তিনে নেত্র
কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরার আগে রঞ্জিত গগৈকে ফোন করল প্রথমা। ফোন ধরে রঞ্জিত বললেন, ‘প্র্যাট, আমি সরি। তোকে ফালতু ঝঞ্ঝাটের মধ্যে ফেলেছিলাম। প্রেসিডেন্টের কার্ডিয়োলজিস্টের আনন্যাচরাল ডেথের জন্যে আর একটু হলেই জেল খাটতে হচ্ছিল তোকে।’
বসের দুঃখ প্রকাশ উড়িয়ে প্রথমা বলে, ‘আপনার কাজ উতরে দিয়েছি স্যার। কার্ডিয়োলজিস্টের শেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছি।’
‘পুরোনো কথা ভুলে যা। তোকে এবার অন্য একটা ঝঞ্ঝাটে ফেলব।’
‘বলে ফেলুন স্যার! তবে ঠিকঠাক একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিন। ডাক্তার-মোক্তারের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্যে কাইমেরা তৈরি হয়নি।’
‘ভালো বলেছিস,’ হাসলেন রঞ্জিত, ‘এবারের কাজটাকে মালব্যনগরের অ্যাসাইনমেন্টের এক্সটেনসান বলতে পারিস…’
‘মালব্যনগরে গিয়েছিলাম ফেক কারেন্সির র্যাকেট ডেসট্রয় করতে…’ বলল প্রথমা।
‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি বা এনআইএ-র রিপোর্ট বলছে, ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্যে ফেক কারেন্সি আবার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এর শেষ দেখতে চাই। তোকে একটা মেল করেছি। তাতে ডিটেলে সব লেখা আছে। দেখে নিস। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই আর বেঙ্গালুরুতে এই র্যাকেটের কিংপিনদের ঘাঁটি।’
‘আমি তা হলে কয়েকদিন কলকাতা থেকে যাই? ছিপ ফেলে দেখি চুনোপুঁটি ওঠে কি না!’
প্রথমা জানে না, তার জন্যে চুনোপুঁটি নয়, রাঘব-বোয়াল অপেক্ষা করে আছে…
১
‘হাই প্রিয়া!’
‘হাই রকি! আপনি এসে গেছেন?’
‘জাস্ট দমদম এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম। এখন দুপুর দুটো বাজে। আমার ধারণা, বাই থ্রি পিএম টিউলিপ বেঙ্গল হোটেলে পৌঁছে যাব।’
‘ঠিক হ্যায়। আপনার জন্য পেন্টিংটা নিয়ে রিসেপশানে ওয়েট করব।’ ফোন কাটে শ্যামলা, ছিপছিপে, কুড়ি বছরের প্রিয়া সেন। জিনিস কেনাবেচার অনলাইন পোর্টাল ‘আর্ট মার্ট’-এর সূত্রে রকি রায়ের সঙ্গে তার আলাপ।
অন্য অনলাইন পোর্টাল, যেমন ফ্লিপকার্ট, ওএলএক্স, মান্ত্রা বা অ্যামাজনের সঙ্গে আর্টমার্টের তফাত আছে। এক নম্বর তফাত, এই পোর্টালে শুধুমাত্র শিল্পসামগ্রী কেনাবেচা হয়। দু’নম্বর তফাত, ক্রেতা বা বিক্রেতা উভয় পক্ষকেই ভালোরকম গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে আর্টমার্টের মেম্বার হতে হয়। সেই টাকাই কোম্পানির লাভ। ক্রেতা বা বিক্রেতার থেকে কমিশন বাবদ আর্টমার্ট কিছু নেয় না। তিন নম্বর তফাত, ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে লেনদেনের কাজটা সরাসরি হয়। কোটি টাকা দামের অ্যান্টিক ভায়োলিন হোক কিংবা লাখ টাকা দামের পিয়ানো বেচা-কেনার মধ্যে আর্টমার্টের কোনও ভূমিকা নেই। তারা শুধু যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
আর্টমার্টে ইউজার নেম প্রিয়া সেন থাকলেও আসল নাম মঞ্জরী চক্রবর্তী। বালিশের পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে ফশ করে সিগারেট ধরায় মঞ্জরী। আবার গলার কাছটা চুলকোচ্ছে। আবার নাক সুড়সুড় করছে। আবার চোখ জ্বালা করছে। আবার ‘কোল্ড টার্কি’ শুরু হচ্ছে।
ড্রাগ উইথড্রয়ালের লক্ষ্মণ মঞ্জরীর মুখস্থ। এক্ষুনি একদাগ কোকেন না নিলেই নয়। ডোভার লেনের তিনতলা বাড়ির ছাদের ঘরে, পাশঝোলা হাতড়ে কোক খুঁজতে থাকে মঞ্জরী…।
মঞ্জরীর বাবা মহেশ চক্রবর্তী নামকরা খৈনি ব্যাবসায়ী। নদিয়ার নিস্তারিণী বিদ্যালয় থেকে সেকেন্ড ডিভিশানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার আর্ট কলেজে ভর্তি হন মহেশ। ইচ্ছে ছিল চিত্রশিল্পী হবেন। আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল মহেশের আঁকার হাত দেখে তাঁকে কলেজ থেকে বার করে দেন। বিতাড়িত মহেশ কলকাতার পথে স্ট্রাগল শুরু করেন। বাসে লজেন্স, ট্রামে ধুপ, ট্রেনে দাদের মলম বিক্রি করে টু পাইস হচ্ছিল। কিন্তু আঁকার নেশা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। শেয়ালদা স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত মুটেমজুরদের মাঝে বসে স্টিল লাইফ আঁকা প্র্যাকটিস করতেন।
গোপাল খৈনির মালিক গোপাল পাণ্ডের মেয়ে অঙ্গনার সঙ্গে মহেশের আলাপ শেয়ালদা স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে। ক্লাস নাইন ফেল অঙ্গনা বাবার সঙ্গে শেষ ট্রেনে শেয়ালদা পৌঁছে দেখেন, নিঝুম প্ল্যাটফর্মে একটা ছেলে মুটেদের ছবি আঁকছেন।
কি কিউট! অঙ্গনা নিজের থেকে মহেশের সঙ্গে আলাপ করেন।
এই আলাপ মহেশের জীবনের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট।
দ্বিতীয় টার্নিং পয়েন্ট গোপাল খৈনির মালিকের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে। মহেশ আজও আনন্দ হলে বলেন, ‘জয় গোপাল!’
‘শিল্প’ শব্দের অর্থ, একই সঙ্গে ‘আর্ট’ এবং ‘ইনডাসট্রি’। ক্লাস নাইন ফেল হলে কী হবে, অঙ্গনা ভালোই ব্যাবসা বোঝেন। আর আর্ট কলেজ থেকে বিতাড়িত মহেশ বোঝেন শিল্প। মহেশ এবং অঙ্গনার বিবাহের সাফল্য চমকপ্রদ। মহেশের ধামাকাদার বিজ্ঞাপনের রকেটে চেপে গোপাল খৈনির বিক্রির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চাঁদে চলে গেল। মহেশ চক্রবর্তী এখন বাংলার প্রথম সারির উদ্যোগপতিদের মধ্যে একজন। পেজ থ্রি পার্টিতে নিয়মিত যাতায়াত, কাগজে ছবি বেরোনো, উদ্যোগপতিদের মিটিং-এ বক্তব্য রাখা কী নয়? অর্থ, যশ, খ্যাতি—সব পেয়েছেন মহেশ। কিন্তু প্রাণে শান্তি নেই। কারণ, খৈনি। খৈনি কারখানার মালিককে বাঙালি সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। সামনে কিছু বলে না। পিছনে হাসাহাসি করে।
ইনসাল্ট নিতে না পেরে মহেশ ঠিক করলেন, ইমেজ মেকওভার করবেন। খৈনি ব্যাবসা যেমন চলছে চলুক। পাশাপাশি আর্ট গ্যালারি খুলতে হবে। তাঁর ছবির কালেকশান হবে ভারতসেরা।
আইডিয়াকে বাস্তবায়িত করতে আঁটঘাট বেঁধে নামলেন মহেশ। কলকাতার নবীন শিল্পীদের ছবি কেনা দিয়ে শুরু করলেন। কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় সমকালীন শিল্পীদের ছবিতে ডোভার লেনের বাড়ির একতলার আর্ট গ্যালারি বোঝাই। এক পিস অরিজিনাল নন্দলাল বসু, এক পিস অরিজিনাল যামিনী রায়, এক পিস অরিজিনাল গণেশ পাইন জোগাড় করে ফেলেছেন। এইবার একটা একজিবিশান করে মিডিয়াকে ডাকবেন। কলকাতার ‘হু-জ হু’-দের বুঝিয়ে ছাড়বেন, কৌন কিতনা পানি মে!
মহেশের উৎসাহেই মঞ্জরী ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকির মধ্যে বড় হয়েছে। তার আগ্রহ কমার্শিয়াল আর্ট আর গ্রাফিক ডিজাইনে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আর্টস নিয়ে গ্র্যাজুয়েশান করেছে। পরের ধাপ, রোডস আইল্যান্ড স্কুল অফ ডিজাইন। অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশান করা হয়ে গেছে। অ্যাডমিশানের জন্য মেল চালাচালি চলছে পুরোদমে।
মঞ্জরী ছোটবেলা থেকে বিদেশ ভ্রমণে অভ্যস্ত। বারো ক্লাসে ওঠার আগেই অধিকাংশ দেশ ঘোরা। ‘তৃতীয় নয়ন’ নামের জলরঙে আঁকা ছবিটি সে আবিষ্কার করে আজ থেকে চার বছর আগে, লন্ডনে। তখন তার ক্লাস টেন।
লন্ডনে গিয়ে টুরিস্টরা কী করেন? টাওয়ার অব লন্ডন এবং লন্ডন আই দেখেন। মাদাম তুসোর মিউজিয়াম এবং বাকিংহাম প্যালেস যান। বিগ বেন, ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবি ও হাইড পার্ক ঘোরেন। শপিং করা আর রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া তো আছেই। সে সবের পাট চুকিয়ে মহেশ আর অঙ্গনা মঞ্জরীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বাঙালি অধ্যুষিত ব্রিক লেনে। অঙ্গনা বাঙালি রেস্তোরাঁর খোঁজ করছেন। মহেশ ব্যস্ত খৈনি রপ্তানির কনট্যাক্ট তৈরি করতে। মঞ্জরীর চোখে পড়ল ‘এসপেসিও একলেকটিকো’ নামের আর্ট গ্যালারিটি।
পাথরে বাঁধানো রাস্তায়, দুটো রেস্তোরাঁর ফাঁকে গ্যালারিটি চট করে চোখে পড়ার কথা নয়। ভারতীয়, বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, চিনা, জাপানি, আমেরিকান এবং ব্রিটিশ শিল্পীদের ছবি ঝুলছে গ্যালারির দেওয়ালে। এত ছবির ভিড়ে আশি সেন্টিমিটার বাই ষাট সেন্টিমিটার মাপের ফ্রেমটি মঞ্জরীর চোখে পড়ে।
ফ্রেম জুড়ে লালপেড়ে শাড়ি পরা এক রমণীর পোটট্রেট। হাতে গোলাপ ফুল। সিঁথিতে সিঁদুর। কপালে সিঁদুরের টিপের জায়গায় তৃতীয় নয়ন আঁকা রয়েছে। গোলাপের লাল পাপড়ি, লাল সিঁদুর আর সবুজ গোলাপ পাতায় আলোর ঝিকিমিকি। ওয়াশে আঁকা ছবিতে বেঙ্গল স্কুলের প্রভাব স্পষ্ট। ছবির কোণে বাংলা ভাষায় সই। ‘তৃতীয় নয়ন’ নামের ছবিটি এঁকেছেন ইন্ডিয়ান আর্টিস্ট, আর এন টেগোর।
গ্যালারির ক্যাটালগ থেকে জানা গেল, ‘ইন্ডিয়ান নোবেল লরিয়েট আর এন টেগোর ১৯২৪ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বুয়েনাস আয়ার্সে ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর আলাপ হয় বিদূষী ও সুন্দরী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর। টেগোরের বয়স তখন তেষট্টি। ওকাম্পোর চৌত্রিশ। টেগোর তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি বিজয়াকে (টেগোর ভিক্টোরিয়াকে এই নামে ডাকতেন) উৎসর্গ করেন। বুয়েনাস আয়ার্সের ওকাম্পো ভিলায় থাকাকালীন এই ছবিটি আঁকা হয়েছিল।’
ক্যাটালগ পড়ে মহেশ প্রচণ্ড উত্তেজিত। রবি ঠাকুরের আঁকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ছবি, যা আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি! এই ছবি কিনলে কলকাতার বাজারে মহেশ চক্রবর্তীর নাম ‘বিখ্যাত খৈনি ব্যাবসায়ী’-র বদলে ‘বিখ্যাত শিল্পরসিক’-এ বদলে যাবে! এই ছবি তাঁর চাই।
মঞ্জরী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ছবিটা জাল না তো?’
গ্যালারি মালিক মারিও প্যাটেল আর এন টেগোর সম্পর্কে কিসসু জানে না। জাল ছবির অভিযোগ শুনে বলল, ‘আমার কাছে এই ছবির অথেনটিকেশান লেটার আছে। দেখবেন?’ তারপর ক্যাবিনেট খুলে একটি হলদেটে চিঠি বার করল। এলমহার্স্ট নামে এক ভদ্রলোক লিখেছেন, ১৯২৫ সালের ৪ জানুয়ারি, ওকাম্পো ভিলায় থাকাকালীন ওয়াশের এই কাজটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ওকাম্পো ভিলা! এলমহার্স্ট! বিজয়া! কলকাতার রবীন্দ্র অনুরাগীরা এই ছবির খবর জানলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। মঞ্জরী এবং অঙ্গনার আপত্তি সত্ত্বেও মহেশ ছবিটা কিনে নেন। দক্ষিণা, কুড়ি হাজার ইউরো। ছবিটি এখন মঞ্জরীর বেডরুমে ঝুলছে।
কলেজে পড়াকালীন মঞ্জরীর ড্রাগ অ্যাডিকশানের শুরু। অল্পবিস্তর নেশা কে না করে? কিন্তু কোকেনের চক্করে মঞ্জরী যে ঢুকে পড়েছে তার কারণ, প্রথম অফারের সময় সে বন্ধুদের ‘না’ বলতে পারেনি। এ হল চক্রব্যূহ। ঢোকা যায়। বেরোনো যায় না। হাতখরচের টাকা দিয়ে অনেকদিন চলল। টুকটাক বাড়ির জিনিস বিক্রি শুরু করেছে মঞ্জরী।
মহেশ আলাভোলা টাইপ। কিসসু বোঝেননি। কিন্তু অঙ্গনার সবদিকে নজর। বাড়ির জিনিস উধাও হয়ে যাওয়া, মঞ্জরীর ব্যবহারের বদল নিয়ে তিনি নানা প্রশ্ন করছেন। বোধহয় কিছু আঁচও করেছেন।
রোডস আইল্যান্ড পালানোর আগে মঞ্জরীর কয়েক লাখ টাকা চাই। মাসছয়েকের নেশার খরচ পেলেই হবে। লুকিয়ে বেচে দেওয়ার মতো জিনিস তার কাছে একটাই আছে। ‘তৃতীয় নয়ন’। কুড়ি হাজার ইউরো মানে রাফলি সাড়ে সতেরো লাখ টাকা। এই ছবি সে কোনও পয়সাওয়ালা, মাথামোটা রবীন্দ্র অনুরাগীকে কুড়ি লাখ টাকায় বেচতে পারবে না?
দীর্ঘদিন নানা জায়গায় ছিপ ফেলে অবশেষে আর্টমার্টে এসে ফাতনা নড়েছে। মুম্বইয়ের নামকরা বিজনেসম্যান রকি রায় ‘তৃতীয় নয়ন’ কেনার জন্যে প্রিয়া সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
আজ ছবির হাতবদল হবে। ভেনিউ, টিউলিপ বেঙ্গল হোটেল।
কোকেন নেওয়া শেষ। মঞ্জরী বিছানা ছেড়ে ওঠে। মেক আপ সেরে বেরোতে হবে।
২
দমদম এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক টারমিনালের বাইরে বেরিয়ে অঙ্কন সেনগুপ্ত দেখল তার জন্যে অপেক্ষা করছে প্রতাপ সিং। হ্যান্ডশেক পর্ব চোকার পরে, অঙ্কনের হাতে মোটকা ব্যাগ ধরিয়ে প্রতাপ বলল, ‘আজই ফিরে যাবে?’
ব্যাগ নিয়ে কার পার্কিং-এর দিকে হাঁটতে হাঁটতে অঙ্কন বলল, ‘হ্যাঁ!’
অঙ্কনের বয়স তিরিশ বছর। উচ্চতা ছ’ফুটের একটু কম। গায়ের রঙ হাতির দাঁতের মতো। ক্লিন শেভড গালে নীলচে আভা। অঙ্কনের পরনে বিজনেস স্যুট। বাঁ-কানে হীরের দুল। কবজিতে মহার্ঘ হাতঘড়ি। শরীর থেকে ফরাসি সুবাস আসছে।
বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ ইন ক্যালকাটা, আর্ট কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশানের পরে কলকাতার পাট চুকিয়ে অঙ্কন মুম্বই পাড়ি দেয়। নানান ঘাটের জল খেয়ে সে এখন মুম্বইয়ে প্রিন্টিং টেকনোলজির কাজ করে। ধারাবির বস্তি থেকে সদ্য লোখন্ডওয়ালার ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটে শিফট করেছে। নেক্সট টার্গেট, সাউথ মুম্বইতে অ্যাপার্টমেন্ট।
কার পার্কিং-এ রাখা পঁচিশলাখি এসইউভির পিছনের আসনে শরীর ছেড়ে দিয়ে অঙ্কন বলে, ‘এত চাপ নেওয়া যাচ্ছে না।’
গাড়ি স্টার্ট করে প্রতাপ বলল, ‘চাপ না নিলে মাল্লু আসবে না বস!’
প্রতাপ অঙ্কনের বিজনেস পার্টনার। অঙ্কন যখন মুম্বইতে স্ট্রাগল করছিল, তখন হঠাৎ বরিভেলি স্টেশানে দুজনের আলাপ। কলকাতা কানেকশানের সূত্রে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তাছাড়া, প্রতাপেরও প্রিন্টিং টেকনোলজির কাজ। তার ব্যাবসায় বিদেশি ইনভেস্টমেন্ট আছে। প্রতাপ চাইছিল মুম্বইতে পা রাখার জায়গা। অঙ্কন চাইছিল ব্যাবসা বাড়াতে। দুজনের বন্ধুত্ব পার্টনারশিপ ব্যাবসায় বদলে যায়। এখন ভালোই রোজগার।
প্রতাপ তার উপার্জনের টাকায় সোনা আর জমি কেনে। অঙ্কন কেনে পেন্টিং। আর্ট কলেজে পড়াশুনোর সূত্রে ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক চিত্রকলা নিয়ে তার বেসিক ধারণা আছে। অপেক্ষাকৃত কম দামে ছবি কেনা এবং বেশি দামে বিক্রি করার মাধ্যমে তার মানি রোল করে। আর্টমার্টের সূত্রে অঙ্কন তৃতীয় নয়নের খবর পেয়েছিল।
আর্টমার্টে প্রাথমিক মেল চালাচালি হয় পোর্টালের সূত্রে। ক্রেতা ও বিক্রেতা সরাসরি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে না। অঙ্কনের ইউজার নেম রকি রায়। প্রিয়াকে পাঠানো প্রথম মেলেই নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছিল সে। প্রিয়ার ফোন আসার পরে ছবির দরদাম নিয়ে কথা হয়েছে। আজ একটু পরে দেখা হবে।
ভিআইপি রোড থেকে উল্টোডাঙ্গা ক্রসিং। সেটা পেরোলেই বাইপাস। মিনিট দশেক গাড়ি চালানোর পরেই টিউলিপ বেঙ্গল হোটেল। রাজকীয় ফয়্যারে গাড়ি দাঁড় করাল প্রতাপ। পাগড়ি পরা, গালপাট্টাওয়ালা ডোরম্যান গাড়ির দরজা খুলে বলল, ‘ওয়েলকাম স্যার!’
মোটকা ব্যাগ হাতে গাড়ি থেকে নামল রকি। প্রতাপ গাড়ি নিয়ে কার পার্কিং-এ চলে গেল। হোটেলের ফ্রন্ট অফিসে চেকইন করার সময়ে আড়চোখে রিসেপশানে চোখ বোলায় রকি। সব চেয়ে দূরের সোফায় বসে রয়েছে শাড়ি পরা, খোলাচুলের একটি মেয়ে। মেয়েটির পাশে, সোফায় শোয়ানো রয়েছে ব্রাউন পেপারে মোড়া চৌকো ফ্রেম। এই তাহলে প্রিয়া!
ফ্রন্ট অফিসের মেয়েটির গলায় ঝোলানো আইকার্ড বলছে, ওর নাম রিনা। সইসাবুদ চুকিয়ে, রকি রায়ের নামে তৈরি জাল প্যানকার্ড স্ক্যান করে, কার্ড ফেরত দিয়ে মিষ্টি হেসে রিনা বলল, ‘ওয়েলকাম টু টিউলিপ বেঙ্গল, মিস্টার রয়। এই নিন আপনার রুমের চাবি। আর…’
‘আর?’ জানতে চায় রকি।
‘প্রিয়া সেন নামের এক মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বলছেন প্রায়র অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে…’
‘রুমে গেস্ট ভিজিট নিয়ে আপনাদের কোনও প্রবলেম নেই তো? সে ক্ষেত্রে আমাকে কফি শপে বসতে হবে।’
‘নো প্রবলেম স্যার! আপনি রুমে সেটল করে আমাকে একবার ফোন করুন। আমি ওঁকে পাঠিয়ে দেব।’
‘থ্যাঙ্কস!’ চাবি হাতে নিয়ে লিফটের দিকে এগোয় রকি।
তিনশো তিন নম্বর রুমে ঢুকে ব্যাগ বিছানায় রেখে রুম সার্ভিসে ফোন করে গ্রিলড স্যান্ডুইচ আর কফির অর্ডার দেয় রকি। রিনাকে ফোন করে বলে প্রিয়াকে পাঠিয়ে দিতে।
রুম সার্ভিস আর প্রিয়া একসঙ্গে ঢুকল। রকি বলল, ‘কফি?’
‘সুগার কিউব একটা। নো মিল্ক।’ সোফায় বসে প্রিয়া, ‘সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘সুগার কিউব দুটো। দুধ দু’চামচ।’ রুম সার্ভিসকে বলে রকি। প্রিয়াকে বলে, ‘ধরাতে পারেন। আমি অবশ্য নন স্মোকার!’
রুম সার্ভিস বেরিয়ে গেছে। স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে রকি বলে, ‘ছবিটা দেখি।’
কফিতে চুমুক দিয়ে ব্রাউন পেপারের মোড়ক খুলে ছবিটি রকির দিকে ঘোরায় প্রিয়া। পরপর তিনটে রিং ছাড়ে।
রকি বলল, ‘এলমহার্স্টের চিঠিটা দেখি।’
প্রিয়া চিঠি এগিয়ে দিল। চিঠিটা মন দিয়ে পড়ে রকি বলল, ‘কত দেব?’
‘সব কথা তো ফোনেই হয়ে গেছে। কুড়ি লাখ। ইন হার্ড ক্যাশ।’
‘ওটা দশ করুন,’ স্যান্ডুইচ শেষ করে ন্যাপকিনে মুখ মোছে রকি, ‘আমার কাছে অত টাকা নেই।’
প্রিয়া কিছুক্ষণ রকির দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরময় ধোঁয়া ছড়িয়ে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল আর্টমার্ট ভদ্রলোকেদের জায়গা।’
‘আমারও সেই রকম ধারণা ছিল।’ হাত নেড়ে ধোঁয়া সরায় রকি।
‘আঠেরো।’ সিগারেট অ্যাশট্রেতে পিষে বলে প্রিয়া।
‘বারো। ছবিটা আপনি কী ভাবে পেয়েছেন, জানি না। খোলা বাজারে যে বেচতে পারবেন না, এটা পরিষ্কার।’
‘পনেরো। আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবেন না। খোলা বাজারে বেচলে অনেক বেশি দাম পাব। কিন্তু লোকে আমায় চেকে পে করবে। আই নিড হার্ড ক্যাশ।’
‘ডান। পনেরো।’ মোটকা ব্যাগ খুলে একগাদা টাকার বান্ডিল বার করে প্রিয়ার হাতে ধরায় অঙ্কন। পাশঝোলায় বান্ডিলগুলো ঢুকিয়ে প্রিয়া রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রকি প্রতাপকে ফোন করে বলে, ‘কাজ শেষ। গাড়ি নিয়ে ফয়্যারে এসো। আর-এক জায়গায় যেতে হবে।’
৩
টিউলিপ বেঙ্গল হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মঞ্জরী। প্রিয়া সেনের নামে কেনা সিমকার্ড জুতোর হিলে গুঁড়িয়ে দিল। একই নামে কেনা সস্তার মোবাইলের স্থান হল নর্দমায়। এই নম্বর জানত একমাত্র রকি। আজ থেকে এই নম্বরে প্রিয়াকে আর পাওয়া যাবে না। পাশঝোলা থেকে নিজের আসল মোবাইল বার করে সে। রকির নম্বর এই মোবাইলেও সেভ করা আছে! কালই মুছে দিতে হবে।
ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ডোভার লেন। তিনতলার ঘরে ঢুকে চোখ থেকে কালো কনট্যাক্ট লেন্স বার করল মঞ্জরী। জন্মগতভাবে তার চোখের মণি খয়েরি রঙের। কালো লেন্স ভোল বদলে খুব হেল্পফুল। একঢাল খোলা চুলের উইগ খুলল। নাক থেকে নামাল কালো ফ্রেমের চশমা।
উইগ, চশমা আর লেন্স আলমারিতে ঢোকায় মঞ্জরী। টাকার বান্ডিলের রাখে চুড়ি রাখার বাক্সে। রোডস আইল্যান্ড যাওয়ার আগে বাবামায়ের ধার, যতটা সম্ভব, মিটিয়ে দেবে সে।
লন্ডন থেকে কলকাতায় ফিরে ‘তৃতীয় নয়ন’ ছবিটা নিয়ে শিল্পবোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মহেশ। সবাই একবাক্যে বলেন, ছবিটা জাল। ব্রিক লেনের মারিও প্যাটেল যে জাল ছবি বিক্রি করে, এটা নাকি কলকাতার চিত্রশিল্প জগতের সবাই জানেন!
সেই থেকে ওই ছবি মঞ্জরীর ঘরের দেওয়ালে ঝোলে। আর্ট গ্যালারি খুলে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে মহেশ অল্পবিস্তর খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি ওই নিয়েই খুশি।
খুশি মঞ্জরীও। এক দাগ কোক নিয়ে জিনস আর টিশার্ট গলায় সে। সাউথ এন্ড পার্কে, বাপ্পার বাড়িতে রেভ পার্টি চলছে। ডিজাইনার ড্রাগের ব্যবস্থা আছে। পার্টি দুপুরে শুরু হয়ে রাত দশটার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বাবামাকে বেফালতু টেনশানে রেখে কী লাভ?
হাজার টাকার পঞ্চাশটা নোট নিয়ে বেরোয় মঞ্জরী। ডোভার লেনের ব্যাঙ্কে তার সেভিংস অ্যাকাউন্ট আছে। তাতে চল্লিশ হাজার টাকা জমা করবে। বাকি দশ হাজার রেভ পার্টিতে খরচা হবে।
দুপুরের দিকে ব্যাঙ্ক ফাঁকা। রাইফেলধারী দারোয়ান ঝিমোচ্ছে। রিকুইজিশান স্লিপ ফিলআপ করে কাউন্টারে দাঁড়ায় মঞ্জরী। ক্যাশিয়ার নিমাই রাউত তাকে চেনে। হালকা হেসে নোটের তাড়া টাকা গোনার মেশিনে ঢুকিয়ে বলল, ‘রোডস আইল্যান্ডে যাওয়ার ভিসা মঞ্জুর হয়েছে?’
‘এখনও না,’ কেজো হাসে মঞ্জরী।
মেশিনে টাকা গোনার কাজ শেষ। আপডেটের জন্যে পাসবই এগিয়ে দিয়েছে মঞ্জরী।
রিকুইজিশান স্লিপে ধপাধপ স্ট্যাম্প মেরে নিমাই পাসবই নেয়। মেশিনে বই ঢুকিয়ে, একটা নোট আলোর সামনে ধরে বলে, ‘নোটটা জাল।’
‘জাল নোট?’ মঞ্জরী অবাক।
দ্বিতীয় নোট আলোর সামনে ধরে নিমাই। বলে, ‘সিরিজের নোট। সবগুলো জাল। এই নোট তুমি কোথা থেকে পেলে?’
মঞ্জরীর পা কাঁপছে! পায়ের নীচের মাটি দুলছে। রকি তাকে ধোঁকা দিল? পনেরো লাখ টাকার জাল নোট গছাল? এবার কী হবে?
নিমাই টেবিলের তলায় লুকোনো সুইচ টিপে দিয়েছে। রাইফেলধারী দারোয়ান ব্যাঙ্কের কোল্যাপসিবল গেটে তালা মারছে। ঘামতে ঘামতে মঞ্জরী বলল, ‘আমি একটা পেন্টিং বিক্রি করে এই টাকাটা পেয়েছি। যে এই নোটগুলো দিয়েছে তার নাম রকি রায়।’
নিমাই গম্ভীর গলায় বলল, ‘টাকা ডিপোজিট তুমি করছ। জাল নোট তোমার কাছে কীভাবে এল, তার ব্যাখ্যা তোমাকেই দিতে হবে। তবে সেই লোকটাকেও ফোন করো। লোকাল থানায় খবর দিচ্ছি। হাজার টাকার নোটের এই সিরিজ নিয়ে এনআইএ-র প্রথমা লাহিড়ী সব ব্যাঙ্ককে মেল করেছেন। ইনফ্যাক্ট, উনি গতকাল এই ব্রাঞ্চে এসেছিলেন…’
মোবাইল থেকে রকিকে ফোন করে মঞ্জরী। যন্ত্রমানবী বলছে, ‘এই নম্বরটির কোনও অস্তিত্ব নেই। ইয়ে নাম্বার মজুদ নহি হ্যায়। দিস নাম্বার ইজ নট অ্যাভেলেবল…’
পুলিশের জিপের হুটারের আওয়াজ শুনতে শুনতে মঞ্জরীর আবার নাক সুড়সুড় করছে, আবার গলা চুলকোচ্ছে, আবার চোখ জ্বালা করছে। কোল্ড টার্কিতে ছটফট করতে করতে মঞ্জরী ভাবল, এনআইএ-র খপ্পরে পড়ে তার যা সর্বনাশ হওয়ার, হয়ে গেল। কিন্তু রকি এখন কী করছে?
৪
টিউলিপ বেঙ্গল থেকে চেক আউট করে রকি। ব্রাউন পেপারে মোড়া পেন্টিং গাড়ির পিছনের সিটে রেখে, ড্রাইভারের পাশের আসনে বসে। রকি রায়ের নামে কেনা সিমকার্ড বুটের হিলে গুঁড়িয়ে, জানলা দিয়ে ফেলে দেয়। রকি রায়ের নামে কেনা শস্তার মোবাইলের ব্যাটারি, ব্যাককভার আর হ্যান্ডসেট আলাদা আলাদা নর্দমায় ফেলে দেয়। এই নম্বরে ফোন করে প্রিয়া আর তাকে পাবে না।
অঙ্কনের চল্লিশ হাজারি মোবাইলে প্রিয়া সেনের নম্বর সেভ করা আছে। সেই মোবাইল থেকে ফোন করে অঙ্কন বলে, ‘বিকাশজেঠু, অঙ্কন বলছি।’
‘আরে অঙ্কন, কী ব্যাপার! নতুন কোনও ছবি?’
‘হ্যাঁ জেঠু। রবি ঠাকুরের আঁকা। বুয়েনাস আয়ার্সের ওকাম্পো ভিলা থেকে জোগাড় করেছি। সঙ্গে অথেনটিকেশান লেটার।’
‘রবি ঠাকুরের আঁকা ছবি?’ বিকাশের গলায় উত্তেজনা।
‘হ্যাঁ। দাম কিন্তু ফিক্সড। কুড়ি লাখ, ইন হার্ড ক্যাশ।’
‘টাকার কথা পরে হবে। তুমি সোজা চলে এসো।’
ফোনালাপ শেষ করে অঙ্কন প্রতাপকে বলে, ‘লাভলক প্লেস চলো। আর্ট হিস্টোরিয়ান বিকাশ সাহাকে ছবিটা বিক্রি করে মুম্বই কাটব।’
প্রতাপ আগেও এখানে এসেছে। সে চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকে।
লাভলক প্লেসে বিকাশ সাহার বিশাল বাড়ি। গাড়িবারান্দায় এসইউভি পার্ক করে প্রতাপ। দারোয়ানকে আগে থেকে বলা ছিল। সে এসে অঙ্কনকে দোতলায় নিয়ে গেল। বছর ষাটেকের সৌম্যদর্শন বিকাশ গালে হাত দিয়ে সোফায় বসে রয়েছেন। অঙ্কনকে বললেন, ‘বোসো।’
বিকাশের সামনের সোফায় বসে ব্রাউন পেপারের মোড়ক সরিয়ে অঙ্কন বার করল, ‘তৃতীয় নয়ন’।
ছবিটা খুঁটিয়ে দেখছেন বিকাশ। কিছুক্ষণ পরে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘তুমি একটা অথেনটিকেশান লেটারের কথা বলেছিলে…’
‘এই যে!’ চিঠি এগিয়ে দেয় অঙ্কন।
চিঠি উলটেপালটে দেখে বিকাশ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তোমাকে আমি বেশ কয়েক বছর ধরে চিনি। তোমার কাছ থেকে পরেশ মাইতি, গাইতোন্ডে, শক্তি বর্মনের ছবি কিনেছি। আর আজ তুমি আমাকে একটা জাল ছবি গছাতে এসেছ?’
‘কী বলছেন আপনি?’ অঙ্কন উত্তেজিত।
‘তুমি ভালো করেই জানো আমি কী বলছি। এই ছবি আর্ট কলেজের কোনও ছেলের আঁকা। ভালো এঁকেছে। কিন্তু ছাত্তরটি জানে না যে রবি ঠাকুর কখনওই বেঙ্গল স্কুলের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না। ওয়াশের কাজ কখনও করেননি। কালার ব্লাইন্ড ছিলেন বলে তাঁর ছবিতে লাল আর সবুজের কনট্রাস্টিং কালার ব্যবহার হত না। সিঁদুরের লাল টিপ, লালপেড়ে শাড়ি, সবুজ পাতা, লাল গোলাপ—এইসব আর যেই আঁকুক, টেগোর আঁকতে পারেন না। ইনফ্যাক্ট, এই অথেনটিকেশান লেটারটাও জাল। এলমহার্স্ট এরকম কোনও চিঠি কোনও দিনও লেখেননি।’
উত্তেজিত অঙ্কন পকেট থেকে মোবাইল বার করে প্রিয়াকে ফোন করে। শুনতে পায়, যন্ত্রমানবী বলছে, ‘এই নম্বরটির কোনও অস্তিত্ব নেই। ইয়ে নাম্বার মজুদ নহি হ্যায়। দিস নাম্বার ইজ নট অ্যাভেলেবল…’
বিকাশও ফোন করছেন। বলছেন, ‘হ্যাঁ প্রথমা, ব্যাঙ্কের ইনফর্মেশান ঠিক। ওই মেয়েটি যাকে ছবি বেচেছিল, সে আমার চেনা। সে একটা জাল ছবিকে রবি ঠাকুরের অরিজিনাল পেন্টিং বলে বেচতে এসেছে। দাম চাইছে কুড়ি লাখ। আপনি এখানে আসুন। অন্য যে সব আর্ট কালেক্টারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাদের জানিয়ে দিন, কালপ্রিট ধরা পড়েছে!’
অঙ্কন বুঝতে পারে, তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। জাল ছবি বেচার অপরাধে ধরা পড়লে ছাড় আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসইউভির ডিকিতে এক কোটি টাকার জাল কারেন্সি রাখা আছে। শত্রুরাষ্ট্র ওয়ারিস্তানের অর্থনৈতিক সাহায্য ছাড়া কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি আর বেঙ্গালুরুতে জাল নোট ছাপার কাজ সে আর প্রতাপ করতেই পারত না। জাল নোট ছাপার জন্যে পৃথিবীর সব সেরা ছাপার মেশিন আর টেকনোলজি সাপ্লাই করেছে ওয়ারিস্তান!
একলাফে গ্যালারি থেকে বেরোয় অঙ্কন। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। একবার এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে আর চিন্তা নেই!
বাড়ির বাইরে পুলিশের জিপের হুটারের শব্দ। অঙ্কন দেখল জিপ থেকে শিম্পাঞ্জির ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে নামছে বছর বাইশের একটা মেয়ে। ডান হাতে নাইন এমএম পিস্তল বার করে প্রতাপের দুই ভুরুর মাঝে ধরছে। বাঁ-হাতে আইকার্ড দেখিয়ে বলছে, ‘প্রথমা লাহিড়ী। এনআইএ।’ প্রতাপ কাঁপতে কাঁপতে এসইউভির ডিকি খুলে দিচ্ছে।
প্রথমা প্রতাপকে নিয়ে ব্যস্ত। এই ফাঁকে এসইউভির পাশ দিয়ে হরিণের ক্ষিপ্রতায় দৌড়ে বেরোয় অঙ্কন। তিন-চার পা দৌড়লেই লাভলক প্লেস। এই সময়ে ট্যক্সির অভাব নেই।
অঙ্কন দেখতে পায়নি, জিপ থেকে নেমে দুজন পুলিশ প্রতাপকে হ্যান্ডকাফ পরাচ্ছে। প্রথমা দৌড়ে আসছে তার পিছনে।
‘ট্যাক্সি!’ রাস্তায় পৌঁছে প্রথম যে ট্যাক্সিটা দেখতে পেল অঙ্কন, তার উদ্দেশে হাত নাড়ল। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল। একলাফে ট্যাক্সিতে উঠে অঙ্কন বলে ‘এয়ারপোর্ট! জলদি!’
প্রথমা দৌড়ে আসছে। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে অঙ্কনের কলার চেপে ধরেছে। প্রথমার চোয়াল লক্ষ্য করে ঘুষি চালায় অঙ্কন। নাছোড়বান্দা প্রথমা অঙ্কনের কলার ধরে চলন্ত ট্যাক্সি থেকে ঝুলছে। চিৎকার করছে, ‘ড্রাইভার! ট্যাক্সি রোকো!’
প্রথমার গলার আওয়াজে এমন কিছু আছে যে ড্রাইভার ব্রেকে পা রাখল। টায়ার আর রাস্তার ঘর্ষণের বিচ্ছিরি শব্দে লাভলক প্লেসকে চমকে দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেছে। ট্যাক্সির দরজা খুলে অঙ্কনকে হিঁচড়ে বার করেছে প্রথমা। কলার ধরে টানতে টানতে বিকাশের বাড়ি ফেরত নিয়ে আসছে।
বিকাশ নীচে নেমে এসেছেন। এক ধাক্কায় অঙ্কনকে গাড়িবারান্দার মেঝেয় ফেলল প্রথমা। ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে খেতে অঙ্কন দেখল, ডিকি থেকে নোটের বান্ডিল বার করে প্রথমা মোবাইল ফোনে কাউকে বলছে, ‘মিশন সাকসেসফুল স্যার! ওয়ারিস্তানের ফান্ডিং-এ জাল নোটের যে র্যাকেট আমাদের দেশে রান করছিল, রবি ঠাকুরের জাল ছবি তাকে বার্স্ট করল। কবিগুরু আজও আমাদের কত দরকারে যে লাগেন তার কোনও হিসেব নেই!’