তুমি

সূর্য যখন উড়ালো কেতন
              অন্ধকারের প্রান্তে,
তুমি আমি তার রথের চাকার
             ধ্বনি পেয়েছিনু জানতে।
সেই ধ্বনি ধায় বকুলশাখায়
প্রভাতবায়ুর ব্যাকুল পাখায়,
সুপ্ত কুলায়ে জাগায়ে সে যায়
                 আকাশপথের পান্থে।
                 অরুণরথের সে-ধ্বনি পথের
                     মন্ত্র শুনায়ে দিলে
তাই পায়ে-পায় দোঁহার চলায়
             ছন্দ গিয়েছে মিলে।
তিমিরভেদন আলোর বেদন
             লাগিল বনের বক্ষে,
নবজাগরণ পরশরতন
              আকাশে এল অলক্ষ্যে।
কিশলয়দল হল চঞ্চল,
শিশিরে শিহরি করে ঝলমল,
সুরলক্ষ্মীর স্বর্ণকমল
             দুলে বিশ্বের চক্ষে।
রক্তরঙের উঠে কোলাহল
               পলাশকুঞ্জময়,
তুমি আমি দোঁহে কণ্ঠ মিলায়ে
             গাহিনু আলোর জয়।
সংগীতে ভরি এ প্রাণের তরী
             অসীমে ভাসিল রঙ্গে,
চিনি নাহি চিনি চিরসঙ্গিনী
             চলিলে আমার সঙ্গে।
চক্ষে তোমার উদিত রবির
বন্দনবাণী নীরব গভীর,
                     অস্তাচলের করুণ কবির
             ছন্দ বসনভঙ্গে।
উষারুণ হতে রাঙা গোধূলির
             দূরদিগন্তপানে
বিভাসের গান হল অবসান
             বিধুর পূরবীতানে।
আমার নয়নে তব অঞ্জনে
              ফুটেছে বিশ্বচিত্র,
তোমার মন্ত্রে এ বীণাতন্ত্রে
              উদগাথা সুপবিত্র।
অতল তোমার চিত্তগহন,
মোর দিনগুলি সফেন নাচন,
তুমি সনাতনী আমিই নূতন,
                অনিত্য আমি নিত্য।
মোর ফাল্গুন হারায় যখন
                আশ্বিনে ফিরে লহ।
তব অপরূপে মোর নবরূপ
                দুলাইছ অহরহ।
আসিছে রাত্রি স্বপনযাত্রী,
             বনবাণী হল শান্ত।
জলভরা ঘটে চলে নদীতটে
               বধূর চরণ ক্লান্ত।
নিখিলে ঘনালো দিবসের শোক,
বাহির-আকাশে ঘুচিল আলোক,
উজ্জ্বল করি অন্তরলোক
               হৃদয়ে এলে একান্ত।
লুকানো আলোয় তব কালো চোখ
               সন্ধ্যাতারার দেশে
ইঙ্গিত তার গোপনে পাঠালো
             জানি না কী উদ্দেশে।
দেখেছি তোমার আঁখি সুকুমার
               নবজাগরিত বিশ্বে।
দেখিনু হিরণ হাসির কিরণ
               প্রভাতোজ্জ্বল দৃশ্যে।
হয়ে আসে যবে যাত্রাবসান
বিমল আঁধারে ধুয়ে দিলে প্রাণ,
দেখিনু মেলেছ তোমার নয়ান
               অসীম দূর ভবিষ্যে।
        অজানা তারায় বাজে তব গান
              হারায় গগনতলে।
বক্ষ আমার কাঁপে দুরু দুরু,
               চক্ষু ভাসিল জলে।
        প্রেমের দিয়ালি দিয়েছিল জ্বালি
             তোমারি দীপের দীপ্তি
মোর সংগীতে তুমিই সঁপিতে
             তোমার নীরব তৃপ্তি।
               আমারে লুকায়ে তুমি দিতে আনি
আমার ভাষায় সুগভীর বাণী,
চিত্রলিখায় জানি আমি জানি
              তব আলিপনলিপ্তি।
        হৃৎশতদলে তুমি বীণাপাণি
              সুরের আসন পাতি
দিনের প্রহর করেছ মুখর,
              এখন এল যে রাতি।
চেনা মুখখানি আর নাহি জানি,
              আঁধারে হতেছে গুপ্ত।
তব বাণীরূপ কেন আজি চুপ,
              কোথায় সে হায় সুপ্ত।
        অবগুণ্ঠিত তব চারি ধার,
মহামৌনের নাহি পাই পার,
হাসিকান্নার ছন্দ তোমার
গহনে হল যে লুপ্ত।
           শুধু ঝিল্লির ঘন ঝংকার
             নীরবের বুকে বাজে।
  কাছে আছ তবু গিয়েছ হারায়ে
             দিশাহারা নিশামাঝে।
  এ জীবনময় তব পরিচয়
             এখানে কি হবে শূন্য।
  তুমি যে বীণার বেঁধেছিলে তার
             এখনি কি হবে ক্ষুণ্ন।
  যে পথে আমার ছিলে তুমি সাথী
         সে পথে তোমার নিবায়ো না বাতি,
  আরতির দীপে আমার এ রাতি
            এখনো করিয়ো পুণ্য।
  আজো জ্বলে তব নয়নের ভাতি
            আমার নয়নময়,
  মরণসভায় তোমায় আমায়
            গাব আলোকের জয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *