তিল থেকে তাল – ৪

…কুলদা গোস্বামী বীরপুর বারের নামকরা মোক্তার। বেঁটেখাটো গোলগাল ঘৃতপক্ষ গৌরবর্ণ দেহ, মাথায় একগাছি চুলও আর নেই সবটা জুড়ে তেলাল একটি টাক। লোকে বলে— বুদ্ধির তাপে গোঁসাই প্রভুর মাথার চুলগুলোও অন্তর্হিত হয়েছে। ওর শুভনাম কুলদারঞ্জন গোস্বামী। চলতি কথায় হয়ে গেছে গোঁসাই প্ৰভু! 

প্রভুই বটেন। কপাল আর মাথা এ দুটোর মধ্যে সীমারেখা এখন বিলুপ্ত। তবু ওইস্থানে বিরাজ করে তিলক ছাপ, নাক অবধি নেমে এসেছে, গলায় কন্ঠি, মুখে হরিনাম, নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব, বিনয়ী আর তেমনি ওর চোখের চাহনি। সারা গোল দেহটা জেরার সময় আদালতে লাট্টুর মতো বনবনিয়ে ঘোরে। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিত হয় তার দু’চোখ, ওর ভরাটি গলা আর শাণিত বাক্যবাণ প্রতিপক্ষের সাক্ষীর সব সাহসকে তছনছ করে দেয়, সে তখন উল্টোপাল্টা বকতে থাকে। আর সেই ফাঁকে গোঁসাই প্রভু তার নিজের যুক্তি সমর্থন করিয়ে নেয় আদালতে। 

পাশকরা উকিলরাও ওকে সমীহ করে, আর ছোকরা উকিলদের তো ট্যাকে গুঁজে রাখে কুলদা গোঁসাই, মায় ছোকরা মুন্সেফ হাকিমরাও ওকে মানে গণে, সমঝে চলে ওর মামলার রায় দেবার সময়। 

গুপি মিত্তিরের পাশের গ্রাম মীরপুরের মৌজায় একলপ্তে বাইশ বিঘে জমি আর একটা পুকুর আছে। এতকাল সেই পুকুর থেকে মীরপুরের চাষিরাও তাদের জমিতে সেচের জল পেয়েছে, ইদানীং গুপি মিত্তির সেই মাঠের দিঘিকে কায়েম করে কাটিয়ে পোক্ত বাঁধ দিয়ে নিজের জমিতেই পাম্প বসিয়ে জল তুলে বিরাট চাষবাড়ি করেছে, গ্রামের অন্য গরিব চাষিদের সেচের জল নিতে দেয়নি। তাদের সারা মাঠের ফসল মরতে বসেছে। মুখের গ্রাস চলে যাবে তাদের। তারা মামলা করেছিল লোয়ার কোর্টে সেখানে বড় উকিল লাগিয়ে অনেক ঘটা করে গুপি মিত্তির জয়ী হয়েছে। মীরপুরের সাধারণ মানুষ গত্যন্তর না দেখে সদরে আপিল করেছে, কেঁদে এসে পড়ে কুলদা গোঁসাই-এর কাছে। 

কুলদা মোক্তারের সময় নেই। বিশেষ করে ফৌজদারি মামলায় ওকে সবাই পেতে চায়। টাকা ঢেলে দেয় কুলদার চরণে—জানে তাদের জিতিয়ে দেবেই গোঁসাই প্রভু। সদরের সে সবচেয়ে ব্যস্ত মোক্তার। মীরপুরের লোকদের কান্নাকাটি দেখে কুলদা মোক্তার রাজি হন। 

—ঠিক আছে, যা দাঁড়াব। তবে বাবা মামলা বড় কাঁচা-ফৌজদারি করে এলে ঠিক জল বের করে দিতাম, এটা কি হবে জানি না। দেখা যাক প্রভু কি করেন! 

গোঁসাই প্রভু শিবনেত্র হয়ে স্মরণ করেন—নিতাই হে, তোমারই দয়া! 

গুপি মিত্তির সকালে সদরে এসেছে। ভজন আর গিরিধারীকে নিয়ে ওর উকিলের বাড়িতে গিয়ে নথিপত্র নিয়ে বসেছে, প্রসন্ন উকিলও বারের নামী উকিল। তিনিই বলেন, 

—ওদিকে দাঁড়িয়েছি কুলদা মোক্তার! সাক্ষীদের একটু তালিম দিতে হবে মিত্তির মশাই জলসেচ তো এতকাল ছিল ওতে, এতবড় প্রমাণটা যেন ওরা হাতে না পায়! 

ভজন গ্রামের পাকা সাক্ষীদার। যতই মামলা হোক ভজন দাসকে কাঠগড়ায় দেখা যায়, মিথ্যাকে সে নিপুণভাবে সত্যে পরিণত করতে পারে মাত্র দশটাকা আর মাংস ভাতের বদলে। গুপি মিত্তিরের সে বাঁধা সাক্ষী। 

ভজন বলে—ওসব ভাববেন না উকিলবাবু, গোঁসাই প্রভু এর আগেও দু-তিনটে মামলায় আমাকে বাজিয়ে নেছে। হড়কায়নি। 

গিরিধারীকেও যোগ্য তালিম দেওয়া হয়ে গেল কী-কী বলতে হবে আদালতে। গুপি মিত্তির তবু সাবধান করে।। 

—হুঁশিয়ার বাবা। 

…ভজন কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে অকম্পিত স্বরে, ওই দিঘিতে সে ছেলেবেলায় হুইলে রুই মাছ ধরেছে, একটা তো আট কেজি ছিল—এই গিরিধারীও দেখেছে। কোনো কালেই ওই দিঘিতে জলসেচ হতো না, পদ্মবন ছিল, ভুবন কবরেজ চোখের চিকিৎসা করত ওই পদ্মবনের পদ্মমধু দিয়ে। 

ভজন বিশদভাবে বর্ণনা করে চলেছে, প্রসন্ন উকিল দেখছে হাকিমও নোট করলেন, ওই আটসের রুই মাছ ধরার কথা, আর পদ্মমধুর কথা। 

গোঁসাই প্রভু নির্বিকার। 

আদালতে আসেন প্যানটুল আর কালো কোট পরে, তবু ললাটে তিলক গলায় কণ্ঠি ঠিকই থাকে। নিবিষ্ট মনে হরিতকি চিবিয়ে চলেছেন। 

মীরপুরের লোকেরাও ঘাবড়ে গেছে এমন সাক্ষীর নিবিড় কথার বাঁধুনিতে। 

ওরা বলে—প্রভু কিছু বলুন! 

ইঙ্গিতে ওদের থামিয়ে দিয়ে গোঁসাই নির্লিপ্তভাবে শুনেছেন সাক্ষীদের কথা। হতাশ হয়ে পড়ে মীরপুরের লোকজন। তাদের সর্বনাশ হয়ে গেল! অতীতে তারা অনেক ফসল করেছে। এগজিবিশনে প্রাইজ পেয়েছে ওই জমিতে জলসেচ দিয়ে ফসল করে। আজ গুপি মিত্তির পয়সার জোরে তাদের সেই জলস্বত্ব কেড়ে নিতে চলেছে। ভজনও সাক্ষ্য দিয়ে গুপি মিত্তিরের দিঘি যে পবিত্র জলাশয়, জলসেচ হতো না, পদ্মবন ঘেরা দিঘি এটা নথিভুক্ত করেছে। গুপি মিত্তির বেশ খুশি। দুই সাক্ষীই মজবুত সাক্ষী দিয়েছে। 

নামছে কাঠগড়া থেকে ভজন। 

স্তব্ধ-আদালত, হঠাৎ লাটুর মতো বোঁ পাক দিয়ে সিধে হয়ে উঠে কুলদা মোক্তার হাঁক পাড়ে—মহামান্য ধর্মাবতারের অনুমতি নিয়ে সাক্ষী ওই ভজনদাসকে দু’ একটা প্রশ্ন করতে চাই হুজুর! 

ভজনদাস ওই ধমকে থমকে দাঁড়িয়েছে। 

পেশাদার সাক্ষী সে। তাই কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াল। 

কুলদা মোক্তার ফর্দ বের করে বলে ওঠে—হুজুর, এই ভজনদাস এই মাসে এবং গতমাসে মিলিয়ে এই আদালতে তেইশটা মামলার সাক্ষী ছিল হুজুর! সতেরোটা ফৌজদারি আর ছটি দেওয়ানি কেসের সাক্ষী, তার আগের দুই মাসে ছিলেন—একুশটি কেসের, এবং এই বৎসরে সাকুল্যে তিনি একশো ছটি কেসের সাক্ষী দিয়েছেন। 

আমার বক্তব্য—ওনার চোখের সামনেই কি সব মামলা ঘটে দৈবক্রমে, তাহলে ওর চোখ এবং অস্তিত্ব ক’টি? 

গুপি মিত্তির ঘাবড়ে যায়। ওর উকিল বলে ওঠে—আই অবজেক্ট। এখানে এ প্রশ্ন অবান্তর। কুলদা গোঁসাই ফর্দের কপিটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, 

—এটা তদন্ত সাপেক্ষ হুজুর। এতে প্রমাণ হবে সাক্ষী শ্রীভজনদাস পেশাদার সাক্ষী কি না? ভজন একটু ঘাবড়ে গেছে। 

এবার গোল দেহটি নিয়ে সার্চলাইটের মতো দৃষ্টি মেলে গোঁসাই প্রভু ভজনকে দেখে হুঙ্কার ছাড়েন, 

—মহামান্য আদালতের কাছে আমার আবেদন, সাক্ষী ভজনদাসকে চাদর খুলে দাঁড়াতে বলা হোক। 

গুপি মিত্তির এখনও ঠিক বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। তবু প্রসন্ন উকিল প্রতিবাদ করে আই অবজেক্ট। সাক্ষীকে অপমান করার অধিকার ওর নেই। 

কুলদা মোক্তার হেঁকে ওঠে—প্রয়োজন আছে হুজুর। আর কি প্রয়োজনে সেটা দেখতে চাচ্ছি—সেটাও ধর্মাবতার বুঝতে পারবেন। 

কাঁপছে ভজনদাস, এতক্ষণ ধরে সাজানো কথাগুলো বলে গেছে, ভাবে নি যে এভাবে মূলে আঘাত করবে ওই জাঁহাবাজ মোক্তার। ভয়ে ভয়ে চাদরটা খুলে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে অনেকে। চাদরহীন এই ভজনদাসকে অনেকেই দেখেনি। কুলদা মোক্তার এবার ডবল তেজে হুঙ্কার করে বলে, 

—হুজুর ধর্মাবতার, সাক্ষী ওই ভজনদাসের ডান হাতটি জন্ম থেকেই পঙ্গু। একটু আগেই তিনি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন যে—ওই মীরপুরে দিঘি থেকে তিনি নিজে দশ সের রুই মাছ ছিপে তুলেছেন, মহামান্য আদালতের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, ওই ব্যক্তি বাঁ-হাতে কি করে দশ সের তাজা রুই মাছ তুলবেন—সেটা যেন ভেবে দেখেন! কথাটা সত্য না মিথ্যা! 

গুঞ্জন ওঠে আদালতে। 

এবার ভজনদাস ঘামছে। গুপি মিত্তিরের টাক ঘামছে। বেকায়দায় পড়েছে প্রসন্ন উকিলও। সাক্ষীকে পড়াবার সময় তিনিও এটা লক্ষ্য করেননি। একেবারে ভরাডুবি হয়ে গেছে। 

ভজন ঘামতে থাকে কাঠগড়ায়। 

কুলদা মোক্তার হুঙ্কার করে ওঠে সাক্ষী বলেছেন পদ্মবন ছিল। পদ্ম ফুটত— 

ভজন এবার যে পায়ের নিচে মাটি পেয়েছে। সে বলে ওঠে—হ্যাঁ ধর্মাবতার। আমি দেখেছি পদ্ম ফুটতো—নীলপদ্ম হুজুর! 

—ইয়োর অনার! সাক্ষী বলেছেন নীলপদ্ম ফুটত! উনি দেখেছেন! কুলদা মোক্তারের কথাতে ভজন জোরে বলে—হ্যাঁ হুজুর! 

কুলদা মোক্তার এবার গর্জে ওঠে—ধর্মাবতার, সাক্ষী দেখেছেন ওখানে নীল পদ্ম ফুটত। ধর্মাবতার, নীলপদ্ম দেখেছিলেন স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র সেই ত্রেতা যুগে, তাই দিয়ে দেবীর পূজা করেছিলেন। তারপর ত্রেতা-দ্বাপর যুগ চলে গেল—এই কলিকালে নীলপদ্ম আবার দেখেছেন ওই সাক্ষী ভজনদাস মিত্তির মশাই-এর ওই পুকুরে! ধন্য ভজনদাস-ধন্য তুমি! আর ধন্য ওই গুপি মিত্তির। 

ধর্মাবতার, রামায়ণের এই অধ্যায়টা একটু অ্যামেন্ড করে নতুন নীলপদ্মদর্শনের কাহিনিকে জুড়ে দিয়ে গুপি মিত্তিরের দীঘিতে জলসেচ দেবার হুকুমই তাহলে দিতে আজ্ঞা হয়। 

সারা আদালতে কলরব, হাসিতে ফেটে পড়ে! ভজন আদালতে দাঁড়িয়ে এবার কাঁপতে থাকে। গুপি মিত্তিরের কাঁপ-ছটকানো অবস্থা। 

মামলা ডিসমিস হয়ে যায় এক কথাতেই। 

আনন্দে জয়ধ্বনি করে ওঠে মীরপুরের লোকজন। সাক্ষী রইল পড়ে। গুপি মিত্তির হটপট করে কোর্টঘর থেকে বের হয়ে এসে ধপাস করে বাইরের বাঁধানো বটতলায় বসে পড়ে! 

প্রসন্ন উকিলের মহুরি তখনও সম্যক টাকা—ফিজ পায়নি। সে হন্যে হয়ে খুঁজছে মিত্তির মশায়কে! ভজনও এসে পড়ে। 

মিত্তির মশায় ভজনকে দেখে এবার লাফ দিয়ে ওর টুটি ধরে গর্জায়— 

—শেয় করে দেব তোকে! 

নিতাই কোনরকমে ছাড়িয়ে দেয়—হায় কর্তা। করছ কি? জলসেচ ওরা পেতনা হয় আবার পাবে। তাই বলে খুনখারাপি করবে নাকি! 

গুপি গর্জায় উঃ। ওই কুলদা মোক্তারই হাঁড়ি ভেঙে দিলে হাটে! কি সাংঘাতিক লোকরে বাবা। 

.

কুলদা গোঁসাই-এর দপ্তর ওদিকের একটা চালাঘরে। তিনজন মুহুরি হিমশিম খেয়ে যায় নথিপত্র আর্জি, মক্কেল-সামলাতে। গোঁসাই প্রভু নির্বিকিার চিত্তে ওদিকে বসে হুঁকো টানছেন। আজ শনিবার কোর্ট সেরে তাকে মেয়ের ওখানে যেতে হবে। একমাত্র কন্যা ওই নিত্যকালী। তাকে দেখতে যেতে হয়। 

তাড়া দেন গোঁসাই প্রভু—ওরে আর কেস নিস্ না নিরু! কাঁচা মামলা নিবি না। আর আমাকে আজ বেরোতে হবে বাবা, নেত্যকে দেখতে যাব। ফিরব কাল সন্ধ্যায়, ওদের বলে দে। 

হঠাৎ সেকেন্ড মুনসেফের বেয়ারাকে আসতে দেখে তাকালেন গোঁসাই প্ৰভু! 

বেয়ারা বলে-হুজুর একবার নমস্কার জানিয়েছেন গো! 

গোঁসাই প্রভু বলে ওঠে, ওই হয়েছে জ্বালা। আরে কলেজে পাশ করেই হাকিম হয়ে এসেছে, ছেলেগুলো ভালো। কিন্তু মামলা বোঝে না। চল—যাচ্ছি। 

ছোকরা সেকেন্ড মুনসেফ আইনের একটা কূট চাপে পড়ে পথ পাচ্ছে না। সে শুধোয়—গোঁসাই প্রভু কী হবে এটার? 

কুলদা গোঁসাই আর্জিটা দেখেই বুঝতে পারে। চেনে বাদীপক্ষকে। এ দিগরের কুষ্ঠি ঠিকুজি তার জানা। বলে ওঠেন তিনি। 

—ওরা তিন ভাই। দাবি করছে দুই ভাই—ছোট ভাইয়ের ওয়ারিশানদের পক্ষ করেনি। এ মামলায় সত্য গোপন করে পক্ষদুষ্ট করা হয়েছে। খারিজ করে দেবেন! 

এককথায় বিধান দিয়ে বের হয়ে এলেন গোঁসাই প্রভু! তাড়া দেন—ওরে নিরু, রিক্শা ডেকে দে। বাড়ি হয়ে ইস্টিশানে যেতে হবে। বলি মামলার নরকেই কি দিন কাটবে? জয় প্রভু! 

গুপি মিত্তির রাগে টং হয়ে ফিরছে লাউগঞ্জে। ট্রেনে মীরপুরের দলও রয়েছে। জয়ের উল্লাসে তাদের মুখ ঝলমলে। গুপি মিত্তির এ কামরা ছেড়ে অন্য কামরায় উঠে গুম হয়ে বসে থাকে। বৈকাল নামছে, ট্রেনটা লাউগঞ্জে এসে থেমেছে। ওরা নামছে। হঠাৎ নিতাই বলে ওঠে—কর্তা! দেখেছ? 

গুপি মিত্তির ক’দিনেই অনেক দেখেছে। নতুন আর কিছু দেখার শখ-সাধ আর তার নেই। তাই বিরক্তি-ভরে বলে—কী আর দেখব? চলো—বাড়ি চলো। সেখানে কী হচ্ছে কে জানে! 

হঠাৎ তারও দৃষ্টি থেমে যায়, পাশের কামরা থেকে নামছে স্বয়ং কুলদা গোঁসাই। অবশ্য কোর্টের পোশাক এখন আর নেই। পরনে লোমবস্ত্র, গায়ে ফতুয়ার উপর নামাবলি, মাথায় পগ্‌গ, কাঁধে বৈষ্ণব বাবাজিদের মতো একটা সুতির ঝোলা, কাঁধ থেকে দু’দিকে ঝোলানো, দোরখোর মতো। যেন কোন বিনয়ী-বৈষ্ণব—জয় প্রভু, জয় নিতাই! 

ভজগোবিন্দ শ্বশুর মশায়কে দেখে এগিয়ে এসে প্রণাম করে, 

—সব কুশল তো? জয় প্রভু! 

কুলদা গোঁসাই-এর হঠাৎ নজর পড়ে গুপির দিকে। 

কুলদা গোঁসাই সহজ বিনীত ভঙ্গিতেই বলে, 

—নমস্কার মিত্তির মশাই। বাড়ি ফিরছেন বুঝি! 

গুপি মিত্তির যেন রাগে-ফেটে পড়বে এবার। তারই এলাকায় এসেছে লোকটা। 

তবু রাগ চেপে বলে—আজ্ঞে! এখানে? 

বলে ওঠেন গোঁসাই প্রভু–আমার জামাই মেয়েকে দেখতে এলাম! 

গুপি মিত্তির চমকে ওঠে। ওই বাপের ওই মেয়েটিকে বিলক্ষণ চিনেছে সে। 

বাপটিকেও এবার সমীহ করে। 

গুপি মিত্তির চলে, 

তখনও হাসছেন কুলদা গোঁসাই। ভজগোবিন্দকে বলেন, 

কি ব্যাপার হে, মিত্তির ভালো করে কথাও বলল না। মামলায় হেরে গিয়ে কি মাথা খারাপ হয়ে গেল ওর। 

ভজগোবিন্দ বলে—তা নয়, অন্য ব্যাপারও আছে। শুনবেন আপনার মেয়ের কাছে। গুপি মিত্তির আমাকেও বদলি করার জন্য চেষ্টা করছে। 

—তাই নাকি! কুলদা মোক্তারের বিস্তীর্ণ কপালের আঙিনায় একটু কুঞ্চন জাগে। 

.

এর মধ্যে রতন বকুলও আসতে শুরু করেছে নেত্যকালীর এখানে। সকালের চা-জলখাবার খেয়ে যায় দুজনে। দুপুরে তরি-তরকারি মাছ থাকে। বৈকালে এসে খায়। দু’দিনেই সন্তানহীনা নেত্যকালী ওই দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছে। 

সুলতাদিও বসে নেই। বকুলের মাস্টারির কাজটা হয়ে গেছে। সকালেই বকুল এসে প্রণাম করে, হাতের ভাঁড়ে মিষ্টি! 

নেত্যকালী বলে—কী ব্যাপারে রে। মিষ্টি হাতে? 

বকুল বলে—তোমার জন্যই আজ পায়ের তলে মাটি পেলাম মাসিমা, স্কুলের চাকরিটা হয়ে গেল। কাল রবিবার, পরশু থেকে জয়েন করতে হবে। এতদিন তো তোমার গলগ্রহ হয়েছিলাম। নেত্য বকুলকে বুকে টেনে নিয়ে বলে—দূর পাগলি। ছেলেমেয়ে কখনও মায়ের গলগ্রহ হয় রে! তা সেটা কোথায়? সেই লাটের ব্যাটা! 

রতনও এসে পড়েছে। 

ওদিক থেকে জানান দেয়—এসে গেছি মাসিমা! 

হাসতে নেত্যকালী। বলে সে-শোন, এবারে তোদের বিয়ে-থা দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। রতন বলে—ওটাই কঠিন কাজ মাসিমা। বাবাটিকে দেখেছ তো! তিনি কি সহজ ছাড়বেন! আমাদের জন্য তোমাদেরই না বিপদ হয়! 

—কেন? বকুল ভাবনায় পড়ে। 

রতন জেনেছে খবরটা। বলে সে–বাবা তো গঞ্জে—বাজারে তাবৎ লোকের কাছে মেসোমশাই-এর বদলির জন্য দরখাস্ত নিয়ে ফিরছেন। জয়েন্ট পিটিশন দিয়ে–মিথ্যা বদনাম দিয়ে মেশোমশাইকে এখান থেকে ট্রান্সফার করাতে চান! 

বকুল বলে—তোমরা চলে গেলে আমাদের কি অবস্থা হবে মাসিমা? আর তো কেউ নেই আমার! 

কথাটা শুনেছে নেত্যকালীও। ভাবনার কথা। 

তবু বলে সে—থাম তো। বদলি এতই সোজা! দরকার হয় তখন অন্য ব্যবস্থাই হবে।

বকুলকে কাছে টেনে নিয়ে বলে নেত্যকালী-তোদের ছেড়ে যাব না রে। তাতে কর্তাকে চাকরি ছাড়তে হয় সেও ভালো! 

বকুল মাসির মধ্যে কি যেন পরম আশ্বাস পেতে চায়! 

হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে নেত্যকালীর—আজ বৈকালে বাবা আসবেন লিখেছেন তোরা দু’জনে রাত্রে এখানে প্রসাদ পাবি। বাবার সঙ্গে জানাশোনাও হবে।…আর এসব নিয়েও আলোচনা হবে! 

.

নেত্যকালী বাবার জন্য আয়োজনের ত্রুটি রাখেনি। 

বাবা নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব। নিরামিষ খান। তাই নানা উপাদানই করেছে। ইস্টিশানের ওদিকে ওই পড়ো জায়গায় কয়েকটা লাউগাছ গজিয়েছে। আর হাড়গোড়ে লাউ ফলেছে। ওখান থেকে একটা কচি লাউ কেটে এনেছে বিমলি! বাবার প্রিয় খাদ্য দুধ-লাউ তাও করেছে নেত্য! 

ভজগোবিন্দ যথাসময়ে মান্যবর শ্বশুরকে নিয়ে ঢুকল বাড়িতে। নেত্য গড় হয়ে প্রণাম করে। ওদিকে রতন-বকুলও এসে গেছে। তাদের প্রণাম করতে দেখে গোঁসাই প্রভু হাঁক পাড়েন—কল্যাণমস্ত! এ দুটি কে-রে নেত্য? 

নেত্যকালী পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে—এখন ওরা বড় বিপদে পড়েছে বাবা। আমারই ভরসায় রয়েছে। আর আমার ভরসা তো তুমিই বাবা! 

গোঁসাই প্রভু রসিক ব্যক্তি। শুধু বুদ্ধিমানই নন—দূরদর্শীও। তাই বলেন। 

—কী কেস রে? 

হাসে নেত্য–তোমার ওই খালি মোকদ্দমা-কেস ছাড়া কথা নেই বাবা? 

গোঁসাই প্রভু হেসে ওঠেন—জয় প্রভু! বুঝলি মা—কোর্টের বাইরেই তো কেসের গোড়াপত্তন হয়। তাই সময় থাকতে তার প্রতিকার করা উচিত। শুনলাম ওই গুপি মিত্তির নাকি তোদের পিছনে লেগেছে। লোকটা কিন্তু সুবিধের নয়! 

নেত্য বাবার হাত-মুখ ধোবার জল গামছা এনে পা ধুয়ে দিয়ে বলে। 

—ওই রতন আর বকুলকে নিয়েই তো ব্যাপার। এই মিত্তির মশায়ের ছেলে রতন— 

গোঁসাই প্রভু বলেন—অ্যাঁ! এ যে দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ রে। কি ভায়া? বাবার সঙ্গে ছোড় ছাড় করে চলে এসেছ—তা কারণটি কি উনি? শ্রীরাধিকে? 

নেত্যকালী সব কথাই বলে, বকুলের উপর অত্যাচারের কথা। মায় গুপি মিত্তির, চোরাকারবার, ওই মদ চোলাই-এর কথা—সব কিছু। 

গোঁসাই-প্রভু নিবিষ্টভাবে হুঁকো টেনে যেন বুদ্ধিতে বালিশান দিয়ে চলেছেন। এবার বলে ওঠেন, 

—ঠিকই করেছ রতন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত ভায়া। 

রতনও সায় দেয়—বাবার ওইসব অন্ধকারের কারবারকে মেনে নিতে বিবেকে বেধেছে। তাই চলে এসেছি। 

গোঁসাই প্রভু বলেন, 

—তাই তোদের পিছনে লেগেছে গুপি মিত্তির? 

নেত্যকালী চিন্তিতভাবে বলে—যদি ওকে বদলি করে দেয় বাবা, এখান থেকে চলে যেতে হবে। আর এ দুটো ছেলেমেয়ের দশা কি হবে ভেবে দেখেছ? আমার মুখ থাকবে না বাবা। 

গোঁসাই প্রভু কি ভাবছেন। হঠাৎ বলেন তিনি। 

—তুই এখানেই থাকবি। লাউগঞ্জের বুকে বসে ওর জবাব দিবি। দরকার হয় কাছাকাছি একটা জায়গা দেখে আমি তোর নামে বায়নাপত্র করে রাখছি। এখানেই বাড়ি তুলে দেব। ভজগোবিন্দকে বদলি করে—ও যাতায়াত করবে, না হয় চাকরি ছেড়ে এখানেই থাকবে। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে! আর গুপি মিত্তিরকেও দেখছি ওষুধ দিতে হবে! পরে ভাবা যাবে ওসব। এখন সন্ধ্যা-আহ্নিক করে নাম-গান সারতে হবে মা। জয় প্রভু! 

.

আজ নেত্যকালীর স্টেশন কোয়ার্টার একা কুলদা গোঁসাই-এর হুঙ্কারে ভরে ওঠে। হাঁক পাড়ছে সে বেদম খঞ্জনি পিটিয়ে। 

—জয় নিতাই গৌর রাধে শ্যাম! 

সুজির গন্ধে দীনু পাগলও ইস্টিশানের টাঙানো একতারা নিয়ে এসে জুটেছে। আজ সেও গৌরচন্দ্রিকা শুরু করে। 

—চল যাই গৌর দরশনে, 
এমন আপনজন আর কে আছে 
গৌরাঙ্গ ধন বিনে— 

বকুল রতন সুলতানি মালতী মায় কুসুম অবধি এসে জুটেছে। বকুলও বৈষ্ণব পদাবলী গান ধরেছে। চোখ-বুজে গোঁসাই প্রভু মাথা নাড়েন 

—আহা! জয় প্রভু—জয় নিতাই! অপূর্ব গান তোমার! 

বলেন তিনি–নেত্য, বড় আনন্দ পেলাম মা। সদরে দিনরাত ওই পোড়া মামলার নরকে পড়ে থাকি রে। বড় ভালো লাগল এখানে এবার। তুই এখানেই থাকবি—মহিলা সমিতি থেকে হরি কীর্তনও হবে। ওই বাড়ি ঘর-মন্দিরও করে দেব। এ বড় শান্তির-ঠাঁই রে! 

নেত্যকালী বলে—কিন্তু বাবা ওই গুপি মিত্তির যে পেছনে লেগে আছে। হুঙ্কার ছাড়েন গোঁসাই প্রভু—ওকে ঠাণ্ডা করব! কুলদা মোক্তার ইচ্ছে করলে ওকে জব্দ করতে কতক্ষণ। 

কুসুমও প্রণাম করে গোঁসাই প্রভুকে। নেত্যকালী পরিচয় করিয়ে দেয়, 

—গুপিবাবুর স্ত্রী! তৃতীয় পক্ষ! 

–বেঁচে থাকো মা! 

গোঁসাই প্রভু বলেন—সব অস্ত্র তোর হাতে মা। এতগুলো লোকের শুভেচ্ছার গুপি মিত্তিরকে নস্যি করে দেব। জয় প্রভু! 

দীনু পাগলা বলে—তাই করেন গো, উ বড্ড ঠ্যাঁটা! 

.

রতন বকুল ভজগোবিন্দ গোঁসাই প্রভু খেতে বসেছে। পরিবেশন করছে নেত্য। কুলদা গোঁসাই ঘৃতপক্ব লুচি ছোলার ডাল-তরকারি ভাজা পর্ব শেষ করে এবার লাউয়ের পায়েস নিয়ে পড়েছেন। 

বলেন—কই হে রতন খাও। এর নাম দুগ্ধ লকলকি—মহাপ্রভুর প্রিয় খাদ্য। 

রতনও বলে—সত্যি এ জিনিস আগে খাইনি মাসিমা। লাউ আমার খুব প্রিয় খাদ্য। এটার স্বাদও হয়েছে অপূর্ব! 

বকুলও মাথা নাড়ে—মাসিমা আমাকে এইটা আর একটু দাও। রাখো তোমার সন্দেশ।

নেত্য খুশি হয়ে বলে—আর একদিন করব তোদের জন্যে। ভারি তো লাউ-এর পায়েস!

গোঁসাই প্রভু পরদিন কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে—ইস্টিশানের আশপাশের জায়গাগুলো দেখে ফিরে যান। ভজগোবিন্দও ঘাবড়ে গেছে গুপি মিত্তিরের দাপটে। শ্বশুরমশায় সান্ত্বনা দেন। 

—কোনো ভয় নেই বাবাজি। কোনো গোলমাল দেখলে যেন খবর পাই। চলিরে নেত্য নেত্যকালী বাবাকে প্রণাম করে। গোঁসাই প্রভু বৈকালের লোকালে গদিয়ান হয়ে সদরে ফিরলেন!

গুপি মিত্তিরও বসে নেই। 

গোঁসাই প্রভু থাকাকালীন ইস্টিশান চত্বরে সে আসেনি, কিন্তু খবরগুলো ঠিকই পেয়ে যায়। সে-ও এবার গঞ্জে জনমত সংগ্রহ করছে ভজগোবিন্দকে হঠাবার জন্য। 

মতিয়া—বুধুয়ার দল ক’দিন মালিকের কথায় চুপচাপ রয়েছে। ওদের আড্ডাটাও জমে না। গদাই বলে, 

—পয়সা দিয়ে মাল খাব চোরের মতো? 

মতিয়া ফুঁসে ওঠে—তোরা কিছু করতে পারবি? তাহলে সব দুরস্ত করে দিব হামি!

মটরা, যতীন গর্জে ওঠে—জান্ লড়িয়ে দেব। 

বুধুয়া গজগজ করে—দেখব ক্যামন মরদ তোরা! একদম কারবার বন্ধ করে দিল। লাউ শ্লা-চাকরি করো। কি হবে এতে! 

যতীন বলে—একটা কিছু কর মতিয়া। 

মতিয়া ভাবছে কথাটা। এরা যেন ধূমায়িত আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসছে, করার কিছু নেই। চুপ করে মাস্টার-গিন্নির দাপট-সয়ে কাজ-কারবার—স্ফূর্তি-আর্তি বন্ধ করে ধুঁকছে। মতিয়া গর্জে ওঠে, 

—চুপ করে থাক তোরা, কুত্তার দল। হামি কুছু করলে তোরা সঙ্গে থাকবি না। চুকলি খাবি। গদাই খুব চাপড়ে বলে—কভি নেই। বাপকা বেটা আমি। 

মটরা সায় দেয়-কসম! লড়ে যাব তুর সাথে। নেত্যকালী দু’একদিন শান্তিতেই রয়েছে। সব চুপচাপ! মনে হয় ভয় পেয়েছে গুপি মিত্তির, আর ওই মতিয়া বুধুয়ার দলও। 

এবার নেত্যকালী মহিলা সেবাসমিতির কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর মাথায় রয়েছে রতনের বিয়ে, নিজের ছেলেমেয়ে নেই। বকুলটার জন্যই দুঃখ হয়। তবু চাকরিটা পেয়েছে এবার বকুল। 

আজ ওদের দু’জনকে খেতে বলেছে এখানে। দুপুরে টিফিনের সময় এসে দু’জনে খেয়ে যাবে। সেই রাত্রে লাউয়ের পায়েস খেয়ে ওরা খুর খুশি। আজ তাই লাউয়ের পায়েসটাই করবে নেত্য। 

দুধও বেশি করে আনিয়েছে। 

বিমলি আর নেত্য বের হয়েছে। তরি-তরকারি লাউ-কুমড়োর ছড়াছড়ি বাড়িতে। কে খাবে? কিন্তু লাউয়ের পায়েস, যে সে লাউ দিয়ে হবে না। কচি অথচ পুরুষ্ট লাউ চাই, সবে ফুল খসেছে অথচ বেশি শক্ত বিচি হয়নি, এমনি নধর লাউয়ের সন্ধানেই এসেছে আদাড়ের এদিকে। 

জায়গাটা অনেকদিন ধরে পড়ে আছে, ইস্টিশানের লাগোয়া। এখানে অনেক লাউ ঝুলছে কয়েকটা গাছে। ওদিকটায় মতিয়াদের বসতি ঝুপড়ি, এপাশ এসে নেত্যকালী বিমলিকে হুকুম করে। 

—ওই লাউটা কাট বিমলি, দেখিস যেন আছড়ে ফেলিস না। বেশ কচি লাউটা, নিয়ে আয়।

বিমলি উদ্যত বঁটি হাতে জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে চলেছে ওই লাউয়ের দিকে, নেত্যকালী দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত-স্তব্ধ চারিদিক। এসময় ওদিকের প্ল্যাটফর্মে ফার্স্ট লোকাল আসছে—তারপর ছাড়বে সেটা সেকেন্ড আপ হয়ে। লোকজন ওদিকেই রয়েছে। 

লাউটা সবে কেটেছে বিমলি এমন সময় ঘটনাটা ঘটে যায়। প্রতিপক্ষ বোধহয় অদূরেই অপেক্ষা করছিল—সুযোগ বুঝে এবার বেড়া-টপকে লাফ দিয়ে পড়ে বিমলির উপর মতিয়া। 

তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে মতিয়া কাহে কাটবে আমার লাউ? 

মতিয়া লাউটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করে, বিমলিও ছাড়বার পাত্রী নয়। সেও লাউটা আঁকড়ে ধরে কোনো রকমে মতিয়ার জবরদস্ত দেহের বাঁধন এড়িয়ে বের হয় আসার চেষ্টা করছে, মতিয়াও ছাড়বে না, জাপটে ধরে সামনে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে, 

—আমার গাছ কাটবে, লাউ ছিনিয়ে লেবে, মারবে কাঁহে? নেত্যকালীও অবাক হয়, বলে সে, 

—অ্যাই মতিয়া, আদাড়ে ও গাছ আপনা থেকেই হয়েছে, গোরুতে ওর লাউ খায়, সবাই নেয় ওই লাউ। ও কি তোর গাছ, না তোর জায়গায় গাছ যে লাউ দিবি না? ছেড়ে দে, ছেড়ে দে লাউ। 

—কভি নেহি। ই লাউ আমি দিব না। জুলুম করবে কাহে? আরে এ বুধুয়া—এ গদাই যতীনয়া— 

নেত্যকালী চিৎকার করে—ডাক তার বাবাদিকে। খবরদার ও লাউ ছাড়বি না বিমলি। 

বিমলিও ছাড়বে না, হঠাৎ মেয়েটা ফস্ করে কামড়ে দিয়েছে বিমলির হাতে। অতর্কিত আক্রমণে লাউটা ছিটকে পড়ে, ধারালো দাঁতের কামড়ে মাংস কেটে গেছে, রক্ত পড়ছে বিমলির হাতে। বিমলিও রক্ত দেখে এবার মারমুখী হয়ে বঁটি তুলেছে। 

নেত্যকালী চিৎকার করে—অ্যাই মতিয়া, ছাড়। দেখবি— 

মতিয়া প্রমাদ গুনেছে। নেত্যকালীও এগিয়ে আসছে, এদিকে বিমলিও বঁটি তুলেছে। খুন-খারাবিই হয়ে যাবে। মতিয়া এমনিতেই বুধনের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে মারামারি কিছুটা রপ্ত করেছে। দু’চার-ঘা মার খেতেও পারে আবার মার দিতেও পারে তাক মতো। বিমলির সেই কৌশলটা জানা নেই। তাই মতিয়া এবার হাতের বিরাট দাঁতওয়ালা রুপোর ইয়া মোটা বালা দিয়ে বিমলির মাথাতেই সজোরে এক-ঘা জমিয়েছে, আর তাতেই বিমলি—নক আউট। 

কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে, বঁটি পড়েছে ছিটকে। 

বিমলি চিৎকার করে ওঠে—খুন করে ফেললে গো দিদিমণি। 

নেত্যকালীও রক্ত দেখে এবার রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মতিয়াকে চুলের মুঠি ধরে টেনে সারাবার চেষ্টা করছে। 

মতিয়া কিন্তু সব অ্যাকসনের সঙ্গে তাল রেখে সমানে চিৎকার করে চলেছে। 

এবার তার ভাষা আর নিনাদ আরও বেড়ে ওঠে। 

বিকট-স্বরে চিৎকার করছে মতিয়া—খুন করে দিল, বুধন, আবে গদাই— 

ইস্টিশানে বুধন তখন তোলা আদায়ে ব্যস্ত। পাগলা দীনু ওদিকে গিয়েছিল প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে। সে গাছাগাছালির আড়াল থেকে ওই গজকচ্ছপের লড়াই দেখে মুক্তকচ্ছ অবস্থায় দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—হায় বাবা। অ্যাই বুধন, শালা তোর মাগ ওইখানে কি করছে দ্যাক গে! একাই লড়ে যাচ্ছে মাইরি। উঃ—কি ত্যাজরে। 

বুধনের কানে আসে কাতর চিৎকারটা। মতিয়ার চিৎকার। বুধনও হাতের কাজ ফেলে দৌড়ালো ওই দিকে। মনমেজাজ তার ভালো নেই। রাতের রোজগার-বন্ধ। এখন পয়সা দিয়ে মাল কিনতে হয়, বাড়িতে যা-এক আধটু চোলাই করে তাতে শানায় না। 

বুধনকে দেখে মতিয়া আরও সপ্তমে গলা তুলে কাঁদতে থাকে। 

—দেখ কি করছে। লাউ কাটল—গাছ তোড়ল—হামাকে দুনো মিলে অ্যাইসা মারলো—তু না এলে বঁটিসে কেটে দিত জরুর। আয় বাপরে- 

নেত্যকালী ধমকে ওঠে—অ্যাই! কে মেরেছে তোকে? তুই-ই তো বিমলির হাতে কামড়ে মাংস তুলেছিস, মাথায় চোট মেরে রক্তগঙ্গা করলি। ছাড়াতে গেলাম বলে কিনা মারল? 

সান্টিং ড্রাইভার গদাধর আর মটরু ওরা সাইডিং-এ কয়েকটা ওয়াগন টেনে নিয়ে গিয়ে ওদিকে রাখছিল, ইঞ্জিনটা মেন লাইনের পয়েন্টের মুখে এসেছে, এতক্ষণ ইঞ্জিনের বিকট শব্দে ওরা মোতিয়ার ওই চিৎকার শুনতে পায়নি, এবার ইঞ্জিনটা এদিকে আসতেই মটরার নজরে পড়ে ব্যাপারটা। সেই-ই দেখায়—ওই যে, ওই দ্যাখ ওস্তাদ। কি হচ্ছে গো। 

গদাধরও দেখেছে মতিয়া একাই লড়ে যাচ্ছে দু’জনের সঙ্গে। আর ওদের চিরশত্রু সেই নেত্যকালীই এবার যেন মতিয়ার উপর চড়াও হয়েছে। চরম বিপদের মুহূর্ত। 

মটরা ইঞ্জিনের সিটির নারকেল দড়িটা ধরে জোরে জোরে টানতে থাকে। স্টেশন প্ল্যাটফর্ম চারিদিক সচকিত করে ইঞ্জিনের তীক্ষ্ণ বাঁশিটা বাজছে কি এক চরম বিপদের সঙ্কেতের মতো। 

সকলেই বের হয়ে আসে। সাড়া পড়ে যায় প্ল্যাটফর্মে—ওদিকে পাম্প রুমে ছিল যতীন। জল উঠছে, পাম্প চালু রয়েছে। ওই বিকট বাঁশির শব্দে সেও দৌড়ে আসে রড হাতে। 

গদাধর ড্রাইভার ততক্ষণ ইঞ্জিন থেকে লাফ দিয়ে নেমে অকুস্থলের দিকে দৌড়েছে, মটরাও চলেছে পিছুপিছু। তাদের পিছুপিছু দৌড়েছে যতীন পাম্পরুম ছেড়ে, ওর-হাতে একটা লোহার ছাই ঝাড়া রড। 

গদাইকে দেখে মতিয়া উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে ওঠে। 

—দ্যাখ, ক্যা হাল করেছে দ্যাখ গদাই। তোরা না এলে আমাকে খুন করে দিত। কত কষ্ট করে লাউ গাছ লাগালাম, পানি দিলাম, উ জোর করে লাউ কাটল। বলতে গেলাম বঁটিসে কাটতে এল! 

নেত্যকালী ধমকে ওঠে—আ মলো, কি হয়েছে যে পাড়াশুদ্ধ নাগরদের ডেকে কাঁদতে হবে? তুই মেরে তো বিমলিকে ঘায়েল করেছিস। আবার ন্যাকামি। 

গদাই এবার যেন করার মতো কোনো কাজ পেয়েছে। 

বুধনও ফুঁসে ওঠে—মারলেন দেখলাম। কাহে মারবেন ওকে? 

নেত্যকালী যে এতদিন ধরে তাদের মদবিহীন করে রেখেছে কৌশলে আজ তাকে এমন কায়দায় 

পেয়ে কেউ ওরা ছাড়তে রাজি নয়। 

তাই গদাই বলে—জরুর মারলেন। 

মটরা গর্জে ওঠে—এ জুলুমবাজি সইব না। এর বিহিত করতে হবে। 

যতীন এর মধ্যে পাম্পরুমেই বেশ খানিকটা মদ গিলে তৈরি। সে টলতে টলতে বলে—জরুর করতে হবে। আভি করতে হবে। 

নেত্যকালী বিমলিকে ওরা ঘিরে ফেলেছে। নেত্য এবার বলে—চলে আয় বিমলি। 

ওরা চলে যাচ্ছে দেখে মতিয়া এবার চিৎকার করে, 

—অ্যাই মরদ। ও মেরে যাবে জুলুম করবে, তোরা কিছু বলবি না? ও কেঁদে ওঠে কচি খুকির মতো-মারলো হামাকে—গদাই এর দু’চোখ ওর দুঃখে ছলমল করে ওঠে। গদাই সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলে—জরুর, এর বন্দোবস্ত হবে। এ মাজি আপনি কাহে মারলেন? 

মটরাও গলা তোলে—কাহে মারবেন? 

নেত্য এবার ধমকে ওঠে—জবাব দিতে হবে ওই মদো-মাতালদের? 

অ্যাই মতিয়া ঢের নষ্টামি করছিস, ওদের থামতে বল না হলে তোর কসবিগিরি ছুটিয়ে দেব। সর—অ্যাই মুখপোড়া 

এহেন সময় ভজগোবিন্দ এখানে এসে পড়ে। 

প্ল্যাটফর্মের লোকজনও বেশ কমে গেছে। আটটা বাইশের সেকেন্ড লোকাল ছাড়তে হবে, যাত্রীরা ট্রেনে উঠে বসেছে। কোর্টপ্যাসেঞ্জারও কিছু আছে। আর আছে রাজ্যের তরিতরকারি মহাজনদের টিন বন্দি দুধ ছানা—মাছ। সব সদরে যাবে। বিয়ে লগনসা। দু’তিনটে বর—বরযাত্রীর দলও রয়েছে ট্রেনে। সময় হয়ে গেছে। ওদিকে পয়েন্ট দেবার লোক নেই, হোমসিগন্যালের মুখেই শান্‌টিং ইঞ্জিনখানা ফেলে রেখে পথ-বন্ধ করে গদাই-মটরা এখানে জুটেছে। 

ভজগোবিন্দ ভেবেছে এটা সামান্য ঝগড়াই–নাহয় বুধুয়া মতিয়ারা মারপিট লাগিয়েছে মদ গিলে, প্রায়ই লাগে। এ এমন নতুন কিছুই নয়। ধমকে ধামকে থামতে হয় তাকেই। 

সেই ভেবে ওখানে গিয়ে ভজগোবিন্দবাবু ওই মদ্যপ বাহিনী বেষ্টিত হয়ে তার গিন্নি আর রক্তাক্ত-হাত কপাল সমেত বিমলিকে দেখে চমকে ওঠে। 

—তুমি! কী ব্যাপার? 

নেত্য ভজগোবিন্দর কথার জবাব দেবার আগেই প্রতিপক্ষ এবার গর্জে ওঠে। 

—এর বিচার করুন মাস্টারবাবু, ওই মাজি এসে জুলুম করে মতিয়ার গাছের লাউ কাটল—মারল—বঁটি দিয়ে খুন করতে গেলে কাহে? 

মটরা বলে ওঠে—এ জুলুমবাজি সইব না। মাফি মাঙতে হবে ওকে মতিয়ার কাছে!

গদাধর এর মধ্যে দু’ঢোক গলায় ঢেলেছে। মতিয়া এই ফাঁকেই তার গুপ্ত সঞ্চয় থেকে ক’বোতল মদ চালু করে দিয়েছে। সেই খুশিতে গদাই গর্জে ওঠে—জরুর মাফি মাঙতে হবে। 

বুধুয়া যোগ দেয়—হ্যাঁ। নইলে কোই কাম করব না। 

মতিয়াও খুশি হয়। আরও জোরে সে কচি আহ্লাদি খুকির মতো ভ্যা-করে কেঁদে ওঠে—ওরা জুলুম করল—মারল হামাকে। 

নেত্যকালী হাড়ে-হাড়ে জ্বলে গেছে। সেও বুঝেছে ওই মেয়েটার মতলব। তাকে জড়িয়ে এবার প্যাঁচে ফেলতে চায়। সেও লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছে! ভজগোবিন্দ পড়েছে আরও বিপদে! তাকে লোকাল ছাড়তে হবে। মদো-মাতালগুলো মদ খেয়ে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবু তাদের নরম সুরেই বলে ভজগোবিন্দ। 

—ওরে বুধন, অ্যাই গদাই, চল বাবা। লোকাল ট্রেন চলে যাক। ওটা ছেড়ে দে। তারপর এর মীমাংসা হবে। চল দেরি হয়ে গেছে ট্রেনের। 

বুধুয়া গর্জে ওঠে—ট্রেন ছাড়বে পরে, আগাড়ি এর মীমাংসা করতেই হবে। 

গদাইও বলে—ঠিক বাত। আগে মাফি মাঙতে হবে ওনাকে মতিয়ার কাছে। জবান দিতে হবে কভি কুচু বলবে না—তব্ উ শানটিং ইঞ্জিন হটাব, না-তো ওই ইঞ্জিন ওখানেই পড়ে থাকবে। 

চমকে ওঠে ভজগোবিন্দ—ট্রেন যাবে না যে রে! 

বলে ওঠে মটরা—যাবে না। ব্যস। চাকা বন্ধ হোয়ে যাবে। 

যতীনও সায় দেয়—পাম্পভি পুরা বন্ধ হবে! 

ভজগোবিন্দ এটা ভাবতেই পারে না। এই লাইট রেলওয়েতে তার বাইশ বছরের চাকরি, এর মধ্যে কোনোকালে এর চাকা বন্ধ হয়নি। বন্যাও নেই এদিগরে। আন্দোলনও নেই। গাড়ি চলেছে ঠিক মতো। আজ তার এখানেই এই কোম্পানির রেলের চাকা বন্ধ হবে এটা ভাবতেই পারে না। পিদ্রু সাহেব কাঁচাখোকা সাহেব, জ্যান্ত-গিলে খাবে তাকে। 

ভজগোবিন্দ চমকে ওঠে— ওরে বাবা! এসব করিস না বুধন! চাকরি চলে যাবে! 

গদাই তখন মদের নেশায় বীর হয়ে উঠেছে। সে শহিদ হবার জন্যই যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বলে সে জান্ যায় যাক্—বাত টলবে না। গাড়ি চলবে না। পহেলি মাফি মাঙতে হবে। এই জুলুমের বিহিত করতেই হবে। 

ভজগোবিন্দ স্ত্রীর দিকে তাকাল। 

নেত্য দেখছে মতিয়ার খেলাটা। মেয়েটা গদাই-এর গায়ে ওর আধআদুড় গা-ছুঁইয়ে কি বলছে। গদাই মতিয়ার চোখমুছিয়ে দিচ্ছে আদর করে। বিমলির কপালে রক্ত ঝরছে। বেশিক্ষণ ওকে এভাবে রাখা ঠিক নয়। ডাক্তারি করাতে হবে। ইনজেকসন দিতে হবে। 

এমন সময় ভজগোবিন্দের কথায় নেত্যকালী ফুঁসে ওঠে। 

—কি বললে? 

ভজগোবিন্দ মিনমিন করছে—ওগো। চাকরি থাকবে না ট্রেন না ছাড়লে। দোহাই তোমার, মতিয়ার কাছে মাফ চেয়ে নাও। নাহলে আমিই বিপদে পড়ব। 

নেত্যকালী তাকাল ওই লোকটার দিকে। তার স্ত্রীকে অযথা মাতালগুলো অপমান করছে, বিমলিকে এভাবে মেরে সমস্ত ব্যাপারটা অন্যায়ভাবে ঘুরিয়ে অন্যপথে নিয়ে যেতে চাইছে ওরা। ভজগোবিন্দ তা নিয়ে ওদের একটা কথা বলেনি। উল্টে বলছে তাকে মাপ চাইতে ওই নষ্টা মেয়েটার কাছে! 

নেত্যকালী এবার কঠিন স্বরে বলে, 

—অন্যায় আমি করি নি। মাপ চাইব না। তাতে তোমার যা হয় হোক। মদো-মাতালদের খুশি রাখতে নিজের ঘরের বউকেও অপমান করো—জানো কার-মেয়ে আমি? 

—ওগো, ভজগোবিন্দের টাক ঘামছে। 

নেত্যকালী গর্জে ওঠে—এমন মাতাল চরানোর চাকরিতে তোমার দরকার নেই। যাক্ ও চাকরি। তবু কুলদা মোক্তারের মেয়ে ওই নষ্টা-মদবেচা মাগির কাছে মাপ চাইবে না। 

গদাধর প্রতিবাদ করে—ঝুট বলবে না, মাপ চাইতেই হবে। 

নেত্যকালী জবাব না দিয়ে বলে—চল বিমলি, তারপর দেখছি তোদের। 

ভজগোবিন্দের সামনে দিয়ে তড়বড় করে নেত্যকালী আহত বিমলিকে নিয়ে বের হয়ে গেল। মতিয়া ফুঁসে ওঠে। 

—ক্যায়সা গালি দিয়ে গেল, মারল গদাই? 

আবার ভ্যাঁ-করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। 

গদাধর ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে–রো মাত মতিয়া। 

ভজগোবিন্দ তবু অনুনয় করে ওদের—বাবা বুধন, ওরে গদাই— 

বুধন ততক্ষণে মাটিতে বসে পড়েছে মদের তেজে, গদাই তখন এ যুদ্ধের সেনাপতিত্ব নিয়ে ফেলেছে। মটরাও ফুঁসছে। 

—ওরে! ভজগোবিন্দ যেন কঁকাচ্ছে—ট্রেনটা ছেড়ে দে বাবা। 

গদাধর গর্জন করে ঘোষণা করছে—ট্রেন যাবে না। 

মটরা ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে—চাকা বন্ধ! জুলুমবাজি সইব না। 

যতীন তখন বটগাছের নিচুকার ডালে উঠে শূন্যপ্রায় বোতল সমেত হাতটা শূন্যপথে আন্দোলিত করে বিশ্বজোড়া আহ্বান তুলেছে, 

—দুনিয়ার মজদুর—এক হো! 

লাউগঞ্জের রেলের চাকা—চলছে না। চলবে না। 

ওই সমবেত চিৎকারে বটগাছের ডালে-বসা কয়েকটা ঘুঘু পতপত করে উড়ে গেল আকাশে ওদের বেতালা চিৎকারে ভয় পেয়ে। 

.

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে বীরপুরগামী সেকেন্ড লোকাল। যাত্রীরা উঠে বসেছে। তরকারি ভেণ্ডাররা তাড়া দেয়—জলদি ছাড়েন গো গাড়ি, কালিপুরের হাট পাব না। সদরেই বা যাব কখন হে! 

গোয়ালারা বিপদে পড়েছে। এত দুধ-ছানা বরবাদ হয়ে যাবে। 

মতি ঘোষ ইস্টিশানের বড়বাবুকে খুঁজছে। ওদিকে গিরিশ চেকারকে ঘিরে ধরেছে অনেক যাত্রী—মামা গাড়ি ছাড়বে কখন গো? 

মামা ডাকে জ্বলে ওঠে গিরিশ। 

গর্জে ওঠে সে—মামা কোন্ শালার রে। ট্রেন ছাড়লে টিকিট দেখার দায় আমার, ট্রেন ছাড়ার দায় আমার নয়। 

তবুও জেরার-চোটে গিরিশ ট্রেন ছেড়ে রতির দোকানে ঢুকে বসেছে। 

দীনু পাগলা তখন ইস্টিশানে গলাফেড়ে বাউল গাইছে, 

—ওরে ঘণ্টা হলো পাখা পড়ল 
টিকিট কাটলি কই। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *