তিন ভাই আর ড্র্যাগন
সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক দেশে তিন ভাই থাকত। ছোটভাইকে তারা নাম দিয়েছিল ন্যালাখ্যাপা। তবে লোকজনদের সামনে অবশ্য তারা এ নামে ডাকত না। তাদের দেশে একবার দেখা দিল এক ড্র্যাগন। আর কী হালই না করল দেশটার। দুর্দশার আর শেষ রইল না। ভেড়া মেরে ষাঁড় খেয়ে জন্তু-জানোয়ার শেষ করেও তার আশ মিটল না। এবার শুরু করল মানুষ খাওয়া। কত জোয়ান, কত পালোয়ান গেল ড্র্যাগন মারতে। কিন্তু ড্র্যাগন তো মরলই না, উলটে ছলছুতো করে তাদেরই হারিয়ে দিয়ে ধরে খেয়ে ফেলল। এই ড্র্যাগনের কথা লোকমুখে পৌঁছোল সেই তিন ভাইয়ের কানে।
বড়ভাই বলল, ‘ড্র্যাগন মারতে পারে এমন লোক আমি ছাড়া এ তল্লাটে নেই।’ এই না বলে তক্ষুনি তুলে নিল তার ভারী গদাটা। চলল ড্র্যাগন মারতে। পথে দেখা এক রুটিওয়ালার সঙ্গে। বড়ভাই রুটিওয়ালাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলল, ‘সুপ্রভাত।’
রুটিওয়ালা উত্তর দিল, ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন বাবা। তা চললে কোথায়?’
বড়ভাই উত্তর দিল, ‘ড্র্যাগন মারতে চলেছি।’
‘কত বীর তো ড্র্যাগন মারতে গেল। তাদের সংখ্যা তো বাপু কম হবে না। তারা সকলেই তো শেষ পর্যন্ত ড্র্যাগনের পেটেই গেছে। তুমি কি আর তার সঙ্গে এঁটে উঠবে?’
‘আরে আমি এই যাব, এক ঘায়ে ড্র্যাগন খতম করব, এই আসব।’ বড়ভাই গর্ব করে বললে।
রুটিওয়ালা বললে, ‘আমার এই ঝুড়িতে যত রুটি আছে আগে শেষ করো, তবে ড্র্যাগন মেরো।’
বড়ভাই রুটি খেতে শুরু করল। তোলে আর টপাটপ মুখে পোরে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। রুটি আর ফুরোয় না। ‘না হে না, ড্র্যাগন মারাটারা তোমার কম্ম নয়।’ রুটিওয়ালা বলে।
বড়ভাই তার কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে চলল। পথে দেখা এক গোয়ালার সঙ্গে। গোয়ালা যাচ্ছে দুধ মাখন নিয়ে বেচতে।
‘সুপ্রভাত’, হেঁকে বলল বড়ভাই।
‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। তা বাপু যাচ্ছ কোথায়?’
‘আমি? আমি যাচ্ছি ড্র্যাগন মারতে।’
‘কত বীর বোগাতীর গেল, তুমি তো বাপু কোন ছার— তারা সকলেই গেল ড্র্যাগনের পেটে।’
বড়ভাই বলল, ‘আমি যাব, আর এক ঘায়ে শেষ করব ড্র্যাগনটাকে।’
গোয়ালা হেসে বললে, ‘তা বেশ, আগে তুমি আমার সব দুধ, সব মাখন শেষ করো তো। তবে বুঝব তুমি ড্র্যাগন মারতে পারবে কি না।’
বড়ভাই মুচকি হেসে মাখন খেতে শুরু করল। মাখন খায় আর দুধে চুমুক মারে। কিন্তু শেষ আর হয় না।
গোয়ালা বলে, ‘না হে না, ড্র্যাগন মারা, হল না সে তোমার দ্বারা।’
বড়ভাই আর রা কাড়ল না, নিজের পথে পা বাড়ালে। চলতে চলতে দেখে একটা সাঁকো। সাঁকো পেরিয়েই অদূরে একটা মস্ত বাগান। আর বাগানভরতি গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে আপেল। গুনে শেষ করা যায় না। বড়ভাই বাগানে গিয়ে হাজির হল। টুকটুকে লাল আপেল পাড়ে আর খায়। ওই বাগানের পিছনেই বাস সেই ড্র্যাগনের। তার এক ছেলে ছিল, খুদে ড্র্যাগন। সেই পথ আগলে রাখে। পাহারা দেয়। ‘কে যেন আসছে মনে হয়।’ খুদে ড্র্যাগন নিজের মনে বিড়বিড়িয়ে কয়। দেখে বড়ভাই আসছে। ছোট ছোট ছোট এক্কেবারে বাবার কাছে।
‘বাবা, বাবা, একটা ভয়ংকর লোক আমাদের ধরতে আসছে। হাতে আবার একটা মস্ত গদা। মেরে ফেলবে, এবারে আমাদের নির্ঘাত মেরে ফেলবে।’ খুদে ড্র্যাগন বলে। বাবা ড্র্যাগন উত্তর দেয়,
‘ঘাবড়ে যাবার কারণটা কী?
অতই সহজ মরণ নাকি?
নতুন লোক
রাখবি চোখ।
আপেল বাগিচায়,
দ্যাখ তো কেমন খায়,
যত্নে বেছে নরম দেখে,
নাকি পাতাসুদ্ধ পুরছে মুখে?
ধরনটা কী?’
খুদে ড্র্যাগন দৌড়ে গেল। উঁকি দিল। ফিরে এল।
‘হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ বেছে, খুঁজে খুঁজে নরম দেখেই খাচ্ছে।’
‘ভালই হয়েছে, ভালই হয়েছে, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।’
‘নমস্কার ড্র্যাগন বাবাজি’ বড়ভাই এসে কয় মিঠে হেসে।
‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন বাবা। এসো বাবা বোসো তুমি হলে কিনা আমার অতিথি।’ এই বলে ড্র্যাগন তাকিয়া এগিয়ে দিয়ে বসাল বড়ভাইকে।
ড্র্যাগন এদিক ঘোরে ওদিক ঘোরে। বড়ভাই কী খাবে তার জোগাড় করে। এবার সে উনুনে আঁচ দিলে। ও বাবা সে কী ধোঁয়া। ড্র্যাগন এবার মাপতে লাগল। মেপে ময়দা বের করল। ময়ান দিয়ে মাখল। ময়দা ঠাসতে ঠাসতে বড়ভাইকে বলে, ‘বড় ভাল ছেলে বাছা তুমি। একটু উপকার করবে? নিচু হয়ে ফুঁ দিয়ে আগুনটা একটু ধরিয়ে দেবে বাবা? বড্ড ধোঁয়া হচ্ছে।’ বড়ভাই তো তক্ষুনি আগুনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর নিচু হয়ে চুলোর মুখে ফুঁ দিতে লাগল। আর বড় ড্র্যাগনটা করেছে কী মস্ত হাঁ করে বড়ভাইকে পিছন থেকে ফেললে গিলে।
এদিকে মেজভাই দেখে বড়ভাই তো আর ফেরেই না। ভাবে আমাকেই যেতে হবে ড্র্যাগনটা মারতে। গদাটাকে একটানে কাঁধের উপর ফেলে মেজভাই বেরিয়ে পড়ল ড্র্যাগন মারতে। কিন্তু কী আর বলব বড়র যা দশা হয়েছিল মেজরও সেই দশাই হল।
আর যে সেই ছোটভাই, যাকে সবাই ন্যালাখ্যাপা বলত সে অপেক্ষা করেই থাকে। দিনের পর দিন যায়। ছোট ভাবে ব্যাপারটা কী! দাদারা তো কই ফিরছে না। ব্যাপার যে সুবিধের নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। ছোটভাই তার গদাটা কাঁধে ফেললে, চলল দাদাদের খুঁজতে আর ড্র্যাগন মারতে। সন্ধ্যা হয়ে এল। পথে দেখা সেই রুটিওয়ালার সঙ্গে। ‘সুপ্রভাত’ রুটিওয়ালাকে সম্বোধন জানিয়ে ছোটভাই বলে। ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। তা চললে কোথায় বাছা?’
‘আমি যাচ্ছি ড্র্যাগন মারতে।’
‘আরে তুমি কী মারবে ড্র্যাগন? কত বীর বোগাতীর গেল আর ফিরল না। তুমি তো ছেলেমানুষ। নেহাতই ন্যালাখ্যাপা। তুমি কী করে ড্র্যাগনের কাছে যাবে বাপু?’
‘এই যাব আর, এই ফিরব। একঘায়ে ড্র্যাগন খতম করব।’
রুটিওয়ালা বলে, ‘দেখি তো তুমি কেমন পালোয়ান। খেয়ে শেষ করো তো আমার রুটির ঝুড়ি। সব শেষ করতে পারলে তবে বুঝব তুমি ঠিক ড্র্যাগন মারতে পারবে।’ ন্যালাখ্যাপা হাত ভরে রুটি মুখে তোলে আর শেষ করে। দেখতে দেখতে ঝুড়ি খালি। রুটিওয়ালা বড় বড় চোখ করে বলে, ‘বাহাদুর বটে, কিন্তু বাপু আর চেয়ো না। আমার রুটি নেই। যাও এবার ড্র্যাগন মারতে।’
ন্যালাখ্যাপা গুনগুন গান গায় আর এগিয়ে চলে। পথে দেখা সেই গোয়ালার সঙ্গে। ‘সুপ্রভাত ভাই, চললে কোথায়?’ গোয়ালা শুধোয়। ‘যাচ্ছি ড্র্যাগন মারতে।’ ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। তবে তুমি তো নেহাত ছেলেমানুষ, ন্যালাখ্যাপা। তুমি মারবে ড্র্যাগন? কত বীর বোগাতীর গেল আর ফিরল না। তুমি তার চেয়ে আমার দুধ আর মাখন আগে শেষ করো দেখি। তবে বুঝব তুমি কেমন বীর। ড্র্যাগন মারতে পারবে কি না?
শ’য়ে শ’য়ে বীর বোগাতীর ড্র্যাগন মারতে গেল
কেউ না ফিরে এল।
তাই বলছি বাছা আগে আমার দুধ মাখন শেষ করো, তবে যাও।’
কথা শেষ হতে না হতেই ন্যালাখ্যাপা একবারে তুলে সব মাখন দিলে মুখে পুরে। ব্যস খতম। তারপর এক চুমুকে সব দুধ শেষ করে বলে, ‘আরও দাও।’
গোয়ালা মাথা নেড়ে বলে, ‘আর নেই ভাই। তুমি ঠিকই ড্র্যাগন মারতে পারবে। যাও ভাই কাজ সেরে এসো।’
ন্যালাখ্যাপা খুশমেজাজে পথ ধরে এগিয়ে চলল। এল সেই সাঁকোর ধারের আপেল বনে। খুদে ড্র্যাগন মানুষ দেখেই ছুটল বাবার কাছে। ‘বাবা, বাবা, মস্ত একটা ভয়ংকর লোক আমাদের ধরতে আসছে। হাতে তার আবার একটা মস্ত গদা।’
বাবা ড্র্যাগন কি ভয় পাবার পাত্র? বলে, ‘দেখে আয় তো বাবা, লাল টুকটুকে নরমটি পেড়ে মুখে পোরে, না পাতাসুদ্ধু খায়।’
খুদে ড্র্যাগন দৌড়োল দেখতে। অবাক হয়ে দেখে মস্ত লোকটা কিছুই ফেলে না। দৌড়ে এসে বাবাকে জানায়—
‘বাবা গো বাবা
মারছে থাবা
ফল, না পাতা, বিচার নাই
পুরছে মুখে, উফ কী খাঁই!’
‘ফ্যাসাদ হল তো বড়’ ড্র্যাগন নিশ্বাস ফেলে বলে। এদিকে ন্যালাখ্যাপা সোজা ড্র্যাগনের কাছে এসে হাজির।
দুরু দুরু করে বুক
হাসি হাসি রেখে মুখ
ড্র্যাগন বলে, ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন বাবা। বোসো বোসো। তুমি আমার অতিথি।’ ড্র্যাগন তাকিয়া এগিয়ে দিলে বসতে। ন্যালাখ্যাপা বসল আরাম করে।
ড্র্যাগন এদিক যায় ওদিক যায়, রান্নার জোগাড় করে। উনুনে আঁচ দেয়। ও বাব্বা সে কী ধোঁয়া। ঠিক আগের মতোই। ড্র্যাগন এবার ময়দা ওজন করলে, মাখবে, ঠাসবে। ন্যালাখ্যাপাকে বলে, ‘আমি এদিকে কাজটা গুছিয়ে নিই, তুমি বাবা আমার একটা উপকার করবে? আগুনটা একটু উসকে দেবে? বড় ধোঁয়া হচ্ছে।’
‘আমি তো তোর চাকর দাসী নই। আমি তোর অতিথি। আমাকে হুকুম করা কোন শাস্ত্রে লেখে রে?’
ড্র্যাগন দেখলে মহাবিপদ। নিজেই চুলোর সামনে মাথা নিচু করে বসে উনুনের মুখে ফুঁ দিতে লাগল। আর সেই ফাঁকে ন্যালাখ্যাপা করেছে কী গদাটা বাগিয়ে ধরে মস্ত ড্র্যাগনটার শিরদাঁড়া বরাবর মারলে এক ঘা। উঃ সে কী জোর ঘা— ড্র্যাগন তো এক ঘায়েই দু’ফাঁক। আর কী হয়েছে জানো? ড্র্যাগনটার পেট থেকে বেরিয়ে এল ন্যালাখ্যাপার দু’ভাই— বড়ভাই আর মেজভাই, এক্কেবারে জ্যান্ত।
দুই ভাই তো ন্যালাখ্যাপাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। ন্যালাখ্যাপা বলল ঠাট্টা করে,
‘ড্র্যাগন দু’ফাঁক হল,
বীর বোগাতীর দাদারা মোর
ঘরেই ফিরে চলো।’
তিন ভাই পথে নামল। ন্যালাখ্যাপা আগে আগে চলে আর বলে, ‘কী হে আমাকে তো খুব তোমরা ন্যালাখ্যাপা বলতে, আর বলবে? দেখলে তো কারা বোকা আর কে পালোয়ান? দু’ভাই তো চট করে ছোটভাইকে কাঁধে তুলে ছুটল বাড়ির পানে। বাড়ি পৌঁছে সে কী ফুর্তি। সে কী খানাপিনা।
ন্যালাখ্যাপার নামই গেল বদলে। দাদারা আর তাকে ন্যালাখ্যাপা বলে ডাকে না। বলে বাহাদুর।