তিল থেকে তাল – ২

হরেন ঘোষের বাড়িতে ছোটখাটো উৎসবের পরিবেশই গড়ে উঠেছে। ক’দিনের মধ্যেই গুপি মিত্তির নিতাই-এর সহযোগিতায় সব ব্যাপারটাকে জমিয়ে তুলেছে। আর আজই বিয়ের দিন। 

শশী নায়েব এককালে জমিদারি সেরেস্তার নায়েবি করে এখন বেশ জমিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বয়সকালে সেবাযত্ন করার কেউ নেই, স্ত্রী গত হবার পর ছেলেদের বউ-নাতিও হয়েছে, কিন্তু বেশ হৃদয়ঙ্গম করেছে শশী নায়েব যে গৃহিণী ছাড়া সেবা করার কেউই নেই। যে যার সংসার নিয়েই ব্যস্ত। 

তাই সে আবার বিয়ে করতেই চাইছিল, আর গুপি মিত্তির খবরটা দিতে শশীও এককথায় রাজি হয়ে একেবারে তৈরি হয়েই এসেছে। 

হরেন ঘোষ-এর চেয়ে হরেন ঘোষের গিন্নির আগ্রহটাই বেশি। এমন রাজা-জামাই পাওয়া ভাগ্যের কথা। মনে মনে এটাও ভেবেছে বকুলের মামি। শশী নায়েব ঝুনো নারকেল হয়ে রয়েছে, বোঁটা খসে পড়ার দেরি নেই। সেই শুভকর্মটি ঘটে গেলে বকুলই হবে প্রভূত সম্পত্তির মালিক। 

তাই ইদানীং বকুলকে বেশি করেই ভালোবাসার ভান দেখাচ্ছে সে। গুপি মিত্তির, হরেন ঘোষ, শশী নায়েব বাইরে ঘরে বসে গল্প করছে। শশীর আবার বায়ুর ধাত। গরমে কষ্ট হয়, নিতাই পাখা করে চলেছে। গুপি মিত্তির মনে মনে খুশি হয়েছে। কোনোরকমে বিয়েটা চুকিয়ে বকুলকে পাচার করে দিতে পারলে রতনের ডানা পালক কাটা হয়ে যাবে। 

সেই-ই তাড়া দেয়—দ্যাখ নিতে, আশীর্বাদ করতে হবে। মেয়ে সাজানো হলো কি না দেখে আয়। ও বেলায় আর সময় হবে না। গোধূলি লগ্নেই বিয়ে। 

বকুল ভাবতেই পারেনি যে তাকে এইভাবে জোর করে বিয়ের নামে সর্বনাশ করার চক্রান্ত করবে ওই গুপি মিত্তির, তার মামাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে কিনে নিয়েছে ওরা এটা বুঝেছে বকুল। মামিও এর মধ্যে শশী নায়েবের দেওয়া দুধে গরদ পরে গিন্নি সেজে কাজকর্ম করছে খুশিমনে। 

তাড়া দেয় মামি—ওরে বকুল চান করে নে মা, আর ওই মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি-গয়নাগুলো পর। আহা জামাই তো নয় যেন মহাদেব। দ্যাখ, কেমন সভা আলো করে বসে আছে। 

হাঁপাচ্ছে শশী নায়েব। এখান থেকে বকুল এক নজরে ওই শীর্ণ প্যাকাটির মতো বুড়োকে দেখে চমকে ওঠে। ওই তার বর হবে। 

বকুলের মনে হয় চিৎকার করে সে প্রতিবাদ জানাবে। কিন্তু নিষ্ফল সেই প্রতিবাদ। মনে হয় কালীবাড়ির ছাগল বলির মতো অবস্থাই হয়েছে তার। ওকে সকলে হাড়িকাঠে পুরে বলিদান দেবে। 

বাঁচার কোনো পথ নেই। 

তবু অনুনয় করে বকুল-এসব কেন করছ মামি? যদি তোমাদের এত বোঝা হয়ে থাকি ওই দিঘির জলে ডুবেই শেষ করব নিজেকে। তবু এভাবে শেষ করে দিও না। পায়ে পড়ি তোমার। 

মামি হেসে ওঠে নিষ্ঠুরভাবে। 

মুখে তবু যেন মধু ঝরে। বলে সে, 

—ওমা! কি অলুক্ষণে কথা বলছিস লা। রাজরানি হয়ে থাকবি। চল। 

আশীর্বাদ-অনুষ্ঠানের সব উদ্যোগ হয়ে গেছে। মামি বকুলকে নিয়ে যেন জোর করে। এবার হাড়িকাঠে পোরা হবে। গুপি তাড়া দেয়—কই আনো বকুলকে। 

বকুল এসে বসেছে। 

ঠিক এমনি সময় ঝন ঝন করে বাইরের দরজায় শিকলটা বেজে ওঠে। দরজা বন্ধ করে এসব অনুষ্ঠান চলছিল গোপনে, আর এই সময় ওই শব্দ শুনে তাকাল গুপি, বকুলের মামাতো বোন পুঁটিও সেজেগুজে বিয়েতে মেতেছে, সেই-ই কিছু বলার আগে দরজাটা খুলে দিতে সটান উঠোনে এসে হাজির হয়েছে নেত্যকালী, সঙ্গে সুলতাদি আর দারোগা গিন্নি 

ওরা এ ব্যাপার দেখে চমকে উঠেছে। 

বকুলও ওদের দেখে বুকচাপা আর্তনাদে কেঁদে ওঠে। 

—দ্যাখো মামা ক্যামন বরের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছে, দ্যাখো। জোর করে। 

নেত্যকালী দাওয়ায় গুপি মিত্তিরের পাশে কোঁচানো ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি পরা ওই ঘাটের মড়ার মতো চেহারার লোকটাকে দেখে চমকে ওঠে। বেশ কড়াস্বরে নেত্যকালী বলে, 

—এই তোমার কাজ মিত্তির মশাই? একটা দুধের মেয়েকে ওই বাঁশমরার হাতে তুলে দিতে এসেছ? তুমি খুনিরও অধম! 

গুপি মিত্তির, ওদের সামনে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়ে একটু ঘাবড়ে গেছে। 

তবু বেশ চড়াস্বরে বলে; 

—এখানে কেন এসেছেন? 

সুলতা বলে—মহিলা সমিতির কাজ এটা। একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে শেষ করতে আমরা দেব না। 

হরেন ঘোষ বেশ কিছু টাকা গিলেছে, সেও বুঝেছে এই পথেই তার সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এহেন সময় শুভ কাজে বাধা আসতে হরেন ঘোষ বলে, 

—আমার ভাগনি তার ভালোমন্দের ভার আমার হাতে, আপনারা কেন কথা বলবেন এতে?

চরম কথাটা বলে ওঠে বকুলের মামি, 

—ওই মেয়ের ভার কে নেবে? ভাতকাপড় কে জোগাবে ওর? 

থমকে যায় এরা। কঠিন প্রশ্ন! নেত্যকালী দেখছে বকুলকে। অসহায় মেয়েটা কি হতাশায় ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এতবড় পৃথিবীতে আজ ওর আপনজন কেউ নেই। 

নেত্যকালীর সারামন কি সমবেদনায় ভরে ওঠে। 

বলে সে—সে ভার আমার। 

চমকে ওঠে বকুল—মাসিমা! 

নেত্যকালী বলে—লেখাপড়া শিখেছিস সুলতার স্কুলে চাকরি না হয়, অন্য কোথাও ঠাঁই না পাস আমার ওখানেই থাকবি। আর ঘোষমশায় আমার ছেলেমেয়ে কেউ নেই, বকুলই না হয় মেয়ে হবে আমার। উঠে আয় বকুল পিঁড়ি থেকে। আর এ বিয়েতে কাজ নেই। 

সুলতাও ভরসা পায়। 

তার স্কুলে চাকরিই দেবে সে বকুলকে। গুপি মিত্তির চমকে ওঠে। তার সব মতলবই ভেস্তে গেল। শশী নায়েবেরও হাজার আট টাকা গলে গেছে তার জন্য শশীও কথা শোনাবে তাকে। তার বিপদ বাড়বেই। গুপি গর্জন করে। 

—খবরদার যাবে না বকুল। আপনাদের নামে কেস করতে পারি। চলে যান আপনারা।

নেত্যকালীও এবার কেসের নাম শুনে ফুঁসে ওঠে, 

—আমার বাবা কুলদা মোক্তার। তার মেয়েকে কোর্ট দেখাবে না মিত্তির মশাই। চলে আয় বকুল—একবস্ত্রে চলে আয়। 

বকুলও এমনি মুক্তিই চেয়েছিল, সেও উঠে পড়ে এদের সঙ্গে চলে আসে। এর মধ্যে পাড়ার কিছু ছেলেমেয়ে-জনতাও জুটে গেছে। ওরা বের হয়ে গেল। 

গুপি মিত্তির তখনও গাচ্ছে—ওই ইস্টিশান মাস্টারের গিন্নিই যত নষ্টের মূল। ওকে দেখে নেব এবার। 

.

গ্রামের বাইরে রেললাইনের ওদিকে গার্লস স্কুল—তার লাগোয়া ছাত্রীনিবাস। এককালে রায়চৌধুরী বাবুদের এসব শখের বাগান ছিল। এখন তার ফৌত, তবু ফৌত হবার সময় তাঁরা ওই বংশের কোনো মহিলার নামে এই বালিকা বিদ্যালয়টা করে পূর্বপুরুষদের ভোগবিলাসের বস্তুটাকে সৎকাজে উৎসর্গ করে গেছেন। 

সুলতা গাঙ্গুলি এখানে হেড মিসট্রেস হয়ে এসে আজ গার্লস স্কুলটাকে আরও বড় করেছে, শুধু লাউগঞ্জই নয়—এদিকের অনেক সঙ্গতিপন্ন চাষি ও গৃহস্থও তাদের মেয়েদের বোর্ডিং-এ থেকে পড়তে পাঠাচ্ছে। ফলে ছাত্রীনিবাসেও বেশ কিছু মেয়ে থাকে। 

বকুল এখানে এসেই আশ্রয় পেয়েছে। 

সুলতাদি বলে—এখানেই থাক বকুল, মাস্টারির চাকরি একটা হবে। ততদিন মহিলা সমিতির অফিসের কাজকর্ম দ্যাখো। আর মেয়েদের ড্রিল করানোর ভারটা নাও, তোমার তো ব্রতচারী ট্রেনিং নেওয়া আছে। 

বকুল ওই হরেন ঘোষের বাড়ি থেকে এখানে বের হয়ে এসে যেন মুক্তির আশ্বাস পেয়েছে। নেত্যকালী বলে বকুলকে—কিছু টাকা হাতখরচা রাখ। আর বোর্ডিঙের খরচা যা হবে চাকরি যতদিন না পাস আমি দেব। 

।বকুল ওদের কাছে, বিশেষ করে নেত্যকালীর কাছে কৃতজ্ঞ। ওই-ই তাকে সেই নরকের জীবন থেকে উদ্ধার করে এনে এই মুক্তির সন্ধান দিয়েছে। 

বকুল বলে, 

—কিছু মাইনে তো এখন পাব মাসিমা, তোমার টাকা লাগবে না। 

নেত্য হাসে—সে আমি বুঝব রে। শোন্—এখন খাওয়া-দাওয়া কর। বৈকালে বাসায় আসবি। ওই তো আমাদের বাসা। 

বকুল ঘাড় নাড়ে। 

বাড়িতে সেই নাটকীয় দৃশ্যটা সে ভোলেনি। 

বকুল জানে গুপি মিত্তিরও সোজা লোক নয়। আর এতবড় অপমান সে চুপ করে সইবে না। বকুলের ভাবনা হয়। বলে সে নেত্যকালীকে, 

—জোর করে তুলে এনে আমাকে বাঁচালে মাসিমা, কিন্তু ওই গুপি মিত্তির কি করে আবার কে জানে? 

নেত্যকালী ফুঁসে ওঠে—ও ভারি আমার মরদ রে। যা খুশি করুক গে। আমি কারও তোয়াক্কা করি না। অন্যায় তো কিছু করিনি। 

বকুল হঠাৎ রতনকে ওদিকে যেতে দেখে দাঁড়াল। 

নেত্যকালী বাসায় ফিরে গেছে। দুপুরের স্তব্ধতা নেমেছে আমবাগানে, গ্রামের শেষপ্রান্ত তারপরই লাল-কাঁকুরে মাটির স্তর নেমে গেছে নদীর দিকে। 

রতনও শুনেছে সবই। এটা সে ভাবতে পারেনি যে তার বাবাই বকুলের এমনি সর্বনাশ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। নিজেকেই সে যেন এর জন্য অপরাধী মনে করে। 

ক্লাস-এর ফাঁকে রতন এসেছে এই দিকে 

ওপাশে মেয়েদের বোর্ডিংটা দেখা যায়। স্কুলের মাঠে মেয়েরা নেই—সবাই ক্লাসে। ছায়ানামা ঘন আম কাঁঠালের নিচে দাঁড়িয়ে রতন যেন কাকে খুঁজছে। হঠাৎ বকুলকে দেখে তাকাল। 

রতন বলে ওঠে—সব খবরই পেয়েছি। তাহলে বোর্ডিঙে এসে উঠলে? 

বকুল ম্লান-মুখে বলে—আর যাব কোথায় বলো? এখন কাজকর্ম পেলে এখানে থাকা যাবে, নাহলে বরাতে কি আছে কে জানে? আর তো দুনিয়ায় যাবার কোনো ঠাঁই দেখছি না। হয়তো এই কৃষ্ণসাগরের জলেই ডুবে মরতে হবে। 

রতন চুপ করে কি ভাবছে। 

সারামন তার গ্লানিতে ভরে ওঠে, মনের আকাশে নামে বিষণ্ণতার মেঘছায়া। অপরাধীর মতো বলে, 

—বাবা যে এইসব কাজ করতে পারেন জানা ছিল না। এত করেও বাবাকে থামাতে পারছি না। ভাবছি এবার চরম প্রতিবাদই করব। 

রতনের দিকে তাকিয়ে থাকে বকুল। বকুল আশা করেছিল হয়তো রতনই প্রকাশ্যে তার বাবার একাজে বাধা দেবে। কিন্তু তা দেয়নি, দিতে পারেনি। তাকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে গেছেন ওই মাসিমা। 

বকুল বলে—বাবার বিষয়-আশয়ের লোভে বাবাকে সমর্থন করবে বৈকি। 

রতন অস্ফুটস্বরে বলে—তা করি না বকুল। 

বকুল বলে—থাক! ওসব জেনে লাভ নেই। মাসিমা না থাকলে ওই ঘাটের মরার সঙ্গেই বিয়ে হয়ে যেত। এখন তোমার বাবা মাসিমাদের কোনো রকম ক্ষতি করে কি না কে জানে! যা লোক! 

রতন বুঝেছে এ বকুলের অভিমানের কথাই। তবু তারও করণীয় কিছু আছে বকুলের জন্য। রতন ও বাড়ির পরিবেশ বাবার ওই ব্যবসায় নামার কথাটায় সায় দিতে পারে না। 

বলে রতন—ওসব কোনো ভয় নেই। এবার বাবার সঙ্গে আমারও একটা বোঝাপড়া হবে। এ সবকিছুই অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে 

বকুল বলে—আমি যাই। 

চলে গেল সে। ওর মলিন-বিষণ্ণ মুখখানা রতনের মনে কি সাড়া জাগায়। আজ ওই বকুলও যেন জানিয়ে গেল রতনের কাছে তার আর প্রত্যাশা কিছুই নেই। তার সব স্বপ্ন হারিয়ে গেছে কি ব্যর্থতার অতলে। 

এটাকে মেনে নিতে পারবে না রতন। 

বকুল তার মনের গভীরে ঠাঁই নিয়েছে তার অজান্তেই। তাকে ভালোবাসার কথাটা গুপি মিত্তির জেনেই বকুলকে এখান থেকে দূর করতে চেয়েছিল। রতনের কাছে আজ এটা পরিষ্কার হয়েছে যে তাকে ভালোবাসার চরম মূল্য দিতে হয়েছে বকুলকেই। তাই রতনও এই ভালোবাসাকে ব্যর্থ হতে দেবে না, দিতে পারে না। 

এগিয়ে চলেছে সে বাড়ির দিকে। 

গুপি মিত্তির চোট খাওয়া সাপের মতো গর্জাচ্ছে বাড়ি ফিরে। শশীনায়েবও লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য দুপুর বেলাতেই অভুক্ত অবস্থায় সব আয়োজন ফেলে গোরুর গাড়িতে করে ফিরে গেছে তার গ্রামে। অবশ্য যাবার সময় গুপি মিত্তিরকেও দু’চারটে কথা বলে গেছে যার বিগলিত অর্থ হচ্ছে গুপি মিত্তির এখন আর কেউটে সাপ নেই, নির্বিষ ঢ্যামনা সাপ। তার পাল্লায় পড়ে নগদ পাঁচ-সাত হাজার টাকা জলে গেল, ইজ্জত গেল শশীর। 

ক’টা মেয়েছেলের দাপটে কেঁচো হয়ে গেছে সে। শেষ কথাটাই ভুলতে পারেনি গুপি মিত্তির বলে গেছে শশী নায়েব। 

—এবার আপনিও ওই শাড়ি আর চুড়ি পরে ওদের দলে ভিড়ুন মিত্তির মশাই। 

.

নিতাই ঝিম মেরে বসে আছে। 

গুপি গর্জাচ্ছে—এবার জয়েন্ট পিটিশন করব ওই ভজগোবিন্দের নামেই। হঠাৎ মতিয়াকে আসতে দেখে তাকাল গুপি মিত্তির। 

দুপুরের নির্জনতা নেমেছে। মতিয়ার আধ-আদুড় গা—যৌবনপুষ্ট দেহের দিকে তাকিয়ে গুপি মিত্তিরের জ্বালাভরা মনটা একটু শান্ত হয়। মতিয়া শাড়ির আঁচল থেকে টাকাগুলো বের করে বলে—রাখো মালিক। আর মাল আজই দিতে হবে। 

মতিয়াই বলে—উ ইস্টিশান গিন্নি কি সব ঝামেলা পাকালো মালিক। বকুলের সাদি গড়বড় করে দিল? বহুত ঝন্‌ঝটিয়া আছে উ। 

গুপি মিত্তিরের কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটে পড়েছে। 

গর্জে ওঠে সে—এবার ওকেই দেখে নেব! যা নিতাই, ওকে নিয়ে গিয়ে গুদাম থেকে দু’বস্তা চাল দে গে। মতিয়া, তোর মালের ব্যবসা জোর চলছে শুনি, টাকা তবু কম দিচ্ছিস। 

মতিয়া তাকাল নিতাই-এর দিকে। ওই চোলাই-এর ব্যবসায় নিতাইকেও কিছু দিতে হয়। সে কথাটা বলতে পারে না। 

তবু মতিয়া বলে—কই আর চলছে মালিক। দু’টিন মাল তো পড়ে আছে।

গুপির ট্রাক যায় রাতের অন্ধকারে, ওদিকে মালের দামও অনেক। 

তাই গুপি বলে—তাহলে দু’টিন মাল আজ গাড়িতে তুলে দে! তুইও কিছু পাবি। আর বেশি করেই মাল বানা—বাইরে আমিই পাঠাবার ব্যবস্থা করব। যা নিতে—হুঁশিয়ার! কিন্তু কে আবার লাগিয়ে দেবে উপরে! মতিয়া নিতাই বের হয়ে গেছে, গুপি মিত্তিরের খাওয়াও হয়নি। হঠাৎ রতনকে দেখে তাকাল। 

রতন ওই নিতাই মতিয়াকে দেখেছে বাবার ঘর থেকে বের হয়ে যেতে, আর শুনেছে বাবার চোলাই মদের ব্যবসার কথাও। ক্রমশ চমকে উঠেছে রতন। 

গুপি বলে—কাল থেকে ধানকলে বসবে। 

—না! রতনের স্পষ্ট সতেজ কন্ঠস্বরে চমকে উঠে তাকাল ওর দিকে গুপি মিত্তির। এবার তার ফেটে পড়ার পালা। গুপি ধমকে ওঠে। 

—না! না কেন? বসতে হবে তোকে। তোর ঘাড় বসবে। 

গুপি মিত্তিরের ওই বাজখাঁই গলার গর্জন দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভিতর বাড়িতেও পৌঁছেছে। কুসুম তখন বসে আছে, তার খাওয়া হয়নি। দুপুরে হঠাৎ বাবা ছেলেকে ওইভাবে 

কথা বলতে দেখে সেও বের হয়ে আসে। 

রতনের কাছে আজ তার পথটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। 

রতন বাবার মুখের উপর জানায়। 

—আপনার অন্ধকারের নোংরা ব্যবসাতে আমি নেই। আর চোলাই মদের ব্যবসাও শুরু করেছেন। ওই টাকায় আমার কোনো দরকার নেই, আপনি জেনেশুনে একটা মেয়ের চরম সর্বনাশ ও করতে গেছিলেন, ভেবেছেন আপনার টাকার জন্য আপনার সব অন্যায়গুলোকে সমর্থন করব? 

গুপি জানায়—এসব করতে হয়। বিষয়সম্পত্তি রাখতে হবে তো? 

রতন বলে—এতে আমার দরকার নেই। 

—তবে এই পিণ্ডি জুটছে কোত্থেকে হে বাপধন? গুপি মিত্তির খিঁচিয়ে ওঠে। 

রতন বলে—এখানে আর থাকছি না। চলে যাব। 

রতন মনস্থির করে ফেলেই কথাটা আজ ঘোষণা করে বেশ সতেজ কন্ঠে। 

—তাই যাও। গুপিনাথও যেন খুশি হয়ে সায় দেয়। তারপরই ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝতেই চমকে ওঠে গুপিনাথ। তার হিসাব—ওই অঙ্কগুলো ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে। ওই মহিলা সমিতি বকুলকে তুলে নিয়ে গেছে; বোর্ডিঙে রেখেছে। চাকরি দিয়ে এখানেই থিতু করবে। আর এদিকে রতনও তাকে ফেলে বাড়ি থেকে চলে যাবার কথাটা ঘোষণা করেছে। 

গুপিনাথ চিৎকার করে—অ্যাঁ! চলে যাবে। মানে? কোথায় যাবে? 

—এখান থেকে চলে গিয়ে ওই স্কুলমাস্টারি নিয়ে বোর্ডিঙেই থাকব। রতন কথাটা জানিয়ে আরও বলে। 

—এ বিষয়ে আমার দরকার নাই। এসব নিয়ে আপনিই থাকুন। 

গুপি মিত্তির এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। এ দুনিয়াকে চেনে সে। তাই সহজে কাবু হয় না। সেও এবার বীরদর্পে জানায়, 

—ঠিক আছে। তাই যাও। সাধু—সবাই সাধু, আর আমিই পাপী। এখানে থাকবে কেন? কানে-মন্তর পড়েছে ওই মহিলা সমিতির। তবে ওদের আমিও সিধে করে তোর তেল মারব, তবে আমার নাম গুপি মিত্তির। ঠিক আছে। 

রতন জবাব দিল না। বের হয়ে যাচ্ছে। 

সামনে কুসুমকে দেখে দাঁড়াল। 

কুসুম সবই শুনেছে। তার স্বামীর ব্যবসা যে বাঁকা পথে চলে তাও জানে। তার জন্য আজ বাপ-ছেলের মতান্তরে সেও দুঃখই পেয়েছে। 

কুসুম তবু বলে—এসব কি করছো বাবা রতন, 

রতন নতুন মাকে অশ্রদ্ধা করেনি কোনোদিন, দেখেছে শান্ত মেয়েটি নীরব সেবায়-মমতায় তার মনের শূন্য ঠাঁই, না পাওয়া স্নেহের অভাবকে পূর্ণ করেছে। তবু আজ রতনকে যেতেই হবে। 

বলে রতন—আমাকে বাধা দিও না নতুন মা। 

কুসুমও মনে মনে স্বামীর একগুঁয়েমিটাকে সহ্য করতে পারে না। তবু সহ্য করেছে। আজ রতনকে চলে যেতে দেখে বলে, 

—আমাকেও ফেলে চলে যাবি বাবা! আমি কী দোষ করলাম? 

রতন নতুন মায়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, 

—তোমাকে শ্রদ্ধা করি নতুন মা। মায়ের অভাব তুমি পূর্ণ করেছিলে। আজ আমার নিজের মা থাকলেও-এ অবস্থায় আমাকে বাধা দিত না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা দরকার। তাই আমাকে যেতেই হবে। 

রতন বের হয়ে গেল। 

কুসুম স্বামীর দিকে তাকিয়ে আজ অনুযোগ-ভরা কন্ঠে বলে, 

—একটা মাত্র ছেলে তার সঙ্গেও মানিয়ে চলতে পারলে না? 

গুপি গর্জন করে—কারোও ডাঁটের পরোয়া করি না। সব আমি টাইট করে দেব। চলো, খেতে দেবে চলো। 

কুসুম কান্নাভিজে স্বরে বলে—এসব ভুল করছ তুমি। ওকে ফেরাও। 

—কভি নেহি। গুপি মিত্তির রেগে গেলে রাষ্ট্রভাষা ছড়াতে থাকে। আজও সে রাজভাষাতেই জবাবটা জানিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল। 

.

কিছুদিন ধরে ব্যবসাটা বেড়ে উঠেছে, লাউগঞ্জ ইস্টিশানের পরিবেশে সন্ধ্যাটা বেশ সুন্দর। ফার্স্ট লোকাল চলে যায় বীরপুরের দিকে দুটো নাগাদ, কলকাতার দিকে যাবার ট্রেন ধরায় ওখান থেকে রাত্রি দশটা নাগাদ। লাউগঞ্জের তাবত মহাজন-গঞ্জের ব্যাপারিরা, কলকাতা যাত্রীর দল ওতেই রওনা হয়ে যায়। 

তারপর ইস্টিশানে নামে স্তব্ধতা। টিম টিম করে প্ল্যাটফর্মের শেডে একটা বাতি জ্বলে। রতিকান্তের দোকানে ক্রেতার ভিড় থাকে না। গ্রামের মতিবাবু, ললিতবাবুরা এসে গল্প-গাছা করে আর আসর জাগিয়ে থাকে দীনু খ্যাপা। লোকটা যেন এই লাউগঞ্জ ইস্টিশানের অতন্দ্র প্রহরী। শেডের একদিকে চট-কাঁথার পুঁটলিটা তোলা থাকে। সন্ধ্যার পর সেটা নামিয়ে গদিয়ান হয়ে বসে গাঁজার টান দিয়ে খ্যানখেনে গলায় হাঁক পড়ে—ব্যোম হর হর ব্যোম। 

রতিকান্তও ওকে ঝড়তি-পড়তি কিছু সিঙাড়া চা দেয়, শেষ উনুনে-ভাত চাপালে বিড়ালের মতো গন্ধ শুঁকে দীনু পাগলা বলে—কি চালরে রতি। অ্যাঁ বাস বেরোচ্ছে বাবা। বুঝছি রাঁধুনি পাগল চাল। 

রতিকান্ত ফুঁসে ওঠে—শালার আবার চালে বাহার চাই? ভাত যেন কাঁড়াচ্ছে রে! 

দীনু পাগলা হাসছে হা হা করে। তু না দিস মা জননীর হেঁসেল তো আছে রে। শ্যালা ঠ্যাটা কোথাকার। দীনুকে বাসমতি চাল দেখাস না—ঢের দেখেছি। 

ইস্টিশানে আবার স্তব্ধতা নামে। 

ইস্টিশান ঘরের মধ্যে তখনও ভজগোবিন্দবাবু হিসেব-নিকেশ করে চলেছে, লাস্ট লোকাল ট্রেন আসবে রাত্রি নটায়। তখন লাউগঞ্জ নিশুতি। লোকজন বিশেষ থাকে না, ঘরে ফেরা যাত্রী কিছু ইস্টিশানে নেমে চলে যায়। ট্রেনখানা পড়ে থাকে প্ল্যাটফরমে। ড্রাইভার-ফায়ারম্যান গার্ড যদুপতিরা ওদিকে একটা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। 

ভোরে সেই ট্রেনই আবার ফার্স্ট লোকাল হয়ে ছেড়ে যায় এখান থেকে। ভজগোবিন্দ ছোটবাবু মদনকে নিয়ে মাহুলি স্টেটমেন্ট তৈরি করছে। সময় মতো না গেলে বড়সাহেব মিঃ বোস তাড়া দেবে। এদিকে খুব কড়া লোক মিঃ বোস। টেলিফোনেও মাঝে মাঝে ওর বাজখাঁই গলার হুঙ্কার ভেসে আসে। 

—হোয়াট ডুয়িং গজাগোবিন্দ? নো স্টেটমেন্ট। ইউ সোয়াইন। 

ভজগোবিন্দকে এই বিকট কালো বার্নিশ করা লোকটা গজগোবিন্দ বলেই ডাকে, আর মদ খেয়ে দিনরাত চোখ লাল করে থাকে। হাঁকাড়ি ছাড়ে গাঁ গাঁক করে। আপিসে ওর ভয়ে সবাই অস্থির, তাই ভজগোবিন্দ এখন হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। কালই স্টেটমেন্ট পাঠাতে হবে। 

.

নেত্যকালী ক্লান্ত হয়ে বকুলকে বোর্ডিঙে গচ্ছিত করে—মহিলা সমিতির মিটিং সেরে ফিরেছে তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বিমলি দিদিমণিকে দেখে বলে– 

—কোথায় ছিলে চৌপরদিন! মুখে জল গণ্ডূষ দাওনি। ইদিকে বাবু দুবার খোঁজ নে গেছে।

—জল দে! হাঁফ ছেড়ে ভারী দেহটা মেঝেতে গচ্ছিত করে বলে ওঠে নেত্য—তা কোথায় রইলেন তিনি? অ্যাঁ সন্ধ্যাবেলায় পূজা আহ্নিক করেনি? 

—না তো! বললেন আপিসে জরুরি কাজ আছে। দেরি হবে। বিমলি কুণ্ঠিত স্বরে জানায়।

নেত্যকালী গরজায়। 

—ঝাটামারি এমন বাপের মাথায়! বামুনের ছেলে, গোঁসাই বংশের জামাই। পুজো পাঠ করবে না কি লা—ওই পোড়া ইস্টিশান মাস্টারিই করবে? অ্যাঁ! 

বিমলি জানে প্রতিবাদ করলে এখুনি তুলকালাম কাণ্ড বেধে যাবে। তাই সেও সায় দেয়—তা তো বটেই। 

নেত্য উঠে দাঁড়ায়—দেখে আসি মিন্‌সেকে। বলি এত কি কাজ তার? 

কাজ করে না ইস্টিশনে বসে গ্যাঁজায় লা? 

নেত্য বের হয়ে গেল আবছা অন্ধকারেই। 

তখন বাইরের শান্ত পরিবেশে ঝড় উঠেছে। ঝড় ঠিক নয়, একটা কলরবই উঠছে। বাতাসে ওঠে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। 

নেত্যকালী ইদানীং এ গন্ধটা বেশি করে পাচ্ছে। শুনেছে কথাটা কানাঘুষোয়, ওই মতিয়া আর বুধনদের ওখানে কি সব কাণ্ড হয়। 

আজও সেই গন্ধটা তীব্রতর হয়ে ওঠে। 

নেত্যকালীর কানে আসে স্তব্ধতা ছাপিয়ে ঢোলকের শব্দ। বেসুরো বেতালা গলায় ঢোলক পিটিয়ে ওরা বেদম হুল্লোড় করে চলেছে ওপাশের বটতলায়। 

নেত্যকালীর অসহ্য বোধহয়। ক্রমশ জায়গাটার সব শান্তি যেন ওরাই শেষ করে দিয়েছে। কি ভেবে ওই দিকেই এগিয়ে যায় সে। 

.

মতিয়া এর মধ্যেই চোলাই-এর কারবার বেশ চালু করে ফেলেছে। এ জিনিসের রসিকের অভাব নেই। মতিয়া এর আগেও গোরুর দুধের ব্যাবসা করেছে কিছুদিন। কয়েকটা গোরুকে পোষার হাঙ্গামা—তাদের খাওয়ানোর ঝামেলা অনেক। তারপর দুধ দুইয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি বয়ে দিয়ে আসতে হতো আর পয়সা পেত সেই মাসকাবারে। তাও ঠিক মতো মিলত না এত ফৈজৎ করেও। 

কিন্তু মদের ব্যবসা চালু করে দেখেছে মতিয়া এর মতো সুখের কারবার আর নেই। একটু সামলে চলতে পারলেই ব্যস। মাল বাড়িতে বয়ে দিতে হবে না। খদ্দেররাই লাইন দেবে আর টাকা বাকি বকেয়া নেই। হাতে-হাতে টাকা। 

মতিয়া পিছনের ওই আদাড় জঙ্গলে কোন্কালের একটা ধসেপড়া বাড়ির মধ্যে এটা তৈরি করে। রাতের অন্ধকারে কিছু খদ্দেরও আসে, তারাই বেশি মাল নগদ দামে নিয়ে চলে যায়। বাকিটাও উঠে যায় এখানেই। 

নেত্যকালী আবছা অন্ধকারে থমকে দাঁড়াল, ওদিকে বটতলায় বুধুয়া—শান্টিং ইঞ্জিনের ড্রাইভার গদাধর, ফায়ারম্যান মটরা, পাম্পম্যান যতীন আরও কারা জমেছে। মদের বোতল ঘুরছে ওদের হাতে-হাতে। 

গদাই বলে—জোর সে গাও ওস্তাদ। 

বুধুয়া ঢোলকে চাঁটি দিয়ে শব্দ তুলে বলে—জরুর! নাচেগা কৌন 

ফায়ারম্যান মটরা টলতে টলতে উঠে জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে। 

—হম্ নাচেগা! লাগাও। 

হাসছে ওরা গদাই হাঁক পাড়ে—মতিয়া রে! দেখছি ওকে! 

গদাই উঠে এদিকেই আসছে। 

মতিয়ার দিকে নজর পড়েছে নেত্যকালীর। এ দিকটার পড়ো জায়গায় লাউ, ধুন্দুল, আরও কি সব লতা জড়াজড়ি করে অন্ধকার করে রেখেছে। মতিয়া কোন্ পাইকেরকে এক হাঁড়ি মদ দিয়ে দামটা নিয়ে সাড়া দেয়—ক্যা রে! কাহে চিল্লাছিস? 

নেত্যকালী দেখেছে কারবারটা নিজের চোখে, রীতিমতো মদের ফোয়ারা ছুটছে এখানে, আর ওই মতিয়াই যেন এসবের মূল। আসরের মক্ষীরানি। মদ-গিলিয়ে রোজগারও করে আর ওই লোকগুলোকে হাতে রেখেছে এই জন্যই। 

ততক্ষণে গদাই মতিয়াকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। 

—তু নাই আসর জমে নাই মাইরি। 

হাসছে স্মৈরিণী মেয়েটা। আবছা আলোয় দেখা যায় ওর মাংসল যৌবন-মদির দেহটা যেন কানায় কানায় উপচে উঠেছে। 

চিৎকার করে গদাই—লাগাও ওস্তাদ, নাচবার লোক এনেছি! 

মতিয়া হাসছে—অ্যাই! 

গদাই বলে—তোকে ছাড়ব না মাইরি, অ্যাই মতিয়া। 

হুল্লোড় চলেছে, মদের ঘোরে চিৎকার করছে ওরা। 

হঠাৎ একটা চাপা-গর্জন শুনে তাকাল ওই লোকগুলো। বুধুয়া বলে ওঠে। 

—মাজি। 

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে পড়ছে। গজরাচ্ছে বুধুয়া। 

—অ্যাই, খাড়া করে দে। 

মতিয়াও দেখছে নেত্যকালীকে, সে মদ বেচে মাত্র, মদ খায় না। তাই ওই নেশাখোর লোকগুলোর থেকে মতিয়া আরও সচেতন। ধূর্ত মেয়েটা নেত্যকালীকে এসময় এখানে আসতে দেখে একটু যেন বিপদে পড়ে। নেত্যকালী ধমকে ওঠে। 

—কী হচ্ছে এখানে? এটা ভদ্দরলোকের জায়গা না তাড়িখানা? 

অ্যাঁ—মদ গিলে কী করছিস এখানে? 

বুধুয়া অনেক চেষ্টায় দুটো হাতজোড় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মদের ঘোরে হাত-পা সব যেন অবাধ্য হয়ে উঠেছে। গদাধরই জানায়। 

— কাজকামের পর একটু রামধুন গাইছি মাজি। 

নেত্যকালী বলে—ওই তোদের রামধুন? অ্যাঁ! মদ গিলে বেলেল্লাপনা ঘুচিয়ে দেব! যত নষ্টের মূল ওই ছুঁড়িটা! কসবি কোথাকার! 

মতিয়া বুঝেছে এবার আক্রমণটা তার দিকেই আসছে। তাই ফুঁসে ওঠে মতিয়া—আমি কি করলাম? যাতা কাহে বলবেন? 

নেত্যকালী ওই জবাবটা সহ্য করতে পারে না। গর্জে ওঠে, 

—কি করিস সব জানি! এত বাড়াবাড়ি আর সইব না। অনেক সয়েছি। মদের ভাটিখানা বসাবি এখানে—এই ভদ্দরলোকের বাড়ির পাশে, চুপ করে সইব? 

মতিয়া জানে তার খুঁটির জোরও কম নয়। এসব সেও গায়ে মাখে না। সেও সমান তেজে ফুঁসে ওঠে, 

—কী করবেন আপনি? অ্যা—শির তোড়িয়ে দেবেন? ঝুটমুট মিছা কথা কাহে বলবেন? অ্যাঁ- 

নেত্যকালীর গলা শুনে বিমলিও বাসার দরজার বন্ধ করে পায়ে পায়ে এখানে এসে হাজির হয়ে ওই মদো-মাতালের কাণ্ড দেখে বলে— 

দিদিমণি। চলে আসুন। দেখছেন না মদ গিলে বেটোর হয়ে আছে ওরা। 

চলে আসুন। 

মটর গর্জে ওঠে—হ্যাঁ। তাই যান। আমরা যা করছি আপনি তাতে বাত করবেন কেনে? অ্যাই মতিয়া চালা নাচ। ধরো ওস্তাদ- 

নেত্যকালী বিমলির সামনে পিছু হঠতে ‘রাজি নয়। 

নেত্যকালী ফুঁসে ওঠে—খবরদার। চেল্লাচেল্লি চলবে না। মদ-ফদ হঠা এখুনি; মতিয়া, সামলা ওসব। ফের যদি দেখি ভালো হবে না। 

মতিয়া শোনায়—যা খুশি করবেন আপনি? আবে বুধুয়া, বাজা ঢোলক। চালা বে গানা – নেত্যকালীর মুখের উপরই ওরা মদের বোতল খুলে গিলতে থাকে, আর জেদ করেই মতিয়াও এবার নাচতে থাকে। ঢোলক বাজছে। ওরা জোর দেখিয়েই তাদের যা খুশি করার অধিকারকে এখানে কায়েম করতে চায়। 

নেত্যকালী গজরাচ্ছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মতিয়ার কাজ কারবারও কিছুটা দেখেছে সে। নেত্যকালী হনহন করে এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে, বিমলি জানে এসময় ওকে পিছু ডাকা চলবে না। কোন শুভকাজেই চলেছে দিদিমণি, সেও বাধ্য অনুগতের মতো ওই আবছা অন্ধকারেই দিদিমণির পিছনে চলেছে। ভজগোবিন্দকে ডাকতে এসে হঠাৎ এখানে ওইসব দেখে চটে উঠেছে নেত্যকালী। ভজগোবিন্দের কথা এখন আর মাথায় নেই। এখন এই বাঁদরামির প্রতিবিধান করার কথাটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। 

নিতাই-এর চোখ-কান সবসময়েই খোলা। তার দু’একটা চর অনুচরও সর্বত্রই ছড়ানো থাকে, বিশেষ করে এই পড়ো ঠাঁইটার আনাচে-কানাচে। কারণটা সে জানে। ঐ মতিয়ার থেকে নিতাই আরও বেশি ধূর্ত। 

তাই এই গোলমালের খবরটা তার কানে পৌঁছাতেই নিতাই সজাগ হয়ে ওঠে। গোবরা অন্ধকারে এসে খবরটা দিতে নিতাই চমকে ওঠে—অ্যাঁ। ওই ইস্টিশান গিন্নির সঙ্গে বাধালো আবার? উঃ হাড়মাস জ্বালিয়ে দিলে ওই ইস্টিশান গিন্নি। তা তিনি গেলেন কোন্‌দিকে দ্যাখ। এসে এখুনি খবরটা দে। 

গোবরাও বের হয়ে গেল। নিতাই ভাবনায় পড়েছে। গুপি মিত্তিরকে জব্দ করেছে ওই ইস্টিশান গিন্নি। ছোটবাবুও ঘর ছেড়ে গেছে। আটকাতে পারেনি তাকে গুপি মিত্তিরের মতো জাঁহাবাজ বাপও। এবার যদি আবার কোনো গণ্ডগোল পাকায় ওই ইস্টিশান গিন্নি তাহলে গুপি মিত্তির নিতাইকেও ছেড়ে কথা কইবে না। 

কি ভেবে নিতাই নিজেই বের হলো ধানকলের আস্তানা ছেড়ে। সাবধান হওয়া দরকার। 

.

মতিয়াদের কলরব সমানে চলেছে। গদাই বিজয়ী বীরের মতো বলে, দেখলি তো ক্যামন হঠিয়ে দিলাম ইস্টিশান গিন্নিকে। বলে কিনা এখানে হুল্লোড়-করা, মদ খাওয়া চলবে না। 

যতীন পাম্পম্যান বলে ওঠে—এটা ওর জায়গা? রীতিমতো রেলকোম্পানির জায়গা। নাচব—বেশ করব। মতিয়া—একটু দ্যাক আমাকে মাইরি! 

মতিয়া হাসছে, সারা দেহে ঝড় তুলে বলে, 

—অ্যাই থাম হতভাগা। মেয়েছেলে দেখিসনি কখনও! 

—তোর মতো মেয়েছেলে দেখিনি রে! তোকে দেখলে বুকে ফাইভ হর্স-পাওয়ার ইঞ্জিনের পিস্টন চলে যায় রে! 

যতীন টলছে। 

হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে নিতাইকে ঢুকতে দেখে তাকাল গদাই। 

—এসো গুরু, নিত্যানন্দ প্রভু। এক ঢোক পেসাদ করে দাও মাইরি 

মতিয়ার হাতের তাজা মাল। 

নিতাই মতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে—কী করেছিস? পুলিশে খবর গেল কী করে? থানা থেকে আসছে ওরা এখানে বোধহয় তল্লাশি চালাবে। 

—অ্যাঁ! মতিয়ার খেয়াল হয়। 

বুধুয়া গর্জে ওঠে—ক্যা করেগা! করনে দেও তল্লাশি। হম্ তৈয়ার হ্যায়! 

নিতাই ওকে চুলের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়ে বলে। 

—মালপত্র পেলে তোকেও টেনে নে যাবে, হাতে-নাতে ধরতে পারলে জেল হয়ে যাবে। চাকরিও চলে যাবে। 

বুধুয়া কঁকিয়ে ওঠে জেলের কথা শুনে। পুলিশকে তারও খুব ভয়। সেই ভয়ের-চোটে তার নেশা ছুটে গেছে। এবার ভীত আর্তস্বরে বলে। 

কি কি হোবে নিতাই দা? অ্যা মতিয়া! 

নিতাই গর্জায়, ছিঃ ছিঃ এইসব হুল্লোড় করছিল লোকে জানতে পারবে না, এখন সামলা। যা মালপত্তর আছে এখুনি পাচার করে দে। 

বুধুয়া কঁকাচ্ছে—কুছতো কর এ গদাই। আরে মতিয়া! ক্যা সত্যনাশ হো গিয়া। আরে বাবা পুলিশ আয়েগি! 

গদাই এগিয়ে আসে, বিপদের গুরুত্ব সেও বুঝেছে। 

বলে সে—মতিয়া, মালের বোতল টিন-ফিন যা আছে দিয়ে দে। মটরা, ওসব নিয়ে গিয়ে ইঞ্জিনের কয়লার নিচে রাখ, যতীন তুই হঠিয়ে নিয়ে গিয়ে পাম্পরুমের ট্যাঙ্কির মধ্যে সরিয়ে দে। 

নিমেষের মধ্যে মতিয়াকে বাঁচাবার জন্য ওরাও যেন প্রাণ দেবার জন্য তৈরি হয়। মতিয়াও কাজে লেগে গেছে। আদাড়-পাঁদাড়ের মাল—হাঁড়ি—চোলাই-যন্ত্র সব নিরাপদ স্থানে চালান করার পরই পুলিশ এসে পড়ে দলবল নিয়ে একবারে এই বটতলাতেই। 

.

ভজগোবিন্দবাবু ইস্টিশান ঘরে কাজ করছে। ন’টার লাস্ট ট্রেন তখন এসে গেছে। এবার রাতের স্তব্ধতা নেমেছে। যাত্রীরাও চলে গেছে যে-যার বাড়িতে। 

রতিকান্ত খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে এবার ঝাঁপ বন্ধ করবে। দীনু পাগল আজ ছাড়েনি। সেও ওই রাঁধুনিপাগল চালের ভাত সাকিতে নিয়ে মুখ ভেঙচে ওঠে—হ্যাঁ শালো রতে, ই তোর ‘আধুনি পাগল’ ইতো গুপি মিত্তিরের গুদোম ছাঁট দেওয়া পচা চাল রে! মানুষে খেতে পারে?

রতি বলে—ভিক্ষের চাল কাঁড়া আর আকাড়া। দিলাম খেতে তা কত ব্যাখানা! ভাগ্‌ শালা।

দীনু পাগল হাসে, বলে সে—এককালে কি খেয়েছি জানিস? কবজিভোর মাংস, অড়হর ডালে আঙুল চুবিয়ে দেখতাম ঘি কতটা আছে—তবে খেতাম। তু শ্লা সে খাওয়ার মম্মো কি বুঝবি র‍্যা? তু তো পিঁপড়ের পোঁদ টিপে খাস। 

দীনুর বোলচাল এমনিই লম্বা লম্বা। 

হঠাৎ অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে ভারী জুতোর মমস্ শব্দ শুনে দীনু চাপা স্বরে বলে—কারা এল রে রতি? 

রতিকান্তও একটু ভয় পেয়ে যায় সামনে দারোগাবাবুকে দেখে। অশ্বিনী দারোগা বেশ ডাঁটো পুরু জাঁদরেল ব্যক্তি, পাতটাঙ্গির মতো ইয়া একজোড়া পুরুষ্ট গোঁফ আর চোখ-দুটো নাকি বিড়ালের চোখের মতো অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে। 

টর্চের জোরালো আলো ফেলে দারোগা হুঙ্কার ছাড়ে। 

—মতিয়া কোথায় থাকে? ওই বুধন? 

রতিকান্ত অন্ধকারে ওপাশের একটা আলোর নিশানা দেখিয়ে বলে—এই তো ওদিকে! 

আবার হুঙ্কার ওঠে—বড়বাবু কোন্‌খানে? 

—আজ্ঞে ইস্টিশানঘরেই রয়েছেন দেখলাম। 

রতিকান্ত মিনমিন করছে। দারোগাবাবু ওদিকে এগিয়ে গিয়ে ভজগোবিন্দকে ঘর থেকে বের করে বলে—চলুন আমার সঙ্গে। আপনার ইস্টিশানের লোকজন কি সব করে আপনি জানেন না? অ্যা—মদের ভাঁটি বসেছে এখানে খবর পাই? 

ভজগোবিন্দ অবিশ্যি কথাটা ভেবেছে আগেও। 

বুধনকে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল তার। সব সময় লোকটা মদ পায় কোথায়? শুধু বুধনই নয়, ওই যতীন পাম্পম্যান, গদাধর, মটরা—মায় লাস্ট লোকালের ড্রাইভার ফায়ারম্যানরাও ট্রেন ছেড়ে ওই মতিয়ার আড্ডাতেই যায় হইচই করে। নিশ্চয়ই কোনো কাণ্ড ঘটে ওখানে। 

ভজগোবিন্দও বলেছে বুধনকে—এত মদ খাসনি বুধন! 

গদাধরকেও এর আগে সাবধান করেছে। মদ খেয়েই সেবার দু’জনে গোটা ট্রেনটাকে ভুল পয়েন্ট দিয়ে আর না দেখে চালিয়ে সিধে নদীর গর্ভে নিয়ে যাচ্ছিল। 

আজ দারোগাবাবুর কথায় মনে হয় মদ তাহলে এখানেই তৈরি হয়। তবু ভজগোবিন্দ বলে—ওসব তো ঠিক জানি না দারোগাবাবু! 

অশ্বিনী দারোগা গম্ভীর ভাবে বলে—এবার জানবেন। আপনিও এনকারেজ করেন মশায়, নাহলে আপনার ইস্টিশানের নাকের উপর এসব বেআইনি কাজ হয় কী করে? 

ততক্ষণে অবশ্য করে কয়েকবার বাঁশি বাজিয়ে অন্ধকারে অশ্বিনী দারোগা হুঙ্কার ছাড়ে—কোম্পানি টেনশন! 

তিন চারজন লাঠিধারী সিটকে লম্বা—বেঁটেখাটো—টাকমাথা লাঠিধারী কনেস্টবল বটতলায় এসে দাঁড়িয়েছে। 

ভজগোবিন্দ দেখছে ওরা বন-বাদাড় ঠ্যাঙাচ্ছে, টর্চের আলো ফেলে এদিক-ওদিকে দেখছে। অশ্বিনী দারোগা মতিয়ার সামনে বেশ ব্যাকরণ বহির্গত ভাষায় বিশেষণ প্রয়োগ করে বলে, 

—কোথায় মদ আছে বল? অ্যাই 

মতিয়ার তখন অন্য মূর্তি! দু চোখে দর-দর ধারায় জল নেমেছে। বুধুয়া জোড়হাতে রামভক্ত হনুমানের মতো বসে পড়ে বলে চলেছে, 

—গরিব আদমি হুজুর। নোকরি করি খাই! এসব বুরা কামে নাই। দারোগা গর্জন করে চলেছে।

—এ লোকগুলো এখানে কেন আসে? এ্যাই? 

গদাধর, মটরা ভেগেছে। যতীন—লাস্ট লোকালের ড্রাইভার ফায়ারম্যান তখন সকলে ধরা পড়ার ভয়ে এন্তার গিলে ফেলে আর সামলাতে পারেনি। বমি করে বসে আছে। 

মতিয়া বলে কান্নাভেজা গলায়। 

—ওরা মাল শহর থেকে আনে, এখানে বসে খায়, চেনা জেনা লোক, আমি স্রেফ দুধের কারবার করি হুজুর। ওই দুটো গোরু আছে—দ্যাখেন! ঐসব ঝুট বাত হুজুর! 

নিতাই-এর হাতের গুণ—আর ম্যানেজ করার জন্যই বোধহয় ছোট দারোগাবাবুও ঝোপঝাড় থেকে শূন্য হাতে বের হয়ে বলেন 

—নাঃ। এসব কিছু নাই স্যার! তবে বাইরে থেকে মাল এনে গেলে এখানে! 

অশ্বিনী দারোগা হুঁশিয়ার করে মতিয়াকে। 

—আর এখানে মদের আড্ডা বসাবে না। কোনোরকম হইচই করবে না। খবরদার যেন এসব না শুনি আর ছোটবাবু এখানে এবার ডিউটি দিতে এসে একবার করে ঘুরে যাবেন। যদি কাউকে মদ গিলে হইচই করতে দ্যাখেন তুলে নিয়ে যাবেন থানায়। 

আর ভজগোবিন্দবাবুকেও বলে যায়—আপনিও দেখবেন! চলো— 

অশ্বিনী দারোগা দলবল নিয়ে চলে যায়, ভজগোবিন্দও ইস্টিশান ঘরে ফিরে এসে তালাবন্ধ করে বাসায় চলেছে। 

অন্ধকারে কুপিটা জ্বলছে। ক্রমশ গদাধর মটরাও ফিরে আসে! গদাধর বলে—শ্যা দারোগা তোকে ধরতে পারবে আমরা থাকতে? কভি নেহি। 

মটরা সায় দেয়—জান লড়িয়ে দেব না? 

বুধন ঘাবড়ে গেছে। এমনিভাবে পুলিশ এখানে হানা দেবে তা ভাবতে পারেনি। 

বুধন বলে—ই কাম ছেড়ে দে মতিয়া, পুলিশ মালুম পেয়ে গেছে। কোই রোজ পাকড়ে লিবে। কৌন শ্লা চুকলি খেয়েছে। 

মতিয়া নীরব রাগে ফুঁসছে। তার মনে অন্য ভাবনা। 

গর্জায় সে–কে পুলিশে খবর দিয়েছে তা জানি! 

—কৌন! বুধন অবাক হয়। 

মতিয়া গর্জে ওঠে—ওই ইস্টিশান গিন্নি! ওকে আমি ভি ছাড়ব না। 

নিতাইও ব্যাপার সামাল দিয়ে এসে পড়ছে। বলে সে—মালপত্র আজই সরিয়ে দে। দিনকতক চুপচাপ থাক মোতিয়া। 

মতিয়া গর্জাচ্ছে—ওই ইস্টিশান গিন্নিই ইসব করল। উকে আমি দেখে লিব! এইসা পিছু 

লাগবে কাহে? 

গদাই, মটরা, যতীনও সায় দেয়। 

—হ্যাঁ, ঠিক কথা! 

বুধুয়া চুপ করে কী ভাবছে। নিতাই ব্যাপারটা শুনে অবাক হয়। 

—এখানেও ওই মাস্টার গিন্নি! 

নিতাই-এর মনে হয় ওই মহিলার জন্য এবার যেন তারও বিপদ ঘনিয়ে আসবে! 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *