তিমিঙ্গিল

তিমিঙ্গিল

তিমি মৎস্যই যে পৃথিবীর বৃহত্তম জীবন, এ বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিরা একমত। আমি কিন্তু নিতান্ত অজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও বলিতে পারি যে, তিমিঙ্গিল নামধারী আর একটি অতি বৃহদায়তন জীব আছে যাহারা তিমি মৎস্যকে গিলিয়া খায়। বিশ্বাস না হয়, অভিধান দেখুন।

অপিচ, তিমিঙ্গিল যদি থাকিতে পারে, তবে তিমিঙ্গিল-গিল (যাহারা তিমিঙ্গিলকে গিলিয়া খায়) থাকিবে না কেন? এবং তিমিঙ্গিল-গিল থাকা যদি সম্ভবপর হয় তবে তিমিঙ্গিল-গিল-গিল থাকিতেই বা বাধা কি?

এইভাবে প্রশ্নটাকে অনন্তের পথে ঠেলিয়া লইয়া যাওয়া চলিতে পারে। কিন্তু তাহাতে অনর্থক কতকগুলা গিল-গিল-গিল বাড়িয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনই লাভ হইবে না। আমাদের প্রতিপাদ্য এই যে, জগতের সর্বত্রই বৃহৎকে বৃহত্তর গ্রাস করিয়া থাকে। অর্থাৎ— বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।

শ্রীযুক্ত নিশিকান্ত গুপ্ত মহাশয় বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া চিন্তা করিতেছিলেন। রাত্রি এগারোটা বাজিতে সাতাশ মিনিট সময়ে তিনি হঠাৎ তড়াক্‌ করিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিলেন। ঘরে আর কেহ থাকিলে মনে করিত, নিশিকান্তবাবু বুঝি বৈদ্যুতিক ‘শক্‌’ খাইয়াছেন। হইয়াছিলও তাই। তাঁহার মস্তিষ্কের ভিতর দিয়া চল্লিশ হাজার ভোল্টের প্রচণ্ড একটি আইডিয়া খেলিয়া গিয়াছিল।

নিশিকান্তবাবু একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ দালাল; ব্যবসা-সম্পৰ্কীয় সকল বিদ্যার হুনরী। তাঁহার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ক্রয়-বিক্রয় তেজী-মন্দা বাজার-জ্ঞান সম্বন্ধে তাঁহার সমকক্ষ কলিকাতা শহরে বড় কেহ ছিল না। এই সূক্ষ্ম বাজার-জ্ঞানের ফলে গত পঁচিশ বৎসরে তিনি কত লক্ষ টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহা তিনি ও ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কেহ জানিত না। যাহারা কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে তাঁহার চমৎকার সুসজ্জিত দোতলা বাড়িখানা দেখিত, তাহারা সহিংসভাবে অনুমান করিত মাত্র।

কিন্তু গত কয়েক বৎসর ধরিয়া বাজারের এমন অবস্থা হইয়াছে যে, নিশিকান্তবাবুর চিত্তে সুখ নাই। কাজকর্ম প্রায় বন্ধ আছে। কারণ কাজ করিতে গেলেও লাভের মাত্রা এত কম হস্তগত হয় যে খরচা পোষায় না। ব্যবসার জগৎটা যেন ধীরে ধীরে প্রলয়পয়োধিজলে ডুবিয়া যাইতেছে।

নিশিকান্তবাবুর অবশ্য অর্থোপার্জনের কোনও প্রয়োজন নাই; ব্যাঙ্ক হইতে ছয় মাস অন্তর যে সুদ বাহির করেন তাহাতে তাঁহার পাঁচটা হাতি পুষিলেও ব্যয়সঙ্কোচ করিতে হয় না। কিন্তু নিশিকান্ত কর্মী পুরুষ, অর্থোপার্জনের নেশা তিনি পঁচিশ বৎসর ধরিয়া অভ্যাস করিয়াছেন। তাই, আফিমের মৌতাতের মতো উপার্জনের মোহই তাঁহাকে বেশি করিয়া চাপিয়া ধরিয়াছে। অথচ দারুণ পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমান মন্দার বাজারে উপার্জন একেবারেই নাই।

নিশিকান্ত জগদ্ব্যাপী অবসাদের মধ্যে কোথাও একটু আশার আলো দেখিতে পাইতেছিলেন না, এমন সময়ে রাত্রি এগারোটা বাজিতে সাতাশ মিনিটে তাঁহার মাথায় চল্লিশ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।

আলোক-বিভ্রান্তের মতো নিশিকান্ত কিছুক্ষণ বিছানায় জড়বৎ বসিয়া রহিলেন। তাঁহার মাথায় ঘুরিতে লাগিল,— মোমবাতি! হ্যারিকেন লণ্ঠন!!

হাত বাড়াইয়া তিনি বেড্‌সুইচ টিপিলেন; রক্তবর্ণ নৈশ-দীপ মাথার উপর জ্বলিয়া উঠিল। নিশিকান্ত প্রায় দশ মিনিট মুগ্ধ তন্ময় ভাবে সেই দিকে তাকাইয়া রহিলেন; তারপর ধীরে ধীরে আবার শয়ন করিলেন।

বালিশের পাশে তাঁহার নোটবুক ও পেন্সিল থাকিত। নিশিকান্ত বুকের তলায় বালিশ দিয়া উপুড় হইয়া শুইলেন, তারপর নোটবুকের পাতা উল্টাইতে লাগিলেন। নোটবুকের অবোধ্য ইঙ্গিতে তাঁহার ব্যবসা-সংক্রান্ত যাবতীয় গুপ্ত কথা লেখা ছিল, তিনি সেইগুলি পড়িতে পড়িতে মনে মনে হিসাব করিতে লাগিলেন। প্রথমে হিসাব করিলেন, কত টাকা তিনি ইচ্ছা করিলেই ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য স্থান হইতে বাহির করিতে পারেন। হিসাব বোধ করি বেশ মনোমত হইল, কারণ তিনি পরিতোষের নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

অতঃপর তিনি নোটবুকের পাতায় পেন্সিল দিয়া আর এক-জাতীয় অঙ্ক কষিতে আরম্ভ করিলেন। বোধ হয় এটা খরচের হিসাব। সমস্ত যোগ করিয়া পাঁচ লক্ষ টাকার কিছু বেশি হইল। নিশিকান্ত খাতা হইতে মুখ তুলিয়া বিড় বিড় করিয়া কি বলিলেন, তারপর নোটবহি বন্ধ করিয়া বালিশের পাশে রাখিয়া দিলেন। তাঁহার মুণ্ডিত মুখে দশ হাজার দীপশক্তির যে হাসিটি ফুটিয়া উঠিল তাহার কাছে রক্তবর্ণ নৈশ-দীপের প্রভা একেবারে ম্লান হইয়া গেল।

তিনি মনে মনে বলিলেন, ‘তিন দিনে বাহাত্তর হাজার টাকা! মানে— রোজ চব্বিশ হাজার।’

নিশিকান্তবাবুর স্ত্রী পাশের ঘরে শয়ন করিতেন, মাঝের দরজায় পর্দার ব্যবধান। নিশিকান্তবাবুর দ্বিতীয় পক্ষ— তবে ভার্যাটি নেহাৎ তরুণী নয়, বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। তিনি অত্যন্ত সৌখীন এবং বন্ধ্যা, এই জন্য বাংলা সাহিত্যে তাঁহার প্রবল অনুরাগ। প্রায়ই মাসিক পত্রিকায় কবিতা লেখেন।

নিশিকান্তবাবু ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন, পর্দার নীচে দিয়া আলো দেখা যাইতেছে। বুঝিলেন, গৃহিণী এখনও মাসিক পত্র শেষ করেন নাই। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হ্যাঁগা, জেগে আছ?’

পাশের ঘর হইতে হ্যাঁগা উত্তর দিলেন, ‘হুঁ।’

আলুথালু বস্ত্র কোমরে জড়াইয়া নিশিকান্ত স্ত্রীর ঘরে গেলেন। স্ত্রী পিঠে বালিশ দিয়া অর্ধশয়ান অবস্থায় শয্যায় দেহ প্রসারিত করিয়া ছিলেন, মাথার শিয়রে একটা ত্রিপদের শীর্ষে বৈদ্যুতিক ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। স্ত্রী কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া নিশিকান্তবাবুর চেহারা দেখিয়া ঈষৎ ভ্রূকুটি করিলেন।

নিশিকান্ত আলোর নিকটে গিয়া সুইচ টিপিয়া আলো নিবাইয়া দিলেন; আবার জ্বালিলেন, আবার নিবাইয়া দিলেন।

বিরক্তভাবে গৃহিণী বলিলেন, ‘ও কি হচ্ছে?’

নিশিকান্ত বলিলেন, ‘বেশ— না? ইলেক্‌ট্রিক বাতি। সুইচ টিপলেই নিবে যায় আবার সুইচ টিপলেই জ্বলে ওঠে।’

স্ত্রী ধমক দিয়া বলিলেন, ‘এত রাত্রে হল কি তোমার?’

নিশিকান্ত স্ত্রীর শয্যার এক পাশে আসিয়া বসিলেন; একটু যেন অন্যমনস্কভাবে বলিলেন, ‘আমি ভাবছি একটা ছাপাখানা করতে কত খরচ লাগে।’

স্ত্রীর হাত হইতে মাসিক পত্র পড়িয়া গেল। তিনি সচকিতে উঠিয়া বসিলেন। বহুদিন হইতে তাঁহার বাসনা নিজের ছাপাখানা করিয়া একটি মাসিক পত্রিকা বাহির করেন; মাসিক পত্রে কেবল কবিতা ছাপা হইবে। পত্রিকার নাম হইবে— ‘মন-কুসুম’— সম্পাদিকা হইবেন স্বয়ং শ্রীমাধুরী দেবী।

স্বামীকে এই সুন্দর পরিকল্পনার কথা বলিয়াছিলেন। কবিতার মাসিক পত্র কিরূপ চলিবে সে-বিষয়ে নিশিকান্তবাবুর মনে কোনও মোহ ছিল না। অথচ স্ত্রীর একটা সখ মিটাইবার ইচ্ছা তাঁহার যে একেবারেই ছিল না তাহা নয়। কিন্তু বাজার মন্দা বলিয়া নিশিকান্ত গা করেন নাই।

মাধুরী দেবী এক নিশ্বাসে বলিলেন, ‘সত্যি কিনবে?— আমার কতদিনের যে সখ। ‘মন-কুসুম’— কেমন নামটি বলো তো? নীচে লেখা থাকবে— সম্পাদিকা শ্রীমাধুরী দেবী। খরচ এমন কিছু নয়; সেদিন নীলকান্ত প্রেসের মালিক আমার কাছে এসেছিল। তারা প্রেস বিক্রি করতে চায়, কোথা থেকে শুনেছে আমি কিনতে পারি। খুব বড় প্রেস— ইংরেজী বাংলা সব আছে; নতুন দাম সাতাশ হাজার টাকা। বলছিল আঠারো হাজার পেলেই বিক্রি করবে। তা— কষামাজা করলে হয়তো কিছু কমেও দিতে পারে।’

নিশিকান্ত ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘খবর নিও যদি বারো হাজারে ছাড়ে তো নিতে পারি।’

মাধুরী দেবী বলিলেন, ‘অত কমে দেবে কি? আচ্ছা—’

নিশিকান্ত শয্যাপ্রান্ত হইতে উঠিলেন। মাধুরী দেবী তাঁহার হাত টানিয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘এখনি শুতে চললে।’

নিশিকান্ত আলস্য ভাঙিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ, আর দ্যাখো, কাল দুই টিন ভাল কেরাসিন তেল আর গোটা দশেক হ্যারিকেন লণ্ঠন কিনে আনিও। আর পাঁচ বাণ্ডিল মোমবাতি।’ বলিয়া নিগূঢ় ভাবে হাস্য করিতে করিতে তিনি নিজের শয্যায় গিয়া শয়ন করিলেন।

অতঃপর সাতদিন ধরিয়া নিশিকান্তবাবুর ভোমরা রঙের সিডান-বডির গাড়িখানি মধুসঞ্চয়ী মৌমাছির মতো কলিকাতার পথে পথে গুঞ্জন করিয়া উড়িয়া বেড়াইল। নিশিকান্তবাবু কোথায় কোথায় গেলেন ও কাহার সহিত নিভৃতে কি কথা বলিলেন তাহা ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্য নয়— সাধ্য হইলেও বলিতাম না। পরের গুহ্য কথা প্রকাশ করিয়া দিতে আমরা ভালবাসি না। এই সব যাতায়াতের ফলে নিশিকান্তবাবুর ব্যাঙ্ক হইতে লক্ষাধিক টাকা অপসৃত হইয়া কোন্‌ মৌচাকে সঞ্চিত হইল তাহাও বলিব না। ঘুষির পুংলিঙ্গে যে-শব্দ উৎপন্ন হয় তাহাকে আমরা অত্যন্ত ঘৃণা করি।

তারপর মাল খরিদ আরম্ভ হইল। নিশিকান্তবাবু যে যে মাল খরিদ করিয়া বাজার কোণঠাসা করিলেন তাহার ফিরিস্তি দিবার প্রয়োজন নাই; তিনি বাজার উজাড় করিয়া গুদামজাত করিলেন। বড় বড় দেশী বিলাতী ব্যবসায়ীরা ভ্রূ তুলিল, মনে মনে হাসিল— কিন্তু অকপট আনন্দে হাত ঘষিতে ঘষিতে মাল সরবরাহ করিল। কেবল নিশিকান্তবাবু কেরাসিন তেলের দিকে গেলেন না; অনেক মূলধন চাই, লাখে কুলাইবে না। অপ্রসন্ন চিত্তে তিনি মনে মনে বলিলেন, ‘করে নিক্‌ ব্যাটারা কিছু লাভ।’

দশদিনের দিন নিশিকান্তবাবুর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হইল। তিনি গুদামে গিয়া মাল পরিদর্শন করিলেন, অফিসে বসিয়া খাতাপত্র তদারক করিলেন; তারপর চেয়ারে ঠেসান দিয়া একটি স্থূলকায় সিগার ধরাইয়া বলিলেন, ‘এইবার।’

সেইদিন রাত্রি সাতটার সময় কলিকাতা শহরের সমস্ত বিদ্যুৎবাতি নিবিয়া গেল। রাত্রি দশটার সময় রাস্তার গ্যাস-বাতিও হঠাৎ দপ্‌দপ্‌ করিয়া চক্ষু মুদিল— তিনদিনের মধ্যে আর জ্বলিল না!

আলোকহীন মহানগরীর বর্ণনা আমরা করিব না। অন্ধকারের যে একটা রূপ আছে— কালিমা লইয়া যাঁহাদের কারবার তাঁহারা সে রূপ নয়ন ভরিয়া দেখুন এবং বর্ণনা করুন। নিশিকান্তবাবুর মতো আমরা আলোর কারবারী।

রাস্তা এবং ঘর অন্ধকার; ট্রাম বন্ধ। হ্যারিকেন লণ্ঠন ও মোমবাতির দর ব্যাঙের মতো লাফাইয়া লাফাইয়া চড়িতে লাগিল। অথচ ঐ দুইটি দ্রব্য নিশিকান্তবাবুর গুদামে বন্ধ। তিনি অল্পে অল্পে ছাড়িতে আরম্ভ করিলেন।

দ্বিতীয় রাত্রেও যখন আলো জ্বলিল না, তখন চারিদিকে বিরাট হৈ হৈ পড়িয়া গেল। আশ্চর্য দৈব দুর্ঘটনায় গ্যাস ও ইলেক্‌ট্রিক যন্ত্র এমন খারাপ হইয়া গিয়াছে যে, কিছুতেই মেরামত হইতেছে না। কিন্তু গৃহস্থের আলো চাই। লণ্ঠন ও মোমবাতির দাম এমন একটা কোঠায় গিয়া উঠিল যে, কল্পনা করাও কঠিন। নিশিকান্তবাবু মাল ছাড়িতে লাগিলেন, এবং ব্যাঙ্কে টাকা পাঠাইতে লাগিলেন। যে সব বড় বড় ব্যবসাদার একগাল হাসিয়া নিশিকান্তকে মাল বিক্রয় করিয়াছিল, তাহারা হাত কামড়াইতে লাগিল।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার সময় নিশিকান্তবাবু হিসাব করিয়া দেখিলেন, তাঁহার মূলধন উঠিয়া বারো হাজার টাকা উদ্বৃত্ত হইয়াছে। তাছাড়া এখনও ষাট হাজার টাকার মাল গুদামে মজুত।

বারো হাজার টাকা পকেটে লইয়া নিশিকান্তবাবু অফিস হইতে বাড়ি ফিরিলেন। স্ত্রী তিনটা লণ্ঠন জ্বালিয়া স্বামীর জন্য স্বহস্তে চা তৈয়ার করিতেছিলেন, তাঁহার কোলে নোটের তাড়া ফেলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘এই নাও।’

মাধুরী দেবী একমুখ হাসিয়া স্বামীর অভ্যর্থনা করিলেন, ‘আজ সরকারকে বাজারে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলুম; একটা হ্যারিকেন দাম পাঁচটাকা!— হ্যাঁগা, আর ক’দিন?’

তৃতীয় দিন সন্ধ্যার সময় নিশিকান্তবাবুর গুদাম খালি হইয়া গেল।

শেষ কিস্তির ষাট হাজার টাকা ব্যাঙ্কে পাঠাইবার সময় ছিল না। এই টাকাটাই নিশিকান্তবাবুর মূল লভ্যাংশ। এত টাকা এখন কথায় রাখিবেন— নিশিকান্ত একটু চিন্তা করিলেন। চেক নয়, নগদ টাকা। অফিসের লোহার সিন্দুকে রাখিয়া গেলেও চলে, কিন্তু—দু’একটা সংবাদ নিশিকান্তর স্মরণ হইল। অন্ধকারের সুযোগ লইয়া চোর গুণ্ডার দল খালি অফিস-বাড়ি ইত্যাদি ভাঙিয়া লুট করিতেছে— বড় বড় দুই-তিনটা অফিসে এইরূপ ব্যাপার হইয়া গিয়াছে। নিশিকান্ত নোটের গোছা পকেটে পুরিয়া লইলেন। বাড়িতে রাখিলে সবচেয়ে নিরাপদ হইবে। বাড়িতে পাঁচটা গুর্খা দারোয়ান, দশটা চাকর আছে; তাহার উপর আবার দু’জন কনেস্টবলকে খরচা দিয়া পাহারা দিবার জন্য নিয়োগ করা হইয়াছে।

নিশিকান্ত অফিস হইতে বাহির হইয়া যখন মোটরে চড়িলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। মোটরের কাচের ভিতর দিয়া দু’ধারে রাস্তার চেহারা সকৌতুকে দেখিতে দেখিতে চলিলেন। কলিকাতা যেন রাত্রিযোগে ভৌতিক শহরে পরিণত হইয়াছে। বড় বড় দোকানের বিদ্যুৎ-দন্ত-বিকশিত হাসি আর নাই, অধিকাংশই বন্ধ। যেগুলি খোলা আছে তাহাতে মোমবাতি ও লণ্ঠন জ্বলিতেছে। পথে গাড়ি মোটরের চলাচলও কম। মানুষ যাহারা যাতায়াত করিতেছে তাহাদের নিশাচর প্রেত বলিয়া ভ্রম হয়।

কলেজ স্ট্রীট বাজারের নিকটে পৌঁছিয়া নিশিকান্তবাবুর ভারি কৌতূহল হইল। কোনও একটা বড় কাজ করিয়া সাধারণের মতামত জানিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক। তিনি মোটর হইতে নামিলেন। একটা ক্ষুদ্র দোকানে আলো জ্বলিতেছিল, তাহার সম্মুখীন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মোমবাতি আছে?’

দোকানদার বলিল, ‘আজ্ঞে আছে, তিনটাকা বাণ্ডিল।’

নিশিকান্ত পকেট হইতে তিনটাকা বাহির করিয়া ছদ্ম বিরক্তির কণ্ঠে বলিলেন, ‘দিন এক বাণ্ডিল। যত সব চোরের পাল্লায় পড়া গেছে। ইংরেজীতে যাকে বলে “শার্ক” এই ব্যবসাদারগুলো হচ্ছে তাই।’

দোকানদার নেহাৎ অশিক্ষিত নয়, একটু রসিক; বলিল, ‘শার্ক তো পদে আছে মশাই, ব্যবসাদারেরা যাকে বলে তিমি মাছ— তাই। আস্ত গিলে খায়। নিন এক বাণ্ডিল।’

নিশিকান্ত দোকানদারের কথাগুলি চাখিয়া চাখিয়া উপভোগ করিলেন; তিনি নিজেই যে তিমি মাছ, দোকানদার তাহা জানে না— অজ্ঞাতসারেই প্রশংসা করিতেছে। তাঁহার ছদ্ম বিরক্তির ভিতর দিয়া একটু হাসি খেলিয়া গেল। তিনি মোমবাতির বাণ্ডিল লইয়া মোটরের দিকে ফিরিলেন।

মোটরে উঠিতে যাইবেন, এমন সময়—

তিমিঙ্গিল!

নিশিকান্ত হঠাৎ বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার চারিপাশে কয়েকজন লোক নিঃশব্দে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তিনি সচকিতে চারিধারে চাহিলেন; অস্পষ্ট আলোয় মুখগুলি ভাল দেখা গেল না।

একজন তাঁহার পেটের উপর ছোরার অগ্রভাগ রাখিয়া চাপা গলায় বলিল, ‘চিল্লাও মৎ!’

আর একজন তাঁহার কোটের ভিতর-পকেটে হাত পুরিয়া নোটের তাড়া বাহির করিয়া লইল। নিশিকান্তবাবু হতভম্ব হইয়া রহিলেন। তিমিঙ্গিলের দল ছায়ার মতো অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল।

তাহারা চলিয়া যাইবার মিনিটখানেক পরে নিশিকান্ত উন্মত্তকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিলেন—‘পুলিস! আমার ষাট হাজার টাকা—’

নিশিকান্ত থানায় গেলেন।

থানার দারোগা বলিলেন, ‘লিখে নিচ্ছি। কিন্তু টাকা আর পাবেন না। এই আলোর গোলমাল হয়ে অবধি শহরটা চোর বদমায়েসের আড্ডা হয়েছে।’

বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে নিশিকান্তবাবুর বিভ্রান্ত চিত্তে একটি ক্ষীণ সান্ত্বনা জাগিতে লাগিল— ‘যাক তবু বারো হাজার টাকা লাভ রইল।’

রাত্রি আটটার সময় তিনি বাড়ি পৌঁছিলেন। মাধুরী দেবী অধীরভাবে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তিনি প্রবেশ করিতেই ছুটিয়া গিয়া বলিলেন, ‘ওগো, ভারি সুখবর। নীলকান্ত প্রেস কিনে নিয়েছি। বারো হাজারেই রাজী হয়ে গেল।’

নিশিকান্ত বসিয়া পড়িলেন; তাঁহার গলা দিয়া একপ্রকার ঘড় ঘড় শব্দ বাহির হইল। ঘরের মধ্যেও যে তিমিঙ্গিল বসিয়া আছে তাহা কে জানিত!

এই সময়, যেন নিশিকান্তকে বিদ্রুপ করিয়া, কলিকাতার ইলেক্‌ট্রিক বাতি আবার জ্বলিয়া উঠিল। বানচাল যন্ত্র এতদিনে ঠিক হইয়া গিয়াছে!

২ পৌষ ১৩৪১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *