তুলনাহীনা – ১ম খণ্ড

তুলনাহীনা – সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রথম খণ্ড

০১.

লে, চ, ঝপ করে আরেকটা গিলে ফেল।

না, দাদা। আমার আর সইছে না।

ওই তো তোদের দোষ। হুইস্কি, হুইস্কি আর হুইস্কি। স্কচ্ হুইস্কি। ভগবানের যেন খেয়ে-দেয়ে অন্য কোনও কর্ম ছিল না। তার কুল্লে রস ঢেলে দিলেন ওই ধেঋেড়ে পাহাড়ে স্কটল্যান্ডের খাজাদের মধ্যিখানে। আরে ব্যাটা ওইটেই যদি দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মাল হত তবে ওই খেয়ে ওদেশের লোকগুলো দুনিয়ার সেরা সেরা কেষ্টবিষ্ট হল না কেন? বাবুরা তো এখনও ইংরেজের গোলাম। ওদিকে দেখ, ফরাসিদের। শুনিনদের জাত। খায় দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মাল-বর্দো, বর্গন্ডি, শ্যাম্পেন। নাচে, গানে, প্রেমে–

কীর্তি বাধা দিয়ে বলল, বাঁচালে, সুদিনদা, তুমি তো জানো, আমি হপ্তা দু তিন ধরে—

একটি জান্-খুশ, দিল-তরুর পরীতে মজেছিস। তা বেশ, তা বেশ, তা বেশ। অতি উত্তম প্রস্তাব। তবে কি না আস্ত একটা আসুপ্ত ভলকানো। তা বেশ, তা বেশ!

এই আমাদেরই গানে গন্ধের চেয়ে গণগন্ধে ভরা কলকাতারই একটি অতি বিখ্যাত বার-এর সুমুখে দুটো দেড় গজি স্টেনলেস্ চোঙার লাল মুণ্ডর উপর বসে দুই ইয়ার পঞ্চ মকারের শ্রেষ্ঠতম যে মটি সর্ব বার-এ খুশবায়ে ম ম করেন তারই সেবা করতে মধ্যমণি তৃতীয় ম-এর আলোচনা-চরে নৌকো ভিড়িয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে দুজনাই ক্ষণতরে বার-এর গর্ভদেশের প্রতি প্রীতিপ্ৰসন্ন নড় করলেন। কারণ বার-এর বারাঙ্গনা কও আর বরাঙ্গনাই কও, বা-মেড় শ্রীমতি বেয়াত্রিচে ইতোমধ্যে লক্ষ করেছেন, দুনো ইয়ারের গেলাস তলানিতে এসে ঠেকেছে এবং সেটা যে তিনি অবশ্যই লক্ষ করেছেন তারই স্বীকৃতিস্বরূপ মোলায়েম মৃদুহাস্য মুখে মাখলেন। হেস্টিংস্ হার্ডিঞ্জের লীলাভূমি মহানগরীর মহা-বারু-এর মহারানির এতখানি দূরদৃষ্টি ও পরাভাবকাতরতা অবশ্যই আছে যে, এই খানদানি বার-এ কোনও মেহমানকে কোনও কিছু নিজের থেকে চাইতে হয় না–তা সে আই সে মিস্ বলে তাঁকে ডাক দিয়ে কিংবা শূন্য গেলাসের উপর ঠুংঠাং করে জলতরঙ্গ বাজিয়ে; এমনকি উচ্চ মঞ্চাসনের সামান্যতম উসখুস দ্বারা আপন অস্বস্তিটা প্রকাশ করে কোনও মেহমানকে কস্মিনকালেও সিন্নোরিনা বেয়াত্রিচের নেকনজর আকর্ষণ করতে হয়নি। সে-পরিস্থিতি, সে-ইনকিলাব ঘটবার বহুপূর্বেই বেয়াত্রিচে নিঃসন্দেহে আত্মহত্যা করবেন। সে আত্মনাশ জাপানি হারাকিরি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ংভূ।… কবে, কবে সেই ফিMো পেলিত্তি, তার পূর্বেকার স্পেনসার-এর আমলে এদেশে এসেছিলেন বেয়াত্রিচে গোষ্ঠীর প্রথম মহিলা। বসন্তসেনাশ্রেণিয়া মনোরঞ্জনী, চিত্তহরিণী এ পরিবার-বংশানুক্রমে।

এখনও আমাদের এই সমসাময়িক বেয়াত্রিচে বিপদে-আপদে উৎসবে-ব্যসনে সুদিনদা এবং তার পঁচো ইয়ারের সম্মানরক্ষার্থে তাদের পার্টির মক্ষিরানির রূপে সেখানে ত্রিযামা যামিনী যাপন করে আসেন। তাঁর এখন বয়ঃসন্ধিকাল, অবশ্য কিঞ্চিৎ ভিন্নার্থে; তিনি যৌবন আর ভরা যৌবনের মাঝখানে। আমাদের ইতিহাসে তিনি পরিপূর্ণ স্টার না হলেও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুল্লেখার মতো বার বার আমাদের সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগিয়ে যাবেন।… তাই এই বেলাই তাঁর সম্বন্ধে কিছুটা বলে নিতে হল।

আবার দেব? কিংবা ইয়েস্ প্লিজ? বাঁধা গতে বেয়াত্রিচে ফ্যালনা বার-মেডের মতো খদ্দেরদের সম্মুখীন হন না। সামান্যতম মৃদুহাস্য দিয়ে জানালেন, এই যে? অর্থাৎ জানি। কী চাই, কখন চাই, জানি। আসছে।

দুই ইয়ারও মানানসই স্মিতহাস্য না-বলা থ্যাঙ্কু জানালেন।

 ছিঁড়ে যাওয়া রসালাপের রিপকর্মটি করতে করতে কীর্তিনাশ চৌধুরী ঈষৎ অভিমানের সুরে বলল, সুদিনা, তুমি মাইরি আমার চেয়ে আর ক-বছরের সিনিয়র? আমাকে যা বলতে চাও সোজাসুজি কইলেই পারো। আস্ত একটা ভলকানো কথাটার মানে কী? মিস্ শিপ্রা ভোরের শিশির-ভেজা শিউলিটি নন সে তো তুমি জানো আমার চেয়েও বেশি। আর পাঁচজনের তুলনায় তুমি তাকে কতখানি বেশি জানো কিঞ্চিৎ গলা খাঁকারির পর– মানে, ইয়ে, কতদিক দিয়ে সেটা অবশ্য আমার অজানা, কিন্তু অশ্রাব্য হবে না, ভরসা আছে। তুমিই তো, বাপু, আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তাঁর সঙ্গে।

সুদিন চৌধুরী : অপরাধ করেছিলুম কি? চুপ করে রইলি যে? এবং এই চুপ করে থাকাটাই সদুত্তর। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে গভীরতম সত্য লুকনো আছে। এই যে তোদের পোয়েট রবিবাবু গেয়েছে,

দেখা হয়েছিল, তোমাতে আমাতে
কী জানি কী মহা লগনে

কেন বাপু, শুভ লগনে বললে অপরাধটা কী হত? অ। তা হলে তেনার অরিজিনালিটি থাকত কোথায়? তাই না? যেদো-মেদো, এস্তেক মুসলমানদের গাইয়া পোয়েট বসিরুদ্দি মৃদম খা তক শুভ লগনটা অ্যামন জাবড়ে ধরে আছে যে ঠাকুরবাড়ির তেতলার কবি, রাজপুত্ত্বর দ্বারকানাথের নাতি, আগাপাশতলা একটা নয়া ধর্মের ভগীরথ দেবেনঠাকুরের নন্দন নোবেল ঘোড়ার রেসে পয়লা নম্বরি সওয়ার তিনি ওই হাজাপচা শুভ লগনটা এস্তেমাল করেন কী প্রকারে? না? কিন্তু তা নয়। এ উত্তরটা অতি রদ্দি মার্কা প্রোলেতারিয়ার যা-তা উত্তর। আসলে ওই যে যেতে যেতে পথে দেখাটা হয়ে গিয়েছিল তার ফলে হল প্রেম– পূর্বরাগ, অনুরাগ, চুম্বন, আলিঙ্গন-এটসেটরা-গয়রহ ইত্যাদি, কিন্তু সে-সব থাক্। ওসবের কথা তুললে কফি হৌসের তরুণরা তেড়ে আসে। প্রেমের এসব বস্তাপচা প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি এখন যাদুঘরের মাল মুজিয়াম পিস। হক্ কথা। কিন্তু দাদা, তার সঙ্গে সঙ্গে যে-বিরহ, হু করে বিবিজান তোমাকে ঠাঠা রোদ্দুরের ব্লদেভুতে ছিবড়েটার মতো ফেলে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন লেকচারারটার সঙ্গে সিনেমায় আরও কত কী, সেগুলো কি শুভ লগনে দেখা হওয়ার সিমটম মোটেই না। মিলনের চুম্বন = শুভ-লগন + রাঁদেভুতে কর্ণমর্দন = অশুভ লগন। একুনে, মহালগন।

তোকে যে ম্যাডাম শিপ্রার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলুম সেটা মহালগন। শিপ্রাপারে পৌঁছে গেছিস, আর তোর মাথাব্যথা কিসের। শিপ্রা তো মধ্যপ্রদেশে? না? ঝেড়ে দে না একখানা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম ওই প্রভিনসের টুরিস্ট ব্যুরোকে। ব্যস। তবে হ্যাঁ, ওদের ব্লেজার ট্রিপ লাঞ্চে আকছারই যাত্রী থাকে দেদার।

তা সে যাক্ গে। কথা হচ্ছিল,

আখ-খ-খ। শাস্ত্রালোচনায় অহরহ বিঘ্নবিপত্তি!

কী ব্যাপার?

 বার-টার পাশেই ডাইনিং-ডানসিং-কাবারে এই তিন প্রকারের আনন্দভবন মিলিয়ে ঢাউস এক জলসা-দরবার। বার-এ তো মেয়েমদ্দে গিসগিস করছিল, সে তো প্রায় উদয়াস্ত লেগেই আছে। কিন্তু নবাব খাঞ্জা খাঁর আসল রঙ-মহল পাশের সেই পঞ্চরঙ্গের শ্রীরঙ্গমে একবার কেউ সম্মুখসগ্রাম লড়ে সে ভিড়ে প্রবেশ করতে পারলে সে ব্যক্তি আর কস্মিনকালেও বলবে না, কলকাতার বাসগুলো বড় ক্রাউডেড। আপনি শক্তসমর্থ জোয়ান মদ্দ মানুষ–আপনার নিতম্ব নিমর্দিত হবে মুহুর্মুহু। আপনি ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন মানেন– আপন রিজার্ভড় টেবিলে পৌঁছতে না পৌঁছতে আপনি দলিত মর্দিত পিষ্টিত এবং আলিঙ্গিত হবেন কেরালার তন্বী শ্যামা থেকে আরম্ভ করে, নর্ডিক ব্লন্ডিনীগণের অকৃপণ সহযোগিতা পেরিয়ে সর্বশেষে পুঞ্জীভূত মাংসাধিকারিণী মার্কিনিদের সঙ্গে অগুনতি কলিশন লাগিয়ে লাগিয়ে নব নব রেকর্ড নির্মাণ করে করে।

সেখানে লেগেছে আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়া এক ধুন্ধুমার।

আমাদের দুই ইয়ার এসব ব্যাপারে সচরাচর নির্বিকার। বলতে গেলে এরা এবং এদের গণ্ডা দুই দোস্ত মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে হাঁটতে শিখেছেন এই জলসাঘরেরই মার্বেল পাথরের মেঝের উপরে।

কিন্তু আজ ভিন্ন গীত।

কাইরো না বেইরুৎ কোথা থেকে এসেছেন সদলবল এক বিশ্ববিজয়িনী নর্তকী। উর্বশী মেনকা থেকে আরম্ভ করে ইজাডরা ডানকান্ আনা পাভলোভা তক আবহমান কাল থেকে আর সবাই নেচেছেন দু খানা পা দিয়ে, কিন্তু এই দিগ্বিজয়িনী নাচবেন পেট দিয়ে। সোনার পাথরবাটিও বুঝি কিন্তু, কিন্তু পেট দিয়ে নাচ!

সাপ হাঁটে পেটের উপর দিয়ে কিন্তু সে-ও তো দেখি নাচের সময় পেটের তোয়াক্কা না করে নাচে কাঁধ দিয়ে, ফণা দিয়ে, কোমর দিয়ে, ল্যাজ দিয়ে, যদিও সাপের পেটটা তার দেহের আগাপাশতলা জুড়ে। আর যদি ভাবার্থে নেন তবে এই সেই উদরসব ফিরিঙ্গি জাত, সে-ও তো পাক্কা দু শোটি বচ্ছর এদেশের চাষাভূষোর অন্ন মেরে আপন পেট ফাটিয়ে দিল, কিন্তু কই, তাকেও তো কখনও ওই দুনিয়া-খেকো পেট দিয়ে নৃত্যের তালে তালে মা মহারানির বন্দনা করতে দেখিনি।

যে কলকাতার তাবল্লোক পাঁচপেয়ে বাছুর দেখার তরে রিস্টওয়াচ গচ্ছা দিয়ে রেস্ত জোগাড় করে তারা আসবে না হদ্দমুদ্দ হয়ে এই বেলি-ডান্স, ঔদরিক নৃত্য পেটভরে দেখতে।

দুই ইয়ার ওই উত্তাল জনসমুদ্র উলুজ্জন অসমীচীন বিবেচনা করে জোগাড় করলেন একখানা উচ্চপদী চেয়ার। তার উপর দাঁড়াতেই স্পষ্ট দেখা গেল নাতিবিস্তীর্ণ নটমঞ্চ।

তখনও উচ্ছেভাজার পয়লাপদ শেষ হয়নি। অর্থাৎ নটরাজ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নন্দীভৃঙ্গী দু কদম আনাড়ি নৃত্য নেচে নিচ্ছেন। তখন বোঝা গেল, হট্টগোলটা উঠেছিল বিরক্তি এবং কথঞ্চিৎ উন্মা বশতও বটে– এসব হাবিজাবির ঠেলায় মেঘে মেঘে যে বেলা হয়ে গেল, আসল মাল বের করবে কখন? এরা কি পিত্তি না চটিয়ে খেতে জানে না।

হঠাৎ সব আলো ক্ষণতরে নিভে গেল। পাঁচ নাগর তার ফায়দাটা ওঠাবার পূর্বেই নন্দনকানন থেকে নেমে এল এক শ্যাফট নীল আলো। আবছা আবছা দেখা গেল যেন সমুদ্র থেকে ভেসে উঠছেন মরুভূমির স্কি, কিন্তু, তন্বঙ্গী নারীরূপিণী এবং দেখা-না-দেখার আলোছায়ার ইন্দ্রপুরীর যেন ইন্দ্রধনু।

সে আবেশ কাটতে না কাটতেই আরও অকস্মাৎ কী হতে কী যেন হয়ে গেল। হলসুষ্ঠু তাবজ্জন যেন বানের জলে হাবুডুবু খেতে লাগল। নাহ! তেমন কিছু একটা প্রলয়ঙ্করী ব্যাপার নয়। মাত্র গণ্ডা দশেক সূর্য জলসাঘরের মধ্যিখানে যেন একটা এটম বমের মতো ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর তারই আচমকা ধাক্কায় তাবৎ পেট্রন-পেট্রনিদের চোখের মণি গেছে উল্টে–সেঁধিয়ে গেছে ভেতর বাগে।

স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে নটরানি– সেই বন্যার উপরে স্টেজের মাঝখানে।

সম্পূর্ণ নিশ্চল। চোখের পাতাটিতে পর্যন্ত কম্পন শিহরণ স্পন্দন কিছু না, কিচ্ছুটি নেই। কিন্তু ওই নিশ্চলতা থেকে সঙ্গে সঙ্গে যেন কোন এক চুম্বন সক্কলের দৃষ্টি টেনে নিয়ে গেল নটরানির নাভিকুণ্ডলীর দিকে।

টগর ফুলের পাপড়ি কোমর বেঁকিয়ে যেন সর্বাঙ্গে পাক খেয়ে ঢলে পড়ে পাশের পাপড়িটির উপর, তিনি ফের তার সখীর উপর এবং এই করে করে মাঝখানের স্থির বিন্দুটিকে কেন্দ্র করে সবকটি সখী যেন নেচেই যাচ্ছেন, নেচেই যাচ্ছেন একে অন্যের পিছনে আমৃত্যু সে রাসনৃত্য!

নটরানির নাভিকুণ্ডলীটি যেন টগরিনীদের রানি।

ক্ষুদ্রাতিতম ক্ষুদ্র নটরানির নাভিটি; কেন্দ্রবিন্দুটি। আর সেই বিন্দুটিকে কেন্দ্র করে হুবহু টগরের পাপড়ির মতো মাংস বলুন, পেশি বলুন, একের পিছনে আরেকটি যেন নেচে চলেছে চক্রাকারে। নাভিকুণ্ডলীর দয়ে যেন ক্রমাগত পাকের পর পাক খেয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুগঠিত পেশি-পাপড়ি।

টগরের পাপড়ি নাচে এক জায়গায় ধীরস্থির দাঁড়িয়ে। এস্থলে তা নয়। এ নারীর কুণ্ডলী-পাপড়ি পরিপূর্ণ প্রাণবন্ত। এরা একে অন্যের পশ্চাতে কভু দ্রুত কভু মন্দ লয়ে যেন চটুল পদক্ষেপে পটীয়সী রাশান বা-এ নর্তকীর মতো নৃত্যে নৃত্যে চক্র রক্ষা করে।

নাভিকুণ্ডলী নিয়ে এ হেন ভেল্কিবাজি দেখানো যে সুকঠিন, সুকঠিন কেন, অসম্ভব সে তত্ত্ব যে কোনও মাল-ডান্সার কসম খেয়ে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু এহ বাহ্য, আগে গিয়ে পূর্ণ সত্য অনুভব হয় তখন, যখন রাত-কানা জনও হঠাৎ লক্ষ করে যে নটরানির বাদবাকি সর্বাঙ্গ নিশ্চল, নিষ্কম্প প্রদীপশিখাবৎ। বস্তৃত ওই যে ওটা গতিশীলা নিঝরিণী নয়, নিতান্তই সীমাবদ্ধ নিস্তরঙ্গ নিষ্প্রাণ সরোবর, অর্থাৎ দয়ের পাকচক্রে না থাকলে মনে কোনও দ্বিধারই উদয় হত না–এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, প্রতিমা নিশ্চয়।

কীর্তিনাশ ফিসফিসিয়ে বলল, ঃ। এ তো স্রেফ হুনুরির একটা কৌশল! এতে আর্ট কোথায় জানেন শুধু কুবের কুল মেড়ো গুষ্টি। পেরেকের বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে কাটান যারা বর্ষা-বসন্ত তেনারা তা হলে এ মহাপ্রাসাদের বিজয়িনী মিশরিনীর চেয়ে হাজার দফে গুনিন পাভলোভা-শঙ্করের শুরুর গুরু। হবেও-বা। নইলে এ মহফিলের চাই সব মেডোরা এখানকার নাভিকুণ্ডে স্নান সেরে নাক বরাবর ধাওয়া করবেন কেন পেরেক শয্যাশায়ী শুরু মহারাজকে ঢিপ ঢিপ করে পেন্নাম জানাতে? ধন্যি, বাবা, তোমাদের আর্ট, নৃত্যকলা উর্বশীমার্গে মোক্ষলাভের চতুর্থ মার্গ!

ইয়ার সুদিনদা ঢের ঢের উঁচুদরের খলিফে। কীর্তিনাশের পাঁজরে কনুই দিয়ে একখানা সরেস গুত্তা মেরে বললেন, ওরে আচাভুয়ো চাটচিস হুইস্কির বোতলটা, আর শুধোচ্ছিস এতে আবার নেশা কোথায়? সবুর কর এক লহমা। এখখুনি তেড়ে আসবে উড়ের হাত থেকে হোজের জলের তোড়ের মতো রসের মুগুর। কালবোশেখীর ঝড়ের আগে, বটগাছের মগডালে অ্যাটুনটুন কাঁপন। উপস্থিত শুরু হয়েছে তারই যেন দোহার। দাঁড়া না, হুড়মুড়িয়ে ঝড় নামল বলে।

একদম করেকট আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বেতারকে ঢিঢ দিয়ে।

তবে হ্যাঁ, আলবৎ, ঝড়টা হুড়মুড়িয়ে নামেনি। নামল ধীরে মন্থরে। কিন্তু দিগবলয় আচ্ছাদন করে।

পুকুরের মাঝখানে ঢিল ছুড়লে যেমন সেখান থেকে চক্রটি চতুর্দিকে চক্রাকারে ক্রমে ক্রমে সম্প্রসারিত হতে থাকে এ ক্ষেত্রেও হুবহু তাই। নাভিকুণ্ডলীর নৃত্য ডাইনে-বাঁয়ে সম্পূর্ণ নীবিবন্ধকে উদ্বেলিত করে তুলল। এদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যে-রসকে বাজুবন্ধ খুল খুল যাওত রূপে সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এস্থলে সে-রসই বাজুচক্র ত্যাগ করে কটিচক্রে সঞ্চারিত হল। নাভিচক্র থেকে উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত হয়ে কম্পন আন্দোলন হল ঊর্ধ্বমুখী অধোগামী। সর্বদেহে কী আবেগ, কী আবেশ। হৃৎপিণ্ড মুহ্যমান।

পঞ্চেন্দ্রিয়, সর্বচৈতন্যের বিলুপ্তি আসন্ন।

 বেয়ারা কীর্তিনাশের কানে কানে বলল, হুজুর, আপকে লিয়ে বহুত জরুরি ফোন।

.

০২.

হ্যালো?

হ্যালো। কীর্তি? শোনো–

এ যে একেবারে নয়া ব্যাপার। কীর্তির হৃদয়দুয়ারে লিলি ডলি বুজু নরগিস মাঝে মাঝে টোকা দিয়েছে বটে কিন্তু সে নিতান্ত হলে হল, না হলে না গোছ কিংবা অগত্যা ইংরেজিতে যাকে বলে অন্য এ রেনি ডে; আর এ হল ঠিক তার উল্টো, এখানে রে নামল খা খা খটখটে শুকনো মাঠে।

তুমি আধঘন্টাটাক পরে এখানে আসতে পার?

কেন? ব্যাপার কী?

মানে? তুমি কি কিছুই বুঝতে পারো না? তোমার কি কখনও বয়স হবে না? কেন, কেন, কেন? মিস্ত্রিকে বুঝিয়ে বলতে হয় কেন তাকে ডাকছি, দর্জিকে ডাকার কারণটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হয়! তুমি কোনটা যে তোমাকে কারণ দেখাতে হবে?

বেচারা কীর্তিনাশ। এই অবেলায় অকস্মাৎ অযাচিত অনুগ্রহ। এখন কি আর তার সে বোধশক্তি আছে যে কোনটা ঘটে সকারণে আর কোনটা ঘটে দেবতাদের যখন নিতান্তই কোনও কিছু করবার থাকে না বলে মানলি রিটার্নে নাম্বার অব অ্যাশ টেকেন দেখাবার তরে। শিপ্রা তখন দেবতাদের একজন। মূর্খ কীর্তির বোঝা উচিত ছিল, অকারণ অনুগ্রহই অনুগ্রহ।

হঠাৎ অতিশয় মধুরা নিস্তেজ গলায় কীর্তি, আমার বড় লোনলি লাগছে যে। তুমি এস।

খুট!

কে বলে কীর্তির নাম কীর্তিনাশ! কীর্তিমান পুরুষ সে। কীর্তিনাশা নদী যখন ওই বংশের সর্বশেষ সন্তানের সর্বশেষ পুকুরটি(!) পর্যন্ত গ্রাস করে ঢেউয়ের ডাকে ডাকে ঢেকুর তুলছেন তখন জন্ম নেয় এই সন্তান। বংশটা লোপ পেলেই করালী কীর্তিনাশা নদী আপন কৃতিত্বের পরিপূর্ণ সাফল্যলাভের আত্মপ্রসাদ প্রসাদাৎ অবশ্যই একটা কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করতেন যে ভূমি গ্রাস করেছেন তারই কোনও এক ভেসে-ওঠা অংশের বালুচরে। সেটা যখন নিতান্তই হল না তখন শেষ সন্তান কীর্তিনাশ নামের স্কন্ধে পীঠ স্থাপনা করে একাই চৌষট্টি-যোগিনী রূপে উচাটন নৃত্য নেচে যেতে লাগলেন।

ফোন ছেড়ে ভরাপাল তুলে বার-এ ফেরার সময় কীর্তিনাশ আপন পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে মনে মনে বলল, ছোঃ, আমার নাম কীর্তিনাশ না কচুনাশ। শিপ্রাপুলিনবিহারী নাগরদের এক ফুঁ মেরে পাঠিয়ে দিলুম পদ্মর হে-পারে। সুদিনদাটা একদম বুড়ব। বলে কি না, ঘুড়িবুড়ির দোআঁশলা না কী যেন। যে রমণীর চতুর্দিকে অষ্টপ্রহর কবি সাহিত্যিক ফিলিমস্টাররা ঘুর ঘুর করছে, যার জিরোবার তরে একলহমা ফুরসত নেই সে মেয়ে ফিল করছে লোনলি। তার হৃদয়টা অত সহজে ভরে না। সুদিনের কথার কোনও মানে হয় না।

বার বার কীর্তিনাশের বুকের রক্তে রিনিরিনি করে বেজে উঠছে আমি লোনলি এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বচৈতন্যে ছড়িয়ে পড়ছে গভীর এক প্রশান্তি।

আবার তার মন ভরে জেগে উঠল, আমি লোনলি। কেমন যেন মনের ভিতর হঠাৎ কে যেন একটা ইয়া লম্বা বিজয়-পতাকা খাড়া করে খটাস করে মিলিটারি কায়দায় তাকে একটা সেলুট ঠুকে জানাল সে বীর, সে বিজয়ী; শিপ্রা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বয়ংবরে সে প্রিন্স্ এলবার্ট। কে না জানে ইয়োরোপের সর্বদেশের রাজপুত্ররা তখন জমায়েত হয়েছিলেন লন্ডনে যে যার রাজাড়ম্বর নিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে কীর্তিনাশের বুকের ভিতর কে যেন বলে উঠল, ছিঃ! এ কী কথা! এটা কি আলিপুরের ঘোড়দৌড় যে তুমি পয়লা নম্বরি হয়েছ বলে দেমাকে মাটিতে পা পড়ছে না–ফারাক শুধু এইটুকু, ঘোড়ার চারটে পা, তোমার দুটো।

কে বোঝে এই সামান্য সত্যটুকু? ইহসংসারের সুদূরতম প্রান্তে একটি রমণী হোক। সে সুন্দরী সদাচার, হোক সে উপেক্ষিতা কদাকার– তার জীবন যেন হঠাৎ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে, মহাশূন্যে সে যেন হঠাৎ একা, সে লোনলি। সে তখন স্মরণ করল তোমাকে। তোমাকে স্মরণ করেছে– এর পর তো আর কোনও চরমতর সত্য নেই। এর থেকেই তো প্রতিষ্ঠিত হল যা জীবের কাছে চরমতম উপলব্ধি সে আছে, তার অস্তিত্ব তার নিজের কাছে এই প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করল।

***

ওরে ইডিয়ট এদিকে আয়। কেটে পড়ছিস যে বড়!

হ্যাঁ, আধ ঘণ্টা পরে যেতে বলেছে। ততক্ষণে ঝপ করে আরেকটা

 বার-এ তখন পুরোদমে যা তর্কাতর্কি চলেছে কোথায় লাগে তার কাছে উভয় ভিয়েতনামের লড়াই। যদিও তর্কের বিষয়বস্তু কবে সেই প্লাতো না লাওৎসের আমল থেকে।

ডানস– বেলি ডানস্– সেকস্।

সরকার পক্ষের প্রধান বক্তা কিউ সি শ্ৰীযুত সুদিনের মুখে এক বুলি। আর্ট ফর আর্টস সেক্। সঙ্গীত হোক, কাব্য হোক, নৃত্য হোক– তার একমাত্র উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি করা। বিদ্রোহী কবিতা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে দেশের স্বাধীনতা আড়াই মিনিট আগে এল না পরে এল, মোনা লিজার ছবি দেখে তাবৎ ফরাসিনী পুত্রশোকে কাতর অবস্থায়ও আ লা মোনা লিজা মুচকি মুচকি হেসেছিলেন কি না, কিংবা বিলকুল শব্দার্থে কান-কাটা ভান গগের ছবি দেখে চিত্ৰামোদীগণ আপন আপন কান কাটাবার জন্য সার্জনদের কসাইখানায় কিউ কেটেছিলেন কি না সেটা সম্পূর্ণ অবান্তর। বেলি-ডান্স ইজ বেলি ডান্স্। আসল দ্রষ্টব্য, উদরমণি নাভিসরোবরে রূপসাগরের যে তুফান জেগে উঠল সেইটে দেখে তোমার চিত্তরাজ্য কি আকুল হয়ে ওঠেনি ওই সরোবরে অবগাহন করে হৃদয়জ্বালা জুড়োতে? তুমি কি ভুলে যাওনি ক্ষণতরে ক্ষুদ্র ওই নাভিকুণ্ড বিশাল চিল্কা কুণ্ড নয়, তুমি

কীর্তির মনে অন্য ভাবনা। শিপ্রার কাছে যাব কোন ড্রিংক খেয়ে? হুইস্কি মুইস্কি চলবে না। বে-এক্তেয়ার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। একদম সাদা চোখেও যাওয়া যায় না। পুরুষের যে তেজস্ বিচ্ছুরিত হয় তার ব্যক্তিত্ব থেকে, তার পৌরুষ সত্তা থেকে সেইটেই তো রমণীকে মুগ্ধ করে বিহ্বল করে, সেটাকে কোনও একটা ড্রিংক মারফত কিঞ্চিৎ মরাল সাপোর্ট তো দিতেই হয়। নাহ্- ওসব বিচার-বিবেচনা করা বেকার। কলকাতার কুল্লে নটবর, কড়ির কুবের, কালোবাজারের নম্বরি নম্বরি ঘড়েল যারা চালাকি আর মিষ্টি হাসির বঁড়শি দিয়ে চিফ ডিটেকটিভের নাড়িভুড়ি থেকে গোপন কথার এপেডিক্স টেনে বার করতে পারে তাদের সব্বাই হার মেনেছেন শিপ্রাদেবীর টেনিস-লনের ওয়াটারলুতে। তিনি মোহাতুর হন, তার সর্বাঙ্গে আবেশ লাগে, তাঁর বক্ষে অরণ্যমর্মর জেগে ওঠে- সবই। ওদিকে কিন্তু বিচার-বুদ্ধির মেকদার জ্ঞান অষ্টপ্রহর ঝাঝালো বাঙাল কাসুন্দির মতো। তাই তোমার মাথাটি রাখতে হবে ফ্রিজের আইস বসে। তার গড়া ট্রাফিক আইনের রেড লাইটটাকে পিংক মনে করে মাত্রা ছাড়িয়েছ তো গেছ। পক্ষান্তরে তিনি যে ভাগ্যবানকে গ্রিন লাইট দেখান তার ট্রাফিক রেগুলেশন সম্বন্ধে, কীর্তিনাশের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আজকের এই ভর রাতের ফোনে যেন কাঁচা সবুজের আবছা আবছা আভাস দেখতে পেল। সুতরাং বহু আত্মচিন্তা ততোধিক পরকীয়া কিংবদন্তি সুবিবেচনা করে কীর্তি স্থিরনিশ্চয় হলেন এহেন পরিস্থিতিতে ড্রিংকরূপে ক্রেম দ্য মৎ-ই প্রশস্ততম এবং তদনুযায়ী ড্রিংক শেলফের দ্বিতীয় স্তরের পূর্বতম প্রান্তে ক্ষণতরে কটাক্ষ হানল। বেয়াত্রিচের বরদাপাণি সেদিকে প্রসারিত হল।

ড্রিংক সমস্যা সমাধান করার পর কীর্তির কান গেল বেলি-ডানস্ তর্কাতর্কির দিকে।

সুদিন-বৈরী শঙ্কর বলছে রেখে দাও আর্ট ফর আর্টস সেক। নাইট ক্লাব, কাবারে ললিতকলা অ্যাকাডেমি নাকি যে এখানে সেই কাইরো না মরক্কো থেকে আসবেন খাপসুরৎ খাপসুরৎ উপকিরা পপ্যার আর্ট আর এপলাইড আর্ট বাবদে আমাদের তালিম দিতে? উইদ ডেমোনস্ট্রেশন। সেইটেই হল আসল তত্ত্ব। আর আর্টের কথাই যদি উঠল তবে বলি, প্রকৃত আর্ট আদ্যন্ত সবকিছু প্রকাশ করে না– ইঙ্গিত দেয় বহু না-বলা, অ-চাখা রসের প্রতি। আজকের নাচে নাভিকুণ্ডলী থেকে নৃত্যরস বহির্গত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে শিহরণ কম্পন জাগিয়ে তুলল এবং নিম্নগামী হয়ে যে রূপে প্রকাশ দিল তার ইঙ্গিতটা ছিল কোনদিকে? সেটা অশ্লীল।

এক ঠোঁটকাটা সদ্য বিলেতফের্তা হাবা সেজে শুধাল, ইঙ্গিতটা কোন দিকে ছিল সেটা আগিয়ে বুঝিয়ে বলুন, তবে তো করা যাবে শ্লীল-অশ্লীলের বিবেচনা।

আখ! তুমি কী সেখানে ছিলে না? যৌনসঙ্গম।

সুদিন অত্যন্ত বিরক্তি এবং তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যৌনসঙ্গম আবার কবে থেকে অশ্লীল হল?

.

০৩.

এসো।

আমাকে যে স্মরণ করেছ তাতে আমি ভারি খুশি হয়েছি। আসলে বলা উচিত ছিল, গর্ব অনুভব করেছি।

না আনন্দটাই বড়। কে কাকে কতখানি আনন্দ দিতে পারে বল।

তোমার কথাই সই। কিন্তু হঠাৎ তুমি এরকম লোনলি ফিল করলে কেন বলল তো? কলকাতার কোন ক্লাব, কোন পাটি, কোন শো থেকে তুমি প্রতিদিন নিমন্ত্রণ পাও না? অবারিত দ্বার একটা কথার কথা। তোমাকে তো সবাই লুফে নেয়। আর তুমি কি না লোনলি!

কিছুমাত্র ছলনা বা ভান না করে শিপ্রা বললে, কীর্তি, তোমার প্রাণরস অফুরন্ত, তোমার মতো অহরহ সজীব আমি খুবই কম দেখেছি। তাই তুমি সহজে বুঝবে না, জনতার মাঝখানে একটা মানুষ কতখানি নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, পরিত্যক্ত হতে পারে। আমার কথা বাদ দাও– এক্কেবারে পয়লা নম্বরিনীদের কথা চিন্তা করো তো : দিনের পর দিন তারা পার্টি পরব ফাঁকশনে যাচ্ছেন, তাঁদের চতুর্দিকে সমাজের সবচেয়ে উঁচু কাতারের পয়সাওলা, খ্যাতিমান শক্তিমান সবরকমের প্রভুরা। আর রয়েছে স্মার্ট সেন্টু। তারা স্মার্ট উইটি কথা বলে, টিপ্পনী কাটে আর সুন্দরী গরবিনীর স্মার্ট উত্তর দেন, যারা পারেন না তারা অন্তত মৃদু হাস্যের তারতম্য দিয়ে কোনটা ভালো কোনটা মাঝারি তার সার্টিফিকেট দেন। আচ্ছা, তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছ, এই সমস্ত ব্যাপারটার উদ্দেশ্য কী, অর্থ কী?

না। তুমি ভালো করেই জানো, আমি খুব চিন্তাশীল প্রাণী নই।

শিপ্রা তার সুডৌল ঘাড়টি আরেকটু উঁচু করে কীর্তির চোখে চোখে তাকিয়ে বললে, ওটা আর কিছু না। ওটা বর্তমান সমাজের একটা প্যাটার্ন মাত্র। চলছে, চলবে হয়তো বহুদিন ধরে, কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে আগাপাশতলা বদলে যেতে পারে।

মানে?

 অতি সহজ। লন্ডনে এ প্যাটার্ন অনেকদিন ধরে গড়ে উঠেছিল। এবং তার গোড়াপত্তন করেছিল সে-দেশের খানদানি লোক। অথচ যেই লাগল লড়াই অমনি তার বড় ভাগটা হয়ে গেল উধাও। বাকিটুকুও ভোল পাল্টে নিল রাতারাতি। কোথায় গেল হাওয়ায় হাওয়ায় মিলে-যাওয়া সিল্কের বুক-কাটা, কোমর-হ্যাঁচা গাউন, অদৃশ্য সিল্কের ফ্রেশ কালার মোজা আর ত্রিভঙ্গ গোড়ালির জুতো! সবাই পরে নিল কাঠখোট্টা চামড়ার চেয়ে পুরু কাঁথার ইউনিফর্ম—প্রাইম মিনিস্টারের বেগম গিয়ে দাঁড়ালেন কিউয়ের ন্যাজে– রেশনশপের সামনে।

আর আমাদের এই কলকাতার প্যাটার্নটা

হঠাৎ থেমে গিয়ে শিপ্রাদেবী বললেন, ওহ! আই এম ফ্রাইটফুলি সরি। তুমি এখানে এসেছ বার ছেড়ে নাক বরাবর। আর তোমাকে একটা ড্রিংক অফার করিনি। কী খাবে বল।

কীর্তি আমতা আমতা করে বললে, না– তা–

শিপ্রা খিলখিল করে হেসে বলল, পষ্ট গন্ধ পাচ্ছি খেয়ে এসেছ ক্রেম দ্য মৎ– আরও কাছে এসে বসো দিকিনি। যে সোফাটাতে সে আধশোয়া অবস্থায় পা দু খানি গুটিয়ে রেখেছিল তারই একটুখানি একপাশে সরে গিয়ে একটান মেরে বসিয়ে বলল, ঠিক ধরেছি। তা এই অবেলায় ক্রেম দ্য মৎ কেন? জব্বর একটা ব্যানকুয়েট খাওয়ার পর ক্রেম দ্য মাৎ দিয়ে মুখশুদ্ধি করেছ বুঝি?

কীর্তি আকাশ থেকে পড়ে বললে, ব্যানকুয়েট! আজ আবার কিসের পরব যে ব্যানকুয়েট হবে। মান্থলি ডিনারও তো পরশুদিন। অবাক করলে বাছা তুমি।

কিসের পরব? আজ তো পরবস্য পরব। গ্রেট বেলি-ডাসের গ্রেটার ব্যানকুয়েট। বেলি-ডানস্ দেখবে বুঝি একাদশীর ফাঁকা পেট নিয়ে? বেলি-ডাস্ দেখতে হয় ফুল বেলি নিয়ে। লিকউইড সলিডে হাফাহাফি। তা সে যাক গে। এসো আমরা দুজনাতে সেলিব্রেট করি ওই মারাত্মক অমিশনটা। শ্যাম্পেন খাবে? বলতে গেলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন গোত্রের কয়েকজন আমার কাছে আছেন। তোমার জন্য বাকেটে বরফ দিয়ে রেখেছি। ওই সেই ঘরটায় পাবে।

শিপ্রার বেশভূষা, তার মোটরগাড়ি দেখলে যে কোনও লোক ভাববে এ মহিলার যা রুচি, প্রতিটি আইটেম এমনই মানানসই যে তার বাড়ি, ড্রইংরুম ড্রাইনিংরুম নিশ্চয়ই অতিশয় নিখুঁত কায়দায় সাজানো– কোনওপ্রকারে কোনও জায়গায় ছন্দপতন হওয়া অসম্ভব। অথচ প্রথম দর্শনে স্মার্ট সেটের যে কোনও ব্যক্তি বিস্মিত হবে। ঘরের একপ্রান্ত থেকে যে কালারস্কিম আরম্ভ হয়ে শেষ প্রান্ত অবধি ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে যাবে, আর আসবাবপত্র কার্পেট কার্টেন ছাত দেয়াল, মাথার উপরের এবং চারদিকের আলো সেই স্কিমের সঙ্গে মিল খাইয়ে যেন একটা হারমনি গড়ে তুলবে এখানে সে কম্পোজিশন একেবারে নেই সে-কথা বলা চলে না, আবার আছেও বলা চলে না। এ কথা তো শিপ্রা-দেবীর বুদোওয়ার না দেখেও বলা চলে সেখানে দৃষ্টিকটু কিছুই থাকতে পারে না কিন্তু সেই অনিন্দ্যসুন্দর সামঞ্জস্যটা তো চোখে পড়ে না।

কিন্তু দু-তিন দিন ধরে সে ঘরে বসলে, চা খেলে তখন বোঝা যায় শিপ্রা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ঘরটি গুছিয়েছে। উদ্দেশ্য দুটি : আরাম এবং একবার এক জায়গায় আসন নিলে যেন ফের উঠতে না হয়। কোচ সোফার হাতার ভিতর থেকে অ্যাশট্রে, ড্রিংকের গেলাস রাখার রিং ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিস তো বেরুবেই, ছোটখাটো ব্রেকফাস্ট খাবার মতো ফোল্ড করা একটা ফ্রেমও ঠিক ফিট করে যায় যার উপর বেয়ারা খাবারের ট্রে চায়ের সরঞ্জাম অনায়াসে রেখে যেতে পারে। আর পাঁচটা অতিশয় ফ্যাশনেবল ড্রইংরুমে বেয়ারা স্ন্যাক্স নিয়ে ঢুকলেই যে কী তুলকালাম কাণ্ড আরম্ভ হয় ভুক্তভোগী মাত্রই সেটা জানেন। পেগ টেবিলে স্ন্যাক্স ধরছে না, সেন্টার টেবিলটা অনেক দূরে–লে আও আওর একটু টেবিল ইত্যাদির মহা ঝামেলা। তারই ধাক্কায় ইতোমধ্যে গালগল্প টুকরো টুকরো খান খান।

শিপ্রার বক্তব্য : মানুষে মানুষে ভাবের আদান প্রদান, রসের দান ও গ্রহণ, অভিজ্ঞতার বিনিময়, একে অন্যের সঙ্গসুখ– এসব নিয়েই তো মানুষের সত্তা, তার অস্তিত্ব। ড্রইংরুম তো তারই কেন্দ্রভূমি। সেখানে যদি ড্রিংক স্ন্যাক পদে পদে বাধা দেয় তবে সেটা ব্যর্থ। নাই-বা হল আমার বুদোওয়ার আন্দ্রা মডার্ন।

জর্মন সিলভারের বালতিতে করে কীর্তি শ্যাম্পেন নিয়ে এসেই শুধাল, বল তো, ভাই, এই দুর্দিনে যখন এক ফোঁটা বিয়ারের জন্য অর্জুনের মতো পাতাল ভেদ করতে হয় তখন তুমি এই জাত শ্যাম্পেন পাও কোথা থেকে?

শিপ্রা আদর করে কীর্তিকে কাছে টেনে এনে বললে, তোমার এত ভয় কিসের? তোমার বেলা দেখি, ভয় করে তুই বিজয়ারে হারাবি? শ্যাম্পেন? সে-কাহিনী সরল, আর এক মিনিটে ফুরিয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে আমি কিছুকাল প্যারিসে ছিলুম। তখন এক গরিব ছোকরা ফরাসি আর্ট স্টুডেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় প্রায় প্রেমের কাছাকাছি। আমি সামান্য যেটুকু পকেটমানি পেতুম তাই দিয়ে তাকে প্রায় জোর করে একদিন অতি সস্তা দরের এক বোতল শ্যাম্পেন খাইয়েছিলুম। আমরা দেশে ফিরে এলুম। তার পর দশ বছরের ভিতরই সে হুশ হুশ করে আর্টের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে একদম হলিউডে পৌঁছে গেল। ওদিকে মিলিয়নেরদের পোট্রট এঁকে পয়সা যা কামায় সে প্রায় পিকাসোর সঙ্গে নেক টু নে। শ্যাম্পেনের পাইকিরি বিক্রির সময় তার এজেন্ট শ্যাম্পেন ডিসট্রিক্টে এসে হুজুরের জন্য যা কেনা হয় তার একটা হিস্যে সে পাঠিয়ে দেয় দার্জিলিঙের ঠিকানায় ঠাণ্ডায় মোলায়েম থাকবে বলে।

তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়?

শিপ্রা হেসে কুটিকুটি। কীর্তির গালে মোলায়েম একটা ঠোনা মেরে বলে, ওরে মূর্খ, লন্ডনে পাকা দু-দুটো বচ্ছর কি হাইড পার্কে ঘাস খেয়েছিস শুধু? সে যাচ্ছে ভেসে ভেসে দেশ থেকে দেশান্তরে, আমিও উধাও হচ্ছি কাঁহা কাঁহা মুলুকে। একদিন কোন খেয়ালের মোহে এজেন্টকে বলেছিল আমার যেন শ্যাম্পেনের অভাব না হয়; তার পর এতদিন সে হয়তো সে-কথা বেবাক ভুলে গিয়েছে তা সে যাক্। বেলি-ডাস্ কীরকম লাগল সেই কথা কও।

কীর্তির অল্প অল্প নেশা হয়ে আসছে। গোড়ার দিকের জড়ত্ব অনেকখানি কেটে গিয়েছে। ওদিকে শিপ্রারও মুখের রঙ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। যুবতী রমণীর প্রস্ফুটিতা চোখ দুটিতে যেন ক্রমে ক্রমে কিশোরীর সদ্য বিকশিত ভাব ফুটে উঠছে।

কীর্তির মুখে কথা ফুটছে। আকস্মিক আমন্ত্রণের বিহ্বলতা কেটে যাওয়ায় ওজন করে কথা কইবার ধরন অনেক পিছনে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, আমি আর নাচটা দেখলুম কই? বরঞ্চ স্মার্ট মাস্টার সুদিনকে সুধিয়ো। আমি বার ছাড়ার সময় সেখানেতে নাচের টপিক নৃত্য করছে– তাণ্ডব নৃত্য।

মানে?

সংক্ষেপে বলতে গেলে হিং টিং ছট। সুদিন-বৈরীরা তারস্বরে ঘোষণা করছেন, ওই বেলি ডান্‌সে আছে দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস এবং ভালগার ইঙ্গিত সর্বোপরি বেলি ডানস্ না আছে বেলি, না আছে ডান্স্। এর বেশি আমি তোমাকে বলতে পারব না। এটুকুও বলতুম না; খানিকক্ষণ আগে তুমি বলছিলে না, এটা একটা সোসাইটির প্যাটার্ন, তাই এটার উল্লেখ করলুম।

শিপ্রা সিগারেট খায় কালেভদ্রে। এবারে একটা ধরিয়ে ধীরে ধীরে বলল, আমার একটি বিশিষ্ট বন্ধু আছেন। তুমি তাঁকে বোধহয় চেন না– কারণ তিনি একদা ছিলেন কাইরো শহরের স্মার্ট সেটের ফ্রন্ট বেঞ্চার। উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে কাইরো অবধি– সবরকম নাচ তাঁর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা আছে। তিনি একদিন আমাকে বলছিলেন, খাঁটি বেলি-ডান্স শিখতে হলে অন্তত বারোটি বছর একটানা রেওয়াজ করে যেতে হয়। আজ রাতে যে মেয়েটি নাচল সে-ও তো শুনেছি বারো বছর ধরে ট্রেনিং নিয়েছে। তাই আশ্চর্য লাগে, সুন্দুমাত্র ভালগার সাজেশন দেওয়ার জন্য বারো বছর ধরে ট্রেনিং!

সবকথা কীর্তির কানে তখন আর ঢুকছিল না।

সেটা শ্যাম্পেনের প্রসাদে নয়। বরঞ্চ তার খনে মনে হচ্ছিল নেশা কেটে যাচ্ছে, খনে মনে হচ্ছিল নেশাটা যেন চড়াৎ করে তালুর ব্রহ্মদেশে চড়ে বসছে। এবং এটাও তার জানা ছিল, দু পাত্র রস-সেবনের সময় স্রেফ ফুর্তি ছাড়া কোনও দুশ্চিন্তা বা অন্য কোনও সমস্যাকে আমল দিলে এরকম ধারা হবেই। সর্বোপরি তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিল একটা ক্রিকেটের মাঠ।

কীর্তি একদা ভালো ক্রিকেট খেলত।

কীর্তি মনের চোখে দেখছিল, পুরো এক বছর ধরে বিপক্ষ ব্যাটিং করছে আর তাকে ফিলডিং করতে দেওয়া হয়েছে আউট ফিল্ডে, একদম কানট্রি সাইডে। অথচ তার দৃষ্টিশক্তি সুতীক্ষ, ফাস্ট বোলিঙের বেলা সে আগেভাগেই ঠাহর করে নিতে পারে ব্যাটের কোণে লেগে বল কি করলে কোন অ্যাঙ্গেলে আসবে, বাং মাছের মতো সর্বাঙ্গে মোচড় খেয়ে প্রায় মাটি থেকে বল কুড়োতে পারে।

তথাপি ক্যাপটেন শিপ্রা তাকে পুরো একটি বছর ধরে তার পার্টিচক্রের রঙ্গভূমিতে তাকে যেন অ্যাপ্রেন্টেসি করালেন এক যুগ ধরে।

আর আজ? বড় বড় চাঁইদের উপেক্ষা করে, বলা নেই কওয়া নেই, একমাত্র তাকেই নিয়ে তিনি চলেছেন পিচ পরিদর্শনে।

.

০৪.

সর্ব বিশেষজ্ঞরা সম্পূর্ণ একমত, মানুষ যে সভ্যতার যাত্রাপথে এতখানি এগিয়ে গিয়েছে তার প্রধানতম কারণ মানুষ বংশানুক্রমে, পিতা পুত্রকে, এক পুরুষ পরের পুরুষকে তার অভিজ্ঞতা বিশদভাবে বর্ণনা করে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। তদুপরি প্রতি যুগের প্রতি পুরুষই পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতাকে উচ্চতর পর্যায়ে তুলবে বলে তার সংস্কার করেছে, নতুন অভিজ্ঞতা পূর্বতর ভাণ্ডারে যোগ দিয়ে সম্পূর্ণ সঞ্চয়কে পূর্ণতর করে তুলেছে।

শুধু একটি মারাত্মক, জীবনমরণ সমস্যার ব্যাপারে, সৃষ্টির সেই আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি।

তুমি কি আমায় ভালোবাসো? এ প্রশ্নটি শুধোবার বেলা পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্য কোনও প্রাণীরই রত্তিভর কাজে লাগে না, এমনকি সমসাময়িক প্রতিবেশী, অন্তরঙ্গ ইয়ারদোস্তের উদাহরণ দিকনির্দেশ সম্পূর্ণ বেকার, বেফায়দা। দাদা আদমের আমল থেকে আজ পর্যন্ত তথা ভুবনবিখ্যাত মহাপুরুষরাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, মহাপ্রলয়ের পর নবসৃষ্টির প্রারম্ভেও মানুষ ওই প্রাচীনতম প্রশ্নটি শুধোবার সময় সেই প্রথমদিনের মতো বিলকুল হাবা বনে যাবে, কাতরাতে কাতরাতে যেসব ধ্বনি প্রকাশ করবে সেগুলো একদম সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কনফার্মড রাম-ইডিয়টের গোঙরানোর মতো।

ওদিকে আবার শিপ্রার চরিত্র বিচিত্র। এমনিতে মনে হয় সে আর পাঁচটা টপ ক্লাস সোসাইটি গার্লেরই মতো- গার্ল বললে স্বল্লোক্তি হয়, লেডি বললে আবার অতিশয়োক্তি হয়ে যায়। আজ চিত্রপ্রদর্শনীর দ্বারোঘাটন, কাল প্রধানমন্ত্রীকে মাল্যদান এসব কোনওপ্রকারের সামাজিক, রাজনৈতিক কর্তব্যকর্ম করতে সে সম্পূর্ণ বিমুখ যদিও দেশে এবং বিদেশে লেখাপড়াতে সে অসাধারণ না হলেও ডিবেটে ছিল অত্যুত্তম, উচ্চারণ ন্যাকামিবর্জিত। দোষের মধ্যে ছিল স্মার্ট সেটের মতো সে ট্যারচা ট্যারচা বাঙলা বলতে পারত না।

তার আসল বৈশিষ্ট্য ছিল আলাপ-আলোচনার সময় মারাত্মক সব অভিমত প্রকাশ করে স্মার্টেস্ট সেটকেও হাজার ভল্টের শক দেওয়া। পবিত্র, শাস্ত্রীয়, আচারসম্মত এ ধরনের শব্দ তার অভিধানে ছিল না, কারণ তার পিতাই সেগুলো স্বহস্তে মুছে সাফ করে দিয়েছিলেন।

তদুপরি তার সঙ্গে প্যারিস-লন্ডন করার পর কোনও জিনিস বা লজি আঁকড়ে ধরার মতো মনোবৃত্তি তার আর ছিল না। সামাজিক আচরণে কাউকেই খুব বেশি কাছে ঘেঁষতে দিত না, আবার হট যাও হট যাও সায়েবিয়ানা সে ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে কখনও দেখেনি বলে সে গন্ধ তার গায়ে ছিল না। কৈশোরে পুরো একটি বছরের অধিকাংশ সময় কেটেছে প্যারিসের লক্ষ্মীছাড়া লঝঝড়ে গরিব পেন্টারদের সঙ্গে। সাম্যবাদ ফ্রানসের পার্লিমেন্টে মূলমন্ত্র বটে কিন্তু তার পরিপূর্ণ সপ্রকাশ দেখতে হলে যেতে হয় লাতিন কোয়ার্টার মা সরস্বতীর সর্ব কলার চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, নৃত্য, আরও কত কী যে নিত্য নিত্য সৃষ্টি হয় ওইসব কলার পাগলা চেলাদের মাঝখানে, যারা তিন দিন ধরে একটা লোফ খায়।

কীর্তি এসব ডিটেল জানত না কারণ শিপ্রা ঘড়ি ঘড়ি তার প্যারিস ভিয়েনার জেল্লাই নিয়ে কথা কওয়া দূরে থাক, ইংরেজি সাহিত্যের কথা উঠলেও সার্ত বা মারলোকে টেনে এনে নিজের বক্তব্য জোরদার করবার চেষ্টা দিত না। কীর্তি শুধু জানত শিপ্রা প্যারিসে ছবি আঁকা আরম্ভ করে এবং এখনও চিলেকোঠায় ওই নিয়ে মাঝে মাঝে মশগুল হয়।

অতীতের ওইসব নানা পরিবর্তনের ফলে শিপ্রার চতুর্দিকে এমন একটি আবহাওয়া বিরাজ করত যে, ঘনিষ্ঠতার বাড়াবাড়ি না করেও সরল জন তাকে মনের কথা বলতে পারত। আর আমাদের শ্রীমান কীর্তিনাশকে নির্মাণকালে সৃষ্টিকর্তা যে প্যাচালো বুদ্ধির সংমিশ্রণ একদম করেননি সেটা ক্লাবের অগারাজ বেয়ারাটি পর্যন্ত জানত।

শ্যাম্পেনটাও পেটের ভিতর বুজু বুজু করছে।

কী করে যে হঠাৎ শিপ্রাকে শুধিয়ে বসল, সে-ই জানে না : আচ্ছা শিপ্রা, তুমি আমাকে অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করো?… আই মিন, আই মিন আমাকে ভালোবাসো? তার পর আবার গবেটের মতো হুট করে বলে ফেলল, হাও সিলি!

গেলাসটা ছিল কানায় কানায় ভর্তি। চো করে এক হ্যাঁচকায় খতম করে খট করে সেটা টেবিলের উপর রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল।

কীর্তি ধরে নিয়েছিল, যে মেয়ে এতদিন ধরে কারও ফাঁদে ধরা দেয়নি– যদিও মাঝে-মধ্যে এর-ওর নামের সঙ্গে জড়িয়ে ওর বদনাম রটেছে আবার আপনার থেকেই সেটা কেটেও গিয়েছে সে বুঝি এহেন অবস্থায় স্মার্ট সমাজের সুপ্রচলিত পদ্ধতিতে খিলখিল করে হেসে উঠবে।

হল এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া।

ধীরে ধীরে আধ শোওয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে কীর্তিকে কাছে টেনে দুই বাহু দিয়ে আলিঙ্গনে বেঁধে খেল চুমো। তার পর তার গালে-মুখে-চোখে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। কীর্তি নির্বাক, অসাড়। এমনকি চুম্বন-আলিঙ্গনের সময় যে সাড়াটুকু দিতে হয় তার বিহ্বল অবস্থায় সেটুকুও সে দিতে পারেনি।

রুদ্র তপস্যার বনে বহুত্রাসে অত্যল্প আশে ভীরু অপ্সরা যেরকম প্রবেশ করে কীর্তির প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল সেইভাবে।

উত্তরে সপ্তর্ষিমণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারকারাজি উভয় হস্তে সপ্ত গ্রহের আকাশকুসুম বর্ষণ করে আচ্ছাদিত করে দিলেন এই ধূলির অতি সামান্য প্রাণী কীর্তিকে।

.

০৫.

শিপ্রারই বাড়িতে পার্টি। তার এক বান্ধবী ফিরেছেন হাওয়াই থেকে হনিমুন যাপন করে। তাদেরই অনারে সুন্দুমাত্র পরিচিত জনকে নিয়ে মাঝারি গোছের শো। সবাই হেথাহোথা ঘোরাঘুরি করছেন গেলাস হাতে করে। বেয়ারাদের হাতের ট্রেতে আছে হুইস্কি, কন্যাক, ভোদকা আর বিয়ার। বর্দো বার্গেন্ডি রাইন মজেলের রেওয়াজ এদেশে নেই বললেই চলে। জোগাড় করাও কঠিন, বিগড়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি। কিন্তু শিপ্রার ওয়াইন-সেলার দার্জিলিঙের মোলায়েম আবহাওয়ায়। নিজেরও যেটুকু মোহ তা ওইসব কন্টিনেন্টাল দ্রব্যের প্রতি। সে-সবের জন্য ব্যবস্থা ড্রইংরুমের ভিতর। সেখানে যে দু পাঁচজন চিড়িয়া আসন নিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই ফরাসি-জর্মন। তারা বিলক্ষণ অবগত আছে এই কলকাতা-সাহারায় শিপ্রাই একমাত্র ওয়েসিস্। সঠিক কোন টেম্পারেচারে এসব পানীয় ফুল্ল বিকশিত হয়ে এই ভিনদেশে স্ব-দেশের রস সুবাস বিতরণ করবে সে তত্ত্বটিতে শিপ্রা স্পেশালিস্ট।

লনের এক প্রান্তে আসন নিয়েছেন সুদিনাদি স্মার্ট কোম্পানি। কীর্তি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রত্যন্ত প্রদেশে। আজ বসেছে সানন্দে। আজ গারাজে বসতেও তার কণামাত্র ক্ষোভ নেই। এ উৎসবের হৃদয় পদ্মাসনে যে রাজার রাজা, বাইরের ভুবনে সে কোথায় কোন ধূলির ধূলিতে অবলুষ্ঠিত হল সে সম্বন্ধে কোন মূর্খ হয় সচেতন।

তদারকির রোঁদে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় শিপ্রা ক্ষণতরে কীর্তিকে উদ্দেশ করে বলল শুধু হ্যালো! ঠোঁটে সেই এক বছরের পুরনো মৃদু হাস্য। কিন্তু সুদিন জানে আজকের এ কণ্ঠস্বর এ মৃদু হাস্য এক ভিন্নবাসিনী ভানুমতীর মদনরসে মন্ত্রপূত।

ইতোমধ্যে বধূ এসেছেন সুদিনাদির সামনে।

সুদিন একগাল হেসে শুধল, কী গো সুন্দরী, হাওয়াই দ্বীপের হুলা হুলা ডানস্ রপ্ত করে এসেছ তো? এক চক্কর দেখিয়ে দাও না পাঁচজন রস-পিপাসুকে।

বধূ বললেন, নিশ্চয়, কিন্তু হাওয়াইয়ের সেই ঘাস পাব কোথায়, নাচের ঘাগরা বানাবার তরে?

সুদিন বললে, সে আর এমন কী বিপত্তি। রাজকুমারী জাহানারা যে মসলিন পরে ঔরঙ্গজেবের সামনে সগর্বে উপস্থিত হয়েছিলেন সেটা জোগাড় করতে কতক্ষণ! সেইটে ফালি ফালি করে ঘাগরা বানিয়ে যদি পরেন–

শঙ্কর বলল, কী বেরসিক রে, বাবা। চাঁদের আলোর টানা আর রামধনুর পোড়েন দিয়ে বোনা হবে সে ঘাগরা। মিলকি উইয়ের দুধ দিয়ে সেটি থাকবে ভেজানো– তবে না সেটি লেপটে থাকবে সর্বাঙ্গে। তবে না দেখা যাবে নৃত্যের তালে তালে প্রতিটি পেশির আন্দোলন, সঙ্কোচন, সম্প্রসারণ।

ইতোমধ্যে বর-কনে এগিয়ে গেছেন আরেক দলকে হেঁ হেঁ করার জন্য।

চৌধুরী আখতর হুসেন শঙ্কর মিত্রকে ফিসফিসিয়ে বললেন, বুড়ো ধেড়ে কাক। সাতান্ন ঘাটের পানি খেয়ে শেষটায় বিয়ে করল নাতনির বয়সী মেয়েটাকে!

মিত্তির বলল, চৌধুরী, আমাদের সোশ্যাল সিসটেমটা তুমি আদৌ বুঝতে পারনি। পুরুষগুলো তো যায় গোল্লায়–ওই যে বললে সাতান্ন ঘাটের ঘোলা জল খেয়ে খেয়ে। বিয়েও যদি করে ওই ঢপের হাফ-বাইজিগুলোকে তবে জাতটা যাবে উচ্ছন্নে। অন্তত একটা সাইড তো ক্লিন রাখা দরকার।

নৃতত্ত্ব আর এগুলো না। কারণ ইতোমধ্যে একটি তরুণী লাভারসহ উপস্থিত। ইনি সদ্য উনিশে পা দিয়েছেন বলে ক্লাবের প্রাচীন মেম্বার তার পিতা তাকে সোসাইটি করতে অনুমতি দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে রসালাপ বন্ধ হয়ে গেল।

এদের এই একটা মহৎ গুণ এক লহমায় ভোল পালটাতে জানে। এই ছিল জল-বিছুটি আর এই হয়ে গেল ধোয়া তুলসীপাতা। চৌধুরী বলল, কী গো মিস্ ডাট, বিলেত যাওয়ার কদ্দূর?

ঠোঁট বেঁকিয়ে সুভা বললে, ফরেন একচেঞ্জ পাব কোথা?

মিত্তির বললেন, লাও! আম্বালাল কস্তুরভাই আছে কী করতে? তার তো দেদার ফরেন টাকা? তোমার পিতৃদেবের লিগেল এডভাইস ভিন্ন দু বান্ডিল বিড়ি কেনে না। সে তোমাকে লন্ডন-অক্সফোর্ড যেখানে প্রাণ যায় সর্বত্র পাউন্ডের দরিয়ায় ডুবিয়ে রাখবে। তোমার আবার ভাবনা কী?

সুভা একটা মামুলি উত্তর দিয়ে কেটে পড়ল। এসব হচ্ছে কথার কথা– নিতান্ত কিছু একটা বলতে হয় বলে প্রসঙ্গটা উঠেছিল। নইলে আমাদের এ গোষ্ঠীর কোনও একসচেঞ্জেরই কোনও ভাবনা নেই।

সর্বশেষে চৌধুরী ধীরে ধীরে প্রত্যেকটি কথা ওজন করে বললে, ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে হয়ে আসছে। ফরেন টাকার কুমির তো শেঠ চন্দ্রবদন। ইংলন্ডে আছে প্রায় লাখখানেক পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি। তারা প্রতি বছর দেশে পাঠায় কয়েক কোটি টাকা। শেঠজিও তাদের কামানো পাউন্ড কিনে নেয় সরকার যে রেটে টাকা দেয় তার চেয়ে বেশকিছু বেশি মুনাফা দিয়ে। ওদিকে শেঠজি খবর পাঠায় নারায়ণগঞ্জে তার আমিনকে সিলেটের অমুক শেখকে অত টাকা পাঠিয়ে দাও। এতে করে

এক হাফ-আনাড়ি বাধা দিয়ে বলল, নারায়ণগঞ্জে শেঠজি পাকিস্তানি টাকা পায় কোথায়? সেখানকার মিল কারখানা তো সব আদমজি ফাঁসি পশ্চিম পাকিস্তানিদের। সেখানে শেঠজির কোন ধান্দা যে তহবিল গড়বে?

চৌধুরী মিষ্টি হেসে বলল, তুমিও যেমন! আদমজির টাকা খাটে অমৃতসরে শেঠজি মারফত অ্যান্ড ভাইস ভারসা। আচ্ছা, না হয় মেনেই নিলুম তোমার আজগুবি গুল। এই কলকাতার শহরে ইন্ডিয়ান টাকা দিয়ে কিনতে চাও কত লক্ষ পাকিস্তানি টাকা খাসা সস্তা ভাওয়ে? সিলেটের মোকামে পাকিস্তানি টাকাটা পাঠিয়ে দেবার জিম্মাদারি তো ওই পাকিস্তানির শেঠজির কী?

কীর্তি এতক্ষণ চুপচাপ বসে একটা গেলাসও শেষ করতে পারেনি। আসলে তার শরীরে পাড় মাতালের রক্ত নেই। সে নয়া নয়া করে দেখছিল, গতরাতের স্বপ্ন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, উল্টেপাল্টে। আর দেখছিল, শিপ্রার দ্রুতপদে আসা-যাওয়া ছোট্ট দুটি পা ঘিরে শাড়ির পাড়ের খেলা। মেমসায়েবদের ফ্রক হয় শতেক ধরনের। প্রতি বচ্ছরে আবার মরসুম-মাফিক বার তিন-চার কাট বদলায়, ভোল পালটায়। সবকটাই যে এক্কেবারে ফেলনা সে কথা বলা চলে না কিন্তু এত চেষ্টা এত জিনিয়াস খাঁটিয়েও প্যারিস এমন একটা ফ্রক বানাতে পারেনি যেটা দুটি পা ঘিরে ঘিরে শাড়ির পাড়ের যে নৃত্য তার কাছে আসতে পারে। তার ওপর শিপ্রার চলনভঙ্গিটি তার কোমরের বাঁকা-সোজা নড়াচড়া, কাঁধের ডাইনে-বাঁয়ে হেলে পড়াটার সঙ্গে এমনই মিল রেখে নিয়েছে যে তার হেথা-হোথা আসা-যাওয়াটাই পাঁচজনের চোখ ভরে দেয়। পাড়টি যেন আল্পনা এঁকে এঁকে সমস্ত লন্টা ছেয়ে ফেলল।

কে কান দেয় তখন আদমজির ফরেন টাকার দিকে আমাদের কীর্তিবাবু না জানেন পলিটিক্স, না বোঝেন ইকনমি। তবু তার কানে গেল শেষ কথাটা চৌধুরীর :

এবার কিন্তু সবকিছু আবার হয়তো ঢেলে সাজাতে হবে। আওয়ামী লীগ জিতেছে ইলেকশানে উইদ এ থান্ডারিং মেজরিটি। দরিয়ার বাকিটুকু ভালোয় ভালোয় পেরুতে পারলে লীগওয়ালা আদমজি ফাঁসির থাউজেন্ড পার্সেন্ট মুনাফা বরদাস্ত করবে না।

সুদিন বললে, সে তো শুধু কেচ্ছা। আখেরে হয়তো-বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একদম কেটে পড়বে। কে জানে, হয়তো-বা পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যাবে।

অ্যাঁ? হঠাৎ যেন কীর্তির কানে জল গেল। ওই স্বাধীনতা শব্দটার সঙ্গে তার কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে। ছেলেবেলা থেকেই সে যা খুশি তাই করেছে। কালেভদ্রে যখন নিতান্ত বাধ্য হয়ে অনিচ্ছায় কোনও কিছু সয়ে নিতে হয়েছে তখনই পেয়েছে দারুণ পীড়া।

একবার শিপ্রাকে কথায় কথায় বলেও ছিল, বিবেক নামক ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমার পরিচয় বড়ই কম। কিন্তু তিনিও মাঝে মাঝে মোকা পেয়ে যখন চাপ দিয়ে আমাকে বাধ্য করেন অপ্রিয় সব কাজ করতে তখন আমার জানটা যেন ঠোঁটের কাছে এসে খাবি খেতে থাকে। বিবেকের চাপ কর্তব্য বাবুর চাপ বাপরে বাপ। এর ওপর আবার বাইরের চাপ। গোলামি!

সুদিন বললে, ওহে কীর্তিবাবু, চুপচাপ বসে বসে টুকুস ঢুকুস করছ যে বড়। অ্যাদ্দিন তুমিই তো, বাবা, ছিলে শিপ্রাদেবীর প্রতি পার্টিতে এডিকং! আজ সব ঝক্কি ওরই ওপর ছেড়ে দিলে কেন বল তো।

তা নয় সুদিনদা! আজ যাদের অনারে পার্টি ওদের ইয়ার-দোস্তও এসেছেন জনাকয়েক। ওঁরা তো নিত্যি নিত্যি এখানে আসেন না। আমার মতো পাকা নন–ওরা ঠিকে। আজ ওদের একটা চান্স্ দিতে হয়। দেখছ না, ম্যাডামকে হেল্প করার ছলে থার্ড ক্লাস বেয়ারার চেয়েও আনাড়ি সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু শ্রীমতীর সঙ্গে দু এক দফে রসালাপ করার সুযোগ পাচ্ছে তো।

সার্ভিসের কথা তুলছ কেন? ওদের বাপ-ঠাকুরদা বাটলার ছিল না কি?

লন্ডনের ক্ল্যারিজে চিফ ওয়েটারও সার্ভিসে তোমার কাছে হার মানবে। তোমার ঠাকুর্দা তো ছিলেন কোম্পানির মুৎসুদ্দি। তবে–

চোক্কর ছোকরা।

ঘণ্টা দুই হয়ে গেল পার্টি আরম্ভ হয়েছিল। এখন একা, জোড়া জোড়া, একসঙ্গে জনা তিনা বিদায় নিতে আরম্ভ করলেন। কোন এক সংস্কৃতের কবি বলেছেন, যেন পরাজিত বাহিনীর সৈন্যরা এক্কা দুক্কা হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে। আরেকটা ছোটখাটো দল চলল একসঙ্গে ওদের অন্য একটা পার্টিডিনারে নেমন্তন্ন। শিপ্রা আগের থেকেই মাফ চেয়ে নিয়েছিল। এ পার্টির দু একজন বানচাল হয়ে যাওয়াতে সুদিন আর কীর্তি তাদের যেন আদর করতে করতে ড্রাইভারদের জিম্মায় মোটরে তুলে দিল। দু একজন সুপ্ত এবং অর্ধসুপ্ত। তাদেরও তুলে দেওয়া হল তদ্বৎ।

সুদিন বলল, কীর্তি ভায়া, এবারে আরামসে একটা শেষ ড্রিংক খাই তোমার সঙ্গে। এসব পার্টিতে এতসব রকমারি চিড়িয়া আসে যে প্রাণখুলে কথা বলা যায় না, আর প্রাণ খুলে কথা কইতে না পারলে গলা খুলে রস পান করবে কী করে?

লনের সুদূরতম প্রান্তে দুজনাতে বসে চুপ করে রইল।

 শিপ্রা শেষ গেস্টকে বিদায় দিয়ে ধীর পদক্ষেপে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল।

 সুদিন দাঁড়িয়ে উঠে বলল, বসুন।

এরা আপনজন। তাই শিপ্রা বলল, না, ভাই, আমি নাইতে চললুম।

ড্রিংক শেষ করে সুদিন উঠল। বললে, আমি ব্ল্যাক ক্যাট-এ যাচ্ছি। তুই আসবি, এখানকার কাজ শেষ হলে?

বেয়ারাদের বিদায় দেওয়া থেকে আরম্ভ করে আরও পাঁচটা কাজ রাউন্ড আপ করার ভার প্রতি পার্টিতেই পড়ে কীর্তির ঘাড়ে।

সুদিন বলল, তোর অনারারি নোকরিটাতে কি কোনওকালে প্রমোশন পাবিনে?

কীর্তি হেসে বলল, কড়া কনট্রাক্ট করা আছে, অনারারি– ঠিক হৈ। কিন্তু, দাদা, পার্মানেন্ট।

.

০৬.

কীর্তি

শিপ্রা?

হ্যাঁ। শোনো। বেড়াতে যাবে? মোটরে। পুরো দিনটা। ফিরতে রাত দশটাও হয়ে যেতে পারে। কোথায় যাব? সে তো তুমি ঠিক করবে। আমি মেয়েছেলে, একটা শখ জানালুম। তুমি পুরুষমানুষ। শেষ ডিসিশন তো তোমার হাতে। হ্যাঁ, একটা সুটকেস নিয়ে এসো— যদি ব্রেকডাউন-টাউন হয়ে যায়। আর সব আমি নিচ্ছি। শিগগির এসো!

কীর্তি ভাবল, হুঁ সে পুরুষমানুষ, কুল্লে ডিসিশন তার হাতে। দু রাত্তির যেতে না যেতেই যে শিপ্রাচক্রের প্রত্যন্ত প্রদেশে সে লিকলিক করত হঠাৎ হয়ে গেল সে চক্রের চক্রবর্তী। নিজেকে সাতিশয় মহিমান্বিত পদে উন্নীত দেখেও তার থেকে অবিমিশ্র আনন্দ আহরণ করতে পারল না। সে বহুদিন বার বার অনুভব করেছে, শিপ্রার কমন সেন্স, সাংসারিক বুদ্ধি তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি। যাকে বলে কালচার সেখানে তো কোনও তুলনাই হয় না। সর্বোপরি কি স্ত্রীলোক কি পুরুষ কস্মিনকালেও কেউ কড়েআঙুলটি তক্‌ তুলে ইঙ্গিতমাত্র দেয়নি তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে বিকট একটা পৌরুষ ভাব।

সে ড্যুক অব এডিনবরা হতে রাজি আছে সানন্দে। কিন্তু রানি এলিজাবেথের সিংহাসনে বসতে যাবে কোন দুঃখে?

ভরসাও অবশ্য আছে, শিপ্রা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাকে যে অযথা অকূল দরিয়ায় ডোবাবে সেটা একেবারেই অসম্ভব। যে মেয়ে কি না ইহজনে কোনও বেয়ারা-বয়কে ডিসমিস করেনি। কলকাতা শহরে রীতিমতো লজ্জাকর রেকর্ড।

তা সে যাকগে। অত ভেবে কী হবে? কিন্তু ভাবনাটা সুখ দিচ্ছে যে।

.

যাত্রারম্ভের শেষ ফিনিশিং টাচ সমাপন করে শিপ্রা শুধাল, তুমি চালাবে? ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে।

আঁতকে উঠে কীর্তিনাশ বললে, সর্বনাশ! তবেই হয়েছে। তোমাকে কেউ বলেনি আমি নিজে যখন গাড়ি চালাই তখন সেটাতে মড়া লাশকেও লিট দিতে রাজি হইনে। করব অ্যাকসিডেন্ট, পুলিশ বলবে তারই ফলে লোকটা মারা গেছে।

স্টিয়ারিঙে বসে শিপ্রা বলল, ফাজলামো রাখো। সোভানি মোটরের জউরি। তার মুখে নিদেন একশোবার শুনেছি তোমার মতো মোটর মেরামতির হুনুরি এদেশে তো নেই-ই, জর্মনিতেও মেলা ভার।

কে বলেছে? সোভানি? তা তো বলবেই। আহা, কালকের পার্টিতে যদি দেখতে তার নৃত্যকলা। তুমি তখন লনের অন্য কোণে, কোন এক কন্সাল না কী যেন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মোলায়েম করছিল। এদিকে সোভানি তার ইয়া আড়াইমণি লাশটাকে লনের উপর বিন ঠেকনা দাঁড় করাতে পারছেন না, ওদিকে সে অন্ধ্রের ফিল্ম স্টার গোলাবাম্মাকে ভরতনাট্যমের কী একটা দারুণ জিগজাগ স্টেপ দেখাবেই দেখাবে। দু পাত্তর টেনেই মগজটি গোবলেট। ভরতনৃত্য সশরীরে দেখাতে গিয়ে দু হাতের চেটো উল্টো করে কোমরে রাখল লখনৌয়ের বাইজি স্টাইলে। তার পর সে হাতির পায়ের সাইজের এক-একখানা থাবা দিয়ে দেখাতে লাগল হরেকরকম মুদ্রা। কী একটা গানও ধরেছিল বুঝি বাজত ঘুঙুরিয়া না কী যেন। শেষটায় জড়ানো গলায় গোলাবাম্মার দিকে সাতিশয় বিনয় লাজুক নয়নে তাকিয়ে বলল, আপনার মতো গুনিনকে বুঝিয়ে বলতে হবে না– সেটা হবে কেরিইং কোল টু এ বার্ড ইন দি হ্যান্ড এ নৃত্যটার মূল বক্তব্য হচ্ছে তন্বঙ্গী শ্রীরাধা রসরাজ কেষ্টঠাকুরকে তাঁর পূর্বরাগ নিবেদন করছেন।

শিপ্রা খুশি হয়ে বললে, পার্টিটা তো তা হলে দারুণ সাকসেসফুল হয়েছিল। আর কী দেখলে?

সেটা ঘটেনি তাই দেখেছি বলি কী প্রকারে?

যথা–

বাসন্তী আর সুশান্ত তো চিরন্তনী মানিকজোড়। পার্টি-পরবের কথা বাদ দাও, তারা হাঁচেন একসঙ্গে, কাশেন এক সুরে। কাল দুজনা বসেছিলেন পার্টি নদীর দু পারে– চখাচখীর মিলন হয় না, জানো তো। এ তারও বাড়া। যেন চিরবিরহের সতীদাহে দু পারে দুজন দগ্ধ হবেন! মাঝে মাঝে আবার একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাপস। তখন চোখ থেকে আগুনের যা হল্কা বেরুচ্ছিল, আমি তো ভয়ে মরি, তোমার সাধের বাড়িটাতে আগুন লেগে যায়।

আরও বিস্তর দেখবার ছিল, শোনবারও ছিল। হ্যাঁ, পুব বাঙলার পলিটিকস্ নিয়ে দেখলুম দু একজন চিন্তিত।

শিপ্রা বলল, তুমি তো খবরের কাগজের হেডলাইনগুলোও পড় না, সে আমি জানি। আর আমি পড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ব্যাপারটা সত্যি বড্ড খারাপ মোড় নিচ্ছে।

কীর্তি বুঝল, শিপ্রা পুব বাঙলার পলিটিটা খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে। তাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুধাল, আমাদের কি বিশেষ গন্তব্যস্থল আছে?

শিপ্রা বলল, রসো, গঙ্গা পেরোই। তার পর তুমি স্থির করবে। বোলপুর যাবে? শান্তিনিকেতন?

কীর্তি বলল, বোলপুর হ্যাঁ। তার পর ঈষৎ কাতর কণ্ঠে বলল, শান্তিনিকেতনে যেতে কিন্তু আমার সঙ্কোচ বোধ হয়, এমনকি ভয় করে।

শিপ্রা আশ্চর্য হয়ে শুধাল, কেন?

ওখানে সঙ্গীত নৃত্য এসব তো আছেই তার ওপর সেখানে হয় নানাপ্রকারের বিস্তর রিসার্চ। এসব তো আমি জানিনে, বুঝিনে। কারও না কারও সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। তখন তিনি যদি কোনও প্রশ্ন শুধান বা আলোচনা পাড়েন তখন আমি মুখ খুললেই তো চিত্তির। আবার একদম চুপ করে থাকাটাও অভদ্রতা।

এ তোমার বাড়াবাড়ি, আমি ভালো করে জানি, তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বহু বৎসর ধরে মন দিয়ে পড়ছ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালেকশন তোমার যা আছে সেটা রীতিমতো বিরল।

কীর্তি করুণতর কণ্ঠে বললে, ভাই, সে আমার নিতান্ত আপন আনন্দ। কিন্তু আটঘাট বেঁধে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় ওই দিয়ে কিছু বলতে যাওয়া তো সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া।

শিপ্রা বাঁ হাত দিয়ে কীর্তির উরু চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, থাক না তা হলে আশ্রমদর্শন। এগোই তো উপস্থিত পশ্চিম দিকে। তার পর দেখা যাবে।

কীর্তি বললে, তুমি আমাকে ভুল বুঝলে আমার দুঃখের অবধি থাকবে না। যাকে বলে রবীন্দ্রদর্শন তার সঙ্গে আমার পরিচয় অতিশয় নগণ্য। তবু আমার একটা অন্ধবিশ্বাস– বরঞ্চ বললে ভালো হয় আমার ইনসটিকটু বলে রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দ এই দুটি লোক যা করে গেছেন সেটা পরিপূর্ণভাবে আপন বুকের রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে, ওই দিয়ে মগজের সেলগুলোর গঠন পালটে নিতে আমাদের আরও একশো বছর লাগবে।

শিপ্রা বলল, জর্মনরাও বলে গ্যোটেকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে তাদের আরও একশো বছর লাগবে। একাধিক চিন্তাশীল লোক বলেছেন, গ্যোটের নির্দেশ যদি সত্যিই আমরা আমাদের চিন্তাধারায়, আদর্শ নির্মাণে মেনে নিয়ে থাকতুম তা হলে হিটলারের আবির্ভাব হত না।

শীতকালে পশ্চিম বাঙলার বিশেষ করে বর্ধমান বীরভূম অঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি থাকে না। তবে লক্ষ করলে প্রকৃতির একটা দিক মাঝে মাঝে বড়ই চমক লাগায়। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। শার্সি দিয়ে তাকিয়ে ঠাহর করা গেল না দেবতা আকাশে উদয় হয়েছেন কি না। তার পর হঠাৎ এক ঝটকায় সব দুনিয়া সাফ, আসমান জমিন এমনকি হাওয়াটাও যেন আলোয় আলোময় হয়ে গেল। রাজা অনেক আগেই আকাশের বেশ উঁচু জায়গায় সিংহাসনে আসন নিয়ে বসেছিলেন। সামনে ছিল যবনিকা। লগ্নকাল প্রত্যাসন্ন হওয়ামাত্রই রাজাদেশে দ্বারী চক্ষের পলকে সে যবনিকা সরিয়ে দিয়েছে।

আজ কুয়াশা কাটল ধীরে ধীরে। মোটরও এগিয়েছিল সাবধানে। শ্রীরামপুর পেরনোর পর শিপ্রা বলল, এরই কাছেপিঠে ডাইনে মোড় নিলে একটা পুকুর আছে। উঁচু পাড়িতে ছোট-বড় গাছ-গাছালি, রোদ্দুরটা পিঠ তাতালে সতরঞ্চি একটু সরিয়ে নিলেই হল। কিংবা বর্ধমান পেরিয়ে বাবার বন্ধুর বাগানবাড়ি। দশ বছর ধরে ফাঁকা। একটা মালী আছে মাত্র। কোনটা পছন্দ? আমার কোনও চয়েস নেই।

এই শীতের সকালে চলাটাই লাগছে বেশ, বসাটার চেয়ে।

যদিও ফ্লাস্কে বিস্তর চা-কফি ছিল তবু একটা পেট্রল স্টেশনের পাশে দরমার দোকানের বেঞ্চিতে দুজনাতে চা খেতে বসল।

কীর্তি দোকানিকে শুধাল, ব্যবসা-বাণিজ্য কীরকম চলছে?

অত্যন্ত সবিনয়ে বললে, আমাদের খদ্দের তো গরুর গাড়ি। এখন বাবুরা হুশ করে মোটরে চলে যান। রাস্ দাঁড়ালে সেও-বা কতক্ষণ। গরুর গাড়ি কমে যাচ্ছে। দোকানটাকে তাই খাড়া করতে পারছিনে।

শুকনো দরদ শোনাবার মতো এদের দুজনার কেউ নয়।

কীর্তি বললে, এটা বাঙলা দেশ, আবার ঢাকা-সিলেটও বাংলাদেশ। কিন্তু আমার মনে হয় বাস, মোটর বোধহয় বাঙলা দেশের নৌকোকে এতখানি ঘায়েল করতে পারেনি। তুমি কখনও বাঙলাদেশে গেছ?

হেসে বললে, খাঁটি বাঙালদেশের মাটিতে কখনও পা ফেলিনি কিন্তু বাংলাদেশে গিয়েছি। কোন এক স্টিমার কোম্পানির কী যেন এক পরবে কলকাতা থেকে সেঁদরবন হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট না কী যেন। কী সুন্দর দেশ, কী বলব। পরে আরও বলব, এখন চল।

মোটর চালাতে চালাতে কিন্তু শিপ্রা বলে যেতে লাগল প্যারিসের গল্প। কথায় কথায় শুধাল, তুমিও তো প্যারিসে ছিলে?

আমি একটা অপদার্থ। মোকামে পৌঁছাই। সব বলব।

.

০৭.

বাগানবাড়িটি শৌখিন নয় বটে কিন্তু মালীটাও আলসে নয়।

বাড়িটার প্রধান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তার তিন দিকের প্রান্তর পরিমাণ বারান্দাগুলো। বাগান, রাস্তা পেরিয়েই কাটা ধানে খোঁচা খোঁচা শূন্য ক্ষেত। দিগন্তে গ্রামের সবুজ আভা। মালী প্রাচীন দিনের, অধুনা লুপ্তপ্রায় আরামদায়ক দু খানা ডেক-চেয়ার পেতে দিয়েছে। মোটর থেকে বের করে সতরঞ্চি-কুশনও।

শিপ্রা বললে, রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা, আর তোমাদের গানে আছে, দুপুরবেলার পিজি গো সন্ধেবেলার উ-ই-স্কি। কী খাবে বল।

বিলিতি পিনক জিন এদেশের বেয়ারা-বুলিতে পিনজিন। ছোট্ট গেলাসে প্রথমে কয়েক ফোঁটা বিটারস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গেলাসে জি ঢালা হয়। এটাকে জিন অ্যান্ড বিটাও বলেন কেউ কেউ। তবে এদেশে, বিশেষ করে গরমের দিনে, জিনের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা পাতিলেবুর রস দিয়ে গিমলেটটাই পছন্দ করেন স্মার্ট সেটের অধিকাংশ মেম্বার।

কীর্তি সঙ্গে সঙ্গে বললে, না, আমি সাদা চোখে কথা কইব।

শিপ্রা আতঙ্কের ভান করে বললে, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন গো? তুমি কি জর্মন আর আমি ফ্রান্স যে যুদ্ধশেষে সন্ধির শর্ত নিয়ে দরকষাকষি করতে এসেছি?

প্রথমটায় সামান্য একটু হকচকিয়ে কীর্তি হেসে বলল, ধরো তাই। কিন্তু আমার কোনওই শর্ত নেই। এতটা কাল আমি তোমার ভিতরের গণ্ডিতে ছিলুম না। তবু জানতুম, তুমি যে ধরনের মানুষ আমি কিছু চাইলে এ ধরনের লোক না বলতে পারে না। তবে এখন, আমি বলছি এখন, তোমার কাছে আমি কোনও কিছু চাইব কেন? যদিও আমি আমার সর্বাঙ্গে গৌরবের কাঁথা জড়িয়ে তোমার কাছে ভিখিরির মতো দু হাত একজোড় করে এককণা খুদের তরে উচ্চকণ্ঠে আবেদন আর দাবি দুই-ই জানাতে পারি।

শিপ্রা বললে, আমি যখন নিজের থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তোমার বুকের কাছে এসেছি তার সরল অর্থ, এবং আমার অধিকার তুমি আমাকে তোমার ডানার ভিতরে খুঁজে নিয়ে সর্ব বিপদ সর্ব আঘাত থেকে রক্ষা করবে। যেখানে কনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও কথাই ওঠে না, সেখানেও পিতা যখন সম্প্রদান করে তখনও তো বর জানে তার ঘাড়ে কী দায়িত্ব চাপানো হল। আর

বাধা দিয়ে অবিমিশ্র সরল এবং অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে কীর্তি বললে, অপদার্থ। আমি যে কত বড় অপদার্থ সেইটে আমি জানি এবং সেটা তুমি আমাকে আজ এখানে না আনলে আজ দুপুরে তোমার বাড়িতে গিয়ে সেইটে ভালো করে বুঝিয়ে আসতুম। আমার মাত্র ওই একটি বক্তব্য আছে : সেটা আমি অপদার্থ।

তথ্যটা যাতে করে শিপ্রার চৈতন্যে গভীর দাগ কাটে তাই কীর্তি অপদার্থ শব্দটার ওপর পুরো জোর দিয়ে চুপ করে রইল।

তত্ত্বটা সত্য হোক মিথ্যে হোক, একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কীর্তিকে যারাই চিনত তারাই জানত, ওর ভিতরে রত্তিভর ভড়ং নেই এবং সে যে অপদার্থ সেটা তার সরল, স্বাভাবিক অকৃত্রিম বিশ্বাস।

পক্ষান্তরে স্মার্ট, নন্-স্মার্ট সব চক্রই আপন আপন অভিজ্ঞতা থেকে নিঃসন্দেহে সোৎসাহে হলপ নিতে এগিয়ে আসত যে শিপ্রার মতো স্থির বুদ্ধিধারিণী কন্যার মাথায় হাত বুলোতে পারে এহেন ধুরন্ধর মহানগরীতে বিরল–সর্বসমক্ষে বুলোয় একমাত্র তার চাকর বেয়ারা ঝি আয়া।

তা হলে প্রশ্ন, জেনে-বুঝে এই শিপ্রা অপদার্থ কীর্তিকে তার পার্টি রাউন্ডে ইনকাম ট্যাক্স্ অফিসারের সঙ্গে বচসা করার জন্য অবশ্য ব্রিফিংটা পুরোপুরি শিপ্রারই পাঠায় কেন? অবশ্য সেটা যে খুব একটা চোখে ঠেকত তা নয়। আর পাঁচজনকেও সে এ-কাজ ও-কাজের ভার দিত। তারাও সানন্দে কর্ম সমাপন করে দিত। তার কারণটাও জলের মতো পরিষ্কার। এই জটিল কলকাতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক করপরেশনিক যুক্তফ্রন্টিক গোলকধাঁধার ভিতরে-বাইরে বহুজনকে নিত্য নিত্য এমনসব ব্যক্তিগত লজ্জাবতী-লতার মতো সাতিশয় ডেলিকেট সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয় স্থলে বুদ্ধিমতী যে রমণী তার মৃদুহাস্য, তার দরদিয়া অনুরোধ, তার মোহনিয়া ছল-কাতরতা দিয়ে গ্রন্থিমোচন করে দিতে পারে অধিকাংশ সমস্যাঁতেই।

অবশ্য নিঃসন্দেহে বলতে হয়, শিপ্রার চাণক্যদত্ত এই কূটনৈতিক দক্ষতার খবর জানত অতি অল্প লোকই। সর্বসমক্ষে সে তাবৎ পার্টির প্রাণ, তাবৎ ক্লাবের জান্।

সেই শিপ্রা এই অপদার্থ কীর্তিটাকে কী তবে বাদরনাচ নাচাচ্ছে?– যদিও সে যে শিপ্রার প্রসাদ পেয়েছে সেটা মাত্র দু দিনের ভিতর কারওরই জানার কথা নয়। কাল যে পার্টি হয়ে গেল সেখানেও কীর্তিবাবু ছিলেন ঐতিহ্য অনুযায়ী পূর্ববৎ পার্টিফিন্ডের লাইনসম্যান। কোথায় ভুবন-ভাগানের ক্যাপটেন শিপ্রা, আর কোথায় সে!

কিন্তু বাঁদরনাচ নাচানো মেয়ে শিপ্রা নয়।

শিপ্রা তাকিয়ে আছে অলস নয়নে রাস্তার দিকে। সাঁওতাল মেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় একে অন্যের আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নিচু গলায় কোরাস গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে হাট থেকে কেনাকাটা সেরে। সাওতাল পুরুষের চিহ্নমাত্র নেই। একটি সাঁওতাল মেয়ে শুধু চলেছে জোড় না মিলিয়ে। হাতে একটা কঞ্চি। সেটা দিয়ে কখনও-বা আস্ফালন করে, কখনও-বা দু কদম নেচে নেয়, কখনও-বা কঞ্চি দিয়ে অন্য মেয়েগুলোকে শাসায় আর তারা খিলখিল করে হাসে। আসলে সাঁওতাল মেয়েরা হাটেবাজারে তাড়িকাড়ি খায় না। এ মেয়েটা ব্যত্যয় এবং সাতিশয় ব্যত্যয়। বেশ খানিকটে গিলেছে। তাই তার এই ফুর্তি।

শিপ্রা তাড়াতাড়ি কীর্তিকে দৃশ্যটা দেখিয়ে বললে, দেখো দেখো, এই মেয়েটা হচ্ছে আমার সাওতাল সংস্করণ– ওদের সোসাইটি গার্ল।

কীর্তি প্রথমটায় আদৌ বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা কী। বললে, ছিঃ! এ মেয়েটা তো রীতিমতো বে-এক্তেয়ার।

শিপ্রা বললে, আহা, তুমি কিছু বোঝ না। ভিন্ন ভিন্ন সোসাইটির ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্নের বে-এক্তেয়ারির রকমফের হয়। আমাদের অজ পাড়াগাঁয়েও দু একটি মেয়ের উড়কু উড়ুক্কু ভাব থাকে তোমরা যাকে বল, ফ্রাইটি গার্ল, একেবারে যেন শব্দে শব্দে অনুবাদ। তার ফষ্টিনষ্টি আর প্যারিসিনীর অর্ধোন্মত্ত তাণ্ডব লম্ফঝম্ফ কি একই প্যাটার্নের তবে হ্যাঁ, যেখানে মদের প্রচলন নেই সেখানে এসব ব্যাপারে মাত্রাধিক্য হয় না। তার পর বেশ কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করে বলল, জানো কীর্তি, আমি অনেক দেশ দেখেছি; আমার জানা মতে পুব বাঙলার একটা বৈশিষ্ট্য যে ওরা মদ খায় না। চাষাভূষো তাড়ি খায় না, মধ্যবিত্তদের তো কথাই নেই আর পার্টিশনের আগে পর্যন্ত বড় বড় বেশকিছু জমিদার কলকাতায় বাড়ি বানাত ফুর্তিফার্তি এবং মদ্যপানের জন্য। ছোট্ট কুর্দিস্তানে কী হয় জানিনে কিন্তু পুব বাঙলার মতো একটা মাঝারি রকমের দেশে মদের প্রচলন নেই, এটা সত্যই বিচিত্র ঠেকে আমার কাছে। ওদের কালচারটাই যেন বর্ধমান বীরভূম এক কথায় রাঢ়ের থেকে স্বতন্ত্র।

কীর্তি বললে, হুঁ। কিন্তু ঢাকা বেতার যা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় সেটা কলকাতার চেয়ে কোনও অংশে খারাপ নয়। তবে পিন্ডির রাজারা সেটা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।

শিপ্রা বাঁকা হাসি হেসে বললে, তুমি অতশত খবর রাখো কী করে। তুমি না অপদার্থ।

.

০৮.

কীর্তি।

ইয়েস, ম্যাডাম।

 ঠাট্টা নয়। তোমাকে গুটিকয়েক কথা বলতে চাই।

দোহাই তোমার। আমি বড় আনন্দে ডুবে আছি। দয়া করে সেটাকে থাকতে দাও।

তুমি যদি আমার কথাগুলো ঠিকমতো গ্রহণ করো, তোমার ভিতর যে স্বাভাবিক বুদ্ধি আছে তারই সাহায্য নিয়ে আমার কথাগুলো বুঝে নাও তবে তোমার আনন্দ কিছুমাত্র কমবে না। কলকাতায় আমার ঘরে শুয়ে শুয়ে তোমাকে যে এ কথাগুলো বলা যেত না তা নয়। কিন্তু তুমি একাধিকবার বলেছ, আমার স্বরটি বড় রোমান্টিক। সেখানে যে আবহাওয়ায় তুমি কী বুঝতে কী বুঝবে, কী বলতে কী বলবে তার জন্যে পরে হয়তো পস্তাবে। তাই তোমাকে এখানে টেনে এনেছি। এখানে চতুর্দিকে লোকজন রয়েছে। হঠাৎ হৃদয়াবেগে আমার হাঁটু জড়িয়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারবে না, আমিও তখন সর্ব সঙ্কল্প ভুলে গিয়ে তোমার কান্নায় গলে যাব না।

বেচারা কীর্তি কোন দিকে যে হাওয়া বইছে কিছুই অনুমান করতে পারছিল না। স্তব্ধ হয়ে শুধু শিপ্রার দিকে তাকিয়ে রইল।

শিপ্রাও সোজা স্থির পূর্ণ দৃষ্টিতে কীর্তির দু চোখে আপন দু চোখ রেখে তার স্বাভাবিক কণ্ঠে বললে, আমি তোমার চেয়ে ছ বছরের বড়, কিংবা বেশি, কম নিশ্চয়ই নয়। আমাদের বিয়ে হতে পারে না। শিপ্রা সজ্ঞানে কথা বন্ধ করল। হয়তো-বা কীর্তির মুখ থেকে কোনও মন্তব্য প্রত্যাশা করছিল। হয়তো-বা তার প্রত্যেকটি বক্তব্য যেন অক্ষরে অক্ষরে, তার সম্পূর্ণ অর্থ নিয়ে কীর্তির বোধগম্য হয় তার জন্য আপন নীরবতা দিয়ে তাকে সুযোগ দিচ্ছিল।

কিন্তু কোনও উত্তরই দিল না। কিন্তু সে যে বক্তব্যটা বুঝতে পেরেছে সেটা তার মুখের ভাব পরিবর্তন থেকেই বোঝা গেল।

শিপ্রা ঠিক আগেরই মতো স্বাভাবিক কণ্ঠে বললে, কিন্তু তারই ফলে আমাদের ভালোবাসাতে সামান্যতম আঁচড়টুকু লাগবে না, আমাদের ভালোবাসাতে কোনও দিক দিয়ে কোনওপ্রকারের অসম্পূর্ণতা থাকবে না। কারণ আমি স্থির নিশ্চয় জানি, আমার সর্ব সত্তা দিয়ে অনুভব করেছি, তোমার ভালোবাসা একাগ্র ভালোবাসা, তুমি আর তোমার প্রেম অভিন্ন সত্তা; আর আমার প্রেম তুমি দিনে দিনে চিনে নিয়ো, আমি আশা ধরি, তুমি কোনওদিন তার শেষ অতলে পৌঁছতে পারবে না। এবং তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলি, এই কলকাতার শহরে শত শত গতানুগতিক যেসব বিয়ে হচ্ছে সেখানে বর যা পায় তার চেয়ে তুমি পাবে এত বেশি যে দুটোর কোনও তুলনাই হয় না। সে-সব আমি স্বপ্নে দেখেছি, তুমি বাস্তবে পাবে। আর আমি তোমার কাছ থেকে কী পাব, কী নেব সেটাও আমি ভালো করেই জানি।

তুমি যে আনন্দসাগরে ডুবে আছ সেটাতেই তুমি থাকবে– শুধু আমাকে পাবে পাশাপাশি।

হায়রে কলকাতার রোমান্টিক সুখনীড় থেকে দূরে এসে পথপার্শ্বে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যুগ্ম ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে সর্বপ্রকার কবিত্ববর্জিত সাদামাটা ভাষায় আলোচনা করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা!

এ বিশ্বাস অবশ্য শিপ্রার পরিচিত জনের ছিল যে, সে যদি কখনও প্রেমে পড়ে তার স্যাঁতসেঁতে হৃদয় বাঙালির মতো রসসায়রে হাবুডুবু খাবে না, তার প্রেম হবে পাক্কা ইংরেজি কায়দায় বিজনেস ইজ বিজনেস হোক না লেনদেনের বস্তু ওক কাঠের তক্তার স্থলে যুবক-যুবতীর প্রেম।

কিন্তু এর পরই কৌতূহল জাগার কথা, শিপ্রার বক্তব্য শুনে– তা সে রোমান্টিক ভাষাতেই হোক কিংবা কাঠখোট্টা কাঠের ভাষাতেই হোক আমাদের অপদার্থ কীর্তি ঠাকুরের হৃদয়মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল।

এ কাহিনী যদি প্রেমের মোলায়েম গদ্যকাব্য হত তবে তারই সরস বর্ণনা দিয়ে হেসে-খেলে দু দশ অধ্যায় জুড়ে বিরাট রসসৌধ নির্মাণ করলে যুবজন উল্লসিত হতেন। কিন্তু এ স্থলে এই যুবক-যুবতী অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, সে পথে প্রেম-রস মুখ্য নয় গৌণও নয়- সেটি তাদের পাথেয়।

আত্মম্ভরিতার গ্যাসে ভর্তি বেলুনমুণ্ড অকালকুষ্মও ভিন্ন অন্য যে কোনও সাদামাটা বাঙালি প্রেমমুগ্ধজন তার প্রতিদান পেলে এতই আত্মহারা হয় যে সে আর তখন প্রিয়ার অন্য কথা শুনতে পায় না। অনাগত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার সাবধানবাণী, দুজনার শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য সামান্য দু একটি বোঝাঁপড়ার কথা কিছুই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। হারানো ছেলে ফিরে পেলে দুখিনী-মায়ের চতুর্দিকময় ঘন অন্ধকার যেরকম একমুহর্তে অন্তর্ধান করে, কীর্তির বেলা হল তাই।

তার চেতনায় মাত্র একটি অনুভূতি পেয়েছি, পেয়েছি, পেয়েছি।

এই আনন্দলোককে লণ্ডভণ্ড করবে কোন পাষণ্ড!

শিপ্রা তার মধুরতম হাসি দিয়ে কীর্তিকে নিরঙ্কুশ আত্মহারা করে দিয়ে বলল, কীর্তি, তুমি যে আনন্দসায়রে অবগাহন করছ সেটাতে আমি ঝড়তুফান তুলতে চাইনে। আমার যা বলার সেটা বলা হয়ে গিয়েছে। তুমি রসসায়র থেকে ওঠার পর তাই নিয়ে চিন্তা করে যদি কিছু বলার থাকে, কাল বল। উপস্থিত তোমার সায়র থেকে যে দু চারটি মুক্তো আহরণ করেছ সেগুলো দেখাও।

সে যাত্রা আর বোলপুর হল না। সামনে ময়ূর সিংহাসন। সেটা ছেড়ে কোন মূর্খ ধায় কাবুল-কান্দাহার পানে সেখানে মোড়ার উপর বসবে বলে।

.

০৯.

কীর্তি আসামাত্রই শিপ্রা উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, পড়েছ কাগজে পাজির পা-ঝাড়াদের ছুঁচোমোটা?

কীর্তি হবার মতো তাকিয়ে রইল।

শিপ্রা বললে, বাবার সঙ্গে যখন প্যারিসে ছিলুম তখন ফরাসিদের মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্যাঁ সিরের কয়েকটি অফিসার বাবার সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুনিয়ার যতরকমের বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। একদিন কী একটা মিলিটারি প্রশ্ন উঠলে তারই খেই ধরে যে চারটি কথাবার্তা হল তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল আর পাঁচটা বাঙালির মতো বাবা মিলিটারির কিছুই জানে না– এস্তেক মিলিটারির ইতিহাস যা কি না সহজপাঠ্য– তা-ও পাল্টে দেখেনি। অফিসারগুষ্টি তো বিস্ময়ে নির্বাক। শেষটায় এক জাঁদরেল বলল, মসিয়ো, এ কী অদ্ভুত ঠাসবুনোট-জড়োয়া কাশ্মিরি শালের মাঝখানে একটা বিরাট ফুটো। পাশ্চাত্য সাহিত্য চিত্রকলা বিশেষ করে জুরিসপ্রুডেনস থেকে আরম্ভ করে হেন বিষয় নেই যেটা আপনি হজম করে আপন সিস্টেমে বেমালুম মিশিয়ে নেন, আর মিলিটারি সায়েন্সের কিছুই জানেন না, এ যে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য!

বাবা একটু সলজ্জ ভাষায় বললেন, ইংরেজ দু-শ বচ্ছর ধরে বিশেষ করে বাঙালিদের ওই জিনিসটার দিকে ঘেঁষতে দেয়নি। পাখি মারার সামান্য একটা শটগান জোগাড় করতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। মিলিটারি সায়েন্স তো প্যোর-ফিজিকস নয় যে পুরনো খামের উল্টো পিঠে তার ফরমুলা লিখে কর্ম খতম করা যায়।

তারা তখন উঠেপড়ে লেগে গেল বাবাকে ওই বিষয়টি শেখাবেই শেখাবে। কাহা কাঁহা মোকামে নিয়ে গিয়ে কী সব দেখাত বোঝাত খোদায় মালুম। ফরাসিদের যে সবচেয়ে বিরাট কলেবর বন্দুক কামানের কারখানা স্লাইডার সেটা পর্যন্ত দেখিয়েছে।

কিন্তু এহ বাহ্য। শামিয়ানা সাইজের বৃহৎ বৃহৎ বান্ডিল বান্ডিল ম্যাপ পাতা হত কার্পেটের উপর, এবং সব্বাই তারই উপর উপুড় হয়ে স্টাডি করতেন ইতিহাসের নামজাদা সব ক্যাম্পেন–নেপোলিয়নের আউস্টার লিৎস থেকে আরম্ভ করে এদানির ডি ডে নরমালি ল্যান্ডিং। একদিন কোত্থেকে জোগাড় করে এনেছিল বাবুর বাদশার পানিপথ লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি। সেটার অধ্যয়ন শেষ হলে ফরাসিরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বার বার বলছিল, ফাতাসতিক, ফরামিদাবল– নে স পা? অর্থাৎ ফ্যানটাসটিক, ফরমিডেবল নয় কি? কিন্তু এহ বাহ্য!।

একটু দম নিয়ে তার পর শিপ্রা বলল, কিন্তু যে কথা বলতে চাইছিলুম সেটা এ সবের বিচিত্র স্মৃতির চাপে প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলুম। সবচেয়ে আমাকে মুগ্ধ– মুগ্ধ কেন, আত্মহারা করেছিল এদের আদব-কায়দা, এদের অপরিসীম সৌজন্য ভদ্রতা। এবং সর্বোপরি তাদের তীব্রতম আত্মসম্মানবোধ কাউকে কোনও কথা দিলে সেটা রাখবেই রাখবে– যায় যা তাতে তার শেষ ফ্রা। এবং সেটা দিয়েও যদি শেষ শোধবোধ না হয় তবে সোজা রাস্তা রয়েছে নাক বরাবর। কপালে পিস্তলটি রেখে গুড়ুম!..

তাই বলছিলুম, এ ছুঁচোমোটা কেন? তুই ইয়েহিয়া, তুই বাবা প্রেসিডেন্ট ডিকটেটর যা-খুশি তাই নিবি তো নে। পুব বাঙলার লোক যদি তোর আদেশ অমান্য করে তবে চালা তোর বন্দুক কামান। আজকের দুনিয়া পরশুর ইতিহাস বিচার করবে ধর্মাধর্ম।

ডিকটেটর হ আর যাই হ তোর আসল স্বত্বটা কী? এবাভ অল তুই আমিম্যান, অফিসার। তোর শরীরের রক্ত, বাইরের চামড়া অফিসারের ধাতু দিয়ে তৈরি। তোর ধর্ম, আত্মগৌরব আত্মসম্মানবোধ। অনার। কথা দিবিনি, দিসনি। কিন্তু একবার দিলে জান কবুল। কী দরকার ছিল তোর গণতন্ত্র ফের চালু করার তরে ওয়ার্ড অব অনার দেবার? কী দায় পড়েছিল ইলেকশন করার? আর এখন হল কী? সোলজার, অফিসার হয়ে তুই তোর শপথ ভঙ্গ করলি, তোর স্বধর্ম ত্যাগ করলি। ভদ্র দেশ হলে অফিসারস ক্লাব থেকে তোর নাম কেটে দিত। ছা!

এতক্ষণে আসমানের বেপরওয়া চিড়িয়া কীর্তিবাবুর কানে জল গেল। তা-ও যেত না যদি না পরশু রাতে তার দেবীর প্রসন্ন বয়ান নির্গত তাপহরা বিন্দু বিন্দু অমৃতবারি তার ব্যথাভরা হিয়াটাকে সদ্য ফোঁটা বেলফুলের মতো বিকশিত করে দিত। সে-রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে শপথ নিয়েছিল, দেবীর পথ তার পথ। পরের দিন ভোরবেলা ইংরেজি কাগজটা তো পড়লই, একটা নেটিভ বাঙলা কাগজের খয়ের খা ভি হয়ে গেল। কিন্তু দু দিন ধরে অনভ্যাসে ফোঁটা চড়চড় করছিল বড্ডই। দুনিয়ার বেকার হাবিজাবি না দিয়ে কাগজ ভর্তি করা যায় না? অধিকাংশ খবরের অর্থ কী উদ্দেশ্য কী তার কোনও হদিসই পাচ্ছিল না সে। আজ যদি কোনও নিরীহ বাঙালি হঠাৎ নটিংহামের একটা লোক্যাল ডেলি পড়তে বসে তবে তার যা অবস্থা হবে কীর্তির হল তাই। কিন্তু তার কপাল ভালো, কালকের বাঙলা কাগজে আওয়ামী লীগের একটি সমসাময়িক ইতিহাসমূলক প্রবন্ধ ছিল। যাই বল, যাই কও, কীর্তির বাপঠাকুদ্দা স্রেফ মাথা খাঁটিয়ে এন্তের টাকাকড়ি কামিয়েছিলেন। ম্যান-ইটার বাঘের বাচ্চা তো আর ভেড়ার ছানা হয় না–কীর্তির খুলিটাতে বেশ খানিকটে বংশলব্ধ মদ্যসিক্ত অর্ধসুপ্ত প্যাচালো ঘিলু বাবুর খোঁচাতে জেগে ওঠবার তরে তৈরি ছিল। পাকা নায়েব যেরকম শহুরে কাঁচা বাবুকে জমিদারির হালটা দু দিনেই বেশ খানিকটে বুঝিয়ে দেয়, এ ক্ষেত্রেও হল তাই।

সদ্যলব্ধ বিদ্যে ফলিয়ে বলল, ওই ইয়েহিয়া ঘুঘুর পেছনে রয়েছেন আস্ত একটা খাটাশ মিলিটারি ক্লিক।

শিপ্রার চোখের পাতা স্তব্ধ– যেন অর্ধাঙ্গে অবশ। এ কী কথা শুনি আজি? দুনিয়ার তাবৎ বাবদে বেহদ্দ বেখেয়াল বেকুব নীচ কুলোদ্ভবা দাসীর মুখে সত্য মিথ্যা জ্ঞান তার তবে কী সম্ভবে? কীর্তির মুখে মোস্ট আপ টু ডেট ইনসাইড স্টোরি।

বিমূঢ় ভাব কেটে যাওয়ার পর শিপ্রা শুধু বলল, তুমি না অপদার্থ কীর্তি?

প্রশ্নটা যেন অদৃশ্য ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ছো, এ খবরটা আবার পদার্থ। খবরের কাগজ থেকে যে তত্ত্ব আধ ঘন্টার ভিতর জোগাড় করা যায়।

শিপ্রা আরও সাত বাও পানিমে। বলল, খবরের কাগজ? ওসব ব অভ্যাস হল তোমার কবের থেকে?

কীর্তি সবিনয় : সে অনেক কথা, পরে হবে।

শিপ্রা : তাই সই, তুমি যখন এসব বুঝতে আরম্ভ করেছ তখন তোমাকে আর একটা খবর জানাই। সেই যে বাবার দোস্ত বুড়ো ফরাসি জাদরেল বাঙলাদেশের মিলিটারি হিন্দ্রি জোগাড় করার চেষ্টা দিয়েছিলেন– নিছক আমরা ওই দেশের লোক বলে। এটাও একরকম দরদি হিয়ার আচরণ বলতে পারো। একদিন বাবাকে কথায় কথায় বললেন, ব্লাঙ্কো, ব্লাঙ্কো! প্রায় কিছুই জোগাড় করতে পারিনি। তবে দিল্লিতে লেখা এন্তের রাজনৈতিক ইতিহাস পেয়েছি বেশকিছুটা। তার থেকে স্পষ্ট ধরা পড়ে দিল্লির হুজুররা বেঙ্গলে মার খেয়েছেন বিস্তর। তাই সে সম্বন্ধে নীরবতাটাই সমধিক। গ্রেট মোগল আকবরের নাম এদেশের লোকও শুনেছে। তিনিও দেখলুম বাঙলাদেশের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র জয় করতে পেরেছিলেন। জয় করেছিলেন তার ছেলে জাহাগির। মন্দ কপাল আমার, তার স্ট্র্যাটেজি খুঁজে পেলুম না।

কিন্তু যা পেয়েছি তার থেকে আমি বুঝেছি, এবং জোর গলায় বলতে পারি।

তেরাঁ, তেরাঁ, পুনরপি তেরাঁ
মল্লভূমি, মল্লভূমি, মল্লভূমি

এই বিরাট পৃথিবীতে আদ্যন্ত অদ্বিতীয়। বিরাট বিরাট নদী আর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি যেখানে হয় সেই চেরাপুঞ্জি থেকে নামে আকাশের জল। দুয়ে মিলে এমন সব ভিন্ন। ভিন্ন আকৃতি প্রকৃতির জলাভূমি তৈরি করে যে সেগুলোর নাম ইয়োরোপীয় কোনও ভাষায় নেই। দেশি শব্দের একটা সুর মনে আছে হাওর না কী যেন। এমনকি মস্কো যেতে পথে যে জলোজমি সেটাও হিটলার পেরিয়ে যেতে পেরেছিল কিঞ্চিৎ লোকক্ষয় স্বীকার করে। কিন্তু তোমাদের দেশে আমাদের সনাতন সংগ্রাম পদ্ধতি চলবে না।

শিপ্রা বলল, আমি এসব আলোচনায় যোগ দিতুম না। তখন সেই প্রথম বললুম, কিন্তু, মসিয়ো ল্যা জেনারেল, আকাশে থেকে বমিং? জেনারেল তো গড্ড্যাম গ্ল্যাড। আপন চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার কাছে এসে ফরাসিরা ভাবাবেগে, আনন্দোল্লাসে উত্তেজিত হলে যা করে তাই করলেন। সর্বপ্রথম আমার গালে খেলেন শুকণ্টকিত কিন্তু অতিশয় মিঠে মিঠে একটি চুম্বন, তার পর আমার চুলের উপর বুলোলেন তাঁর হাত, এবং সর্বশেষে রাজপ্রাসাদীয় কায়দায় দিলেন আমার বাঁ হাতটি তুলে ধরে একটি অতিশয় রিফাইনড চুম্বন।

প্রায় নৃত্য করতে করতে বার বার বললেন, মাদৃমোয়াজেল, মাদৃমোয়াজে। অর্থাৎ, কল্যাণী, কল্যাণী।

সে তো বুঝলুম– ফরাসিরা ওইভাবে বে-এক্তেয়ার হয়। তার পর কী বলতে চান তিনি? আর আমিই-বা এমন কোন গূঢ় গুহ্য মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিক ট্যাকটিকাল প্রশ্ন শুধিয়েছি যে ঝানু জাঁদরেল আত্মহারা হবেন!

আমার পাশে আসন নিয়ে কিঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর বললেন, আমি বড্ড ভুল করেছি, মাদমোয়াজেল, বড় ভুল বুঝেছি এতদিন ধরে। আমি মনে করেছিলাম, তুমি। লন্ডন-প্যারিস সমাজে বাস করে করে দেশাত্মবোধ হারিয়ে ফেলেছ, কিন্তু এখন আমি দেখছি তুমি দেশের স্বার্থ, দেশের বিপদ সম্বন্ধে বেশ সচেতন। প্রশ্নটা তো অতিশয় সাদাসিধে, কিন্তু তারই ভিতর দিয়ে আমি তোমার অন্তরের অন্তস্তল অবধি দেখতে পেয়েছি।

শোনো, মাদমোয়াজেল, স্ত্রী হোক পুরুষ হোক, সবচেয়ে মূল্যবান ধন মানুষের মনুষ্যত্ব। কিন্তু আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস সেটাতে মানুষ পৌঁছয় দেশাত্মবোধ, ন্যাশনালিজম, পেট্রিয়টিজমের ভিতর দিয়ে এবং তার দৃঢ় ভূমি–

শিপ্রা বলল, অবাক মানবে, কীর্তি, তার পর সেই বৃদ্ধ জেনারেল এক লাফে কোচ ছেড়ে, যেন অদৃশ্য এক পতাকা এক হাতে উঁচু করে ধরে, রাস্তার ছোকরাদের মতো ঘরময় নাচতে নাচতে চেঁচাতে লাগলেন,

লিবেরতে, লিবেরতে, তুজুর লা লিবেরতে
লিবার্টি, লিবার্টি, অলওয়েজ লিবার্টি
 স্বাধীনতা স্বাধীনতা, স্বাধীনতা চিরদিনের।

.

১০.

উপরে চল। আমার কোনও বান্ধবী, বন্ধু দূরে থাক, কেউ কখনও দোতলায় ওঠেনি। বাবা কাউকে উপরে আনতেন না বলে আমি সে রীতিটা এখনও মেনে চলি। কিন্তু তোমাকে এখন সবকিছু দেখে-চিনে নিতে হবে। তুমিই মালিক। যদি চাও, বাড়ি-ঘর যা কিছু আছে, উইল করে তোমার হাতে সঁপে দেব।

কীর্তি আঘাত পেল; বললে, তুমি কি আমাকে এখনও চিনতে পারোনি?

শিপ্রা তাড়াতাড়ি বললে, সরি, আমি দুঃখিত। এই হল বাবার স্টাডি। এখানে বসে তিনি বৈষয়িক কাজকর্ম করতেন। আমার খেয়াল-খুশিমতো ওই কোণের কোচটাতে বসে খবরের কাগজ, বইটই, মাঝে মাঝে শেয়ার মার্কেট রিপোর্ট পড়তুম। আমি জানতুম তিনি তাতে খুশি হতেন। কাজ করতে করতে কখনও গুনগুন করতেন, খুশি হলে শিস্ দিতেন। কোনও কারবার ঠিক তার পছন্দমতো না এগোলে গরগর করে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আর প্রায়ই মাথা তুলে বেশ উঁচু গলায় বলতেন, দিজ আর লুকিং আপ, আমাকে শুধোতেন, তোর জন্য শ-খানেক চা-বাগানের শেয়ার কিনব? আমি শুধু একটু মুচকি হাসতুম– আমি ও-সবের কীই-বা বুঝতুম, তখন? কিন্তু আমাকে কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য শেখাননি। বলতেন, এসব শুকনো জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মানুষের প্রাণরস শুকিয়ে যায়–আমি অবশ্য কখনও তাঁর প্রাণরসে ভাটার টান পড়তে দেখিনি। শেষটায় বলতেন, তোকে কিচ্ছুটি শিখতে হবে না। তুই পেয়েছিস আমার ঠাকুমার বুদ্ধি এবং বিশেষ করে বিচক্ষণতা। বাবা পেয়েছিল তার বুদ্ধির বারো আনা, আমি পেলুম আট আনা, তোতে ফের এক্কেবারে ফুল হাউস ন সিকে। যেদিন দরকার হবে পুরো হপ্তাটাও লাগবে না, তুই হয়ে যাবি শেয়ার মার্কেট কুইন, কিংবা মফৎ লাগল এবং দেওকরণ নানজির সমন্বয়। এবারে চলো এগিয়ে।

 বিরাট জোড়া খাটের বেডরুম। একশো বছরের পুরনো স্টাইলের।

শিপ্রা বলল, এখানে বাবার আর একটা ড্রইংরুম আর গেস্টরুম আছে। তবে এগুলো কখনও ব্যবহার হয়নি। এইখানে বাবার হিস্যে শেষ। এই আমার বেডরুম।

ছবিতে কীর্তি ফরাসি ধনী কুমারী কন্যার বেডরুম দেখেছে। এবারে আপন চোখে দেখল।

দেওয়ালে ওয়ালপেপারের বদলে খুব দামি সিল্কের ওয়ালকাভার। তার উপর আবার ভিন্ন ভিন্ন রঙিন সিল্ক দিয়ে বেহালাতে জড়ানো ফুলের মালার ডিজাইন। ছাতের চার কোণে চারটি দেবশিশুর বা-রিলিফ। তাদের হাত থেকে ঠিক মাঝখানে এসেছে চারটে ফুলের মালা। সেগুলো যেন ঝুলিয়ে রেখেছে একটা ফোয়ারার পাদপীঠচক্র। পায়ের নিচে ফরাসি কার্পেট।

আর খাটটি ঘোট এবং সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরা। খাঁটি ফরাসি পালঙ্ক। এমনকি তিনদিকে ফরাসি কায়দায় সিল্কের কার্টেন ঝুলছে। বেড-কাভার ভারী কিন্তু সুতোগুলো অতি মিহিন। কার্টেন আর বেড-কাভারের ডিজাইন দেয়ালের সিল্কের সঙ্গে ম্যাচ কিন্তু মতিফ ভিন্ন– এখানে জলে চালিত ময়দা পেশার ওয়াটার-মিল ডিজাইন। ঘরের এক কোণে ড্রেসিংটেবল– তার উপর বিচিত্র ঢপ-ঢঙের বিস্তর শিশি-বোতল, এক সারি কৌটো– অথচ কীর্তি খুব ভালো করেই লক্ষ করে বুঝেছিল, শিপ্রা প্রসাধন করে সামান্যতম। সমস্ত ঘরটার কালার স্কিম মভ রঙের।

শিপ্রা বলল, আমার অত বাহার সয় না। বাবা করিয়েছিলেন টপ টু বটম।

পাশে শিপ্রার একান্তে বসার বুদওয়ার। তার মধ্যে দ্রষ্টব্য, মাঝারি সাইজের সেক্রেটারিয়েট এবং প্রায় সম্পূর্ণ একটা প্রান্তজুড়ে বিরাট দৈত্যপ্রমাণ গ্র্যান্ড পিয়ানো।

কীর্তি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, তোমাকে তো কখনও পিয়ানো বাজাতে শুনিনি।

শিপ্রা বলল, আমার বাজনা শোনাবার মতো নয়। মাত্র দশ বছরের হেঁ ছেঁড়া রেওয়াজে শোনাবার মতো হাত পাকা হয় না। আমি বাজাই রাত ঘনালে আর অতি ভোরে। এবারে চলো ব্যালকনিতে।

.

১১.

ভেবে নিয়েছ? অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেছ? এখনও ব্যাক-আউট করার সময় আছে?

কাতর কণ্ঠে কীর্তি বললে, সমস্ত রাত ভেবেছি। কিন্তু কথাগুলো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আর ভয়ও করছে।

শিপ্রা একটা কুশনওলা লম্বা হেলান চেয়ারে আধ-শোওয়া হয়ে সামনের পার্কের দিকে তাকিয়েছিল। বললে, ট্যারচা হয়ে বসো আর আমার দিকে না তাকিয়ে তাকাও পার্কের দিকে। সবুজ দিয়ে চোখ ভরে নাও। আর ভয়টা কিসের, শুনি।

যেন প্রাণপণ সিংহের কেশর ধরে, মরি-বাঁচি ভাব মুখে মেখে বললে, মাত্র একটি কথা নিয়ে আমি সমস্ত রাত ভেবেছি। আমাদের যদি বিয়ে না হয় তবে তোমার যে নিন্দে হবে, সে কথাটা কি ভেবে দেখেছ।

শিপ্রা অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে সহজ গলায় বললে, আমি জানতুম তুমি এ কথাটা তুলবে কিন্তু তুমি না অপদার্থ? তা হলে এ দুশ্চিন্তা তোমার মাথায় ঢুকল কী করে? কলকাতা-বোম্বায়ের স্মার্ট সেটের যে কোনও বিবাহিত-অবিবাহিত জোয়ান-বুড়ো ক্ষণতরে চিন্তা না করে উল্লাসে নৃত্য করত আমার মতো মেয়েকে মিসট্রেসরূপে পেলে।

কীর্তি লাফ দিয়ে উঠে শিপ্রার মুখ চেপে ধরে বললে, মাথার দিব্যি দিচ্ছি, শিপ্রা, তুমি যদি ওই শব্দটা আর কখনও ব্যবহার করো তবে ওই তোমার পায়ের সামনে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব।

কীর্তির হাতে হাত বুলাতে বুলোতে বললে, আচ্ছা আর বলব না। তোমাকে তো দিব্যি কেটে বলেছি, আমি তোমার সব আদেশ মানব।

কীর্তি বললে, সমস্ত রাত ওই দুশ্চিন্তাটার সঙ্গে মাখানো ছিল আমি পেয়েছি, আমি তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছি। এবং আমি জানি আমার যে তিনটি সত্যকার খাঁটি বন্ধু, সুদিনদা, শঙ্কর আর খান সায়েব এরাও ঠিক এইভাবেই আমার অনুগ্রহ লাভের কথা ভাববে।

শিপ্রা উঠে বসে বললে, আমার যে লোকনিন্দাটা হবে সেকথা শুনে আমি হাসব, না কাঁদব ভেবে পাইনে। লোকনিন্দার প্রাপকরূপে আমি ভেটার। আমার বয়স যখন মোল পেরুল সেদিন বাবা আমাকে ডেকে বললেন, আজ থেকে তুই এ বাড়ির মিসট্রেস আর আমি যেসব পার্টি দিই তাতে হোস্টেস্। বুঝলি? আর আমি আমার ইয়ারদের যে রকম পার্টি দিই তুই যেদিন দিবি সেদিন আমাকে ডাকতে পারিস, না-ও ডাকতে পারিস। বুঝলি তো? সেদিন দুপুরবেলা বাবা আমার ক্লাস-ফ্রেন্ডস্, স্কুলের সব টিচার এবং অন্যান্য যাদের কাছে পড়েছি আর আমার ফ্রেন্ডস ছেলে এবং মেয়ে দুই-ই সবাইকে দিলেন জব্বর একটা ভোজ। সেটাতে হোস্টেস হতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি যদিও বাবা নিচের তলায় নেমে আগের মতো একবারও তদারকি করেননি। শুধু খাবার সময় আমাদের হেডমিস্ট্রেসের পাশে বসে তাকে আদর-আপ্যায়ন করতে করতে আহারাদি করেছিলেন।

তোমরা আবার পার্টি করো! আর আমার পার্টিই-বা কী? কে এক সোভানি একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে ভরতনৃত্যের নামে হস্তীনৃত্য নেচেছিল! ওইখানেই তো ফুলস্টপ। বাবার পার্টিতে অন্তত জনা পাঁচেক বেহুশকে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলতে হত। জনা দশেককে দুজন তাগড়া জোয়ান বেয়ারা দু দিক থেকে স্যান্ডউইচ করে মোটরে তুলে দিত।

অবশ্য বাবা আমাকে বিস্তর টিপস আগের থেকেই দিয়ে রেখেছিল। একটা এখনও মনে আছে। যদি লক্ষ করিস কেউ একটু বে-এক্তেয়ার হয়ে যাচ্ছে তার পাশে গিয়ে বসবি। তাকে আদর-সোহাগ করে বলবি, আকল, তুমি তো জানো, আজ থেকে আমি হোস্টেস। আমার ভারি ইচ্ছে আমি নিজে তোমাকে ড্রিংক দিই। তুমি কোনও বেয়ারার ট্রে থেকে ড্রিংক তুলবে না। কথা দাও। কথা নিজেই দেবে। খাস হোস্টেসের কোনও অনুরোধ কোনও লোক উপেক্ষা করে না। তার পর বার টেবিলে গিয়ে যে ড্রিংকই হোক না সেটা বেয়ারাকে পাতলা করে দিতে বলবি। তাকে বোঝাতে হবে না। তার পর খামকা টালবাহানা করে, এর-ওর সঙ্গে দুটো কথা কয়ে বেশ দেরি করে এসে তোর সেই আনককে গেলাসটা আপন হাতে রেখে প্রথম তো হাজার দফা মাফ চাইবি তার পর জুড়ে দিবি লম্বা এক কাহিনী –গেলাসটা কিন্তু হাতে। গল্প শেষে গেলাস দিবি। তোর আন্কটিও চক্ষুলজ্জায় তোর কাছে ঘন ঘন ড্রিংক চাইবে না। আর কেউ যদি নিতান্তই বেহেড টালমাটাল হয়ে যায় তবে মজুমদার, কাঞ্জিলাল, ভবতোষ এদের কাউকে একটু হিন্ট দিয়ে আসবি। ওদের মাথা ঠাণ্ডা। সব সঙ্কটে মুশকিল-আসান।

পার্টি শেষ হল। বাবা ভারি খুশি। বললেন, একদিন তুই যে শহরেই যাস না কেন, নামজাদা হোস্টেস হবি। দু চারটে পার্টি করার পর মজুমদার, কাঞ্জিলালকেও তোর দরকার হবে না।

কিন্তু সেইদিন থেকেই আমার বদনাম শুরু। বিস্তর লোকের মুখে ছ্যা ছ্যা। বিশেষ করে মেয়েদের। এমনকি বাবার স্কুলফ্রেন্ড চৌধুরী সাহেব বাবাকে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, এটা ঠিক হল না। বাবা বলেছিলেন, দেখো, চৌধুরী, তুমি খানদানি মুসলমান ঘরের ছেলে। তোমার চতুর্দশ পুরুষে কেউ মদ খায়নি তবু তুমি মদ ধরেছ। শুনেছি অভ্যাসটা নাকি মুসলমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর হিন্দুদের তো কথাই নেই। নিত্যি নিত্যি নতুন নতুন বার খুলছে এবং সেগুলো ভর্তি। বেশিরভাগ ক্লাবে আসে সুদুমাত্র মদ খেতে। আর ড্রিংক পার্টির কথাই নেই। আমার মেয়ে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, সে আমি জানি তার ছোট্ট বয়স থেকে। তদুপরি তার হিউম্যান ইনট্রেস্ট অফুরন্ত। চাকরবাকররা তাদের বাড়িতে তাদের সমাজে কী করে, না করে তার থেকে আরম্ভ করে সে কুইন ভিক্টোরিয়ার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বর্ণনা খুটিয়ে খুটিয়ে জেনেছে। এ মেয়ে পাটিতে যাবে সেটা প্রায় অসম্ভব। তাই পার্টিতে, ক্লাবে বার-এ একটা ভদ্রমেয়ের আচরণ কীরকম হওয়া উচিত, সেসব জায়গার এটিকেট মেনে নিয়ে ভদ্রতা শালীনতাসহ কীভাবে মেলামেশা করবে, সেটা আমার কাছ থেকে শিখবে, না শিখবে ওইসব পাঁড় মাতাল ভেঁপো ছোঁড়াদের কাছ থেকে কোনও ক্লাবে বা পার্টিতে কেউ যদি অশালীন আচরণ করে তখন কীভাবে চতুরতা এবং ডিপ্লোমেসির সঙ্গে নিজের ভদ্রতা নিজের ডিগনিটি বাঁচিয়ে তাকে ট্যাকল করতে সে-সব শেখাবে ওইসব ছোঁড়ারা? আর শুধু কী তাই? আজ তাকে বলে রেখেছিলুম সে যেন কর্নেল সরকারের টেবিলে দু এক সিপ চাখে। আস্তে আস্তে তাকে ভোদকা আবসাতেরও দ্রব্যগুণ শেখাব। কোনটা কতখানি ক্ষতি করে, ও জেনে নেবে। তার পর কারও পাল্লায় পড়ে যা তা গিলে নিজের অনিষ্ট করবে না, বানচালও হবে না, কাকে কতখানি কী ঢেলে দিতে হবে সেটাও জেনে যাবে– হবে আইডিয়াল হোস্টেস। বাপের চেয়ে ভালো গুরু সে পাবে কোথায়?

শিপ্রা বললে, কথাটা অতি সত্য। আমার হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছে পাশে এক গুরুমশাই বসেছিলেন মাত্র। স্কুল না-যাওয়া অবধি তাঁরই কাছে সব শিখেছি : প্রাইভেট টুটার বাবা ককখনও রাখেননি। কলেজে পড়ার সময়ও বাবার ঘরের এক কোণে বসে অধিকাংশ সময় পড়াশুনো করতুম। মাঝে মাঝে তাকে প্রশ্ন শুধোতুম। জানা থাকলে সুন্দর বুঝিয়ে দিতেন– আর কী অসীম ধৈর্য। না জানা থাকলে একগাল হেসে বলতেন, ওরে শিপি, তুই যে বাপ-মারা বিদ্যে রপ্ত করে নিচ্ছিস। তার পর তার কোনও এক বন্ধু বা পরিচিত স্কলারের কাছে পাঠিয়ে দেবার সময় বলতেন, শিখে এসে আমায় বাতলে দিস্। তাঁর আর একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গুরুকে আপন বাড়িতে টেনে আনলে সত্য বিদ্যার্জন হয় না। গুরুগৃহে বসে থাকবে বারান্দার বেঞ্চিতে– গুরুর কখন কৃপা হয়।

কীর্তি মুগ্ধ হয়ে বলল, শিপি, তুমি সত্যি ভাগ্যবতী।

শিপ্রা বললে, আমার নামে কীসব বদনাম রটে তার খবর আমি রাখিনে আমরা যারা পার্টি-ফার্টি করি তাদের মধ্যে কার না বদনাম হয়! কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও বিবাহিতা রমণী বলেনি আমার বাড়ি থেকে তার স্বামী বে-এক্তেয়ার হয়ে ফিরেছে। বাবা বলতেন, তুমি লেডি। এ আইনটা বিশেষভাবে তোমার বেলা প্রযোজ্য। আর আমি নিজে যে সবচেয়ে মোলায়েম ড্রিংকে সীমাবদ্ধ করে নিজেকে সংযত রাখব সে-বিষয়ে তার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না।

কীর্তি হাবা ছেলের মতো গদগদ সুরে বলল, সে কি আমরা জানিনে? কিন্তু ড্রিংক। কেন, কোন ব্যাপারে তোমার সংযম-সৌজন্যের অভাব। সুদিনদা যে জালা জালা খায়, ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত ডোন্টো কেয়ারের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায় সে-ও তোমাকে রীতিমতো সমীহ করে চলে। আমাকে বলে, ওরে মূর্খ! তোরা ভাবিস শিপ্রা বুঝি বেখেয়ালে আমাদের এটা-ওটা দেখতে পায়নি। ও মেয়ে না দেখেও সব দেখে, না শুনেও সব শুনতে পায়। আর আসল গেরো কী জানিস, তার আচরণ বা কথায় প্রকাশ পাবে না, সে অপরাধ নিয়েছে। তা হলে তো গেরোটা ফস্ করে খুলে যেত– হাত-পা ধরে মাপ চেয়ে নেওয়া যেত। বলে এটাই নাকি তোমার ব্রহ্মাস্ত্র।

শিপ্রা বললে, যাহ! বিশ্বভুবনটা রিফর্ম করার ভারটা কি আমার স্কন্ধে।

কিন্তু–

শিপ্রা বললে, আজ এসব অপ্রিয় আলোচনা এখানেই থাক। ইরানিরা যেরকম বলে, তখন আলোচনার কার্পেটটা রোল করে গুটিয়ে এক কোণে খাড়া করে রাখা হল। পরে

হয় আমরা ওটা আবার ঘরময় বিছিয়ে পুরনো আলোচনার শেষ রেশ ধরে নতুন করে ঢেলে সাজাব। আরেকটা কথা তোমায় বলি, কীর্তি। আমাকে যতশত গুণের গুদাম মনে করো না কেন, আমি অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করি দৈবে, অদৃষ্টে– আমি ফেটালিস্ট, অনেকটা খৈয়ামের মতো। তার প্রত্যাদেশ, তারই ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলে পেয়ালা অধরে ধরো। অর্থাৎ আনন্দ করো। সেটা তো মোটামুটি মানিই, কিন্তু সবচেয়ে সেই ফরাসি বৃদ্ধ জেনারেল আমাকে যে ধর্মে দীক্ষা দেন :

লিবেরতে লিবেরতে, তুজুর লা লিবেরতে।

.

১২.

খান সাহেবের সঙ্গে কীর্তির হঠাৎ মোলাকাত। খান সোৎসাহে বলে, হ্যাঁ রে, কিতে, এদানির তুই শিপ্রা বেগমকে দেখেছিস? আরে, ভাই, বয়স যেন দশটা বচ্ছর কমে গেছে। মোটরে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে হাত নেড়ে নেড়ে যা প্যারটা জানাল, মাইরি, যেন আমি বহু বছরের লঙ লস্ট ব্রাদার। মেয়েদের ব্যাপারটাই ভানুমতীর খেল। আমি তো জানতুম বিয়ের জল পড়লে তবে না মেয়েদের জেল্লাই বাড়ে। কালা পেঁচিটা হয়ে যায় সোনালি ক্যানারি!

কীর্তি ভদ্রতার মৃদু হাসি হেসে বললে, শিপ্রা তো চিরকালের সুন্দরী।

খানের মাথায় অন্য চিন্তা। ব্যবসার। সে কথা কী শুকনো মুখে পাড়া যায়! বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছিস। তা চ, ঝপ করে একটা খেয়ে নিবি। ফাস্ট ক্লাস গর্ডনস।

এই অবেলায়?

বলিস কী রে? বেলা তিনটে অবেলা। চ-চ।

গুণীরা বলেন, অন্ধকার গুহায় আলো জ্বালালে সে অন্ধকার হাজার বছরের পুরনো হোক, আর দশ মিনিট পূর্বে কারও মশাল নিভে গিয়ে থাকার অন্ধকার থোক, দেশলাই দুটোকেই দূর করবে এক সময়েই, এক মুহূর্তেই। কিন্তু খান প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু কীর্তির। না যাব না বলে এক লহমায় সে বন্ধুতে আগুন ধরানো যায় না। আসলে কীর্তির ইচ্ছা ছিল পানের মাত্রাটা আস্তে আস্তে কমানো।

আরাম করে বসে খান ঢক করে পয়লা গেলাস বটম আপ করে কীর্তিকে বলল, হ্যাঁ রে, তুই তো কোথাও যাস নে। তবু একবার যদি আমার সঙ্গে আগরতলায়? তুই থাকলে কুচক্রীরা সমঝে যাবে, তোর শেয়ারসুদ্ধ, তুই আছিস আমার পিছনে। দু দিন আগে এরই ধাক্কায় আমাকে যেতে হল করাচি-লাহোরে।

কীর্তি হতভম্ব। তোতলাতে তোতলাতে বলল, তোর কি মাথা খারাপ? সেই হাইজ্যাকিঙের পর থেকে ওসব জায়গায় ইন্ডিয়ান হয়ে গেলি কোন সাহসে?

কীর্তির পিঠ চাপড়ে দিয়ে খান্ বলল, বেশ বাওয়া, বেশ। চতুর্দিকে নজর ফেলে ওকিবহাল হয়ে উঠছিস। এবারে ব্যবসার দিকে একটু মন দে না।

তা সেখানে কী দেখলি, কী শুনলি?

আর বলিসনি। ওদের কাগজগুলোর ক্রুড ছুঁচোর মতো ফিচেল মিথ্যে কথা বলার ধরন আর বহর দেখলে তোর মতো অগাও তাজ্জব মানবে। বলে কি না, আওয়ামী লীগ গুণ্ডা ভাড়া করে ইলেকশন জিতেছে। বিদেশি রিপোর্টারগুলো মিটমিট করে হাসে। আরে, ঝুট যদি বলবিই তবে বল্ হিটলারি স্টাইলে, গ্যোবেলসের সুপারফাইন সুতো দিয়ে বোন একটা মিহিন জাল। পুব বাঙলার পৃনের আনা লোক নাকি ইয়েহিয়াকে ফাদার-মাদার রূপে দেখে– মসজিদে মসজিদে তার জিন্দেগি আর ভালাই-এর জন্য দোয়াদরুদ পড়ে।

এর ফলে কী হবে জানিস? হিটলারি রাজের আখেরি ওক্তে যা হয়েছিল, ঠিক তাই। এরা হয়ে যাবে আপন প্রপাগান্ডার ভিকটিম! একদম টপ-এ যারা আছে– ইয়েহিয়াকে ঘিরে– তারা জানে এসব মিথ্যে প্রপাগান্ডা। কিন্তু যদি আখেরে বাঙলাদেশ রুখে দাঁড়ায় তবে সেটাকে দমন করার প্রস্তুতির ভার যে শত শত অফিসারের কাঁধে পড়ছে, তারা তো জানে না এসব ডাহা মিথ্যে, তারা ভাববে এসব বাড়াবাড়ি, মশা মারার জন্য খামোখা সেই কোন সুদূর পুব পাকিস্তানে পাঠাতে হবে কামান-ট্যাঙ্ক। কাজে আসবে গাফিলি। পানি-কাদা সাপ-জোঁকের দেশে এমনিতেই পশ্চিম পাকি সেপাই যেতে চায় না, এখন সেখানে যেতে হবে বিদ্রোহ দমন করতে? কিসের বিদ্রোহ? অ্যাদ্দিন ধরে তোমরা গাইলে ভিন্ন গীত। সাধারণ সেপাই যদি অফিসারকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে তবে আর্মির মরালটি হয়ে যায় ঝরঝরে।

আখেরে মামেলাটা এ শেপ নেবে কি না, সে জানেন আল্লা। কিন্তু লাহোর-পিন্ডির ক্লাবে ক্লাবে কী অন্ধ আত্মপ্রসাদ, কী কাণ্ডজ্ঞানহীন বড়-ফাট্টাই।

আর মদের কথা যদি তুলিস তো আমরা কলকত্তাইয়ারা ওদের তুলনায় শিশু, শিশু, শিশু। আমাদের সবচেয়ে বড় ক্লাবে সম্বৎসরে যে পরিমাণ খাওয়া হয় তাই দিয়ে ওদের ছোটাসে ছোটা ক্লাবের কপালে তিলকটি কাটা যাবে না। জালা জালা মদের সঙ্গে সঙ্গে সব্বাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালিগালাজে ভর্তি অশ্লীলতম ভাষায় যেসব নোংরা নর্দমায়। তারা গড়াগড়ি দেয়, গল্পের নামে মোস্ট পয়েন্টলেস যেসব মলকুণ্ডের বর্ণনা দেয় সে-সব না শুনলে কোনও দেশের গাটারস্নাইপও বিশ্বাস করবে না যে, নগরের সবচেয়ে সম্মানিত ক্লাবে দ্রসন্তানরা এসব বলে, শোনে আর চতুর্দিকে কী অট্টহাস্যের গমগমানি।

আমাকে এক্কেবারে চাটনি বানিয়েছিল সর্বশেষে এক জমিদার ব্যারন বললেই ঠিক হয় বাড়ির একটা বিরাট হলঘরে। ব্লু ফিল্ম কখনও দেখেছিস? তার বাস্তব– থাক্। তুই যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু যার সামনে আমি হরহামেশা প্রাণ খুলে সব কথা বলেছি, তোকেও ভাই বলতে পারব না।

কীর্তি বললে, বলারই-বা কী দরকার?

খান বললে, না ভাই, শুধু বলার জন্যই বলছিনে। আমি শুধু ভাবি এইসব আত্মপ্রসাদমত্ত দিবান্ধ, মিথ্যা ভাষণ যাদের হাড়ে হাড়ে এমনই ঢুকে গেছে যে পবিত্র শপথগ্রহণের সময়ও কুণ্ঠা নেই, লজ্জা নেই, যৌন ব্যাপারে যারা পশুর চেয়েও অধম এরা ভাবে এরা সভ্য, এদের তুলনায় পুব বাঙলার লোক জংলি, বর্বর। এসব ব্রুটগুলো শাসন করতে চায় সরল, বিশ্বাসী, দ্র পুব বাঙলার লোককে!

খান ভালোভাবেই জানত, কীর্তির মতো মাত্রা রক্ষায় অভ্যস্ত বনেদি ঘরের ছেলের কাছে এসব অবিশ্বাস্য, এসব তার কল্পনার বাইরে, তার দৃষ্টিচক্রের বহু বহু দূরে। পাকেচক্রে যদি-বা সে এ জাতীয় পশ্বাচারের কাছে-পিঠে এসে পড়ে তবে সঙ্গে সঙ্গে তার ইনসটিনটই তার লাগাম ধরে উল্টো পথে ডার্বি স্পিডে তাকে ছুটিয়ে দেবে। কিন্তু সে নিজে এ যাত্রায়, বিশেষ করে ব্যারনের বাড়িতে যে পাইকিরি পাপাচার যে সামান্য অংশটুকু দেখেছিল, এবং পরে শুনেছে আর সব জমিদারবাড়িতেও এসব ডাল-ভাত, পুরুষানুক্রমে চলে আসছে তাই নিয়ে মনে মনে তোলপাড় করছিল এক একটা জাত এ রকম পথে চলে কী কারণে? আর পাঁচটা জাতের সঙ্গে মেলামেশার পরও নিজেদের সভ্যতর মনে করে কোন যুক্তি দিয়ে? দুজনাই চুপ।

খানই শেষটায় বললে, তুই তো জানিস আমাকে পুরো দুটি বৎসর লন্ডনে কাটাতে হয়েছিল, বাবার হুকুমে। ইংরেজের সঙ্গে আমার যে খুব-একটা দহরম-মহরম হয়েছিল তা নয়। তবু তাদের চরিত্র, সামাজিক আচরণ খানিকটে আমার নজরে আসে। অবশ্য যেসব বিশেষ বিশেষ সীমাবদ্ধ সম্প্রদায় থেকে ইংরেজ ভারতবর্ষে রাজত্ব করার জন্য লোক সংগ্রহ করত তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে বৃহৎ অভিজ্ঞতা আমি যেটা অনিচ্ছায় সঞ্চয় করেছি সেটা তাদের অজ্ঞতা, সর্বগ্রাসী অজ্ঞতা। শিক্ষিত অশিক্ষিত তা তারা খবরের কাগজ পড়ুক আর না-ই পড়ক– শতকরা ৯৯ জন বাইরের দুনিয়ার কোনও খবর তারা রাখে না। ফ্রান্সে, শুনেছি, অজ্ঞতাটা তারও বাড়া।

পাঞ্জাবি সেপাইয়ের জনপদবধূ কি জানে, পুব বাঙলা কোথায়? এবং সেখানকার বধূর বুকে তারই মতো একটা সুখ-দুঃখ, দু মুঠো অন্নের যেন অনটন না হয় তার তরে তারো জীবনভর একই দুশ্চিন্তা!

তুই শুনলে হাসবি, আমি লাহোর ক্লাবের মেম্বার, ইংরেজ ও গাঁইয়া মেয়ের অজ্ঞতার ভিতর বিশেষ কোনও তফাত দেখিনে। লাহোরের মেম্বার ভ্যাটভূট করে ইংরেজি বলতে পারে বলে আমরা ভুল ধারণা করে বসি তারা বুঝি আপ টু ডেট।

এই সর্বব্যাপী অজ্ঞতার মাঝখানে ইংরেজ শাসকের অজ্ঞতা তাকে দিয়েছিল ভারতীয়ের প্রতি অবজ্ঞা আর পাঞ্জাবি করে ঘৃণা পুব বাঙলার লোককে। তুই তো ঘটি, তবু নিশ্চয় জানিস ওরা বড় টাচি, বাঙলাকে অবহেলা করলে সে তার উত্তর দেয় তিন ডবল অবহেলা দিয়ে। ইংরেজের অবহেলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে তাই তার একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু ব্যাটা যেদিন ঠিক ঠিক বুঝে যাবে, পাঞ্জাবি শুয়ারটা তাকে ঘৃণা করে, তখন শুরু হবে আতসবাজি।

খান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললে, সবই ঠিক, কিন্তু জানিস তো জোর যার মুলক তার। ব্যাটাদের শুধু বন্দুক নয়, আছে ট্যাঙ্ক-প্লেন।

কীর্তি বলল, ইংরেজের কি ট্যাঙ্ক-প্লেন ছিল না। তত্ত্বকথার মূল তত্ত্ব কী জানিস? আজ যদি ক্লেসিয়াস ক্লে আলি তোকে রাস্তায় পেয়ে এক ঘুষিতেই লম্বা করে দেয় সেটাতে তো তোর লজ্জা পাবার কিছু নেই, কিন্তু তার পর যদি তুই তার দাসত্ব স্বীকার করে নিস, সেখানে লজ্জা। ট্যাঙ্ক-প্লেনের শক্তি দিয়ে কাল যদি পাঞ্জাবি টের পাল পুব বাঙলাকে ছারখার করে দেয় তাতে বাঙাল লজ্জা পাবে কেন? শক্তিশালী হামেশাই দুর্বলকে পরাজিত করে।

কিন্তু তার পর যদি বাঙা পাঞ্জাবির দাসত্ব স্বীকার করে নেয় তবে সেখানে বাঙালের লজ্জা। তুই-আমি বাঙালি আমাদেরও লজ্জা।

.

১৩.

শিপ্রা অভিমানের সুরে বললে, এত দেরি করে এলে? এরই মধ্যে আমাকে অবহেলা?

কীর্তি অবাক। সামলে নিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, রবিঠাকুর ছাড়া দেখছি আমাদের গতি নেই :

তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।

 আমি এসেছি তোমার দেওয়া সময়ের দশ মিনিট আগে এবং অতি ভয়ে ভয়ে। কারণ তোমাকে ঘরসংসার দেখতে হয়, তার ওপর পুরো তদারকি করতে হয় ব্যবসা-সম্পত্তির। এবং সর্বোপরি কয়েকটা চ্যারিটির হিসাবপত্র দেখা। ইজ্যাক্ট টাইমের এক মিনিট পূর্বে এলে হয়তো বারান্দায় মোক্ষম এক ধাক্কা, কোন এক ঝুনঝুনিয়া বা টুনটুনিয়ার সঙ্গে। আর তিনি হন যদি সিস্টার তেরেসা বা ক্লারা তা হলে তো কেলেঙ্কারি ব্যাপার। যাকে বলে, আমি মরমে মরে যাব, তার শরমে শে শে।

শিপ্রা বললে, উপরে চল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললে, চ্যারিটির কাজ যৎসামান্য। আমি নিজে সেসব স্থলে যাই। সিস্টারদের পক্ষে এখানে আসা সহজ নয়। এবং শুনেছি ক্যাথলিক নাদের অন্তত দুজন না হলে রাস্তায় বেরুনো বারণ। সে কথা থাক। আসল কথাটা শোনো। মনে কর কেউ যদি স্থির করে তার সাংসারিক সব অভাব দূর না হওয়া পর্যন্ত কোনও ভিখিরিকে ভিক্ষে দেবে না, কেউ যদি ভাবে বৈষয়িক সব ব্যাপার গোছগাছ না করে বৃন্দাবন যাব না, তা হলে এঁরও আজীবন ভিক্ষে দেওয়া হবে না, ওঁরও কস্মিনকালে তীর্থদর্শন হবে না। প্রত্যেক দানকর্মে থাকে আত্মবিসর্জন, ক্ষতিস্বীকার তা সে যত সামান্যই হোক। এই যে তুমি ক্ষুদ্রতম এটিকেট রক্ষার্থে বন্ধুর সিগারেট আগে ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা পরে ধরাচ্ছ তাতেও আছে পাঁচ সেকেন্ডের সেকরিফাইস।

কীর্তি সোৎসাহে বললে, হা হা, মনে পড়ছে, তুর্গেনিয়েফও বলেছেন, রকফেলারের লক্ষ লক্ষ ডলার দানের কথা যখন মনে আসে তখন আমার হৃদয়ে তার প্রতিদানে কৃতজ্ঞতা, কিন্তু যেদিন দেখলুম, আমাদের গ্রামে আটটি কাচ্চা-বাচ্চার বাপ এক অতি গরিব চাষা একটি অনাথ বাচ্চাকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিল তখন তার স্মরণে আমার মাথা গভীর গভীরতম শ্রদ্ধায় নত হয়। চাষার ভয় ছিল তার বউ সংসার চালাবার জন্য প্রতিটি কোপেক গোনে, সে দারুণ চটে যাবে। সে রান্না করতে করতে শুধু আপন মনে মন্তব্য করেছিল, এখন থেকে আমরা সপ্তাহে যে একটা দিন পরবের রোববারে চিজ খেতুম সেটা ছাড়তে হবে। আমার ঠিক ঠিক মনে নেই

কিছু দরকার নেই এ ঘটনাটির বর্ণনা তুর্গেনিয়েফের ভাষায় দেবার। ছ বছরের বাচ্চাও যদি এটি আধো আধো কথায় প্রকাশ করে তবু তার মূল্য এক কানাকড়ি কমবে না। লক্ষ টাকা দামের ফুলদানিতে একটি গোলাপ রাখো, আর চার আনার কাঁচের গেলাসে রাখো, গোলাপের সৌন্দর্য কি তখন আসমান-জমিন ফারাক হয়ে যাবে?

কিন্তু তোমার উদাহরণ সত্যি ক্লাসিক পর্যায়ের। রকফেলার বিশ লক্ষ ডলার দান করে কী ক্ষতিটা স্বীকার করলেন? ব্যাঙ্কের খাতাতে কয়েকটি শূন্য কাটা পড়ল মাত্র। বস্তৃত তন্মুহুর্তেই তিনি পাইকিরিতে আরও বিশখানা রোলস্ কিনতে পারেন।

তার নিভৃত বুদওয়ারে কীর্তিকে নিয়ে গিয়ে শিপ্রা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল তার ডিভানের উপর। কীর্তিকে বললে, বসো আমার পায়ের কাছটায়– আমি কেষ্টঠাকুর না হলেও তুমি তো অৰ্জুন। তিনি বুদ্ধিমান; ঠাকুরের পায়ের কাছে আসন নিয়েছিলেন। নিছক বিনয়বশত নয়; তার কুটিল স্বার্থ ছিল। আমারও তাই। তোমার মুখ দেখতে পাব বলে।

বলতে বলতে তার খোঁপা খুলে চুলে বিলি দিতে দিতে মাথার পাশের গোটা তিনেক কুশন ঢেকে দিল। কীর্তি লম্বায়, পরিমাণে এরকম রাশি রাশি চুলের স্তূপ আগে দেখেনি। বিস্ময়ে সেটার প্রশংসা করতে ভুলে গিয়ে বলল, তোমার খোঁপা দেখে তো আমার কখনও মনে হয়নি তোমার এত চুল।

কোঁকড়া চুলের ওই একটিমাত্র সুবিধে। কিন্তু আমার বক্তব্য শেষ হয়নি।

নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পূর্বে কিংবা হঠাৎ বিন্-নোটিশে এলে তুমি। তোমাকে তখন বসিয়ে রেখে টাকাকড়ির টানা-হ্যাঁচড়া করব ওই টুনটুনিয়া না ঝুনঝুনিয়ার সঙ্গে ইভন ফাইভ মিনিটস? নো, এ হানড্রেড টাইম নো। তাকে তদ্দণ্ডেই বিদায় দিলে কী হবে। একটা ডিল হয়তো হবে না। ঝুনঝুনিয়াও বিরক্ত হবেন।

ওরে হাবা, শোন, এইটুকু যদি আমি ত্যাগ স্বীকার না করতে পারি তোর সঙ্গ পাবার তরে তবে তোর মূল্যটা কত? ডিলটাতে হয়তো আমার দশ হাজার টাকার মুনাফা হত। তা হলে যে কোনও মুদি তোকে বলতে পারবে তোর দাম নিশ্চয়ই দশ হাজার টাকার চেয়ে কম– এ তো সোজা হিসাব। আর স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের মূল্য কত? মাত্র ত্রিশটি মুদ্রা। অবশ্য তাঁর যে শিষ্য তাকে বেচে দিয়েছিল দুশমনদের কাছে সে ছিল গ্যালিলির জেলে। আজকের দিনেও সেখানে ত্রিশ মুদ্রা পর্বতপ্রমাণ। আর আমার কাছে দশ হাজার কী! ওদিকে দু হাজার বছর ধরে দুনিয়ার দ্র-ইতর সক্কলের কাছ থেকে জুডাস পাচ্ছে অভিসম্পাত। আমাকে দেবে ক-হাজার বছর ধরে ঝুনঝুনিয়ার কাছে তোমাকে বেচে দেওয়ার জন্য।

তার পর আরামসে চোখ বন্ধ করে বললে, ভাগ্যিস, মা কালীর আশীর্বাদে তুমি-আমি কেউই যিশুখ্রিস্ট নই।

এমন সময় কোনও নোটিশ না দিয়ে কীর্তি হঠাৎ মাথা নিচু করে শিপ্রার একটা পায়ে চট করে চুমো খেয়ে অন্য পায়ে মুখ চেপে দিতে লাগল দীর্ঘতর চুম্বন।

ধড়মড়িয়ে শিপ্রা উঠে বসে কীর্তির মাথা চেপে ধরে বললে, ছি ছি! এ তুমি করছ কী?

কীর্তি কোনও উত্তর দিল না। নিরাশ হয়ে শিপ্রা বসে রইল।

অনেকক্ষণ পরে কীর্তির চুল ধরে তার মাথা টেনে তুলল তখন বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ ভাব না দেখিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললে, কেন? পদচুম্বন সমাসটা কি তোমার একেবারে অজানা। মানুষ গুরুর পদচুম্বন করে। কিন্তু আমি তো কখনও কোনও গুরুর কাছে দীক্ষা নেবার মতো পাত্র নই। তুমিই তো আমার গুরু।

বিস্মিত হয়ে শিপ্রা শুধাল, সে কী?

 শোনননি চণ্ডীদাস তাঁর রজকিনীকে গুরু আখ্যা দিয়েছেন তাঁর গীতে?

সে তো তিনি তাঁর সাধনার ক্ষেত্রে রামীকে অনেক রূপেই দেখেছেন, অনেক নামেই ডেকেছেন। তুমি তো অপদার্থ অবশ্য তোমার আত্মাপলব্ধির ভাষায়।

অবাক করলে, গুরু, অপদার্থের তো গুরুর প্রয়োজন সর্বাধিক। খাঁটি সোনাতে কেউ কখনও পরশপাথর ছোঁয়ায় নাকি। আচ্ছা, তর্কস্থানে না হয় গুরুর প্রসঙ্গ বাদই দিলুম। কিন্তু প্রিয়ার পদচুম্বন কি তার প্রসাদলব্ধ জন করে না। তুমি যাকে গুরুদেব বলে প্রায়ই উল্লেখ করে তিনি গেয়েছেন :

অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে—

শিপ্রা বাধা দিয়ে বললে, সে তো তাঁর জীবনদেবতার পদচুম্বন করেছেন তিনি।

রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে কীর্তি বললে, বা রে। এর কয়েক লাইন আগেই তো ওর সঙ্গে তার মহা সাড়ম্বরে, আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক চক্র ততোধিক রেখার জাল এঁকে শুভলগ্ন স্থির করে, শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে পুরোহিত বৃদ্ধ বিপ্রের হাতে ধান্য দূর্বা তীর্থবারি এবং মন্ত্রসহ বিয়ে হল এবং সখীদল ও শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের পর সামাজিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করল।

দোঁহাকার সাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি।

এবং এই যে একটা অভূতপূর্ব, ইতিহাসের সর্ব স্বয়ংবর বিবাহকে আপাদ-মস্তক লজ্জিত বিড়ম্বিত করি পাণিগ্রহণ– আমি এই পাণিগ্রহণ সমাসটির দিকে তোমার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, শিপি– এই পাণিগ্রহণ মহোৎসবটি সমাধান হল এটির নির্যাস, এটির মধুরতম মধুমন্ত্র পাচ্ছি :

অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর।

 বধূ, বধূ, বধূ আবার বলি বঁধু নয়, বধূ।

সেই বধূর পদচুম্বন করেছিলেন আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ যার ভিতর সকল রসের ধারা সর্বদেশ সর্বকাল থেকে বয়ে এসে সম্মিলিত হয়েছিল। দম নিয়ে কীর্তি বলল,

তোমরা যা বল তাই বল, আমার কাছে বধূ যা জীবনদেবতাও তা।

এর পর দেখ, কবিতাটি তোমার আমার অতি কাছে চলে এল। কবিতার সখী পথ দেখিয়ে বরবধূকে বাসরঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানে স্বয়ং তুমি। তার পর পাদপীঠ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ তুমি যদি সে-ভাবে চরণ প্রসারিত করতে তবে আমি ছুটে গিয়ে পাদপীঠ সগ্রহ করে আনতুম না। তুমি যে শয়নে চরণ প্রসারিত করলে। তাই তো আমাকে ওই অবস্থাতেই পদচুম্বন করতে হল।

ইতোমধ্যে শিপ্রা তার দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে কীর্তির কবিতা আবৃত্তি, তার আপন টীকা কিছুটা শুনছিল। কিছুটা আপন মনে ভাবছিল। তার রাশি রাশি চুল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কীর্তি মাত্র দু দিন ধরে দরদি হিয়ার আহ্বান পেয়ে বক্ বক্ করতে শুরু করেছে। কিন্তু অতদিনের নীরব স্বভাব চট করে যায় না বলে চুপ করে শিপ্রার চুলের ভিতর এদিক-ওদিক আঙুল চালাচ্ছে।

হঠাৎ শিপ্রা মাথা তুলে কীর্তির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্বরে বলল, এসব প্রাণের কথা কার না শুনতে ভালো লাগে? কিন্তু, কীর্তি, আমার মন বার বার ঘুরেফিরে ওই পাদপীঠ কথাটির দিকে যাচ্ছে। পাদপীঠ, সোজা বাঙলায় চৌকি, ইংরিজিতে পেডেস্টেল। তোমার হৃদয়ে দু দিনেই আমার যা মূর্তি গড়ে তুলছ তার পাদপীঠটা উঁচু হতে হতে এখন সেটা ময়দানের বিরাট বিরাট মূর্তির দশ হাত উঁচু পাদপীঠ, স্ট্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, না তুমি আরম্ভ করেছ পাদপীঠ দিয়ে। সেটাকে গড়েছ তোমার চেয়ে তিন মাথা উঁচু। তার উপর খাড়া করবে বা বসাবে নিশ্চয়ই কোনও দেবীপ্রতিমা– অন্য কিছু মানাবে কেন? এবং স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছি সে দেবী আমি। নয় কি?

কীর্তি মুগ্ধ হয়ে ভাবছিল, আহা, এই তো শিপ্রা। রবি-কাব্যের কত না অতলে ডুবেছে সে। অথচ প্রয়োজনমতো আমার মতো এমেচারের সঙ্গেও সে কদম কদম মিলিয়ে চলতে পারে। ওই তো তার মহৎ গুণ। পার্টিতে, ব্যবসাতে, বিয়েবাড়িতে সর্বত্র সে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সক্কলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে।

শিপ্রার প্রশ্নের উত্তরে কীর্তি, যেন সমের শেষে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, অবান্তর, অবান্তর এ প্রশ্নটা। প্রশ্নটাই স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ!

হায় রে কীর্তিঠাকুর! তুমি এখনও তোমার শিপ্রা চতুরাকে চিনতে পারনি। সে যেন সন্দেহের ধন্দে দোটানা হয়ে বলল, তোমার ওই কবিতাতেই আছে, বিয়ে বাড়িতে ছিল।

সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ!

বাঙ্গালোরি শাড়ি, বেনারসি ব্লাউজ আর ছেরামপুরি খোঁপা– ওই তো আমার সাজ। এ কি মানাবে সিংগির ঘাড়ের উপর বসলে?

তার চেয়ে ওখানে বসে যদি আমি হীরা-পানা বসানো সোনার চিরুনি দিয়ে কহকিনী মায়াবিনীর মতো চুল আঁচড়াই তবু না হয় ভেঁপো ছোঁড়ারা ওদিকে তাকিয়ে দু একটা রসাল টিপ্পনী কাটবে!

কীর্তির রোমানসে এই পয়লা খোঁচা। এবারে আসছে কু দ্য গ্রাস, ক্লের মোক্ষম মুষ্ট্যাঘাতে রোমান্স-বেলুনের শেষ সর্বনাশ।

অতি গুরুগম্ভীর হাস্যহীন আস্যে শিপ্রা বললে, সবচেয়ে খাসা মানায়, যদি আমি সেখানে কোমরে আঁচল বেঁধে টাটা স্টিলের কড়াইয়ের খাগড়াই কসার খুন্তি দিয়ে তোমার জন্য পুঁইশাকের চচ্চড়ি ঘাটাই।

আহা, যেন একটি সার্থক গবিতা! একটি বাক্যকেই তিন অসমান হিস্যেয় ভাগ করে তিন লাইনে ছাপলেই কোথায় পাউন্ড, কোথায় বন্ধু সমর সেন?

ডাস্টবি-এ পচা ইঁদুর
রিকশায় চীনা গণিকা

 এগুলো মহাকাব্যরূপে স্বীকৃত হয়েছে। এবারে জুড়ে দিলে ময়দানের মিনারশিখরে ইশটিলের কড়াই।

কীর্তি যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। হার মানতে মানতে তবু শেষ বাণ ছাড়ল–

দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।

অতি সোহাগভরে দু হাত দিয়ে কীর্তির মাথা বুকে খুঁজে নিয়ে তার মধুরতম কণ্ঠে বললে– সে কণ্ঠস্বর তার পিতা বড় ভালোবাসতেন– ওরে ক্ষ্যাপা, প্রিয়াকে দেবতা করার জন্য প্রেমিক প্রেমিকা, উভয়েরই শাস্রাধিকার অর্থাৎ প্রেমাধিকার চাই। তোমার কিছুটা আছে বিধিদত্ত- কিন্তু দিনে দিনে সেটা বাড়বে না কমবে সেটাও জানেন একমাত্র বিধিই।

তুমি বার বার বলেছ, তুমি অপদার্থ, তাই তোমার ভিতর আমি কী দেখলুম যে তোমাকে ভালোবাসলুম? উত্তর দিই নি। আজ বলি, ওই প্রেমাধিকার। যাকে আমি নাম দিই ধাতু।

কীর্তি শুধাল, ধাতু? বুঝিয়ে বল।

 শিপ্রা বললে, তোমাকে নির্মাণ করার সময় বিধাতা একটা বিশেষ ধাতুও মিশিয়ে ছিলেন। সেটা আমি চিনতে পেরেছি। এর বেশি বুঝিয়ে বলা যায় না। ওটা বোঝার জিনিস নয়, উপলব্ধির ধাতু। হয়তো নিজেই একদিন উপলব্ধি করতে পারবে। ব্যস! এখন চুপ করো।

.

১৪.

কীর্তিদের ক্লাব-বারের উচ্চ উচ্চ দণ্ডাসনে বসে ডাইনে-বাঁয়ে স্টিয়ার করাটা যারা সব সময় পছন্দ করতেন না, তারা আসন নিতেন ছোট ছোট টেবিলের চতুর্দিকে। আবদার ড্রিংক এনে দিত টেবিলে টেবিলে। আবদার কথাটা ফারসি থেকে এসেছে প্রাচীনতর যুগে, জোর চালু হয় কোম্পানির আমলে এবং ইদানীং মুমূর্ষ। যদিও আব শব্দের অর্থ জল, প্লেন ওয়াটার– যেমন আবহাওয়া ও দার কথাটার অর্থ, যে ধরে, যেমন জিম্মেদার তথাপি রূঢ়ার্থে সে মদ্যাদি তরল দ্রব্যের রক্ষক ও পরিবেশক। ইরান দেশে এই ব্যক্তিই যদি দ্ৰশ্রেণির শিক্ষিত তরুণ বা তরুণী হয় এবং বন্ধু বা বান্ধবীরূপে কাব্যালোচনা, সঙ্গীতাদির দ্বারা বিশেষ একজনকে আপ্যায়িত করে বা আসর জমিয়ে তোলে তবে তার নাম সাকি।

দণ্ডাসীনদের ভিতর কথাবার্তা হয় ছেঁড়া-ছেঁড়া। টেবিলওলাদের ভিতর মাঝে-মিশেলে দু একটি বিষয় নিয়ে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী আলোচনাও হয় কিন্তু আমাদের রক বা পাড়ার চায়ের দোকানে সেখানে প্রাগুক্ত ক্লাবের মতো একে অন্যকে চেনে এবং প্রায় সব খদ্দেরই বেনামি একটা ক্লাবের অনারারি মেম্বার যে রকম তর্কাতর্কির সাইক্লোন টর্নেডো বয়ে যায়, এই খানদানি ক্লাবে সেরকম হয় না। কারণ কেউই কোনও বিষয়ে সিরিয়াসলি নেয় না, কারওরই বিশেষ কোনও মতবাদে দৃঢ়বিশ্বাস নেই। তারা শুধু একটি বিষয়ে অচঞ্চল দৃঢ়মত পোষণ করেন পানের দ্রব্যটি যেন যে লোক যা নিত্যি নিত্যি খায় আজও যেন নির্ভেজাল তাই হয়। এবং যেহেতু সাধারণ মানুষ যদি কোনও বিশেষ একটা জিনিসের প্রতি তার সর্ব চৈতন্য সর্ব ধ্যানে পরিপূর্ণ নিয়োগ করে দেয় তবে সে অন্য সব বাবদে অম্লাধিক উদাসীন হতে বাধ্য– অর্জুন যে রকম পাখির চোখের দিকে তাগ করার সময় শুরু, ভ্রাতা এমনকি বৃক্ষটাকেও দেখতে পাননি। বাইবেলও বলেছেন, দুই প্রভুর সেবা করা যায় না!

আজ কিন্তু তর্কটা জমে উঠেছে। ইয়েহিয়া খান এসেছেন ঢাকায়। শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা আপস করতে। কীর্তি এসে দলে ভিড়ল আলোচনা যখন অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে– বসল তার সুদিনদা ও ইয়ার খানের পাশে। যে সমস্যা নিয়ে বাগবিতণ্ডা হচ্ছে সেটা : ইয়েহিয়া কি সত্যই আওয়ামী লীগের হাতে পুব বাঙলার চোদ্দ আনা কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।

মিত্তির যদিও প্রায় প্রতি রাত্রেই কিঞ্চিৎ বে-এক্তেয়ার হয়ে বাড়ি ফেরে তবু সবাই জানে যে বদ্ধ মাতাল অবস্থায়ও সে যদি কাউকে কোনও কথা দেয় তবে পরের দিন সে কথা তুললে, যদিও সে সে কড়ার বিলকুল স্মরণে না আনতে পারে তবু ক্ষয়ক্ষতির পরোয়া না করে সত্য রক্ষা করবে। অতএব তার দৃষ্টিবিন্দু এক্ষেত্রেও সেই ঐতিহ্যগত। বলল,

তোমরা ভুলে যাচ্ছ ইয়েহিয়া সেপাই, অফিসার। সে পলিটিশিয়ান নয় যে ঘড়ি ঘড়ি ভোল পালটাবে। ইংরেজ জাতটা পলিটিকস করে। আমাদের হোমরুল, অটোনমি, হাফ-স্বরাজ, স্বরাজ দেবার হোলি প্রতিজ্ঞা করে সেটা ভঙ্গ করেছে। কতবার হিসাব নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিক একই সময়ে গোপনে আরবদের কাছে কসম খেল যুদ্ধ শেষে প্যালেস্টাইন ওদের হাতে সঁপে দেবে এবং সঙ্গে সঙ্গে টাকার কুমির মার্কিনদের হুবহু ওই একই প্রতিজ্ঞা করল। যুদ্ধ শেষে চেষ্টা করল, নিজেই সেটা হজম করার। শেষটায় যখন নিতান্তই বদহজমে যায় যায়, তখন আরব আর ইহুদিদের লড়িয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। এবং দুই পক্ষকেই আগুনের দরে আউট অব ডেট পুর্না পুর্না বন্দুক কামান বিক্রি করল। ওদিকে দেখ দ্য গল। সেপাই। রাজ্য চালনার সময় আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষার আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে পদে পদে মার খেয়েছে। ইয়েহিয়াও সেপাই।

সুদিন বললে, ইয়েহিয়া যদি সত্যিকার সেপাই হয় তবে পাক্কা সাড়ে তিনটি মাস ধরে ন্যাজ খেলানো কেন, বাবা? ইলেকশন হয়েছে সেই ডিসেম্বরের প্রথম হপ্তায় আর আজ মার্চের মাঝামাঝি। এখনও ডেট স্থির হয়নি এসেমরি কবে বসবে– বল না শঙ্কর তোর মামা না এসেমব্লিতে কী যেন কোন ডাঙর নোকরি করে এসেমব্লি ডাকতে কতদিন সময় লাগে? আসলে সুদিনের মতলব শঙ্করকে তাতানো। কারণ শঙ্করজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তর্কে সুদিনের বিপক্ষ মত তারস্বরে প্রচার করা। অন্য সর্ব বাবদে হরিহরাত্মা। আজ সব্বাইকে অবাক করে বলল, মেরেকেটে উইদ এ ভেরি লিবরেল মার্জিন– সাত দিন। কিন্তু সে প্রশ্নটা তোলার পূর্বে ভুলে যাচ্ছিস কেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইয়েহিয়া তো মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসেমব্লি সেশন ডিক্লেয়ার করে ফের সেটা নাকচ করে দিল। কী বল, মিত্তিরঃ ইয়েহিয়া না সোলজার।

ইউনুস মির্জা মেদিনীপুর না কোথাকার খাঁটি পাতি। রঙটিও বায়স প্রায়। দেমাক করেন তিনি মোগল না পাঠান কী যেন। বলতে ভালোবাসেন উর্দু- যদিও সেটা তালতলার স্ল্যাং। বেহারের নেটিভ আবদাররা পর্যন্ত সে বত্রিশ ভাজা শুনলে মুখ টিপে হাসে। উড়ে-ঘেঁষা বাংলা শুনলে মারওয়াড়ি ত আপন বাংলার পিঠে হাত চাপড়ায়। যেন মিত্তিরকে নিয়ে মিত্রপক্ষ রচনা করার জন্য অর্থাৎ ইয়েহিয়ার পক্ষ নিয়ে বলল, কিন্তু ইয়েহিয়া যথেষ্ট কারণও দেখিয়েছেন।

কীর্তিসখা খান ফ্যাকচুরিয়াস। কারণ না কচু! লেম একিউজ এবং তার কারণ– ঘোড়াটার চারটে পা-ই আগাপাশতলা লেম।

মিত্তির কী যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু খান বাধা দিয়ে বললে, লীগে-ইয়েহিয়ায় যদি একটা সমঝোতা হয়ে যায় তবে তো ল্যাঠা চুকে গেল। সে নিয়ে তর্কাতর্কি হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতো বিলকুল বেকার। আর যদি না হয় এবং ফলে পুব বাঙলা বিদ্রোহ করে– লীগ কুল্লে দেশের ভোট পেয়েছে তাই বিদ্রোহটা হবে তামাম দেশজুড়ে আর স্বভাবতই ইয়েহিয়া চালাবে খুন-খারাবির দমননীতি। তখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণজন আর ভারত সরকার রি-অ্যাক্ট করবে কীভাবে?

শঙ্কর তার পূর্বমত কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে চিন্তিত চিত্তে বললে, পাঞ্জাবি পাঠান সেপাইরা তাদের প্রতিবেশী, জাত-ভাই কাশ্মিরি মুসলমানদের সাহায্য দেবার নামে এসে তাদের ঘরবাড়ি কীরকম লুটপাট করেছিল সেটা অন্তত আমার অজানা নয়। আর এই বহুদূরের বাঙালদেশে তারা নরম চামড়ার দস্তানা পরে পিউনিটিভ অ্যাকশন নেবে, সেটা দুরাশা।

মির্জা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, যা-ই করুক না কেন, ওটা তো পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার।

খান তো রেগে টং। ঘরোয়া ব্যাপার! আসা ডিপ্লোমেটিক ভাষা। যেটা ডাহা সত্য বিকৃতির ভদ্র বা ভণ্ড নাম। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মেলা নিকট আত্মীয় রয়েছে পুব বাঙলায়, আর এখানে যেসব হিন্দু রেফুজি পুব বাঙলা থেকে এসেছে তাদের সে দেশে মা-ভাই রয়েছে ঢের ঢের বেশি। তাদের গায়ে বুঝি রক্ত নেই। তাদের বেলা এটা শব্দার্থে সত্যার্থে ঘরোয়া ব্যাপার। তোমার বেলা ওটা ডাহা নির্জলা ফন্দি–মানুষ মারার অজুহাত।

সুদিন বললে, ফ্রান্স-জর্মনির লড়াই ছিল ওদের দুজনার ঘরোয়া ব্যাপার। তবে কেন শতাধিক বৎসরের নিরপেক্ষ সুইটজারল্যান্ড হিটলারলাঞ্ছিত কি ইহুদি, কি জর্মন পলাতক সবাইকে আশ্রয় দিল? এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বে-আইনিভাবে। এদের প্রায় কারওরই সরকারি পাসপোর্ট, সুইস ভিসা ছিল না।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উচিত যে সুইস ফ্রন্টিয়ারে সে-দেশে ঢোকার সময় যে ধরা পড়েছে তাকে ধাক্কা মেরে যে দেশ থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সে দেশের পুলিশের হাতে সমর্পণ করা। অর্থাৎ পলাতক পুত্রকে ফের ডাইনির হাতে সমর্পণ করা। ওরা সবাই ছিল জর্মন সিটিজেন। হিটলার তাদের নিয়ে কী করবে, না করবে, সেটা তার নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। তবে সুইটজারল্যান্ডের মতো দ্র দেশ, ভদ্রতর সরকার দিনের পর দিন এরকম বেআইনি কর্ম করে ওদের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল কেন? তদুপরি সুইস সরকার বেশ জানত, হিটলার যখন হল্যান্ড, বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা চুক্তি উপেক্ষা করে দুটো দেশ দখল করে বসে আছে তখন প্রয়োজন বোধ হলে কিংবা নিতান্তই খামখেয়ালির ঝোঁকে সুইটজারল্যান্ডকেও আক্রমণ করতে পারে। বেআইনিভাবে পলাতক জর্মনদের আশ্রয় দেবার বিগলিতাৰ্থ : সুইটজারল্যান্ড আক্রমণ বাবদে অর্ধসুপ্ত ম্যান-ইটার হিটলার বাঘার ন্যাজ ধরে হ্যাঁচকা টান মারা।

সোমেন চাটুয্যে বললে, অত সাত সুমুদ্র পাড়ি দিচ্ছ কেন বাওয়া? ওই যে তোমার পুব পাকিস্তান থেকে তেইশটি বচ্ছর ধরে কখনও বানের জলের মতো হুড়মুড়িয়ে, কখনও ঢেউয়ে ঢেউয়ে, আর ছিটেফোঁটায় তো অহরহ রেফুজি আসছে, তাদের ঢুকতে দিচ্ছ কোন আইনে। ওহে মির্জা সাহেব, ওদের ঠেলায় তোমার-আমার প্রাণ যায়। তুমি, দাদা, যাও না বর্ডারে। তোমার গভীরতম পলিটিকাল ডকট্রিন ঘরোয়া ব্যাপারটা প্রিচ করো না ওদের সামনে সবিস্তর সালঙ্কার। একটি কাজের মতো কাজ হয়।

শঙ্কর বলল, ছিঃ চাটুয্যে! মির্জা সাহেব উচ্চাঙ্গের সমাজসেবক এবং ভারতপ্রেমী। তাঁর অকাল মৃত্যু কামনা করাটা কি ব্রাহ্মণসন্তানের পক্ষে গৌরবের বিষয়!

এমন সময় বেয়ারা মিস্টার মির্জার হাতে একখানা ভিজিটিং কার্ড এনে দিল। সেটার উপর চোখ প্রায় না বুলিয়েই মির্জা সক্কলের দিকে চোখের দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে বললে, জেন্টলমেন, আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু লক্ষ্ণৌ থেকে এসেছেন। আপনারা যদি সদয় অনুমতি দেন তবে তাকে এখানে নিয়ে আসি, নইলে অন্য টেবিলে

তার সেই বিগলিত অনুরোধ শেষ হবার পূর্বেই সমস্বরে কোরাস গান উঠল :

নিশ্চয়, নিশ্চয়
সানন্দে, সানন্দে
মেহেরবানি কিজিয়ে,
সার্টেনলি, সার্টেনলি (কোরাস)

 ক্লাবটা ইন্টারন্যাশনাল, মেম্বাররা কসমোপলিটান। এ হেন অভ্যর্থনা সাতিশয় স্বাভাবিক। গ্রাম্য কবির আপ্তবাক্য এই ফ্যাশন-ক্লাবে বেশভূষোয় ঠিক ফিট করবে না কিন্তু ভিতরের রস একই। শহুরে শ্যাম্পেন আর গাঁইয়া তাড়ির ধর্ম এক, বর্ণ ভিন্ন :

যে রসে মগন
তাহাতে তখন
হোক না কুজন
হল মহাজন।

 শুধু খান আর কীর্তি উদ্বাহু হয়ে পাঞ্চজন্য আমন্ত্রণে যোগ দিল না।

মির্জা সেটা বোধহয় লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু তাতেই-বা কী? ওভারহুয়েলমিং মেজরিটি তাঁর পক্ষে। যদিও জানা কথা, আজ স্পষ্টতর হল যে আওয়ামী লীগের থান্ডারিং মেজরিটির চেয়ে ঢের ঢের বেশি কবুল করেন ভুট্টোর হুইসপারিং মাইনরিটিকে।

চাটুয্যে ফিসফিসিয়ে খানের কানে কানে বললে, ব্যাটার হাড়কিপটেমি তার লোমে লোমে খাটাশের দুর্গন্ধ ছাড়ে। কখনও কোনও বন্ধুজনকে সঙ্গে আনতে দেখেছিস? তার সামনে চিচিং ফাঁক হয়ে যাবে যে। আজ শালাকে দু তিন রোদ খাওয়াতে হবে অন্তত। বেটা উড়ে স্নবস্য সুব। ওদিকে দোস্তটি খানদানি লখনওয়ি মনিষ্যি। জাতে ওঠবার তরে কোন না তিন পাত্তর খাওয়াবে? তুই অত মুখ গুমড়ো করেছিলি কেন রে, উল্লুক?

দ্যাখ, ও ব্যাটার দেওয়া শ্যামপেন আমার কাছে বিষ্ঠে। সত্যি বলতে কি, আল্লার কুদরতে ওই মির্জা সম্বন্ধী যদি কোনওদিন দরাজদিল হয়ে যায়, তবে তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আর্সেনিক খেয়ে মরতে রাজি আছি আমি একশো বার।

তুই বড্ড সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস। আর আজকের এই পুব বাঙলা নিয়ে ফ্যাশনেবল কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ এরকম সিরিয়াস হয়ে গেলিই-বা কেন? এই দ্যাখ না তোর এক লেঙোটার ইয়ার শ্রীমান কীর্তিকে। চাঁদপারা মুখ করে কখনও কান দিল, কখনও দিল না।

কীর্তি উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে এমন এক বিশেষ স্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হল যেখানে রাজাও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না, লক্ষ মোটরের মালিক ফোর্ডকেও পায়ে হেঁটে যেতে হয়।

টয়লেট থেকে ফেরার সময় বারের পাশে আসতেই বেয়াত্রিচের চোখে চোখ পড়ল। ইঙ্গিতটা অস্পষ্টতমের চেয়েও এক বাও নিচে। তবু কীর্তি বারের সর্বশেষ দণ্ডাসনে বসতেই বেয়াত্রিচে কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে, মনামি।

ডিউটির সময় খাওয়াটা আমার পছন্দ নয়। তবু তোমার সম্মানে। কিন্তু দুটো ড্রিংকই অন মি।

আস্তে বল। নইলে বার-এর বোতলগুলো হাসতে হাসতে ফেটে পড়বে। একে তুমি লেডি, তদুপরি অবিবাহিতা লেডি। তোমার আপন কেতাদুরস্ত দেশে কখনও কোনও সিরিনা নোংরা লিরা হাতে তুলে একটা হুনোর জন্য পে করে?

না, কিন্তু আমি তোমার বন্ধু, সেইটেই আমার পরিচয় নম্বর এক। সিন্নোরা না সিস্লোরিনা– সেটাকে ঘোড়ার রেসে বলে অলসো র‍্যান–মানে থার্ড প্লেসও পায়নি। এবারে মন দিয়ে শোনো। এখন ঘাড় ফিরিয়ে ডান দিকে তাকিয়ো না। পরে এক ঝলকে দেখে নিয়ে, কিন্তু ভালো করে চিনে নিয়ো। তোমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসে ওই যে রামছাগল মির্জাটা, তার পাশে বসেছে তার এক ইয়ার-জান্ দিলের ইয়ার–একটা শয়তান ছাগল।

কেন যে তোমাকে বলছি, জানিনে। না, জানি।

তোমরা পাচো ইয়ারে বার-এর টেবিলের পাশে বসে কত না আজেবাজে কথা বল কে বা শোনে কে বা দ্যায় কান? কালেকস্মিনে অবশ্যি দু একটা সিরিয়াস আলোচনা করো বটে, কিন্তু কেউই সিরিয়াসলি ওসব গায়ে মাখো না। তোমাদের আলোচনা পিন টু এলিফেন্ট।

তিন দিন ধরে দেখছি, ওই মির্জেটা রোজ রোজ আসছে, সাঁঝের পয়লা ঝেকেই। রোজই কানে আসছে পুব পাকিস্তান নিয়ে আলোচনা এবং রীতিমতো সিরিয়াস। তিন দিন ধরে। কেমন যেন খটকা লাগল। কাল সন্ধ্যায় লক্ষ করলুম, তোমাদের অভ্যাসমতো এক ব্যাপার থেকে অন্য ঘটনায় তোমাদের কথাবার্তা চলে গেলে ওই মির্জেটা আবার সন্তর্পণে আলোচনাটার মোড় ফেরায় পাকিস্তানের দিকে। আমি তো বার-এর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অবধি চৌকিদারি করি, সব কথা কানে যায় না, তবু আমার মনে হল মির্জা যত না নিজের কথা কয়, তার চেয়ে প্রশ্ন শুধিয়ে শুধিয়ে সব্বাইকে ওসকায়।

কীর্তি অবিশ্বাসের সুরে কিন্তু দরদি গলায় বলল, ওসব তোমার কল্পনা, বেয়াত্রিচে ডার্লিং।

বেয়াত্রিচে বললে, কাল বেলা তিনটে অবধি তোমার মন্তব্যটা মেনে নিতে আমার বিশেষ আপত্তি হত না।

কাল বেলা তিনটেয় মির্জা বারে এলেন ওই ইয়ারকে নিয়ে। বার তখন শূন্য, আমিও দুপুরের মিনি নিদ্রায় এক কোণে টুলছি। ওই দূরের কোণটায় বারের উঁচু টুলে বসে নিচু গলায় গুজুর গুজুর আরম্ভ করলেন, মির্জা কখনও ভাঙা ভাঙা উর্দু বলে সে উর্দু আমাদের এলিয়েট রোডের যমজ– ওটা আমার সড়গড়। কখনও বলে ইংরেজি– সেটা বুঝতে আমাকে বেগ পেতে হয় অবশ্য। কিন্তু সেইটে আসল কথা নয়। আসল কথা ওরা ভেবেছে আমি অতদূর থেকে তাদের কথা শুনতে পাব না, বুঝতে পারব না। আর আমি তো সামান্য বারু-মেড়। বুওনো দিও–গুড় লর্ড তোমাদের চোখের একটি চুলের কাঁপন থেকে একশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, কেউ এখন কন্যাকের বদলে উইস্কি চায়, কে একটা নোভালজিনের বড়ি চায়। আর দশ হাত দূরের থেকে ওদের ঠোঁটের করতাল বাজানো থেকে বুঝতে পারব না, ওদের খুলির ভিতর কী সব বদামি আবজাব করছে? জানো, শার্লক হোমস অন্ধকারে বেড়ালের চেয়ে দেখত বেশি!

সর্বক্ষণ তারা কথা কইছিল পুব আর পশ্চিম বাঙলার বাঙালিদের নিয়ে। দোস্তকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল মির্জা উভয় বাঙলার বাঙালিদের মধ্যে কোনও দোস্তি নেই। বলল, জানেন না, ১৯৬৫-র লড়াইয়ের সময় যেসব পাঞ্জাবি পাঠান সেপাই বর্ডারে পাহারা দিচ্ছিল তাদের দিন কেটেছে বাদশাহি খানা খেয়ে, নবাবের হালে। গায়ের বাঙালি মেয়েরা বিরিয়ানি কোর্মা বেঁধেছে আর পুরুষগুলো বাঁকে করে সেগুলো ডেগ-ডেগচিতে নাকে নাকে ভরে নিয়ে গিয়েছে ওদের কাছে, আর–

হঠাৎ থেমে গিয়ে বেয়াত্রিচে বললে, বাকিটা এখন না। আমার মনে হল ওই বিদেশি ঘুঘুটি আমার দিকে একবার আড়নয়নে তাকাল যেন। তুমি এখন একটা চোটা পেগ পরিমাণ হেসে আমার গালে একটি মিষ্টিমধুর ঠোনা মারো। ভাবটা, যেন আমার সঙ্গে প্রেমালাপ করছিলে।

কীর্তি কিন্তু অকৃত্রিম হাসি হেসেই ঠোনা মেরে বললে, দান্তে তো তাঁর প্রিয়া বেয়াত্রিচের সঙ্গে কদাপি রসালাপ করেনি।

দণ্ডাবতরণ করে চলেছে মৃদুপদে কীর্তি পার্টির দিকে। বিদেশি ঘুঘুকে যেন শুনিয়ে দিয়ে একটুখানি উঁচু গলায় বললে, টেক কেয়ার! খান চটবে।

কীর্তি ঘাড়টা একটু পেছনবাগে বেঁকিয়ে আরেক গাল হেসে বলল, ও আমার আন্ডার স্টাডি।

তোমার হাফ ড্রিংকটা পাঠিয়ে দিচ্ছি! বাব্বা! রসে টইটম্বুর। প্রেমের বন্যা যেন। পেটে আর এক ফোঁটাও ধরবে না।

কীর্তি চেয়ারে বসতে না বসতে শুনতে পেল বিদেশি ইয়ার যেন যৎসামান্য ব্যঙ্গের সুরে টিপ্পনী কেটে বললেন, কোনও কোনও বার-এর ভিতরে-বাইরে দু দিকেই স্বরাজ। বন্দোবস্ত আচ্ছা হ্যায়।

সুদিন বেশ কঠিন গলায় বললে, সিন্‌রিনা বেয়াত্রিচের পরিবার বহু ক্লাবের বহু মেম্বারের চেয়ে প্রাচীনতর। আমাদের কলকাত্তাই কায়দা শিখতে অনেকেরই সময় লাগে, মিস্টার লারি।

মির্জার মুখ একটু বেগুনি হল। যদিও তার চামড়াটা গণ্ডারের বাটা কোম্পানি কিনতে চেয়েছিল দক্ষিণ মেরু অভিযানের বুট বানাবার তরে।

লারি কিন্তু সত্যই বেয়াত্রিচের ঘুঘুবর। যেন বিরাট প্রশংসা শুনে আনন্দের হাসিতে খান খান।

ইতোমধ্যে মির্জা দাঁড়িয়ে উঠে কীর্তির সঙ্গে লারির পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, ইনি আমাদের চৌধুরী কীর্তি সাহেব, আর ইনি মি. লারি।

মি. লারি যে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়েছেন সেটা না-দেখার ভাব। ভান করে কীর্তি ওর দিকে ভালো করে না তাকিয়ে ছোটাসে ছোটা একটা নমস্কার বলে ঝপ করে বসে পড়ল।

চাটুয্যে গুনগুন করে খানকে শুনিয়ে বললে, ব্যাটাচ্ছেলে মির্জাটা অ্যাদ্দিন ধরে আমাদের সঙ্গে ওঠবস করছে অথচ এটিকেটের এ অক্ষরটিও তার রপ্ত হল না। পরিচয় করিয়ে দেবার সময় কার নাম আগে আর কার নাম পরে বলতে হয় অ্যাটুকুন হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান হল না।

চাটুয্যের জ্যাঠামশাই তাঁর কচ্ছপের খোল ড্রেস শার্ট বিলেত থেকে স্টার্চ করিয়ে আনতেন, আর আইনের বই বাঁধিয়ে আনাতেন প্যারিস থেকে। চাটুয্যের মামা রসাল ঘোষালকুল যে পরিবারের গুরু তাঁরই একজন ইন্ডিয়ার প্রথম লর্ড। কায়দাকেতায় কেতাদুরস্ত।

কীর্তি দরদি কণ্ঠে বললে, মি. মির্জা, আমার নাম কীর্তি চৌধুরী। পাঞ্জাবি মহাখানদানিদের মতো চৌধুরী কীর্তি নই। আমি অতিশয় সাদামাটা বাঙালি– আল্লাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মি. লারি বড়ই অমায়িক ব্যক্তি। মৃদুহাস্যে শুধোলেন, পাঞ্জাবি হতে কি আপনার ঘোরতর আপত্তি?

কীর্তি বুড়বকের মতো মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, পাঞ্জাবি পাঞ্জাব পঞ্চ + আব– পাঁচ রকমের জল। ওরে বাবা!

লারি কীর্তির চেয়ে অধিক বুড়বকের মতো প্রশ্নভরা মুখে এর-ওর দিকে তাকালেন।

আমাদের ক্লাব-মেম্বার চাটুয্যেরই পূর্বপুরুষগণ অম্মদেশীয় শাস্ত্ররাজির ভূরি ভূরি টীকাটিপ্পনী রচনা করে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। বক্ষ্যমাণ চাটুয্যের কাছে সংস্কৃত গোমাংস রাহমাংসবং বলা চলে না, কারণ উভয় মাংসেই তার ঔদরিক নীতি উদার, তবে সেটাকে সে মহামাংস অর্থাৎ মানুষের মাংস হিসেবে গণ্য করে। তাই এস্থলে টীকাকারের রক্ত কার গায়ে তার চেয়ে বেশি।

লারির দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জ্ঞানদান করে বললে, শব্দার্থে অর্থহীন, ভাবার্থে মহা মূল্যবান। পাঁচ ঘাটের জল খাইনে এ-ইডিয়ামের অর্থ আমি যত্রতত্র সর্বত্র থেকে আমার পানীয় সঞ্চয় করিনে। আমার রুচি আছে। অর্থাৎ কীর্তিবাবু ফেসটিডিয়াস, বাছেন, চুস্ করেন, অর্থাৎ ভেরি choosy।

লারিকে ঘায়েল করা কঠিন কর্ম।

বললেন, বাঙালি আর্যের পূর্বপুরুষ তো পাঞ্জাব থেকে এসেছেন। তারা তো পাঞ্জাবি।

অতিশয় মৃদুকণ্ঠে সুদিন বলল, এবং তাদের পূর্বপুরুষ বাঁদর- ডারউইন বলেছে। বলেই একটি কৃত্রিম হাই চাপতে চাপতে বললে, ভেরি সরি, মিস্টার লারি। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত, গুড নাইট। সকলের দিকে তাকিয়ে আরেকটা হাই চেপে, আরেকটা গুড নাইট হেঁকে বারের দিকে চলল।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। লারি আর মির্জা ছাড়া।

কীর্তি মনে মনে বললে, বেয়াত্রিচের সন্দটা বোধ হয় ঠিক। বাবুদের সব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি বলে সভা ভঙ্গে ক্ষুণ্ণমনা।

তার সঙ্গে চলল মাদ্রাজি রঙ্গনাথন। সমস্ত সন্ধ্যা মুখ খোলেনি।

কীর্তি তাকে শুধাল, তুমি আর লারি যখন একসঙ্গে টয়লেট যাচ্ছিলে তখন আসতে-যেতে কী গুজুর গুজুর করছিলে?

বলছিল, পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তান অভিন্ন অচ্ছেদ্য রাষ্ট্র। এক রাষ্ট্রাংশ যদি কেটে পড়ে তবে দ্রাবিড়রা যে উত্তর ভারত থেকে কেটে পড়তে চায় সে আন্দোলন কি বলবান হবে না? সেপারেটিস মুভমেন্ট আরও আবোল-তাবোল কী সব। সে মুভমেন্ট ভারতকে দুর্বল করে দেবে। পুব বাংলার আন্দোলন দৃষ্টান্ত হয়ে, অপরোক্ষে ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। সদানন্দ, সদানীরব রঙ্গনাথন শেষটায় বলল, নোজি চ্যাপ, শুক অঁক করছে সর্বক্ষণ! বেরুবার সময় বেয়ারা কীর্তির হাতে একখানা চিরকুট দিল। তাতে লেখা :

ডার্লিং কে,
কাল আমার অফ ডে। পাঁচটায় খানের ওখানে যাব। তুমি আসতে পারবে? বাকি সব-কথা ওর সামনে হবে।
—তোমার
বি।

.

১৫.

শিপ্রা ব্যালকনির উপর অর্ধশায়িত অবস্থায় তাকিয়ে আছে পার্কের সবুজ ঘাসের দিকে। এ সময়টায় কলকাতার ঘাস তার সবুজিমা অনেকখানি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু যে জন অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানে, অল্পের ভিতর বৃহতের সন্ধান পায় সে যৎসামান্য উপাদান থেকে তার রসের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে পারে। কলকাতায় থাকার মধ্যে আছে কী? নিচে ঘাস, উপরে আকাশ। রসগ্রাহীর কাছে দুটোই সজীব। ঘাস তার রঙ বদলায় ঋতুতে ঋতুতে। গ্রীষ্মের প্রতাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ পরী তার ডানা দুটির উপর যে ক্রিম আপন হাতে তৈরি করে মাখেন তাতে নীলের পরিমাণ দিতে থাকেন কম– রঙ প্রতিদিন হলদের দিকে চলতে থাকে।

এমন সময় হঠাৎ হয়তো একদিন অকাল বৃষ্টি হল। সঙ্গে সঙ্গে পরের দিনের সার্থক করার কথা স্মরণে ক্রিমে নীলের মেকদার বাড়িয়ে দেন।

কিন্তু যে জন প্রতিদিন ওই ঘাসের দিকে না তাকায়, সবুজের ধ্যানে অন্তত ক্ষণতরে নিমগ্ন না হয় সে এই প্রাণবন্ত পরিবর্তনের রস থেকে হয় বঞ্চিত। শিপ্রা যবে থেকে প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে সেই থেকে সে এ রস চেখে আসছে। বিলেতে দুটো শীতকালে যখন মাঠ-বাট বরফে ঢেকে শ্বেতে শ্বেতে শ্বেতময়, তখন সে সেটার সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় কিন্তু কলকাতার সে সময়কার হলদে-ঘেঁষা সবুজ ঘাসের বিরহ-বেদনা অনুভব করেছে।

কলকাতার আকাশ অতিশয় সজীব। তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় কৈশোরে– যখন জ্বর-সর্দির ভয় কম ছাতে শুয়ে। শহরের প্রদীপ যেমন যেমন নিভতে থাকে লাজুক আকাশবধূ তারই সঙ্গে সঙ্গে তারার মালা, অলঙ্কার একটির পর একটি পরতে থাকেন। হয়তো সে ঋতুতে প্রথমেই দেখতে পাবেন কেসিয়োপিয়া, কৃত্তিকা সাতভাই চম্পা কিংবা হয়তো বধূ প্রথমেই পরবেন কালপুরুষের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রমণিটি, তার পরই সপ্তর্ষি। চক্ষু যদি নিদ্রাহীন হয় তবে স্পষ্ট দেখতে পাবেন অরুন্ধতী, তার স্বামী বশিষ্ঠের পাশে বসে ক্ষণতম মৃদুহাস্য করছেন মিটমিটিয়ে। হয়তো সে রাত্রে আকাশে তার রঙ বদলাতে বদলাতে পরে নেবেন তার মেখলা, নীবিবন্ধ আকাশ-গঙ্গা দিয়ে, দিগ্বলয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তজুড়ে। সেই কটিবন্ধ থেকে ঝুলবে কত না অত্যুজ্জ্বল ক্ষীণ-জ্যোতি, মধ্যজ্যোতির মণিমাণিক্য। আর অভিসারিকার গতিবেগ এতই মৃদুমন্দ যে সেটা চোখেই পড়ে না। হঠাৎ দেখতে পাবেন পশ্চিমাকাশের একটি গয়না নেই– তার বদলে পূর্বাকাশে আর একটি উজ্জ্বলতর মণির স্তবক।

মর্ত্যের কোন রাজ-রাজ্যেশ্বরী অভিসারে যেতে যেতে এই ইন্দ্রপুরীর মণির মতো ক্ষণে ক্ষণে অলঙ্কার পরিবর্তন করতে পেরেছেন।

কিন্তু হায়, এ বধূ রাত্রিশেষে হয়ে যাবে বিধবা। উষস দেবীর আশীর্বাদ তার তরে নয়। তার আগমনের আভাস পাওয়ামাত্রই বধু সর্ব অলঙ্কার ধীরে ধীরে বর্জন করেন। সর্বশেষে সর্বোল শুকতারা মণিটি।

শিপ্রা এ সৌন্দর্য উপভোগ করেছে বহুবার। আর সব বিষয়ে সে ইংরেজের মতো কাঁটায় কাঁটায় চলে। নিত্যদিনের রুটিন কাজকর্মে কোনও কামাই দেয় না। শুধু ডাইরি লেখার বেলায় সে আর সর্ব বাঙালির মতো গাফিলিতে পরিপক। সেই অনিয়মের ডাইরিতে, যেখানে শূন্যতারই রাজত্ব বেশি– লেখা-পাতার ওয়েসিস সামান্য। সে কটির অধিকাংশে আছে আকাশের অভিসার যাত্রা।

হঠাৎ শিপ্রার মনে নতুন ভাবোদয় হল, হৃদয়-মনের এই নবজাতক, এর কথা ডাইরিতে বলতে হবে।

ইতোমধ্যে অকালবৃষ্টি নেমে শিপ্রার পায়ের উপর সে রাতের এবং প্রতি রাতের কীর্তির মতো চুমো খেতে লাগল। শিপ্রা চোখদুটি বন্ধ করল– আহ! পা সরাল না।

আর কীই-বা দরকার! সে নেপালিশ ব্যবহার করে না। আলতা মাখে কালেভদ্রে– নিতান্ত বুড়ি নাপতেনিটাকে নিরাশ না করার জন্য।

.

যেখানে মানুষ জানে, তার প্রিয়জন আসবেই আসবে, ঠিক সময়েই আসবে, এমনকি তার কিছু পূর্বেও আসতে পারে, সেখানে প্রতীক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত মধুময়। কিন্তু যে স্থলে স্থিরতা থাকে না, আসবে কি আসবে না, সেখানে সন্দেহের দোলা হৃদয়-মন অশান্ত বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই আরবি প্রবাদ বলে, আল-ইন্তিজারু আশাদু মিনাল মউৎ– মৃত্যুর চেয়েও অধিক শক্তি ধারণ করে প্রতীক্ষা। কিন্তু মৃত্যু বা প্রতীক্ষা শিপ্রা-হৃদয়ের চেয়ে বলবান নয়।

দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজল। বুকটা ধক করে উঠল শিপ্রার। এ তো অসম্ভব। কীর্তি এখনও এল না!

মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। আশ্চর্য!

কিন্তু ওই তো হেডলাইটের জোর আলো গেটের উপরে পড়েছে। ছুটে গিয়ে গেট খুলে দেয় না কেন? দারওয়ানটা অতি নিষ্কর্মা। বৃথা পাঁচ মিনিটের ওপর অযথা আরও আধ মিনিট। নাঃ! ঐত্তো।

শিপ্রা ব্যালকনি ছেড়ে সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়াল।

স্বভাবতই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে যে-উপরে দাঁড়িয়েছে তার পায়ের দিকে চোখ পড়ে। কীর্তি চেঁচিয়ে বললে, এ কী? তোমার পা ভেজা, শাড়ির অনেকখানি ভেজা। যাও, যাও। এখুনি পা মুছে ফেল–না আমি ভালো করে আচ্ছাসে রগড়ে রগড়ে বোন্ড্রাই করে দেব?

শিপ্রা শান্ত কণ্ঠে বললে, তুমি যখন রয়েছ—

বুদওয়ারে ঢুকে শিপ্রা ডিভানে বসে পা-দুটি প্রসারিত করল। বললে, বাথরুমে বড় টাওয়েল আছে।

সঙ্গে সঙ্গে দেখ তো না দেখ তো কীর্তি গেল আর এল।

পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললে, যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই। পেয়েছি একটি জলচৌকি– এই নাও। সেই মধুর চিন্ময় কবিতাটিকে এবারে সশ এ করা যাবে, এই সেই পাদপীঠ।

পাদপীঠ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ।

কিন্তু কাপড় ছাড়ো, আগে কাপড় ছাড়ো। নইলে পা যে বার বার ভিজে যাবে।

কাপড় ছাড়ি কখন? তুমি যেরকম ক্ষিপ্রবেগে ঢুকলে আর ক্ষিপ্রগতিতে বেরুলে তাতে করে দোরের গোড়ার সঙ্গে তোমার কলিশন লাগল জোর। ফলে ছিটকে এসে পৌঁছলে আরও স্পিট সেকেন্ড পূর্বে। কাপড় ছাড়ি কখন? নিয়ে আসছি শাড়ি কোনটা আনব? এখানেই ছাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের উপর দুষ্ট হাসির আবেশ।

কীর্তির মুখের রঙ একটু বদলাল বোধহয়।

শিপ্রা হাঁটু গেড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললে, তুমি কি ভুলে গেলে, কীতা, মিতা আমি মমারত্রের মতো রদ্দি পাড়ার বদ্ধ পাগল মুক্ত পাগল আর্টিস্টদের পাঁচতলা ছ-তলার উপরকার স্টুডিওতে আনাগোনা করেছি পুরো একটি বছর। ওইসব আকাশ-ছোঁয়া চিলকুঠুরির থেকে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে মুক্ত প্রকৃতি, নগ্ন আকাশ। কুঠুরির ভিতরেও তাই। তারা প্রকৃতাবস্থায় প্রকৃতিদত্ত রূপে কেউ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছে, কেউ পড়ি পড়ি সোফাটার উপর অঘোরে ঘুমুচ্ছে, কেউ এক কোণে কফি বানাচ্ছে। আমি যে শেষ পর্যন্ত অপ্রকৃতাবস্থায়ই রয়ে গেলুম তার একমাত্র কারণ, মডেল হয়ে পোজ দিতে গিয়ে ওরা সর্বপ্রথম ন্যুড হয়। দি রেস্ট ফলোজ। আমি কখনও পোজ দিইনি।… আচ্ছা কোন শাড়িটা পরে আসব।

তন্মুহূর্তেই অচিন্ত্য উত্তর সেই জরি পাড়ের নীলাম্বরী?

 শিপ্রা চিন্তার ভান করে বললে, সেটা তো ভেজা নয়।

???

শিপ্রা বললে, ওহো, তুমি তো পদাবলী রসের সোয়াদ জানো না, তবু তোমার সহজিয়া রসানুসন্ধানবৃত্তি তোমাকে ঠিক পথেই নিয়ে গিয়েছে। বুঝিয়ে বলি : আমি যদি নীলাম্বরীই পরি, তবে তার মূল রসটি অপূর্ণ থাকবে কেন। সে শাড়ি ভেজা না হলে তুমি গাইতে শিখবে কী করে,

চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি
পরাণ সহিত মোর

এই আটটি মাত্র শব্দের মাধুর্যবৈভব প্রথম শ্রবণে কে না বিচলিত হয়েছে!

শিপ্রা বৃথা বিনয়াসক্ত নয়। নীলাম্বরী পরে নিয়ে তবু বললে, নীলাম্বরী পরতে হলে যতখানি শ্বেতাম্বরী হতে হয় আমি ততখানি ফর্সা নই।

কীর্তি চোখ বন্ধ করে আটটি শব্দে মেশানো রসের ককটেল চুক চুক করে চাখছে।

ওরে কীর্তিনাশ, বুদ্ধিনাশ, এ আটটি শব্দের রস গ্রহণ করার তরে একটা মানুষের একটা যৌবন যথেষ্ট নয়। ক-বার কটা যৌবন-জ্বালা সইতে হয় কে জানে?

শিপ্রা বললে, মডেল হয়ে পোজ দিইনি, ভেবো না তাই আমি গঙ্গোত্রীর জলে ধোয়া তুলসীপাতাটি।… সেটা বোধহয় তুমি ইতোমধ্যে খানিকটে হৃদয়ঙ্গম করে। ফেলেছ। নইলে আজ তুমি পাকি পাঁচ মিনিট লেটে আসতে না। কিংবা আমি এরই মধ্যে বাসি ফুল।

কীর্তি চুপ করে শুনল। অভিযোগের জবাবে কোনও সাফাই গাইল না। হয়তো ভেবেছে, খুদ কোতোয়ালই যখন জানে তার মগজ গড়া ফরিয়াদ বিলকুল কুটমুট ঝুটা তখন বেকার তাবৎ বাৎ বজ্রসেনের।

শিপ্রা বললে, বেয়াত্রিচে কী জানাল।

অনেক কথা। খান আর আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। এই ঘুঘু লারিটা ইয়েহিয়ার গুপ্তচর। মোটামুটি যে কটা তথ্য জানতে এসেছে তার প্রথম, ইয়েহিয়া-মুজিবে যদি সমঝোতা না হয়, এবং ইয়েহিয়া দমননীতি চালায় তবে পশ্চিম বাঙলার হিন্দু-মুসলমান পুব বাঙলার বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানাবে কি? জানালে কতখানি? নকশালপন্থিদের বন্দুক-বোমা আছে? তারা সেগুলো পুব বাঙলায় পাঠাবে কি? আর কোন কোন রাজনৈতিক দলের অস্ত্রশস্ত্র আছে? পশ্চিম বাংলার জনগণ কিংবা। এবং সরকার ভারত সরকারের ওপর চাপ দেবে কি– পুব বাঙলাকে অল্ আউট সাহায্য দেবার জন্য? দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান মতিগতি কী সে সম্বন্ধে লারি অলরেডি ওকিবহাল। লারি নাকি পি করে মির্জাকে বলেছে, বুদ্র পাল রাজত্ব করে দিল্লিতে। পুব পাকে বিদ্রোহ দেখা দিলে ওই তো তাদের আল্লার পাঠানো বেহেস্তি মোকা– পুব বাঙলাকে পুরো মদত দিয়ে বিদ্রোহ সফল করা, সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে পশ্চিম পাককে চিরতরে দুবলা কমজোর করে দেওয়া। এই সামান্য তত্ত্বটি তারা এখনও সমঝে উঠতে পারেনি। তবে একথাও সত্য, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কল-এর মতো কিছু জঙ্গি আদমি বলছেন, পুব বাঙলার বিদ্রোহ একটুখানি ছড়িয়ে পড়লেই সেখানে বিনা বাক্যব্যয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ো। পুব বাঙলাকে স্বাধীন করে দাও। পশ্চিম পাক প্রান্তে আক্রমণ করবে না। সেখানে ডিফেনসিভ স্ট্র্যাটেজি।

দ্বিতীয় বৃহৎ প্রশ্ন, মির্জার মতো যথেষ্ট বাঙালি মুসলমান পশ্চিম বাঙলায় আছে কি, যারা দিল-জান্ দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিরুদ্ধে জোর প্রপাগান্ডা চালাবে? তারা সন্তর্পণে অর্ধপ্রকাশ্যে হুইসপারিং প্রপাগান্ডা চালাবে তো, যে ভারতের স্বার্থ পুব বাঙলাকে সাহায্য না করা। পুব বাঙলা পাকিস্তান থেকে কেটে পড়লে দক্ষিণ ভারত ঠিক ওই নজির দেখিয়েই উত্তর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কেটে পড়বে।

শিপ্রা চুপ করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সব কথা শুনে যাচ্ছিল। তার মনে পড়ল ফ্রান্সের সেই বুড়ো জেনারেল তার পিতাকে বলেছিলেন, রাজনীতি যখন দেউলে হয়ে যায় তখন সে রাজনীতির উদ্দেশ্য সফল করতে হয় অন্য মাধ্যমে, অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে, অর্থাৎ পুরোপুরি সংগ্রাম চালিয়ে। তার মনে চিন্তা এল, ইয়েহিয়া ঢাকায় যে রাজনীতির চাল চালছে তাতে লীগ কিস্তিমাত হবে না। অতএব দমননীতি অনিবার্য। কীর্তিকে শুধাল, তোমাদের পকেট-ক্লাবে তোমাদের সঙ্গে বসে তো মাত্র একটি মাদ্রাজি রঙ্গনাথন। সে কী বলল?।

কীর্তি উৎসাহিত হয়ে বললে, তুমি সত্যি সত্যি অদ্ভুত একটা সিথ সেনসের মালিক। নানা প্রকারের ইঙ্গিত সত্ত্বেও যখন সদানীরব তামিল সন্তান রাম-গঙ্গা কিছুই বলল না, তখন সে যখন টয়লেট যাচ্ছে তখন লারি তার সঙ্গ নিয়ে তাকে করল ফ্রন্টেল অ্যাটাক কিন্তু ওর জিভের আর্তরাইটিস সারাবে, লারি! আমাকে অবশ্য লারি সম্বন্ধে তার মন্তব্য প্রকাশ করল দুটি শব্দে নোজি পার্কার।

শিপ্রা বললে, তার মানে টিকটিকি বিভীষণ, রঙ্গনাথন সেভেন্থ সেন্স্ ধরে। তোমার সম্বন্ধে তার কী ধারণা জানো? মাস তিনেক পূর্বে আমারই এক পার্টিতে ওর পাশে গিয়ে বসেছি এমন সময় তুমি লন ক্রস করছিলে তখন, অ অল থিংস, বলে কি না, আমি যদি মেয়েছেলে হতুম তবে ওই চ্যাপিটাকে নিশ্চয়ই বিয়ে করতুম।

কীর্তি বললে, শূর্পণখার দেশে মেয়েরাই পুরুষকে তাড়া লাগায়। আর্য রামচন্দ্র, আদিকবি বাল্মীকি এ তত্ত্বটা জানতেন না বলে মেয়েটাকে নির্লজ্জা, বেহায়া ঠাউরে তাকে নিয়ে মশকরা করেছেন। দাঁড়াও, আমি বেয়াত্রিচেকে একবার ফোন করি। আজ তার অফ ডে বটে, বাড়ি ফেরার পথে তবু একবার ঢু মেরে যাবে বলেছিল। আমাদের দুই ইয়েহিয়া-দাসের হালটা কী।

ফরাসি কেতার বেডরুমে রোমানসের মৃদু সুবাস। সেখানে ফোন।

শিপ্রা তাড়াতাড়ি জলচৌকিটা সরাল এ ঘর থেকে। পাতল একখানা ডবল সাইজের শেতল-পাটি, করভুরয়ের ওড়ওলা কুশন– ওগুলো অতটা পিছলোয় না– একপ্রান্তে ছোট্ট শ্বেত পাথরের রেকাবিতে দুটি চাপা ফুল, অন্য প্রান্তে মুরাদাবাদি পানদান। নিজে শুয়ে পড়ল ঠিক মাঝখানে। বাঁ হাতে লম্বা হান্ডিলওলা আভাশেপের মসৃণতম রুপোর হাত-আয়না– ফরাসি স্টাইলের, অন্য হাতে বাজু সোনার পাতে মোড়া হাতির দাঁতের সিলেটি চিরুনি।

কীর্তি ফিরে এক নজরে সব দেখে বললে, আহ! এই তো দিল-আরাম গুলিস্তান, আর তুমি পরী–

নীলবসনা সুন্দরী–

বল কী? ও-বই তো ছেলে-ছোকরারা পড়ে। মেয়েরাও?

অন্তত আমি। আর মনে হচ্ছে, তোমার ওই ভি-দেশি টিকটিকিটি পাঁচকড়ির অরিন্দম না কী যেন নাম–তার শাকরেদি করতে পারেন পাকা চুলে পৌঁছনো অব্দি।

ক্লাবে আমাদের পকেট-ক্লাব কেটে পড়েছে। ওদের সঙ্গ দিচ্ছে একমাত্র খান।

 খান! বল কী?

সে আজই স্থির করেছে, সুপার টিকটিকির পার্ট নিয়ে দুই ঘুঘুকে পাম্প করবে। মুখে জানিনে জানিনে বললেও সে ইসলাম ও তার ইতিহাসের অনেক গভীরে ডুব মেরেছে। সেইটে ভাঙিয়ে বলবে কনফিডেন্স ট্রিকস্টার! তার পর অতিশয় গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে বলল, আজ সন্ধ্যায় কিন্তু বেয়াত্রিচে একটা মারাত্মক খবর দিয়েছে। সে নিজেই নাকি প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারেনি– ঘুঘু যখন মির্জাকে তার মরাল চড়াবার জন্য তাকে বলল, ইয়েহিয়া এসেছে লীগকে স্রেফ ধাপ্পা মারতে। সমঝোতার কথাবার্তার বাহানায় ইয়েহিয়া শুধু সময় নিচ্ছে, পাঞ্জাব-পাঠান সৈন্য আনতে। এবং শুধু তাই নয়, লীগ যদি-বা স্ট্রাটেজি হিসেবে কিংবা মঙ্গলের জন্য ইয়েহিয়ার সর্ব শর্ত মেনে নেয়, তবুও ইয়েহিয়ার জুন্টা স্থির সমস্ত পুব বাংলার ওপর দিয়ে মিলিটারি স্টিমরোলার চালাবে।

তার অর্থ?

সরল। যে পরিমাণে ট্যাঙ্ক, আর্মাড কার আনা হচ্ছে তার থেকে বোঝা যাচ্ছে তামাম দেশটাকে খাকছার করে দেবে। অবশ্য অতখানি সবিস্তার লারি বলেনি। তাই বেয়াত্রিচের মনে ধোকা, সে ঠিক ঠিক শুনতে পেয়েছে কি না, বুঝতে পেরেছে কি না।

শিপ্রা বহুক্ষণ হল আরশি-চিরুনি একপাশে রেখে দিয়ে পুরো মন দিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ গ্রহণ করছিল।

উভয়েই অনেকক্ষণ ধরে আপন আপন মনে চিন্তা করছিল।

শেষটায় শিপ্রা বললে, ওখানে আন্দোলন হলে পশ্চিম বাঙলা নির্লিপ্ত থাকতে পারবে না।তার পর শুধাল, আচ্ছা, বেয়াত্রিচে এ ব্যাপারে অত উৎসাহী আর কৌতূহলী কেন?

ঠিক ওই প্রশ্নটাই আমি ওকে শুধিয়েছিলুম। বললে, সে তার মার কাছে ক্লাস টেন্ অবধি পড়েছিল। তখন তাদের ইতালিয়ান রচনা সঙ্কলনে ছিল মাদসিনির বক্তৃতা স্বাধীনতা সংগ্রামের যুবাদের উদ্দেশে। সেগুলো তার মনে এমনই গভীর দাগ কেটেছে। যে সেই সময় থেকে পৃথিবীর যেখানেই যে জাতই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয় তখনই তার প্রতিটি খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। রাত্রে নাকি আবার মাদসিনির ভাষণ পড়ে তার প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।

খানদানি রক্ত আছে তার শরীরে। ও ক্লাব-বার-এর রানি, কিন্তু তোমাদের বার-এট-লর বারের চেয়ে আভিজাত্যে কোনও অংশে কম নয়।… কিন্তু আজ এ আলোচনা এখানেই থাক। আমাকে চিন্তিত তো করেই, পীড়াও দেয়।

কীর্তি সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল। হঠাৎ পানদানটার দিকে আঙুল তুলে শুধাল, ওই মুরাদাবাদি-তাজমহলটি পেলে কোথায়?

উনি ছিলেন বাবার ঠাকুমার নিত্যসহচরী। তুমি মাঝে মাঝে পান চিবোও বলে তোমার অনারে ওঁকে আলমারির উচ্চাসন থেকে নামিয়ে আমাদের সমাসনে বসিয়েছি।

তুমিও তো ।

সে অতি কালে-কম্মিনে। নেমন্তন্নের ভোজে বড় বেশি ঘি-চর্বি থাকলে মুখটাকে পরিষ্কার করার জন্য। বাড়িতে একা একজনের জন্য পান রে, সুপুরি রে অত বায়নাক্কা সয় কে? হ্যাঁ, আগরতলা যাচ্ছ কবে?

বাইশ কিংবা তেইশে।

 আমাকে ঠিক ঠিক জানিয়ো অন্তত একদিন আগে। তুমি আমাকে পিক আপ করবে, না আমি নিজে সোজা দমদমা যাব। উয়েদার খারাপ হলে কিন্তু আমার গা গুলোয়।

কীর্তি নির্বাক, স্তম্ভিত। সে তার প্রেমনিবেদন ভিন্ন অন্ন সব অনুভূতি– ভয়, বিস্ময় ঘৃণা কোনও অনুভূতিই তার চোখে-মুখে প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ এখন তার বিস্ময় তাকে এমনি অভিভূত করল যে সে বিস্ময় যেন তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল।

শিপ্রা তো লক্ষ করবেই। তবু সহজ সুরে বলল, কেন, কী হল?

কীর্তি সহজ সুরের অন্য দিকপ্রান্তের শেষ সীমানায়। জাত ইডিয়টের মতো চি চি শব্দ করল, তুমি, তুমি যাবে?

শিপ্রা যথেষ্ট সচেতন–কীর্তির মগজে তখন কোন ভূতের নৃত্য আরম্ভ হয়েছে। তবু সুন্দুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করে বললে, বা, রে! তুমি ওটা ধরে নাওনি? অবশ্য তোমার সব ট্রিপে তোমার সঙ্গে সর্বত্র যাব তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এবারের যাত্রায় রয়েছে খান। এরকম হোস্ট কোথায় পাব আমরা? একবার একটা ছোট স্টেশন থেকে গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে এমন সময় ধরা পড়ল হুইস্কির ন্যাজ সোডা ফুরিয়ে গিয়েছে। অমনি হোস্ট খান লম্ফ দিল এলার্ম চেনের দিকে। সবাই চেঁচাল করো কী করো কী? সামনেই সিলেটের সবচেয়ে বড় জংশন কুলাউড়া। ততক্ষণ জল দিয়েই হবে। খান গাড়ি থামাল, চাকরকে ছোটাল স্টেশনে সোডার জন্য। গার্ডের হাতে কশ টাকা জমা দিয়েছিল সে নিয়ে মতভেদ আছে। বলেছিল, এই নাও, জরিমানার পঞ্চাশ টাকা, বাকিটা রইল আরও জরিমানার জন্য। যতক্ষণ না বেয়ারা সোডা নিয়ে ফেরে ততক্ষণের ভিতর তুমি গাড়ি চালালেই ফের চেন টানব। গেস্টদের মধ্যে ছিলেন, আসামের আই. জি একজন ডাঙর সেক্রেটারি, ল অ্যান্ড অর্ডারের হর্তাকর্তা। এরা গার্ডকে মুখ দেখান কী করে? সবাই নাকি উল্টো দিকের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে মুখ ঢেকে ছিলেন।

হঠাৎ শিপ্রা টানটান সোজা হয়ে বসে স্থির দৃষ্টিতে কীর্তির দিকে তাকিয়ে এবারে যেন–ইংরেজিতে যাকে বলে থিক অব দি ব্যাটল, বিরাট রণক্ষেত্রের যে অংশে লড়াই চলছে প্রচণ্ডতম প্রতিযোগিতায় এবং ওইখানেই খুব সম্ভব জয়-পরাজয়ের মীমাংসা হবে– সে জায়গায় পৌঁছে বলল, শোনো শ্ৰীযুত কীর্তিমান রায়চৌধুরী, তুমি ভাবছ এ মেয়েটা এগিয়ে গিয়ে স্বেচ্ছায় লোকনিন্দা গায়ে মাখতে যাচ্ছে কেন? তবে শোনো। এক নম্বর বলে ফরাসি কায়দায় ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের উপর রেখে বলল, আমি প্রথমদিনই তোমাকে স্পষ্ট বলেছি, সমাজের কুৎসা– আই কেয়ার এ ফিগ এ পিন, এ জট, এ টিটল–

বলে মারল তুড়ি। ফের তর্জনীটি অনামিকার উপর রেখে বললে, দুই নম্বর : আমরা যেমন যেমন ঘনিষ্ঠতর হব, কুৎসার নানারকম বেরকমের ধ্বনি জেগে উঠবে চতুর্দিক থেকে, যে রকম ফিলারমনিক অর্কেস্ট্রায় হয়। বেজে উঠবে আরও যন্ত্র, আরও ধ্বনি, বাড়তে থাকবে ধ্বনির বৈচিত্র্য, ভলুম, উচ্চতা এবং শেষটায় পৌঁছবে ক্রেসেন্ডো-তে– সর্বোচ্চস্তরে– যখন একসঙ্গে সবকটা যন্ত্র তীব্রতম তুমুল নাদে হল ভরে দেবে।

আমি আগরতলা গেলে ফিরে এসেই শুনব কনসার্ট ক্রেসেন্ডোতে। ফের মারল তাচ্ছিল্যের তুড়ি।

এবারে মধ্যমা। তোমার কি লোকনিন্দা হবে–

এতক্ষণে কীর্তির কিঞ্চিৎ চৈতন্যোদয় হয়েছে। বাধা দিয়ে বললে, সেটা আমাকে বলতে দাও, তোমার যদি আপত্তি না থাকে।

বিনীত কণ্ঠে আবার যেন শিপ্রা নিবেদন করল, তা হলে তোমার কোনও ইচ্ছা, কোনও নির্দেশে আমার কোনও আপত্তি থাকতে পারে না-না-না। আমি চলব তোমার আদেশে। আমার অভ্যাস– সেটা বিধিদত্ত– আমার বক্তব্য আমি স্পষ্ট ভাষায় জোরদার গলায় প্রকাশ করি। আসলে তুমি জোরদার, ঢের ঢের বেশি জোরদার।

এখন যদি বল, না তুমি আগরতলা যাবে না আমি নত মস্তকে সে আদেশ মেনে নেব এবং আমার অনুভূতির কোনও পরিবর্তন হবে না। তার পর বসে বসে প্রহর গুনব। কবে তুমি ফিরবে। তখন সেটা ধূমধামে করব সেলিব্রেট। তুমি নিজেই স্বীকার করবে, তোমার আদেশে আমার হৃদয়-মনে কোনও জায়গায় আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি।

এবারে কীর্তি বললে, আমার সামাজিক নিন্দার কথা তুলেছিলে? তুমি বহুদর্শী– তোমার মুখে এটা আদৌ মানায়। পুরুষের কুৎসা রটনা তার আয়ু কদিন? জলের তিলক কপালে কাটলে শুকোতে যতক্ষণ লাগে– বরঞ্চ বলি জিন্-এর। ওটা স্পিরিট, উপে যায় তড়িঘড়ি। দেখতে পাও না, এদেশের নিত্য দিনের ট্র্যাজেডি এমন সব পাষণ্ড যাদের কোনও কুকীর্তি কারও অজানা নয় তাদের হাতে আমরা নিত্যনিয়ত সঁপে দিই না সদ্য ফোঁটা শিউলিফুলের মতো সরল নিষ্পাপ বধূদের?

আমার বদনাম! খতিয়ে দেখলে শুনবে, অনেকেই আমাকে হিংসে করছে, কেউ কেউ আভাসে ইঙ্গিতে তোমার কাছে আমার এমন সব বদ-অভ্যাস কুকর্ম কেচ্ছা– যেগুলোর সঙ্গে জীবনে আমার কখনও পরিচয়ই হয়নি দূর থেকে সন্তর্পণে এগিয়ে দেবে; সেখানে আমার চিন্তা করার কিছুই নেই। তুমি আমাকে ভালো করেই চেনো আমার কোনও দুর্বলতা তোমার অজানা নয়। ফারসিতে বলে, দুশমন কী করতে পারে, দোস্ত যদি মেহেরবান হয়? –দু চারজন বন্ধু আমার এমন আছে যাদের শরীরে-মনে যথেষ্ট বল আছে এবং দরকার হলে যারা সক্কলের সামনে দু পাঁচজনকে ঠ্যাঙাতে হামেহাল তৈরি– তা তারা তাদের সামনেই হোক্ আর আড়ালেই হোক, তোমার-আমার সম্বন্ধে অপছন্দসই কোনও মন্তব্য করলে। কিন্তু এ কথাটার উল্লেখ করলুম, নিতান্ত কথায় কথায়, এটা অবান্তর।

আর অগুনতি লোক তোমার রুচির খুব একটা প্রশংসা করবে না, তুমি আমার মতো অপদার্থকে বেছে নিয়েছ বলে।

শিপ্রা কোনও মন্তব্য করল না। সর্বশেষ কীর্তি বলল, কুকুর ঘেউ ঘেউ করে; কাফেলা এগিয়ে যায়। দি ডগ বার্কস, দি ক্যারাভান পাসেস।

.

১৬.

বাগডোগরা অ্যারপোর্ট পৌঁছবার পাঁচ মিনিট আগে হঠাৎ শিপ্রা দেখে, পালে পালে সাদা ছোট ছোট মেঘের টুকরো যেন তেড়ে আসছে তাদের প্লেনের দিকে। প্লেন ঢুকে গেল মেঘের রাজ্যে। আবার তেমনি হঠাৎ প্লেনটা ফাঁকাতে বেরুতেই শিপ্রা দেখে পূর্ব দিগন্ত থেকে পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে শ্বেত-শুভ্র হিমালয়। কী বিরাট, কী মহান, কী গম্ভীর সে গিরিরাজ। অথচ অতি দূর থেকে দেখছে বলে মনে হল যেন মাত্র গজ তিনেক খাড়াইয়ের এবড়ো-খেবড়ো একটা দেয়াল, পৃথিবী ইসপার-উসপার হয়েছে। পাঁচিলের উপরের প্রান্ত যেন অসমান ঝালর-কাটা– উচ্চতায় শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিশেষ তারতম্য চোখে পড়ছে না বলে পর্বত প্রাচীরের উপরের রেখা কাটা কাটা–নীল আকাশের পটভূমিতে পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত নিরবচ্ছিন্ন প্রসারিত হয়ে।

কিন্তু হায়, ভালো করে দেখতে না দেখতেই প্লেন রানওয়ের দিকে নামতে লাগল। দূরের এবং কাছের গাছপালার পিছনে বিরাট হিমালয় পর্যন্ত ঢাকা পড়ে অদৃশ্য হল।

শিপ্রার শরীর রোমাঞ্চিত। এরকম দৃশ্য সে জীবনে কখনও দেখেনি। তার দু চোখ হরিষে বিষাদে ভরে গিয়েছে। তখন হঠাৎ মনে এল কীর্তির কথা বিস্ময়ে উত্তেজনায় তার কথা মোটেই মনে পড়েনি, তার দৃষ্টি সে দিকে আকর্ষণ করেনি। গোটা দুই খোঁচা দিয়ে বার বার শুধাল, দেখলে, দেখলে?

তোমার মাথাটা যেভাবে জানালার উপর চেপে ধরে শার্সিটা চিবোচ্ছিলে সেটার মার্জিন ধরে আমি মাত্র একটা কোণ দেখেছি। কিন্তু এর আগে আরও কয়েকবার দেখেছি।

শিপ্রার উত্তেজনা তখনও পুরো মাত্রায়; আমি প্লেন থেকে আলপস দেখেছি অনেকবার। উপর দিয়ে ফ্লাই করার সময় জিনিভার বিরাট লেক থেকে ছোট ছোট ডোবাগুলোর নাম পর্যন্ত পিন্ ডাউন করতে পেরেছি। কিন্তু এরকম ওভারহুয়েলমিং দৃশ্য কখনও দেখিনি– যেটা মানুষের সর্বচৈতন্য আচ্ছন্ন করে তার সত্তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে। দেয়। কিন্তু কী ট্র্যাজেডি। দু মিনিট দেখতে না দেখতে সবকিছু ঢাকা পড়ে গেল।

খান সান্ত্বনা জানিয়ে বললে, কিছু ভয় নেই, শোক করার নেই। বাগডোগরা থেকে আমরা যাব গৌহাটি– অনেকখানি পথ– হিমালয়ের সমান্তরাল রেখা ধরে। পুরো পথ ধরে বাঁ দিকে গিরিরাজকে যত প্রাণ চায় দেখবে আর পেন্নাম করবে। কিন্তু কালো চশমাটা পরে নিও। নইলে চোখ ড্যামেজড হতে পারে।

শিপ্রা বিপুল বিক্রমে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, কেন? পার্বতী কি তার পিতা হিমালয়ের মুখের দিকে তাকাতেন না– না তিনি গগলস পরতেন? আর হিমালয়ের শুভ্রতা যার তুলনায় মসীতুল্য, তার প্রাতঃসূর্যরুচি শ্বেতাম্বর বর শঙ্কর? শুভদৃষ্টির লগ্নেও কি তিনি গান্ধারীর মতো চোখে ফেটা বেঁধেছিলেন?

কীর্তি বললে, ওরকম অলৌকিক কর্ম শুধু মেয়েরাই পারে। আমরা তো নহি বধূ, নহি কন্যা।

শিপ্রা ব্যঙ্গ করে টিপ্পনী কাটল, অ। বধূর জন্য পাদপীঠ সগ্রহ করাতেই সর্ব সাধনা সর্ব কামনা শেষ? বলে দেব খানকে সব? কেন? চন্দ্রবংশের সংবরণ না কে যেন সূর্যের মেয়ে তপতাঁকে রানি করতে চেয়েছিলেন বলে শ্বশুরমশাই সূর্যের দিকে অপলক চক্ষে তাকাতে তাকাতে উপাসনা করে প্রার্থনা জানাননি?

শিপ্রা কান্নায় কান্নায় ভেঙে পড়ে আর কি! প্লেন ফের আকাশে ওঠামাত্রই ধরা পড়ল মেঘ আর কুয়াশা এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হিমালয়ের রূপরেখা ঢেকে ফেলেছে। দেবতারা কী অকরুণ, কী নিষ্ঠুর!

খান পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে বললে, ওসব মেঘ-কুয়াশার নুইসেন্স যে কোনও সময় কেটে যেতে পারে। ততক্ষণ নিচের দিকে তাকাও না– ব্রহ্মপুত্র নদ। ইনিও তো হিমালয়ের জন্ম নিয়ে, বাপের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে না থেকে দেশের পর দেশ অতিক্রম করে যাচ্ছেন, পথিকের তৃষ্ণা নিবারণ করে, তার অংশাবতার জনপদবধূর কলসিতে ঢুকে তাদের কাঁখে আরামসে বসে আনন্দধ্বনি ছলাৎ ছলাৎ করছেন। তার পর তিনি আদর করে কোলে তুলে নেবেন গঙ্গাকে– দু পথ ধরে দুজনাই বেরিয়েছিলেন হিমগিরি থেকে।… শুধোইগে পাইলটকে ওই মেঘবাবুদের গাত্রোৎপাটন করার আশু সম্ভাবনা আছে কি না।

কামাখ্যার উপর দিয়ে যাবার সময় কীর্তি বললে, এ জায়গার মেয়েরা বিদেশি পুরুষদের মেড়া বানিয়ে রাখে।

শিপ্রা বললে, আমাকে এখানে নামিয়ে দাও। ভালো করে দেখে নিক সব্বাই, সত্য সত্য তিন সত্যের মেড়ি কাকে বলে।

কীর্তি বললে, আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, জোর গলায়, তোমার যা ইচ্ছার জোর, উইল-পাওয়ার আছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ব্রহ্মা বিষ্ণু তোমার অনিচ্ছায় তোমাকে স্বর্গে ইন্দ্রাণী উর্বশীর আসনে বসাতে পারবেন না, মর্তে চার্মিং মার্লেনে ডিটরিষ, সুইট, লিলিয়ান হার্ভের মাধুর্য দিতে পারবেন না। নরকে যমরাজার পাটরানি যমীর কথা দূরে থাক। আর তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি মেড়ি, নেড়ি, ভেড়ি যা খুশি তাই হবার শক্তি ধরো– অর্থাৎ কারও তোয়াক্কা না করে। তুমি তো কলকাতাতে এখনও একপাল মেড়া পোযো=

শিপ্রা বাধা দিয়ে বললে, থ্যাঙ্ক ইয়ু। কিন্তু বল তো, আমি কী হতে চাই?

কীর্তি চিন্তিত মনে আসমান-জমিন অনুসন্ধান করতে লাগল।

 শিপ্রা ডান দিকে একটু সরে বসে কীর্তির উরুতে হাত রেখে বললে, কীর্তি-প্রিয়া।

পেটুক গাণ্ডেপিণ্ডে খেতে খেতে মারা গিয়েছে তবু ভোজনকর্মে বিরতি দিতে পারেনি, এ দৃশ্যটি প্রাচীন দিনের বন্নভোজনের একাধিক পরিবেশক চোখের সামনে দেখেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু স্পর্শকাতর রূপের পূজারি, সুন্দরের পিয়াসীদের সামনে প্রকৃতি অকৃপণ হস্তে ছবির পর ছবি, দৃশ্যের পর দৃশ্য, রূপের পর রূপ ঢেলে দেন তবে সে বেশিক্ষণ সেদিকে তাকাতে পারে না। তার হৃদয় তখন আকুলিবিকুলি করে প্রত্যেকটি দৃশ্যের রস দিয়ে সে যেন তার হিয়া রাঙিয়ে নিতে পারে– শ্রীকৃষ্ণ যে রকম সুন্দরী রাধাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, রাধে, তোমার চোলির রঙ দিয়ে আমার মস্তকাভরণ রাঙিয়ে দাও, (রাধা কি তবে ভ্রমবশত, না স্বেচ্ছায়, বুক চিরে তারই রক্ত দিয়ে কানুর মস্তকের চূড়া লালে লাল রঙিয়ে কৃষ্ণচূড়ার জন্ম দিলেন?)– যাতে করে দুর্দিনে প্রাণের রসধারা যখন শুকিয়ে যায় সেই দারুণ দহনবেলায় এসব দৃশ্যের একটি একটি স্মরণে এনে নিজের ভাগ্যকে ক্ষমা করতে পারবে।

নিশ্চল হিমালয়, সচল ব্ৰহ্মপুত্র, বুকের উপর কত শত দ্বীপ শিশুর মতো প্রতিদিন বেড়ে বেড়ে বড় হয়ে উঠছে, জলের উপর ফোলা পালের স্ফীতবক্ষ বিশাল নিতম্ব মহাজনি নৌকার সারি যেন ডিমের খোসার সাইজ আর ওদেরই মতো হেলেদুলে নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, চরের পরিবর্তে হঠাৎ জেগে উঠছে, মাথা উঁচু করে ক্ষুদ্রায়তন উমানন্দ পাহাড় কিন্তু তার আকস্মিক অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব বুকে লাগায় চমক, গোয়ালপাড়ার ঘন সবুজ বাঁশ বেত আম-কাঁঠালের মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে উঠেছে হাজার হাজার অবঙ্কিম ঋজু গুবাকবৃক্ষের শুভ্রতা। কত দেখবে পিয়াসী শিপ্রা!

সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গৌহাটি, শিলচর শেষটায় আগরতলা। টসটসে ভেজা ব্লটিঙের মতো তার সৌন্দর্য গ্রহণশালার ভাণ্ডারী আর কোনও নবীন রস নিতে সম্মত হয়নি। শুধু শিলচর থেকে ত্রিপুরা পাহাড়ের উপর দিয়ে প্লেন যাচ্ছে তখন কীর্তি ডান দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এই তোমার বাল্যসখী বিকিস্-এর দেশ, সিলেট।

ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে, বিকি সত্যি বলেছিল, ফ্ল্যাট পুব বাঙলার মতো সবুজে সবুজ তো বটেই, মাঝে মাঝে উঁচু-নিচুর টিলাটালি, ক্ষুদে ক্ষুদে পাহাড়, আর সমস্ত দেশটা আঁকা-বাকা নদী-নালায় ভর্তি– সবুজ জেব্রার উপর ফালি ফালি ঘোলাজল স্বচ্ছ জলের ডোরা। মাঝে মাঝে আবার দিঘিও তো। না, স্মরণে এল বিলকিস্ বলেছিল ওগুলো হাওর, লম্বা-চওড়ায় অনায়াসে পাঁচ-সাত মাইল জুড়ে জল– মোস্ট ডেঞ্জারাস। শুধু দেখতে পেল বিকিসের বর্ণনার ময়ূরের মতো পেখম-মেলা বিরাট বিরাট কৃষ্ণচূড়ার নিচে, টিলার উপরে চা-বাগানের কলঘর, সানুদেশে চা গাছের ঝোঁপ, পাশের টিলার উপর ম্যানেজারের নির্জন নিঃসঙ্গ ছিমছাম বাঙলো– প্লেন যাচ্ছিল খুবই উঁচু লেভেলে।

আগরতলায় যে বাঙলোতে তারা উঠল সেটা উঠবার সিঁড়ি থেকে বাথরুমে জমাদার ঢোকবার দরজা পর্যন্ত সবকিছু মেগনাম সাইজের। বাড়িটা বানিয়েছিল এক ইংরেজ– ত্রিপুরা থেকে বিশ্বের জুগুলোতে একদা সে হাতি সাপ্লাই করত পাইকিরি হিসেবে, অন্য লোক যে রকম ভেড়া-ছাগল বিক্রি করে। নীলকরদের কুঠির মতো এক একটা কামরা আস্ত এক-একটা জলসাঘর– ছাত যে কোন উঁচুতে দেখতে হলে দুরবিনের প্রয়োজন। তাবৎ বাড়িটা জুড়ে যেন হাঁ করে সবকিছু গিলে ফেলে বিশাল বিস্তীর্ণ হলঘর। প্রটেস্টান্ট ইংরেজ যেন ক্যাথলিক পোপের ভাটিকানকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল। দেশে ফেরার সময় বাড়িটা বিক্রি করতে গিয়ে দেখে, ত্রিপুরার লোকের কাছে হাতি ঘরকি মুরগি বরাবর বলে তারা বর্মার রাজদত্ত উপহার শ্বেতহস্তী পোষার খরচটা সম্বন্ধে আগাপাশতলা ওকিবহাল। অতএব শেষটায় এই শ্বেতোত্তর হস্তী ক্রয় করলেন আমাদের কলকাত্তাই খানের আব্বাসাহেব, বড়া খান।

শিপ্রা প্রথম পদার্পণের সময় এসব কিছুই লক্ষ করেনি। স্বপনচারিণীর মতো বাথরুমে ঢুকল। বেরিয়ে সোজা ডাইনিংটেবিলে। সেখানে ইতোমধ্যে এসে গেছেন দুই ইয়ারের স্থানীয় ইয়ারের দু পাঁচজন। সামনে গেলাস। শিপ্রা দেবীকে পরম ভক্তিভাবে নমস্কার জানিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আপন আপন গেলাস একটানে শেষ করে ফের নমস্কার জানিয়ে প্রসেশন-পদ্ধতিতে ইয়াররা বেরিয়ে গেলেন।

ক্লান্ত কণ্ঠে শিপ্রা শুধাল, এরা পালাল কেন? আমি কি বাঘ?

খান তাড়াতাড়ি বলল, তুমি বাঘ না, তুমি ক্লান্ত। আর এরা যাবে কোথায়? বললেই আসবে, না বললেও আসবে। ওরা মফস্বলের লোক। তাদের দুশ্চিন্তা, বেগানা লোগের সাক্ষাতে বেগমসাবের সেবার (আহারাদি) তুরু (ত্রুটি) হইতে পারে। বাদে তেনার লগে লগে আরাম করন লাগবো (শুতে যেতে হবে)।

সীমান্তপারের পাকিস্তান থেকে এসেছে একাধিক বর্ণগোত্রের মাছ। কে বলে ভারত-পাকের সাধারণ জন জন্তু-জানোয়ারের প্রতি নির্দয়? ওপারযাত্রী মা চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন– পুত্র যেতে পারল না তার কাছে পাসপোর্ট-ভিসার অভাবে। এ পারের চাষা গিয়েছিল বর্ডার ক্রস করে ওপারে তার গুটি কবরেজের কাছে দাদিজানের জন্য কফ নিবারণের গুটি চারেক বড়ি আনতে। খুঁজে রেখেছিল পরনের দু হাতি লুঙ্গির তাঁকে। পড়ল ধরা। কাস্টমসের ছোটবাবু তার বিলিতি ফার্মাকপিয়ার ফিরিস্তিতে এই অসভ্য ওষধির নাম হল ডবল ফাইন। কিন্তু মাছের বেলা সদয়তর ব্যবস্থা তার পাসপোর্ট লাগে না, তার ট্যাক কেউ খোলে না। কালোতে এলেও ইলিশের রঙ কালো হয় না, কই ধরা পড়ার ভয়ে, পাঙাশ হয় না। দুটো বর্ডার ক্রস করে এসেছে খাসি পাহাড়ের কমলানেবু।

শিপ্রা বললে, মফস্বলের লোকের আহারাদি হয় মৌসুমে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে। এখানে দেখি নেবুর দোসর আনারস।

তাই তো লোকে বলে বাঘের দুধও মেলে। বাঘিনীও দুধ দেয় বিশেষ অবস্থায়। এখানে সর্বাবস্থায় বাঘ তো পেটে বাচ্চা ধরে না– বাঘ ভি দুধ দেয়। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে অবস্থা বড়ই সঙ্গিন। বর্ডারে এখন আর রাইফেলধারী পুব বাঙলার পুলিশ নেই– তাদের স্থলে এসেছে মেশিনগান, নানাবিধ অটোমেটিক হাতে পাঞ্জাবি পাঠান আর্মিমেন– পশ্চাতে আর্মার্ড গাড়ি। কাছেই কুমিল্লা কেনটনমেন্ট, ময়নামতীর ঘাঁটি। হাজার হাজার সেপাই-অফিসার আবজাব করছে। পূর্বাঞ্চলে কুমিল্লাতেই পশ্চিমাদের সবচেয়ে ডাঙর কেনটনমেন্ট।

শিপ্রার আবছা আবছা মনে পড়ল, বাগডোগরা, এই আগরতলা এমনকি শিলচর কিছুটা দূরে হলেও সবকটাই ইন্ডো-পাক বর্ডারের কাছাকাছি বলে সর্বত্রই এমনকি প্লেনের ভিতরও তার কানে এসেছে মাত্র একটি টপিক। সেটা রহস্যময় ও প্রশ্নে প্রশ্নে কণ্টকিত। সুদ্দমাত্র লীগকেই যদি শায়েস্তা করতে হয় তবে কামান কেন, ট্যাঙ্ক কেন, সাঁজোয়া গাড়ি কেন? তবে কি ইন্ডিয়া অ্যাটা করার জন্য? তাই হবে। কারণ শেষ গুজব, লীগ-ইয়েহিয়াতে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে। ভারত যদি আক্রান্ত হয়, চীন কি তবে ফের দুশমনি করবে?

আরও কতশত প্রশ্ন।

খেয়েই শিপ্রা মারল ছুট– অনন্তকাল ধরে সে ঘুমুবে।

নিদ্রা-রেকর্ডে কুম্ভকর্ণের নাসিকা-গর্জন গোল্ড মেডেল পেয়েছে কিন্তু রেকর্ড কৃত্তিবাস স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, ক্ষুদ্র নিদ্রাকৰ্মটি কিন্তু হেঁদো। রইলেন শ্রীবিষ্ণু। অনন্তশয্যা। কিন্তু অবতার এবংকিংবা অংশাবতার হয়ে যখন অবতীর্ণ হতেন। তন্দ্রাবস্থায়? হা, ধিক! শাস্ত্রাদির সম্যক অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ রাখার কুফল বক্ষ্যমাণ পুস্তক।

তবু, অন্তত এটুকু বলা যেতে পারে সেই দিন-যামিনীর শিপ্রা-নিদ্রা তার পূর্বতর রেকর্ড। তর্কাতীত ছ লেংথে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল।

ঘুম একটুখানি কেটেছে মাত্র। সঙ্গে সঙ্গে শিপ্রা অনুভব করল, দুটি ছোট কোমল হাত– মেয়েছেলেরই নিশ্চয় তার পা টিপে দিচ্ছে, কিন্তু চাপেতে যে জোর, সেটা যেন পুরুষের। একটুখানি চোখ মেলে ক্ষীণালোকে দেখল, পাহাড়ি মেয়ে। এখানকার পাহাড়িদের নাম কু কী– কিন্তু শিপ্রার মনে হচ্ছে, আর পাঁচজন বাঙালিদের মতো গারো, লুসাই, কুকি সবই বরাবর।

কণ্ঠে অত্যন্ত বিরক্তি মিশিয়ে শুধাল, তোমাকে পা টিপতে বলেছে কে?

কুণ্ঠিত কণ্ঠ : কেউ না। আমার মিসিবাবা হয়রান হয়ে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লে আমি তখন পা টিপে দিতুম। সে আরামসে বেশি ওৎ ঘুমুত। আমি আরও দু মিনিট পরে চলে যেতুম– আপনার মালুম ভি হত না।

বাঁচালে, বাবা। পা টেপো আর যাই টেপো, চুলটা তো আঁচড়ে দেবে। নইলে হাতের নড়া খসে যেত– খুশি হল শিপ্রা।

কটা বেজেছে?

 গ্যারহ সে জ্যাদা।

সর্বনাশ! ওদিকে কানে আসছে মফস্বলের বারান্দায় শ্যামবাজারি রকের তুফান।

হন্তদন্ত হয়ে উঠে বললে, আয়া, তুমি ওদের গিয়ে বল, আমি এখুনি আসছি, ওদের কেউ যেন না পালায়। মফস্বলি এটিকেটের বাড়াবাড়ি অম্লান বদনে মেনে নেওয়াটাও এটিকেট নয়। আর ফিরে এসে এখুনি চুলটা আঁচড়ে দাও। আলোটা জ্বালো।

সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ মাথার কোন অজানা কোণ থেকে একটা সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত তার মনে ভেসে উঠল, লারি যে মির্জাকে বলেছিল, তামাম পুব বাঙলার ওপর স্টিমরোলার চালানো হবে সেইটেই ঠিক। সে যখন গভীর নিদ্রায় অচেতন তখন তার অবচেতন মনে নানা গুজব নানা তথ্যের কাটাকুটি করে সিপ্লিফিকেশন অঙ্কের মতো এই সরল রেজালটে পৌঁছেছে। কিন্তু আশ্চর্য! এই নিয়ে এত যে বচসা, ভবিষ্যদ্বাণী ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে সে শুনল, কেউ তো একবারের তরেও বলল না, ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়ির ছয়লাপ, হয় ভারতকে ভয় দেখাবার জন্য কোনও গভীর কূটনৈতিক চাল, নয় সরাসরি ভারতকে আক্রমণ। সবাই বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছে, নিছক সেঁদরি কাঠের লাঠি নিয়ে লম্ফঝম্প করছে লীগ, যদি তাদের অন্য কোনওপ্রকারের অস্ত্রের ব্যবস্থা থাকত, তবে সেটা কস্মিনকালেও গোপন থাকত না। অতএব ট্যাঙ্ক-কামান ভারতের তরে কিউ. ইউ, ডি। শিপ্রার মনে হল, তারা ওজনের আঁকে ধুরন্ধর পোদ্দারের মতো অতখানি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যুক্তিতর্কের সিটিটাকে যাচাই করে দেখেনি। এরিথমেটিকের অঙ্ক কষেছে তার অবচেতন মন; এদের সচেতন মন যেন জিওমেট্রির স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে চলে গেছে জিওমেট্রিক টেনজেনটে সরাসরি বিপরীত মুখে।

.

১৭.

আয়া খোঁপাটা বাধল কোন দূর বা নিকট পাহাড়িনী স্টাইলে সে সমস্যার সমাধান না করেই ছুটল বারান্দার হাইড পার্কি মিনি-মিটিঙের দিকে। দূর থেকেই লেডি-সুলভ মাঝারি গলায় বলল, আপনারা কোনও তকলিফ করবেন না, প্লিজ। আমি একপাশে বসে শুধু শুনব।

প্রথমটায় ওস্তাদি গানের অবতরণিকা আলাপের মতো বাক্যালাপ কিঞ্চিৎ মন্দ মধুর কৃচিৎ কাকলির সুর ধরেছিল বটে কিন্তু পেটের ভিতরকার তরল দ্রব্যগুণ যাবে কোথা? দ্রুত তেতালে স্থগিত দারুণ সংগ্রামে তারা ফিরে এলেন, দ্যাখ তো না দ্যাখ, ডার্বি ঘোড়া ধূলির ঝড় উড়িয়ে।

সুস্পষ্ট দুটি দল। মধ্যপন্থা জনশূন্য। স্বয়ং চেয়ারম্যান খান খনে ফ্রন্ট বেঞ্চার খনে চেয়ার আসীন।

প্রথম পক্ষের বক্তব্য : ঢাকাতে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে। মারপিট হবে না।

দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য : আদৌ হয়নি; হবেও না। ইয়েহিয়া জাত ঘুঘু। টালবাহানা দিয়ে সময় নিচ্ছে, শুধু আরও সৈন্যঅস্ত্রশস্ত্র জমায়েত করার জন্য।

শিপ্রা এসবের অধিকংশই শুনেছে। বেয়াত্রিচে যা বলেছিল সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিল মাত্র।

তুমুল তর্কযুদ্ধের সময় হঠাৎ এক এক সময় সবাই একসঙ্গে চুপ মেরে যায়।

সে স্তব্ধতা ভাঙলেন একটি বয়স্ক মুসলমান। তিনি হংসমধ্যে বক। অবশ্য বকের মতো জল খাচ্ছিলেন না, চুষছিলেন একটা নিম্বু পানি। বললেন, একটা ঘটনা আমার কাছে বড় রহস্যময় ঠেকেছে। দিন কয়েক আগে দুটো পাঞ্জাবি সেপাই গিয়েছিল বাজারে। কী একটা সামান্য অজুহাত পেয়ে রাস্তার ছোঁড়ারা হয়তো-বা লীগের দু একজন ছিল করেছে ওদের ডাহা বেইজ্জত। শেষটায় দুজনার পাতলুন মিয়া সাহেব যেন বিষম খেয়ে আচমকা থেমে গেলেন।

শিপ্রাই বুঝেছে সক্কলের পয়লা। অভয়বাণী শুনিয়ে বলল, মৌলভি সায়েব, আপনার যা বলার অসঙ্কোচে বলে যান। আমি নাজুক, লজ্জাবতী লেডিদের একজন নই, যারা কারও মুখে বাচ্ছা বিইয়েছি শুনলে ভিরমি যান, তাঁরা জন্ম দেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কাছে সর্বদাই প্রথমটাই প্রকৃতিসম্মত এবং ভিরাইল ঠেকেছে।

মৌলভি সায়েব কিন্তু সেদিক দিয়ে পাক্কা মডার্ন। ভদ্র রমণীর আদেশ অলঙ্। বললেন- পাতলুন কেড়ে নেয়। ভাগ্যিস অন্য হ্রস্বতর অঙ্গবস্ত্র পরনে ছিল, তাই মানে মানে ছাউনিতে ফিরতে পারল।

কেউ মৃদু হাস্য, কেউ-বা অট্টহাস্য করলেন। শিপ্রা প্রথম শ্রেণিতে।

 সায়েব বললেন, কিন্তু আসল কথা, তারা ছাউনিতে ফিরে গিয়ে বন্দুক এবং ইয়ার-দোস্ত নিয়ে এসে বেধড়ক মার লাগাল না কেন, গুলি চালাল না কেন, দোষী নির্দোষীকে অবিচারে– বেধড়ক? যা আকছারই হয়ে থাকে পাকিস্তানে। সেইখানেই তো রহস্য। তার কিছু করল না, সেইটাই তো রহস্য।

এবারে শিপ্রা যেন আলোচনায় যোগ দিল। বলল, শার্লক হোমসের অন্যতম রহস্য গল্পে আছে তিনি পুলিশ ইনসপেকটরকে বললেন, রাত্রে কুকুরটার রহস্যময় আচরণের দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইনসপেকটর আশ্চর্য হয়ে বলল, সে তো কিছু করেনি। হোমস হেসে বললেন, সেইখানেই তো রহস্য। শিপ্রা থেমে গেল।

খান আর কীর্তি ছাড়া আর সবাই কৌতূহলী নয়নে শিপ্রার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। এ সজ্জনদের মাঝখানে মাত্র ওরা দুজনাই জানে, শিপ্রা পয়েন্টলেস, উদ্দেশ্যহীন গল্প বা উদ্ধৃতি কখনও ছাড়ে না।

মিঞা সাহেব কিন্তু ধরে ফেলেছে। সে হোমস পড়েনি তবু। কারণ তার বক্তব্যের সঙ্গে এটা মিলে যাচ্ছে। হয়তো-বা তার এবং অন্য কিছুজনের গল্পটি স্মরণে এসেছে।

অন্য সবাই স্কুলবয়ের মতো পূর্বাপর সংযোগসহ সবিস্তার পূর্ণ বিবরণীর জন্য শুরু শিপ্রার দিকে তাকিয়ে আছে বলে সে বলল, আস্তাবল থেকে দামি ঘোড়া গিয়েছিল চুরি, গভীর রাত্রে, অথচ সেটাকে পাহারা দেবার জন্য যে কুকুরটা ছিল সেখানে, সে ঘেউ ঘেউ করে স্টেবল বয়গুলোকে জাগিয়ে তোলেনি। ডিটেকটিভ হোমস তার থেকে অনুমান করলেন, চুরি করেছে কুকুরের কোনও ঘনিষ্ঠজন। পরে ধরা পড়ল, চুরি করেছিল জমিদারের আস্তাবলরক্ষক স্বয়ং– অসদুদ্দেশ্যে।

মিঞা সায়েব সোৎসাহে বললে, বিলকুল সহি বাৎ! সেপাই দুটো তার ভাই-বেরাদর, ইয়ার-দোস্তকে অতি অবশ্যই তাদের বে-ইজ্জতির কাহিনী বলেছিল। তারা কিছু করল না, কমান্ডানটও কিছু করল না, এমনকি যেটা কম-সে-কম মিনিমামেসট সিভিল, পুলিশকে তদন্ত করার জন্য আদেশ করল না। অর্থাৎ কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করল না। বিগলিতার্থ যা স্বাভাবিক যা প্রত্যাশিত সেটা ঘটল না। কেন?

অন্য গুহ্য খবর আমার না থাকলেও আমি এর থেকে এই অর্থই বের করতুম, কর্নেল কর্তা ওদের বুঝিয়ে বলেছেন,

এখনও তোদের সময় হয়নি।
যেথায় চললি যাসনি কো ধনি।

অর্থাৎ এ তাবৎ প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও যে পরিমাণ সৈন্য পশ্চিম পাক থেকে জোগাড় করা হয়েছে সে-সংখ্যা দিয়ে লীগ এবং তাদের অন্ধ সমর্থক পাগলা পাবলিককে শায়েস্তা করা যাবে না। তোদেরও সময় আসবে, মোকা পাবি তোটা দিলসে জাসে দাদ নেবার।

ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা ১৯২০/৩০-এর স্টাইলে চুলকাটা, ঘাড় কানের কাছে প্রায় কামানো এক ফুল-বাবু বললে, অর্থাৎ, স্যাকরার টুং টুং, কামারের এক ঘা।

মিঞাজি ভুরু কুঁচকে বললেন, এক ঘা নয়, চক্কোত্তি। একশো ঘা।

এক সিলেটি কারবারি ফ্রানস দেশে চালান দেয় কোলাব্যাঙ। কুমিল্লার আশেপাশে খুদ শহরের সর্বাঙ্গে এন্তের বিজ্ঞাপন সেঁটেছে, এখানে কোলাব্যাঙ ক্রয় করা হয়; কোলাব্যাঙের স্থলে কোনও কোনও বিজ্ঞাপনে আছে ঘাড় ব্যাঙ। এক খাস আগরতলি তাকে শুধাল, কিও হাজি, তুমি মুরগির চালান বন্ধ করে দিয়েছ? মিঞা হজ করার জন্য সুদূর মক্কা যাওয়া দূরে থাক, ঢাকা-চাটগা অবধি তার দৌড়। পরে এসেছে শার্ক স্কিনের পাতলুন, সিল্কের প্রিনকোট। এর অদ্ভুত হাজি ডাকনাম হল কী করে সে এক রহস্য এবং খাটো কান শুধাল, কিতা?

শিপ্রা কারও কথা কেটে আপন কথা কয় না। এস্থলে তার উত্তেজিত কৌতূহল ব্যত্যয় বাধাল। সঙ্গে সঙ্গে শুধাল, হাজি সায়েব, কিতা মানে কী?

এতাবৎ ভদ্রা শিপ্রা কাউকে উপেক্ষা করেনি, আবার কারও প্রতি বিশেষ দৃষ্টিনিক্ষেপও করেনি।

হাজি তাই শিপ্রাবানুর নেকনজর পেয়ে বিগলিত। কোমরে দু ভাজ হয়ে, বাও করে, ঘন ঘন কুর্নিশ ছেড়ে বলল, জনাব বেগমসাহেবা খানম-বানু, যে কোনও অর্বাচীন সিলেটি আপনাকে বলবে, কিতা মানে কী

আলবৎ। কিন্তু সেখানেই শব্দটার শেষ অর্থ খতম হয়ে দাঁড়ি কাটেনি। ওটা অনেক রহস্য ধরে। তুমি কিতা? তার কতই না উত্তর হতে পারে

আর এক সিলেটি সেখানকার মদনমোহন কলেজের লেকচারার, বললে, শুরুর গানে যদি সামান্য পাঠান্তর করি–বলেই দু হাত দিয়ে দু কান ছুঁলেন, অপরাধী যে-রকম মাফ চায় এবং বলি।

ওগো মিতা সুদূরের মিতা
আমার কী বেদনা জানো কি তা?

তা হলে ওই শেষ কি তা সিলেটি কিতার রহস্য ধরে।

শিপ্রা খুশি হয়ে দুই সিলেটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কীর্তি যাকে সে আদর করে কীতা ডাকে তার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল।

হাজি পূর্বতর প্রশ্নের খেই ধরে বললে, মুরগির ব্যবসার ঠ্যালাতেই তো, দাদা এখানে পালিয়ে এলুম। আমি লীগের রীতিমতো সম্মানিত সদস্য। ওদিকে খুদ লীগ হাইকমান্ডের হুকুম কি না জানিনে, পাঞ্জাবি-পাঠানদের খানাদানা সাপ্লাই বন্ধ করো। কিন্তু কার্যত গাঁয়ের লোকসুদু আমন ক্ষেপে গেছে, আমিও তাদের দলে, তাই ইচ্ছে থাকলেও মুরগি জোগাড় করতে পারি ক শো–ওই কেনটনমেন্টের তরে? ওটা তো অজানা থাকবে না। তার পর শা– সরি সরি বড়কর্তা কর্নেল আমায় এত্তেলা পাঠাল–

বাপস্!
সব্বোনাশা!
কিতা কিতা!
ইয়াল্লা! (কোরাস)

ধুকুপুকু মুরগিবাচ্চার জানটা নিয়ে গেলুম কর্নেল সমীপে- সুপুতুরের বাপ নিঝংশ হোক। আমাকে এই মারে কি তেই মারে। আন্দেশা করছি, হিন্দুদের মতো ধর্মপত্নীর সোনার কাঁকন-জোড়া খুলে আনলেই হত। বিক্কিরি করলে, এই মাগির বাজারেও এক কেস স্কচ কেনা যায়। তারই নাকি এক বোতল পেটে ঢেলে ডাচ্ কারেজ সঞ্চয় করে এলে হত। ব্যাটা– শিপ্রার দিকে ক্ষণতরে তাকিয়ে সেলাম ঠুকে বলল, ম্যাডাম। আপনি আমার এই অভদ্রস্থ কথাগুলো অ্যাটুকুন মাফ করে দেবেন প্লিজ। য ফলা শিখতে গিয়ে পাঠশালে পড়েছি,

অশ্লীল কুবাক্য সদা মুখে ফোটে যার।
লোক সনে ঐক্য সখ্য রহে না তাহার।

শিপ্রা : সাহেব, আপনি কি ভুলে গেলেন, আমি গোড়াতেই আপনাদের হুশিয়ার করে দিয়েছি, আমি লেডি নই। আপনি দিল্ জাম্ ভরপুর করে গালাগাল দেন, আপনার ওই কবিতার অশ্লীল কুবাক্য এস্তেমাল করুন। আমার কলিজাটা নেচে উঠবে। ওই হারামজাদারা আমার দু চোখের দুশমন।

হাজিকে তখন আর পায় কে? চেয়ার ছেড়ে উঠে অর্ধনৃত্য করে বললে, শাবাশ, শাবাশ, ম্যাডাম। এবার আমার সত্য জ্ঞানোদয় হল আপনি নিকষ্যি কুলিন লেডি। আপনি পরমহংসী। পাতিহাঁস, পাতি নেড়ের মতো পাতি লেডি এসব উত্তমোত্তম ভাবব্যঞ্জক কটুবাক্য শুনে কানে আঙুল– অবশ্য ফুটো দুটো পুরোপুরি বন্ধ করেন না, কারণ তাদের জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবলা– আর চোখে মুখে ছ্যা ছ্যা করেন। আমার মনে কোনও সন্দ নেই আপনি রিয়েল স্টাফ, খাঁটি স্কচ, ও স্যরি স্যরি, আই মিন আপনি পুরো পাক্কা লেডি। বিশেষ করে হারামির পরিবর্তে রূঢ়তর কিন্তু হাইলি কালচারড– জাদাটা যোগ করে।

কী বলব, ব্যাটা দেখি আমার হাঁড়ির খবরত রাখে। বললে, তার পাঁচশোর বদলে এখন থেকে হাজারটা মুরগির দরকার। আমি পাক্কা ইংরেজিতে বললুম, বাই দি লর্ড হ্যারি, পাব কোথায়? সম্বন্ধী ব্যাটা বলল, আমি জানি, তুমি রোজ ঢাকার হোটেলগুলোকে মুরগির চালান পাঠাও। আমিও কম যাইনে। ব্লাফ-মাস্টারের বেলুন। বললুম, তা হলে আপনি সেপাই মারফত সেগুলো স্টেশন থেকে পকড়কে আনিয়ে নিন। আমি জানতুম এখনও কামারের ঘায়ের লগন আসেনি।

তার পর কর্নেল হঠাৎ একদম খাদে নেমে বললে, মিস্টার মজুমদার, আমরা একটা পোলট্রি ফার্ম খুলতে চাই ময়নামতিতে। আপনি তো স্পেশালিস্ট। মেন্ পয়েন্টগুলো বাৎলে দিন। আপনার ব্যবসাতে চোট লাগবে না। আমার চাহিদা প্রতিদিন বেড়েই যাবে, কমবে না। তোমার থেকে আরও বেশি নেব। আমি অবশ্য হরবকৎ জেন্টেলম্যান আনাড়িতে নাড়ি-জ্ঞান শিখিয়ে বেহেস্ত যাব না কেন? সেইসব টিপসই দিলুম যেসব ঢাকা-কলকাতা দেয় তাদের রুরাল ব্রডকাস্টে পশুপক্ষী পালন বাবদে চাষাদের। শুনেছি, ওগুলো পালন করলে প্রতি তিন মাস অন্তর মুরগির মড়ক অনিবার্য। অবশ্য আল্লা যদি আমাদের প্রতি সদয় হন। কিন্তু এহ বাহ্য। দাদারা, বলুন ইয়েহিয়া-মুজিবে সমঝোতার সম্ভাবনা কতখানি? তা হলে আর্মির সংখ্যা কমত না?

শিপ্রা বললে, আমাকে এক বিদেশি জেনারেল বলেছিলেন, দেশের রাজধানী, বড় বড় শহরের পাকা পলিটিশিয়ান এমনকি আর্মির মধ্যস্তরের অফিসাররা বহুক্ষেত্রে যেসব টপ সিক্রেট জানতে পায় না, যেমন ট্রপ মুভমেন্ট, গ্রামের সাধারণ লোকের কাছ থেকে তা লুকিয়ে রাখা যায় না। হাজি সাহেব অবশ্য জবরদস্ত সাপ্লায়ার। কিন্তু তিনিও তো মুরগি-আণ্ডা কিনবেন গায়ের চাষা-ভূষোর কাছ থেকে। শাক-সবজি, এক কথায় যাবতীয় তাজা মাল ওরাই বেচে! জেনারেল বলছিলেন ইয়োরোপের যে কোনও কেন্টনমেন্ট থেকে মাত্র এক হাজার সৈন্য সরালে, সে-ও অতিশয় গোপনে, তবু আশপাশের গায়ের লোক সেই সন্ধ্যায় পাবৃ-এ বসে সঠিক নম্বরটি বলে দিত– একে অন্যের বিক্রির পরিমাণে খবর বদলাবদলি করে। এবং করেও।

হাজি তো তার মতের সমর্থন পেয়ে খুশি। বাকি পাঁচজনও তাজ্জব মানল। আর যেসব কলকাতার সোসাইটি লেডিজ দেখেছে তারা, খানের নিমন্ত্রণেই তারা এসেছেন আকছারই স্বামী বা ফিয়াসেসহ, তারা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন গেলাস-ফিল্ডে। ইনি তো এক ঘণ্টা হয়ে গেল ছোট্ট একটা ব্রান্ডির আধখানাও শেষ করতে পারেননি, ওদিকে ইয়েহিয়া রাজার গল্প, যেসব গল্পের রাজা– সেটাতে দস্তুরমতো তাদের অজানা সব তত্ত্বও যোগ দিতে পারেন।

আর কীর্তি তবে গর্বভরে আসমানি ঘোড়ায় চেপে তামাম শহরটার উপর হাওয়াই চক্কর মারছে।

খান মিটমিটিয়ে হাসছে। একবার হাত কচলাতে কচলাতে বললও, আমার বৃথা প্রশংসা করবেন না। এঁকে আমি গড়িনি। ইনি আমার স্কুলে পড়েননি। হেঁ হেঁ! ফের সবিনয় ভাব, কেন মিছে লজ্জা দিচ্ছেন!

খানের প্যারা দোস্ত গোস্বামী সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তোমার প্রতি কোনও অবিচার হবে না; তোমার যা মগজের পরিমাণ সেটুকুন দিয়ে ওই সেই চাষার কবরেজি বড়িও হয় না। কিন্তু মোদ্দাটা হচ্ছে এই; আমরাও বই পড়ি, মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর ত্রৈমাসিক, বিলিতি লিটরারি সাপ্লিমেন্ট– অবরে সবরে। তার কিছুটা মনেও গাঁথা হয়ে যায়। কিন্তু কই, সঠিক মোকায় তো সেগুলো কাজে লাগাতে পারিনে। ওদিকে দেখ, বেগমসাহেবা যে দু চারটি কথা কইলেন তাতে তাঁর গভীর তত্ত্বজ্ঞান, গভীরতর স্বাধ্যায় তো ধরা পড়লই, কিন্তু কী অলৌকিক মোকা মাফিক সেগুলোর প্রয়োগ! দেশ– অর্থাৎ পার্টিতে গল্পগুজব হচ্ছে এটা রয়েল সোসাইটির মিটিং নয়। পাত্র– আমরা অর্ধশিক্ষিত, ফুর্তির চিড়িয়া, তদুপরি ভিন্ন ভিন্ন ধান্দায় চড়ে বেড়াই, আমরা রিসার্চ করিনে। এবং সর্বশেষে সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট কাল, অর্থাৎ টাইমিং। মিঞাসাহেব বা হাজির বক্তব্য শেষ হওয়ার বহু পূর্বেই তিনি ঠাহর করে নিয়েছিলেন, নলটা চলেছে কোন দিকে। যে কোনও মুহূর্তে ইন্টারাপ করে দেখেছ কোনও মেয়েছেলে কবে যার এ অভ্যাসটি নেই এবং সেটাতে তাদের হক্ক আছে তার বক্তব্য তিনি বলতে পারতেন। না, তিনি অপেক্ষা করে রইলেন। যতক্ষণ না আমাদের মন তৈরি হয়, তার প্রত্যেক শব্দ যেন আমাদের প্রত্যেকটি ব্রেন-সেলে পুরো মাত্রায় আঘাত দেয়। এই অসাধারণ গুণটি বড়ই দুর্লভ, হে খান, বড়ই দুর্লভ।

শিপ্রা চলে গেছে খাবার তদারকিতে আজ এদের সকলের দাওয়াত, তাদের ফ্রেন্ডস অ্যান্ড এনিমিজসহ।

আপন আপন গেলাস নিয়ে সবাই ডাইনিংরুমে এলেন।

শিপ্রা লক্ষ করল, হাজিকে সে তার পাশে বসাল এবং আর পাঁচজনের গালগল্পে কান না দিয়ে ডিনারের প্রায় অধিকাংশ সময়টা গম্ভীর মুখে গুজুর গুজুর করল। অবশ্য টেবিলের কায়দা মেনে মেনে। শিপ্রা তো প্রায় সেই ষোল বছর থেকে হোস্টেস। ওদিকে গল্প করছে, শুনছে মনপ্রাণ দিয়ে যে অন্য দিকে কোনও খেয়ালই নেই, ওদিকে তার চোখ তো চোখ নয়, বন্দুক। প্রত্যেকটি গেস্টের প্রতি বন্দুকের অব্যর্থ নিশানা। প্রত্যেকের মনে ধারণা হল শিপ্রা যেন একমাত্র তাকেই খেতে ডেকেছে আর সামনে বসে বাড়ছে। শ্রীহরি ও সখীগণসহ শ্রীরাধা যখন চক্রাকারে নৃত্য করতেন, তখন শ্রীরাধা তো কথাই নেই, প্রত্যেকটি সখী দেখতেন তারই পাশে পাশে কেষ্ট-ঠাকুর নেচে চলেছেন।

ডিনারের পর সবাই বিদায় নিলেন। রাত্রি তৃতীয় বামে পৌঁছেছে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠি উঠি করছে।

বিদায় নেবার সময় মিঞাসাহেব শিপ্রাকে বললেন, এটা মহরমের মাস। ইয়েহিয়া কট্টর শিয়া। সুন্নিরা মহরম মাস পবিত্র বলে স্বীকার করে বটে কিন্তু শিয়াদের কাছে মহরমের মাহাত্ম্য সর্বাধিক– এমনকি দুই ঈদের মাস বা রোজার মাসের সঙ্গেও তার তুলনা হয় না। এই পবিত্র মাসে ইয়েহিয়া খুন-খারাবি আরম্ভ করবে কী? কি জানি?

.

শিপ্রা শুয়ে পড়েছে। ঘরে আলো জ্বলছে দেখে দরজার সামনে একটুখানি সামান্য নড়াচড়া করতেই শিপ্রা ডাকল, এসো।

একটা চেয়ার টেনে পাশে বসতেই শিপ্রা বলল, আহ্! এই তোমাকে পেলুম এখানে আসার পর থেকে একলা। ভিড়ে তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলি। কীই-বা ভিড় ছিল আজ! কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার লোকের মেলা– আর তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, খুঁজছি বার বার।

শিপ্রার প্রসন্নতা দেখে কীর্তি সাহস সঞ্চয় করে বলল, হাজিকে শুধোচ্ছিলুম তিনি কুমিল্লা-আগরতলা এত ঘন ঘন মাকু মারেন কী করে। হাজি তুড়ি মেরে বললেন, ও তো ডালভাত। আমার তিনটে ভিন্ন ভিন্ন ন্যাশনালিটির তিনখানা পাসপোর্ট আছে। যখন যেটার দরকার হয় তাই দিয়ে চালাই। যদিস্যাৎ নিতান্তই আর্জেন্ট কাজ থাকে তবে বর্ডার চেকপোস্ট-এর লোকগুলোকে একটুখানি ইশারা দিই। ব্যস। বাতলটা বাতলটা, বউয়ের জন্য জবাকুসুমটা, ছেলের জন্য ইনস্ট্রমেন্ট বক্সটা এসব তো আমি প্রায়ই সওগাত দিই, পাসপোর্ট থাকলেও। আর তার চেয়েও জলদির মামেলা হলে কালোয়। যেসব পথ-বিপথ দিয়ে কেপাতা যায়, সুপুরি আসে, তার সবকটা আমার নখাঘদর্পণে। আমি শুধালুম, আমাকে বর্ডার অবধি দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন? হেসে বলল, আমি রাতারাতি আপনার কাগজপত্র তৈরি করিয়ে কালই খাস কুমিল্লায় আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এখন পাকিস্তানে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। তবে বর্ডার অবধি সে তো হেসে-খেলে। কালো পথগুলোও দেখাতে পারি। তবে মোটর ছেড়ে এদিক-ওদিক খানিকটে হাঁটতে হবে।

তুমি যদি অনুমতি দাও, তবে একবার বর্ডার পর্যন্ত হয়ে আসি। প্লিজ।

 খানকে বলেছ?

হ্যাঁ, সে সঙ্গে সঙ্গে বললে, তোমার অনুমতি নিতে।

শিপ্রা চিন্তা না করেই বললে, তবে যাও। তোমার কোনও ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি প্রতিবন্ধক হব এ পরিস্থিতিটা আমি কল্পনাই করতে পারিনে। এবং আমি জানি, তুমি গোঁয়ার নও খামাখা বিপদ ডেকে আনবে না। আমার মনে হল হাজি পাকা লোক। তুমি গাইড পেয়েছ সর্বোত্তম।

কীর্তি বললে, আর ঘণ্টা দু ত্তিন পরেই হাজি গাড়ি নিয়ে আসবে। তুমি কিন্তু তোমার কাঁচা ঘুমটি নষ্ট করো না। আমরা দুপুরের আগেই ফিরব।

আমাকে একটা চুমো দাও।

চিরকালই শিপ্রার ঘুম ভাঙে পাশের মসজিদের ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সারারাতের পার্টি থেকে ফিরে যত ভোরের মুখেই শুতে যাক না কেন। আজও দেখতে পেল হাজির মোটরের হেডলাইট, শুনতে পেল বারান্দা দিয়ে কীর্তির এগিয়ে যাওয়া, কিন্তু বেরুল না।

সকালে খানের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে শুধাল, আজ তোমার পার্টি কখন শুরু হবে– মোটামুটি?

খান ইতস্তত করে বললে, তুমি যদি অনুমতি দাও তবে আমি একটু কাজ সেরে আসি। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের কাজ। এই ডামাডোলের বাজারে কিছুটা ব্যবসা গুটোতে হবে কিছুটা গুছোতে। নইলে যেতুম না।

বা রে, যাবে না কেন?

আরাম পেল খান। বললে, আর শোনো, যে ইংরেজ বাড়িটা বিক্রি করে সে তার বেশিরভাগ বই-ম্যাগাজিন রেখে গিয়েছে। বিলিয়ার্ড রুমের পাশের কামরায়। ইট্রেসটিং কিছু পেয়েও যেতে পারো।

কামরায় ফিরে দেখে, আয়া জরাজীর্ণ এক প্যাকেট তাসের প্রায় সব ক-খানা কার্পেটের উপর পেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে, কী যেন হিসাব করছে আর বিড়বিড় করছে আপন মনে।

হঠাৎ শিপ্রাকে দেখে চরম লজ্জা পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তাসগুলো এক ঝটকায় তুলে নিল। মাথা নিচু করে বার বার মাফ চাইল।

শিপ্রা সেদিকে যেন কানই দিল না। বরঞ্চ বলল, তা থামলে কেন? কী খেলছিলে, পেশেন্স?

একটু হিম্মত পেয়ে তার খিচুড়ি ভাষায় বললে, না, মিসিবাবা। আমি তার থেকে দেখছিলুম, কী কী হবে, মানে কী সব ঘটবে–

ফিউচার?

রাইট, মিসিবাবা। আর ভাগ্যগণনা। দুটো প্রায় একই। আমি যে মেমসায়েবের কাছে বাচ্চা বয়েস থেকে জোয়ানি ত নোকরি করেছি, তিনি আমায় তাসের বহুত কুছ থেল শেখান। আমার সঙ্গে রোজ দুপুরে খেলতেন। আমি ভেবেছিলুম, আপনার পায়ের শব্দ শুনতে পেলেই তাস ঝটপট তুলে নেব। বেয়াদবি মাফ করুন। আমি একদম মশগুল হয়ে গিয়েছিলুম।

কাট দ্যাট আউট। কোনও বেয়াদবি হয়নি। তা মশগুল হবার মতো কী পেয়েছিলে?

গম্ভীর স্বরে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাতে চেষ্টা করল। বলল, এই যে সবাই ভাবছে ফিনসে লড়াই শুরু হবে কি না, এক দফা জেসা হুয়া, সেইটে হবে কি না? মেমসাহেব বলত, আমি পাহাড়ি– সাদা-দিল-ঔরৎ। আমরা নাকি ওদের চেয়ে ঢের ভালো ফিউচার দেখতে পারি।

শিপ্রা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অলস কৌতূহলে শুধাল, কী দেখলে?

পাহাড়িনী কুঞ্চিত করে বললে, সব আন্ধেরা, আন্ধেরা। এসা বড় একটা হয় না। ফিসে দেখি। তাস শাফ করে শিপ্রার কাছে নিয়ে এসে বলল, টোকা দিজিয়ে। তা হলে উয়োঠো হোগা আপকা গিননা। শিপ্রা লক্ষ্মী মেয়ে। তুরন্ত টোকা দিল।

ইংরেজের ছেড়ে যাওয়া বইয়ের ভিতর সে পেয়েছে ইংরেজ লেখক উইলিয়ম মেকপিস থ্যাকারে ও সিলেট নিয়ে একখানা মোটা বই। তার জানা ছিল থ্যাকারের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। এই বইয়ের যে ক-খানা পাতা উল্টিয়েছে তাতে মনে হল লেখকের অন্য কোনও একটা নতুন গবেষণাপ্রসূত মতবাদ আছে। অবশ্য এটা ধ্রুব সত্য, থ্যাকারের পিতা সিলেটের সর্বময় কর্তা ছিলেন কিছুকাল। শিপ্রার চিন্তাধারা চলল অন্যদিকে। থ্যাকারে কি এসব মামোজাম্বোতে বিশ্বাস করতেন? কিপলিং। আজকাল তো বিস্তর হিপি করে।

আয়া গভীরতম মনোযোগ সহকারে এক-একখানা করে তাস ফেলে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে। এমনই বাহ্যজ্ঞানশূন্য যে শিপ্রার প্রশ্ন প্রথমটায় তার কানেই ঢোকেনি। সংবিতে ফিরে বলল, ঘোটালা, ফিসে ঘোটালা! এই তো দেখুন, বার বার পরপর তিনবার পাঞ্জা এসেছে। তো নিকলা, এক তরফমে পাঁচঠো আদমি। তার বাদে দেখিয়ে, দুটো দস্সা এসেছে। লাখ লাখ আদমি লেকিন মুশকিল আছে ইনকা। বোহ মুশকিল দোঠাই কালা দসসা। লেকিন উয়ো পাঁচঠো কিয়া? তিন বার আয়া। পেহলাই।

শিপ্রা অনুমান করল, দশের তাসগুলোকে আয়া জনতা হিসেবে নিয়েছে। কথায় বলে দশের মুখ খোদার তবল, এরই হুবহু লাতিন ভ পপুলি, ভস্ দেই; দশজনের গলা ঈশ্বরের গলা অতএব দশের তাস পপুলি, পাবলিক, জনারণ্য অর্থাৎ আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাদের বিপক্ষে আয়া প্রত্যাশা করেছে টেক্কা, কিংবা বাদশা অর্থাৎ ইয়েহিয়া। এসেছে পাঞ্জা। পঞ্চ আবৃ? পাঞ্জাব? হঠাৎ তার মনে পড়ল, লারি বলেছিল মির্জাকে, অনেকেরই বিশ্বাস, ইয়েহিয়ার তথাকথিত সমর্থক যে মিলিটারি জুন্টা আছে তারা সংখ্যায় পাঁচ এবং আসলে ওদের আদেশে ইয়েহিয়া ওঠবস করে। শিপ্রা আপন মনে হেসে উঠল। ধর্মরাজের পশ্চাতে পঞ্চপাণ্ডব। না তা হলে ইয়েহিয়াটা সাইফার। আয়াকে এই পাঞ্চজন্য তাসের মাহাত্ম্য বোঝাতেই সে আনন্দে ফেটে পড়ে আর কি! বার বার বলল, পুরানা মেমসায়েবের চেয়ে মিসিবাবার নজর বহু দূর দূর যায়, কাঁহা কাহা মুলুকে। বেরুল পরপর রুইতন আর ইস্কাপনের টেক্কা।

শিপ্রা, আয়া দু জনাতেই একই ওয়াটারলুতে। পরাজয়। কোনও অর্থ বেরয় না।

ভারত, পূর্ব বাঙলার কটা লোক তখন জানত, ইয়েহিয়া হারেমের পাটরানি হবার জন্য চলেছে তখন জোর লড়াই। একজন ফর্সা পশ্চিম পাকি– লোকে তার নাম দিয়েছে। জেনারেল রানি; অন্য জন পুব বাঙলার শ্যামা, ডাকনাম ব্ল্যাক বিউটি।

এসব হোকাস পোকাসে শিপ্রার মতো মেয়ের কৌতূহল দুরন্ত বাচ্চার হাতে বেলুনের মতো দীর্ঘজীবী। শিপ্রা পুস্তকের সুগন্ধি বাগিচায় ডুব মারল। আরব কবি বলেছেন, পুস্তক সে যেন একটি বাগান, যেটাকে পকেটে পোরা যায়। তার পর আয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টির ফলাফল শিপ্রার কানে আর যায়নি।

শুধু একবার শুনল, মুজিব। সঙ্গে সঙ্গে এলেন হরতনের বিবি মুজিবের বিবি। তার বাদেই পরপর দুটো কালো গোলাম। ভেরি ব্যাড়, ভেরি ব্যাড়। উনি বন্দি অবস্থায় গোলামদের পাহারায় থাকবেন কয়েক মাস।

আয়া যখন শেষটায় সব তাস গুটিয়ে নিল তখন হাই তোলার আভাসটা হাত দিয়ে চেপে শিপ্রা শুধাল, হরেদরে কী দাঁড়াল?

আয়া ভদ্রতা জানে। বললে, বড় খারাব তাস এককে বাদ দুসরা। লেকিন এদের নসিব ঔরভি খারাব হত যদি না মিসিবাবা টোক দিতেন। স কে সব বদ কিস্যুৎ। সক্কলের কপালে দুঃখ। তসল্লি (সান্ত্বনা) বস ইয়েহ– দুঃখের শেষে সুখ বেশি আখেরে।

তা হলেই হল, আনমনে বলল সে।

 আয়া শুধাল, আপনার নসিব দেখব?

প্লিজ ইয়োরসেলফ।

এবারে পুরো তাসে টোকা মারল আয়া নিজেই। শিপ্রা আবার তার বই-বাগানে হেথা-হোথা ঘুরতে লাগল। বাগানটা কিন্তু তেমন আ মরি আ মরি করার মতো নয়। যদি সিলেটি বান্ধবী বিলকিসের সঙ্গে দেখা হয় তবে বইটার কথা তাকে বলবে। কিন্তু কোথায় কোন গ্রামাঞ্চলের জমিদারবাড়িতে হল তার বিয়ে। আবার দেখা হবার সম্ভাবনা কতখানি? হায়, শিপ্রা জানত না, ত্রিপুরা পাহাড়ের উপর দিয়ে আসবার সময় সে যেসব হাওর দেখেছিল তারই একটার পারে বিলুকিদের বাড়ি, টিলার উপর, প্লেন থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল মাত্র। পুনরায় ডবল হায়, হায়। জানা থাকলেই-বা কী হত?

না, সে খুঁজত এলোপাতাড়ি এবং ডাউন করতে পারত না। কিন্তু তাতেও তো আছে সুখে-দুঃখে মেশানো ছোট্ট একটি অনুভূতির আবেশ।

আয়া যেন বসে বসে উল্লাসে নৃত্য করছে। এরকম একটার পর একটা নিরবচ্ছিন্ন খুশ- কিস্মতের তাস সে কভি ভি দেখেনি। আচ্ছি শাদি, আচ্ছে বাল-বাচ্চে–ভুরু কুঁচকে বলল, লেকি কম। মাত্র কটি এই কথাই তার কানে এসেছিল। বিলকুল বোগাস! মুচকি হেসে ভাবল, পাহাড়িদের ভিতরও তা হলে আর‍্যা গান্ধারী মাতুকুল শ্রেষ্ঠা!

অকস্মাৎ শিপ্রার খেয়াল গেল অকস্মাত্তর বেগে আয়া উপু হয়ে দু হাত দুবাহু দিয়ে সব তাস গুটিয়ে নিচ্ছে। শুধাল, কী হল?

নিশ্চুপ।

শিপ্রা একটুখানি কাত হয়ে আয়ার মুখের দিকে তাকাল। সে ইতোপূর্বে বিস্তর মঙ্গোলিয়ান টাইপের পাহাড়ি মেয়ে দেখেছে, এবং লক্ষ করেছিল, এদের ভাব-পরিবর্তন মুখের ওপর অতি সামান্য রেখা আঁকে, রঙ পালটায়। এখন দেখে, আয়ার মুখ যেন কালো হয়ে গিয়েছে ছোট্ট বাচ্চা কাঁদবার আগে যেরকম মুখ বিকৃত করে অনেকটা সেইরকম।

অবাক হয়ে শুধাল, কী হল তোমার? খারাপ কিছু একটা দেখেছ? তুমি বড় সিমল। এসব কখনও কি সত্যি সত্যি ফলে? না হয় আমাকে বলেই দেখো, আমি কীভাবে নিই।

না পুছিয়ে মিসিবাবা। বলা শেষ হওয়ার পূর্বেই, সেই কবেকার বাচ্চা বয়েস থেকে তার হাড়ে হাড়ে লোমে লোমে যেসব ভদ্রতম দেশি-বিলিতি এটিকেট ঢুকে গিয়েছে, সেগুলো এক লহমায় ভুলে গিয়ে খাস পাহাড়ি মেয়ের মতো দুই হাঁটুর উপর শাড়ি টেনে তুলে ছুট দিল বাবুর্চিখানার দিকে।

শিপ্রা একটু মুচকি হাসল। সামান্য তাসের হেরফের ভুলিয়ে দিল সরলা পাহাড়িনীর পূর্ণজীবনের অভ্যাস, শালীনতাবোধ অবশ্য আয়ারই মতে– সেটা অলক্ষ্মনীয় শালীনতা, সামান্য দু খানা তাস এক টানে তাকে নিয়ে গেল সেই দুর্গন্ধ অন্ধকার গিরিগুহায়, তার ভিতরটা এক লহমায় ভরে দিল যুগ যুগ সঞ্চিত তার পিতৃপিতামহ পূর্বপুরুষদের ভীতি দিয়ে হিংস্র জন্তুর ভয়, ঝঞ্ঝা-বিদ্যুতের ভয়, সভ্য বিদেশির বন্দুকের ভয় এবং সবচেয়ে বড় ভয়– পৈশাচিক প্রেত-দৈত্যের দানবিক অট্টহাস্যের বিভীষিকা।

সব জানে, সব বোঝে শিপ্রা কিন্তু তবু তার মনটা খচখচ করতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *