তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ – দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ – দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

২০০৩ সাল থেকে ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক গানের শিল্পী মান্না দে’র জন্য আমার গান লেখার শুরু৷ অন্যভাবে বলা যায়, আমার স্বপ্নকেই ছুঁয়ে ফেলা সেদিন থেকে৷ সমস্ত পৃথিবীকে নিজের চোখে দেখার আনন্দ, আমার চেনা সব মানুষের সুখে থাকা, আমার না-পাওয়ার তালিকায় কিছু না-থাকা— যদি এই সব প্রাপ্তিগুলোকে একসঙ্গে করা যায়, তারও বেশি আমার পাওয়া— সঙ্গীতের দেবতা মান্না দে’র জন্য গান লেখার সুযোগ৷ আমি ভাগ্যবান, মান্নাবাবুর নিজের রেকর্ড করা ৩৪টি গান লেখার সুযোগ হল— অসামান্য সুরকার মান্না দে সুর করলেন ২৩টি গান— ১২টি গান নিজে গাইলেন— ১১টি গান গাইলেন অন্য শিল্পীরা৷ এই ৪৫টি গান এবং স্ত্রী-র স্মরণে সম্পূর্ণ না-হওয়া আরও চারটি গান— এই সুবাদে দীর্ঘসময় সান্নিধ্য পাওয়া এমন একজনের— শিল্পী হিসেবে যিনি তো শ্রেষ্ঠই, মানুষ হিসেবেও তাঁর কোনও তুলনা নেই৷ তিনি আমার পিতৃতুল্য৷ কাজ করতে করতে কত যে অভিজ্ঞতা হল, ভাবতে গেলে অবাক লাগে৷ ২০১০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত কলকাতায় আসতেন— অনুষ্ঠান এবং রেকর্ডিংয়ের কাজে৷ অত্যন্ত ব্যস্ত রুটিন৷ তবু তার ফাঁকে ডেকে নিতেন৷ গানের sitting থাকলে, অন্য কাউকে allow করতেন না৷ শুধুমাত্র যাদের সঙ্গে কাজ, তাদের নিয়েই বসতেন৷ আবার কাজ ছাড়াও কখনও কখনও চলত তাঁর সঙ্গে অসাধারণ আড্ডা৷ আমার পরম সৌভাগ্য, দু’জায়গাতেই সুযোগ পেয়েছি আমি৷

সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই মান্নাবাবুর কাছে প্রথম যাওয়া৷ ২০০৩, ‘আমার প্রিয় মনীষী’ অ্যালবামের কাজ চলছে৷ বিভিন্ন মনীষীদের নিয়ে ১২টি গান লিখেছি৷ বললেন, ‘ক্যাসেটে ১২টা গান একটু বেশি হয়ে যাবে না? ১০টা হলেই ভাল হয়৷’ আমরা বললাম— ‘তা হলে কোন দুজন বাদ যাবেন?’ মান্নাবাবু আমাকে বললেন— ‘একটা কাজ করুন৷ বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করুন, কোন দুজনের নাম তাঁরা কম শুনেছেন, সেই দুজনকেই আমরা বাদ দেব৷’ তারপরে মান্নাবাবুর হাসি দেখে বুঝলাম মজা করেই এ কথা বলেছেন৷ ১২টি গানই রইল৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম— এমন একজন প্রবাদপ্রতিম মানুষ প্রথম আলাপেই আমার মতো অতি সাধারণ একজনকে কীভাবে, কত সহজে আপন করে নিলেন প্রথম দিনেই৷

তখন মান্নাবাবুর বয়স ৮৪ বছর৷ কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি যে কতটা তরুণ, কতদূর আধুনিক, তার প্রমাণ পেলাম পরে৷ একদিন সকাল থেকেই তাঁর সেই বিখ্যাত ঘরে গানের Sitting চলছে৷ সকাল গড়িয়ে দুপুর৷ এখানে একটা কথা বলি, যখন সকালের দিকে meeting থাকত, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আপনার office-এ কোনও অসুবিধা হবে না তো?’ যাই হোক, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া তো হল৷ মান্নাবাবু বললেন— ‘এবারে আর বসার সময় হবে না৷ আজ যতদূর হয়, আমরা গানগুলো এগিয়ে রাখি৷ একদম সময় নষ্ট করা যাবে না৷ আপনারা খাওয়া-দাওয়ার পরে কী যেন ফোঁকা-ফুঁকি করেন৷ নিন দেবপ্রসাদবাবু, ওগুলো খেয়ে-টেয়ে নিন৷ আমি জানি, সময় মতো ও-সব না টানলে মুড আসে না৷’ আমার তো গা-হাত-পা কাঁপতে শুরু করল, ঘেমে-ঘুমে একাকার৷ তোতলাতে আরম্ভ করলে, বললেন— ‘আপনাদের এই ন্যাকামি আমার একদম ভাল লাগে না৷ কাকা কী বলতেন, জানেন? খেতে হয় সামনে বসে খাও৷ কাজের সময় বারবার বাইরে গেলে কাজের অসুবিধা হয়৷ হ্যাঁ, খেলে ভাল ব্র্যান্ডের জিনিসই খাবে৷’ আমি তখন বাঁচার জন্য অসহায়ের মতো বললাম— ‘দাদা, আমি তো খাই না’ (ঈশ্বর, ক্ষমা করুন, সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম তাঁর কাছে)৷ তখন মান্নাবাবু বললেন, ‘then it’s alright’৷ ধরলেন মৃণালদাকে— ‘আপনি খান আমি জানি, ধরান মশায় ধরান৷’ উপায় নেই৷ মৃণালদার হাত এত কাঁপতে থাকল যে সিগারেটটা ঠিকমতো ধরাতেই পারলেন না৷

রেকর্ডিং হয়ে গেল৷ মান্নাবাবু ফিরে গেছেন ব্যাঙ্গালোরে৷ দু’একদিন বাদে ফোন৷ এ-কথা, সে-কথার পরে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘আপনার remuneration ঠিকমতো পেয়েছেন তো?’ আমি বললাম— ‘দাদা, আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলাম, এটাই তো সব থেকে বড় পারিশ্রমিক৷’ আমার এ-কথা শুনে একদম খুশি হলেন না৷ বললেন— ‘Come to the point I asked. Please be Professional in all respect.’

আজীবন কাজ করেছেন ভারতবর্ষের সব কিংবদন্তি musician-দের সঙ্গে৷ বর্তমান সময়ের musician-দের মানিয়ে নিতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি৷ কোনও ইগোতে ভুগতেন না৷ বরঞ্চ অনেক musician-দের খুবই সম্মান করতেন৷ রেকর্ডিংয়ের আগে রিহার্সাল চলছে৷ হঠাৎ মিউজিক অ্যারেঞ্জার শান্তনু বসুকে বললেন— ‘গিটারের Sound পাচ্ছি৷ কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না তো৷’ আসলে একটি নতুন ছেলে বাজাচ্ছিল৷ ভয় পেয়ে থামের আড়ালে বসে বাজাচ্ছিল সে৷ মান্নাবাবুর মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিল৷ মান্নাবাবু শুনে বললেন— ‘সেকি কাণ্ড, আরে, ও তো খুব ভাল বাজাচ্ছে৷ ওকে সামনে এসে বাজাতে বলো৷’

লাইফ রেকর্ডিং৷ একবার গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গেলেন৷ সবাই তটস্থ৷ কোনও ভুল হয়নি তো কারও৷ বললেন— ‘রাহুল সেতারটা এত ভাল বাজাচ্ছে, গাওয়া যায় নাকি এর সঙ্গে৷’

২০১০৷ লেকটাউনের studio world-এ রেকর্ডিং চলছে৷ আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য নতুন একটি অ্যালবামের গান গাইছেন৷ মান্নাবাবুর স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ৷ কলকাতায় হাসপাতালে ভর্তি৷ কিন্তু কমিটমেন্ট৷ সবাই বারণ করা সত্ত্বেও এসেছেন কাজটা করে দিতে৷ Recordist রুদ্রাশীষ, কোনও technical problem হওয়াতে একই জায়গা মান্নাবাবুকে আর একবার গাইতে বলল— বোঝানোর জন্য লাইনটা একটু গেয়ে শোনাল রুদ্র৷ Lunch break-এ মান্নাবাবু বললেন— ‘বাঃ রেকর্ডিস্ট ছেলেটি তো দারুণ সুন্দর গায়৷’ কাজ শেষে রুদ্র যখন কিছু লিখে দিতে বলল, মান্নাবাবু দরাজ হাতে লিখে দিলেন রুদ্রকে— দু’পাতা জুড়ে৷ ঘটনাচক্রে সেটিই তাঁর শেষ রেকর্ডিং৷

মনে পড়ছে গৌতম বসুর কথা৷ মান্নাবাবুর খুব পছন্দের recordist৷ তখন ‘ভারততীর্থ’-র recording চলছে৷ গৌতম মুখ ফসকে অভ্যাসবশত বলে ফেলল— ‘দাদা, এ-জায়গাটা আর না-গাইলেও চলবে৷ আমি ‘কেটে’ নিয়ে ‘জুড়ে’ দেব৷’ মান্নাবাবু বললেন— ‘সেকি গৌতম, তুমি কাকে আবার কাটবে?’ গৌতম যখন বর্তমান রেকর্ডিং প্রযুক্তি-র কথা বুঝিয়ে বলল, মান্নাবাবু তো অবাক৷ বললেন— ‘না, না, বাবা, আমাকে কেটে জুড়ো না৷ আমি বরং আর একবার গেয়ে দি৷’

বর্তমান শিল্পীদের কে কেমন গাইছেন সে-খবরও রাখতেন৷ Science city-তে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহুদিন পরে একসঙ্গে অনুষ্ঠান৷ গ্রিনরুমে শুভমিতা এলেন প্রণাম করতে৷ শুভমিতা নিজের নাম বলতে, মান্নাবাবু বললেন— ‘আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি তো খুব ভাল গান করেন৷’ পয়লা মে, ‘মান্না দে সঙ্গীত আকাদেমি’ প্রতিবছর অনুষ্ঠান করে৷ ২০১০ সাল পর্যন্ত, যতদিন কলকাতায় এসেছেন, মান্নাবাবু নিজে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন৷ আমরা একবার ফোনে জানালাম, অনুষ্ঠানে কোন কোন শিল্পী থাকবেন, সব শুনে মান্নাবাবু বললেন— সঙ্গে আপনারা শম্পা কুণ্ডুকেও রাখুন৷ ও বেশ ভাল গাইছে৷ পরে এই ঘটনাটি শুনে শম্পা নিজেও অবাক৷

তখন ‘চাঁদের বাড়ী’ ছবির কাজ চলছে৷ পরিচালক তরুণ মজুমদার৷ সুরকার অরুন্ধতী-শিবাজী৷ আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তরুণবাবুর নতুন ছবিতে কী ধরনের গান লিখলেন৷’ এ-খবরটিও মান্নাবাবু জানেন!

একদিন মান্নাবাবুর Music room-এ অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলি এলেন৷ সামনে একটি অনুষ্ঠানের জন্য৷ বেবিদা (প্রতাপ রায়) বললেন— ‘মান্নাদা, রূপা ভাল গানও করে৷’ রূপা গাইতে শুরু করলেন— ‘শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু’৷ তাকিয়ে দেখি গান শুনতে শুনতে মান্নাবাবুর দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে৷ তাঁর মধ্যে শিল্পী সম্পর্কে কোনও ছুঁৎমার্গ ছিল না৷ আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল৷ প্রায়ই গর্ব করে বলতেন— ‘আমি ধন্য, রবীন্দ্রনাথের দেশে আমি জন্মেছি৷’ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল সুরঞ্জনা-র কথা৷ সুরঞ্জনা রবীন্দ্রভারতীর P.R.O৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় মান্না দে-কে D.Lit উপাধি দিতে চায়৷ সুরঞ্জনা এসেছে V.C.-র প্রতিনিধি হয়ে৷ মান্নাবাবু বিব্রত৷ বারবার বলছেন, আমি সামান্য গান করি৷ আমাকে এ-সব কেন? দু-এক কথার পরে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ উঠল৷ রবীন্দ্রনাথের সব আলোচনাতেই সুরঞ্জনা যথাযথ বলছে, মান্নাবাবু একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন৷ সুরঞ্জনা কোনও এক অবকাশে তখন বলল, ‘Vice-chancellor Dr. করুণাসিন্ধু দাস আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছিলেন, ফোন করব?’ মান্নাবাবু বললেন— ‘অবশ্যই৷’

সেদিন সরস্বতী পুজো৷ মান্নাবাবু কলকাতায়৷ সকালে ফোন পেলাম— ‘বিকালে ফাঁকা থাকলে চলে আসুন, একটু আড্ডা দেওয়া যাবে৷’ সেই বিকেলটা ছিল বিশেষভাবে ব্যতিক্রম৷ অন্য কেউ নেই৷ এমন তো হয় না৷ বুঝলাম হঠাৎ করে কোনও প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয়েছে৷ মান্নাবাবুর কলকাতার বাড়িতে দুটি বিশেষ ঘর আছে৷ একটি তাঁর বাড়ির নিচের তলায় গানের ঘর৷ যেখানে সঙ্গীত সাধনা করতেন স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দে৷ পরবর্তীকালে মান্না দে৷ সেখানে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল না৷ অন্য ঘরটি এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির নিচের তলার একটি ছোট ঘর৷ সেটি ছিল অফিস ঘর এবং প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডার জায়গা৷ সেখানেই আড্ডা চলছে৷ হঠাৎ বললেন— ‘গৌরীবাবু এবং পুলকবাবুর লেখার identification সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়৷’ আমি বললাম— ‘Content-এর ব্যাপারে দুজনেই খুব rich৷ মিলের বিষয়ে গৌরীবাবু বেশি accuracy চাইতেন, রবীন্দ্রনাথের মতো৷ আর ভাষা, অলঙ্কার দিয়ে লিরিকগুলোকে সাজিয়ে তুলতেন৷ আর পুলকবাবুর style-টা একটু অন্যরকম৷ একদম মুখের কথাটাই গানের লাইন হিসেবে তুলে আনতেন অনেক সময়৷ বিশেষ করে আপনার জন্য যখন গান লিখতেন একটা অন্য ঘরানা তৈরি হয়ে যেত৷ বিষয়ে এবং শব্দে৷ বাংলা কাওয়ালি, বাংলা গজল, কাহিনীমূলক গান, সম্পর্কের, জীবনের, প্রকৃতির গান— গানে অপ্রচলিত কথা— যেমন ‘যোগ্য’, ‘প্রতিবাদ’, ‘অরণ্যে’, ‘আবর্জনা’ কি সাবলীলভাবে আপনার গানে প্রয়োগ করেছেন৷ বিশেষত আপনার গানের মুখড়াতে অসাধারণভাবে মাঝে মাঝে independent লাইন লিখেছেন— যেমন ‘আমি তো মানুষ’, ‘আমি তোমারই দিকটা নিলাম’৷ বললেন, ‘আপনি তো বেশ ভাল study করেছেন৷’ বিস্ময়ের ব্যাপার ঘটল চলে আসার সময়৷ বিদেশের একটি Project-এ আমাকে দিয়ে কিছু গান লিখিয়েছিলেন৷ কাজটা তখনও সম্পূর্ণ হয়নি৷ আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন— ‘এটি রাখুন৷’ খামে করে গান তো আমিই ওনাকে দিই, ভাবছি আমাকে কী দিলেন৷ মান্নাবাবু বললেন— ‘ওই Project-টায় আপনার গানের remuneration৷ আমি ওদের বলেছি, আরও কিছু দিতে৷ এটা advance হিসেবেই মনে করুন৷’ আমি বললাম— ‘দাদা, আপনি কেন দিলেন? ওরা যখন আসবে, তখন না হয় দিতেন৷’ উনি বললেন— ‘তা হয় না৷ আপনার কাজ তো আপনি করে দিয়েছেন৷ you must get it now৷’ বাইরে বেরিয়ে গলির মুখে এসে কৌতূহলবশত খামটা খুললাম৷ অ্যাডভান্স হিসেবে যে টাকাটা মান্নাবাবু আমাকে দিয়েছিলেন, কোনওমতেই আমি তার যোগ্য নই৷ আসলে তিনি অসাধারণ বলেই তো কাউকে তেমন সাধারণ ভাবতে পারতেন না৷

একদিন বললাম— ‘দাদা, বারাসতের দিকে এর মধ্যে Programme আছে?’ বললেন— ‘না তো৷’ তখন আবার বললাম— ‘মধ্যমগ্রাম বা কাছাকাছি কোথাও৷’ এবারে বললেন— ‘কী ব্যাপার বলুন তো? হঠাৎ আমার function নিয়ে আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?’ আমি তখন আমতা আমতা করে বললাম— ‘মানে, ওইদিকে গেলে আপনাকে আমাদের বাড়িতে একটু নিয়ে যেতাম৷’ শুনে মান্নাবাবু আকাশ থেকে পড়লেন— ‘একি কথা দেবপ্রসাদবাবু, আপনার বাড়ি যাব, তার জন্য function-এর কি প্রয়োজন৷ এমনিই একদিন যাওয়া যাবেখন৷’ তারপরে একটু হিসেব করে বললেন— ‘এবারে তো tight schedule৷ পরেরবার একটা plan করা যাবে৷’ সেই সুযোগ আর হল না৷ ২০১০ সাল থেকে ম্যাডাম এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে তাঁকে রেখে মান্নাবাবু ব্যাঙ্গালোর থেকে আর কোথাও যেতেই পারেননি৷ এই আপশোস আমার আজও যায়নি৷ কেন যে আগে বলিনি৷ আসলে তিনি ছিলেন আমাদের ধারণার বাইরে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব৷ মহান মানুষ৷

আমার দাদা তখন কলকাতায় এসেছেন৷ ক্যালিফোর্নিয়ায় settled৷ বিখ্যাত বিজ্ঞানী৷ ৫৫ বছর বয়সে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছেন৷ মান্না দে-র অন্ধ ভক্ত৷ খুব ইচ্ছা মান্না দে-র সঙ্গে কথা বলার৷ অন্তত ফোনে৷ মান্নাবাবুকে সে-কথা বললাম৷ বিশেষ করে দাদার sports-এর অ্যাচিভমেন্টগুলো শুনে খুব খুশি হলেন৷ দাদা এবং রমাদি (মান্নাবাবুর বড় মেয়ে) আমেরিকায় প্রায় কাছাকাছি থাকে শুনে আমাকে বললেন— ‘আপনি মশায় লোকটা তো খুব খারাপ৷ এতদিন কেন আলাপ করাননি?’ ফোনে আলাপ হল৷ হঠাৎ ফোনটা কেটে গেল৷ মান্নাবাবু নিজেই ফোন করলেন৷ দাদা তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না৷ মান্নাবাবু বললেন— ‘রমার সঙ্গে অবশ্যই আলাপ করে নেবেন৷ আমি নাম্বার দিয়ে দেব৷’ দাদা একটু ইতস্তত করে বলল— ‘মানে, আমার কি পরিচয় দেব?’ মান্নাবাবু বললেন— ‘কেন? বলবেন, আমি দেবপ্রসাদবাবুর দাদা৷’ রমাদির সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না৷ কিন্তু মান্নাবাবু এত জোর দিয়ে বললেন, আসলে বোঝাতে চাইলেন— ড্যাডির গানের গীতিকারকে তাঁর কন্যা অবশ্যই জানেন৷

এমন অভিজ্ঞতা আমার ম্যাডামের সঙ্গেও হয়েছিল৷ তখন ‘আমার প্রিয় মনীষী’-র কাজ হয়ে গেছে৷ ব্যাঙ্গালোরে ফোন করেছি৷ ম্যাডাম (মান্নাবাবুর স্ত্রী) ফোন ধরলেন৷ মান্নাবাবু তখন ছিলেন না৷ বললাম— ‘বউদি আপনি আমাকে চিনবেন না৷ দাদা এলে দয়া করে একটু বলবেন, কলকাতা থেকে দেবপ্রসাদ ফোন করেছিল৷’ ম্যাডাম বললেন— ‘Yes দেবপ্রসাদবাবু আপনাকে আমি অবশ্যই চিনি৷ মনীষীদের গান খুব ভাল লিখেছেন৷’ আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ পরবর্তীকালে তো জেনেছি এবং বুঝেছি মান্নাবাবুর জীবনে এবং গানে নিঃশ্বাসে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে কেমনভাবে জড়িয়ে ছিলেন ম্যাডাম৷ আর মান্নাবাবু? বউদি ছিলেন তাঁর প্রাণ, তাঁর হৃদয়৷ একদিন ফোনে কথা হচ্ছে৷ মান্নাবাবুর বেশ কাছের একজন সম্পর্কে হঠাৎ বললেন— ‘আগে বুঝতে পারিনি, ও একদম ভাল লোক নয়৷’ আমি বললাম— ‘কেন দাদা? কী করেছে?’ — ‘আরে শুনুন, শুনুন, ‘ও’ ফোন করেছিল৷ সুলু ফোন ধরেছিল৷ সুলুকে একবার wish করল না?’

সবাই জানেন রমাদি দুরারোগ্য অসুখে ভুগছেন৷ মাঝে মাঝেই খবর আসত অবস্থা ভাল নয়৷ এমন পজেটিভ মানুষ, ভীষণভাবে ভেঙে পড়তেন৷ বলতেন— ‘কেন যে রমার এমন হল? অথচ সুলু ওদের কত যত্ন করে মানুষ করেছে৷ ঠিক ঠিক খাবার ঠিক সময়ে দিত৷ অথচ কি যে হয়ে গেল৷’ বুকের ভিতরে আমারও অশ্রুপাত শুরু হয়ে যেত৷ হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলতেন— ‘শুনুন, দেবপ্রসাদবাবু, এই যে সঞ্চারীটা লিখেছেন, একটু অন্যভাবে ভাবা যায় কি?’

আমার spine fructure হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলাম৷ ফোনে ফোনে নিয়মিত গান তৈরির কাজ চলত৷ প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন— ‘কেমন আছেন?’ একদিন বললেন— ‘চায়ে দুধ না খাওয়াই ভাল, দেখবেন ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে৷ মাছ, ডিম, দুধ নিয়মিত খাবেন৷’ আমার মতো একজন সামান্য গীতিকারকে নিয়েও উনি এমন উদ্বিগ্ন? আমি কেমন বিহ্বল হয়ে যেতাম৷ মা-বাবা ছাড়া এমন কথা আর কে বলে৷ অথচ তিনি মান্না দে৷ যাঁর কণ্ঠে স্থান পেয়ে সঙ্গীত ধন্য হয়েছে৷

অনেক ব্যাপারেই ব্যতিক্রমী ছিলেন মান্নাবাবু৷ অনেক নতুন গীতিকার-সুরকারকে সুযোগ দিয়েছেন৷ একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করে৷ অনেক গীতিকার-সুরকার বহু নামী-দামি শিল্পীদের জন্য গান তৈরি করেছেন, কিন্তু একমাত্র মান্না দে’র গানই তাঁদের পরিচিতি দিয়েছে৷ কিছু গানের উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়— ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’ (কথা: জহর মজুমদার), ‘খুব জনতে ইচ্ছে করে’ (কথা: মুক্তি রায়চৌধুরি), ‘এই কুলে আমি আর ওই কুলে তুমি’ (কথা: বঙ্কিম ঘোষ), ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘দশবছরের বংশী’, ‘খেলা ফুটবল খেলা’, ‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়’ (সুর: সুপর্ণকান্তি ঘোষ)৷ কথা এবং সুরকে মান্না দে যেখানে পৌঁছে দেন, গানকে তা অমরত্ব দেয়৷

আবার এর উল্টো ঘটনাও আছে৷ বহুদিন বাদে মান্না দে নতুন আধুনিক গানের অ্যালবাম করবেন৷ ২০০৫ সাল৷ HMV-র ইচ্ছা মান্নাবাবু তাঁর বহু অমর গানের গীতিকারের কথায় নিজের সুরে গানগুলো করুক৷ প্রয়াত সেই গীতিকারের অপ্রকাশিত গান নিয়ে বসলেন৷ কিন্তু কোনও লেখাই পছন্দ করতে পারলেন না৷ বললেন— ‘এভাবে হয় না৷ এই গানগুলো তো উনি আমার কথা ভেবে লেখেননি৷ কত আলোচনা করে আমাদের গান তৈরি হত৷ এখন আর সে-সুযোগ কই৷ উনি তো আমাকে অসহায় করে দিয়ে চলে গেছেন৷ ওর মতো গীতিকার আর হবে না৷’ তাই বলে কি প্রাোজেক্ট cancel হল? মোটেও না৷ সব যুগের সমসাময়িক সহকর্মীদের সঙ্গে adjustment করার ক্ষমতা এবং গান গাইবার প্রবল ইচ্ছার জন্য ২০১০ পর্যন্ত সঙ্গীত চর্চায় মগ্ন থেকেছেন— সারা পৃথিবী জুড়ে অনুষ্ঠান, নতুন গানের সুর, রেকর্ডিং— সঙ্গীতের ইতিহাসে মান্না দে এক এবং অনন্য৷ তাঁর তুলনা তিনি নিজে৷ এজন্যই তৈরি হল আধুনিক গানের সেই অ্যালবাম— ‘ঠিক ছবির মতো’— সুর: মান্না দে, কথা লেখার সুযোগ পেলাম আমি৷

কেমন লেখা পছন্দ করতেন মান্না দে? এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ বারবার দিতেন৷ স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতেন৷ কী অসাধারণ তাঁর সেই পাঠ৷ বলতেন— ‘দেখেছেন, সুর ছাড়াই রবীন্দ্রনাথের গান পড়তে কী চমৎকার ভাল লাগে৷ যেমন ছন্দ, যেমন ভাষা, তেমন সুর এবং তাল নিয়ে কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷ কত সহজভাবে কাজগুলো করতেন৷ আর প্রতিটি লেখার মধ্যে দারুণ Song value৷’ তবে গানের গীতিকারেরা একটু বেশি সচেতন হয়েই মান্নাবাবুর জন্য গান লিখতেন৷ আমি একদিন একটু দুঃসাহসী হয়ে বলেছিলাম— ‘দাদা, আপনার অধিকাংশ গানই recite করা যায়৷ এমন সুন্দর বিষয় এবং উপস্থাপনা৷’ উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন— ‘Yes, song value না থাকলে আমি গাইবই না৷’ অনেক সময় এমন হয়েছে কোনও লেখার বিশেষ কোনও জায়গা আমাকে বুঝিয়ে বলতে বললেন৷ আমি সাধ্যমতো বললাম৷ এবারে মান্নাবাবু বলতেন— ‘গানটি যখন শ্রোতারা শুনবেন, আপনি তো সবাইকে গিয়ে বুঝিয়ে বলার সুযোগ পাবেন না৷’ এভাবেই প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর কাছে শিক্ষা পেয়েছি৷ বারবার ইংরেজি গান শুনতে বলতেন— ‘গানগুলো ভাল করে শুনবেন৷ দেখবেন, ভালবাসার কথা ওরা কেমন সুন্দরভাবে বলে৷ হিন্দি-উর্দুটাও খানিকটা জানা দরকার৷ পুলকবাবু আমাকে খুঁচিয়ে অনেক শায়েরীর মানে বুঝে নিত৷ সেই ভাব নিয়ে কত অসাধারণ মৌলিক গান লিখেছে— ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’ গানটা তো সেই ভাবেই তৈরি৷’

তিনি লঘুসঙ্গীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক৷ সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ৷ আবার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিক৷ ‘মান্না দে সঙ্গীত আকাদেমি’-র আয়োজনে মহাজাতি সদনে মান্না দে’র জন্মদিন পালিত হচ্ছে৷ মধ্যমণি স্বয়ং মান্না দে৷ ভীষণভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন৷ দর্শকাসনে বসেছিলেন সুলোচনা দেবী৷ সেদিকে তাকিয়ে বললেন— ‘I am an one-woman man’৷ স্ত্রী-র প্রতি এমন ভালবাসা দৃষ্টান্তস্বরূপ৷ ২০১০ সালে বৌদি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, মান্নাবাবু তখন কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ৷ দেশ-বিদেশ থেকে ডাক আসছে নানা অনুষ্ঠানের জন্য৷ গানই তাঁর জীবন৷ সবসময় বলতেন— ‘আমি যেন গান গাইতে গাইতে চলে যাই৷ সুলোচনার আগে যেতে চাই৷’ কিন্তু ম্যাডামকে ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরের বাইরে আর কোথাও যাননি৷ শুধুমাত্র তাঁর জন্যই গান গাইবার প্রবল তৃষ্ণা সংবরণ করেছেন৷

বড় সাধ ছিল স্ত্রী-র স্মরণে শেষ অ্যালবামটি করে যাওয়ার৷ শেষ কয়েক মাস শুধু সেই প্রসঙ্গেই কথা হত৷ বলতেন— ‘দেবপ্রসাদবাবু, আমার যন্ত্রণাগুলো আপনি ঠিক ধরতে পেরেছেন৷’ স্মৃতি থেকেই ওই অবস্থাতেও গানগুলো গেয়ে শোনাতেন৷ হাসপাতালে যখন খানিকটা সুস্থ হয়েছেন— ডাক্তারদের বলতেন— ‘আমাকে আর আটকে রাখবেন না৷ একটা জরুরি রেকর্ডিং আছে সামনে— আমার স্ত্রীকে স্মরণ করে৷ আমি confirm করলেই কলকাতা থেকে সবাই আসবে কাজটা করাতে৷’

কেউ কথা রাখেনি৷ স্বয়ং ঈশ্বরও নয়৷ শেষ জীবনে শারীরিক ভাবে এত যন্ত্রণা পেলেন৷ ম্যাডামকে হারিয়ে অসীম শূন্যতার সমুদ্রে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করেছেন৷ সেই বেদনা নিয়ে চলে গেলেন একাকী৷ পড়ে রইল হাজার, হাজার গান৷ আমাদের প্রত্যেকটি অনুভূতির সঙ্গী হয়ে৷ এমন বন্ধু আর কে আছে! প্রতিদিনই ঋণ বাড়ে তাঁর কাছে৷ মনে মনে শুধু বলি মান্নাবাবুর সুর করা সেই গানের বাণী— ‘তোমার কথা লিখতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে৷ যদি, অন্তবিহীন আকাশ হত আমার লেখার খাতা/তোমার কথা লিখে যেতাম/কয়েকটা যুগ ধরে৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *