তিতাস একটি নদীর নাম (উপন্যাস) – অদ্বৈত মল্লবর্মণ
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।
স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায় ; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।
মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভিষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।
তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।
কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারিদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোঘল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে–উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের তক্তের হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুখাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ্ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটি নদী।
তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই।
ঝরণা থেকে জল টানিয়া, পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনোকালে সে পায় নাই। অসীম সাগরের বিরাট চুম্বনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনোকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোন্কালে কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল; বাঁ তীরটা একটু মচ্কাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি খুঁজিয়া, কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে। এক পাকে শতশত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল অনেক মাঠ-ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে–মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়। এই তার ইতিহাস। কিন্তু সে কি আজকের কথা? কেউ মনেও করে না কিসে তার উৎপত্তি হইল। শুধু জানে সে একটি নদী। অনেক দূর-পাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমনীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক–কিন্তু কাঁকনের মতই তার বলয়াকৃতি।
অনেক নদী আছে বর্ষার অকুণ্ঠ প্লাবনে ডুবিয়া তারা নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পারের কোনো হদিস থাকে না, সবদিক একাকার । কেউ তখন বলিতে পারে না এখানে একটা নদী ছিল । সুদিনে আবার তাদের উপর বাঁশের সাঁকোর বাঁধ পড়ে । ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়িরা পর্যন্ত একখানা বাঁশে হাত রাখিয়া আর একখানা বাঁশে পা টিপিয়া টিপিয়া পার হইয়া যায় । ছেলে-কোলে নারীরাও যাইতে পারে । নৌকাগুলি অচল হয় । মাঝিরা কোমরে দড়ি বাঁধিয়া সেগুলিকে টানিয়া নেয় । এপারে ওপারে ক্ষেত । চাষীরা দিনের রোদে তাতিয়া কাজ করে । এপারের চাষী ওপারের জনকে ডাকিয়া ঘরের খবর জিজ্ঞাসা করে । এপারের চাষী ঘাম মুছিয়া জবাব দেয় । গরুগুলি নামিয়া স্নান করিতে চেষ্টা করে । অবগাহন স্নান । কিন্তু গা ডোবে না । কাক- স্নান করা মাত্র সম্ভব হয় কোন রকমে । নারীরা কোমরজলে গা ডুবাইবার চেষ্টায় উবু হয় । দুই হাতে ঢেউ তুলিয়া নীচু–করা ঘাড়ে-পিঠে জল দিয়া স্নানের কাজ শেষ করে । শিশুদের ডুবিবার ভয় নাই বলিয়া মায়েরা তাদের জলে ছাড়িয়া দিয়াও নিরুদ্বেগে বাসন মাজে, কাপড় কাচে, আর এক পয়সা দামের কার্বলিক সাবানে পা ঘসে । অল্প দূরে ঘর । পুরুষমানুষে ডাক দিলে এখান হইতে শোনা যাইবে; তাই ব্যাস্ততা নাই ।
কিন্তু সত্যি কি ব্যাস্ততা নাই ? যে-মানুষটা এক-গা ঘাম লইয়া ক্ষেতে কাজ করিয়া বাড়ি গেল, তার ভাত বাড়িয়া দিবার লোকের মনে ব্যাস্ততা থাকিবেইত । দুপুরে নারীরা ঘাটে বেশি দেরি করে না । কিন্তু সকালে সন্ধ্যায় দেরি করে । পুরুষেরা এজন্য কিছু বলে না । তারা জানে এ নদী দিয়া কোনো সদাগরের নৌকা আসা- যাওয়া নাই ।
শীতে বড় কষ্ট । গম্ গম্ করিয়া জলে নামিতে পারে না । জল খুব কম । সারা গা তো ডোবেই না; কোমর অবধিও ডোবে না । শীতের কন্ কনে ঠাণ্ডা জলে হুম্ করিয়া ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিবার উপায় নাই; একটু একটু করিয়া শরীর ভিজে । মনে হয় একটু একটু করিয়া শরীরের মাংসের ভিতর ছুরি চালাইতেছে কেউ । চৈত্রের শেষে খরায় খাঁ খাঁ করে । এতদিন যে জলটুক্ অবশিষ্ট ছিল, তাও একটু একটু করিয়া শুষিতে শুষিতে একদিন নিঃশেষ হইয়া যায় । ঘামের গা ধুইবার আর উপায় থাকে না । গরুরা জল খাইতে ভুল করিয়া আসিয়া ভাবনায় কাতর হয় । মাঘের মাঝামাঝি সরষে ফুলে আর কড়াই-মটরের সবুজিমায় দুই পারে নকসা করা ছিল । নদীতেও ছিল একটু জল । জেলেরা তিন-কোণা ঠেলা-জাল ঠেলিয়া চাঁদা পুঁটি টেংরা কিছু-কিছু পাইত । কিন্তু চৈত্রের খরায় এ সবের কিছুই থাকে না । মনে হয় মাঘমাসটা ছিল একটা স্বপ্ন । চারিদিক ধু-ধু করা রুক্ষতায় কাতরায় । লোকে বিচলিত হয় না । জানে তারা , এ সময় এমন হয় ।
তিতাসের তেরো মাইল দূরে এমনি একটা নদী আছে । নাম বিজয় নদী । তিতাসের পারের জেলেদের অনেক কুটুম বিজয় নদীর পারের পাড়াগুলিতে আছে । তিতাসের পারের ওরা ওই নদীর পারের কুটুম-বাড়িতে অনেকবার বেড়াইতে গিয়াছে । বিয়ের কনের খোঁজে গিয়াছে । সে-সব গাঁয়ে তারা দেখিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় । একদিক দিয়া জল শুকায় আর একদিক দিয়া মাছেরা দমবন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় নাক জাগাইয়া হাঁপায় । মাছেদের মত জেলেদেরও তখন দম বন্ধ হইতে থাকে । সামনে মহাকালের শুষ্ক এক কঙ্কালের ছায়া দেখিয়া তারা একসময় হতাশ হইয়া পড়ে । যারা বর্ষার সময় চাঁদপুরের বড় গাঙ্ এ নৌকা লইয়া প্রবাস বাহিতে গিয়াছিল, তারা সেখানে নিকারীর জিম্মায় নাও জাল রাখিয়া রেলে চড়িয়া আসিয়া পড়ে । তাদের কোন চিন্তা থাকে না । হাতের টাকা ভাঙিয়া এই দুর্দিন পার করে । কিন্তু যারা বর্ষায় ঘরের মায়া ছাড়িয়া বাহির হয় নাই তারাই পড়ে বিপদে । নদী ঠন্ ঠনে । জাল ফেলিবে কোথায় । তিন-কোণা ঠেলা-জাল কাঁধে ফেলিয়া আর-এক কাঁধে গলা-চিপা ডোলা বাঁধিয়া এ-পাড়া সে-পাড়ায় টই-টই করিয়া ঘুরিতে থাকে, কোথায় পানা পুকুর আছে মালিক হীন ছাড়া বাড়িতে । চার পারে বন বাদাড়ের ঝুপড়ি । তারই ঝরাপাতা পড়িয়া, পচিয়া, ভারি হইয়া তলায় শায়িত আছে । তারই উপর দিয়া ভাসিয়া উঠিয়া ছোট মাছেরা ফুট দেয় । গলা-জল শুকাইয়া কোমর-জল, কোমর-জল শুকাইয়া হাঁটু-জল হইয়াছে । মাছেদের ভাবনার অন্ত নাই । কিন্তু অধিক ভাবিতে হয় না । গোপালকাছা-দেওয়া দীর্ঘাকার মালো কাঁধের জল নামাইয়া শুন্য-দৃষ্টিতে তাকাইতে তাকাইতে এক সময় খেউ দিয়া তুলিয়া ফেলে । মাছেদের ভাবনা এখানেই শেষ হয়, কিন্তু মাছ যারা ধরিল তাদের ভাবনার আর শেষ হয় না । তাদের ভাবনা আরও সুদূর-প্রসারী । সামনের বর্ষাকাল পর্যন্ত ।
বর্ষাকালের আর খুব বেশি দেরি নাই । সঙ্কট অবসানের সম্ভাবনায় অনেক মালো উদ্বেগের পাহাড় ঠেলিয়া চলিয়াছে, হাতে ঠেলা-জাল লইয়া চুনো-পুঁটি যা পায় ধরিয়া পোয়া দেড়-পোয়া চাউলের যোগাড় করিতেছে । কিন্তু গৌরাঙ্গ মালোর দিন আর চলিতে চায় না । একদিন অনেক খানাডোবায় খেউ দিয়া কিছুই পাইল না, নামিলে টগবগ করিয়া পচা জলের ভুরভুরি উঠে, আর খেউ দিলে তিনচারিটা ব্যাঙ্ জাল হইতে লাফাইয়া এদিকে ওদিকে পড়িয়া যায় ।
উঠানের একদিকে একটা ডালিম গাছ । পাতা শুকাইয়া গিয়াছে । গৌরাঙ্গসুন্দরের বউ লাগাইয়াছিল । বউ যৌবন থাকিতেই শুখাইয়া গিয়াছিল । গাল বসিয়া, বুক দড়ির মত সরু হইয়া গিয়াছিল । বুকের স্তনদুটি বুকেই বসিয়া গিয়াছিল তার । তারপর একদিন সে মরিয়া গিয়াছিল । সে মরিয়া গিয়া গৌরাঙ্গকে বাঁচাইয়াছে । তার কথা গৌরাঙ্গসুন্দরের আর মনে পড়ে না । তারই মত শুকাইয়া-যাওয়া তারই হাতের ডালিম গাছটা চোখে পড়িতে আজ মনে পড়িয়া গেল । উঃ, বউটা মরিয়া কি ভালই না করিয়াছে ! থাকিলে, আজ তার অবস্থা হইত ঠিক নিত্যানন্দদাদার মত ।
নিত্যানন্দ থাকে উত্তরের ঘরে । তার বউ আছে । আর আছে একটি ছেলে, একটি মেয়ে । নিত্যানন্দ-পরিবারের দিকে চাহিয়া গৌরাঙ্গ শিহরিয়া উঠে ! একপেটের ভাবনা নিয়াই বাঁচি না, দাদা চারিটা পেটের ভাবনা মাথায় করিয়া কেমন তামাক খাইতেছে । তার যেন কোন ভাবনাই নাই ।
সত্যি নিত্যানন্দের আর কোন ভাবনা নাই । যতই ভাবিয়াছে, দেখিয়াছে কোন কূল-কিনারা পাওয়া যায় না । বৌ ঝিমাইতেছে । ছেলেমেয়ে দুইটা নেতাইয়া পড়িয়া কিসের নির্ভরতায় অক্ষম নিত্যানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া আছে । আর নিত্যানন্দ কোন উপায় না দেখিয়া কেবল তামাক টানিতেছে ।
পশ্চিমের ভিটায় গৌরাঙ্গসুন্দরের ঘর । ডালিম গাছে কাঁধের জাল ঠেকাইয়া দিয়া ডোলাটা ছুঁড়িয়া ফেলিল দাওয়ার একদিকে । দক্ষিণ ও পূর্বদিকের ভিটা খালি । তাদের দুই কাকা থাকিত । এক কাকা মরিয়া গিয়াছে এবং তার ঘর বেচিয়া তার শ্রাদ্ধ করিতে হইয়াছে । আরেক কাকা ঘর ভাঙিয়া লইয়া আরেক গাঁয়ে ছাড়িয়া গিয়াছে ।
গৌরাঙ্গ অকারণে খেঁকাইয়া উঠিল, ‘খালি তামুক খাইলে পেত ভরব ?’
‘কি খামু তবে ?’
না, লোকটার কেবল পেটই শুকায় নাই । মাথাও শুকাইয়া গিয়াছে ।
‘চল যাই বুধাইর বাড়ি ।’
নয়ানপুরে বোধাই মালো টাকায় সব মালোদের চেয়ে বড় । বাড়িতে চার পাঁচটা ঢেউটিনের ঘর । দুই ছেলে রোজগারী লোক । বোধাই হাতীর মত মোটা ও কাল । শরীরেও হাতীর মত জোর । তার কারবার অন্য ধরণের । বড় বড় দীঘি ইজারা নিয়া মাছের পোনা ফেলে । মাছ বাড়িতে থাকে, আর তারা তিন বাপ বেটায় লোকজন লইয়া জাল ফেলে, মাছ তোলে, মাছ চালান দেয় । এ কাজে বোধাই অনেক লোকজন খাটায় । নদীতে জল না থাকিলে, মালোরা যখন দুই চোখে অন্ধকার দেখে তখন তারা যায় বোধাইর বাড়িতে ।
কিন্তু তিতাসে কত জল ! কত স্রোত ! কত নৌকা ! সব দিক দিয়াই সে অকৃপণ ।
আর বিজয়-নদীর তীরে-তীরে যে-মালোরা ঘর বাঁধিয়া আছে, তাদের কত কষ্ট । নদী শুকাইয়া গেলে তাদের নৌকা-গুলি অচল হইয়া থাকে আর কাঠ-ফাটা রোদে কেবল ফাটে ।
তিতাস-তীরের মালোরা যারা সেখানে বেড়াইতে গিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় দেখিয়া আসিয়াছে । রিক্ত মাঠের বুকে ঘূর্ণির বুভুক্ষা দেখিতে দেখিতে ফিরতি-পথে তারা অনেকবার ভাবিয়াছে, তিতাস যদি কোনোদিন এই রকম করিয়া শুকাইয়া যায় ! ভাবিয়াছে এর আগেই হয়ত তাদের বুক শুকাইয়া যাইবে , ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ পাশের জনকে নিতান্ত খাপছাড়াভাবে বলিয়াছেঃ ‘বিজ্ নার পারের মালোগুষ্টি বড় অভাগা রে ভাই, বড় অভাগা !’
যারা বিজয় নদীর দশা দেখে নাই, বছরের পর বছর কেবল তিতাসের তীরেই বাস করিয়াছে, তারা এমন করিয়া ভাবে না । তারা ভাবে তিন-কোণা ঠেলা-জাল আবার একটা জাল ! তারে হাঁটু-জলে ঠেলিতে হয়, উঠে চিংড়ির বাচ্ছা । হাত তিনেক তো মোটে লম্বা । বিজয়ের বুকে তা-ই ডোবে না । তিতাসের জলে কত বড় বড় জাল ফেলিয়া তারা কত রকমের মাছ ধরে । এখানে যদি তিতাস নদী না থাকিত, বিজয় নদী থাকিত, তবে নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেই রকম অবস্থা হইত । ওদের মতো থেলা-জাল ঘাড়ে করিয়া গ্রামগ্রামান্তরের খানা-ডোবা খুঁজিয়া মরিতে হইত দুই আনা এর দশ পয়সার মোরলা ধরিবার জন্য ।
জেলেদের বউ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা – বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে । যে-সব নদীর নাম মেঘনা এর পদ্মা । কি ভীষণ ! পাড় ভাঙ্গে । নৌকা ডোবায় । কি ঢেউ । কি গহীন জল । চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে ! কত কুমীর আছে সে-সব নদীতে । তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন । রাতে-বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে । এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া ! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া ! তিতাস কত শান্ত । তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামীপুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না । বৌরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্ত-মনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে ।
বাংলার বুকে জটার মতো নদীর প্যাঁচ । শাদা, ঢেউ-তোলা জটা । কোন্ মহাস্থবিরের চুম্বন-রস-সিক্ত বাংলা । তার জটাগুলি তার বুকের তারুণ্যের উপর দিয়া সাপ-খেলানো জটিলতা জাগাইয়া নিম্নাঙ্গের দিকে সরিয়া পড়িয়াছে । এ সবই নদী ।
সবগুলি নদীর রূপ এক নয় । উহাদের ব্যবহার এবং উহাদের সহিত ব্যবহার তাও বিভিন্ন রকমের । সবগুলি নদীই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কাজে আসে । কিন্তু এ কাজে আসার নানা ব্যতিক্রম আছে । বড় নদীতে সওদাগরের নৌকা আসে পাল উড়াইয়া । উহার বিশাল বুকে জেলেরা সারাদিন নৌকা লইয়া ভাসিয়া থাকে । নৌকায় রাঁধে, খায়, ঘুমাইয়া থাকে । মাছ ধরে । সব বিষয়ে একটা কোঠর রূপ এখানে প্রকটিত । তীরে তীরে বালুচর, তাল নারিকেল সুপারির বাগ । স্রোতের খরায় তীরের মাটি কাটে, ধ্বসে । ঢেউয়ের আঘাতে তীরগুলি ভাঙিয়া খসিয়া পড়ে । গৃহস্থালি ভাঙ্গে । ক্ষেত খামার ভাঙ্গে, তাল-নারিকেল, সুপারির গাছগুলি সারি বাঁধিয়া ভাঙিয়া পড়ে । ক্ষমা নাই । ভাঙ্গাগড়ার এক রুদ্র দোলার দোলনায় করাল এক চিত্তচঞ্চল ক্ষিপ্ত আনন্দ । সে-ই এক ধরণের শিল্প ।
শিল্পের আরেকটা দিক আছে । সৌম্য শান্ত করুণ স্নিগ্ধ প্রসাদগুণের মাধুর্যে রঞ্জিত এ শিল্প । এ শিল্পের শিল্পী মহাকালের তাণ্ডবনৃত্য আঁকিতে পারে না । পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না । এ শিল্পের শিল্পী মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করিয়াছে ।
এ-শিল্পী যে-ছবি আঁকে তা বড় মনোরম । তীর-ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট শিল্পী । তারপর জমি । তাতে অঘ্রাণ মাসে পাকা ধানের মৌসুম । মাঘ মাসে সর্ষেফুলের অজস্র হাসি । তারপর পল্লী । ঘাটের পর ঘাট । সে ঘাটে জীবন্ত ছবি । মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে । বৌ-ঝিরা সব কলসী লইয়া ডুব দেয় । পরক্ষণে ভাসিয়া উঠে । অল্প দূর দিয়া নৌকা যায়, একের পর এক । কোনটাতে ছই থাকে, কোনটাতে থাকে না । কোনো কোনো সময় ছইয়ের ভিতর নয়া বউ থাকে । বাপের বাড়ি থেকে স্বামী তার বাড়িতে লইয়া যায়; তখন ছইয়ের এ-পারে ও-পারে থাকে বউয়ের শাড়ি-কাপড়ের বেড়া । স্বামীর বাড়ি থেকে যখন বাপের বাড়িতে যায়, তখন কিন্তু কাপড়ের বেড়া থাকে না । থাকে না তার মাথায় ঘোমটা । ছইয়ের বাহিরে বসিয়া ঘাটগুলির দিকে চাহিয়া থাকে সে । স্বামীর বাড়ির ঘাট অদৃশ্য না হইলে কিন্তু সে ছইয়ের বাহিরে আসে না ।
তারা স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যায় অনেক হাসি-কান্নার ঢেউ বুকে লইয়া । যে বৌ স্বামীর বাড়ি যায়, তার এক চোখে প্রজাপতি নাচে, আরেক চোখে থাকে জল । এরা সব ভিন্ জাতের বৌ । বামুন, কায়েত, নানা জাতের । জেলেদের বৌরা জেলে-নৌকাতেই যায় । তারা অত সুন্দরীও নয় । অত তাদের আবরুরও দরকার হয় না । কিন্তু ওরা খুব সুন্দরী । জেলের ছেলেরা কপালের দোষ দেয় । অমন সুন্দর বৌ তাদের জীবনে কোনদিন আসিবে না । ভালো করিয়া চায় তারা । ভালো করিয়া চাহিতে পারিলে প্রায়ই ছইয়ের ফাঁক দিয়া, বাতাসে শাড়িটা একটু সরিয়া গেলে, চকিতে তারই ফাঁক দিয়া, টুকটুকে একখানা মুখ আর এক জোড়া চোখ চোখে পড়িবে । বৌয়ের অভিভাবক ছইয়ের দুই মুখে গুঁজিয়া দিয়াছে শাড়ির বেড়া; তাতে বৌকে সকলে দেখিতে পারে না, কিন্তু বৌ সকলকে দেখিতে পায় । তিতাসের জলে অনেক মাছ । মালোর ছেলের স্ফূর্তি রসাইয়া উঠে । জালের দিকে চোখ রাখিয়াই গাহিয়া উঠে, ‘আগে ছিলাম ব্রাহ্মণের মাইয়া করতাম শিবের পূজা, জালুয়ার সনে কইরা প্রেম কাটি শণের সুতা রে, নছিবে এই ছিল ।’ বৌ ঠিক শুনিতে পাইবে ।
গ্রামের পর গ্রাম । নৌকাখানা সেখানে ঢুকিয়া পড়ে । সাপের জিহবার মত চকিতে সে-খাল গ্রামখানাকে ঘুরিয়া কোথায় পলাইয়া গিয়াছে । হয়ত আরো দূরে গিয়াছে । আরো কয়েকখানি গ্রামের পাশ দিয়া জের টানিতে টানিতে গিয়া, তারই কোনটাতে বৌকে লইয়া যাইবে । খালের পাড়েই বাড়ি । ছোট্ট ছেলে-পিলেরা তৈরি হইয়া আছে, বৌকে কি করিয়া চমকাইয়া দিবে । তৈরি হইয়া আছে হয়ত আরও কেউ । খালটা এইখানে শুকাইয়া গিয়াছে । এইখানে নৌকা হইতে উঠিয়া বৌকে খানিকটা হাটিয়া যাইতে হইবে । শিল্পী শান্ত সবুজ সুন্দর রঙে ক্ষেতগুলির বুকে-বুকে যে নক্সা আঁকিয়া রাখিয়াছে তাহারই আল দিয়া বৌকে হাটিতে হইবে । তিতাসের তীরে না থাকার কি কষ্ট । যে-বউয়ের যাওয়ার বাড়ি একেবারে তিতাসের তীরে, কর্ম-চঞ্চল ঘাটখানাতে তার নৌকা লাগে । দশ-জোড়া নারীর চোখের দবদে স্নান করিয়া সে বৌ নৌকা থেকে নামে । তারপর বাপের বাড়ি হইলে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট ভাইবোনদের বুকে চাপিয়া ধরে । আর স্বামীর বাড়ি হইলে পিঠের কাপড় সুদ্ধ টানিয়া তুলিয়া ঘোমটা বড় করে, তারপর আগে-পিছে দুই-চারিজন নারীর মাঝখানে থাকিয়া ধীরে ধীরে জড়িত পায়ে ঘাটের পথটুকু অতিক্রম করে ।
পথটুকু অতিক্রম করিয়া জমিলা বাহির-বাড়ির মসজিদ-লগ্ন মক্তবের কোণে পা দিয়া একবার পিছন ফিরিয়া চাহিল । তার স্বামী মাঝির সঙ্গে তখনও কেরায়া নিয়া দরদস্তর করিতেছে । দুই-এক আনা ফেলিয়া দিলেই মাঝি খুশি হইয়া চলিয়া যায় । বুড়া মাঝি । যা খাটিয়াছে ! সঙ্গে মাত্র দুই ননদ । তাও ননদের ছোট সংস্করণ ! সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে । ভয় করে না বুঝি ! লোকটা যেন কি ! তাদের আসিতে বলিয়া নিজে আসিতেছে না । বাড়ির পথে বড় বড় ঘাস । সাপ বাহির হইয়াছে হইত । ব্যাঙ্ মনে করিয়া এখনই জমিলার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে যদি ছোবল দেয় !
ছমির মিয়া হিসাবী লোক । কাউকে এক পয়সা ঠকায় না । বেহুদা কাউকে এক পয়সা বেশিও দেয় না । সব কাজ ওজন করিয়া করে । মাঝি হাত মানিয়া নৌকায় গিয়া উঠিলে, ছমিরের মনে অনাহূত এক ছোপ প্রসন্নতা রঙ গুলাইয়া দিল । আজ তার কিসের রাত ! এ রাতে কেউ কোন দিন মাঝিকে ঠকায় ! কেউ যেন না ঠকায় !
মাঝি দশ মিনিট ঝগড়া করিয়া যাহা পায় নাই, এক মিনিট চুপ করিয়া তাহার চারিগুণ পাইল ! চক্ চকে সিকিটা শাদা নদীর খোলসা অল্প আলোকে ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া লগিতে ঠেলা দিল ।
ছমির কাছে আসিলে জমিলার মনে হইল – এতক্ষণ এতগুলি সাপ তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটিকে ঘিরিয়া কিল্ বিল্ করিতেছিল, এখন সব কয়টা সরিয়া পড়িয়াছে । কি ভাল তার মানুষটি !
কিন্তু তার চাইতেও ভাল একজনকে দেখিয়া আসিয়াছে সেই মালোপাড়ার ঘাটে । বড় ভাল লাগিয়াছে তার মানুষটাকে । প্রথম দৃষ্টিতেই সে তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে, সেও কি তেমনি ভালবাসে নাই ? কেমন অনুরাগের ভরে চাহিয়াছিল । আর কেমন মানুষ গো ! একবার দেখিয়াই মনে হইল যেন কতবার দেখিয়াছি । বেলা ফুরাইতেছে । একটু একটু বাতাস বহিতেছে । আর সেই বাতাসে আমার শাড়ির বেড়া খুলিয়া গেল, আর তখনই তাকে আমি দেখিতে পাইলাম । যদি না খুলিত, তবে ত দেখিতেই পাইতাম না । এমনই কত লোককে যে আমরা দেখিতে পাই না । অথচ দেখিতে পাইলে এমনি করিয়া আপন হইয়া যাইত । আমরা কি আর দেখি ? যে দেখাইবার, সে-ই দেখায় ! তা না হইলে সে যখন জলে ঢেউ খেলাইয়া কলসী ডুবাইল, ঠিক সেই সময়ে আমার শাড়ির বাঁধন খুলিল কেন ? বর্ষায় আমার বাপ ওদের গাঁয়ে ভিজা নালিতার আঁটি-বোজাই নৌকা লইয়া যায়, পাট ছাড়াইবার জন্য । আবার যখন বাপের বাড়ি যাইব, বাপকে বলিয়া রাখিব, এই রকম এই রকম মেয়েটি, দেখিতে ঠিক আমার মত । তার বাপকে বলিয়া দেখিও, আমার মেয়ে তোমার মেয়ের সঙ্গে সই পাতিতে চায়, তুমি রাজি আছ কিনা।