পুত্র নিষাদ ‘ভয়ংকর’ বলতে পারে না। সে বলে ‘ভয়মকর’। যে বাড়িতে এখন সে বাধ্য হয়ে বাবার সঙ্গে বাস করছে, সেখানে তার কাছে ‘ভয়মকর’ একটি ঘর আছে। ঘরটি বেসমেন্টে, অর্থাৎ মাটির নিচে। সেখানে হিটিং সিস্টেমের যন্ত্রপাতি বসানো। উত্তপ্ত জলীয় বাষ্প যন্ত্রপাতিতে তৈরি করে সারা বাড়িতে ছড়ানো হয়। যন্ত্রপাতি থেকে সারাক্ষণ ভৌতিক শব্দ আসে।
আমেরিকানরা বেসমেন্ট ব্যবহার করে প্রয়োজনীয়(?) আবর্জনা জমা করে রাখার জন্য। আমেরিকান সব ভূতের ছবিতে বেসমেন্টের ভূমিকা থাকবেই।
আমি ঠিক করেছি, অন্তত একটি গল্প এই বেসমেন্টে বসে লিখব। লেখার সময় সম্পূর্ণ একা থাকব। কেউ উঁকি দিতে পারবে না। ভৌতিক গল্পের নাম দিয়েছি ‘আদর’। প্রথম কয়েকটি লাইন: ‘মিস রাকার কুকুরের নাম “আদর”। নামের সঙ্গে কুকুরের ভাবভঙ্গি যায় না। তাকে দেখেই মনে হয় সে মিস রাকার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার মতলব আঁটছে।’
গল্প নিয়ে আমি এগোতে পারছি না। যখনই বসি, তখনই খবর আসে অতিথি এসেছে। অতিথি কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলবেন।
বাংলাদেশি এই সামাজিকতা আমার কাছে (নিষাদের ভাষায়) ‘ভয়মকর’। এই সামাজিকতায় রোগী দেখতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু দেখতে গেলে হবে না, দেখতে যাওয়ার বিষয়টি অন রেকর্ড থাকতে হবে। রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকে জানাতে হবে—অমুক দেখতে এসেছিল। এতক্ষণ ছিল। পথ্য হিসেবে এসব বস্তু এনেছে।
মরণাপন্ন রোগী। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন, দর্শনার্থী তাঁকে ডেকে তুলে বলবেন, ঘুমাচ্ছিলেন? আহা, উঠলেন কেন? আপনার ঘুম দরকার। ডাক্তার কী বলেছেন বলুন তো, শুনি। আপনার নিজের মুখে না শুনলে আমার মন শান্ত হবে না। ভালো কথা ভাই সাহেব, পরে ভুলে যাব। এক হালি কচি ডাব এনেছি। আপনার বেডের নিচে রেখেছি, মনে করে খাবেন। শরীর শুদ্ধির জন্য কচি ডাব অত্যন্ত উপকারী…
আমেরিকা নানান সংস্কৃতির মানুষের জগাখিচুড়ি বলেই আলাদা আমেরিকান কালচার বলে কিছু তৈরি হয়নি। তবে হাসপাতাল এটিকেট মনে হয় তৈরি হয়েছে। চিকিৎসার জন্য অপেক্ষায় থাকা রোগীরা কারও সঙ্গেই কথা বলে না। বেশির ভাগ রোগীকে একা আসতে দেখা যায়। রোগী সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ঘুরবে, এত সময় তাদের কোথায়? এক বৃদ্ধকে দেখলাম নিজের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিজেই টেনে টেনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসছে না।
বাংলাদেশি রোগ-সংস্কৃতি এই দিক দিয়ে ভালো। আমরা কিছু করতে পারি বা না পারি, উদ্বিগ্ন গলায়, অপরিচিত গলায় রোগীর সঙ্গে দুটা কথা বলি।
এই সংস্কৃতি অবশ্যই এশিয়ান। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে দেখেছি, রোগী দেখতে দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন আসছে। রোগীর ঘরে সারাক্ষণ ক্যাওম্যাও শব্দ।
আমেরিকায় আমাকে কঠিন নির্দেশাবলি দিয়ে দিয়েছে, তার মধ্যে আছে—
এক. কারও কাছ থেকে ফুল বা ফুলের তোড়া গ্রহণ করা যাবে না। (কেমো নেওয়ার সময় শরীরের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যায় বলেই এই সতকর্তা।)
দুই. কারোর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না, পাশে বসা যাবে না।
দুই নিষেধাজ্ঞা আমি মেনে চলছি। শুধু একবারই নিষেধ ভেঙেছি। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ফুলের তোড়া নিয়েছি, তাঁর পাশে বসেছি।
কোনো প্রধানমন্ত্রীর এত কাছে বসা এ-ই আমার প্রথম, এ-ই নিশ্চয়ই শেষ।
প্রধানমন্ত্রীর আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা আমার কাছে এতই স্বাভাবিক বলে মনে হলো, আমি বলেই ফেললাম, আপনার কথাবার্তা তো মোটেই প্রধানমন্ত্রীর মতো লাগছে না।
যাঁরা দেশ চালান, তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেন না। সারাক্ষণ তাঁদের ক্যামেরা অনুসরণ করে, সিকিউরিটির লোকজন অনুসরণ করে। তাঁরা জানেন, তাঁদের প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও লক্ষ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক থাকা শুধু মহাপুরুষদের পক্ষেই সম্ভব। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে—মহাপুরুষদের বইপত্রে পাওয়া যায়, বাস্তবে পাওয়া যায় না।
প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের মানুষদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করেন তাঁর অতি কাছের লোকজন। এঁরা এমন এক মানববন্ধন তৈরি করেন যে, বন্ধন ভেদ করে কারও পক্ষেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই মানববর্মের প্রধান (এবং হয়তো বা একমাত্র) কাজ হলো নিজের অবস্থান ঠিক রাখা, প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষ হয়ে থাকা। এ কাজটি করার জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করবেন, এমন কথাগুলোই শুধু তাঁকে শোনান। এমন একটি বাক্যও বলেন না, যা শুনে প্রধানমন্ত্রীর ভালো লাগবে না, অথচ তাঁর শোনা উচিত।
কী সর্বনাশ! আমি দেখি রাজনীতির কচকচানি শুরু করেছি। এও বাঙালি কালচার, সুযোগ পেয়ে কোনো বাঙালি রাজনীতির কপচাবে না, তা হবে না। আমি আমার প্রগলভতার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী অনেক ব্যস্ততার ভেতর বাংলাদেশের একজন লেখকের জন্য আলাদা সময় বের করেছেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার। তাঁর নিজের আসার দরকার ছিল না। একজন কাউকে দিয়ে আমার খোঁজ নেওয়ালেই আমি আনন্দিত হতাম। তাঁর কাছ থেকে ১০ হাজার ডলারের চেকটি নিতে আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমি এখনো নিজের খরচ নিজে চালাতে পারছি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অর্থ যারা অর্থকষ্টে আছে তাদের জন্য থাকাই বাঞ্ছনীয়।
আমার অস্বস্তি দেখে শাওন বলল, তুমি চেকটা হাতে নাও। এখানে আছে তোমার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের মানুষের দোয়া। আমি সঙ্গে সঙ্গে অতি বিনয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে চেক গ্রহণ করলাম।
পাদটীকা:
প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। আমার পুত্র নিষাদ বলল, আমি উনার উপর ‘লাগ’ করেছি। (সে ‘র’ বলতে পারে না, লাগ করেছি অর্থ হলো রাগ করেছি)
আমি বললাম, কার ওপর রাগ করেছ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর?
হুঁ।
কেন, বলো তো?
উনি আমার জন্য কোনো খেলনা আনে নাই।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক যন্ত্রণা। সবাইকেই তুষ্ট রাখতে হয়। সেই সবার মধ্যে পাগল এবং শিশুরাও আছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০১১