তিল থেকে তাল – ৬

সন্ধ্যার পর থেকেই গুপির গুদামে নিতাই, যোগেন সরকার ক’জন কুলি দিয়ে মালের বস্তা নামাচ্ছে আর ওজন করছে। ওদিকে কেরোসিন তেলের সমূহ অভাব। আট দশখানা গ্রামের লোক এইবার অন্ধকারেই থাকবে। কিন্তু মালের সন্ধানী দু’চারজন কারবারি এসে পড়েছে। 

গুপিনাথ চারগুণ দাম হেঁকে ঘোষণা করে—মাল নাই, নিতে হয় নাও। না পারো চলে যাও বাপু হে! 

…..ট্রাকবন্দি চালও পাচার হচ্ছে। 

গুপি গুদামের কোণে কালো শিষ-ওঠা ল্যাম্পের সামনে বসে টাকা গুনছে। পাঁজা পাঁজা নোট। 

নিতাইকে ডেকে বলে—আজ এই অবধি থাক নিতে! 

নিতাই বলে—পেরায় শেষ করে এনেছি গো! বাকিটুন— 

হাসে গুপিনাথ—কালকের দিনটা টিকিয়ে রাখ, দেখবি এই বাকি মাল বেচে আজকের দ্বিগুণ লাভ করবি। একবারে মা-লক্ষ্মীকে বিদায় করতে নেই রে। 

নিতাই সায় দেয়—ঠিক আছে। 

গুপি বলে—এসব বন্ধ-ছন্দ করে চল একবার ইস্টিশানমুখো, কি হলো দেখতে হবে। ব্যাটারা যেন ঝিমিয়ে না পড়ে। 

….গুপি মিত্তিরের আসল কারবার আর ওদের পিছনে সমর্থন করার আসল কারণটা এবার বুঝেছে নিতাই। এক রাতেই গুপি মিত্তির গুদামের বিলকুল পচা মাল—বরবাদী চাল সব চারগুণ লাভে সাফ করেছে। আর কেরোসিন তেল বেচে কতো হাজার টাকা ঘরে তুলেছে সেটা জানে না! কারণ তেলের ব্যাপারটা ঘটেছে অন্য গুদামে। 

তবু গুপিকে খুশি দেখে নিতাই বলে। 

—কর্তা এত খাটলাম, কিছু নগদ বিদেয় হবে না? 

গুপিনাথ গোটাকয়েক দশটাকার নোট তুলে দিয়ে বলে, 

—ওই তোর দোষ নিতে। চোখের নজর তোর ভালো না—চল! দু’জনে স্টেশনের দিকে এগোল। 

.

স্তব্ধ-স্টেশনে অন্যদিন লাস্ট লোকালের পর জমাট অন্ধকার নামে। বট-অশ্বত্থ—কৃষ্ণচূড়া গাছের জড়াজড়ি অন্ধকারে জোনাকি জ্বলে। দু’একটা কুকুর পড়ে থাকে। প্ল্যাটফর্মের দরজার বেড়ার ওদিকে জেগে থাকে রতিকান্ত, আর দীনু পাগলা। 

ওদের খাওয়ার পর দীনু কোনো জমিদার বাড়ির ভোজের গল্প শুরু করে, সেখানে নাকি দুধে-হাত ধোবার ব্যবস্থা হয়েছিল সেবার। ঘি খাবে—দুধে আঁচাবে! এইসব গল্প চলতে থাকে।

…আর কোনো লোক থাকে না। আপিস-ঘরটাও বন্ধ করে ভজগোবিন্দ চলে গেছে।

সেই স্তব্ধতা নামা রাজ্যের আজ রূপবদল হয়েছে। 

মহিলা সমিতির শামিয়ানার নিচে হ্যাজাক জ্বেলে শতদল-পুলক-রতনরা রয়েছে। বিমলি ও ছিল—এবার উঠে গেছে। মাঝে মাঝে পুলক, শতদল ক্ষীণ-গলা তুলে আওয়াজ দেয়, মহিলা সমিতি জিন্দাবাদ। 

সুলতা-নেত্যকালী একটু আগে রাউন্ড দিয়ে গেছে। রতিকান্তর দোকান তখনও খোলা। কয়েকজন দূরের যাত্রী বাড়ি ফেরেনি। রয়ে গেছে ট্রেনের আশায়, তারাও এদিক-ওদিক গড়াচ্ছে। 

দীনু পাগলার একতারায় সুর ওঠে। 

আজ দর্শক শ্রোতা পেয়ে দীনু পাগল একটানা নেচে চলেছে, গান গেয়ে। ওদিকে বটতলায় বুধনের দল মদের বোতল খুলে আসর মাত করে রেখেছে। ওখানেই হাজিরার সংখ্যা বেশি। মতিয়া মদের জোগান দেবার জন্য দিনরাত খেটে চলেছে। জায়গাটায় উঠেছে তীব্র মদের গন্ধ। 

ঢোলক পিটে কারা বেদম উল্লাসে নাচছে। 

অনেক সমর্থক জুটেছে এখানে, মতিয়ার দরবারে। মতিয়াও চোখ ঘুরিয়ে গা-ঝাঁপিয়ে এগিয়ে আসে—মালিক! 

গুপিনাথ সব দেখে শুনে খুশি হয়ে বলে, 

—চালিয়ে যা। কিছু টাকা রাখ। কাল সকালে আরও লোক পাবি। এদের খেতে দেবার ব্যবস্থা হবে রতির ওখানে। নিতে আজই রতিকে বলেছে, পঞ্চাশজন খাবে এখানে। 

নিতাই জানে নাড়ু নিয়ে নাড়াচাড়া করলে নাড়ু না মিলুক, নাড়ুর গুঁড়ো গুঁড়ো পড়ে। সেটা তার হাতেই আসবে। 

নিতাই বলে ওঠে। ওসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে মালিক। তবে খরচা— 

একশো টাকার নোট ফস্ করে বের করে বলে গুপি–নিয়ে রাখ। পরে হিসেব দিবি। 

.

….রতিকান্তেরও লাভ হয়েছে দারুণ। 

অন্য সময় এতকাল ধরে ইস্টিশানে চা-খাবারের দোকান নিয়ে রতিকান্ত কোনো রকমে চালাত, লাভ তেমন হতো না—খেয়ে-পরে চলে যেত। একদিনেই রতিকান্ত বুঝেছে মা লক্ষ্মী সদয় হলে লাভ কেমন হতে পারে। 

সকালের মুখেই তার দুটো ভাইপোকে এনে কড়াই-এ বসিয়েছে। খেতের আলু চটকেছে, তেওড়া কলাই-এর বেশনে চুবিয়ে ছেড়েছে এক পিস বেগুনি কুড়ি পয়সা। ভাঁড়ের চায়ের দাম হেঁকেছে চারআনা। তাছাড়া মহিলা সমিতির আসার পর সিঙাড়া-রসগোল্লাও বিক্রি হয়েছে অনেক। আর মতিয়ার ওখানে গেছে দু’ঝুড়ি পিঁয়াজি—এক গামলা আলুর দম—আরো অনেক কিছু। 

বেচে কুল পায়নি সে। 

রাতের বেলার তবু চায়ের হাঁড়ি সমানে চলছে। 

নিতাইকে দেখে চাইল রতি। রতিকান্ত চারজন লোক লাগিয়ে বাইরে জোল কেটে কড়াই কড়াই আলু সেদ্ধ করছে। ওদিকে সেদ্ধ হচ্ছে ঘুগনির জন্য বিরাট এক কড়াই-এ মটর দানা। 

নিতাই বলে—কাল দুপুরে পঞ্চাশ-ষাটজন খাবে বুধুয়ার ওখানে, ধর। 

নম্বরি নোটটা এগিয়ে দেয় নিতাই। 

রতিকান্ত বলে—মোটে পঞ্চাশজন? দিদিমণিদের এখানে ভাত-ডাল-কালিয়া-চাটনির মেনু, একশো বিশ জন খাচ্ছে। চারটাকা পেলেট। 

গুপি মিত্তির পিছনে ছিল। সেই ঘোষণা করে। 

—তাহলে বুধনের ওখানে খাবে একশো পঁচিশ জন। মাংস আর ভাত। নে ধর। পারবি তো। রতিকান্ত খুশি হয়ে আরও টাকা হাতিয়ে বলে, 

—বীরহাটা থেকে তিনজন কারিগর এনেছি, ওদিকে খাবার ডিপার্ট খুলেছি দ্যাখেন গে।

গুপি বলে—ঠিক যেন সব হয়। 

রতিকান্ত এবার পয়সার মুখ দেখেছে। ধোঁয়া লাগা অবহেলিত মা কালীর ছবি আর বিবর্ণ গণেশ ওই শেডের কুলুঙ্গিতে এতকাল পড়েছিল। আজ রতিকান্ত ভক্তিভরে প্রণাম জানায়। 

—বাবা গণেশ, দু’চারদিন রেল-বন্ধ রাখো বাবা। একটু গুছিয়ে নিই। হঠাৎ অন্ধকারে কার খ্যানখ্যানে গলার হাসি শুনে তাকাল। 

গর্জে ওঠে রতি—অ্যাই শালা, তুই! 

দীনু পাগলা হাসছে—কারো পোষমাস কারো সর্বনাশ। শ্লা যত শ্যাল শকুনি ভাগাড়ে এসে পড়েছে মাইরি। তা আমারও লাভ মন্দ হয়নি। অ্যাই দ্যাখ। 

দীনু এর মধ্যে তিনটাকা কত পয়সা রোজগার করেছে। 

আর বলে সে, খাবার ভাবনাও নাই। দিদিমণির দলে বসে খেলাম আবার বুধুয়ার ওখানেও কচুরি-ডাল-জিলাপি খেয়ে এলাম। বুঝলি রতে। 

রতি ধমকে ওঠে—থাম দিকি। 

ভজগোবিন্দ সেই কোটর থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে একবার বের হয়েছিল প্রাকৃতিক কাজগুলো সারতে। বাসার কাছে গিয়ে দেখে দরজায় ইয়া তালা ঝুলছে। ফিরে এসেছে। 

ক্ষুণ্ণমনে ফিরছে ভজগোবিন্দ। ওদিকে প্ল্যাটফর্মে তখন মহিলা সমিতির তরফ থেকে নেত্যকালী কি বক্তব্য রাখছে। এই ধর্মঘট সম্পূর্ণ বেআইনি। ভজগোবিন্দ ওদিকে প্ল্যাটফর্মের টেপাকলে হাত-মুখ ধুচ্ছে। হঠাৎ কাকে দেখে তাকাল। স্বয়ং নেত্যকালী আর বিমলি বাসার দিকে চলেছে। 

—শুনছ। 

জায়গাটা নিরিবিলি। গাছের ছায়ায় অন্ধকার। ভজগোবিন্দর ডাকে দাঁড়ানো নেত্যকালী। এই ভাষণ দেবার তেজটা তখনও রয়েছে। তাই বেশ চড়া গলায় বলে—শুনছি! 

ভজগোবিন্দকে অন্ধকারে দেখতে ঠিক পায়নি নেত্য। দেখলে বুঝতে পারত একদিনেই ভজগোবিন্দের নেওয়াপাতি ভুঁড়ি টসকে গেছে। চোখে-মুখে কালির দাগ। 

ভজগোবিন্দ বলে—এসব কি বাধালে বলো দিকি? এখন সদরে খবর গেছে কোম্পানির সাহেবরা তো যা তা বলবেন। চাকরিও যাবে—শুধু একবার ক্ষমা চাইলেই সব মিটে যেত—

নেত্যকালী সংযত স্বরে নেত্রীসুলভ গলায় গাম্ভীর্য এনে শুধোয়—আর কিছু বলবে?

ভজগোবিন্দের টাকে যেন ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে কেউ। তবু কাতরকণ্ঠে বলে ভজগোবিন্দ—এসব করছ—এইবার মালি মামলা হবে। পুলিশ আসবে। গুপি মিত্তির তো আজ ওয়ার্নিং দিয়ে গেল, তোমার জন্যই এতবড় বিপদে পড়েছি। 

নেত্যকালী বলে ওঠে—বাবাকে ওসব খবর দিয়ে এসেছি, টাইট হয়ে বসে থাকো।

—চাকরি যাবে যে, ভজগোবিন্দ ককিয়ে ওঠে। 

—যাক! ও চাকরির কাঁথায় আগুন দিই! বাড়ি যাবে তো? 

ভজগোবিন্দ কাতরস্বরে জানায়—রেলের অপিস—তাদের সম্পত্তির-চার্জে আমি, সব ফেলে যাব কী করে। 

ফুঁসে ওঠে নেত্যকালী—তবে মরা আগলে বসে থাকো। বি-মলি – 

বিমলি জানে এগোতে হবে এবার। নেত্যকালীও গটগট করে চলে গেল বিমলির সঙ্গে ভজগোবিন্দকে অকুল পাথারে ফেলে রেখে। 

ওর যেন ঠাঁই কোথাও নেই। 

সংসারে বিরক্তি এসে গেছে। ভজগোবিন্দ রাগে গরগর করে সেই ইস্টিশানের কোটরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। খাবেই না, খিদে-তেষ্টাও যেন ভুলে গেছে সে। বাঁচতে আর বাসনা নেই। বাঁচার সব আনন্দ তার ফুরিয়ে গেছে। 

কতক্ষণ বসেছিল ঘরের মধ্যে জানো না ভজগোবিন্দ। হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে। হয়তো তাকে নেত্যকালীই ডাকতে এসেছে। খিদেটা চাড়া দিয়ে ওঠে। নেত্যকালী তাহলে ভুল বুঝতে পেরেছে এবার। 

ভজগোবিন্দ অনেক আশা নিয়ে দরজাটা খুলে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ব্যান্ডেজ বাঁধা বিমলি। হাতে একটা থালায় খানকয়েক রুটি, বাটিতে ডাল-তরকারি একটু দুধ আর বাতাসা। 

খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে বিমলি থালাটা টেবিলে ঠক্ করে নামিয়ে দিয়ে দাঁড়াল। শুকনো কণ্ঠে বলে, 

—খেয়ে নিতে বলেছে দিদি। 

নেত্যকালী তাকে বাসায় যেতেও বলেনি, রাগ-অভিমান ঠেলে ওঠে ভজগোবিন্দের মনে। তবু শুধোয় সে, 

—তোর দিদি কিছু খেয়েছে রে? 

বিমলি গোঁজ-এর মতো দাঁড়িয়ে বোদামুখে জানায় — 

তোমার সঙ্গে কথা বলতে মানা আছে, খেয়ে নাও—থালাবাটি নে যাব। 

ভজগোবিন্দর রাগটা এবার ফেটে পড়ে। 

থালাটা তুলে নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে গর্জায় ভজগোবিন্দ— 

খাব না! আমিও ধর্মঘট করলাম, নেহি খায়েগা। নিয়ে যা তোর থালা-বাটি-খাবার সব।

অবশ্য রুটি তরকারি দই নিক্ষেপণের ফলে তখন ধুলায় গড়াচ্ছে, দুধ তরকারি ডাল পড়েছে ঘরের মেঝেতে। বিমলিও কোনো জবাব না দিয়ে মুখ বুজে থালা বাটিগুলো তুলে নিয়ে গটগট করে বের হয়ে গেল। 

রতিকান্ত আসছিল এদিকে। সে দেখেছে ব্যাপারটা। 

রতিকান্ত মাস্টারবাবুকে দেখেছে ক’বছর ধরে। শান্ত-ভালো মানুষটা আজ নানা চাপে জ্বলে-পুড়ে উঠেছে। চুপ করে সরে এল সে। 

ভজগোবিন্দ দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে এবার কুঁজো থেকে গ্লাস নিয়ে জল গড়িয়ে খেতে যাবে—আবিষ্কার করে কুঁজোয় জলও নেই। জল পুরে দেবার মতো কোনো লোকও আজ স্টেশনে নেই। তারা সর্ব ধর্মঘট করেছে। রাতের অন্ধকারে বটতলায় ঢোলক বাজে বেদম। 

বুধুয়া বলে—আজ আচ্ছাসে নাচ, কাল শ্লা খ্যামটা-নাচ হবে। 

গদাই বলে ওঠে—শাবাশ মন ভাইরে! 

কদিন কাজ-কাম নেই। খাবার-মদ্ সব জুটছে বসে বসেই। আর দিনরাত মতিয়া মুচিপাড়ার স্বৈরিণী বসন-পুঁটির মতো মেয়েদের মনে হয় ওরা যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে গেছে। 

.

রতনের সময় নেই। 

ওর সঙ্গে যোগ দিয়েছে পুলক, শতদলের ক্লাব। আজ লাউগঞ্জের সাধারণ মানুষও বুঝেছে গাড়ি বন্ধ করে ওই কটা মানুষ তাদের সকলকেই বিপদে ফেলেছে। বাজারে চাল-ডাল-তেল অমিল। বাইরের মানুষও আসতে পারছে না—এদেরও বেরোবার সোজা পথ নেই। 

তাই তারা এবার মহিলা সমিতিকেই সমর্থন করছে। রতন বকুল মালতী-সুলতারাও আজ গ্রাম প্রদক্ষিণ করে শোভাযাত্রা করে গ্রামের নারীমহলে উদ্দীপনা এনেছে। 

সকালে মিষ্টি আলো আজ লাউগঞ্জের শান্ত-জীবনে কি আলোড়ন এনেছে, খবরটা দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। 

সুলতাদি গার্লস স্কুলের ছুটি দিয়ে স্কুলের মেয়েদেরও শোভাযাত্রায় নিয়ে চলেছে। সকাল হয়েছে লাউগঞ্জে আর লাউগঞ্জ যেন ঘুম থেকে মুখর হয়েই জেগেছে। 

—মহিলা সমিতি জিন্দাবাদ! 

—জুলুম করে ট্রেন বন্ধ করা চলবে না। 

ওদের নিনাদে মুখর হয়ে উঠেছে পল্লির পথ। পাড়ার বউ-ঝিরা শঙ্খ বাজাচ্ছে, যেন এ এক নতুন উৎসবই শুরু হয়েছে। শোভাযাত্রার পুরোভাগে চলেছে নেত্যকালী-সুলতাদি মানসী আরও অনেকে। বকুল আরও মেয়েরা ফেস্টুন ধরে চলেছে। 

রাত জেগে রতন দলবল নিয়ে এবার ফেস্টুনও লিখে ফেলেছে অনেক। 

.

গুপিনাথও বসে নেই। অবশ্য সে বাড়ি থেকেই ওই শোভাযাত্রা দেখেছে, আর তার উত্তাপ টের পেয়েছে আগেই। সকালের চাও আসেনি। একবার বাড়ির ভেতর যেতে দেখে কুসুম শাড়ি পরে বের হবার জন্য তৈরি। তবু গুপি শুধোয়, 

—চা হবে না? 

কুসুম বলে ওঠে—কমলের মা দেবে! আর কমলের মা দুপুরে খাবে না। 

গুপি বলে—যাচ্ছ কোথায়? মচ্ছব খেতে চলেছ নাকি? 

কুসুম বলে ওঠে—তোমার ওই নচ্ছার মাগিটার সঙ্গে এত ভাব-কিসের বাপু? দিনরাত ওই মতিয়ার ওখানে তুমি কী করতে যাও? মচ্ছব খেতে না মদ গিলতে? অ্যাঁ! ওগুলোকে দিয়ে ধর্মঘট করাচ্ছ—মুঠো-মুঠো টাকা দিচ্ছ। 

চমকে ওঠে গুপিনাথ। মেয়েরা যে এত বুদ্ধি ধরে তা জানত না। আর জিভের ধারও ওদের খুরের থেকেও বেশি। তবে ঘটে যে এতটুকু বুদ্ধি নাই সেটা বুঝেছে গুপিনাথ। না হলে জেনেশুনে কেউ এসব কথা নিজের স্বামীর সম্বন্ধে বলে। 

গুপিনাথ শোনায়—দেওয়ালেরও কান আছে কুসুম। ছিঃ ছিঃ স্বামী-গুরুজন। বলে না পতি পরম গুরু। তার নামে এইসব মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ? দিও না, দিতে নাই! পাপ হয়। 

কুসুমকে প্রথম বিয়ে করে এনে এসব নীতিবাক্য শোনাত গুপি, আর কুসুমও চুপ করে শুনত। এখন কুসুমের দিব্যজ্ঞান লাভ হয়েছে, পিছনে আছে মহিলা সমিতি আর নেত্যকালী। তাই কুসুম ঝাঁঝালো স্বরে বলে, 

—বাপু আর জ্ঞান দিয়ো না। তোমাকে খুব চিনেছি, আমরা মা-ছেলেতে যা ভালো বুঝেছি, করছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হাটে-হাঁড়ি ভেঙে দেব। 

কুসুম বের হয়ে গেল সাবধানবাণী শুনিয়ে। 

গুপিনাথও গুম হয়ে থাকে। এ যেন তার কাছে ইজ্জতের লড়াই। আর লাভ যা করেছে তাও আশাতীত। আজ গুদামের বাকি মাল পাবার জন্য অনেকেই ঘুরছে। সেগুলো শেষ করে তবে থামবে গুপিনাথ 

বাইরে তখন শোভাযাত্রা চলেছে। 

নিতাইও দেখছে ও শোভাযাত্রা। 

নিতাই বলে—সারা-গাঁয়ের মেয়েদের জড়ো করেছে গো। বুধনের দলের জোর এখন কমে যাচ্ছে। 

গুপি মিত্তির বলে ওঠে—তুইও জনতাকে জাগিয়ে তোল নিতে। তামাম মুচিপাড়া, বাউরি পাড়া—বাগদি পাড়ার মেয়ে মদ্দকে এনে হাজির করে দে। বেশ গালভরা স্লোগান জোগাড় কর নিধু মাস্টারের কাছ থেকে। আর নিধেকে দশটা টাকা দিয়ে বলগে আজ কবিগান গাইতে হবে ওই বটতলায়। 

নিতাই নিধিরামকে চেনে। স্কুলের দপ্তরি, বেশ সুরেলা গলায় নিজেই বাঁধনদারি করে কবিগান গায়। 

নিতাই বলে—নিধি তো রতনবাবুর চ্যালা গো? তাছাড়া চালু ছোকরা। উ শালা কি করবে কে জানে? 

গুপি ভাবনায় পড়ে—তালে দেপুরের বিষ্টুকেই দেখবি। জাঁকিয়ে যেন মেলার মতো গান হয়, বুঝলি। যা, পরে যাব আমি। 

নিতাইও চলে গেল। তার চর-অনুচর গোবরা আর গণেশকে নিয়ে। সাইকেল রিকশা ছাড়া এখন নিতাই চলাফেরা করে না। উটকো বেশ কিছু পয়সা পাচ্ছে সে। নিতাই জুত করে ঠ্যাং তুলে রিকশায় বসে ইস্টিশানের দিকে চলেছে। ওখানে গিয়ে দেখেশুনে কর্মপদ্ধতি স্থির হবে। 

.

স্টেশনের মুখে গিয়ে রিকশাটা থামল। অবাক হয় নিতাই। 

সামনের মাঠটার রূপ বদলে গেছে। কয়েক ক্রোশ দূরে কেশেরপাড়ে এসময় মেলা চলছিল। সেই মেলার বেশ কিছু দোকানদার খবর পেয়ে রাতারাতি গোরুর গাড়িতে অস্থায়ী দোকানপত্ৰ তুলে এনে এখানের ফাঁকা মাঠের দখল নিয়েছে আর দোকানপত্র সাজিয়ে বসে পড়েছে। 

ওপাশে এর মধ্যে নাগরদোলা ফিট করে ব্যবসা শুরু করেছে কারা। 

স্কুলের ছুটি, ছেলেপুলেরা এসে ভিড় করছে, নাগরদোলা ঘুরছে, বেলুন-ফুলঝুরিওয়ালাও হাজির। ওদিকে বাঁশ পুঁতে টিনের বেড়া দিয়ে মেলা ফেরত মিষ্টির দোকানদার তার রেডিমেড লাড্ডু-জিলাপি দরবেশ-এর থালা সাজাচ্ছে। মনোহারি দোকানদার ক’জন দোকান সাজাতে ব্যস্ত। নিজেরাই সারবন্দি দোকান দিয়েছে পথ ছেড়ে—দুপাশে দোকান! 

গোবরা বলে—অ নিতাই দা। ই যে মেলা বসে গেল গো। 

নিতাই খুশি হয়েছে। বলে সে— 

বসুক! রেল বাবার মেলা। তবেই তো গান জমবে! 

বুধুয়া মাথায় পগ্‌গ বেঁধে গদাইকে নিয়ে তদারক করছে। তাদের ডেরা অবধি মেলার সীমানা চলে গেছে। বটতলায় আজ তাদের গান জমবে দারুণ। 

ওদিকে মহিলা সমিতির বিরাট শোভাযাত্রা আসছে। ধুলো উড়ছে। কলরব ওঠে। 

গুপি মিত্তির বসে নেই। নিজেই এবার থানায় গিয়ে হাজির হয়েছে। তার দু’ ওয়াগন চাল পড়ে আছে সাইডিং-এ। অবশ্য চাল এক বস্তাও নেই। শুধু তালাবন্ধ করে রেখেছে গুপি মিত্তির ওয়াগনটায়। 

এই ফাঁকে সেও বুদ্ধিটা বের করেছে! 

অশ্বিনী দারোগা ওকে দেখে এগিয়ে আসে—আসুন মশাই! 

গুপি মিত্তির থানার থমথমে ভাব দেখে বলে, 

—গাঁয়ে এতবড় কাণ্ড চলেছে আপনারা চুপ করে থাকবেন স্যার। ইস্টিশানে এবার ফৌজদারি—রক্তপাত না হয়। 

অশ্বিনী দারোগা বিশাল বপুটা নাড়াচাড়া করে বলে, 

—কী আর করব বলুন? ওয়াচ করছি। ইস্টিশান মাস্টার তো কোনো রিপোর্ট করেনি থানায়— 

গুপি বলে—তাই বলে আমার দু’ ওয়াগান মাল লুটপাট হয়ে যাবে? দশ হাজার টাকার দায়িত্ব কে নেবে বলুন? তাই বলছিলাম প্ল্যাটফর্মে ভিড়— 

জনতা হঠান! শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা আছে—লুটপাটের ভয়ও রয়েছে! আর ইস্টিশান মাস্টার তো ঘরে বন্দি। সে কী করবে? 

অশ্বিনী দারোগা গুপি মিত্তিরের কথায় কি ভাবছেন। 

গুপি মিত্তির হুঁশিয়ার লোক। এবার মুখই নয় হাত খুলেছে সে। বেশ কিছু বস্তু করতলগত হতে অশ্বিনী দারোগা এবার হুঙ্কার ছাড়ে দরজায়, 

—হাবিলদারকো বোলাও। আপনি যান গুপিবাবু। রিপোর্ট করেছেন। এবার কাজ হবেই। আমিও কাজ বুঝি। 

মহিলা সমিতির দলবল প্ল্যাটফর্ম জুড়ে বসেছে। গান চলেছে। দেশাত্মবোধক গান। লাউগঞ্জের মানুষ—অত্যাচারিতা নারীদের মনে জোর আনার গান। ওদিকে বুধনের ওখানেও বটতলা ছেয়ে বসে গেছে খিচুড়ির-লোভে মদের নেশায় বাউরি পাড়ার দলবল। মাঠের কাজ বন্ধ—অনেকেই এসে বসে পড়ে চিৎকার করছে। 

এমন সময় পুলিশ বাহিনীকে আসতে দেখে সাড়া পড়ে যায়। এসব লাউগঞ্জের ইতিহাসে ঘটেনি। 

পুলিশ থানা আছে—তাদের দেখেছে খেতে আর ঘুমোতে। মাঝে মাঝে ধড়াচূড়া পরে পথে ঘোরে মাত্র। আর ছিঁচকে চোর-টোর ধরার নাম করে দু’একজনকে ধরে নিয়ে যায়, আবার ঘা-কতক দিয়ে ছেড়ে দেয়। সেও কালে কবিষ্যে। 

এমন সাজগোজ করে বন্দুক-লাঠি নিয়ে বাঁশি বাজিয়ে ওই দারোগা ছোট দারোগা আর থানার সাতজন সিঁটকে লম্বা পুলিশকে বের হতে দেখেনি। 

—পুঁ! বাঁশি বাজছে। 

অশ্বিনী দারোগা ভরাটি গলায় হুঙ্কার ছাড়ে—অ্যাটেনশন! 

ধপধপ্ শব্দে জুতো ঠুকে পুলিশবাহিনী দাঁড়িয়ে পড়েছে ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে। 

জানলার ফোকর দিয়ে ওই পুলিশ বাহিনীকে দেখে এবার ভজগোবিন্দও বের হয়ে আসে।

কদিন দাড়ি না কামাবার ফলে মুখে-গালে ইয়া দাড়ি, চোখ-দুটো কোটরাগত, শুধু রোদে ঝকঝক করে ওর ঘামঝরা টাকটাই, যেন মুক্তোর দানা বসানো-টাক। 

অশ্বিনী দারোগা গাঁক গাঁক করে ওঠে। 

—স্টেশনে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা আছে কেন রিপোর্ট করেননি? 

ভজগোবিন্দ মিনমিন করে— শান্তি তো আগেই ভঙ্গ হয়ে গেছে। শুনছেন না—এদিকে এনারা, এদিকে ত্যানারা! শান্তি আর আছে নাকি! 

অশ্বিনী দারোগা এ জবাবে খুশি নয়। 

গুপিনাথ, বদনবাবু নবীন রায় গ্রামের প্রবীণ মাতব্বরাও এসেছে। তাদের সামনে অশ্বিনী দারোগা হুঙ্কার ছাড়ে ভজগোবিন্দের দিকে তাকিয়ে। 

—কে দায়িত্ব নেবে এসবের? 

ভজগোবিন্দ এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে বলে, 

—আপনারা এসেছেন, এবার সব বুঝে নিন! আমি যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব! 

অশ্বিনী দারোগা এসব ঝামেলায় যেতে চায় না। 

বলে সে—আপনি ঘরে থাকুন গে! অপিস ঘরে। আমি পাহারার ব্যবস্থা করছি। আর সেই লাউগাছটা কোথায়? সেই লাউ— 

নিতাই-ই সন্ধান নিতে অশ্বিনী দারোগা হুকুম দেয়, 

—রাম সিং, তুমি আর মিয়ালাল দু’জনে ওই লাউকে পাহারা দেবে। এগজিবিট নাম্বার ওয়ান! টেক কেয়ার! গো—মার্চ! 

ওরা দু’জনে লাঠি হাতে চলে গেল সেই প্রখ্যাত লাউগাছের দিকে, লাউটা তখনও গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। ওরা দু’জনে জুতোর মশমশ শব্দ তুলে লাউ পাহারা দিতে থাকে ক্রশ মার্চ করে।

এবার অশ্বিনী দারোগা বেল্টটাকে টাইট করে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে-বসা মহিলা সমিতির উদ্দেশে হুঙ্কার ছাড়ে। 

—দশ মিনিটের মধ্যে আপনারা এখান থেকে সরে যান। রেলের জায়গায় থাকবেন না। না হলে আমরা ভিড় সরিয়ে দিতে বাধ্য হবো। শান্তিপূর্ণভাবে সরে যান, এখানে ভিড় করবেন না। 

রতন, নেত্যকালী, সুলতা, কুসুমরা দেখছে দারোগাকে। গুপী মিত্তিরই চালটা দিয়েছে।

বুধনরা প্ল্যাটফর্মের নিচে আছে। এরা রয়েছে উপরে। এদের হঠাতে পারলে এখানে আর ঠাঁই পাবে না মহিলা সমিতি। 

অশ্বিনী গর্জন করে—চলে যান! নাহলে লাঠি চলবে। গুলি চালাব। চালাতে বাধ্য হবো।

গুপিনাথও খুশি হয়েছে। মহিলা সমিতিও এবার মরিয়া হয়ে ওঠে। জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছে তারা। 

নেত্যকালী গর্জে ওঠে—চালাও লাঠি। মেয়েদের ওপর লাঠি চালিয়ে ওই মাতালদের ধর্মঘট টিকিয়ে রাখবে—ক্যামন দারোগা দেখি! 

অশ্বিনী দারোগার কাছে এই চ্যালেঞ্জ এসেছে। অশ্বিনীও গর্জে ওঠে। 

—নিশ্চয়ই চালাব! 

ভজগোবিন্দ স্ত্রীকে-থামাবার চেষ্টা করে—ওগো! 

—ওগো ফোগো বলবে না। আমি মহিলা সমিতির সভানেত্রী! জোর করে রেল কোম্পানি লাঠি চালাবে। তুমি তাদের দালাল! 

নেত্যকালীন গর্জনে ভজগোবিন্দ তেউড়ে যায়! 

অশ্বিনী দারোগা এবার হুঙ্কার ছাড়ে—লাঠি চালাব— 

এগিয়ে আসে কোমরে কাপড় জড়িয়ে মালতী, এবার বলে ওঠে সে, লাঠি চালাবে বৈকি! তোমার মুরোদ জানা আছে! বলি যাবে? 

চমকে ওঠে অশ্বিনী দারোগা স্বয়ং গৃহিণীকে এখানে দেখে। এবার মালতীই আসর নিয়েছে। বলে ওঠে সে, 

—চালাও লাঠি! ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব না! কই—হাঁ-করে দাঁড়িয়ে আছ যে! ঘরে ভাত বন্ধ করে দেব, ঢুকতে দেব না, থানাতেই থাকবে। 

অশ্বিনী দারোগার বেল্টটা ভুঁড়ি গলিয়ে যেন পড়ে যাবে এবার। পিছু হটছে সে। মালতীও সমানে চোপা চালিয়ে যাচ্ছে—কই! চালাও লাঠি দেখি, অশ্বিনী দারোগার অনেক কাহিনিই ফাঁস করবে এবার। অশ্বিনী বলে—এই! থামো—ওগো! যাচ্ছি! 

মালতী বলে—তাই যাও। চুপ করে সরে যাও। আমরা মিটিং করছি করব। কই গাড়ি চালাতে বলো গে ওদের। দেখি ক্যামন মরদ। এখানে এয়েছেন লাঠি চালাতে! গুলি করতে! মরদ! 

অশ্বিনী দারোগা এসে ধপাস করে রতির দোকানের বেঞ্চে বসে হাঁক পাড়ে—জল দে।

মহিলা সমিতির চিৎকার তখন বুধুয়ার দলকে ছাপিয়ে শোনা যায়। গুপি বলে—ঘরের লোককে শায়েস্তা করতে শেখেননি, থানার লোককে সযুত করবেন কী করে? রিপোর্ট করব। 

অশ্বিনী দারোগা কিছু বলার আগে ভজগোবিন্দ বলে। 

—ওদের শায়েস্তা করা যায় না! 

ভজগোবিন্দ দারোগাবাবুকে দেখে ভরসা পেয়ে কোটর থেকে বের হয়েছিল ভেবেছিল একটা ব্যবস্থা এবার হবে। দারোগাবাবু সেদিকে না গিয়ে গেছেন ওই মহিলা সমিতির দিকে, তারপরই প্যাভেলিয়ানে ফিরে এসেছেন, একেবারে বোল্ড আউট হয়ে। 

ভজগোবিন্দ তবু বলে—ওই মতিয়া বুধুয়াদের একটু বলুন দারোগা সাহেব, ধমক-ধামক দিয়ে কাজে নামান—

অশ্বিনী দারোগা গুপি মিত্তিরের দিকে চাইল। 

গুপি মিত্তির বলে—ওরা তো প্ল্যাটফর্মে নেই—একশো চুয়াল্লিশ ধারার বাইরে আছে ওরা।

অশ্বিনী দারোগা ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে চুপ করে থাকে। 

গুপি হাঁক পাড়ে—নিতাই। দারোগাবাবুকে ডাব দে। আর রতি এই ইস্পিশাল রাজভোগ দে!

ভজগোবিন্দ চুপচাপ সরে গেল আবার কোটরের দিকে। বেশ বুঝেছে কোনো সুরাহাই হবে না। সমানে তখনও চিৎকার করে চলেছে দুই পক্ষই। আর বাইরে মেলাও জমে উঠেছে। 

.

দীনু পাগলা এই অবসরে কোত্থেকে একটা পাথরের চাঁইকে তেল সিঁদুর মাখিয়ে এনে চত্বরের চারা বট অশ্বত্থ গাছের নিচে বসিয়ে কিছু আকন্দ-কলকে-ধুতরো ফুল ছিটিয়ে চিৎকার করছে, 

—জয় বাবা রেল ভৈরব কি জয়! 

দীনুকে চেনা যায় না। গেরুয়া-আলখাল্লা লাল ধুলোয় সিঁদুরে হয়ে উঠেছে। পাথরের চাঙড়টাকে তেল সিঁদুর মাখিয়ে বাকি তেল সিঁদুর খানিকটা নিজের কপালে লেপে ওই চারা বটগাছের বাঁধানো-চাতালে একটা ত্রিশূল গেঁথে বসে রাতারাতি শিবের মহাভক্ত সেজে গেছে। 

হুঙ্কার ছাড়ছে—বড় জাগ্রত দেবতা–বাবা রেল ভৈরব! সব মনস্কামনা পুরা করবে বাবা।

…এর মধ্যে বেশ কিছু লোকও জুটে গেছে। বাঁধানো চাতালে বাবার প্রণামিও পড়েছে দশ নয়া-পাঁচ নয়া—সিকি আধুলিও দু’একটা ছিটকে আসে। আর দীনু পাগল তত জোরে হাঁকাড় মারছে। 

—বাবা রেল ভৈরবের মেলায়—মানসিক করেগা মনস্কামনা পূর্ণ হবে! 

ভক্তেরও অভাব নেই। মানসিক করার মতো অনেকেই জুটে যায়! 

.

গোরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে নন্দরানির ঝুমুরের দল ফিরছে মেলার গান শেষ করে শহরের দিকে। রাঢ়-বাংলার দূর দূরান্তরে ধান ওঠার সময় থেকেই মেলা বসে বিভিন্ন জায়গায়। মাঠে-ঘাটে কোনো পরিত্যক্ত শিবমন্দির না হয় বুড়োরাজকে কেন্দ্র করে ক’দিন মেলা হয়। দোকানপত্র সার্কাস ম্যাজিকওয়ালারা আসে, তাঁবু খাটিয়ে খেলা দেখায়। কবিগান–ঝুমুর না হয় যাত্রা— গানও বসে। সেই এলাকার চারিপাশের মানুষজন এসে ভিড় করে। কেনা-বেচা হয়। 

আবার সেই ক’দিনের মেলা ফুরিয়ে যায়, মাঠে নামে আবার স্তব্ধতা। দোকান পসার গুটিয়ে দোকানিরা চলে যায় অন্য মেলার খোঁজে। এইভাবে চলে তাদের পরিক্রমা। 

নন্দরানির দলও এ দিগরের নামকরা ঝুমুর দল। 

তার দলের সেরা নাচিয়ে ফুল্লরা দাসীর যৌবন এখন বর্ষার মাতাল ময়ূরাক্ষী নদীর মতো টলমলো, চোখের চোখা বাণে নাকি এই এলাকার অনেক জোতদার খাপ্‌ছি খায়, হেঁচকি তোলে, আর ধান-বেচা টাকায় ফুল্লরাকে ক’দিনের জন্য শাড়ি—কেউ গয়না দিয়েও খুশি করে। 

কিন্তু ফুল্লরা মৌমাছির জাত, সে গুনগুনানি জানে। তারপর এ মেলার দিন শেষ হলে হড়কে গিয়ে অন্য মেলায় জোটে, নতুন ফুলও জুটে যায় সেখানে। 

নন্দরানি বলে— 

অ ফুল্লরা, য্যাদ্দিন যৌবন ত্যাতদিন এই বাহার লা, এর মধ্যি আখের গুছিয়ে নে। ভাঁটা পড়লে আর চকমকানি থাকবেনি, কাদা পাঁকই বের হবে লা। তবে নেত্য—গীতের বিদ্যেটা রপ্ত রাখবি! 

ওই ফুল্লরা তার দলের মূলধন! নটেশ্বর বাঁধনদারও তার জন্যে দল ছেড়ে যেতে পারে নি। নটেশ্বর শুধু বাঁধনদারই নয়, দলের ম্যানেজার কাম-রক্ষক। দল-পরিচালক। 

কেশের পাড় মেলার গান শেষ করে ওরা পাঁচক্রোশ পথ গোরুর গাড়িতে এসে লাউগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে মাঝপথে কাশীপুর ইস্টিশানে নেমে দইদের মেলায় যাবে! 

বেলার দিকে লাউগঞ্জে খান তিনেক গোরুর গাড়ি ধূলিধূসর পথ পার হয়ে সওয়ারি নিয়ে এসে হাজির হয় ইস্টিশানের সামনে 

নটেশ্বর লাউগঞ্জ ইস্টিশানের সামনে চত্বরে দোকানপসার—নাগরদোলা—কলের গানের শব্দ আর বাতাসে পাঁপড়—আলুর চপ ভাজার মিষ্টি-গন্ধে মেলার চেনা পরিবেশ খুঁজে পায়! 

ও গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে বলে। 

—এ কোথায় এলাম গ মাসি? অ্যাঁ—লাউগঞ্জেও নতুন মেলা বসেছে নাকি গো! তা শহর শহর গাঁ-মেলা জমলে দারুণ জমবে গো! 

নন্দরানির ভারী দেহটাকে দলের পুটু আর ফ্যান্ডি দুজনে ধরে গোরুর গাড়ি থেকে মাটিতে নামিয়ে দেয়। নন্দরানি দেখে-শুনে বলে—তাই তো র‍্যা নটো! অ ছেলে কিসের মেলা গো! 

একটা ছেলে হেঁকে ওঠে, 

—বাবা রেল ভৈরবের মেলা! রেল-বন্ধ কিনা—তাই রেলের পুজো হচ্ছে গো। ধুন্দুমার কাণ্ড চলছে। তা কিসের দল গা। 

গোরুর গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে অন্য মেয়েরা। এতটা পথ আসতে গোরুর গাড়ির আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে গা-গতর টাটিয়ে গেছে তাদের। ফুল্লরা-পুটু-খ্যান্ত ওরা নেমে গা-গতর ছাড়াচ্ছে।

চারিদিকে জমেছে কৌতূহলী জনতা। মেলা খেলার মুলুকে ওদের নাম পরিচয় আছে। ওদের নাচগানের মুগ্ধ দর্শকের অভাব নেই পল্লি অঞ্চলে। তাই খবরটা ছড়িয়ে পড়ে, ওদেরও বক্সআপিস কিছু আছে। তারকা না হোক জোনাকি পোকা ওরা ওদের মনোজগতে। তাই ভিড় জমেছে ওদের কেন্দ্র করে। 

নটেশ্বর ইস্টিশানের দিকে ছুটেছে খবর নিতে। 

কোমরে চাদর বাঁধা—বগলে বারোমেসে বিবর্ণ ছাতা, নটেশ্বর এদিক-ওদিক ঘুরে দু’পক্ষের ওই চিৎকার শুনেছে, দেখেছে গাড়ি জড়ভরত হয়ে পড়ে আছে ইস্টিশানে, ইঞ্জিনও ঠাণ্ডা। সাড়াশব্দ নেই। 

নটেশ্বর এসে খবর দেয়, 

—কেলেঙ্কারি হয়েছে মাসি। টেরেন বন্ধ। গাড়ি চলছে না। 

নন্দরানি বিপদে পড়ে—তাই নাকি রে! তালে কী হবে ওরে নটো! ওদিকে মেলায় যেতে পারবোনি, ইদিকে দলের থাকার ব্যবস্থা, খোরাকি এসব জুটবে কী করে? মেলাই খরচায় পড়ে গেলাম যে রে! 

খবরটা নিতাই পেয়ে যেতেই খুশি হয়। 

নন্দরানির দলের নাম ডাক আছে। ফুল্লরার মতো নাচিয়ে মেলা ভার। 

হঠাৎ যেন তাদের দল পাকা ফলের মতোই এসে পড়েছে ওদের হাতে। বুধুয়া, মতিয়া খুশি ভরে বলে, 

—লাগাও নিতাইদা, আজ ঝুমরি নাচ গান। 

গদাই পেঁয়াজ চিবুচ্ছিল। খবরটা শুনে ঠেলে উঠে পড়েছে। 

—জরুর হবে ওস্তাদ। ফুল্লরার নাচ—অফ্ বাবা! 

ওরা আজ ধর্মঘট করার নতুন জোর খুঁজে পায়। 

নন্দরানি হঠাৎ ভিড় ঠেলে সিটকে লম্বা লোকটাকে আসতে দেখে চাইল। সঙ্গে রয়েছে গদাই।

নটেশ্বরের নজর ওই গদাই-এর দিকে। নিজে রসিক ব্যক্তি নটেশ্বর। একাসনে বসে দুটি পাঁইট বোতল শেষ করে সে তার বাঁধনদারির মেজাজ পায়। কাল তেমন মাল জোটেনি। আজও ভাবনায় পড়েছিল এই লাউগঞ্জে এসে, কিন্তু এই দুটি মূর্তিকে দেখে নটেশ্বর চিনেছে। মালদার ব্যক্তি।

সুতরাং নটেশ্বর যে জলে পড়বে না, এটা আঁচ করেই নিয়েছে। নিতাই নন্দমাসিকে নিজের পরিচয় দেয়, 

—আমি নিতাই বাগ, ওই যে ধানকল দেখছেন ওর ম্যানেজারই বলতে পারেন। 

হেসে ওঠে ফুল্লরা খিলখিল করে—তাকাল নিতাই। নীল সায়রে যেন দমকা হাওয়া ঢেউ তুলেছে। 

ফুল্লরা বলে-বাঘ! তা কি বাঘ গো। আধ-বাঘা, নেকড়ে, ঝিঙেফুলি না ডোরাকাটা? চোখ দেখে মনে হচ্ছে ভাই তুমি খ্যাঁকশিয়াল। 

নিতাই ঢোক গেলে। ঠা-ঠা করে হাসছে বুধুয়াও। 

নন্দরানি ধমকে ওঠে—থাম তুই ফুল্লরা। 

ফুল্লরার চোখে রাতজাগা নেশার ছাপ। গাড়ির সিধানে বসে সে পা-দোলাতে থাকে। নন্দরানি বলে, 

—বাবা নিতাই। বলো কী বলছিলে? 

নিতাই বলে—আজ রাতে এখানে একখানা আসর হোক মাসি। বাসাও দিচ্ছি, খোরাকি চাল, তেল সব দেব। আর পেন্নামি একান্ন টাকা। বিবাক প্যালা পেন্নামি যা পড়বে দলের। 

নটেশ্বর শুনছে কথাটা। বুধুয়া-গদাই-এর মুখ-চোখে সে দিশি মালের সন্ধান পেয়েছে, তেষ্টাও পেয়েছে তার ওই দ্রব্যের। নন্দরানি বিচক্ষণা দলনেত্রী। বলে সে, 

—বড্ড কম বলছ বাবা। একশো টাকা রেট নি গো—এদিকে ট্রেন-বন্ধ। যাবার পথ নেই। বসে মার খাবে দল। বাসাও কোথাও পাবে না। শেষ পর্যন্ত বুধন মধ্যস্থতা করে, 

—পঁচাত্তর টাকা। ব্যস মাসি। 

নটেশ্বর কানে-কানে বলে নন্দরানিকে—বসতি হয়ে যাবে দল, তবু খোরাকি পাবে। বাসা পাবে! হয়তো কালও রেল-বন্ধ থাকলে একপালা হয়ে যাবে। গেয়ে দিই মাসি। 

নন্দরানি সাতপাঁচ ভেবে বলে—ঠিক আছে বাবা। তবে নিতাই, খোরাকিতে দুবেলা মাছ দিতে হবে। ফুলি আবার মাছের মাথা নালে ভাতের গেরাস মুখে তুলতে পারেনি গো! 

ফুল্লরাকে মাছ কেন মাংসই খাওয়াবে নিতাই। তাই বলে সে, 

—মাছ মাংসর জন্যে ভাববে না মাসি। মাংস এই দ্রব্য চাও তাও পাবে। দু’হাতের তালুর মাপ দেখিয়ে সেই অমূল্য দ্রব্যটির বোতলের উচ্চতাও দেখিয়ে দেয়। 

ফুল্লরা হেসে ওঠে—তা নিতাই না গৌর, তাহলে চলো ভাই, বাসাতেই চলো। তা ভালো বাসা মিলবে তো গা নতুন নাগর! 

বুধুয়া—গদাই ততক্ষণে হাঁকডাক করে দলের কিছু লোককে এনেছে। হুকুম করে বুধুয়া—ফট্‌কে, এদের মালপত্র নিয়ে চল কলবাড়িতে! 

আর মেলায়, গেরামে বলে দে। আজ নন্দরানির দলের ঝুমুর গান হবে—রাত-ভোর এই ইস্টিশানে! 

কলরব ওঠে—ইয়া- 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *