তুলনামূলক আলোচনা : কোরআন ও বাইবেল

তুলনামূলক আলোচনা –কোরআন ও বাইবেল

এমন অনেক বিষয়ের বর্ণনা বাইবেলে রয়েছে যেসবের বিবরণ কোরআনেও দেখা যায়। উভয় ধর্মগ্রন্থে যেসব নবীর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাঁদেরমধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় হযরত নূহ, ইবরাহীম, ইউসূফ, ইলিয়াস, ইউনুস, আইয়ুব ও হযরত মুসার (আঃ) কথা।

যেসব রাজা-বাদশাহর কাহিনী উভয় ধর্মগ্রন্থে রয়েছে তন্মধ্যে সৌল, দাউদ ও সোলায়মানের নাম উল্লেখযোগ্য। উভয় ধর্মগ্রন্থের নানাবর্ণনায় এদের নাম ঘুরেফিরে এসেছে। এছাড়াও বিশেষ এমন কতকগুলো ঘটনার বর্ণনা উভয় ধর্মগ্রন্থে বিদ্যমান যেসব ঘটনা অলৌকিক প্রভাবের ফল। যেমন : পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলের সৃষ্টি, মানুষের সৃষ্টি, মহাপ্লাবন এবং একোডাস বা ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা প্রভৃতি। পরিশেষে, বাইবেলের নতুন নিয়মে (ইঞ্জিল) হযরত ঈসা ও তার মা মরিয়ম সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। এদের সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে কোরআনেও।

এই দুই ধর্মগ্রন্থে যেসব বিষয় বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো যখন আধুনিক জ্ঞানের আলোকে, বিশেষত সেকুলার তথ্যজ্ঞানের নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়, তখন কোন্ চিত্র পাওয়া যায়?

কোরআন, ইঞ্জিল ও আধুনিক বিজ্ঞান

কোরআনের সাথে বাইবেলের নতুন নিয়মের সুসমাচারসমূহের (ইঞ্জিলের প্রথম থেকে চতুর্থ খণ্ড) তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। সেই কথাটি হল : সুসমাচারসমূহের যেসব অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যজ্ঞানের বিচারে সমালোচনাযোগ্য।

কোরআনে বহুবারই হযরত ঈসার কথা (যীশুখ্রিস্ট) উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন–পিতৃগৃহে হযরত মরিয়মের জন্ম, হযরত মরিয়মের মধ্যে অলৌকিকত্বের আভাস, উচ্চ পর্যায়ের নবী হিসেবে হযরত ইসার মর্যাদা, মসীহ্ বা ত্রাণকর্তা হিসেবে তার ভূমিকা, তার উপরে অবতীর্ণ ওহীর মাধ্যমে মানবসমাজে তাওরাতের সত্যতার ঘোষণা ও তার সংস্কার সাধন, তার ধর্মপ্রচার, তাঁর প্রেরিত ও শিষ্যবৃন্দ, তাঁর অলৌকিক কার্যকলাপ, আল্লাহর নিকট তাঁর উঠে যাওয়া, শেষ বিচারদিনে তার ভূমিকা প্রভৃতি নানাবিষয়ের বর্ণনা কোরআনে বিদ্যমান।

কোরআনের ৩ নং সূরা ও ১৯ নং সূরার (এই ১৯ নং সূরাটি সূরা মরিয়ম নামে পরিচিত) বেশকিছু দীর্ঘ আয়াত হযরত ঈসার পরিবার স্বজন তথা মাতৃকুল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এসব আয়াতে হযরত মরিয়মের জন্ম, তার যৌবনকাল এবং অলৌকিক উপায়ে তার মাতৃত্বলাভের বর্ণনাও স্থান পেয়েছে। কোরআনে হযরত ঈসাকে সবসময়ই “মরিয়ম-পুত্র” বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং হযরত ইসার পূর্বপুরুষদের তালিকার বর্ণনায় স্থান পেয়েছে তার মাতৃকূল। যেহেতু যীশুখ্রিস্ট অর্থাৎ হযরত ঈসার দৈহিক দিক থেকে কোনো পিতা ছিলেন, সেহেতু তার বংশাবলীর ক্ষেত্রে তার মাতৃকূলের বংশপরিচয়-সংক্রান্ত কোরআনের এই বক্তব্য ও বর্ণনা একান্ত যুক্তিসঙ্গত। এখানে মথি ও লুক-লিখিত সুসমাচারের (বাইবেল/ইঞ্জিল) সাথে কোরআনের বর্ণনার পার্থক্য সুস্পষ্ট। মথি ও লুক একান্ত অযৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও হযরত ঈসার তথাকথিত পিতৃকুলের বংশলতিকা তুলে ধরেছেন এবং সেখানেও এই দুই লেখকের মধ্যে বর্ণনার গরমিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

কোরআনে হযরত ইসার মাতৃকুলের বংশলতিকা টানা হয়েছে-হযরত নূহ ও হযরত ইবরাহীম হয়ে হযরত মরিয়মের পিতা (কোরআনে তাকে বলা হয়েছে ইমরান) পর্যন্ত।

“আল্লাহ্ বাছিয়া নিয়াছেন আদম, নূহ্ ও ইবরাহীমের পরিবার এবং ইমরানের পরিবারকে তাঁহার সমস্ত সৃষ্টির উপরে–তাহারা একজন হইতে আরেকজন।”–সূরা ৩ : আয়াত ৩৩ ও ৩৪।

অর্থাৎ, হযরত ঈসা তার মা হযরত মরিয়ম এবং মরিয়মের পিতা ইমরানের মাধ্যমে হযরত নূহ এবং হযরত ইবরাহীমের বংশধর। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাইবেলের নতুন নিয়মের সুসমাচারসমূহে অর্থাৎ ইঞ্জিল যীশুর পূর্বপুরুষবর্গের নাম-তালিকা প্রণয়নে যে ভুল করা হয়েছে, কোরআনে সেরকম কোনো ভুল নেই। শুধু তাই নয়, বাইবেলে পুরাতন নিয়মে অর্থাৎ তওরাতে হযরত ইবরাহীমের বংশ-তালিকায় তার পূর্বপুরুষগণের যে অবান্তর তালিকা তুলে ধরা হয়েছে, কোরআন সেই ত্রুটি থেকে মুক্ত।

সকলকে এই সত্য স্বীকার করে নিতেই হবে, মোহাম্মদ (দঃ) নিজে। কোরআন রচনা করেছিলেন বলে যে ধারণা করা হয়, তা আগাগোড়াই ভুল। শুধু তাই নয়, পূর্বোক্ত বিচার-বিশ্লেষণ থেকে মোহাম্মদ (দঃ) কোরআন রচনা করেছিলেন বাইবেল নকল করে সেই ধারণাও সুস্পষ্টভাবে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। বিচার-বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে-আসা এই যে সত্য, তার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ওইসব ধারণা সত্য হলে, প্রশ্ন জাগে যে, মোহাম্মদ (দঃ) যদি বাইবেল থেকে কোরআন নকল করে থাকেন তাহলে বাইবেলে বর্ণিত যীশুর পূর্বপুরুষগণের নাম-তালিকা কেন, কি কারণে তিনি হুবহু নকল করলেন না? কে তাঁকে তা নকল করতে বাধা দিয়েছিল?

যদিও এখানেই প্রশ্নের শেষ নয়, বরং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই পর্যায়ে মোহাম্মদকে (দঃ) বাইবেলের অশুদ্ধ ও অবাস্তব তালিকা শুধু করতে এবং সেই শুদ্ধ তালিকা কোরআনে বর্ণনায় স্থান দিতে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল কে এবং কোরআনে বর্ণিত যীশুর (হযরত ইসার) পূর্বপুরুষগণের পরিচয় সর্বাধুনিক তথ্যজ্ঞানের নিরিখে এখন সকলরকম সমালোচনার ঊর্ধ্বে বিরাজ করছে। পক্ষান্তরে, বাইবেলে বর্ণিত যীশুর বংশাবলীপত্র কোরআনের বর্ণনার বিপরীত, এবং আধুনিক তথ্যজ্ঞানের নিরিখেও অগ্রহণযোগ্য।

মোদ্দাকথা, কোরআন মোহাম্মদ (দঃ) কর্তৃক রচিত হওয়ার অবাস্তব বক্তব্য এবং বাইবেল থেকে তার কোরআন নকল করার’ অবান্তর দাবি এই একটিমাত্র পর্যালোচনায় সম্পূর্ণভাবেই নাকচ হয়।

ইতিমধ্যে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এবং নতুন নিয়মের সাথে বেশকিছু বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এই পুস্তকে বাইবেল পুরাতন নিয়মের বিশ্বসৃষ্টির বর্ণনার উপর যে গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে, তা উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে, একইবিষয়ে কোরআনে যে বর্ণনা রয়েছে, তাও যথাযথভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। উল্লিখিত দুই বিচার-বিশ্লেষণের ফলাফল সম্পর্কে এই পর্যায়ে নতুন করে আলোচ্য আর কিছু নেই।

বাইবেলে বর্ণিত রাজা-বাদশাদের কাহিনীর পর্যালোচনায় এবারে আসা যাক। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, এক্ষেত্রে আধুনিক ঐতিহাসিক জ্ঞান যেমন অস্পষ্ট, প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্তও তেমনি অপ্রতুল। এই অবস্থায় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে কোরআন ও বাইবেলে বর্ণিত রাজা-বাদশাহদের কাহিনীর উপরে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ সত্যি দুরূহ।

নবীগণের কাহিনী সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে ওই দুই ধর্মগ্রন্থে পাশাপাশিভাবে যেসব নবীর কাহিনী ও ঘটনা বর্ণিত রয়েছে, সে-সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞান-গবেষণা এখনো তেমন বেশিকিছু জানাতে পারছে না। সুতরাং, এক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচার-পর্যালোচনা যথার্থ হওয়া অসম্ভব।

যাহোক, পূর্বোক্ত দুটি বিষয় ছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয় কোরআন ও বাইবেলে বর্ণিত রয়েছে, যা মনোযোগ আকর্ষণ করে। এখন যে তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, তার আলোকে উক্ত দুটি বিষয়ের উপর অনায়াসেই বিচার-বিশ্লেষণ চালানো যায়। বিষয় দুটি :

মহাপ্লাবন; এবং

ইহুদীদের মিসরত্যাগ।

প্রথম, মহাপ্লাবনের ব্যাপারটি সার্বিকভাবে মানব-সভ্যতার ইতিহাসে তেমন কোনো স্বাক্ষর রেখে যায়নি। যেমনটি বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে। ফলে, বাইবেলের বর্ণনায় বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবনের যে কাহিনী প্রচলিত রয়েছে আধুনিক তথ্যজ্ঞানের আলোকে তা অসমর্থনযোগ্য। পক্ষান্তরে, একই মহাপ্লাবনের কাহিনী কোরআনে বর্ণিত রয়েছে। যা আধুনিক প্রতিষ্ঠিত তথ্যজ্ঞানের আলোকে মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত কোরআনের সেই বর্ণনার কোনো বিরূপ সমালোচনা করা অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, ইহুদীদের মিসরত্যাগের ব্যাপারে বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনা প্রমাণভিত্তিক এবং বৃহত্তর পরিধিতে তা একে অপরের পরিপূরক। তাছাড়া, আধুনিক গবেষণা ও তথ্যজ্ঞানও উভয় ধর্মগ্রন্থের এতদসংক্রান্ত বর্ণনার প্রতি উল্লেখযোগ্যভাবেই ঐতিহাসিক সমর্থন দিচ্ছে।

বাইবেলের (পুরাতন নিয়ম) মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত বর্ণনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় :

বাইবেলে মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত বর্ণনা দুটি এবং দুটি বর্ণনা রচিত হয় দুটি ভিন্ন সময়ে;

খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত বাইবেলের জেহোভিস্ট পাঠের বর্ণনার রচনাকাল; এবং

সেকেরডোটাল পাঠে বর্ণিত মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত বিবরণ রচিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সেকেরভোটাল পুরোহিতদের রচিত বলেই বাইবেলের এই পাঠের এই নামকরণ।

এ দুটো পাঠের বর্ণনা আলাদা নয়; বরং একটার সাথে আরেকটা এমনভাবে গেঁথে রয়েছে যে, দুটো পাঠ-ই ওতপ্রোতভাবে জুড়ে রয়েছে। অন্যকথায়, একটা অনুচ্ছেদ থেকে একটা পাঠের কিছু অংশ মুছে দিয়ে আরেকটা পাঠের কিছু অংশ এনে সে জায়গটা পূরণ করা হয়েছে। জেরুজালেমের বাইবেল শিক্ষায়তনের অধ্যাপক ফাদার ডি. ভক্স তার বাইবেলের আদিপুস্তকের অনুবাদের ভাষ্যে স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, বাইবেলের বর্ণনায় কিভাবে উল্লিখিত দুটি পাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, কোনো বর্ণনা সম্ভবত জেহোভিস্ট পাঠ দিয়ে শুরু ও শেষ হয়েছে। কিন্তু এর মাঝখানেই ভরে দেয়া হয়েছে সেকেরডোটাল পাঠ। এ ধরনের জেহোভিষ্ট পাঠ দিয়ে শুরু ও শেষ এমন অনুচ্ছেদ শুধু আদিপুস্তকেই (বাইবেল) পাওয়া গেছে দশটি (অনুরূপ সেকেরডোটাল অনুচ্ছেদের সংখ্যা হচ্ছে নয়টি)। কোনো একটা ঘটনা জানার জন্য এ ধরনের জোড়াতালি দেয়া বর্ণনায় অবশ্য তেমন কোনো অসংলগ্নতা নেই মনে হয়। কিন্তু একটু গভীর বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই দুই পাঠের মধ্যে স্ববিরোধিতা বিদ্যমান মারাত্মক ধরনের।

উদাহরণস্বরূপ মহাপ্লাবনের কথা উল্লেখ করা যায় সেই ভিন্নদৃষ্টির গভীরতর বিচার-বিশ্লেষণে ফাদার ডি. ভক্স বাইবেলের মহাপ্রাবনের বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন, “বাইবেরে মহাপ্লাবনের দুটি বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এই মহাপ্লাবনের যে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে–এই বর্ণনামতে তার কারণ ছিল ভিন্ন। দুই বর্ণনায় মহাপ্লাবন কতকাল স্থায়ী হয়েছিল, সেই সময়কালও ভিন্ন। তাছাড়া, হযরত নূহ (আঃ) তাঁর নৌকায় কতটি জন্তু-জানোয়ার তুলে নিয়েছিলেন সে বিষয়ে ওই দুই বর্ণনার মধ্যে রয়েছে পার্থক্য।”

আধুনিক তথ্যজ্ঞানের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণে বাইবেলের মহাপ্লাবন সংক্রান্ত এই বর্ণনা সম্পূর্ণভাবেই অগ্রহণযোগ্য। যথা :

(ক) বাইবেলের পুরাতন নিয়মে, এই মহাপ্লাবন সংঘটিত হয় গোটা বিশ্বব্যাপী এবং এরফলে গোটা বিশ্বে মারাত্মক ধ্বংসলীলা সাধিত হয়।

(খ) বাইবেলের জেহোভিস্ট পাঠের বর্ণনায়, মহাপ্লাবন সংঘটিত হওয়ার কোনো সময়কাল উল্লেখ নেই। কিন্তু সেকেরডোটাল পাঠে এই মহাপ্লাবন তথা বিশ্বব্যাপী এই ধ্বংসলীলা বিশেষ একটা সময়কালে সংঘটিত হয়েছিল বলা হয়েছে। অথচ, উক্ত সময়কালে বিশ্বব্যাপী ওই ধরনের কোনো ধ্বংসলীলা সংঘটিত হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।

এই অভিমতের সমর্থনে ও সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে সেকেরভোটাল পাঠে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, এই মহাপ্লাবন যখন সংঘটিত হয় তখন হযরত নূহের বয়স ছিল ৬০০ বছর। এদিকে বাইবেলের আদিপুস্তকের পঞ্চম অধ্যায়ের বংশাবলীপত্রে (এটি সেকেরভোটাল পাঠ থেকে গৃহীত এবং এই পুস্তকে বলে দেয়া হয়েছে যে, হযরত আদমের ১৬৫৬ বছর পরে এই মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়। অন্যদিকে, বাইবেলের আদিপুস্তকের সেকেরভোটাল পাঠেরই বর্ণনায় (১১, ১০-৩২) রয়েছে হযরত ইবরাহীমের বংশাবলীপত্র। আর সেই বংশাবলীপত্রের হিসেব থেকে দেখা যায়, হযরত ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেছেন মহাপ্লাবনের ২৯২ বছর পর। বাইবেলের বর্ণনা থেকে জানা গেছে যে, হযরত ইবরাহীম মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫০ সালের দিকে জীবিত ছিলেন। তাহলে মহাপ্লাবন সংঘটনের সময়কাল দাঁড়ায় খ্রিস্টপূর্ব একুশ বা বাইশ শতাব্দীর দিকে। বাইবেলের বংশাবলীপত্রে বর্ণিত সময়ের গণনা যে আদৌ সঠিক নয়, সে সম্বন্ধে আধুনিক মানুষের হাতে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত তথ্য, প্রমাণ ও হিসেব এসে গেছে। সুতরাং, বাইবেলের সেকেরডোটাল পাঠের লেখকদের ওইসব মনগড়া হিসেব এখন আর কারো নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। মজার ব্যাপার, আধুনিক যুগে প্রকাশিত বাইবেলের কোনো সংস্করণেই এখন আর ওইসব হিসেব আগের মত কাহিনীর শুরুতে দেখা যায় না; ওইসব হিসেব একেবারেই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাইবেলের মূল বর্ণনায় বংশাবলীপত্রের নামে এখনো ওইসব হিসেব চালু রয়েছে এবং বাইবেলের আধুনিক কোনো ভাষ্যকার ভুলেও সে ভুলের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন না। অথচ, তাঁদের সেই ভাষ্যগুলো নাকি রচিত হয়েছে সাধারণ পাঠকদের জন্যই। অতীতের পুরাতন সংস্করণের বাইবেলগুলোতে কাহিনী শুরুর প্রথমেই বেশ গুরুত্ব দিয়ে সময়কালের এইসব হিসেব প্রকাশ করা হত। সেই হিসেব অনুসারেই এই সময়কালের হিসেব গণনা করা হয়েছে। তবে, যেকালে ওই ধরনের হিসেব সম্বলিত বাইবেল প্রকাশিত হত, সেকালে মানুষদের নাগালের মধ্যে আজকের যুগের মত এতসব তথ্য-পরিসংখ্যান ছিল না। সুতরাং, বাইবেলে বর্ণিত ওইসব বংশাবলীপত্র তথা হিসেব কতটা সঠিক, তা নির্ণয় করা তখনকার কোনো মানুষের পক্ষে কঠিন ছিল বৈকি। ফলে, ওই ধরনের ভিত্তিহীন হিসেব-সম্বলিত বাইবেলের যাবতীয় বক্তব্য বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করতে সেকালের মানুষদের কোনো অসুবিধা হতো না।

মহাপ্লাবনের যেকথা বাইবেলে বর্ণিত তা আধুনিক তথ্যজ্ঞানের তুলনামূলক বিচারে এখন একথা বিশ্বাস করা অসম্ভব যে, এইমাত্র খ্রিস্টপূর্ব একুশ বা বাইশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ওইরকম এক মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়েছিল; এবং সেই মহাপ্লাবনে সারা দুনিয়ার সবকিছু অর্থাৎ, জমিনের উপরের সমস্তকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল শুধু রক্ষা পেয়েছিল নূহের নৌকার লোজন ও জন্তু-জানোয়ার। ইতিহাস জানিয়ে দিচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব ওই একুশ ও বাইশ শতাব্দীর দিকে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় নানা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং সেসব সভ্যতার নানা নির্দশন এখন পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, এখনো সেসব নিদর্শন বিরাজ করছে একটি উদাহরণে বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠবে। আধুনিক ইতিহাসের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি, ওই সময়টাতে মিসরে পুরাতন রাজত্বের অবসান ও মধ্যবর্তী রাজত্বের সূচনা ঘটে। এদিকে, ওই সময়কার মিসরীয় সভ্যতার বহুকিছু ইতিহাস ও নিদর্শনাবলী এখনো বিরাজমান। সুতরাং, ওই এলাকার ওই সময়ের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে এতকিছু জানার ও প্রত্যক্ষ করার পর একথা এখন আর কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না যে, তখন সংঘটিত ওই মহাপ্লাবনে বিশ্বব্যাপী মানুষের সব সভ্যতাই সমূলে ধ্বংস হয়েছিল।

অতএব, ঐতিহাসিক বিচার বিশ্লেষণে এটা স্বীকার না করে উপায় থাকে না যে, বাইবেলে মহাপ্লাবন সংক্রান্ত যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা আধুনিক তথ্যজ্ঞানের নিরিখে বাস্তব প্রমাণের বিপরীত। মূলত, বাইবেলের বিভিন্ন রচনায় মানুষের হস্তক্ষেপের যে প্রমাণ ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে, মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত এই দুটি পাঠের বর্ণনার মধ্যেও তার পরিচয় সুস্পষ্ট।

মহাপ্লাবন সম্পর্কে কোরআনে যে বর্ণনা রয়েছে, তা বাইবেলের বিবরণ থেকে শুধু পৃথকই নয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের বিচারেও মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত কোরআনের এই বর্ণনার বিরোধিতা ও সমালোচনা করার ক্ষেত্র এবং অবকাশ নেই।

কোরআনে মহাপাবনের ধারাবাহিক কোনো বিবরণ নেই। বিভিন্ন সুরায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই মহাপ্লাবনের মাধ্যমে নূহের জাতির উপর গজব নেমে এসেছিল। এ বিষয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পাওয়া যায় কোরআনের ১১ নং সূরার ২৫ থেকে ৪৯ নং আয়াতে। কোরআনের ৭১ নং যে সূরাটি সূরা নূহ নামে পরিচিত, তাতে হযরত নূহের ধর্মপ্রচারের কথাই বেশি করে বয়ান করা হয়েছে। ২৬ নং সূরার ১০৫ থেকে ১১৫ নং আয়াতের বর্ণনাও একইধরনের। যাহোক, কোরআনের বর্ণনানুসারে সেই মহাপ্লাবনে কি ঘটেছিল, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমেই বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন, কি কারণে এই মহাপ্লাবন হয়েছিল। কোরআনের মতে, যখন কোনো জাতি বা সম্প্রদায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে নিদারুণভাবে পাপাচারে লিপ্ত হয় তখন সে জাতির উপর আল্লাহর গজব নেমে আসে।

বাইবেলে বলা হচ্ছে, ধর্মীয় দিক থেকে অধঃপতিত ‘গোটা মানবজাতিকে শাস্তিপ্রদানের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী এক মহাপ্লাবন হয়েছিল। কোরআনে সে বক্তব্যের বরং বিরোধিতাই করা হচ্ছে। কোরআনের মতে, বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক জাতির উপরই নেমে এসেছিল বিভিন্ন ধরনের গজবঃ এমনি ধরনের এক গজব ছিল এই মহাপ্লাবন। কোরআনের ২৫ নং সূরার ৩৫ থেকে ৩৯ নং আয়াতে সে কথাটিই বলা হয়েছে এভাবে:

“আমরা দিয়েছিলাম মুসাকে কিতাব এবং নিয়োগ করেছিলাম তার ভাই হারুনকে তাহার উজির বা সাহায্যকারী। আমরা বলেছিলাম? যাও সেইসব লোকদের নিকট যাহারা অস্বীকার করেছে আমাদের নিদর্শনাবলী। আমরা ধ্বংস করেছিলাম তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে। যখন নূহের জাতি নবীদের অস্বীকার করিল, আমরা তাদের ডুবাইয়া দিয়েছিলাম, তাদের বানিয়ে দিয়েছিলাম নিদর্শন মানবজাতির জন্য। আদ, সামুদ ও রাস-এর সঙ্গীদের এবং তাদের মধ্যবর্তী অনেকের (সম্প্রদায়গুলোকে আমরা ধ্বংস করেছিলাম)। আমরা সতর্ক করেছিলাম তাদেরকে নিদর্শনাবলীর দ্বারা এবং আমরা নির্মূল করেছি তাদের সম্পূর্ণরূপে।”

এমনিইভাবে ৭ নং সুরার ৫৯ থেকে ৯৩ নং আয়াতেও কিভাবে নৃহের জাতি, এবং আদ, সামুদ, লুত (সডোম) ও মাদিয়ান সম্প্রদায়ের উপর গজব নেমে এসেছিল তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

এভাবেই কোরআন জানিয়ে দেয় যে, মহাপ্লাবনের যে ধ্বংসলীলা গজবের আকারে নেমে এসেছিল, তা বিশেষভাবে নির্ধারিত ছিল নূহের জাতির জন্য? বাইবেলের বিবরণের সাথে কোরআনের বর্ণনার মৌল পার্থক্য এখানেই।

দ্বিতীয় বুনিয়াদী তফাতটা হল, বাইবেলে যেখানে মহাপ্লাবনের সময়, তারিখ ও মেয়াদকাল উল্লেখ রয়েছে, সেখানে কোরআন এ সম্পর্কে কিছুই বলছে না, না মহাপ্লাবনের কোনো দিন-তারিখ, না তার স্থায়িত্বকাল।।

মহাপ্লাবনের কার্যকারণ সম্পর্কে উভয় ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা মোটামুটিভাবে একইরকম। বাইবেলের সেকেরডোটাল বর্ণনায় (আদিপুস্তক ৭, ১১) মহাপ্লাবনের দুটি কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই কার্যকারণ দুটি একইসঙ্গে ঘটেছিল : “ওইদিন মহাজলধির সমস্ত উনুই ভাঙিয়া গেল এবং আকাশের বাতায়ন সকল মুক্ত হইল।” কোরআনে এ সম্পর্কে ৫৪ নং সূরার ১১ ও ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

“আমরা খুলিয়া দিলাম, আসমানের দরওয়াজাসমূহ অতিবর্ষণের সহিত এবং মাটিতে তীব্র প্রস্রবণ সৃষ্টি করিলাম–যেন পানি একত্রিত হইয়া হুকুম অনুযায়ী তাহা সমাধা করে যা নির্ধারিত।”

নূহের নৌকায় যা-কিছু ছিল, সে সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। আল্লাহ্ হযরত নূহকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বস্ততার সাথে তা পালন করেছিলেন। যেমন :

“(নৌকায়) প্রত্যেক জিনিসের এক জোড়া তুলিয়া নাও; তোমার পরিবারবর্গকে এই একজন বাদেযাহার বিরুদ্ধে আল্লাহর নির্দেশ জারি হইয়া গিয়াছে,এবং যাহারা বিশ্বাসী। তবে, অল্পসংখ্যক লোকজনই তাহার সহিত ঈমান আনিয়াছিল।”

যে ব্যক্তিটি হযরত নূহের পরিবার থেকে বাদ গিয়েছিল সে ছিল হযরত নূহেরই পথভ্রষ্ট সন্তান। আমরা জানি (সূরা ১১, আয়াত ৪৫ ও ৪৬), কিভাবে তার সম্পর্কে হযরত নূহের আরজি ব্যর্থ হয়েছিল : আল্লাহ্ নিজের হুকুম রদ করেননি। নূহের পরিবারবর্গ ছাড়া (অবশ্য ওই গোমরাহ্ ছেলেটি বাদ দিয়ে) আর মাত্র সামান্য কয়েকজনই ওই নৌকায় আরোহী ছিলেন, এঁরা ছিলেন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী।

পক্ষান্তরে, বাইবেলের বর্ণনায়, ওই নৌকার মধ্যে বিশ্বাসীগণ ছিলেন কি না সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। আসলে, নৌকার আরোহীদের ব্যাপারে বাইবেলে মোট তিন ধরনের আলাদা আলাদা বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা :

বাইবেলের জেহোভিস্ট বর্ণনায় পবিত্র পশু ও পাখি এবং অপবিত্র পশু পাখির মধ্যে একটি পার্থক্য টানা হয়েছে (সাত জোড়া করে অর্থাৎ প্রতিটি পবিত্র প্রজাতির মধ্য থেকে সাতটি পুরুষ ও সাতটি নারী প্রজাতি নৌকায় গ্রহণ করা হয়েছিল পবিত্র-অপবিত্র নির্বিশেষে প্রতিটি প্রজাতির মাত্র এক জোড়া করে। এখানে সাত’ শব্দের দ্বারা নিশ্চিতভাবেই বহু’ বোঝানো হয়েছে, কেননা সেকালে সেমিটিক ভাষায় অনেক সময় বহু’ বোঝাতে সাত উল্লেখ করা হত)।

সংশোধিত জেহোভিস্ট বর্ণনানুসারে (আদিপুস্তক ৭,৮) নৌকায় গ্রহণ করা হয়েছিল পবিত্র-অপবিত্র নির্বিশেষে প্রতিটি প্রজাতির মাত্র এক জোড়া করে।

পক্ষান্তরে, বাইবেলেরই সেকেরডোটাল বর্ণনায় রয়েছে, নৌকায় ছিলেন হযরত নূহ্ ও তাঁর পরিবারবর্গ (কেউ বাদ যায়নি)। আর সেই নৌকায় গ্রহণ করা হয়েছিল প্রত্যেক প্রজাতি থেকে এক জোড়া করে।

মহাপ্লাবনের ধারণা কি ছিল সে সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে কোরআনের ১১ নং সূরার ২৫ থেকে ৪৯ নং এবং ২৩ থেকে ৩০ নং আয়াতে। কোরআনের এই বর্ণনার সাথে বাইবেলের মহাপ্লবনের ধরন-সংক্রান্ত বর্ণনার তেমন কোনো পার্থক্য নেই যা উল্লেখ করার মত।

বাইবেলের বর্ণনামতে, হযরত নূহের নৌকা আরারাত পর্বতমালায় গিয়ে ঠেকেছিল (আদিপুস্তক ৮, ৪) আর কোরআনে বলা হয়েছে, পর্বতটি হচ্ছে ‘জুদি’ (সূরা ১১, আয়াত ৪৪)। উল্লেখ্য যে, এই জুদি পর্বত হচ্ছে আরমেনিয়াস্থ আরারাত পর্বতমালার মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, দুই ধর্মগ্রন্থের বর্ণনার সাথে সঙ্গতি রাখার বাসনায়-পরবর্তীকালের লোকেরা যে ওই পর্বতমালা ও পর্বতটির নাম বদলে দেয়নি, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। আর ব্লাশার রচনাতেও একথার প্রমাণ মেলে। তাঁর মতে, আরব দেশেও ‘জুদি’ নামে একটি পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। নামের এই মিল দেখে ধারণা করা হয়, আরবের পর্বতশৃঙ্গের ওই নামটি পরে প্রদত্ত।

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, এই মহাপ্লাবনের ব্যাপারে বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনায় কি ধরনের প্রধান প্রধান পার্থক্য বিদ্যমান, তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া সম্ভব। যদিও এখনপর্যন্ত কোনো কোনো বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ার কারণে এই পার্থক্যের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভবত অসম্ভব। তবে, ইতিমধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠিত তথ্য ও প্রমাণ আমাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে এবং বিভিন্ন আবিষ্কার আধুনিক জ্ঞানভাণ্ডারকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তার আলোকে বলা যায় যে, বাইবেলের বর্ণনা বিশেষত মহাপ্লাবনের সময়কাল ও তার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি-সম্পর্কিত বক্তব্য আদৌ সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পক্ষান্তরে, মহাপ্লাবন সম্পর্কিত কোরআনের বর্ণনায় এমনকিছু নেই যা নিরপেক্ষ বিচারে বিরোধিতা বা সমালোচনার যোগ্য।

যদিও, এখানে একটি প্রশ্ন ওঠতে পারে, মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত বাইবেলের বিবরণের প্রচারকাল ও কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালের মধ্যে ব্যবধান যখন প্রচুর, তখন এমনো তো হতে পারে যে, সে সময়ের মধ্যে মানুষ বেশ কিছু প্রমাণ ও তথ্যজ্ঞান আহরণ করেছিল এবং সেইসব তথ্য ও প্রমাণ মহাপ্লাবনের ঘটনার উপরে নতুন করে আলোকসম্পাত করেছিল। (আর সেই আলোকেই রচিত হয়েছিল কোরআনের মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত কাহিনী)। এ প্রশ্নের জবাব একটিই, আর তা হল, না। কেননা, বাইবেলের পুরাতন নিয়মের কাল থেকে কোরআন অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত যে সময়টা, সে মুদ্দতে মহাপ্লাবনের এই সুপ্রাচীন কাহিনীর সত্যতার ব্যাপারে মানবজাতির নিকট শুধু একটি দলিলই প্রমাণ হিসেবে বিদ্যমান ছিল, আর তা হল, খোদ এই বাইবেলটি।

সুতরাং, একদিকে মহাপ্লাবন-সংক্রান্ত আধুনিক তথ্যজ্ঞানের সাথে কোরআনের বর্ণনায় এই যে সামঞ্জস্য এবং অন্যদিকে সেই সামঞ্জস্য-বিধানের ব্যাপারে মানুষের হস্তক্ষেপ বা ভূমিকার কোনো প্রমাণ না-থাকায় মহাপ্লাবনের প্রশ্নে কোরআনের সেই বক্তব্যের সঠিকত্বের ব্যাপারে অপর ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করতেই হয়। বলা অনাবশ্যক যে, সেই অপর ব্যাখ্যাটি হল এই : “একদা বাইবেল ছিল প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত আসমানী কিতাব। কিন্তু সময়ে বাইবেলের বাণীসমূহ মানুষের হস্তক্ষেপে বিকৃত হয়ে পড়ে। তারপর অবতীর্ণ হয় আরেকটি প্রত্যাদেশপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ : কোরআন।”