তিন সমুদ্র সাতাশ নদী পারের বঙ্গ সংস্কৃতি
প্রথমবার উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসবের সময় আমি এদেশেই ছিলাম। আয়ওয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ে। উদ্যোক্তাদের কেউ একজন খবর পেয়ে আমাকে ও স্বা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে আর কোনও লেখককে আনানো হয়নি, শিল্পীদের মধ্যেও ক’জন এসেছিলেন মনে নেই, পরিচিতদের মধ্যে পূর্ণদাস বাউলকে দেখেছিলাম।
সেবারে অনুষ্ঠান হয়েছিল নিউইয়র্কের এক গির্জা সংলগ্ন হলে। দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা হাজার খানেকের বেশি নয়, কাচ্চাবাচ্চা সমেত। বেশ কিছুটা বিশৃঙ্খলা ও হইহল্লা ছিল, প্রথমে মনে হয়েছিল ভাগলপুরে কিংবা হায়দরাবাদে প্রবাসী বঙ্গ সম্মেলন যেমন হয় অনেকটা সেই রকম। তবে সুদূর সাগর পারে, এই যা। অবশ্য সুদূর সাগর পারে বলেই বাংলা গান ও বাংলা আলোচনা শুনলে কিছুটা রোমাঞ্চ হয়ই।
পরবর্তী পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন শহরে আমন্ত্রিত হয়েছি। দু-একবার আমন্ত্রণ পেয়েও আসতে পারিনি অন্য কাজের ব্যস্ততায়। ক্রমশ এই সম্মেলন এত বৃহৎ আকার ধারণ করেছে যে আমি পূর্ব অভিমত পালটাতে বাধ্য হয়েছি। প্রতিবারই অন্তত পাঁচ-ছ’হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ তো সমবেত হনই। কোনও এক বছরে নাকি আট-দশ হাজারে পৌঁছেছিল। ভারতে কিংবা বাংলাদেশেও একসঙ্গে এত বাঙালি কোনও অনুষ্ঠানে আসে না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে এত মানুষকে এক জায়গায় টেনে আনা সম্ভবই নয়। আমেরিকার বাঙালিরা তা পেরেছেন। আমেরিকার সব কিছুই বড়-বড়, সেই দৃষ্টান্তে বাঙালিরাও তাঁদের সম্মেলন এত বড় করে ফেলেছেন। এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করাও কম কৃতিত্বের কথা নয়।
একবারের উৎসবের কথা বিশেষভাবে মনে আছে। ১৯৯২ সালে টরেন্টো শহরে। যথারীতি মস্ত বড় হোটেলে অবস্থান, অনুষ্ঠান শুরুর আগের মাঝরাত পেরিয়ে হঠাৎ বেজে উঠল তীব্র ঘণ্টাধ্বনি। ফায়ার অ্যালার্ম। এ দেশের নিয়ম এই আগুনের সঙ্কেত পেলেই হাতে কিছু না নিয়ে, এক বস্ত্রে, লিফটের বদলে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে যেতে হবে। সেবারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সস্ত্রীক আমি ছিলাম পাশাপাশি ঘরে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে পরে শুতে গেছি। সতেরো আঠেরো তলা, গেঞ্জি পরা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নামতে শুরু করেছি।
হাতে কিছু নেওয়ার কথা নয়, কিন্তু মেয়েরা বোধহয় গয়নার বাক্সের মায়া ছাড়তে পারে না, আর ছেলেরা সিগারেট-দেশলাই। বাইরে টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছিল, তাতে ভিজতে ভিজতে সৌমিত্র আর আমি সিগারেট টানতে লাগলাম। সৌভাগ্যবশত এক জায়গায় শর্ট সার্কিট হয়ে কিছু আগুনের ফুলকি দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত বড় রকমের কোনও অগ্নিকাণ্ড হয়নি। এবং পরবর্তী তিনদিন শ্রী কান্তি হোর-এর সুযোগ্য ও সুভদ্র পরিচালনায় খুব সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠানগুলি স্মরণীয় হয়েছিল।
দেশ থেকে অনেকে বইপত্র, শাড়ি, গহনা ও অন্যান্য পসরা এনে সাজিয়ে বসেন, ভালোই বিক্রি হয় শুনেছি। একবার আমার চেনা এক মহিলা এনেছিলেন অসাধারণ সব একসকুসিভ শাড়ি, প্রত্যেকটাই আলাদাভাবে বৈচিত্র্যময়। দ্বিতীয় দিনেই সব শেষ। অনেকেই বেশ হতাশ। তাঁরা স্টলটির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অনুযোগ জানাতে লাগলেন, এত কম এনেছেন কেন? আমার চেনা মহিলাটি বিব্রতভাবে বলতে লাগলেন, আগামী বছর আরও বেশি আনব, এবারে ঠিক বুঝতে পারিনি। সেই মহিলা নিজেও পড়ে আছেন নীল রঙের এক স্বর্গীয় শাড়ি। হতাশ ক্রেতাদের মধ্যে এক নারী ফস করে বললেন, আপনি যেটা পড়ে আছেন, ওটাই দিন না। দেশে গিয়ে আবার কিনে নেবেন। সে মহিলা অবাক হয়ে বললেন, আমি এটা পরে আছি। এটা দেব কী করে? দু-তিনজন নারী এগোতে এগোতে বসলেন। হ্যাঁ, দিন না, দিন না…। তারপর কয়েকজন নারী কর্তৃক এক মহিলার বস্ত্রহরণ হয়েছিল কি না। তা আমি ঠিক জানি না।
নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও এইসব উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ আড্ডা। এক একজনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। পুরোনো বন্ধু, হালকা ধরনের পূর্ব প্রেমিক। মাথার চুল সম্পূর্ণ লাল, এক অচেনা যুবতী আমাকে একবার বলেছিল, সে অনেক দূর থেকে এসেছে শুধু আমাকে তার জীবনের একটি গোপন কথা শোনাবে বলে। অন্যান্য বন্ধুদের কৌতূহলী উঁকিঝুঁকিতে সে গোপন কথা আর আমার শোনা হয়নি। এই রকমই এক উৎসবে নীললোহিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল তার সুনীলদার। সেই বাউণ্ডুলে ছেলেটি এখন কোথায় আছে জানি না।
প্রথম প্রথম বেশ কয়েক বছর দেখেছি, বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসবে সাহিত্যের ওপর ঝোঁক ছিল বেশি। মূল মঞ্চে বসতেন লেখক লেখিকারা, শ্রোতাদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর জমে উঠত। এখন যেন সাহিত্যকে ক্রমশই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পেছনের সারিতে, গান-বাজনা, নাটক ইত্যাদির ওপর ঝোঁক বেশি। বাংলা সাহিত্য বাঙালির গর্ব। সেই সাহিত্যকে অবহেলা করে অন্য যা কিছু হয়, তাই-ই কি সংস্কৃতি? বাংলাদেশিরা আলাদাভাবে যেসব উৎসব করে, তাতে কিন্তু সাহিত্যই প্রাধান্য পায়। এখনও।