তুমি ঠোঁটে নিও খড়কুটো
কপালটা মোবাইলের ওপর ঢলে পড়েছিল প্রহরের৷ টুংটাং শব্দে সেটা বেজে উঠতেই তড়াং করে লাফিয়ে উঠল মাথাটা৷ একটা কল আসছে৷ আননোন নাম্বার৷
ঘুমের ঘোরে সাতপাঁচ না ভেবে সেটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা তরল নারীকণ্ঠ শোনা গেল, ‘নমস্কার৷ আপনি কি একাকীত্বে ভুগছেন?’
এতক্ষণে ফোনেই সময়টা লক্ষ করে প্রহর৷ রাত সাড়ে তিনটে বাজছে৷ মাথাটা গরম হয়ে ওঠে ওর, ‘না, আমি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছি৷ রাত্রিবেলা কমোডে বসে আছি… ন্যাকামো মারা হচ্ছে শালা?’
ওপাশের গলাটা ধমক খেয়ে এতটুকু গলে না, ‘আপনার কি প্রয়োজন বন্ধুত্বের উষ্ণ ছোঁয়া?’
‘তোর বাপকে দিগে যা শালা… ঢ্যামনা কোথাকার! কানের গোড়ায় এমন উষ্ণ ছোঁয়া দেব যে…’
রেগেমেগে গিয়ে ফোনটা কেটে দেয় প্রহর৷ কেটে যেতেই গুগল ডকের সাদা স্ক্রিনটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে৷ ওর মাথার পাশেই হাতে লেখা কাগজগুলো পড়ে আছে৷ সেগুলো চোখের সামনে মেলে ধরতে ধরতে বিড়বিড় করে, ‘শুয়োরগুলো বিরক্ত করার সময় পায় না আর৷ রাতবিরেতে যতসব…’
কাগজের বোঝা থেকে শেষ পাতাটাকে আরেকবার গুছিয়ে নেয়৷ তারপর গুগল ডকের স্ক্রিনটা ভালো করে দেখে৷ গোটা গল্পটাই প্রায় টাইপ করা হয়ে গেছে৷ শেষের দিকে এসে ঘুম পেয়ে যাওয়ায় কখন মোবাইল স্ক্রিনে কপাল রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি৷
উঠে বসে বড়ো করে একবার হাই তোলে৷ হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে ছোট্ট একটা মেসেজ করে, ‘কীরে জেগে আছিস?’
অপর দিক থেকে মেসেজের বদলে একটা ফোন আসে৷ সেটা রিসিভ করে প্রহর, মেয়েলি গলা শোনা যায়, ‘তুই টাইপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলিস, নারে?’
‘তা ঘুমের আর দোষ কী? দিন দিন তোর হাতের লেখার অবস্থা যা হচ্ছে পড়তে গিয়ে মাথা ধরে যায়৷ তুই ঘুমাসনি কেন?’
‘ভাবছিলাম৷’
‘কী ভাবছিলিস?’
‘ভাবছিলাম এত রাত অবধি জেগে আমার লেখাগুলো টাইপ করিস, আদৌ কোনও লাভ হবে তাতে?’
‘মানে?’
‘মানে আমার লেখা আদৌ কেউ ছাপবে টাপবে না, ফালতু তোর এতটা পরিশ্রম…’
‘ঠিকই বলেছিস৷ এই দাঁড়া আমি একটু পরে ফোন করছি৷ একটা কল করব…’
‘এত রাতে! কাকে?’
‘ওই এক মহিলা৷ উষ্ণ ছোঁয়া-টোয়া দেবেন বলছিলেন৷ তোর জন্য পরিশ্রম করে তো লাভ নেই৷ তুই আগে থেকেই হেরে বসে আছিস…’
ওপাশের কণ্ঠটা একটু চুপ করে থাকে৷ তারপর বলে, ‘সেটা আমার কাছে বড়ো কথা নয়৷ কিন্তু আমার জন্য তোর নিজের জীবনটা ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে…’ প্রহর উত্তর দেয় না৷ তার বদলে হাসির আওয়াজ শোনা যায়৷
‘আমি হাসির কী বললাম?’
‘না, হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে গেল৷’
‘কেন?’
‘আমার মাও বাবাকে সারাক্ষণ বলত জানিস, তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবনটা ঝরঝরে হয়ে গেল… সারাক্ষণ খিটখিট করত৷ তারপর একদিন খিটখিট করা বন্ধ করে দিল… কবে বলত?’
‘কবে?’
‘বাবা যেদিন মারা গেল৷ বাবার বডির সামনে বসে মা যেন কিছু বলতে চাইছিল৷ কানে কানে কিছু একটা বলেওছিল৷ আমি শুনতে পাইনি৷ কিন্তু এখন গেস করতে পারি৷’
‘কী বলেছিল?’
‘আমরা সারা জীবন ধরে কেবল ক্ষইতেই থাকি৷ সময় আমাদের ক্ষয় ছাড়া আর কিছু শেখায় না৷ মাঝে মাঝে অবশ্য ভাবি যে এই বুঝি খানিকটা বেড়ে উঠলাম… কিন্তু আসলে সেটা একটা নতুন ক্ষয়ের শুরু৷ যে যত বেশি ক্ষইতে পারে সে তত বেশি বেঁচে থাকে… তার বেঁচে থাকা তত বেশি…’
ওপাশের নারীকণ্ঠ কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না৷ তারপর নরম গলায় বলে, ‘কিন্তু এত রাত অবধি জেগে ফোনের দিকে চেয়ে থাকলে চোখ দুটো যে যাবে… আলোটা নিভিয়ে দে৷ বাকিটা কাল সকালে করবি…’
হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে প্রহর৷ মাথার কাছের জানালাটা খোলা৷ সেটা দিয়ে বাইরে তারার আলো দেখা যাচ্ছে৷ আলো কিছুটা মেঝের উপর এসে পড়েছে৷ তার উপর একটা ছাতিম গাছের ডাল যেন ঘুমপাড়ানি সুরে দুলছে৷ গালের নীচে হাত রেখে পাশ ফিরে শোয় প্রহর৷ মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে টেনে নেয়৷
মেয়েটাও শুয়ে পড়ে৷ আঁধার নামে দু-জনকে ঘিরে৷ তবে ঘুমের আগেই স্বপ্ন নামে ওদের চোখে৷
‘তুই একদিন অনেক বড়ো লেখক হবি, জানিস…’ প্রহর চাপা স্বরে যেন নিজেকেই বলে৷
‘হ্যাঁ, তুই যা শুরু করেছিস না হয়ে উপায় কী?’ হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে মেয়েটার, কৌতূহলী গলায় বলে, ‘এই তখন উষ্ণ অনুভূতি না কী যেন বলছিলি… ওই কেসটা কী?’
‘কিছু না৷ একটা মাঝবয়সী মহিলা জিজ্ঞেস করছিল আমি একাকীত্বে ভুগছি কিনা?’
‘তুই কী বললি?’
‘বললাম হ্যাঁ ভুগছি৷ তখন বলল একাকীত্ব দূর করার জন্য নাকি কীসব দুষ্টু গল্প শোনাবে৷’
‘দুষ্টু গল্প! সেটা আবার কী?’
বড়ো করে একটা হাই তোলে প্রহর৷ তারপর বলে, ‘দুষ্টু লেখকরা যেসব গল্প লেখে তাদেরকে দুষ্টু গল্প বলে৷ যেমন তুই বেশ ভালো দুষ্টু গল্প লিখিস৷ এবার ঘুমিয়ে পড়…’
মেয়েটার জানলা দিয়ে বয়ে আসা হাওয়া ছেলেটার জানলায় নরম স্পর্শ বুলিয়ে যায়৷ দু-জন একই সঙ্গে ঘুমায় না৷ কেউ আগে কেউ পরে৷ কিন্তু কোথায় যেন একটাই সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ছুঁয়ে যায় ওদের৷
‘এই যে ভাইপো, সকাল সকাল দোকান খুলে ফেলেছ!’
সকালে দোকান খুলে ম্যাগাজিনগুলো ঝাড়তে ঝাড়তেই পিছন থেকে ভেসে আসা আওয়াজটা শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেল প্রহরের৷ গলাটা সে চেনে, এবং সকালে গলাটা শুনলেই সারাদিন মনটা ব্যাজার হয়ে থাকে৷ ভদ্রলোক দোকানে আসেন ম্যাগাজিন কিনতে৷ তবে গল্প-উপন্যাসের নয়, ওর ছেলে সম্ভবত কোনও সরকারি চাকরির পরীক্ষা-টরীক্ষা দিচ্ছে৷ কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের জন্য ম্যাগাজিন কিনতে আসেন৷ মুশকিল হল কিনে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কেটে পড়েন না৷ জাঁকিয়ে বসে বেশ খানিক জ্ঞান দেন ওকে৷ পাশের দোকান থেকে চা খান৷ ওকেও খাওয়ান৷
ঘণ্টাখানেক বকবক করে ওর মাথার ঝিকু নাড়িয়ে দিয়ে যান৷ প্রহর উত্তর না দেওয়ায় পাশের চায়ের দোকানে দুটো চা দিতে ইশারা করে ভদ্রলোক বললেন, ‘ছেলের ক-টা ম্যাগাজিন কেনার ছিল৷ ভাবলাম সেই সঙ্গে একটু চা-ও খেয়ে যাই…’
‘সেই সঙ্গে আমার মাথাটাও…’ চাপা গলায় বিড়বিড় করে প্রহর৷ দোকানের পাশে রাখা টুলটার উপর বসেন ভদ্রলোক৷ তারপর শার্টের বোতামের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা বুকের লোমের উপর আঙুল বুলিয়ে বলেন, ‘ভাগ্যে তোমার দোকানটা ছিল৷ নইলে এই সব ম্যাগাজিন ট্যাগাজিন আবার আমি কোত্থেকে…’
প্রহর কোনও উত্তর দেয় না৷ উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না তার৷ লোকটা নিজেই বলে চলে, ‘তাও মাঝে মাঝে ভাবি বুঝলে, এইসব ম্যাগাজিনের দোকান ফোকান করে আর ক-টাকাই বা রোজগার করো৷ আজকাল তো আর এইসব… তারপর ভাবি সবাই যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কী গরমেন্ট সার্ভিস করে তাহলে তাদের বইপত্র বেচবে কে? না ভাই, তোমার রোজগার কম হলেও কাজটা ছোটো নয়…’
‘আপনারটা ছোটো নাকি?’
প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক আঁতকে উঠে একবার নীচের দিকে তাকিয়ে কী যেন খেয়াল করে নেন৷ তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কী বললে?’
‘আপনার চাকরির কথা বলছি৷ ভালোই তো চাকরি করেন৷ এত গল্প করার সময় পান কী করে বলুন তো?’
‘আরে চাকরি মানেই কি দাঁতে লোহা পেশার কাজ নাকি? আমার মাথার কাজ, বুঝলে? এই যে তোমার দোকানে এসে গজালি করছি, দুটো গল্প করছি, চারদিকের খবর জানতে পারছি, এটাও কি কম কথা?’
টুলের উপরে বসে চায়ের কাপ তুলে নেয় প্রহর, ‘ক-দিন আর আসতে পারবেন জানি না৷ দোকান টোকান তুলে দেব৷’
‘তুলে দেবে কেন?’
‘খুলে রেখে লাভ কী হচ্ছে? বিক্রিবাটা নেই…’
‘তো কী করবে ভেবেছ?’
‘আপাতত হাতে কাজ নেই৷ সাইকেলটা আছে, আজকাল ফুড ডেলিভারির কাজ সাইকেল নিয়েও করা যায়৷ ওই করব…’
‘ম্যাগাজিনের দোকান থেকে সোজা খাবার?’
‘তা ছাড়া আর উপায় কী? বইয়ের দোকান ছিল বাবার৷ বাবার চিকিৎসায় সেটাও বিক্রি করে দিতে হল৷ তাও বাঁচাতে আর পারলাম কই? ম্যাগাজিনের স্টলটা টিকিয়ে রেখেছি এতদিন৷ সেটাও মনে হয় আর রাখতে পারব না…’
লোকটা আর কিছু বলে না৷ নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দেয়৷
এই সময় গরগর করে আকাশ ডেকে ওঠে৷ রাস্তার দিকে চেয়ে কী যেন একটা ভাবছিল প্রহর৷ মেঘের ডাকে চমক ফিরে উপরে তাকিয়েই বিরক্ত হয়৷ ঠোঁট উলটে বলে, ‘শালা এই এক হয়েছে৷ যখন তখন বৃষ্টি৷ সব ম্যাগাজিন ঢাকা দেব তারপর দেখব বাবু থেমে গেলেন৷ ভালো লাগে না আর…’
প্রহরের ম্যাগাজিনের স্টলটা ওদের গলির মাথায়৷ স্টলের ঠিক পেছনেই একটা সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান৷ সেটা দুপুরবেলা বন্ধ থাকে৷
ওটাই আগে প্রহরের বাবার বইয়ের দোকান ছিল৷ সেটা বেচে দিয়ে এখন সে দোকানের পাশেই একটা কাঠের মাচা মতো বেঁধে তার উপর ম্যাগাজিনের স্টল করেছে৷ ইদানীং মাচাটা কিছু গড়বড় করছে৷ উপরে প্লাস্টিকের ছাউনি কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে৷ বৃষ্টি হলে সেখান থেকে টপটপিয়ে জল পড়ে৷ ক-দিন পরেই দোকান তুলে দেবে বলে আর মেরামত করেনি৷ অবশ্য বৃষ্টি পড়লেই নীল প্লাস্টিক দিয়ে ম্যাগাজিনগুলো ঢেকে দেয়৷ তারপর টুল ছেড়ে স্টলেরই এককোণে উঠে বসে একমনে তাকিয়ে থাকে বৃষ্টির দিকে৷
মোড়ের মাথা পার করে ছুটে যাওয়া গাড়িগুলোর উপরে বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু করেছে৷ স্যাঁতস্যাঁতে একটা হাওয়া এসে আছড়ে পড়ে ম্যাগাজিনের পাতাগুলো পতপত করে উড়িয়ে দিচ্ছে৷ দ্রুত উঠে পড়ে তিরপলটা টেনে ফুটোগুলো ঢাকার চেষ্টা করে প্রহর৷
‘একটা কথা বুঝতে পারি না ভাইপো…’ লোকটা কী যেন ভাবতে ভাবতে বলে৷
‘কী?’
‘এত ঝামেলায় মধ্যে তুমি দোকানটা এতদিন খুলেই বা রেখেছ কেন?’
‘একটা স্বপ্ন আছে কাকা…’
‘কী স্বপ্ন?’
প্রহর হাসে৷ উত্তর দেয় না৷ দোকানটা সত্যিই আর বেশিদিন খুলে রাখতে পারবে না৷ এভাবে আর সংসার চলছে না৷ কেবল একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার আগে একটা ছোট্ট ইচ্ছাপূরণ করতে চায় ও৷ স্বপ্ন৷ ছোট্ট একটা স্বপ্ন, কিন্তু প্রহরের জেদ৷ ওটা না হলে যত কষ্টই হোক দোকান সে বন্ধ করবে না৷
কলেজে পড়ার সময় টাকার অভাব ছিল বলে একটা ক্লাস এইটের বাচ্চাকে টিউশন পড়াত প্রহর৷ ভারী বদ বাচ্চা৷ মাঝেমাঝেই হোমওয়ার্ক শেষ না হলে মেয়েটা অঙ্কের খাতা লুকিয়ে ফেলে বলত খাতা হারিয়ে গেছে৷ প্রহর খানিক বকাঝকা করেছিল প্রথমদিন৷ মেয়েটা শেষে ওর দিদির পুরোনো সাদা খাতা টেনে এনে উলটো দিক থেকে অঙ্ক কষেছিল সেদিন৷
সেদিন আর অঙ্ক চেক করার সময় ছিল না বলে প্রহর সে খাতা বাড়ি নিয়ে আসে৷ রাতে সেটা চেক করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করে খাতাটা সামনের দিকে থেকে খুললে বেশ কয়েকটা পাতা জুড়ে বাংলায় কীসব লেখা আছে৷ পড়ে বুঝতে পারে সেগুলো ছোটো ছোটো কিছু গল্প৷ ছোটোবেলা থেকে গল্পের বইয়ের পোকা প্রহর৷ সাহিত্য টাহিত্য নিয়েও কিছু ধ্যানধারণা আছে৷ সেই ছোটো একপাতার গল্পগুলো পড়ে সে চমকে ওঠে৷ রীতিমতো পাকা হাতের লেখা৷ কেবল কয়েকটা বিশ্রী বানান ভুল আর জঘন্য হাতের লেখা…
কে লিখেছে এগুলো? মেয়েটার দিদি নিশ্চয়ই! নাম সম্ভবত পলি৷ পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝে মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনেছে প্রহর৷ কিন্তু চাক্ষুষ দেখেনি৷ সে নাকি এবার এইচ এস দেবে৷
সারারাত জেগে একদিনে গল্পগুলো পড়ে শেষ করে প্রহর৷ খাতাটা ফেরত দেওয়ার সময় গল্পগুলোর উপরে ছোটো ছোটো করে লিখে দেয়, ‘এগুলো তো ছাপা হওয়া দরকার…’
কথাটা লেখিকার চোখে পড়বে এমন আশা তার ছিল না৷ নিতান্ত ঝোঁকের বশেই লিখে দিয়েছিল কথাগুলো৷ পরে একদিন আবার মেয়েটা খাতা হারিয়ে ফেলায় আবার দিদির পুরোনো খাতা টেনে এনে অঙ্ক করে সে৷ যথারীতি খাতা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেই গল্পগুলোর জায়গাটা খুলে দেখে প্রহর৷ সেখানে লেখা আছে পাঁচটা শব্দ, ‘আমি ওসব পারি না তো…’
‘লিখতে যখন পারেন, ছাপতে অসুবিধা কী? আমার বাবার বইয়ের দোকান ছিল, জানেন?’
বিক্রির সঙ্গে বই ছাপার যে সম্পর্কটা খুবই ক্ষীণ সেকথা তখন প্রহরের মাথা থেকে উধাও হয়েছে৷ পরের দিন টিউশন পড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অন্ধকারের মধ্যে পেছনের জানলার গ্রিল থেকে কে যেন ডাক দেয় প্রহরকে, ‘শুনুন, আপনার সত্যি ভালো লেগেছে গল্পগুলো?’
প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেছিল প্রহর, তারপর খানিক সামলে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, কেন অন্যদের ভালো লাগেনি?’
‘আসলে আমি অন্য কাউকে পড়াইনি৷’
‘সে কী! কেন?’
‘বুঝতেই পারছেন একটু কনজারভেটিভ ফ্যামিলি৷ ওরা লেখালিখি পছন্দ করে না৷ তাছাড়া আমারও খুব কনফিডেন্সের অভাব…’
‘হ্যাঁ সে আপনার হাতের লেখা দেখেই বোঝা যায়… তা কোথাও পাঠিয়েছেন? ছাপতে?’
‘উঁহু, ছাপা হলে সবাই জেনে যাবে৷ কলেজে উঠলে তখন আর কেউ খিটখিট করবে না৷ তখন পাঠাব… তবে…’
‘তবে কী?’
‘তবে ততদিন আপনি চাইলে আপনাকে পড়তে দিতে পারি৷ কেউ পড়ে না তো… কিন্তু বোন যদি দেখে ফেলে? ও খুব শয়তান…’
‘মাকে বলে দেবে… তাই তো?’
অন্ধকারের মধ্যেই মেয়েটা উপর নীচে মাথা নাড়ায়৷
‘বেশ তো, আমাকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দেবেন…’
মেয়েটার মুখে আবার আঁধার নামে, ‘ফোন মায়ের কাছে থাকে৷ দেখে নেবে…’ অতঃপর মাথা খাটিয়ে একটা বুদ্ধি বার করে প্রহর৷ সে হঠাৎ ঘোষণা করে মাসের মাঝামাঝি তার হাতের টাকা শেষ হয়ে যায়, ফলে সে টিউশন পড়িয়ে একই টাকা নেবে, কিন্তু দু’ভাগে৷ একবার নেবে মাসের পনেরো তারিখ আর একবার এক তারিখ৷ মাইনে আসে মুখ বন্ধ খামে৷ সেই খাম থাকে পলির জিম্মায়৷ পলি একটা ছোটো ডায়েরির পাতায় যতটা সম্ভব ছোটো হাতের লেখায় গল্প লিখে ভাঁজ করা নোটের মাঝে পাতাটা মুড়ে আঠা দিয়ে বন্ধ খামের মধ্যে ঢুকিয়ে বোনের হাতে দিয়ে দেয়৷ সেই টাকার খাম বাড়িতে নিয়ে এসে আতশকাঁচ ধরে গল্প পড়ে প্রহর৷ কখনও চমকে ওঠে, কখনও চোখে জল আসে, কখনও স্তম্ভিত হয়ে যায় সেসব লেখা পড়ে৷ কী অদ্ভুত সুন্দর লিখতে পারে মেয়েটা!
আগে কাগজের দু-পিঠেই গল্প লিখত পলি৷ মাসখানেক পরে প্রহর লক্ষ করে গল্পের শেষে দু-চারলাইনে নিজের কথাও লিখতে শুরু করেছে৷ অনেকটা চিঠির মতোই, কেবল সাধারণ চিঠির চেয়ে ঢের বেশি সংকোচে ভরা৷ যেন কাউকে নিজের মনের কথা উজাড় করে বলতে গিয়েও একটু থমকাচ্ছে সে৷ প্রহরের অবশ্য কিছু বলার উপায় থাকে না৷ খাম তো সে আর ফেরত দেয় না…
মেয়েটার ওই সংকোচটুকুর আড়াল ভেদ করে দেখা হৃদয়ের অল্প ঝলকগুলোকে জড়ো করতে করতে কখন যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে প্রহর, সে নিজেও বুঝতে পারেনি৷
কিছুদিন পর প্রহরের ছাত্রীর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়৷ মেয়ের বাড়ি থেকে বলে দেয় আর পড়াতে আসতে হবে না৷ টিউশনি বন্ধ৷ ফলে কাগজপত্র আদানপ্রদানটাও একরকম বন্ধই হয়ে যায়৷
একমাস পলির সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না প্রহরের৷ ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো ভুলেই গেছে তার কথা৷ সকাল থেকে দোকানে বসে থাকতে হয় বলে টিউশনিগুলো আর নেই বললেই চলে৷ সেদিন বিকেলেও দোকানে বসে মাছি তাড়াচ্ছিল প্রহর৷ এমন সময় একটা সাইকেল এসে থামল দোকানের সামনে৷ ভারী গলায় প্রশ্ন এল, ‘এই যে ভাই, তোমার এখানে কল্লোলিনী পাওয়া যায়?’
প্রহর দু-দিকে মাথা নাড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সাইকেলের দিক থেকে আবার মেয়েলি গলায় প্রশ্ন এল, ‘একটু দেখুন না, ভীষণ দরকার…’
চকিতে মুখ তুলে তাকাল প্রহর৷ সাইকেলের কেরিয়ারে বসে আছে পলি৷ সম্ভবত বাবার সাইকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে সে৷ তার মুখে অদ্ভুত একটা ইশারা খেলে গেল৷ সেটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল প্রহরের৷
সে অল্প হেসে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বলল, ‘ইয়ে আজ নেই তো৷ কাল এনে দিতে পারি…’
‘তাই দিও, এ অঞ্চলে কোথাও পাচ্ছি না… আমার মেয়ের আবার ওইটাই…’
‘এই যে অ্যাডভান্স…’ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট প্রহরের দিকে বাড়িয়ে দেয় মেয়েটা৷ কায়দা করে সেটা নিয়েই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে প্রহর৷ সাইকেলটা ক্রিংক্রিং শব্দ করে আবার উলটোদিকে গতি নেয়৷ মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে এবার ওর দিকে চেয়ে চোখ টিপে হাসে৷
রাস্তার অপর প্রান্তে সাইকেলটা মিলিয়ে যেতে নোটের ভিতর ভাঁজ করা কাগজটা খোলে প্রহর৷ আগের মতো খুদে খুদে অক্ষরে পরিচিত হাতের লেখায় তাতে লেখা আছে, ‘এবার থেকে কল্লোলিনীটা রেখো৷ ওটা এদিকের কোথাও পাওয়া যায় না৷ দামও বেশি৷ পঞ্চাশ টাকা৷ টিফিনের জন্য মা পাঁচটাকা দেয় রোজ দু-টাকা করে বাঁচালেই মাসে একদিন দেখা আর কথা হয়ে যাবে…’
এভাবে আবার মাসখানেক চলে৷ একদিন হঠাৎ করেই একটা কাণ্ড ঘটে৷ সন্ধে হলে গলির মোড়টা ফাঁকা হয়ে যায়৷ তখন বিশেষ লোকজন আর চোখে পড়ে না এদিকটায়৷ ঘড়িতে রাত ন-টা বাজছে দেখে দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছিল প্রহর৷ হঠাৎ পেছনে পায়ের আওয়াজ হতে ঘুরে তাকিয়েই অবাক হয়ে যায়, পলি এসে দাঁড়িয়েছে৷ গায়ে স্কুল ড্রেস৷ মুখে একই সঙ্গে ক্লান্তি আর উচ্ছাস৷
‘তুই! এখানে! এখন৷’ প্রহর হতবাক হয়ে যায়৷
‘স্কুল থেকে টুরে নিয়ে গেছিল বাসে করে৷ আমি স্যারেদের ভুলভাল বলে একটু আগেই নেমে গেছি…’
‘কেন?’
‘এখানে আসব বলে… আমার তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে, লিখে লিখে নয়৷ সামনা সামনি…’
‘যদি দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতাম…’ বিড়বিড় করে কথাটা বলে টুলটা ওর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘বোস…’
‘উঁহু, বসলে দেরি হয়ে যাবে৷ দশমিনিট মতো আছে আছে৷ তার বেশি দেরি হলে বাবা ফোন করবে ওদের৷ চল হাঁটি…’
প্রহর ঝট করে দোকানটা বন্ধ করে দেয়৷ তারপর দু’জনে মিলে গলি থেকে বেরিয়ে বাইরের বড়ো রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে৷ পলির মুখটা গোলগাল৷ চোখ দুটো বেশ বড়োসড়ো৷ কিছুকিছু সৌন্দর্যের মধ্যে চটক থাকে না৷ বরঞ্চ সেসব মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুকের ভিতর রৌদ্রতপ্ত মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়ার মতো শান্তি নামে৷
এই মুহূর্তে তার মুখে সারাদিনের জার্নির ছাপ৷ পিঠে স্কুলের ব্যাগ৷ দু-হাতে তার স্ট্র্যাপদুটো ধরে ধীরে পায়ে হাঁটছে পলি৷ কারণটা একটু পরে বুঝতে পারে প্রহর৷ হাত নামিয়ে হাঁটলে পাশাপাশি হাঁটার কারণে মাঝে মাঝে স্পর্শ লেগে যাচ্ছে হাতে৷ ভারী অস্বস্তি হচ্ছে তখন৷
‘আর মাসখানেক পরেই তো কলেজে উঠে যাবি…’
‘আমার খুব আনন্দ হচ্ছে জানিস৷ ইচ্ছা হলেই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে… কী বল?’
‘সে তো হবে, কিন্তু কী বলেছিলিস মনে আছে তো?’
পলি নরম হাসি হাসে, ‘ঠিক আছে পাঠাব৷ কিন্তু আমার হাতের লেখা ওরা বুঝতে পারলে তবে তো ছাপবে৷’
‘বেশ তো, তুই লিখে আমাকে দিবি, আমি মোবাইলে টাইপ করে দেব৷ তারপর সেটা প্রিন্ট করে…’
‘তুই ওগুলো ছেপেই ছাড়বি, নারে?’
প্রহর কাঁধ ঝাঁকায়, ‘সারাদিন কত লোক আসে দোকানে, ম্যাগাজিন উলটে পালটে দেখে৷ প্রিয় লেখকের নাম খোঁজে৷ নাম দেখতে পেলে হাসি মুখে কিনে নিয়ে যায়… আমার ভারী ইচ্ছা করে একদিন সবাই তোর নামও খুঁজুক… ঠিক করেছি…’
‘কী ঠিক করেছিস?’
‘অন্তত একদিন হলেও তোর লেখাওয়ালা ম্যাগাজিন বেচব আমি৷ তারপর আমার দোকান থাক না থাক কিছু যায় আসে না…’
কী যেন ভাবছিল পলি, হঠাৎ থমকে সামনে তাকিয়ে বলে, ‘এই তুই ভূতের রাজার তারা দেখেছিস?’
‘ভূতের রাজার তারা৷ সেটা কী?’
পলির চোখ দুটো বেড়ালের মতো সতর্ক হয়ে ওঠে৷ সামনের দিকে উৎসুক দৃষ্টি বুলিয়ে দ্রুত বলতে থাকে সে, ‘আমার মা বলে জানিস, মা যখন ছোটো ছিল তখন একদিন রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখে একটা বাড়ির দরজার কাছে একটা লাল নীল হলুদ রঙের তারা জ্বলছে নিভছে৷ তারার ভিতর থেকে একটা লোক নাকি বেরিয়ে আসছিল…’
‘ধুর যত বোকাবোকা গল্প…’
‘সত্যি বলছি রে৷ মা পরে জেনেছিল ওই তারার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ওর ভিতর থেকে নাকি একটা লোক বেরিয়ে আসে৷ সেই হল ভূতের রাজা৷ ওর কাছে যা চায় মানুষ তাই পায়…’
‘হেঃ, তোকে বাচ্চা পেয়ে সিনেমার গল্প বলেছে…’
‘না রে… আমিও একবার দেখেছিলাম জানিস… কিন্তু দেখেই পালিয়ে গিয়েছিলাম, সামনে যেতে সাহস হয়নি…’
প্রহর অবিশ্বাসের চোখে তাকায় পলির দিকে৷ বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে মেয়েটা? কিন্তু ওর মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না৷ ও থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায়?’
‘ওই যে দেখ ওখানে… ভালো করে তাকা, এখনও দেখতে পাবি…’
কী যেন একটা ছিল পলির গলায়৷ এক মুহূর্তের জন্য মিথ্যেটাকেই সত্যি মনে হয় প্রহরের৷ তার চোখের মণি নিজের অজান্তেই ঘুরে যায় পেছনের দিকে, ‘কই…’
গলিটা অন্ধকার হয়ে আছে৷ সেদিকে চেয়ে কিছুই দেখতে পায় না প্রহর৷ হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে পলি, ‘তুই কী বোকা রে৷ আমি বললাম আর তুই বিশ্বাস করে ফেললি৷’
হাসির চোটে পলির শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, অজান্তেই টাল সামলাতে হঠাৎ প্রহরের বাঁহাতের কবজিটা আঙুল দিয়ে ধরে ফেলে ও৷ পরমুহূর্তেই ছেড়ে দেয়৷ নিজেকে সামলে নেয় পলি৷
‘ভূতের রাজা টাজা নয় বোকা, ওটা আমার বাড়ি…’
অপ্রস্তুতে পড়ে যায় প্রহর৷ পলির নরম হাতের স্পর্শটা এখনও ওর কবজিতে লেগে আছে৷ যেন ঐ কয়েকটা মুহূর্ত আজীবনের জন্য চিহ্ন রেখে গেছে ওর হাতে৷ নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাতেই ও তড়িঘড়ি বলে, ‘আমি আসি আজ৷ তুই বাড়ি ঢুকে যা…’
পলি বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল৷ হঠাৎ কী মনে করে ফিরে এসে বলে, ‘শোন…’
‘কী?’
‘ভালোবাসি…’ শব্দটা উচ্চারণ করেই এক ছুটে বাড়ির দিকে পালিয়ে যায় পলি৷
এসব অবশ্য বছর দু’য়েক আগের কথা৷ কলেজে উঠতে বাড়ি থেকে ফোন কিনে দেয় পলিকে৷ তখন আর দু’জনের যোগাযোগ করতে অসুবিধা হয়নি৷ কলেজে উঠে থেকে সে আর বাবার সাইকেলে যাতায়াত করে না৷ ফলে শনিবার ক্লাস বাঙ্ক করে প্রহরের ম্যাগাজিনের দোকানে এসে বসে থাকতে বিশেষ অসুবিধা হয় না পলির৷ রাতে দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরে রান্না করে প্রহর৷ মাকে ওষুধ খাওয়ায়, কিছুক্ষণ গল্পগাছা করে৷ তারপর মা ঘুমিয়ে পড়লে নিজের ঘরে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পলির হাতে লেখা গল্পগুলো গুগল ডকে টাইপ করে এক এক করে৷ পরদিন দোকান খোলার আগে সেগুলো প্রিন্ট করে খামে ভরে সাইকেলে করে পত্রিকার অফিসে দিয়ে আসে৷ এ জিনিসটা গত দেড় বছর একরকম রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর৷ আজও কলেজ ফেরত পলির ক্লান্ত শরীরটা যখন গলির মাথায় দেখা গেল তখন শহর জুড়ে ঝিমন্ত দুপুর নেমেছে৷ একটু আগেই ঝড় হয়ে গেছে৷ ধীরপায়ে এগিয়ে সে দেখল পাটাতনের উপর পা মেলে বসে একমনে কী যেন ভাবছে প্রহর৷ একটা ধাক্কা মারল পলি, ‘আরও জেগে থাক রাতে, তারপর দোকানে এসে ঘুমা আর সব চুরি হয়ে যাক…’
‘ধুর…’ মৃদু হাসল প্রহর, ‘এসব জিনিস চুরি করবে কে?’
কয়েকটা ম্যাগাজিন সরিয়ে জায়গাটা ফাঁকা করে তার উপর উঠে বসে পলি৷ একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে কয়েকটা পাতা উলটে বলে, ‘দু-দিন আগেই ফোন করেছিলাম এদেরকে৷ লাভ হল না কিছু…’
‘কী বললি?’
‘বললাম আমিই সেই দুষ্টু গল্পের লেখিকা প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস৷ আমার লেখা ছাপবেন আপনারা?’
নিজের কপাল চাপড়ায় প্রহর, ‘তুই সত্যি বলেছিস এটা?’
মুখ বাঁকায় পলি, তারপর হতাশ গলায় বলে, ‘ভেবেছিলাম এমাসে গল্পটা আসবে৷ ব্যাঙ…’
‘দেড় বছরে বারোটা গল্প পাঠালাম৷ একটাও পছন্দ হল না শালাদের? লোকে বিয়ে করতে গিয়ে এত সম্বন্ধও দেখে না…’
‘তুই ফোন নাম্বার ঠিকঠাক লিখিস তো? হয়তো ওরা ফোন করে পায় না বলেই…’ প্রহর রেগে ওঠে,
‘হ্যাঁ, আমার তো চোখ খারাপ, তাই না?’ ‘চোখ খারাপ কি না জানি না কিন্তু মাথা খারাপ…’
‘কেন? মাথা খারাপ কেন?’
‘নয়? নইলে আমার লেখা কবে ছাপা হবে, কবে আমার লেখা বেচবে, সেই ভেবে দিনের পর দিন…’
প্রহরের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে৷ পলি প্রসঙ্গ পালটে ফেলে, ‘বাদ দে ওসব, ম্যাগি খাবি? আমি বানিয়েছি…’
‘দে…’
পলি ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করে ওর হাতে দিয়ে দেয়, কাঁটা চামচ দিয়ে ম্যাগিতে ছোবল মারে প্রহর৷ তারপর চিবাতে চিবাতে বলে, ‘তুই দুপুরবেলা কিছু খাস না?’
‘ম্যাগি খেতে ভালো লাগে না৷ দলা পাকিয়ে যায়…’ শব্দ করে দলা পাকানো ম্যাগি চিবাতে থাকে প্রহর, ওর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে পলি৷ বোঝা যায় খিদে পেয়েছিল ছেলেটার, সে ধীরে ধীরে বলে, ‘আচ্ছা ধর আমার লেখা কোনওদিন ছাপা হয়ে গেল৷ কী হবে তাতে? লিখেটিখে তো আর সংসার চলে না, তাই না?’
‘সে তো ম্যাগাজিন বেচেও চলে না, তো?’
‘তাহলে লাভ কী? যতই লেখালেখি করি, কোনওদিন কিছু না কিছু চাকরি তো একটা করতে হবে৷’
প্রহর ঢোঁক গিলে মৃদু হাসে, তারপর ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, ‘আমার বাবার খুব শখ ছিল লেখক হবার৷ পারেনি৷ শেষে বইয়ের দোকান খুলল৷ ওই লেখালিখির আশেপাশে থাকা যাবে৷ দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হয় আর কী…’
‘মানেটা কী? শুধু আশেপাশে থাকার জন্য এতকিছু?’
পলির কাঁধে চাপড় মারে প্রহর, ‘আহা! রাগ করছিস কেন? আসলে কি জানিস, তোর মতো, আমার বাবার মতো লোকজনদের ভেতরে না একটা আগুন থাকে৷ হ্যাঁ, সেই সঙ্গে ইএমআইয়ের প্রেসার থাকে, কলেজের ফিজ থাকে, বাড়ি ভাড়ার টাকা থাকে, কিন্তু ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ আগুনটা জ্বলে না ওঠে… যেদিন আগুনটা জ্বলে ওঠে সেদিন ওইসব চাহিদাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়… একটা নেশার মতো…’
‘আর তুই সেই আগুন জ্বালাতে চাস আমার মধ্যে, তাই না?’
প্রহর কাঁধ ঝাঁকায়, ‘তারপর দেখবি নিজে থেকেই হয়ে যাবে সব, আমাকে আর দরকারই হবে না তোর৷’
‘যদি দরকার হয়?’
‘তাহলে তো আমি আছিই এখানে…’
‘কোথায় আছিস? তুই তো তখন আর এই দোকানে থাকবি না৷ দুপুরবেলা কোথায় দেখা হবে আমাদের?’
‘ওমা! খাবার অর্ডার করে দিবি, একেবারে বাড়িতে হাজির হয়ে যাব…’ ওর দিকে সরে আসে পলি৷ হাতের উপর একটা হাত রাখে, ‘এই দোকানটা চলে গেলে তোর খুব কষ্ট হবে নারে?’
‘বাবার তৈরি দোকানটা তো কবেই চলে গেছে… এখন আর অত যায় আসে না৷ মায়ের শরীরটা ঠিক হলেই…’
আচমকাই ওর কাঁধে মাথা রাখে পলি, ‘যেদিন আমি রোজগার করব সেদিন দু-জনে মিলে একটা বইয়ের দোকান খুলব, কেমন?’
প্রহর পাশের দিকে চায়, মিহি হেসে বলে, ‘লোকে এসে জিজ্ঞেস করবে, ‘দাদা আপনার কাছে প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাসের লেখা বই আছে?’
পলিও হাসে, ‘আর তুই কী বলবি?’
‘বলব শুধু বই কেন, গোটা প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাসটাই আছে৷ তবে ওটা দেওয়া যাবে না৷ এক কপিই আছে…’
হাসতে হাসতে ওর কবজিটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে পলি৷ অদ্ভুত একটা মায়া জড়িয়ে ধরে ওদের দু-জনকে৷
সেদিন বাড়ি ফিরে প্রহর দেখে মায়ের শরীরটা খারাপ করেছে আরও৷ জ্বর এসেছে নতুন করে৷ সন্ধের দিকে নিজে থেকে উঠে রান্না করার চেষ্টা করছিল, তাতেই মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে যায়৷
প্রহর হিসেব করে দেখে পরের মাসে মায়ের ওষুধ কেনার টাকা থাকবে না৷ যে ক-জন কলেজ জীবনের বন্ধু ছিল তাদের সবার থেকেই ধার নেওয়া হয়ে গেছে৷ এখন মাসের শেষ, সহজে আর কেউ ধার দেবে না৷
রাতে বিছানায় শুতে গিয়ে হঠাৎ ভীষণ কান্না পেয়ে যায় প্রহরের৷ ভারী অসহায় লাগে নিজেকে৷ কোনওদিকে কোনও রাস্তা খোলা নেই৷ যেভাবেই হোক এবার ফুড ডেলিভারির কাজটা শুরু করতে হবে৷ কিন্তু ওর জেদটা? স্বপ্নটা?
‘তোর গলাটা এমন লাগছে কেন বল তো?’ রাতে ঘুমাবার আগে পলির ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন আসে৷
‘কিছু না, একটু টায়ার্ড আছি জাস্ট৷ তোর লেখাটা প্রিন্ট করে জমা করতে গেছিলাম৷’
পলি একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘ওটাই থাক আপাতত, মাসখানেক আর কিছু লিখতে পারব না৷ ইন্টারনাল আছে… আচ্ছা একটা কথা বল তো?’
‘কী?’
‘ম্যাগাজিনে লেখা ছাপলে লেখককে কত দেয় জানিস?’
‘ডিপেন্ড করে৷ কেউ দুশো-তিনশো দেয়, কেউ হাজারখানেক দেয় হয়তো…তুই নতুন, তোকে বেশি দেবে না… কেন?’
‘আমি জানি তোর টাকার দরকার হিরু৷ বিশ্বাস কর আমি যতটা পারি মন দিয়ে লেখার চেষ্টা করি… তুই…’
‘আমি কী?’
‘আমি কিছু করতে পারছি না বলে আমার উপর বিরক্ত হোস না তো তুই?’
‘তুই কখনও ফুটবল খেলিসনি, নারে পলি?’
‘না কেন?’
‘খেললে বুঝতিস যখন গোল হয় তখন সেটার পাশে একজনের নাম লেখা থাকে৷ কিন্তু যখন হয় না তখন গোটা টিমের কিংবা দেশের নাম লেখা থাকে…’
‘মানে?’
‘মানে পাসারেইয়া ট্যাকেল করতে পারেনি, বুরুচাগা থ্রু বাড়ায়নি, মারাদোনা পায়ে বল পায়নি, তাই গোল হয়নি… দোষ তো কারও একার নয়… দুনিয়ায় সফলতা মাঝে মাঝে একজনের হলেও ব্যর্থতা একজনের হতেই পারে না…’
‘ও আমি মারাদোনা! আর তুই কে?’
‘আমি সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘটিবাটি বেচে খেলা দেখতে আসা সাপোর্টার৷ যে জানে যতই কড়া ট্যাকেল হোক, যত ম্যান মার্কিং আসুক, যতই বাঘা গোলকিপার থাক, ওই একটা বাঁপা ম্যাজিকের মতো সব বাধা টপকে ওয়ার্ল্ড কাপ এনে দেবে…’
‘একদিন ঠিক পারব, দেখিস…’
রাত আরও ঘন হয় একসময়৷ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে ওরা কখন৷ স্বপ্ন দেখে সবুজ ঘাসের গালিচায় তিরের বেগে চলেছে একটা বেঁটেখাটো চেহারার লোক৷ যার উপরে বিশেষ কেউ ভরসা রাখতে পারেনি৷ সেই ভরসা রাখতে না পারা মুখগুলোকে সূক্ষ্ম পায়ের মোচড়ে কাটিয়ে যাচ্ছে সে৷ একজন… দু-জন… সাতজন…
পরদিন সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙে প্রহরের৷ এতক্ষণে দোকানের জন্য বেরিয়ে যায়৷ ঘড়ির দিক চোখ পড়তেই আঁতকে ওঠে৷ সর্বনাশ!
বেরনোর তাড়াহুড়োতে ফোনের দিকে তাকানোর কথা আর খেয়াল ছিল না৷ সাইকেলে প্যাডেল করার আগের মুহূর্তে খেয়াল করে পলির নম্বর থেকে গোটা দশেক মিডস কল! এতবার তো করে না, হল কী মেয়েটার? দু-বার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয় ফোনটা৷
‘এই একদম ভুল হয়ে গেছে রে… ফোনটা…’
‘একটা ব্যাপার ঘটেছে, জানিস…’ পলির গলাটা গম্ভীর শোনায়৷
‘কী?’
‘আজ সকালে একবার ফোন করেছিলাম ওদের৷ আমার কোনও লেখা সিলেক্ট হয়েছে কি না জানতে…’
‘কী বলল?’
কেটে কেটে উচ্চারণ করে পলি, ‘বলল ওরা নাকি জানাতে ভুলে গেছিল৷ আজ ওদের নতুন সংখ্যা বেরোবে, তাতে আমার লেখা আছে… ওই যে আগের মাসে যেটা পাঠিয়েছিলাম…’
‘তুই সত্যি বলছিস?’ প্রহরের গলা কেঁপে যায়৷
‘কী জানি, আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না, এতদিন জানাল না আজ হঠাৎ করে…’
সকালে উত্তেজনায় আর কিছু খাওয়া হয়নি প্রহরের৷ যে ডিস্ট্রিবিউটার ম্যাগাজিন দিয়ে যায় তার আসার কথা দুপুর বারোটায়৷ সকাল দশটা থেকে তিনবার ফোন করে ফেলেছে প্রহর৷ ওর আর তর সইছে না৷ পলি আজ আর কলেজ যায়নি৷ সাড়ে এগারোটা নাগাদ ব্যাগ কাঁধে চলে এসেছে ওর দোকানে৷
শেষবার ছেলেটা ফোন ধরে বলেছে পনেরো মিনিটের মধ্যে ম্যাগাজিন নিয়ে ঢুকছে৷ পলির কলেজের ব্যাগটা পড়ে রয়েছে স্টলের একপাশে৷ সে প্রহরের দিকে চেয়ে হাসে, ‘তুই এত উতলা হচ্ছিস কেন বলতো?’
‘কারণটা তুইও জানিস, আজকের দিনটার জন্য কম অপেক্ষা করেছি আমরা?’
‘এরপর তো আর অপেক্ষা করতে হবে না৷ আমার কিন্তু ভালোই লাগত, জানিস?’
‘কী ভালো লাগত?’
‘এই যে তুই নেই-নেই করে বইয়ের দোকানটা চালিয়ে নিচ্ছিলি৷ এখন থেকে তোকে রোদে ঘুরতে হবে৷ লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেল বাজাতে হবে৷ আমার কেমন জানি ভালো লাগছে না৷’
আজও ঝিমঝিমে বৃষ্টি হয়ে চলেছে সকাল থেকে৷ সেই সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইছে থেকে থেকে৷ একটু কাছে সরে এসে পলি প্রহরের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে৷ আঙুলের ফাঁকে আঙুল আশ্রয় পায়৷ দু-জনের হাতই ঘামে ভিজেছিল৷
হাওয়ার দাপটে শুকিয়ে যায় তারা৷
সেই হাওয়া নীলচে প্লাস্টিকের চাদর উড়িয়ে নিয়ে যায়, সেইসঙ্গে ওড়ে পলির চুল৷ ছেলেটার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে পলি, ‘তুই না থাকলে আজকের দিনটা কোনওদিনও আসত না আমার জীবনে…’
‘আমাদের জীবনে…’ বিড়বিড় করে বলে প্রহর৷ পলির চুলগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে৷ মেয়েটার দিকে ফিরে তাকায় ও৷ গালের উপর একটা হাত রাখে৷ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল এসে পড়ে সেই হাতে৷ দুই-হাত মেয়েটার দুটো গালের উপর রাখে সে৷ চোখ বুজে ফেলে পলি৷
‘উঁহু, চোখ বুজতে নেই… স্বপ্নটা তো সবে শুরু হয়েছে, তাকা আমার দিকে…’ চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় পলি৷ সে চোখের ভেতর নিজের স্বপ্নটাকে সযত্নে লালিত হতে দেখে সে৷ ওর থেকে বেশি নিরাপদ আর কোথাও থাকতে পারে না স্বপ্নটা৷ সেটাকে আরও ভালো করে দেখতে চোখদুটো কাছে নিয়ে যায় সে৷ ঠিক সেই সময় ক্রিংক্রিং করে একটা বেল বেজে ওঠে৷ সাইকেলের বেল৷
ঝড়ের মধ্যে দিয়ে কোনওরকমে সাইকেল চালিয়ে ডিস্ট্রিবিউটার ছেলেটা এসে উপস্থিত হয়েছে দোকানের সামনে৷ দু-জন একটু সরে বসে৷ লজ্জায় মুখ আনত হতে যাচ্ছিল দু-জনের কিন্তু তার আগেই উত্তেজনা সেটাকে দ্রুত সরিয়ে দেয়৷ ‘দাও, ম্যাগাজিনটা দাও আগে…’
একরকম ছিনিয়ে ম্যাগাজিনটা হাতে নেয় প্রহর৷ তারপর দ্রুত সূচিপত্রে চলে যায়৷ উপর থেকে নীচে আঙুল বুলিয়ে দেখতে থাকে৷ একবার দেখে, দু’বার দেখে, তিনবার দেখে, ওর মুখের আলোটা একটু একটু করে নিভে আসে৷ থমথমে মুখ তুলে পলির দিকে তাকায় সে, ‘তোর নাম দেখতে পাচ্ছি না তো!’
‘সে কী! বলল যে ছাপা হবে…’
পলি উঁকি মারে সূচিপত্রের উপর৷ ততক্ষণে প্রহর ভেতরের পাতা উলটাতে শুরু করেছে৷ প্রত্যেকটা পাতা চট করে উলটে নিয়ে হতাশ হয়, ‘কই নেই তো…’
‘কী করছ তোমরা?’ ডিস্ট্রিবিউটার ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘টাকাটা দাও, আমি কেটে পড়ি৷’
মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে দেয় প্রহর৷ অকারণে বাকি পত্রিকাগুলোও উলটেপালটে দেখে৷
‘তোকে ঠিক বলেছিল? এই মাসেই ছাপা হবে?’
‘তাই তো বলেছিল, ফোনে পরিষ্কার বলল…’
‘ওদের একবার ফোন করে দেখ তো…’
পলি নিজের নম্বর থেকে দু-বার ফোন করে সকালের নম্বরটায়৷ কিন্তু কল লাগে না৷ কেটে যায়৷
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা৷ হাওয়ার শন শন শব্দ কেবল নীরবতাকে খানখান করে দিতে থাকে৷ একসময় প্রহর ম্যাগাজিনটা রাগে ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ টেবিলের উপরে সজোরে একটা ঘুসি মারে৷ ‘এরকমই করে শালারা৷ মানুষকে আশা দেখিয়ে ছেড়ে দেয়৷ ঠিক আছে, আমিও দেখে নেব কতদূর যেতে পারে৷’
ওর কাঁধের উপর একটা হাত রাখে পলি৷ নরম শান্ত গলায় বলে, ‘কী আর করবি? যা ভাগ্যে নেই তা নিয়ে লড়াই করে কী লাভ? তার থেকে…’
‘দেখ আমার জ্ঞানের কথা ভালো লাগছে না৷ আর এই হতাশার ফ্যাচফ্যাচে ব্যাপারটা না, তোকে একদম মানাচ্ছে না…’
‘আমি হতাশ হয়েছি! কে বলেছে তোকে? হতাশ তো তোর হওয়ার কথা…’
‘আমার! মানে?’
‘হ্যাঁ, ডেলিভারি বয়ের চাকরি করা হবে না তোর…’
কয়েকটা রাগের রেখা খেলে যায় প্রহরের মুখে৷ পলির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে৷ ওর কাঁধে হাত রাখে পলি৷ মুহূর্তে সেটা সরিয়ে দেয় প্রহর৷ পলি নরম গলায় বলে, ‘আগে আমার কথা তো শোন, তারপর রাগ দেখাবি না হয়…’
‘বল…’
ডিস্ট্রিবিউটার ছেলেটা এতক্ষণে আবার ঝড়ের মধ্যে মাথা বাঁচিয়ে সরে পড়েছে৷ পলি আচমকাই ওর কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘আমি ওদের প্রথম যে গল্পটা পাঠিয়েছিলাম সেটাই ওদের পছন্দ হয়ে গেছিল৷ ওরা ছাপতেই চাইছিল, কিন্তু আমি বারণ করে দিয়েছিলাম৷’
‘বারণ করে দিয়েছিলি? কেন?’
‘আমি চাইনি, তাই…’
‘চাসনি মানে? ম্যাগাজিনে তোর গল্প ছাপা হোক সেটা তুই চাসনি? সত্যিই?’
‘উঁহু, ওটা তুই চেয়েছিলি৷ ওটা তোর স্বপ্ন ছিল…’
‘তাহলে তোর স্বপ্ন কী ছিল?’
পলি হাসে৷ ওর গালে অল্প করে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে, ‘আমরা কবে নিজেদের স্বপ্নটা অদলবদল করে নিয়েছি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনি, জানিস?’
‘তুই কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না৷’
‘বুঝতে হবে না, ম্যাগি খাবি?’
‘নিকুচি করেছে তোর ম্যাগির… কী বলছিস পরিষ্কার করে বলতো আগে…’
‘খেতে রাজি হ, তাহলে নিজেই বুঝতে পারবি৷’
পলি নিজের ব্যাগটা এগিয়ে দেয়৷ বিরক্ত মুখে তার চেন খুলে হাত ঢুকিয়ে দেয় প্রহর৷ টিফিন বক্সের বদলে অন্য একটা শক্ত কিছুতে হাত লাগে তার—একটা বই৷ মুহূর্তে টেনে সেটা বের করে আনে৷ কালচে প্রচ্ছদের উপরে বড়বড় করে লেখা আছে বইয়ের নাম, খড়কুটো৷ নীচে লেখিকার নাম৷ নামটা চেনা প্রহরের৷ সে অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে৷ চোখের পলক পড়ে না৷
‘ওরা আমার প্রথম গল্পটাই পছন্দ করেছিল৷ কিন্তু আমি ওদের বলেছিলাম ম্যাগাজিনের জন্য না লিখে বরং আমি আরও কিছু গল্প পাঠাব, সেগুলো পছন্দ হলে একটা বই ছেপে যেন বের করে ওরা৷ আমি কয়েকটা গল্প পাঠাই৷ সেগুলো পড়ে ওরা রাজি হয়ে যায়…’
‘তার মানে আমি এতদিন যেগুলো পাঠাতাম সেগুলো…’
‘যেত ওদের কাছেই৷ কিন্তু কোনওটাই ম্যাগাজিনে ছাপা হয়নি, কারণ ওগুলো ম্যাগাজিনের জন্য ছিল না৷’
‘কিন্তু তুই কেন…’
নিজের পকেট থেকে পার্সটা বের করে পলি একটা সই করা চেক বের করে আনে৷ তারপর প্রহরের বন্ধ হাতটা খুলে তাতে গুঁজে দেয় সেটা৷ বলে, ‘ওরা অ্যাডভান্স দিয়েছে৷ এতে তেমন কিছু হবে না জানি৷ কিন্তু আস্তে আস্তে টাকা জমা করলে একটা ভবিযুক্তি বইয়ের দোকান হবে না? কী রে?’
‘আমি… বইয়ের দোকান… মানে…’ খাবি খায় প্রহর৷
‘আমাদের স্বপ্নপূরণ করতে হবে না?’
‘মানে?’
‘মানে আমি যে বললাম—আমাদের স্বপ্নটা কবে অদলবদল হয়ে শেষে এক হয়ে গেছে আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনি… তোর ম্যাগাজিনের দোকানে তো আর বই বিক্রি হবে না… বইয়ের দোকান না করলে তোর স্বপ্নটা…’
একটা অদ্ভুত আবেগের স্রোত স্থবির করে দেয় প্রহরকে৷ হাওয়ার ঝাপটায় উৎসর্গের পাতাটা আবার খুলে যায়৷ ও অবাক চোখে তাকায় সেই খোলা পাতাটার দিকে৷
‘এই এটা তোর বাড়ির লোক দেখলে কী হবে বল তো?’
হাত নাড়িয়ে একটা ভঙ্গি করে পলি, ‘ধুর, আমার আর কিছু যায় আসে না…’ আচমকাই দুটো হাত দিয়ে পলিকে জড়িয়ে ধরে ও৷ ঝড়ের দাপট দুটো শরীরকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় কোথায়৷ প্রহর শুধু কানের কাছে ফিসফিস করে শুনতে পায়, ‘থ্যাঙ্ক ইউ সবকিছুর জন্য… তুই না থাকলে…’
প্রহর কিছু বলতে পারে না৷ ওর দুটো হাত এখনও সেই অবাস্তব জড়বস্তুকে ধরে আছে৷ যেন এইমাত্র কোনও পরাজাগতিক ওয়ার্ম হোল থেকে বেরিয়ে এসে ওর হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে গেছে কোনও অজ্ঞাত প্রাণী৷ ওর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে৷ কখনও কখনও মানুষ চোখ খুলে স্বপ্ন দেখে, আবার কখনও কখনও স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে যায়…
হঠাৎ কী যেন দেখে চেঁচিয়ে ওঠে পলি, ‘ওই দেখ হিরু, ভূতের রাজার তারা…’ প্রহর ফিরেও তাকায় না, ‘তোর গুলতানি বন্ধ কর তো৷ ওসব কিচ্ছু নেই…’
‘নারে সত্যি দেখলাম… আয় আমার সঙ্গে…’
ওর হাতটা ধরে একরকম জোর করেই ঝড়ের মধ্যে ছুট লাগায় পলি৷ হাওয়ায় কাগজ ওড়ে, পাতা ওড়ে… শব্দগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়৷ দু-জনে কী এক অবাস্তবকে তাড়া করে দৌড়ে বেশ কিছুদূর চলে আসে৷ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে পলি৷ প্রহর থেমে বড় করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, ‘কই তোর ভূতের রাজার তারা? কিছুই তো নেই এখানে…’
পলি একগাল হাসে, তারপর ওর মাথায় হাত রেখে বলে, ‘এই তো বোকা… আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ তুই আমার ভূতের রাজা৷ যে কাছে থাকলে সব ইচ্ছাপূরণ হয়ে যায়…’
ঝড়ে উড়ে আসা খড়কুটো নাচতে থাকে ওদের ঘিরে৷ ধুলোর চাদর এসে কখন যেন সবার চোখ থেকে ঢেকে দেয় ওদের…