১
ছোটলাইনের ট্রেনটা ঢিকিয়ে গড়িয়ে চলেছে, ভোরবেলায় কাক-কোকিল ডাকার মুখে বীরপুর জংশন থেকে বড় লাইনের ট্রেনের ঝড়তি-পড়তি যাত্রীদের কুড়িয়ে সদর শহর বীরপুর থেকে বের হয় ট্রেনটা এই লাইনের শেষ ইস্টিশান লাউগঞ্জের দিকে। প্রায় তিরিশ মাইলের যাত্রাপথ, আর পথে দু-দশটা ইস্টিশান আছে, আর কারণ-অকারণে রাঢ়ের ধু-ধু মাঠের বুকে একটা টিনের চালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
কিছু যাত্রী—আনাজপত্রওয়ালা ফড়ে—কিছু গ্রাম থেকে আসা আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে জবুথবু বুড়োবুড়ি ওঠে। চেকার গিরিশবাবুর শ্যেনদৃষ্টি তাদের উপর নিবদ্ধ থাকে।
এই মাঝ মাঠের ইস্টিশানগুলোকে ওদের ভাষায় বলা হয় হল্ট। এদের টিকিট কাটে খোঁজ নিয়ে গিরিশচন্দ্র, অবশ্য পয়সাটাই নেয়-তেমন যাত্রী দেখলে টিকিট দেয়, নাহলে দেয় না।
এ নিয়ে গিরিশবাবুর বদনামও আছে। এই লাইনে ওই ঘুণধরা বুড়ো গিরিশ পুরনো লোক।
টিং টিং-এ প্যান্ট পরে, মাথায় টিকিতে একটা শুকনো ফুল বাঁধা। কালো কোট দীর্ঘদিনের ব্যবহার রোদে-জলে ঘামে-বিবর্ণ হয়ে নিজস্ব একটা বর্ণ আর গন্ধ নিয়ে গিরিশবাবুর শ্রীঅঙ্গে বিরাজ করছে।
গিরিশবাবু বলে—কোম্পানি মাইনে দেয় কত বাবা? আর বাজার? সে তো লাফিয়ে উঠছে— —তাহলে বলো সমতা রেখে চলতে গেলে কি করণীয় হে যশোদা?
….গার্ড যশোদা আর চেকার গিরিশ দু’জনের অবশ্য কিছু বখরার ব্যাপার আছে। ড্রাইভার যদুপতি গজগজ করে।—
ভাগ না দিলে হল্ট ইস্টিশানে দাঁড়াইয়ে আবার সিটি বাজাই গাড়ি ছেড়ে দিব হে! প্যাসেঞ্জার উঠল না উঠল আমার কাঁচকলাটি হে মামু!
গিরিশ চেকারকে এই লাইনে সবাই এই মামা নামেই ডাকে। কোন্ সুবাদে যে ওই ডাক তা কেউ জানে না। গিরিশ তাতেই চটে কাঠ। তবু যদুপতিকে চটাতে সাহস নেই তার। লোকটা কাঠগোঁয়ার আর তেমনি মাতাল!
লাউগঞ্জ পৌঁছে দিনের বেলাতেই মদ গিলবে ওই মতিয়ার ঝুপড়িতে বসে আর খোঁজখবর করলে ইঞ্জিনের কয়লার গাদায়—না হয় জলের ট্যাঙ্কের নীচে দু-একটা চোলাইয়ের দড়িবাঁধা বোতলও বের হবে।
যদুপতিকে দুটো টাকা দিয়ে গিরিশ বলে—নে বাবা।
যদুপতি টাকা দুটো তেলকালি-মাখা প্যান্টের পকেটে গুঁজে নারকেল পাতা বাঁধা স্টিম হুইসেলটায় টান দিতে আধমরা ইঞ্জিনটা ক্ষীণ আর্তনাদ করে কঁকিয়ে ওঠে।
গিরিশ বলে—এরপর করজোড়া হল্টে বিয়ের বরযাত্রী উঠবে, লগনসার বাজার, একটু টাইম রেখো যদু।
…যদুপতি গজরায়—বিয়ের বরযাত্রী, ভাগ দিতে হবে মামা, নাহলে বরকে ফেলেই বরযাত্রী নে চলে যাব—বুঝবা মজা।
গড়িয়ে গড়িয়ে মাঠ—রাঢ় অঞ্চলের তাবৎ যাত্রী কুড়িয়ে ফার্স্ট লোকাল যখন ইন্ করছে লাউগঞ্জ ইস্টিশানে তখন বেলা হয়ে গেছে।
সামনে নদী, খরার সময় বালিখাতে ঝিরঝিরে জল বয়, নদীর ধারে অর্জুন, বাঁশবন—শুকনো অশ্বত্থগাছের ছায়ারেখা উঁচু পগারে সারবন্দি তালগাছ-এর প্রহরা। লাল ডাঙার ওদিকে লাউগঞ্জ ইস্টিশানের সিগন্যালটা কেঁপে কেঁপে ঘাড় কাত করে নামছে, অর্থাৎ ফার্স্ট লোক্যালকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
পয়েন্টের মুখে এসে যদুপতি ইঞ্জিন থেকে আধখানা দেহ বের করে সামনে মতিয়াকে দেখে হাত নাড়ে।
—আগিয়া মতিয়া।
মতিয়ার টানটান গতর, টানা চোখ—ডাগর পুরুষ দেহ। আর ওর অনাবৃত নিটোল মাংসল হাত দুটো ‘যদুলালের মনে গোলাবি আমেজ আনে’ ওদিকে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পয়েন্টম্যান বুধুয়া।
দাঁড়াবার সাধ্য তার নেই, টলমল করছে। সকালেই সে মতিয়ার চোলাই-এর নতুন পরখ করেছে বোধহয়। রোজই করে।
আসলে লাউগঞ্জ বীরপুর লাইট রেলওয়ের খাতায় বুধুয়ার নামটাই লেখা আছে পয়েন্টম্যান হিসেবে।
কিন্তু সজ্ঞান অবস্থায় বুধুয়াকে প্রায়ই পাওয়া যায় না। সেবার ফার্স্ট লোক্যাল-এর পয়েন্ট দিয়ে ট্রেনখানাকে বীরপুরের দিকে না পাঠিয়ে সোজা গুপি মিত্তিরের ধানকলের সাইডিং-এ দিয়ে দিয়েছিল আর গদাধর ড্রাইভারও চোখ-বুজে সেই ট্রেনখানাকে সিধে নিয়ে গিয়ে ধানকলের পেছনের বাফারেই ভিড়িয়ে দিয়েছিল আর কি?
মহা কেলেঙ্কারি!
কোনরকমে ইস্টিশান মাস্টার ভজগোবিন্দবাবুই বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওদের। অবশ্য তারপর থেকে গদাইকে দিয়েছে ওই সান্টিং ইঞ্জিন চালাতে এখানে আর বুধুয়ার চাকরিটা রয়ে গেছে ওই মতিয়ার জন্যই।
এখানের গ্রামসভার মাতব্বর-ধানকল মালিক গুপি মিত্তির মতিয়াকে একটু নেক-নজরে দেখে। তাই মতিয়ার স্বামী বুধুয়াকে সেবারের মতো মাফ করা হলো। তবে এখন মতিয়াই পয়েন্ট দেয় বেশির ভাগ সময়। …ইঞ্জিনটার স্পিড কমিয়েছে যদুপতি। মতিয়া এসে উঠেছে ইঞ্জিনে। যদুপতি বলে—এবার তোকে ইঞ্জিন চালানোও শিখিয়ে দেব মতিয়া। মতিয়া গা-গতর নেড়ে বলে—গদাই ভি বোলে। ছোড় উ গাড়ি চালানোর বাত। বহুত ঝামেলা—আগুন কা সাথ লড়াই।
যদুপতি লুব্ধ-দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে—তা সত্যি। ইঞ্জিনের তাতে তোর সোনার অঙ্গ পুড়ে কালি হয়ে যাবেক মাইরি।
মতিয়া হাসে—তাই নাকি রে! খুব যে ভাবনা তোর?
যদুপতি বলে—হবে না! তু কত সোন্দর মাইরি।
—হ্যাঁ!
মতিয়া খিলখিল করে হাসছে, হাসছে নয় যেন যদুপতির সামনে ইঞ্জিনের বয়লারের মুখটা কেউ খুলেছে—আর ঝলকাচ্ছে আগুনের ফুলকি-উত্তাপ। এ আগুন ওর সারামনে জ্বালা ধরায়।
ট্রেনটা এসে লাউগঞ্জ প্ল্যাটফর্মে থামল।
ভজগোবিন্দ দেখছে মোতিয়াকে, ইঞ্জিন থেকে নামছে সে।
.
ভজগোবিন্দ চট্টরাজ লাউগঞ্জ ইস্টিশানের স্টেশনমাস্টার, সহকারী মদনবাবু ওদিকে আপ লোকালের বুকিং নিয়ে ব্যস্ত।
রাঢ়-এর বিস্তীর্ণ এলাকার একমাত্র যাতায়াতের পথ এই রেলগাড়ি। মাঝে কয়েকটা নদী, বিল পড়ে। কুয়ে ময়ূরাক্ষী দ্বারকা—অজয়-এর বাড়তি জল ঠেলেঠুলে এই অঞ্চলের চারিদিকে ঢুকে পড়ে। নিকাশি ব্যবস্থা তেমন নেই, ফলে অনেক জলা-বিল গড়ে উঠেছে, আর আছে মাঠগড়ানি জলের প্রবহমান ছোট-বড় কাঁদর।
ফলে সদর শহর বীরপুরের সঙ্গে যাতায়াতের পাকা রাস্তা তেমন কিছু নেই। একটা খোয়া-ঢালা সড়কের মতো আছে, কিন্তু নদীনালা বিলের জন্য সে রাস্তা পাকা হয়নি। গাড়িও চলে না।
যদিও প্রতিবার ভোটের সময় এ নিয়ে অনেক আসর গরম করা লেকচার হয়, শোভাযাত্রাও বের হয়, আবার ভোট ফুরিয়ে গেলেই সব ঠাণ্ডা। ফলে এই ছোট লাইনই এ অঞ্চলের একমাত্র যোগাযোগের পথ। লাউগঞ্জের চারিপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে আসে বজরাবন্দি তরি-তরকারি, দুধ-ছানা আর এদিকের মাঠে হয় প্রচুর ধান-গম। সে-সবও ওয়াগনবন্দি হয়ে চালান যায়, মালপত্রও আসে ট্রেনে এ এলাকার অন্য সবকিছুই। ফলে লাউগঞ্জ ইস্টিশানের নামডাক আছে।
ভজগোবিন্দ তাড়া দেয়—ওহে যদুপতি, আধঘন্টা লেট হয়েছে, এদিকের লোকাল ছাড়ব এখুনি।
মালপত্র উঠছে, গার্ড যশোদা গুনছে বাজরা, ছানার টিনগুলো, সেই হিসেবে বুকিং ছাড়াও বাড়তি হিসাব একটা থাকে মালবাবুদের, মহাজনদের কাছ থেকে সেটা আদায় হয় অলিখিত নিয়মেই। আর সেই টাকাটার হারাহারি ভাগ পায় গার্ডসাহেবও।
গিরিশ দেখে মাত্র।
তার আমদানি ওই রোডসাইড থেকে।
যশোদাবাবু বলে—ছাড়ছি ভজগোবিন্দবাবু, মালপত্র গুনতি করে নিই আগে।
গাড়ি ছাড়বার সময় পার হয়ে গেছে। যাত্রীদের অনেকেই তাড়া দেয়। ও মাস্টারমশাই।
ভজগোবিন্দ খুঁজছে বুধুয়া, পোর্টার রতনকে। টাক ঘামছে তার।
চিৎকার করে—ওহে মদন। মাল বুকিং বন্ধ করো। বলে দাও পরের গাড়িতে মাল যাবে। এখন নো এস্পেস। গাড়ি ছাড়তে হবে।
মালপত্র আর বুকিং-এর বাকি নেই।
বুধুয়া রতনকে দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার যদুপতিও নেই। তাই ওদের খুঁজছে সে। যাত্রীদের সামনে ওইসব হাঁক-ডাক করে কোনোরকম কোর্ট বজায় রাখে মাত্র।
স্টেশনের শেডের একপাশে রতিকান্তের চায়ের স্টল। রেল কোম্পানির কাছে লাইসেন্স নিয়েই স্টল করেছে সে। লাউগঞ্জের অনেকেই আসে চা-খেতে খবরের কাগজ পড়তে। সেটা অবশ্য বৈকালের দিকে।
এখন যাত্রীদের ভিড়ই বেশি—ফড়ে-মহাজনরাও চা-বিস্কুট সিঙাড়া রসগোল্লা খায়। ট্রেনের দেরি হলেই রতিকান্তের লাভ, তবু খদ্দের কিছু পাবে। সে আর দোকানের ছেলেটা বদন এন্তার চা-সিঙাড়া বেচে চলছে।
এ ট্রেন চলে গেলে দু’তিন ঘন্টা মাছি উড়বে, বিক্রিও হবে না, দুপুরের দিকে কে আর চা খাবে। ফলে রতিকান্ত খুশি।
ভজগোবিন্দ চরকির মতো এদিক ওদিকে ঘুরছে। বটতলা-কৃষ্ণচূড়া-আমগাছের নীচে, কোথাও ড্রাইভার যদুপতির পাত্তা নেই।
চায়ের দোকানের বদনই সুধায়!—কাকে গোরুখোঁজা করে খুঁজছ গো মাস্টারবাবু?
—যদুপতিকে দেখেছিস? কোথায় যে যায়? ভজগোবিন্দ বলে।
বদনা খবরটা দেয়।
—ওদের দেখলাম উদিকে, প্যাজি আর আলুর চপ দে এলাম, ওই বটতলায় রইছে গো।
—তাই নাকি! উঃ হাড়মাস জ্বালিয়ে দিলে!
ভজগোবিন্দ দৌড়ালো ওই বুধুয়ার আস্তানার দিকে।
রতিকান্ত দেখেছে ব্যাপারটা। বদনই যদুপতির সন্ধান দিয়েছে ভজগোবিন্দবাবুকে। এবার হাতে-নাতে ধরে টেনে এনে যদুপতিকে ইঞ্জিনে তুলে গাড়ি ছাড়বে। তারও বিক্রি বন্ধ। এখনও গণ্ডা দশেক সিঙাড়া আছে—চপও রয়েছে কিছু। সব পড়ে পড়ে বাসি হবে। গাড়ি চলে না গেলে আর কিছু সময় পেত, সেগুলো উঠে যেত। কিন্তু বদনার জন্যই তা হলো না।
গর্জে ওঠে রতিকান্ত—অ্যাই বদনা, তোকে দালালি করতে কে বলেছে রে? যে যেখানে থাকে থাকুক—তোর কী? মারব এক থাপ্পড়!
থাপ্পড়ের ভয়ে বদনা একটু ঘাবড়ে গিয়ে চিঁচিঁ করে।
–শুধুলে—
—থাম! ধমকে ওঠে রতিকান্ত। বলে—যা বাকি সিঙাড়া কনসেশন করে ঝেড়ে দে গে। চার আনায় তিনটের দর।
ইস্টিশানের আশপাশে বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকাই পড়ে আছে। ঝোপঝাড়—আগাছার জঙ্গল। এদিকে ভজগোবিন্দ আর ছোটবাবুর কোয়ার্টার, আর ওপাশে ওই গাছগাছালির ধারে বুধন পয়েন্টম্যান যতীন—শান্টিং ড্রাইভার গদাধর, ফায়ারম্যান মটরের এক ধারের বাসা। তবু বুধন ওই একটা ঘর নিয়েই খুশি হয়নি। আশপাশের জায়গায় কয়েকটা ঝুপড়ি তুলেছে, গোরু বাছুর আছে—আর নাকি অন্য কারবারও তার আছে।
সামনে একটা বটগাছের নীচেটায় বুধুয়ার বউ মতিয়া সাফসুতরো করে নিকিয়ে রাখে।
ওখানেই বসেছে, এদের সাময়িক আড্ডা। ড্রাইভার যদুপতি—বুধয়া—যতীনও আছে, সামনে শালপাতায় আলুর চপ-সিঙাড়া মুড়ি আর বোতলের সঙ্গে গেলাসটাও ওদের হাতে হাতে ঘুরছে। মতিয়া গোরুদুটোকে খড়-জাব দিতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে ধমকায় বুধুয়াকে।
—আউর গিলবি না, অ্যাই? ডিউটি দিতে হবে না অ্যাঁ!
বুধুয়া তখন মৌজ হয়ে গল্প জুড়েছে।
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ভজগোবিন্দকে আসতে দেখে তাকাল বুধুয়া। ভজগোবিন্দকে দেখে যতীন হাতের বোতলটা পিছন দিকে রাখবার চেষ্টা করে বলে ওঠে—মাস্টারবাবু!
ভজগোবিন্দ চটে ওঠে। বেশ কড়াস্বরেই বলে।
—অ্যাই যদুপতি, ওদিকে গাড়ি আর কত লেট করবে?
চলো—
যদুপতি বলে—যাচ্ছি বড়বাবু! ইঞ্জিনে জল-কয়লা না দিলে গাড়ি চলে না। প্যাটে কিছু না পড়লে দেহটাও চলবে কেনে বলুন?
ভজগোবিন্দ এতবড় যুক্তিপূর্ণ কৈফিয়তে খুশি হতে পারে না। বলে সে,
—মদ গিলে গাড়ি চালাবে, শেষকালে কি হতে কি হবে! আর তোদেরও বলি বুধুয়া, চাকরি করবি না এই সব বাঁদরামি করবি? অ্যাই—চল—গাড়ি ছাড়তে হবে!
যদুপতি কোনো রকমে উঠে দাঁড়াল। বাকি দ্রব্যটা বোতলের মুখে ছিপিটা এঁটে রাখতে হবে, শালপাতা থেকে এক খাবলা আলুর-চপ নিয়ে চিবোতে চিবোতে চললো যদুপতি!
বুধুয়া হাঁক পাড়ে—এ মতিয়া, যা পয়েন্টটা দিয়ে ফেলাগি নেড়ে শ্লো টেরেনটাকে হঠা বাবা! গদাই এদিকে দুটো ওয়াগন ঝড়ঝড়ে শান্টিং ইঞ্জিনটার পিছনে জুড়ে সাইডিং-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, চিৎকার করে সে-আবে মটরা। দ্যাখ পানি সব পড়ে গেল ট্যাঙ্কি থেকে!
মটরার ওপাশে ইঞ্জিনের একটা খোপরে দড়ি, রকমারি নাটবল্টু, এঁটেল মাটির তাল মজুত থাকে।
মটরা গর্জে ওঠে—বীরপুরের কারখানায় নে গিয়ে সেরে আনো ইঞ্জিন গদাই দা। ঐ শ্লা ফুটো ইঞ্জিনে কাজ হয়?
গদাই বলে—এই মা লক্ষ্মী রে। ক্যামন পক্কিরাজের বাচ্চার মতো চলছে। যা তালি মার বাপু।
মটরা এঁটেল মাটি খানিকটা নিয়ে নেমে গিয়ে ট্যাঙ্কের গায়ে থাবড়ে বসিয়ে ফুটো বন্ধ করতে থাকে। ওপাশের লাইন দিয়ে তখন যদুপতি দু’নম্বর আপ নিয়ে বের হচ্ছে।
ঘন্টাচারেক এখন লাউগঞ্জ ইস্টিশনটা ঝিমিয়ে থাকবে। শেডটা খালি প্রায়। ওদিকে নড়বড়ে বেঞ্চে বসে রতিকান্ত সকালের বিক্রিবাটার পয়সা-কড়ি গুনছে। বদন শেষ আঁচে কড়াই-এ ভাত চাপিয়েছে।
ভিড় কেটে যেতে ইস্টিশানের আশপাশের কুকুরগুলো এবার প্ল্যাটফর্ম শেড-এর এদিক ওদিকে খাবারের টুকরো-টাকরার সন্ধান সেরে ল্যাজে মাথায় এক হয়ে বিশ্রামের আয়োজন করছে।
স্তব্ধতা নেমেছে ইস্টিশানে।
ভজগোবিন্দবাবুও এবার সকালের সংগৃহীত কপি-মুলো-বেগুনের ভাগ নিয়ে বাসায় পাঠিয়ে নিজে চলেছে বাসার দিকে একটু ভয়ে ভয়েই।
বাসার কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়াল। চাপা-হাঁক ডাকটা ক্রমশ যেন সোচ্চার হয়ে ওঠে।
—বিমলি! চা হলো তোর?
ভজগোবিন্দ বাড়ি থেকে বের হয় সকালে, সূর্য ওঠারও আগে।
ফার্স্ট লোকাল ছাড়তে হয় তখন। তার আগেই ওই শীতে ঠাণ্ডায় চান করতে হয়! পুজো- আচ্চা সেরে যখন বের হয় তখনও সূর্য ওঠেনি।
চান ইস্টিশানেই সারতে হয় তাকে।
বাড়ি ঢুকতে নেত্যকালী স্বামীর দিকে তাকাল। এখানে কাজ করে বিমলি, নেত্যকালীর বাপের বাড়ির থেকে আনা বিমলিও বেশ সযুত আর নেত্যকালীর মতোই তেজিয়ান!
নেত্য বলে ওঠে—বলি এতক্ষণে ফেরার সময় হলো? কি এত চাকরি করো ওখানে?
ভজগোবিন্দ তাকাল স্ত্রীর দিকে।
ব্যস হলেও নেত্যকালীর ছেলে হয়নি, দেবা আর দেবী। আর ইস্টিশানের দৌলতে বিনা পয়সায় দুধ-ছানা-মাছ-তরিতরকারি সবই জোটে। ফলে খাওয়ার গুণে শরীরটাও সতেজ। আর হাতে অফুরন্ত সময়।
শহরের মেয়ে—বাপেরও নাম ডাক আছে এ দিগরে। লাউগঞ্জের কারবারি লোক, গঞ্জের ব্যবসাদাররাও ওই নেত্যকালীর পিতৃদেব কুলদা গোস্বামীকে চেনে। বারের নামী মোক্তার। তেমনি দফরফ! অর্থও বেশ রোজকার করেন।
ফলে তস্য একমাত্র কন্যাকে লেখাপড়াও কিছু শিখিয়েছিলেন। এখন নেত্যকালী তাই এখানে বাসা বেধেও বসে সেই।
লাউগঞ্জের নারীসমিতি গড়ে তুলেছে। স্কুলের দু’চারজন শিক্ষিকা—হেড মিসট্রেস সুলতা দেবী, দারোগার স্ত্রী লতিকা, সাবরেজিস্টার গিন্নি আরও অনেকেই এর সভ্য, দলবেঁধে এরা নারীকল্যাণ সমিতির মিটিংও করেন গার্লস স্কুলের ওদিকে সুলতা ঘোষ-এর বাসায়।
নেত্যকালী চা-জলখাবার খেয়ে এবার বেরোবার আয়োজন করছে। আজ সমিতির জরুরি মিটিং আছে। বাসিনী জানে দিদিমণির এরপর কি দরকার। পানের বাটা এনে পান সেজে তিনশো ছ’নম্বর বাহারি পাতার জর্দা দিয়ে চাদরটা এনে হাতে দিতে নেত্য বলে—রান্না কর।
ভজগোবিন্দ একপাশে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িতে জোরে কথা বলার উপায় তার নেই। নেত্যকালী বলে ওকে।
—খেয়ে নিয়ো, আমার দেরি হবে। নারী কল্যাণ সমিতির মিটিং সেরে তবে ফিরব।
ভজগোবিন্দ ঘাড় নাড়ে।
জানে ওকে বাধা দেবার সাধ্য ভজগোবিন্দের নেই। তবু ওই নারীকল্যাণ সমিতি নিয়ে সেদিন ইস্টিশানে দু’চারটে কথা শুনেছিল। দক্ষিণপাড়ার কোন্ এক গরিবের বউকে হাসপাতালের ডাক্তার দেখতে চাননি, মহিলা সমিতির মাতব্বর এই নেত্যকালীও অন্য মেয়েদের সঙ্গে গিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ি-চড়াও হয়ে তাকে বিনা ভিজিটে রোগী দেখতে যেতে বাধ্য করেছিল।
কথাটা স্বয়ং মিত্তির মশায়ই বলেছিল।
গুপি মিত্র এইখানের বড় ধানকলের মালিক। বড় ব্যবসাদার। আড়তও আছে। এখানের সিমেন্ট লোহার স্টকিস্ট। চাল-ডাল আলুর আড়ত, গুপি মিত্তির এখানের মাতব্বর!
সেই গুপি মিত্তিরই বলেছিল—এসব ঠিক নয় মাস্টার। শুনলাম তোমার গিন্নিও ছিলেন ওই মহিলাদের দলে!
ভজগোবিন্দ শান্ত-নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। এখানে চাকরি করতে হয় তাকে। তাই গুপি মিত্তিরের মতো দুদে লোককে চটাতে সাহস নেই তার। গ্রামের কেউ কোনো কথা বলুক তাদের নিয়ে এও চায় না সে। তাই মহিলা সমিতি নিয়ে আজও স্ত্রীকে মাতামাতি করতে দেখে বলে ভজগোবিন্দ,
—ওসব রুক্ষু ঝামেলায় কেন যাও?
নেত্যকালী স্বামীর দিকে তাকাল। দুদে মোক্তারের একমাত্র কন্যা সে, সেই মোক্তারি চালেই জেরা করে।
—সে কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?
ভজগোবিন্দ একটু থতমত খায়, তবু বলে সে,
—নানা কথা ওঠে। ওই গুপি মিত্তির মশাই বলছিল সেদিন ছিদাম ডাক্তারকে সমিতির ওরা অপমান করে ভালো কাজ করেনি। তুমিও ছিলে ওদের দলে।
নেত্যকালী কঠিন চাহনিতে তাকাল স্বামীর দিকে। গুপি মিত্তিরকেও চেনে নেত্যকালী। আজ স্বামীর মুখে তার কথা শুনে বলে—
গুপি মিত্তিরের কথায় মহিলা সমিতি চলে না। আমরা যা ভালো বুঝেছি, করেছি। সাধ্য থাকে তার প্রতিবাদ করুক। ওই হুঁকোমুখো মিনসের মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবো! আমি আসছি—
নেত্যকালী চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বেশ বীরদর্পেই বের হয়ে গেল। ভজগোবিন্দ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বিমলার ডাকে চমক ভাঙে তার—চা খাবেন তো? –
ভজগোবিন্দের স্ত্রীর সামনে একেবারের বেশি চা খাবার অধিকার নেই। ওতে নাকি অম্বল হয়। ভজগোবিন্দ স্ত্রীকে চলে যেতে দেখে বলে,
—চা দিবি? দে—তারপর রান্নাবান্না কর। দুপুরের গাড়ি ছাড়তে হবে খেয়ে-দেয়ে গিয়ে।
.
গুপি মিত্তির সামান্য অবস্থা থেকে লাউগঞ্জের মাটিতে ধাপে ধাপে গেড়ে বসেছে নিজের চেষ্টায় আর বুদ্ধির তেজে! এখন তার ভিত এখানের মাটিতে বেশ মজবুত হয়েই বসে গেছে। ধানকল চালু ব্যাবসা—আড়ত, কিন্তু বাড়িতে তার শান্তি নেই।
এই নিয়ে তার তৃতীয় সংসার। প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান রতনই তার বর্তমান বংশধর। প্রথমা পক্ষ তাকে রেখেই মারা যায় তখনও গুপি মিত্তিরের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। টুকটাক কারবার-পত্র করে, তারপর ও বিয়ে করেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষও গত হবার পর, সবে বছর কয়েক আগে গুপি মিত্তির গরিবের ঘর থেকে কুসুমকে এনেছিল।
রতন ক্রমশ বড় হয়েছে—গুপিরও বরাত ফিরেছে। কিন্তু গুপির নজর বদলায় নি।
রতন পড়াশোনায় ভালো। গুপি মিত্তির তাকিয়েছিল ম্যাট্রিক পাশ করার পরই তাকে কারবারে বসাতে। কিন্তু রতন তখন থেকেই জেদি। সে বাবার মতে মত দিতে পারেনি! নিজের জলপানির টাকাতেই সদরের কলেজে পড়ে বি-এ পাশ করেছে। বাবার কাছে তবু হাত পাতেনি—বরং টিউশানি করেই হাতখরচা চালিয়েছে, আর তাকে সাহায্য করেছিল এখানের বর্তমান হেডমিস্ট্রেস সুলতা দিদি! সুলতা তখন ওখানেই থাকত কোন স্কুলে!
রতন পাশ করে ফেরার পরও গুপি মিত্তির বলে—কাজ কারবার দেখাশোনা কর। চাকরি- বাকরিতে কি হবে?
গুপি মিত্তির এর আগেই চাল-ধান সিমেন্টের কালোবাজারি নিয়ে দু’একবার ধরা পড়েছে। বর্ডার এলাকায় চাল পাচার করার ব্যাপারে সেবার জেল হতে হতে বেঁচে গেছে বেশ কিছু টাকা গোপনে খরচ করে।
বাবার ব্যবসা সম্বন্ধে রতনের একটা ধারণাও ছিল। আর সেটা বেশ ভালো নয় মোটেই। কেমন আঁধারে ঢাকা—রহস্যাবৃত। ইদানীং দেখেছে রতন ধান কলের পচা-ভাঙানো ধান—বাতিল চাল—খুঁদও কোন অদৃশ্য পথে ওই নিতাই ঘোষ পাচার করছে।
পয়েন্টম্যান বুধুয়া আর তার ডাঁটো বউ মতিয়াকেও দেখা যায় এখানে, না হয় ধান কলে আর সেই ধান খুঁদ দিয়ে তৈরি হচ্ছে গোপনে চোলাই মদ ওই স্টেশনের ধারের জঙ্গলে কোন্ কালের পড়ো বাড়িতে।
এসবের সঙ্গে তার বাবার যেন অদৃশ্য কোনো যোগসূত্র আছে বলেই মনে হয় রতনের।
রতন ভেবেছে এই কথাগুলো।
ইদানীং এখানের স্কুলেই সে কাজ নিয়েছে। ইংরাজি পড়ায়। গার্লস সেকশনেও সুলতাদি ওকে ক্লাস নিতে বলেছে। সেখানেও শিক্ষিকার অভাব। রতন বাবার এই অন্ধকারের ব্যবসা থেকে ওই শিক্ষাদানের কাজেই বেশি আনন্দ পায়।
আজ তাই বাবার কথাতে সায় দিতে পারে না সে।
কুসুম ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল।
গুপিনাথ বলে স্ত্রীকে—তোমার ছেলেকে জবাবটা দিতে বলো নতুন বউ।
কুসুম এ বাড়িতে নতুন এসেই বুঝেছে রতনের দিকে ওর বাবার যতটুকু নজর দেওয়া, স্নেহ করা দরকার কিছুই করেননি। হয়তো রতনের মনে তাই একটা অভিমানই রয়ে গেছে। আর কিছুটা নীরব বিক্ষোভ।
কুসুম এ বিষয়ে নিজেকেই অপরাধী মনে করে। হয়তো তার এ বাড়িতে আসাটায় মন থেকে রতনের সায় নেই।
কিন্তু রতনকে চিনেছে কুসুম। এ ব্যাপারে তার কোনো অভিযোগই নেই। রতন বাবার কথায় বলে,
—এ ব্যাপারে নতুন মাকে টানা কেন? আমি তো বলেছি আপনার ব্যবসাতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
গুপি অবাক হয়—সেকি! ধানকল তোমার নামেই করে দিয়েছি।
রতন শোনায়—ওসব আপনি করেছেন, আপনিই দেখবেন। আমাকে এসবে টানবেন না। আমি লেখাপড়া শিখেছি, লেখাপড়ার কাজেই থাকব। ফুঁসে ওঠে গুপি মিত্তির।
—মাস্টারি করবে! তা এটা কেন করবে বলো? ওই হরেন ঘোষের ভাগনিটাও শুনি ওই স্কুলে যাতায়াত করে। আর স্কুলের মাস্টারনির দল ওই মহিলা সমিতির তুমি নাকি পান্ডা, বলি ওইসব না করে—ব্যবসাপত্র দ্যাখো। আমার সিধে কথা। যাও, কাল থেকেই ধানকলের গদিতে বসতে হবে।
রতন জবাব দিল না বেশ মুখভার করেই চলে গেল।
গুপিনাথ গর্জে ওঠে—সব আমি জানি; এবার বিহিত করছি।
কুসুম চুপ করেই ছিল।
স্বামীর এই তর্জন-গর্জন সে এসে থেকেই দেখছে। লোকটা অল্পতেই চটে ওঠে, বোধহয় ফালতু পয়সা সহজে হাতে এসে গেছে তাই মেজাজটা সহজেই গরম হয়ে ওঠে টাকার গরমে।
কুসুম বলে—যা করার বুঝে-শুনে করো। ছেলে বড় হয়েছে জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে।
গুপি ফুঁসে ওঠে—ছাই হয়েছে। ঘাড়ে বদবুদ্ধি চেপেছে, আর ওই মহিলা সমিতির পেত্নিরা ঘাড়ে-ভর করেছে ওর।
কুসুম বলে—তবু যা করবে তাতে যেন লোকে না বলে সত্মা-ই এসব করিয়েছে। বদনামের কপাল আমার। বলছিলাম বরং ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে-থা দিয়ে দাও—গরিবের ঘরের মেয়ে হোক তবু ক্ষতি নাই।
গুপি গর্জায়—আগে ঘাড় থেকে পেত্নি নামাই, তারপর দেখছি ওটাকে। …দরজার কাছে কার শুকনো অকারণ কাশির শব্দ শুনে কুসুম মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে ওদিকের অন্দরমহলে চলে গেল। গুপি মিত্তির চোখ তুলে তাকাতে ওদিকে নিতাইকে দেখে বলে—আয়।
নিতাই-এর চেহারাটা জীর্ণ পাকধরা। গায়ের রং কালোই আর রোদে পুড়ে সেটা তামাটে হয়ে গেছে, চোখ-দুটো উঁচু কপালের নীচের খোঁদলে যেন গচ্ছিত হয়ে গেছে, চোখের কোলে কালি—নাকটা খাঁড়ার ডগের মতো ঠেলে বের হয়ে আসে।
নিতাই ঘোষ গুপিনাথের বাহন, ওর কারবারের অনেক গুহ্যতত্ত্ব নিতাই-এর জানা, কারণ নিতাই-এর হাতেই সেগুলোর লেনদেন হয়।
ওদিকে জেলার সীমান্ত, ছোট্ট নদী পার হলেই অন্য জেলা। সেখানে চালের দাম অনেক বেশি। পুলিশের চেকপোস্ট আছে দুদিকেই। কিন্তু গুপিনাথ-এর চালের ট্রাকগুলোর শ’ শ বস্তা চাল কোন অদৃশ্য পথে ঠিক ওপারে চলে যায়। কাল রাতেও গেছে দু’ট্রাক মাল।
নিতাই এসে টাকাটা দিতে গুপি মিত্তির একটু খুশি হয়ে পঞ্চাশ টাকার একখানা নোট নিতাইকে দিয়ে এবার নতুন কাজের কথা পাড়ে।
গুপি মিত্তির বলে—ওই হরেন ঘোষকে ডেকে আন নিতাই
নিতাই একটু অবাক হয়।
হরেন ঘোষ-এর অবস্থাও অদ্যভক্ষ ধনুর্গুণঃ। আজ খেতে কাল নেই। পোষ্য অনেক, আর বিশেষ করে হরেনের ভাগনি বকুলকে মনে পড়ে নিতাই-এর। ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারে না সে।
তাই শুধোয় সে-হরেনকে কেন?
গুপিনাথ এতক্ষণ ধরে মনে মনে গজরাচ্ছিল। দু’একদিন দেখেছে রতনকে মহিলা সমিতির আপিস থেকে ওই হরেনের ভাগনি বকুলের সঙ্গে বের হতে। দু’জনে খুব হাসিখুশি থাকে।
গুপি মিত্তির ভেবেছিল ব্যাপারটা এমন কিছুই নয়, কিন্তু এখন রতনকে ওখানে মাস্টারি নিয়ে তার মুখের উপর জবাব দিতে দেখে বুঝেছে বকুলের সঙ্গেও কিছু ব্যাপার ঘটছে, তারই তেজে রতনও বিগড়ে যাচ্ছে।
নিতাই-এর কথায় গুপি মিত্তির বলে।
—ওর ভাগনি কী করে? ওই বকুল না ফকুল।
নিতাই-এর চোখ-কান চারিদিকে খোলা থাকে আধুনিক কালের র্যাডার যন্ত্রের মতো লাউগঞ্জের যেখানে কোন ঘটনা-ঘটুক তার গোচরে আসবেই।
এটাও এসেছে। তবু নিতাই বলে।
….কেন কর্তাবাবু, বকুল তো ভালো মেয়ে। লেখাপড়ায় ফার্স্ট হয়েছে বরাবর। ভালো ভাবে পাশ করেছে। শুনছি বড় দিদিমণি ওকে গার্লস স্কুলে মাস্টারি দিচ্ছে।
গুপির খবরটা মনঃপূত হয় না। চাকরি পেলে বকুল আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তার জন্যই ওকে এখান থেকে বিদায় করবে সে; গুপি মনে মনে কথাটা ভেবেছে পথও করেছে। এবার নিতাই-এর কথায় গুপি বেশ কড়া মেজাজে বলে ওঠে—ভালো তো সবাই, যত্তোসব নচ্ছার ইতর! তুই হরেনকে ডেকে আন এখুনি।
নিতাই বেরোতে যাবে, হঠাৎ গুপির খেয়াল হয় রাগের বশে এতক্ষণ অন্য কথাই বলেছে। ফালতু কথা। কাজের কথাটা মনে পড়েছে এবার। তাই বলে গুপিনাথ-শোন, যাবার পথে একবার ওই বধুয়া মতিয়াকে তাগাদা দিয়ে দু’দিনের মাল বিক্রির টাকাটা নিয়ে আসবি। নাহলে ছুঁড়িটা ভয়ানক ঠ্যাটা—পুরো টাকা গায়েব করে দেবে। যা।
নিতাইকে পাঠিয়ে গুপি মিত্তির এবার পাশে পড়ে থাকা তালপাতার পাখাটা নিয়ে হাওয়া করতে থাকে। ইদানীং লাউগঞ্জে বিজলি বাতি এসেছে। ধানকলেও আছে। বাজারে দত্তদের বাড়িতে, জমিদার হরিহরের বাড়িতেও গেছে বিজলি। গুপি মিত্তির ওসব বিলাসিতার ধার ধারে না। বাজে খরচা করে বিজলি নেবার কথাও ভাবেনি। তালপাতার পাখাই ভালো।
.
বকুলের কাছে এ জীবনের বোঝাটা মাঝে মাঝে দুঃসহ হয়ে ওঠে। ছেলেবেলাতেই বাবা মারা যায়, দূরের কোন অজপল্লিগ্রামে সে ছিল তখন। জমি জায়গা যা ছিল তা নামমাত্র। তাতে ক’মাসের খোরাক হতো বাকিটুকু তার বাবাকে এখান-ওখান থেকে জুটিয়ে আনতে হতো অনেক ফন্দিফিকির করে। বাবা মারা যাবার পর সে পথও বন্ধ হয়ে যেতে বকুলের মা ছোট্ট বকুলকে নিয়ে তাই এই হরেন ঘোষের আশ্রয়ে এসে হাজির হয়।
মা মারা গেছে বকুল এখনও পড়ে আছে এখানেই।
তবু ভালো ছাত্রী, সুলতাদি ওকে স্কুলে ফ্রি পড়ার ব্যবস্থা করেছিল, মায় বইপত্রও দিয়েছে। বকুল ফার্স্ট ডিভিশান-এ পাশ করেছে।
আর তাই যেন মামির জ্বালাটা আরও বেশি।
হরেন ঘোষ হাঁপানির রুগী, এককালে যা ছিল বসে খেয়েছে সব, এখন জীবনের বোঝা বইতে হাঁপিয়ে উঠে ফুঁ-ফুঁ করে শ্বাস টানছে, আর হরেন গিন্নির তর্জন-গর্জনও তত বেড়েছে।
সকালবেলায় বকুল একগাদা এঁটো বাসন নিয়ে বসেছে; বাড়িতে ঝিয়ের পাট নেই। আগে ওই এঁটো মাজা—ঘর ঝাঁট দেওয়া রান্না করা এসব করত বকুলের মা, এখন উত্তরাধিকার সূত্রে ওসব বকুলকেই করতে হয়।
মামিমা গর্জে ওঠে খ্যানখ্যানে গলায়—বলি ওই তো দু’খানা বাসন তাও মাজতে বেলা হয়ে গেল, এরপর উনুনে আঁচ পড়বে, রান্না হবে কখন? ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে চাট্টি ভাতে ভাতও দিবি না? তা দিবি কেন? শত্রুর কি সাধে বলে?
বকুল কড়াইটা মাজতে মাজতে বলে—কাঠের উনুনে বড্ড বেশি পুড়েছে মামিমা। হয়ে যাবে এক্ষুনি।
মামিমা মুখনাড়া দেয়—কাঠের উনুন ছাড়া কয়লা কে জোগাবে? তোর বাবা? বড় বড় বাত আছে। নাও, হাত চালিয়ে করো; উনুনে-আঁচ দিয়ে দে বাইরে কোথায় যাবি না ওই সব হুজুকে।
দুধ দিতে এসেছে গোয়ালা, মামা বলে—হাত-ধুয়ে দুধটা নে।
বকুল দুধ নিতে গিয়েই গোল বাধায়। হাতটা পিছল হয়েছিল, হাত পিছলে দুধের পাত্রটা পড়ে যেতেই মামিমা লাফ দিয়ে এসে এবার ওর গালেই কসে চড় দেয়।
—হাত পায়ের বশ নেই? পিণ্ডি গিলিস কেবল? দূর করতে পারো না এই আপদকে।
হরেন ঘোষ জানে না কি করবে, তার গলায় বেঁধেছে। ওই একা বকুলই নয়, নিজের মেয়েও বেশ বড় হয়ছে। বিয়ে-থাও দিতে পারছে না। বিয়ে নয় এবার দিন চালাবার ভাবনাটাই বড় হয়ে উঠেছে তার কাছে।
তবু হরেন বলে—চুপ করো না।
গিন্নি মুখ ঝামটা দেয়—দূর করব এবার ওটাকে।
বকুলের চোখ ফেটে জল নামে। কিন্তু কাঁদবার উপায়ও তার নেই। মামা এখনই অনখ বাধাবে। তাই গুম হয়ে বাসন মাজতে থাকে সে।
হঠাৎ বাইরে নিতাই-এর ডাক শুনে তাকাল হরেন।
হরেন ঘোষ একটু অবাক হয়—মিত্তির মশাই ডাকছেন; কি ব্যাপার হে নিতাই! বসো।
নিতাইকে খাতির করে বসায় হরেন ঘোষ।
নিতাই বলে—কি করে বলব বলো ঘোষমশায়, হুকুম হলো ডেকে আন। এলাম তবে মনে হলো খবর ভালোই, নাহলে এত চটজলদি ডাকবে কেন তোমায়?
হরেন ঘোষ ওই গুপি মিত্তিরকে সমীহ করে চলে। এর মধ্যে কয়েকশো টাকা ঋণও নিয়েছে জমি কিছু বন্ধক রেখে
তবে টাকার তাগিদা দেয় না মিত্তির। হুট করে মামলা করেই থাবা বসায় লোকের জমিতে। টাকার জন্য ডাকে নি তা বোঝে হরেন।
গিন্নিও এসেছে।
হরেন ঘোষ ঘরের মধ্যে ধুতি বদলে আলনা থেকে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে বের হবে, হেঁপো রুগী, তাই ধুসো চাদরটাও জড়িয়ে নিল, যাতে ঠাণ্ডা-ফাণ্ডা না লাগে। গিন্নির কথায় বলে।
—কেন ডাকছে তা তো বুঝছি না, যাই ঘুরে আসি একবার।
.
গুপি মিত্তির জানত হরেন ঘোষের টিকি বাঁধা আছে তার কাছে। শুধু হরেন ঘোষেরই নয়, এ গ্রামের অনেকেরই টিকি বাঁধা রয়েছে তার হাতে। আর তার কথা শুনতেই হবে হরেন ঘোষকে। গুপি মিত্তির আগে থেকেই ভেবে রেখেছে।
হরেন ঘোষ আসতে গুপি প্রথমে কথাটা না পেড়ে কুশল সংবাদই নেয়, –এসো হরেন। শরীর ভালো আছে তো?
হরেন ঘোষও চতুর ব্যক্তি, বর্তমানে ফেরে পড়ে কাবু হয়ে আছে।
তবু মানুষ চেনে সে। গুপি মিত্তির তাকে এসব কথা শুধোতে সেও অবাক হয়েছে। তবু জানায়।
—আর শরীরের কী দোষ বলুন মিত্তিরমশায়, অভাব-অনটন তো লেগেই আছে। তারপর ঘাড়ে দু’দুটো মেয়ে—বিয়ে-থাও দিতে পারছি না।
গুপি মিত্তির এবার তাক্ বুঝে বলে।
বিয়ে দাও না কেন ভাগনির—ভালো পাত্র আছে। দোজবরে অবিশ্যি—তোমারও চেনা-জানা। বকতোড়ের শশী নায়েব
হরেন ঘোষ কথাটা শুনে একটু ঘাবড়ে যায়—শশী নায়েব। বয়েস যে অনেক বেশি মিত্তির মশাই।
গুপি শোনায়—তোমার ভাগনিও কচি-খুকি নয় হে। আর তোমার এই অবস্থা! শশী দেবে-থোবে ভালো। ধরো নগদ দেবে হাজার পাঁচেক। গহনাপত্র দেবে। ওতেই তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও। বাস!
আর শশীও তোমাকে বিপদে-আপদে সাহায্য না করে থাকতে পারবে? হরেন ঘোষ কথাটা এবার তলিয়ে ভাবছে। ভাববার কথাই।
এখানে বকুলের বিয়েটা দিতে পারলে সুরাহা হবে তার সংসারের। আর গুপি মিত্তিরও খুশি হবে।
অবশ্য শশীর বয়সও অনেক। তাই ইতিউতি করে জানায় হরেন—কোনো গোলমাল হবে না তো?
গুপি মিত্তির অভয় দেয়—আমি থাকতে ওসব কিছুই হবে না হরেন। তবে কথাটা একটু গোপনে রেখো। আর ওই বকুলকে ক’দিন বাইরে একটু কম বেরোতে দাও, হাজার হোক বিয়ের কনে।
—কবে নাগাদ বিয়ে হবে? আয়োজনপত্র আছে, হরেন প্রশ্ন করে।
গুপি মিত্তির মনে মনে খুশি হয়েছে। এত সহজে হরেন রাজি হয়ে যাবে ওই অজপাড়া গ্রামে-ঘাটের মড়ার সঙ্গে বকুলের বিয়ে দিতে তা ভাবেনি।
শশী নায়েবও রাজিই আছে। পাত্রী খুঁজছে সে ব্যাকুল ভাবে।
গুপি বলে—যত শীঘ্রি শুভকাজ সারা যায় তার ব্যবস্থা করছি।
তাহলে ওই কথাই রইল।
তবু সাবধান করে গুপি।
—একটু গোপনে কাজটা সারতে হবে। বুঝলে?
.
নেত্যকালী মহিলা সমিতির ঘরে এসেই বকুলকে দেখতে না পেয়ে শুধোয়— মেয়েটা আসেনি সুলতাদি?
সুলতা জানে বকুলের জন্য নেত্যকালী টিফিন কৌটায় করে সন্দেশ না হয় পিঠে-পায়েস যা ভালোমন্দ করে নিয়ে আসে। আজও কিছু এনেছে বোধহয়।
নেত্যকালীর ছেলেমেয়ে নেই হয়তো তাই মেয়েটাকে একটু বেশি ভালোবাসে। সুলতাদি ওদিকে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একটা সেবাকেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যাপারে আলোচনা করছিল রতনের সঙ্গে।
রতন মহিলা সমিতির কিছু বাইরের কাজকর্ম করে দেয়, সেই সুবাদেই বকুলের সঙ্গে পরিচয়। আর এক গ্রামেই তারা মানুষ, চেনে জানে অরা দু’জনকে। ক’দিন বকুল আসেনি এখানে।
সুলতাদি বলে—ক’দিন আসেনি। শরীর খারাপ কিনা কে জানে?
নেত্যকালী বলে ওঠে,
—তা হতে পারে, ওর মামিটা এক নম্বর পিশাচ। রোগ-জ্বালি হলে ডাক্তার বদ্যিও দেখাবে না। মেয়েটার খবর নেওয়া দরকার।
সুলতা, মালতী এখানের দারোগা গিন্নিও সায় দেয়। রতন বকুলের খবরটা জানে না। নেত্যকালীকে এ সম্বন্ধে আগ্রহ নিতে দেখে একটু খুশি হয় মনে মনে। নেত্যকালী-সুলতাদি আর মালতী বের হয়ে গেল বকুলের মামার বাড়ির দিকে।
রতনও কথাটা ভেবেছে। বাবার ওই ধানকলের আড়তে বসতে সে পারবে না। অন্ধকারের কাজগুলোকে সে ঘৃণাই করে সারা মন দিয়ে। তার তাকিয়ে শিক্ষকতাই করবে সে। আর দরকার হয় স্কুল বোর্ডিঙে উঠে আসবে।
গ্রামের বাইরে বেশ কিছুটা এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে স্কুলবাড়ি, আম বাগানের দিকে বিস্তীর্ণ দিঘির ধারে বোর্ডিংটা। পড়াশোনা করার মতো মনোরম পরিবেশই রয়েছে এখানে। মাস্টারি করতে করতে প্রাইভেটে এম-এ টা দেবে।
কি যে স্বপ্ন দেখছে রতন একজনকে ঘিরে। সে বকুল। শান্ত-সহজ একটি মেয়ে। শ্যামবর্ণ চেহারায় একটা নমনীয়তা ফুটে ওঠে। জানে রতন মামার ওখানে কি কষ্টে থাকে বকুল। পরনের শাড়িটাও বিবর্ণ—সুলতাদিই ভাবছেন ওকে মাস্টারির কাজ দেবার কথা।
রতনের মনের অতলে ওই শান্ত মেয়েটি কি মধুর স্বপ্নরেশ আনে।
স্কুলের ঘন্টা বাজছে ছেলেদের কলরব শোনা যায়। স্কুলের দিকে এগিয়ে যায় রতন!
.