তিন তিরিক্ষে নয়

তিন তিরিক্ষে নয়

(১)

বি.এ. পাশ দিয়ে চাকরির আশায় সবাই যখন মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, তখন আমি এ পথে না গিয়ে নিজে কিছু একটা করব বলে সিদ্ধান্ত নিই৷

ছেলেবেলা থেকেই বই পড়ার এক অদম্য নেশা আমার মধ্যে ছিল৷ কলেজে বন্ধুরা যখন ছাইপাশ গিলত, আমি তখন গিলতাম বাংলা-ইংরেজি বিভিন্ন সাহিত্যিকদের রচনা৷ সহজ ভাষায় সাহিত্যের সুরারস ছিল আমার নেশার বস্তু৷

বলাবাহুল্য এই সব আত্তীকরণের জন্য বাংলা ভাষার উপর কিঞ্চিৎ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছিল৷ তাই আগামী আজীবন সাহিত্যচর্চাকেই নিজের জীবিকা হিসেবে বেছে নিলাম৷

কলেজ জীবনে আমার কিছু লেখা কয়েকটা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল৷ বন্ধু মহলে বেশ খ্যাতি লাভও করেছিলাম৷ তাই ভেবেছিলাম এই পথে গেলে কিছু একটা হয়তো করতে পারবো জীবনে৷ কিন্তু আমার এ ধারণা যে কতখানি অমূলক ছিল তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি৷

আজ প্রায় তিন বছর ধরে আমার করুণ অবস্থা৷ প্রকাশকদের লেখা পছন্দ হয় না৷ তাবড় তাবড় প্রকাশকদের হাতে তাবড় তাবড় লেখক৷ ছোটখাটো, নবজন্মা কয়েকটা প্রকাশনী যাও বা দু’একটা লেখা নেয়, রয়্যাল্টির টাকা ঠিকমত মেটায় না৷ কোর্ট-কাছারি করতে গেলে যা আয় তার তুলনায় ব্যয় বেশি৷ তাই সেসব ঝামেলায় পড়ি না৷ কি লেখা লিখি নাই? থ্রিলার, সাসপেন্স, রম্য রচনা, হাস্যকৌতুক, এমনকি একটা আস্ত উপন্যাস পর্যন্ত লিখেছি৷ কোন কিছুতেই প্রকাশকদের মন পাওয়া যায় না৷ প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা ছাড়া ছাপতেই চায় না৷ এদিকে নতুন লেখকের লেখা না ছাপলে, পাঠককুলে কেমন সাড়া জাগাবে বা কেমন কাটবে অথবা লেখনীর মান ঠিক কতখানি সেসবও বোঝা দায়৷ আশা করি তোমরা বুঝতেই পারছ, বর্তমানে আমার অবস্থা কতটা শোচনীয়৷ তাতে অবশ্য আর্থিক বিষয়ে তেমন অসুবিধা পোয়াতে হয় না৷ মা, বাবা মারা যাওয়ার আগে যথেষ্ট বিষয়-সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন৷ সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই যাকে নিজের বলে চিনতাম সেই ঠাম্মা দু’বছর হল গত হয়েছেন৷ এখন রায়পুরের এই বিরাট বাড়ি জুড়ে একা আমার রাজত্ব৷ দুজন ভৃত্য আছে, সকাল-বিকাল কাজ করে চলে যায়৷

সুতরাং এদিক দিয়ে আমার অবস্থা সচ্ছল বলা যেতে পারে৷ তবে “যা সম্পত্তি আছে তাতে সাত পুরুষ বসে খাবে” ওই ধারণায় আমি বিশ্বাসী নয়৷ যা আছে তাতে সাত পুরুষ না হোক তিন পুরুষ আরামসে চলে যাবে৷ কিন্তু ওই যে, রাজার ধনও একসময় ফুরিয়ে আসে৷ সুতরাং প্যারাসাইটের মতন না থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে চাই৷

যাইহোক, এত রকমারি লেখা যখন কাটলো না তখন ঠিক করলাম একটা ভূতের গল্প লিখব৷ বাঙালি ভূতে বিশ্বাস করুক বা নাই করুক, ভয় পাক বা না পাক, গল্প কিন্তু পড়বেই৷ একটা আশার আলো ছিল মনে৷ তাছাড়া বিগত কদিন ধরে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটা লেখা পড়ে বেশ অনুপ্রাণিতও হয়েছি৷ একটা জম্পেশ প্লট সাজিয়ে লেখালেখির কাজ শুরু করলাম৷

(২)

শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক যে কতখানি মধুর হতে পারে তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত পার্থ আর মৃত্যুঞ্জয়৷ আদ্যিকালের গুরুগম্ভীর শিক্ষকদের মত পার্থ একেবারেই নয়৷ ছাত্রদের মনের অবস্থা সে বোঝে৷ তাদের অন্তরের আওয়াজ সে যেন শুনতে পায়৷

পার্থর পুরো নাম পার্থসারথি রায়চৌধুরী৷ বড় জমিদার বংশের ছেলে৷ একসময় বহুকাল জাপানে চাকরি করেছিল, এখন টিউশনি পড়ায়৷ মৃত্যুঞ্জয় তারই ছাত্র৷ ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা বেশিদিনের না হলেও তাদের মধ্যে এক অন্তরের যোগসূত্র ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে৷ এর পিছনে মূলত দু’টি কারণ আছে৷ প্রথমত দুজনেরই বই পড়ার চরম নেশা, এককথায় বইপোকা৷ দ্বিতীয়ত দুজনেই ঘুরতে খুব ভালোবাসে৷ যদিও এই ব্যাপারে ছাত্র মৃত্যুঞ্জয় একেবারে কাঁচা৷

সেবারে মহালয়ার এক মাস পর পুজো পড়ল৷ পার্থ তার নতুন পুরনো সকল সাঙ্গ-পাঙ্গদের সঙ্গে পাহাড়ে একটা ট্যুর ঠিক করল৷ দার্জিলিঙের সিটং৷ কিন্তু যাত্রার দিন যত এগিয়ে এল, তত একে একে যাত্রী কমতে থাকল৷ অবশেষে সেই সংখ্যা এসে ঠেকল তিনে৷ পার্থ এক কথার মানুষ, যা বলে তাই করে৷ ঠিক হল তিনজন মিলেই যাত্রা করবে৷

গুরু পার্থ আর দুই শিষ্য মৃত্যুঞ্জয় আর অভিজিৎ, তিনজন মিলে রওনা দিল নির্দিষ্ট দিনে৷ পার্থ আগে থেকেই গাড়ি রিজার্ভ করে রেখেছিল৷ গাড়ি স্টেশনে থামতেই নেপালি চালক থাপা এসে সাদর অভ্যর্থনা জানাল৷ খাঁড়া, সংকীর্ণ এসব পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ওঠানো বেশ ঝকমারি ব্যাপার৷ সুনিপুণ হাত, বাঁকের সঠিক অনুমান, চাকার আন্দাজ, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন৷ বাঁক ঘোরাতে বা স্পিড বজায় রাখতে একটু ভুল হলেই গাড়ি গড়িয়ে যাবে সোজা ফুট শয়েক নিচে৷ প্রতি বছর, খাদে গাড়ি উলটে মৃত্যুর এরকম কত খবর কাগজে বেরোয়৷

সর্পিল ভঙ্গিতে ঊর্ধ্বগামী পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে তিনজন হোমস্টেতে পৌঁছাল৷ ততক্ষণে বেলা হাঁটা দিয়েছে বিকেলের পথে৷ প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু সিটং-৩৷ চারিপাশের ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য মৃত্যুঞ্জয়ের মনে এক পুলকধারা বয়ে আনে৷ যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়৷ ওই দূর পাহাড়ের কোন একটা বাঁকে চিরকালের বাঁধাধরা নিয়মেই বয়ে চলেছে তিস্তা৷ মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি বনানির শান্ত নিবিড়তায় তলিয়ে যেতে শুরু করেছিল তার মন৷

হঠাৎই মৃত্যুঞ্জয় শরীরে কোন কিছুর একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করল৷ পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো পেঁজা তুলোর মত একরাশ ভিজে মেঘ তার শরীর ছুঁয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে৷ কি ঠান্ডা স্পর্শ! এত কাছে থেকে এভাবে কোনদিন মেঘ দেখা বা ছোঁয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় মহিমান্বিতর মত সে তাকিয়ে রইল৷ পার্থ এসব দেখে অভ্যস্ত, সুতরাং তার কাছে এসব এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়৷

দোতলা কটেজের মত দেখতে হোমস্টেগুলো৷ বিস্তীর্ণ পাহাড়জুড়ে জায়গায় জায়গায় অল্প পরিসরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তাদের রংবেরঙের চূড়ার মত মাথাগুলো উঁচিয়ে আছে৷ ঠিক যেন পিঁপড়ের গর্ত৷ প্রায় প্রত্যেক হোমস্টেগুলোর চালায়, নয়তো সদর দরজায়, আর নয়তো পাশে একটা ইয়াব্বড় লম্বা বাঁশের খুঁটি৷ তাতে পাঁচরঙা আলাদা আলাদা ধ্বজা হাওয়ার তালে তালে দুলছে৷ পার্থদার গাড়িতেও ঠিক এরকম একটা সে দেখেছিল৷

পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি নামে৷ তিনজনে নিজ নিজ ঘরে ব্যাগপত্র রেখে স্নানে গেল৷ কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে একজন এসে জানিয়ে গেল, স্নান সেরে তাড়াতাড়ি নিচে চলে আসতে৷ খাবার দেওয়া হবে৷

মৃত্যুঞ্জয় স্নান সেরে ঘরে এসে চুল আঁচড়াতে যাবে, তক্ষুনি সে খেয়াল করল ঘরে একটাও আয়না নেই৷ পাশে অভিজিৎ, পার্থর ঘরে গিয়েও দেখল৷ কিন্তু সেখানেও কোন আয়না ছিল না৷ সঙ্গে করে ছোট্ট একখানি ফোল্ডিং আয়না এনেছিল সে৷ তখনকার মত সেটাতেই কাজ চালাল৷

অভিজিৎ, -এর আগেও দু’তিনবার পার্থর সাথে ট্যুরে গেছে৷ মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে এটাই তার প্রথম অভিজ্ঞতা৷ কাজেই সে বেশ উৎসুক হয়ে আছে সব ব্যাপারেই৷ কালকে তারা ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখবে৷ সিলপু পাহাড়ের চূড়া থেকে নাকি খুব সুন্দর দেখায় এখানকার ভোরের সূর্যোদয়৷ তাদের হোমস্টে থেকে হেঁটে গেলে কিছুটা পথ পরেই৷ তারপর সেখান থেকে ফিরে ডাওহিল হয়ে কার্শিয়ং বাজার৷ তারপর সোজা বাড়ির পথে৷

ওরা তখনও নিচে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ মৃত্যুঞ্জয় আগে ভাগেই নিচে নেমে এল৷ হোমস্টের ঠিক পিছনের দিকে কিছুটা জায়গাজুড়ে একটা ছোট্ট হল ঘরের মতো ডাইনিং হল৷ কাছে যেতেই দেখল একজন ভৃত্য টুংটাং শব্দে কিছু বাসন বের করছে৷ আগত মৃত্যুঞ্জয় কে দেখে, উদ্দেশ্য করে বললো, ‘বসুন বাবু!’

এখানকার লোকেরা বাংলা জানেনা৷ হয়ত নিজেদের ভাষা আর নয়ত হিন্দিতে কথা বলে৷ ভৃত্যের মুখে বাংলা শুনে ওর মনে কৌতুহল জাগল৷ জিজ্ঞেস করল, ‘বাঙালি?’

‘আজ্ঞে!’ বলেই ফিরে দাঁড়ালো ভৃত্য৷

হাফহাতা স্যান্ডো গেঞ্জি৷ কাঁধের একপাশে পৈতে ঝুলে পড়েছে৷ পায়ের নির্দিষ্ট স্থান থেকে অনেকাংশেই উপরে পড়া ধুতি৷ মসৃণ ত্বকের দুধে আলতা রং এক লালিত্বের সৃষ্টি করেছে৷

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মৃত্যুঞ্জয়৷ তখনই ব্রাহ্মণ পাচক ‘ইস! আবার বেরিয়ে পড়েছে, বাঁধন দিতে হবে দেখছি৷’ বলেই বিরক্তি মাখা মুখে হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

তখন কত রাত হবে ঠিক জানা নেই৷ সবাই যে যার নিজের নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে৷ মৃত্যুঞ্জয়ের ঘুমটা ভেঙে গেল৷ প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তার৷ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল৷ সেই সাথে সারা ঘর জুড়ে একটা উগ্র মিষ্টি গন্ধ৷ বিছানা হাতড়াতেই সেটা ভিজে মনে হল৷ আলো জ্বালতেই দেখে পুরো বিছানা ভিজে স্যাঁতস্যাঁত করছে৷ সে নিজেও ভিজে পুরো ঝুপড়ি৷ কতক্ষন যে এইভাবে আপাদমস্তক সিক্ত অবস্থায় পড়েছিল সে নিজেও জানে না৷ এত ঘাম তো হতে পারে না৷ ছাদের দিকে চেয়ে দেখল ফুটো আছে কিনা৷ ফুটো তো দূরের কথা সামান্য একটা ফাটল পর্যন্ত তার চোখে ঠেকলো না৷ বিছানার কাছে ঝুঁকে সেটার গন্ধ শুঁকতে সে বুঝতে পারল ওটা গোলাপ জল৷ উগ্র সুবাসটাও সেটা থেকে আসছে৷ এসব কান্ড দেখে সে যত না আশ্চর্য হল তার চেয়ে ভয় পেল বেশি৷

ঘটনাটির ইতিহাস-ভূগোল কিছু বুঝতে পারার আগেই সহসা একটা কালো বিড়াল তার খাটের তলা দিয়ে ছুটে ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পালালো৷

সেও বিড়ালটার পিছু নিল৷ সেটাকে লক্ষ্য করে হোমস্টের বাইরের পাহাড়ি রাস্তাটায় এসে থামল৷ অন্ধকার রাত৷ এখানে স্ট্রীট লাইটের কোন বালাই নেই৷ যতদূর চোখ যায় শুধু ঘোলাটে কালো পরিবেশ চোখে পড়ে৷ শুধু অনতিদূরের দু’একটা হোমস্টের মিটমিটে বাল্বের ম্লান আলো, অতি সামান্যই তাদের পরিধির অংশগুলোকে অতিকষ্টে আলোকিত করছিল৷ এমনসময় সেগুলো হঠাৎই একসাথে কালিপটকার মত সশব্দে ফেটে গেল৷ চমকে উঠল মৃত্যুঞ্জয়৷ পরক্ষণেই একটা খটখট শব্দ তার কানে এল৷ কেউ খড়ম পরে হাঁটলে যেরকম শোনায়, শব্দটা ঠিক সেরকম৷ সে আবিষ্কার করল শব্দটা তার পিছন থেকে আসছে৷ পাহাড়ি ঢালু অন্ধকার রাস্তা থেকে, এবং সেটা ক্রমশই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে৷

মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে স্বল্প ব্যবধানে শব্দটা থেমে গেল৷ সে পকেট থেকে টর্চটা বের করে আগত শব্দের দিক লক্ষ্য করে আলো ফেলতেই দেখল, একটা কুচকুচে কালো বিড়াল৷ পাশবিক হিংস্রতায় ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে৷ হাড় হিম করা সেটার কদাকার, ভয়ানক চাউনি৷

‘হ্যাট হ্যাট… দূর হ… দূর হ!’

সেটাকে তাড়াতে গেলে মৃত্যুঞ্জয়কে উদ্দেশ্য করে গরগর করে গুঁঙিয়ে উঠল৷ যেন সে মৃত্যুঞ্জয়কে সাবধান করে দিচ্ছে, তাকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করার জন্য৷

সে এবার আরো মেজাজের সাথে সেটাকে তাড়ানোর উপক্রম করল৷ কিন্তু এর পরেই একটা আশ্চর্য্য ব্যপার ঘটল৷

বেড়ালটা এক পা, এক পা করে পিছোতে থাকল৷ যত সেটা পিছোতে থাকল তত সেটা আকারে আগের থেকে বড় হতে লাগল৷ এবার সে বেশ ভয় পেল৷ জড়তা মেশানো, ভীতসন্ত্রস্ত গলা ছেড়ে সেটাকে আবার তাড়াতে উদ্যত হল৷ যত গালিগালাজ করতে থাকল সেটা তত পিছোনে সরে যেতে থাকল৷ আর আকারেও বড় হতে লাগল৷ একগুন, দু’গুন…৷ একসময় যখন সেটা টর্চের আলোর সীমারেখায় এসে থামল তখন সেটার আকার আগের তুলনায় দশগুনে দাঁড়িয়েছে৷ কালো কুচকুচে বৃহদাকার বাঘের মত দেখাচ্ছে৷ সেটার জ্বলজ্বল হলদে চোখের অনড় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার অন্তরের অজানা ভয়টাকে জাগিয়ে তুলল৷ হিমশীতল তীরের বৃষ্টি হল তার সারা শরীর জুড়ে৷ এই বুঝি এক্ষুনি ঘাড়ে এসে ঝাঁপালো৷ সেটা যে কোন সাধারণ বিড়াল ছিল না ততক্ষণে সে বুঝতে পেরে গেছিল৷ আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে সে ছুট লাগাল হোমস্টের দিকে৷ ঘরে ঢুকে প্রচন্ড হাঁপাতে লাগল৷ এই রাত্রে পার্থদাকে ডাকবে? ভাবতে ভাবতে সে বুঝতে পারলো তার হাত-পা কাঁপছে৷ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে৷ সে বিছানায় গিয়ে বসলো৷ মাথাটা ধরে এসেছিল৷ শরীরে তাপ বেশ বেড়ে গেছিল৷ চোখটা ছল ছল করছিল৷ এক সময় আর বসে থাকতে না পেরে শরীরটাকে লুটিয়ে দিল বিছানায়৷

যতক্ষণে সে চোখ খুলল ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে৷ পার্থ, অভিজিৎ, হোমস্টের মালকিন আর দড়কচা মার্কা গলাওয়ালা, সারা মুখে দমড়ানো মোচড়ানো ঢেউ খেলানো চামড়ার এক বুড়ো তার পাশে বসেছিল৷ মহাদেবের সাপের মত বুড়োর গলায় ঝুলছে একটা টেথোস্কোপ৷ সহজেই অনুমেয় এই ব্যাটা নিশ্চয় কোন ডাক্তার৷

এমন সময় গতরাত্রের সব ঘটনা মনে পড়ে গেল৷ কিছু বলার আগেই পার্থ বলে উঠল, ‘আয়নাটা কোথায়? ব্যাগে আছে?’

প্রশ্নটার উদ্দেশ্যর আদ্যপ্রান্ত, ভূত-ভবিষ্যৎ কিছুই বুঝতে পারল না৷ জিজ্ঞাসাসূচক চোখে চারটে মুখের দিকে বার বার তাকাতে থাকল৷

এবার ওপাশ থেকে মালকিন বেশ উত্তেজনার সাথে বললো, ‘জলদি বাতাইয়ে কাঁহা হে? আপতো খুদ মরিয়েগা হামে ভি মারিয়েগা৷’

এসব মরা মরা কথা শুনে হতভম্ব, নির্বাক মৃত্যুঞ্জয় আঙ্গুল তুলে একটা কোণের দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘ওই কিট ব্যাগের প্রথম চেনটা খুললেই পাবে৷”

পার্থ নিমেষের মধ্যে ছোঁ মেরে ব্যাগটা তুলে আনল৷ আয়নাটা নিয়েই প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ মৃত্যুঞ্জয়ও তার পিছন পিছন গেল৷

বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল৷ পার্থ লোকটার হাতে আয়নাটা সঁপে দিল৷ লোকটা তৎক্ষণাৎ সেটা পিচ রাস্তার উপর সজোরে আছড়ে মারল৷ আয়নার শত টুকরো কাঁচগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল৷

ঘন্টাখানেক পরে তারা হোমস্টে ছেড়ে পুনরায় তাদের যাত্রা শুরু করল৷ বুড়ো ডাক্তারের ওষুধ বেশ কাজে দিয়েছে৷ মৃত্যুঞ্জয় শরীরে অনেকটা বল পেয়েছে, স্বস্তি বোধও করছিল বটে৷ ঘুরতে এসে অল্পতে মুষড়ে পড়লে চলে না৷ সেটা তার ভালোভাবেই জানা ছিল৷ তাছাড়া বয়োঃজ্যেষ্ঠ দাদার সামনে প্রেসটিজেরও একটা ব্যাপার বলে কথা৷

কার্শিয়াং বাজারে এসে একটি চায়ের দোকানে সবাই বসল৷ তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়ে পার্থ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল, ‘তু নিজে মরতিস তো বটেই সঙ্গে আমাদেরকেও মারতিস৷ অবশ্য দোষটা আমারই৷ অভিকে আগেই জানিয়েছিলাম৷ তোকেই বলতে ভুলে গেছিলাম৷’

‘ব্যাপারটা ঠিক কী হল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না পার্থ দা৷ কাল রাত্রে…’

‘চা টা আসুক৷ গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে বলছি৷’

কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এসে পড়ল৷ মাটির কুপটির ধূমায়িত গরম চায়ে পার্থ একটা লম্বা চুমুক দিল৷ তারপর মৃত্যুঞ্জয় কে জিজ্ঞাসা করল, ‘আগে বল দেখি গতকাল রাত্রে কি দেখেছিস যে ঐরকম জ্বর বাঁধালি?’

গতরাত্রের সব ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়, পার্থকে বিস্তারিতভাবে বললো৷ সব শুনে পার্থ বলা শুরু করল, ‘বহু বছর আগে গোটা দার্জিলিং জুড়ে গোর্খা জাতির পাশাপাশি অনেক অ-গোর্খাও বসবাস করত৷ দশটা বাসন-কোসন একসাথে থাকলে একটু আধটু টুংটাং হয়েই থাকে৷ পরে নকশালবাদের প্রসার ঘটলে তাদের দৌরাত্ম্যে এই টুংটাং পরিণত হয় দাঙ্গায়৷ গোটা দার্জিলিংএ জায়গায় জায়গায় জ্বলতে থাকে দাঙ্গার আগুন৷ এইসব গোর্খাদের একটা বিশেষ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আছে৷ সেটা নষ্ট হওয়ার ভয় দেখিয়ে নকশালবাদীদের উস্কানিতে গোর্খারা শুরু করে মিশন অ-গোর্খা উৎক্ষেত৷ যারা পারল অন্যত্র পালিয়ে বাঁচল৷ আর বাকিরা কচুকাটা হল৷ এরকম বহু অ-গোর্খাদের মেরে স্থানে স্থানে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল৷ আর নয় তো তাদের লাশগুলোকে, রদ্দি কাগজের গাদার মতো করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল৷

‘কী নৃশংসতা বাপরে! তার মানে তুমি বলতে চাইছো…’

কথাটা সম্পূর্ণ বলার আগেই মৃত্যুঞ্জয়কে থামিয়ে দিল পার্থ৷ ওর মনের বাকি কথাটা আঁচ করতে পেরেছিল সে, ‘হ্যাঁ! আমরা যেখানে ছিলাম সেই জায়গায় তখন শয়ে শয়ে লাশ পোঁতা হয়েছিল৷ পরে জায়গাটায় বাড়ি তৈরি হয়৷ কিন্তু তাদের অতৃপ্ত আত্মা যাবে কোথায়? তিন হাজারেরও বেশি অতৃপ্ত আত্মা রয়ে গেল সেখানেই৷ এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে৷ আমরা বাস করি ত্রিমাত্রিক জগতে অর্থাৎ থ্রি-ডাইমেনশনে৷ আর প্রেতাত্মারা থাকে ফোর্থ-ডাইমেনশনে৷ কোন প্রতিফলিত মাধ্যম, যেমন আয়না দিয়ে আমাদের জগৎ আর ওদের জগতের সাথে এক সংযোগ তৈরি করা যায়৷ আর এই সংযোগ তৈরি হলেই ঘটবে যত গন্ডগোল৷ তোর ওই আয়নার মাধ্যমেই একটা প্রেতাত্মা তাদের জগত থেকে এখানে চলে আসে৷ ভাগ্য ভালো কোন ক্ষতি করেনি৷ সবাই এক হয় না, অনেক দুরাত্মা মানুষের প্রাণহানি পর্যন্ত করে থাকে৷ এর জন্যই ওই হোমস্টেতে প্রতিফলক জাতীয় কোন জিনিস নেই৷ আমি এসব জেনেছিলাম যখন এখানে প্রথমবার ঘুরতে এসেছিলাম তখন৷

মৃত্যুঞ্জয় করজোড়া কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘মা দুর্গার অশেষ কৃপায় আমি এ যাত্রায় বেঁচে গেছি!’

‘কিন্তু পার্থদা ওই হোমস্টের মালকিন আর পাচক ঠাকুর থাকে কিভাবে? ওদের ভয় করে না?’

‘পাচক ঠাকুর! পাচক ঠাকুর এখানে কোথা থেকে পেলি?’ অবাকবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল মৃত্যুঞ্জয়কে৷

‘কেন! ওই যে ডাইনিং হলে দেখলাম, কথাও বলল৷ লোকটা তো বাঙালি৷’

‘বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না৷ ওটা পাচক ঠাকুর ছিল না রে! আজ অনেক বছর থেকেই পূর্ব পুরুষের ভিটা আঁকড়ে একাই পড়ে থাকে মালকিন৷ বিধবা মেয়ে মানুষ, বিয়ে-শাদী করেনি৷ আর তু যাকে দেখেছিলি সে আদপেও কোন মানুষ ছিল না৷ ওদেরই একজন ছিল, বুঝলি!’

মৃত্যুঞ্জয়, পার্থর মুখপানে নীরব দৃষ্টিতে প্রস্তরবৎ তাকিয়ে রইল৷

(৩)

এবছর শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে৷ গরম জামাকাপড়, লেপ কিছুই মানছে না৷ সেসব ভেদ করে ঠান্ডা হাড়ে নাড়া দেয়, শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে তোলে৷

এই শীতকাল বাঙালির বনভোজনের সময়৷ অন্তত আমি এই কালের মধ্যে এটাই বিশেষত্ব খুঁজে পায়৷ যাইহোক এত খেটে লেখা গল্পটার মূল্য প্রকাশকেরা এবারও যখন দিল না তখন পরের গল্পটার বিষয়বস্তু ভাবার জন্য মস্তিষ্কের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন মনে করলাম৷ হারলে চলবে না বন্ধু! এই আশা নিজেই নিজেকে দিলাম৷ দেখা যাক বলা তো যায়না পরেরবার হয়তো বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েও যেতে পারে৷

বন্ধু-বান্ধবরা মিলে ফিস্ট করবো বলে ঠিক করলাম৷ জায়গাও ঠিক করা হল৷ যেটা ফিস্ট করার জন্য একেবারেই মানানসই নয়৷ আর পাঁচটা গতানুগতিক জায়গার থেকে একেবারেই আলাদা৷ উদ্ধারণপুর৷ যেখানে সবাই মরা পোড়াতে, গঙ্গা স্নান করতে যাই৷ আমরা যাব সেখানে ফিস্ট করতে৷

নির্দিষ্ট দিনে সকলে মিলে যাত্রা শুরু করলাম৷ সকাল ন’টা নাগাদ আমাদের গাড়ি কাটোয়া ছাড়িয়ে এসে পৌঁছালো উদ্ধারণপুরে৷ গঙ্গার উজানেই উদ্ধারণপুরের ঘাট৷ উত্তর-দক্ষিণ বিস্তৃত গঙ্গার কিনারায় শ্মশান৷

গাড়ি থামতেই সকলে নেমে প্রথমে মা গঙ্গা, শ্মশান কালী কে প্রণাম জানালাম৷ ঘাটের পশ্চিম রাস্তা ধরে কিছুটা গেলে পরেই শ্মশান৷ শ্মশান পেরিয়েই উঁচু ঢিবির মতো একটা জায়গায় কিছু আকন্দ আর অজানা জংলি ফুলের জঙ্গল৷ সেটার ওপারে সুদূর বিস্তৃত মাঠ৷ এটাই আমাদের বাছাই করা বনভোজনের জায়গা৷ যদিও বন বিনা এই খোলা মাঠে ভোজন করাটাকে বনভোজন বলা যায় কি যায় না সেটা তর্কের বিষয়৷ যাইহোক সবাই মিলে রান্নার কড়াই, খুন্তি, মশলাপাতি, সবজি ইত্যাদি সামগ্রীর জোগাড় জানতি করল৷ আমি এদিকে উনুনে রান্না চাপালাম৷

হাসি-ঠাট্টা, খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে বিকাল গড়িয়ে এল৷ তারপর শুরু হল মদের আসর সঙ্গে তারস্বরে কোরাস৷ বন্ধুদের মধ্যেই একজন একটা পেগ নিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে কপালে ঠেকালো৷ তারপর বিকট চিৎকার করে বলল, ‘ব্যোম কালী! শ্মশানবাসিনী মা গো৷ জয় জয় শ্মশানকালীর জয়!’

এসব আদিখ্যেতা আমার একেবারে সহ্য হয়না৷ মনে ভক্তি নেই৷ শুধু লোক দেখানি…৷ ওহ্, এমন করছে যেন শ্মশান সাধুদের থেকে নিয়ে পেসাদ খাচ্ছে৷ ঢং যত্ত!

সকলেই পেটে দিয়ে চোখ লাল করল৷ কেউ অনবরত ভুল বকতে থাকল৷ কেউ বা চুপচাপ, অজানা কোন অলীক কল্পনার স্রোতে ভেসে গেল৷ যা বুঝলাম ঘন্টা দু’য়েকের আগে নেশা কাটা দায়৷ যদিও আমরা বেশ রাত করেই ফিরব বলে ঠিক করেছিলাম তবুও, যেহেতু আমি এসব খাই না সুতরাং এই মাতাল সঙ্গীদের মাঝে আমি হলাম নিঃসঙ্গ৷

আসর ছেড়ে উঠে গেলাম ঘাটের দিকে৷ কিছুটা দূরে একটা চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে৷ জায়গায় জায়গায় পোড়া কাঠ, বাঁশ, ছেঁড়া মাদুর, কাঁথা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে৷ ইয়াব্বড় বড় কুকুরগুলো জ্বল জ্বল চোখে, লালায়িত জিভ বের করে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশিভোজের আশায়৷ হয়তো এখুনি একটা আধপোড়া মরা পেয়ে সেটাকে নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি করবে৷ ভয়ানক অথচ কি সুন্দর৷

শ্রীচৈতন্যদেবের পারিষদ শ্রী উদ্ধারণ ঠাকুরের নামানুসারে এই ঘাটের নাম৷ গঙ্গার তীরের ভারাক্রান্ত বাতাস তার স্নেহ শীতল স্পর্শে মনে আনে অজানা আনন্দের প্রবাহ ধারা৷ বেশ ভালো লাগে এই সভয় রহস্যাবৃত আনন্দের অনুভূতি৷ এখানেই সবার পরিসমাপ্তি ঘটে, আমারও ঘটবে৷ দূরের ওই দিগন্তজোড়া পর্দানশীন আসন্ন মায়াবী অন্ধকার কত যে জীবন-মৃত্যুর অজানা রহস্য লুকিয়ে রেখেছে তা বলা কঠিন৷

‘দেবব্রত!’

অদূরের অন্ধকার থেকে কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকলো৷ বন্ধুদের কেউ নয় নিশ্চিত৷ তাদের কারও এরকম বাজখাই গলা নাই৷ তাহলে কে? শব্দের দিক লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে, কে ডাকছে আমাকে?’

‘আমি ডাকছি রে শালা! এদিকে আয়৷’

কাছেই, গঙ্গার পাড়ে দপ করে একটা আগুন জ্বলে উঠল৷ যজ্ঞকুণ্ডের আগুন৷ রাস্তা ছেড়ে ঘাট বেয়ে নেমে এগিয়ে গেলাম৷ দাউ দাউ করে জ্বলছে যজ্ঞকুণ্ড৷ ও ধারে বসে দীর্ঘ জটাধারী, লম্বা লম্বা দাঁড়িওয়ালা এক সাধুগোছের লোক৷ পরনে কালো আলখাল্লা৷ গোটা মুখে ছাই-ভষ্ম মাখা৷ রক্তের মতো লাল ঠোঁট বিড়বিড় করে আউরে চলেছে মন্ত্র৷

‘আপনি কি আমাকে ডাকলেন?’

সাধু চোখ খুলল৷ তাঁর দৃষ্টি আমার দিকে৷ রক্তবর্ণ চোখের চাউনি এক লহমায় আমার শরীরের সব রক্ত জল করে দিল৷ বুকে ছ্যাঁত করে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল৷

‘বোস ওখানে!’

যজ্ঞকুন্ডের বিপরীত দিকে সাধুর মুখোমুখি বসলাম৷

‘আপনি আমার নাম…’

‘ওরে শালা আমি সব জানি! অঘোরীরা সব জানে৷ তোর নাম দেবব্রত অধিকারী৷ রায়পুরে থাকিস৷ সব, সব জানি আমি৷’

কথাগুলো শুনেই আমি থ মেরে গেলাম৷ মনে শতশত চিন্তা ভিড় করে এল৷ এই সাধু আমার ব্যাপার এতশত জানল কি করে? অলৌকিক শক্তি, নাকি কোন বদ মতলব? আজকাল এসব ভন্ডামির শেষ নেই৷

গলাটা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে বললাম, ‘আমাকে এখানে ডাকার কারণ? যদি একটু খোলসা করে বলেন৷’

‘বলছি বলছি! তার আগে আমি যেগুলো বলছি সেগুলো সত্যি কিনা বল দেখি৷ তোর লেখালেখি কেউ ছাপচে না, তাই মানসিক কষ্টে ভুগচিস, অনেক কায়দায় লিখেও কোন লাভ পাস নি, পদে পদে অপমানিত হচিস৷ কি যেগুলো বললাম সব সত্যি?’

শুনে দু’মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম৷ ভাবলাম এই সাধু এত কিছু জানল কি করে? আমি একটু চাপা স্বভাবের৷ বন্ধুদের কাছে এসব নিয়ে আলোচনা করিনা৷ তাই ভন্ড হলে নাম-ঠিকানা কোন ভাবে জেনে থাকতে পারে৷ কিন্তু এগুলো জানা অসম্ভব৷ পাঁচ জনের কাছ থেকে শুনে থাকাও সম্ভব নয়৷ তাহলে কি সত্যিই এর অলৌকিক শক্তি আছে?

‘কিরে কি ভাবচিস, আমি এতোসব জানলাম কি করে? নাকি এই ব্যাটা ভন্ড বটে, এই ভাবচিস?’

একটু অপ্রতিভ হয়েই বললাম, ‘না না তা না৷ যা বললেন তা একশো ভাগ সত্যি৷ কিন্তু আপনি এত সব জানলেন কি করে বাবা?’

ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল অঘোরীর৷ বলল, ‘তোর সব সমস্যার সমাধান বাতলে দিতে পারি যদি আমার কথা মত চলিস৷’

কথাটা শুনে আমার চোখ এক নতুন আশায় বড় বড় হয়ে গেল৷ মনে কোন এক সাফল্য পাবার আনন্দ প্রবাহ খেলে গেল৷ সাতপাঁচ না ভেবেই উৎসাহের সাথে বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ শুনবো! শুধু আমাকে একটা পথ করে দিন৷’

ঠিক তখনই কি একটা মনে হতেই জিজ্ঞেসা করলাম, ‘কিন্তু, আপনি আমার মত এক অপরিচিতকে সাহায্য করতে চাইছেন কেন?’

হাঃ হাঃ হাঃ! চারিপাশের নিস্তব্ধতা চিরে একটা বিকট অট্টহাস শোনা গেল৷ অঘোরী বলল, ‘এক বছর বন্যায় এই উদ্ধারণপুর ভেসে গেচিল প্রায়৷ তখন তোর বাপ ত্রাণ দান করে অনেকের সাহায্য করেচিল৷ আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে৷ সে আজ থেকে বহু বছর আগের কথা৷ মায়ের আদেশ৷ তার প্রতিদান ফেরানোর সময় হয়ে গেচে৷ মা মারে! জয় মা, জয় মা!’

আকাশ পানে চোখ তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে প্রণাম করল অঘোরী৷

‘ব্যাটা তোকে আমি এক অসীম শক্তিধর জিনিস দেব৷ তার সাহায্যে তুই ত্রিকালজ্ঞান লাভ করবি৷ যে কারোও ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সব জানতে পারবি৷ প্রচুর অর্থ পাবি৷ কিন্তু এর কিছু শর্ত আছে৷’

‘আমি সব শর্ত মানতে রাজী৷ শুধু আমার একটা কিনারা করে দিন ব্যস৷ এই একঘেঁয়ে দুঃখ, কষ্টের জীবন আর ভালো লাগছে না৷’

‘বেশ, তাহলে শোন! কাল থেকে ঠিক এক মাস পর্যন্ত তোকে সম্পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে৷ ভুলেও কোনো মেয়েছেলের সংস্পর্শে আসা যাবেনা৷ তাহলে কোন কাজ হবে না৷ ব্রহ্মচর্য পালন করা হয়ে গেলে, পরের মাসে অমাবস্যার একুশ দিন আগে আমার কাছে আসবে৷ তারপর কি করতে হবে তখন বলব৷ যাঃ, এখন ভাগ! আমার সাধনার সময় হয়েচে৷ ভাগ শালা! জয় মা…৷’

(৪)

আজ ব্রহ্মচর্য পালন করার শেষ দিন৷ আদেশ মত আমি নিজেকে এই কটা দিন নারীসঙ্গ থেকে দূরে রেখেছি৷ বলতে গেলে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছি একপ্রকার৷ যদিও মেয়ে বান্ধবী আমার নেই বললেই চলে৷

সেদিনের পর থেকে সেই অজানা শক্তিকে পাবার আকাঙ্ক্ষা, আসক্তিতে পরিণত হয়েছে৷ জানিনা, আমার বর্তমান পরিস্থিতি আর এই মানসিক বিকারের জন্য কিনা৷ তবে এক অদম্য লোভ, লালসা কোথা থেকে না জানি আমাকে আষ্টেপিষ্টে পেয়ে বসেছে৷ যেখানে আমি আদৌ জানিনা কি পেতে চলেছি৷ আদৌ পাব কিনা৷ তার ভালো-মন্দ কোনটারই কোন যুক্তি ব্যাখ্যা এখন আমাকে ভাবাচ্ছে না৷ শুধু উন্মত্ত চাতক পাখির মতো একফোঁটা ভাগ্যের আশায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি৷

দুপুরের মধ্যে রওনা দিলাম উদ্ধারণপুরের দিকে৷ বিকাল নাগাদ গাড়ি এসে পৌঁছালো৷ তখন দিগন্ত রেখায় জ্যোতির্ময়ীর বলয়ের শেষ অংশটুকুই দেখা যাচ্ছে৷ পড়ন্ত বিকেলের সোনালী-লালচে আভায় টলটলে গঙ্গার জল চিকচিক করছে৷ আমার মনে বড় অস্থিরতা৷ আর কিছুক্ষণ পরেই এক মায়াবিনী বুড়ি তার চুপড়ি থেকে সন্ধ্যা বের করে ছড়িয়ে দেবে গগন পানে৷ ঢেকে দেবে কালো অন্ধকারে৷ শিয়ালের হুক্কাহুয়া কলরবে এই ঘাটের মরা, প্রেতাত্মা, পিশাচ, ডাকিনী, যোগিনী, যা কিছু অশুভ সব জেগে উঠবে৷ যা কিছু ভালো সবকিছু বিনাশ হবে৷ দূর, বহুদূর থেকে ভেসে আসবে আপনজনকে হারানো হতভাগাদের বুকফাটা আর্তনাদ৷ ‘অতৃপ্ত, আমি আজও অতৃপ্ত!’

কতক্ষন এরকম উদ্দ্যশ্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা৷ সম্বিত ফিরল এক পরিচিত কন্ঠস্বরে৷ দেখি দক্ষিণের শ্মশান ঘাটের কাছে যজ্ঞকুন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে অঘোরীবাবা ইশারায় আমাকে ডাকছেন৷

সন্তর্পনে এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে৷ গুরু গম্ভীর গলায় বললেন, ‘চল আমার সঙ্গে৷’

ঢিবি, আকন্দ, জংলি ঝোপ পেরিয়ে আমরা এলাম মাঠে৷ এই মাঠ আমার চেনা৷ এখানেই আগেরবার ফিস্ট করেছিলাম৷ মাঠ পেরোতেই একটা বনে এসে পড়লাম৷ চারিদিকে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার৷ অঘোরী বাবা একটা চেলাকাঠে আগুন, মশালের মতো করে নিয়ে এসেছে৷ সেই আলোতে যেটুকু যা চোখে পড়ছে৷ সম্ভবত অশ্বত্থ বন৷ আমি ওনার পিছন পিছন চলেছি৷

মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা জায়গায় এসে থামলাম৷ আশেপাশের দু-একটা গাছপালা, কিছু ঝোপঝাড় কেটে, পরিষ্কার করে করা হয়েছে জায়গাটা৷ আমাকে কিছু শুকনো কাঠ জোগাড় করে আনতে বলা হল৷ তারপর সেগুলো দিয়ে যজ্ঞকুণ্ড এর মত করে আগুন জ্বেলে তার পাশে আমাকে বসতে বললেন৷

      
‘যেগুলো বলচি মন দিয়ে শোন৷ তোকে আমি যে শক্তি দেব তার আরাধনা তোকে করতে হবে আজ থেকে একুশ দিন পর্যন্ত৷ এর কিছু বিধিনিষেধ আছে৷’

উনি তাঁর পুঁটুলি থেকে একটা কালো আসন, একটা মড়ার খুলি বের করে পাশে রাখলেন৷ তারপর একটা গাছের ভাঙা ডাল দিয়ে কিছুটা দূরে একটা গণ্ডি কেটে দিলেন৷

‘আজ থেকে একুশ দিন পর্যন্ত গভীর রাত্রে, দিগম্বর অবস্থায় তোকে এই কালো আসনে বসে ওই গন্ডির ভেতরেই সাধনা করতে হবে৷ হাগা, মুত, খাওয়া-দাওয়া সব ওখানেই সারতে হবে৷ গন্ডি থেকে বেরোনো যাবে না৷ আসন থেকে ওঠাও যাবে না৷ অন্যথায় মৃত্যু অনিবার্য!’

আমি চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছি৷ কি করতে চলেছে জানিনা৷ অজ্ঞাত কোন এক শক্তি যেন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এসব করাচ্ছে৷

অঘোরী বললেন, ‘এক মনে মা’কে ডেকে যাবি৷ অন্য কিছু ভাববি না৷ সাধনার এই একুশ দিনে অনেক কিছু দেখতে পাবি৷ অনেক প্রলোভন দেখাবে৷ কিন্তু তোকে স্থির থাকতে হবে৷ উত্তেজিত হলে চলবে না৷ এই সবই মা পরীক্ষা নেবে৷ যদি ঠিকঠাক সব মেনে চলিস তাহলে কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যার দিন তুই মন্ত্রসিদ্ধ হবি৷’

এমন সময় একটা প্রশ্ন মাথা নাড়া দিল, ‘কিন্তু বাবা আমি কার সাধনা করবো সেটা তো বললেন না?’

ঊর্ধ্বে মুখ করে, চোখ উল্টে, বজ্রকঠিন কণ্ঠে অঘোরী বলল, ‘দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরেক রূপ কর্ণপিশাচিনীর সাধনা করবি তুই৷ ভয় নেই মরার পর আবার মানুষ রূপে জন্মাতে পারবি৷ ত্রিকালজ্ঞান পাবি, ত্রিকালজ্ঞান! ধন দৌলত সব পাবি৷’

কর্ণপিশাচিনী নামটা আগে কখনো শুনিনি৷ তবে উনার কথা শুনে আমার কেমন ভয় ভয় করল৷ কিন্তু সাফল্য লাভের অদম্য চাহিদা, লোভের কাছে এসব ভয় এখন তুচ্ছ বলে মনে হল আমার৷ এক অতি প্রাকৃতিক শক্তি পেতে চলেছি আমি৷ আর পাঁচজনের মতো আমি সাধারন থাকবো না, অসাধারণ হয়ে উঠব৷ যারা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তারাই এবার মান্যিগন্যি করবে৷ আমিই হব আমার ভাগ্য বিধাতা৷ ললাটের যত কিছু দুঃখ, যা কিছু খারাপ সব মুছে দেব এক লহমায়৷ পুনঃরচনা করবো নিজের ভাগ্য৷ যেখানে থাকবে শুধু সুখ, ধন-দৌলত, ঐশ্বর্য, মান৷ অচিরেই তাচ্ছিল্যের তীর্যক হাসির রেখা ফুটে উঠল ওষ্ঠ বলয়ের কোণে৷

রাত গভীর হলে সাধনায় উপনীত হলাম৷ অঘোরী বাবার নির্দেশমতো দেহের সব পোশাক খুলে বিবস্ত্র হলাম৷ তারপর গন্ডির মধ্যে কালো আসন পেতে পদ্মাসনে বসলাম৷ তিনি আরও কিছু ক্রিয়ার কথা বলেছিলেন, সেগুলো করলাম সব একে একে৷ প্রথমে ঘি -এর একটা প্রদীপ জ্বাললাম৷ তারপর তাতে আঙুল ডুবিয়ে সেটার কিছুটা পায়ের ত্বকে লাগালাম৷ পাশে রাখা কাঁচের বোতলের মদ মড়ার খুলির মধ্যে ঢাললাম৷ মদ পূর্ণ খুলিটা দু’হাতের কোশে নিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরলাম৷ ভাবলাম, যে ছেলে আজ পর্যন্ত এই জিনিসটাকে অপছন্দ করত, খাওয়া তো দূরের কথা ছুঁয়েও পর্যন্ত দেখেনি, সে কিনা আজ এই সব ছাইপাশ খাবে? পরক্ষনেই অন্তর থেকে কেউ যেন বলে উঠল– এটা ছাইপাঁশ নয় রে, এ হচ্ছে অমৃত, খেয়ে নে! আমার এতদিনের আদর্শকে মেরে, ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিলাম৷ খেতে ভাল না৷ কেমন একটা ঝাঁঝালো বাজে গন্ধ৷ মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল৷ শরীরটা হালকা হয়ে এল৷

নিজের ভাগ্য রচনার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম৷ নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হল৷ আগে কেন পায়নি এসব৷ নিজের উপরেই রাগ হল খুব৷ কয়েকটা ফালতু আদর্শ-নীতিকে জীবনের রূপরেখা করে চলেছিলাম এতদিন৷ কি লাভ এসব আদর্শ-নীতি নিয়ে, যেখানে না আছে ভোগের মজা, না আছে বিলাসব্যসনের সুযোগ৷ আছে শুধু দুঃখ আর অপমান৷

কালো কালিতে অবগাহন করা রাত্রি ভর করেছে চারপাশে৷ নিঝুম নিস্তব্ধতার মাঝে কখনো কখনো গঙ্গার জলের কলধ্বনি আর দূরে কোথাও শেয়াল-কুকুরের কান্নার ডাক ভেসে আসছে৷ চোখ বন্ধ করে, মন স্থির করে আমি এক মনে মন্ত্র জপ করা শুরু করলাম, ‘ওমঃ কর্ণপিশাচিনী কর্ণে হুম স্বাহাঃ..!’

জপ শুরু করা মিনিট কুড়ি হয়েছে কি, অনুভব করলাম কেউ যেন গন্ডির চারপাশে আমাকে ঘিরে সমানে আমার চারপাশে হেঁটে চলেছে৷ আমার সমস্ত শরীর দিয়ে অনবরত ঘাম ঝরতে লাগল৷ ভয়ে নয়৷ আতঙ্কে বা উত্তেজনাতেও নয়৷ এ এক অজানা কোন অনুভূতি৷ যেটাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না৷

পরদিন মলমূত্র সব আসনেই ত্যাগ করলাম৷ নিতম্ব থেকে নিচের প্রায় সমস্তটাই বিষ্ঠায় মাখামাখি হয়ে গেল৷ ওনার কথামতো কিছুটা বিষ্ঠা ডান কানের লতিতে লাগালাম৷ এতে নাকি তাড়াতাড়ি সিদ্ধিলাভ করা যায়৷

অলৌকিক শক্তি লাভের লোভে এই পথে এসেছি বটে৷ কিন্তু এসব অনভ্যস্ত জীবনধারণ আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠল৷ তার উপর আবার এই নোংরা পরিবেশ৷ এভাবে এখনো কুড়ি দিন কাটাতে হবে ভেবেই কেমন কেমন করে উঠল ভিতরটা৷ ঘনঘন মদ খেতে লাগলাম৷ একটা জিনিস লক্ষ করলাম৷ মদের নেশা এসব মানসিক অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ দিচ্ছে৷ তবে কেবল এই মদের উপরেই তো বেঁচে থাকা যায় না৷ নেশা কাটলে চরচর করে খিদে লাগে৷ আধপোড়া মরার এক টুকরো মাংস দিয়ে গিয়েছিল অঘোরী বাবা৷ এটাই এখন আমার দু’বেলার আহার৷

এই দেবীর সাধনা করতে গেলে নাকি সাধককে নোংরা থাকতে হয়৷ এতে দেবী প্রসন্ন হন৷ কালচে লাল বর্ণের মাংসটা৷ বোধহয় এই অংশটাই আগে পুড়ে গেছিল৷ মুখের কাছে নিয়ে যেতেই নাক সিঁটকালাম৷ আঁশটে, পচা একরাশ বিশ্রী দুর্গন্ধ যূথবদ্ধভাবে আমার নাকে ভিড় করে এল৷ টুকরোটায় জিভ ঠেকাতেই গা’টা পুরো গুলিয়ে উঠল৷ হড়হড় করে বমি করে মদ যা খেয়েছিলাম গতকাল থেকে সব উগরে দিলাম৷ আসন সমেত গন্ডির সমস্ত অংশ বৃষ্ঠা, বমি, মূত্রে একাকার হয়ে গেল৷ জলা বমি গণ্ডির পরিধি পেরিয়ে বয়ে গিয়ে বেলে মাটি দ্বারা শোষিত হল৷ মনে মনে ভাবলাম, না এসব অখাদ্য খাওয়া সম্ভব নয়৷ আর ঠিক তখনই অঘোরী বাবার সেই কথাটা “ত্রিকালজ্ঞান পাবি! ধন-দৌলত পাবি!” আমার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকল৷ কি যে হল, কপ করে একটা কামড় বসালাম মাংসের টুকরোটায়৷ দাঁতে করে ছিঁড়ে চিবাতে লাগলাম সেটার গুরুভাগ৷ আমার মধ্যে আর এখন আমি নেই৷ কোনো এক অপার্থিব, অজানা, অমানবিক প্রবৃত্তি দ্বারা আমি বশীভূত, চালিত৷

দিন যত পার হতে লাগল সাধনা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল৷ অঘোরী বাবার কথা মত সত্যি সত্যিই ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল৷ কখনো প্রচন্ড বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়-বৃষ্টি৷ কখনো বা অতি সুন্দর অপ্সরার মতো মোহিনীর আগমন৷ আবার কখনো বীভৎস ভয়ঙ্কর সব প্রেতাত্মার আনাগোনা৷ আমি কিন্তু অনড়৷ চারপাশে যাই ঘটছিল না কেন সবটাই ওই গন্ডির বাইরে৷ কোনো কিছুই আমার অঙ্গ স্পর্শ করছিল না৷ কাজেই এসব ভয়, প্রলোভনে যদি কোনভাবে আসন ছাড়ি তাহলে আমার মৃত্যু যে অনিবার্য সেটা আমি ভালোভাবে জানতাম৷

(৫)

এভাবে একুশ তম দিন উপনীত হল৷ আমার সিদ্ধিলাভের দিন৷ আজই সেই পরীক্ষার দিন, যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আমি পাব ত্রিকালজ্ঞান৷ হয়ে উঠব অসীম শক্তিধর৷ আর যদি না হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ আমার মুন্ডচ্ছেদ হয়ে নরকে নিক্ষিপ্ত হবে৷

মায়ের সাধনায় বিভোর হয়ে ছিলাম৷ এমন সময় একটা সুমধুর কন্ঠস্বর শ্রুতিগোচর হল৷ আমার ঘোর কাটল৷ দেখি এক অত্যন্ত সুন্দরী অর্ধনগ্না নারী আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে৷ জোনাকির মতো স্নিগ্ধ জ্যোতি তার সমগ্র শরীর থেকে বেরিয়ে এসে এই নিষ্প্রাণ অন্ধকারে সুন্দর প্রাণের সঞ্চার ঘটাচ্ছে৷ তার উন্নত স্তনযুগল আমার মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করছে৷ কেবল আমি কেন৷ এরকম বিহ্বল করা লাবণ্যময় সৌন্দর্য, দৃষ্টিকর্ষক স্তনযুগল, বিমোহিত করার মত নিতম্ব যে কোন পুরুষকে উন্মত্ত করার জন্য যথেষ্ট৷ এ যেন অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ৷

তার পরিচয় জানতে চাইলে রমণী বলল, ‘আমি কর্ণপিশাচিনী! তোর সাধনায় তুষ্ট হয়েছি৷ বল কি চাস তুই?’

আমার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল৷

বললাম, ‘মা আমাকে ধন-দৌলত, ঐশ্বর্য দাও৷ আমার সকল দুঃখ, কষ্ট দূর করে দাও মা৷’

‘তোকে ধন, মান, সুখ সব দেব৷ তবে আমার তিনটি শর্ত আছে; আমি সব সময় তোর সাথে থাকবো কিন্তু আমার উপস্থিতি যেন কেউ জানতে না পারে, আমি যখনই চাইবো তখনই তোকে আমাকে তুষ্ট করতে হবে, আমার কোন কথার অবাধ্য হওয়া চলবে না৷ এই শর্ত লঙ্ঘন হলে তোকে আমার হাতে মরতে হবে৷’

‘রাজি মা রাজি, সব শর্তে রাজি৷’

‘বেশ৷ এবার বল আমাকে কিরূপে পেতে চাস৷ ভার্যা, না প্রেয়সী রূপে?’

‘প্রেয়সী রূপে!’

(৬)

আজ প্রায় এক মাস হতে চলল এই কর্ণপিশাচিনীর জন্য আমি দু’হাতে টাকা রোজগার করছি৷ এখন আমার লেখা নেওয়ার জন্য প্রকাশকদের বিশাল লাইন পড়ে বাড়ির বাইরে৷ তবে যেটার জন্য আমি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছি সেটা গণৎকার হিসেবে৷ সপ্তাহে একদিন ঘরে পসরা জমাচ্ছি৷ লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ, বর্তমান বলে দিতে পারি৷ কার কখন কীভাবে মৃত্যু, কার স্ত্রী বা স্বামী কার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত, আজ কোন নাম্বারে লটারি লাগবে, সব কথা এই কর্ণ পিশাচিনী আগে থাকতে কানে কানে জানিয়ে দেয়৷ অঢেল পয়সা পায়৷ পাঁচশ টাকা করে ভিজিট নিই৷ লোকে আজকাল খুব মান্যি-গন্যি করে৷ রাজা থেকে উজির কেউ তোষামোদ করতে ছাড়ে না৷ এমনকি আমার একটি উপন্যাস নিয়ে ছবি করার প্রস্তাব আসছে মাসেই আমার কাছে আসবে সেটাও জেনে গিয়েছি৷

কর্ণপিশাচিনী আমাকে সব দিচ্ছে, ধন, মান, রতিসুখ৷ কিন্তু এই পিশাচিনী সবসময় আমার ডান কাঁধে বসে থাকে, আর ফিসফিস করে অনবরত কথা বলেই যায়৷ এক মুহূর্তের জন্য থামেনা৷ এটাই আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এভাবে বেশিদিন চললে যে আমি বদ্ধ পাগল হয়ে আত্মহত্যা করব, ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করেছি৷ শর্ত অনুযায়ী আমি বারণ করতে পারব না৷ তাহলে ওর হাতেই আমাকে মরতে হবে৷ তবে একটা উপায় বের করেছি৷
 চারিদিকে এখন আমার যথেষ্ট নাম-ডাক হয়েছে৷ সেই সুযোগে আমার এই রমরমা বাজার যে বেশ ভালোই চলবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷ কাজেই আর কয়েক মাস এভাবে চালিয়ে নিয়ে এই কর্ণপিশাচিনীকে বিদায় করব৷ যে একে দিতে পেরেছে সেই একে নামাতে পারবে৷

আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল৷ ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান দেখে বহুজনের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা জেনে, আটটি ভৌতিক গল্প লিখেছি৷ এখনও আরো কয়েকটা লিখব তারপর সেগুলোর সংকলন বই আকারে প্রকাশ করাব ঠিক করেছি৷ কয়েকটা প্রকাশকের সাথে ইতিমধ্যে কথাও হয়েছে৷ কেন জানিনা মন বলছে এটা বেশ ভালোই কাটবে৷

আদেশ ছিল কর্ণ পিশাচিনী সাধনা করলে কোন নারীর কাছে আসা যাবেনা৷ মেলামেশা তো দূরের কথা৷ কিন্তু এ যে মানুষের মন৷ বড় জটিল৷ একে নিয়ন্ত্রন করে পৃথিবীর কোন শক্তির সাধ্য? যতই প্রেয়সী হয়ে থাকুক না কেন৷ শেষমেষ ও একটা পিশাচিনী৷ নিম্ন পর্যায়ের জীব৷ খুব জোর সে তার মায়ার ছলে আমাকে ভোলাতে পারে, ভালোবাসতে নয়৷

ইদানিং বছর কুড়ি-একুশের একটা মেয়ে প্রত্যেক সপ্তাহে আসছে আমার কাছে৷ প্রথম দিকে কিছু পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য আসতো৷ সমস্যা মিটে গেলে এখন নানা অছিলায় আমার কাছে আসে৷ প্রথমটায় বুঝতে পারিনি৷ পরে বুঝতে পারলাম সে আমার প্রেমে পড়েছে৷ ওর উপস্থিতি আজকাল আমারও ভালো লাগে৷ ঠিক করলাম পরেরবার এলে ওকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করবো৷ রাজি হলে বিয়ের প্রস্তাব দেব৷

কিন্তু একটা ভয় আমাকে ভিতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল৷ আমার মনের কথা যদি কর্ণপিশাচিনী টের পায় তাহলে অনর্থ হয়ে যাবে৷ সে কিছু টের পাবার আগেই তাকে বিদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে৷ সেইমত একদিন রওনা দিলাম উদ্ধারণপুরের দিকে৷ অঘোরী বাবার সাহায্য ছাড়া একে নামানো অসম্ভব৷

ঘাটে গিয়ে দেখি একটা মড়াকে পোড়ানোর পূর্ব প্রস্তুতিপর্ব চলছে৷ কাছে যেতেই, স্তম্ভিতবিস্ময়ে প্রস্তরবৎ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলাম৷ দু’জন ডোম মড়াটার গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘি মাখাচ্ছে৷ এ মড়া আমার চেনা৷ এ আমার গুরু অঘোরী বাবা৷ যার সান্নিধ্যে আমি পিশাচসিদ্ধ হয়েছি৷ আমার সব জল্পনা-কল্পনা যে এভাবে ভেস্তে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি৷ এ যে তীরে আসার আগেই তরী ডুবে গেল৷ এই পিশাচিনী কে নামাবো কিভাবে? বজ্রাহতের মত অপলক দৃষ্টিতে, বিপন্ন মুখে ভ্যালভ্যাল করে চেয়ে থাকলাম কেবল৷

একটা ডোমকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি করে হল?’

বলল, ‘চেনা নাকি? হবেনা! এতজনার ক্ষতি করেছে৷ শালা বুড়ো! নিজের সুবিধার লেগে কতজনকে খারাপ খারাপ সিদ্ধি পাইয়ে দিয়েছে৷ আগুন লিয়ে খেলা করলে যা হয়৷ দিয়েছে কোন ভুত-পেত ঘাড় মটকে৷ এই কিছুক্ষণ আগেই দেখি বুড়ো গঙ্গার পাড়ে মরে পড়ে আছে৷’

(৭)

মাসির শরীর খারাপ শুনেই ছুটে এসেছি৷ বুড়ির পরিবার থাকতেও নেই বলা চলে৷ মাসতুতো দাদা বড় কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরি করে৷ বিয়ে থা করে বউ নিয়ে আলাদা থাকে৷ বিধবা মায়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখে না৷ সেলাই আর মাঝে মাঝে দু’একটা হাতের কাজ করে একা বিধবার পেট কোনরকম চলে যায় আর কি৷

বর্ধমান জেলার ভালকিমাচান গ্রামে একটি ছোট্ট মাটির কুটিতে থাকে মাসি৷ ছোটবেলায় মা, বাবার সাথে গরমের ছুটিতে বেড়াতে আসতাম এখানে৷ জায়গাটা বরাবরই খুব ভালো লাগে আমার৷ কর্মসূত্রে ব্যস্ততার কারণে এখন সেভাবে আসা হয় না ঠিকই, তবে সুযোগ পেলেই চলে আসি৷

আজকাল সব কিছুর মধ্যেই কেমন যেন একটা সৌন্দর্যের পরশ পায়৷ খারাপের মধ্যেও একচিলতে ভালো আমার চোখে ঠিক ধরা দেয়৷ প্রেমে পড়লে বোধহয় মানুষের এসব আজগুবি স্বভাবের উদ্ভব হয়৷ দিবাস্বপ্ন দেখে৷ ভেবেই বড্ড বোকা বোকা লাগে৷ নিজের উপরেই হাসি পেল৷

বিগত কয়েকদিন থেকেই একজনকে খুব ভাল লাগতে লেগেছে আমার৷ রায়পুরের এক নামজাদা হস্তরেখাবিদ এবং সাহিত্যিক দেবব্রত অধিকারী৷ ইদানীংকালে জমিজমা বিষয় সংক্রান্ত পারিবারিক এক মামলায় আমার বাবা প্রায় হারতে বসেছিল৷ এনার কাছে আসার পরই তো উনি আশ্বস্ত করলেন৷ বললেন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে৷ মামলার রায় আমাদের পক্ষেই যাবে৷ কি অদ্ভুত! একেবারে মিলে গেল৷ মামলার ফল বেরোলো, আমরা জিতলাম৷

এইতো সেদিনই গেছিলাম মিষ্টিমুখ করাতে৷ উনার লেখা আবার আমার খুব প্রিয়৷ বলতে দ্বিধা নেই যে প্রথম দেখাতেই ওনার প্রতি আমার ভাললাগা তৈরি হয়৷ ধীরে ধীরে এখন সেটা ভালবাসায় পরিণত হয়েছে৷

খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে বেশ রাত হয়ে গেল৷ ছোট্ট চৌকি খাট৷ তবে আমার আর মাসির শোবার পক্ষে যথেষ্ট৷ শুয়ে শুয়ে আপনমনে কি চিন্তা করছি, এমন সময় মাসি বললো, ‘সায়নী! বিয়ে করে শাউর বাড়ি চলে গেলে এই মাসিকে ভুলে যাবি বল?’

‘ধ্যাত! কি যে বলো না৷ তোমাকে ভুলতে পারি তাই? আমার একমাত্র সাধের মাসি বলে কথা৷’ আহ্লাদে জড়িয়ে ধরলাম মাসিকে৷

তখন গভীর রাত৷ ঘুমটা ভেঙে গেল৷ ছাদে, টালির উপর ঘড়্ ঘড়্ শব্দ হচ্ছে৷ ঠিক কেউ যেন একটা ধাতুর তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে টালির উপর আঁচড় কাটছে৷ আমার কেমন একটু ভয় ভয় করল৷ মাসিকে ঘুম থেকে তুলবো কিনা ভাবছি, এমন সময় কাঠের সদর দরজায় জোরে জোরে টোকা মারার শব্দ শোনা গেল৷ সে কি শব্দ! সমস্ত দরজা জুড়ে সম্মিলিত অনেকগুলো হাত ধাক্কা মারছে৷ এই এখুনি বোধহয় দরজাটা ভেঙে পড়বে৷

মাসিকে নাড়া দিতে যাব, এমন সময় একটা বিশেষ শব্দে আমার চোখ গেল দরজার দিকে৷ দরজার হুড়কোটা আপনা থেকেই খুলে গেল৷ পুরনো আমলের দরজার পাল্লা দুটো কর্কশ শব্দে খুলে গেল৷ মাঘের বাঘ জব্দ হওয়া শীতের এক পশলা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় হু হু করে কেঁপে উঠল আমার সর্বাঙ্গ৷ দরজার পাশের কোলঙ্গার প্রদীপটা একটু নিভু নিভু হয়ে আবার জ্বলে উঠল৷ প্রদীপের স্তিমিত আলোকে দেখলাম, পেঁজা তুলোর মতো একরাশ ঘন কুয়াশার মেঘ চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল৷ ধীরে ধীরে সেই কুয়াশা কাটার সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে এল এক নারীর অবয়ব৷ এক পা, এক পা করে সে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে৷ চারিদিকের নিবিড় নিস্তব্ধতা ভেঙে তার পায়ের নুপূর বাজছে৷ ছম্… ছম্… ছম্…! কয়েক হাত দূরত্বের ব্যবধানে এসে দাঁড়াল৷ তারপরই জ্বলন্ত অঙ্গারের মত তার দুটো চোখ জ্বলে উঠল৷

মাসি তখনও নিদ্রাচ্ছন্ন৷ তড়িঘড়ি আমি ঘুম ভাঙাতে উদ্যত হলাম৷ তখনও আমার চোখ ওই অতিজাগতিক জীবের উপর থেকে সরে নি৷

‘ই..ই..ই..!’

মাসি আর্ত স্বরে গোঙাতে শুরু করল৷ তার সারা শরীর বেঁকে, দুমড়ে-মুচড়ে যেতে লাগল৷

‘সায়নী!’

ফ্যাঁশফ্যাঁশে মেয়েলি ডাকে আমার চোখ গেল আগন্তুকের দিকে৷ কি ভয়ানক! সেটার দু’চোখে নরকের দৌরাত্ম্য গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা মৃত্যু কুন্ডের জ্বলন্ত আগুন৷ কুচকুচে কালো ঠোঁটের বলয়ের কোণে ঈষৎ নারকীয় হাসি স্পষ্ট৷ ফ্যাকাশে সাদা চামড়া৷ উসকো খুসকো চুলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর নারীমূর্তি! মানুষ নয়, তাহলে কে? ভূত, পিশাচ, প্রেত?

মনের কথাটাও বোধহয় জানতে পারে৷ তীক্ষ্ণ, কানফাটানো চিৎকার করে বলল, ‘আমি কর্ণপিশাচীনি!’

(৮)

সাত সকালে কাগজটা হাতে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছি, হাত থেকে কাপটা পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল৷ কাগজের শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে ছাপা ”ভাল্কিমাচানে যুবতীর মৃতদেহ উদ্ধার৷”

আরো লিখেছে, ”গলা টিপে, চোখ গেলে রহস্যময় ভাবে খুন করা হয়েছে৷ বছর বাইশের যুবতীর নাম সায়নী মিত্র৷ মাসিকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে জেরার জন্য…”

বুঝতে বাকি থাকল না এটা কার কাজ৷ অঘোরী বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল৷ উনি বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন নারীর সঙ্গ থেকে বিরত থাকতে৷ নচেৎ সেই নারীকে এই পিশাচিনী মেরে ফেলবে৷

আমার সারা শরীর রি রি করে জ্বলে উঠল৷ মাথায় রক্ত চড়ে গেল৷ আমি যেন মানসচক্ষে সায়নীকে মরতে দেখছিলাম৷ আহঃ, কি নৃশংস, যন্ত্রনাদায়ক সেই মরণ! আমার জন্য, আমার জন্যই মরতে হল ওকে৷ বুক ফাটা চাপা যন্ত্রনায় দু’চোখ জলে ভরে গেল৷ কি জানি কি হল৷ হঠাৎ মাথায় আগুন জ্বলে উঠল৷ তখনও কর্ণপিশাচিনী আমার ঘাড়ে বসে ফিসফিস করে কথা বলেই চলেছে৷ বজ্রকঠিন চিৎকারে ওর কথা কাটলাম৷

‘চুপ কর তুই শালী! দূর হ আমার কাছে থেকে৷ একটা নিরপরাধ প্রাণ নিয়েছিস তুই৷ ভাগ শালী!’

কথাটা বলার ঠিক পরে পরেই একটা তীব্র চিৎকারে আমার কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হল৷

‘আ..আ..আ..আ..!’

রাগের বশে কর্ণ পিশাচিনীর শর্ত লঙ্ঘন করেছি৷ লঙ্ঘন নয়৷ উলঙ্ঘন, ঘোর উলঙ্ঘন! এবার আমার মৃত্যু নিশ্চিত৷

নিজের নিয়তির লিখনটা নিজে লিখতে চেয়েছিলাম৷ বুঝতে পারিনি, যেদিন পিশাচ সিদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেদিন থেকেই অদৃশ্য কলমে মর্মান্তিক পরিণতির যবনিকা টানছিলাম নিজের অজান্তেই৷

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে কখন বলতে পারব না৷ অনবরত চিৎকারে ডান কানের পর্দা ফেটে গাল, গলা সব রক্তে ভিজে গিয়েছে৷ বন বন করে মাথা ঘুরছে৷ জানি আমার এই আসন্ন মৃত্যু কেউ আটকাতে পারবে না৷ কোনরকমে দেওয়াল হাতড়ে পড়ার টেবিলে এলাম৷ একটা চিঠি লিখতে হবে৷

চিঠিটা লিখে কোনরকমে টলতে টলতে, এখানকার-সেখানকার জিনিসপত্রে ধাক্কা খেতে খেতে বাইরের পোস্ট বাক্সটার কাছে এলাম৷ সেটাকে পোস্ট বাক্সে ফেলার পর আর পা এগোল না৷ পোস্ট বাক্সটাকে আঁকড়ে ধরে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম৷ পারলাম না৷ ওইখানে পড়ে গেলাম৷ পাশের স্ট্রীট ল্যাম্পগুলো জ্বলছে৷ লোকজন কেউ নেই আশেপাশে যে আমাকে একটু সাহায্য করবে৷ উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই৷

ছোটবেলায় দিদার বলা কথাটা মনে পড়ল৷ দিদা বলত, লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু৷ নিজের কথা ভাবলে কেমন লাগে৷ কি ছিলাম আমি আর কি হয়ে গেলাম৷ বিবেকদংশনে বিধ্বস্ত আমার মন বলে উঠল, পাপী, আমিতো পাপী৷ ধন, ঐশ্বর্য পাওয়ার লালসাই আমার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালো শেষমেশ৷ অনেক অর্থ এখন আমার৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, এক সিকিও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবো না৷ ভাগ্য লিখতে চেয়েছিলাম না৷ সেই ভাগ্যই আজ এই পাপীর অন্তিমকালে সঙ্গ ত্যাগ করল৷ অচিরেই হাসির রেখা ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে৷ এ হাসি অজ্ঞতার৷ নিজের অজ্ঞতার উপরেই হাসছি৷ সায়নীর কথা খুব মনে পড়ছে৷ ওর সাথে একটা নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন বুনেছিলাম৷ সেই তো ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী৷

কত রাত হয়েছে জানি না৷ লাইটগুলোর উজ্জ্বলতা কমে আসতে লাগল৷ সামনে সবকিছু কেমন যেন আবছা হতে লাগল৷ কর্ণপিশাচীনির চিৎকারের শব্দটাও ক্রমশ কমে আসতে লাগল৷ শান্তি নামবে আর মুহূর্ত পরেই! শান্তি…শান্তি…চরম শান্তি!

(৯)

আজ অনেকদিন পর দেবব্রতর চিঠি পেলাম৷ সেটা পেয়ে যতটা না খুশি হলাম, পড়ে তার থেকে কষ্ট পেলাম বেশি৷ কলমের খোঁচায় জায়গায় জায়গায় পাতা ছিঁড়ে গেছিল, অসংলগ্ন হাতের লেখা দেখে বুঝলাম খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে চিঠিটা লিখেছিল৷ সে লিখেছিল-

প্রিয় নবারুণ,

                    
বহুদিন যাবৎ নানা ব্যস্ততার কারণে তোর সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি৷ তার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি৷ আমার হাতে সময় কম৷ বেশি কথা লিখতে পারলাম না৷ আমার একটি অনুরোধ তোর কাছে৷ এই চিঠির সাথে আমার লেখা নয়টি গল্পের পান্ডুলিপি আছে৷ আমার ইচ্ছা সেগুলো বই আকারে প্রকাশ পাক৷ তুই কোন প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ কর৷ আমার বিশ্বাস আমার এই শেষ ইচ্ছা পূরণ হবে৷ তুই যখন এই চিঠি পড়বি ততক্ষণে হয়তো আমি ইহজগৎ ত্যাগ করেছি৷ আমার মৃত্যুর কারণ জানার কোন আগ্রহ মনে পোষণ করবি না৷ এতে তোরই ক্ষতি৷ শুধু এটুকু জেনে রাখ পুরোটাই আমার নিজের পাপের ফল৷ ভালো থাকিস৷

ইতি
তোর বন্ধু
দেবব্রত অধিকারী

রেলের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার৷ সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটে৷ হঠাৎই মনে পড়ল গত দু’দিন আগে কাগজে একটা খবর বেরিয়েছিল৷ তাড়াহুড়োই পড়া হয়ে ওঠেনি৷ পুরনো কাগজের গাদা ঘেঁটে বের করলাম কাগজটা৷ হ্যাঁ ঠিক! এই তো শিরোনামে লেখা, ”রায়পুর বড় বাড়ির বাইরে মিলল যুবকের মৃতদেহ” মন দিয়ে লেখাটা পড়লাম৷ বিশেষ কিছু লেখা নেই৷ কেবল এটুকু লিখেছিল বড় বাড়ির সামনে, পোস্ট বাক্সটার নিচে পড়ে থাকা মৃতের নাম দেবব্রত অধিকারী৷ রহস্যজনকভাবে কান আর মাথার শিরা ফেটে মৃত্যু৷

(১০)

আজ তিন মাস পর দেবব্রতর বই শুভ মুক্তি পেতে চলেছে৷ তার কথা মনে করে কিছুটা মন খারাপ হল৷

দুপুর নাগাদ পার্সেল হাতে পেলাম৷ খুলতেই দেখি ঝাঁ-চকচকে রঙিন প্রচ্ছদে বড় বড় হরফে লেখা ‘তিন তিরিক্ষে নয়’৷ পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ বইটার শেষ পাতায় এসে আমার চোখ আটকাল৷ পুরনো হলদেটে পাতা৷ লাল কালিতে লেখা একটা চিঠি৷ আচমকা দেখলে মনে হবে সেটা রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে৷

এমনটা হওয়ার তো কথা না৷ ওর পান্ডুলিপির মধ্যে এরকম কোন চিঠি তো ছিলনা৷ প্রকাশককে ফোন করলাম৷ প্রকাশক জানালেন সে নিজেও অবাক৷ কারণ এরকম কোনো চিঠি ছাপার সময় সে দেখেনি কিন্তু প্রতিটা বইয়ের কপিতে এটা আছে৷ আশ্চর্যজনকভাবেই নিজে থেকে যেন ফুটে উঠেছে সেটা৷ লেখাটার প্রতি জিজ্ঞাসা বাড়ল৷ রিসিভারটা রেখে লেখাটা পড়া শুরু করলাম…

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *