তিল থেকে তাল – ৭

নিতাই একটু আগেই নিধিরাম দপ্তরিকে বলতে গেছিল আজ রাতে… একপালা কবি গান গাইবার জন্য। নিধিরাম লেখাপড়া কিছু শিখেছে, স্কুলে কাজ করে আর কবিগান গায়। 

কিন্তু নিধিরাম নিতাইকেও জবাব দিয়েছে। 

—ওসব খেউড়ের আসরে নাই গো নিতুদা। মদ-খেয়ে হুল্লোড় করছে বুধনের দল। সব্বাই নেশায় টঙ্‌। কি গাইব সেখানে? 

নিতাই গুম হয়ে ফিরছিল, পথেই এই নন্দরানির দলকে পেয়ে সাথে সাথে ‘বুক’ করে ঘোষণা করে—শালা নিধে আবার কবিয়াল, কি জানে ও? আজ নতুন জিনিস দেখাব। নন্দরানির দলের ঝুমুর-গান! 

.

কথাটা রটে গেছে চারিদিকে। 

মেলার চত্বরে—প্ল্যাটফর্মে, রতিকান্তের দোকানে তাই সাজ সাজ রব পড়েছে। দূরের গ্রাম থেকে গোরুর গাড়িতে টপ্পর লাগিয়ে আসছে বাড়ির বউ-ঝি-বুড়ি, লোকজনও আসছে রেল ভৈরবের মেলা দেখতে। 

আর দু’পক্ষ সমানে চিৎকার করে চলেছে এই চত্বরে! 

খবরটা আসে মহিলা সমিতির ক্যাম্পে! নন্দরানির ঝুমুর দলের খবর। 

ওইখানে লোক ভেঙে পড়ছে এখন থেকেই। নেত্যকালী—সুলতা—মহিলা সমিতির ওরা বলে—ছিঃ, ছিঃ এইবার মদ আর ওই ঝুমরি নাচের আসর বসবে এখানে! 

পুলক, শতদলরা বলে—আমরাও মেয়েদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠান করব। 

নেত্যকালী বলে-ওই ঝুমুর দলের ওদের থামাতে পারবি না? কি জঘন্য নোংরামি!

হঠাৎ রতনের মাথায় কথাটা আসে। এর আগেও কুলতলির মেলায় দেখেছিল সে তরুণ কবিয়াল নিধিরামের বাহাদুরি। নিধিরাম সেবার পাল্লার আসরে ওদের দলকেই ঠাণ্ডা করেছিল। 

খেউড় চাপান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল নন্দরানির দল! 

আজও সেই পথই নেবে সে। আর নিধিরামের কবিগানের নাম-ডাক আছে। 

বকুলও ভাবছে কথাটা। তাদের দলের জায়গা ফাঁকা করে ওই ঝুমুর-নাচের আসর বসবে, এতে কেমন যেন হেরে যাচ্ছে তারা। 

তবু সুলতা শুধোয়—হ্যাঁরে রতন, নন্দরানির দলের টাকা কে দিচ্ছে! 

নেত্যকালী ফুঁসে ওঠে—কে আর দেবে? ওই গুপিমিত্তির। 

কুসুমও গুম হয়ে আছে। নেত্যকালী বলে ওঠে, 

—কুসুম, ঘরের লোকটার তোর গুণ কত দ্যাখ। ঝুমরির দলও এনেছে। রতন, কুসুম দু’জনেই অস্বস্তি বোধ করে। রাগও হয় রতনের বাবার উপর। কি যেন নেশার ঘোরে সে ওই বুধন মতিয়ার দলের এই অন্যায়কে সমর্থন করে চলেছে। 

কুসুম বলে—দেখছি ওকে! 

নেত্য, জানায়—সে দেখবি পরে। এখন মুখ থাকে কি করে তাই ভাব। 

রতন বলে—হবে। নিধিরামের আসর বসবে এখানে। পাল্লার আসর। ওই নন্দরানির দলকে পথে বসিয়ে দেব! 

—পারবি! নেত্যকালী শুধোয়। সে ঘোষণা করে—দ্যাখ, যত টাকা লাগে দেব!

রতন বলে—দেখছি। 

.

সন্ধ্যার মুখ থেকেই আজ সারা লাউগঞ্জ—আশপাশের গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছে ইস্টিশান চত্বরে। নন্দরানির দলের ঝুমুরের গানের সঙ্গে নিধিরাম কবিয়ালের পাল্লা হবে! জবর-খবর। 

আগে থেকেই লোকজন এসে চট—তালাই শতরঞ্চি পেড়ে জায়গা দখল করেছে। কয়েকটা ডেলাইট টাঙানো হয়েছে, বাঁশের মাথায় লাল সালু দিয়ে আসরও করেছে ওরা। 

মতিয়ার অবসর নেই। আজ জালা জালা মদ নামছে আর উড়ে যাচ্ছে। 

যতীনের পাম্প রুমেই চোলাই বসেছে। যতীন আগুনের আঁচে মতিয়ার নিটোল দেহটার দিকে তাকিয়ে বলে। 

—আগে বল্লে মাইরি বয়লারের জল ফেলে মাল ঢেলে চোলাই করে দিতাম! 

হাসে মতিয়া―নে! যা বলছি কর। বোতলে পোর ওগুলো! 

ওদের আজ চালু বাজার পড়েছে! আঁচলে টাকা বাঁধছে মতিয়া। আর নিতাই সাবধানি দৃষ্টি রাখছে, যাতে ভাগের টাকা না সরে যায়। 

এক একবার এসে আবার আসরে গিয়ে সব ব্যবস্থাও দেখছে। 

গুপিমিত্তিরও খুব খুশি। 

সন্ধ্যার পরেই তর গুদামের পচা-ধসা সব মাল সাফ হয়ে গেছে। আর ঘরে এসেছে নগদ কয়েক হাজার টাকা। কেরোসিন তেল বেচেছে তিনগুণ দামে। বাকি মাল সরিয়ে দিয়েছে। 

এখন গুপি মিত্তির খুশি মনে বের হয় আসরের দিকে। 

…হ্যাজাক, ডেলাইটের আলোয় চারিদিক জমজমাট। এদিকে অভয়চরণ গাছতলায় ঝাণ্ডির ছক পেতে বসেছে। তার হাতে চামড়ার পাত্রে ঘুঁটিটা নিপুণ শিল্পীর ছোঁয়ায় যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। 

হাঁকছে সে—জাহাজ-কাঁটা-রুইতন-চিড়িতন টেরাই করেন বাবু, লাক টেরাই। রাজা, রাজা হয়ে যাবেন! 

অনেকেই রাতারাতি রাজা বনবার জন্য দু’টাকা— পাঁচটাকার নোটও ছকে এড়ে চলেছে, কিন্তু হাড়ের গুটি নির্বিকার! অভয় দান কুড়িয়ে আবার হাঁক পাড়ে—লাক টেরাই করেন বাবু! লাক টেরাই! 

হারমোনিয়াম ডুগি তবলায় আসরে গদ বাজছে। চারিদিকে বসেছে গণ্যমান্যরা, পিছনে ইত্যিজনের ভিড়। শুধু মাথা আর মাথা। নিতাই গুপি মিত্তিরকে দেখে একটা চেয়ার এনে বসিয়ে দেয় খাতির করে। 

কনস্টেবল দু’জন থমকে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে 

নতুন ডিউটি পড়েছে তাদের, ওই কর্তিত লাউ আর লাউগাছ যেন ঠিক থাকে। কারণ সদর থেকে খবর এসেছে কালই কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে তদন্তে আসছেন ওই লাউ দেখতে। 

খবরটা অবশ্য এসেছে দারোগাবাবুর কাছে। এরা কেউ জানে না এখনও। 

ওরা মনের আনন্দে ঝুমুর-নাচের আসর বসিয়েছে। 

এদিকে তৈরি হচ্ছে রতন আর মহিলা সমিতি। নিধিরামও তৈরি। আজ ওই আসরে শুধু ঝুমুর-নাচের দলেরই নয়—গুপি মিত্তির, বদন ঘোষদের—আর মতিয়ার কেচ্ছা গাইবে সে! অন্যায়ভাবে এত লোকদের কষ্ট দেবার প্রতিবাদ জানাবে নিধিরাম তার কবিগানে! 

ইস্টিশান ঘরের কোটরে বসে ঝিমোচ্ছে ভজগোবিন্দ। তার সহ্যশক্তি ফুরিয়ে এসেছে। মুখে-গালে দাড়ি, চোখ কোটরাগত। পরনে এখন আন্ডারওয়্যার আর গেঞ্জি। ক’দিন ধরে ওগুলো পরার ফলে কাপড়-জামা দলামোচা পাকানো— ধুলোয় ভরে গেছে, ঘামের গন্ধ ওঠে। তাই খুলে রেখে আন্ডারওয়ার পরেই বসে আছে কাঠের বাক্সের ওপর। বাইরে তখন তুমুল কাণ্ড চলেছে। গানের সুর ওঠে। 

ঘুঙুর বাজছে—’শাবাশ’ ধ্বনি ওঠে। 

টোকার শব্দে দরজাটা খুলে দেখে ভজগোবিন্দ রতিকান্ত একটা এনামেলের রং-চটা থালায় কয়েকটা রুটি তরকারি নিয়ে এসেছে। রতিকান্ত জানে ক’দিন এই ডামাডোলে লোকটার খাওয়া জোটেনি। থালাটা আর এক গ্লাস জল নামিয়ে দিয়ে বলে রতিকান্ত—খেয়ে নিন বড়বাবু! 

ভজগোবিন্দ উদাস চাহনি মেলে চাইল। বলে ওঠে সে। 

—খেতে আর সাধ নেই রে রতি। বিষ দিতে পারিস? একটু সেকো বিষ! 

রতিকান্ত অবাক হয়—ওসব কথা কেন বলছেন? 

ভজগোবিন্দও টেলিগ্রামে খবরটা পেয়েছে। রেল কোম্পানি আর সহ্য করবে না। কালই পুলিশ ফোর্স নিয়ে তৈরি হয়ে আসছেন স্বয়ং বড়সাহেব ডি কস্টা। কালো তেলো হাঁড়ির মতো মুখ, আর তেমনি জাঁদরেল কাঁচাখেগো সাহেব। 

ভজগোবিন্দ চেনে ওকে। 

ভয়ে সিঁটিয়ে উঠেছে সে। 

ভজগোবিন্দ একখানা রুটি খেয়ে বলে- আর খাব না-রে। খিদে নেই! কাল যে কি আছে বরাতে কে জানে! শেষ করে দেবে ডি কস্টা! 

গলা নামিয়ে রতিকান্ত বলে–আপনি কি করবেন। ওরাই তো গাজোয়ারি করে কাজ- বন্ধ করল! আর ওই গুপিমিত্তিরই ওদের মদত দিচ্ছে। 

ভজগোবিন্দ বলে—তুই তো দেখলি সব। কিন্তু সাহেব কি তা শুনবে! তাই বলছিলাম, রাতে একটু সেকো বিষ এনে দে। খেয়ে-দেয়ে চিতপটাং হয়ে পড়ে থাকি, সব জ্বালা-যন্ত্রণা মিটে যাক! 

ওদিকে বেদম নাচ চলেছে। 

নটেশ্বর বসেছে আসরে, ওদিকে বিশাল বপু নিয়ে আসর জুড়ে বসে নন্দরানি সামনে তার পানের বাটা। ফুল্লরা নেচে চলেছে। 

মতিয়া, বুধন-গদাই যতীনের দল চিৎকার করে—শাবাশ! 

হঠাৎ ফুল্লরার কী যেন হয়ে যায়! 

বুধুয়া ওকে বৈকাল থেকেই মদ জুগিয়েছে। নটেশ্বরও দু’ পাঁইটের জায়গায় মাত্রা ছাড়িয়ে তিন বোতলই গিলেছে, তারপরই চোখে ধুতরো ফুল দেখছে আসরে। আখরগুলো সব কেমন হারিয়ে যায়, জড়িত কণ্ঠে বলে, 

—গা ফুলি! জোরসে গা! তুফান নাচ— 

ফুল্লরার সারা দেহে কাঁপছে তাজামালের প্রভাবে! বাজারে যে মদ খায় তাতেও ভেজাল থাকে, মতিয়া ওদের খুশি করার জন্য বেশ তরিবত করে খাঁটি মদই খাইয়েছে। 

.. ফুল্লরা নাচছে, পা ঠিক রাখতে পারছে না! 

গুপি মিত্তির তন্ময় হয়ে দেখছে ওই নাচ! হাততালি দিয়ে বাহবা জানায়, হঠাৎ এমনি সময়ে ছিটকে পড়ে ফুল্লরার বিশাল দেহটা একেবারে ওর ঘাড়েই—আর গুপিনাথও নড়বড়ে চেয়ার সমেত ছিটকে পড়েছে। 

সারা আসরে হইহই পড়ে! 

কোন্ ফচকে ছোঁড়ার-দল জোরে সিটি বাজাচ্ছে। 

ফুল্লরা ওদের সামনেই—হড়হড় করে বমি করছে আসরেই! বিশ্রী টকটক গন্ধ ওঠে। দর্শকদের সকলেই হইচই করে ওঠে। 

কে চিৎকার করে—নাচ চালাও। কেউ না থাকলে ধুমসো মাসিকেই তুলে দাও। 

নন্দমাসির লাচই দেখব— 

দৌড়ে আসে নিতাই। গুপি মিত্তিরের সর্বাঙ্গ তখন বমিতে মাখামাখি হয়ে গেছে। কলরব ওঠে—গান-বন্ধ হবে নাকি হে? মাঝরাতে যাব কুথায়? লাগাও গান! নালে পাল কেটে চাপাই দিব। 

আসর বেসামাল হয়ে উঠেছে। নন্দরানি আর্তনাদ করে- 

হেই বাবা, অ নিতে, বের করে দে বাবা। ওরে ফুলি কি হলো রে! হঠাৎ ওই কলরবের মধ্যে ঢোল বেজে ওঠে! 

ওপাশে বসেছিল নিধিরাম তার দলবল নিয়ে। সে যেন এবার মৌকা পেয়ে গেছে। বিশে ঢোল বাজায় খাসা। কাঠি ঢোলে তাং-বাজিয়ে নাচছে সে, তার নাচই আজ ওই ফুল্লরার নাচকে যেন হার মানায়। 

আসরশুদ্ধ লোক নিধিরামকে দেখে খুশি হয়। 

—শাবাশ নিধে, জমিয়ে দে ভাই। 

কে গর্জে ওঠে–চালা রং! শ্লা মাসির দলকে ফুঁকি ছাড়া করে দে! 

চমকে ওঠে নন্দমাসি—নটেশ্বরও চেনে নিধিরামকে। 

দইদের মেলাতেই সেবার পাল্লা দিয়ে তাদের উৎখাত করেছিল মেলা থেকে। আজ আবার এখানে এসে জুটেছে নিধিরাম। 

ঢোলের সোমে নিধিরামের সুরেলা গলা বেজে ওঠে। 

—সভার মাঝে কেলেঙ্কারি কি হলো মশাই! 
দুটো সত্যি কথা বলি তবে—রাগ করো না ভাই।। 

মৃদু আটকুশি ছন্দে-ঢোল বাজছে তালে তালে, আসরের গোলমাল থেমে গিয়ে স্তব্ধতা নেমেছে। শ্রোতারা বলে ওঠে। 

—চালা ভাই নিধি! 

নিধিরাম এবার গলা তুলে পদ ধরেছে, 

নারীজাতি মাতৃজাতি পূজ্য ত্রিলোকেতে,
মহামায়ার অংশ তারা জানে সর্বলোকে। 
হেথা লাউগঞ্জে ঘটে গেল তাদের অপমান, 
মদ গিলে, হল্লা করে ওরা বলে, আমিই ভগবান।। 

মহিলা সমিতির ওদিক থেকে শাবাশ ধ্বনি ওঠে। 

নিধিরাম লয়তানে গেয়ে চলেছে নেচে নেচে- 

তাই রেল-বন্ধ-গরিবের ভাত-বন্ধ হেথা ঘোর কলিকাল! 
অন্ধকারে পাচার হলো মুখের গ্রাস তেল ডাল আর চাল।।

কোলাহল করে ওঠে জনতা—ঠিক বলেছিস ভাই রে। বলিহারি! 

গুপি মিত্তির বমি-মাখা অবস্থায় গর্জে ওঠার চেষ্টা করে। নিতাইও বুঝেছে, এখন কিছু বললে জান্ থাকবে না। তাই চুপিচুপি বলে গুপি মিত্তিরকে—কেটে পড়ো কর্তা। হাওয়া ভালো নয়।

ওরা কেটেই পড়ে! তখন নিধিরাম ওই বুধুয়া-মতিয়াদের নিয়ে গান গেয়ে চলেছে। তারপরই রং-এর ছিটে দেয় ধুয়ার মুখে 

—অধরা যৈবন সখী নদীর মতন বয় গো 
কে মাতবি মরণ খেলায় আয় লো ছুটে আয় লো 
মরি হায় হায় রে। 
লাউগঞ্জে রসের জোয়ার টলমল বয় রে- 

আসর ফেটে পড়ে তুমুল হাসিতে। নন্দরানি গর্জাচ্ছে। ফুল্লরার জ্ঞান ফিরেছে। দু’চোখ মেলে দেখছে ওই নিধিরামকে। নটেশ্বরও যেন চৈতন্য ফিরে পায়। বিড়বিড় করে সে। 

—গাইবি ফুলি! 

নন্দমাসি চাপা-স্বরে গর্জে ওঠে—আর গেয়ে কাজ নাই। মুরোদ বোঝা গেছে তোদের! এ্যাখন ফুরোনের ট্যাকা দেয় কি না দ্যাখ! ছিঃ ছিঃ কি কেলেঙ্কারি? অ্যা—দলের নাম ডুবোলি তোরা? 

.

রাত পুইয়েছে অনেক সমারোহের পর। দূর-দূরান্তেরের লোকজন চা খেয়ে ফিরবে এইবার। অনেকেই ফিরে গেছে। মেলার দোকান পসারের বাঁশ দু’একটা খুলছে। চারিদিকে ছড়ানো এঁটোপাতা—ছাই, কাগজের টুকরো আর মেলা দেখতে আসা গোরুর গাড়ির খড় ছিটিয়ে পড়ে আছে। 

দীনু পাগলা ভোর থেকেই জেগে উঠে বাবাকে সিঁদুর মাখিয়ে চিৎকার করে।

—জয় বাবা রেল ভৈরব! আজ বাবার অভিষেক হবে হে! বাবা- 

রতিকান্তের দোকানের বেঞ্চে ঘুমন্ত ছেলে কটাকে তুলে রতি উনুনে-আঁচ দিয়ে গজগজ করে-ই, ফ্যাসাদ ভালো লাগে না। কবে যে বান্ধ হবে সব কে জানে! 

মহিলা সমিতির প্যাণ্ডেলে ঝাঁট পড়ছে। আবার এসে হাজির হবেন ওনারা। আজ পূর্ণোদ্যমে চালাবে দু’পক্ষই। হাওয়ায় খবরটা ছড়িয়ে পড়ে—বড় সাহেব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা আসছে পুলিশ ফোর্স নিয়ে। আজই হেস্তনেস্ত যা হবার হবে। 

তাই রতন, শতদলরাও সকালবেলাতেও এসে পড়েছে। 

ওদিকে সারারাত হইচই করে ঝিমিয়ে পড়েছে মতিয়ার দল। গাছতলায় এখান ওখানে যে যেখানে পেরেছে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে। 

মতিয়াও রতির কাছে খবরটা শুনে চমকে ওঠে। বড়সাহেব আসছে পুলিশ নিয়ে। এবার মেয়েটা সত্যিই ঘাবড়ে গেছে। ওরা জানে মরদগুলোকে। এমনিতে ভীতুর ডিম, শুধু মতিয়াই গ্যাস দিয়ে ওদের এই ধর্মঘট করিয়েছে। আর মদ-গিলিয়ে ওদের বীর সাজিয়ে রেখেছে। 

এবার শেষ রক্ষা করতে না পারলে কেলেঙ্কারি হবে। তাই মতিয়াও আজ উঠে-পড়ে লেগেছে মদের জোগান দিয়ে ওদের সে চাঙা করে রাখতে চায়। তবু গুপি মিত্তিরকে একবার কথাটা জানানো দরকার। সকালবেলায় বুধনকে ঠেলে তুলে দিয়েছে মতিয়া 

—অ্যাই ওঠ রে। 

বুধন কি একটা রঙিন স্বপ্ন দেখছিল—সেই নাচওয়ালির গা-থেকে রঙিন সব আলো ঝলকাচ্ছে, বুধন সেই আলোর মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় বেমক্কা-ধাক্কা খেয়ে ঠেলে ওঠে সে—তুই! 

ঘুমভরা চোখ মেলবার চেষ্টা করে তাকালো বুধন! মতিয়া বলে, 

—শুনেছিস, বড় সাহেব ডি কস্টো আসছে আজই, পুলিশ আসছে, বন্দুকওয়ালা পুলিশ। 

বুধন ধপাস করে আবার এলিয়ে পড়ে কঁকাতে থাকে—অ্যাঁ। পুলিশ, বড়সাব? মরে যাব মতিয়া। ইসব কাহে করলি তু? এখন ঐ কস্টো সাহেব শ্লা চুতরমে লাথ মারবে। নোকরি চলে যাবে—অব, বাপ! হামিই ধরমঘট না করব! 

মতিয়া ওর চুলের মুঠিটা খপ করে ধরে গর্জায়। 

—জান্ খা লেগা তেরা! ক্যা রে! মারেগা ঝাপ্পড়। মু-বন্ধ করে থাক। সব সামাল দিব হামি! তু ওই যতীনদের কুছু বলবি না—লে বোতলিয়া। পিলা দিবি ওদের য্যায়সে না ঘাবড়ে যায় ওরা! 

বুধন মারের ভয়েই চুপ করে গেল! শুধোয় সে—তুই কোথায় যাবি? মতিয়া বলে—আসছি! ওরা উঠলে যিন পিলিয়ে তৈয়ার করে রাখবি। আজ শেষ লড়াই। মস্তানার মতো লড়তে হবে! সমঝাবে! আভি আসছি। মতিয়া চলে গেল গা-গতর নাড়িয়ে। 

বুধনের ঘুম ছুটে গেছে! এখন তার মাথায় এসেছে রাজ্যের ভাবনা। ডি কস্টা সাহেবের তেলো হাঁড়ির মতো মুখ আর ভরাটি আওয়াজটা মনে পড়তে ভয় হয়, যেন মেঘ ডাকছে।

বুধন করার কিছু না পেয়ে একটা বোতলেই মুখ লাগাল। তবু এই ভয়টাকে ভুলতে পারবে সে! 

.

গুপি মিত্তিরকে খবরটা পাঠিয়েছে অশ্বিনী দারোগাই। রাতভর ঠিক ঘুম আসেনি তার। ওদিকের ঘরে কুসুম খিল দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। বমি-মাখা জামা-কাপড় বদলে মাঝরাতে স্নান করেও গায়ের গন্ধ যায় না গুপির। ঘিনঘিন করছে সারা-গা। কুসুম ওই গন্ধটা পেয়ে তাকিয়েছিল মাত্র। দেখেছে গুপি ওর চোখে-মুখে কি ঘৃণার ছাপ। 

কুসুম বলে—এবার ওটাও ধরেছ তাহলে? 

গুপি গর্জে ওঠে—অ্যাও। খবরদার। 

কুসুম বেশ সাহস ভরেই বলে—মারবে নাকি! মেরেই দ্যাখো। তবু ঘরে আছি। কাল সকালেই ছেলের কাছে তোমার গুণের সব কথাই বলে এখান থেকে চলে গিয়ে মায়ে-পোয়ে ঘরভাড়া করে অন্যত্তর থাকব। আর ছেলের বিয়েও দেব ওই বকুলের সঙ্গে—সেইখানেই সংসার পাতাব 

গুপি গর্জে ওঠে—ওইটাই বাকি আছে, না? তার আগে তোমার ছেলেকেও টাইট করব!

কুসুম রাত-দুপুরে আর কথা বাড়ায়নি। ওঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। গুপি মিত্তির রইল বাইরে-পড়ে। গুপি নিষ্ফল আক্রোশে গর্জায়—ঠিক আছে। 

বৈঠকখানা ঘরের তক্তাপোশে পাতা শতরঞ্চির উপর বাকি রাতটুকু পড়ে কাটিয়ে দেয়। ঘুমও আসেনি। যেমনি মশা আর তেমনি ছারপোকা। কুটকাট কামড়ায় আর মশাগুলো দল বেঁধে যেন কানের কাছে সানাই রসুন চৌকি বাজিয়ে চলেছে! রাতভর ছটফট করেছে গুপিমিত্তির! ভোরের দিকে একটু চোখ লেগেছে এমন সময় নিতাই আর একজন কনস্টেবলের ডাকে উঠতে হলো! শুধোয় গুপি মিত্তির! 

—কী ব্যাপার? 

কনস্টেবলকে এসময় দেখে গুপি মিত্তির একটু ঘাবড়ে গেছে। সকালেই ওই ধড়াচূড়াধারী পুলিশের মুখ দেখেছে—দিন ক্যামন যাবে কে জানে। তবু এক ফাঁকে দেওয়ালে টাঙানো রাধাকেষ্টর যুগল মিলনের ছবিটার দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রথম ঠাকুর দর্শন করে এবার বডিটা ফিরিয়ে নিয়ে শুধোয় গুপি মিত্তির—সাত সকালে কী হলো রে? 

নিতাই বলে—থানা থেকে খবর এসেছে আজ রেলের বড় সাহেব ডি কস্টা না কে আসছে, সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ সাহেবও আসবেন পুলিশ ফোর্স নিয়ে। গাড়ি বন্ধ রাখার জন্য কড়া এসটেপ নেবে, গাড়ি চালাবেই। এসপেশাল ট্রেনে আরও লোকজন নে আসছেন ওরা। 

কনস্টেবল খবরটা দিয়ে চলে গেল, অবশ্য যাবার সময় নিতাই ওকে চা-মিষ্টি-খাবার ব্যবস্থাও করে দিতে ভোলেনি। গুপিমিত্তির এবার তক্তাপোশের উপর টানটান হয়ে বসে কি ভাবছে। নিতাইও কর্তাকে আজ এখানে পড়ে রাত-কাটাতে দেখে একটু অবাক হয়। শুধোয় সে। 

—ইখানে কেনে গো? 

গুপি মিত্তির কথার জবাব না দিয়ে এবার তার সিদ্ধান্তটা জানায়, 

—মরুকগে ওরা। ধর্মঘটে আর আমি নাই। মেলা টাকা জলে গেছে। আমি রোজকার করেছি ওদিকে উনি, তোদের গিন্নিমা সিন্দুকের চাবি হাতিয়ে খুঁটে বেঁধে নে ঘুরছে। মুঠো মুঠো টাকা খরচা করছে ও নিজে! দু’দিকের লোকসান কি কম! আর নয়- 

নিতাই একটু অবাক হয়। কর্তাবাবু নিজেই এগিয়ে গিয়ে ধর্মঘটে টাকা দিয়েছে। আজ তার এই নিরাসক্ত ভাব দেখে বলে, 

গুদোমের সব পচা-মাল তো তিনগুণ দামে ঝেড়ে, নিদেন পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা দমকা লাভ করেছ। 

গুপিনাথ বলে—মাল সব সাফ! আমিও আর নাই! 

মতিয়াকে ঢুকতে দেখে তাকালো গুপিনাথ! সকালেই ওর গা-গতরে যেন জোয়ার নেমেছে। ডাগর চোখে জলধারা! মতিয়া বলে, 

—মরে যাব মালিক! এখন বাঁচাতে হবে ওদের। তোমার কারবার করলাম অ্যাদ্দিন!

গুপি হিসেব বোঝে! ধর্মকে ওঠে গুপি–টাকা তো দিইছি। এবার হাতে-পায়ে ধরগে সাহেবের। আমি কি করব! যা এখান থেকে! 

মতিয়া এবার কোণঠাসা বিড়ালের মতো গা-গতর ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে। বলে সে। 

—তাহলে বাসাতেই যাই, আর ওই মহিলা সমিতির ইস্টিশান গিন্না, সুলতা দিদিমণিকে আর থানাতেও খবরটা দিই গে! মদ চোলাই-এর হাঁড়ি-টিন-জালা মালপত্র মায় তৈরি মদ অবধি তোমার ধানকলেই রয়েছে, সেই খবরটা দিই গে! কে মদ-চোলাই করে দেখুক ইবার পুলিশ। 

লাফ দিয়ে ওঠে গুপিনাথ। 

—অ্যাই! থাম! অ্যা—সব আমার ওখানে করছিস! 

হাসছে মতিয়া—হামাকে ফাঁসাবে—ছেড়ে দিব? যাই- 

গুপি আর্তনাদ করে—দাঁড়া! ওরে নিতে! অ্যা—সাংঘাতিক মেয়ে তুই! ওরে বাবা!

মতিয়া বলে—তালে চলো! বড় সাহেবকে সামাল দেবে! ব্যস! যাবে তো মালিক? ক্যা—

গুপি বলে ওঠে—যাব! চল যাচ্ছি। 

মতিয়া চলে গেল। গুপি এবার বলে অ্যাঁ। 

সাংঘাতিক মেয়েছেলে ওটা! নিতাই বলে—শেষকালে ঘাটে এনে মাছ ছেড়ে দেবে মালিক! ধর্মঘট মিটে যাবে। তুমি বড় সাহেবের সঙ্গে ওদের লিডার হয়ে কথা বলে সেটা মিটিয়ে দাও। আমি বীরপুর বার্তায় ফলাও করে ছাপিয়ে দেব—জনদরদি সমাজসেবক অক্লান্ত কর্মী গুপিনাথ মিত্র মশায়ের মধ্যস্থতায় এতবড় ধর্মঘট-এর নিষ্পত্তি হয়েছে। সবাই জানবে তোমার এলেম। তারপর দাঁড়াও ভোটে—দেখবে কী হয়? 

গুপিনাথ মিত্তিরের কাছে এ এক নতুন পথের ইশারা। নতুন ভবিষ্যৎ-এর সন্ধান। টাকা সে অনেক রোজগার করেছে। অঢেল। এবার ওই গৌরবের পথটাই যেন তাকে হাতছানি দেয়। খবরের কাগজে তার নাম ছাপা হবে। ছবি উঠবে—নেতা হয়ে উঠবে গুপি মিত্তির। 

বলে গুপি–সত্যি বলছিস নিতে? 

নিতাইও দেখছে গুপি মিত্তির টোপ গিলেছে। তারই মঙ্গল ওতে। নিতাই বলে, 

—ডি-এম সাহেব, এস-পি সাহেব আসছেন। তাদের সামনে নাম জানাবে, তোমার এলেম দেখবে, এ কম কথা। ফলাও করে ছাপা হবে, তবে কিছু খরচা করতে হবে। 

গুপি বলে—করব। তাহলে ওই নন্দ ছবিটবি তোলে, ওকেও যেতে বল! যেন ফস্ ফস্ করে ডি-এম সাহেব, এস-পি সাহেবের সঙ্গে আমার ছবিগুলো তুলে নেয়! 

নিতাই অভয় দেয়—ও নিয়ে ভেবো না! নাও চানটান করে ভালো ধুতি-জামা পরে নাও। আমি বাজার থেকে ভালো মালাটালা দেখে নে আসি। নেতা সাজতে গেলে এসব লাগবে! 

একটু অবাক হয় গুপি-মালায় কী হবে? ঠাকুর পুজো-টুজো করবি নাকি? 

হাসে নিতাই—এসব নতুন ঠাকুর গো। এসের মালাও লাগে আর প্যালাও লাগে। ন্যাতাদের পুজোর ধরন আলাদা। এবার বুঝবে। চলো! 

.

খবরটা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ক’দিনের প্রস্তুতির আজ শেষ পরীক্ষা। বড় সাহেবরা আসছেন, দীনু পাগলা পাথরের পুঁড়িটাকে থাবড়ে চিৎকার করে—মুখ রাখিস বাবা রেল ভৈরব! মন্দির বানিয়ে দেব তোর! 

লোকজন জমছে 

গার্লস স্কুল থেকে শোভাযাত্রা করে এসেছে মেয়েরা। ঘর-উজাড় করে এসেছে হাঁড়ি-খুন্তি ফেলে গিন্নিবান্নিরা। গাড়ি-বন্ধ করার বিচার চাই! ওদিকে বুধন কোম্পানিও এখন ফিট! 

আর গুপিনাথ এর মধ্যে একটা টুলে দাঁড়িয়ে গলা তুলে বক্তৃতা দিচ্ছে! 

—এই ট্রেন বন্ধ কেন হলো তার তদন্ত করতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে। আর লাউগঞ্জের নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের চোখে অযোগ্য ওই ইস্টিশান মাস্টার ভজগোবিন্দকে বদলি করাতে হবে। 

মটরা ধ্বনি তোলে আমাদের দাবি মানতে হবে! 

সরবে সোচ্চারে ওরা ধ্বনি তুলছে। 

ভজগোবিন্দের এবার অন্তর-কাঁপুনি শুরু হয়েছে, গলা শুকিয়ে আসছে, যেন তাকে এবার বলিই দেবে ওই বড় সাহেব। আন্ডারওয়্যার-পরা গায়ে ধুসো চাদর-জড়ানো মূর্তি। একমুখ দাড়ি—টাকটা তবু ঘামছে। 

ওদিকে মহিলা সমিতির চিৎকার ওঠে। 

এদিকে প্রবলতর বেগে বুধুয়ার পার্টি—তাদের নেতাকে পেয়ে জয়ধ্বনি করছে। 

এমন সময় শোনা যায় রেল লাইনের আউটার থেকে ট্রেনের শব্দটা। ক’দিন পর স্তব্ধতা ভেদ করে বড় সাহেবের স্পেশ্যাল ট্রেনটা গুমগুম শব্দে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে, নদীর ব্রিজ পার হয়ে লাউগঞ্জের দিকে আসছে। 

ঝনঝন করে বেজে ওঠে স্তব্ধ-ফোনটা। কাঁপছে ভজগোবিন্দ। তবু ফোনের গর্জনও থামে না। কোনোরকমে ফোন ধরতে আগের ইস্টিশান বীরপুর-চিৎকার করছে। 

—লাউগঞ্জ। হ্যালো-লাউগঞ্জ! মরে গেছ নাকি ভজগোবিন্দ। বড় সাহেবের স্পেশ্যাল ট্রেন আমাদের ইস্টিশান ছেড়ে গেল তোমার ওদিকে! ভজগোবিন্দ সাড়া দিয়ে বলে। 

—মরিনি এখনও, এইবার মরব হে চাটুয্যে! 

ফোনটা নামাতে কর্ণপটহবিদারী চিৎকার ওঠে দু’পক্ষ থেকে, ওরা দেখছে বড়সাহেবের স্পেশ্যাল ট্রেনটাকে নদী পার হয়ে হোম সিগন্যালের ওদিকে পড়ে থাকা সেকেন্ড লোকালের পেছনে দাঁড়াতে। 

ঝপঝপ্ করে পুলিশবাহিনী নামছে! হাতে রাইফেল। কত কে জানে। সারবন্দি দাঁড়িয়ে যায় তারা। বাঁশি বাজছে—তারপরই বন্দুকে বেয়োনেট লাগিয়ে ওরা জুতোর শব্দ তুলে তালে তালে পা-ফেলে মার্চ করে আসছে এদিকে। সামনে দুটো শাল ডালের মতো ইয়া হাত নিয়ে দশাসই বিকট একটা লম্বা মোটা লোক এগিয়ে আসছে দানবের মতো। চাকামতো মুখ আঁর মুখখানা ভুসোমাখা হাঁড়ির তলার মতো কালো কুচকুচে। পিছনে স্বয়ং ডি-এম সাহেব, আর পুলিশ সাহেব, সামনে ওই বিকট দর্শন দৈত্যটি স্বয়ং খুদে রেলের জেনারেল ম্যনেজার ডি-কস্টা সাহেব। 

দু’পক্ষ তখন সামনে গলা তুলে চিৎকার করছে। ডি কস্টা সাহেব এতখানি পথ রোদ ঠেলে এসে ঘেমে নেয়ে উঠেছে, ঘামছে নয়, যেন আলকাতরা ঝরছে গা-থেকে। 

গুপি মিত্তির হইচই করে, 

—ওরে গাছের ছায়ায় চেয়ার আন গোটাকতক। 

চেয়ার এসে যায়। গুপি বলে-বসুন স্যার! ওরে রতি, হুজুরদের জন্যে ডাব আন। নিতে—

ডি কস্টা স্বয়ং তরুণ ডি-এম সাহেব দেখছেন বিচিত্র ওই জীবটিকে। গুপি মিত্তিরের গলায় মালা, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, নিতাইও কটা মালা এনে বড় সাহেব—ডি-এম সাহেব — পুলিশ সাহেবের গলায় পরিয়ে দিতে হাততালিও পড়ে চড়চড় শব্দে। 

ডি কস্টা বলে—হোয়াট ইজ দিস? 

ইতিমধ্যে ডাবও এসে গেছে। গুপিনাথ জোড়হাত করে বলে— 

ওয়েল কাম টু লাউগঞ্জ সাহেব। আই গ্রামসভার পক্ষ থেকে ওয়েলকাম করছি পুওর গুপি মিত্তির প্যাডিমিল ওনার স্যার, টেক ডাব ওয়াটার। 

আমার গার্ডেনের ডাব। সুইট স্যার- 

তেষ্টাও পেয়েছে। তাই ডাবটা এক নিশ্বাসে বিরাট মুখ-গহ্বরে উপুড় করে নিঃশেষ করে দিতে ডি কস্টা সাহেবের হাতে আবার একটা ডাব এসে যায়। ডি-এম, এস-পি দুজনে বলেন, 

—না। আর দরকার নেই। 

ডি কস্টা সাহেব তখনও ট্যাঙ্কে জল পোরার মতো ডাব খেয়ে চলেছে। পুরো এক কাঁদি তিনটি কুল্যে এগারোটা ডাব শেষ করে বড় সাহেব এবার চেয়ারে বসল। মচাং করে চেয়ারটা ওই বিরাট বপুর ওজনে কেঁপে ওঠে। কিন্তু রেল কোম্পানির শাল কাঠের শিল্পার দিয়ে তৈরি মজবুত চেয়ার তাই বড় সাহেবের ভারে না টকে টিকে রইল। স্তব্ধ-চারিদিক। হঠাৎ যেন বোমা ফেটেছে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে অনেকে। ডি কস্টা সাহেব গর্জায় গজ গোবিনড্। ইউ ব্লাডি—গজো গোবিনড্‌—কাম হিয়ার। 

ভজগোবিন্দ বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে এসেছে। পরনে রেলের প্যান্টল, কদিন আগেও সেটা ভুঁড়িতে আঁটত না চেপে বসত, সেই প্যান্টুল এখন ঢিলে হয়ে খসে পড়ছে, আটকাবার জন্য গামছা দিয়ে কষে বাঁধা। গামছার বাকিটা ল্যাজের মতো পিছনে ঝুলছে, আর বোতাম খোলা কোট গায়ে সাহেবের সামনে এসে বু বু বু করতে থাকে ভয়ে। দু’ হাঁটু ঠকঠকিয়ে কাঁপছে আর বিনবিন করে টাক ঘামছে তার। 

ডি কস্টা সাহেবের হেঁড়ে গলার গর্জনে কেঁপে ওঠে ভজগোবিন্দ। ডি কস্টা গর্জাচ্ছে—হোয়াট ইন্‌ দিস ট্রেন বনধ কাহে? বোলো—জলদি বোলো ইউ সোয়াইন! উত্তর দাও। 

ভজগোবিন্দ বলবার চেষ্টা করে—আমি-আমি কিছু জানি না সাহেব ওই ওরা বুধনের দল, গদাই বল্লো—চাকা বনধ ব্যস, ওরা গাড়ি-চালানো বন্ধ করে দিলে কি তুচ্ছ-ব্যাপার নিয়ে স্যার! 

মতিয়াও তৈরি ছিল। 

সে ভ্যাঁ করে এবার কেঁদে সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে বড়ি থ্রো করেছে। বিকট-স্বরে বলে—হামি’ পয়েন্টসম্যান বুধুয়ার জরু আছি সাহেব। 

—হ্যাঁ! হ্যাঁ! ডি কস্টা সাহেব দেখছে ওই মেয়েটাকে। নধর-নিটোল দেহ মতিয়াও যেন ইচ্ছে করেই তার ওই যৌবন-মাতাল দেহটাকে খানিকটা বেআব্রু করে রেখেছে। গা-গতরে ঢেউ জাগিয়ে কাঁদছে সে। 

ডি কস্টা সাহেবের বিকট মুখে তার কঠিন চামড়ায় যেন ঈষৎ কুঞ্চন জাগে। সেই বুলডগের মতো গর্জনও থেমে গেছে। কড়া রুক্ষগলায় একটু কোমলতার আভাস এনে বলে, 

—রো মত! বোলো ক্যা হুয়া। বোলো! হমকে ডরো মত— 

মতিয়াও এই ফাঁকে বলে যায় তার উপর অকথ্য অত্যাচার-প্রহারের কল্পিত ব্যাপারটা। ওই রেল কোম্পানির জায়গায় আগলপাহারা করে সে। ওই লাউগাছ লাগাল-জল দিল। আর ওই ইস্টিশান মাস্টার গিন্নি এসে জোর করে দখল নিতে গেল। লাউগাছ কাটল লাউ কাটলেন। 

মতিয়ার কান্নাটা আবার চাগিয়ে ওঠে। 

কান্না ভিজে-স্বরে বলে সে—হুজুর হামি রুখতে গেলাম—ইস্টিশান গিন্নি আর তার লোক বঁটি দিয়ে আমাকে কাটতে এল। 

গুপিনাথ এইবার আসরে নেমেছে! মতিয়া ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে। গুপিনাথ এর মধ্যে সাহেবকে এগারোটা ডাব খাইয়ে আর ভজুর দোকানের এক নম্বর কালাকাঁদ হাফ কেজিটাক খাইয়ে তার কাছে এসে গেছে। গুপিনাথ বলে ওঠে সাহেবকে বোঝাবার জন্য প্রাঞ্জল ভাষায়। 

— ইয়েস স্যার! কাটিং উইথ বঁটি। সার্প ওয়েপন স্যার-খাজিং জিং জিং। সি মার্ডার মতিয়া স্যার! তাই ওরা প্রটেস্ট করল অনলি টু সেভ হার স্যার। দ্যাট ভজগোবিন্দ ওয়াইফ্ এ ডেঞ্জারাস—ফেরোসাস লেডি স্যার। বুধুয়াও আর্তকণ্ঠে বলে, 

—হম দোনোকো উলোক খতম করত স্যার। গদাই মটরা হমলোগকা জান বাঁচাল। ডরসে টেরেন চালাতে পারল না। ওই ইস্টিশান মাস্টারকা জরু আউর উলোক সব খুন করত বল্লে!

এতক্ষণে যেন বুঝেছে সব ব্যাপারটা ওই ডি কস্টা সাহেব। চারিপাশে তাকিয়ে দেখেছে ওই মহিলা বাহিনীকে। ওরা তখনও স্লোগান দিচ্ছে— 

জুলুমবাজি চলবে না। 

মতিয়ার জন্য রেল-বন্ধ করা—চলবে না! 

ডি কস্টা চিৎকার করে ওঠে, স্টপ! স্টপ অল দিস! ক্লিয়ার আউট ফ্রম দি প্ল্যাটফর্ম। আই শ্যাল অ্যারেস্ট অল অব ইউ। 

গুপিও সামনে ওই মহিলা বাহিনীকে দেখে এবার সাহস পেয়ে চিৎকার করে—ওরাই যত গণ্ডগোলের গোড়া। রুট অব অল গোলমাল স্যার। ওদের সবাইকে অ্যারেস্ট করুন স্যার কেবল আমার সহধর্মিণী ওই যে ওই কালপাড় শাড়ি, ওই কুসুমকে বাদ দিয়ে। খুব ভালো মেয়ে স্যার। কেবল দলে পড়ে এইসব করছে স্যার। সরে এসো ওগো! 

ডি কস্টা এবার গোলমালের কারণটা জেনে নিয়ে গর্জন করে—গজো গোবিনড কল ইয়োর ওয়াইফ। বোলাও তুমারা জরুকো? হোয়াই সি হ্যাজ ডান দিস! কল হার! 

ভজগোবিন্দের শিরে-সংক্রান্তি। এদিকে সাহেব—ওদিকে তেমনি হয়েছে স্ত্রী-টি। কাছে এগোবার সাধ্য তার নেই। ভজগোবিন্দকে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডি কস্টার রক্ত সব মাথায় উঠে পড়ে। এবার বোম ফাটে। 

—ইউ সোয়াইন, কল ইয়োর ওয়াইফ। বোলাও- 

ভজগোবিন্দ বলে ওঠে—বোলালেও সে আসবে না স্যার। 

—ক্যা! আসবে না? দারোগা সাব–ব্রিং হার। না আসে টবে অ্যারেস্ট করে আনবেন ওকে। রেল কোম্পানির হিসট্রিতে ধর্মঘট নাই, ওর জন্য ধর্মঘট হলো, রেলের সো মেনি থাউজেন্ড রুপিস বরবাদ, এত পাবলিকের ট্রাবল দিল—সি ইজ দি রুট। অ্যারেস্ট হার রাইট নাও। আভি বোলাইয়ে— 

মতিয়া তখনও সাহেবের সামনে বসে গা-গতর আধ-আদুড় করে চোখের জল-মুছে চলেছে। মাঝ মাঝে ধুয়ো ধরে। 

—হামাকে খুন করত! রেল থেকে হটিয়ে দিত— 

মহিলা সমিতির ওরা এতক্ষণ ধরে যেন নাটকই দেখছিল, নতুন এক নাটক। নেত্যকালী ও দেখছে মতিয়ার ওই ঢং আর ওই হাঁড়িমুখো সাহেবটার চোখ-জুড়ে দেখেছে সে কিসের ছায়া।

মতিয়া আর গুপিনাথ দু’জনে মিলে ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ অন্যদিকেই নিয়ে চলেছে। 

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলেন—মিঃ ডি কস্টা। ওসব বিচার হবে পরে তার আগে এবার ওদের গাড়ি ছাড়ার ব্যবস্থা করতে বলুন। 

গুপিনাথও জানে কাজ তার বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছে। এবার ভজগোবিন্দ আর ওই নেত্যকালীকে জালে ফেলেছে। এখানের ভাত তাদের এবার উঠিয়ে ছাড়বে। 

সেই সঙ্গে এই বুধুয়া-গদাইদের সব দোষও মাপ করিয়ে নেবে। 

এই সুযোগে নন্দ কয়েকটি ছবিও তুলেছে ফ্যাস-ফ্যাস করে আলো জ্বেলে। 

ডি কস্টা বলে—নাউ অল উইল বি সেট রাইট স্যার। 

কিন্তু ভজগোবিন্দের গিন্নির এ অবাধ্যতা সে সহ্য করবে না। তার মনে হয় ওই মহিলাই নিশ্চয় এসব করিয়েছে। তাই ডি কস্টারও জেদ চেপে গেছে। 

—অ্যারেস্ট হার। অল অব দি মহিলা সমিতি গ্রুপ। 

এমন সময় নেত্যকালী নিজেই আসরে অবতীর্ণ হয়। 

মহিলা সমিতির অপমান সে সইবে না। বেশ চড়া-গলায় বলে ওঠে, 

—অ্যারেস্ট করবে কে শুনি? এই যে—করো অ্যারেস্ট! কি করেছি যে অ্যারেস্ট করতে হবে? মদ-এর কারবার হবে ইস্টিশানে বাধা দিইছি এই অপরাধ। নষ্টা ছুঁড়িটা একপাল ভেড়ুয়া নিয়ে হল্লা করবে ইস্টিশানে, তাতে না বলা যাবে না? 

কেমন সাহেব তুমি! অ্যা—ওই ছুঁড়ি তোমাকেও বশ করেছে দেখছি। বিচার করতে হয়—সাফ বিচার করো! ওই জায়গার লাউ সবাই খায়। ওর গাছ? ওর বাবার জায়গা? 

ডি কস্টা কিছু বলার আগে গুপি মিত্তির বলে—রেলের জায়গা ও রেল কোম্পানির লোক। কেন যাবেন আপনি? 

নেত্যকালী ফুঁসে ওঠে—তুমি কোন্ কোম্পানির লোক যে এত দরদ দেখাতে এসেছ ওই মতিয়ার জন্য? ধর্মঘট কে করাল? ওকে কত টাকা দিয়েছিলে তুমি? আর গুদামের সব পচা মাল বেচেছ গাড়ি-বন্ধ করিয়ে। 

গুপি মিত্তির বলে—সাট আপ। এই সেই নেত্যকালী সাহেব। ভজগোবিন্দের ওয়াইফ।

ডি কস্টাও দেখছে নেত্যকালীকে। ডি কস্টা তার বড়সাহেবি মেজাজ কায়েম রেখে এবার গর্জে ওঠে- 

আপনাকে অ্যারেস্ট করা হলো, বেআইনিভাবে রেলের কর্মচারীর পরিবারকে মারপিট করেছেন, রেলের জায়গার দখল নিয়ে দ্যাট কদু কাটলেন, আপনার জুলুমের জন্যই ওরা রেল চালাতে পারেনি! রেল কোম্পানির এত না লস হয়ে গেল, পাবলিক সাফার করল। আপনিই এর জন্য দায়ী। 

নেত্যকালী গর্জে ওঠে—আমি মেরেছি? ওই হারামজাদি মতিয়াই আমার লোক এই যে এই বিমলিকে মাথায় ওই কাঁকন দিয়ে মারলে, মাথা ফাটিয়ে দিল হাতে কামড়ে দগদগে ঘা করে দিল আবার বলে আমি মেরেছি। ওই খুনে—মদ-বেচা ছুঁড়ি—তার এক পাল ওই পোষা ভেড়ুয়াদের বল্লে গাড়ি চালাবি না—ব্যস ওরাও গাড়ি-বন্ধ করে দিল। কিরে গদাই অ্যাই যতীন অ্যাই মটরা—বল! 

ওরা তখনও মতিয়ার দেওয়া মদে টোর। গদাই ভিড় ঠেলে আসতে গিয়ে ছিটকে পড়ে আর কি। মটরা টলছে। 

নেত্যকালী গর্জে চলেছে—এইসব কাজের লোকের নমুনা। আর ওই নাদাপেটা মিনসে বলে কিনা আমি ধর্মঘট করালাম। 

পরক্ষণেই বেশ গমকের সঙ্গে বলে ওঠে নেত্যকালী, 

—আমি যে তোমার রেল চালাই হে সাহেব। পয়েন্ট দিই। ওই আমাদের ঘরের লোক—কতবার বললে ওদের ট্রেন যেতে দে—পরে বিচার হবে। ওরাই তা শুনল না। 

দোষ হলো ওর! বাঃ সাহেব—বেশ বিচার, সাধু হলো চোর, আর যে চুরি করল সে হলো সাধু! 

মতিয়া আবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে! 

—সাহেব মা বাপ! সব ঝুট বলছে। দেখিয়ে ক্যায়সে মেজাজ ওর। হকো কতো গালি দিল সাহেব! 

—থাম মাগি! নেত্য গর্জে ওঠে! 

রতনও এগিয়ে আসে! কী যেন বলতে চায়! 

ডি কস্টা তবু সাহেবি মেজাজে চলেছে। হাকিম নড়বে তবু হুকুম নড়বে না। এতটুকু দুর্বলতা দেখালে তার এতবড় রেলের কর্মীবাহিনীর মাঝে ডিসিপ্লিন থাকবে না। ডি কস্টা কঠিন—স্বরে বলে— 

ওসব পিছু বলবেন আপনি, পরে বিচার হবে তখন আই শ্যাল সি। নাউ আপনাকে আমাদের সাথে সদরে যেতে হবে! রেল কোম্পানির এনা লস্ হলোগ্ এইসা বরদাস্ত নেহি করেগা। ভজগোবিন্দ— 

ভজগোবিন্দ এবার যেন পড়ে যাবে। 

বেশ বুঝেছে ভজগোবিন্দ ওই নাদাপেটা সাহেব তাকে এবার ছাড়বে না। ওর মর্জিমতো তাকে কি শাস্তি দেবে কে জানে। চাকরিই যাবে হয়তো, নাহয় এবার নির্ঘাত এই দিব্যি পাওনা গণ্ডার ইস্টিশান থেকে মাঠের মধ্যের কোনো ইস্টিশানেই চালান করে দেবে, আর সবই ঘটে গেল ওই নেত্যকালীর জেদের জন্য। তার কোনো দোষ নেই! অকারণে শাস্তি পাবে-অপমান সইবে সে। 

ভজগোবিন্দ সাহেবের সামনে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে! ডি কস্টা সাহেব হাতের বেটনটা জুতোয় ঠুকতে ঠুকতে বলে। 

ইউ অলসো গো উইথ মি! তুম ভি যাবে। 

ভজগোবিন্দ তবু চিঁ-চিঁ করে। 

—ইস্টিশান ছেড়ে যাব সাহেব! 

গর্জে ওঠে ডি কস্টা—ইউ আর আন্ডার সাসপেনসন। টুমাকে হামি সাসপেন্ড করেছি! গো টু সদর—ইউ ওয়াইফ হ্যাজব্যান্ড বোথ! আই শ্যাল টিচ ইউ এ গুড লেসন! 

মদন অ্যাও ছোটাবাবু, টেক চার্জ অব দি স্টেশন! 

গুপিনাথের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে! 

খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে সে—ভেরি গুড সাহেব। জয় বাবা রেল ভৈরব! 

টেক দেম ফ্রম লাউগঞ্জ সাহেব। শান্তি পাব আমরা! 

গুপি শুধোয় তাহলে সাহেব ওরা ট্রেন চালাতে যাক! 

ডি কস্টা বলে–লেট দেম গো। যাও শ্লা লোগ আপনা কামমে যাও। 

আউর গড়বড় করলে আই শ্যাল কিক্ ইউ আউট! গো— 

গুপিমিত্তির দু’হাত তুলে চিৎকার করে—ডি কস্টা সাহেব কি জয়! লাউগঞ্জ রেলওয়ে—জিন্দাবাদ!

ওর দলদল এবার গলা মিলিয়ে চিৎকার করে। মটরা হেঁকে ওঠে, মহিলা সমিতি—মুর্দাবাদ!

রতন এগিয়ে আসে। সুলতা-কুসুম-মালতী অনেকেই। বকুলের চোখে জল নামে।

আজ তার একমাত্র অবলম্বন ওই মাসিমা—তাকেও এখান থেকে দুঃসহ-অপমান নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। রতনও কিছু করতে পারেনি! 

তবু রতন ডি কষ্টাকে কি বলতে চায়! 

—মিঃ ডি কস্টা! 

ধমকে ওঠে গুপি-মিত্তির। বেশ চড়াস্বরেই বলে। 

—ওটাকেও অ্যারেস্ট করো সাহেব। এ ডেঞ্জারাস বয়—মোস্ট অবাধ্য! 

ইতর—হারামজাদা! 

রতন বলে ওঠে—বাবা! 

—থাম তুই! তোকেও জেলে পাঠাব। তেল মরবে তোর! 

গুপি মিত্তির বলে—সাহেব, টেক দেম কুইক! নাহলে ভয়ানক গোলমাল হতে পারে স্যার! শান্তি ভঙ্গ—ফৌজদারি সব করতে পারে এরা। 

এস পি বলেন—আপনি থামুন! আমরা রয়েছি কোনো অশান্তি হবে না! 

বকুলের চোখের জল বাধা মানে না। মাসিমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে –তুমি চলে যাবে মাসিমা। আমার কী হবে? আমার আর কেউ রইল না। 

বকুলের কথায় গুপিনাথ এবার ফুঁসে ওঠে, 

—এবার তোমার সুলতাদিকেও স্কুল থেকে আউট করে—তোমাকেও তাড়াব। ওই শশী নায়েবের ঘরেই তোমাকে যদি চালান না করি আমার নাম গুপি মিত্তির নয়! 

ডি কস্টা হুঙ্কার ছাড়ে। 

—কাম টু দি স্টেশন রুম! ইউ গজ গোবিনড্—টেক ইয়োর ওয়াইফ। চলো দোনো—সদরমে। আই শ্যাল টিচ ইউ এ গুড লেসন! ধর্মঘট করার সাজা ঠিকই মিলবে! 

…নেত্য যেন হেরে গেছে। 

বিমলি কাঁদছে—আমার কি হবে দিদি! 

নেত্য বলে—বাবার কাছে যাবি! সব বলবি গিয়ে! 

নেত্যর দু’চোখে জল আসছে। তবু চেপে রেখেছে সে। মহিলা সমিতির কণ্ঠও যেন রোধ হয়ে আসে। কে একটা মালা এনে নেত্যকালীকে পরিয়ে দেয়। 

ভাঙা গলায় ওরা চিৎকার করে—মহিলা সমিতি জিন্দাবাদ। 

ডি কস্টা এবার যুদ্ধজয় করেছে। 

গলায় গুপি মিত্তিরের দেওয়া সেই গাঁদা ফুলের ডবল মালা ঝুলছে, মুখে পাইপ। কালচে মুখে কাঠিন্য জাগে! 

নিতাই এর মধ্যে ঠ্যাং-এ দড়ি বেঁধে নিচের দিকে মুখ ঝুলিয়ে ডজনখানেক রঙ-বেরঙের মুরগি এনেছে, অন্য একজনের হাতে ইয়া রুই মাছ আর সন্দেশের হাঁড়ি। ডি কস্টা খুশিই হয় সব দেখে। 

গুপি মিত্তির বলে—ওসব সাহেবের গাড়িতে তুলে দে! পান খাবেন স্যার। 

ডি কস্টা গর্জন করে—গজ গোবিন্দ—ইউ নেট্যকালী দেবী চলো. গাড়িমে। যাও তুম লোগ্‌ ট্রেন ছোড়ো—লাইন ক্লিয়ার করো। বয়লারমে পুরা ইটিম লাগাও— 

নেত্য হতাশ হয়ে পড়েছে। বড় মুখ করে বাবার কাছে সদরে গেছিল হয়তো বাবা কিছু করতে পারবেন। কিন্তু এখনও কোনো খবর পায়নি নেত্যকালী। বাবা তার জন্য কিছু করতে হয়তো পারেনি। তাই আজ নেত্যকালীকে মুখ কালো করো মিথ্যা অপবাদ নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে এখান থেকে। 

তবু নেত্যকালী এতটুকু দমেনি! 

সামনে গুপি মিত্তির দাঁড়িয়ে, গলায় তারা জবা ফুলের মালা। নেতার বেশে আজ সে সামনে এসেছে। এতবড় ধর্মঘট-এর মীমাংসা করেছে, নগদ প্রচুর টাকাও ঘরে তুলেছে। আর ওই ভজগোবিন্দকে নেত্যকালী সমেত লাউগঞ্জ থেকে উৎখাত করে দিয়েছে। 

গুপি বলে—তাহলে চল্লেন মা জননী? যান! 

কুসুম চুপ করো গেছে। জানে ওই মানুষটা এবার তাকেও বাড়ি ফিরে সমুচিত জবাব দেবে! বকুলের চোখে জল! 

সুলতাও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সেও বুঝেছে আজকের যুদ্ধে জয়ী হয়ে গুপি মিত্তির এবার তাদের স্কুল কমিটিতেও ঢুকবে। তার চাকরিও চলে যাবে। 

গুপি মিত্তির এবার লাউগঞ্জের সব কিছুতেই থাবা বসাবে! 

গুপি এদের দিকেও বেশ কটমট করে তাকিয়ে তাগাদা দেয়, 

—তাহলে চলুন সাহেব। ওদের নিয়ে চলুন! 

হঠাৎ একটা সাড়া পড়ে যায়। চারিদিকে গোলাকার ভিড় জমেছিল এই বিচিত্র বিচারের দৃশ্য দেখার জন্য। এতক্ষণ ধরে এখানে একটা বিচিত্র নাটকই অভিনীত হচ্ছিল। 

মতিয়াও ঠেলে উঠেছে বিজয়িনীর মতো। 

সে জানে তার কারবারও এবার জোর চলবে, বাধা দেবার কেউ নেই। এমন সময় ওই গোলাকার ভিড়ের বেষ্টনী ঠেলে শশব্যস্ত হয়ে ঢুকছে বেঁটেখাটো গৌরবর্ণ গোলগাল একটি মানুষ পরনে থ্রি কোয়ার্টার সাদা জিনের প্যান্ট, গোড়ালির কাছে এসে থেমে গেছে, গায়ে কালো বুক খোলা কোট, গলায় কণ্ঠি। নাক থেকে কপালের ময়দান অবধি দীঘল তিলক চিহ্ন! পায়ে ধূলিধূসর লাল কেডস্! হাতে একগাদা নথিপত্র, লাল খেরোতে জড়ানো! পিছনে কোর্টের উর্দি-পরা পেয়াদাও রয়েছে একজন। 

ওই লোকটির চোখ মুখ ঘামে চকচক করছে। আর দু’চোখের তারা দুটো যেন বনবনিয়ে ঘুরছে। ভিড় ঠেলে আসরে ঢুকে মৃদুকণ্ঠে বলে ওঠে গোঁসাই প্রভূ।

—জয় প্রভু! সবই তোমার ইচ্ছে! 

চমকে ওঠে নেত্যকালী—বাবা! 

এতক্ষণ ধরে প্রতিটি মুহূর্ত ওর কথাই ভাবছিল নেত্যকালী। বাবাকে এসময় দেখে নেত্যকালীর উৎকণ্ঠা-ভরা স্বর ধ্বনিত হয়—এসেছ তুমি বাবা! 

মধুর হাসি হাসেন গোঁসাই প্রভু! কুলদা গোঁসাই বলেন, 

—দেরি হয়ে গেল মা। নানা কাজ সেরে বীরহাটা অবধি ট্যাক্সিতে করে এসে এতটা পথ রিকশায় আসতে দেরি হয়ে গেল! 

নেত্য বলে—এরা ওই বড় সাহেব আমাকে অ্যারেস্ট করে সদরে নিয়ে যাচ্ছে বাবা। তোমার জামাইকেও যা তা বলেছে—তাকেও সাসপেন্ড করেছে। 

কুলদা গোঁসাই-এর ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে ওঠে।

—তাই নাকি! অ্যারেস্ট করেছে? তোকে? পরক্ষণেই বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় বলে—কুলদা গোঁসাই-এর মেয়েকে অ্যারেস্ট করেছে, ওই পেটমোটা ছুঁচো হাঁড়িমুখো সাহেব? 

এস-পি আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এখানে নেমে ডি কস্টার কর্মীদের সঙ্গে এই মিটিং-এ একটু থেকেই তারা চলে গেছেন অন্যদিকে। অন্য জরুরি কাজ সেরে ফিরবেন তারা। এখানে তাঁদের বিশেষ প্রয়োজন হবে না। তা জেনে তাঁরা ওদিকে গেছেন। 

ডি কস্টা এতক্ষণ একাই এখানে বীরত্ব দেখিয়ে চলেছিল। এবার ওই নতুন মানুষটিকে ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়তে দেখে সে হেঁড়ে গলায় গর্জে ওঠে। 

—হু আর ইউ? 

ডি কস্টার ওই গর্জনে কর্ণপাত না করে গোঁসাই প্রভু বলেন—কোনো ভয় নেই মা প্রভুর কৃপায় সব পথ পরিষ্কার করে এসেছি। দ্যাখ না মজাটা। 

ডি কস্টা জবাব না পেয়ে রেগে যায়। তার মেজাজ তুঙ্গে ওঠে। হাতের বেটন তুলে গর্জে ওঠে গোঁসাই প্রভুর দিকে। 

—টেল মি, হু আর ইউ। 

গোঁসাই প্রভু মৃদু-হাসি হেসে অমায়িকভাবে বলে। 

—চটো না সাহেব। ক্রমশ চিনবে আমিটি কে? 

সামনে গুপি মিত্তিরকে দেখে কুলদা গোঁসাই বলে—প্রাতঃপেন্নাম মিত্তির মশাই। বেশ খুশি খুশি লাগছে? সব কুশল তো? 

গুপি মিত্তিরও দেখেছে কুলদা গোঁসাইকে। 

মনে মনে ভয়ও পেয়েছে এবার। লোকটাকে বিশ্বাস নেই। সদ্য হারা মামলাটার কথা মনে পড়ে। গোহারান করে ছেড়েছিল তাকে আদালতে। আজ আবার সেজেগুজে এখানে কি মতলবে এসেছে এই কুলদা গোঁসাই কে জানে! 

গুপির গলায় জবা ফুলের মালা, ধোপদুরস্ত কাপড়। 

কুলদা গোঁসাই বলে—উচ্ছৃণ্ড্য করা হয়ে গেছে নাকি আপনাকে? অ্যাঁ। 

ডি কস্টা বলে—স্টপ দিস ননসেন্স! কাম অন— 

এমন সময় স্বয়ং ডি-এম সাহেব আর এস-পিকে আসতে দেখে কুলদা গোঁসাই নমস্কার করে। ডি-এম সাহেব ওকে এজলাসে বহুবার দেখেছেন। ওর সওয়ালের ধার সম্বন্ধে তিনি ও ওয়াকিবহাল। লোকটা দুদে মোক্তার। হঠাৎ এখানে দেখে ডি-এম সাহেব শুধোন—এখানে যে কুলদাবাবু, কী ব্যাপার? কুলদা গোঁসাই বিনীতভাবে জানান। 

—একটু প্রয়োজনে আসতে হয়েছে স্যার—ধর্মাবতার? কই হে—গেলে কোথায়?

কোর্টের বেলিফ ওর ডাকে এসে হাজির হয়। 

ডি কস্টা গর্জাচ্ছে—চলো— 

কুলদা গোঁসাই বলে—কিঞ্চিৎ ধৈর্য ধরতে হবে সাহেব। 

ধর্মাবতার, তাহলে অনুমতি দেন মহামান্য আদালতের শমনগুলো এঁদের সার্ভ করে দিক।

পরক্ষণেই বেশ গলা তুলে এজলাসে সওয়াল করার ভঙ্গিতে বলে ওঠে সে –বেলিফমশাই- ইনিই একনম্বর আসামি—শ্ৰীন্যাসিমেন্টো পোর্টমেন্টো ডি কস্টা। ধরুন সাহেব। সই করে নিতে হয় মহামান্য আদালতের শমন। নিন। 

ডি কস্টা গর্জে ওঠে। 

—হোয়াট? হোয়াই শমন! আই ওন্ট টেক ইট। 

কুলদা মোক্তার এবার বলে ওঠে—টেক ইট সাহেব। না হলে ডি-এম সাহেব সামনে আছেন। কনটেম্পট অব কোর্ট-এর ধারায় আর এক নম্বর ঠুকে দেব। ঘাড় কাত করে শমন নিন। কোর্টে গিয়ে যা বলার বলবেন। টেক ইট। 

শান্ত-মানুষটি বেশ কঠোর-স্বরে গর্জে ওঠে। 

ডি কস্টা ঘাবড়ে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সকলেই দেখেছ তাকে। ডি কস্টার সেই ফোলানো বেলুন এবার চুপসে আসে। মুখ-বুজে ডি কস্টা সাহেব শমনটা নিয়ে গর্জে ওঠে। 

—হোয়াট? আমাকে আসামি করা হয়েছে! 

কুলদা মোক্তার শান্তস্বরে বলে—আদালতের যা বলার বলবেন। বেলিফ মশাই ইনি দু নম্বর আসামি শ্রীভজগোবিন্দ চট্টরাজ—ইস্টিশান মাস্টার, লাউগঞ্জ ইস্টিশান। ধরো বাবাজি—সই করে ওটা নাও। 

ভজগোবিন্দের এবার চমকাবার পালা। 

—আমি কী করলাম বাবা! 

ভজগোবিন্দ শ্বশুরমশায়কে দেখে একটু ভরসা পেয়েছিল। কিন্তু এবার শমন হাতে নিয়ে কাঁপছে, সব ভরসা-মুছে গেছে মন থেকে ভজগোবিন্দের। 

কুলদা গোঁসাই বলে—মামলার কাছে বাপ-ছেলে, মেয়ে-জামাই-এর কোনো সম্বন্ধ নেই বাবা। ওসব পরের কথা। 

চর্কিবাজির মতো ঘুরছে কুলদা মোক্তার, বলে ওঠে, 

—এবার ফৌজদারির মূল আসামীদের শমন ধরান। অবশ্যি দারোগাবাবুকে কপি দিয়ে এসেছি, কইরে নেত্যকালী—মা বুধন কাহার, মতিয়া কাহার, গদাধর দে, মটরা সহায়, যতীন দাস—হ্যাঁ ওরা কে মা? অ ভজগোবিন্দ, বাবা আসামিদের শনাক্ত করিয়ে দাও বাবাজি। মহামান্য আদালতের হুকুম- 

মতিয়া-বুধন-যতীনরা দল বেঁধে এক জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিল। ওরা খুশি হয়েছে। কাজ করতে যাবে। যা হোক সব গোলমাল ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে গুপি মিত্তিরের দয়ায়। ওরা চলেছে—ওদের নাম শুনে থমকে দাঁড়ালো তারা। 

নেত্যকালীর বলে–ওই তো সবাই ওরা রয়েছে। 

বেলিফও ছিনেজোঁকের মতো গিয়ে হাজির হয়ে ওদের পিছু লেগেছে। প্যাড টিপছাপ দেবার কালি বের করে এক-একটাকে ধরছে আর টিপ-ছাপ নিয়ে শমন ধরিয়ে দিচ্ছে। 

ওরাও কোর্টের পেয়াদার উর্দি দেখে একটু ঘাবড়ে গেছে। তাছাড়া দেখেছে স্বয়ং বড় সাহেব শমন না নিতে ওই কোট-পরা লোকটা গর্জে ওঠে ওকে থামিয়ে দিয়েছে। মুখ বুজে সাহেবকে ওসব নিতে হয়েছে। 

তাই বুধুয়ারাও নিয়েছে শমনটা। 

আর ততক্ষণে অশ্বিনী দারোগাও এসে পড়ে। স্বয়ং এস-পি সাহেব রয়েছেন ঘটনাস্থলে। অশ্বিনী দারোগা এসেছে ওই আসামিদের বডি ওয়ারেন্টের কপি পেয়ে। ওদের কালই কোর্টে হাজির করতে হবে। 

কুলদা মোক্তার এবার দারোগাকে দেখে বলে, 

—এই যে দারোগাবাবু, এই আপনার বডি ওয়ারেন্টের আসামি কজন—মতিয়া কাহার, বুধন, যতীন দাস, মটরা আর গদাধর দে। এদের জিম্মা করে নিন। কাল মহামান্য আদালতে হাজির করবেন। 

অর্থাৎ পুলিশ হেপাজতে থাকতে হবে ওদের কাল অবধি। 

এবার ডি কস্টা গর্জে ওঠে, 

—ওরা গাড়ি চালাতে যাবে। ওদের অ্যারেস্ট করবেন—হোয়াই? কুলদা মোক্তার জানায়,

—সাহেব, ফৌজদারির আসামী ওরা। কাল কোর্টে হাজিরার দিন ছিল, যায়নি। তাই পুলিশ দিয়ে ওদের হাজির করাতে আদেশ দিয়েছেন মহামান্য আদালত। 

ডি কস্টা বলে—গাড়ি চলবে না? 

—অন্য লোক দিয়ে চালাও কেস্টা সাহেব। অনেক লোক তোমার। ওদের আজ ছাড়া চলবে না। যাও বুধন—থানাতেই যাও বাবাজি দল বেঁধে। 

কুলদা মোক্তারের কথায় কঁকিয়ে ওঠে মতিয়া—এ মালিক থানাতে যেতে হবে কাহে?

ডি-এম সাহেবও অবাক হয়েছেন। ট্রেন চলছিল কিন্তু ওই ধুরন্ধর ব্যক্তিটি এসে সব গোল পাকিয়ে দিয়েছে আইন আদালতের বাঁধন দিয়ে। আর এসবই আইন-সম্মতই করছে। 

তবু বলেন তিনি—কি ব্যাপার গোঁসাই প্রভু। এসব কি গোলমাল হয়ে গেল।

মতিয়া কাঁদছে। বুধন-যতীন-মটর-গদাই নিঝুম। ডি কস্টা সাহেবও গজরাচ্ছে। তার সামনে এবার সমূহ বিপদ। 

উপরে ম্যানেজিং বোর্ড ওকে হুকুম দিয়েছে যে ভাবে হোক ট্রেন-চালু করতেই হবে। না হলে তাকেও ছাড়বে না কর্তারা। এবার তাকেও রিটায়ার করিয়ে দেবে, না হয় সাসপেন্ড করবে। 

সব কাজ তর্জন-গর্জন করে সেরে এনেছিল, কিন্তু ওই কুলদা মোক্তার এসে সব উল্টে দিয়েছে, ট্রেন চালানো যাচ্ছে না আজ। দল বেঁধে তার কর্মচারীদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলেছে। তার চাকরি ইজ্জত সব শেষ হয়ে গেছে। উল্টে নিজেও ফৌজদারি আসামি হয়ে গেছে। শুধু গুপিনাথ ওই মতিয়ার কান্না-দেখে গর্জন করে। 

—কাঁদিস নে মতিয়া, আপিল করব। আমি লড়ে যাব তোদের জন্যে! ডোন্ট ফিয়ার কেষ্টো সাহেব, আই এম হিয়ার! হাইকোর্ট অবধি মামলা লড়ব! 

হঠাৎ তাকাল ওর দিকে কুলদা মোক্তার! খেয়াল হয় তার। 

—ওহে বেলিফ মশাই, তিন নম্বর মামলাটার শমন দাওনি? ওই তোমার ভুল! দাও, দাও। ইনিই শ্রীগুপিনাথ মিত্র! 

এই যে—নিন। চলুন এবার হাইকোর্টে। 

গুপিনাথ এবার লম্ফ দিয়ে ওঠে। 

—আমার নামে শমন! কীসের শমন! 

কুলদা মোক্তার বলে—নিন, নিয়ে দেখুন। অবশ্যি আপনাকে ফৌজদারিতে এখনও পাইনি—দেওয়ানিই চলল। পরে দেখব। আপাতত ধরুন এটা! শমন হাতে নিয়ে দু’এক লাইন পড়ে গুপি মিত্তিরের কালচে মুখ তামাটে হয়ে ওঠে। কাঁপছে সে। হাতের লাঠিটা এবার শূন্যে তুলে রতনের দিকে ধেয়ে যায়। গর্জাচ্ছে সে। 

—রতনা, আজ তোকে খুন করে ফেলব। এই তোর কাজ! তুই বলিস কিনা আমার নামে ধান কল, আমাকে হিসাবপত্র বুঝিয়ে দিতে হবে। কল দখল দিতে হবে তোকে? খুন করেঙ্গা! 

লাঠিটা ধরে নেয় গোঁসাই প্রভু। মধুঝরা কণ্ঠে বলেন! 

—কি করছেন মিত্তির মশাই। এখুনিই তো ফৌজদারিতে পড়বেন! অলরেডি তিনশো সাত ধারায় পড়ে গেছেন! আবার ননবেলেবেল কেসে পড়বেন! গুপির পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। চোখে যেন সর্ষেফুল দেখছে এবার। গর্জায় সে। 

—আমিও লড়ব! দেখে নেব কেমন মোক্তার তুমি! 

ডি-এম সাহেব দেখছেন সব জট পাকাচ্ছে। তাই বলেন তিনি—আসল ব্যাপারটা কি গোঁসাই প্রভু! রেল কি আজ চলবে না? 

কুলদা গোঁসাই এবার শান্তভাবে বলে। 

—আমি তো এসব করতে চাইনি হুজুর। এনারা—ওই গুপি মিত্তির সব জট পাকালেন, আর ওই কেষ্টো সাহেব এসে তাতে ফোড়ন কাটলেন! পরক্ষণেই কাগজপত্র বের করে বলে গোঁসাই প্রভু। 

—ওই যে জায়গায় লাউগাছটা রয়েছে। যার লাউ কাটতে বাধা দিল ওই মতিয়া দলবল নিয়ে ওটা কিন্তু হুজুর রেলের জায়গা নয়! অন্য ব্যক্তির জায়গা— 

ডি কস্টা চিৎকার করে—ওটা রেলের জায়গা—সিওর! 

—না! না! এই যে হুজুর তার দলিল পড়চা। এই জায়গা সেই মালিকের কাছ থেকে আমার কন্যা ওই নেত্যকালী দেবী কয়েকদিন আগে বায়নাপত্র করে ওই জায়গার সব স্বত্বাধিকারিণী হয়েছেন। 

এই তার বায়নানামা দলিল ধর্মাবতার! 

দলিল ঠিকই! ডি-এম সাহেব এবার ডি কস্টাকে বলে ওঠেন, 

—ওরই জায়গা! আপনার লোক কেন বাধা দিতে গেল ওকে? 

গোঁসাই প্রভু বলেন! 

—তার জন্যই এই মামলা হুজুর। ইনি আর ওই স্টেশন মাস্টার দুজনে জোর করে আমার কন্যাকে তার জায়গা থেকে বলপূর্বক বেদখল করার জন্য এদের নিয়োজিত করেছিলেন! 

গর্জে ওঠে ডি কস্টা—নেভার! 

—আদালতে গিয়ে বলবেন! কুলদা গোঁসাই কথাটা ছুড়ে দিয়ে আবার ডি-এম সাহেবকে অন্য কাগজ বের করে বলে ওঠে! 

—হুজুর! ওই বুধন মতিয়ারা দল বেঁধে আমার মেয়ে আর তার সহকারিণী ওই বিমলি দাসীকে মারে, কামড়ে দেয়—রক্তপাত ঘটায়। এই তার ডাক্তারি সার্টিফিকেট, পুলিশ কেসের ডাইরি নাম্বার। 

মামলা রুজু করে শমন দেওয়া সত্ত্বেও—ওই ফৌজদারি আসামীরা কোর্টে যায়নি। ফলে মহামান্য আদালত তাদের বডি-ওয়ারেন্ট করেছেন! কাল শুনানির দিন ধার্য আছে হুজুর! 

নিখুঁত পরিকল্পনা করেই কাজে নেমেছেন কুলদা গোঁসাই। 

বলে ওঠে—হুজুর, আপনি, স্বয়ং এস-পি মহোদয় সাক্ষী। সর্বজন সমক্ষে এসব ব্যাপার গোপন করে ওই কেষ্টো সাহেব আমার কন্যাকে অপমান করে—সদরে আটকে নিয়ে চলেছিলেন। তার জন্য কালই খোলা আদালতে আর এক নম্বর মানহানির মামলা—রুজু করব ডি কেষ্টো সাহেব, সামলাবে এইবার! 

সুলতা—বকুলরা সকলেই খুশি। 

রতন বলে ওঠে—তাই করুন! ছিঃ ছিঃ না জেনে না শুনে এইভাবে অপমান করবেন উনি একজন ভদ্রমহিলাকে? 

সুলতা বলে এবার ভরসা পেয়ে। 

—মহিলা সমিতিকে উনি অপমান করেছেন! 

হেঁকে ওঠে কুলদা মোক্তার—আর এক নম্বর! 

কুলদা গোঁসাই এবার শুভ কাজ সেরে চারিদিকে তাকিয়ে ডি-এম সাহেবকে বলেন! 

—তাহলে যেতে আজ্ঞা হয় হুজুর। নেত্যকালীর মায়েরও শরীর ভালো নেই! চলি সাহেব কাল আদালতে সাক্ষাৎ হবে! আর দারোগাবাবু, তাহলে আসামিদের নে যান। বেলিফ মশাই—আপনি আদালতে ফিরে গিয়ে বিলি করা শমনের রিপোর্ট জমা করে দিন গে! কাল কেস উঠলে দেখা যাবে। 

নমস্কার হুজুর। চলো মা- 

সব দাপট আর দফা-রফা শেষ হয়ে গেছে। ন্যাসিমেন্টো ডি কস্টা এবার প্রমাদ গণে। তার চাকরির দফা শেষ। আর আদালতে ওই তিন নম্বর মামলার কী হবে তার কে জানে! 

ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে সে! 

হঠাৎ এবার ওই নেত্যকালীর সামনে দমাস্ করে হাঁটু গেড়ে দুটো কুলোর মতো হাত একত্র করে কাতর-স্বরে চিঁ-চিঁ করে ওঠে ডি কস্টা—সেভ মি মাদার ড্যানসিং কালী। মাদার নেট্যকালী।

নেত্যকালীর জুতসই ইংরাজি এটাই খুঁজে পেয়েছে সে। দেখেছে কালী ঠাকুরকে। হিন্দুদের জাগ্রত দেবতা। তার অ্যান্টি-বউবাজারে ফিরিঙ্গি কালীর থানে পুজো দিতে যায়। 

এবার ডি কস্টাও সেই জ্যান্ত কালীর সামনে বড়ি থ্রো করে ব্যাকুলভাবে আর্তনাদ করে।

—সেভ মি মাদার। সেভ ইয়োর পুওর সন! অল মাই ফল্ট মাদার! বহুত ভুল করেছি হামি ফরগিভ মি মাদার ডানসিং কালী। 

ট্রেন-চালু করো মাদার! নাহলে হামার নোকরি ‘নট’ হয়ে যাবে। বাল-বাচ্চা ভুখা মরবে মাদার। সেভ ইয়োর পুওর সন্। 

নেত্যকালীর পা-ই ধরে আর কি! 

চমকে ওঠে নেত্যকালী। সুলতা—কুসুম ওই সমবেত জনতাও অবাক হয়েছে। হাসছে কুলদা মোক্তার। 

—কি হল অ কেষ্টো সাহেব! অ্যাঁ! হামাগুড়ি দিচ্ছ কেন গো! জয় প্রভু। সবই তোমার ইচ্ছে! তা দাও একটু হামাগুড়ি। ওতে ওই পরার্থে-খাওয়া কুক্কুট মাংসজাত উদরের মেদ একটু কমবে! 

নেত্যকালীর চরণে তখন হামলে পড়েছে ডি কস্টা। 

আর্তনাদ করছে! নেত্যকালী বলে—ও বাবা! এ যে বিটকেলি কাণ্ড করছে গো!

গোঁসাই প্রভু বলে—করবে মা! কিঞ্চিৎ ওষুধ দিয়েছি কিনা! একটু করবে! 

—মেয়েছেলে নিয়ে পথে বসবে বলছে। চাকরি চলে যাবে বলছে। নেত্যকালী বলে—এসব ভালো নয় বাবা, লোকের খেতি করে কি হবে! 

ও যে জামাই-এর ক্ষতি করবে মা? কুলদা গোঁসাই বলে! 

ডি কস্টা কুলদা গোঁসাই-এর কথায় বলে ওঠে, 

—মাদারের ফিট ডাস্ট নিয়ে বলছি মোক্তার সাহেব তোমার জামাই ওই ভজগোবিন্দবাবুকে কিছু করব না। ও লাউগঞ্জেই পোস্টেড থাকবে বরাবর! হোল লাইফ। 

কুলদা মোক্তার জেরা করে। 

—আর পিছনে ওই মতিয়া বুধনদের লাগিয়ে রাখবে। তোমার মতলব বুঝি সাহেব। এখন কারে পড়ে চিঁ-চিঁ করছ। ছাড়া পেলেই ছোবল মারবে! 

ডি কস্টা বুকে ক্রশ এঁকে বলে কাতর-স্বরে। 

—মাদার মেরির নামে সোয়ার করছি মোক্তারবাবু, ওই হারামজাদাদের পুরা সেট কো আভি ট্রানস্ফার করেগা। দে উইল নেভার কাম টু লাউগঞ্জ। আই সোয়ার! প্লিজ মাদার—ফরগিভ মি! ট্রেন চালু করো মাদার। 

নেত্যকালী বলে—মহিলা সমিতি তো প্রথমদিন থেকেই তাই চেয়েছিলে! তুমি এসে ওদের হয়ে কথা বললে- 

—মিসটেক মাদার। উই মেড এ মিসটেক। দ্যাট গুপি–হোয়ার ইজ গুপি। ওইই সব উল্টে দিল! 

গুপিকে ত্রি-সীমানায় দেখা যায় না। সে নেই এখানে। 

ডি কস্টা হাঁপাচ্ছে এতক্ষণ কথা বলে। নেত্যকালী বলে। 

—বাবা। সাহেব কথা দিচ্ছে। এবারের মতো মাপই করে দাও। 

কুলদা মোক্তার বলে, 

—ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তখন দেখছি। তবে সাহেব ওইসব কথাগুলো যা-যা বললে তা তোমাকে ডেমি কাগজে লিখে সই করে দিতে হবে দু’জন সাক্ষীর সামনে তাহলেই সব মামলা তুলে নেব। আব ট্রেনও চলবে এখুনিই। রাজি। 

ডি কস্টা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বলে সে—ডান্! আই সোয়ার—চলো সব লিখে দিচ্ছি।

কুলদা মোক্তার বলে ওঠে ডি-এম সাহেবকে। 

—তাহলে গাড়ি চলছে স্যার। অ বুধন —যা 

তেজের সঙ্গে ডি কস্টা বলে—ক্লিয়ার করো লাইন। গদাই ইঞ্জিন হঠাও। আজই তুমলোক ভি হামারা সাথ চলো। ট্রান্সফার কর দিয়া তুমলোক কো। 

মতিয়ার সাধের বাসা ভেঙে যেতে সে আর্তনাদ করে, 

—সাহেব মা-বাপ। 

ডি কস্টা স্বয়ং তখন তার বাপ-মাকে ডাকছে। মতিয়ার ওই ডাকে গর্জে ওঠে—চলো। সিধা। আভি চলো–লাও সমান, তুম্ এক নম্বর বদমায়েশ। তুম্ এসব করলে। অ্যাই বুধন চলো—জলদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *