তিল থেকে তাল – ৮

সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ওরা ইঞ্জিনে স্টিম তুলছে। যাত্রীদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়, ক’দিন পর আবার ট্রেন চলছে। মেলার দোকান পসারও ভাঙছে এবার। নন্দরানির দলও ইস্টিশানে এসে উঠেছে গাড়িতে। 

হঠাৎ কুলদা গোঁসাই নেত্যকালী স্টেশন ঘরে গলদঘর্ম হয়ে ওই গুপি মিত্তিরকে ঢুকতে দেখে তাকাল। 

গুপি মিত্তির দেখেছে সব রেল ধর্মঘট মিটে গেছে। বুধুয়া-মতিয়ার পুরো দলকে বদলি করা হয়েছে। কি কস্টা সাহেব ওই নেত্যকালীর কাছে মাপ চেয়ে পার পেয়ে গেল। 

আর গুপি মিত্তির কিনা ওদের হয়ে লড়তে গিয়ে সিধে ফেঁসে গেল। বুধুয়া-মতিয়ার দল—গদাধর গিয়ে কাজে লেগেছে। 

নিতাই ডাকছে—কর্তাবাবু। 

গুপি মিত্তির গাছের নিচে বসে ঘামছে। এবার তার যেন সব যাবার পালা। হারাতে বসেছে সব। ধানকল চলে গেলে বিপদে পড়বে সে। আর এবার নেত্যকালী গেড়ে বসল—পিছনে রয়েছে ওই কুলদা গোঁসাই। 

গুপি মিত্তির ভেবে কূল-কিনারা পায় না। 

নিতাই বলে—ইস্টিশান গিন্নি বড় ভালো গো। নাহলে এককথায় ওই পেটমোটা সাহেবকে মাপ করে দিল। আর রতনকেও নিজের ছেলের মতো ভালবাসে। 

নিতাই-এর মুখে নতুন কথা শুনছে গুপিনাথ 

তার স্বপ্নের প্রাসাদ ধুলোয় মিশিয়ে গেছে। সকালে আজ সে স্বপ্ন দেখেছিল এবার সব কাজ ঠিকঠিক গুছিয়ে তুলে নিজেই দলনেতা হয়ে উঠবে। এই দিগরের খবরের কাগজে নাম উঠবে ছবি ছাপা হবে। তার জন্য নন্দনকেও কিছু টাকা দিয়েছে, ছবিও উঠেছে কিন্তু তারপর পাশার দান উলটে দিয়েছে ওই কুলদা মোক্তার। নাহলে নেত্যকালীকে সে বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিল এখান থেকে। বুধুয়া মতিয়াদের সগৌরবে পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করেছিল। 

কিন্তু এখন। নিজেই এক সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে। রতনও আজ যেন বেঁকে বসেছে, আর কুসুমও ওই মামলার নাম শুনে বেশ খুশি হয়েছে তাও দেখেছে। 

গুপিনাথ এ সংসারে আর থাকবে না। সবাই এখানে বেইমান, ওই স্ত্রী-ছেলে সব্বাই। তাই গুপিনাথ নিতাই-এর কথায় বলে, 

—ওসবে আর নেই নিতে। সব ছেড়ে-ছুড়ে যেদিকে দু’চোখে যায় চলে যাব। 

চমকে ওঠে নিতাই। তাহলে তার ভাতই উঠে যাবে। তাই নিতাই বলে—ওসব ছেলেমানুষি করো না কর্তা। ঝড় এলে গাছগুলোর মাথাও নুইয়ে যায়, সে কতক্ষণ। ঝড় চলে গেলে আবার সিধে হয়ে যায়। তবে তুমি কেনে একটু ঘাড় কাত করবে না। তারপর আবার মৌকা আসবে গো—গুপিনাথও এতবড় দামি কথাটাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। বিষয়-সম্পদ তার সবকিছু। এসব ছেড়ে স্বর্গে যেতে পারবে না সে। তাই নিতাই-এর কথায় বলে গুপিনাথ 

—তুই বলছিস! 

—হ্যাঁ গো! চলো না। একটা আপস করে নাও। হাজার হোক ছেলে তো! 

গুপিও কথাটা মানে। রতন নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি এসব চায় না। তাই নিতাই-এর কথায় গুপি উঠে বসল। এক ঝটকাতে গুপিনাথ আজ টসকে গেছে। 

প্ল্যাটফর্মে কর্মব্যস্ততা নেমেছে। ওদিকে ক’দিন ধরে ইঞ্জিনগুলো পড়েছিল, তাতে নতুন কয়লা দিয়ে স্টিম করা হচ্ছে, তেল মবিল দিচ্ছে ইঞ্জিনে। যাত্রীরা গাড়িতে উঠছে। নন্দরানির দলও এবার গাড়িতে উঠেছে। গুপিনাথ তাকাল। সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসছে এখানে। 

ফুল্লরা পানের পিচ ফেলে দেখে বলে, 

—গুপীনাথবাবু যি গো। ভালো আছেন তো? কাল রাতে মাইরি ক্যামন লিশা লেগে গেল—

-–গুপিনাথ সরে যায়। রাগে-ঘৃণায় সর্বাঙ্গ জ্বালা করে ওঠে। কি ভুলই না করেছিল সে ওই মতিয়াদের সমর্থন করতে গিয়ে। এখন মতিয়া বুধন-গদাধরও তাকে এড়িয়ে গেল। 

নিতাই তাড়া দেয়—এসো গো অ কর্তা। 

কুলদা মোক্তার নেত্যকালী রতন সবাই রয়েছে। বকুল-কুসুমও নিশ্চিন্ত হয়েছে। সুলতার ভয়ও কেটে গেছে। এমন সময় ওই গুপিনাথকে আসতে দেখে তাকাল গোঁসাই প্রভু। 

আড়চোখে তাকিয়ে গুপিনাথের ঝুলঝাড়া অবস্থাটা দেখে নেয়। 

রতন চুপ করে আছে। তার বকুলের কোনো ব্যবস্থাই এখনও হয়নি। মাসিমাও চুপ করে আছে। এমন সময় কুলদা গোঁসাই গুপিনাথকে দেখে বলে— 

তাহলে আজ চলি নেত্য। কাল আবার মামলাগুলো তুলে নিতে হবে। 

তবে রতন তোমার মামলা কাল উঠবে। একদিনেই ভাবছি ফয়সাল্লা করে নেব। 

গুপিনাথও জানে ওর এলেমের কথা 

ধান কল চলে যাবে রতনের হাতে, আর জমা-খরচের হিসাব পেশ করলে বিপদ বাড়বেই। দু’নম্বরি হিসেব থেকে ওই মোক্তার অনেক কিছু গোপন খবর করে নেবে। 

গুপি বলে ওঠে—প্রভু আমার মামলাটির তাহলে কী হবে? 

—আদালতে গিয়ে হাজির হন। কুলদা মোক্তার নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে। 

—মরে যাব প্রভু। গুপিনাথ আজ ভয় পেয়ে গেছে। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলে, 

—বাপ-ছেলের এ বিবাদ মিটিয়ে দ্যান। এসব কেন? আমি ওর হাতে সব তুলে দিয়ে হিমালয়ে চলে যাব। 

নেত্যকালী দেখছে গুপিনাথকে। 

আজ সে-ই বলে—ছেলের বিয়ে দিতে হবে ওই বকুলের সঙ্গে। 

গুপির আর্তনাদটা তবু গর্জনে পরিণত হয়। 

—কভি নেহি। পথের ভিখারি হব তবু ওই বিয়ে দেব না। 

কুলদা গোঁসাই বলে ওঠে—তাহলে ধানকল ছেড়ে দিতে হবে। বিষয়-আশয় মায় ভদ্রাসন অবধির ভাগ পাবে রতন। 

—পাক! গুপির কণ্ঠস্বর গর্জে ওঠে। 

কুসুম সব দেখেছে। তার কাছেও ওই লোকটার সবকিছু যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে। কুসুম বলে, 

—তাহলে আমিও আর বাড়িতে ফিরব না। ছেলের বিয়ে দিয়ে তাদের সংসারেই থাকব।

কুলদা মোক্তার বলে, 

—তাহলে তিন ভাগ হবে সবকিছু, মিত্তির তুমি পাবে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। 

—অ্যাঁ। আর্তনাদ করে ওঠে গুপিনাথ কুসুমের দিকে তাকিয়ে। দুনিয়ার রূপটাই যেন বদলে যায় তার কাছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। জগতে তার যেন কেউ নেই। 

কি ভেবে আজ গুপিনাথ পরাজিত বেদনার্ত স্বরে বলে— 

তাহলে বিয়েই হোক ওদের। সব থাকবে তো! ওরে রতন আবার কিছু করবি না তো রে?

হাসে নেত্যকালী। বকুলের সলজ্জ-মুখে হাসির আভাস জাগে। 

গুপিনাথ যেন সংসারের অসারতাকে অনুধাবন করতে পেরেছে। সে এবার নিজের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই যেন বলে ওঠে, 

—যা ইচ্ছে করগে। ওসব বিষয়-আশয়ে আর আমার লোভ নেই রে। 

আমি ওসবে আর নেই প্রভু! দিব্যজ্ঞান লাভ হয়েছে। 

গোঁসাই প্ৰভু দু’চোখ নির্মীলিত করে যুক্ত করে বলেন, 

—সবই তোমার ইচ্ছা প্রভু! সুমতি দাও ঠাকুর ওই গুপিনাথকে। তাহলে রাজি গুপিনাথ! নেত্যকালী বলে—এই বুধবার শুভদিন, ওই লগ্নেই বিয়ে হচ্ছে। আর বিয়েতে ওর খরচাপ আমি করব। তোমার দাবি-দাওয়ার কিছু থাকবে না। 

গুপি কোণঠাসা হয়ে ঘাড় নাড়ে—না, মা জননী! 

নেত্যকালী বলে—তবু ঘটাপটা যেন হয়। নমো-নমো করে সেরো না মিত্তির, ধর্মঘট করিয়ে নিদেন পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ করছ তা জানি! 

মনে মনে চমকে ওঠে গুপিনাথ ওর সঠিক খবরের পরিচয় পেয়ে। অসহায়ের মতো ঘাড় নাড়ে—হবে মা জননী। কোনো ত্রুটি হবে না! 

কুলদা গোঁসাই বলে ওঠে—তাহলে ও মামলা তুলে নিচ্ছি। আর বকুলদের বিয়েতেও আসছি!

ডি কস্টা এতক্ষণে ট্রেন-চালু করার ব্যবস্থা করে ডাকতে এসেছে গোঁসাই প্রভুকে। তিনি ও শহরে যাবেন! ওই বিয়ের কথা শুনে ডি কস্টা বলে ওঠে—দেন আই অ্যাম অলসো কামিং গোসাই পরভো! 

নেত্যকালী বলে—আসবে বৈকি! 

.

বৈকাল নামছে শস্যরিক্ত প্রান্তরে। নদীর বালুচর কাশবনে শেষ আলোর লাল আভাস জাগে! রতন আর বকুল কদিন পর আজ এসেছে এখানে! আজ তারা পথ পেয়েছে। বাঁচার পথ। 

বকুলের চোখে ওই আলোর আবেশ জাগে, ঘরে-ফেরা পাখির ডাকে মুখর হয়ে ওঠে আকাশ!

বকুল বলে—মাসিমার জন্যে এসব হচ্ছে! 

রতন তাকালো ওর দিকে। বলে ওঠে, 

—কেন তুমি কি চাওনি? 

সলজ্জ-আভা নামে বকুলের মুখে-চোখে, তীক্ষ্ণ-সিটির শব্দে ওদের চমক ভাঙে। 

.

ক’দিন ধরে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটার পর এইবার আবার লাউগঞ্জ লাইট রেলওয়ে চালু হয়েছে। জমে থাকা দু’খানা ট্রেন ফিরে চলেছে বীরপুরের দিকে বাঁশি বাজিয়ে। রেলপুলের উপর গুমগুম শব্দ তুলে চলেছে ট্রেনটা বাঁশি বাজিয়ে! তাদের জীবনও যেন এবার অমনি গতিবেগে মুখর হয়ে নতুন ছন্দে বয়ে চলেছে! 

লাউগঞ্জ ইস্টিশানে সেই স্বাভাবিক রূপ ফিরে এসেছে। শুধু সেই বটতলার আড্ডাটা আর নেই। ঘরগুলো বন্ধ। মতিয়ারা ডেরা উঠিয়ে অন্য ইস্টিশানে চলে গেছে, কাল থেকে ওখানে নতুন লোক আসবে। 

আজ ওখানের গাছগাছালির নিচে আবছা অন্ধকার জমেছে। চারিদিকে ছড়ানো শালপাতা মাটির-ভাঁড় বিচালির রাশি, দু’ চারটে শূন্য বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেউ নেই ওই আসরে। শুধু নির্বিকারভাবে একটা গোরু কোত্থেকে এসে এতবড় অঘটনের মূল কারণ সেই বৃত্তচ্যুত লাউটা বেওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিবিয়ে চলেছে। 

লাউ-এর পাহারাদাররা আর কেউ নেই। 

শূন্য প্ল্যাটফর্মে শুধু দীনু পাগলার চিৎকার শোনা যায়। 

—জয় বাবা রেল ভৈরব। সব ফুসফাস করে দিলি বাবা। আর ক’টা দিন লাগিয়ে রাখলে তোর মন্দির হয়ে যেত। থাক্ শালা ওই ফাঁকায় হিমে জলে পড়ে। 

আজ স্তব্ধতা নেমেছে লাউগঞ্জে—আবার আগেকার মতো। 

ঝড়ের পর অখণ্ড স্তব্ধতা আর প্রশান্তি নেমেছে ছায়া আঁধার-ঘেরা ইস্টিশানের চত্বরে। 

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *