১০
সমস্ত রাত দুটি চোখের পাতা এক করতে পারেননি।
প্রকাণ্ড হাটতলার একপ্রান্তে পুরুষেরা, সে-দলে তিনি নিজে। আর অপরপ্রান্তে শিষ্যার দল, যে-দলে ঘুমাচ্ছে কুসুমমঞ্জরী। মাঝখানে—দীর্ঘায়ত হাটতলার মাঝামাঝি কর্তা-মশাই একাই শুয়েছেন। সমস্ত দিনে পদব্রজে এসেছেন তারকেশ্বর থেকে এই চার-ক্রোশ পথ। দেহ ক্লান্ত। কিন্তু মন অশান্ত। কার্যকারণ সূত্রে সমস্ত ঘটনাগুলিকে গ্রথিত করতে পারছিলেন না।
রাধা একজন তরুণ বরাতিকে, কমলকুমারকে নিয়ে মশাল হাতে ওঁদের খুঁজতে বের হয়েছিল—কর্তা-মশায়ের নির্দেশেই! তিনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন—কী মর্মান্তিক প্রয়োজনে সেই ধন্বন্তরি পৃথকস্থানে রাত্রিবাসের জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়েছিলেন। এটাও বুঝেছিলেন—সম্ভবত ওঁরা আশ্রয় নিয়েছেন কোন মন্দির প্রাঙ্গণে। রাধা কোন প্রশ্ন করেনি রূপেন্দ্রনাথকে। শুধু মঞ্জরীর হাতটি দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে বলেছিল, আয়।
কমলকুমার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল, ঠাকুরমশাই। এই ডাকাতে কালীর মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন? কী দুঃসাহস। শোনেননি, এখানে নরবলি হয়?
রূপেন্দ্র সহাস্যে প্রত্যুত্তর করেছিলেন, সেজন্যই তো খড়্গহাতে অপেক্ষা করছি। জল্লাদটা এলে তাকে বলি দেব বলে।
বলেছিলেন, মশালটা নিয়ে এসতো ভাই। কোশাকুশি আর খড়্গটা মায়ের মন্দিরে রেখে আসতে হবে।
এবার কপাট খুলেই জ্বলন্ত মশালের আলোয় দেখতে পেলেন—বিশালাক্ষী স্বস্থানে অধিষ্ঠিতা। অট্টহাস্য করে উঠেছিলেন তান্ত্রিক পিতার উপযুক্ত পুত্র। মাতৃমূর্তির দিকে ফিরে ‘যে-কথাটা বলেছিলেন তার অর্থগ্রহণ হয়নি সেই কমলের : ধমক খেয়ে সুবুদ্ধি হয়েছে দেখছি! ক্ষ্যাপামির একটা সীমা থাকবে তো?
তারপর ফিরে এসে তাঁকেও ঐ একই ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল কর্তা-মশায়ের কাছে। এবং তারপর যে-যার শয্যায়। কিন্তু নিদ্রার কোনও আভাস নেই।
কী হতে পারে? তিনি কি তাহলে হাতটা সত্যিই বাড়িয়ে দেখেননি? মনে মনে ভেবেছেন, কিন্তু বাস্তবে অর্ধচন্দ্রাকারে হাতটা তিনি ওভাবে ঘোরাননি। তা না হলে মায়ের মূর্তিকে স্পর্শ করতে পারেননি কেন? মাকে ধমক দিয়েছিলেন—কিন্তু সত্য সত্যই তো মৃন্ময়ী মূর্তি তখন
শ্মশানে নেচে বেড়াচ্ছিল না। তা সম্ভব নয়। তাহলে?
—ঘুম যদি নাও হয় চুপটি করে শুয়ে থাকছ না কেন?
রূপেন্দ্রনাথ বসেছিলেন খুঁটিতে ঠেশ দিয়ে। ঘুরে দেখলেন। শুক্লপক্ষের সপ্তমীর চাঁদ ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে—তবু আলোর পশরা তার শেষ হয়নি। আবছা আলোয় চিনতে কোনও অসুবিধা হল না। শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, ওর দেহগঠনের একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। ডম্বরু-আকৃতির। ক্ষীণকটির দুই প্রান্তে পুরন্ত দেহের আভাস
রূপেন্দ্রর ভ্রুকুঞ্চনটা এত কম আলোয় নিশ্চয় দেখতে পায়নি, কিন্তু বাচনভঙ্গিতে বুঝতে পারে তাঁর বিরক্তিটা। রূপেন্দ্র বললেন, ঘুম তো আপনারও হয়নি। ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন অহেতুক?
রাধারানী বসল যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। বলল, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ, ঠাকুর। একমাত্র কর্তামশাই বাদে আখড়ায় আর সবাইকেই আমরা ‘তুমি’ সম্বোধন করি। অহেতুক রাগ কর না।
—কিন্তু এতক্ষণ তো আমাকে ‘আপনি’ই বলছিলে?
–সে তো দিনের বেলায়। রাতের কানুন ভিন্ন।
—ও! তাই বুঝি? তা আজ তোমাদের শয়নব্যবস্থাটাও ভিন্ন জাতের হয়ে গেল কেন? আখড়ায় ‘ভেজাল’ জুটে গেছে বলে?
—তা নয় গো মশাই! আখড়ার বাইরে এটাই প্রথা। কর্তামশাই বলেন, “লোকমধ্যে লোকাচার/সদ্গুরু মধ্যে একাচার।” তোমরা দুজন না থাকলেও এই ব্যবস্থাই হত। গাঁয়ে-গঞ্জের গাঙে চখারা এ-পারে, আর চখীরা ও-পারে।
রূপেন্দ্রনাথ হাসলেন। বাগ্বৈদগ্ধ্যে বোঝা গেল মেয়েটি সুরসিকা। তবু জবাব দিলেন না। রাধারানী প্রসঙ্গান্তরে এল, একটা কথা বলবে?
–কী?
—তখন তুমি সেই শ্মশানকালীকে ও-কথা বললে কেন?
বিষয়টা মঞ্জুকে বলেননি। সে ভয় পাবে বলে। ভেবেছিলেন, কাল কর্তা-মশাইকে বলবেন, জানতে চাইবেন কী করে হল এই ভ্রান্তি। কিন্তু এখন এই মেয়েটির প্রশ্নে তাকেই সব কথা খুলে বললেন। কারও সঙ্গে আলোচনা না করে যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। বুঝেছেন, মেয়েটি কিছু প্রগলভা, কিন্তু বুদ্ধিমতী।
আদ্যন্ত শুনে রাধা বলল, তা এতে অবাক হবার কী আছে? ‘মা কালীতো জাগ্রতা। তিনি ইচ্ছে করলে পারেন না পীঠ ছেড়ে শ্মশানে যেতে?
—মা কালী পারেন, শুধু শ্মশানে কেন, মহাকাশের শেষপ্রান্তেও। কিন্তু মানুষের গড়া মৃন্ময়ী মূর্তি পারে না।
–কেন পারবে না? তিনিই তো “ মা?
—না! তিনি “ মায়ের প্রতীক মাত্র। জাগতিক আইন-কানুন মেনে চলতে হয় মৃন্ময়-মূর্তিকে! মাটি-পাথরের মূর্তি ওভাবে শ্মশানে ঘুরে বেড়াতে পারে না।
–কে বলেছে?
—শ্রীরূপেন্দ্রনাথ দেবশর্মাঃ।
এ কথার জবাব নেই। রাধা শুনেছে—কর্তামশাই তাকে গোপনে জানিয়েছেন,রূপেন্দ্রনাথ একজন সিদ্ধপুরুষ। তাঁর আদরযত্নের যেন কোন ত্রুটি না হয় এদিকে রাধাকে সবিশেষ দৃষ্টি দিতে বলেছেন। রূপেন্দ্রের হুকুমে দামোদরে অকাল ষাঁড়াষাড়ির বাণ আসে—মত্ত গজদানব শান্ত হয়। তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং এ দার্ঢ্য প্রত্যাশিত। সিদ্ধপুরুষ না হলে কি কেউ “মাকে ওভাবে গালমন্দ করার সাহস পায়? বলে, তাহলে কেন তুমি হাত বাড়িয়ে ঁমায়ের স্পর্শ পেলে না?
—জানি না। সমস্যাটা তো সেটাই! আমার মনে হচ্ছে এইভাবে আমি আমার দক্ষিণহস্তটা চালনা করেছিলাম, বাস্তবে হয়তো করিনি। আমি ভেবেছি করেছি, সেই চিন্তাটাই…
নীমিলিত নেত্রে হস্তচালনার ক্রিয়াটা দেখাতে গেলেন রূপেন্দ্র! এবার কিন্তু তা শূন্যে শেষ হল না। বাধা প্রাপ্ত হল একটি নারী দেহে। পৃষ্ঠদেশ নয়, বক্ষে
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো হাতটা টেনে নিতে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ। আর সে হাতখানি হঠাৎ দু-হাতে ধরে ফেল্ল রাধা। বললে, সত্যি করে বলতো ঠাকুর—কেন পালিয়ে গেছিলে? কীসের ভয় তোমার? সুন্দরী বউকে কেউ বেদখল করে নেবে ভয়ে? না কি কোন রাক্ষসী তোমার ঘাড় মটকে রক্ত খাবে বলে?
রূপেন্দ্রনাথ কোন জবাব দিলেন না। ধীরে ধীরে ওর মুঠি থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। রাধা বাধা দিল না। হাতটা ছেড়ে দিল। একটু ঘনিয়ে এসে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললে, কই, জবাব দিলে না যে?
অসতর্ক হস্ত-সঞ্চালনে ঐ মেয়েটির পীনোন্নত বক্ষে করস্পর্শ করাতেই কি ওর বুকের দরজার আগলটা খুলে গেল? রূপেন্দ্র বলেন, কোন প্রশ্নের জবাব?
—কাকে তোমার ভয়? তুমি শ্মশানকালীকেও ভয় পাও না—তাঁর বেচাল দেখলে তাঁকে ধমক দাও। তাহলে কাকে ডরাও গো তুমি?
—যদি বলি : নিজেকে? নিজের মনটাই কি সব সময় নিজের মুঠোয় থাকে? রাধা ঠোঁট উলটায়। বলে, তাহলে বলব মিছে কথা বলছ! তুমি সিদ্ধপুরুষ। তোমার মন তোমার মুঠোয়। তাকে আবার ভয় কী?
রূপেন্দ্র ওর চোখে-চোখে তাকিয়ে বলেন, কোন জবাবটা শুনলে খুশি হবে? যদি বলি : তোমার ভয়ে?
রাধার মাথাটা নিচু হয়ে যায়। পরক্ষণেই সে চোখে চোখে তাকায়। কী-একটা কথা বলতে চায়—কিন্তু বলা হয় না। রূপেন্দ্রের পাশেই শুয়েছিল একজন বরাতি —- সেই কমলকুমার। ঘুমের ঘোরে ধমক লাগায়, তোমাদের প্রেমালাপ কি থামবে না? ঘুমাও না বাপু!
রাধা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, চলি। কে কোথায় দেখবে। ভুল বুঝবে।
রূপেন্দ্রও তৎক্ষণাৎ বললেন, তুমি ভুল না বুঝলেই হল।
রাধা পা বাড়িয়েছিল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু বলে না। ধীর পদে চলে যায় ও-প্রান্তে। চাঁদ অস্ত গেছে। পুব-আকাশে আলোর আভাস। সূর্য এখনো দিগন্তের অনেক নিচে। পূর্বগগনে এখন একচ্ছত্র সম্রাট ঐ ‘ভুলকো তারাটা।
‘ভুলকো’ তারা। কার ‘ভুল’কে সম্বল করে ওর ওমন নামটা হল গো? জ্যোতিষাচার্যরা বলেন—উনি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য! আসুরিক সাধনার মূর্ত প্রতীক।
কিন্তু ‘আসুরিক’ মানে তো ‘তামসিক’ নয়।
দেবযানীও তো ঐ শুক্রাচার্যের আত্মজা।
তাঁর সাধনা কি তামসিক? ‘ভুলকো’?