তিতির বন্ধু – রতনতনু ঘাটী

তিতির বন্ধু – রতনতনু ঘাটী

রোবট নিয়ে তিতির কোনো আগ্রহ নেই। এর আগে কলকাতায় রোবটের এক প্রদর্শনী হয়েছিল। তিতি বাবা-মার সঙ্গে দেখতে গিয়েছিল। একদম মন ভরেনি তিতির। বাড়ি ফেরার পথে তিতির বাবা গাড়িটা একটা ছোটো গর্ত থেকে বাঁচাতে ব্রেক কষে তিতির মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বলো মিলি, রোবট মেলাটা তোমার ভালো লাগেনি?’

তিতির মায়ের ওটা ডাকনাম। ওই নামে বাবাকে ছাড়া আর কাউকে ডাকতে শোনেনি তিতি। এমনকী, দাদু বা দিদাকেও না। দাদু দিদা মাকে ডাকেন মুন্নি বলে। তিতির মা বললেন, ‘দারুণ, ভীষণ, ভীষণ ভালো!’

তিতির বাবা তিতিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে তিতি, তোর ভালো লাগেনি?’

তিতি কোনো উত্তর দেয়নি। একদম ভালো লাগেনি তিতির। রোবটের আবার মেলা কী? যে মেলায় বেলুন নেই, ফুচকা, পাঁপড়ভাজা, আলুকাবলি নেই, নাগরদোলা নেই, সেটা আবার মেলা কীসের। এমনকী, কলকাতায় বই নিয়ে যে বড়ো মেলা হয়, তাও তিতির খুব ভালো লাগে।

তিতিকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা-মা অন্য কথায় ডুবে গিয়েছিলেন। সে-কথার সবটা কানে নেয়নি তিতি। যেটুকু শুনছে, তার সার কথা এই, তিতির বাবা রোবটের ব্যাবসা শুরু করবেন। বিদেশ থেকে রোবট এনে কলকাতা, দিল্লি, মাদ্রাজ, মুম্বাইয়ে বিক্রি করবেন। মায়ের কথাটা খুবই মনে ধরেছে। তিতির কিন্তু ভালো লাগেনি। বাবা যখন বলেন, রোবট হল যন্ত্র মানব, সে-কথাও মনে ধরে না তিতির। যন্ত্র আবার মানুষ হয় নাকি? বড়োদের যে কী বুদ্ধি। একদম ভালো লাগে না এসব।

কী ভালো লাগে তিতির? একজন জানে। সে তিতির স্কুলের বন্ধু পিয়ালি। ক্লাসে দু’জনে পাশাপাশি বসে। তিতি পিয়ালিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর কোনো রং ভালো লাগে রে পিয়ালি?’

পিয়ালি চটপট মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আকাশি।’

‘আমারও।’ তারপর তিতি জানতে চায় ‘তোর কোনো ফল খেতে ভালো লাগে?’

পিয়ালি বলে, ‘লিচু।’

‘আমারও।’

পিয়ালি জিজ্ঞেস করে, ‘তোর এক্কাদোক্কা খেলতে ভালো লাগে, না কম্পিউটার গেম?’

তিতি ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দেয়, ‘এক্কাদোক্কা।’

তিতির ভালো লাগার তালিকা অনেক বড়ো। তবু পিয়ালি যেটুকু জানে, তিতি মালা গাঁথতে ভালোবাসে। পুতুল খেলতে, রান্নাবাটি খেলতে, নদী, বন আর পাহাড়ের ছবি আঁকতে ভালোবাসে। পরি, রাজা, রাক্ষসখোক্কসের গল্প শুনতে ভালো লাগে তিতির। ছড়া পড়তে ভীষণ ভালোবাসে তিতি, আকাশে রামধনু দেখতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে কচুপাতা মাথায় দিয়ে ভিজতে, পিঁপড়ের পায়ে একটা ফূুলের পাপড়ি বেঁধে দিতে, ঘাসফড়িংয়ের সঙ্গে সারা বিকেল লাফাতে-ঝাঁপাতে। আর ভালোবাসে পুতুলের মতো তুলতুলে একটা ছোট্ট ভাই পেতে।

এর কোনোটাই পায় না তিতি। এসব একদম পছন্দ করেন না মা-বাবা, এসবের কোনোও কিছু দেখলেই মা বলেন, ‘মেয়েটা দিন-দিন ‘রাস্টিক’ হয়ে উঠছে। একটা ব্যবস্থা করো।’

বাবাও সায় দেন সে-কথায়, চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই নিয়ে তিতিকে বারণও করেন বাবা-মা। বলেন, ‘মাম, তোমাকে অনেক বড়ো হতে হবে। ইংরেজি শিখতে হবে। আধুনিক হতে হবে। ওসব তো গ্রামের ছেলেমেয়েরা চায়।’

উলটে তিতি জবাব দেয়, ‘আমাকে তোমরা ‘মাম’ বলবে না, মামণি বলবে। আমার মাম শুনতে ভালো লাগে না। তাও যদি না পারো, তিতি বলেই ডেকো।’

তিতি নামটাও যে বাবা-মার একদম পছন্দ নয়, তাও জানে তিতি। ওই নামটা দাদুর দেওয়া। বাবা-মা অনেকবার চেষ্টা করেছেন ওর তিতি নামটা বদলে দিতে। পারেননি। অন্য কোনো নামে তিতিকে ডাকলে তিতি সাড়াই দেবে না। অন্য নাম ভালো লাগে না তিতির।

তিতির আরও কী-কী যে ভালো লাগে না, তা জানেন তিতির মা ও বাবা। ছেলেদের মতো ছোটো করে চুল কাটতে ভালো লাগে না, ছেলেদের মতো পোশাক পরতে ভালো লাগে না, হইহুল্লোড় ভালো লাগে না, গানের তালে-তালে নাচতে ভালো লাগে না। আরও অনেক কিছু ভালো লাগে না তিতির। যেমন, চারপাশে এত যন্ত্র ভালো লাগে না। মার ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় কাচা, রান্না করা—সব কাজেরই যন্ত্র আছে। তবু, ওরা যখন শহরতলিতে থাকত, তখন ওদের বাড়িতে কাজ করার জন্য যে বকুলমাসি ছিল, তাকেই সবচেয়ে ভালো লাগত তিতির। কলতলায় বসে কেমন ঝকঝকে করে বাসন মাজত, বকবক করতে করতে ঘর মুছত কেমন, আব সেই ভেজা মেঝের ওপর তিতির ছোট্ট পায়ের ছাপ দেখলেই কেমন মুখ ভার করে বকত তিতিকে। কাচা জামা-প্যান্টের সঙ্গে কেমন একটা গন্ধ মিশিয়ে দিত যে বকুলমাসি, ভীষণ ভালো লাগত সেই গন্ধটা তিতির। কাপড়-কাচা যন্ত্র কোথাও থেকে এনে দিতে পারবে কি সেই গন্ধটা? বকুলমাসি টক বেলের যে আচারটা তৈরি করত কাঁচালঙ্কা দিয়ে, মায়ের রান্না-করা যন্ত্রটা কি পারবে সেই আচারটা তৈরি করে দিতে? তাই মানুষের মতো যন্ত্রও যেমন ভালো লাগে না তিতির, তেমনই ভালো লাগে না যন্ত্রের মতো মানুষও।

তবু তিতি বুঝতে পারে, বাবা-মাকে আধুনিকতায় পেয়েছে। যা তার একদম অপছন্দের।

ওরা এখন শহরতলি থেকে চলে এসেছে শহরের একেবারে মাঝখানে, অভিজাতদের পাড়ায়। বাবা এখানে মস্ত বড়ো একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। অনেক ঘর। তাই মাঝে-মাঝে একলা থাকতে ভয় করে তিতির। মাকে খুব সকাল-সকাল অফিসে যেতে হয়। মা কি একটা বড়ো কোম্পানির ম্যানেজার। অফিসে সকলেই মাকে ‘মেমসাব’ বলে ডাকে। মা এখন বেশির ভাগ সময় প্যান্ট-শার্ট পরেন। ঘরে যখন বাবা-মা পেছন ফিরে চেয়ারে বা সোফায় বসে থাকেন, তখন কে মা আর কে বাবা, গুলিয়ে ফেলে তিতি। কেমন একই রকম মনে হয় দুজনকেই।

বাবার এখন রোবটের ব্যাবসা। সারা ভারত জুড়ে বাবার ব্যাবসা। তাই বেশিরভাগ সময় বাবাকে থাকতে হয় কলকাতার বাইরে। যখন বাড়িতে আসেন, মায়ের সঙ্গে ব্যাবসা নিয়ে আলোচনা, গুরুগম্ভীর কথাবার্তার ফাঁকে কথা বলারই সুযোগ পায় না বাবার সঙ্গে। সময় পেলে বাবা শুধু একবার জিজ্ঞেস করেন তিতিকে, ‘এখন পিয়ালির সঙ্গে আব মেশো না তো মাম?’

তিতি এ-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায় অন্য ঘরে। সেদিনও তিতি পাশের ঘর থেকে শুনল, মা বাবার কাছে তার সম্পর্কে অভিযোগ করছেন, ‘জানো তো, সেদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি সারা ঘরময় চকখড়ি দিয়ে এক্কাদোক্কা খেলার ঘর কাটা মেঝেতে। ড্রইং রুমের সেন্টার টেবিলটায় রান্নাবাটি খেলার জঞ্জালে ভরতি। তুমি এর একটা ব্যবস্থা করো।’

বাবা বলছেন, ‘আমি হাতে সময় পাই কই। তুমিই একটু ম্যানেজ করো।’

মা বলছেন, ‘এই নিয়ে তিতিকে মেরেছি সেদিন।’

‘কড়া শাসনে রাখতে হবে। ওই স্কুলটা থেকেও ছাড়িয়ে আনতে হবে তিতিকে। আমার অবাক লাগে, আমাদের মেয়ে এমন হয় কী করে?’ বলে বাবা চুপ করে গেলেন।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর তিতি শুনল, মা বাবাকে বলছেন, ‘সারাক্ষণ একা থাকে তো, তাই তিতি কিছুতেই ওর ওই অভ্যোসগুলি কাটিয়ে উঠতে পারছে না। আমিও তো অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। কী করা যায় ভাবো।’

বাবা কিছুটা ঝাঁঝের সুরে বলছেন, ‘কাজের লোক রাখা মানেই তো এগুলিকে আরও উসকে দেওয়া। দ্যাখো না, এখনও মাঝে-মাঝে সেই বকুলমাসির কথা বলে। ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়।’

কী যে করা যাবে, বুঝে উঠতে পারে না তিতি। কীই-বা করা যাবে? তিতি ভাবে, ‘আমার যে অন্য কিছু একদম ভালো লাগে না গো মা, একদম ভালো লাগে না!’

বাড়িতে তিতির একা-একা থাকাটা এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। একদম কষ্ট হয় না। অফিস-মিটিং করে মার বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সেই সন্ধে সাতটা পেরিয়ে যায়। প্রায় এক মাস হল বাবা বিদেশে। অনেক রোবটের অর্ডার নিয়ে বাবা আমেরিকা গেছেন। ভারতে এখন বড়োলোকেরা দরোয়ান বা কাজের লোকের বদলে রোবট রাখছে বাড়িতে। মানুষের চেয়ে তারা নাকি কাজ করে ভালো। মানুষের চেয়ে যন্ত্র-মানুষ ভালো হয় কী করে, মাথায় ঢোকে না তিতির।

সন্ধে হয়ে গেছে। বাড়িতে একা বসে-বসে একটা পুতুল তৈরি করছিল তিতি, বাতিল কাপড়ের টুকরো আর কাগজ দিয়ে। তখন হঠাৎ পিয়ালির কথা মনে পড়ে গেল তিতির। কাল পিয়ালি তার বাবার সঙ্গে গিয়েছিল সার্কাস দেখতে। তিতি ভাবে বাবার সঙ্গে সে কোনোদিন সার্কাস দেখতে যায়নি। বাবার অত সময়ই নেই।

পিয়ালি বলেছিল, ‘জানিস তিতি, যখন বাঘের খেলাটা শুরু হল, আমি তখন বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম। অত বড়ো বাঘ, মা গো!’ বলেই পিয়ালি দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল ভয়ে।

এখন বাবার হাতের একটু স্পর্শ পেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তিতির। কতদিন তিতি বাবাকে ছোঁয়নি। খুব মনখারাপ হয়ে গেল। তিতি ভাবে, কেন এমন হয় না, আমি, মা, বাবা, আমরা সকলে দূরে কোনো নদীর ধারে বেড়াতে গেছি। ছোট্ট ভাইটা সবে হাঁটতে শিখেছে। বাংলোর লনে হাঁটতে-হাঁটতে পড়ে যাচ্ছে সে। আর আমি তার হাত ধরে তাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে ঘাসফড়িং দেখাচ্ছি, প্রজাপতি চেনাচ্ছি। ফুলে হাত দিতে নেই বলে নিষেধও করছি মাঝে-মাঝে। মা-বাবা বাংলোর বারান্দায় চেয়ারে আমাদের দেখছেন, আর হাসছেন। দূরে নদীর জলে অনেক লাল রং ছড়িয়ে সূর্য ডূবে যাচ্ছে। কেন এমন হয় না, এমন হয় না কেন?

মন খারাপ করে বসে রইল তিতি। সকলের তো সবকিছু হয় না। যেমন পিয়ালির বাড়িতে এত যন্ত্র নেই, কম্পিউটার গেম নেই, এত একলা থাকতে হয় না পিয়ালিকে। যেমন তার ভাই নেই, বাবা-মাকে কাছে পায় না, কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না তাদের। সকলেরই জীবনে ‘নেই’ আছে।

চুপচাপ বসে ছিল তিতি। এমন সময় দরজা খোলার শব্দ হল। মার কাছেও চাবি থাকে। তাই মা এলে তিতিকে উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হয় না। মা নিজেই দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন। তিতি ভাবল, মা এসেছেন।

দরজা খুলে প্রথমে ঢুকলেন বাবা, তারপর মা। ড্রাইভারকাকু কী একটা বড়ো মোড়ক নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বাবা তিতির পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘একা-একা মন খারাপ করছিল তো মাম? এই দ্যাখো, তোমার জন্যে বন্ধু এনেছি।’

তিতি ভাবল, এত বড়ো মোড়কে বন্ধু তা হলে রোবট-নাকি? সত্যিই তাই। প্যাকেট খোলা হল। তিতির সমান লম্বা একটা রোবট। বাবা বললেন, ‘এর নাম ‘রোবটিকা’। জানো মাম, আজ থেকে রোবটিকা আমাদের বাড়িতে থাকবে। তোমার সব কাজ করে দেবে। তোমার সঙ্গে ভিডিও গেম খেলবে, তোমার পড়া বলে দেবে। কেমন, খুব মজা হবে না মাম?’

বাবার একটা হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল তিতি। বাবার শরীরের উত্তাপ পেতে-পেতে মনে-মনে বলল, ‘বাবা, তুমি পিয়ালির বাবার মতো হতে পারো না? আমাকে মুনুমা বলে ডাকতে পারো না বাবা? আমাদের গোটা বাড়িটায় যে শুধুই যন্ত্রের গন্ধ একদম ভালো লাগে না বাবা।’

মাও জামা-প্যান্ট ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাবা রোবটটা চালিয়ে দিতেই হাঁটতে শুরু করল। মেঝের ওপর হাঁটতে লাগল থপথপ করে, অনেকটা সেই ই. টি. সিনেমার ভিন গ্রহের প্রাণীটার মতো। হেঁটে গিয়ে বইয়ের ডেস্কটা সুন্দর করে গুছিয়ে দিল তিতির। তারপর চুপচাপ এসে দাঁড়িয়ে রইল আদেশের অপেক্ষায়। মা বললেন, ‘দ্যাখো মাম, বেশ মজার, না? তোমার বাবা অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে এনেছেন এই রোবটিকাকে। নামটাও বেশ, রোবটিকা, বল?’

তিতি বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে-মনে ভাবল, এর চেয়ে একটা বেড়ালও ঢের ভালো ছিল। ছোট্ট পুষিটার সঙ্গে খেলে-খেলে সময়টা কেটে যেত তিতির।

এর পর বাবা সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন তিতিকে। রোবটিকা কেমন করে দরজা খুলে দেবে, পড়া বলে দেবে, ওর সঙ্গে ভিডিও গেম খেলবে, সব।

তিতি আর কিছু দেখল না। ও দেখে, বুঝে লাভ কী? রোবটিকা দিয়ে তার কী হবে? তার চেয়ে এই যেটুকু সময় বাবাকে কাছে পাচ্ছে, বাবার শরীরের উত্তাপ পাচ্ছে, এই তো ঢের।

সেদিন রাত্রে ছোট্ট খাটে শুয়ে তিতি স্বপ্ন দেখল। সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন। সে এক আজব পৃথিবী। গাছ নেই, ফুল নেই, নদী নেই, বন নেই পাহাড় নেই। শুধু যন্ত্র আর যন্ত্র। এমনকী, একটাও মানুষ নেই। সেখানে বোতাম টিপলে বৃষ্টি হয়, সূর্য ওঠে। আর সেই অদ্ভুত পৃথিবীতে তিতি একা, কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সবশেষে কেঁদেই ফেলল তিতি।

ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কাঁদতে দেখে পাশের খাট থেকে উঠে এলেন মা। তিতিও জেগে উঠেছে। একদম ঘেমে গেছে তিতি।

পরের দিন থেকে বাবা আবার চলে গেলেন তাঁর কাজে। মা অফিস-মিটিংয়ে ব্যস্ত। তিতি স্কুল আর বাড়ি। বাড়িতে রোবটিকা থেকে গেল। রোবটিকা রোবটিকার মতোই থাকে। তিতি থাকে তিতির মতো। রোবটিকা নামটাও তিতির একদম পছন্দ নয়। আর ওই নামে না ডাকলে নাকি সাড়াও দেবে না রোবটিকা। তাই তিতি যেমন একলা ছিল তেমন একাই।

স্কুল থেকে ফিরলে রোবটিকা দরজা খুলে দেয়। ব্যাস, ওইটুকুই। তিতি আগের মতোই নিজে খাবার নিয়ে খায়, ডেসকে বই গুছিয়ে রাখে, একা-একা পুতুল নিয়ে রান্নাবাটি খেলে, এক্কাদোক্কা খেলে। রোবাটিকার থাকা না-থাকা দুটোই সমান তিতির কাছে।

মা অফিস থেকে ফিরে দু-একদিন বলেছেন, ‘মাম, তুমি রোবটিকার সঙ্গে মেশো না কেন? ও তো তোমার বন্ধু হওয়ার জন্যেই তৈরি হয়েছে?’

তিতি মায়ের কথা বুঝতে পারে না। ওভাবে কি কেউ কারও বন্ধু হয়? পিয়ালির সঙ্গে তিতির বন্ধুত্ব হবে বলেই কী পিয়ালি এসেছে পৃথিবীতে? বন্ধু হয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে না। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, বন্ধু হয়ে ওঠে।

উত্তরে তিতি মাকে বলেছে, ‘আমার কোনো কষ্ট হয় না। বেশ ভালো আমার একা-একা খেলা।’

একদিন দূর থেকে বাবা মাকে টেলিফোন করেছিলেন। তিতি পাশের ঘর থেকে শুনেছে। বাবা জানতে চেয়েছিলেন রোবটিকার সঙ্গে তিতির বন্ধুত্ব হয়েছে কি না। উত্তরে মা বলেছিলেন, ‘সেই নিয়েই তো ভাবনা। ওরা দুজনে আলাদা-আলাদা থাকে। মাম মনে হয় রোবটিকাকে মানিয়ে নিতে পারছে না।’

তিতি একদিন একটা পুতুলকে সাজাতে বসেছে। আপনমনে পুতুলের সঙ্গে কথাও বলে চলেছে। হঠাৎ মনে হল, তার ইতি নামে কোনো বন্ধু থাকলে বেশ হত! তিতির বন্ধু ইতি। পিয়ালির নামটাই বদলে এবার থেকে ইতি রাখলে কেমন হয়?

এমন সময় পুতুলের জামার দরকার পড়ল তিতির। জামাটা তো সেই বারান্দার কোণে কাগজের বাক্সের মধ্যে। পুতুলটাকে এমনভাবে সাজিয়েছে, হাত থেকে ছেড়ে দিলে আবার সব খুলে যাবে। আঠার টিউবটাও বারান্দায়। নিজের ওপর খুব বিরক্ত হল তিতি। এত ভুলোমন হলে এই হয়। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বসলেই তো হত।

হঠাৎ রোবটিকার দিকে তাকিয়ে বলল তিতি, ‘এই ইতি, বারান্দা থেকে পুতুলের জামাটা এনে দে না।’

বলেই অবাক হয়ে দেখল তিতি, রোবটটা সত্যিই হেঁটে গিয়ে বারান্দা থেকে পুতুলের জামাটা এনে দিল তিতিকে। খুব ভালো লাগল তিতির। আর রোবটিকা নয়, ওকে এবার থেকে ইতি বলেই ডাকবে। তবে যে বাবা বলেছিলেন, ‘রোবটিকা নামে না ডাকলে ও সাড়া দেবে না।’ সে যাকগে। ইতি, আজ থেকে ও ইতিই।

একদিন রান্নাবাটি খেলার সময় জল এনে দিতে বলল ইতিকে। তিতি বলল, ‘দেখিস ইতি, মেঝেয় জল ফেলিস না যেন। মা তা হলে বকবে।’

রোবটটা জল এনে দিল।

দেখতে-দেখতে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল ইতির সঙ্গে। তিতি যখন পড়তে বসে, ইতি পেনসিল কেটে দেয়, দরকার পড়লে বই এনে দেয় ডেসক থেকে। রুটিন বলে দেয়। কোনোদিন কী পড়া আছে, তাও মনে করিয়ে দেয় ইতি। এসব দেখে মা ভীষণ খুশি। সে-কথা একদিন ফোনে বাবাকে বলেছেন মা, তিতি শুনেছে।

তিতি সেদিন ইতিকে বলেছে, ‘দ্যাখ ইতি, আমরা রোজ বিকেলে দুজনে খেলব এক্কাদোক্কা, রান্নাবাটি। পুতুল সাজাব মাকে বলে দিস না যেন!’

ইতির দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে তিতি বুঝেছে, ইতি মাকে বলবে না।

সেদিন বাথরুমে পড়ে গেল তিতি জল আনতে গিয়ে। ওর পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে ইতি গিয়ে হাজির বাথরুমে। তিতির হাঁটুতে চোট লেগেছে দেখে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে লাগিয়ে দিয়েছে ইতি। আসলে ইতিও ভালোবেসে ফেলেছে তিতিকে। তিতি ভাবে, ইতিটা আসলে রোবট না, বন্ধু আমার মিষ্টি বন্ধু! ঘরে এখন তিতি আগের মতো যন্ত্রের অত তীব্র গন্ধও পায় না। সেই বিশ্রী গন্ধটা আর নেই।

কাল তিতি আর ইতি চকখড়ি দিয়ে মেঝেতে দাগ কেটে এক্কাদোক্কা খেলছিল। এরকম অনেক দিন খেলেছে। হঠাৎ বিকেলে মা অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলে ঢুকেই দেখেন, ইতি আর তিতি খেলছে। তখন আবার ইতিরই খেলার পালা। এক পা তুলে লাফিয়ে-লাফিয়ে খেলছিল ইতি। মাকে দেখে ও থমকে গেল। মার দুচোখ জুড়ে বিস্ময়। এ কী করে সম্ভব?

তিতি দেখল, মা কেমন দিশেহারা হয়ে গেলেন। ছুটে গিয়ে বাবাকে দিল্লিতে ফোন করলেন।

মা ফোনে চেঁচিয়ে কথা বলছেন, ‘তুমি আজই চলে এসো। আমি বাড়ি ফিরে দেখলাম তিতির সঙ্গে রোবটিকা এক্কাদোক্কা খেলছে। এ কী করে সম্ভব? তুমি এক্ষুনি চলে এসো।’

বাবা চলে এলেন রাত দশটার মধ্যে। তিতিকে কাছে ডেকে আদর করে জানতে চাইলেন, ‘রোবটিকা তোমার বন্ধু?’

তিতি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। ওর নাম রোবটিকা নয়, ইতি। দ্যাখো বাবা, তুমি ওকে ইতি বলে ডাকো, ও কাছে আসবে।’

বাবা ইতি বলে ডাকতেই, সত্যি-সত্যি কাছে এসে দাঁড়াল ইতি।

বাবা উঠে গিয়ে আমেরিকায় ফোন করলেন ব্যস্ত হয়ে। বাবার ফোনে চাপা স্বরের কথা এ-ঘর থেকে শুনতে পেল না তিতি। শুধু এটুকু শুনল তিতি, বাবা কাল ইতিকে নিয়ে চলে যাবেন আমেরিকায়। ওর কোনো একটা যন্ত্র নাকি খারাপ হয়ে গেছে, সারানো দরকার।

তারপর বাবা এ-ঘরে এসে ইতিকে ভরে ফেললেন প্যাকেটে। তিতি অনেক করে বলল, ‘বাবা, ওর তো কোনো দোষ নেই। আমিই তো ওকে এক্কাদোক্কা খেলতে ডেকেছিলাম। ইতি যে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে বাবা। আমাকে এখন আর একলা থাকতে হয় না বাড়িতে।’

তিতির কোনো কথাই বাবার কানে ঢুকল না। খাওয়ার পর তিতিকে তার ছোটো খাটে শুইয়ে বাবা ঘুম পাড়াতে-পাড়াতে বললেন, ‘আমি আবার নিয়ে আসব ওকে মাম। একদিনেই সারানো হয়ে যাবে।’

তিতি ঘুমিয়ে যেতে বাবা ঘুমোতে গেলেন। মাও কাজ সেরে চলে এলেন। তিতি কিন্তু সত্যি-সত্যি অনেকক্ষণ ঘুমোল না। খুব কাঁদল তিতি, একা-একা। কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তিতি নিজেও জানে না।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেতে বাবা তিতির খাটের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। পাশের ঘর থেকে প্যাকেট খুলে বেরিয়ে এসে ইতি বসে আছে তিতির মাথার পাশে। একটা হাত তিতির কপালে।

বাবা ধড়ফড় করে উঠে গিয়ে দেখলেন, জ্বরে তিতির গা পুড়ে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *