তিতির মৌ – চন্দন সেন
কেয়া, কামিনী, কদম্ব, টগর মিতুলের বন্ধু চারটি ফুল।
মিতুল ছোট্ট মেয়ে
মিতুলের মা ঘুঁটেকুড়ুনি দাসী
বণিক
বণিকের কয়েকজন ভৃত্য ও একটি হাতি একটি শিশু হাতির মুখোশ পরে অভিনয় করবে।
প্রথম প্রেক্ষণ
[ বাগান। সকাল বেলা।
কেয়া, কামিনী, কদম্ব, টগর। একসঙ্গে গাইছে ]
গান
ভোর এলরে ভোর এলরে-
ফুটবি চলে আয়-
(আয়রে) ফুটবি চলে আয়-
শ্রাবণের আকাশ থেকে
মেঘ যে ওঠে ডেকে ডেকে
সূর্য বলে ফোটনা সই-
(নইলে) ওঠাই হল দায়।
ফুটবি চলে আয়।
পাখির গলায় জেগেছে সুর
রাতের আঁধার গিয়েছে দূর
সূর্য তবু থমকে আছে মেঘের ইশারায়।
ফুটবি চলে আয়।।
কেয়া। ফোটা তো হল ভাই, সে তো এখনও এল না।
টগর। কী করে আসবে? আকাশে মেঘ না, সুয্যি কোনোটাই এখনও চোখ মেলতে পারছে না।
কামিনী। না, না, সূর্য ওঠার আগেই তো সে আসে রে।
কদম্ব। কোনোদিন তো তার দেরি হয় না।
কেয়া। আসবে বলে বসে আছি কখন থেকে-
ফুটিয়ে ডালা ফুলের মালা আদর মেখে কখন থেকে।
কদম্ব। সে না এলে বৃথাই ফোটা, মিথ্যে হবে সূর্য ওঠা-
ভোরের হাসি শুকিয়ে যাবে তারেই ডেকে,
-কখন থেকে।
কামিনী। সে যে সখা জন্ম হতে
(আমরা) তাই যে ফুটি তারই পথে আদর পেয়ে
খেলায় মাতি তাকেই দেখে,
-কখন থেকে
কেয়া। ইস! কত দেরি হয়ে গেল রে, শরতের সকাল হলে এতক্ষণ অনেক আগেই সূর্য উঠত-
টগর। বসন্ত হলে তো কথাই নেই-
কামিনী। শীতেও সূর্য উঠতে এত দেরি হত না।
কদম্ব। কিন্তু এটা যে শ্রাবণ, তাই সাত সকালেই মেঘ রয়েছে ঢেকে আকাশ।
কেয়া। তবু দেখ এখনও সে এল না, মিটছে না আশ।
টগর। না রে ওই ওই তো তাকে দেখা যাচ্ছে-
কামিনী, কদম্ব। মিতুল, মিতুল, তাড়াতাড়ি এসো….. আমরা কখন থেকে ফুটে বসে আছি।
কেয়া। কিন্তু ওকে কেমন ক্লান্ত লাগছে দেখ।
টগর। আহারে বেচারির সারারাত নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি- দেখ দেখ চোখ দুটো ফোলা ফোলা- মুখটাও বিষাদ কালো, দৃষ্টিও করুণ, ঠেকছে না ভালো।
কামিনী, কদম্ব। (চিৎকার) কী হয়েছে? কী হয়েছে রে মিতুল? (গলা নিচু করে) কেমন আস্তে আস্তে করুণ ছলছল চোখে আসছে দেখ।
কেয়া। ওর নিশ্চয়ই মন ভালো নেই, আয়, আয় আমরা গান গেয়ে তোর মন ভোলাই।
চারজনে। গান
মিতুল সোনা, মিতুল সোনা,
ফুল তুলে যায় ভোরের বেলা-
মিতুল সোনা মিতুল সোনা
মোদের সঙ্গে করবে খেলা।
সুয্যি ওঠার অনেক আগে
কুঞ্জে অলি কুসুম জাগে-
মিতুল সোনার হাসি রাঙায় শাওন ভেলা,
ভোরের বেলা।
[ ছোট্ট মিতুল করুণ মুখে প্রবেশ করে ]
টগর। কী হয়েছে মিতুল সোনা?
কেয়া। তুমি গান শুনেও হাসছ না, তোমার রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি?
কামিনী। তোমার বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।
কদম্ব। তোমায় কেউ দুঃখ দিয়েছে মিতুল সোনা?
[ মিতুল করুণ মুখে হাসে, তারপর গান গায় ]
মিতুল। গান
ওগো প্রিয় ফুল সখীরা, কোনো দুঃখ নাই, নাইরে,
আমার কোনো দুঃখ নাই-
প্রতিদিন ভোরের বেলা ফুল তুলি আর গাই,
গাইরে, আমার কোনো দুঃখ নাই।
টগর। তুমি কেন রাখছ ঢেকে তোমার ব্যথা-
কেয়া, কামিনী। তোমার করুণ চোখে বিধুর মুখে কান্নাভরা অনেক কথা-
কদম্ব। আমরা তোমার গোপন বেদন জানতে শুধু চাই, চাই রে-
মিতুল। কোনো দুঃখ নেই।
চারফুল। (একসঙ্গে) না, না, তুমি বলো তুমি বলো- আমরা তোমার গোপন বেদন জানতে শুধু চাই চাই রে-
মিতুল। গান
আমি ছোট্ট মেয়ে, আমার ছোট্ট জীবন,
ছোট্ট দুঃখ, আমার দুঃখ আমারই থাক-
তোমরা আমার প্রিয় সখী কতদিনের
কুসুমিত ভালোবাসায় ঋণী আমি কত ঋণের!
ব্যথার কথা জানিয়ে যেন ঋণের বোঝা না বাড়াই
আমি যে তা চাইরে!
চারফুল। না, না- তুমি আমাদের ছোট্ট সখী আমরা তোমার সুখে সুখি-
আমরা তোমার দুঃখে দুখী কেন তবে দিচ্ছ ফাঁকি?
মিতুল। বেশ তবে বলো কী বলব?
টগর। কেন দেরি করে এলে, কোনোদিন তো ভোরে ফুল তুলতে এত দেরি করো না-!
কদম্ব। কেন তোমার চোখেমুখে গভীর ব্যথা?
কেয়া। তোমার নিশ্চয়ই রাতে ঘুম হয়নি?
কামিনী। কিংবা তোমাদের ঘরে নিশ্চয়ই বড়ো বিপদ-!
মিতুল। ফুল সখীরা, তোমরা যখন আমায় এত ভালোবাস, আমায় যখন এত করে বলছ, তখন সব বলতে মন চাইছে। তখন তোমাদের খুলেই বলি আমার কথা- আমার ঘরে আজ অনেক দুঃখ, ভীষণ বিপদ। তোমরা তো জানো আমার বাবা নেই কবে থেকেই, মা আমার ঘুঁটেকুড়ুনি দাসী! অনেক কষ্টে অনেক যন্ত্রণায় আমায় বড়ো করে তুলছে আমার মা-
সকলে। আহা রে, তোমার মা-এর অনেক কষ্ট অনেক দুঃখ-
মিতুল। হ্যাঁ ভাই-
গান
মা আমার দুঃখী বড়ো, ঘুটেকুড়নি দাসী হায়-
সারাদিন খেটে খেটে
(মা) দুটো রুটি জোগান পেটে-
না খেয়ে তা আমায় খাওয়ান-
তার মুখে তাতেই সুখের হাসি।
ঘুঁটেকুড়ুনি দাসী।
চারজনে। আহারে! তোমার তো দুঃখ ভারী!
বলো না তোমার জন্য কী করতে পারি?
মিতুল। প্রয়োজন নেইকো তারই-
আমি নিজেই নিজের দুঃখে ভাসি
মা যে আমার দুঃখিনী এক ঘুঁটেকুড়ুনি দাসী।
চারজন। বলো মিতুল, তোমার কীসের দুঃখ?
মিতুল। বলছি, ছাড়বে না যখন তোমরা, তখন শোনো- এই তো কদিন আগে সন্ধেবেলা মালাগুলো বিক্রি করে- ফিরে গিয়ে মাকে দেখি মাথা নিচু করে একা একা কাঁদছে ঘরে। আমায় দেখে দুটো কান্নাভেজা চোখ মুছে বলল ডেকে-
[ ফ্ল্যাশ ব্যাক! সামনে জোন তৈরি হয়, অন্যরকম আলোর ]
মা। (ম্লান হেসে) যাবি রে মিতুল অন্য কোথা এখান থেকে?
মিতুল। মা, এখানেতে জন্ম আমার,
এখানেতে কুটির তোমার,
এখান ছেড়ে আমরা মাগো কোথাও যাব না।
মা। যেতে আমার মন কী চায় রে-
এমন শান্ত কুটির, চেনা আকাশ
ফুলের গন্ধ মাতাল বাতাস
বনানির এমন মায়া অন্য কোথাও পাব না।
মিতুল। যাব না মা-যাব না।
মা। কিন্তু আমি যে ঘুঁটেকুড়ুনি দাসী, কপাল সর্বনাশী; তোকে যে রোজ ভাতটুকুও দিতে পারি না-
মিতুল। আমিও মা কষ্ট করে, যত্ন করে, মালা গাঁথি, বিক্রি করি ঘরে ঘরে, দুজনেরই চলে তো যায়, কাউকে তো ধারি না।
মা। (তবু) তোকে রোজ ভাত জোগাতে পারি না।
তাই মিতুল আমি যে রাতে কাল
নিজেকেই দিয়েছি অনেক গাল,
ভেবে রেখেছি একবার দেখে আসবই শহরের হাল-
অন্য কোনো কাজ যদি পাই
থেকে যাব তবে ওখানেই বাকি কাল।
মিতুল। না, না, পারব না মা থাকতে সেথা,
এই বাগানের স্মৃতি দেবে ভীষণ ব্যথা।
এত বন্ধু ছেড়ে আমি একাই কেন সুখের খোঁজে যাব?
এমন সব বন্ধু কুসুম মাগো, কোথায় পাব?
মা। (তবু) মিতুল, আমি যে কাল দেখতে যাবই শহরের হাল।
না খেয়ে আর মালা গেঁথে হচ্ছে জানি জীবন নষ্ট।
বলে দিলাম আমি স্পষ্ট
কাল ভোরেতে যাবই যাব।
তারপরেতে এসে ফিরে ভাবনা চিন্তা করেই ধীরে-
এখান থেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেব,
শহরেতে কাল ভোরেতে যাবই যাব।
মিতুল। যেয়ো না মা, শহরে মানুষ থাকে ইটের অন্ধ খাঁচায়।
দরকার নেই এমনভাবে বাঁচায়।
মা। (চলে যেতে যেতে) মিতুল রে, দুঃখকষ্ট শহরেতে পেলে পাব,
তবু আর সয় না, এবার আমি যাবই যাব।।
[ ফ্ল্যাশ ব্যাক কেটে যায়। মিতুল ফুলদের মাঝখানে ফিরে আসে ]
মিতুল। পরদিনই মা গেল চলে সকালবেলা,
এল ফিরে আবার ঘরে সন্ধ্যাবেলা।
তারপরেতে বলব কী ভাই মরণ খেলা-
জমছে দেখি ক্ষণে ক্ষণে মাকে ঘিরে-
টগর। কেন মা শহর পর্যন্ত যেতে পারেননি?
কেয়া। তোমার মা অন্য কোনো বিপদে পড়েছেন?
কামিনী, কদম্ব। কী হল ভাই তোমার মার?
মিতুল। কী জানি তার, সন্ধেবেলায় মায়ের চোখে নেমে এল অন্ধকার।
গা পুড়ে যায়, ভীষণ জ্বর, কাঁপছে দেহ, কাঁপছে স্বর।
ভয়ে আমার কান্না পেল,
মা নাকি পথের মাঝেই মাথা ঘুরে
পড়েছিল দুপুরবেলা জ্বরের ঘোরে, কেউ একজন দয়া করে মাকে আবার পৌঁছে দিয়ে গেছেন ঘরে।
চারজন। আহারে, তোমার মায়ের কী দুঃখ কী কষ্ট!
মিতুল। কিন্তু আর তো সময় করতে পারি না নষ্ট! কারণ ভয় পেয়ে আমি রাজবৈদ্যের কাছে ছুটে গেলাম।
সকলে। রাজবৈদ্য! সে তো অনেক টাকা লাগে ভাই।
মিতুল। কিন্তু মায়ের আমার চিকিৎসা তো চাই। এদিকে পয়সাওতো নাই।
সকলে। তারপর তারপর?
মিতুল। রাজবৈদ্য মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, বললেন না, না, হবে না, অন্তত দুই মোহর ছাড়া আমার ওষুধ পাবে না! গরিব আমরা কোথায় পাব মোহর? কাল সন্ধের এই ঘটনা- ফিরে আসছি আপন ঘরে রাগদুঃখ নিয়ে, এমন সময় দেখি রাস্তা দিয়ে – ফিরছেন এক বণিক আপন ঘরে, সঙ্গে অনেক লোক লশকর।
[ আবার ফ্ল্যাশব্যাক। রাস্তা। হাতির পিঠে বণিক, বাজনা বাজছে। মঞ্চ আস্তে আস্তে অন্ধকার। লোকের চিৎকার বাজনার শব্দ শোনা যায় ]
মিতুল। আমি যাচ্ছি হাতির পাশ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। বেশ কিছু দূর চলে গেছি। হঠাৎ দেখি বণিকমশাই আমার পিছু ছুটে এসেছেন, মুখে তাঁর দারুণ বিস্ময়। আর রাগে তাঁর দেহ কাঁপছে। আমার কাছে এসেই বললেন-
বণিক। এই মেয়ে তুই আমার হাতির পাশ দিয়ে যেতে যেতে কাঁদছিলি?
মিতুল। হ্যাঁ বণিকমশাই। আমার মা জ্বরে কষ্ট পাচ্ছে।
বণিক। কিন্তু এদিকে যে আমার হাতি দাঁড়িয়ে পড়েছে। জানিস না আমার অদ্ভুত হাতি কাউকে কাঁদতে দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যদি তাকে বুঝিয়ে বলিস কানে কানে মিষ্টি স্বরে- -আমি আর তোর সামনে কাঁদব না রে হাতি, কাঁদব না রে।- অমনি হাতি চলতে শুরু করে।
মিতুল। (চোখ মুছে) আমি জানতাম না বণিকমশাই, বেশ আমি যাচ্ছি। এক্ষুনি হাতিকে গিয়ে বলছি- -আর আমি তোমার সামনে কাঁদব না। কক্ষনো না-
[ যেতে চায়। বণিক কথা বলে ]
বণিক। দাঁড়া। তুই তো বেশ লক্ষ্মী মেয়ে! তা কাঁদছিলি কেন?
এখনও জল দেখছি দু-চোখ ছেয়ে!
মিতুল। আমার মায়ের ভারী অসুখ। রাজবৈদ্য দুই মোহর পেলে ওষুধ দেবেন। তবে মায়ের প্রাণ বাঁচবে।
বণিক। দুই মোহর! (হাসি) সোজা কথা দুই মোহর? অত সস্তা!
ঠিক আছে- তোকে একটা সুযোগ দিচ্চি। ওই, ওই যে রাস্তাটা, ওটা সোজা গেছে মধুপুরে। মধুপুরের কাজলদিঘির পাশেই আমার বাড়ি।
মিতুল। শ্বেত পাথরের প্রাসাদ তো-?
বণিক। তুই তো সব জানিস মেয়ে!
মিতুল। ও বাড়িতে গত শ্রাবণের পূর্ণিমার উৎসবে আমি মালা বেচতে গিয়েছিলাম।
বণিক। ও- হ্যাঁ-হ্যাঁ শুনেছি বটে এক বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে মালা কিনেছিল ওরা, সুন্দর মালা ছিল। তা বেশ তো, পরশুই তো পূর্ণিমা, মালা বেচতে আসিস, অনেক মালাই কিনব। এবার উৎসবও হবে বড়ো। আমার এবার বাণিজ্যে অনেক লাভ হয়েছে রে। দেখছিস না কেমন বাজনা বাজিয়ে হাতি নিয়ে যাচ্ছি! আসিস তুই পরশু সন্ধেবেলা।
মিতুল। কিন্তু আমার যে দুই মোহর-
বণিক। ও হ্যাঁ। মোহর। দেখ দুই মোহর কি সহজে মেলে! আচ্ছা তোকে একটা সুযোগ দেই। এবারে আমি অনেক বড়ো উৎসব করব শুনলি তো? বাইরে থেকে অনেক গানবাজনার লোক আসবে। কিন্তু আকাশে যেমন মেঘ দেখছি, ভয় হচ্ছে শ্রাবণ পূর্ণিমার চাঁদ হয়তো উঠবেই না। ফলে আমার সব আয়োজন হবে মাটি। তা মেয়ে, যদি সেইদিন চাঁদ হাসে, চাঁদের মুখে যদি আলোর হাসি নাচে, পাবিরে দুই মোহর তুই, জেনে রাখ আমার কাছে। মনে রেখো মেয়ে- চাঁদ যদি হাসে তবেই- দুটি মোহর পাবেই।
[ বণিক চলে যায়। ফ্ল্যাশ ব্যাক ভেঙে যায় ]
মিতুল। শুনলে তো সব তোমরা ভাই, আজই তো ভাই পূর্ণিমা। কিন্তু আকাশের মুখ যে ভার করে আছে ভাই, মোহর পাওয়ার আর কোনো আশাই নাই।
চারজন। আহারে, তোমার ভাগ্য বড়ো মন্দ,
শ্রাবণের ওই কালো মেঘ হল প্রতিবন্ধ।
আমরা তো ভাই ছোটো ছোটো ফুল, তোমার দুঃখে ভেবেই আকুল-
কীভাবে যে হাসবে গো চাঁদ, আকাশ যে আজ অন্ধ।
তোমার ভাগ্য বড়ো মন্দ।
টগর। (হঠাৎ) না, না, একটা উপায় পড়ছে মনে-
কথাটা যে ডুবে ছিল বিস্মরণে!
চলে যাও ভাঁড়ুর বাগান,
পাবে তিতির মৌ ফুলের সন্ধান।
তিনজন। ঠিক, ঠিক বলেছ। তিতির মৌ- এ অঞ্চলে একটাই গাছ আছে। কিন্তু কঠিন বড়ো যাওয়া তার কাছে।
মিতুল। কেন বন্ধু কেন?
তিনজনে। বাগানের মালিক ভা৺ড়ু দত্ত, শয়তান সে এক মস্ত, কাউকেই সে বাগানে দেয় না ঢুকতে।
মিতুল। গান
সময় যে বয়ে যায় যায়
ভাবনার সুযোগ তো নাই।
সেই ফুল খুঁজে পাই বা না পাই,
আমি যে যাব সেখানে ছুটে।
(শুধু) ঠিকানা বলে দাও মুখটি ফুটে।
যদি আজ রাতে চাঁদ ওঠে বাঁচবে গো মা
তাকে বাঁচাবার সুযোগটা চাই!
টগর। বেশ তবে যাও ভাই সাবধানে।
কদম্ব। ভরসা শুধু রাখো মনে ভাঁড়ু দত্তের ঘুম ভাঙতে দেরি যে হয় ঢের।
সাঁঝে ঘুমোয়, পাহারা দেয় সারাটি রাত-
লাঠি ঠোকে তার শক্ত দু-হাত
শেষ রাতেতে ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্তিতে ফের।
কামিনী,কদম্ব। তবে যাও দ্রুত সেথা, তোমার দুঃখে আমরা পেলাম গভীর ব্যথা,
তিতির মৌ চাঁদের মেয়ে সুন্দর ফুল,
তার কাছে যাও তাড়াতাড়ি সোনার মিতুল।
কদম্ব। সামনেই চকের পোতা পার হয়ে ভাই,
দক্ষিণেতে যেতে হবে মাঠ পেরিয়ে
রায়দিঘিটার বাম পাশেতে মেঠোপথের আল ছাড়িয়ে
ভাঁড়ুদত্তের বাগান পাবে; সাবধানেতে সেখানে যাবে।
মিতুল। যাই তবে ভাই, শুভাশিস দাও গো তবে আমায় সবাই।
দুটি মোহর পেলেই আমার বাঁচবে যে মা-
তিতির মৌ ফুল না পেয়ে ফিরব না, না!
যাই তবে যাই।
[ মিতুলের প্রস্থান
[ দৃশ্যান্তর। আলো জ্বলে। ভাঁড়ু দত্তের বাগান। মিতুল ও তিতির মৌ ]
মিতুল। তিতির মৌ, তিতির মৌ ফুল, কী সুন্দর তুমি-
এমন ফুলকে কাছে পেয়ে ধন্য হলাম আমি।
কী সুন্দর তুমি!
তিতির। তুমি ওগো ছোট্ট মেয়ে, আরও সুন্দর আমার চেয়ে,
আজ বন্ধু হয়ে এলে যখন, ভালোবাসা নাও।
এলে কত কষ্ট করে, এবার বলো স্পষ্ট করে,
সামান্য এই ফুলের কাছে কী সাহায্য চাও?
মিতুল। শুনলে পাবে বড়োই ব্যথা, আমার বড়ো করুণ কথা-
রোগশয্যায় কাঁপছে যে আজ মাগো আমার।
রাজবদ্যি বলল আমায়, ঔষধ যে নিতে চায়,
অন্তত দুটি মোহর তাকে দিতে হবে উপহার।
গরিব আমি, কেমন করে তা করব জোগাড়!
ঘুঁটেকুড়ুনি দাসীর মেয়ে আমি, মোহর যে আমার চেয়েও দামি।
শেষে এক বণিক বলল ডেকে, চাঁদ যদি এই পূর্ণিমাতে হাসে ওই আকাশ থেকে,
খুশি হয়ে সে আমাকে দুটি মোহর দেবে।
রাজবৈদ্যের হাতে তবে মা-র চিকিৎসা হবে।
তিতির। কিন্তু ভাই, তুমি কি জানো না- চাঁদ যে আমার মা?
কাল শেষ রাতেতে মা আমাকে ফুটিয়ে দিয়ে
সোহাগে বলল হেসে,
তিতির সোনা, আমি কাল আর উঠছি না,-
ভালো থেকো আনন্দে ও অনুরাগে-
রাঙিয়ে আলো নীল পরাগে।
মিতুল। তবে কি ভাই তোমার কথাতেও চাঁদ আজ রাতে উঠবে না? তবে কি মোহর আমি পাব না? তবে কি ঘুঁটেকুড়ুনি দাসী মা আমার রোগে ভুগে শেষ হয়ে যাবে? (কান্না)
গান
বলো তিতির, বলো আমায়,
মা গেলে মা পাব কোথায়?
দুটি মোহর না পেলে যে
(তার) প্রাণটা টলমল।
বলো তিতির, বলো।
তিতির। আর বোলো না ভাই মিতুল সোনা, বোলো না ভাই,
তোমার বেদন শুনে আমি ছোট্ট ফুল যে কষ্টে মরে যাই।
তুমি জানো না মোর ভাগ্যলিপি-
প্রথম রাতে জন্ম আমার চাঁদের আলোর তাপে
(তবু) দ্বিতীয় রাতে চাঁদ উঠলেই আমার বুক যে কাঁপে।
মিতুল। কেন ভাই মাকে দেখলে বুক কাঁপে? এ কেমন কথা-
তিতির। (ম্লান হেসে) ঠিক কথা, না ভাই মা দেখলে কারো বুক কাঁপে?
ঠিক আছে ভাই, বিদায় জানাই তুমি আমার সখী।
দেখা হল, চোখের জলে, তুমিও আমায় পথে পেলে;
বাঁধব এবার তোমার হাতে ভালোবাসার রাখি।
যাও ফিরে যাও নিজের ঘরে, জানাই তোমায় মনের জোরে,
চাঁদ মা আমার উঠবেই আজ রাতে।
মা বলেছে, ঠিক তিনবার -মা- বলে যদি দিই চিৎকার,
তবে চাঁদের আলো ছড়িয়ে যাবে এধার থেকে ওধার।
তখন গেঁথে হাজার মালা,
তুমি বণিকবাড়ি চলে যেয়ো ভুলে মনের জ্বালা।
আকাশ তখন যতই ঢাকুক মেঘে, মায়ের আমার চাঁদের হাসি থাকবে তাতে লেগে।
দেখে আমার চাঁদমায়ের মুখখান, মোহর দেবে বণিক ধনবান।
মিতুল। বিদায় বন্ধু, বিদায়, মনে জাগছে খুশির গান,
বন্ধু, তোমার হৃদয় মহান, বড়োই মহান!
যা চেয়েছে ব্যাকুলভাবে আমার ছোট্ট প্রাণ-
অচেনা এই মিতুলকে ভালোবেসে তাই করলে দান!
হৃদয় তোমার বড়োই মহান
বিদায় বন্ধু, বিদায় [ মিতুল চলে যায়
[ দৃশ্যান্তর ]
[ মিতুল খুশি হয়ে ফিরে এসেছে ফুলেদের মধ্যে ]
মিতুল। গান
ফুটবি চলে আয়-
(আয়রে) ফুটবি চলে আয়-
শ্রাবণের আকাশ থেকে
মেঘ যে ওঠে ডেকে ডেকে
সূর্য বলে ফোটোনা সই
নইলে ওঠাই হল দায়।
ফুটবি চলে আয়।।
চারফুল (একসঙ্গে)। ওই ওই তো আজ ঠিক সময় মিতুল সোনা এসেছে।
টগর। ওই দেখ কী খুশি খুশি লাগছে ওকে।
কদম্ব। ওর হাসি আজ উছলে পড়ছে
কেয়া, কামিনী। মিতুল সোনা, মিতুল সোনা। তোমার মা ভালো আছে?
মিতুল। হ্যাঁ খুব ভালো। কাল রাতে চাঁদ উঠেছে- মেঘ চিরে। বণিকমশাই বড়ো খুশি হয়ে আমায় দুটি মোহর দিয়ে দিলেন। বললেন, তুমি খুব পয়া মেয়ে! এই নাও দুই মোহর! রাজবদ্যি মোহর পেলেন, ওষুধ দিলেন। সেই ওষুধ খাইয়ে দিলাম মাকে। জানো, মা ভালো হয়ে গেছে, ভোরেই মায়ের মুখে কোনো যন্ত্রণা নেই, আছে হাসি।
চারটি ফুল। আমরা খুব খুশি, মিতুল সোনা, খুব খুশি।
মিতুল। এমন খুশির ভোরে যাব একবার আমার নতুন বন্ধুর কাছে-
তিতির মৌ ফুলের কাছে।
সারা বাগানে ওই একটিই ফুল, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দরদী!
ভাঁড়ু দত্তর চোখ এড়িয়ে যাব তিতির মৌ-এর কাছে,
সে জানে না, তার সঙ্গে আমার কত কথা আছে!
কী মিষ্টি ফুল তিতির মৌ, কী সুন্দর নাম!
এমন বুকভরা তার ভালোবাসার কী দেব ভাই দাম?
আমি শুধু বলব তাকে, তোমায় আমি ভুলব না ভাই-
টগর। কেন যাবে সেখানে হায়, আর তো কোনো প্রয়োজন নাই।
মিতুল। কেন ভাই কেন? বলছ কেন এমন কথা?
এমন উপকারকে অস্বীকারে চিরকাল যে বইব ব্যথা!
কেয়া। তুমি কি মিতুল জান না কিছু? তোমায় কি বলেনি সে?
দ্বিতীয় রাতের চাঁদ দেখলেই মরণ যে তার কাছে আসে!
মিতুল। সেকী! কেন এমন বলছ কেয়াফুল?
কদম্ব। ঠিকই মিতুল, কেয়া করেনি একটুও ভুল। তিতির মৌ চাঁদের মেয়ে, চাঁদ তার মা। কিন্তু তার ভাগ্যটাই অভিশপ্ত। প্রথম রাতে চাঁদ উঠলেই তিতির মৌ ভুবনভোলানো হাসি নিয়ে ফোটে। কিন্তু দ্বিতীয় রাতে চাঁদ ওঠার পর যখন তৃতীয় প্রহরে ঢলে পড়ে চাঁদ, তিতির মৌ ফুলও ঝরে পড়ে, ছোট্ট জীবন শেষ হয়ে যায় চাঁদের অস্ত যাওয়ার একটু আগে। দ্বিতীয় রাতে চাঁদ না উঠলে অন্তত বেশ কিছুক্ষণ সে বাঁচতে পারে।
কামিনী। কিন্তু তিতির মৌ এমন উদার, তোমায় এমন ভালোবেসেছে যে তার নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেই তোমায় খুশি করেছে। তোমার হাতে মোহর জুটেছে, তোমার মায়ের জীবন বেঁচেছে।
মিতুল। না, না, তিতির মৌ আমার বন্ধু, আমার কত আদরের বন্ধু। (কান্না)
চারটি ফুল। গান
একটি -দুটি তারা জ্বলে ওঠে আকাশে,
একটি দুটি সুর জেগে ওঠে বাতাসে।
-পৃথিবীটা সুন্দর- – বলে যায় ওই চাঁদ,
(তবু) তিতির মৌ কেঁদে কয়,-
আজ মোর শেষ রাত
আজ মোর শেষ রাত।।
[ গান মৃদু কণ্ঠে চলে ]
মিতুল। তিতির মৌ, বন্ধু আমার, আমায় তো একবারও খুলে বলোনি- তোমার ভাগ্যটা এমন, কেন বলোনি? কেন? (কান্না)
চারফুল, মিতুল। গান
তিতির মৌ তিতির মৌ, মিষ্টি ফুলের নাম,
মৃত্যুহীন তোমার কথা হৃদয়ে লিখিলাম।
নিজের জীবন পরের তরে
বিলিয়ে দিলে অকাতরে-
এমন উদার ভালোবাসার সোনার বেশি দাম
তিতির মৌ, তিতির মৌ, মিষ্টি ফুলের নাম।।