তা
প্রথম দিন অফিস থেকে ফিরে প্রমীলাকে দেখেই চমকে উঠেছিলাম।
চমকে উঠেছিলাম, কারণ ওরকম কুৎসিতদর্শন মহিলা আমি এর আগে দেখিনি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে, কুচকুচে কালো রং, উঁচু কপাল, ট্যারা চোখ এবং অত্যন্ত লম্বা। সব মিলিয়ে প্রথম দেখাটা মনে রাখার মতো।
টাই খুলতে খুলতে রিনিকে বললাম, এ কে?
রিনি গলা নামিয়ে বলল, মুন্নির নতুন আয়া।
বললাম, কোথা থেকে জোটালে? অন্ধকারে দেখলে মুন্নি তো দূরের কথা মুন্নির বাবাও কেঁদে উঠবে।
রিনি হাসল। বলল, তুমি ভীষণ অসভ্য। কারও চেহারা নিয়ে ওরকম করে বলতে হয়? আমি বললাম, সকলেই অপর্ণা সেনের মতো মিষ্টি দেখতে হয় না, তা বলে এতখানি খারাপ হওয়াটাও বাড়াবাড়ি।
রিনি বলল, বাড়ির বাবুদের ছুকছুকে বাতিক থাকলে দেখে দেখে এরকম আয়াই রাখা উচিত।
আমি কপট রাগের সুরে বললাম, অ্যাই! কী হচ্ছে!
রিনি তারপর সিরিয়াসলি বলল, অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে ওকে। চেহারা খারাপ হলে কী হবে, এফিসিয়েন্ট। বেচারার কোনো ছেলেপুলে নেই, তার ওপর বালবিধবা।
আমি বললাম, আহা!
দুই
সেটা প্রথম দিনের কথা।
তারপর দেখতে দেখতে অনেকদিন কেটে গেছে, অনেক মাসও। প্রমীলারও চেহারাটা আমার চোখে সয়ে গেছে দেখতে দেখতে। চেহারা ছাপিয়ে যা চোখে পড়েছে তা ওর দরদ। মনে হয়েছে মুন্নি যেন রিনির মেয়ে নয়, প্রমীলার নিজেরই মেয়ে।
রিনিকে ওর অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে বাইরে যেতে হয়। আজ দিল্লি, কাল বোম্বে, আমাকেও তাই। সে-কারণে একজন ভালো আয়া আমাদের বিলাসিতা ছিল না; ছিল নিতান্তই প্রয়োজন।
মনে আছে, একবার রিনি দিল্লি ছিল বেশ কয়েকদিনের জন্য। আমি কলকাতাতেই ছিলাম। সেই ক-দিন আমার চোখের সামনে প্রমীলা যেভাবে মুন্নিকে বুকে করে রইল তা বলার নয়।
মুন্নিটা যত বড়ো হচ্ছে, ততই দুষ্টু হচ্ছে। আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। সবসময় দুটি ফেস-টাওয়েল মুখের কাছে ধরে রাখা চাই, আর তা দিয়ে অনবরত নাক ঘষা চাই। টেডি-বিয়ার, জাপানি পুতুল, ফ্লুরির চকোলেট, কিছু দিয়েই তাকে রাখা যায় না, যদি-না ‘তা’ তার সঙ্গে থাকে।
প্রমীলার নতুন নামকরণ হয়েছে আমাদের বাড়িতে। নামকরণ করেছে মুন্নিই। প্রমীলার সেই নতুন নাম, ‘তা’।
প্রমীলাকে খেতে পর্যন্ত দিত না মুন্নি। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর যখনই মুন্নি একটু চোখ বুজত তখন ও বেচারি কোনোরকমে চান সেরে, বেডরুমের মেঝেতে বসেই কোনোরকমে খেয়ে নিত। আমি অন্য ঘরেই থাকতাম, তাই প্রাইভেসির বিঘ্ন হত না।
যেখানেই যাক, যা-ই করুক, তার সঙ্গ ছাড়া মুন্নির একমুহূর্ত চলত না। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মধ্যে মুন্নি কেঁদে উঠত। আমি আমার ঘর থেকে দৌড়ে আসতাম। বেডরুমের মধ্যে খাটের পাশে টেবিল-ল্যাম্পটা। দেখতাম মশারির মধ্যে মুন্নিকে বুকে করে প্রমীলা বসে থাকত। আর ওর কান্না থামাবার চেষ্টা করত। মুন্নিকে বুকে করে ওর বসে থাকার ভঙ্গির মধ্যে এমন এক মা-সুলভ মমতা থাকত যে, মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগত; মুন্নি সম্বন্ধে মমতা কার বেশি? রিনির না প্রমীলার? এই সন্তানহীনা মহিলার মুখে-চোখে টেবিল-লাইটের আলোয় যে-ভাব দেখতে পেতাম তা রিনির মুখেও কোনোদিন দেখিনি।
আজকালকার মডার্ন মায়েরা নির্দয় হওয়াটাকেই আধুনিকতার লক্ষণ বলে মনে করেন। ভাবাবেগ, সে প্রেমিক বা স্বামীর সম্পর্কেই হোক কী সন্তানের সম্পর্কেই হোক, প্রকাশ করার মধ্যে যে ইনটেলেকচুয়ালিজম নেই তা এঁদের মতো আর কেউ এমন জানেননি।
আমি জানি না, কেন ইদানীং রিনি প্রায়ই বলত, প্রমীলা বড়ো আদর দিচ্ছে মুন্নিকে। মেয়েটাকে স্পয়েল করে ফেলল। মেয়েটাকে সামলাতে পারে ও ভালো, কিন্তু শুধু ভালোবাসলেই তো হয় না, তাহলে তো সকলেই আয়া হতে পারত ভালো।
আমি পুরুষমানুষের স্থূল বুদ্ধিতে বুঝতে পারতাম না, ভালোবাসার চেয়েও বড়ো কোয়ালিফিকেশন আয়ার মধ্যে আর কী থাকতে পারে? যাই হোক, আমার বুদ্ধি স্থূলই হোক কী সূঞ্জই হোক, বাড়ির মধ্যে বাড়ির ব্যাপারে আমার বুদ্ধি ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। সেখানে আমি নন-এনটিটি। তাই বাদানুবাদের মধ্যে না গিয়ে আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতাম। কিন্তু আমার মন কেবলই বলত, এই সন্তানহীনা মহিলার প্রতি রিনি ভালো ব্যবহার করছে না। কারণ, কেন জানি না, আমার মনে হত প্রমীলাকে আর যে-গঞ্জনাই দেওয়া হোক সে তা সইতে পারে, মুন্নির অযত্ন হচ্ছে, মুন্নিকে ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে না; এ অপবাদ তার পক্ষে অসহ্য ছিল।
কিছুদিন বাদে রিনি কয়েকদিনের জন্যে জামশেদপুরে গেল। জামশেদপুর যাওয়ার আগেই মুন্নির জ্বর এসেছিল। জ্বর প্রায় তিন পর্যন্ত উঠেছিল কিন্তু ওষুধ পড়াতে জ্বর আবার কমে যায়। ডাক্তারের অভয়বাণী পেয়ে মুন্নিকে রেখেই রিনি জামশেদপুরে চলে গেল। ওর নাকি না-গেলেই নয়।
আমার মন ভালো লাগছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল, কিছু-একটা গোলমাল হবে।
রিনি যেদিন বিকেলের ট্রেনে গেল সেদিনই রাতে মেয়ের ধুম জ্বর এল। মুখ-চোখের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি ডাক্তারবাবুকে খবর দিলাম, তিনি এসে ওষুধপত্র দিয়ে গেলেন। কিন্তু সারারাত মুন্নি যন্ত্রণায় চিৎকার করল। সে-রাতে আমার ঘর থেকে কম করে পাঁচবার আমি উঠে এলাম। কিন্তু আমার মতো অপদার্থ বাবারা শুধু টাকা রোজগার করতে জানে, ছেলে-মেয়েদের বুকের সব ভালোবাসা উজাড় করে ভালোবাসতে জানে, কিন্তু তাদের শারীরিক কষ্ট লাঘব করার কোনো উপায়ই জানে না তারা।
মুন্নির বয়স এখন দু-বছরও হয়নি। আধো আধো কথা বলে, কিন্তু কোথায় ব্যথা, কীসের কষ্ট তা বুঝিয়ে বলতে পারে না। যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে জল পড়ে, কিন্তু জানাতে পারে না কী করলে সে-কষ্টের উপশম হয়। বাবা হওয়ার আনন্দ অনেক, কিন্তু অবলা শিশু সন্তানের যন্ত্রণা চোখের সামনে নিরুপায়ে দাঁড়িয়ে দেখাটা বড়োই কষ্টের।
যতবারই আমি দৌড়ে ওঘরে গেছি ততবারই দেখেছি যে, প্রমীলা মুন্নিকে বুকে করে ওর কষ্ট উপশমের জন্যে নানারকম প্রক্রিয়া করছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই মুন্নির কান্না বা গোঙানি থেমে গেছে। আরামে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে মুন্নি তার তা-র কোলে।
ও থামতেই প্রমীলা বলেছে, দাদাবাবু আপনি গিয়ে ঘুমোন, আমি তো আছি। আপনি কেন কষ্ট করছেন?
পাশের ঘরে আমি শুতে যেতে যেতে ভেবেছি, আমি ওর বাবা। ওর জন্য কিছু কষ্ট তো আমার করা উচিত কিন্তু তুমি তো পঞ্চাশ টাকার আয়া—তুমি কীজন্যে ওকে বুকে নিয়ে এত কষ্ট করছ? কেবলই ভেবেছি, আর মনে হয়েছে, প্রমীলা যা করে, যা করেছে এতদিন, তা শুধু ওর কর্তব্য নয়, শুধু টাকার বিনিময়ে করা নয়। ভগবান কখনো ওর কোলে যা দেননি, তা ওর নিজের না হলেও, ক্ষণেকের জন্য, কিছুদিনের জন্য ওর কোলে পেয়ে ও যেন ধন্য হয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে এই সন্তানহীনা রমণীর কোল থেকে সাক্ষাৎ যমদূত এলেও আমার মুন্নিকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কী, একথা ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ঘুমোতে গেছি।
পরদিন ভোরেই মুন্নির সমস্ত শরীর ভরে হাম দেখা গেল। মেয়ে একেবারে বেহুঁশ হয়ে রইল। চোখ-মুখ লাল। চোখের পাতা, মুখের ভেতর হাম একেবারে ছেয়ে ফেলেছে। সকালে মুন্নির মুখের দিকে চেয়ে আমি খুব ভয় পেলাম। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন ভয়ের কিছু নেই। হাম বেরোলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবুও ভয় পেলাম।
তারপর প্রমীলার মুখের দিকে চাইতেই দেখি আমার মেয়ের ক্লিষ্ট মুখের ছায়া তার মুখে। প্রমীলা মুন্নির চেয়ে বেশি বই কম কষ্ট পাচ্ছে না।
ডাক্তার আবার এলেন। হাম ভালো করে উঠে যাওয়ার ওষুধ দিয়ে গেলেন।
মনখারাপ করে আমি অফিসে গেলাম। অফিস থেকে বার তিনেক ফোন করে খবর নিলাম। শুনলাম হাম উঠেছে। প্রমীলাই ফোন ধরল, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মুন্নি বড়ো কষ্ট পাচ্ছে দাদাবাবু।
অফিস থেকে ফিরে মুন্নির অবস্থা দেখে ওর কাছে আর দাঁড়াতে পারলাম না। পাশের ঘরে এসে ডাক্তারবাবুকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, কোনো চিন্তা করবেন না, যেমন যেমন বলেছি, ওষুধ খাইয়ে যান। এরকম হয়। অসুখ মানেই তো সুখের অভাব।
আমি একটা গল্পের বই নিয়ে তাতে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম।
সে-রাতেও সারারাত প্রমীলা ঘুমোল না। সারারাত প্রায় ঠায় বসে কাটাল। পরদিন এবং পরের রাতেও ওরকম করে কাটল।
তার পরদিন ভোরবেলা বহুদিন পর মুন্নির গলা শুনলাম। মুন্নি তার মা-র নাম ধরে ডাকল না, তার বাবার নাম ধরে ডাকল না। ঘোরের পর জ্ঞান এলে, মুন্নি প্রথম কথা বলল—তা।
তারপর বার বার ডাকল—তা, তা, তা।
আমি দৌড়ে বেডরুমে গেলাম।
প্রমীলা মাথার দিকে জানলার পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল। কাচের শার্সি বন্ধ ছিল কারণ, ঠাণ্ডা লাগানো বারণ। সেই ভোরের আলোয় দেখলাম প্রমীলা মুন্নিকে বুকে নিয়ে বসে আছে, আর তার দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছে আনন্দের। আর মুন্নি তার ছোটো ছোটো হাত দুটিতে প্রমীলার কুশ্রী মুখটি ধরে সমানে ডেকে চলেছে—তা, তা, তা।
এই দৃশ্য দেখে আমার বুকের মধ্যে কোথায় না-জানি কী হয়ে গেল। কোন তারের সঙ্গে কোন অদৃশ্য তারের যোগাযোগ ঘটে গেল। প্রমীলার কাছে নিজেকে বড়ো ছোটো লাগল। মনে হল, কই, মুন্নির ডাকে আমার চোখে তো এমন করে জল এল না! নাকি আমি পুরুষমানুষ বলে? নাকি আমি দু-পাতা ইংরেজি পড়েছি বলে?
সেদিন সকালের পরই দেখতে দেখতে মুন্নি ভালো হয়ে উঠতে লাগল।
আমি অফিসে গিয়েই কাজে বেরিয়েছিলাম সেদিন। ফিরে জানলাম যে, রিনি কলকাতা ফিরে ফোন করেছিল আমায়। অফিসে ফিরতে ফিরতেই বেলা হয়েছিল বলে এবং তাড়াতাড়ি ফিরব বলে আমি আর রিং ব্যাক করলাম না।
অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িটা ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়েছিল। আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম, মনটা খুব খুশি ছিল আমার। মুন্নিটা ভালো হয়ে উঠেছে, রিনি ফিরে এসেছে। একথা ভেবেও ভালো লাগছিল যে, প্রমীলা আজ তিনরাত পরে ঘুমোতে পারবে। বেচারি গত তিনদিন তিনরাত একটুও ঘুমোয়নি। অন্য প্রাণীও কেউ ছিল না যে, ওকে একটু রিলিভ করে।
বেল টিপতে ঠাকুর দরজা খুলল। বসবার ঘরে ঢুকতেই মুন্নির গলা শুনতে পেলাম বেডরুম থেকে। মুন্নি ডাকছে তা, তা ও তা। আধো আধো গলায় করুণ স্বরে ডাকছে মুন্নি। তা, তা, তা।
এমন সময় রিনির গলা শুনলাম, রাগ রাগ গলা। রিনি বলল, খুব বকব। চুপ করো, চুপ করো বলছি। তা তা করবে না, খুব বকব।
দেখলাম ঠাকুরের মুখটা ফ্যাকাশে।
ওকে শুধালাম, কী হয়েছে রে?
ঠাকুর বলল, প্রমীলাকে বউদি তাড়িয়ে দিয়েছে।
সে কী? অবাক হয়ে বললাম আমি।
রিনি খাটে বসেছিল, মুন্নিকে পাশে শুইয়ে।
আমাকে ঢুকতে দেখেই বলল, তোমার পেয়ারের আয়াকে একটু আগে তাড়ালাম।
আমার খুব রাগ হয়ে গেল। বললাম, কারণটা কী?
রিনি বলল, কারণ নিশ্চয়ই একটা ছিল। এটা আমার ব্যাপার। ঘর-গেরস্থালির ব্যাপার। সবটাতে তোমাকে কৈফিয়ত দিতে পারব না।
তারপর একটু পরে নিজেই বলল, আমার মুখে মুখে কথা বলছিল, অনেক দিন থেকেই বলছিল, তার ওপর মুন্নিটার স্বভাব একেবারে নষ্ট করতে বসেছিল।
আমি বললাম, প্রমীলা তিনরাত তিনদিন এক ফোঁটা বিশ্রাম পায়নি, ঘুমোয়নি একটুও। কাজটা কি তুমি ভালো করলে? ওকে কি ফিরিয়ে আনা যায় না?
রিনি চড়া গলায় বলল, ওকে ফিরিয়ে আনলে আমিই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
আমি কোনো কথা বললাম না। নিজের ঘরে চলে গেলাম।
সে-রাতে আমি খাইনি। রিনির সঙ্গে তিনদিন কথা বলিনি, কিন্তু তাতে কারও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি।
তিন
প্রমীলার জায়গায় নতুন আয়া এসেছে নেপালি। তার নাম কাঞ্চী। বয়সে প্রমীলার চেয়ে ছোটো, দেখতেও প্রমীলার চেয়ে ভালো।
মুন্নির সব কাজ এখন সেই করে। সকাল-বিকেল বেড়াতে নিয়ে যায়। ‘নিনি-বাবা-নিনি, মাখন-রোটি-চিনি’ বলে মুন্নিকে ঘুমও পাড়ায়। মুন্নি প্রথম ক-দিন মাঝে মাঝে তা, তা, করে ডেকে উঠত। ইদানীং একবারও ডাকে না।
মাঝে মাঝে ভাবি মেয়েটাও কি তার মায়ের মতোই অকৃতজ্ঞ?
কাজ-কর্মের অবকাশে মাঝে মাঝে প্রমীলার কথা মনে পড়ে। খুব ইচ্ছে করে, যদি পথেঘাটে কোথাও দেখা হয়ে যায় ওর সঙ্গে, তা হলে ওর হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব, ওর জন্যে যদি কিছু করতে পারি তা করব। প্রমীলা কোথায় গেছে তা আমি জানি না। কেউ জানে না। তার পুরো ঠিকানাটাও আমাদের কাছে নেই।
জানি না, রিনি হয়তো তার মেয়ের ভালোর জন্যেই প্রমীলাকে তাড়িয়েছিল। হয়তো তার হিসেবই ঠিক।
কিন্তু এও জানি না, জগতে এবং জীবনে যা-কিছু ঘটে সব কিছুই হিসেবের ভেতরে পড়ে কি না। প্রমীলার মমতা, প্রমীলার চোখের জলও তো হিসেবের বাইরেই ছিল।
আমার ভারি ভয় করে। প্রমীলার চোখের জলে মুন্নির কোনো অভিশাপ লাগবে না তো! পরক্ষণেই মনে হয় মুন্নির ‘তা’ কি কখনো মুন্নির কোনো ক্ষতি করতে পারে?
অনেকদিন হয়ে গেছে প্রমীলাকে তাড়ানোর দিন থেকে, কিন্তু আজও তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়নি। সে সুযোগ আসেনি আমার।
প্রমীলা কি কলকাতাতেই আছে? নাকি চলে গেছে ডায়মণ্ডহারবার লাইনে তার গরিব ভাইয়ের আশ্রয়ে?
নাকি আবারও ভুল করে করে কোনো নতুন মুন্নিকে বুকে করে তার বুকের উত্তাপে তার ‘তা’, কী ‘থা’ কী ‘দা’ হয়েছে সে?
মা তো সে কখনোই হতে পারবে না।
জানি না কিছুই। শুধু এটুকুই জানি যে, এই মুহূর্তে এই নির্দয় হৃদয়হীন শহরের অনেক ঘরেই আমার মুন্নির মতো মুন্নিদের বুকে আঁকড়ে অনেক প্রমীলারা বসে আছে। তিরিশ-চল্লিশ টাকার বিনিময়ে হিসেববহির্ভূত যা-কিছু তারা দিয়েছে, প্রতিমুহূর্তেই দিচ্ছে; তারা তা কখনো ফেরত পাবে না মুন্নিদের অকৃতজ্ঞ মা-বাবাদের কাছ থেকে।