কোনো নিউইয়র্কবাসীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আবহাওয়া আজ কেমন যাবে?
সে হতাশ ভঙ্গি করে বলে, তিন ডব্লিউ! তিন ডব্লিউর বিষয়ে কিছু বলা ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব না।
তিন ডব্লিউ হচ্ছে—
১. Women
হ্যাঁ, মেয়েদের বিষয়ে কিছু বলা সব দেশের জন্যই কঠিন।
২. Work
‘কাজ’ আমেরিকায় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলেই ভয়াবহ। অকারণ দেশ দখল করে করে দেউলিয়ার কাছাকাছি। লিবিয়া চলে গেল। পরবর্তী দেশ কোনটি, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি।
৩. Weather
তিন ডব্লিউর শেষটি Weather। নিউইয়র্কের জন্য সম্ভবত এটা সত্যি। অক্টোবরে এখানে কখনো বরফ পড়ে না। এই অক্টোবরে বরফ পড়ে একাকার। মানুষ মারা গেছে তিনজন। আমেরিকানের মৃত্যু সহজ কথা না।
যা-ই হোক, বরফপাতের গল্প বলি। সকাল নয়টা বাজে। আমার পুত্র নিষাদ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, বাবা ‘ভয়মকর’ অবস্থা। (পুত্র ভয়ংকর বলতে পারে না, বলে ভয়মকর।)
আমি বললাম, ঘটনা কী?
সে বলল, আকাশের সাদা মেঘগুলো মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
বাংলা ভাষার লেখকদের বরফপাতের বর্ণনায় থাকে, ‘পেঁজা তুলার মতো বরফ পড়ছে।’ এর বাইরে আমি কিছু পাইনি। শিশুর কাছে শুনলাম, আকাশের সাদা মেঘ নেমে এসেছে। নবীজি (দ.) বলেছেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার জন্য সুদূর চীনে যাও।’ আমি বলছি, ভাষা শিক্ষার জন্য শিশুদের কাছে যাওয়া যেতে পারে।
থাকুক এই প্রসঙ্গ। তৃতীয় ডব্লিউ নিয়ে কথা বলি। আগের দিন প্রচণ্ড ঠান্ডা গিয়েছে। বাড়ির বয়লার ফেটে গেছে। হিটিং কাজ করছে না। আমরা ঠান্ডায় জবুথবু। পরদিনই আবহাওয়া উষ্ণ। ঝলমলে রোদ।
আমি গায়ে রোদ মাখানোর জন্য ঘরের বাইরে রোদে বসেছি। হাতে কফির মগ। আমার সামনে পাশের বাড়ির গায়ানিজ এক যুবক এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, গ্র্যান্ডপা। কেমন আছ?
আমি ধাক্কার মতো খেলাম। এই প্রথম এমন বয়স্ক মানুষ আমাকে ‘গ্র্যান্ডপা’ ডাকল। তাহলে কি আমার চেহারা গ্র্যান্ডপা ডাকার মতো হয়ে গেছে!
শাওন বলল, গ্র্যান্ডপা ডাকায় তোমার কি মন খারাপ লাগছে?
আমি বললাম, লাগছে।
শাওন বলল, তোমার নিজের নাতি-নাতনি আছে। তারা যদি তোমাকে ‘গ্র্যান্ডপা’ ডাকে, তাহলে কি তোমার খারাপ লাগবে?
আমি বললাম, অবশ্যই না।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করলাম। আসলেই তো। গ্র্যান্ডপা ডাকায় আমার মন খারাপ হবে কেন?
আমার এখন চার নাতি-নাতনি। আমি যেখানে বাস করি, তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ বলে এদের আমি দেখি না। ওরাও গ্র্যান্ডপা ডাকার সুযোগ পায় না।
‘এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লাইনিং’। আমার কর্কট রোগের সিলভার লাইনিং হলো, এই রোগের কারণে প্রথমবারের মতো আমার তিন কন্যা আমাকে দেখতে তাদের সন্তানদের নিয়ে ‘দখিন হাওয়া’য় পা দিল। ঘরে ঢুকল তা বলা যাবে না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। সূর্যের চেয়ে বালি গরম হয়—এই আপ্তবাক্য সত্য প্রমাণ করার জন্য মেয়েদের স্বামীরা মুখ যতটা শক্ত করে রাখার, ততটা শক্ত করে রাখল।
অবশ্য আমিও সেই অর্থে তাদের দিকে যে ফিরে তাকালাম, তা না। ঘরভর্তি মানুষ। মেয়েদের দেখে হঠাৎ যদি আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করে কেঁদে ফেলি, সেটা ভালো হবে না।
আমি আমার তিন ডব্লিউর অর্থাৎ তিন কন্যার গল্প বলি।
১. প্রথম ডব্লিউ
নোভা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছে। আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে বর্তমানে দেশে ফিরেছে। পিএইচডি ডিগ্রির সঙ্গে সে হিজাবও নিয়ে এসেছে। মাশআল্লাহ, কেয়া বাত হায়।
আমি যখন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছি, তখনকার কথা। ইউনিভার্সিটি আমাকে বাগান করার জন্য দুই কাঠা জমি দিয়েছে। আমি মহা উৎসাহে শাইখ সিরাজ হয়ে গেলাম। খুন্তি, খুরপি, কোদাল কিনে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। মহা উৎসাহে জমি কোপাই, পানি দিই। বীজ বুনি। আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী কন্যা নোভা।
বিকেল পাঁচটায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি, বাড়ির সামনে খুরপি ও কোদাল নিয়ে নোভা বসে আছে। প্রথমে জমিতে যেতে হবে, তারপর বাসায় ঢোকা। যেদিন ফসলে জমি ভরে গেল, সেদিনের দৃশ্য—মেয়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে টকটকে লাল টমেটো প্লাস্টিকের বালতিতে ভরছে এবং বলছে, বাবা, আই মেইড ইট! (মেয়ে তখনো বাংলা বলা শেখেনি)।
মেয়ের আনন্দ দেখে চোখ মুছলাম।
২. দ্বিতীয় ডব্লিউ
নাম শীলা। শুরুতে ছিল শীলা আহমেদ। স্বামী এসে স্ত্রীর নামের শেষে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বাবাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দেয়। এখন শীলার নামের অবস্থা কী জানি না। এই মেয়েটিও বড় বোনের মতো মেধাবী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স ও এমএতে ইকোনমিকসে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে।
এখন তার গল্প। তখন শীলার বয়স ১২ কিংবা ১৩। সবাইকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়েছি। হোটেলে ওঠার সামর্থ্য নেই। বন্ধু ফজলুল আলমের বাসায় উঠেছি (ফজলুল আলম হচ্ছে আগুনের পরশমণির শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলমের ছোট ভাই।)
আমি ক্যাম্পিং পছন্দ করি, ফজলু জানে। সে বনে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করল। আমরা জঙ্গলে এক রাত কাটাতে গেলাম। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। তাঁবুর ভেতর জড়সড় হয়ে শুয়ে আছি। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। দেখি, শীলা বসে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা, কী হয়েছে?
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
আমি বুঝলাম, এই মেয়ে কঠিন ক্লস্ট্রোফোবিয়া। আসলেই সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি বললাম, গরম কাপড় পরো। তাঁবুর বাইরে বসে থাকব।
সে বলল, একা একা থাকতে পারব না। ভয় লাগে। কিছুক্ষণ একা থাকতে গিয়েছিলাম।
আমি বললাম, আমি সারা রাত তোমার পাশে থাকব।
তাই করলাম। মেয়ে একপর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাল। সকাল হলো। মেয়ের ঘুম ভাঙল। সে বলল, বাবা, তুমি একজন ভালো মানুষ।
আমি বললাম, মা! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই।
এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে—পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে। যেমন, তার বাবা।
৩. তৃতীয় ডব্লিউ
তৃতীয় কন্যার নাম বিপাশা। অন্য সব ভাইবোনের মতোই মেধাবী (বাবার জিন কি পেয়েছে? হা হা হা। আমাকে পছন্দ না হলেও আমার জিন কিন্তু মেয়েকে আজীবন বহন করতে হবে।)
এই মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিকসে অনার্স এবং এমএতে প্রথম শ্রেণী পেয়ে আমেরিকায় কী যেন পড়ছে। আমি জানি না।
আমার ধারণা, এই মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী বলেই খানিকটা বোকা। তার বালিকা বয়সে আমি যখন বাইরে কোথাও যেতাম, সে আমার সঙ্গে একটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি দিয়ে দিত। এই শিশিতে নাকি তার গায়ের গন্ধ সে ঘষে ঘষে ঢুকিয়েছে। তার গায়ের গন্ধ ছাড়া আমি ঘুমুতে পারি না বলেই এই ব্যবস্থা।
যেদিন আমি আমেরিকা রওনা হব, সেদিনই সে আমেরিকা থেকে তিন মাসের জন্য দেশে এসেছে। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। একবার ভাবলাম, বলি—মা, অনেক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। ফিরব কি না, তা-ও জানি না। এক শিশি গায়ের গন্ধ দিয়ে দাও। বলা হলো না।
আমার তিন কন্যাই দূরদ্বীপবাসিনী। ওরা এখন আমাকে চেনে না, হয়তো আমিও তাদের চিনি না। কী আর করা? কে সারা সারা!
পাদটীকা
ফ্রম এভরি ডেপ্থ্ অব গুড অ্যান্ড ইল
দ্য মিস্ট্রি হুইচ বাইন্ডস মি স্টিল।
ফ্রম দ্য টরেন্ট অর দ্য ফাউন্টেন,
ফ্রম দ্য রেড ক্লিফ অব দ্য মাউন্টেন
মাই হার্ট টু জয় অ্যাট দ্য সেইম টোন
অ্যান্ড অল আই লাভ্ড্, আই লাভ্ড্ অ্যালোন।
(এডগার অ্যালান পো)
নিউইয়র্ক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৭, ২০১১