তিন সঙ্গী
বনমালা লঞ্চ থেকে নামল পনেরো-ষোলোজন যাত্রী। প্রত্যেকেই বিরক্ত। এতক্ষণ সবাই চুপ করে ছিল, এখন সবাই বিড়বিড় করতে-করতে নামছে জেটিতে। কেউ কারুর বিরুদ্ধে নালিশ করছে না, যেন নিজেকেই শোনাচ্ছে নিজের অসুবিধের কথা।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। পৌনে সাতটায় এখানে পৌঁছবার কথা। মাঝখানে চরে আটকে রইল বনবালা! একসময় তো মনে হয়েছিল, রাতটাই কাটাতে হবে মাঝ নদীতে। সারেং নতুন, তাই। নদীর রাস্তা চেনে না, ভাঁটার সময় কি চোখ বুজে লঞ্চ চালালে চলে? তবে ভাঁটা কেন, আজকাল জোয়ারের সময়ও পুরো নদী ভরে না।
মিশমিশ করছে অন্ধকার চারিদিকে। শুধু লঞ্চের জোরালো আলোয় চকচক করছেনদীর জল। জেটিখানার দুটো দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। বনবালা যে আজ আর আসবে, কেউ আশা করেনি।
চুনীলাল হাতের থলি দুটো ঝুলিয়ে বাঁধের রাস্তায় এসে দাঁড়াল। অন্ধকারটা চোখে সইয়ে নিচ্ছে। ভ্যান পাওয়ার কোনও আশা নেই। এই সাড়ে তিন মাইল রাস্তা হেঁটে যেতে হবে তাকে।
টর্চ আছে চুনীলালের কাছে। কিন্তু টর্চ জ্বালবে কোন হাতে। দু-হাতে দুটো ভারী বোঝা। একটা ভ্যান পেলে কত আরামে যাওয়া যেত।
—কোথায় যাবেন?
চুনীলাল চমকে কেঁপে উঠল। একটা ঢ্যাঙা লোক, ঠোঁটে বিড়ির আগুন। নিঃশব্দে কখন এসে দাঁড়িয়েছে একেবারে পাশ ঘেঁষে। নিশ্চয়ই ওর খালি পা।
—আমি যাব নাজনেখালি। আপনি?
—গাববেড়ে। কী করবেন, হাঁটবেন?
—উপায় কী?
–চলুন তবে এক সঙ্গে গল্প করতে-করতে চলে যাই।
চুনীলাল বোঝা দুটো নামিয়ে রেখে টর্চ জ্বালাল। নির্লজ্জভাবে লোকটির সারা গায়ে আলো বুলিয়ে দেখে নিল। রোগা, লম্বা, চিবুকে অযত্নের দাড়ি। ধুতির ওপর একটা নীল সার্ট। এর এক হাতে একটা পোঁটলা।
চুনীলাল জিগ্যেস করল, গাববেড়ে কত দূর? নাজনেখালি ছাড়িয়ে?
লোকটি একটু শুকনো হেসে বলল, না, আগে। আপনার আধাআধি রাস্তা। দাদা নতুন লোক বুঝি?
—নাজনেখালি আমার শ্বশুরবাড়ি। তবে নতুন নই, পুরোনো জামাই।
চুনীলাল টর্চ নিভিয়ে দিল। লোকটিকে সে লঞ্চে দেখেছে কি না ঠিক মনে করতে পারছে না। অবশ্য চুনীলাল ছিল ছাদে, ঠান্ডা হাওয়ার জন্য অনেকেই নীচে নেমে গিয়েছিল।
—চলুন আর দেরি করে লাভ কী? হাঁটা দি।
চুনীলাল থলি দুটো তুলে নিল। টর্চটা সে লোকটির হাতে দিতে পারত কিন্তু লোকটা চায়নি। স্থানীয় লোক, ও নিশ্চয়ই রাস্তা চেনে।
দুপা গিয়েই লোকটা জিগ্যেস করল, নাজনেখালিতে কার বাড়ি যাবেন?
–বসন্তলাল বেরা, আমার শ্বশুরমশাই।
–বসন্তলাল বেরা? চিনলাম না তো।
–নাজনেখালির সবাইকে আপনি চেনেন?
—প্রতি হাটবারে যাই। না চেনার তো কথা নয়।
—হাটে ওনার তামাকের দোকান।
—ও বাসুদা! তাই বলেন! ওর বড় ছেলেটি গত সনে মারা গেছে জঙ্গলে?
—হ্যাঁ? আপনার নামটা কী?
—নিরাপদ দাস। আপনি তো তাহলে আমার কুটুম্ব হলেন। বাসুদার পিসি হলেন তো আমার দিদিমার দিদি। বাসুদাকে বলবেন গাববেড়ের নিরা, তা হলেই বুঝবেন।
চুনীলাল চুপ করে গেল। এ সম্পর্কের কথা তার মনে দাগ কাটেনি। দিনকাল খারাপ। আজকাল কারুকে বিশ্বাস নেই। লোকটার গায়ে-পড়া স্বভাবটা বেশ সন্দেহজনক। তার বড় শালা জঙ্গলে বাঘের পেটে গেছে, সে খবর এ-তল্লাটে কে না জানে?
এত রাতে একজন অচেনা লোকের সঙ্গে যে এইরকম অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে নেই তা চুনীলাল জানে। কিন্তু একটা লোকে যদি নিজে থেকে চায় তাহলে চুনীলাল কি না বলবে? অত ভীতু সে নয়। তার কোমরে একটা ছুরি আছে। সেই জন্যই তো লোকটাকে আগে-আগে রেখেছে চুনীলাল, যাতে ও হঠাৎ পেছন থেকে না কিছু করতে পারে।
লোকটিকে আর একটু পরীক্ষা করার জন্য চুনীলাল বলল, কুটুমই যখনই হলেন, তখন একটা উপকার করবেন? আমার দু-হাত আটকা, একটা থলে একটু ধরবেন? তাহলে একটা সিগ্রেট খেতে পারি। বেশ ঠান্ডাই বাতাস দিচ্ছে তো।
নিরাপদ নামের লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে আমতা-আমতা করে বলল, দাদা নিতাম তো, কিন্তু বাঁ হাতটা কম জোরি। একটা বড় চোট লেগে ছিল, এখনও ব্যথাটা মরেনি। আচ্ছা দেখি পারি কি না!
চুনীলালের একটা থলে ধরার চেষ্টা করে সে বলল, ওরে বাবা, এ যে বেদম ভারী। কী আছে এতে দাদা?
উত্তর আগে থেকেই তৈরি ছিল। চুনীলাল বলল, কয়েকখানা লোহার চাটু আর কড়াই! ও বাড়িতে চেয়েছে! আগে তো ভাবিনি যে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভেবেছিলুম ভ্যান পাব—।
—বড় লজ্জা দিলেন দাদা। হাতটা এমন দুর্বল হয়ে আছে। ও জিনিস বইতে পারব না। একটু দাঁড়াই বরং আপনি সিগ্রেট খেয়ে, জিরিয়ে নিন।
সন্দেহজনকভাবে লোকটির দিকে তাকিয়ে চুনীলাল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। নিজে একটি ধরাল, নিরাপদকে দিল না। যদি চায় তো দেখা যাবে। লোকটা একটা হাত খালি রাখতে চায়, অ্যাঁ?
নিরাপদ রাস্তার পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসল জল ছাড়তে।
আর তখনই দেখা গেল তাদের পেছন থেকে এসে পড়েছে একটা টর্চ লাইটের আলো।
লোকটা সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে চুনীলালের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কে আসছে?
চুনীলালও অবিকল এই প্রশ্নই করতে চাইছিল। এইবার কি আসছে ওর সঙ্গীরা? কাছাকাছি কোনও বাড়ি ঘর নেই। একদিকে নদী, অন্য দিকে ফাঁকা মাঠ!
চুনীলাল টর্চটা বার করে জ্বালাল। তার টর্চটা বড়, আলো বেশি। কে আসছে ওদিক থেকে, একটা মেয়ে? অবশ্য একটু ঠান্ডা পড়লে এদেশে পুরুষরাও গায়ের চাদর দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেয়।
আর-একটু কাছে আসতে বোঝা গেল একজন স্ত্রীলোকই বটে। বছরচল্লিশেক বয়স হবে, বেশ লম্বা সমর্থ চেহারা। সে জিগ্যেস করল, ওগো, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
চুনীলাল বা নিরাপদ কেউই উত্তর দিল না। স্ত্রীলোকটিকে একেবারে সামনে আসতে দিল।
প্রথমে চুনীলালকে ভালো করে দেখার পর নিরাপদর মুখের দিকে চোখ রেখে চেনা মানুষের মতন গলায় বলল, এত রাতে কোথায় যাচ্ছ? এ-রাস্তা খুব খারাপ, জানো না? গত সপ্তাহেই একটা ডাকাতি হয়ে গেছে!
নিরাপদ জিগ্যেস করল, তুমি কে গো? তুমিই বা এত রাতে রাস্তায় বেরিয়েছ কেন?
স্ত্রীলোকটি বলল, আহা রে! চেনে না যেন! আমার নাম চাঁদমণি, গোসাবা বাজারে থাকি, আমায় সবাই চেনে।
—গোসাবা বাজারে? দেখিনি তো?
–দ্যাখোনি? দেখেও এখন না দেখার ভাব কচ্ছ?
এসব ব্যাপার-স্যাপার চুনীলালের একদম ভালো লাগছে না। সে কোমরের ছুরিটায় হাত দিয়েছে। বারুইপুর রেল ইয়ার্ডে অনেকেই চুনীলালকে ভয় পায়। কিন্তু এদের এদিককার কায়দা বোধহয় অন্যরকম। এত রাতে মেয়েছেলে বার করেছে। ওরা ভাবছে, মেয়েছেলের মুখ দেখে চুনীলাল অন্যমনস্ক হয়ে যাবে!
নিরাপদ বলল, না হয় বুঝলুম, তুমি গোসাবা বাজারে থাকো। এত রাতে তুমি এখানে এসেছ কেন?
চাঁদমণি বলল, আমি তো তোমাদের দেখেই এলুম। তা তোমরা আবার ডাকাত-টাকাত নও তো!
চুনীলাল আর নিরাপদ তাকাল পরস্পরের মুখের দিকে। এই অন্ধকারে তারা কী দেখল, কী বুঝল কে জানে?
চাঁদমণি বলল, ডাকাত হলেই বা কী! আমি বেওয়া মেয়েমানুষ, আমার কাছে তো কিছু পাবে না। কানের এই দুল দুটো পেতলের।
চুনীলাল এবার কড়া গলায় জিগ্যেস করল, ইয়ে, আপনি কোথায় যাবেন?
চাঁদমণি বলল, গাংড়াদহ।
নিরাপদ বলল, সে তো নাজনেখালি ছাড়িয়ে। সেখানে যাবে, এত রাতে?
চাঁদমণি বলল, শুধু-শুধু রাত আরও বাড়িয়ে লাভ আছে? চলো, যেতে-যেতে কথা বলি।
চুনীলাল থলে দুটো তুলে নিল। এবারেও সে চলল সবার পেছনে। স্ত্রীলোকটি আগে-আগে টর্চ জ্বেলে চলল।
নিরাপদ জিগ্যেস করল, গাংড়াদই কোন বাড়ি যাবে?
চাঁদমণি বলল, সে তুমি চিনবে না।
—কেন চিনব না, ওখানে আমার আপন কাকা থাকে।
—থাকুক গে! তোমায় নাম বলি আর অমনি তুমি একদিন সে-বাড়িতে গিয়ে হাজির হও? তোমায় আমার খুব চেনা আছে!
—তুমি ভুল করছ গো। অন্য কারুর সঙ্গে আমায় গুলিয়ে ফেলছ। আমায় তুমি কবে চিনলে?
—তুমি ঢ্যাঙা ফকির দলের কেষ্ট নও?
—এই দ্যাখো! বললুম ভুল হয়েছে। আমি তো নিরাপদ গো!
—হুঁ, নিরাপদ! এই সোঁদরবনে যতগুলো আপদ দেখি, সবগুলোরই নাম নিরাপদ!
চুনীলাল মনে-মনে একটু হাসল। নিশ্চয়ই এই লোকটা কেষ্ট, তার কাছে নাম ভাঁড়িয়েছে! কী মতলব? শালীর বিয়ের জন্য একগাদা কাঁসার বাসনপত্র এনেছে চুনীলাল, তার দাম অনেক।
চাঁদমণি বলল, কেন আমি গাংড়াদহে যাচ্ছি শুনলে তোমরা হাসবে। কিন্তু আমার মন ঠিকই বুঝেছে।
নিরাপদ বলল, তাহলে শুনি একটা হাসির কথা!
চাঁদমণি বলল, একবার সাতদলের হাট থেকে ফিরতে আমার রাত হয়েছিল। তার কদিন আগেই চুয়ান্ন নম্বর দাগে একটা বাঘ ধরা পড়েছে। গা-ছমছম করছিল, তখন একটা লোক হাঁটতে লাগল আমার পাশে-পাশে। তারপর একসময় সেটা আমায় চেপে ধরল। তখন বুঝিনি। পরে বুঝিছি, সেটা মানুষ নয় গো, সে ছিল একটা অপদেবতা। সেই থেকে রাত-বিরেতে পথে-ঘাটে একলা মানুষ দেখলে আমি ভয় পাই।
চুনীলাল বলল, এই হাসির কথা?
চাঁদমণি বলল, না, এটা নয়! শোনোই না। সেই অপদেবতা তো আমার বে-ইজ্জতি করল। তাতে আমি পোয়াতি হলুম। তা আমি পেট নষ্ট করিনি। সবাই আমায় বলতো বাঁজা মেয়েমানুষ। আমার স্বামী সেই জন্যই তো আমায় দূর করে দিয়েছিল। তারপর বলব কি দাদা, আমার একটা ফুটফুটে চাঁদের মতন মেয়ে হল, যে দেখেছে, সেই বলেছে, আহা! এমনটি আর দেখিনি!
চুনীলালের মতন ঝানু লোকও এসব কাহিনি শুনে চমকে যায়। বলে কী? অপদেবতা এসে ধরল, তার ফলে পোয়াতি হল?
চুনীলাল হেসে উঠে বলল, হুঁ! অপদেবতাই বটে। এ-রাস্তায় প্রায়ই সেরকম উপদ্রব হয় বুঝি?
চাঁদমণি বলল, প্রায়ই হয় কি না জানি না, আমি সেই একবারই দেখেছিলুম।
হঠাৎ গল্প থামিয়ে পেছন ফিরে চাঁদমণি বলল, তুমি দুহাতে বোঝা বইছ কেন? একটা আমায় দাও না। আমি কি নিয়ে পালাব নাকি?
চুনীলাল বলল, আপনি নিতে পারবেন না, বড্ড ভারী।
—থাক আমায় আর আপনি আজ্ঞে করতে হবে না। আমার গায়ে কত জোর তো জানে না! গতর খাঁটিয়ে খাই!
চুনীলালের হাত থেকে প্রায় জোর করেই একটা থলি নিয়ে নিল সে। অস্ফুটভাবে বলল,, ভারী একটু বটে। বাসনপত্তর আছে বুঝি? বাড়িতে কারুর বিয়ে আছে?
মেয়েরা বোঝে। কী করে যেন ঠিক বুঝে যায়।
নিরাপদ বলল, তারপর, তোমার সেই মেয়ে এখন কোথায়?
চাঁদমণি বলল, সেই অপদেবতা আমায় কোথায় ধরেছিল জানো? ঠিক এইখানে। হিহি-হিহি!
নিরাপদ আর চুনীলাল একটু থমকে গেল। দুজনে একই কথা ভাবল।
চাঁদমণি বলল যা ভাবছ তা নয়। আমি পাগল নই গো, পাগল নই। খুব সেয়ানা! আহা, আজ চাঁদ উঠলে বেশ হত, না গো? বেশ সক্কলের মুখ দেখতে পেতুম। দেখতুম তোমাদের মধ্যে কেউ অপদেবতা নাকি! হিহিহিহি…
হাসির মাঝখানেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল চাঁদমণি। নিরাপদ তার হাত ধরে টেনে তুলে জিগ্যেস করল, লেগেছে? ক্লিষ্ট গলায় চাঁদমণি বলল, হ্যাঁ। লেগেছে। মচকেছে মনে হয়! এখনও অনেকটা রাস্তা যেতে হবে।
নিরাপদ বলল, আমাদের বাড়িতে তাহলে রাতটা থেকে যাও। আর-একটু বাদেই আমাদের গাঁ।
—কেন, তোমার বাড়িতে থাকব কেন, তুমি আমার কে?
—পায়ে লেগেছে বলে বললুম।
—তোমার বাড়িতে কে আছে?
—মা আছে, ভাই, বোন আছে, একটা পিসি আছে। আমার ছোট ছেলে আছে।
বউ নেই?
—না। মরে গেছে।
—বউ নেই, সেইজন্য এত রস! আমি কারুর বাড়ি যাই না।—ও গো, তুমিই বলো না। আমি কেন ওর বাড়ি যাব? তুমি তাহলে রাগ করবে না?
চুনীলাল বলল, আমার থলেটা দাও আমি এগোচ্ছি। শুধু-শুধু দেরি করছ তোমরা
চাঁদমণি চোখ ঘুরিয়ে বলল, বললুম না রেগে যাবে! দুজন চলনদার সঙ্গে থাকলে এই সুবিধে। একজন তেড়িবেড়ি করলে অন্যজন সামলে দেয়।
নিরাপদ রাগ করে বলল, আচ্ছা থাকতে হবে না আমাদের বাড়ি, হাঁটতে পারো তো চলো।
চাঁদমণি বলল, তোমাদের তো আসল কথাটাই বলা হয়নি। যেজন্য আমি যাচ্ছি। আমার সেই মেয়ে তো ফোঁটা ফুলের মতন নধরপানা হয়ে উঠল। দেখতে-দেখতে পনেরো বছর কেটে গেল! আর অমনি গাংড়াদর এক ছোকরা তাকে বিয়ের জন্য কী ঝোলাঝুলি? মেয়েও বেশ রাজি। আমি ভাবলুম অপদেবতার জিনিস, কদ্দিন আটকে রাখতে পারব কে জানে, তার চেয়ে বাবা পার করে দেওয়াই ভালো। তাই দিয়ে দিলুম বিয়ে।
—এখন সেই মেয়ের কাছে যাচ্ছ?
—হ্যাঁ। কিন্তু কেন যাচ্ছি। তা শুনলেই তো হাসবে। বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই তো মেয়ে পোয়াতি। আজ সন্ধেবেলা সাতটার লঞ্চ ছেড়ে চলে গেল। আমি খেয়েদেয়ে লম্ভ নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। তারপর একটা স্বপ্ন দেখলুম। দেখলুম কী আমার কুসুমের ব্যথা উঠেছে। যন্ত্রণায় সে ছটফট করছে। জামাই আমার বাড়িতে নেই। মাছ ধরতে সে সাগরে চলে যায়। সাত-আট দিন পরে ফেরে। আহা, মেয়েটা কত কষ্ট না পাচ্ছে। তাই তো ছুটে চলে এলুম।
নিরাপদ বলল, স্বপ্ন দেখলে আর ছুটে চলে এলে? হে-হে-হে! স্বপ্ন কখনও সত্যি হয়?
—বলেছিলুম না হাসবে? কেন, স্বপ্ন সত্যি হয় না?
—যাঃ!
—যাঃ কি গো। এ মিনসেটার ধরন ধারণই আলাদা! জিগ্যেস করছি, তোমার কোনও স্বপ্ন কখনও সত্যি হয়নি?
নিরাপদ চুপ করে গেল।
চাঁদমণি চুনীলালকে জিগ্যেস করল, তুমি চুপ করে কেন? তুমি বলো না। স্বপ্ন যদি সত্যি না হবে, তবে অমন স্বপ্ন দেখলুম কেন? তোমার কোনও স্বপ্ন সত্যি হয়নি?
চুনীলাল বলল, আমার পেট গরম হয় না। স্বপ্নফপ্নও দেখি না।
—কোনওদিন দ্যাখোনি!
—না।
—তুমিও অপদেবতা নাকি! দেখি তো ভালো করে মুখখানা।
চুনীলালের মুখের ওপর টর্চ ফেলল চাঁদমণি। তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। একটা হাত তুলে আড়াল করে বলল, আঃ, কী হচ্ছে।
—বলো, বলো, আমি কি মিছিমিছি যাচ্ছি এত কষ্ট করে। আমার মেয়ের কিছু যদি…
—আমি তার কী জানি!
—কী হৃদয়হীন মনিষি গো তোমরা। আমি অসহায় মেয়েমানুষ একটা কথা জিগ্যেস করছি। তাতে অমন মুখ ঝামটা দিতে হয়? মনে করো আমি স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিলুম। আর আমার মেয়েটা যদি সত্যিই কষ্ট পেয়ে মরে যায়?
খুনখুন করে কাঁদতে শুরু করল চাঁদমণি। চুনীলাল সিগারেট ধরাল। এখনও তার চোখ ধাঁধিয়ে আছে। সে যেন সব ভুল দেখছে। একজন স্ত্রীলোক এত রাত্রে মাঝ রাস্তায় একবার হাসছে। একবার কাঁদছে। এসব কি সত্যি, না মনের ভুল!
চাঁদমণি কান্না থামিয়ে নিরাপদকে বলল, আমি আর পরের জিনিস বইতে পারছি না। এই, এটা ধরো না!
—ধরতুম গো দিদি। কিন্তু আমার হাতেও যে একটা আছে। আর আমার বাঁ-হাতটা যে কমজোরী। গতমাসে চোট লেগেছিল।
—কীসে চোট লেগেছিল। কার বাড়িতে সিঁধ কাটতে গিয়েছিলে?
—সিঁধ কাটতে যাইনি। আমিই ডাকাতের হাতে পড়েছিলুম। এই তো এই রাস্তায়। জিনিসপত্র সব কেড়ে নিলে, প্রাণে যে একেবারে মারেনি, সেই যথেষ্ট।
—কাদের দল!
—তা কে জানে। ওসব ব্যাপারে আর মুখ খুলতে নেই। আজও ভয়-ভয় করছিল। কী করব, ক্যানিং থেকে আমার মাল আনতে যেতেই হয়। তা আজ দাদাকে দেখলুম, সঙ্গে তারও জিনিসপত্তর আছে, তাই ভরসা পেলুম।
নিরাপদ চুনীলালের দিকে তাকাতেই সে কোমরে হাত দিল। চাঁদমণি চুনীলালের কাছে সরে এসে নিরাপদকে বলল, আমার বাপু তোমাকে একটু সন্দো হয়েছিল প্রথমটায়। এ লোকটা ভালো, নতুন লোক বটে কিন্তু অপদেবতার মতন নয়কো!
নিরাপদ তার বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখাল। তাতে একটা বীভৎস ক্ষত। সে ফিসফিস করে বলল, আমি বড় গরিব মানুষ গো।
এতক্ষণ বাদে চুনীলাল বেশ উদার হয়ে গিয়ে নিরাপদকে বলল, এই নাও একটা সিগ্রেট নেবে নাকি?
চাঁদমণিকে সে বলল, চলো গো, পা চালিয়ে চলো। তোমার মেয়ে যদি সত্যি কষ্ট পায় তবে আর দেরি করা ঠিক নয়! আমরা সবাই মিলে দেখে আসি।