্থহীন করে দেয়; অংশ কি কখনও পূর্ণের চেয়ে বৃহত্তর হতে পারে। সিন্ধু-বিন্দু কি কখনও সিন্ধুর চেয়ে বিরাটতর কায়া ধারণ করতে পারে? ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় এই হবিগঞ্জের লোকটি কোন দুঃসাহসে একাই যুদ্ধঘোষণা করে দিল ইয়েহিয়া, তার ফৌজ এবং সবচেয়ে বাস্তব কঠিনতম শত্রু ওদের ট্যাঙ্ক, বমার প্লেন, সাঁজোয়া গাড়ি, বিরাট বিরাট কামানের বিরুদ্ধে? লোকটা তো গলির আধ-পাগলা পুচকে ছোঁড়াটার মতো নয়, যে নিত্যি নিত্যি রাস্তায় রাস্তায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্তালিন হিটলার মা কালী মৌলা আলির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ঘোষণা করে। দুজনার কাছ থেকে আমি ওর কথা শুনলুম। দুজনাই একমত : লোকটা অতিশয় শান্ত প্রকৃতির, স্থির ধীর। তার দুর্দমনীয় চঞ্চলতা প্রকাশ পায় সুন্দুমাত্র তার ঘন ঘন ঠা ঠা উচ্চহাস্যে– যেন সে সর্বক্ষণ তক্কে তক্কে আছে ঠা ঠা করার সুযোগের তরে।… মেজর সে। সে কি জানে না, ইয়েহিয়ার শক্তি কতখানি? পুব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে সৈন্যসংখ্যা কত, কোন কোন শহরে আছে ক্যান্টনমেন্ট, ট্যাঙ্ক বোমারু জঙ্গিবিমান সংখ্যা সব– সব তার নখদর্পণে, সে যে তাদেরই একজন; সে জানবে না? সব জেনেশুনে সে হয়ে পড়ল একা, একান্ত একা ছিটকে পড়ল সেই সর্বগ্রাসী অসংখ্যের মাঝ থেকে? যেন গ্রহচ্যুত নক্ষত্রের মতো ক্ষিপ্ত বেগে অদৃশ্য অজানার পানে ধেয়ে ধেয়ে জ্বলে পুড়ে ছাই-ভস্ম খাকধুলোতে–না– নিঃশেষ নাস্তিতে পরিণত হতে?
কোন মামদো-পিশাচ চাপল তার স্কন্ধে যে হঠাৎ উদোম ভূতের নৃত্য আরম্ভ করে দিল সে!
জানো শিপ্রা, বরিশালের খাজা বাঙাল আমার এক ক্লাসফ্রেন্ড বিপদে পড়লেই, মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করত,
কী কল পাতাইছ তুমি?
বিনা বাইদ্দে নাচি আমি।
হ্যাঁ, এ ভূতের বাদ্যের সঙ্গতও নেই। কোথায় মৃদঙ্গ, জগঝম্প, ঢক্কা-ডিড্ডিম? এমনকি একটা বাঁশের বাঁশি– অর্থাৎ একটা রাইফেলও নেই কারও কাছে।
বললুম না, অজানা অদৃশ্যের উদ্দেশে?
শেখ সায়েব, আওয়ামী লীগের নেতারা সব কোথায় কে জানে?
কোনওপ্রকারের নির্দেশ মেজর পাননি। ইনি যে পদক্ষেপ করলেন সেটা পরে ওঁদের সম্মতি পাবে কি যদি, অবশ্য, তাঁরা স্বয়ং কোনও নিরাপদ আশ্রয় পান।
বরিশাল-খুলনা থেকে সিলেট, কক্সবাজার থেকে দিনাজপুর এই বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে এমন কোনও সংযোগ ব্যবস্থা নেই যে, সংবাদ আদান-প্রদান মারফত ইয়েহিয়ার বর্বরতার ফলে কোন জায়গায় কী প্রকারের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল সে-সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হওয়া যায়।
তিন শ্রেণির বাঙালি রাইফেলটা অন্তত চালাতে পারে
(ক) বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব অফিসার সেপাই বাঙালি
(খ) আধা-মিলিটারি বেঙ্গল রাইফেলস
(গ) পুলিশের বেশকিছু সংখ্যা
এরা কি মেজরের পন্থা অবলম্বন করবে? যদি না করে তবে যেসব কিশোর-যুবক তাঁর চতুর্দিকে জড়ো হবে, রাইফেল চালানোর ওই যৎসামান্য ট্রেনিংটুকুই-বা ওদের দেবে কে?
এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, উপর থেকে নির্দেশ না-পাওয়া সত্ত্বেও গ্রামের লোক সাড়া দেবে কি?
কীর্তি দম নিয়ে বললে, এরকম দফে দফে প্রশ্নের সংখ্যা অগুনতি। মোদ্দা কথা : অর্গেনাইজেশন নেই, নির্দেশ নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই।
আমার লেটেস্ট খবর দুই মেজর কয়েকশো রাইফেল নিয়ে এগুচ্ছেন শ্রীমঙ্গলের দিকে। সেখানে নাকি একঝাঁক খান রয়েছে।
তার পর কাল ২৭ মার্চ চাটগাঁ থেকে আমাদের এই মেজরেরই মতো সমস্ত দায়িত্ব আপন স্কন্ধে নিয়ে মেজর জিয়া স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা করেছেন, চাটগাঁ বেতার মারফত। এখন দেখা যাক বাদবাকি দেশটা কীভাবে সাড়া দেয়।
শিপ্রা বলল, তুমি যেসব সমস্যার অসম্পূর্ণ ফিরিস্তি দিলে ঠিক ওইগুলোই নিয়ে মেজর বিব্রত হয়েছেন, এমনতরো না-ও হতে পারে। যারা তোমাকে বিবরণ দিয়েছে তারা পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে তাদের যুক্তি বুদ্ধি অনুযায়ী এসব প্রশ্ন তুলেছে। এই সমস্যাগুলোকে মেজরকে বিব্রত করুক আর না-ই করুক, তাঁর অন্য সমস্যা থাক আর না-ই থাক, প্রশ্নগুলোর কিন্তু একটা বাস্তব মূল্য আছে। এগুলোতে প্রতিবিম্বিত হয়েছে, অন্তত হবিগঞ্জ অঞ্চলের সাধারণ জনের চিন্তাধারা, মনের অবস্থা। আমাদের কাছে তার মূল্য প্রচুর।
কীর্তি মুগ্ধ হয়ে বললে, মিতা, আমি কি বৃথাই বলি তুমি তুলনাহীনা। আমি শুধু সমস্যা আর প্রশ্নগুলোকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম, তোমার অন্তর্দৃষ্টি গিয়েছে সেগুলোর পটভূমির দিকে তীক্ষ্ণতম ক্ষুরধার নিয়ে।… বেচারী রবি কবি! তাঁকে যেতে হয়েছিল তুলনাহীনার সন্ধানে সাতসমুদ্র পেরিয়ে আর্জেনটিনা না কোথায় যেন।
সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে
দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।
আর আমি কী অবিশ্বাস্য ভাগ্যবান।
শিপ্রা হেসে বললে, আর আমি যদি বলি, আমি ভাগ্যবান, আমিও দেখেছি সমুদ্র না পেরিয়ে–
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।
এমন সময় ঘরটাকে দাপটে খান খান করে খান সাহেবের প্রবেশ।
গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললে, মদ্যাদি যখন আরেক কদম এগুলেই সম্পূর্ণ বর্জন করে ফেলবে। তখন মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে নাও না, এই বেলাই? আমার মতো সরু পাবে না। খুদ আরব মুলুকেও না। পাকি একটা ঘণ্টা আমি বেতারযন্ত্রটার কান মলে মলে, বিবিসি কলোন ভিয়েনা ছুঁ মারার সঙ্গে সঙ্গে সাপটে দিলুম আধা বোতল গর্ডন। আর হেথায় হেরি, ফুলবাবু মশাই আর পটের বিবিটি কড়ে আঙুল পরিমাণ গেলাসটি শেষ করতে পারেননি। একেই কি বলে সভ্যতা? হায় শ্রীমধু!… শোনো আমি এসেছি তোমাদের বাইরে নিয়ে যেতে। সত্যি বলছি এরকম বন্ধ ঘরের অবশ বাতাসে গুজুর গুজুর করতে তোমাদের গুজুর গুজুরের উদ্দেশ্যই সফল হবে না। মুক্তি সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে হলে চাই মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস। আরেকটা তত্ত্বকথা বলি, তোমরা মদ ছেড়ে দিলেই বাঙালিরা রাতারাতি পাঞ্জাবিদের হাইকোর্ট দেখাতে পারবে না, আর মাত্রা বাড়ালেও লীগ তাদের আশা ভরসা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে না। অ্যাব্বড়া যুদ্ধটা যখন চার্চিল চালালো সে কি তখন নির্জলা উপবাস করেছিল? হ্যাঁ, নির্জলা অতি অবশ্য বটে; নির্জলা হুইস্কি ওই সময়েই মাঝে-মধ্যে সে টেনেছিল। রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না? তৈরি হও এখখুনি।
ঘর থেকে বেরুতেই দেখে জিমি দাঁড়িয়ে আছে।
খান তার গতানুগতিক সম্ভাষণ করার পূর্বেই জিমি নিচু গলায় বললে, সব কথা বলতে গেলে এখানে দাঁড়িয়ে হয় না। কাল একজন নতুন গেস্ট এসেছে হোটেলে। আমাকে অ্যাংলো জেনে ড্রিংক অফার করল, দোস্তি জমাবার তরে। তার ইংরেজি উচ্চারণ থেকে হানড্রেড পার্সেন্ট শ্যোর লোকটা পাঞ্জাবি। কিন্তু কোন পাঞ্জাবের? অথচ হোটেলের খাতাতে লিখেছে, মিরাট। আমার কীরকম যেন ধোকা লাগছে। কারণটা হয়তো আপনার কাছে এপিল করবে না, তবু বলি। লোকটা যদি আর পাঁচটা টুরিস্টের মতো আমাকে সোজাসুজি শুধাত, ইন্ডো-পাক বর্ডার কতদূরে, কদুর অবধি যাওয়া যায়, রেফুজিরা ভিড় লাগায়নি তো রাস্তায়, তা হলে আমার মনে ধোকা লাগত না। দিস জনি সোজা পথ না ধরে বিস্তর বিটিং এবাউট দি বুশ করে করে পৌঁছল চেরাপুঞ্জিতে– কী তার আগ্রহ, কত বৃষ্টিপাত, বছরে কদিন বৃষ্টি হয়, আর যত সব রাবিশ প্রশ্ন। তার পরও বর্ডারের পথ ধরল না। ফের আশ-কথা পাশ-কথা। তার পর এল বর্ডারের টপিক। আমি ইচ্ছা করেই ভাসা ভাসা উত্তর দিতে লাগলুম। কখনও-বা রহস্যময় উত্তর ফিসফিস করে। স্পষ্ট দেখলুম তার ক্যোরিসিটি দারুণ উত্তেজিত হয়েছে। মুখোশ খসে গেছে। হুস হুস করে একটার পর একটা প্রশ্ন শুধাতে লাগল। মাঝেসাঝে বাজে প্রশ্নের ভেজাল দিয়ে আসল উদ্দেশ্য কামুক্লাজ করতে ভুলে গিয়েছে। তার প্রশ্নের রকমারি থেকে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম ব্যাটা এখানে আসার আগেই সবকিছুর সন্ধান নিয়ে এসেছে। এখন শুধু লেটেস্ট অবস্থাটা জানতে চায়।
আরেকটা কথা : এখানে নেবেই চেল্লাচেল্লি, পথে তার ট্রানজিস্টার খোয়া গিয়েছে। মুজিক ভিন্ন সে দু দণ্ড বাঁচতে পারে না। আকে সক্কলের পয়লাই শুধাল, এখানে ট্রানজিসটার পাওয়া যাবে তো, দোকান কোথায়? ছুটল টি না খেয়েই। সঙ্গে সঙ্গে আমি বড়য়াকে ফোনে আমার সন্দেহের কথা জানালুম। বড়য়া তো একদম শ্যোর, লোকটা ওয়েস্ট পাঞ্জাবের। এবারে শুনুন মজাটা। যতবার আমি তার কামরার বারান্দা দিয়ে গিয়েছি কান পেতে শুনেছি, নো, নো, নো মুজিক এটোল। লো ভলুমে শুনছে নজ। এনি উয়ে, টক্। মুজিক ককখনও না।
আজ আমাকে শুধাচ্ছিল, অত উঁচু অ্যারিয়েল কার? তবে কি বেতারকর্মী? তবে
হঠাৎ জিমি থেমে গেল। বললে, ওই আসছে চিড়িয়াটি। আপনি পরিচয় না করতে চাইলে, স্যার কেটে পড়ন। ও সক্কলের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চায়। দু একবার স্নাবড়ও হয়েছে। অভ্যাস বদলায়নি।
চিড়িয়া এসেই অতিশয় যৎকিঞ্চিৎ বিরক্তির সুরে বললেন, বাজে ট্রানজিসটার। আচ্ছা, ওই মি. বড়য়া, সে এটার দাম কেটে একটা পুরো পাক্কা রেডিয়ো সেট দেবে না, ওইরকম স্কাই হাই এরিয়েলসহ?
আমার তো মনে হয় না, মি. কুরেশি। (বাজে কথা। কিন্তু জিমি বড়ুয়ার স্বার্থ দেখছে)
কেন? হোটেল বলতে পারে না, আমি রেসপেকটেবল গেস্ট? ওর মেশিন বিগড়োইনি।
আমি পাতি রিসেপশনিস্ট। বরঞ্চ ম্যানেজার পারেন। (জিমি জানে, বেটা আখেরে বড় রেডিয়ো কিনবেই।)
খান মাঝখানে নাক গলিয়ে বললে, আপনাদের কথার মাঝখানে বাটু ইন করছি বলে অপরাধ নেবেন না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি টুরিস্ট। হেথা হোথা ঘুরে বেড়াবেন। ট্রানজিসটারটা কাজে লাগবে আজকাল প্রতি বুলেটিনে গরম গরম খবর দিচ্ছে। আর বাড়ির বড় সেটটা দিয়ে শুনবেন রাত্রে ফরেন, দুবলা স্টেশন।
চিড়িয়া সোৎসাহে খানের সঙ্গে জোর ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যান্ডশেক করে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলুম। আমার নাম রহমান কুরেশি
জিমি বিস্মিত হল, খান তখখুনি নিজের পরিচয় দিল না কেন– যেটা স্বাভাবিক এটিকেট।
খান তখন কুরেশিকে বলছে, বা শ্যোরলি আই মেট ইউ এট লাহোর, প্রেসক্লাবে– এই ফেব্রুয়ারি, না জানুয়ারিতে অর্থাৎ হাইজ্যাকিঙের আগে। আপনার গলায় ছিল ভারি মজার একটা টাই।
এক মিলিমিটারের শতাংশের এক অংশ টাক লোকটা যেন বেসামাল হল। একটু জোর গলায় বললে, অসম্ভব। আমি কখনও পাকিস্তান যাইনি। আরও সামান্য গলা চড়িয়ে আমি ইন্ডিয়ার সিটজেন বাই বার্থ। উত্তরপ্রদেশ।
খান প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, আই এম স্যরি, অত্যন্ত দুঃখিত…, অতঃপর তার এক্কেবারে নিজস্ব উর্দুতে–বেয়াদবি মাফ করেংগাহৈ।
কুরেশি উর্দুতে তুফান তুলে টর্নেডোতে পৌঁছবার পূর্বেই খান ইংরেজিতে ফিরে গিয়ে বলল, আমি উর্দু জানি না তাই বলে কি কোনটা লক্ষ্ণৌয়ের উর্দু আর কোনটা লাহোরের উর্দু তার তফাত জানিনে! আমি মুগ্ম মুসল্লম বানাতে জানিনে, তাই বলে কোনটা সুখাদ্য হয়েছে আর কোনটা রদ্দি তা-ও জানিনে! লাহোরের কারও মুখে এমনকি স্যার ইকবালের ভাতিজার মুখেও এমন চোস্ত উর্দু শুনিনি।
থ্যাঙ্কু, খুদা হাফিজ বলে কুরেশি ঈষৎদ্রুতপদেই স্থান ত্যাগ করলেন। জিমি একটু গলা চড়িয়ে বললে, আমি কি বড়ুয়াকে ফোন করব আপনার ট্রানজিসটার বিষয়ে?
কুরেশি শুনেও শুনল না।
.
খান একরকম জোর করে দুই ইয়ারকে নিয়ে গেল মরেলল্লাতে। বললে, এ দোকানের প্রতিষ্ঠাতা আমাদের বেয়াত্রিচের দেশ-ভাই, কিন্তু আভিজাত্যে বেয়াত্রিচের হেঁটোর বয়সী। মানুষের হাতে তৈরি অপ্রাকৃতিক লোকটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শিপ্রার খুবই পছন্দ হল। এমপরিয়ামে যদিও শিপ্রা গেল অনিচ্ছায় তবু আসামের পাত সিল্ক জীবনে সে এই দেখল প্রথম। খান শব্দতত্ত্ব ঝেড়ে বলল, আমার চেয়েও যারা অগা তারা বলে পট্টবস্ত্র– সিল্ক- পাট থেকে তৈরি হয়। আমার মনে হয় এই পাত শব্দটা অনেক অহমিয়া পাট উচ্চারণ করে বলে ওটার শুদ্ধি করে পণ্ডিতেরা ওর নাম পট্টবস্ত্র দিয়েছেন।
বড়বাজারও দেখাল খান, বললে, এই দেখ, মাতৃক সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ! তাবৎ দোকানিই খাসিয়া মেয়েছেলে। ব্যাটাছেলেগুলো বিড়ি ফোঁকে, জুয়ো খেলে আর প্রতি সন্ধ্যায় মদ খেয়ে মাতলামো করে, বউয়ের পয়সায়। তবে হ্যাঁ, বউ যদি কোনও ইয়ারের সঙ্গে রাত্রিবাস করে আসে– কত পার্সেন্ট করে জানিনে, আমার অতি সোহাগের খাসিয়া মেয়েদের সম্বন্ধে আমি অপ্রিয় কোনও কথা বলতে চাইনে– তবে স্বামীটির টু ফাঁ করার সামাজিক হক্ক নেই। অত্যুত্তম ব্যবস্থা।
শিপ্রা বললে, স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক বাবদে আজ পর্যন্ত কোনও সামাজিক ব্যবস্থারই প্রশংসা তো করা যায়ই না, গুণী-জ্ঞানীরা স্বীকৃতি পর্যন্ত দেননি। তাই বিশ্বজনের মতে পৃথিবীতে মাত্র যে একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রবাদ আছে সেটি বিবাহ একমাত্র জুয়োর বাজি খেলা (গ্যামলিং) যাতে দু পক্ষই হেরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যুধিষ্ঠির তো জুয়ো খেলায় সর্বস্ব হারালেন। এর পর তার জুয়ো খেলা বন্ধ– বাজি ধরার স্টেক একটা কানাকড়িও নেই। দুর্যোধন ছোকরা চালাক। সে দিয়ে দিল দ্রৌপদীকে ফেরত– সব জুয়ো যখন বন্ধ তখন চলুক ওই মোক্ষম জুয়োটি, যেখানে দুই পক্ষই হারে। এখানে একদিকে একজন দ্রৌপদী, অন্যদিকে পাঁচজন।
খান শুধল, পাঁচজন কেন? আমি তো শুনেছি, তিনি অর্জুনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, যে কারণে তার পতন হল। অর্জুন অন্তত লুজার নন।
শিপ্রা বললে, আর অন্য মতে তিনি যে গোপনে কর্ণকে ভালোবাসতেন সেটা জানো না? যে মোটর ড্রাইভারের ছেলে কর্ণ (তখনও কুন্তী ছাড়া কেউই জানে না, কর্ণ আসলে যুধিষ্ঠিরেরও অগ্রজ) প্রকাশ্য রাজসভায় ডাচেস্ বল, এমপ্রেস বল, দ্রৌপদীকে সক্কলের চেয়ে এমনকি দুঃশাসনের চেয়েও বেশি অপমান করেছিল রূঢ় চণ্ডালের ভাষায়। বাকর্ষণ করাতে দুঃশাসনকে বলা যেতে পারে বর্বর, কিন্তু ভাষা দিয়ে অপমান করাতে কর্ণ ইতর, মিন। ভাষার মার মোক্ষমতম মার। অতএব দ্রৌপদীও লুজার। এবং সবচেয়ে বেশি লুজার। কারণ দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবকে কস্মিনকালেও অপমান করেননি।
এবারে কীর্তি মুখ খুলল, বিস্ময়ের ভান করে বললে, অতাই বুঝি কেউ কেউ বিয়ে গ্যাম্বলটাকে ডরায়!
.
০৭.
টোকা দিয়েই কটেজে ঢুকেছিল। কিন্তু হাবভাব দেখেই বোঝা গেল বিলক্ষণ উত্তেজিত।
শিপ্রা বলল, এক কাপ চা?
থ্যাঙ্কু মাদাম। খানের দিকে তাকিয়ে বলল, মি. কুরেশি মিসিং।
খান ইচ্ছা করেই শিপ্রাদের কিছু বলেনি– কুরেশির সঙ্গে তার প্রেমালাপ সম্বন্ধে। জিমিকে বলল, দাঁড়াও, এঁরা ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানেন না। বলে নিই। বলা শেষ হলে কীর্তি মন্তব্য করল, মিসিং নয় এবসকভিই— পালিয়েছে।
জিমি বললে, সেই যে আপনার সঙ্গে কথা প্রায় শেষ না করে কুরেশি ঘরে চলে গেলেন তার পর লাঞ্চ, টিতেও এলেন না। তা সে মেলাই টুরিস্ট আকছারই দু-তিনটে খাবার পর পর মিস্ করে যান। টির সময় বেয়ারা অনেকক্ষণ ধরে টোকা দিল– সাড়া দিল না। ডিনারে এল না। সন্ধ্যা থেকে দুটো কামরাই অন্ধকার। রাত এগারোটায় কিন্তু একটা বেয়ারা দেখতে পেল ঘরে আলো জ্বলছে। টোকা দিয়ে সাড়া পেল না। সমস্ত রাত কিন্তু আলো জ্বলল। সংক্ষেপে বলছি, আজ সকাল দশটায় বেয়ারাদের সন্দেহে ম্যানেজার পুলিশ ডেকেছেন। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল সুট মুট শার্ট টাই শেভিঙের জিনিস সব বিছানার উপর ছড়ানো, ট্রানজিসটারও রয়েছে। তখন কে যেন লক্ষ করল, নেই মাত্র একটি জিনিস– সুটকেসটা, অর্থাৎ শূন্য সুটকেসটা মাত্র নিয়ে লোকটা দুপুররাতে উধাও হয়েছে। কাল রাতে আমার ডিউটি ছিল না। তাই পুলিশ আমাকে কিছু শুধোয়নি। শুধোলে কী বলব, মি. খান?
সত্যি কথা বলবে। সে যেসব প্রশ্ন করেছিল আর তোমার উত্তর যতখানি স্মরণে আনতে পার বলবে। তোমার মনে কী সন্দেহ হয়েছিল অথবা নিজের কোনও মন্তব্য প্রকাশ করবে না, পুলিশ সরাসরি জিগ্যেস না করলে। সর্বশেষে বলবে, তোমার যতদূর জানা মি. খানের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আর কেউ তাকে দেখেনি। পুলিশ আমার কাছে আসবে। আমিও সরাসরি যে কটি কথা হয়েছিল বলব। আমাকে জিগ্যেস না করলেও আমি আমার সন্দেহের কথা বললে বলতেও পারি। তুমি কোনও চিন্তা করো না, জিমি। আমি আমার ওয়ার্ড অব অনার দিচ্ছি তোমাকে, তোমার কেশাগ্রটুকুও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। এখন তুমি নিশ্চিন্ত মনে ডিউটিতে ফিরে যাও।
জিমি চলে যেতেই খান বললে, জিমিকে বলিনি, এখন বলি, আমি লাহোরের প্রেস ক্লাবে কখনও যাইনি। ওটা প্যোর ব্লাফ।
শিপ্রা : তা হলে ঠিক ওইটেই বললে কেন?
কীর্তি : সোজা উত্তর : প্রেসক্লাবে যায় নুজ-মেন এবং খবরের সন্ধানে বিস্তর পাই। নেটিভ লাহোরের পাঞ্জাবি স্পাই যায় বিদেশি সংবাদদাতাদের পাম্প করতে। লোকটা যদি সত্যই স্পাই হয় তা হলে, তা হলে হয়তো সামান্য একটু বেসামাল হবে।
শিপ্রা : কিন্তু মজাদার টাই?
খান : ওর গলায় ছিল যে টাইটা সেটার মতো বিকট টাই আমি কখনও বাস্তবে বা ফিল্মেও দেখিনি। শিলঙের মতো আন্ডার ডেভেলাপড় শহরের হোটেলে-ক্লাবে অর্ধসভ্য ইংরেজ এখনও পরে এডওয়ার্ডিয়ান সোলেস টাই। সেটা দেখার পরও যে খলিফে ওরকমের আচাভূয়া টাই পরে, তার স্টকে পাদ্রি সায়েবদের পানসে টাই থাকার কথা নয়। এটাও ব্লাফ, আগের ব্লাফটা জোরদার করার জন্য।
কীর্তি : তার প্রতিক্রিয়ায় সে তার ন্যাশনালিটি নিয়ে চেল্লাচেল্লি করতে লাগল। আর তুই তখন নিশ্চয়ই খুব বেকুব বনে গেলি? না?
শিপ্রা : এ কী কথা। সে তো তখন খুশি যে তার টেসট সফল হয়েছে।
খান : না, কীর্তির অনুমানটাই ঠিক। এরকম একটা থার্ড ক্লাস টেস্টের মুখে নেহাত কাঁচা স্পাইও বিচলিত হয় না। সে যে স্পাই এটা আমি তখন আদৌ ধরে নিইনি। রোমান্টিক জিমি হয়তো ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখে ধরে নিয়েছে লোকটা স্পাই আর যখন সর্বত্র পা স্পাই ম ম করছে। তাই ব্যাটার চেল্লাচেল্লি শুনে আমি প্রথমটা বেকুব বনে গিয়েছিলুম। তখন বুঝলুম, একমাত্র গাড়ল পাঞ্জাবিদের মধ্যে গাড়লস্য গাড়লই কল্পনা করতে পারে, সে পার্ফেক্ট স্পাই এবং শুধু তাই নয়, আর পাঁচটা, জাতভাই, গাড়লের মনে বিশ্বাস জন্মাতে সমর্থ হয় যে, সে স্পাইরানি মাতাহারির জারজ সন্তান কারণ তার উর্দু অ্যাসন চোস্ত লখুনওয়ি যে এখনও বাপের সে-সুপুত্ত্বর পয়দা হয়নি যে ঠাহর করতে পারবে, সে আম্মাজানের গব্ব থেকে তেড়ে পাঞ্জাবি বুলির ফোয়ারা ছুটিয়েছে শালিমার বাগ-এর বেবাক ফোয়ারা এক জোট করে।… খান নিজের রসিকতায় নিজেই খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করেছে। শেষটায় সামলে নিয়ে বলল, লোকটা যেই না আমার ইচ্ছাকৃত বিকৃততর খাস কলকাত্তাই উর্দুর দুটিমাত্র লজো শুনেছে অমনি ছোটাল তার উর্দু- সে যে উত্তর প্রদেশের প্রকৃত সন্তান সেইটে সপ্রমাণ করার জন্য। আর বলব কী দিদি, সেটা শুনলে আমাদের পাড়ার পর্দানশিন কুলীন ঠাকরুন পদিপিসি পর্যন্ত বলে উঠত, এ ম্যা– ভদ্রলোকের ছেলে, মাইরি, কতা কইচে ডাইভার সদ্দারজির মতো নোকের সামনে লজ্জা করে না! অতিশয় নির্ভেজাল অমৃতসর-লাহোর-মার্কা পাঞ্জাবি উর্দু-প্লাস্টিকের পাতর-বাটি! সুনীতি চট্টো রেকর্ডে তুলে রাখতেন। আমাদের পাড়াতে এক বাঙাল ভদ্রলোক আছেন–তুই তো চিনিস রসরাজ ভশচায–ত্রিশ বছর ধরে। প্রায়ই বলতে শোনা যায় রারী (রাঢ়ী) দ্যাশে মাক্যা থাকা দ্যাশের আপন ব্বাসাটা (ভাষাটা) এক্কেবারে পাউরি গেছি, (ভুলে গিয়েছি, পাসরি গেছি)। এমনই আবেস্তা (অবস্থা) ওংকা (এখন) গিরিনি (গৃহিণী) পইরজন্ত (পর্যন্ত) আমার বিসুর্দ রারী ধ্বসা (বিশুদ্ধ রাঢ়ী ভাষা) বুস্তা পারইন না (বুঝতে পারেন না)। মি. কুরেশি উর্দু বলার সময় হুবহু ভশচাযের আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আপন উত্তর প্রদেশীয়ত্ব সপ্রমাণ করার জন্য লেগেছিলেন ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুলের চর্বি খেয়ে।
এমন সময় জিমি এসে বললে, পুলিশ আপনার কাছে আসতে চায়, না আপনি যাবেন।
খান বললে, আমিই যাচ্ছি। থাকত আজ আই জি তালেবর দত্ত, :, আমাকে কেন, কাউকে কোনও প্রশ্ন না শুধিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, ক্যা করে আপন হাতে পাকড়াত হারামিকে।
খান চলে গেলে শিপ্রা শুধাল, খান লাহোরিটাকে টেস্ট না করে অগাটার চেয়ে অগা সেজে, ধীরে ধীরে খাঁটি মুসলমানত্ব জাহির করে সেটা করতে পারত সে কোনও ভান না করে, এবং অতি অনায়াসে, কারণ তুমিই বলেছ, সে ইসলামের ইতিহাস বহু বৎসর ধরে পড়েছে এবং মুসলমান মুসলমান ভাই-ভাই, তাই ইয়েহিয়া তার বড় ভাই সাহেব মির্জা সেটা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। তার পর লাহোরের মিঞাজিকে সাপ্লাই করত ইন্ডিয়া সম্বন্ধে রগরগে বোগাস ইনসাইড় ইনফরমেশন, এবং পাম্প করত তার পেট থেকে পশ্চিম পাক সম্বন্ধে যতখানি মাল বের করতে পারে, এবং সবচেয়ে ইমপর্টেন্ট কনটাক্ট রাখার নাম করে ভারতে পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানি স্পাইদের যে-কটা নাম সংগ্রহ করতে পারে। দুচ্ছাই, ওসব আবার বলি কেন?– লারি কোম্পানিকে সে যে-উদ্দেশ্য নিয়ে তেলিয়েছিল।
কীর্তি বললে, ওরকম একটা গণ্ডমূর্খকে কোনও দেশ যে স্পাই করে পাঠাতে পারে, সেটা বেচারী অনুমান করবে কী করে? সে ভেবেছিল, একটুখানি ন্যাজ খেলানোর পর, ধরবে সাপের ন্যাজটা। কিন্তু পয়লা কোপেই বেরিয়ে এল সাপের বদলে কেঁচো। তবে মিঞা খুব একটা কাজে লাগতেন বলে মনে হয় না। ওকে হয়তো পাঠিয়েছিল জেনে-শুনে যে সে ধরা পড়বেই। ভারতের কদিন লাগে ওকে পাকড়াতে, পাকড়ে ওকে নিয়ে কী করে– অর্থাৎ ওর নাম করে, কিংবা ওকে বাধ্য করে বোগাস খবর পাঠায় কি না, ওকে কিনে ফেলে নিজেদের স্পাই করে পশ্চিম পাকের এমন জায়গায় পাঠায় কি না, যেখানে সে পরিচিত নয়, এবং আরও অনেক কিছু– এবং তার থেকে বিচার করবে ইন্ডিয়ান অ্যান্টি-শাই বিভাগ কতখানি চালাক, কতখানি আপ-টু-ডেট।
শিপ্রা : ঢাকা বেতার এখন খবর দেবে। কী বলে শুনি।
প্রধান খবর ছিল, হামিদুল হক বিবৃতি দিয়েছেন, এটা যুদ্ধ নয়, হত্যা নয়, বর্বরতাও নয়। সামান্য অপারেশন। তাতে দু চারজন লোক মরবেই–
কীর্তি : মাই গড!
–যারা আইন মেনে চলছে আর্মি তাদের কোনও ক্ষতি তো করছেই না, বরঞ্চ তাদের নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশ লীগ শয়তানদের গুণ্ডামি থেকে রক্ষা পেয়েছে। এখন যা লুট রাহাজানি খুন হচ্ছে সেসব করছে লীগের লোক। গ্রামের লোক ভারি খুশি, আর্মি অপারেশনের খবর শুনে আমার কাছে গাঁয়ের সব খবর আসে এবং সর্বপ্রকারের কটুকাটব্য, জলজ্যান্ত মিথ্যা ভাষণ। সংক্ষেপে বলতে গেলে আয়নার উল্টো ছবির মতো ইয়েহিয়া-টিক্কার সপক্ষে অনবদ্য একখানা মাস্টারপিস।
শিপ্রা স্তম্ভিত হয়ে শুনল। সে এমনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে যে গ্যোবেলস্-এর তুলনা পর্যন্ত তার অবশ মনে সঞ্চারিত হল না।
কীর্তি অতখানি না। শুধাল, এই হটি কে চেন? ইনি বাঙালি মুসলমান। ইনি এবং একজন বাঙালি হিন্দু দুজনাতে পার্টিশনের পূর্বে বর্মা থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য ফান্ড থেকে অন্তত লাখ তিরিশেক টাকা তছরূপ, চুরি, যা ইচ্ছে, বল করাতে– ওদের নামে গ্রেফতারির হুকুম বেরোয়। ঠিক ওই সময় পার্টিশন হল; হক ঢাকা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। খুব সম্ভব এখনও তার নামে কলকাতায় এরেস্ট ওয়ারেন্ট জারি আছে; এই চব্বিশ বছরে তিনি ভারতে পদার্পণ করেননি। সেখানে রাজনীতির খেলাধুলোতে সুবিধে না করতে পেরে রাজনৈতিক বনবাসে চলে গেলেন– তখনকার মতো। বর্মার কড়ি দিয়ে একটা দৈনিক খবরের কাগজ কিনে রেখেছিলেন; সেইটে দিয়ে আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াতে লাগলেন। অনেকটা–
থামলে কেন?
অল রাইট– অনেকটা গোয়িং ইনটু টেম্পরারি রিটায়ারমেন্ট লাইক এন ওড় প্রসটিটুট, বিকাম এ হোল-টাইম, প্রফেশনাল পিমপ অ্যানড় এওয়েট এ স্টেজ-ব্যাক অ্যাজ দি সো ওনার অব্ ফুল-ফ্লেজেড় ব্রথেলস্।
খানের প্রবেশ।
খান : চতুর্দিকে পুলিশ ছড়িয়ে পড়েছে; হুলিয়া বেরিয়েছে মিঞাকে পাকড়াবার জন্য।
কীর্তি : চতুর্দিকে কেন? ও তো এখন সিধে ধাওয়া করবে সবচেয়ে নিকটের পাক বর্ডারের দিকে। এবং যাবে চেরাপুঞ্জির ঘুরতি পথে। জিমিকে যে পই পই করে চেরাপুঞ্জির খবর জিগ্যেস করেছিল সেটা শুধু কামুফ্লাজ নয়। পশ্চাদপসরণ– লাইন অব রিট্রিট সম্বন্ধেও ওকিবহাল হওয়ার প্রচেষ্টা তাতে ছিল। এবং সে সোজা সরকারি সড়কও ধরবে না। খাসিয়ারা অতিথি-বৎসল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর হয়ে চেরাপুঞ্জি একপাশে রেখে কী একটা জায়গার নাম, কী যেন, উঠনি–মহাদেরে উঠনি না কী যেন সেটা অপরিহার্য কয়েকশো ধাপ সান-বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে চেরাপুঞ্জি অঞ্চলের উচ্চতা থেকে নামবে কী যেন একটা ছোট্ট খাসিয়া গ্রামে কী এক পুঞ্জি– সেখান থেকে কোম্পানিগঞ্জ, ভুলাগঞ্জ, জন্তিয়ার ওত্রাইটার পথ খুবই সহজ। চেপোস্টটার নাম বোধহয় ডাউঁকি। সে নিশ্চয়ই সেখানে যাবে না। ওখানেও পা-সিলেটে ঢোকার তরে বিস্তর চোরাবাজারের গুপ্তিপথ রয়েছে।… স্পাই মাস্টার যে রকম ভয় পেয়েছে আর অ্যাক্কেলটিও গুড়ম, সে তার বর্তমান মুক্ত-কচ্ছাবস্থায় দু কান-কাটার মতো সদম্ভে গৌহাটির অষ্টপ্রহর গগ করা সরকারি বে-সরকারি কোনও পথই ধরতে পারে না।
খান শুধাল, ম্যাপটি যোগাড় করলে কোত্থেকে?
কীর্তি, তৃপ্ত বদনে : হাজি সকল কাজের কাজী; নিজের থেকেই দিয়েছিল, টু মাইল টু এন ইঞ্চ ম্যাপগুলো।
খান : তার পর প্রশ্ন উঠল, লোকটা সবকিছু ফেলে রেখে সুদুমাত্র খালি সুটকেসটা নিয়ে গেল কেন? এমনকি ট্রানজিসটারও ফেলে গেল কেন? অন্তত ডাউঁকি বর্ডারের অবস্থাটা তো গৌহাটি স্টেশন থেকে শুনতে পেত।
কীর্তি : উত্তর অতি সরল। সুটকেসটাতে ছিল ফস বটম গুপ্তি-তলা। সেখানে আর কিছু না থাক, ম্যাপ-ট্যাপ কম্পাস এমনকি হোট ট্রান্সমিটার থাকাও অসম্ভব নয়। কামরার ভিতর সেগুলো নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। অতএব পয়লা মোকাতেই ওটা সে ফেলে দেবে যে কোনও জঙলা একটা খাদে তার অভাব কী এখানে। তোকে যদি কখনও মার্ডার করি তবে শিলঙে ডেকয় করে এনে। লাশ গায়েব করার তরে আইডিয়াল প্রলোভিনী এখানকার খাদগুলো। লেকের পাশ দিয়ে যদি যায় তবে সেটা ব্যাড সেকেন্ড। কী মূর্খ লোকটা সেটা আরও বোঝা গেল ট্রানজিসটার সঙ্গে নেয়নি বলে।
শিপ্রা বললে, অনুমান করতে পারছি।
খান বললে, আমি সদাই ওয়াটসন। রহস্য সমাধান হয়ে যাওয়ার পরও সে-সমাধানের কৈশলও তার কাছে রহস্যময় থেকে যায়।
কীর্তি বললে, নিয়ে গেলে পুলিশের হুলিয়াতে অন্তত থাকত সম্ভবত পলাতকের হাতে ট্রানজিসটার আছে। তোরই মতো পুলিশ ভাববে, ওই যন্ত্রটি ছাড়া ওর চলবে কী করে? ওদিকে সে সেটা সুটকেসে পুরলে সেটার ওজন বাড়বে। খাদের ঝোঁপঝাড়ে আটকা পড়বে না– তদুপরি পুলিশের অন্যতম শক্তিকরণ চিহ্নও তার হাতে নেই। পুলিশ কিছু বুদ্ধি খাটালে ও সামান্য তৎপর হলেই ওকে ধরতে পারবে সেই উঠনির নিচে। পকেটে যদি কিছু পায় তবে, কম্পাস আর ম্যাপ।
খান বললে, মিঞাকে নিয়ে দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। তোকে ফারসি প্রবাদটি তো একাধিকবার বলেছি, আহাম্মুখ দোস্তের চেয়ে আক্কেলওলা দুশমন ভালো। কিন্তু ওই মিঞাটার মতো দুশমন যদি রাঁচির সার্টিফিকেট প্রাপ্ত ইম্বেসাইল হয়, সে সম্বন্ধে প্রবাদ নীরব।
শিপ্রা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, এরকম, একটু ভালো, আরও বোকা কত আসবে-যাবে, সে নিয়ে মাথা ঘামালে হবে বর্বরস্য বলক্ষয়– আর তুমি, খান, মাত্র অর্ধ বর্বর। চলো না কলকাতায়, তোমার মতো ধুরন্ধর চোখ না মেলেও দেখতে পাবে মার্কিন, রুশ, চীনা, বিশেষ করে উভয় পাকের চর কভু স্ববেশে কভু-বা ছদ্মবেশে আবজাব করছে।
কীর্তি বললে, তোমাদের সম্মতি থাকলে কালই কলকাতা রওনা হওয়া—
খান আশ্চর্য হয়ে শুধাল, এত ম্যাপ ঘাঁটাঘাঁটির পর ডাউঁকি যাবে না?
কীর্তি শান্ত কণ্ঠে বললে, করিমগঞ্জে যে দু একটি শরণার্থী দেখেছি, সেই প্যাটার্নই। তো ইছামতী থেকে পদ্মা ব্রহ্মপুত্র ডাউঁকি, সর্বত্রই একই রূপে দেখা দেবে।
খান বললে, অ-অ-অ! হাতে হাঁড়ির একটা ভাত টেপা ঝোঁপের দশটা পাখির সমান।
.
০৮.
জিমি!
ইয়েস, ম্যাডাম!
তুমি সত্যি ভেরি ভেরি ব্যাড় বয়।
আমার ড্যাডি, অনুমতি করুন ম্যাডাম, আমাকে এইটুকু হাইট থেকে (হাত দিয়ে দেখিয়ে) এই সত্য বাক্যটি বলেছেন। আমার মনে যেটুকু সন্দেহ ছিল, আজ থেকে সেটা একদম লোপ পেল
ফাজলামো করো না। সেই ভোর চারটে থেকে তোমাকে আমি খুঁজছি। সবাই বলে, তুমি অফ ডিউটি। সো হোয়াট? শেষটায় গৌহাটির পথে তোমার বাড়ি গেলুম। পথে দেখি, সেই জোয়ান বেয়ারাটা, ভ্যাক করে যে কেঁদে ফেলেছিল আমার সামনে, সে ছুটেছে টাটু ঘোড়ার মতো। জিগ্যেস করলুম, লিটু চাই। বললে, তোমার বাড়ি যাচ্ছে, তোমাকে খবর দিতে। সেখানে শুনলুম, ইয়োর বেড হ্যাঁজু নট বি স্লেপ্ট ইন এটোল। আই লাইক দ্যাট! কোথায় ছিলে সমস্ত রাত? আমি তোমার বাপ হলে এতক্ষণে আমার দুই উরুর উপর উপু করে ফেলে, উইদ দি রং সাইড অফ মাই ব্রাশ এমন প্যাদানি দিতুম–
হঠাৎ জিমিকে গৌহাটিতে পেয়ে এমন খুশি যে বহুদিন পরে অনর্গল বকর বকর করে যেতে লাগল।
জিমি সবিনয় বললে– ছোকরাকে এরকম বকাঝকার লাই ইতোপূর্বে কেউ কখনও দেয়নি অ্যান্ড বাই হোয়াট এ ড্রিমল্যান্ড ফেয়ারি! মাদার মেরি তুমি এঁকে সর্ব অমঙ্গল থেকে রক্ষা করো, মা!– ম্যাডাম, আমার ওজন ১৭০ পাউন্ড, তাই এই মাটিতে লম্বা হচ্ছি! আপনি– ছোকরা জীবনে এতখানি স্নেহ ইহজন্মে পায়নি। নইলে এরকম বাঁচালতা তার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকত। বাপের স্নেহ ছিল পুরুষের, পিতার স্নেহ।
চুপ করো। এই চেয়ারটায় বসো তো। তার পর হ্যান্ডব্যাগ খুলে সিল্কে মোড়া একটা কেস বের করল। বলল, খুলে দেখো। তুমি পরো। আর বিয়ের বউয়ের আঙুলে আংটি পরাবে তো, চার্চের ভিতর? বেরিয়ে এসেই এটি তাকে পরিয়ে দেবে- ইফ আই বি অন দি আদার সাইড
ম্যাডাম, প্লিজ!
শোনো। আমি বেঁচে থাকলে অন্য কথা। এখন সিরিয়াস হয়ে শোনো। এটা তোমাকে আমি ফ্রি দিচ্ছি না। আমি প্রতিদান চাই।
জিমি হাত তুলেছে শপথ করতে।
শুনে যাও, প্লিজ। তোমার হেল্প্ আমার দরকার হতে পারে, না, হবেই। হয়তো উইদাউট এনি নোটিস। হয়তো-বা দিতে পারব। তুমি না বললে আই শানট টেক ইট এমিস্ এটোল। সি হোয়াট আই মিন?
প্লিজ, ম্যাডাম। আমাকে মাত্র একটি কথা বলতে দিন। আমার ড্যাডির জীবনের আদর্শ তিনি নিয়েছিলেন কার কাছ থেকে আমি ঠিক জানিনে। বোধ হয় প্রিন্স কনসর্ট এলবার্টের এই মটো ছিল। জর্মনে দুটি শব্দ, ইষ ডিনে (Ich diene) আমি সেবা করি, আমি সেবার জন্য, আই এম হিয়ার টু বি যুজড়। আমিও সেই আদর্শে বিশ্বাস করি।
গুড। আমি তোমাকে এমন কোনও সেবা করতে বলব না, যেটা হীন কিংবা তোমাকে কোনও বিপদে পড়তে হবে। প্রথম সন্ধ্যাতেই আমি বুঝেছিলুম, পরের হিত করে তুমি আনন্দ পাও। তার পর যখন মি. খানের কাছ থেকে শুনলুম, পাঞ্জাবি গুপ্তচরের প্রতি তোমার ঘৃণা, এবং খানকে সবকিছু তুমি বলেছ যাতে করে সে খানের বা অন্য কারওর অনিষ্ট না করতে পারে তখনই– ওয়েল নেভার মাইন্ড– তুমি কবে কলকাতায় আসছ?
আপনি যখনই আদেশ করবেন।
আচ্ছা, তোমাকে শেষ প্রশ্নটা জিগ্যেস করি : তোমার পিতা এবং তুমি বড় হওয়ার পর, তোমার সম্প্রদায়ের আর পাঁচজনের মতো তোমরা ক্যানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলে না কেন?
ড্যাডি ছিলেন অতি এক্সপার্ট বয়লার ইনসপেক্টর। কাজেই তিনি আর পাঁচজনের তুলনায় ঢের ঢের ভালো অফার পেয়েছিলেন। এবং তিনি এটাও জানতেন, তার নিকট আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই মাইগ্রেট করার ফলে তাকে বৃদ্ধ বয়সে নিতান্তই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে। তবু তিনি যাননি। কেউ জিগ্যেস করলে উত্তরটা এড়িয়ে যেতেন। মাত্র একদিন একবার আমাকে, একান্ত আমাকেই বলেছিলেন, যারা যাচ্ছে, যাক্। আমি কখনো বলব না, তারা অন্যায় করছে। কিন্তু, মাই জিমি, আমি যে-দেশে জন্মেছি, যে-দেশকে আমি ছেলেবেলা থেকে ভালোবাসতে শিখেছি, সে-দেশ আমি ত্যাগ করতে পারব না। আমি এদেশেই মরতে চাই, যাতে করে আমার বাপ-পিতামোর হাড্ডির কাছে আমার হাড়িও ঠাই পায়– আই উয়ান্ট মাই বোস টু বি গেদার আনটু মাই ফোর ফাদার্স হোয়ার দে আর। ম্যাডাম, আমার বেলাও তাই সে হিয়ার। আমি চলে গেলে তার গোরে ফুল দেবে কে?
তাই তো, অবাক হয়ে ভাবল মনে মনে শিপ্রা, তাই তো, খ্রিস্টান-মুসলমান যাদের গোর দেওয়ার রীতি, তারা চায় তাদের হাড়গুলো যেন তাদের বাপ-পিতামোর হাড়ের কাছে স্থান পায়, কালক্রমে ধুলো হয়ে মিশে যায়। হৃদয় দিয়ে যারা এ দেশকে ভালোবেসেছে তাদের পক্ষে এদেশ ত্যাগ না করার বিরুদ্ধে এটা একটা অতিরিক্ত হৃদয়ের যুক্তি।
সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল, বার্টন না ওপেন্হাইম্ কার লেখাতে সে-যেন পড়েছে, বসরা বন্দর থেকে ভারতাগত জাহাজ যেসব শত সহস্র মুসলমানদের ওষধি-রক্ষিত মৃতদেহ সাত-সমুদ্র পেরিয়ে নিয়ে এসেছে, তাদের বোঝাই করে এগিয়ে চলেছে মরুভূমির এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে বিলীন শত সহস্র উষ্ট্র-গর্দভের কাফেলা পুণ্যভূমি কারবালার দিকে, যেখানে তাদের নেতাজি শহীদ ইমাম হোসেনের রক্তধারা কারবালা-মরুভূমির সহস্রাধিক বৎসরের শুষ্ক বালুকা সিক্ত, রঞ্জিত করেছিল, যেখানে তার অস্থি সমাহিত হয়েছিল তারই নিকটে একই মরুভূমিতে ভারতীয় অস্থি স্থান পাবে বলে, একই ধুলোয় ধূলি হবে বলে।
এবং এরই সঙ্গে তার মনে আরেকটি চিন্তা উদয় হয়ে তার দেহটা যেন বিষিয়ে দিল : জেনারেল ইয়েহিয়া অতিশয় গোঁড়া কট্টর শিয়া, এবং সম্প্রতি জানতে পেরেছে মিস্টার জুলফিকার আলি ভুট্টোও শিয়া– গোপনে গোপনে তিনিও ধর্মান্ধ, তার শিয়া মতবাদ ভিন্ন অন্য সর্ব বর্ণ সর্ব গোত্রের মুসলমানের প্রতি তার প্রতিটি লোমকূপ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-হলাহলে জর্জরিত।
এবং সে সাম্প্রদায়িকতা এমনই বিশ্বব্যাপী যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ–যে সে ধর্মান্ধতাকেও পরাস্ত করে ধর্মনিয়ন্ত্রিত পবিত্র মহরম মাসে, পুণ্য শুক্রের দিবসারম্ভে তাদের সর্ব পবিত্রতাকে কলুষিত করে শিয়াদের ধর্মবৈরী সুন্নি মূর্খ পাঠানকে উত্তেজিত নিয়োজিত করে তার ধর্মভ্রাতা পুব বাঙলার সুন্নি মুসলমানকে নিধন করতে, তার বধূভগ্নী কন্যাকে। তাদের শেখানো হয়েছে পূর্ব বাংলার মুসলমান কাফির। ইয়েহিয়া শুধু মদের নেশায় বলতে ভুলে গিয়েছিলেন শিয়ারা সর্ব সুন্নিকে, অতএব পাঠানকেও কাফের মনে করে।
ইয়েহিয়ার পরলোক ইরাকের কারবালায়, ইহলোক শিয়া ইরানে। তিনি ভুলতে পারেন না, ভুলতে চান না যে তার পূর্বপুরুষ কিজিলবা গোষ্ঠী এসেছে ইরান থেকে শুধু ভুলে গেছেন তারা ইরানে এসেছিল মূল মাতৃভূমি সুন্নি তুর্কোমানিস্তান থেকে। ইরানের সঙ্গে তাঁর দোস্তি; পুব বাঙলার সুন্নি তাঁর দুশমন। তার দোস্ত ইরান তাই তাঁর সুন্নী নিধন কর্ম সুসমাপ্ত করার জন্য শানিয়ে দিচ্ছে তার তলওয়ার, সওগাত পাঠাচ্ছে বোমারু বিমান।
হঠাৎ সংবিতে ফিরে এল শিপ্রা। জিমি সম্বন্ধে শেষ কথা তার যা জানার ছিল সেটা জানা হয়ে গিয়েছে। তার আনুগত্য ইংলন্ডে বা কানাডার প্রতি একস্ট্রা টেরিটরিয়াল নয়।
আমাদের মেয়েরা একদা অষ্ট অলঙ্কার দিয়ে প্রসাধন করতেন, ওষ্ঠরঞ্জন ইদানীং বহুস্থলে হোটেলে, ট্রামে-বাসে, থিয়েটারে তাদের একমাত্র অলঙ্কার। পক্ষান্তরে। গোরা রায় অদ্যাপিও অষ্টপদী ব্রেকফাস্ট খায়! তারই এক ঢাউস সংস্করণ বেয়ারা এনে রাখল জিমির সামনে।
শিপ্রা বললে, আজ এই খাও। এতদিন তোমার কর্তব্যের আওতায় না পড়া সত্ত্বেও তুমিই যে আমার খানার তদারকি করতে সে আমি জানি। একটু মৃদু হেসে বললে, আর কলকাতার বাড়িতে খাবে পুইশাকের চচ্চড়ি আর মোচা-ঘন্ট।
কিন্তু আপনি অর্ডার দিলেন কখন?
ওহে জনপদবাসী যুবক, আমি নাগরিকা। আমাদের টেকনিক ভিন্ন। আমার চেয়েও সুচতুরা, বিদগ্ধা নাগরিকার নাম বেয়াত্রিচে। আমাকে তুলে খেতে পারে। এসো কলকাতায়। এই এপ্রিলেই। ওই কথাই রইল– ডান?
ডান! অনার ব্রাইট। ওই কথাই রইল।
শিপ্রা সেন্টিমেন্টাল নয়। শব্দটি ইংরেজিতে স্থানবিশেষে সবসময় প্রশংসনীয় নয়। বাংলায় আমরা বলি ভাবাবেগে গদগদ হওয়া, উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হওয়া কিংবা যে-রকম বলা হয়, পড়য়া প্রহ্লাদ যখন বর্ণমালার ক অক্ষরে এলেন, তখন কৃষ্ণ নামের স্মরণে ভাবাবেশে মূৰ্ছিত হয়েছিলেন। শিপ্রার অনুভূতি এস্থলে সে পর্যায়ে নয়। সে দেখতে পেয়েছিল জিমির ভিতর একাধিক চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য যেগুলোকে সাধারণ জন রিসেপ্সনিস্টের মামুলি কর্তব্যবোধ মনে করে তার দিকে আরেকবার ভালো করে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করত না। সব ভালো হোটেলেরই রিসেপসনিস্ট– এমনকি ক্লাব-চ্যাটার বসের সমগোত্রীয় হোটেল-সব হয়তো বলেই ফেলত, ছোকরার উচ্চারণ ট্যাঁশুয়া–চেষ্টা করে গেটের সেবা, কিন্তু সেবাই যে জিমির ধর্ম সেটা যত না বুদ্ধি দিয়ে ততোধিক অনুভূতি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করেছিল শিপ্রা। শিপ্রার সেন্টিমেন্ট আছে, কিন্তু সে সেন্টিমেন্টাল নয় কারণ তার সেন্টিমেন্টের পিছনে অহরহ জাগ্রত থাকে পর্যবেক্ষণশীল অন্তর্দৃষ্টি।
শিপ্রা আর জিমি লাউঞ্জে বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় একে অন্যকে যখন চিনে নিচ্ছিল, খান ততক্ষণে ঝপঝপ গোটা পাঁচেক জিন মোকামে পৌঁছিয়ে দিয়েছে, রেস্তোরাঁতে বসে কীর্তি সঙ্গ দিয়েছে বটে কিন্তু সে আধ গেলাসও শেষ করতে পারেনি।
মাইক্রোফোনে প্যাসেঞ্জারদের উদ্দেশে সমন জারি হয়েছে। খান খপ করে কীর্তির গেলাসটা তুলে নিয়ে বট আপ করে বললে, চ, যত সব দুশ্চরিত্র পেঁচি মাতাল!
লাউঞ্জে শিপ্রাদের সামনে দাঁড়িয়ে এবারে বাক্য সম্পূর্ণ করে বললে, যত-সব পেঁচি মাতালদের পাল্লায় পড়ে আমার চরিত্রটা ঝরঝরে হয়ে গেল!
জিমি এখন শিপ্রার প্রটেজে। জিমির ইংরেজি ব্ল্যাশুয়া হোক, আর নাই থোক, তার বাংলাটা খাজা ব্ল্যাশ মার্কা। শিপ্রা প্রথম তাকে বুঝিয়ে বললে, পাড় মাতাল অর্থাৎ কনফার্মড বুজার, আর পেঁচি মাতাল মানে, যারা আধ ফোঁটা গিলতে না গিলতেই ঘরের ভিতর আটটা পাঁচিল দেখতে পায়। তার পর খানকে শুধাল, পেঁচির সহবতে দুশ্চরিত্র হলে কোন অলৌকিক অধ্যবসায় এবং ইন্দ্রজাল-ভানুমতীর সমন্বয়ে।
খান হাহাকার সহকারে বললে, হায় হায়, এই সামান্য তত্ত্বটুকু পর্যন্ত জানো না, সুন্দরী। তাই বলছ ভানুমতীর খেল। ওই যে আমাদের পাড়স্য পাড় কেষনগরের ব্যারিস্টার গোসাঁই, তাকে লন্ডনে পুলিশ ধরে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। অপরাধ? রাস্তায় মাতলামো করেছে রাত দুটো অবধি। পুলিশ যা প্রমাণপত্র পেশ করলে তার সামনে হাকিমের মনে কোনও সন্দেহের অবকাশ রইল না, ব্যাটা পাড়। তবু জানো তো, ব্রিটিশ জাস্টিস, অপরাধের পুরো বয়ান শোনার পর তবে তো স্থির করবে, দণ্ডটা গুরু না লঘু হবে। আসামিকে শুধালেন, এমন কি কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল, এমন কি কোনও বিপাকে পড়েছিলে যে ফলে বেহেড মাতলামোটা করলে?
গোসাঁই চিঁ চিঁ করে করুণ কণ্ঠে বললে, আমি দুজন অসচ্চরিত্র লোকের পাল্লায় পড়েছিলুম, ধর্মাবতার, ইওর অনার।
জজ উৎসাহ দিয়ে বললেন, খুলে কও।
গোসাঁই অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে, মি লাট, আমার সঙ্গী-দুটো যে এতখানি দুশ্চরিত্র জানা থাকলে আমি কস্মিনকালেও ওদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতুম না। দুই শয়ারই- বেগ পার্ডন, স্যর টি টি, টী টোটেলার। মদ্যস্পর্শটা মুসলমানদের চেয়েও হারাম বলে বিশ্বাস করে। ক্রিসমাস, আপন আপন জন্মদিনে পর্যন্ত মদ্যপান করে না।
প্রহেলিকাচ্ছন্ন দ্বিধাভরা কণ্ঠে জজ ফের বললেন, আরও খুলে কও।
আর ছিল, হুজর, একটা পুরো মেগনাম সাইজের হুইস্কির বোতল খাঁটি স্কচ, ছিপি পর্যন্ত খোলা হয়নি। সেই সমস্ত বোতলটা আমাকে একাই খতম করতে হল, পাষণ্ডেরা কিছুতেই হিস্যে নিল না। মেগনাম বোতলে নেশা হবে না তো কী হবে? ওই দুটো লোককে দুশ্চরিত্র বলব না তো কী বলব, কুসঙ্গ বলব—
কলকাতার স্মাট সেট-এর কায়দা-কেতা প্রটোকল-বাঁধা। কোন অঙ্গের রসিকতায় মুখে ফুটবে একটুখানি স্মিত হাস্যের ক্ষীণাভাস, কোন পর্যায়ের চুটকিলাতে শীতের ফাটা ঠোঁটের চেরা হাসি, মোনালিসা-স্মিতহাস্য করে করে স্তরে স্তরে সর্বশেষ রবীন্দ্রাগ্রজ বড়বাবুর ঠাঠা অট্টহাস্য। শিপ্রা কোনও প্রটোকল কখনও মানেনি, তার হাস্যমাত্রা কী হবে সেটা মেট-এর আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু গাঁইয়া জিমি একহাতে মুখ চেপে অন্য হাতে পেট চেপে দু ভাঁজ হয়ে গিয়েছে।
শিপ্রা বললে, আমো সেই লন্ডনি জজের মতো রহস্যাচ্ছলা হয়ে শুধোই, এস্থলে কথিকাটি কীভাবে প্রযোজ্য।
আরে কও কেনে? আমি সদাই সাথীরূপে রাখি ছটা বিগ হুইস্কি, ছটা ব্রা জিন– তোমাদের এই প্যারা কংগ্রেস সরকারের মেহেরবানিতে এসব সুধা ভারতময় লুকোচুরি খেলে, কটকে রাজরাজমহেন্দ্ৰবরম বা তিরুচিরপল্লী কোনটা ড্রাই, কোনটা ওয়েট, কোনটা সঁতসেঁতে, সেটা আবার হঠাৎ এক লম্ফে বোফ্রাই হয়ে গিয়েছে কবে, তার নেই খবর– মরো গিয়ে সেখানে সুধার অভাবে। অতএব প্রকৃষ্টতম পন্থা ক্যাঙারু পদ্ধতি। আপন থলেতে আপন মাল নিয়ে চলা-ফেরা করা। আজ সঙ্গে ছিল ছটা বড়া জিন্ আর ছিল আন্দেশা, দুনো ইয়ারের তরে বাড়ন্ত হলেই তো সব্বোলাশ নাশ নয় লাশ আখেরে হল সর্বনাশই। ছটার সাড়ে পাঁচটা খেলুম আমি, ইয়ার খেলেন হাফ। চরিত্র নষ্ট হল না আমার, এই পেঁচি মাতালটার পাল্লায় পড়ে? বরঞ্চ গোসাঁইয়ের কপাল ছিল ঢের ভালো, তার প্রলোভন ছিল মাত্র সেই বোতলটা। কাউকে খেতে দেখলে, কিংবা যদি কেউ সঙ্গ দেবে বলে জানা থাকে তবে প্রলোভনটা হয় প্যারাডাইজে সেই প্রথম নর-নারীর মতো নজিরহীন, অভূতপূর্ব লালসাভরা আপেল। এক পেগ আপেল, নো, আই মিন একটা আপেল সেটা হাফাহাফি করে খেয়ে একে অন্যকে উৎসাহিত করল। বাবু কীর্তিনাশ আমাকে সঙ্গ দেবার লোভ দেখিয়ে চাটলেন তার জিন্টা, পেঁচি রাধুনী যে রকম আড়াই ফোঁটা ঝোল চেটোতে নিয়ে দেড় বার চেটে নুনটা পরখ করে নেয়। এখন বল, ভদ্রে শিপ্রা, সম্পূর্ণ মদ্যবর্জিত লোক এবং কীর্তি কে বেশি বিপজ্জনক দুশ্চরিত্র! তবে কি না, একটা সান্ত্বনার কথা, শুধু ওই ছটা জিন পেগ নয়– ছ বোতল স্কচ আর তিন বোতল স্কচ লুট করেছি ওই পাতি স্পাই পাঞ্জাবিটার ঘর থেকে।
ত্রিমূর্তি বাকহারা, স্পন্দনহীন। এলেফেন্টার প্রস্তর ত্রিমূর্তি এদের তুলনায় তখন মুখরিত বাঁচাল।
.
০৯.
পো; আলীগ্রাম
গ্রাম পাহাড়পুর, সিলেট,
২০/৩/৭১
দোয়া পর সমাচার এই,
স্নেহের শিপ্রা বোন–
শিপ্রা যেন বিজলির শক খেল। খামের উপর ছিল ভারতীয় স্ট্যাম্প। ঠিকানাও অচেনা হাতের। অলস অবহেলায় চিঠি খুলেছে, আনমনে পড়তে শুরু করেছে– হঠাৎ বুঝতে পারল এ যে বিলকিসের চিঠি! কত যুগ পরে! চিঠির ডান কোণে তাকালো- হ্যাঁ, সিলেটের ঠিকানা। খামটা তড়িঘড়ি বাস্কেট থেকে তুলে নিল ঠিকই তো দেখেছে। ভারতীয় স্ট্যাম্প। তারিখ বিশ। তখনও তো মানুষ পূর্ব বাঙলা ছেড়ে চলে যেতে আরম্ভ করেনি। পাঁচ সেকেন্ডের ভিতর আগাগোড়া চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে ধরে ফেলল জায়গাটা যেখানে তার উত্তর আছে। লিখেছে :
এখানকার অবস্থা এমনই অস্বাভাবিক যে চিঠিটা এক হিন্দু ভদ্রলোক মারফত ভারতে পাঠালুম। ভদ্রলোক সেই পার্টিশনের সময় থেকে সবরকমের ঝড়ঝঞ্ঝা সয়েছেন, কিছুতেই দেশত্যাগ করতে রাজি হননি। কাল হঠাৎ এসে আমার মেয়েকে বললেন, তাকেও শেষ পর্যন্ত ভিটের মায়া ত্যাগ করতে হল। মেয়ে আশ্চর্য হল, কারণ আমাদের অনেকেই তো এখনও পুরো আশা ধরে আছেন, লীগ আর ইয়েহিয়াতে সমঝোতা হওয়া খুবই সম্ভবপর। অথচ একাধিকবার যখন হিন্দুদের চতুর্দিকে ঘোরঘুট্টি অন্ধকার, প্রায় সবাই পালাচ্ছে তখনও তিনি প্রতি সন্ধ্যায় এখানে এসে বৈঠকখানায় তোমার জামাইবাবুর সঙ্গে দাবা খেলে গেছেন। উপস্থিত হিন্দুদের ভিতর বিশেষ কোনও চাঞ্চল্য নেই, তবু তিনি বেবিকে বললেন, এতদিন বাইরের গুণ্ডা এসেছে মারপিট লুঠতরাজ করতে, তার হিন্দু-মুসলমান প্রতিবেশী, ইয়ার দোস্তের সাহায্যে তিনি তাদের ঠেকিয়েছেন। এবারে তাঁর স্থির বিশ্বাস স্বয়ং সরকার আসবে বেহদ্দ জুলুম করতে। জুলুম করতে আসে যে-সরকার তার জাত নেই, ধর্ম নেই। মুসলমান-হিন্দু কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না। বেবি তার ইঙ্গিতের কিছুটা ধরতে পেরে ভয় পেয়ে শুধাল, মুসলমানদের উপরও জুলুম চলবে নাকি? তিনি ভালো-মন্দ কোনও উত্তর না দিয়ে বেবির হাতে চন্দনকাঠের একগাছি মালা দিয়ে চলে গেলেন। ভশচায় মশাই করিমগঞ্জ হয়ে কোথায় যাবেন সেটা এখনও স্থির করতে পারেননি। দাদার বন্ধু শ্ৰীযুত দেশরঞ্জন চক্রবর্তী, করিমগঞ্জ, কাছাড়, ঠিকানায় উত্তর দিয়ে। ভশচাষ আমাদেরই মতো সাদামাটা মানুষ; তাঁর দিব্যদৃষ্টি আছে এরকম কোনও খবর বা গুজব আমার কানে কখনও পৌঁছয়নি, ভবিষ্যদ্বাণী করতেও শুনিনি। তাই তার দেশত্যাগ শুধু বেদনা দিচ্ছে। এর মধ্যে আশা বা নিরাশার কোনও আভাসই নেই।
বাইরে যথেষ্ট। মিনিটে মিনিটে রকমারি খবর গুজব এখানে পৌঁছাচ্ছে আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত। কোনটা সুখবর, কোনটা দুঃসংবাদ সেটা পর্যন্ত সবসময় বোঝা যায় না কারণ তারই ফল আখেরে কী হবে, কেউ অনুমান করতে পারে না। সর্বোপরি বেবি আর তার বেতার। ঢাকা বলে এক কথা, পিন্ডি বলে উল্টোটা, লন্ডন মনস্থির করতে পারে না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলুম, ইন্ডিয়া ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে কি? কলকাতা শুনে তো মনে হয় না। কিন্তু কে জানে? হয়তো দিল্লিই জানে সবচেয়ে বেশি কিন্তু উচ্চবাচ্য করাটা সময়োপযোগী বলে মনে করছে না।
চুপ করে শিপ্রা ভাবতে লাগল– বাকি চিঠি পড়া স্থগিত রেখে। একরাশ চিন্তা একটা আরেকটাকে ঠেলে ফেলে কোনওটাই তার শেষ সীমানা অবধি পৌঁছয় না। শুধু একটু বেদনাবোধ তার হৃদয়-মনের গভীর অতলে বসে আছে। তার কোনও পরিবর্তন নেই। ওয়ান জার্ট কার্ট থিংক ইট আউট– বহুকাল ধরে সে জানে বিকিদিদের পক্ষে দেশত্যাগ করে কলকাতা চলে আসাটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কতকাল হয়ে গেল, কতবার সে অনুরোধ করেছে একবার দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে– দু দশ দিনের জন্য। সে নিজে যাবে স্থির করার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়াটা হয়ে গেল বটে কিন্তু সেটা পাহাড়পুর নয়, সেটা স্কটল্যান্ডের পাহাড়পর্বত, নদী হ্রদ। তার পর দীর্ঘ নীরবতা। আলস্য, জড়ত্ব।
আবার চিঠিখানা পড়তে আরম্ভ করল, অন্য এক জায়গা থেকে। লিখছে, প্রকৃত বিশ্বাসযোগ্য দেশের খবর দেবার মতো কিছুই নেই। সব পরস্পরবিরোধী। এবং সবচেয়ে মারাত্মক যে পাপ বিষ প্রত্যেকের দেহমনকে আচ্ছন্ন করে তাকে নির্জীব, ক্লীব করে দিচ্ছে সেটা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। কেউ জানে না, কার কপালে কী আছে? কোনও সন্দেহ নেই, এখন, এই মুহূর্তে দেশের পনেরো আনা লোক– মেয়েছেলেরাও পিছিয়ে নেই–লীগপন্থি। সত্য বটে এরকম সর্বব্যাপী আন্দোলন আমি ইতোপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তবু মনে ভয় জাগে- একাধারে ভাবালুতার উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন জড়ত্ব– এ দুটোর ভিতর জিতবে কোনটা যদি কখনও পরীক্ষা আসে।
শেষ কথা। বেশিরভাগ লোকের বিশ্বাস, লীগ-ইয়েহিয়াতে যদি সমঝোতা না হয় তবে পূর্ববঙ্গবাসী যে আন্দোলন আরম্ভ করবে এবং সেটাকে আয়ত্তে আনার জন্য জুন্টা যে দমননীতি প্রবর্তন করবে তার আন্দোলনটা সেই স্বদেশী যুগ থেকে আরম্ভ করে যে-ধারা বয়ে ইয়েহিয়াতে এসে পৌঁছেছে সেই সনাতন ধারা বয়েই চলবে, সেই প্যাটার্নই যুগধর্মের বর্ণে রঞ্জিত হয়ে স্বপ্রকাশ হবে মাঝে মাঝে কখনও-বা ভাষার জন্য, কখনও-বা ইউনিভার্সিটির উচ্ছলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে কয়েকটি নিষ্পাপ যুবক আত্মাহুতি দিয়ে শহীদ হবে; এবং ইয়েহিয়ার দমননীতিও সেই আলিপুর মামলার ফলস্বরূপ কয়েকটা দ্বীপান্তর ধরনের শাস্তি, জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস, হাঙ্গার স্ট্রাইকের সময় রবারের নল দিয়ে জোর করে গেলানো, কখনও-বা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ, গোপনে গোপনে কিছুটা উৎপীড়ন– এই প্রাচীন রাজকীয় পন্থাই অবলম্বন করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে-পন্থার সমান্তরাল হয়ে চলবে সেই সনাতন তোষণ-নীতি মোমেন খানদের সংখ্যা বাড়ানো হবে অকাতরে, স্পাই পোষা হবে অগণিত এবং অধুনা যে ছাত্র-আন্দোলন দ্রুতবেগে উগ্র হতে রুদ্রতর রূপ ধারণ করছে সেটাকে করায়ত্ত করার জন্য বিস্তর ছাত্র-স্পাইকে অকৃপণ হস্তে বিতরণ করা হবে দেদার কাঁচা টাকা, মাসিক মাইনে, তাদের ককটেল পার্টির জন্য কাপ্তাই ড্যামাবদ্ধ পরিমাণ নিষিদ্ধ পানীয় এবং সমান্তরাল পন্থায় সঙ্গে সঙ্গে সানন্দে সসম্মানে এগিয়ে যাবে এতাবৎ সরকার কর্তৃক পদদলিত, সমাজ কর্তৃক লাঞ্ছিত ভাড়াটে গুণ্ডার পাল– যেসব ভ্ৰষ্টমতি, দুষ্টবুদ্ধি, রাষ্ট্রদ্রোহী, পঞ্চনদবৈরী সম্প্রদায় সরকারের মেহেরবানি কদরদানি তাচ্ছিল্যভরে উপেক্ষা করে সদাশয় সরকারের প্যারাদের বদনমণ্ডলে আপন গণ্ডদ্বয় পূর্ণ নিষ্ঠীবন বিচ্ছুরিত করে লাঞ্ছিত করেছে তাদের পৃষ্ঠস্কন্ধমস্তকে সরকারি ফরমান মাফিক লগুড়াঘাত করতে করতে।
বোন শিপ্রা, বুঝতেই পারছ, এটা আমার ভাষা নয়। আমাদের পাশের গায়ের এক সরল গোসাঁইজিকে সেই দেশত্যাগী ভট্টাচার্য যাত্রাকালে একখানা চিঠি লেখেন। বেচারী গোসাঁই সেই চিঠি তোমার জামাইবাবুকে কাঁদতে কাঁদতে পড়ে শোনান।
সর্বশেষে ভশচায ইতোপূর্বেই যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেইটেই যেন প্রাণখুলে লিখেছেন, যেন গৌর গোসাঁইয়ের নরম বুকটি খান খান করার জন্য কিংবা যাবার বেলা সেটাতে হিম্মত ভরে দেবার জন্য। লিখেছেন, এক দরবেশ একদা আমায় বললে, খুদা-পাক্ সব শহরে এবং প্রতিটি জনপদখণ্ডে চার চারজন করে সাধুপুরুষ কুতুব (মিনার) বা স্তম্ভ রাখেন। সে দেশ, সে জনপদ তাদেরই দৃঢ়াত্মার ওপর নির্মিত। এ অঞ্চলে তুমি একজন, তোমার পিতা ছিলেন আর একজন। এঁরা স্বেচ্ছায় কদাচ, কুত্রাপি দেশত্যাগ করেন না। ভুবনেশ্বরের দৈবাদেশে যদি মাত্র একজনও দেশত্যাগ করেন তবে সে-দেশ, সে অঞ্চলের জনপ্রাণী কীটপতঙ্গ পর্যন্ত সমূলে বিনষ্ট হয়– সমূলস্তু বিনশ্যতি, মহতী বিনষ্টি–অন্য তিন মহাত্মা কুত্ত্বসহ। তুমি জানো– তোমাকে আর কী শেখাব সম্পূর্ণ গ্রাম যদিস্যাৎ খাণ্ডবদহনে ভস্মীভূত হয় তবে সর্বজনপূজ্য মহাকাল মন্দিরও নিষ্কৃতি পান না। দরবেশ ফারসিতে বলেছিলেন :
দাবানল যবে জনপদভূমি
দগ্ধদহনে দহে
কিবা মসজিদ, কবরসৌধ
প্রভেদ কিছু না সহে।
তুমি, গৌর, এ অঞ্চল ছাড়লে এর সর্বনাশ হবে।
তাই যাত্রারম্ভে তোমাকে সে-প্রস্তাব দিইনি।
গুরু সাক্ষী, তোমার আখড়া সাক্ষী, তার রাধামাধব বিগ্রহ সাক্ষী, আমি কস্মিনকালেও ভবিষ্যদ্বাণী করিনি। তবু একটা কথা বলে যাই, দীর্ঘ চব্বিশ বৎসর ধরে আমি নিরবচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তানে বাস করেছি, তার দৈনন্দিন পরিবর্তন, ক্রমবিকাশ, পতন-অভ্যুদয় সাগ্রহে লক্ষ করেছি। এরই ওপর নির্ভর করে আমার ভবিষ্যৎ দর্শন গণনা। এর সঙ্গে গণৎকারের ফলিত জ্যোতিষ গণনা পদ্ধতির কণামাত্র সাদৃশ্য সামঞ্জস্য তো নেই-ই, অপিচ ফলিত জ্যোতিষীর বাক্যাড়ম্বরসহ ভ্রান্তিমুক্ত ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করার মতো কোনওপ্রকারেরই শাস্রাধিকার আমার নেই।
জনসাধারণের বিশ্বাস, ঢাকার দরকষাকষি নিষ্ফল হলে পুব পাক রাজনীতি সেই প্রাচীন ধারা বেয়েই চলবে, হয়তো ঈষৎ দ্রুততর বেগে। সঙ্গে সঙ্গে দমন-নীতিও তার ধারা বেয়ে চলবে, হয়তো ঈষৎ উদ্দামতর বেগে, রূঢ়তর পরিমাণে। মোদ্দা কথা প্যাটার্নের পরিবর্তন হবে না।
সেখানে আমার বক্তব্য, না, অবশ্যই হবে।
প্রথম সম্ভাবনা : কলমের এক খোঁচাতে পুব পা যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চায় সেইটে রাতারাতি পেয়ে যাবে। এটা কিছু অভিনব ইন্দ্রজাল নয়। খুদ পাকিস্তানের জন্ম ও স্বাধীনতা কলমের এক খোঁচাতেই হয়েছিল। সে উদ্দেশ্যে কজন লোক, কী স্বার্থত্যাগ করেছে, শুনি? কজন নেতা কারাবরণ নির্বাসন গমন করেছিলেন বলতে পারো? এক সিলেটি খালাসি তার সরল ভাষায় বলেছিল, স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান অর্জন করলেন জিন্না সাহেব তার পাতলুনের ভাঁজ–ক্রিজ সমুচা চো রেখেই, ফাইভ ফিফটি ফাইভ ফুঁকতে ফুঁকতে। তিনি যদি গাঁধী নেহরুর মতো জেলে-ফেলে যেতেন তবে গোটা হিন্দুস্তানটাই তার কজাতে এসে যেত। অন্তত একথা তো সত্য যে, ইংরেজ অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে পাক রাষ্ট্র নির্মাণে সম্মতি দিল তখন হবু পাক নেতারা রীতিমতো সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছিলেন।… তার পর গেল তেইশ বৎসরের মধ্যে কলমের এক খোঁচাতে কী রত্তিপরিমাণ স্বাধিকার অর্জন করতে পেরেছে? সে প্যাটার্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবশ্য বলতে পারো, সেটা ১৯৪৭-এর প্যাটার্ন। তাই সই। আমার প্রতিপাদ্য ছিল গত তেইশ বৎসরের প্রচলিত প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। ইয়েহিয়ার কলমের এক খোঁচাতেই যদি স্বায়ত্তশাসন ভূমিষ্ঠ হয় এবং এ তথ্য সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য যে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁর সে সদিচ্ছাই ছিল- তবে আর যা বল, আর যা কও সোঁদরী কাষ্ঠের লাঠি আপাদমস্তক নিষ্প্রয়োজন। আমার ইয়ার মৌলবি সাহেবের জবানে, বিলকুল বেকার, বেফায়দা ফজুল! এটা বললুম, নিতান্ত কথাপ্রসঙ্গে।
বিকল্পে যদি তা না হয়, তবে ঈশ্বর রক্ষতু। তখন যে দমননীতির বজ্রপাত হবে সেটাও সেই মান্ধাতার আমলি টিয়ার গ্যাস ছেড়ে হেথা হোথা বন্দুকের গণ্ডা কয়েক ফাঁকা আওয়াজ মেরে, দু দশ জনকে শহীদ পর্যায়ে উত্তোলন করে পুনরায় সেই প্রাচীন প্যাটার্নের অনুকরণ করবে না। (খুদাতালার দোহাই, এঁরা আমার নিত্যপ্ৰাতঃস্মরণীয়) এটা হবে সম্পূর্ণ অভিনব, অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য, অতুলনীয়। যদিও-বা কলমের এক খোঁচায় স্বরাজ দানের উদাহরণ আমাদের কারও কারওর স্মরণ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, কিন্তু এই সিলেটে তথা পূর্ববঙ্গে দমননীতির চরমতম বীভৎস বিভীষিকার প্রকাশ তো আমাদের স্মৃতি মন্থনে প্রভাসিত হচ্ছে না। অম্মদেশীয় সাতিশয় নগণ্য সংখ্যক দু একজন মাত্র জানেন যে আমাদের সমসাময়িক কালেই বহু দূরের এক সভ্য দেশে অভূতপূর্ব এক নবীন প্যাটার্ন বুনেছিলেন বহু, বিচিত্র প্যাটার্নের সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ইতিহাসের এক অত্যুভূত অলিম্পন ডিকটেটর হিটলার। কজন জর্মন কল্পনা করতে পেরেছিল যে লুথার, কান্ট, গ্যোটে, বেটোফেনের মতো চিন্তাশীল, রুচিবান দেশে হঠাৎ এমন এক সৃষ্টিছাড়া কিং-নর আবির্ভূত হয়ে মাতৃভূমির সর্ব ঐতিহ্য সর্বসাধনার ধন লণ্ডভণ্ড করে এমন এক নৃশংস নিপীড়ন, সর্বব্যাপী নিধনযজ্ঞ প্রজ্বলিত করবে যে তার তুলনার জন্য মানুষকে এ যুগ ছেড়ে যেতে হবে চেঙ্গিস-আর্টিলার সন্ধানে
আর ভুলো না গোসাঁই, হিটলার যুদ্ধজীবী ছিল না। তার উভয় কুল অসামরিক। সে নিজে চিত্রকর। এখানে ইয়েহিয়া, তার মন্ত্রণাদাতা, তার আদেশ বহনকারী সর্বভূতে আছে মাত্র একটি ভূত– তেজস, অগ্নি, রণাগ্নি। এদের প্রত্যেককে তুমি ফৌজাবতার নাম দিতে পারো। এমনকি ইয়েহিয়া হারেমের রানি, প্রধান রক্ষিতার জনসমাজে প্রচলিত আদুরে নাম জেনারেল রানি।
অতএব, যদিস্যাৎ কলমের খোঁচায় সমস্যার সমাধান না হয় তবে বিকল্পে কী হবে? সবাই ভাবছে সনাতন সঙ্গিনের খোঁচা। না। আমাদের সুদূর এই পাহাড়পুরেও খবর পৌঁছে গেছে ঢাকাতে কী পরিমাণ ট্যাঙ্ক জড়ো হচ্ছে এবং হবে। এবারকার প্যাটার্নে হিটলারের কীর্তিকে ইয়েহিয়ার বিস্ফোরক-চূর্ণ-ধূম্রে ম্লান করে দেবে, অষ্টাঙ্গ আচ্ছাদিত করে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে দেবে। ঈশ্বরের অভিসম্পাতে যদি এই বিকল্পই সাধিত হয়– আমি সন্ধ্যাহ্নিকের পর প্রতি রাত্রে আমাদের গুরু পির শাহজালালকে নতজানু হয়ে স্মরণ করিয়ে দিই, তিনি তার মাতৃভূমি আরব-ইয়েমেন ত্যাগ করে যেখানে এসে মুক্তিলাভ করলেন সে-দেশকে একমাত্র তিনিই রক্ষা করতে পারেন তবে আমি যে অনিশ্চিত আশ্রয়ের সন্ধানে যাচ্ছি, সেখানে হয়তো নিষ্কৃতি পাব না। তথাপি আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা ছাড়ব না, সুদিনের প্রতীক্ষায় দিন গুনব।
মহাত্মাজি পদ্ধতিতে যদি দেশের মনস্কামনা পূর্ণ হয় তবে সোঁদরী কাঠের লাঠি বেকার!
বিকল্পে হিটলার পদ্ধতির ট্যাঙ্ক-কামানের সামনে সোঁদরী কাঠের লাঠি বেফায়দা।
তুমি, তোমার পিতা গোস্বামী সমাজের উজ্জ্বল নীলমণির পুত্র এবং শিষ্য। আমি জানি, তাই তুমি ওপারে যাবার জন্য নিত্যনিয়ত প্রস্তুত; এখন এপারে থাকার জন্য প্রস্তুত হও।
আমার শেষ অনুরোধ—
চিঠিটি অসমাপ্ত। বিস্তর দারুণ ইনটারেসটিং বইয়ের শেষ কখানা পাতা ছিল না বলে বালিকা শিপ্রা কতবারই না নিষ্ফল আক্রোশে গর্জন করেছে। প্লটটা কী সুন্দর সাজানো, ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত কী অদ্ভুত অথচ বাস্তব, চরিত্রগুলো রহস্যের কুহেলিকাচ্ছন্ন সত্ত্বেও পাত্র-পাত্রী সুস্পষ্ট পাতা কটির অভাবে অকস্মাৎ সবাই একসঙ্গে কর্পূর হয়ে গেল। কত কাল চলে গেল তার পর। এখন আর সে-অনুভূতির উদয় হয় না। মসিয়য়া পোওয়ারো বা দি সেন্ট অসমাপ্ত রেখেই, ফরাসি কায়দায় কাঁধে শ্রাগ্-এর সামান্য ছোঁওয়া লাগিয়ে বিলিয়ে দেয়।
জাল আবার এল সেই প্রাচীন দিনের অনুভূমি। অসমাপ্তির নিবিড়ঘন নৈরাশ্য– আক্রোশ দূরে থাক, ক্ষোভেরও শেষ রেশ সে-নৈরাশ্যে ঠাই পায়নি। যে লোকটি প্রতি শব্দে, প্রতি ছত্রে, প্রতি দরদি কথায় শিপ্রার চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়ে স্বপ্রকাশ করতে করতে তার সম্পূর্ণ আপন-প্রিয় হয়ে গিয়েছিল সে হঠাৎ কোন অদৃশ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এ যে মরণেরও অধিক মরণ। এ বড় অন্যায়, কঠিন অবিচার।… বিলকিসও এই আকস্মিক অসমাপ্তির ওপর কোনও মন্তব্য করেনি।…আজ কোথায় এই জনপদ স্পষ্টবক্তা, সত্যদ্রষ্টা! হঠাৎ শিপ্রার সর্বাঙ্গ ভয়ে শিউরে উঠল। হিটলারের আগমন ও ফলস্বরূপ শাশ্বত রাষ্ট্রাদৰ্শবৈরী শ্মশান-ধূম্রে গঠিত পৈশাচিক তৃতীয় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন শিপ্রা জয়ী ভটচাযের মতো সামান্য যে কটি জর্মন বিধিদত্ত দিব্যদৃষ্টি দ্বারা দেখতে পেয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই প্রাণ দেন সূক্ষ্ম দৃঢ় তারে ঝুলতে ঝুলতে ক্রমে ক্রমে নিরুদ্ধ নিশ্বাস হতে হতে। কসাই যে রকম হুক-এ ঝুলিয়ে রাখে শূকর বাছুরের মৃতদেহ, এদের নগ্ন শবও হিমঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন শত্রু-মিত্র সর্বজনের দর্শন ও শিক্ষা-দানার্থে।
প্রক্রিয়ার পূর্ণ ফিলম্ হিটলার প্রতি রাত্রে ডিনারের পর সবান্ধব আদ্যন্ত দেখতেন, আপন প্রাইভেট সিনেমা হলে।
.
১০.
নির্জীব কণ্ঠে কীর্তি বললে, শুনেছ, শিপ্রা?
শিপ্রা উঠে গিয়ে কীর্তির দু জানুর উপর কোলে বসে ডান হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে, বাঁ হাত দিয়ে তার মাথা বুলোতে বুলাতে বললে, কিছু কিছু শুনেছি বইকি? আজকাল বিদেশি বেতারগুলো– কাপুরুষ, মিন, ইতর, কী গাল দেব ভেবে পাইনে,- একটু একটু সাহস সঞ্চয় করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তোমার মুখে শোনা সে তো ভিন্ন–
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কীর্তি বললে, শুনে কোনও আনন্দ পাবে না। সব খবরই দুঃখের। একটিমাত্র খবর আমাকে এই নৈরাশ্যের মধ্যে মাঝে মাঝে আশার আলোক দেখায়। সুন্দরবনের পাশ থেকে হাসনাবাদ, যশোর হয়ে সীমান্তের যতখানি কাছে যেতে দেয়– গিয়েছি ভগবানগোলা, পদ্মার ওপারে পুব বাঙলার সারদা পুলিশ কলেজ, আইয়ুব ক্যাডেট কলেজ- দুটো জায়গাতেই হারামিরা হানা দিয়ে পুলিশকে খুন করেছে। ভাগ্যিস, ক্যাডেট কলেজের বাঙালি প্রিনসিপ্যালে ঝাণ্ডু ঝাণ্ড পলিটিশিয়ানদের বহু পূর্বেই অশথ গাছের মগডালের কাঁপন থেকেই কালবৈশাখীর পূর্বাভাস ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছিল বলে মিঞাজি ছেলেদের আপন আপন বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরাই হারামিদের চার নম্বরি শিকার–
চার নম্বরি মানে?
অস্ত্র ব্যবহার যারা জানে, তারা ওদের শিকার। পয়লা নম্বর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি– এরাই ৬৫-র যুদ্ধে লাহোর বাঁচিয়েছিল এবং যত সব বড়ফাট্টাই করনেওলা পাঞ্জাবি পাঠান বলে তারা রণবীর, যোদ্ধার জাত, মার্শাল রেস, এদের সব্বাইকে ঢিড দিয়ে পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি মেডল আর ডেকোরেশন। তার প্রতিদান স্বরূপ এইসব প্রাণরক্ষকদের যেখানে মেডলের ঝোলে সেখানে ঢুকিয়েছে বজ্র-বুলেট, ইয়েহিয়া মেডল– আইয়ুব মেডলের জায়গায়। দুই নম্বর : ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এরা সশস্ত্র পুলিশ। রাইফেল চালাতে জানে, ব্যস। তিন নম্বর : সাধারণ পুলিশ, যাদের কেউ কেউ একটু-আধটু বন্দুক চালাতে পারে। এগুলোর কথা আমরা আগেই শুনেছিলুম। এবার এসেছে চার নম্বর : যে-কটি ক্যাডেট পুব বাঙলায় আছে তাদের ছাত্র এবং প্রাক্তন ছাত্র এরাও কিছুটা রাইফেল চালাতে জানে। এদের বেশকিছু ছেলে–কত আর বয়েস হবে, ষোল-সতেরো– পদ্মা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এসে এখানে ওখানে জড়ো হয়েছে। একটি ছেলে– কী বলব, শিপ্রা, সে কী লাবণ্যভরা মুখ, আর সর্বক্ষণ চোখে মুখে হাসি লেগেই আছে, আমার কান্না পেল, বয়স তার চোদ্দ হয় কি না হয়!
শিপ্রা কেমন যেন অজান্তে কীর্তির কোল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মনে পড়ল, ভট্টাচার্য তার বন্ধু গোস্বামীকে লিখেছিলেন, এবারকার প্যাটার্ন যাই হোক না কেন, সেটা হবে সম্পূর্ণ অচিন্ত্যনীয়। নইলে চোদ্দ বছরের বাচ্চা–? না তো, অভিমন্যুর বয়স কত ছিল? মনে আনতে পারল না শিপ্রা।
কীর্তি যে ছিন্নালিঙ্গন হয়েছে সেটা সে লক্ষই করেনি। গলাতে একটু জোর দিয়ে বলে যেতে লাগল, তোমাকে শক্ত হতে হবে শিপ্রা, এ ছাড়া অন্য গতি নেই। এখন শোনো। আমরা সেই চোদ্দ বছরের ছেলেটিকে মোটরে তুলে নিয়েছিলুম। কথায় কথায় বললে, যেন তেমন বলার মতো কিছু নয়, জাসটু এমনি, কে যেন কাকে খেয়া নৌকোয় বলছিল, ২৫শে ছিল বিষ্যুৎবার–।
শিপ্রা বললে, হ্যাঁ, ২৭শে মুহররম্ ছিল ওইদিন। পরদিন অমাবস্যা। ইসলামি পঞ্জিকা পড়ে পড়ে তার সবকিছু সড়গড় হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মুহরর যে শুদ্ধ উচ্চারণ সেটাও শিখেছে ওই পঞ্জিকার মেহেরবানিতে। বললে, পরে বুঝিয়ে দেব।
কীর্তি বললে, শনিবার দিন সকালে ঢাকাতে কারফু ছিল না। এক ভদ্রলোক বেরিয়েছেন তার বন্ধুর সন্ধানে। সে বন্ধু থাকেন যে-পাড়ায় তার পাশের বাজারটা আগের দিন ভোরে হারামিরা পুড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে তার সন্ধান না পেয়ে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন সেই পোড়া বাজারের একপাশে। এমন সময় একটা ছোট্ট বাচ্চা, মা, মা বলে ডেকে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা পার হতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছে– এমনিতেই সে ভালো করে চলতে শেখেনি তার ওপর দু চোখ জলে ভরে যাওয়াতে কিছুই ঠিক ঠিক দেখতে পারছিল না। রাস্তার ওপার থেকে এক বুড়ি ভাঙা গলায় ডাকছে, ওরে দুলাল, ও দুলু, আয় এদিকে আয়। দেশের স্বাভাবিক অবস্থায় ভদ্রলোক হয়তো কিছুই লক্ষ করতেন না। এখন কিন্তু শুধালেন, কী হয়েছে? বুড়ি, পরশুদিন ওর বাপ রিকশা চালাতে বেরিয়েছিল; এখনও ফেরেনি। রোজ রাতদুপুরে ফেরে। সে-রাতেই তো চাদ্দিকে গোলাগুলি চলল। ভোরের দিকে বাচ্চাটার মা রাস্তা পেরোচ্ছিল জল আনতে, এমন সময় কোত্থেকে একটা মিলিটারি গাড়ি এদিক দিয়ে জোর হাঁকিয়ে যাচ্ছিল। থমকে দাঁড়াল। বউটাকে গোটা তিনেক সেপাই একটানে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল, আমি রাস্তায় পৌঁছতে না পৌঁছতে। দেখলাম গাড়ি বোঝাই অল্পবয়সী অনেকগুলি মেয়েছেলে। মোল্লাজির কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লুম– আমার ছেলে-বউয়ের খবর নেবার তরে। তিনি বললেন, মেয়েগুলোকে ছাউনিতে নিয়ে গিয়েছে। ওরা আর ফিরবে না–
শিপ্রা এতক্ষণ কীর্তির মুখোমুখি টান টান খাড়া হয়ে সব শুনছিল। আস্তে আস্তে ডান হাত মুঠো করে, শক্ত– আরও শক্ত চাপ দিতে লাগল। নখগুলো বুঝি তেলোতে ঢুকে যাবে। বাঁ হাত দিয়ে ডান মুঠো জোরে চেপে ধরল। ডাইনে-বাঁয়ে সে অল্প অল্প টাল খেতে শুরু করেছে। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গিয়েছে, মেলে যাওয়া চোখ দৃষ্টিহীন, কীর্তির চোখের মণি ভেদ করে মহাশূন্যে বিলীন। কীর্তি দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি তার কোমর ধরতে গেছে। শিপ্রা তাকে নিরস্ত করে শুধাল, তুমি মনস্থির করেছ তুমি কী করবে?
অতিশয় শান্ত কণ্ঠে কীর্তি বললে, সে তো আমি আগরতলাতেই করেছি, তুমি জানো। তবে হয়তো আমার অজান্তে লারির কুচক্রের ব্যাখ্যান শুনে আমার মন বিরূপ হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। এ কী ঔদ্ধত্য! নিরীহ পুব বাঙলার লোককে নিয়ে তোমরা বন্দুকের জোরে যা-খুশি করতে পারো?
শিপ্রার চট করে মনে পড়ল, বহুদিনকার ভুলে যাওয়া একটা ঘটনা। খান তাকে বলেছিল, ওই যে আমার ক্যাবলা শান্ত কীর্তিকান্ত– ওর মতো নিঝঞ্ঝাটে প্যালারাম এ দুনিয়ায় খুঁজতে হলে শকুন্তলার আশ্রমে-ফাশ্রমে যেতে হয়। মাত্র একটিবার একটা ব্যত্যয় ঘটেছিল– কেউ যদি দোসরা একটা বলতে পারে, আমি হাজার টাকা দিতে রাজি। বার আসিয়াতিকের টাকার কুমির মালিক খোট্টা ফোট্টা হবে– খামখা, অন্তত কীর্তির বিশ্বাস, বিলকুল বে-কারণ, খামখা, ঠাস করে চড় মেরেছিল এইটুকুন একটা বয়কে। কীর্তি প্রথমটায় কিছুক্ষণ ধরে চিন্তা করল। তার পর আমাদের কিচ্ছুটি না বলে মালিকের সামনে কী যেন ফিসফিস করল। মাইন্ড ইয়ু–আগাপাশতলা সাদা চোখে। মালিক ব্যাটাও কুল্লে দুনিয়ার মতো জানত, কীর্তিকান্ত সাতিশয় কর্মে ক্লান্ত শান্তশিষ্ট প্রাণী। সেই হল তার ব্যাকরণে ভুল। যেমন গুণ্ডাকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করা যায়, তেমনি শান্ত স্বভাবকে বস করতে হয় শান্ত স্বভাব দিয়ে। সে কীর্তির দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কী যেন একটা বলল। সঙ্গে সঙ্গে কীর্তি ঠাস ঠাস করে মালিককে মারল দুটো চড়। হৈহৈ রৈরৈ। পুলিশ এল। মালিকের বক্তব্য, হোটেল বার-এ যে কোনও ব্যক্তি আইন প্রয়োগ করার ভার আপন স্কন্ধে নিয়ে টেকিং ল ইন হিজ ঔন হ্যান্ড ভায়োলেন্ট অ্যাকশন নেয় তাকে সে বার-থেকে বের করে দিতে পারে। কীর্তির বক্তব্য, বয় যা করে থাকুক না কেন, মালিক আইন প্রয়োগ করার ভার আপন স্কন্ধে নিয়ে ভায়োলেন্ট অ্যাকশন করেছে– প্রথম– কীর্তির আগে। অতএব সে বার ছেড়ে বেরিয়ে যা। কে যেন মাফ চাইবার প্রস্তাব করাতে কীর্তি তাকে লাগায় তাড়া।… শেষটায় মোকদ্দমায় কীর্তির জরিমানা হয়। আর মালিককে জজ ভবিষ্যতে সাবধান হওয়ার জন্য ওয়ার্নিং দেন। পরদিন থেকে কীর্তি তিন বেলা ওই বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। এশিয়ান বার-এ কীর্তির প্রবেশ নিষেধ এ হুকুম আদালত দেননি। হনুমান লঙ্কায় ন্যাজ পুড়িয়েছিলেন বলে তাকে কি আর ফিসে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি? কীর্তি মালিকের ওপর কড়া চোখ রাখে, আর মাঝে মাঝে নোটবুকে কী সব টোকে। মালিকের প্রাণ অতিষ্ঠ। তার শেষ আশা, কীর্তি এ কর্ম কতদিন চালাবে? ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে। উঁহু। ঠিক উল্টো। প্র্যাকটিসের ফলে অভ্যাস। অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় সে তিন বেলার ম্যাদ আরও বাড়াতে লাগল। মালিক বেয়ারা বয়কে ভালো করে শাসন করতে পারে না, মালিক চোখ রাঙালেই দেয়ালঘড়ি থেকে টাইমটা নোটবুকে কীর্তি টুকে নেয়– চড় মারার বাসনা মালিকের মাথায় উঠেছে। চাকরবাকরের পোয়াবারো। তাদের শাসন করলেই তারা এক ঝলক কীর্তির দিকে তাকায়। কীর্তি নোটবুক খোলে।… শেষটায় মালিকই হার মানল। মাফটাফ কী যেন, মনে নেই।
খান যদিও শিপ্রাকে বার বার বলেছিল, সবাই তখন কীর্তি যে আন্ডার ডগ-এর তরে মালিককে চড়, সরকারকে জরিমানা দিল, তার জন্য পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছিল, তবু শিপ্রা লক্ষ করেছিল ঘটনার অন্য আরেকটা দিক– সেটা কীর্তির ধৈর্য। ক্ষণতরে উত্তেজিত হয়ে চড় মারা, জরিমানার খেসারতি দেওয়াটা বিরল নয়, কিন্তু দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে স্বেচ্ছায় একটা রুটিন মেনে চলা বঙ্গসন্তানের পক্ষে যে কী গব্বযন্তনা সেটা শিপ্রা জানে– নইলে যে-বাঙলা সাহিত্যে সবকিছু আছে সেখানে নিত্যদিনের সহজ কর্ম ডাইরি-লিখন এবং তার থেকে যে ডাইরি-সাহিত্য গড়ে ওঠে– ইয়োরোপে যার ছড়াছড়ি– সেটা একদম নেই কেন?
আজ পূর্ব বাঙলার সাহায্যে দেবার মতো যে বিল ধাতু কীর্তির আছে, সেটা তার ক্লান্তিহীন, নিরবচ্ছিন্ন, অতন্দ্র ধৈর্য। সবুর সে করতে জানে; মেওয়াও সে চায় না।
কীর্তির চেয়েও আরও শান্ত কণ্ঠে শিপ্রা বললে, কোনওপ্রকারের অত্যাচারই তুমি বরদাস্ত করতে পারো না, সেটা আমি অনেক আগেই জানতুম আর আমাকেও এটা কতখানি পীড়া দেয়, সেও তুমি জানো। এছাড়া তোমার অন্য কোনও কারণ আছে?
কীর্তি খানিকক্ষণ চুপ করে ভেবে নিয়ে বললে, পুর্ব বাঙলার পাশে গিয়ে পশ্চিম বাঙলার দাঁড়ানোটা আমার কাছে এতই স্বতঃসিদ্ধ যে নিজের জন্য আমি কোনও যুক্তি, ঐতিহাসিক নজির বা আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের সমর্থন খুঁজিনি। তবে সেদিন খানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ল একজন লোকের কথা। কপাল আমার মন্দ; একদা বাধ্য হয়ে অধ্যয়ন করতে হয় আমাকে, আন্তর্জাতিক আইন। এ বিষয়ে বহু দেশের বহু আইনজ্ঞ বিস্তর গ্রন্থ লিখেছেন; তদুপরি ছিলেন জিনিভা কনভেনশন, সাধনোচিত ধামে গত, লিগ অব নেশনস্, আছেন জীবতের চেয়েও অধম সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জ–
ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক,
তাহার তরে মিথ্যা করা শোক,
কিন্তু যখন বলে জীবন্ত
সেটা শোনায় তিতো।
এবং এমনই নোংরারকমের তিতো শোনায় যে কবি স্বয়ং পুস্তকাকারে ছাপার সময় এ লাইন কটি বাদ দেন। সে-কথা থাক্। আন্তর্জাতিক আইন শব্দদুটো শুনলেই আমার তেতো হাসি পায়। বড়ম্বরপূর্ণ স্ফীতোদর-এর ধারাগুলো নির্মিত হওয়ার বহু আগের থেকেই হোমরাচোমরা রাষ্ট্রগুলো সেগুলো তো ভেঙেছেই, নির্মিত হব-হচ্ছি হব-হচ্ছি। যখন করছে, তখনও এগুলো মদমত্ত উদ্ধত পদাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বার বার প্রমাণ করেছে এর ভারিক্কি ভারিক্কি ধারা-উপধারা সব পেপার টাইগারস, এগুলোতে বিশ্বাস করার ভান, ভক্তির ভণ্ডামি দেখায়, একমাত্র নপুংসক, পদলেহী, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল কতগুলো রাজনৈতিক যারা আপন আপন দেশের জনসাধারণের স্বীকৃতি না পেয়ে ওইসব অস্তিত্বহীন আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে অনেকটা নেই-ভূত খেদানেওলা ওঝার আগড়ম-বাগড়ম বিড়বিড় করে ইউনাইটেড নেশন্সের পবিত্র জর্ডনজলে বাপ্তিস্ম হয়ে আপন আপন দেশে ফিরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট, ডিকটেটররূপে স্বৈরতন্ত্রের অবাধ অত্যাচার-অবিচার চালায়– সুন্দুমাত্র টিকে থাকার জন্য। তাদের জন্য প্রতি মাসের টায় টায় পয়লা তারিখে আসে বন্দুক কামান, রোক্কা #পেয়া তনখা বৃহৎ-বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যারা এইসব রাষ্ট্রপ্রধানদের মারফত তাদের দেশগুলোকে শোষণ করে প্রতি মাসের পয়লা তারিখে, বাড়িউলি ও ভাড়াটিনীদের কাছ থেকে এতখানি টায়-টায় তার অতিশয় হক্কের পাওনা অষ্ট-গণ্ডা, ন-সিকে পায় না। পুতুল রাজার পাল আর তাদের মনিব দু দলই প্রতিদিন দুই কায়দায় দুনিয়াটাকে শুনিয়ে দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন –ফোঃ! ছোঃ!
শিপ্রা জানালা দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে পার্কের নিরস ঘাসের দিকে তাকিয়ে নির্জীব কণ্ঠে বললে, আমারও সেঁতো, তেতো হাসির সঙ্গে বেরিয়ে আসছে সেই প্রবাদপ্রায় তত্ত্বকথাটি, তোমারই ভূতের মতো উল্টো পা চালিয়ে, কাদম্বিনী বাঁচিয়া প্রমাণ করিতেছে, সে বাঁচে নাই।
কীর্তি বললে, তাই সুর মিলিয়ে গাইতে প্রাণ চায়, মাধবী, বাঁচিবে কি মরিবে কি? দ্বিধা কেন? কিন্তু নিদারুণতম তত্ত্ব, মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাশ হতে হয়, শিপ্রা, যখন সেই লোকটির কথা স্মরণে আসে, যার কথা খানকে বলছিলুম। হল্যান্ডের হুগো গ্রটিয়ুস, একাধারে বহুবিষয়ে পণ্ডিত, বিশেষ করে ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রে অর্থাৎ জুরিসপ্রুডেনসে অসাধারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিটির সম্বন্ধে কমিয়ে-সমিয়ে বলতে গেলেও আস্ত একটা দিন কেটে যাবে। ভাবো দিকিনি সেই কোন ১৬২৫-এর কাছাকাছি একসময়ে এই লোকটি নির্বাসনে, প্যারিসে প্রকাশ করেন যুদ্ধ ও শান্তিবিষয়ক আইন-কানুন। সেই আমলে লোকটি স্বাধীন মতবাদ প্রচার করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন স্বদেশে। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তাঁর ছিল আর একটি লুকনো গুণ, যে-সম্বন্ধে কড়া দণ্ডধর জেলার এবং অন্য সর্বজন ছিলেন তিমিরান্ধকারে তাঁর নিপুণ চতুরতা। তাই দুই বছর যেতে না যেতে এটিয়ুস হল্যান্ডের জেল থেকে পালিয়ে, যখন, সে-দেশময় হুঙ্কার উঠেছে, ধরো ধরো পাকড়ো পাকড়ো তারি মাঝখান দিয়ে, নিজস্ব চতুরতা প্রসাদাৎ দিব্য স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে প্যারিসে পৌঁছিলেন। ফ্রান্সের রাজা সসম্মানে তাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রাখেন। আজও সে-রাজা গুণীজনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন।
আন্তর্জাতিক আইনে বিশ্বাস করো, আর নাই-বা করো ঘটিয়ু তার জন্মদাতা বলে আজ সর্বত্র স্বীকৃত। তাঁর যেসব বিধান তখনকার গুণী-জ্ঞানীদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল আজও সেগুলো বহুলোককে বিস্মিত করে, এবং নিশ্চয়ই বিগ ইয়েহিয়া এবং জুন্টার বিগার কর্ণে বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপবৎ শোনাবে।
সর্বপ্রথম তিনি বলছেন, মানুষে মানুষে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, নেশনে নেশনে তাই হবে। ব্যক্তিবিশেষ অন্য ব্যক্তির অনিষ্ট করলে যেরকম তাকে দমন করা হয়, ঠিক সেইরকম একই মাপকাঠি দিয়ে বিচার করতে হবে এক নেশন অন্য নেশনের অনিষ্ট করছে কি না, যদি করে থাকে তবে সে নেশনকে দমন করতে হবে। এ কথাগুলো নীতি হিসেবে অনেকেই মেনে নেবে। অবশ্য ভণ্ড মুচকি হাসিসহ।
কিন্তু এর পরই তিনি যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, যে ব্যবস্থা অবলম্বন বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছেন সেটা আজ যদি ইউনাইটেড নেশনসে কেউ প্রস্তাব করে তবে প্রভু খ্রিস্টের ন্যায় তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। দুই নেশনে যদি লড়াই লাগে তবে ছোট-বড় কোনও নেশনই নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না, সে হক্ক তার নেই।
শিপ্রা আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কী? সব নেশনকে নামতে হবে লড়াইয়ে?
উৎসাহিত হয়ে কীর্তি বললে, ঠিক ধরেছ, গুরু। আমিও প্রথমটায় আমার চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি তো বাংলায় বললুম নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। আসলে এটিয়ুস ব্যবহার করেছেন, নন্-বেলিজারেট হতে পারবে না, অস্ত্র সংবরণ করে থাকতে পারবে না– তিনি সজ্ঞানে নিউট্রেল শব্দটি এড়িয়ে গেছেন, সে তো তিনি কাউকেই থাকতে দেবেন না। ওই যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া বশত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে নেশনের সামান্যতম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তাকেও দোষী নেশনকে সাজা দেবার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হবে।
সাজা দেবার জন্য!
হ্যাঁ, সুদ্দুমাত্র কড়া শাসনের শাস্তি দেবার জন্য। তাতে করে সে-রাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধি পেল কি না, আখেরে তার ক্ষতির পরিমাণটা কী দাঁড়াবে– এ সমস্ত কুটিল অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা সম্পূর্ণ অবহেলা করে।
শিপ্রা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। কীর্তির একটা হাত তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে আপন কপালে থাবড়া মেরে বলল, হায় রে কপাল! সাড়ে তিনশো বছর হতে চলল ভদ্রলোকের কোন প্রস্তাবটা কে মেনেছে? কোন রাষ্ট্র আজ জানে না, পুব বাঙলায় আজ কী হচ্ছে? মাত্র ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্র বাকি দু জনা আগের থেকেই হাত গুটিয়ে আরাম করছিলেন তারই প্রধানমন্ত্রী ঘাড় ফিরিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন যখন হাহাকার রব উঠেছে অস্ট্রিয়ায়, তার কাতর আর্তনাদ ধেয়ে চলেছে লন্ডন পানে ধর্ষণ করছে তাকে গুণ্ডা হিটলার!… কে বলে নির্লজ্জতারও একটা সীমা আছে? বছরটা ঘুরলো কি না, পড়ি মরি হয়ে এবার ছুটল সেই সৌন্দৰ্যামোদী গোরা রাজ–চেকদের স্বহস্তে যূপকাষ্ঠে আবদ্ধ করার জন্য যাতে করে পিশাচ পূজোর পুরুত হিটলারের এক ঘা-তেই পটপট করে সারি বেঁধে সবকটা মুণ্ডই থাক।
কীর্তি একটু চিন্তা করে বলল, হিটলারের কীর্তিকাহিনী পড়লে শিউরে উঠতুম একদিন। এখন মনে হয় বেচারীর শেষ সান্ত্বনাটুকুও গেল।
মানে?
সাধনোচিতপ্রাপ্ত ধামে বসে সে অন্তত একটা গর্ব অনুভব করত যে, এ যুগে সজ্ঞানে তার মতো নিষ্ঠুরতা আর কেউ দেখাতে পারেনি। পঁচিশের পৈশূন্য-রাত্রে, ইতোমধ্যে বাঙালির মরণকামড় খেয়ে সেখানে ইয়েহিয়ার বেশ কটি চেলা হিটলারের সঙ্গ পেয়ে হাইল হিটলার পাকিস্তান জিন্দাবাদ সম্ভাষণান্তে দু দণ্ড রসালাপ করতে বসে গেলেন। যথাভ্যাস, হিটলার কাউকে মুখটি খোলর মোকামাত্র না দিয়ে তাঁর গৌরবময় দিনের মনিকি কায়দায় বলে যেতে লাগলেন, গ্যাস চেম্বার তার চেয়েও সস্তায় মানুষ খতম করার ইনজেকশন আবিষ্কার, ইহুদি রমণীদের কুন্তলদাম দিয়ে মোলায়েমতম তাকিয়াকুশন নির্মাণ, লাশের নীল উল্কিতে চিত্রবিচিত্র চামড়া দিয়ে তৈরি ল্যাম্পশেড– ওহোহো! সেগুলো কী অপূর্ব আলো-ছায়ার আলিম্পন ঘরের সর্বত্র বিচ্ছুরিত করে দিত।
বাধা দিয়ে এক পাঠান বললে, খাবসুরত নয়ি নয়ি চিজের বাই যদি তুললেন, তবে, আমার মনে হয়, হুজুর, গৃহস্থঘরের উচ্চ কুচ বিশিষ্টা… হঠাৎ কীর্তি থেমে গেল।
শিপ্রার তিক্ত মুখ কীর্তি ইতোপূর্বে আর দেখেনি। বললে, এখনও লজ্জা! ভয় তোমার গেছে, জানি, কোনওকালেই খুব-একটা ছিল না। ঘৃণাটা আমাদের কখনও যাবে না। তোমার সম্মুখে যে কঠোর কর্তব্য উপস্থিত সেখানে সহকর্মী সংগ্রহ করার জন্য তোমাকে লজ্জাশরম সম্পূর্ণ বর্জন করে স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই বলতে হবে হীনতম অশ্লীলতম আচরণের কথা।
কীর্তি নীরস কণ্ঠে : পাঠান বললে, আমরা জনাদশেক একটা কলেজের মেয়েকে ধর্ষণ করার পর মেয়েটা আমারই নিচে খাবি খেতে লাগল। বেহুশ হওয়ার আগে পানি পানি বলে গোঙরাচ্ছিল, আধমরা গলায় আস্তে আস্তে ইয়া আল্লা! ইয়া রসূল! আরও কী কী সব বিড়বিড় করছিল, আমি জানিনে ওসব, কিন্তু ডেরা ইসমাঈল খানের মৌলবি সাহেবের জবানে শুনেছি। তার পর হাত-পা খিচতে খিচতে হঠাৎ চোখদুটো ইয়াব্বড়া তাম্বুর মতো খুলে গেল। দেখি, চোখের কালো মণিটনি কিচ্ছু নেই, একদম সাদা চোখদুটো জড় ছিঁড়ে ফেলে সমুচা উল্টে গিয়ে ভিতরের দিকটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে আমাদের সর্দারকে ফাঁসি দেওয়ার পর লাশে অ্যাসা চোখ দেখেছিলুম– মার্বেলের মতো ধবধবে সাদাতে কিন্তু রক্তের ছিট গোলাবি রঙ ধরে তার পাকা আপেলের গোলাবি গালের মতো হয়ে গিয়েছিল। তখন গালদুটো হলদে রঙের পুঁজ মাফিক–আলবৎ তখন না, যখন সে ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল আপন জান নেবার জন্য আর আমরা নিচে তখন তৈয়ার ছিলুম ওকে পাকড়াবার জন্য। আরও কত পড়ল, আমরা গপাগপ পড়ার আগেই ধরে নিলুম। জ্যায়সাকে পাক্কা মেওয়া। হিটলার সাহেব, কী বাতাই আপকো। সবসে খাবসুরত দেখলুম, লাল খুন তার দুধের মতো সফেদ উরুর উপর– ওয়াহ, ওয়াহ্। সবকুছ আমার পির সাহেবের মেহেরবানিতে।… কিন্তু, হুজুর, জওয়ান ঔরটা বড়া বেতমিজ ছিল। কুছ না– অচানক দম বন্ধ— ছটসে মরে গেল। আমাদের শের দিল খান গয়রহ তিন বেরাদর তখনও বাকি। লেকিন ওরা পাক্কা মর্দ। জিন্দা-মুদাতে ফরক করনেওয়ালা পাঠানকা বেটা ওরা নয়। জঙ্গি খান একটা চোচির ডগা কামড়ে মুখে পুরল। আমি ছোরা দিয়ে দুসরাটা কেটে- অ্যাসা বড়া কভিভি দেখবার খুশ-কিস্মাৎ আমার জিন্দেগিতে হয়নি– পুরা সমুচা হাড্ডিতক কেটে আমার সঙিনের ডগায় খোঁচা দিয়ে সঙিন উঁচা করে ধরলুম। তার পর সব ভাই-বেরাদরের তালে তালে হাততালি শুনতে পেয়ে সঙিন উঁচা করে জুড়ে দিলুম মহরম মিছিলের নাচ আপনি, জনাব-ই-আলা হিটলার-সায়েব হয়তো জানেন না, মহরম আমাদের সবৃসে খাস, সসে পা মাস
আর তখনও চলছে মহরম। মেজর আসন খান আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, বড়া বড়হিয়া খেদমত করেছ পূরব-পাকিস্তানের কাফির লেড়কিকে খতম করে পাক্ মহরম মাসে। সোনার মেডেল পাবে। আমি সুপারিশি চিঠঠি আজই ভেজ দেব।
হিটলারের লাল গাল তখন হলদে। সর্বাঙ্গে কম্পন।
এমন সময় কে একজন কঠিনদর্শন অপরিচিত, ইউনিফর্ম-পরা অফিসার এসে উপস্থিত। সেটা হিন্দুর নরক, মুসলমানের দোজখ, খ্রিস্টানের হেল, ইহুদির গেহানেম, গ্রিকদের কলাসিস কোনও মুলুকেরই উর্দি নয়। পাঠানরা ঠাহর করতে পারছিল না, তারা কোথায় এসেছে। তবে এটা যে বেহেশত বা দোজখ কোনওটাই নয় সেটা বুঝে গিয়েছিল। হিটলার ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিলেন অত্যন্ত বিষণ্ণ বদনে।
অফিসার ডান হাত তুলে হাইল হিটলার সম্ভাষণ জানিয়ে শুধাল, আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? এ প্রতিষ্ঠানের দ্বারোদ্ঘাটনের সময় আপনিই ছিলেন প্রথম এবং একমাত্র সদস্য– যাকে বলে ফাউনডেশন মেম্বার। আপনি তকলিফ করে অন্যত্র যাবেন কেন?
হিটলার বিষণ্ণতর বদনে বললেন, আমি বিখ্যাত জর্মন গোষ্ঠীর একজন; কিন্তু আজ বড়ই লজ্জা পেয়েছি কতকগুলি আকাট, পাড় বর্বরের কথায়। আপনারা আমার সাধনোচিত ধাম নির্ণয় না করতে পেরে এই নবীন প্রতিষ্ঠানের পত্তন করেন। আমার কোনও আপত্তি নেই– কারণ ইহুদিদের জন্য আমিই এক নয়া নিধনাগার গ্যাস চেম্বার নির্মাণ করি। কিন্তু এই পাঠানদের সামনে আমাকে নিত্য নিত্য লজ্জা পেতে হবে, এটা আমার সইবে না। আমাকে বরঞ্চ ডিমোট করে নিম্নাঙ্গের যে কোনও অগ্নি পূরীষ কুণ্ডে পাঠান।
অফিসার বিস্মিত হয়ে শুধালেন, লজ্জাটা কিসের? আমি অতিশয় প্রাচীন সর্বাভিজ্ঞ অফিসার। আদম-ইভের প্রথম পাপ থেকে আরম্ভ করে হেন কোনও অতিশয় উর্বর মস্তিষ্কধারীর অচিন্ত্যনীয় কল্পনা-প্রসূত কোনও আচরণ দেখিনি– অপরাধ নেবেন না– যেটা আপনাকে লজ্জা দিতে পারে।
হিটলার বললেন, থ্যাঙ্কু! আমি গর্ব অনুভব করছি। কিন্তু শুনুন, আমি ফ্রানসকে পদানত করেছি, আরেকটু হলে আমার চেয়ে ঢের ছোট ক্যালিবারের চার্চিলকেও ঘায়েল করতুম, গ্যাস চেম্বার, অনেক নতুন নতুন উৎপীড়ন পন্থা আবিষ্কার করেছি সে নিয়ে আমার কোনও অহমিকা নেই। গর্ব, আত্মপ্রসাদ, দম্ভ, ঔদ্ধত্য ছিল আমার মাত্র একটি সামান্য, সঙ্কীর্ণ বিষয়ে যেটাকে হোমরা-চোমরা পলিটিশিয়ান, মিলিয়নের, রাজারাজড়া, বীরবীরেন্দ্র কেউই কণামাত্র সম্মান দেন না, বস্তুত অবহেলা, তাচ্ছিল্য করেন, এমনকি কৃপার চোখে দেখেন– সে বিষয় আর্ট। এ তাবৎ আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস ছিল, কলানৈপুণ্যে আমি কল্পনা পরীর পাখায় ভর করে যে সর্বোচ্চ গগনে উড্ডীয়মান হয়ে নব নব সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম উল্কট উৎকট দৈহিক মানসিক যন্ত্রণাদায়িনী পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলুম, সেগুলো মহাপ্রলয় পর্যন্ত মহামানবের অভাবনীয় গৌরব, বিশ্বমানবের অকল্পনীয় বৈভব হয়ে মহাপ্রলয় পর্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে আমার জয়ধ্বনি গাইবে। এই মাত্র আমার সে-বিশ্বাস নস্যাৎ হল। এখন শুনছি, দিক-দিগন্তব্যাপী টিঢিক্কার।… মহামূর্খ যে-পাঠানের না আছে সাহিত্য না আছে নাট্য, যাদের সঙ্গীত শুনে শিবাশগাল সোল্লাসে উপযুক্ত শিষ্যপ্রাপ্তির পরিতুষ্টিতে চিৎকারিয়া নব নব কর্ণপটহ বিদারিণী রাগ-রাগিণী দ্বারা বনস্পতি মরুভূমি প্রকম্পিত করে সেই পাঠান আজ আমাকে সর্বজনসমক্ষে, নিপীড়ন কলাশাস্ত্র ও তজ্জনিত সঙিনাগ্রে স্তন সম্বলিত নৃত্যে প্রথম ভাগের প্রথম ছত্র শিক্ষা দান করল! যে-লোকে আছি তার অন্ত নেই তাই সেখানে অন্তিম বাসনাও নেই, নইলে এই মুহূর্তে বাম করতল নিষ্ঠীবনপূর্ণ করে সেই কুণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে সর্ব অবসান ঘটাতুম। আমি চললুম।
কীর্তি বললে, এটা এক ভদ্রলোক আমাকে রসিয়ে রসিয়ে শোনাচ্ছিলেন যে-জায়গার একটা লজ্রঝড় ছাউনিতে তার নামটাও বিকট- ফাঁসি দেওয়া না কী যেন। সেই বাগডোগরা যেখান থেকে তুমি হিমালয় দেখেছিলে, তারই কাছে। ভদ্রলোক নিষ্ঠাবান মুসলমান। পুব পা থেকে এপারে এসে ছেলে-ছোকরাদের জড়ো করে বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছিলেন। কথায় কথায় তার মুখে গড়ে নতুন নতুন হাসির গল্প, কিংবা হাসি-কান্নায় মেশানো। আমি একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে শুয়ে অধোমুখে দেখছিলুম সেই হাস্যমধুর লোকটি খোলা আকাশের নিচে, জায়নামাজ পেতে প্রায় দুপুররাত অবধি নামাজ পড়লেন, দু হাত তুলে প্রার্থনা করার সময় গুনগুন করে গীত গাইলেন। তিনিই তার আপাতদৃষ্টিতে স্রেফ গুলতানি শেষ করে আমাকে বললেন, আচ্ছা, চৌধুরী সায়েব, বলুন তো হিটলার ইহুদিকুলকে নির্মূল করার সময় কি খুব বেশি ইহুদি স্পাই, স্যাদি-এর মদদ পেয়েছিল? আমি যদূর জানি খুব অল্প কয়েকজন মাত্র।
আমি বললুম, স্পাই স্যাদি আদৌ পায়নি। যেটুকু যে-কজন করেছে সেটা হিটলার-হিমলারের সেপাইদের গুলিভরা বন্দুকের সঙিনের খোঁচা খেয়ে খেয়ে।
অথচ দেখুন, মাতাল লম্পট ইয়েহিয়া ওদিকে আবার কট্টর শিয়া। ভুট্টোর বাপ স্যার শাহ নাওয়াজ খান ভুট্টোকে খাঁটি সিন্ধি মুসলমান বলা চলে না। সিন্ধু দেশের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করে খুদ আরবদের হাত থেকে অষ্টম শতাব্দীতে। পক্ষান্তরে ভুট্টোর হিন্দু পূর্বপুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন রাজপুতানাতে সপ্তদশ শতাব্দীতে। পরে সিন্ধুদেশে চলে আসেন এবং ক্রমে ক্রমে বিরাট বিস্তীর্ণ, আল্লা জানেন কত লক্ষ বিঘের জমিদারি গড়ে তোলেন।
শিপ্রা বলল, বাপ! একবার ভাবো তো মারওয়াড়, রাজপুতানার যারা এদেশে বসবাস করছে, তারা যদি মাছ-মাংস খেয়ে আমাদের সঙ্গে এক হয়ে যেত, তবে আমরা, বাঙালিরা কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতুম না। পুব বাঙলায় যদি তারা মুসলমান হয়ে যেত, থাক। বল কী বলছিলে।
ভদ্রলোক বললেন, ভুট্টোর পিতা জমিদারির জোরে ক্রমে ক্রমে জুনাগড় স্টেটের প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশবিভাগের সময় মি. জিন্নার নির্দেশ অনুসারে তিনি নওয়াব সাহেবকে জুনাগড় যেন পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হয় সেই মন্ত্রণা দেন। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান প্রজারা রুখে দাঁড়াল। শেষ ফল তো জানেন। শাহ নাওয়াজ শেষ চিঠিতে জিন্নাকে লিখলেন,
জুনাগড়ের মুসলমানদের পাকিস্তান-প্রীতি নেই বললেও চলে।
কিন্তু আশ্চর্য, শাহ নাওয়াজ গোষ্ঠী শিয়া এবং অত্যন্ত গোঁড়া শিয়া। উভয় বাঙলায় শিয়ার যে ছিটেফোঁটার ভগ্নাংশ লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে সিন্ধুতে তারও বাড়া–আছি-কি-না-আছি গোছ। তৎসত্ত্বেও।
শাহ্ নাওয়াজ খানের চারজন বিবি ছিলেন। জনৈক প্রাজ্ঞ সমসাময়িক ঐতিহাসিক কাম-সাংবাদিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এই ধরনের পরিবারে এইটেই ছিল রীতি। সে-সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছলেন কী করে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি– যদিও আমি পুব পাকের নিম্নতম স্তরের জজ ছিলুম বটে, তবু শুধু যে সেই দেশের মুসলিম আইনানুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন ব্যবস্থার গভীরে প্রবেশ করতে হয়েছিল তাই নয়, ভারতের ভিন্ন ভিন্ন। প্রদেশে মুসলমান, আধা-মুসলমান, সিকি মুসলমানদের ওপর সম্পত্তি বন্টন ব্যাপারে দেশাচার কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে তার গবেষণাও আমাকে করতে হয়েছে। কিন্তু এসব শপ শুনতে কি আপনার মন যাচ্ছে।
আমি সবিনয় বললুম, ধর্মাবতার, হুজুরই, বেগ পাৰ্ডন, মহামান্য আদালতই বিচার করুন। যদি অনুমতি দেন তবে নিবেদন, আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার নই।
বাধা দিয়ে ছোট জজ বললেন, সেটা আর বলতে হবে না। সংবাদদাতা গুষ্টির নিতান্ত চ্যাংড়া ভিন্ন কোন বড়া সাব ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল বার, কলকাতায় তো জাত-বেজাতের এন্তের, ত্যাগ করে হোটেলের দুর্গম প্যাসেজ, বিপদসঙ্কুল বারান্দা পর্যন্ত বেরোন সন্দেশ সংগ্ৰহনার্থে? মাফ করবেন আপনি বলুন।
ও সে তেমন কিছু নয়, মোদ্দা কথা, ওদেরও অধম যারা তামাশা দেখবার তরে হাসনাবাদ থেকে করিমগঞ্জ-আগরতলা অবধি রোদ মারে, আমি তাদেরও কেউ নই, আর আপনাদের মতে, স্বয়ং আল্লাতালা দ্বারা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠতম সৃষ্ট দেবদূতের কাছে এসে দাঁড়াবার মতো দম্ভ, হীন কৃপার পাত্র বাতুল আমি–
জজ জিভ কেটে ছি ছি, তওবা তওবা বলে কানে আঙুল দিলেন। এসব না-হক অভদ্রভাবে বন্ধ না করলে আল্লা পাক আমাকে আমার মায়ের কোলে ফিরে যেতে দেবেন না। কীর্তি বললে, ভাবালুতা, ক্ষুদ্র হৃদয়-দৌর্বল্য জজদের সর্বথা বর্জনীয়। তাই তাঁর আম্মাজানের কথাটা আপন অবিবেচনা মনে করে সেটা ঢাকবার জন্য তাড়াতাড়ি খেই তুলে নিয়ে বললেন, ভারতের যত্রতত্র ভূস্বামী, যত্রতত্র একদারনিষ্ঠতা– এটা মূল সূত্র, অবশ্য বাস্তবতর হবে একদারদাসত্ব। চারটে বিয়ে করে বারোটা ছেলে পয়দা করলে, ভাগ, তস্য ভাগের ফলে তিন পুরুষেই জমিদারি নিকুচি। অতএব রীতি চার স্ত্রী নয়, এক স্ত্রী এবং হারেমে জনাতিনা খাদেমা অর্থাৎ সেবিকা, কিংবা ওই জমিদার বিগ্রহের সেবাদাসীও বলতে পারেন। নিতান্ত যারা আল্লাকে বড্ড বেশি ডরায় তারা দু জন সাক্ষী সামনে রেখে বিয়ের একটা ভড়ং করে। তা সে যাক গে। মোদ্দা কথা, মি. জুলফিকার আলি ভুট্টোর মাতা শাহ নাওয়াজকে বিয়ের প্রাক্কালে হিন্দুধর্ম বর্জন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানেরই একাধিক কাগজ একাধিকবার বলে, বিয়েটা নাকি আদৌ হয়নি। ভুট্টো-প্রেমীজন প্রমাণ স্বরূপ বলেন, বিবাহে গুলাম মহম্মদ, হিদায়েউল্লা ও উল্লেখযোগ্য কিছু লোক ছিলেন। নিন্দুক বলে, ওটা বিয়ের মজলিস্ ছিল না মোটেই। ইংরেজ যেটাকে বলে nautch বাইনাচ। প্রধান নর্তকী কে ছিলেন, সে আলোচনা ঐতিহাসিক-কাম-সাংবাদিকরা করবেন।
বিয়ে হয়েছিল কি না, সেটা তর্কাধীন। জানি যে, আপনার কী মত, কিন্তু সেটা আমার মনের ওপর কণামাত্র রেখাপাত করে না। তর্কাতীত সত্য, জুলফিকারের মাতা হিন্দুরূপে জন্ম নেন। তার ওপরও আমি কোনও প্রাধান্য আরোপ করিনে। এক হজরত আলি ছাড়া আমাদের পয়গম্বরের সব শিষ্যই তো মুসলিম হওয়ার আগে আরবদের বর্বর ধর্ম মেনে চলতেন।
কিন্তু যারা ফ্রয়েট পদ্ধতি দ্বারা মি. ভুট্টোর সর্বপ্রধান ধর্ম- ভারতের প্রতি এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, হিন্দুদের প্রতি তার প্রতি লোমকূপে প্রোথিত বিদ্বেষ, দ্ৰজনবর্জিত ভাষায় সুযোগে, কুযোগে, অযোগে নিত্য নিত্য তাদের প্রতি কুৎসিততম গালিগালাজ, এই একটিমাত্র অটল অবিচল অপরিবর্তনীয় অবিমিশ্র ধাতু দিয়ে নির্মিত তার সত্তা। তবে কি তার দেহে যে হিন্দু রক্ত আছে সেইটেই অস্বীকার করার জন্য, লোকে যেন সেটা স্মরণেও না আনতে পারে সেই উদ্দেশ্যে এই হিটলার-প্রশংসিত নীতি, হিট হিট হিট, হাতুড়ি দিয়ে হানো, হানো, হানো যতক্ষণ না লোকে পুনরাবৃত্তির ফলে হিপনোটাইজড, সম্মোহিত অবস্থায় তোমার বাণী, সত্যই হোক মিথ্যাই হোক, গলাধঃকরণ করে?
অপরাধ নেবেন না, আমার স্মৃতিরাজ্যে শেক্সপিয়রকে দেবার মত আসন নেই–হ্যামলেট না কে যেন বলেছিলেন তার দেহে তাঁর মাতার যে অংশটুকু আছে সেটা তিনি ছিঁড়ে ফেলে দিতে চান অথচ ভুট্টোর মাতৃদেবী হয়তো সতী-সাধ্বী নারী ছিলেন। এবং আমি এসব কথা আদৌ তুলতাম না যদি ভুট্টো স্বয়ং একাধিকবার শেখ সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশ না দিয়ে থাকতেন। শেখের ব্যাকগ্রাউন্ড জানে না কে? আমারই মতো পুব বাঙলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মামুলি মুসলমান তিনি। ভুট্টো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, পুব বাঙলার সমস্ত অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী মুজিব এবং তার ব্যাকগ্রাউন্ড। একথা তথাপি তর্কাতীত সত্য যে মুজিবের মাতার সঙ্গে তাঁর পিতার বিবাহ হয়েছিল কি না সে প্রশ্ন ফরিদপুর অঞ্চলের লীগবৈরী, মুজিবের আশু পরলোক গমনাকাতক্ষী নেমকহারাম বিহারিরা পর্যন্ত করেনি এবং বিয়েটা প্রমাণ করার জন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী হেদায়েউল্লার উপস্থিতিও প্রয়োজন হয়নি।
ভুট্টো ইসলামের কোনও নির্দেশই মানেন না। ওদিকে ভয়ঙ্কর শিয়া।
জুন্টার নির্দেশে যে মেজর জেনারেল ইসকন্দর মির্জা সর্বপ্রথম আইনত ডিকটেটর হয়ে তিন সপ্তাহ রাজত্ব করেন তিনিও গোঁড়া শিয়া। মির্জাই ধর্মভ্রাতা ভুট্টোকে আপন উপদেষ্টা রূপে বা মন্ত্রণা সভায় ডেকে নিয়ে রাজনীতির সুন্নৎ (সারকামশিসন) করান অবশ্যই শিয়া কায়দায়। অবান্তর নয় যে মির্জাকে ডিকটেটরিতে প্রমোশন দেবার ষড়যন্ত্রটা করা হয় এক শিয়া-ভবনে, ভুট্টোজনকের প্রাসাদে।
ইয়েহিয়াও গোঁড়া শিয়া। শিয়ারা বিশ্বাস করেন, সুন্নিরা তো মুসলিম নয়ই, তারা কাফির। এবং চরমপন্থি শিয়াদের স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস, সুন্নিমাত্রই ওয়াজিব উল ক অর্থাৎ সুন্নি দর্শনমাত্রই তাকে নিধন করা শাস্ত্ৰাদেশ।
ওদিকে জুন্টাতে কোনও শিয়া আছেন বলে শুনিনি। ইসকন্দরের আমল থেকে এযাবৎ জুন্টাই পাক রাষ্ট্রের একমাত্র শক্তিধর।
সেই সুন্নি জুন্টাকে বোকা বানিয়ে, পুব বাঙলার মুসলমান মাত্রই কাফির সে-তালিম মুসলমান পাঞ্জাবি-পাঠান-বেলুচের অস্থিমজ্জায় উত্তমরূপে ঢুকিয়ে দিয়ে অগণিত বাঙালি মুসলমানকে করালো খুন, তাদের অবলাদের করালো ধর্ষণ, তাদের ঘরদোরে জ্বালাল খাণ্ডবদাহন মাত্র দুটি শিয়া। অদ্যদ্ভুত পৈশাচিক নৈপুণ্য না থাকলে দুটি মাত্র শিয়া ইয়েহিয়া এবং ভুট্টো যাদের কাছে উভয়াপা-এর অগণিত সুন্নিই কাফির এক পা-এর কাফির দিয়ে অন্য পাক-এর কাফির উৎপাটন করার মতো ধৃষ্টতা হৃদয়ে ধরতে পারত কি?
হিটলার পেরেছিল কি জর্মনির কাফির ইহুদিদের বোকা বানিয়ে, তাতিয়ে দিয়ে ফ্রান্সের কাফির ইহুদিদের হত্যাধর্ষণলুণ্ঠন করাতে? দূরেই থাক সে দুরাশা! বরঞ্চ সে যাদের মর্ত্যের আদর্শ মানব (সুপারম্যান) উপাধি দিয়ে চিরজীবন প্রপাগান্ডা চালাল, সেই নর্ডিক জাতের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভ্রান্ত অনেক অফিসার, রমেলসহ, তিন-তিনবার চেষ্টা দিল তাকে হত্যা করতে। ফলে দু হাজার থেকে পাঁচ হাজার কে জানে কত– নর্ডিক সুপারম্যানকে মেশিনগান্-এর গুলিতে, ফাঁসিকাঠে, শক্ত সরু তারে ঝুলতে ঝুলতে আধ ঘণ্টাটাক শূন্যে পা দুটো আছড়াতে আছড়াতে এ পদ্ধতিতে ফাঁসির মতো এক ঝটকায় না–দমবন্ধ হয়ে প্রাণ দিল। এ যাবৎ কোনও শিয়ার শরীরে আঁচড়টি তক লাগেনি।
এবারে বলুন, চৌধুরী সাহেব, সেই অনামা অমর্ত্যলোকে কার নীচাসন– হিটলারের না ইয়েহিয়ার ফাঁসুড়েদের?
.
১১.
আলিঙ্গন ঘনতর করে বাষ্পভরা কণ্ঠে কীর্তি বললে, এই তো আমার অক্ষয় সম্পদ। তোমার প্রেমই আমাকে দেখিয়ে দেবে পথ, অরে দেবে আমার বুক সাহস দিয়ে, আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মতো অপদার্থকে করে দেবে কর্মনিষ্ঠ। যেখানেই যাই না কেন, যেতে যেতে তাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি না কেন, তোমার কথা ভাবলেই পাব নবীন উৎসাহ।
মৃদুকণ্ঠে শিপ্রা বললে, তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই।
কীর্তি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
শিপ্রা বিদায়-বেলার পীড়া হালকা করে দেবার জন্য বলল, একজন নীরবে চিন্তামগ্ন হলে অন্যজন প্রায়ই বলে, তুমি কী ভাবছ সেটা যদি আমাকে জানাও তবে তোমাকে একটা পেনি দেব– এ পেনি ফর ইয়োর থট; আমি যদি এটা পাল্টে বলে দিতে পারি, তুমি এখন কী ভাবছ, তুমি একটা পেনি দেবে?
কীর্তি তবু চুপ।
শিপ্রা বাসনার লহরে হরে রঙিন দুটি ঠোঁট দিয়ে কীর্তিকে নিবিড় চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দিয়ে বললে, তুই ভাবছিস, মিতা, এখন যদি বলি, আমাকে বিয়ে করো তবে শিপি আগের মতো আর না বলতে পারবে না, এইমাত্র যখন কথা দিয়েছে আমাকে তার অদেয় কিছু নেই বল, কিতা, ঠিক ধরেছি কি না?
কীর্তি একটিমাত্র শব্দে উত্তর দিল, ঠিক।
শিপ্রা অভিমানের ছল করে বললে, বা রে! তুমি কোনও উৎসাহ দেখাচ্ছ না যে! একদিন আমার দুর্বলতম মুহূর্তে- যেদিন আমি আমার সর্ব উজাড় করে দিয়েছিলাম তোমাকে, অগ্রণী হয়ে, নিজের থেকে নারীর শেষ সম্বল তুমি আমায় বলনি ওইটেই তোমার একমাত্র ভাবনা। আমি তখন সেটাকে হালকা করে দেবার জন্য বলেছিলুম, হৃদয় আর ভাবনা তো একই সত্তা :
কিবা সে হৃদয়? হৃদয় কাহারে কয়?
সে তো একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি।
শেষ ভাবনা উধাও হয়ে যাবে শেষ কামনা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন রইবে শুধু একবিন্দু শোণিত; ভাবনাটা উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে তোপ হৃদয়ও। ভাবনা-ভরা হৃদয়-হারা সুন্দুমাত্র একবিন্দু শোণিত তো মানুষ ভিন্ন সব প্রাণীরই আছে। ভাবনাভরা শোণিতবিন্দুটির নামই তো কীর্তি ঠাকুর। আমার ঠাকুর। উত্তরে তুমি বলেছিলে, তোমার মন্তব্যটাতে শোণিতবিন্দুও নেই।… আজ যদি কবির সুরেলা গলার সঙ্গে আমার বেসুরো গলা মিশিয়ে অর্থাৎ একটু পরিবর্তন করে গাই, জানি সেটা জনসমাজে করলে হবে ধৃষ্টতা, কিন্তু তুমি আমি মধুর ভাষে দীন, হিয়া প্রকাশে হীন, তাই কবি সেটা ক্ষমা করবেন
হৃদয়-বাসনা পূর্ণ হল আজি
হেরি আঁখি-ভরা মনে
মম প্রিয়া চিত্তমাঝে বসি স্থির আসনে।
তা হলে?
কীর্তি তখনও চুপ।
শিপ্রার আদর যেন অফুরন্ত। বললে, আজ আমার পেনি জমাবার দিন। যদি বলতে পারি এখন তুমি কী ভাবছ, আরেকটা পেনি দেবে?
বল।
মিতা, আমি জানি যে, তুমি জানো, আমি কী উত্তর দেব। এবং সেই নিয়ে তোমার মনে তোলপাড় আরম্ভ হয়েছে। আগে ছিল ভাবনা, এখন দুর্ভাবনা।
কীর্তির ঠোঁটের কাছে এনে তার নিশ্বাস শিপ্রা আপন নাক দিয়ে নিঃশেষে শুষে নিয়ে গুনগুন করে গাইল, আমাতে মিশা তব নিশ্বাস নবীন উষার পুষ্প সুবাস– বার বার। তার পর আবার বার বার বাসনার রঙে লহরে লহরে রঙিন হল, হে প্রিয় করুণ মম অরুণ অধর পিয়ো হে পিয়ো। তার পর কীর্তনিয়া রীতিতে বার বার আখর দিল, অরুণ অধর পিয়ো হে পিয়ো। মাঝে মাঝে থেমে থেমে কীর্তির নিশ্বাস নিঃশেষে শুষে নিয়ে আপন বুক ভরে নেয়– তার শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই।
হঠাৎ একবার দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করা সত্তেও সেটা কীর্তির গাল ছুঁয়ে গেল। কীর্তির দু হাত দিয়ে ছড়িয়ে পড়া ঘন কোঁকড়া চুলের নিচে আধা হারিয়ে-যাওয়া মুখটি কাছে টেনে এনে বললে, বল দেখি, তুমি কি অস্বস্তি বোধ করছ?
শিপ্রা চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে ঠোঁটে মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললে, অস্বস্তি কিসের? নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে শুধু আমি একটু হতাশ হলুম। আমি আশা করেছিলুম, বাবার বন্ধু ফরাসি ফৌজি অফিসাররা যেরকম ভালো মন্দ বিপদ আপদ, সুখ দুঃখ, সব অবস্থাতেই ধরে নেয় যে এটাই প্রকৃতির নিয়ম, এটাই তো স্বাভাবিক, আটপৌরে– এমনকি আমাদের কবির সর্বশেষ কবিতার যে প্রায় সর্বশেষ ছত্রে আছে, অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে ঠিক তা-ও নয়, ছলনাটাও তাদের কাছে ছলনা নয়, ওটা অত্যন্ত স্বাভাবিক কিন্তু কবির অনায়াস বেশিরভাগ চরিত্রেই থাকে এবং সেটার মূল্য দেয় শোল্ডার শ্রাগ করে, তা পি বলে, মানে, জানা তো ছিলই, জীবনটা একটানা শ্যাম্পেন আর কাভিয়ার হতে পারে না, জেনারেল ব্যাটা আটকে দিল প্রমোশনটা, আর প্রিয়া তো হর-হামেহাল উঁচিয়ে আছেন জিল করার পিস্তল– তার পর সেই স্বাভাবিক আটপৌরেটার সামনে তার আচরণটাও অনায়াসলব্ধ– প্যারিসের প্রিমা দন্নার অযাচিত প্রেম যদিস্যাৎ অকস্মাৎ বিলকুল ফ্লকে লটারির প্রাইজের মতো পেয়ে যায় তবে অনায়াসে তাকে নিয়ে সগর্বে বুক ফুলিয়ে বেড়িয়ে বেড়াবে, আবার বিকল্পে যদি উপলব্ধি করে, পরের দিন জুয়োর দেনা শোধ না করতে পারলে মান-ইজ্জত থাকবে না, তখন তো সেই নিত্যদিনের তা পি –সো মাচুদি ওয়ার্স আছেই– প্রিয়ার মুখটি সাদরে তুলে ধরার মতোই অনায়াসে পিস্তলটা তুলে ধরে ঠেকাবে রগে– আমি আশা করেছিলুম একটানা বহু সায়ং সন্ধ্যা তাদের অনায়াস সঙ্গ পেয়েছিলুম বলে আমিও তাদের শোল্ডার শ্রাগ করে তাঁ পি- বয়ে গেল– বলতে পারব, অন্তত খানিকটে।
কীর্তি করুণ কণ্ঠে বললে, কেন অযথা আত্মনিন্দা করো? আমার যদি কাল ভোরের প্লেনে করে মোলায়েম সুইটজারল্যান্ডে যাবার প্ল্যান থাকত তা হলে তুমি সেটাকেও অত অনায়াসে নিতে পারতে না। যাকে ভালোবাসি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকলেও হারাই-হারাই ভাবনাটা সবসময়ই জেগে থাকে হৃদয়ের কোনও এক গোপন কোণে। তার ওপর তুমি মেয়েছেলে। পুরুষের হৃদয় যদি একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি দিয়ে গড়া হয়, তবে মেয়েদের বেলা একবিন্দু শোণিত আর রোদনের রাশি। আসলে আমার প্রশ্নটাই ভুল। আমি কিংবা খান তো এমন কোথাও যাব না, যা তোমার অস্বস্তির কারণ হতে পারে, আমি কিংবা খান বন্দুক চালিয়ে কটা পাঠানকে খতম করতে পারব? ছোকরা জিমি পর্যন্ত জানে, তুমিই তো বলেছিলে, আমাদের কাজ কলকাতায়। সেই ঘুঘু লারিটা পর্যন্ত জানে, নজর রাখতে হবে কলকাতার ওপর। এবং আমাদের বড় বড় ক্লাবগুলোর ওপরও। যেসব ছেলে-ছোকরারা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে পুব বাঙলাকে সাহায্য করতে চায়, তারা টাকার জন্য, বন্দুকের জন্য যাবে যেসব পয়সাওয়ালাদের কাছে তারা তো এসব ক্লাবেরই মেম্বার। এবং এরা লারি-ফারির সামনেও বেপরোয়া বলে দেবে, ছোকরাদের জন্য একসপ্লোসিভ যোগাড় করতে কার লবেজান, কে একরাশ টাকা দিয়ে ছেলেদের পাঠিয়েছে নাগা পাহাড়ে, সেখানে যদি জাপানিদের ফেলে-যাওয়া বন্দুক-মেশিনগান নাগাদের কাছ থেকে কেনা যায়। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট এখনও আসরে নামেনি বলে ছেলেরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, না মুরুব্বিরা তাদের শুধু হাতে ফিরিয়ে দেবে। শুধু কি তাই, খান বলেনি বুঝি, বাংলাদেশের এক রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার এ-পারে সময়মতো চলে এসেই শুনতে পেলেন, অমুক বাঙালি হিন্দু অফিসার বর্ডারে মোতায়েন হয়েছেন। ইআল্লা বলে এক লক্ষে তাঁর কাছে উপস্থিত। ব্যাপার কী? পার্টিশনের পূর্বে দু জনা একই জায়গায় ট্রেনিং পেয়েছিলেন, পার্টিশনের সময় পর্যন্ত একই আর্মিতে কাজ করেছিলেন। দু জনাতে দোস্তি হয়েছিল গভীর। গিয়েই বললেন, জানো তো, দোস্ত, আমি রিটায়ার করেছি বটে কিন্তু দেশে যে সঙ্কট এসেছে সেটার মোকাবেলা যথাসাধ্য আমি করবই করব– এই ভরসা যদি আমার দেশের লোক রাখে তবে কি সেটা অন্যায় হবে? আসলে অতখানি লম্বা-চওড়া অজুহাত একে অন্যকে এরা কখনও দেননি। এক ইয়ার আরেক ইয়ারকে দেখা মাত্রই বুঝে গিয়েছেন ব্যাপারটা কী। বাক্যব্যয় না করে ইয়ারকে নিয়ে গেলেন অস্ত্রাগারে, হাত দিয়ে কুল্লে হাতিয়ার দেখিয়ে বললেন, যা খুশি নিয়ে যাও, যত খুশি নিয়ে যাও হেলপ্ ইয়োরসেল। সত্যি বলছি।
শিপ্রার অবসাদ আগাপাশতলা উধাও। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ফরাসি অফিসারদের কাছ থেকে সে শুধু ফৌজি-তত্ত্বকথাই শোনেনি, শুনেছে বিস্তর গুলও তাদের মুখে নইলে আর্মিতে ঢুকবেই-বা কেন, গুল মারার সনাতন ট্রাডিশনটাই-বা ডোবাবে কেন? কিন্তু এরকম একটা সৃষ্টিছাড়া ভুতুড়ে গুল? ঢোক গিলে রাম-ভোলার মতো টক্কর ঠোক্কর খেতে খেতে শুধলে, সে কী করে হয়? তুমি সত্যি জানো? এ তো বিশ্বজোড়া শান্তির সময়ও অসম্ভব। আর এখানে সরকার যাকে পাঠিয়েছে সীমান্ত রক্ষার জন্য, তাঁর কী হাল হবে? বলা তো যায় না, ইয়েহিয়া জাতাকলে পড়লে দুর্যোগটা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য কোনও না কোনও ডেসপারেট মিলিটারি গ্যাম্বল শুরু করে দেবে। তার শেষ তাস দিয়ে। আক্রমণ করবে আইনত নিরপেক্ষ কিন্তু কার্যত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ভারতকে– যাতে করে রাষ্ট্রপুঞ্জ ইন্টারফিয়ার করে দুই পক্ষকে ঠেকায় আর ইয়েহিয়া সেই লুপহোল দিয়ে সুড়ৎ করে বেরিয়ে যায়।
কীর্তি সোল্লাসে বললে, শুধু ইয়েহিয়াই বুঝি কলিযুগের নিরেস যুধিষ্ঠির! সত্য যুগের আসল যুধিষ্ঠির, না ইয়েহিয়া কে যে জুয়োতে বেশি বুদুমি দেখাতেন সেটা বাঙলার ইতিহাসে একটা চিরন্তনী সমস্যা হয়ে রইবে। সেই গুপ্তযুগ কিংবা তারও আগের থেকে কত না রাজা, পাঠান-মোগল কেউ বাদ যাননি এদেশে এসেছে জুয়ো খেলতে, ওদের সক্কলেরই মারাত্মক প্রয়োজন ছিল, যুদ্ধের জন্য হাতির। ত্রিপুরাতে প্রচুর সে মাল, প্রতিবেশী সিলেটিরা এখনও পৃথিবীর সেরা মাহুত। ইংরেজ বোম্বাই, মাদ্রাজ যে কোনও জায়গায় জুয়ো পার্টি বসাতে পারত। কিন্তু বেছে নিল বাঙলা। ধনী দেশ, অন্তত তখন পর্যন্ত ছিল আমাদের তরফ থেকে স্টেকটা হবে ভারী। জিওপলিটিক নামক আধা-বিজ্ঞানটি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তথ্যগুলো তো ছিল আমাদের বুদু এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কে যেন কথাচ্ছলে বলে, অক্সিজেন আবিষ্কৃত হয়, ১৭৭৪-এ। মন্ত্রী সবিস্ময়ে শুধালেন, তার আগে মানুষ বাঁচত কী দিয়ে? তার পর পাঁচ আঙুলে খ্যাস খ্যাস করে দাড়ির উকুনকে আদর করতে করতে ডরালু গলায় শুধালেন, কিন্তু সাপ্লাই ঠিক আছে তো?–
শিপ্রা শুধালে, তুমি একদিন কথায় কথায় বলছিলে না ডাঙর ইয়েহিয়ার আর বড়া বড়া জুন্টা-গোসাঁইদের কানও বড় বড় হয় তখন মনে পড়েনি ভলতের এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর এপিগ্রাম লিখেছেন চার ছত্রে, অনেকটা আমাদের সুভাষিতের মতো, হিতোপদেশ পঞ্চতন্ত্রে বিস্তর আছে–
কীর্তি ঠিক বুঝতে না পেরে শুধালে, পঞ্চতন্ত্র? সে তো কোন এক মোল্লা না কে যেন বাঙলা একটা সাপ্তাহিকে লেখে।
শিপ্রা বললে, দম্ভ আছে লোকটার! স্বয়ং বিষ্ণুশর্মা যে বই লিখে দূর মার্কিন মুলুক পর্যন্ত প্রাতঃস্মরণীয় লেখক হলেন, তাঁর গল্পের কাছে কখনও কেউ আসতে পারবে নাকি যে সে তার রাজ গুলতানির জন্য পঞ্চতন্ত্র নাম বেছে নিল।
কীর্তি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, বাঁচালে! আমি ভেবেছিলুম মাস্টারের পড়ানো সেই আগম পুরাণ বেদ পঞ্চতন্ত্রকথা বুঝি, আমাদের যে তন্ত্রট আছে তারই পাঁচটাতে মিলে কোনও একটা সিনথেসিস।… যাকগে… ভলতেরের একটা এপিগ্রাম বলতে যাচ্ছিলে না?
হ্যাঁ।
এলাস! লেজোরেই দে গ্রাঁ
সঁ সুভাঁ দ্য গ্রাঁদ জ অরেই
হায়! বড়লোকদের যে আকছারই বড় বড় কান হয়, অর্থাৎ গাধার কান। স্বভাবতই ইঙ্গিত রয়েছে, এদের মস্তিষ্কও ওই প্রাণীটার মতো।
কীর্তি বললে, তাই তো রক্ষে। বড়লোকদের ধন-দৌলত আছে, যশ-প্রতিপত্তি প্রচুর। তার ওপর যদি মগজটিও সরেস ধরনের হত তবে গরিবদের আর বাঁচতে হত না। তাদের হাড়-মাস খেয়ে চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাত। এই ধরো না টিক্কা-ইয়েহিয়ার একটা মোক্ষম মুখোমি। আজ যে সমস্ত পুব বাঙলায় বড়র অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছোট রুখে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিবাহিনী ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে দর্শন বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব নিকুচি করে দিয়ে সামথিং গ্রোইং আউট অব নাথিং তার জন্য ওই মূর্থনীতি আচরণ কতখানি দায়ী সে-কথা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। এটা আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ, আপন খেয়াল নয়। মনে আছে তোমার, শিলঙে তোমাকে বলেছিলুম হবিগঞ্জের এক পাগলা-জগাই, শব্দে শব্দে,
ঢাল নেই, তলওয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার
ট্যাঙ্ক কামান হামলা করে, হুঙ্কারে মার মার!
সেই মেজর আমার এক মুরুব্বিকে বলেছেন, পঁচিশে রাত্রেই টিক্কা প্রয়োজনের চেয়েও ঢের ঢের অপর্যাপ্ত সৈন্যবল, আধুনিকতম ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি, কামান সর্ব বল নিয়ে আক্রমণ করল তিন শ্রেণির লোককে। প্রথম দল বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি। একদা পাকিস্তানের, বস্তৃত পশ্চিম পাকিস্তানের হয়ে এরাই লড়েছিল আইয়ুবখানি যুদ্ধে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ এবং তাঁর অল্পক্ষণ পরেই মামুলি পুলিশকে আক্রমণ করে প্রায় বিধ্বস্ত করে দিল। এদের মাত্র যে কিছু লোক পালাতে সক্ষম হয়েছিল, তাবৎ পুব বাঙলায় সুদু মাত্রই এরা জানে, কী করে রাইফেল চালানো শেখাতে হয়। এদের নিয়েই গড়ে উঠল বাঙলা দেশময় মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট দল। এখন প্রশ্ন এই, এদের মাত্র যে কিছুসংখ্যক লোক লীগের প্রতি কতখানি দরদি ছিল সেটা বলা কঠিন- জুন্টা অবশ্যই সেটা আদৌ হিসাবে ধরেনি তাদের পুরো পাক্কা ধারণা, এদের সমূলে বিনাশ করতে কী আর বেগ পেতে হবে, সময়ই-বা লাগবে কতটুকু?–বমার অব্ বেলুচিস্তানের ওই বাবদে দম্ভ তো আজ দেশে-বিদেশে কারও অজানা নেই কিন্তু একথা তো সত্যি, যে এই তিন শ্রেণির লোক ডিসিপ্লিন্ কাকে বলে সেটা অতি উত্তমরূপে জানে, উপরওলার আদেশ এস্থলে মার হোক, বুচার হোক, টিক্কা খানের আদেশ তারা অন্তত একশো বছর ধরে মেনে নিতে অভ্যস্ত, এবং সর্বশেষ কথা– পাক আল্লার নামে কসম খেয়ে তারা রাষ্ট্রপতির আনুগত্য স্বীকার করেছে। তাই প্রশ্ন, এদের এভাবে টিক্কা যদি আক্রমণ না করত তবে কি এরা নিজের থেকে বিদ্রোহ করত?।
কীর্তি থামল। যেন সামান্য একটু চিন্তা করে বললে, এ প্রশ্নের উত্তর মেজর কখনও পাবেন না। করতই, সেটা জোর গলায় বলা চলে না, আবার আলবৎ করত না তার উত্তরও তদ্বৎ। তবে মেজরের একটা সত্য নির্ণয় তর্কাতীত। ওরা আক্রান্ত না হলে, এবং তারই ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না দিলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলাটা তো প্রায় অসম্ভব হত। আবার, তাদেরই চোখের সামনে গ্রামাঞ্চলে দিনের পর দিন, মুক্তি গড়ে না উঠলে, গ্রামের লোক তো মনোবল হারিয়ে ফেলত– রুখে দাঁড়ানো দূরে থাক, বিরুদ্ধ ভাব অন্তরে অন্তরে পোষণ করতই-বা কদিন? এবং তার শেষে যখন বর্বররা ব্যাপকভাবে সর্বত্র হত্যা-লুণ্ঠন-দহন-ধর্ষণ আরম্ভ করত এবং করত তার সর্বাবস্থাতেই– তখন? তখন তো টু লেটু, তখন কে গড়ে তুলত মুক্তিবাহিনী?
শিপ্রা বললে, আমার মনে হয়, ভারত যে সরাসরি ইয়েহিয়ার গালে চড় মারছে না, তার প্রধান কারণ, সে দেখতে চায়, বাংলাদেশে যে বিদ্রোহ মনোবৃত্তি দেখা দিয়েছে সেটা বাঙালির নিত্যকালের হুজুগে মেতে ওঠার সোডা-বোতলের গ্যাস কি না। সেটা ঠিক ঠিক অনুমান না করে তড়িঘড়ি পুরোদম যুদ্ধে যদি নেমে যায় এখখুনি, এবং অল্পদিন পরেই পুব বাঙলার মনোবল ভেঙে যায় তবে যে শেষটায় ভারতকে বিশ্বের কাছে বিড়ম্বিত হতে হবে। ওদিকে ফরাসি অফিসারদের একজন আমাকে লিখেছেন, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, মিলিটারি দৃষ্টিবিন্দু থেকে জোর দিয়ে বলেছেন একমাত্র প্যোরলি মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির বিচারে– এইটেই ভারতের সুবর্ণ সুযোগ, এই বেলায়ই ভারতের যুদ্ধে নেমে যাওয়া উচিত।… তা তো বুঝলুম, কিন্তু প্রশ্ন, সব জেনেশুনে পৃথিবীর প্রায় সব নেশনই চুপ করে আছে কেন?
বা-রে! তোমার আপন দেশ ভারতবর্ষও তো এখনও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
সে কী কথা! একটা দেশের সরকারই বুঝি সব! আমরা– তুমি, আমি– আমরা বুঝি দেশের মালিক নই! এই বাঙলাদেশেই তুমি কখনও দেখেছ, ঘটি-বাঙাল হঠাৎ এক হয়ে গিয়ে পুব বাঙলার বেদনায় চিৎকার করে বলে উঠেছে, ভাই আমরা আছি। আর এটাও তো স্বীকার করতে হবে, আজ পর্যন্ত ভারতই সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে, স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছে, তার পূর্ণতম সহানুভূতি কার প্রতি। তুমি জানো–
কীর্তি কেন যে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেটা বুঝতে না পেরে শিপ্রা থামল। তার হাতখানা আপন হাতে তুলে নিয়ে শুধালে, বন্ধু, আমার কোনও কথা কি তোমাকে পীড়া দিল?
কীর্তির মুখে অমনি হাসি ফুটল। কণ্ঠস্বরে যেন সর্ব মধু ঢেলে দিয়ে বললে, শিপ্রা তুমি সত্যি শিপ্রা– শব্দটি এসেছে ক্ষিপ্রা থেকে, অর্থাৎ যে দ্রুতগতিতে চলে। তুমি প্রথম যেদিন আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি– কেউ-দেখল-কেউ-না– প্রসন্ন স্মিত হাস্যের আভাস দিয়েছিলে, সেদিনই সর্বপ্রথম আমি একটা বড় বাঙলা অভিধানের স্মরণ নিই। তারই কল্যাণে বুঝতে পারি যে শিপ্রা বা ক্ষিপ্রা–
ক্ষিপ্ৰা বললে আরও মানানসই হয়।
চিন্তাকুল বদনে কীর্তি যেন আপন মনে বললে, প্রেমে পাগলিনীকে ব্যাপা বা ক্ষিপ্তা বলেছেন কবি, কিন্তু সংক্ষিপ্তা যেন না হয় আমার প্রতি তোমার প্রেম-প্রীতি-আসক্তিটি–
শিপ্রা করুণ কণ্ঠে অনুনয় করল, বলবে না, রাজা, আমার কোন কথায় তোমার বুকের ভিতর থেকে গরম বাতাস বেরুল- হঠাৎ, কোনও আভাস না দিয়ে?।
কীর্তি যেন ঝটিতি রাজাদেশ পালনে শশব্যস্ত হয়ে বললে, বলছি, শুরু, বলছি। যে মুহূর্তে তুমি বললে, পশ্চিম বাঙলার লোক আজ যেন সমবেত কণ্ঠে পুব বাঙলার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহস দিচ্ছে, আমরা আছি আমার মনে তৎক্ষণাৎ সেই দুশ্চিন্তা, সেই কবেকার আগরতলায় যার জন্ম, সেটা অহরহ আমাকে আশা-নিরাশায় ক্ষণে আকাশে তোলে, ক্ষণে মাটিতে আছাড় মারে। পুব বাঙলা দাঁড়িয়েছে প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে। সে শক্তিকে একমাত্র সৈন্যবল ছাড়া আর সব দিচ্ছে পূর্বাচল-অস্তাচলের দুই বৃহত্তম রাষ্ট্র যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, প্লেন– যা চাই তাই, যুদ্ধ যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে তবে পশ্চিম পাকে তার জন্য অপর্যাপ্ত অকাতর অর্থসাহায্য সেসব সাহায্য যদি সুন্দুমাত্র পশ্চিম পাকেই যেত তবু না হয় একটা ব্লাফ মারা যেত এগুলো পশ্চিম পাকে দেওয়া হচ্ছে, ভারত আফগানিস্তান ও রুশ একজোট হয়ে যেন পশ্চিম পাক আক্রমণ করে বিশ্বশান্তি ভঙ্গ না করে!–এগুলো খোলাখুলিভাবে পাঠানো হচ্ছে পুব বাঙলায় হারামিদের হাতে, তারা কী নয়া ধরনের বিশ্বশান্তি রক্ষা করছে সেটা জেনেশুনে যাতে করে তারা আরও নির্ভয়ে, জীবন বিপন্ন না করে আরও নিধনধর্ষণলুণ্ঠনদহন কর্ম আরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে করতে পারে। শুধু কি তাই নিরীহ গ্রামবাসী নরনারীকে কীভাবে যমদূতেরও বাড়া নিষ্ঠুর নির্যাতনের ভয় দেখাতে হয়, কী প্রকারে স্বামী পিতা পুত্রের সম্মুখে অবলা নারীকে ধর্ষণ করে মানুষের শেষ সম্পদ তার আইজ্জৎ ইমান কোন কোন বীভৎসতা দ্বারা বিনাশ করে তাকে ক্লীব পশুত্বে পরিণত করার বিভীষিকা দেখাতে হয় সে-সব নীতি কায়দা শেখাবার জন্য বিত্তশালী দেশে বাছাই বাছাই সাদিস্তদের জন্য একটা– কেউ কেউ বলেন একাধিক বিশেষ স্কুল খোলা হয়েছে– খানদানি মিলিটারি অফিসার ও জোয়ানদের জন্য। আইয়ুবের সামনেই সেখানে পশ্চিম পাকের আর্মি বাছাই বাছাই লোক পাঠায়। ইয়েহিয়ার সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না, কিন্তু জুন্টা জানত, হাওয়া একদিন কোন দিক দিয়ে বইবে। তারা সে ইস্কুলে ছাত্র পাঠাতে কোনও কসুর করেনি। আসলে আজ আর এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, যে স্বয়ং আইয়ুবই জানতেন, পুব পা আর পশ্চিম পাকে একদিন মোকাবেলা হবেই হবে।
তাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জনপদবাসী কতদিন ধরে এ অত্যাচার সইতে পারবে? তারা যদি মনোবল হারায় তবে তো সর্বনাশ! প্রবলতর শত্রুর হাতে পর্যদস্ত হওয়াতে লজ্জার কিছু নেই, কিন্তু সে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়াতে, তার দাসত্বে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়াতে সর্বনাশের চেয়ে সর্বনাশ। কারণ তার ফল ভোগ করতে হবে তাদের সন্তানদের বংশানুক্রমে।
ছোট-বড় শহর আয়ত্তে রাখা খানদের পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম, হাজার হাজার গ্রাম আয়ত্তে আনা অসম্ভব। কিন্তু যদি জনপদবাসী বশ্যতা স্বীকার করে নেয় তবে এইসব বাচ্চারা, ক্ষুদে ক্ষুদে বাচ্চারা, সুন্দুমাত্র দু চারটে উটকো বন্দুক নিয়ে ট্যাঙ্ক-সাঁজোয়া গাড়ির মোকাবেলা করছে, তারা পা জমাবে কোথায়?
জানো শিপ্রা, চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে বেরোয় খানদের সন্ধানে। বেতার নেই, কোনও প্রকারের যোগসূত্র নেই এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের আর ক রাউন্ড গুলিই-বা পায় এরা যাত্রাপথে নামবার সময় চাষাভুষো যদি এদের আশ্রয় না দেয়, চিড়ে মুড়ি না যোগায়, খানদের সন্ধান না বাতলায় তবে কদিন লড়বে তারা?
শিপ্রা অন্ধকার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, পার্কের উপরের রাস্তায় ক্ষীণ একটা আলোর দিকে। তার মনে ক্ষণে ক্ষণে ভয় জাগছিল ওদের জয়াশা আমাদের জয়াশা ওই আলোরই মতো ক্ষীণ। আবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে সাহস জেগে উঠছিল, প্যারিসের সেই বুড়ো জেনারেলের স্মরণে। তিনি বলেছিলেন, মামোয়াজেল যতক্ষণ না একটা জাত পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, ততক্ষণ সে পরাজিত হয়নি। এবং শেষ যে আপ্তবাক্যটি বলেছিলেন সেইটে সে মুখ ফুটে কীর্তিকে শোনাল;
যে ভেঙে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, তাকে প্রবলতম শক্তিও দাঁড় করাতে পারে না। যে জাত ভেঙে পড়েনি সে-ও যেন অপরের সাহায্যের ওপর বড় বেশি ভরসা না রাখে।
অকস্মাৎ, অপ্রত্যাশিত, অত্যত হল কীর্তির প্রতিক্রিয়া! সোফা ছেড়ে প্রায় নাচ শুরু করে দিল ঘরময়। শিপ্রা অবাক। এমন কী দারুণ নয়া সত্য ছিল তার কথা কটিতে?
শিপ্রার হাত দু খানি আপন হাতে তুলে বলল, বাঁচালে তুমি আমাকে। আমি কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলুম এইবারে বলি, যে কথাটা, কবে সেই আগরতলা থেকে আমার মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু বলার মতো সাহস যোগাড় করতে পারিনি। আমি জানি, অনেকে মনে করে বাইরে তুমি যে রূপেই দেখা দাও না কেন, যেমন মনে করো হিস্পানি টাঙ্গো নাচে স্পেনের কন্সালকে পার্টনার পেলে এদেশের অজানা টাঙ্গোর জন্মভূমিতে যে রীতিতে একে অন্যের সঙ্গে সেঁটে গিয়ে দুই দুহু কুহু কুহু করতে করতে দো-দুল-দোলা জাগাও সেটা তোমার নিতান্ত বাহ্যরূপ, আসলে তোমার হৃদয় নামক বস্তুটি গড়া স্টেনলেস স্টিল দিয়ে। নাগরমল তুষ্ণীয়াল ভেজাল স্টেনলেসের রাজা, একদা তোমার এডমায়ারারদের রিংসিটে যে বসত সে চিনবে না আঁটি বস্তু। কিন্তু আমি প্রথমদিন থেকেই জানি, কী দারুণ রোমান্টিক তুমি। প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে পারতুম; হৃদয়ের শত সহস্র সংজ্ঞা, বহু বিচিত্র বর্ণনা আছে। তবু তুমি হৃদয় বলতে ভাবনার রাশিটাই যে তার মূল ধাতু সেটা মেনে নিয়েছ কেন? এবং সেই ভাবনারাশির সঙ্গে টানাপড়েন জড়িয়ে রয়েছে একটা অনাগত নৈরাশ্য- যেটা আমার মনে অহরহ এনে দেয় অজানা ভীতি।
শিপ্রা চায় না, তার আপন মনের মানুষ কোনও দুঃখ পায়– তা সে বাস্তব বা কাল্পনিক যা-ই হোক না কেন। বললে, আমি নৈরাশ্যবাদী নই। আমার কাছে বিশ্বসৃষ্টির কোনও অর্থ বা মূল্য এখনও ধরা পড়েনি। এর বেশি কিছু পাপষ্টি বলতে গেলেই আমি নিজের সঙ্গে নিজেই তর্কে জড়িয়ে পড়ব।
কীর্তি যেন একটু সাহস পেল। বললে, তা হলে তুমি বুঝতে পারবে অন্তত অনেকখানি। কিন্তু আমি যতদূর সংক্ষেপে পারি বলতে চাই, আমার বুকে একটা কাঁটা অহরহ খচ্ পচ্ করে খোঁচাচ্ছে সেটার কথা বলা দূরে থাক, ভাবতেও আমি চাইনে।
আমি জানি, তুমি রোমান্টিক। তাই আমার মতো অপদার্থ যখন একদিন তার জড়ত্ব ঝেড়ে ফেলল তখন তোমার আশা হয়েছে, আমি অবশ্যই একটা কৃতিত্ব দেখাতে পারব অসাধারণ না হোক, মামুলি বিস্বাদ, মিডিওকারের চেয়ে উচ্চ স্তরের, অন্তত সে ভিন্ন স্তরের তো হবেই, যতই ক্ষুদ্রতম ক্ষুদ্র হোক না কেন, আমার সাফল্য তার মধ্যে কিছু-না-কিছু একটা অসাধারণত্ব থাকবেই। কারণ, আমার জড়ত্বটা ছিল মিডিওকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের মামুলি বিরস চঞ্চলতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন– অসাধারণ বললেও অত্যুক্তি নয়, প্রশস্তি তো নয়ই।… কিন্তু আমি যতই ঘুরে-ফিরে সবকিছু দেখি, কোন পথে মুক্তি কোন দিকে আশার আলো তার সন্ধানে সর্ব চৈতন্য নিয়োজিত করি সেখানে কণামাত্র জড়ত্ব নেই, প্রচেষ্টাতে বিন্দুমাত্র শিথিলতা নেই- ততই স্পষ্ট অনুভব করি, আমি এমন কোনও সফলতা অর্জন করতে পারব না, যা দেখে তুমি গর্ব অনুভব করতে পারো–
এতক্ষণ কীর্তি কথা কইছিল মাথা নিচু করে। অকস্মাৎ যেন তার বুকে পরশ লাগল তারই চেনা আরেকটি বুকের অজানা স্পন্দন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনই শুধু সে শিহরণ জাগাতে পারে। চকিতে মাথা তুলে তাকাল শিপ্রার বিহ্বল মুখের দিকে।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আছে দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে স্নেহময়ী তুমি মাতা। সে মাতা আমাদের জনগণভাগ্যবিধাতাতেই সীমাবদ্ধ নন। সে মাতা দেশকালের অতীত– সে মা-জননী চিরন্তনী। তাঁর পরিচিত জনের নিত্যদিনের পরিচয় তাকে করে দেয় আমাদের কাছে অপরিচিত। নিত্যদিনের প্রাচীন অভ্যাস, সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে কজন ভাগ্যবান তাকে অকস্মাৎ একদিন চিনে ফেলতে পারার তুলনাহীন সম্পদ অক্ষয় অধিকার পায়। তাই না খ্রিস্ট বলেছেন, শিশুর মতো সরল হতে হবে তাঁকে দেখতে যদি চাও।
শিশুর মতো সরল চোখে তাই দেখতে পেল, সেই মধু মুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই। সুধাভরা আঁখি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
শিশুকে আদর করার মতো শিপ্রা টেনে আনল কীর্তিকে তার কোলের দিকে।
মা মেরির মতো প্রসন্ন কল্যাণ মুখ স্মিতহাস্যে আলোকিত করে বললে, তোর মতো সরল লোক আজ বিরল। তুই কি সত্যি ভেবেছিস, আমি মনের কোণে কখনও ঠাই দিয়েছি, তুই একদিন গারিবাদি হবি, মাদৃজিনি-র মতো হিরো হবি! আর, দূর বিদেশের জন্য খুনিয়া এক হিরো, আটপৌরে সমাজেও যে হিরোর মতো দাপাদাপি করত, সেই বায়রন গেলেন গ্রিসে, দেশটাকে মুক্ত করতে হিরো স্টাইলে মারা গেলেন বিষ্টিতে ভিজে, বেতো সর্দিতে, তার সঙ্গে এসে জুটেছিল সঁতসেঁতে বিলুয়া হাওয়ার জ্বর, পুব বাঙলায়ও বিলের অনটন নেই। এই বুঝি হিরোজনোচিত শেষ শয্যা গ্রহণের নাটুকে কায়দা! ওদিকে তাঁর প্রথম যৌবনের সামাজিক আচরণ তাঁর দেশবাসীরা তাদের বুকের পাথরে খোদাই করে রেখেছে খুবই গভীর অক্ষরে। গ্রিসের মতো একটা প্রাচীন সভ্য দেশের জন্য তার সর্বস্বান, আত্মত্যাগ, অকালমৃত্যুবরণ খান খান হয়ে গেল, না পেলেন ঠাই সেই পাথরে টক্কর খেয়ে। শেষটায় সেই নটিংহাম যেখানে একদা ডাকু-বীর রবিনহুড় তার প্রতাপ দেখিয়েছিল সেইখানে বীর বায়রন পেলেন ছ ফুট লম্বা তিন ফুট চওড়া গর্তে তাঁর চিরদিনের আবাস।… আর এখন তো দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। কম্যুনিস্ট ভায়ারাও রব তুলেছেন, প্রিয়েরে দেবতা করা চলবে না, চলবে না, চলবে না। ব্যক্তিবিশেষ কিছুই নয়। আমিও বলি, যদি কেউ থাকে তবে সে হরিপদ কেরানি।
বিস্তর লোক এখনও বলে, এককালে তো সবাই বলত, প্রকৃত বীরের প্রকৃষ্টতম উদাহরণ যদি দেখতে চাও তবে তার সন্ধান পাবে চার্চিল-এ। বলতে গেলে ওই একটিমাত্র লোক, অবহেলিত, বহু বৎসর ধরে তার পার্টিদ্বারা প্রায় অপমানিত, কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না– বাঙলাদেশ যেন এরই মতো কস্মিনকালেও না করে হিটলার যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চরম লাঞ্ছনাসহ পলায়িত ইংরেজের দেশে উইএনড় কাটাবার জন্য স্যান্ডউইচের রুটি কাটছেন। শত লক্ষ প্রাজ্ঞজন এখনও বিশ্বাস করেন, সেই বিকট সঙ্কট থেকে, সুনিশ্চিত বিনাশ থেকে ইংলন্ডে ও অসূর্যাস্ত কলোনিগুলোকে অবশ্যম্ভাবী শৃঙ্খলাবদ্ধ দাসত্ব থেকে পরিত্রাণ করতে আবির্ভূত হলেন, শ্বেত-কল্কি চার্চিলাবতার। কিন্তু… কিন্তু বুঝলে মিতা, স্বয়ং সেই চার্চিলও ভুলে গেলেন– কৃষ্ণাবতারও তো পরবর্তীকালে সীতা স্মরণে আনতে পারেননি– বেবাক ভুলে গেলেন তে হি দিবসা গতাঃ! এখন আর লাটবেলাটের বীরত্বের খড়ম পুজো করার দিন নেই। এখন গণতন্ত্র আর একচ্ছত্র মানে না, জমিদারবাড়িতে পাত পাড়তে যায় না, এখন পাঁচো ইয়ারে মিলে লাগায় পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো। সামত্ত জয়সেনের বীরত্বের যুগ ভিক্ষুণী সুপ্রিয়াদের ছায়াতলে স্নান। তিন মাস যেতে না যেতেই পঞ্চপিতার এক পিতা ভয়ত্রাতা চার্চিল পেলেন তার চরম অসম্মান। এককালে পিতা পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করত, গণতন্ত্রের যুগে পুত্রগণ–তারাই গণ, তারাই গণপতি, কবির ভাষায়, জয়ধ্বজা ওই যে তাদের গগন জুড়ে/পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে এখন পুত্রগণ পিতাকে ত্যাজ্যপিতা করে।
কীর্তি আরামের নিশ্বাস ফেলে বললে, আমার পিতা আমাকে অসংখ্যবার ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তুমি যে গণতন্ত্র গণতন্ত্র কপচাচ্ছ, বলছ, পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে, সেটা পূবের কোন দেশে চালু হয়েছে কও?
তোমার কথাও ঠিক, আমার কথাও ঠিক। গণতন্ত্রের পিটুলি গেলাতে যখন পাঞ্জাবিদের অরুচি ধরল তখন তারা আইয়ুবকে বানাল ডিকটেটর। অন্য দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে– ফিল্ড-এ জয়লাভ করে জাদরেলরা হতেন ফিল্ড মার্শাল; মার্শাল ল জারি করে আইয়ুব খেতাব নিলেন ফিল্ড মার্শাল। জেনারেল ইয়েহিয়া সেটার কার্বন কপি হলেন না। তাই তার জঙ্গিগুষ্টি তার প্রথম যৌবনের রক্ষিতা, বর্তমানে ইয়া ধুমসী লাশকে খেতাব দিয়েছে জেনারেল রানি। চীনেরা যে রকম কাগজের বাঘ বানায়, পা ভারতেও পেপার ডেমোক্রেসি, পেপার ডিকটেটর, পেপার পাদুর জেনারেল রানি।
কীর্তিকে আরও কাছে টেনে নিয়ে কিছুটা তিক্ততা কিছুটা করুণা মেশানো গলায় বললে, তোমার শক্তিতে যা আছে, তাই তুমি করবে। লঙ জাম্প মেডেলিস্টও আপন ছায়া লাফ দিয়ে ডিভোতে পারে না। আরেকটা সত্যে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুব বাঙলা যদি স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয় তবে স্বাধীনতা আনবে সে-দেশের চাষাভূষা, মাল্লামাঝি এমনকি লেঠেল-ডাকাতও কিছুদিনের তরে পৈতৃক ব্যবস্থা ক্ষান্ত দিয়ে তারা গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, পঞ্চতন্ত্র কিছুই বোঝে না। বুঝবার দরকারও নেই। সেই নিরীহ চাষা-বউকে ধর্ষণ করছে ইয়েহিয়া। ইছামতীর ওপার থেকে ওদের আর্তচিৎকার শোনা যায় এপারে, আমাদের পারে। একটা অতি নগণ্য সাপ্তাহিক থেকে আমার এক বন্ধু কাটিং পাঠিয়েছে–তাতে এক ফরাসি দরদি বলছে, যেন তারা আপন জাতভাই, এখনও যাদের দেশভাই বলে মনে করে, সে-সব পশ্চিমবঙ্গের লোককে চিৎকার করে আপন অসহায় অবস্থা জানিয়ে সাহায্য মাঙছে। তাদের আপন মরদরা তো সন্ধেবেলায়ই বন্দুকের গুলিতেই মরেছে আপন চোখের সামনে। তার পর সমস্ত রাত ধরে চলেছে অত্যাচার, টর্চলাইট দিয়ে বনবাদাড় থেকে খুঁজে বের করছে নতুন নতুন শিকার।
উত্তরে তোমরা বলেছ, ভাই, আমরা আছি।
তুমি যাবে পুব দিকে, ছায়ার মতো তোমার পিছনে আমি আছি।