তিনি যখন বাইরে – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

তিনি যখন বাইরে – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

শীতকালে এ গ্রামের সন্ধ্যে। রাতের তফাত করা যায় না। খানিক আগেই হলুদ আলোর বিকেল ছিল। এখন ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। আজও বিদ্যুৎ পৌঁছোয়নি এখানে। অনেকক্ষণ হল হরিডাক্তারের চালাঘরের চেম্বারে পেশেন্ট নেই। ডাক্তারবাবু ভাবছেন, এবার তাহলে ঝাঁপ ফেললেই হয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে গল্পগাছা করবেন, রেডিয়ো শুনতে-শুনতে চা-টা খাওয়া হবে।

ডাক্তারবাবু না থাকলে স্ত্রী বাড়িতে একা। সরকারি হাসপাতাল থেকে রিটায়ার করার পর হরিডাক্তার চলে এসেছেন গন্ডগ্রাম এই বাদাখালিতে। বড়ো শান্ত, নিস্তরঙ্গ এখানকার জীবনযাত্রা। প্রায় পনেরো বছর থাকা হয়ে গেল এই গ্রামে। মানুষের সেবার কথা ভেবেই আসা। ছেলেমেয়েরা সব কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত।

বাদাখালির সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি বিকেল চারটের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর হরিডাক্তারই ভরসা। লোকাল রুগি তো আছেই। বাদাখালি ঘিরে সুন্দরবনের অসংখ্য দ্বীপ। ভুটভুটি নৌকোয় নদী পেরিয়ে হামেশাই সিরিয়াস পেশেন্ট নিয়ে আসে গ্রামের লোক। ম্যালেরিয়া, ভেদবমি, সাপে-কাটা, বাঘে থাবা-মারা, আরও কত কী! সবে সাতটা বাজে। এখনই কী চেম্বার ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে? ভাবতে ভাবতে লণ্ঠনের আলোয় মেডিসিনের বই পড়ছিলেন ডাক্তারবাবু। এমন সময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দুটি ছায়ামূর্তি। লণ্ঠনের স্তিমিত আলোতেই ডাক্তারবাবু আন্দাজ করতে পারলেন, এরা এলাকার লোক নয়, দূরের কোনো দ্বীপ থেকে এসেছে। একেবারে হতদরিদ্র গেঁয়ো চেহারা। ডাক্তারবাবু ডাকলেন, ‘এসো, ভিতরে এসো। কী হয়েছে?’

একজনের বয়স পঁয়তাল্লিশের কম বেশি। অন্যজন কুড়ি-বাইশ হবে। বাবা আর ছেলে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। চেহারায় বেজায় মিল। ছেলেটি কেমন যেন ভ্যাবলা মেরে আছে। বাবা তার কনুই ধরে এনে বসালো চেয়ারে। নিজে বসল পাশেরটায়। টেবিলের ওপারে হরিডাক্তার এখন তাদের মুখোমুখি। ছেলেটিকে দেখিয়ে লোকটি বলল, ‘এর জন্যই আসা। আমার ছেলে, একটিই সন্তান। পাঁচদিন হয়ে গেল মুখে কোনো কথা নেই। ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে আছে। খাইয়ে দিলে অল্প একটু খাচ্ছে। একফোঁটা ঘুমোচ্ছে না।’

কপালে ভাঁজ পড়ল হরিডাক্তারের। তাঁর সুদীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে এ ধরনের রুগি প্রথম দেখছেন। ছেলেটি শুধু বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে আছে, তা নয়। চোখের পাতা পড়ছে অনেক দেরি করে। কোনো নির্দিষ্ট কিছু দেখছে না সে। শূন্যে ভাসছে দৃষ্টি। মুখটা আবার একটু হাঁ করে রেখেছে।

‘বিশেষ কোনো ঘটনার পর কী এরকম হয়ে গেল?’ জানতে চাইলেন হরিডাক্তার। আসলে বুঝতে চাইছেন ছেলেটা কোনো শক পেয়েছে কি না? গভীর দুঃখ বা ভয়ের কিছু দেখেছে কি না?

লোকটি বলে, ‘না, ডাক্তারবাবু, এমনি হঠাৎ। উঠোনে বসে দা দিয়ে কাঠ সাইজ করছিল, ওর মা খেতে ডেকেছে, ছেলে এই চেহারায় উপস্থিত।’

‘তখন তুমি কোথায় ছিলে?’

‘আমি নদীর ধারে নৌকো থেকে জল ছেঁচছিলাম। বউ দৌড়ে এসে জানালো ছেলের অবস্থা। আমার প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। বাড়ি এসে দেখি, আজব ব্যাপার! বউ ঠিক কথাই বলেছে।’

লোকটা থামতে হরিডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘তারপর কী করলে?’

‘কী আর করব! গ্রামের মুরুব্বিদের ডাকলাম। কেউ বলল, ভূতে ধরেছে। অনেকে বলছে, বাণ মেরেছে আমার কোনো শত্রু। ছেলেটাকে হাবা বানিয়ে দিয়েছে। অনেক ওঝা-বদ্যি করলাম। জলপড়া খাওয়ানো, ঠাকুরথানে নিয়ে যাওয়া, সবই হল। কোনো উন্নতি নেই।’

হরিডাক্তার খাঁটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। ভূত, ওঝা এসবে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। হাবা হয়ে যাওয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন রোগের প্রকৃত কারণ। ছেলেটার চোখে-মুখে এখনও পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অভিব্যক্তি একই রয়ে গিয়েছে। বাকি দু-জনের আলাপ-আলোচনা মাথায় ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওর বাবা বলছে, মা খেতে ডাকছে শুনে ছেলেটি কাজ ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। কান তার মানে ঠিক আছে। হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মনে এল হরিডাক্তারের। লোকটির কাছে জানতে চান, ‘তোমার ছেলে বাঘটাঘ দেখেনি তো? তারপর থেকে হয়তো ভয় খেয়ে আছে।’

‘না-না, বাঘ দেখবে কী করে! আমাদের ন্যাজাট গ্রামে বড়োমামা কোথা থেকে আসবে? কত লোকের বসবাস!’

সুন্দরবনের লোক বাঘকে ‘বড়োমামা’ ডাকে, কেউ বা বলে ‘বড়ে মিঁঞা’। হরিডাক্তার বললেন, ‘অশক্ত, বুড়োবাঘ তো মাঝে মধ্যে চলে আসে গ্রামে। দৌড়ে গিয়ে শিকার ধরার ক্ষমতা যে বাঘের নেই, মানুষ হচ্ছে তাদের কাছে সহজ শিকার।’

একটু ভেবে নিয়ে লোকটি বলে, ‘তা অবিশ্যি ঠিক। তবে বড়োমামা শুধু আমার ছেলেকে ভয় দেখিয়ে পালাবে? গ্রামের আর কোনো ক্ষতি করবে না? গ্রামে বাঘ পড়া মানে তো হুলস্থূল কান্ড!’

পয়েন্টটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হরিডাক্তার ছেলেটিকে বললেন, ‘হাতটা একটু দেখি।’

ছেলেটির মুখে কোনো ভাবান্তর হল না। হাতটা কিন্তু বাড়িয়ে দিল। পালস ধরলেন ডাক্তারবাবু। সামান্য দ্রুত চলছে। ছেলেটির চোখের পাতা টেনে দেখলেন। জিভ ঢুকিয়ে নেওয়ার পর আগের মতোই সামান্য হাঁ হয়ে রইল মুখ। ডাক্তারবাবু চোয়াল ধরে নাড়ালেন, হয়তো কিছু আটকে আছে। আলতোর ভান করে বেশ জোরেই চাঁটি মারলেন গালে। ছেলেটির বাবা বোধহয় বুঝে ফেলল। বলল, ‘আমরাও অনেক মারধর করেছি ডাক্তারবাবু। কোনো ফল হয়নি।’

হরিডাক্তার বিব্রত বোধ করলেন। ফিরে এলেন নিজের চেয়ারে। একটা প্যাড টেনে কিছু লিখতে লিখতে বললেন, ‘মনে হচ্ছে, মেন্টাল প্রবলেম। মনের রোগের চিকিৎসা আমার সাধ্যের মধ্যে নয়। কলকাতায় ভবানীপুরে আমার ভাইপোর চেম্বার। ও মনের ডাক্তার। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। ছেলেকে নিয়ে গিয়ে দেখাও। ছেলের আর তোমার নাম বলো।’

‘আমি মাধব বেরা। ছেলে লাল্টু’, বলার পরে লোকটি হাতজোড় করে কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ‘কলকাতার ডাক্তার মানে তো মেলা টাকার ব্যাপার। আমি দিন আনি দিন খাই। জোয়ান ছেলেটা তবু কাজে হাত লাগাত, সে এখন হাবা হয়ে বসে রইল। ওর মা কেঁদেকেটে একশা করছে। যা করার হয়, আপনিই করুন। আপনি আমাদের ভগবান।’

চিঠির শেষটুকু লিখে হরিডাক্তার বললেন, ‘সায়ন, মানে আমার ভাইপো টাকা নেবে না। চিঠিতে লিখে দিয়েছি আমি। শুধু একটু সকাল-সকাল যেয়ো। ওর বিরাট পসার।’

আশ্বাসে কোনো লাভ হল না। মাধব বেরা বলল, ‘দু-জনের কলকাতা যাওয়ার টাকা কোথায় পাব, বলুন। আমাদের অবস্থা আপনার চেয়ে আর কে ভালো জানে!’

এ ক্ষেত্রে হরিডাক্তার যা করে থাকেন, তাই করলেন। পকেট থেকে এক-শো টাকার নোট বের করে চিঠিসমেত বাড়িয়ে ধরলেন মাধব বেরার দিকে। বললেন, ‘সায়নকে দেখিয়ে আমাকে একবার রিপোর্ট কোরো।’

করুণ মুখ করে ঘাড় হেলিয়ে মাধব বেরা জিনিস দুটো জামার পকেটে ঢোকাল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে নমস্কার করল ডাক্তারবাবুকে। ছেলেটিও করল। মুখের ভাব সেই একইরকম।

ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হরিডাক্তার ভাবেন, ‘আশ্চর্য রোগ! এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাঁকে জানতেই হবে। আলোচনা করতে হবে ভাইপো সায়নের সঙ্গে। আচমকা একটা কথা মাথায় এল, ছেলেটা অভিনয় করছে না তো? হয়তো সাংঘাতিক কোনো অপরাধ করেছে কিংবা দেখেছে ঘটতে। তারপরই বোবা সেজে বসে গিয়েছে, যাতে কেউ ওর মুখ থেকে কথা বের করতে না পারে।’

অভিনয়টা করেছে মাধব বেরা। ডাক্তারবাবু চেম্বার থেকে বেরিয়ে পা চালিয়েছে ঘাটের দিকে। হাবা হয়ে যাওয়া ছেলেকে বলেছে, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা লাল্টু। নিরাপদ না আবার নৌকো ছেড়ে দেয়। অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে এনেছি।’

কাছাকাছি অমাবস্যা। আকাশে ফালি চাঁদ। চারপাশ নিকষ কালো। মাধব বেরার হাতে চার ব্যাটারির জ্বলন্ত টর্চ। মাটির রাস্তা ধরে নদীর দিকে যেতে যেতে নিজের ভাগ্যদেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে মাধব। হরিডাক্তার তো যে-সে ডাক্তার নন, রোগটা প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন। অথচ গ্রামের ছ-জন ছাড়া সকলের চোখেই ধুলো দিয়ে রেখেছে মাধব। আসল ঘটনা লোক জানাজানি হলে মাধবদের কপালে জেল একেবারে বাঁধা। পাঁচ দিন আগে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে মাধবরা। নদীতে মাছ ধরা মাধবদের পেশা। শীতকালে মাছেদের আনাগোনা কম। জালে মাছ প্রায় ওঠেই না। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিল মাধবদের। বাড়িতে হাঁড়ি না চড়ার হাল। মাধবরা পাঁচ বন্ধু মিলে ঠিক করে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাবে আর মধু আনতে। অবশ্যই আইনের চোখে ধুলো দিয়ে। সুন্দরবনের কিছু দ্বীপ সরকার বাঘেদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সেখানে মানুষের যাওয়া মানা। কিছু দ্বীপে মানুষ যেতে পারে মধু সংগ্রহ করতে, তবে কাঠ কখনোই কাটা চলবে না। সেই সব জঙ্গলে বাঘ নেই। যেতে হয় সরকারের ঘরে টাকা দিয়ে পারমিট করিয়ে। সে দ্বীপে বাঘ তেমন নেই, মধুও তেমন পাওয়া যায় না। টাকা ওঠে না পারমিটের। মাধবদের দল ঠিক করে, লুকিয়ে বাঘেদের জন্য সংরক্ষিত দ্বীপে গিয়ে কাঠ, মধু চুরি করে আনবে। কিছুদিন হল মাধবদের দলে তার ছেলে লাল্টুও যোগ দিয়েছে। বাবা, কাকাদের সঙ্গে মাছ ধরে। মাধব ঠিক করে, ছেলেকে জঙ্গলে নিয়ে যাবে না। সেখানে পদে-পদে বিপদ। বাঘ, সাপ, অন্যান্য জীবজন্তু, তা ছাড়া জলপুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় তো আছেই। মাধবরা অভাবে পড়ে বেশ কয়েকবার গিয়েছে কাঠ, মধু চুরি করতে। দলের দু-জন খাদ্য হয়েছে বাঘের। বাবার নিষেধ ছেলে শুনল না। যাবেই যাবে জঙ্গলে। বিপদের যে আলাদা একটা আকর্ষণ থাকে। লাল্টু হুমকি দিল, ‘তুমি যদি আমাকে না নিয়ে যাও, মাকে বলে দেব।’

মাধবদের দলের কেউই নিজের বউকে বলে বাঘের জঙ্গলে যায় না। বললে তারা যেতে দেবে কেন? সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে কে আর নিজের প্রিয়জনকে ছাড়তে চায়! অগত্যা লাল্টুকে সঙ্গে নিতে হল। শুভদিন দেখে সাতজনের দল নৌকো করে জলপুলিশের টহলদারি এড়িয়ে পৌঁছেছিল এগারো নম্বর ব্লকে। তখন দুপুর। ওই দ্বীপে তারা আগেও গিয়েছে, বাঘের কবলে পড়তে হয়নি। বাঘ তো আর জঙ্গলে থিকথিক করে না। থাকে অনেক গভীরে। এমনিতেই পৃথিবীতে বাঘ কমে আসছে।

শিবাই গুনিন নৌকো থেকে নেমে মন্ত্র পড়ে জঙ্গল বেঁধে দিল। এতে নাকি বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচা যায়। দলের সকলেই জানে, এটা অন্ধ বিশ্বাস। মন্ত্র পড়ার পরও বাঘের পেটে যায় মানুষ। তবু মনে একটা সান্ত্বনা থাকে, সাহস বাড়ে।

সাতজনের দল থকথকে কাদা মাড়িয়ে ঢুকে গিয়েছিল জঙ্গলে। তাদের হাতে মোটাসোটা লাঠি, মাথার পিছনে মানুষের মুখওলা মুখোশ। বাঘকে ঠকানোর কায়দা আর কী! এতেও কাজ হয় না। সুন্দরবনের বাঘ ভীষণ চালাক, ঘাপটি মেরে অনুসরণ করে মানুষের দলকে। এগিয়ে যাওয়া লক্ষ করে মানুষের সামনে পিছন বুঝে নেয়। দলের একজনকে নিশানা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড়ে। নিমেষে টেনে নিয়ে জঙ্গলের গভীরে চলে যায়। যে মানুষটাকে বাছে, সে দলের সামনের অথবা পিছনের নাও হতে পারে। মাঝখান থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাই বেশি। বাঘ কী দোষ বা গুণ দেখে মানুষ বাছে, তা মাধবদের জানা নেই।

দশ মিনিটের ওপর জঙ্গল ধরে এগিয়ে গিয়েছিল দলটা। কোথাও কোনো বিপদের গন্ধ পাওয়া যায়নি। গাছের ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে যাচ্ছে বাঁদর। হেঁতালের ঝোপ থেকে উঠে আসছে ছোটো কোনো জন্তুর চলে যাওয়ার সরসর আওয়াজ। ভরদুপুরে বিস্তর মশা। একদম সামনে হাঁটছে বলাইদা। জঙ্গল সে সবচেয়ে ভালো চেনে। তারপরই মাধব, দু-জনের পরে লাল্টু। সবশেষে শিবাই গুনিন। তার চোখ চতুর্দিকে।

হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে হুড়মুড়ে শব্দ, মুহূর্তের মধ্যে মাধব শুনতে পায় লাল্টুর গলা, ‘ও বাবা গো, মা রে…’

মাধব ধরেই নিয়েছিল, যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল, এক আশ্চর্য কান্ড, শিবাই গুনিন লাঠির ঘায়ে বাঘটাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করেছে। বড়ে মিঁঞার নিশানা ছিল লাল্টুর ওপর। মাটিতে পড়ে বাঘটা দাঁত খিঁচিয়ে ফের লাফ দিয়েছিল শিবাইয়ের দিকে, এতক্ষণে যে যার লাঠি বাগিয়ে ধরে তুমুল চিৎকার করতে-করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের ওপর। বেসামাল হয়ে হলুদ ডোরাকাটা বিদ্যুতের মতো জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছিল।

লাল্টু তখন মাটিতে বসে জ্বোরো রুগির মতো কাঁপছে, চোখ বড়ো-বড়ো, মুখে চাপা গোঁ-গোঁ আওয়াজ। হাঁটার শক্তি ছিল না লাল্টুর। পাঁজাকোলা করে তোলা হয়েছিল নৌকোয়। তারপর দলটা নিজেদের গ্রামে ফেরার নদীপথ ধরে। নৌকোয় আসতে আসতে সকলেই প্রায় ঘটনার আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিক হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছিল। একমাত্র লাল্টু ছিল ব্যতিক্রম। চোখ বড়ো-বড়ো করে, গুম মেরে আছে। মাধব ভেবেছিল, প্রথম অভিজ্ঞতা তো, ভয় ভাব থেকে বেরোতে একটু সময় লাগবে। নৌকোয় বসেই সকলে ঠিক করে নিল, আজকের ঘটনার কথা কাউকে জানানো হবে না। গ্রামের কেউ যদি খবরটা পুলিশের কানে তুলে দেয়, শাস্তি অনিবার্য।

সমস্যা হল লাল্টুকে নিয়ে, হতভম্ব ভাবটা কাটছে না। ছেলেকে ওই অবস্থায় বাড়ি নিয়ে ঢুকতেই, ওর মা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে মড়াকান্না জুড়ল, ‘এ তুমি ছেলেকে কী করে নিয়ে এলে! সুস্থ, সবল ছেলের এই হাল কেন হল?’

মাধব বউকে মিথ্যে করে বলল, ‘পারমিট নিয়ে তিন নম্বর ব্লকে মধু ভাঙতে গিয়েছিলাম। ওই দ্বীপে কোনো বিপদ-আপদ নই। ছেলে দিব্যি এদিক-ওদিক ঘুরছিল, হঠাৎ দেখি এরকম হয়ে গিয়েছে।’

বউ ধরে নিল লাল্টুকে ভূত বা অপদেবতায় ধরেছে। ডাকা হল ওঝা, শুরু হল ঝাড়ফুঁক। দলের সাতজন আসল ঘটনা জানে। যার মধ্যে লাল্টুও আছে। ওর মুখে কথা ফিরিয়ে আনাটাই মাধবের প্রধান কাজ। কথা ফুটলেও ঘটনাটা লাল্টু কাউকে বলবে না। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না কথা। নৌকোয় বসে বাবা-কাকাদের আলোচনা থেকে জেনে নিয়েছে, ঘটনাটা চেপে যেতে হবে।

হরিডাক্তারকে ভরসা করে ঘটনাটা বলতে পারেনি মাধব, যদি কোনোভাবে ফাঁস হয়ে যায়, কলকাতার ডাক্তারকেও বলবে না। সে আবার হরিডাক্তারের ভাইপো। কথাটা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছোতে সময় লাগবে না। ডাক্তার যখন নামী, সব কিছু না শুনেও সারিয়ে দিতে পারবেন রোগ।

যাক, এই সুযোগে কলকাতাটা আর-একবার দেখা হয়ে যাবে মাধবের। সেই কোন ছেলেবেলায় গিয়েছিল। লাল্টু তো কলকাতা দেখেইনি। কত দোকানপাট, গাড়িঘোড়া, হইচই!

ছেলেকে নিয়ে ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে মাধব, নিরাপদ এখনও আছে। নৌকোর গলুইয়ে জ্বলছে টেমির আলো।

একসপ্তাহ কেটে গেল। বাদাখালিতে আজ হাটবার। এই দিনটাতেই বাদাখালি একটু মুখর হয়ে ওঠে। অন্য দিনগুলো একেবারে ঠাণ্ডা। মানুষজন কথা বলে আস্তে। বাতাসের শব্দ শোনা যায়। হরিডাক্তার সকালবেলা ঝোলা হাতে হাটে এসেছেন জিনিস কিনতে। এদিক-ওদিক ঘুরতে-ঘুরতে চোখ থামল দু-জনকে দেখে, মাধব বেরা ও তার ছেলে। মাটিতে বসে মাছ বেচছে তারা। ছেলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। রীতিমতো চেঁচিয়ে, হেঁকে খদ্দের ডাকছে। ডাক্তারবাবু ভাবেন, ব্যাপার কী হল! ছেলেটার রোগ নিয়ে তিনি যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। অনেক ভেবেছেন, পড়াশোনা করেছেন। মাধব বেরা রিপোর্ট দিচ্ছে না দেখে নিজেই ফোন করেছিলেন ভাইপোকে। সায়ন কাগজপত্র খুঁজে জানাল, গত তিনদিন আগে মাধব বেরার নাম লেখা আছে লিস্টে। নাম লেখানোর পর পেশেন্ট আর আসেনি।

ব্যাপারটা ভারি আশ্চর্য ঠেকেছিল হরিডাক্তারের কাছে। এখন আরও অবাক লাগছে ছেলেটাকে সুস্থ দেখে। বৃত্তান্তটা কী, জানতে হবে। হরিডাক্তার এগিয়ে যান ওদের দিকে।

হরিডাক্তারকে দেখে গদগদ হয়ে ওঠে মাধবের মুখ। বলে, ‘মাফ করে দিন ডাক্তারবাবু। আজই আপনার কাছে যেতাম। ক-দিন একদম সময় পাইনি।’

ভাইপোর সঙ্গে কথা হওয়াটা চেপে গিয়ে হরিডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘ছেলে তো ভালো হয়ে গিয়েছে, দেখছি। সায়নের ওষুধেই হল?’

মাধব কিন্তু কোনো ছলনার আশ্রয় নিল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কলকাতার ডাক্তারবাবুর কাছে নাম লিখিয়েছিলাম, দেখাতে হয়নি। তার আগেই সেরে গেল ওর অসুখ।’

‘কীভাবে?’ বিস্ময়ের গলায় জানতে চান হরিডাক্তার।

মাধব বলে, ‘আমার নাম লেখা হল আটচল্লিশ নম্বরে। যে দিদিমণি লিখলেন, বললেন, ‘‘ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে আসুন। তার আগে ডাক আসবে না।’’ দিদিমণিকেই জিজ্ঞেস করলুম, ‘‘কোথায় যাওয়া যায় বলুন দিকিনি।’’ উনি বললেন, ‘‘কাছেই চিড়িয়াখানা। চলে যান’’।’

‘বুদ্ধি মন্দ দেননি। কখনো চিড়িয়াখানায় যাইনি আমি। লাল্টুরও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে গেলাম। চিড়িয়াখানায় গিয়েই লাল্টু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেল। তারপর আর ডাক্তারবাবুর কাছে যাইনি।’

হরিডাক্তার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘সে কী কথা! এ আবার হয় না কি?’ একটু থেমে কপাল কুঁচকে বললেন, ‘ব্যাপারটা একটু ভেবে বলো দেখি।’

‘বলার মতো কিছু নয়। দুজনে মিলে ঘুরছি। যেসব পশুপাখি আমরা গ্রামে খোলা জায়গায় দেখি, খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে এরা। লোকে হামলে পড়ে দেখছে। হাসি পাচ্ছিল খুব।’

থামল মাধব। হরিডাক্তার চোখ কুঁচকে রেখেছেন। বললেন, ‘বলে যাও।’

মাধব ফের শুরু করে, ‘ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখে লাল্টু পাশে নেই। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, নতুন জায়গা, হাবা ছেলে, লোকের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি পৌঁছোতে পারবে না। ছুটোছুটি করে খুঁজতে গিয়ে দেখি, লাল্টু বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে খুব হাত-পা নাড়ছে। আমি তো অবাক! ছেলের আমার এ কী বদল! সাত-আট দিন থম মেরেছিল যে ছেলে, এখন একেবারে চনমন করছে। কাছে গিয়ে শুনি, লাল্টু কথাও বলছে। যদিও খুব খারাপ কথা। বাঘটাকে তেড়ে গালিগালাজ করছে, ভেংচি কাটছে, মারবে বলে শাসাচ্ছে। বাঘটা অবশ্য ওকে পাত্তাই দিচ্ছিল না, নিজের মতো পায়চারি করে যাচ্ছিল। লাল্টুকে টেনে নিয়ে এলাম। লাফালাফি বন্ধ হল ওর। তাই নাম লিখিয়েও কলকাতার ডাক্তারবাবুর কাছে গেলাম না। এখন একেবারে সুস্থ আছে ছেলে। ওই দেখুন না।’

হরিডাক্তার লাল্টুর দিকে তাকালেন। সে লজ্জা-পাওয়া হাসি হাসল। চুপ করে একটু ভেবে নিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বুঝেছি।’

ঘুরে গিয়ে হাঁটা দিলেন। মাধবের ছেলে দৌড়ে এসে একটা আড়মাছ ঢুকিয়ে দিল ডাক্তারবাবুর ঝোলায়। বলল, ‘খুব টাটকা, আজ সকালেই ধরেছি। নিয়ে যান।’

হরিডাক্তার দাম দিতে গেলেন। লাল্টু কিছুতেই নিল না। ফিরে গেল নিজের জায়গায়।

হাটের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে নিজের মনে হাসছেন হরিডাক্তার। মাধবের ছেলের রোগটার সমস্ত রহস্য এখন তাঁর কাছে পরিষ্কার। তিনি প্রথমেই ঠিক ধরেছিলেন, ছেলেটা ভয়ংকর কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। সুন্দরবন বলেই বাঘের কথা বলেছিলেন। মাধব তখন স্বীকার করেনি। সম্ভবত নিষিদ্ধ জঙ্গলে গিয়ে বাঘের মুখোমুখি হয়েছিল ছেলেটা। পুলিশের ভয়ে মাধব কথাটা চেপে গিয়েছিল। চিড়িয়াখানায় বাঘকে খাঁচার মধ্যে দেখে সাহস ফিরে পায় ছেলেটা। মনের সুখে মেজাজ দেখায়। চিড়িয়াখানায় বাঘগুলো খাঁচাবন্দি থাকে বলেই কলকাতার লোকদেরও এত হম্বিতম্বি। দু-চারটে বাঘ ছেড়ে দিলে, কলকাতাও এই এলাকার মতো শান্ত, নিরীহ হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *