তিল থেকে তাল – ৫

নবকুমার নিজেই পাত্র। গঞ্জে তার বিড়ি-সিগারেট পানের দোকান। বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। ধার-দেনা করে নবকুমার চারটে ইস্টিশান আগে কালীপুরে কনে ঠিক করেছে। 

বিয়েতে চলেছে, 

ওর কাকাই বরকর্তা। নবকুমার বিয়ের সাজে চলেছে। 

গাড়ি আটটা—নটা—দশটা বেজে গেছে। গায়ে-হলুদ হবে কনের বাড়িতে। 

নব শুধোয়—হ্যাঁ কাকা টেরেন চলছে না, গায়ে হলুদ হবে কখন গো? 

কাকা কাশির বেগ চেপে শোনায়, 

—গায়ে-হলুদ চুলোয় যাক। বিয়ে হয় কিনা দ্যাখ। যাবি কী করে? আটকোশ পথ যেতেই তো লগ্ন উরে যাবেক রে! 

—অ্যাঁ! নবকুমার কঁকিয়ে ওঠে! 

সেও ওই বরের পোশাকেই নেমে পড়ে ড্রাইভারকে খুঁজছে! 

কলরব ওঠে ইস্টিশানে। ক্রমশ সংবাদটা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে লাউগঞ্জের বাজারে, গ্রামের পথেঘাটে! এ এক নতুন খবর। তাই অনেকেই এসে পড়েছে ব্যাপারটা দেখতে! 

নিতাইও ধানকলে খবরটা শুনে চমকে ওঠে। 

তবু যাচাই করে নেয় সে। দেখছে নবকুমার বর বেশে বাজারে এসেছে ডুলির খোঁজে। সেই বলে—শালার টেরেন বন্ধ গো—তাই ডুলি খুঁজছি। ডুলিতে চেপেই বিয়ে করতে যাব! 

.

এরপর নিতাইও ধেয়ে আসে গুপি মিত্তিরের বাড়িতে। গুপির ক’দিন মন-মেজাজ ভালো নেই। চারিদিকে কেবল লোকসানই চলছে। ধানকলের চাল চালানটা টিকে আছে মাত্র, গুদামে জমে আছে চাল-ডাল-আলু। পচবে এইবার। ওদিকে মামলাতেও হেরে গেছে—মানইজ্জত-এর ফানুষ যেন ফাটিয়ে দিয়েছে ওই নেত্যকালী। রতনও বাড়ি আসেনি। উল্টে বকুলেরও চাকরি হয়েছে। কানাঘুষোয় খবর পায় ওরা নাকি এবার বিয়ে করবে। 

গুম হয় বসে আছে গুপি মিত্তির। 

গিন্নির সঙ্গেও একচোট হয়ে গেছে। তহবিলের একশো টাকার হিসেব নেই।

ওটাকা গিন্নিই খয়রাতি করেছে। তাই নিয়েই বেধেছিল তার সঙ্গে। 

গুপির মনে হয় সংসার ছেড়ে কোথাও চলে যাবে! এমনি মনের অবস্থা। হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে নিতাইকে ঢুকতে দেখে মাছের চোখের মতো ফ্যাসা চাহনিতে তাকাল মাত্র গুপি।

নিতাই বলে—কর্তা! লেগেছে এবার জোর! তোমার ওই নেত্যকালী আর মতিয়া!

গুপিনাথ চুপ করে কি ভেবে বলে—ও মেয়ে পাঁচালী-ঝগড়ায় কী হবে বল? ও তো থেমে যাবে! 

গুপিনাথের কথায় নিতাই বলে—থামছেনি। জমে উঠেছে দারুণ। মতিয়াকে নাকি মেরেছে ওই ইস্টিশান গিন্নি, আর বুধুয়া-গদাই যতীনের দলও চ্যালেঞ্জ করেছে—হয় মাপ চাও না হয় রেল চলবে না। আটটার লোকাল যায়নি। ধর্মঘট করে বসে আছে ওরা। লাইনে ইঞ্জিন পড়ে আছে আর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের যাত্রীরাও আটকে রয়েছে। তুলকালাম কাণ্ড চলেছে! 

—অ্যাঁ! বলিস কী! 

গুপিনাথ এবার সিধে হয়ে বসেছে। তার শূন্য-দৃষ্টিতে এবার জেল্লা ফিরে আসে। এক নিমিষে সে ব্যবসায়ীর দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে লাভক্ষতির হিসাব কষে এবার পরবর্তী-কর্মপন্থা নির্ধারণ করার কথা ভাবছে। 

নিতাই কর্তাকে ভাবিত দেখে শুধোয়—কি হলো গো! 

গুপি মিত্তির বলে—ওরা ধর্মঘট করেছে তাহলে! সব ট্রেন বন্ধ! তা এনারা কী করছেন? ভজগোবিন্দের দল? 

নিতাই বলে—তা জানি না কর্তা। তবে এখন ভজা ব্যাটা গর্তে পড়েছে। 

একটু জুত করে ঠেসে ধরতে পারলে, মানে ওদের দিয়ে ধর্মঘট চালাতে পারলে ভজগোবিন্দের 

চাকরি নিয়ে টান ধরবে। 

গুপিও ভেবেছে কথাটা। বলে সে, 

—নিদেন বদলি হবে নির্ঘাত। কী বলিস? 

নিতাই সায় দেয়—হবেই! কেউ বাঁচাতে পারবে না! 

গুপি আবার কি ভাবছে। ওর-ভাবনার ধার কাছে ঘেঁসতে পারে না নিতাই। 

কি ভেবে গুপি ধ্যানাসন ছেড়ে উঠে বলে! 

—ছাতাটা দে! 

অর্থাৎ বের হবেন কর্তা। এবার বোধহয় সত্যিকার খেলাই শুরু হবে গুপি মিত্তিরের। ছাতাটা নিয়ে গুপি বলে—চল। একটু ঘুরে আসি। 

.

নেত্যকালী বিমলিকে নিয়ে সটান মাধব ডাক্তারের এখানেই এসেছে। গঞ্জের নামকরা ডাক্তার মাধববাবু। নেত্যকালীকে চেনেন মাধববাবু। ওদের মহিলা সমিতির সেবাশ্রম প্রসূতিসদন খোলার ব্যাপারেও মাধববাবু জড়িত। নানাভাবে সাহায্য করেন ওদের। 

বিমলিকে দেখে মাধববাবু অবাক হন। 

—কী ব্যাপার! কামড়ে দিয়েছে হাতে, কপালেও চোট! 

নেত্যকালী এর মধ্যে সুলতাকে খবর দিয়েছে। সেও এসে পড়ে। মাধববাবু বিমলিকে ইনজেকসন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে কপালে স্টিচ করে বলেন। 

—ওষুধপত্র দিচ্ছি। ব্যবহার করুন! দাঁতের বিষ কিনা, জ্বরও হতে পারে। খবর পেয়ে রতনও এসে পড়ে। সবই শুনেছে সে। 

আরও শুনেছে ওই বুধুয়ার দল ইচ্ছে করেই ট্রেন-বন্ধ করে সারা লাউগঞ্জের লোককে বিপদে ফেলেছে। রতন বলে—এ অন্যায় আমরা সহ্য করব না। 

নেত্যকালীর ব্যাপারটা অন্য রকম! সে বলে। 

—ওসব পরে হবে রতন। তার জন্য সুলতা মহিলা সমিতির জরুরি মিটিং ডেকে যা করার করবে। তোমাকে বাবা এখুনি সাইকেল রিকশা জোগাড় করতে হবে দুটো। বীরহাটা অবধি যাবে—ওখানে থাকবে আবার বৈকালে ফিরবে আমাদের নিয়ে। 

রতন ঠিক বুঝতে পারে না ব্যাপারটা। তাই শুধোয় সে— 

এখন বীরহাটা যাবেন কেন? 

নেত্যকালী ধমকে ওঠে—এত কৈফিয়ত দিতে পারি না। থানায় যাচ্ছি, ওখানেই রিকশা নে চলো, যা-দাম নেয় আমি দেব! আজই সদরে যেতে হবে। রেল-বন্ধ! তুমিও সঙ্গে যাবে। 

বীরহাটা নামকরা জায়গা, এখান থেকে মাইল ছয়েক দুরে। ওখান থেকে বাস ভাড়ার ট্যাক্সি মেলে সদরে যাবার জন্য। রতন বুঝতে পারে না এ সময় এভাবে সদরে কেন যাবে মাসিমা। চারিদিকে গোলমাল—অশান্তি। তবু আর কোনো প্রশ্ন না করে রতন এগিয়ে যায় রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে। তার চেনা-শোনা রিকশা আছে। যে ভাবে হোক রিকশা জুটে যাবে। 

.

অশ্বিনী দারোগা বেশ জমিয়ে চা-শেষ করে সিগ্রেটটা ধরিয়ে সুখটান দিয়েছে, এমন সময় বাসার থেকে ডাক শুনে তাকাল! 

—মাজি ডাকছেন! জরুরি! 

অশ্বিনী দারোগা তখন সবে এক ঘটিচুরির আসামিকে দুটো রদ্দা কষে গর্জন করছেন— পুঁতে ফেলব শালাকে। 

এ সময় জরুরি ডাক শুনে উঠে পড়তে হলো। পুঁতে ফেলার পুণ্যকর্মটা আপাতত স্থগিত রেখে বলেন, শালাকে দু’চার ঘা লাগাও আর কোথায় কি করেছে বের করো। আমি আসছি 

মালতীর কাছে অশ্বিনী দারোগা কেঁচো। স্ত্রীকে সমীহ করতে হয় দারোগাদের মতে অনেক মহাবীরকেই। কারণ ওখানে তাদের সব কর্মের অলিখিত ডায়েরি থাকে। 

দাওয়ায় বসে আছে নেত্যকালী, পাশে ব্যান্ডেজ বাঁধা বিমলি। হাতে ব্যান্ডেজ কপালে ব্যান্ডেজ। নেত্যকালীর হাতে মাধব ডাক্তারের সার্টিফিকেটটা দংশন এবং আঘাত করার ফলেই এত ক্ষত তাও লেখা আছে। 

মালতী বলে—একটা ডাইরি করিয়ে দাও। এখুনি। 

অশ্বিনী দারোগা একটু ব্যাজার মুখে বলে—এখানে কেন! থানায় গেলেই তো হতো। মালতী ফুঁসিয়ে ওঠে—ওখানে গেলে তোমার চরণে যে পেন্নামি দিতে হতো। লজ্জা করে না ওসব কথা বলতে? 

অশ্বিনী দারোগা স্ত্রীকে সামাল দেবার চেষ্টা করে। 

—কি যা-তা বলছ? 

অনেক দেখেছে মালতী। অধ্যাপকের মেয়ে সে। এসব কাণ্ড সইতে পারে না। আর স্বামী দেবতাটিকে সে উত্তম ভাবেই চেনে। তাই তাড়া দেয়। 

—কি আজ হবে, না পেন্নামি দিতে হবে! ওদের তাড়া আছে। করে দাও গে ডাইরিটা।

অশ্বিনী দারোগা বুঝেছে এখানে তার কিছু করার উপায় নেই। নাহলে জেনারেল ডাইরি করাতে সে খুবই অরাজি। কারণ এরপর এই নিয়ে আবার হাঙ্গামা-মামলা মোকদ্দমাও ঘটে। অকারণে ঝামেলা নিতে চায় না। তাই এড়াবার জন্যই বাঁকা পথ নিতে হয়। কিন্তু নেত্যকালী দেব্যা সেইসব পথ পাকাপোক্তভাবে এঁটে এসেছে মায় সার্টিফিকেটও এনেছে। 

নেত্যকালী বলে—হবে? না, দেরি হবে? আমাকে এখুনিই ছাড়তে হবে দারোগাবাবু।

মালতীই অভয় দেয়—হবে না মানে? একটা মেয়েকে ধরে এইভাবে মারবে, মহিলা সমিতি আছে কেন? 

তারপরেই অশ্বিনী দারোগাকে ধমকে ওঠে মালতী। 

—কি হলো! পাথরের ঠাকুরের মতো দাঁড়িয়ে রইল যে। যাও। চলো, আমিও যাচ্ছি। নাহলে কোথায় কি লিখবে কে জানে? ওদের বিশ্বাস নেই। 

ওরা এসে থানায় ঢুকল। 

ততক্ষণে রতনও রিকশা নিয়ে হাজির। নেত্যকালীকে দেখে হাঁক-পাড়ে—মাসিমা রিকশা মজুত। 

নেত্যকালী নিশ্চিন্ত হয়ে বলে—একটু বোস বাবা। কাজ সেরেই বের হচ্ছি দেরি হবে না। 

ছোটবাবু নেই। অশ্বিনী দারোগা নিজেই বোদা মুখ করে ডাইরি লিখতে বসল। কুলদা মোক্তার-এর বাড়িটা শহরেও দিকে বনেদি অঞ্চলেই। বিরাট একটা দিঘির চারিপাশের সাজানো বাড়িগুলো। উকিল মোক্তারদের পাড়া এটা। আরও দু’চারজন ব্যবসায়ী এখানে সুন্দর বাড়ি করেছে। 

কুলদা মোক্তার আগে থেকেই এখানে গেড়ে বসেছে। তাই তার বাড়ির চারিদিকে বেশ খানিকটা বাগান। শখ করে নানা ফল-ফুলের গাছ লাগানো। কলমি আমের গাছগুলোয় মুকুল এসেছে, বাতাসে মিষ্টি-গন্ধ ওঠে। 

কুলদা মোক্তারের বিরাট বাড়ির একতলায় তার লাইব্রেরি। ওদিকে মফস্সলের মক্কেলদের থাকার জন্য দু’তিনটে ঘর, স্নানের জায়গা—পায়খানাও আছে। একপাশে দু’জন মুহুরি থাকে। ওদিকে দুটো ঘরে ফরাস পাতা এখানের একটায় মুহুরিরা কাজ করে। ওঘরে বসেন গোঁসাই প্রভু নিজে আর আলমারিতে ঠাস বোঝাই রেকর্ড কড়চা—এমন আরও একটা ঘর আছে। সারা জেলার ম্যাপ-কড়চা জমির কাগজপত্র তার কাছে। বেশ বনেদি ঠাট-বাট গোঁসাই প্রভুর। 

গোঁসাই প্ৰভু নামাবলি গায়ে তক্তাপোশের উপর বসে হরিনামের ঝুলির ভেতর আঙুল চালিয়ে নামজপ করছেন। এরপর শুরু হবে আর্জি লেখা। 

উনি বলেন—এতে একাগ্রতা, চিত্তের প্রসন্নতা লাগে হে। প্রভুর নাম করা তারই জন্য। জয় প্রভু। 

ওদিকের বেঞ্চে বসে আছে নটবর, আরও দু’তিনজন মক্কেল। ওদিকের ঘরে নিরু মুহুরি কোনো মক্কেলকে নিয়ে পড়েছে। আর্তনাদ ভেসে আসছে- 

—ওরে বাবারে। আর মেরো না গো। মরে যাব গো- 

গোঁসাই প্রভুর ধ্যানভঙ্গ হয়। বেশ চড়া গলায় কুলদা গোঁসাই ধমকে ওঠে—নিরু! কেষ্টর জীব। এত কষ্ট দিচ্ছিস কেন বাবা, এক ঘা বসাবি ফট্ করে কপাল বরাবর। ব্যস এত কেন! একঘায়েই কাজ হবে। মামলা মেরামত করতে এত কেন? 

লোকটার কপালে বেশ খানিকটা ফাটার দাগ, জামায় রক্ত। দেখে-শুনে কুলদা গোঁসাই লোকটাকে বলে। 

—কাঁচা মামলা কুলদা গোসাঁই নেয় না বনমালী। ফৌজদারি মামলা করবে—রক্তপাতের দাগ থাকবে না এ কেমন কথা? নিরু ওকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারি করিয়ে আর্জিটা কোর্টে জমা দিয়ে দে গে। 

নিরু এক নম্বরকে নিয়ে বের হলো। কুলদা গোঁসাই ওপাশের মক্কেল নটবরকে উঠতে দেখে শ্যেনদৃষ্টি মেলে বলে। 

—নটবর, তোর বাবা চারা ভাঙানির মামলা, ওরে বদন— 

নটবর বাধা দেয়। 

—মামলায় দরকার নাই প্রভু। জমি যায় যাক, মার খেতে পারব নি খ্যামা দ্যান প্রভু—

হাসেন কুলদা মোক্তার। 

—আমার মামলায় হার নেই বাপধন। মৌরসি মোকরারি স্বত্বের জমি যাবে কেন তোমার? শুধু একটু মেরামত। হাঁ-করে দেখছিস কি বদন, দে নটবরের ঠ্যাং-এ এক ঘা। পা-টা কিঞ্চিৎ জখম করবি ব্যস। 

নটবর ভিরমি খাবে আর কি। চিৎকার করছে সে-আজ্ঞে। 

কে শোনে কার কথা। বদন এসে খপ করে ধরেছে নটবরকে, পাশের ঘরে টেনে নিয়ে যায় তাকে। 

রতন ঘরে ঢুকে ওদিকের ওই আর্তনাদ শুনে চমকে ওঠে। নেত্যকালী বিমলাও ঢুকছে। কুলদা গোঁসাই আর্জি লিখতে ব্যস্ত। কাগজ থেকে মুখ না তুলেই শুধোন—কীসের মামলা? ফৌজদারি না দেওয়ানি? 

নেত্য বলে ওঠে—বাবা আমি। 

কুলদা মোক্তার তখন অন্যমানুষ। কোনোদিকে তার নজর নেই। বলেন তিনি। 

—মামলার কাছে মা-বাবা কেউই নেই। তবে কাঁচা-মামলা হলে আমি নেই। পেসন্ন উকিল—নরেশ উকিলদের কাছে যাও। 

হঠাৎ মুখ তুলে তাকাতে নেত্য রতনকে দেখে তিনি অবাক হন— তোরা! 

অ্যাঁ, কতক্ষণ এসেছিস? বলবি তো। বসো ভায়া! 

হঠাৎ বিমলির ব্যান্ডেজ বাঁধা-চেহারার দিকে তাকিয়ে ফৌজদারি মোক্তার কিসের গন্ধ পান। বলেন তিনি। 

—কি ব্যাপার রে? উসকো-খুসকো চেহারা— 

নেত্যকালীর সঞ্চিত অশ্রু এবার বাবার কাছে ঝরে পড়ে। কুলদা গোসাঁই চঞ্চল হয়ে ওঠেন। বলেন 

—চল, ভেতরে চল মা। বেলা হয়েছে। তোর কথা শুনব—আর জলটল খাবি তোরা। এতটা পথ এসেছিস। 

নেত্য বীরহাটা এসে রিকশা ছেড়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সদরে এসেছে। বাবার কথায় বলে—আজই ফিরতে হবে। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। 

—ট্যাক্সি কেন? কুলদা মোক্তার অবাক হন। 

—ট্রেন-বন্ধ। আর তার বৃত্তান্ত বলতেই তো আসা। 

নেত্যকালী এখানে আসার আগেই খবর পেয়েছে যে গুপিমিত্তিরও গেছে ইস্টিশানে মতিয়াদের ওখানে। তাই নেত্য বলে। 

—এর মধ্যে ধর্মঘট হয়েছে, তুচ্ছ-কারণে। আর গুপিমিত্তিরও ঠিক এই ফাঁকে গে হাজির হয়েছে বদমায়েশির মতলব নিয়ে। 

.

বেলা হয়ে গেছে। কুলদা মোক্তার ঘন ঘন তামাক টানছেন ডাবা হুঁকোয়। নেত্যকালীর মুখে সব শুনেছেন, প্রকৃত কি ঘটছে, কেন ঘটেছে আদ্যপান্ত সব। মায় লাউগাছটা কোনখানে – সঠিক কোথায় তার অবস্থান সে খবরও নিয়ে কি ভাবছেন গোসাঁই প্ৰভু! 

নেত্যকালী বলে—আমাদের ফিরতে হবে বাবা। 

কুলদা মোক্তারের ধ্যান-ভঙ্গ হয়। মামলার সূক্ষ্ম প্যাঁচগুলো তামাকের ধোঁয়ায় ভালো খোলে। আর পথগুলো যেন পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার সামনে। কুলদা মোক্তার বলেন—ফিরবি? 

হঠাৎ বুদ্ধি যেন এসে যায় তার মাথায়। 

বলেন—বিমলার মুহুরি নাম্বার কাগজ কপি এসব দিয়ে যা। 

মায়, ডাক্তারি সার্টিফিকেটটাও। আর বিমলি টিপছাপ দিক–তুইও সই কর এখানে। 

নরু- 

নরু মুহুরি এসে হাজির হয়। কুলদা মোক্তার বলেন। 

—লাউগঞ্জ মৌজার পড়চা-রেকর্ড—খতিয়ানগুলো খুঁজে এই দাগ-নম্বরটা বের করো। ওটা নিয়েই বোধহয় সেদিন কথা বলেছিলাম না ঘোষদের সঙ্গে? 

নরু মুহুরিও সায় দেয়—অ্যাজ্ঞে হ্যাঁ। 

খুশিতে ঝলমল করে ওঠে কুলদা মোক্তার—ঠিক আছে। জয়প্রভু, সবই তোমার ইচ্ছে। বুঝলি নেত্যমা—কোন ভয় নেই। চলে যা। তোর ব্যাপারে এবার খেল দেখাচ্ছি। ভজগোবিন্দকেও বলবি যেন রেল কোম্পানির ভয়ে—কারো ধমকে এতটুকু না ঘাবড়ায়। আমি সব পথ মেরে রাখছি। 

—তাহলে চলি। 

রতন তাড়া দেয়! হঠাৎ রতনকে দেখেই যেন আর একটা কথা মনে পড়ে যায় কুলদা মোক্তারের। বেশ খুশিভরে বলে ওঠেন। 

—রতন ভায়ার বিয়ের ব্যবস্থা কিছু হলো? 

রতন একটু লজ্জাবোধ করে। এসব কথা ঠিক এসময় ভাবতে পারে না সে। রতন বলে।

—এখন মাসিমার এই বিপদ, ওসব কথা থাক! 

হাসেন কুলদা মোক্তার—থাকবে কেন? তোমার মাসিমার বিপদ সব পার হয়ে যাবে প্রভুর ইচ্ছায়। তোমারও হবে ভায়া। হ্যাঁ—এই কাগজে একটা সই করে দাও! 

অবাক হয় রতন—এতে সই করতে হবে কেন? 

নেত্যকালীও দেখেছে কাগজটা। বলে সে—ওকালতনামা! 

হাসেন গোসাঁই প্রভু—হ্যাঁরে। বুঝলে রতন তোমার হয়ে একটা ছোট্ট দেওয়ানি মামলা দায়ের করার অধিকার দিচ্ছ আমায়। কোনো ভয় নেই। কুলদা মোক্তার যেচে তোমার ওকালত নামা নিচ্ছে—এ খবর সদরে বের হলে সমূহ খেতি হবে আমার। তবু কী করব বলো—তোমার জন্যে এটুকু করতে দাও। কোনো ভয় নেই, সই করো। 

নেত্যকালীও বলে—বাবা বলছেন, সই কর রতন। কোনো ভয় নেই। 

রতন ওকালতনামায় সই করতে কুলদা মোক্তার সেটাও সযত্নে তুলে ব্যাগে পুরে বলে—তাহলে এসো ভায়া। পরে দেখা হবে! যথা-সময়ে। আমি খবর রাখছি। 

নেত্যকালী বাবাকে প্রণাম করে চোখের জল-মুছে বলে। 

—তাহলে চলি বাবা! 

—হ্যাঁ! আর রতন ভায়া—এখন আগ বাড়িয়ে ঝামেলা করো না। যদি নিদেন কিছু করতেই হয় ফৌজদারি টৌজদারি, ঘা কতক দিয়ে চলে এসো—তারপর আমি দেখব। 

জয় প্রভু! সবই তোমার ইচ্ছে। 

.

…গুপিমিত্তির বেশ খুশি মনেই আসছে। ইস্টিশানের বাইরের চত্বরে তখন গ্রামের অনেক লোকজন জুটে গেছে। নবকুমার তখনও ডুলি পায়নি। সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে টোপর মাথায় দিয়ে সে গর্জাচ্ছে। 

—বিয়ে যদি এ লগ্নে না হয় আমার বিয়ে দেবে ওই রেল কোম্পানি? নালিশ করব।

অন্য এক বরও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। 

তরিতরকারির মহাজনদের শিরে-সংক্রান্তি। দুধওয়ালা মতি ঘোষ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ড্রাইভার—ফায়ারম্যানদের পাত্তা নেই। গিরিশ চেকার এর মধ্যে বেগতিক দেখে কালো কোট—টিংটিং-এ প্যান্ট খুলে লুঙি পরে বসে আছে এক কোণে 

আর প্ল্যাটফর্মে তখন যেন মেলা বসেছে। 

কলের জলও নেই—ইঁদারা থেকে জল তুলে রতিকান্ত চা করছে—আর মালোদের দু-তিনজন বালতি বালতি জল বেচছে পাঁচ পয়সা গ্লাস হিসাবে। 

রতির দোকানের সামনে যেন খণ্ডযুদ্ধ চলেছে।

সমস্বরে কলরব ওঠে—চা দাও তিনটে। 

কেউ হাঁকে—আলুর-চপ আর মুড়ি। আট আনার 

রতিকান্ত, বদন আরও দুটো ছেলে হাঁপিয়ে উঠেছে। কড়াই-এর আধ কাঁচা চপই যেন ফুটন্ত তেল থেকে খাবলে তুলবে ওরা। রতি বাধা দেয়। 

—উঠতে দ্যান গো কড়া থেকে। আয় বাবা! ইকি করছেন গো! 

মতি ঘোষ—তরকারির মহাজন গোবিন্দ জানা—এখানের ধ্যানেশবাবুও রয়েছে, তারা গুপি মিত্তিরকে দেখে যেন ভরসা পায়। নিতাইও রয়েছে সঙ্গে 

মতি ঘোষ বলে—এর বিহিত করুন মিত্তির মশাই। জন্মেও শুনিনি রেলে ধম্মোঘট হয়, রেল-বন্ধ থাকে! এখন লগনসার বাজার, মণ মণ দুধ-ছানা-দই সব বরবাদি হলে কত লোকসান হবে বলুন? 

তরকারির ফড়েরাও আর্তনাদ করে—মরে যাব মিত্তির মশাই। চালান টেরেন, আপনি বলুন আজ্ঞে। 

গুপি মিত্তির ওদের থামাবার জন্য বলে। 

—আমি তো সব শুনেই আসছি। দেখছি কি হয়। তা ইস্টিশান মাস্টার কোথায়? 

চায়ের দোকানের ছেলেটা বলে। 

—আজ্ঞে বড়বাবু ঘর দোর জানলা বন্ধ করে ভেতরে রয়েছেন। এত ডাক হাঁকেও রা কাড়ছেন না গো! 

গুপিমিত্তির হাসছে—এ্যা! ইঁদুরের গর্তে সেঁধিয়েছে ঝামেলা বাধিয়ে। কেন? যাক গিন্নির কাছে! জল দেখছি এবার। 

.

ভজগোবিন্দ হাল ছেড়ে দিয়ে এসে এবার ইস্টিশান ঘরের মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে। বাইরে কোলাহল কলরব চলেছে। হাজার জন ফাঁক-ফোকর দিয়ে নানা প্রশ্ন করে—তার আর কত জবাব দেবে সে। ছোটবাবুও গোলমাল দেখে প্যাঁদানি খাবার ভয়ে সিধে কোয়ার্টারে গিয়ে খিল বন্ধ করেছে। কিন্তু ভজগোবিন্দ ইস্টিশনের-চার্জে। সে আর যাবে কোথায়? এদিকে কোয়ার্টারও বন্ধ। গিন্নি যে কোথায় গেল বিমলিকে নিয়ে কে জানে? ভজগোবিন্দ এসে এখানে দরজা-জানলা বন্ধ করে আশ্রয় নিয়েছে। 

মাঝে মাঝে টেলিগ্রাফের কলটা বেজে ওঠে টরে টক্কা—টরে টক্কা। সারা লাইনে খবর হয়ে গেছে গাড়ি-বন্ধ। লাউগঞ্জে নাকি ধর্মঘট হয়েছে। গাড়ি যায়নি। বীরপুর থেকে তার আগেই সেকেণ্ড ডাউন ছেড়েছে পথে আসছেন তিনি। ইস্টিশানে ঢোকার পথও বন্ধ। থাকবে হোম সিগন্যালের বাইরে ওই মাঠে পড়ে। 

ভজগোবিন্দের মনে হয় এ দুনিয়ার সবই মিথ্যে, এবার এসব ঝামেলা চুকলে সে নির্ঘাৎ হিমালয়ের কোলেই চলে যাবে। সংসারে আর থাকবে না কোনো মতেই। 

গলাটা শুকিয়ে আসছে। কুঁজো থেকে জল নিয়ে খাচ্ছে। দরজায় বেশ চড়াস্বরেই কে ডাকছে—দরজা খুলুন। 

গলাটা চেনা। গুপি মিত্তির এসেছে। গ্রামসভার একজন মাতব্বর সে। 

এবার গুপি মিত্তির যদি ওদের বলে-কয়ে গাড়ি চালাতে পারে এই ভরসাতেই ভজগোবিন্দ দরজা খুলে ওকে আপ্যায়ন করে—আসুন মিত্তির মশাই। বাইরে চড়া-রোদ। গুপি মিত্তির ওই বদ্ধঘরের ঠাণ্ডা পরিবেশে ঢুকে গর্জে ওঠে- 

বাইরে শ দুশো প্যাসেঞ্জার রোদে পুড়ছে, গাড়ি-বন্ধ। মহাজনদের মাল বরবাদ হচ্ছে, আর ঘরে খিল দিয়ে বেশ ঘুমোচ্ছেন? অ্যাঁ! 

ভজগোবিন্দ ঘাবড়ে গিয়ে বলে—ঘুম মাথায় উঠে গেছে মিত্তির মশাই। গাড়ি-বন্ধ করেছে ওরা। 

গুপি মিত্তির গর্জে ওঠে—ওদের গাড়ি চালাতে বলো। 

ভজগোবিন্দ যেন নেতিয়ে পড়েছে এবার। গুপি মিত্তির তত গৰ্জায়। 

—সব নষ্টের মূল তোমার সেই গিন্নিটি। তখনই বলেছিলাম সামলাও মাস্টার। কে শোনে কার-কথা। এখন বোঝো ঠ্যালা। চাকরি না যায়। গাড়ি চলবে না তাহলে? 

ভজগোবিন্দ কঁকাচ্ছে—সদরে জানাতে হবে এবার। 

—তাই জানাও। আর জানালেই কি সব হয়ে যাবে? এত হাজার হাজার টাকার মাল থাকবে, এত লোকের দুঃসহ-কষ্ট হচ্ছে, এর জন্য দায়ী তুমি। তার কি হবে? উপরে খবর দেবে দাও। মোটকথা গাড়ি চালাতেই হবে। 

গুপি মিত্তির বাইরের ওই জনতাকে শুনিয়ে আজ উচ্চৈঃস্বরে লেকচার দিয়ে চলেছে। গুপি মিত্তির হুঙ্কার ছাড়ে। 

—লাউগঞ্জ গ্রাম সভার পক্ষ থেকে বলছি। গাড়ি না চললে আমরাও ব্যবস্থা নেব। লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম। গুপি মিত্তির হুঙ্কার ছেড়ে বের হয়ে গেল। ভজগোবিন্দ আজ অসহায়, বিব্রত। 

ভয়ে কাঁপছে সে, টাক ঘামছে। টাকের ঘাম কপাল বেয়ে নামছে। বাইরে তখন যাত্রীদের স্লোগান চলছে 

—গাড়ি চালাতে হবে। 

ওদিকে নদীর ধার থেকে গুরু গুরু শব্দ ওঠে। সেকেন্ড ডাউন ট্রেন পুল পার হয়ে ইস্টিশানে ঢুকছে, কিন্তু সিগন্যালের পাখাটা ডাউন দেবারও কেউ নেই। প্ল্যাটফর্মে গাড়ি ঢোকার ওমুখে গদাই-এর পরিত্যক্ত ইঞ্জিন বেশ জম্পেশ হয়ে দাঁড়িয়ে তখনও বয়লারের শেষ কয়লার ধোঁয়াটুকু বের করছে গলগল করে। 

সেকেন্ড লোকালের সিটি শোনা যায়। 

আবার ঝামেলা বাড়বে। ভজগোবিন্দ দড়াম করে অপিসঘরের দরজাটা বন্ধ করে হুড়কো এঁটে বসে পড়ে লম্বা কাঠের বাক্সের উপর। যা হবার হোক—সে আর বেরোচ্ছে না এখান থেকে। ভজগোবিন্দ বন্দির মতো চুপ করে বসে আছে, এসব কিছুর আড়ালে। 

মতিয়া এর মধ্যে বেশ চালু হয়ে উঠেছে। ক’দিন চাপা থাকার পর আজ মেয়েটা যেন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে। বটতলায় এর মধ্যে খাটিয়া চারপাই একটা টুল মোড়া এসে গেছে। অবশ্য বুধুয়া গদাই-এর অবস্থা তখন তূরীয়। মতিয়া এর মধ্যে তার গোপন সঞ্চয় থেকে মদের বোতল বেশ কয়েকটা সাপ্লাই দিয়েছে। 

ওরাও জমিয়ে বসে। এমন সময় গুপি মিত্তির আর নিতাইকে আসতে দেখে বুধুয়া উঠে বসে মিত্তির মশায়ের দু’খানি চরণ বুকে সাপটে ধরার চেষ্টা করছে। একখানি চরণ করতলগত হয়েছে অন্য চরণ লটপট করছে। গুপি হেঁকে ওঠে—আরে পা-ছাড়। পড়ে যাব। 

বুধুয়া বলে—চরণে ঠাঁই দিতে হবে মিত্তির মশাই। আপনি ছাড়া আর যে আমার কেউ নাই মালিক। ধৰ্ম্মঘট করলাম আশীব্বাদ করুন। 

মতিয়া এসে ছাড়াল কোনোরকমে। 

—এই পা-ছাড়। বসুন মালিক! 

গুপি মিত্তির পা-ছাড়া এবার মোড়ায় বসে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করে এদের দেখে চলেছে। 

মটর বলে—জান লড়িয়ে দেব মালিক। ওই ইস্টিশান গিন্নি বলে, আমরা মদো মাতাল। মতিয়াকে ইনসাল্ট করবে? দ্যাখ, দিয়েছি চাকা বনধো করে। 

মতিয়া বলে—আমাকে মারল। পিটল ওই দ্যাখেন লাউগাছ লাগালাম, জোর করে লাউ কেটে নিল। বঁটি দিয়ে সে খুন করে দিত— 

গুপি মিত্তির বলে—খুবই অন্যায়। এর বিহিত করতেই হবে। 

গদাই বলে—তাই এই ধরমঘট। ও ধরমঘট চলছে, চলবে। 

গুপি মিত্তির এর মধ্যেই হিসাব করে নিয়েছে। তার লাভ-ক্ষতির হিসাব 

রতির দোকানে যে হাহাকার দেখেছে একটা দিন রেল-বন্ধ থাকলে লাউগঞ্জের বাজারে, ওই বিরাট এলাকায় এর চেয়েও বেশি হাহাকার উঠবে। স্বকিছু আসে ট্রেনেই। জোগান একদম বন্ধ হয়ে যাবে। 

মতিয়া বলে কাঁদ-কাঁদ গলায়, 

—আমাদের কী হবে মালিক? ধরমঘট করলাম বিচার পাব বলে। 

গুপি মিত্তির বলে—ঠিক করেছিস মতিয়া। 

—হ্যাঁ। মতিয়ার ডাগর দু’চোখে খুশির ঝিলিক জাগে। 

গুপিমিত্তির বলে—চালিয়ে যা ধর্মঘট। আমি তোদের পিছনে আছি। তবে শোন—কাউকে একথা বলবি না। 

ঘাড় নাড়ে মতিয়া। ধূর্ত মেয়েটা বুঝে নিয়েছে মালিকেরও বিশেষ স্বার্থ আছে এর সঙ্গে হয়তো নেত্যকালীকে সযুত করার জন্যই হোক বা আরও অন্য কারণেই হোক গুপি মিত্তির তাদের পিছনে থাকবে। মতিয়া এবার তাক বুঝে বলে—মালিক, এতগুলো লোকের খাবার-মদ-বিড়িফিড়ি দিতে হবে। তলব তো মিলবে না। পয়সাকড়ি নাহলে ধর্মঘট চলবে ক্যায়সা? 

গুপি মিত্তির হিসাবটা আগেই করে চলেছে। 

তাই পাঞ্জাবির নিচেকার ফতুয়ার পকেট থেকে দলাপাকানো বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলে—এটা রাখ। আর নিতাইকে বলে দেব দরকার হলে ওকে টাকার কথা বলবি। পরম বাধ্য এখন মতিয়া। চোখে কি রহস্যের ঝিলিক এনে বলে—হ্যাঁ। মালিক। 

গুপি শুধোয়—তা সেই মাগি গেল কোথায় রে? ইস্টিশান গিন্নি? 

মতিয়া এখানেই রয়েছে। ঠিক খবর জানে না। তাই বলে সে, 

—নেহি মালুম মালিক। 

খবরটা আনে নিতাই। সে এর মধ্যে এই দিগরে ঘুরে-ফিরে অনেক খবরই এনেছে। নিতাই বলে—আজ্ঞা তাকে দেখা যাচ্ছে না। 

গুপি মিত্তির খুশি হয়—বলিস কিরে! তবে কি না পাত্তা হয়ে গেল ব্যাপার গোলমাল দেখে? নিতাই বলে–কে জানে? দুটো রিকশা নে রতনবাবুর সাথে বীরহাটা গেছে শুনলাম। থানায় কিসের ডায়েরিও করিয়েছে। 

গুপি ভাবছে, রতনকে নে গেল, তা সেই বকুলটাও গেছে নাকি? ভাববার কথা। ওই নেত্যকালীকে বিশ্বাস নেই। হয়তো রতনা বকুলকে নিয়ে গিয়ে বিয়ে-থা দিয়েই আনবে। তাহলেই সব খেলার শেষ হবে। 

গুপি বিপদে পড়েছে। 

এমন সময় স্টেশনের ওদিকে কাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার শুনে উৎকর্ণ হয়ে তাকাল গুপি মিত্তির। নিতাইও এগিয়ে যায় ওদিকে। 

কি যেন একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটতে চলেছে।

আকাশ কাঁপিয়ে নারীকণ্ঠের স্লোগান ওঠে— 

—আমাদের দাবি মানতে হবে—ট্রেন-বন্ধ করা চলবে না। 

মতিয়ার বিচার চাই— 

….আসরে এতক্ষণ এই মতিয়া বুধুয়ার দলই একপক্ষের ঠাঁই দখল করে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছিল এবার প্রতিপক্ষও এসে গেছে। তারা ঘোষণা করছে—এ ধর্মঘট মানি না। 

রেলের চাকা চালাতে হবে। 

গুপি মিত্তির অবাক হয়—ওরা কারা রে? 

মতিয়াও দেখছে। বুধুয়া এবার বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে ওঠে—রেলের চাকা চলবে না।

জুলুমবাজি নিপাত যাক—মাস্টার গিন্নির বিচার চাই। 

মটরা-যতীন-গদাই আরও দু’চারটে রাখাল ছোঁড়া মজা দেখতে এসেছিল, তারাও গলা তুলে ওদের দাবি জানায়।

ওদিকে তখন জোর চিৎকার চলেছে। 

সব ছাপিয়ে সেকেন্ড লোকাল মাঠ-এর মাঝখান থেকে সিটি বাজাচ্ছে। 

কিন্তু সিগন্যাল নেই। ওই ট্রেনের ড্রাইভার শঙ্করলাল—ফায়ারম্যান রজনীও এসে পড়ে। মতিয়া হাঁকে ওদের, 

—আবে শঙ্করা, দ্যাখ খুন করত আমাকে তুরা থাকতে। 

ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে মতিয়া, একেবারে শঙ্করের কয়লা-মাখা জামার বুকে মাথা-রেখে কচি-খুকির মতো কাঁদছে সে। শঙ্করা বলে ওঠে, 

—ধরমঘট করে ঠিক কাম করেছিস। কাহে মারবে? আবে রজনী ইঞ্জিন পড়ে থাক ওখানে। বসে যা– 

মতিয়া ঝোপের ভিতর থেকে দু’জনকে দুটো মদের বোতল আর ভাঁড় দিয়ে বলে—তুর জন্যই বেঁচে আছি শঙ্কর। 

শঙ্কর ততক্ষণে তার বাঁচার জন্যই গলায় সেই অমৃত ঢেলে চলেছে। তার যোগ্য সহকারী রজনীও বসে নেই। 

নিতাই দৌড়ে এসে খবর দেয়— মহিলাসমিতি এসে গেছে কর্তা। একেবারে টেবিল-চেয়ার নে—শামিয়ানা খাট্টে যুৎ করে বসছে গো। 

ওই মাস্টারনি—বকুল আরও কত মেয়ে ভিড় করেছে। ওনারা রেল চালাবেন। 

মতিয়া গর্জে ওঠে—হামি পয়েন্ট দিতে পারি, তবভি রেল চালাতে শিখল না। ওরা রেল চালাবে? আবে শঙ্করা— 

শঙ্কু বলে ওঠে—তুকে কি ইঞ্জিন চালানো শিখিয়ে দেব মতিয়া মেরা জান্। তবে এখন লয়, 

এখন চাকা-বন্ধ। 

চেল্লাবে— 

ওরা জড়িতস্বরে এলোমেলো চিৎকার করে। তার তুলনায় মেয়েদের চিৎকারটা বেশ পোক্ত গুপি মিত্তির বলে—নিতে। কাল, না আজই ধানকল হতে জনা-পঁচিশ কুলি-কামিন এনে বসিয়ে দে, শুধু চেল্লাবে। রোজ যা লাগে আমি দেব। 

.

সুলতারা খবরটা শুনেছে। নেত্যকালী বিমলি রতনের সঙ্গে চলে যাবার পরই রেল-বন্ধ হবার খবরটা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। গঞ্জে-বাজারে-দোকানে আলোচনা গুঞ্জন শুরু হয়। লাউগঞ্জের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। এতকাল অবধি শত বর্ষা ঝড়-জলেও ওই ছোটলাইনের গাড়ি ঠিক চলেছে এদের নাড়ীর সঙ্গে গতি মিলিয়ে। আজ সেই স্পন্দন যে অতর্কিতে এইভাবে স্তব্ধ হয়ে যাবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। কিন্তু ঘটে গেছে সেটা। 

অনেকেই এবার বিপদে পড়ে। 

দোকানে মাল নেই, কী হবে? কেউ বাইরে যাবে—উপায় নেই। 

বাইরে থেকে আসছে অনেকের আত্মীয়-স্বজন, বিয়ের লগনসা। বরও আসবে বাইরে থেকে, কনের বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেছে। এত আয়োজন বৃথা যাবে। 

মহিলা সমিতিরও মিটিং বসে। 

সুলতাই এখন সভানেত্রী। নেত্যকালীর সদরে গেছে। সুলতা-মালতী, সাব-রেজিস্টার গিন্নি, বকুল মায় কুসুম আরও অনেক বউ গিন্নিদের ডেকে আনা হয়েছে। সকলের প্রয়োজনে আজ ট্রেন-চালু করা দরকার। 

সুলতা বলে—গ্রামের এই এলাকার সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য মহিলা সমিতিই এই কাজে এগিয়ে যাবে। আমরা কর্তৃপক্ষকে চাপ দেব ট্রেন-চালু করা হোক। সদরে টেলিগ্রাম করব। মিনিস্টারদের মেমোরেন্ডাম পাঠানো হবে কলকাতায়। রেলমন্ত্রীকেও লিখছি দিল্লিতে। 

অনেক গৃহিণীই এসব ঠিক বোঝেনি। সবে হাতা-খুন্তি রেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। তবু মেয়েদের ব্যাপারে মেয়েরা একজোট অন্তত বাইরে। পুরুষদের মতো তারা অযথা তর্ক-কচকচি ক্ষমতার লড়াই-এ মেতে ওঠে না। তাই তারা একত্রে বলে ওঠে, 

—নিশ্চয়ই। 

সুলতা ঘোষণা করে—আমরাও প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আন্দোলন চালাব। দরকার হয় ক্যাম্প করে ধর্না দেব। 

মেয়েদেরও জেদ চাপছে, নতুন এক লড়াই-এর জেদ। 

এতকাল লাউগঞ্জের মেয়েদের এসবে কোনো অধিকার ছিল না। ঘরের মধ্যে বন্দি থাকত—না হয় যাত্রা শুনতে যেত, তাও গোরুর গাড়ির ছই-এর মধ্যে বন্দি অবস্থায়। বাইরে বেরোলে মুখে থাকত মুখঢাকা ঘোমটা। আজ এই নতুন এক অধিকার পাবার জন্য তারাও ঘোষণা করে—হ্যাঁ। তাই করব। তবু ওই কতকগুলো লোকের হুকুমবাজি সইব না। বেশ তৈরি হয়েই মহিলা সমিতি একেবারে টেবিল-চেয়ার মায় দত্ত গিন্নির বাড়ির শামিয়ানা অবধি এনে প্ল্যাটফর্মের এপাশে গেড়ে বসেছে। আর ওই ধিক্কার ধ্বনি তুলে সরবে তাদের প্রতিবাদে ঘোষণা করছে লাউগঞ্জের সাধারণ মানুষের হয়ে। 

আটকে-পড়া যাত্রীদের অনেকেই বলে—ঠিক করছেন ওরা। ক’টা লোক ছুতোয়-নাতায় ট্রেন-বন্ধ করবে কেন? 

তরুণের দলও এসে জুটেছে। 

ছেলেদের ক্লাবের সেক্রেটারিও এসেছে আশার আলো তরুণদলও জমেছে এখানে। তাদের নেতা শতদল বলে-আমরাও আছি। চালিয়ে যান দিদি! 

সুলতাও জোর পাচ্ছে। 

ক্লাব থেকে ওরা শতরঞ্চি হ্যাজাক আনার ব্যবস্থা করছে। 

শতদল চৌধুরীর আবার নাটকে বেশি শখ। গান-বাজনাও করে। লম্বা চুল, গলাটা মিহি আর চলাফেরাটাও মেয়েলি ধরনের। আড়ালে ওর ক্লাবের ছেলেরা ওকে শতদল না বলে বিগলিতদ বলে ডাকে। অবশ্য শতদল তাতে অখুশি নয়। তার ভাবটা অমনিই বিগলিত ধরনেরই? 

শতদল বলে—ক্লাব থেকে একটা মাইক আনলে মন্দ হয় না-রে পুলু, সামস্কৃিতিক অনুষ্ঠান করা যেত ছেলেমেয়েদের দিয়ে। 

পুলক ধমকে ওঠে—থামো তো শতদল, এ হচ্ছে দাবির লড়াই। এখানে দেখছ না স্বৈরাচার আর গণতন্ত্রের লড়াই চলছে। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। 

মহিলা সমিতির আবির্ভাবেই সাড়া পড়ে গেছে। 

ওদিকে চেল্লাচ্ছে বুধনদের দল। আর নিতাই এর মধ্যে কলবাড়ি হাড়িপাড়া মুচিপাড়া ঠেঙিয়ে খোরাকি আর দু’টাকা রোজ দেবার কড়ারে জনা পঞ্চাশ বাছাবাছা চাঁছাছোলা গলার ডাকসাইটে পাড়া-কোন্দলি আর জাঁহাবাজ চিৎকার করনেওয়ালাকে এনে বসিয়ে দিয়েছে। তারাও নতুন উদ্যমে এবার গলা ফেড়ে চিৎকার শুরু করেছে। 

গুপি মিত্তির খুশি হয়। 

—হ্যাঁ। চালিয়ে যা। 

কি কৌতূহল বশে প্ল্যাটফর্মের ভিড় দেখে গুপি মিত্তির এগিয়ে আসে। ওদিকে নজর পড়তেই ঘাবড়ে যায়। মহিলা সমিতির প্যান্ডেলে বসে আছে গ্রামের বউ ঝিরা—আর সুলতার পাশে বিরাজ করছেন তারই তৃতীয়পক্ষ শ্রীমতী কুসুম! মনে হয় গর্জন করে উঠবে গুপি মিত্তির। রাগে- ফেটে পড়বে। কিন্তু সাহস হয় না। 

মহিলা সমিতির আশপাশে জমেছে ওই শতদল-পুলকদের ক্লাব, আরও কৌতূহলী যাত্রীরা ও দর্শকবৃন্দ। 

রতিকান্তের দোকানের ছেলেটা একঝুড়ি সিঙাড়া আর একটা বড় কেটলির-চা এনেছে। হাতে-হাতে উঠে যায়। 

কুসুমই খুঁট খুলে দামটা দিয়ে দিল। 

গুপি মিত্তির এবার যেন গর্জে উঠবে স্ত্রীর এই অপব্যয় দেখে। তার আগেই কলরব শুনে দাঁড়াল। 

—এসে গেছে। 

—এসে গেছে। 

কলরবটা দূর থেকেই শোনা যায়। স্টেশন চত্বরের লোক হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে। কে জানে বোধহয় সদর থেকে সাহেবরাই এসেছেন, এবার একটা বিহিত হবে। কিন্তু তা নয়— দেখা যাচ্ছে ঢুকছে নেত্যকালী পিছনে ব্যান্ডেজ বাঁধা বিমলি। ডান হাতটা ফেট্টি দিয়ে বেঁধে গলার সঙ্গে ঝোলানো। পিছনে আসছে রতন– যেন ওদের বডিগার্ড। 

দৃশ্যটা দেখে এবার চমকে ওঠে গুপি মিত্তির। এতক্ষণ ভেবেছিল লিডার নেই, এদের চ্যাঁচামেচিও একটু পরেই থেমে যাবে। কিন্তু লিডারকে এবার সশরীরে সবাহন ফিরে এসে এই আন্দোলনের তরণীর হাল ধরতে দেখে গুপি মিত্তির গর্জায়—বাঁদর কোথাকার। 

বেহায়ার মতো রতনও এসে ঢুকেছে ওই মহিলা সমিতির প্যান্ডেলে, ওই বকুল মেয়েটার চোখে-মুখে দেখেছে হাসির ঝিলিক। রতনা এগিয়ে গিয়ে তার নতুন মাকেও কি বলছে! 

অসহ্য। 

গুপি মিত্তির এবার ওদের এই সমবেত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেবেই! 

—নিতে! 

নিতাই এগিয়ে আসে, গুপি বের হয়ে এসে ভিড় ঠেলে, গলা নামিয়ে বলে— ওদিকে ঠিক আছে? চেল্লাচ্ছে তো ওরা, 

—হ্যাঁ। 

—চালিয়ে যেতে বলে গুদামে আয়। আমি থাকছি ওখানে। 

নিতাই মিশিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। 

গুপি মিত্তির চলেছে গুদামের দিকে গঞ্জের বাজার ঘুরে। চারিদিকে সন্ধানী-চোখ মেলে দেখছে গুপিনাথ। এর মধ্যেই মণিরামের দোকান, সত্যহরির আড়ত ফাঁকা। ওরা গুপিকে দেখে এগিয়ে আসে। দোকানেও জমেছে খরিদ্দারের ভিড়। 

কিন্তু মাল নাই। 

অনেকে থলি ব্যাগ হাতে রিকশা ধরে, না হয় দৌড়ে চলেছে ছ’মাইল দূরের বীরহাটার বাজারে যদি সেখানে কিছু মেলে। 

সত্যহরি গুপিনাথকে দেখে এগিয়ে আসে। 

মোটা থলথলে দেহ, সত্যহরির কাপড়টা ঊর্ধ্বাঙ্গে থাকে না। রাখা সম্ভব নয়। পিছলে পড়ে। তাই নাভির নিচে তেল ধুতিখানা কোনোরকমে জড়িয়ে প্যাঁচ মেরে আব্রু রক্ষা করে সে। 

সত্যহরি বলে—মিত্তির মশাই, ট্রেন-বন্ধ, মালপত্র কিছু নাই! 

গুপিনাথকে দেখে মণিরাম লালাজিও এসে পড়ে। আজ গুপিনাথই এখানে একমাত্র ব্যক্তি যে তাদের এই বিপদে কিছু করতে পারে। 

গুপিনাথ বলে—তাই তো গেছিলাম ইস্টিশানে। যত নষ্টের মূল ওই ইস্টিশনমাস্টার। ওটাকে না তাড়ালে ট্রেন চলবে না। ব্যবস্থা করছি এবার। 

সত্যহরি বলে—তার আগে মালপত্র কিছু না পেলে তো মরে যাব। মণিরামও অনুনয় করে।

—কিছু মাল যদি থাকে মিত্তির মশাই দেন, যা দাম চান দেব। 

গুপিনাথ খুব গা-করে না। মনে মনে খুশিই হয়েছে সে। তবু নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে—দেখি সন্ধার মুখে এসো। কি আছে খোঁজ নিতে হবে। 

তবে বাপু—জানাজানি যেন না হয়, তাহলে ছিঁড়ে খাবে সবাই। 

ওরাও অভয় দেন। 

—না, না। তা কেন হবে? 

গুপি মিত্তিরও এইটাই চেয়েছিল, এর জন্যই সে মতিয়াদের গোপনে মদত দিয়ে চলেছে যাতে ধর্মঘট চালিয়ে যায় তারা। মতিয়াকে মদ-চোলাই করতে পচা চালও দিয়ে চলেছে। একঢিলে দুই পাখিই বধ করবে সে। 

ওই ভজগোবিন্দকে বদলি হতেই হবে, যদিও বা চাকরিটা থাকে। তা হলেই নেত্যকালীও চলে যেতে বাধ্য হবে এখান থেকে। আর ধর্মঘটের মরশুমে গুপিও চারগুণ লাভ করবে এতকালের জমা পচা চাল, ডাল ভেজাল তেল আর কেরোসিন তেল বেচে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *