তিনটি ছবির রহস্য

তিনটি ছবির রহস্য

মধুপুরে আমার মামাবাড়ির পাশেই ছিল একটা শুকনো নদী৷ আমি কোনোদিন সে নদীতে এক ফোঁটাও জল দেখিনি৷ কিন্তু একসময় নাকি সে নদীতে সারা বছরই জল থাকত, কুলুকুলু করে স্রোতের শব্দও হত৷

এখন নদীটা একেবারে মজে গেছে৷

শুধু দু’দিকের উঁচু পাড়ের মাঝখানে খাতটা বোঝা যায়৷

যখন এ নদী জ্যান্ত ছিল, তখন এর নাম ছিল মধুবংশী৷ নামটা শুনতে সুন্দর, কিন্তু কেন এরকম নাম তা এখন আর কেউ জানে না৷

ছোটবেলায় আমরা ওই শুকনো নদীর খাতে নেমে লুকোচুরি খেলতাম৷ একটু বড় হবার পর আমি ওখানে একটা শিমুল গাছের তলায় বসে ছবি আঁকতাম রোজ৷

আর্ট কলেজে ভর্তি হবার পর আমাদের মাস্টারমশাই অশোকদা বলে দিয়েছিলেন, যখনই সময় পাবে একটা বড় খাতায় স্কেচ করবে৷ চোখের সামনে যা দেখবে, তাই-ই এঁকে ফেলবে৷ যা চোখের সামনে নেই, এমন কিছুও মন থেকে আঁকতে পারো৷ ভালো হোক, খারাপ হোক, এঁকে যাবে৷ ভালো আঁকা শেখার এই একমাত্র উপায়৷

অশোকদার সেই কথা শুনে আমার নেশা ধরে গিয়েছিল৷ বড় খাতাটা নিয়ে ঘুরতাম সবসময়, যেখানে-সেখানে বসে শুরু করতাম আঁকা৷ হাওড়া স্টেশনে এসে একদিন জানা গেল, ট্রেন দু’ঘণ্টা লেট, অপেক্ষা করতে হবে৷ অমনি আমি প্ল্যাটফর্মে বসে পড়ে স্কেচবুকটা খুলে শুরু করে দিয়েছি আঁকতে৷

বছরে দু’বার আমরা যেতাম মধুপুর৷ গরমের ছুটিতে, আর পুজোর সময়৷

আমার দাদু খুব শখ করে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন৷ বাড়িটা তেমন বড় নয়, কিন্তু অনেকখানি বাগান৷ আর একপাশে তো একটা নদী ছিলই৷

এখন দুই মামাই থাকেন বিদেশে৷ একমাত্র বড়মামা যান মধুপুরে৷ কিন্তু তাঁর শরীর ভালো নয়, তিনি ভাবছেন বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন৷ সেটা শুনলে আমাদের খারাপ লাগে, কিন্তু কী আর করা যাবে৷ বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাবার আগে আমার বারবার যেতে ইচ্ছে হয়৷ কলকাতা থেকে আর কেউ না গেলে আমি একাই চলে যাই৷

সে বাড়িটা পাহারা দেয় মঙ্গল সিং, বাগানের একধারে তার কোয়ার্টার৷ তার বউ, দুই ছেলে, এক ছেলের বউও থাকে সেখানে৷ বড়মামা অবশ্য বলে রেখেছেন, বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলেও তিনি মঙ্গল সিংকে বাগানের খানিকটা অংশের জমি লিখে দেবেন৷

আমি একা মধুপুরে হাজির হলে মঙ্গল সিং-এর বাড়ি থেকেই আমার জন্য খাবার-টাবার আসে৷ ওরাই আমার দেখাশুনো করে৷

শিমুল গাছতলায় ওরা আমার জন্য চেয়ার-টেবিল পেতে দেয়৷ আমি বসে বসে ছবি আঁকি সারাদিন৷

আগে মামাতো ভাই-বোনেরা অনেকে আসত, সবসময় হাসি, মজা, গল্পে সরগরম থাকত জায়গাটা৷ এখন প্রায় নিঝুম৷ কাছাকাছি আর বাড়ি নেই৷ অন্য লোকজনও এদিকে বিশেষ আসে না৷

আমার খাতাখানা ছবিতে প্রায় ভরে গেছে৷ অবশ্য আরও একটা খাতাও আছে, সেটা বেশ বড়৷ দশ দিন থাকব, দুটো খাতাই ভর্তি করে নিয়ে যেতে পারলে বেশ হয়৷

দুজনের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা আছে৷ আর্ট কলেজে আমার ঠিক পাশেই বসে অতীশ আর সঙ্ঘমিত্রা৷ যদিও বসে একেবারে সামনের দিকে, তবু মাঝে মাঝেই আমরা মিলিয়ে দেখি, কে কতটা স্কেচ করেছে৷ অতীশ সব সময়েই আমার থেকে এগিয়ে থাকে, যে-কোনো জিনিস দেখেই ও স্কেচ করে ফেলতে পারে ঝটাপট৷ আর সঙ্ঘমিত্রা অত তাড়াতাড়ি আঁকতে পারে না, সে ধরে ধরে আঁকে, সংখ্যায় কম হলেও তার ছবিগুলোই বেশি ভালো হয়৷

আমি বেশিরভাগ ছবিই দেখে দেখে আঁকি৷ অতীশ সবই আঁকে মন থেকে৷ ও গাছপালার ছবি একেবারে পছন্দ করে না৷ নানারকমের মানুষ আর জীবজন্তুর ছবিই বেশি আঁকে৷

আমাদের মাস্টারমশাই অশোকদা অবশ্য বলেছেন, কিছু একটা দেখে দেখে আঁকাও দরকার৷ একটা গাছকেও ঠিক মতন আঁকা মোটেই সহজ নয়৷

শিমুল গাছতলায় বসে, চতুর্দিকে যা দেখা যায়, তা প্রায় সবই আমার আঁকা হয়ে গেছে৷ একই জিনিস বারবারও আঁকা যায়৷ এখান থেকে দেখা যায় মাঠের শেষ প্রান্তে দুটো ছোট ছোট পাহাড়ের রেখা৷ বৃষ্টির সময় কিংবা মেঘলা দিনে সেই পাহাড় অন্যরকম দেখায়৷ তিন-চারখানা ছবি এঁকেছি সেই পাহাড়ের৷

সঙ্ঘমিত্রা পাহাড় আঁকতে ভালোবাসে৷ আমার কাছে মধুপুরের এই বাড়িটার গল্প শুনে ও আমাকে অনেকবার বলেছে, একবার আমাকে নিয়ে চল না, আমিও তোর পাশে বসে ছবি আঁকব৷

আমি বলেছি, যখন ইচ্ছে যেতে পারিস৷ অনেক ঘর খালি পড়ে আছে৷ খাওয়াদাওয়ারও কোনো অসুবিধে নেই৷

কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর ওর আসা হয় না৷ একটা না একটা কারণে আটকে যায়৷ এইবারই তো আমার সঙ্গে আসবে বলে সব ঠিকঠাক, হঠাৎ ওর জামাইবাবুর সঙ্গে চলে গেল দেরাদুন৷ সেখানে অবশ্য অনেক বড় বড় পাহাড় দেখতে পাবে৷

অতীশ কলকাতার বাইরে বিশেষ যেতে পারে না৷ ও একটা টিউশানি করে৷

সেদিন বিকেলে আমি হঠাৎ একটা বাঘ আঁকতে শুরু করলাম৷ কেন হঠাৎ বাঘ আঁকার কথা মনে এল, তা জানি না৷ চিড়িয়াখানার বাইরে আমি কখনো বাঘ দেখিনি৷ মনে যখন এসেছে, তখন আঁকতে ক্ষতি কী? সত্যিকারের বাঘ কিংবা বাঘের ছবিও না দেখে মন থেকে ঠিকঠাক আঁকা মোটেই সহজ নয়৷

আঁকতে আঁকতে সন্ধে হয়ে গেল৷

কিন্তু আঁকার নেশা একবার ধরে গেলে আর ছাড়া যায় না৷ এখানে আলো নেই, তাই বাড়ির মধ্যে ঢুকে ছবিটা শেষ করতে বসলাম৷ মনে হল, ভালোই হয়েছে, ঠিক বাঘ বাঘ দেখাচ্ছে৷

তারপর মনে হল, শুধু স্কেচ করার বদলে এটার গায়ে রং দিলে আরও বিশ্বাসযোগ্য হবে৷

হলদে, কালো, আরও সব রংই আছে৷ রং দেওয়া যখন শেষ হল, তখন আমি হঠাৎ একটা তীব্র গন্ধ পেলাম৷ এটা কিসের গন্ধ? ইঁদুর মরে পচে গেছে নাকি? না তো, এ গন্ধ অন্যরকম৷ মনে পড়ল, চিড়িয়াখানায় গিয়ে এই গন্ধ পেয়েছি৷ বাঘের খাঁচার সামনে!

প্রথমে একটু ভয় পেলেও একটু পরে মজাই লাগল৷ এখানে তো বাঘ আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ আমি বাঘের ছবি আঁকছি, অমনি বাঘের গন্ধ পেলাম, এ তো সবই মনের ব্যাপার৷

আসল মজাটা হল পরদিন সকালে৷

ঘুম ভাঙল মঙ্গল সিং আর তার ছেলেদের চ্যাঁচামেচিতে৷ তারা উত্তেজিত ভাবে কী যেন বলাবলি করছে৷

বাইরে এসে দেখি, মঙ্গল সিংয়ের দু’হাতে ধরা রয়েছে একটা বেশ বড় সাইজের বেড়াল৷ সেটা ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ করছে৷

মঙ্গল সিং বলল, দেখো খোকাবাবু, একঠো শের আয়া৷ শের!

মঙ্গল সিং আমার জন্মের আগে থেকেই এ বাড়িতে আছে৷ সেই জন্য আমাকে খোকাবাবু বলে৷

শের, মানে বাঘ? যাঃ, তা কখনো হয়? মধুপুরে বাঘ আসবে কোথা থেকে? কাছাকাছি জঙ্গল-টঙ্গল কিছু নেই৷ নিশ্চয়ই একটা বিড়ালকে ধরে মজা করছে আমার সঙ্গে৷

কাছে গিয়ে দেখি, বেড়াল তো নয়৷ গায়ে গোল গোল ছাপ৷ মুখটাও একটু অন্যরকম৷ একটা চিতাবাঘের বাচ্চা! এগুলোকে বলে লেপার্ড৷

কিন্তু আমি কাল রাত্তিরে একটা বাঘ আঁকলাম, আর অমনি আজ সকালে একটা বাঘ এসে গেল? একেই বলে কাকতালীয়!

মঙ্গল সিং বলল, এই বাচ্চা শেরটা শুকনো নদীর খাতে খেলা করছিল৷

কী করে যে বাঘের বাচ্চাটা এল সেখানে, তার কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া গেল না৷ আমি বাঘের ছবি এঁকেছি বলেই একটা জ্যান্ত বাঘ এসেছে, একথা বললে সবাই হাসত নিশ্চয়ই৷

একজন রিকশাওয়ালা বলল, বাচ্চাটাকে আমায় দিয়ে দাও, আমি পুষব!

হৈ হৈ করে আপত্তি জানাল মঙ্গল সিং-এর দুই ছেলে৷

কারুকে দেওয়া হবে না, তারাই বাঘটা পুষবে!

একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হল বাচ্চাটাকে৷

কী করে যে রটে গেল খবর, দুপুরের দিকে অনেকেই এসে পড়ল বাঘ দেখতে৷

বাঘ অতি হিংস্র প্রাণী, কিন্তু বাচ্চা বয়েসে ভারী সুন্দর দেখায়৷ এর গায়ের চামড়াটা যেন মলমলের মতন৷ চোখ দুটো দারুণ ধারালো৷

পরদিন দুপুরবেলা আমি আবার শিমুল গাছতলায় আঁকতে বসেছি, হঠাৎ একসময় চোখ তুলে দেখি, সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক৷ খুব মন দিয়ে আঁকছিলাম, তাই লোকটির পায়ের আওয়াজ শুনতে পাইনি৷

লোকটির যেমন বিচিত্র পোশাক, তেমনই অদ্ভুত চেহারা৷

মাথার চুলে সন্ন্যাসীদের মতন জটা, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, একটা চশমা পরা, তার একটা ডাঁটি ভাঙা৷ তার গায়ের লম্বা আলখাল্লাটাও অনেক রঙের৷ তার মানে নানারকম টুকরো টুকরো কাপড় সেলাই করা৷ তার কাঁধ থেকে ঝুলছে তিন-চারটে থলে, সেগুলোও নানা রঙের৷ তার মধ্যে একটা থলের মধ্যে জ্যান্ত কিছু আছে, সেটা নড়ছে৷

তার ডান হাতে একটা বর্শা৷

লোকটিকে দেখে আমার বুকটা একবার কেঁপে উঠল৷ অবশ্য, দুপুরবেলা একজন জলজ্যান্ত মানুষকে দেখে ভয় পাবার কী আছে? তবু, দু-একজন মানুষকে দেখলে এমনিই একটু ভয় ভয় করে৷

লোকটি হঠাৎ এল কোথা থেকে?

আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে গম্ভীরভাবে বলল, জয় মহাদেব! মেরা বাচ্চা কিধার হায়?

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ছেলে? এখানে কোনো বাচ্চা ছেলেকে তো কোথাও দেখিনি৷

লোকটি হিন্দিতে বলল, বাচ্চা ছেলে নয়৷ বাঘের বাচ্চা৷ সেটা আমার৷ সেটা এখানে এসেছে আমি জানি৷ আমি গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এখানে এসেছি৷

আমি বললাম, একটা বাঘের বাচ্চা এখানে এসেছে ঠিকই৷ কিন্তু সেটা আপনার কী করে হল?

লোকটি বলল, আমি বাঘ পুষি৷ আমার ঝোলায় সব সময় সাপ থাকে, বেজি থাকে, শিয়াল থাকে৷ আমি এদের নিয়ে ঘুরে বেড়াই৷

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ঘুরে বেড়ান?

লোকটি বলল, কখনো স্বর্গে, কখনো নরকে৷ সে তুমি বুঝবে না৷ আমার বাচ্চা ফেরত দাও৷

মঙ্গল সিংদের বাড়ির সামনে দড়ি দিয়ে বাঁধা লেপার্ডের বাচ্চাটা খুব জোরে জোরে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শুরু করেছে৷

সেখানে মঙ্গল সিং-এর এক ছেলেকে দেখে আমি জোরে বললাম, বুধন সিং, বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে এসো তো?

বুধন সিং বাচ্চাটাকে নিয়ে এল৷

সেই লোকটির কাছে আসতেই বাচ্চাটা জোরাজুরি করে এক লাফ দিয়ে বুধন সিং-এর কোল থেকে নেমে সেই লোকটির পায়ে মাথা ঘষতে লাগল৷ ঠিক পোষা কুকুরের মতন৷

লোকটি বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে বলল, আহা হা, এর গলা কে বেঁধেছে? এর দুখ লাগছে৷ আহা হা! ঠিক হ্যায়, বাচ্চু, তোর আর দুখ লাগবে না৷

সে বাচ্চাটার গলা থেকে দড়িটা খুলে দিল৷

এ বাচ্চাটা যে ওই লোকটিরই পোষা, তাতে কোনো সন্দেহই নেই৷ সুতরাং ওকে ফেরত দিতেই হবে৷

লোকটি বুধনের দিকে তাকিয়ে বলল, এক গিলাস পানি পিলাওগে?

বুধন দৌড়ে গেল জল আনতে৷

আমি আমাদের বাড়িতে দেখেছি, বাইরের কোনো লোক জল চাইলে, তাকে শুধু জল দিতে নেই৷ মা-মাসিরা জলের সঙ্গে কিছু না কিছু মিষ্টিও দিতেন৷ এখানে এখন মিষ্টি কোথায় পাব?

তাই জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের এই বাগানে ভালো আম হয়েছে, আপনি আম খাবেন?

লোকটি এক হাত নেড়ে বলল, আমি কারুর বাড়িতে জল ছাড়া অন্য কিছু খাই না৷

এবারে আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তা হলে আপনি খিদের সময় খাবার পান কোথায়?

লোকটি বর্শাটা ওপরের দিকে তুলে বলল, ওইখান থেকে খসে খসে পড়ে!

এমন অদ্ভুত লোকও আগে দেখিনি৷ এমন অদ্ভুত কথাও আগে শুনিনি৷ আকাশ থেকে খসে খসে পড়ে খাবার?

লোকটি চলে গেল জল খেয়েই৷ বাঘের বাচ্চাটা দৌড়োতে লাগল তার পায়ে পায়ে৷

বুধনের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল৷ সে বাচ্চাটা পুষবে ঠিক করেছিল৷ তবে সে নিজেই বলল, জানো তো নীলুবাবু, এই সব মুসাফিররা খুব রাগী হয়৷ ওদের কথা না শুনলে এমন অভিশাপ দেয় যে পাথরেও আগুন জ্বলে যায়৷

এরপর আমি সেই লোকটির ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম৷ দু-তিনবার চেষ্টাতেও ঠিক হল না৷ ওকে সামনে দাঁড় করিয়ে আঁকতে পারলে তবু হয়তো কিছু হত৷

আমি ফিরে আসার ঠিক আগের দিন একটা সত্যিকারের আনন্দের ঘটনা ঘটল৷ অনেকটা অবিশ্বাস্যও বটে৷

সকালবেলা বসে আমি শিমুল গাছের তলায়৷ এখনো ছবি আঁকতে শুরু করিনি৷ এখানে বসে চা-জলখাবার খেতেও ভালো লাগে৷

একটু পরে শুনতে পেলাম অনেক দূরে একটা হৈ হৈ শব্দ হচ্ছে৷ একসঙ্গে অনেক লোক চ্যাঁচাচ্ছে, কিন্তু কোনো কথা বোঝা যাচ্ছে না৷

এরকম গণ্ডগোল শুনলে প্রথমেই মনে হয়, কোথাও মারামারি শুরু হয়েছে বুঝি!

আমাকে খাবার দিতে এসে মঙ্গল সিং বলল, খোকাবাবু, তুমি কোঠির ভিতরে গিয়ে বসো৷ দিনকাল ভালো নয়৷

আমি বললাম, গন্ডগোল তো হচ্ছে অনেক দূরে৷ এখানে ভয় পাবার কী আছে?

মঙ্গল সিং বলল, বুধনকে সাইকেল নিয়ে দেখে আসতে বলছি৷ কিন্তু তুমি সাবধানে থাকবে৷

আমি বসে রইলাম সেখানেই৷ দূরে হৈচৈ চলতেই থাকল৷

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে মনে হল, লোকজনের চিৎকার কিছুটা কাছে চলে আসছে৷ এখন আর শুধু চিৎকার নয়, তার মধ্যে শাঁখ বাজছে, মেয়েরা উলু দিচ্ছে৷

শুকনো নদীটার দু-ধার দিয়ে কিছু লোক ছুটে আসছে এদিকেই৷

তারপরই দেখলাম, সেই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য৷

শুধু মানুষ নয়, নদীর খাত দিয়ে ধেয়ে আসছে জল৷ ঘোলা জল, যেন টগবগ করে ফুটছে৷

নদীর পাড়ে কিছু কিছু ছোট গাছ গজিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো ডুবে যাচ্ছে৷ ওদিক থেকে কিছু কিছু মাছ ভেসে আসছে, তাও দেখা যাচ্ছে৷ জল যেন আনন্দে লাফাচ্ছে৷ আমাদের বাড়ির খুব কাছেই বালি জমে জমে খাতটা একেবারে বুজে গিয়েছিল, সেখানে এসে থমকে গেল জলের স্রোত৷

কিছু লোক কোদাল আর শাবল নিয়ে লাফিয়ে পড়ল৷ সেই বালির বাঁধ ভেঙে দিতে বেশি সময় লাগল না৷ আবার জলের তোড় চলে এল এদিকে৷ দেখতে দেখতে আমাদের বাড়ির পাশটায় জেগে উঠল সেই পুরোনো নদী৷

এত জল আসছে কোথা থেকে? এখন তো বর্ষাকালও নয়৷ বর্ষা আসতে আরও দু’সপ্তাহ দেরি আছে৷ তা হলে একটা মরা নদী বেঁচে উঠল কোন মন্ত্রে?

বুধন ফিরে আসার আগেই আমরা উত্তরটা জেনে গেলাম দৌড়ে আসা লোকজনদের কাছ থেকে৷

এখান থেকে এগারো মাইল দূরে একটা বড় নদী আছে৷ অনেক বছর আগে সেই নদীর একদিকে একটা বাঁধ দেওয়া হয়েছিল বন্যা আটকাবার জন্য৷ কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো৷ প্রত্যেক বছর সেই নদীর উল্টোদিক বন্যায় ডুবে যায়৷ আর এদিকের নদীগুলো গেল একেবারে শুকিয়ে৷

এরকমই চলছিল বছরের পর বছর৷ এ বছর আর মানুষ বন্যায় ডুবতে রাজি নয়৷ কাল সারাদিন ধরে কয়েকশো মানুষ সেই বাঁধটা কেটে দিয়েছে৷ বড় নদীর জল ঢুকে পড়েছে ছোট নদীতে৷ প্রাণ ফিরে পেয়েছে মধুবংশী নদী৷

বাড়ির ঠিক পাশেই একটা জ্যান্ত নদী থাকলে সে বাড়ির চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়৷ এতদিন ওই নদীর খাতে গরু চরত, এখন আবার নৌকো ভাসছে৷ ডুব দিচ্ছে মাছরাঙা পাখি৷ পাড়ে বসে আছে বক৷ সব দৃশ্যটাই অন্যরকম৷

আমার কলেজ খুলে যাবে, তাই আর বেশিদিন থাকা গেল না৷ এখন ওখানে ছবি আঁকার অনেক নতুন বিষয় এসে গেছে৷

ফিরে আসার পর নদীটার কথা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন বড়মামা৷ তিনি বললেন, তা হলে ভাবছি, বাড়িটা বিক্রি না করলেও হয়৷ শেষ জীবনে ওখানেই গিয়ে থাকব৷

বাঘের বাচ্চার কথাটা অবশ্য বাড়ির কেউই বিশ্বাস করল না৷ সকলেরই ধারণা, ওটা আমার বানানো গল্প৷

আসল দুটো চমক কিন্তু এর পরেও বাকি ছিল৷

আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের আঁকা ছবি নিয়ে একটা প্রদর্শনী হবে, তা আগেই ঠিক ছিল৷ প্রত্যেকের একটা করে ছবি৷ বড় বড় শিল্পীরা এসে দেখে বিচার করবেন, কোন ছবিতে কী দোষ আছে বা গুণ আছে৷

আমি ঠিক করলাম, আমার ওই বাঘের ছবিটাই দেব৷ রংটা ঠিক করতে হবে, আর ভালো করে ফ্রেমে বাঁধাতে হবে৷

অতীশ কী ছবি দিচ্ছে, জানবার জন্য গেলাম ওর বাড়িতে৷

অতীশের নিজস্ব কোনো আঁকার জায়গা নেই, দু’খানা ঘরের ফ্ল্যাটে থাকে সাতজন৷ ছাদে ওঠার সিঁড়িতে ও আঁকার জিনিসপত্র রাখে, ওখানেই বসে কাজ করে৷ একবার বৃষ্টিতে ওর অনেক ছবি ভিজে গিয়েছিল৷

অতীশ তিন-চারখানা ছবি বেছে রেখেছে৷ সবই মানুষের ছবি৷ তার মধ্যে থেকে একটা ছবি তুলে ধরে বলল, ভাবছি, এটাই দেব৷

ছবিটা দেখে আমার চোখ দুটো গোল হয়ে গেল৷

এ তো সেই মধুপুরের মুসাফির, যে বাঘের বাচ্চা পোষে! অবিকল সেই চেহারা, সেই পোশাক, কাঁধে ঝুলছে কয়েকটা থলে, এমনকি চোখে ডাঁটিভাঙা চশমা৷

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই লোকটির সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল?

অতীশ একটু অবাক হয়ে বলল, কোথায় মানে? কোনো জায়গাতেই দেখা হয়নি৷ মন থেকে এঁকেছি৷

আমি বললাম, একদম মন থেকে? এরকম একটা অদ্ভুত চেহারার লোকের চেহারা তোর মনে এল কী করে?

অতীশ বলল, আমি ভাবলুম, ঠিক সাধুও নয়, সাধারণ পথিকও নয়, এমন একজনকে আঁকব, যে শুধু পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, এই থলেগুলোর মধ্যেই যার পুরো সংসার৷

আমি জিজ্ঞেস করলাম, অতীশ, তুই চশমা পরা মুসাফিরও দেখিসনি কখনো?

অতীশ হেসে বলল, না, দেখিনি৷ চশমাটা আগে ছিলও না৷ আজই সকালে ফাইনাল টাচ দেবার সময় কী খেয়াল হল, চশমাটা বসিয়ে দিলাম৷

অতীশ কি মিথ্যে কথা বলছে? একবারও না দেখলে হুবহু একরকম একটা মানুষ আঁকা কী করে সম্ভব?

শুধু শুধু মিথ্যে কথাই বা বলবে কেন? ওর স্বভাব সেরকম নয়৷ বরং মুখের ওপর অনেক সত্যি কথা বলে দেবার সাহস ওর আছে৷

এখন যদি আমি বলি, ওই ছবির মানুষটিকে আমি জলজ্যান্ত দেখেছি, তা কি অতীশ বিশ্বাস করবে?

বলা হল না৷

অতীশই বলল, চল, সঙ্ঘমিত্রার বাড়িতে যাই৷ ও দেরাদুন থেকে আজই ফিরেছে৷ ওর বাড়িতে গেলে সিঙাড়া-সন্দেশ সাঁটানো যাবে, আর ওর নতুন ছবিও দেখা হবে৷

সঙ্ঘমিত্রারা বেশ বড় বাড়িতে থাকে৷ ওর বাবা ওকে আঁকার জন্য দোতলায় একটা স্টুডিও বানিয়ে দিয়েছেন৷ সেই ছবির ঘরেই সে রাত্তিরে ঘুমোয়৷

সে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অতীশ বলল, কী রে সঙ্ঘমিত্রা, বাইরে বসে কী সব ছবি-টবি আঁকলি দেখাবি না? আমরা তাই দেখতে এলাম৷

সঙ্ঘমিত্রা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, চায়ের সময় হয়ে গেছে, তাই না? চা খেতে এসেছিস, না ছবি দেখতে?

আমি বললাম, চা তো খাবই৷ শুধু চা নয়৷ আর কী খাওয়াবি?

সঙ্ঘমিত্রা বলল, আগে কিছুই খাওয়াব না৷ যদি ছবি দেখতে চাস, আগে দেখতে হবে৷ খাওয়ার পর ছবি দেখার মুড থাকে না৷

অতীশ বলল, তা হলে আজ ভালোই খাওয়া হবে মনে হচ্ছে৷ দেখি, আগেই ছবি দেখি৷

সঙ্ঘমিত্রা পাঁচখানা ছবি দেখাল৷ সবই ক্যানভাসে তেল রঙে আঁকা৷ চারখানা ছবিই পাহাড়ের৷ আর পাঁচ নং ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ধরে বলল, এটাই এবার একজিবিশানে দেব ভাবছি৷ এটাই আমার বেশি পছন্দ৷

সে ছবিটার তলায় নাম লেখা, বার্থ অফ আ রিভার৷ একটি নদীর জন্ম৷

আমি নিঃশব্দে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷

দূরে অস্পষ্ট পাহাড়ের রেখা, সামনের দিকে একটা ছোট নদী৷ ক্যানভাসের অর্ধেকটায় সে নদী জলে ভরা, অর্ধেকটা শুকনো৷ শুকনো দিকটায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে৷

অতীশ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, হ্যাঁ, বেশ ভালো হয়েছে৷ অর্ধেকটা জল বলে মনে হচ্ছে, নদীটা যেন একটু বাদেই ভরে যাবে৷ বেশ গতি আছে৷ বাঁশি বাজাচ্ছে, এই ছেলেটা কে রে? কেষ্ট ঠাকুর নাকি?

সঙ্ঘমিত্রা বলল, যাঃ, দেখছিস না, হাফপ্যান্ট পরা৷ শ্রীকৃষ্ণ কখনো হাফপ্যান্ট পরে নাকি? যাতে ভুল না হয়, তাই হাফপ্যান্ট পরিয়েছি৷

অতীশ বলল, ওর মাথায় একটা গামছা বেঁধে দিলে পারিস৷

সঙ্ঘমিত্রা আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী রে, নীলু, তুই কিছু বলছিস না যে!

আমি বললাম, খুবই ভালো হয়েছে৷ তবে এই নদীটা আমি চিনি৷ এর নাম মধুবংশী৷ মধু নামে একজন লোক এই নদীর ধারে বসে একসময় বাঁশি বাজাত!

সঙ্ঘমিত্রা জিজ্ঞেস করল, এই নদীটা তুই চিনিস? কোথায় দেখেছিস?

আমি বললাম, মধুপুরে৷

সঙ্ঘমিত্রা একটু অবাক হয়ে বলল, তোর সেই মামার বাড়ির কাছে? সেখানে তো আমার যাওয়াই হল না এ পর্যন্ত৷ সে নদী তো আমি দেখিনি৷

আমি বললাম, না গিয়েও অনেক কিছু দেখা যায়৷ এই নদীটা তুই কবে এঁকেছিস রে? ঠিক কত তারিখ?

সঙ্ঘমিত্রা হিসেব করে বলল, জুন মাসের দু’তারিখে৷

আমার মনে পড়ল, মধুপুরের সেই নদীতে জল আসতে শুরু করে তিন তারিখ সকালে৷ নদীটা প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠার আগেই সঙ্ঘমিত্রা ওকে এঁকেছে৷ শিমুল গাছটা পর্যন্ত রয়েছে ঠিক জায়গায়৷

সেবারে আমাদের প্রদর্শনীতে পাশাপাশি ছবি ছিল তিনটে৷ একটা বাঘ, একজন অদ্ভুত মুসাফির আর একটি নদীর পুনর্জীবন৷ এই তিনটে ছবির পেছনে যে কী রহস্য আছে, তা অন্য কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না৷

প্রদর্শনীর অন্য ছবিগুলোর পেছনেও এরকম রহস্য আছে কি না, তা তো আমিও জানি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *