তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ
বিষবৃক্ষের বীজ
দিগবিজয়ী তৈমুর লং এদিকে-ওদিকে-সেদিকে লুব্ধ দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও একজন মাত্রও যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে পেলেন না।
—গর্বিত শ্বেতাঙ্গদের দেশ ইউরোপেও নয়। তাঁর হাতে রুশিয়ার ভয়াবহ দুরবস্থা দেখে শ্বেতাঙ্গদের প্রাণ ভীষণ ভয়ে থরহরি কম্পমান।
তখনকার ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নরপতি ছিলেন স্পেনের অধিপতি। তিনি তো ভেট পাঠিয়ে মোসাহেবি করতে চান।
তৈমুর লং স্পেনকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,—আচ্ছা, আচ্ছা, তুমি নির্ভয় হও। সমুদ্রে বড় মাছের সঙ্গে ছোট মাছরাও বাস করতে পারে।
আচম্বিতে তাঁর দৃষ্টি আবিষ্কার করলে টিকিধারী চিনাদের মুল্লুক। কেবল ওকেই জয় করতে বাকি আছে। তৎক্ষণাৎ ঘোর রবে হতে লাগল ঘন ঘন তূর্যধ্বনি—বাজতে লাগল ডিমিডিমি রণডঙ্কা—ধেয়ে এল মেদিনী থরথরিয়ে পঙ্গপালের মতো সৈন্যদলের পর সৈন্যদল।
তৈমুর লং খাপ থেকে তরোয়াল খুলে পদভারে মাটি কাঁপিয়ে সদম্ভে অগ্রসর হলেন। বার্ধক্যে তিনি তখন প্রায় অন্ধ।
তারপর—
তারপর বেশ খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে সর্বজয়ী মৃত্যুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন—পথের উপরে তাঁর অসাড় হাত থেকে খসে পড়ল দিগবিজয়ীর রক্তস্নাত তরবারি। ধনেপ্রাণে বেঁচে গেল চিনদেশ। সেখানে আর হাজার-হাজার নরমুণ্ড সাজিয়ে পিরামিড গড়া হল না।
দেশের পর দেশ রক্তপ্লাবনে ডুবিয়ে, নরমুণ্ডের পিরামিডের পর পিরামিড সাজিয়ে তৈমুর লং যে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেছিলেন এইবারে ক্রমে ক্রমে তার ফলফসল ফলতে আরম্ভ করলে।
তাঁর বংশধররা সিংহাসন নিয়ে সাংঘাতিক বিবাদ করতে লাগল—সহোদর আর সহোদরকে মানলে না। পৃথিবীর নানা দেশের রাজপরিবারে বিভিন্ন সময়ে এমন ব্যাপার দেখা গেছে বটে, কিন্তু আর কোনও বংশেই ব্যাপারটা এমন ধারাবাহিকভাবে অবশ্যপালনীয় ঐতিহ্যের মতো হয়ে ওঠেনি।
তৈমুরের বংশে পুরুষানুক্রমে বারংবার দেখা গিয়েছে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি—এমনকী সে বংশে পিতাপুত্রের সম্পর্কও প্রায়ই অহি-নকুল সম্পর্কের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলে তৈমুরের মৃত্যুর পরেই তাঁর বিপুল সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড ও ছারখার হয়ে যায়।
তাঁর এক উত্তরপুরুষ রাজপুত্র বাবর স্বদেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে গিয়ে রাজ্য স্থাপন করলেন এবং পরে তিনিই হলেন ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
তাঁর পুত্র হুমায়ুনের কোনও ভাই ছিল না। তাই বোধ করি সিংহাসন নিয়ে কোনও মারামারি কাটাকাটি হয়নি।
তাঁর পুত্র আকবরও পিতার একমাত্র সন্তান। সুতরাং ভ্রাতৃবিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তিনি সন্তান-সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। তাঁর পুত্র সেলিম (পরে জাহাঙ্গির নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন) বিদ্রোহী হয়েছিলেন।
তারপর থেকেই কাকে রেখে কাকে বাদ দেব? পিতৃদ্রোহ ও ভ্রাতৃবিরোধ মোগল রাজবংশে যেন একটা বাঁধাধরা রীতি হয়ে ওঠে—প্রজাদের সঙ্গে বেমালুম মিশে যায় রাজরক্ত এবং এসব কথা এতবার অসংখ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে যে, এখানে তা নিয়ে বাক্যব্যয় করা বাহুল্যমাত্র।
যে সাজাহানের শেষ জীবনের ট্র্যাজেডি আমাদের চক্ষু অশ্রুজলে পূর্ণ করে তোলে, তিনিও যৌবনে পিতার আজ্ঞাবহ পুত্রের মতো জীবনযাপন করেননি। বিদ্রোহী হয়ে পিতা জাহাঙ্গির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন, পরে যুদ্ধে হেরে ভালোমানুষ সাজতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং তিনি ভ্রাতৃহত্যাতেও হস্ত কলঙ্কিত করতে ছাড়েননি।
তাঁরই যোগ্য পুত্র ঔরঙ্গজিব। বৃদ্ধ ও অক্ষম পিতাকে শেষজীবনের কয়েকটা বৎসরের জন্যে কারাগারে নিক্ষেপ করে তিনি রক্তের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। দুই সহোদরকে হত্যা ও আর এক সহোদরকে চিরদিনের মতো ভারত থেকে বিতাড়িত করে তবে ক্ষান্ত হয়েছিলেন।
যথার্থ পক্ষে ধরতে গেলে মোগল রাজবংশের শেষ পরাক্রান্ত সম্রাট হচ্ছেন বাহাদুর শাহ। সিংহাসন পাওয়ার পর তাঁর রাজত্বকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বটে, কিন্তু ঔরঙ্গজিবের পুত্র হয়ে সিংহাসন অধিকার করার সময়ে তিনিও বংশগত ধারা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে তিনি প্রায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ভ্রাতৃবিরোধে ও খুনখারাবিতে যোগদান না করে পারেননি।
তারপরেও মোগল রাজপরিবারে ভ্রাতৃবিরোধ ও খুনোখুনি একটা অবশ্যম্ভাবী কাণ্ড হয়ে ওঠে এবং যে-কারণে তৈমুরের সাম্রাজ্য ছারখার হয়ে যায়, তৈমুরের বংশধরদের নির্বুদ্ধিতার জন্যে মোগল সাম্রাজ্যেরও অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় ঠিক সেই কারণেই।
রক্তাক্ত বাদশাহি প্রহসন
রক্তাক্ত বাদশাহি প্রহসন? মিলনান্ত নয়—বিয়োগান্ত। অথচ প্রহসন। কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয়নি। একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দিই।
বাহাদুর শা-র মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্রদের মধ্যে অনেক মারামারি, কাটাকাটি ও খুনোখুনি চলল, তারপর ময়ূর সিংহাসনের উপরে চেপে বসলেন তাঁর পুত্র জাহান্দার শা। ঘটা হল, বাজনা বাজল, আলোর মালা দুলল।
তারপর মাস দুই যেতে না যেতেই সকলের বুঝে নিতে দেরি লাগল না যে, ভারতসম্রাটের মুকুট ধারণ করেছেন একটা সিদ্ধিখোর, বদ্ধমাতাল, মাথাপাগলা, বদখেয়ালি আস্ত ভাঁড়।
প্রথমেই তিনি ইমতিয়াজ-মহল উপাধি দিয়ে একটা সাধারণ নাচনাওয়ালিকে সম্রাজ্ঞী সাজিয়ে নিজের পাশে এনে বসালেন। লালকুঁয়ার নামে ইতিহাসে যে কুখ্যাত হয়ে আছে। তাদের উদ্ভট সব কীর্তিকথা বলবার জায়গা এখানে নেই, সংক্ষেপে মাত্র দু-চারটির উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে।
হঠাৎ একদিন লাল-কুঁয়ারের খেয়াল হল জলে ডুবে মরবার সময় লোকে কী করে তা দেখবার জন্যে।
সম্রাট জাহান্দার শা বললেন, ‘এ আর এমন শক্ত কথা কী? এখনি তোমাকে দেখাচ্ছি।’
দুর্গপ্রাসাদের অনতিদূরে প্রবহমানা যমুনা নদী এবং নদীর বুকে নৌকোয় বসে এপার থেকে ওপারে ভেসে চলেছে যাত্রীভরা নৌকোগুলো।
সম্রাট হুকুম দিলেন—’এই সেপাইরা, একখানা নৌকো এখনি ডুবিয়ে দিয়ে আয়!’
সেপাইরা হুকুম তামিল করতে ছুটল। লাল-কুঁয়ারকে নিয়ে সম্রাট লালকেল্লার উঁচু ছাদে গিয়ে উঠলেন—সেই উপভোগ্য দৃশ্য দেখে হেসে গড়াগড়ি দেওয়ার জন্যে! তার পরের দৃশ্য আর বর্ণনা না করাই ভালো।
সম্রাট একদিন রাজপথে বেরিয়ে পড়লেন—ঘোড়ার বা হাতির পিঠে বা তাঞ্জামে চড়ে নয়, দস্তুরমতো হ্যাঁকোচ-প্যাঁকোচ গরুর গাড়িতে চেপে। চললেন কোথায়? সাধারণ সরাবখানায় ঢুকে ছোটলোকদের সঙ্গে মিলেমিশে একেবারে ছোটলোকের মতো মদ্যপান করতে!
একদিন শুঁড়িখানায় মদ খেতে গিয়ে সম্রাট আর ফিরে এলেন না। পরদিন সকালে লালকেল্লায় হুল্লোড় আর হুলুস্থূলু—বাদশা লোপাট, বাদশা লোপাট! সেপাইরা দলে দলে পথে পথে বেরিয়ে পড়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে অবশেষে দেখে, ভারতসম্রাট জাহান্দার শা মদে বেহুঁশ হয়ে একখানা ভাড়াটে গাড়ির মধ্যে দিব্য নিদ্রাসুখ উপভোগ করছেন! ছোটলোক ভবঘুরে ইয়াররাও মাতাল হয়ে তাঁকে গালি দিলে বা লাথি মারলেও সম্রাট রাগ করতেন না!
আর একদিন। দিল্লি শহরের এক জায়গায় একটা উঁচু পাথরের ঢিপি ছিল, তার ঢালু গা খুব তেলা। রাস্তার ছোট ছোট ছেলেরা এই ঢিপির মসৃণ গা বয়ে হড়কে নামতে নামতে চারিদিক আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত করে তুলত।
একদিন শিশু ও বালকরা এমনই আমোদে মেতে আছে। হঠাৎ সচমকে তারা দেখলে, জমকালো পোশাকপরা এক বুড়োখোকা আহ্লাদে আটখানা হয়ে নাচতে নাচতে এসে শিশুদের খেলায় যোগদান করলে। বুড়োখোকার বয়স তখন পঞ্চাশ! তিনিই দিল্লির বাদশাহ শুনে শিশুরা একেবারে হতভম্ব!
দুনিয়ার আর কোনও দেশে এমন আজব বাদশাহ আর কেউ দেখেছে?
ডাকু নাদির শা মর্যাদাহীন ময়ূর সিংহাসন লুটে নিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তার অনেক আগেই হাজার হাজার মানুষের রক্তে দুই হাত ডুবিয়ে এই নৃশংস বুড়ো খোকা ময়ূর সিংহাসনে আরোহণ করে তার সমস্ত গৌরব ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল—এসব প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয় এবং প্রহসনই শেষটা বিয়োগান্ত দৃশ্যে পরিণত হয়েছিল। দিল্লি জাহান্দার শাহকে পুরো এক বৎসরও সহ্য করতে পারেনি—হত্যাকারীরা গলা টিপে ও লাথি মেরে তাঁকে জাহান্নমে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
শেষপর্যন্ত এমনই রক্তাক্ত প্রহসনের ভিতর দিয়েই দিল্লিতে একদিন নকল ময়ূর সিংহাসনের উপরে সাজিয়ে রাখা নকল ও অসার বাদশাহির ঝকমকানি নিঃশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এইবারে ঔরঙ্গজিবের উত্তরাধিকারী মহম্মদ মুয়াজ্জাম বা শা আলম, বাহাদুর শাহের সিংহাসন অধিকারের ব্যাপার নিয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনা করব। তা হলেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন তৈমুরের রোপিত বিষবৃক্ষের ফল কীভাবে বারে বারে সমগ্র মোগল রাজবংশে ছড়িয়ে পড়েছিল—মোগল রাজকুমাররা শুনে বা দেখে বা ঠেকেও কিছুই শিখতে পারেননি—এমনকী এই অভিশপ্ত বংশে জন্মগ্রহণ করে মিষ্টস্বভাব ও দয়ামায়ার অধিকারী হয়েও বাহাদুর শাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও রক্তপ্লাবনে গা ভাসাতে হয়েছিল।
সাবধানি ঔরঙ্গজিব
ঔরঙ্গজিবের পাপী মন, পাছে স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিজেকেই ভোগ করতে হয়, সেই ভয়ে সর্বদাই উদবিগ্ন হয়ে থাকত। একে পিতৃদ্রোহের ধাক্কা মৃত্যুর অনেক আগেই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল, তার উপরে তিনি নিজের পিতাকেও যে ভাবে আগ্রা দুর্গে বহুকালের জন্যে বন্দি করে রেখেছিলেন, তাঁর নিজের পুত্রদেরও কেউ তাঁর সঙ্গে যদি সেই রকম অসদাচরণ করে, সেই ভয়ে পুত্রদের কারুকেই কাছে না রেখে তিনি দূরে দূরান্তরে থাকতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি তাঁর কোনও পুত্রকেই বিশ্বাস করতেন না—যদিও ছোট ছেলে কামবক্সের উপরে তাঁর প্রাণের টান ছিল একটু বেশি মাত্রায়। থাক প্রাণের টান, তবু সাপের বাচ্চা তো!
তাঁর সন্তানসংখ্যা দশ—পাঁচ ছেলে, পাঁচ মেয়ে। মেয়েদের কথা ধরব না, ঔরঙ্গজিবের মৃত্যুর সময়ে দুই পুত্রও বর্তমান ছিল না। বড় ছেলে মহম্মদ সুলতান যৌবনসীমা পার হয়েই অপুত্রক অবস্থায় মারা পড়েন এবং চতুর্থ পুত্র আকবর বিদ্রোহী হয়ে প্রথমে রাজপুতদের সঙ্গে যোগ দেন, তারপর শিবাজির পুত্র শম্ভুজির দলে ভিড়ে সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে পারস্য দেশে পালিয়ে যান ও পারস্যপতির অন্নদাস হয়ে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ঔরঙ্গজিব পুত্রদের অকারণে সন্দেহ করতেন না। আকবরের পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ও যুবরাজরূপে বিবেচিত মহম্মদ মুয়াজ্জামও (পরে বাহাদুর শাহ) পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে প্রায় সাত বৎসরকাল বন্দিজীবন যাপন করে পরে মুক্তিলাভ করেন। পিতার মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন সুদূর কাবুলের শাসনকর্তা।
তৃতীয় পুত্র আজম শাহ কারাগারে নিক্ষিপ্ত না হলেও কোনও কোনও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁরও যোগসাজস ছিল। তবু নারাজ মনেও ঔরঙ্গজিব তাঁকে কতকটা নিজের কাছাকাছি থাকতে দিয়েছিলেন।
ছোট ছেলে মহম্মদ কামবক্স নিজেকে পিতার প্রিয়পাত্র জেনে বয়সে প্রৌঢ় হয়েও ব্যবহার করতেন আদুরে দুলালের মতো। তিনি বিজাপুরের সুবাদারের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দূরে দূরে তিন ভ্রাতার অবস্থান, কারুর সঙ্গে কারুর ঝগড়া করবার বিশেষ সুবিধা নেই।
নিজের মৃত্যর পর যাতে ভ্রাতৃবিরোধ না হয় সেজন্যেও ঔরঙ্গজিব অল্প মাথা ঘামাতেন না—কারণ কথিত আছে, তিনি নিজের সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন সুবায় বা প্রদেশে বিভক্ত করে তিন পুত্রকে দান করে গিয়েছিলেন। এই উইলখানি ঔরঙ্গজিবের মৃত্যুর পর তাঁর উপাধানের তলায় পাওয়া যায়। সাম্রাজ্য ভাগ হয়েছিল এই ভাবে : যুবরাজ মুয়াজ্জাম পাবেন উত্তর-পশ্চিমের বারোটি প্রদেশ এবং দিল্লি হবে তাঁর রাজধানী। আজম শাহ পাবেন দক্ষিণের ছয়টি প্রদেশ এবং আগ্রা হবে তাঁর রাজধানী। বিজাপুর ও হায়দ্রাবাদ দুটি প্রদেশ নিয়ে কামবক্স যদি খুশি থাকেন, তা হলে কেউ যেন তাঁর উপরে কোনও তম্বিতাম্বি না করেন।
কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি ঔরঙ্গজিবকে ক্ষমা করলে না, জীবনে যত মহাপাপ তিনি করেছিলেন, মৃত্যুর পরেও তাঁর পরলোকগত আত্মার উপরে সেসব অনাচার ও দুষ্কৃতি চেপে বসেছিল দুঃসহ বোঝার মতো।
ঔরঙ্গজিব শেষ শয্যা গ্রহণ করলেন। পিতা সাজাহানের রোগশয্যাকে পুত্র হয়েও তিনি কেমন করে বন্দিশালার মধ্যে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ঔরঙ্গজিব তা ভুলতে পারেননি। নিজের অন্তিমকালে পাছে তারই পুনরাভিনয় হয়, সেই ভয়ে নিকটস্থ পুত্র আজম শাহকে তিনি মালোয়ার বিদ্রোহ দমনের অছিলায় দূরে যাত্রা করতে হুকুম দিলেন।
আজম শাহের শম্বুকগতি
কিন্তু সাপের বাচ্চা সাপ ছাড়া আর কিছু হয় না। পিতার ছল ধরে ফেলতে আজম শাহের বিলম্ব হল না। তিনি বুঝতে পারলেন, পিতার শেষদিনের আর দেরি নেই। লোকদেখানো হুকুম তামিল করবার জন্যে তিনি যুদ্ধযাত্রা করলেন বটে, কিন্তু শম্বুকগতিতে। চার দিনে মোট চল্লিশ মাইল!
গোদাবরী নদীর তীরে তাঁবু ফেলবার পর আজম শাহ খবর পেলেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ তারিখে অর্ধ শতাব্দীর উপর রাজত্ব ভোগ করবার পর ঔরঙ্গজিব রাজদণ্ড ফেলে দিয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত—কে আর এখন বোকার মতো যুদ্ধযাত্রা করে, নিজের আখের ভুললে চলবে না।
মন্ত্রীরাও আজম শাহকে পিতার শেষকৃত্য করবার জন্যে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার জন্যে অনুরোধ করলেন।
আজম শাহের দেরি হল না। পিতৃহারা পুত্র চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে পিতার মৃত্যুর পরের রাত্রেই মৃত্যুশয্যার পাশে এসে পড়লেন এবং সাধারণ লোকের মতোই অশ্রুজড়িত ভগ্নস্বরে ‘পিতা! পিতা!’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন। সবাই বলাবলি করতে লাগল—’ওঃ, রাজপুত্র কী পিতৃভক্ত!’
শেষকৃত্যের তোড়জোড় করতে করতে আজ শাহ কিন্তু নিজের কাজ গোছাতে ভুললেন না! পিতার দেহ সমাধিস্থ করেই তিনি নিজেকে গোটা হিন্দুস্থানের ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে দিলেন। প্রকাশ্যভাবে রাজমুকুট ধারণ করে নিজের নাম গ্রহণ করলেন—’আবুল-ফয়েজ, কুতবউদ্দিন, মহম্মদ আজম শা, গাজি।’ উপস্থিত সমস্ত প্রধান প্রধান রাজকর্মচারী তাঁর আনুগত্য স্বীকার করলেন—তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সেনাপতি জুলফিকার খাঁ পর্যন্ত।
আজম শাহের নামে যে সব মুদ্রা প্রস্তুত হল তার উপরে লেখা রইল—সম্রাট আজম শাহ।
মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন, আগে কামবক্সকে দমন করা হোক।
আজম শাহ বললেন, ‘উহুঁ’, আগে মুয়াজ্জাম। যদিও সে নয় দারাশেকো, তাকে শায়েস্তা করতে হলে একগাছা যষ্টিই যথেষ্ট, তবু আগে তার লম্ভঝম্প বন্ধ করা দরকার। চল হিন্দুস্থানের দিকে।’
আজম শাহ আমেদনগর থেকে সসৈন্যে যাত্রা করলেন হিন্দুস্থানের পথে।
মুয়াজ্জামের সমস্ত গতিবিধির খবর আজম শাহের কাছে এসে পৌঁছোতে লাগল। সর্বাগ্রে তাঁর নজর গেল আগ্রার দিকে। তিনি ছুটলেন আগ্রা দুর্গ দখল করবার জন্যে।
এর কারণও ছিল। তাঁর বা মুয়াজ্জাম, কারুর হাতেই উচিতমতো টাকাকড়ি ছিল না। আগ্রা দুর্গের ভাণ্ডারে রক্ষিত আছে কয়েকজন মোগল সম্রাটের রাজত্বকালে সঞ্চিত কোটি কোটি টাকা মূল্যের বিপুল ধনরত্ন। যে আগে সেই ধনরত্নের ভাণ্ডার দখল করতে পারবে, কেউ পারবে না তার অগ্রগতি রোধ করতে।
অতএব আগ্রা চলো, আগ্রা চলো!
মুয়াজ্জাম শা আলম
সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, নরহন্তা তৈমুরের বংশে জন্মগ্রহণ করলেও মুয়াজ্জাম ছিলেন না রক্তের ভক্ত। তিনি ছিলেন যেন অনেকটা হিন্দুদের দৈত্যসন্তান প্রহ্লাদের মতো।
পিতাকে কারারুদ্ধ এবং দারাকে হত্যা করেও ঔরঙ্গজিবের রক্তপিপাসা তৃপ্ত হয়নি, তারপরেও তিনি দাদার রক্তাপ্লুত কাটামুণ্ড পর্যন্ত স্বচক্ষে দর্শন করতে ছাড়েননি। এবং আর এক অগ্রজ মুরাদের সাহায্যে যুদ্ধজয়ী হয়েও তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে বিষপ্রয়োগে হত্যা করতেও তিনি সংকুচিত হননি। তাঁর কোনও অতিভক্তও বলতে পারবে না, এই সব মহা অপকর্মের পরেও ঔরঙ্গজিব জীবনে কোনওদিন অনুতপ্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু ঔরঙ্গজিবের পুত্র হয়েও মুয়াজ্জামের মন ছিল ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তার মধ্যে ছিল দয়ামায়া ও পারিবারিক স্নেহ-ভালোবাসার স্থান। যুবরাজরূপে রাজধর্মে দীক্ষিত হয়ে রাজ্যরক্ষা এবং আত্মরক্ষার জন্যে তাঁকে তরবারি ধারণ করতে হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি কোনওদিন দেখেননি ভ্রাতৃহত্যার বিকট দুঃস্বপ্ন। বরং তিনি সহোদরদের সঙ্গে মিলেমিশে নিরুপদ্রব জীবনযাপন করতেই চেয়েছিলেন। পরের ঘটনাবলিই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করবে এই সত্য।
আজম শাহ হিন্দুস্থানের দিকে সসৈন্যে ছুটে আসছেন আগ্রা দুর্গের রত্নভাণ্ডার লুণ্ঠন করবার জন্যে, এই সংবাদ পেয়েই মুয়াজ্জাম তাঁর রাজ্যলোভী ভ্রাতাকে পত্র লিখে জানালেন, তুমি কেন বৃথা রক্তপাত করবে? তুমি কি জানো না যে যুবরাজরূপে পিতা আমাকেই নির্বাচন করেছেন এবং তোমাকে দান করেছেন দক্ষিণের কয়েকটি সুবা? এতেও তুমি যদি তুষ্ট না হও তাহলে এর উপরে আমি গুজরাট ও আজমির প্রদেশও ছেড়ে দিতে রাজি আছি।
কারুর কারুর মতে মুয়াজ্জাম আরও বলেছিলেন যে, এতেও যদি তোমার মন না ওঠে, তাহলে অগণ্য নিরপরাধ লোককে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা না করে এসো, আমরা দুজনে স্বহস্তে তরবারি নিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হই—যে জিতবে সেই-ই পাবে হিন্দুস্থানের সিংহাসন।
এই প্রস্তাব শুনে আজম শাহ রেগে টং হয়ে উঠলেন বেনিয়ার (তিনি তাঁর দাদাকে বেনিয়া নামেই ডাকতেন) স্পর্ধা দেখে।
তিনি বললেন, ‘বেনিয়া দাদা ভালো লেখাপড়া জেনেও শেখ সাদি মিয়াজির ‘গুলিস্তানে’র এই উক্তি বোধহয় ভুলে গেছেন—’দশজন গরিব লোক একখানা লেপ গায়ে দিয়েই সুখে ঘুমোতে পারে কিন্তু এক রাজ্যের মধ্যে দুই রাজার স্থান সংকুলান হয় না।’
‘দুখানা তরবারি কি একখানা খাপে ঢোকে? ভাগাভাগি করতে হলে একমাত্র শর্তে আমি সম্মত হতে পারি। সকলের ভাগ সমান হওয়া উচিত—একজন নিজের পাতে বেশি ঝোল টানবে কেন? আমি চাই এইরকম ভাগাভাগি (এখানেও তিনি কবি-কথিত বচন উদ্ধার করলেন)—’আমার অংশে থাকবে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত, আর তুমি পাবে ছাদের উপর থেকে শূন্যতল পর্যন্ত।’
তারপর সগর্বে বুক চিতিয়ে জামার আস্তিন গুটিয়ে দুই বাহু প্রসারিত করে বললেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে আবার আমাদের দেখা হবে।’
মুয়াজ্জাম দুঃখিত মনে উপলব্ধি করলেন, এমন অবস্থায় যুদ্ধ অনিবার্য। তখন তিনি আত্মরক্ষার জন্যে যুদ্ধের তোড়জোড় করতে লাগলেন—দারার শোচনীয় পরিণাম তিনি ভোলেননি। আত্মরক্ষা করতে না পারলে তাঁকেও অপঘাতে মরতে হবে—ঘাতকের খড়গঘাতে ভ্রাতাকে নিজের মুণ্ডচ্ছেদ করবার অবসর দেওয়ার আগ্রহ তাঁর ছিল না। কোনও মানুষেরই তা থাকে না।
আগ্রার মতো দিল্লির লালকেল্লার মধ্যেও প্রভূত ধনরত্ন সঞ্চিত ছিল। যে এই দুটি কেল্লা আগে দখল করতে পারবে তার জয়ের আশা সুনিশ্চিত।
দুজনেরই যাত্রাপথ প্রায় সমান সমান। আজম শাহকে সাতশো মাইল অতিক্রম করে আগ্রায় পৌঁছোতে হবে, আর মুয়াজ্জামকে যেতে হবে সাতশো পনেরো মাইল।
দুজনেই লোক-লশকর নিয়ে যথাসম্ভব শীঘ্রগতিতে অগ্রসর হলেন। এবং প্রথম চালে জিতে গেলেন মুয়াজ্জামই। সর্বাগ্রে তিনি দিল্লি এবং তারপর আগ্রা দখল করে বসলেন।
গোয়ালিয়র পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে আজম শাহ এই দুঃসংবাদ শ্রবণ করলেন।
তারপর শোনা গেল, আশি হাজার সৈন্য নিয়ে মুয়াজ্জাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।
কিন্তু এজন্যে তিনি একটুও চিন্তিত হলেন না, কারণ তাঁর অধীনে ছিল পঁয়ষট্টি হাজার অশ্বারোহী ও পঁয়তাল্লিশ হাজার বন্দুকধারী পদাতিক সৈন্য। সৈন্যবলে তিনিই অধিকতর শক্তিশালী। তার উপরে মুয়াজ্জামকে কোনওদিনই তিনি মানুষের মতো মানুষ বলে গণ্য করতেন না—সে লড়াইয়ের কী জানে? একখানা লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলেই সে তরোয়াল ফেলে পালাবার পথ পাবে না! যুদ্ধের প্রথম নীতি হচ্ছে, শত্রুকে তুচ্ছ মনে না করা। এই নীতি না মেনে কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধনের কী পরিণাম হয়েছিল সকলেই তা জানে। এখন ওই নীতি অগ্রাহ্য করে দর্পী আজম শাহও কী বিপদের খাঁড়ার তলায় গিয়ে দাঁড়ালেন, এইবারে আমরা তা দেখতে পাব।
জাজাউয়ের যুদ্ধ
অতঃপর যে যুদ্ধ হয় আমরা খুব সংক্ষেপে তা বর্ণনা করব। ব্যাপারটা বিয়োগান্ত হলেও এর মধ্যেও প্রহসনের অভাব নেই।
মুয়াজ্জাম দিল্লি ও আগ্রা দুর্গ দখল করেছেন, এই খবর পেয়েই আজম শাহ যেন খেপে গেলেন। তার উপরে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতুষ্পুত্র এবং বাংলা ও বিহারের সুবাদার মহম্মদ আজিমও বহু সৈন্য ও প্রভূত ধনসম্পত্তি নিয়ে পিতার সঙ্গে যোগদান করেছেন শুনে প্রচণ্ড রাগে তিনি আর সব কথা ভুলে গেলেন।
ভারী ভারী কামান ও অতিরিক্ত যা কিছু মাল পিছনে ফেলে রাখবার হুকুম হল—মুয়াজ্জাম লড়াই করতেই জানে না—মশা মারবার জন্যে কামান পাতবার দরকার কী? মুয়াজ্জামকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে তরবারিই যথেষ্ট! অতএব তাড়াতাড়ি এগুবার জন্যে কতকটা ঝাড়া-হাত-পা হয়ে আজম শাহ প্রাণপণ বেগে ছুটে চললেন।
তিনি স্থির করলেন, যুদ্ধক্ষেত্র হবে সমুগড়ে। এ হচ্ছে সেই ইতিহাসখ্যাত সমুগড় প্রান্তর, বাহান্ন বৎসর আগে যে যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভের ফলে ঔরঙ্গজিব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারার মুণ্ডচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন। গণৎকাররাও তিথি-নক্ষত্র দেখে ভবিষ্যদবাণী করলে—ঠিক, ঠিক। জায়গার মতো জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে, যুদ্ধজয় অবশ্যম্ভাবী!
সমুগড়ে গিয়ে পৌঁছোবার আগেই সৈন্যদের অবস্থা দস্তুরমতো কাহিল হয়ে পড়ল।
একে তো এ অঞ্চলে দুর্ধর্ষ গরম পড়ে, তার উপরে পথে পুকুর কি ইঁদারা পাওয়া গেল না—এক জায়গায় কেবল একটা নালার ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল অব্যবহার্য, নোংরা ও পঙ্কিল জল। সে অস্বাস্থ্যকর জল যে পান করেছিল সেই-ই যাতনায় কাতর হয়ে পড়েছিল। আমির-ওমরাদের ততটা কষ্টভোগ করতে হল না—কারণ তাঁদের সঙ্গে ছিল মশক-ভরতি মিষ্ট জল, বিপদে পড়ল কেবল সাধারণ যুদ্ধব্যবসায়ীরা। বিষম তেষ্টায় তাদের প্রাণ ঠা-ঠা করতে লাগল, অনেকের শুকনো জিভ মুখের বাইরে বেরিয়ে ঝুলে পড়ল, অনেকে তৃষ্ণার জ্বালা সইতে না পেরে মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করলে।
তারপর বিপদের উপর বিপদ—সমুগড়ে পৌঁছে শত্রুর কোনওই পাত্তা পাওয়া গেল না।
মুয়াজ্জাম দূতের মুখে আজম শাহের গতিবিধির সব খবরাখবর পাচ্ছিলেন। তিনি ধীরে সুস্থে ঢোলপুরের নিকটবর্তী জাজাউ প্রান্তরে তাঁবু ফেলে ছোট একদল অগ্রবর্তী রক্ষীসৈন্যকে শত্রুর সন্ধানে প্রেরণ করলেন।
আজম শাহও দৌড় দিলেন জাজাউ প্রান্তরের দিকে।
অগ্রসেনাদল জাজাউ প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছেই আক্রান্ত হল। প্রধান সেনাদল নিয়ে মুয়াজ্জাম নিজে ছিলেন অনেকটা পিছনে, ঘটনাস্থলের বার্তা যথাসময়ে তাঁর কাছে পৌঁছোল না। তিনি নিশ্চিন্তভাবে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়লেন।
আজম শাহের পুত্র বিদার বখত অনেক সৈন্যসামন্ত নিয়ে সেই অগ্রবর্তী শত্রুদলকে তেড়ে গিয়ে আক্রমণ করলেন, তারা খানিক লড়াই করেই অসংখ্য শত্রু দেখে, বুদ্ধিমানের মতো চম্পট দিতে বাধ্য হল।
বিদার বখত আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন—’আমরা জিতে গিয়েছি—আমরা জিতে গিয়েছি—জোরসে বাজাও জয়ডঙ্কা!’
ডিমি ডিমি ডিমি ডিমি রণদামামাগুলো গভীর রবে বাজতে বাজতে বিদায় বখতের বিজয়বার্তা দিকে দিকে প্রেরণ করতে লাগল।
সেই ডঙ্কাগুলোর ঘোর নির্ঘোষ শুনেই আজম শাহ আহ্লাদে আটখানা হয়ে পুত্রের সঙ্গে যোগ দিতে ছুটলেন—কেউ কেউ বাধা দিয়ে বললে, ‘হুজুর, একটু সাবধান হওয়া উচিত—আগে ভালো করে খবরাখবর নেওয়া দরকার।’
আজম শাহ খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘এ সব হচ্ছে মেয়েলি কথা। সৈন্যদল, অগ্রসর হও, অগ্রসর হও!’
তিন মাইল দূরে মুয়াজ্জাম তখন নিকটবর্তী অরণ্যে শিকার খেলা নিয়ে মেতে ছিলেন। আচম্বিতে শত্রু-দামামার বিজয় ঘোষণা শুনে তাঁর মনে পড়ে গেল, অগ্রবর্তী সেনাদের সঙ্গে তাঁর পুত্র আজিম-উসসানও আছেন! পুত্র বিপদে পড়েছে ভেবে প্রধান সেনাদল নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন।
একজন খবর-দার সব দেখেশুনে আজম শাহকে গিয়ে বললে, ‘হুজুর, আসল ফৌজ নিয়ে এইবার মুয়াজ্জাম লড়াই করতে আসছেন।’
আজম শাহ চিরদিনের অভ্যাসমতো বুক ফুলিয়ে জামার আস্তিন গুটাতে গুটাতে ক্রুদ্ধস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘আমার সমুখে কোনও শত্রু আসতে সাহস করবে? আনো আমার হাতি, দাও আমাকে একগাছা লাঠি! আমি মুয়াজ্জামকে শায়েস্তা করব লাঠির চোটেই। মাভৈঃ! আমি আমার বিজয়ী পুত্রের সঙ্গে মুলাকাত করতে যাচ্ছি!’
তখন আসল লড়াই শুরু হয়েছে—মুয়াজ্জামের কামান-শ্রেণি ভৈরব গর্জন ও দীপ্তমুখ থেকে ঘনঘন তপ্ত গোলা উদগার করছিল।
তাতল বালুকাভরা প্রান্তর এবং গ্রীষ্মের তপ্ততাও ভয়াবহ। হু-হু করে লু ছুটছে—ধুলোর ঝড়ে আজম শাহের তৃষ্ণার্ত সেনাদলের প্রাণান্ত পরিচ্ছেদ হয়ে উঠল। সে ঝড়ের বেগ এত তীব্র যে নিক্ষিপ্ত তির আবার ফিরে আসে নিক্ষেপকারীর দিকে! স্বহস্তে নিক্ষিপ্ত তির ফিরে এসে অনেককে বধ করতেও ছাড়লে না!
ব্যাপার দেখে সেনাপতি জুলফিকার খাঁ বুদ্ধিমানের মতো সদলবলে পিছিয়ে এলেন, রাজা জয়সিংহ যোগ দিলেন শত্রুদলের সঙ্গে এবং অন্যান্য অনেক সেনাপতিও জুলফিকারের পথ অবলম্বন করলেন।
যিনি ভালো করে না দেখেশুনে জয়ডঙ্কা বাজাবার হুকুম দিয়ে এই অভাবিত কাণ্ড বাধালেন, আজম শাহের পুত্র সেই বিদার বখতও এক গোলার আঘাতে মারা পড়লেন এবং আহত হলেন তাঁর এক ভ্রাতাও। তা ছাড়া সেই সঙ্গে বহু সেনাপতিকেও মৃত্যুমুখে পড়তে হল।
কিন্তু আজম শাহের ভ্রূক্ষেপ নেই কিছুতেই—যেখানে জোর যুদ্ধ চলছিল সেইদিকে হস্তীচালনা করবার জন্যে মাহুতকে হুকুম দিলেন।
মাহুত হাতজোড় করে বললে, ‘হুজুর, আমার হাতি অনায়াসে একশো মাইল ছুটে পালাতে পারবে। যদি আদেশ করেন—’
মাহুতের ইঙ্গিত বুঝে আজম শাহ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, ‘কী! আমাকে পালাতে বলছিস? তৎক্ষণাৎ তরবারির এক আঘাতে তাকে মাটির উপরে ফেলে দিয়ে নিজেই মাহুতের স্থান অধিকার করে হাতি চালাতে লাগলেন। তাঁর দেহের কয়েক জায়গায় তির বিদ্ধ হল কিন্তু তিনি আমলে আনলেন না। অবশেষে বন্দুকের এক গুলির আঘাতে তাঁর মৃতদেহ হাতির পিঠেই লুটিয়ে পড়ল।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারার ছিন্নমুণ্ড দর্শন করে ঔরঙ্গজিব খুশি হয়েছিলেন। সুতরাং আজম শাহের কাটা মুণ্ড দেখেও মুয়াজ্জাম খুশি হয়ে নিশ্চয়ই পুরস্কার দান করবেন! এই কথা ভেবে পাঠান সেনানি রুস্তম দিল খাঁ হাতির পিঠে চড়ে আজম শাহের মৃতদেহ থেকে মুণ্ডটা কেটে নিয়ে ছুটে গিয়ে মুয়াজ্জামের পায়ের তলায় উপহার দিলেন।
পুরস্কার? বিষম ক্রুদ্ধ হয়ে মুয়াজ্জাম তাঁকে ভীষণ তিরস্কার করতে লাগলেন—রুস্তম খাঁ তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচলেন।
তারপর মুয়াজ্জামের দুই চক্ষু দিয়ে ঝরঝর করে শোকাশ্রু ঝরতে লাগল।
নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করবার পর আজম শাহ তিন মাস দশদিন বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চান্ন বৎসর সাত মাস ছয় দিন। তিনি নিজেই নিজের মৃত্যুর কারণ, এ কথা বললে ভুল বলা হয় না। এ হচ্ছে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের কথা।
কিন্তু আজম শাহের মৃত্যুর পরেও মুয়াজ্জাম হাঁপ ছাড়বার সময় পেলেন না। কারণ তারপর নিজেকে ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে ঘটনাস্থলে এগিয়ে এলেন ঔরঙ্গজিবের প্রিয়তম কনিষ্ঠ পুত্র মহম্মদ কামবক্স। তাঁর নামেও প্রস্তুত হল স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা।
সে আর এক বিয়োগান্ত প্রহসন।
কামবক্সের কারদানি
সম্রাট নাম ধারণ করবার পর থেকেই কামবক্স যথেচ্ছভাবে যে অত্যাচার আরম্ভ করলেন, তার ফলে সকলেরই প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল।
অতিরিক্ত আদর পেয়ে ঔরঙ্গজিবের জীবদ্দশাতেই তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, এখন হাতে ক্ষমতা পেয়ে তিনি ব্যবহার করতে লাগলেন ঘোর উন্মাদগ্রস্তের মতো।
সেসব এখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলবার জায়গা হবে না। যেসব মানী আমির-ওমরাও বিশ্বস্তভাবে তাঁর স্বার্থরক্ষার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের কারুকে তিনি যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করলেন, এবং কারুর সমস্ত সম্পত্তি লুটে নিলেন।
রুস্তম দিল খাঁয়ের কুকীর্তির কথা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে, হতভাগ্য আজম শাহের কাটা মুণ্ডভেট দিয়ে মুয়াজ্জামের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছিলেন পুরস্কারের বদলে তিরস্কার; এখন কামবক্সের অনুগত হয়ে লাভ করলেন চরম দণ্ড প্রাণদণ্ড। আর এক দিক দিয়ে দেখলে বলা যায় এ হচ্ছে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত।
এমনি সব অত্যাচারের ফলে বহু নিরপরাধ ও প্রধান ওমরাহকে অপঘাতে মারা পড়তে হল, বহু ধনীর সর্বস্ব লুণ্ঠিত হল এবং দলে দলে লোক ধনপ্রাণ বাঁচাবার জন্যে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হল।
অবশেষে কামবক্স হায়দ্রাবাদ ছেড়ে মুয়াজ্জামের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষার জন্যে সদলবলে বেরিয়ে পড়লেন।
এইবার মুয়াজ্জাম কী করছেন তা দেখা দরকার।
মুয়াজ্জাম বা শা আলম ঔরঙ্গজিবের মৃত্যুর পূর্বেই আসীন ছিলেন তাঁর উত্তরাধিকারী যুবরাজের আসনে, সুতরাং এখন পিতার মৃত্যুর পর তিনি যে সিংহাসন লাভ করলেন সে কথা বলাই বাহুল্য। ‘সম্রাট’ উপাধি তিনি তাঁর দুই ভ্রাতার মতো গায়ের জোরে গ্রহণ করেননি। এবং সম্রাট হয়ে তিনি নিজেকে বাহাদুর শাহ নামে পরিচিত করলেন। অতঃপর আমরাও তাঁকে ওই নামেই ডাকব।
তারপর আজম শাহের সঙ্গে যুদ্ধ ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু।
সম্রাট বাহাদুর শাহ জয়ী হয়ে দেখলেন, তাঁর চারিদিকেই অন্যান্য শত্রুর দল আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে এবং তাদের মধ্যে রাজপুত ও শিখরা ক্রমেই অধিকতর বিপদজ্জনক হয়ে উঠছে। তাই সর্বাগ্রে তিনি রাজপুতানা আক্রমণ করলেন।
সেখানে ছোটখাটো কয়েকটা যুদ্ধে জিতেই তিনি খবর পেলেন, তাঁর ছোট ভাই কামবক্সও ‘সম্রাট’ নামে নিজেকে পরিচিত করে তাঁকে আক্রমণ করবার জন্যে সসৈন্যে অগ্রসর হচ্ছে।
বাহাদুর শাহ, যে ভ্রাতৃবিরোধের পক্ষপাতী ছিলেন না, সেটা আমরা আগেই দেখেছি। এবারেও রক্তপাত না করে ভালোয় ভালোয় সব গোলমাল মিটিয়ে ফেলবার জন্যে তিনি দূত-মারফত কামবক্সকে এই মর্মে জানালেন যে—তুমি যদি বাবার উইলের শর্ত অনুসারে দুটি সুবা নিয়ে তুষ্ট থাকো তাহলে তোমার সঙ্গে আমি কোনও শত্রুতাই করব না। আশা করি তোমার দাদা আজম শাহের পরিণামের কথা তুমি ভুলবে না। মোসাহেবদের কুপরামর্শে ভুলে আমাকে আক্রমণ করে নিজের বিপদকে নিজেই ডেকে এনো না।
বাহাদুর শাহের কথা কামবক্স কানেও তুললেন না, মোসাহেবদেরই মত মেনে নিয়ে তিনি সগর্বে বললেন—’আমি যুদ্ধ করব। সৈন্যগণ! প্রস্তুত হও, অস্ত্র নাও, দিল্লি চলো!’
কিন্তু কোথায় সৈন্যদল? বিরাট এক বাহিনী নিয়ে বাহাদুর শাহ এগিয়ে আসছেন শুনে কামবক্সের অধিকাংশ সৈন্য দলে দলে পলায়ন করল এবং অনেকে যোগ দিলে বাহাদুর শাহের দলেই।
কামবক্স কিন্তু একটুও দমলেন না, বললেন, ‘কী দরকার আমার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে? আমার সহায় আল্লাহ,—তিনি আমার মঙ্গলই করবেন!’
চাটুভাষী গণৎকাররাও ভবিষ্যদবাণী করলে—’হুজুর, নিশ্চিন্ত থাকুন, আল্লাহ আশ্চর্যভাবে আপনাকে রক্ষা করবেন, যুদ্ধে আপনার জয়লাভ অনিবার্য!’
তিনি তাদের কথাই বিশ্বাস করলেন এবং কপাল ঠুকে তিন-চারশো মাত্র অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বাহাদুর শাহের লক্ষাধিক যোদ্ধাকে ঠেকাবার জন্যে বেরিয়ে পড়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন।
তারপর যুদ্ধের নামে যা হল তা প্রায় একতরফা হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়—এক পক্ষ মারলে, আর এক পক্ষ প্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেলে, ভূমিতলে বইতে লাগল বীভৎস রক্তবন্যা! বিপুল বাদশাহি বাহিনীকে অঙ্গুলাগ্রে গণনীয় কামবক্সের কয়েকজন সৈনিক ঠেকাতে পারবে কেন? অনেকে মরল, অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল, নিতান্ত বিশ্বাসী কয়েকজন মাত্র তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লড়তে ও মরতে লাগল।
শাজাহানের রাজত্বকালে, অন্যান্য রাজপুত্রদের সঙ্গে তরুণ ঔরঙ্গজিব একবার একটা খ্যাপা হাতির সামনে গিয়ে পড়েছিলেন। বড় ভাইরা অর্থাৎ দারা, সুজা ও মুরাদ বুদ্ধিমানের মতো সরে পড়ে বিপদ থেকে নিস্তারলাভ করলেন, কিন্তু ঔরঙ্গজিব পালাবার নাম মুখেও আনলেন না, তরোয়াল খুলে সেই মত্তমাতঙ্গের সামনে একাই রুখে দাঁড়ালেন। এই সাহস ও বীরত্বের জন্য ঔরঙ্গজিব পরে পিতার কাছ থেকে প্রভূত প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
সম্রাট হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও কামবক্স যে কত বড় ‘বাপকো বেটা’, সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তার জ্বলন্ত নজির দিলেন।
নিজের অধিকাংশ সৈন্য হত বা আহত, সম্মুখে নিশ্চিত পরাজয় বা মৃত্যু জেনেও কামবক্স একবারও পশ্চাৎপদ হলেন না, যেখানে শত্রুরা দলে ভারি সেইখানেই মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তিরধনুক নিয়ে প্রাণপণে লড়াই করতে লাগলেন। তাঁর নিজের দেহের কয়েক জায়গা আহত হয়ে দরদর ধারে রক্ত ঝরতে লাগল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে তিনি ধনুক থেকে বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করে শত্রু বধ করতে লাগলেন—পরে পরে তাঁর দুটো তূণ খালি হয়ে গেল—বাহশাহি সৈন্যরা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে সাহস পেলে না—অনেকে মারাত্মক চোট খেয়ে মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ল—অনেকে তাঁর মারমূর্তি দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল—তিনি একাই যেন একশো! তাঁর অসমসাহস ও বীরত্ব দর্শন করে শত্রুপক্ষের সবাই বিপুল বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল!
অবশেষে যা হওয়ার তাই হল। ক্রমাগত রক্তপাতের ফলে কামবক্স নির্জীবের মতো হাতির হাওদার ভিতরে শুয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
বাদশাহি সেপাইরা তখন চারিদিক থেকে তাঁর হস্তীকে ঘিরে ফেলেছিল। কামবক্সের অচেতন দেহ পালকিতে তুলে বাহাদুর শাহের সামনে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করা হল।
এই রণক্ষেত্রে হাজির ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাফি খাঁ। তিনি নিজে গুণে দেখেছিলেন, কামবক্সের হাতির চারপাশে বাষট্টি জন বাদশাহি সৈন্যের মৃতদেহ পড়ে আছে!
তৎক্ষণাৎ বড় বড় চিকিৎসককে ডেকে তাঁদের হাতে কামবক্সের জীবনরক্ষার ভার দেওয়া হল। সম্রাট বাহাদুর শাহ নিজে এসে ভ্রাতার ক্ষতস্থানগুলি সযত্নে ধুয়ে এবং তাঁর রক্তাক্ত পোশাক বদলে দিলেন। নিজের গা থেকে শাল খুলে সস্নেহে ঢেকে দিলেন ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ।
তারপর করুণস্বরে বললেন, ‘ভাই, তোমাকে যে এমন অবস্থায় দেখতে হবে এটা আমি কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি।’
কামবক্স বললেন, ‘সকলই ভগবানের ইচ্ছা।’
‘কেন এমন মরিয়া হয়ে লড়তে গেলে?’
‘আমি মরে দেখাতে চাই যে আমি ভীরু নই, আমার দেহে আছে মহাবীর তৈমুরের রক্ত!’
কামবক্স কিছু খেতে চাইছিলেন না, বাহাদুর শাহ জোর করে তাঁর মুখে স্বহস্তে কয়েক চামচ খাবার তুলে দিলেন।
কামবক্স কাতরস্বরে বলে উঠলেন, ‘উঃ, বড় তেষ্টা!’
বাহাদুর শাহ তাড়াতাড়ি তাঁর মুখের সামনে গোলাপজল মেশানো পানীয়ের পাত্র তুলে ধরলেন।
সেই রাত্রেই কামবক্স অন্তিমশ্বাস ত্যাগ করলেন।
পিতা ঔরঙ্গজিব বিদ্রোহের ভয়ে পুত্রদের দূরে দূরে প্রেরণ করেছিলেন। তবু বিদ্রোহী হয়ে পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন তাঁর চতুর্থ পুত্র আকবর। এবং মুয়াজ্জাম ও আসফ শাহও পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন বলে ঔরঙ্গজিবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
কিন্তু সাম্রাজ্য লাভ করে বাহাদুর শাহ পিতার নীতি মানেননি। তিনি পুত্রদের দূরে দূরে না পাঠিয়ে নিজের কাছে কাছেই রেখেছিলেন এবং তাঁর নীতিই সফল হয়েছিল; কারণ বাহাদুর শাহের জীবনকালে তাঁর কোনও পুত্রই বিদ্রোহাচরণ করেনি।
তবে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্ররা পরস্পরের সঙ্গে মারামারি কাটাকাটি করেছিল বটে, কিন্তু সেটা হচ্ছে মোগল রাজবংশের চিরাচরিত রীতি।
এবং সে রীতির মূলে ছিল পূর্বপুরুষ তৈমুর রোপিত বিষবৃক্ষের বিষফলের প্রভাব। মোগল রাজবংশ লুপ্ত হওয়ার আগে সে বিষক্রিয়ার জের মেটেনি। অভিশপ্ত বংশ!