1 of 2

তিস্তা

তিস্তা

প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে হু-হু হাওয়ায় সকালের রোদে দাঁড়িয়ে তিস্তার বানের মতো একসঙ্গে অনেক কথা মনে পড়ে গেল যোগেনের। গ্রাম তার কোনোদিনও ভালো লাগে না। ওর সত্যিই কি আবার এতদিন পর তিস্তার পারে ফিরে আসার দরকার ছিল? যা তার এখানে ছিল সবই তো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সর্বগ্রাসী তিস্তা!

থাকবার মধ্যে ছিল কয়েক বিঘা ধানি জমি–আর দাদা। যোগেনের দাদা নগেন। লেখাপড়া। করেনি, শহরে যায়নি কোনোদিন। সে শুধু চাষ বুঝত। রোদে-জলে মাঠেঘাটে বিবর্ণ ছাতা হাতে ঘুরে বেড়াত। দাদা নিজে লেখাপড়া শেখেনি, শহরে আসেনি, কিন্তু যোগেন যে বি এ পাশ করে শহরের একটা সওদাগরি অফিসে চাকরি করছে সে তার দাদারই জন্য। বুড়ো দাদাই তাকে। পড়াশোনা শিখিয়েছিল, বাবা-মার অবর্তমানে নিজের ছেলের মতো করে ভাইকে মানুষ করেছিল।

মানুষ করেছিল কথাটা ভাবলে যোগেনের হাসি আসে। বাজারের ঝুলিয়ে রাখা মরা পাঁঠাদের গায়ে যে ছাপ থাকে সেই রকম একটা ছাপ মেরে দিয়েছে ইউনিভার্সিটি। আর সেই ছাপের জোরে দিনগত পাপক্ষয় করেছে ও।

একথা মনে হচ্ছে যোগেনের, বোধহয় নগেন আজ নেই বলে। বন্যার বহুদিন পরে একটা বিবর্ণ পোস্টকার্ড এসেছিল মেসের ঠিকানায়, লেখা ছিল, কল্যাণবরেষু বাবা যোগেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাইতেছি যে, তোমার দাদা নগেন আর নাই। আমার মেজো ছেলে স্বপনও নাই। তাহারা দু-জনেই রাক্ষসী তিস্তার তোড়ে ভাসিয়া গিয়াছে। আমরা সকলে ভাসিলেই বোধকরি ভালো হইত। যে অবস্থায় আমরা এখন আছি তাহার চেয়ে মরিয়া যাওয়া ভালো ছিল। ইতি আং আশীর্বাদক হারু কাকা।

পুঃ তোমাদের বাড়ি পড়িয়া গিয়াছে। জমি বালিতে ও পলিতে ভরাট। যত শীঘ্র পার একবার আসিবার চেষ্টা করিও।

চেষ্টা করলেই কি আর তখন আসা গেছে? তা ছাড়া এক একবার মনে হয়েছে, গিয়ে হবেটাই বা কী? দাদা নেই, বাড়ি নেই, দেখতে গিয়ে লাভ কী? তবু জানে না, কেন, কীসের টানে, বাস্তুভিটের টানে ভিড়-ভারাক্কা কমলে ধার-ধুর করে টিকিটটি কেটে চলেই এসেছে যোগেন।

বেলা পড়ে গিয়েছিল। হাওয়াতে এতদিন পরেও যেন একটা পচা দুর্গন্ধ বইছে, যে গন্ধ নোরা জলে হয়, কী শকুনির ডানায় ওড়ে। প্রায় পাঁচ মাইল পায়ে হেঁটে যখন গ্রামে এসে পৌঁছোল যোগেন তখন সত্যিই কিছু চিনতে পারল না। চারদিক ধু-ধু। ঘর বাড়ি বলতে কিছু নেই, এমনকী হারু কাকার অমন দোতলা লাল টিনের ছাদওলা বাড়িটারও কোনো চিহ্নমাত্র নেই। গোরুর গলার ঘন্টা নেই, গাছের ছায়া নেই, বাছুরের হাম্বা নেই, ঘুঘুর ডাক নেই, শেষ বিকেলের হাওয়াটা যেন নদীর পাশের একটা নিস্তব্ধ রুক্ষ শশ্মশানের উপর দিয়ে বইছে। ফিসফিস করে হাওয়াটা। প্রেতিনির মতো নদীর সঙ্গে কথা বলছে। ঝুর ঝুর করে বালি উড়ছে, বালি ঝরছে। সেই মরুভূমির মধ্যে অনেক দূরে পাতায় আর চটে ছাওয়া কতগুলি ঘরের মতো দেখল যেন যোগেন।

বড়ো অশ্বত্থগাছটা পড়েনি। আরও বহু বড়ো বড়ো গাছও রয়ে গেছে। ছোটো গাছ, যেগুলো পড়েনি, সেগুলো কাদা মেখে কুৎসিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আগে যেখানে খুরসেদ মিঞার বাড়ি ছিল সেখানে কে একজন একটা ন্যাড়া তালগাছের তলায় ঝুপড়ি বানিয়ে একটা দোকানমতো দিয়েছে। যাদুকরী বিড়ি দেশলাই, মুড়ি, কিছু শুকনো আলু আর চোপসানো বেগুন। দিশি বিস্কুটে, মাছি ভনভন করছে। লোকটা একটা চট, আলোয়ানের। মতো গায়ে দিয়ে বসে একমনে এক চোখ বন্ধ করে বাঁ কান পরিষ্কার করছিল।

যোগেন কাছে যেতেই বলল, কই চলেন বাহে।

তারপরই বলল, চিনতে পারল না?

যোগেন অবাক হয়ে দেখল তারু কাকা। হারু কাকার দাদা। ভাবা যায় না! যে হারুকাকা আর নীরু কাকা দাওয়ায় বসে হুকো খেত আর মহাজনি কারবার করত, যাদের কাছে এই স্বল্প-বসতি গ্রামের সকলের মান সম্মান হাসি আনন্দ সব বাঁধা ছিল! যারা বিপদে আপদে হর্তাকর্তা ছিল তাদেরও আজ এই অবস্থা।

যোগেন থতমতো খেয়ে ছোটোবেলায় অভ্যাসবশে জুতোটা খুলে ফেলে হাতে নিল।

তারু কাকা খকখক করে কাসল, বলল, থো থো আর ভক্তি দেখাইয়া কাম নাই। ক্ষুধা লাগছে? খাবি কিছু?

যোগেন বলল, না।

তারুকাকা বলল, তবে যা গিয়া–

যোগেন শুনল। তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে একটু চুপ করে থাকল। বলল, যামু কই? যাওনের জায়গা নাই।

তারু কাকা উঠে দাঁড়াল। কোমর টান করে দাঁড়াতে কষ্ট হয় আজকাল। ধরা গলায় বলল, ক্যান? নগেন নাই বইল্যা কী সবাই ভাইস্যা গেছে গিয়া? যা যা–সোজা অশ্বত্থাগাছ তলায় চইল্যা যা। হারুরে। পাবিআনে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী ভাবল যোগেন, তারপর বিষণ্ণ গোধূলিতে পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে গ্রামের মাঝের অশ্বত্থাগাছের দিকে এগিয়ে চলল।

ওর মাথার উপর একটা চাতক পাখি ফটিক জল ফটিক জল ডাকতে ডাকতে চমকে বেড়াতে লাগল। যোগেন একবার উপরে তাকিয়ে জোরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তিস্তায় তো অনেক জল .হালা ওইহ্যানে যাওনা ক্যান?

অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিল যোগেন। ঘুম ভাঙল, সূর্য উঠে যাবার বেশ পরে। কাল বিকেলে মনে হয়েছিল পাখিরাও বুঝি সব ভেসে গেছে। কিন্তু এই প্রথম সকালে মনে হল, সব পাখি মরেনি। সকালের রোদ বড়ো বড়ো অশ্বত্থাপাতায় ঝিলমিল করছে। কটা শালিক এসে বসেছে উপরের ডালে।

কাল রাতে হারু কাকার সঙ্গে অনেক গল্প করেছে যোগেন। বেশ ঠান্ডা ছিল। গাছতলায় আগুন জ্বেলে বসে হারু কাকার কথা শুনছিল। বন্যার তাণ্ডবের কথা। হারুকাকার দাড়িওয়ালা মুখটাকে গাছের গুড়ির পটভূতিতে আগুনের আভায় কোনো সন্ন্যাসীর মুখ বলে মনে হচ্ছিল। হারুকাকা আস্তে আস্তে বলছিল, আমরা আবার নতুন কইর‍্যা উদবাস্তু হইলাম-বোঝলা যোগেন।

যোগেন কথার উত্তর দেয়নি কোনো। শুনছিল। ভাতের গরম ফ্যানে নুন মিশিয়ে কাচের গেলাসে করে যোগেনকে দিয়ে গিয়েছিল। যোগেন বুনিকে শেষ দেখেছিল অনেকদিন আগে। তখন হারু। কাকার বাড়ির মেয়েদের সচরাচর চোখে দেখা যেত না। কৃচিৎ কদাচিৎ গ্রামের কোনো অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হত। তবে ওরা যখন ছোটো ছিল তখন দুপুরে দুপুরেটো-টো করে ঘুরে বেড়াত। চরের পাশে পাশে কাশফুলে আর নলবনে হাওয়ার ঢেউ উঠত। ঘুঘু ডাকত ঘুঘুর ঘু–আপালচাঁদের জঙ্গলের দিক থেকে ময়ূরের ডাক শোনা যেত। তিস্তার ওপারের সরস্বতী চা বাগানের পাশে নেপালি গোয়ালাদের দুধের বাথান বহুদূর থেকে দেখা যেত।

বুনি বলত, চলেন যোগেনদা, আমরা একদিন সাঁতরাইয়া চইল্যা যাই। ওপারে। যাইবেন? আপনে যা ভিতু।

যোগেন হাসত। বলত, তিস্তা সাঁতরানো তোমার মতো রোগা মেয়ের কম্ম নয় একটু গিয়ে ভয়েই মরে ভেসে যাবে।

উত্তরে বুনিও হাসত। বলত, ভাই-বোন না যে আমি ভাইস্যা গেলে আপনারে ছাইড়া যামু। আপনারে এমন কইর‍্যা জড়াইয়া ধরুম যে আপনারেও আমার লগে ভাইস্যা যাইতে হইব।

যোগেন কথা বলত না।

মুড়ি আর বাতাসা দিয়ে সকালের খাওয়া শেষ করল যোগেন।

গ্রামের ছেলে-বুড়োরা সকলেই যে যার জমি উদ্ধারে লেগেছে। সকাল আটটা নটা বাজতেই সমস্ত গ্রামে এমন একটা কাজের জোয়ার, চেঁচামেচি, উদ্দীপনা, পড়ে গেল যে, ছোটোবেলায় এমন কোনোদিন দেখেছে বলে যোগেনের মনে পড়ল না। সকলের চোখে মুখেই বাঁচার জন্যে একটা প্রচণ্ড জেদ দেখতে পাচ্ছে যোগেন। এই অলস, মন্থরগতি, ভাগ্যে-বিশ্বাসী, অল্পে-সন্তুষ্ট, হুঁকো-খাওয়া লোকগুলোর মধ্যে এতখানি আগুন লুকোনো ছিল ভাবতে পারেনি ও কোনোদিন।

ধীরু দাস কোদাল কাঁধে ছুটে যাচ্ছিল। যোগেন বলল, কী কাকা?

ধীরু দাস মুখ ফিরিয়ে বলল, আইছস। আর ক্যান? এবার লাইগ্যা পড়। হালার ব্যাটা হালার তিস্তা আমাগো হারাইবে, তা অইব না।

যোগেন বলল, সরকার কিছু করবে না?

হারু মণ্ডল বলল, কইরলে করব। তাগো লইগ্যা বইস্যা থাহনের কাম কী? আমাগো কি হাত-রথ নাই? না, তাও নদীতে নিছে? বলেই হারুকাকা দৌড়ে গেল।

দুপুরে হারুকাকারা সকলে ফিরল। গাছতলায় সকলে বসে কলাইকরা থালায় ভাত আর বেগুনসিদ্ধ খেল, নুন, আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে। তাতেই কত তৃপ্তি। যোগেনও খেল। যোগেন কাল থেকে যত দেখছে তত যেন অবাক হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল, কেঁদে কেঁদে চোখ-ফোলানো কতগুলি নারী পুরুষ দেখবে। কিন্তু এসে দেখল এদের কারো চোখেই জল নেই। যা আছে তা জ্বালা।

খাওয়া-দাওয়ার পর হারুকাকা বুনিকে ডেকে বলল, খাওন-দাওনের পর যোগেনরে লইয়া যা। কোথায় নিয়ে যাবে, কী বৃত্তান্ত, হারুকাকা কিছুই বলল না। তারপর ষাট বছরের হারু দাস রোদের মধ্যে দলবল নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল।

যোগেন কিছুক্ষণ একা একা অশ্বত্থ গাছতলায় বসে রইল। ফুরফুরে হাওয়ায়। একসময়ে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বুনি বলল, চলেন যাই।

যোগেন উঠল। বলল, কোথায়?

কই আর? আপনাগো বাসায়। বলেই, ফিক করে হাসল। যেন যোগেনের বাড়ি ভেসে গেছে, ওদের বাড়ি ভেসে গেছে বলে ওর কোনো দুঃখই নেই। যেন খুব একটা মজার ব্যাপার হয়েছে।

ওরা চুপচাপ দুপুরের ধুলো-ওড়া হাওয়ায় ভেসে ভেসে হাঁটতে লাগল রোদে।

একটু পরে বুনি বলল, নগেনদায় আমারে বড়ো ভালোবাসত।

যোগেন বলল, জানি। আর কিছু বলল না। বুকের মধ্যেটা একবার মুচড়ে উঠল শুধু।

অনেকখানি হেঁটে যখন ওরা যোগেনদার বাড়ির কাছাকাছি এল তখন যোগেনের চেনা চেনা লাগল। তার পরই জায়গামতো পৌঁছে গেল।

বুনি বলল, রোদের বড়ো তেজই আমি এইখানে বইলাম একটু।

যোগেন বলল, বোসো।

তাকিয়ে দেখল, উঠোন নেই, সন্ধ্যামালতির বেড়া নেই, তুলসীতলা নেই, দাওয়া নেই, পুবের ঘর নেই, কিছুই নেই। এমনকী বড়ো ঘরেও চিহ্নমাত্র নেই। রান্নাঘরের টিনের চালাটা কী করে যেন কাদায় আটকে অ্যারোপ্লেনের ডানার মত উঁচু হয়ে আছে। সজনে গাছটার কিছু হয়নি। পাতাগুলোও সবুজ আছে। যার তলায় বুনি বসে আছে। আশ্চর্য!

যোগেনও গিয়ে বুনির পাশে বসল। বুনি বলল, ভাবেন কী?

না।

নাঃ আবার কী? সবাই কোদাল হাতে লাইম্যা গেছে আর আপনি কেমন মরদ? খালি খালি নিঃশ্বাস ছাড়েন।

যোগেন হাসল। বলল, হে কথা না। কার লইগ্যা করুম আমি? আমার আছে কেডা?

বুনি এবার বড়ো বড়ো চোখ করে যোগেনের মুখে তাকাল। তারপর বল, হ! কইছেন ঠিকেই। তবে পলাইয়াই যান। দেহি আমি কিছু করবার পারি কিনা। তারপরই বলল আমিই বা কার লইগ্যা করুম?

যোগেন বলল, থাউক, থাউক, আপনের আর এই রৌদ্রে কোদাল কোপাইয়া কাম নাই।

বুনি হাসল। বলল, ক্যান? গইল্যা যামু? ডরাইয়েন না। এহনে আমি সব পারি।

তারপর আরো কিছুক্ষণ ওরা দুজনে চুপ করে বসে রইল।

একজোড়া ঘুঘু কোথা থেকে উড়ে এসে আগে যোগেনদের যেখানে উঠোন ছিল সেখানে পাইচারি করে বেড়াতে লাগল।

বুনি বলল, বাস্তু ঘুঘু।

যোগেন বলল, অরা জোড়ায় থাকে ক্যান?

বুনি বলল, তা ক্যামনে কমু? আপনে জানেন?

নাঃ।

ওরা উঠল।

যোগেন ভাবল, তিস্তার ধারটা একবার ঘুরে যায়। কথাটা বুনিকে বলল।

তিস্তার চরে কিন্তু সেই ছোটোবেলার মতো রোদ্দুর। তেমনি হাওয়া কাশফুলে, নলখাগড়ার বনে তেমনি ভালোলাগা। সরস্বতীপুরের চা বাগানের দিকে বহুদূরের, পাড়ে, নেপালি গোয়ালাদের দুধের বাথান তেমনি আছে। বালিতে তেমনি শী শী শিস বাজছে।

জলের ঝরঝরানি শুনতে শুনতে ওরা দুজনে শীতের দুপুরের রোদে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। যোগেনের এত দুঃখের মধ্যেও হঠাৎ যেন সেই ছোটোবেলার মতো ভালো লাগতে লাগল। অনেকক্ষণ পর যোগেন আস্তে আস্তে বলল, ওই পারে যাইবা বুনি? নদী পারাইবা?

বুনি বার বার বাচ্চা মেয়ের মতো জোরে জোরে মাথা নাড়ল, অস্ফুটে বলল, নাঃ। দু-চোখে দু ফোঁটা জল চিকচিক করতে লাগল। তিস্তার তীব্র জলরাশির গর্জনে কান পেতে, যোগেন ওই পারের বৈকুণ্ঠপুরের গভীর জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইল। যদিও এই তিস্তা ওদের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তবু হঠাৎ এই নদীকে যোগেনের ভীষণ ভালো লাগতে লাগল। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে, মনে মনে নমস্কার করল তিস্তাকে–।

যোগেনের মুখে সামান্য হাসির আভাস ফুটে উঠল। যোগেন ভাবল, সবকিছুলন্ডভন্ড করে তছনছ করে তিস্তা ওদের আবার নতুন করে বাঁচার সুযোগ দিয়েছে।

বুনি অবাক চোখে যোগেনের দিকে চেয়ে বলল, কি? ভাবেন কি নদীর পানে চায়? পাগল হইলেন না কি যোগেনদা?

যোগেন বুনির দিকে না ফিরে জলের দিকে চেয়েই বলল, নাঃ। কিছুনা। কিছু ভাবি না। তারপর বলল, চল, ফির‍্যা যাই। অনেকদিন পরে দেশজ ভাষাতে কথা বলে খুব ভালো লাগল ওর।

চলুন।

ওরা দুজনে পাশাপাশি চরের পথ বেয়ে অশ্বত্থাগাছের দিকে ফিরতে লাগল। পেছনে তিস্তার গর্জন ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। বুনির গায়ের গামছা-গামছা শাড়ি ছাপিয়ে মেহনতের ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছিল। ঘামের গন্ধ এত ভালো লাগে জানত না যোগেন।

হাঁটতে হাঁটতে যোগেনের শরীরের পেশিগুলো হঠাৎ টান টান হয়ে উঠল। কীসের অধীর আগ্রহে পেশিগুলো অশান্ত হয়ে উঠল। অনেকদিন একঘেয়ে ক্লান্ত হাতে ও কলম পিষেছে। ঘ্যানঘেনিয়ে নোট বই মুখস্থ করে বি এ পাশ করেছে, প্রকাণ্ড অফিসে দু-বেলা বসে লাল নীল ছাপা কাগজে বিল লিখেছে–অফিসের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতম মেসিনের মতো। ওর এই শিরা-বের করা দুটি হাতে, একা একা যে সত্যিকারের এত কিছু করা যায়, কোদাল চালানো যায়, লাঙল বওয়া যায়, বুনির মতো কোনো ঘামের গন্ধ মাখা নরম চোখের দুঃখী মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শিউরে ওঠা যায়, নিজের চেষ্টায়, নিজের উদ্যমে, নিজের ঘামে যে নিজের চোখের সামনে দেখতে দেখতে কিছু সৃষ্টি করা যায়, এত সব কথা হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলল যোগেন।

সেই আদিগন্ত আকাশের নীচে, নদীর গর্জনের সঙ্গে হাততালি দিয়ে যোগেনের নাচতে ইচ্ছা করল। এমনকী আনন্দে যোগেন একটু দৌড়িয়েও গেল সামনে।

বুনি বলল, করেন কি? খামোখা দৌড়াইয়েন না। ক্ষুদা লাগলে খাওনের কিছু নাই।

যোগেন কথাটা শুনে, থেমে গেল।

যতদূর চোখ যায়, মরুভূমির মতো সাদা উজ্জ্বল উত্তপ্ত মাঠ। যোগেনের চোখ জ্বালা করতে লাগল। ও মনে মনে বলল, এই সমস্ত মরুভূমিময় ও নতুন করে সবুজ ফসল বুনবে। ফুলে-ভরা গাছ বসাবে, ছায়া আনবে, বাছুর নাচাবে, ঘুঘু ডাকবে–সব-সব–ও কিছু করবে।

বুনির ঘামে-ভেজা হাতের পাতাটা ওর হাতের পাতার মধ্যে হঠাৎ জোরে মুঠি করে ধরল যোগেন। বুনির হাত ধরে, ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল। ওর নীলরঙা হাফশার্ট আর বুনির কালোশাড়ির পাড় তিস্তার হাওয়ায় একরাশ কাশফুলের মতো এলোমেলো হতে লাগল। এবং ঠিক তখুনি।

ওদের মাথার উপর দিয়ে একজোড়া ঘুঘু ডানা ঝটপটিয়ে তিস্তার দিকে উড়ে গেল। সেদিকে চেয়ে রইল ওরা দু-জনে। নির্বাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *