তা বেশ – অনুবাদক: কমলা রায়

তা বেশ

১৮৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির রাতে সরেন্তোয়, করভারা ফ্রানচেসকো আউরেলিও আমিদেই এবং তাঁর স্ত্রী ফ্লোরিদার একটি ছেলের জন্ম হল— ছেলেটির নাম হল কসমো আন্তনিও করভারা। ভূমিষ্ঠ হয়েই অদ্ভুত অভ্যর্থনা পেল সে— পৃথিবীতে বেশ উত্তম-মধ্যম প্রহার। প্রসব হতে সময় লেগেছিল অনেকক্ষণ— প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়— তাই পৃথিবী-প্রবেশের সময় সে কাঁদল না। কাজে কাজেই ধাত্রী তার মাথাটা নীচের দিকে ঝুলিয়ে না-কাঁদা পর্যন্ত বেশ কিছুক্ষণ ধরে মার লাগাল— কারণ, পৃথিবী-প্রবেশের পথে কান্না দিয়ে যাত্রা করাটাই পদ্ধতি।

১৮৬১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৬২ সালের ১৫ মার্চ অর্থাৎ এই তেরো মাসে বাচ্চাটির দুধ দেবার লোক বদল হল পাঁচবার। প্রথম দু’জনের দুধ ছিল না যথেষ্ট, তাই তাদের জবাব দেওয়া হল। তৃতীয়টির বেলায় কারণ একটু অন্যরকম ছিল— একদিন স্নানের সময় প্রায় ফুটন্ত গরম জলে একটুও ঠান্ডা জল না মিশিয়ে সে বাচ্চাটিকে ফেলে দিয়েছিল। ফলে, ও ভীষণভাবে পুড়ে যায়— অনেক কষ্টে ওর প্রাণ রক্ষা হয়। ভগবান দয়া করে ওর প্রাণ রক্ষা করলেন বটে, কিন্তু তার বদলে নিলেন তার মাকে। চতুর্থ নার্সটি ওকে বিছানা থেকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল মোটে তিনবার। আর মোটে একবার নার্সের কোলে নামবার সময় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল নীচে। এতবার পড়ে গিয়েও বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি বাচ্চাটির— শেষবার নাকের হাড়টা ভেঙে গিয়েছিল শুধু।

যতদিনে তার ন’বছর বয়স হল, ততদিনে কসমো আন্তনিও ডাক্তার আর ওষুধওলার সাহায্যে শিশুকাল থেকে বাল্যকাল পর্যন্ত পৌঁছতে যেসব অসুখের সিঁড়ি সাধারণত ভাঙতে হয়, তার সব ক’টিই পার হল। ন’বছর বয়সে ধর্ম সম্বন্ধে প্রগাঢ় বিশ্বাস নিয়ে সে স্কুলে পড়তে এল।

ধর্মের গ্রন্থে সাত রকম দাক্ষিণ্যের উল্লেখ আছে স্কুলে যাবার কয়েক দিন আগে কসমো আন্তনিও এই সাত রকমের এক রকম প্রায় অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ফেলল। সমুদ্রের ধারে একটি উলঙ্গ ছেলেকে দেখে, তার বাপ নেপলস থেকে যে নতুন পোশাকটা কিনে এনেছিলেন, সেইটে খুলে তাকে পরিয়ে দিয়ে নিজে শুধু নাবিক টুপিটি পরে বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু হায় রে! এত ভাল কাজ করার পরিণাম হল বাড়িতে এসে বাবার কাছে অকর্মণ্য, বোকা, গাধা বলে গালি খাওয়া আর কানের উপর এমন জোরে টান যে আর-একটু হলেই বেচারার কান দুটো মাথা থেকে খুলে আসছিল আর কী।

স্কুলে কসমো আন্তনিও এত মন দিয়ে পড়াশুনো আর ধর্মচর্চা শুরু করে দিল যে বছর ষোলো বয়সে তার যক্ষ্মারোগের লক্ষণ দেখা গেল। De Gratia নামে বইটাতে ও যেদিন পড়ল ‘Si quis dixerit grataim perseverantiae none esse gratis datam, anathena sit’ সেই দিন ধর্ম সম্বন্ধে গভীর শিক্ষা প্রথম ও লাভ করল। রোমান ক্যাথলিক ধর্মে বলে যে ভগবান যাকে উদ্ধার করতে চান সে লোক ভাল কি মন্দ বিচার করেন না; ভাল কাজ একবারে করে উঠতে না পারলে বারবার চেষ্টা করার ক্ষমতা তিনি তাকে দান করেন।

সেন্ট টমাসও বলেছেন তাই।

কসমো আন্তনিও কয়েক সপ্তাহ ধরে এই প্রশ্ন নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন রইল। তারপর হঠাৎ একদিন রাত্রে দেখা গেল, শুধু শার্ট গায়ে, একটা বাতি হাতে সে ডর্মিটরির ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখ-চোখ লাল, যেন জ্বর হয়েছে, চোখের দৃষ্টি সাধারণ মানুষের মতো নয়, কী এক অদ্ভুত আভায় জ্বলজ্বল করছে। কী ব্যাপার? ও একটা চাবি খুঁজছে। লোকে যখন জিজ্ঞাসা করল কীসের চাবি, তখন সে জবাব দিল, অধ্যবসায়ের চাবি। দেখা গেল, সে একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছে। নেহাৎ ভাগ্যের জোরে ব্রেন ফিভার হয়ে প্রায় মাস খানেক যায়-যায় অবস্থায় থেকে সে যাত্রা ও বেঁচে উঠল।

যখন ভাল হয়ে উঠল তখন ধর্মে ওর আর একটুও বিশ্বাস রইল না। শুধু তাই নয়— রইল না আরও অনেক কিছু। মাথা থেকে চুলগুলো সব উঠে গেল, কথা বলার শক্তি বন্ধ হল, চোখের দৃষ্টি প্রায় অর্ধেকটা নষ্ট, আরও অনেক কিছু। আগের কথা কিছুই আর সে মনে করতে পারল না— প্রায় এক বছর কাটল তার জড়ের মতো। শেষটায় শিরদাঁড়ায় ডুশ দেওয়ার ব্যবস্থা করে অনেক কষ্টে সে ভাল হয়ে উঠল। বাইশ বছরেরও কিছু বেশি বয়সে সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও দর্শনের ডক্টরেট হবার জন্যে পড়তে গেল। এই বয়সেই তার মাথাভর্তি টাক, চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত কম, আর ছেলেবেলায় সেই পড়ে যাওয়ার ফলে নাকটি ভাঙা।

১৮৮৭ সালের অক্টোবর মাসে সে সাসারির নিম্ন বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পদপ্রার্থী হল— আশ্চর্যের কথা, পেয়েও গেল চাকরিটি। মানবশিশু আর অন্যান্য জন্তুর শিশুতে প্রভেদ বোধহয় বিশেষ নেই। যদি ছোট ছোট ছেলেরা তাদের মাস্টারকে পছন্দ না করে, আর মাস্টারও ক্ষীণদৃষ্টিতার জন্যে ঠিকমতো দেখতে না পান, তা হলে ক্লাসঘরকে ভূতের আড্ডা করে তুলতে ছেলেদের একটুও দেরি হয় না। এক্ষেত্রেও হল তাই— অ্যাসিস্ট্যান্ট মাস্টার ক্লাসে ছেলেদের ঠিক শায়েস্তা রাখতে পারেন না বলে হেডমাস্টার মশাই প্রায়ই অনুযোগ করতে লাগলেন। সাসারির পথেঘাটেও ছোট ছোট ছেলেরা প্রোফেসর কসমো আন্তনিওকে কম জ্বালাতন করত না। শেষকালে সাধারণ বিজ্ঞানের প্রোফেসর দলফো দলফি ওকে স্কুলে ও স্কুলের বাইরে রক্ষা করবার ভার নিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি কসমোকে তাঁরই বাড়িতে এসে ভাগাভাগি করে থাকতেও অনুরোধ করলেন।

দলফো দলফি মাস্টারি কাজ নিয়েছিলেন বেশ বেশি বয়সেই। লেখাপড়ায় যে তাঁর কোনও বিশেষ ডিগ্রি ছিল তা নয়— চাকরিটি জোগাড় করেছিলেন পার্লামেন্টের একজন জাঁদরেল সভ্যের দয়ায়— সাধারণত এ কাজ নিতে গেলে যে পরীক্ষা দিতে হয় তা তাঁকে দিতে হয়নি। এর আগে, তিনি প্রথমে আফ্রিকাতে পর্যটক হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার পর বহু বছর কাজ করেছিলেন জেনোয়ার এক খবরের কাগজে। সারা জীবন প্রায় বারো-তেরোটা ডুয়েল লড়েছিলেন তিনি আর সেগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই জয় তাঁর হয়েছিল। ধর্মটর্ম তিনি মানতেন না। এখানে সঙ্গে থাকত তাঁর এক জারজ কন্যা… অদ্ভুত নাম মেয়েটির— শয়তানের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি তার নাম রেখেছিলেন সাতানিনা।

কসমো আন্তনিও আশা করেছিল যে দলফো দলফির ছায়ার তলায় সে এবারে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু হায় রে মানুষের আশা! যেটুকু সময় অবসর থাকত দলফো দলফি তাঁর পর্যটক জীবনের ভ্রমণকাহিনি, খবরের কাগজের আপিসের বিচিত্র জীবনযাত্রা, আর তাঁর ডুয়েল লড়ার গল্প বলে বেচারা কসমোকে অতিষ্ঠ করে তুলতেন। দলফি তাঁর নিজের অদ্ভুত জীবন নিয়ে ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসতেন— আলোচনা মানে এ নয় যে তাঁর শ্রোতাও কিছু বলার অবকাশ পেত, কথাবার্তা যা বলার, তা তিনি বলতেন একাই। পা ফাঁক করে চেয়ারে বসে, বুক ফুলিয়ে, মুখের অসংখ্য আঁচিলের উপর যে চুলগুলো হয়েছিল সেগুলো পাকাতে পাকাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে বাজে বকতেন তিনি। গল্প যত বড় হত, কসমো আন্তনিও তত বেশি যেন তার নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত, কোনও কথারই প্রতিবাদ করত না। স্কুলের ছাত্ররা বা রাস্তার ছোঁড়ারা এখন দলফির ভয়ে কসমোকে আর কিছু বলতে সাহস পেত না। এদের হাত থেকে সে যে নিষ্কৃতি পেয়েছিল তা সত্যি। কিন্তু অন্য দিকে, সে তার নিজের স্বাধীন সত্তাটুকু হারিয়ে ফেলেছিল, স্কুলের ছুটির পর অবসর সময়টুকু যে নিজের খুশিমতো কাটাবে সে অধিকার তার ছিল না, এমনকী স্কুল থেকে যে সামান্য মাইনে পেত, সে টাকাও থাকত না তার কাছে। দু’-চার পয়সা দরকার হলে সাতানিনার কাছে দরবার করতে হত। পনেরো বছর বয়সেই সাতানিনা এদের সংসারে কর্ত্রী হয়ে উঠেছিল— খুব গোপনে পয়সা দেবার সময় সে ওকে সাবধান করে দিত, ‘পয়সা নিয়ে যা-ই করুন না কেন, বাবাকে যেন বলবেন না! তা হলে উনিও পয়সা চাইতে শুরু করবেন, আর দু’জনে মিলে পয়সা নিতে থাকলে আমি সংসার চালাব কেমন করে?’

ভারী সুন্দরী সাতানিনা— কসমো আন্তনিওর এত ভাল লাগত ওকে যে একবার ও দলফিকে বলেছিল, ওর নামটা ছোট করে নিনা বা নিনেতা বলে ডাকতে। দলফি সে কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাগল নাকি? নিনা— নিনেতা! ওর নাম হচ্ছে শয়তান, বুঝলে হে শয়তান!

‘Salute, O Satane,

O Ribellione

O Forza Vindice

Della Ragione’

শয়তান, তোমাকে আহ্বান করি!

বিদ্রোহ, তোমাকে আহ্বান করি।

মানুষের স্থির চিন্তাধারার সঙ্গে যুদ্ধ তোমার

তোমাকে নমস্কার করি।’

বছর তিনেক কাটল এই ভাবে। লোকে প্রোফেসর কসমো আন্তনিওকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করত যে কী করে সে দলফো দলফির মতো একটা বিদঘুটে লোকের সঙ্গে দিনের পর দিন কাটাতে পারছে। এ সব কথার জবাব সে কখনও দিত না। ঘাড়টা একটু বেঁকিয়ে, ক্ষীণদৃষ্টি চোখ দুটো অর্ধেকটা বন্ধ করে, হতাশার ভঙ্গিতে সে হাত দুটো দু’পাশে ছড়িয়ে দিত— সামান্য হাসির চেষ্টায় আরও করুণ দেখাত তার মুখটা। সে বেশ বুঝতে পারত যে দলফো দলফি সম্বন্ধে প্রশ্ন করে লোকে তাকেই বলতে চাইছে যে কত বড় একটি অপদার্থ সে।

সত্যি কথা বলতে কী, একটু জোর করে চেপে ধরলে, কসমো আন্তনিও নিজেই স্বীকার করে ফেলত যে তার মতো অপদার্থ আর পৃথিবীতে নেই। তবে, এ বিষয়ে তার তখনও একটু সন্দেহ ছিল— অনেকদিন ভেবেচিন্তে সে ঠিক করেছিল যে তার চেয়েও অপদার্থ পৃথিবীতে আর একটি আছে সে হচ্ছে মানুষের জীবন, অতিসাধারণ জীবন। জীবন যখন এত বড় অপদার্থ, তখন চারদিকে নজর ফেলে,তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটিয়ে কিংবা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ভান করে লাভ কী— বিশেষ করে যখন দেখা যায় যে অপদার্থ জীবন তার নখগুলো দিয়ে কোনও কোনও লোককে আঁচড়ে দেবার জন্যে একেবারে বদ্ধপরিকর! কসমোর মতে এরকম ক্ষেত্রে বিরোধিতা করে কোনও লাভ নেই— জীবনকে যা খুশি তাই করতে দেওয়া ভাল, কারণ আমরা বুঝতে না পারলেও কোনও একটা বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা জীবনের আছেই; তাও যদি না হয়, জীবন যে একদিন শেষ হয়ে যাবে তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই— তবে অযথা কী লাভ তার সঙ্গে বিবাদ করে!

তার অনুমান মিথ্যা হল না। জীবন একদিন হঠাৎ সত্যিসত্যিই শেষ হল— কিন্তু তার নয়। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে দলফো দলফির হঠাৎ এপোপ্লেক্সি হল— জ্ঞান তিনি আর ফিরে পেলেন না।

কসমো এই আঘাত আশা করেনি— সে একেবারে কাহিল হয়ে পড়ল। তার মনে হল সমস্ত বাড়িটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেছে— এমন ফাঁকা যে অবাক লাগে। বাড়ির কোনও আসবাবপত্রের সঙ্গে পরিচয় করবার অবসর তার আগে কোনওদিন হয়নি— সে জানত মাত্র একটি লোকে সারা বাড়ি ভরে আছে। আজ, সেই আসবাবপত্রের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল যে ওই জিনিসগুলোও কসমোরই মতো যেন তারই প্রতীক্ষা করছে যে আর কখনও ফিরবে না।

এদিকে সাতানিনার কান্না কিছুতেই থামে না। প্রথমে কসমো তার কান্না থামাবার কোনও চেষ্টাই করেনি, ভেবেছিল, যাই কেন সে না বলুক, সে কথার কোনও মূল্য সাতানিনার মন এখন স্বীকার করবে না। কয়েক দিন পরে স্কুলের হেডমাস্টার মশাই আর অন্য অন্য মাস্টারেরা তাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, বেচারা সাতানিনার জন্যে কী ব্যবস্থা সে করছে— হঠাৎ বাপ মারা গেল, আইনত কোনও পেনশন ও পাবে না। বাপ একটি পয়সাও রেখে যাননি, কাছাকাছির কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, দূর-সম্পর্কেরও কোনও আত্মীয় নেই; মেয়েটা ভেসে না যায়। কসমো তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল যে এ সব কথা নিতান্তই বাহুল্য। মেয়েটা তার কাছেই তার নিজের মেয়ের মতো থাকবে। হেডমাস্টার মশাই আর অন্য অন্য মাস্টারেরা ঘাড় বেঁকিয়ে চলে গেলেন— এইটে বোঝা গেল যে এ ব্যবস্থা তাঁদের মনঃপূত হল না। তারা কেন অসন্তুষ্ট হলেন, কী ভুল যে সে বলল, তা বুঝতে না পেরে কসমো অবাক হয়ে গেল। তার প্রস্তাবে অন্যায়টা কোথায় সাতানিনার সঙ্গেও এই বিষয়ে সে কথাবার্তা বলল— আশ্চর্যের কথা এই যে সেও তার প্রস্তাব গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না, বরং জোর গলায় জানিয়ে দিল যে তার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা সাতানিনার পক্ষে অসম্ভব, যত শিগগির সম্ভব তাকে চলে যেতেই হবে।

অবাক হয়ে কসমো প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু যাবে কোথায়?’

‘যেদিকে দু’চোখ যায়’— জবাব দিল সাতানিনা।

কসমো আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু যেতে তোমাকে হবেই বা কেন?’

এ প্রশ্নের কোনও জবাব পাওয়া গেল না।

কয়েকদিন পরে অন্যান্য শিক্ষকেরা কারণটা তাকে বুঝিয়ে বলল— তার বয়স সবে মাত্র পেরিয়েছে তিরিশ, সাতানিনারও হল আঠারো। কাজে কাজেই সে সাতানিনার বাপের বয়সি নয়, আর সাতানিনাও তার মেয়ে হবার মতো ছোট নয়। এবার সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে সাতানিনা চলে যেতে চাচ্ছে কেন? প্রোফেসর কসমো একবার পায়ের আঙুলের দিকে, একবার হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল। তারপর গলায় যেন কী আটকে ছিল, সেটাকে গিলে ফেলবার চেষ্টা করতে করতে ভাবতে লাগল— তার বন্ধুরা কি তবে সাতানিনাকে… বিয়ে… বিয়ে করার কথা বলছিল? কসমোর মাথা ঘুরে উঠল— তার মনে হল সে এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে।… না, নিশ্চয় তারা ওর সঙ্গে ঠাট্টা করছিল। নাঃ, এরকম করে হবে না, সাতানিনার সঙ্গে আর একবার ভাল করে কথা বলে তার মাথা থেকে ওই যেদিকে দু’চোখ যাওয়ার বদ্ধ পাগলামিটা দূর করতেই হবে।

সাতানিনাও সকলের মতো সেই একই কথা বলল, একমাত্র একটি শর্তে সে তার কাছে থাকতে পারে— যদি ওদের বিয়ে হয় তবেই সে কসমোর কাছে থাকবে।

কসমো এই ভেবে রীতিমতো ভয় পেল যে সে নিজেই পাগল হয়ে যাচ্ছে।… হয় সত্যিই তার মাথা খারাপ হচ্ছে আর নয়তো ওরা সকলে মিলে ওর সঙ্গে একটা বিশ্রী নিষ্ঠুর ঠাট্টা করছে। ও কিছুতেই বুঝতে পারল না যে সাতানিনার মতো একটি সুন্দরী যুবতী তাকে বিয়ে করবার কথা ভাবতে পারল কী করে— ওরা বিয়ে না করে এক বাড়িতে থাকলে যে গ্রামে কোনও বদনাম রটবে এ কথা সে বিশ্বাসই করতে পারল না! আচ্ছা, এও কি হতে পারে যে তাকে বিয়ে করাটা খুব ভয়াবহ বা ঘৃণ্য বলে সাতানিনা মনে করছে না? মনে যেন কী আশা হল! তাকে দেখতে কেমন, ভাল করে দেখার জন্যে আয়নার কাছে গিয়ে ও একবার দাঁড়াল— সত্যিসত্যিই ও যতটা খারাপ দেখতে, তার চেয়েও ঢের বেশি কুৎসিত লাগল ওর নিজের চেহারাকে। চিরকাল রোগে ভুগে, আর ভাগ্যের লাঞ্ছনা ভোগ করে ওর মুখের রং রোগীদের মতো হলদে হয়ে গিয়েছে— মাথাভর্তি টাক, চোখের দৃষ্টি অর্ধেক নেই। স্বাস্থ্যে, আনন্দে ভরপুর সাতানিনাকে নিজের পাশে কল্পনা করতেই তার মাথা ঘুরে গেল। সাতানিনা তাকে বিয়ে করবে? এও কি সম্ভব? ও আবার সাতানিনার কাছে ফিরে গেল। আমতা আমতা করে অনেক কষ্টে জিজ্ঞাসা করল সত্যিসত্যিই সে ওকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না। হতভম্ব হয়ে সে দেখল সাতানিনা একটুও লজ্জা না পেয়ে, দ্বিধা না করে জবাব দিল যে, সে যে শুধু রাজিই আছে তা নয়— কসমো যদি তাকে বিয়ে করে তা হলে সে সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

হাত তুলে সাতানিনার কথায় বাধা দিতে গেল কসমো— কিন্তু কোনও কথা বেরোল না তার মুখ দিয়ে, ছোট ছেলের মতো ঝরঝর করে সে কেঁদে ফেলল। একটু পরে সামলে নিয়ে সে বলল কৃতজ্ঞতার কথা কেন সাতানিনা তাকে বলছে? উলটে তারই বরং কৃতজ্ঞ থাকা উচিত চিরদিন। ভাগ্য যে তার জন্যে এত বড় সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিল তা তো সে জানত না! এ যে সত্যিসত্যিই অসম্ভব ব্যাপার—

কয়েকদিন ধরে প্রোফেসরের মুখ দিয়ে ভাল করে কোনও কথাই বেরোল না।

বাগদত্ত বরবধূকে একই বাড়িতে থাকতে হচ্ছে— কাজে কাজেই বিয়েটা তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। হেডমাস্টার মশাই এটাও আশা করছিলেন যে তাড়াতাড়ি বিয়েটা চুকে গেলেই তাঁর সহকারী পরির রাজ্য ছেড়ে আবার মাটির পৃথিবীতে নেমে আসবে। কিন্তু তাঁর এ আশা বৃথাই থেকে গেল, ১৮৯২ সালের ১৩ মার্চ ওদের সরকারিভাবে বিবাহ হল— কয়েক বছর আগে প্রোফেসর ধর্ম সম্বন্ধে যে মত গ্রহণ করেছিল তার ফলে গির্জায় গিয়ে বিয়ে করতে সে রাজি হল না।

বিয়ে করে প্রোফেসর খুবই সুখী হল বটে কিন্তু তার বোকামির মাত্রা দিন দিন যেন আরও গেল বেড়ে। বছরের পর বছর দুঃখভোগে যা হয়নি, এই ক’দিনের সুখভোগের ফলে তাই হল— কসমো এতদিন ধরে যা শিখেছিল এমনকী ল্যাটিন ব্যাকরণ পর্যন্ত ভুলে গিয়ে শিক্ষকতার সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়ল। সাতানিনাকে ছাড়া আর কিছু সে জেগে বা ঘুমিয়ে বা স্বপ্নেও দেখতে পায় না। জোর করে সাতানিনা খেতে না বললে সে খেতেও চায় না। তার আনন্দমুখর স্ত্রীকে খাবার টেবিলে বসে থাকতে দেখলেই সে তৃপ্তিবোধ করত, সাতানিনা যদি তার দেহকে তার সুন্দর ছোট ছোট দাঁত দিয়ে স্পর্শ করার যোগ্য মনে করত তা হলে সে নিজেকে সাতানিনার খাদ্য করে ধরে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না।

এদিকে দলফো দলফির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্কুলের ছেলেদের বা রাস্তার ছোঁড়াদের ভয়ও গেল ভেঙে। এবারে যা গোলমাল আরম্ভ হল তার সঙ্গে আগের গোলমালের কোনও তুলনাই হয় না। হেডমাস্টার মশাই খুব চটাপটি করলেন, সহকারীকে যতদূর সম্ভব বকাবকি করলেন— কোনও ফল তো হলই না বরং প্রোফেসর কসমো এমন মধুরভাবে হেডমাস্টার মশাইয়ের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল যে মনে হল ঘটনাটার সঙ্গে ওর নিজের কোনও সম্পর্ক নেই। সমস্ত ব্যাপার দেখে সাতানিনা প্রতিপত্তিশীল বন্ধুটির কাছে চিঠি লিখতে বাধ্য হল। তাঁর ক্ষমতা আগের চেয়েও এখন অনেকটা বেশি— সাতানিনা তাঁকে লিখল প্রোফেসরকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এমন কোনও জায়গায় চাকরি দিতে যেখানে এত গোলমাল নেই— যেমন সাধারণ কোনও পাঠাগার কিংবা শিক্ষাবিভাগের রাজমন্ত্রীর কোনও দপ্তর। এই চিঠির ফলে, প্রায় দু’মাস পর কসমো মন্ত্রী-দপ্তরে দেখা করার আদেশ পেয়ে রোমের দিকে রওনা হল। দুষ্টুমি করলেও তার ছাত্ররা সত্যি সত্যি তাকে ভালবাসত— এই বিদায়ে তারা ব্যথিত হল। হেডমাস্টার মশাই আর অন্য অন্য শিক্ষকেরা কিন্তু ওর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। সাতানিনার এই সময় সন্তান-সম্ভাবনা— সমুদ্র পার হবার সময় সে ভারী অসুস্থ হয়ে পড়ল। আসল ইটালিতে পা দেওয়ার আনন্দে, রোমের এত কাছে আসার আনন্দে চিভিতাভেকিয়াতে জাহাজ থেকে নেমে কিন্তু সে সব দুঃখ ভুলে গেল। তার বাবার নানাদেশ ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব যে তারও রক্তে এত প্রবল এ অনুভব করে সাতানিনা বিস্মিত বোধ করল।

শিক্ষাবিভাগের মন্ত্রীর আপিসে যে কপি করার বিভাগ সেই বিভাগের তত্ত্বাবধায়কের পদে প্রোফেসরকে নিয়োগ করা হল— কিন্তু তত্ত্বাবধান প্রোফেসর বিশেষ কিছুই করতে পারলেন না। দিনমজুরি দিয়ে যেসব অল্প মাইনের কেরানি নেওয়া হত তারা শিগগিরই তাদের নতুন মনিবকে চিনে নিল। যদি কোনও খিটখিটে বুড়ো, যার সম্বন্ধে নানারকম জনরব, তাদের কাজের তদারক করবার জন্যে নিযুক্ত হত তা হলে অবিশ্যি কথা ছিল না— সেলাম করত সবাই, খাতির করত। কিন্তু এই রকমের একটা গোবেচারা লোককে সম্মান দেখিয়ে লাভ কী? তারা যে খুব বেশি জ্বালাতন করত তা নয়, তবে কাজকর্ম যখন কম, তখন দু’-একটা হালকা ঠাট্টা করতে ছাড়ত না! আর একটা সুবিধে ছিল এই যে নকল করতে ভুল করলে দোষটা পড়ত প্রোফেসর কসমোর ঘাড়ে।

হয়তো কোনও সময় কসমো বললে, ‘শুনছেন আপনারা কে কী কপি করছেন আমায় একটু দেখান তো! এত গোলমাল করবেন না, আমার কথা শুনুন। শুনছেন, ও মশাই, আপনি, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাকে বলছি, ragione লেখবার সময় এবার থেকে দয়া করে একটা g লিখবেন, বুঝলেন?’

এর খুব মজার উত্তর দেওয়া চলে, ‘অনেকগুলো থাকাই ভাল প্রোফেসর, দুটো ‘g’ দেওয়াই ভাল, reason-এর ব্যাপার কিনা।’

প্রোফেসর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়, ‘তা বেশ, তা বেশ’ আর অভ্যাস মতো গলাটাকে একবার লম্বা করে ঘাড়টা কুঁজো করে, অর্ধেক অন্ধ চোখ দুটো প্রায় বন্ধ করে ফেলে। বোতলের তলার কাচ যেমন পুরু প্রোফেসরের চশমার কাচও তাই— চশমার কাচের ভিতর দিয়ে চোখ দুটো ভাল দেখাই যায় না।

যারা কপি করে তারা যখন প্রোফেসরকে ওইরকম করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ‘তা বেশ’ বলতে শোনে তখন তারা আর হাসি চেপে রাখতে পারে না। ওরা যে কেন এইরকম করে তা প্রোফেসর বুঝতে পারে না। কোনও কিছু গোলমাল হলেই ‘তা বেশ, তা বেশ’ এই কথা দুটো বলা ওর কেমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কেরানিরা আজকাল ওকে ‘প্রোফেসর তাবেশ’ বলে ডাকে। এই নতুন নামকরণটা যখন ওর কানে গেল ও তখন একটু হাসল, গলাটা একবার লম্বা করল, ঘাড়টাকে কুঁজো করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল… কোনও সময় অজান্তে ওই অভ্যাসটা তার হয়ে গেছে… নিষ্ঠুর ভাগ্যের কাছে ক্রমাগত ঘা খেয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি এখন ওর দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এতদিনে, ওর সব দুঃখের বদলে ও শান্তি পেয়েছে, ভবিষ্যতেও যত দুঃখ আসবে সে তা হাসিমুখে সহ্য করে নেবে— ভাগ্য বিপর্যয়কে ও আর ভয় করে না। পৃথিবীর সমস্ত কেরানি হাসুক না দলবদ্ধ হয়ে, যা খুশি বলে ওকে ডাকুক— যতক্ষণ আপিসে বসে ও কাজ করে সব সময় ওর মনটা ঘুরে বেড়ায় সাতানিনার কাছে। আপিস থেকে ওদের বাড়ি অনেক দূরে হলেও, প্রোফেসর যেন পরিষ্কার দেখতে পায় তাদের ভিয়া সান নিচ্চোলো দা তলেনতিনোর ছোট ফ্ল্যাটটিতে সাতানিনা একমনে সংসারের কাজ করছে।

১৮৯৩ সালের ১৫ অগাস্ট সাতানিনা নির্বিঘ্নে একটি পুত্র-সন্তান প্রসব করল, ছেলের নাম হল দলফিনো। পিতৃত্বের গৌরবের আনন্দে বেচারা প্রোফেসর একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল। সাতানিনা কিন্তু ছেলেকে দুধ দেবার মতো শক্তি পেল না, তাই দূরে সাবিন পাহাড়ের তলায় একটি গ্রামে একজন ধাইমার কাছে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিতে হল। প্রোফেসর এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই জেনে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল আর ধাইমার খরচ জোগানোর জন্য সিগার, কফি প্রভৃতি নিজের দু’-একটি ছোটখাটো শখ ছেড়ে দিল।

যারা ভেলকি খেলা দেখায় তাদের কখনও লক্ষ করেছেন কি? একের পর এক তারা খেলা দেখিয়ে চলে— আর চারদিকে জনতা ঘিরে দাঁড়িয়ে ব্যগ্র ব্যস্ততায় দেখে সেই খেলা। কিংবা হয়তো সার্কাসের মালিক যখন তার দলের কোনও এক বেচারাকে কোনও একটা শক্ত খেলা দেখাতে বলে চেঁচিয়ে সকলকে শোনায়, ‘এই খেলাটা ভাল করে লক্ষ করুন আপনারা। এখন আমরা আগের চেয়েও শক্ত একটা খেলা দেখাচ্ছি। ভাল করে লক্ষ করুন সবাই।’ খেয়াল করেছেন নিশ্চয়? বেচারা সামান্য ক্লাউন কসমো আন্তনিওকে দিয়ে সার্কাস-মালিক ভাগ্যবিধাতা ওর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত একের পর এক কত শক্ত খেলাই যে না খেলাল তার আর শেষ নেই। কিন্তু সবচেয়ে শক্ত খেলা তখনও ছিল বাকি— ১৮৯৪ সালের ৩০ মে কসমোর ডাক পড়ল সেই খেলায়।

রোজের মতো সেদিনও বিকেল সাড়ে ছ’টায় প্রোফেসর কসমো যথাসময়ে বাড়ি এসে পৌঁছল— সাতানিনা যে মিষ্টি খেতে ভালবাসে, ফিরতি পথে তাই একবাক্স কিনে নিয়ে এসেছে বগলে পুরে। সিঁড়িগুলো আস্তে আস্তে উঠে, পকেট থেকে চাবি বার করে, চাবি লাগানোর ছিদ্রটা অনেক কষ্টে খুঁজে নিয়ে দরজা খুলে সে ভিতরে ঢুকল। কিন্তু ঘরে সাতানিনা নেই— কোথায় গেল সে? এমন সময় সে তো কোনও দিন বাইরে বেরোয় না। খাবার ঘরের টেবিলে কোনও আয়োজন করা হয়নি, রান্নাঘরে রান্না হওয়ার কোনও চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না— নিশ্চয় কিছু হয়েছে তার! আগুন নিভে গেছে, সকালবেলা ঝি এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদোর যেমন পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে ঠিক তেমনি আছে সব। কী হতে পারে সাতানিনার? হয়তো দলফিনোর ধাইমার কাছ থেকে খুব জরুরি কোনও খবর এসেছিল! কিন্তু তা হলেও আপিসে ওর কাছে কোনও খবর না পাঠিয়ে তার চলে যাওয়াও তো সম্ভব নয়। লম্বা সিঁড়ি ভেঙে সে আবার নীচে গেল, বাড়ির দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করল, পাশের বাড়ির তলায় যে ছোট দোকানটা আছে সেখানে খোঁজ নিল, পাশের ফ্ল্যাটের চাকরকে জেরা করল— কিন্তু কেউ কোনও খবরই দিতে পারল না। উপরে, তার নিজের ফ্ল্যাটে, তিনটি ঘর তাদের আসবাবপত্র নিয়ে এমন চুপচাপ— যেন তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছে কখন আবার সেই সুখশান্তিময় জীবনযাত্রা শুরু হবে। পরিপাটি গুছানো পরিবেশের সঙ্গে নিজের বিভ্রান্ত অবস্থার তুলনা কসমো আর সহ্য করতে পারল না। সাতানিনার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল— প্রথমে এদিক ওদিক ঘুরে দেখল খানিক, তারপর টেলিগ্রাফ আপিসে গিয়ে দলফিনোর ধাইমার কাছে একটা রিপ্লাই-পেড টেলিগ্রাম করল। তারপর চরকির মতো একান্ত নিরুদ্দেশভাবে সারা শহরটা সে ঘুরে বেড়াল —রাত হয়ে গেল কত কিছু খেয়ালই রইল না। হঠাৎ তার হুঁশ হল যে টেলিগ্রামের জবাব আসার সময় হয়েছে, তখন সে আবার বাড়ি ফিরে এল— মনে মনে এই আশা নিয়ে যে হয়তো সে বাড়িতে এসেই দেখতে পাবে সাতানিনাকে। কিন্তু দারোয়ানের প্রথম কথাতেই তার সে আশা ভাঙল। এতক্ষণে হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল যে সে বড় ক্লান্ত, এত ক্লান্ত যে আবার সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে আর কিছুতেই পারবে না। কিন্তু তাও পারল। তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শোবার ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালতে আর তার ইচ্ছে করল না— অনেক কষ্টে একটা ইজিচেয়ারে বসে সাতানিনার ফিরে আসার প্রতীক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে, কীসের যেন একটা আওয়াজ তাকে চঞ্চল করে তুলল— মনে হল শব্দটা যেন তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে; মাথার ভিতর দিয়ে, পেটের মধ্যে দিয়ে, হাঁটুর ভিতর দিয়ে এমনকী পায়ের তলায় পর্যন্ত সেই শব্দ; মনে হল শব্দটা সবেগে তারই দিকে আসছে— সারা শরীর তার কাঁপতে লাগল, ভাবনা চিন্তা যেন সব দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আধজাগা অবস্থায় বসে রইল সে। তারপর টেলিগ্রাম নিয়ে পিয়োন বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কি না দেখবার জন্যে জানলার কাছে উঠে গেল। এখানে এসে সে দেখল যে শব্দটা আসছে নীচের রাস্তা থেকে— একটা ইলেকট্রিক লাইট খারাপ হয়ে গিয়ে ওইরকম বিশ্রী আওয়াজ করছে।

সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলফিনোর ধাইমার কাছ থেকে টেলিগ্রাম এল— সাতানিনা সেখানে যায়নি। কসমোর শেষ আশাটুকু নিবে গেল। কয়েক ঘণ্টা পরে ঝি এল রোজকার বাজার আর ঘরদোর পরিষ্কার করে দিতে। টাস্কানির মেয়ে, শক্ত সমর্থ, ঝকঝকে বুদ্ধি, কড়া কথা বলতে মুখে বাধে না।

মনিবকে চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকতে দেখে সে বলে উঠল, ‘খুব ভোরেই আজ ঘুম ভেঙেছে বুঝি।’

‘সে এখানে নেই,’ কসমো জবাব দিল, ‘কাল থেকে— এখানে আর নেই।’

‘সত্যি? কী সর্বনাশ!’ ঝি বলে উঠল।

প্রোফেসর কসমো একবার হাত দুটো দু’দিকে ছড়িয়ে দিল, তারপর আস্তে আস্তে বসে পড়ল চেয়ারে— ওর চেহারা দেখে মনে হল যেন সমস্ত জ্ঞান বুদ্ধি সে হারিয়ে ফেলেছে।

‘সারা রাত ফিরে আসেনি।’ এই কথাটা শুধু তার মুখ দিয়ে বেরোল।

‘কোন কোন জায়গায় তিনি যেতে পারেন, বলুন তো।’ ঝি জিজ্ঞাসা করল।

জবাবে শুধু সে একটা হতাশার ভঙ্গি করল।

ঝি বলল, ‘আমি বলি কী, নীচে… মানে, একতলায় কয়েকজন… কী বলে, কয়েকজন বিদেশি থাকে, তাদের ওখানে একবার খোঁজ করে দেখুন। আমি জানি ওদের মধ্যে একজন… একজন তাঁর ছবি আঁকছিল।’ প্রোফেসর চমকে উঠল, তারপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার স্ত্রী? ছবি আঁকছিল? কখন?’

‘আমি ভেবেছিলাম আপনি জানেন সব। কেন, রোজ সকালে লাঞ্চ খাওয়ার পর উনি তো ওখানেই যেতেন।’

মুখটা হাঁ করে শির-বের করা হাত আস্তে আস্তে পায়ের উপর বুলোতে বুলোতে সে চুপ করে বসে রইল।

ঝি বলল, ‘আমি নীচে গিয়ে জেনে আসছি। বেশি দূরে নয় এই তো দু’পা। লোকটাকেও আমি চিনি— ছবি আঁকে, জাতে ফরাসি।’

এ সব কথা তার কানে গেল কি না কে জানে। ঝি নিজেই তাড়াতাড়ি নেমে গেল নীচে আর একটু পরেই ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। কোনওরকমে দম নিয়ে সে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম তাই! সেও কাল চলে গেছে… একই ভাবে… একই সময়ে… আশ্চর্য নয়?’

চুপ করে বসেই রইল প্রোফেসর কসমো— তার মুখে ভাবের কোনও পরিবর্তন হল না। মৃত মানুষের মতো তার দৃষ্টি! একমনে সে তার পায়ের উপর চাপড় দিতে থাকল। কিছুক্ষণ ঝিটা তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর নিজের মনেই গৃহকর্ত্রী সম্বন্ধে নিজের মতামত প্রকাশ করতে আরম্ভ করলে, ‘এমন বোকা কি আর দেখা যায়। এত ভালবাসে তোকে তোর স্বামী, মুখ ফুটে একটি কথাও বলে না বেচারা, এখানে তো তার কাছে দিব্যি নিশ্চিন্দিতে থাকতে পারতি, তা নয়…’ এবারে মনিবের দিকে ফিরে বললে, ‘কেন আপনি এত মন খারাপ করছেন, মন হালকা করে ফেলুন শান্তি পাবেন। ওরকম ভাবে চুপ করে থাকবেন না। ওর মতো বোকা একটা বদ মেয়েমানুষের জন্যে ভেবে কী লাভ আছে বলুন! আর যদি ভালবাসার কথা বলেন, তা হলে আমি কী বলি জানেন? উনুনে চাপানো দুধের কড়া দেখছেন তো? প্রথমে দুধটা ফুঁসে ওঠে, তারপর ফুটতে থাকে, তারপর উপচে পড়ে যায় চারদিক দিয়ে… ভালবাসাও ওই রকম। কী হবে দুঃখ করে? বুকে বল বাঁধুন। মন হালকা করবার চেষ্টা করুন। ওরকম চুপ করে বসে থাকবেন না।’

বন্ধুভাবে মেয়েটা কথাগুলো বলল, উত্তরে কিন্তু প্রোফেসর কিছুই বলল না— সে যে সব কথা শুনেছে সেটা শুধু তার ঘাড় নাড়া দেখে বোঝা গেল। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জলও বেরোল না তার, অন্যের কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে ইচ্ছেও হল না একটু। নিজে সে কিছুতেই ভেঙে পড়বে না, কারও কাছে এতটুকু সমবেদনা বা সান্ত্বনা সে আশা করে না। অনেকদিন তার মনে হয়েছে যদি কোনও অভাবিত কারণে সাতানিনা মারা যায়, কিংবা আর তাকে ভাল না বাসে তা হলে কী গভীর দুঃখই না সে পাবে— আজ মনের অন্তরতম প্রদেশে কিন্তু সেই দুঃখের কোনও সাড়াই সে পেল না। যা এতদিন মাঝে মাঝে ওর কল্পনায় দেখা দিত, আজ তা সত্যি-সত্যিই ঘটল— কিন্তু আশ্চর্য, কোনও দুঃখ, কোনও কষ্ট, কিছুই সে বোধ করছে না। সে ভেবেছিল যে এরকম ঘটলে তার চারদিকে সমস্ত— পৃথিবী ভেঙে পড়বে, অন্তত সে নিজে এই আঘাত কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না— কিন্তু কিছুই তো তার হল না, কিছু না। ঝিকে বাকি মাসের মাইনে চুকিয়ে দিয়ে তাকে ও নিশ্চিন্তভাবে বিদায় দিল; সে বেচারা যাবার সময় যখন আরও গোটা কত সান্ত্বনার কথা বলল, তখনও চিরকালের অভ্যাসমতো, যেন কিছুই হয়নি, এমনিভাবে বলতে লাগল, ‘তা বেশ, তা বেশ।’

ঝি চলে যাবার পর, একলা যখন সে চেয়ারটিতে এসে বসল, তখন হঠাৎ সে বুঝতে পারল যে একটা আঙুল তোলবার মতো ইচ্ছাশক্তিও তার আর অবশিষ্ট নেই। তা হলে সত্যি-সত্যিই তার চারদিকের পৃথিবী ধ্বসে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এত আস্তে ধরেছে ভাঙন— এত আস্তে, যে সে নিজেই বুঝতে পারেনি। চেয়ারগুলো ঘরে ঠিকঠাক সাজানো… পোশাকের আলমারিটাও তাই… বিছানাটাও পাতা রয়েছে ঠিক… কিন্তু ভবিষ্যতে কার কী কাজে লাগবে এগুলো?…

দু’হাত দিয়ে সে তার পা দুটো ঘষতে লাগল, ক্রমশ ক্রমশ আপনা থেকেই জোরে, আরও জোরে— তার মনে হল যেন তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে —কী এক অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা হাড়ের ভিতর থেকে সমস্ত শরীরে যেন ছেয়ে যাচ্ছে। চেয়ার থেকে সে উঠতে পারল না, শুধু বসে বসে ঝি যে খবর দিয়ে গেল সেই কথাগুলো বিড়বিড় করে বকতে লাগল, ‘ছবি আঁকা… ফরাসি… রোজ সকালে তার কাছে যেত।’ ঠান্ডায় তার দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল— সে শুধু চুপ করে বসে আপনা থেকেই ক্রমশ আরও জোরে নিজের পা ঘষতে লাগল, কাঁপুনি কিন্তু কিছুতেই থামল না। শুধু তিনটি কথা গেঁথে গেল তার মনে— ছবি, ফরাসি-আর্টিস্ট, আর সে যে রোজ সকালে যেত তার কাছে সেই কথা। তিনটি কথা, কাগজের তিনটি হাওয়া-কলের মতো তার চোখের সামনে যেন অনবরত ঘুরতে আরম্ভ করল— আর সেই ঘূর্ণিপাকের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে ক্রমশ তার মাথাও আরম্ভ করল ঘুরতে। একবার ভয়ানক কাঁপুনির পর সে অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেল মাটিতে।

১৯০৪ সালের মার্চ— ন’বছর দু’মাস কেটে গেছে। প্রোফেসর কসমোর এখন আর মনেই পড়ে না, যে সার্কাস-মালিক ভাগ্যবিধাতার হুকুম মতো সেই সবচেয়ে শক্ত খেলা খেলতে গিয়ে সে হাসপাতালে প্রায় মৃত্যুর দরজায় গিয়ে পৌঁছেছিল। সাবিন পাহাড়ের তলায় ছোট গ্রামটিতে থাকত যে তার ছোট্ট ছেলেটি— তার কথাই সেদিন তাকে বেঁচে থাকবার শক্তি দিয়েছিল। তার কাছেই এখন দলফিনো থাকে। বেচারার বয়স দশ বছরেরও বেশি হল কিন্তু দেখলেই মনে হয়, যে নেহাৎ বাপের অশেষ সেবাযত্নে অনেক কষ্টে সে বেঁচে আছে। এত রোগা আর দুর্বল সে, যে স্কুলে পড়ার সময় তার বাবার যে অসুখ হবার উপক্রম হয়েছিল, তারও সেই অসুখ হবার সম্ভাবনা।

আট বছর বয়স পর্যন্ত দলফিনো জানত যে তার জন্মের পরেই তার মা মারা গেছেন। কিন্তু বছর দুয়েক আগে, একদিন যখন তার বাবা আপিসে, তখন মুখে রং আর পাউডার মাখা বিশ্রী চেহারার একটি স্ত্রীলোক তাদের বাড়িতে এসে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তাকে বলে যে তার মা মারা যায়নি, বেঁচেই আছে— সে তার মা, সত্যিই সে তার মা, তাকে ভয়ানক ভালবাসে সে, তার কাছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত থাকতে চায়, এমনি করে তাকে বুকে জড়িয়ে লক্ষ্মী সোনা বলে আদর করতে চায়।

এই সময় দলফিনোর ধাইমা এসে ঘরে ঢোকে। বিধবা হবার পর সে রোমে তার পালিত ছেলের কাছেই চলে আসে; এখন সে দলফিনোর ধাই আর বাড়ির ঝিয়ের কাজ করে। সকালে বাজার থেকে ফিরে এসেই ছেলেকে ওই চরিত্রহীনার কোলে দেখে সে ছুটে এক ঝটকায় তাকে ছিনিয়ে নিল। দলফিনো বেচারা ভয়ে জড়সড় হয়ে শুনল যে তার মা বলে পরিচয় দিয়ে যে মেয়েমানুষটি এসেছিল তাকে তার ধাই যা মুখে আসে তাই বলে গাল দিচ্ছে। দু’জন স্ত্রীলোকে শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি, বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটল, আর এই উত্তেজনার ফলে দলফিনোর বেশ কয়েকদিন ভীষণ জ্বরে ভুগতে হল।

কসমো আন্তনিও থানায় গিয়ে ডায়েরি করে এল যে ওই সর্বনেশে মেয়েমানুষটা তার যথেষ্ট ক্ষতি করেও খুশি নয়; এখন আবার ছেলেটার সর্বনাশ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

অনেক দিন আগে, ওদের বিয়ে হবারও আগে সাতানিনা যে বলেছিল যেদিকে দু’ —চোখ যায় চলে যাব— সেই অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরে বেড়ানোর শখও তার অনেকদিনের। যে ফরাসি আর্টিস্ট তার ছবি আঁকছিল তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সে প্যারিসে বছর চারেক ছিল, তারপর অবনতির ধাপে ধাপে নামতে নামতে সে নীস, তুরিন, মিলান অনেক শহরেই ঘুরে বেড়িয়েছে। রোমে পৌঁছবার কয়েকদিন পরেই সে তার স্বামীর চোখে পড়ে যায়। সাতানিনা যে অধঃপাতের চরমে নেমেছে এ কথাই কসমো ভেবে রেখেছিল তবু নিজের চোখে তাকে দেখে ও জ্ঞান হারাল। পথের লোকজন ধরাধরি করে তাকে ডাক্তারের দোকানে নিয়ে যেতে তবে ওর আবার জ্ঞান ফিরে আসে।

সাসারিতে থাকার সময় দন মেলকিয়রা স্পানু নামে সার্দিনিয়ার এক পুরোহিতের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল— রোমে সে তার প্রায় হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়ল— বহুকাল পূর্বে কসমো পুরোহিত হতে হতে নাস্তিক হয়ে পড়েছিল— এতদিন পরে তার মধ্যে আবার ধর্মভাব জাগিয়ে তোলার জন্যে দন স্পানুর চেষ্টার আর শেষ ছিল না। আপিসে কোনও কাজ না থাকার দরুন যখন প্রোফেসর ক্লান্ত হয়ে পড়ত তখন সময় কাটানোর জন্যে একটার পর একটা ধর্ম সম্বন্ধীয় বই দন স্পানু ওকে পড়তে দিত। তার যৌবনে সে যে এত কষ্ট পেয়েছিল সে যে শুধু তার মাতৃস্বরূপ পবিত্র ধর্মের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছিল বলেই— এ কথা পুরোহিতের তর্কে প্রোফেসর মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু তাই নয়, নিশ্চয় কোনও বিশেষ কারণে ভগবান তাঁর দেবদূতদের আর সাধু মহাত্মাদের দলে দলফিনোর মতো সুন্দর ছেলেকেও টেনে নিতে চাইছেন। এ শুধু তাঁর পবিত্র সাবধানবাণী— অবিশ্বাসী প্রোফেসর কসমো পৃথিবীতে যখন একা হয়ে পড়বে তখন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সে যেন কোনও মঠে শ্রমণের জীবন যাপন করে, তাঁর নিশ্চয় তাই ইচ্ছে। ট্রফন্তানে-তে একটা শ্রমণের মঠ আছে— ভারী সুন্দর জায়গা, ভগবানের আশীর্বাদ যেন সেখানে ঝরে পড়ছে। অনুতাপ করার সত্যিই উপযোগী জায়গা— কসমো সেখানে নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারবে।

এইসব কথা শুনে প্রোফেসর কসমো অভ্যাসমতো গলাটা একবার বাড়িয়ে, ঘাড় কুঁজো করে, চোখ দুটো বন্ধ করে বিড়বিড় করে শুধু বলত, ‘তা বেশ, তা বেশ।’

কোনও কোনও দিন আপিস থেকে বেরিয়ে সে দেখত সান্তা মারিয়া দেলা মিনার্ভার সিঁড়ির উপর দন স্পানু তার জন্যে অপেক্ষা করছে— অন্যদিকে প্যান্থিয়নের সিঁড়ির গায়ে রানির মতো হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীও। দূর থেকে স্ত্রী ও পুরোহিত দু’জনে দু’জনের দিকে হিংস্র ভাবে তাকিয়ে আছে। যতই কামান না কেন পুরোহিতের মুখে সর্বদাই দাড়ি থাকত, তিনি দূর থেকে স্ত্রীলোকটির দিকে তাকিয়ে সব সময় হাত দিয়ে দাড়ি ঘষতেন— আর মেয়েটিরও রংমাখা ঠোঁটে সর্বদা বিশ্রী একটা হাসি ফুটে থাকত।

প্রোফেসর আপিস থেকে সামনের ছোট মাঠটায় নেমে একবার আড়চোখে স্ত্রী যে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সেই দিকে তাকাত তারপর সোজা পা বাড়াত পুরোহিতের দিকে। ভিয়া পিয়া দি মার্মো পর্যন্ত যেতে না যেতে ওর স্ত্রী তাকে ধরে ফেলত— টাকা চাইলে সে কিছুতেই না বলতে পারত না, কিন্তু ক্ষমা করবার কথা বললেই ঘৃণায় ও মুখ ফিরিয়ে নিত। পুরোহিতের কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ও জানত যে অনেকখানি বকুনি খেতে হবে আজ স্ত্রীকে টাকা দেওয়ার জন্য। হাত দুটো ঘষতে ঘষতে তার স্বাভাবিক হাল ছেড়ে-দেওয়ার ভঙ্গি করে আগে থেকেই সে বলে উঠত, ‘তা বেশ, তা বেশ।’

এদিকে বসন্ত এসে পড়ল এই সময়টা যক্ষ্মা রোগীদের পক্ষে বড় খারাপ, রোমের জল হাওয়া এই সময় ভাল থাকে না— ডাক্তার তাকে পরামর্শ দিলেন দলফিনোকে নিয়ে অন্তত বসন্তকালের প্রথম মাসটা সমুদ্রের ধারে কাটিয়ে আসতে। কসমো এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করে ১৯০৪ সালের ৫ মার্চ ছেলেকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে নেততুনো গ্রামে সাজানো-গুছনো ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে এসে উঠল।

এক মাস নিশ্চিন্ত মনে ছুটি উপভোগ করবার মতো জায়গা বটে। আগের দিন পর্যন্ত এখানে বৃষ্টি হয়ে গেছে কিন্তু এখন পরিষ্কার আকাশ ঝকঝক করছে রোদ্দুরে, হাওয়া দিচ্ছে মৃদু মৃদু —বসন্ত যে এসে পড়েছে তাতে আর সন্দেহ নেই।

আর সত্যি সত্যিই রোম ছাড়ার একটু পরেই গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রোফেসর অনুভব করল— সবুজ মাঠের মধ্যে একটার পর একটা লাল ফুলের রূপ ধরে বসন্ত যেন তার সামনে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলছে! কী ফুল? বোধহয় ফুল ধরেছে পীচ গাছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তো একটা— ওই আর একটা— ওই যে আরও আরও অনেকগুলো। এতদিনে সত্যিসত্যিই তা হলে বসন্ত এসেছে! পীচ গাছগুলো রক্তিম আনন্দমুখর, বসন্তের আবির্ভাবে!…ওঃ, কত দিন পরে সে আজ লক্ষ করছে এসব।

গভীর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল সে— মাঠের খোলা মিষ্টি হাওয়ায় নিশ্বাস নেবার অভিনব অনুভূতি ওকে যেন মাতাল করে তুলল। তার মনে হল, নিষ্ঠুর ভাগ্য তার উপর কিছুটা দয়া করবার জন্যেই এই অপরূপ দৃশ্য তার চোখের সামনে মেলে ধরেছে। এক অচিন্তনীয় আনন্দে ওর বুক ভরে উঠল— বর্তমানের এই ধূলিমাখা দিনগুলি দূরে রেখে কোন অজানা পথ বেয়ে ও সেই বহুদিন আগেকার ছেলেবেলায় ওর নিজের গ্রামে ফিরে গেল। তখনকার মতো তার অতীতের, বর্তমানের সব দুর্ভাগ্যের কথা গেল ভুলে— তার ছেলের এই মারাত্মক অসুখ, তার নাম কলঙ্কিত করছে যে চরিত্রহীনা ভুলল তাকে, যে পুরোহিত তাকে এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না তাকেও ভুলল। দলফিনো নিশ্চয় বাঁচবে না, তবু তার আরোগ্যের জন্যে তার সামান্য আয়ের অতিরিক্ত ব্যয় যে সে করছে, তার যে এই দুঃখময় সুতিক্ত অস্তিত্ব, জীবনের এই দুর্বহ বোঝা— কিছুই আর তার মনে রইল না। অন্তরে তার সব অন্ধকার বটে, কিন্তু বাইরে তো এই সবুজ মাঠ, নীল আকাশ, বাতাসের মৃদু সজীবতা, বসন্তের উত্তপ্ত নিশ্বাস। মুগ্ধ হয়ে কসমো বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

সত্যিই, মধুর হতে পারত জীবন, কিন্তু আর কোথাও নয়, এই খোলা মাঠের সবুজের মধ্যে। শহরের সরু গলির মধ্যে ভাগ্যের হিংস্রতা যত প্রখর, এখানে এই মাঠের মধ্যে তা নিশ্চয়ই হতে পারে না। ভাগ্যের নির্যাতনের একটা মূর্তি ও মনে মনে তৈরি করেছিল, তার মনে হত সেই মূর্তি সব সময় তার পিছনে পিছনে আসছে। বিরাট বীভৎস সেই মূর্তি— সোজা হয়ে দাঁড়াবার অবকাশ তাকে দেয় না, সব সময় মাথা নিচু করে চলতে হয় তার আক্রমণের ভয়ে। এই বীভৎস মূর্তিটি তার স্ত্রীর।

এই সুন্দর দৃশ্যকে রুদ্ধ করে দিয়ে আবার তার স্ত্রীর মূর্তি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল— সে তাড়াতাড়ি সেই ছবি মন থেকে দিলে দূর করে। এখন আবার সে বাইরের জগৎকে দেখতে পাচ্ছে— ওই দূরে দেখা যায় আলবান পাহাড়ের দল। কেউ যেন উপর দিকে ওদের তুলে ধরে আছে— এত হালকা দেখাচ্ছে ওদের, ওরা যে নিরেট পাথরের তৈরি তা মনেই হয় না। ওই যে মন্তে কাভে, চূড়ায় মেপল আর বীচের মালা পরে বসে আছে, হালকা বনের মাঝে আছে পুরনো আশ্রমটি। আর ওই আরও দূরে ফ্রাসাটি— সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল। ট্রেনের শব্দে এক ঝাঁক চড়ুই পাখি উড়ে গেল— ওদের মাথার উপরে, অনেক উঁচুতে চিকচিকে পাখায় ভর দিয়ে একটা চিল। চিলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এতদিন পরে ল্যাটিন ব্যাকরণের প্রথম কথাটি প্রোফেসরের মনে পড়ল— উঃ কতদিন আগে ও ব্যাকরণ শেখাত— সেই যে: হ্যাঁ তাই তো। এখন যেন মনে হচ্ছে তার সেই স্কুলমাস্টার-জীবনের প্রথম ক’টা বছরও বেশ ভালই কেটেছিল। সব সুখ ভাঙল যেদিন থেকে সে একই বাড়িতে দিন কাটাতে আরম্ভ করল ওই—

প্রোফেসরের মন আবার খারাপ হয়ে গেল, বিড়বিড় করে সে বলল, ‘তা বেশ।’

এরকম মনের অবস্থা অবিশ্যি তার আর বেশিক্ষণ রইল না— করচ্চেতো স্টেশন পার হবার পর সে বুঝতে পারল যে সমুদ্র আসতে আর বেশি দেরি নেই। ছেলেমানুষের মতো ওর মন খুশি হয়ে উঠল। ব্যগ্র হৃদয়ে সে অপেক্ষা করে রইল— যে-কোনও মুহূর্তে সেই বিরাট নীলের সৌন্দর্য তার চোখের সামনে দেখা দেবে। সমুদ্র, সমুদ্রকে সে এত ভালবাসে— কত বছর আগে সে সমুদ্র দেখেছিল শেষবার, আর একবার দেখার কী আকুল আগ্রহই না ছিল তার মনে। ওই তো! ওই তো দেখা যায়! প্রোফেসর এত বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল যে দাঁড়িয়ে উঠে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অসীম আগ্রহে আর আনন্দে সে সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে লাগল। একটু পরেই তার মাথা ঘুরে উঠল, বসে পড়ে সে দু’হাতে মুখ ঢাকল।

ট্রেন কয়েক মিনিটের জন্যে আনৎসিও নামে একটা সুন্দর ছোট্ট শহরে থামল— এ শহরে প্রোফেসর কখনও আসেনি। স্টেশন থেকে শহরের যতটুকু দেখা যায়, ট্রেন থেমে থাকার সময়টুকু ও তাই দেখে কাটাল। একটু পরেই গাড়ি থামল নেততুনোতে— প্রথম সমুদ্র দেখে প্রাণভরে যে নিশ্বাস নিয়েছিল, সেই নিশ্বাসের ঘোরে তখনও সে আচ্ছন্ন— এত গভীর নিশ্বাস অনেক দিন সে নেয়নি।

আপিসের কেরানিরা এই ছোট্ট শহরটা সম্বন্ধে ওকে অনেক খবর দিয়েছিল। শহরের সবচেয়ে বড় বাজারে গিয়ে, সে খোঁজ নিল কোথায় সমুদ্রের ধারে কম ভাড়ায় ছোট্ট ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে। বাজারের তলায় ডান দিকে ছোট একটি বাড়ি, একেবারে সমুদ্রের উপরে, ভাড়া ওর পক্ষে বেশি হলেও কোনও রকমে চালিয়ে নিতে হবে— প্রোফেসর এই বাড়িটিই নেবে ঠিক করল। বাজারটা বাড়িটির পিছন দিকে পড়ল, এদিকে সামনেই টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য যেসব সেপাইরা দলে দলে আসে তাদের ব্যারাক-বাড়ি। এদিককার ঘরের জানলাটা প্রায় মাটির সঙ্গে লাগা, ওদিকে অর্থাৎ সমুদ্রের দিকের ঘরের জানলাটা কিন্তু প্রায় দোতলা সমান উঁচু। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে মনে হয় যে-কোনও মুহূর্তে সমুদ্র যেন ঘরের মধ্যেই ঢুকে পড়বে, মাঝখানকার বেলাভূমি মোটেই চোখে পড়ে না। প্রোফেসর বাড়িউলিকে ভাড়া জমা দিয়ে বলল যে সে কাল থেকে এসে থাকবে, তারপর বেড়াতে বেরোল সমুদ্রতীরে।

তার বাড়ির পশ্চিম দিকেই শহরের বহু পুরনো ষোড়শ শতাব্দীর বিরাট দুর্গ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালগুলো কালো হয়ে গেছে— সমুদ্রের ধার থেকে দেয়ালগুলো গাঁথা। দুর্গের তলায় সমুদ্রের ঢেউ যেখানে এসে ভেঙে পড়ছে, ও সেখানে পাঁচিলের উপর ঘণ্টাখানেক অপূর্ব আনন্দ উপভোগে কাটিয়ে দিল। দূরে মন্তে চিরচেল্লোর দেখা যায় পাথরের আভাস— মনে হয় যেন নীল সমুদ্রের মধ্য থেকে স্বর্গের মনোরম একটা দ্বীপ উঠেছে। আরও দূরে সমুদ্রতীরের দিকে তাকালে দেখা যায় স্তুরার দুর্গ। ডানদিকে একটু ওধারে জাহাজে ভর্তি, কয়লার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আনৎসিও বন্দর, তারপরে অবাধ অশেষ জল সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে— এত শান্ত যে একটা ছোট ঢেউ পর্যন্ত তীরে এসে ভেঙে পড়ছে না। অনেক কষ্টে সে এই অপরূপ দৃশ্য থেকে নিজেকে টেনে এনে অল্প কিছু খেয়ে নিল। বিকেল পাঁচটার আগে রোমে ফিরে যাবার আর গাড়ি নেই; মাঝের এই ঘণ্টা তিনেক সময় কাটানোর জন্যে আনৎসিও আর নেততুনোর মাঝামাঝি বর্গেস-এ যে সুন্দর পার্ক আছে— সেইখানে যাবে ঠিক করল।

একদিকে সবুজ বন আর মাঠ, অন্যদিকে পাহাড়ের তলায় সমুদ্র— সোনা মাখা বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে ভারী সুখী মনে হল কসমোর; মনে হল এত সুখী জীবনে আর কখনও সে হয়নি। পার্কে ঢোকবার দরজা খোলাই ছিল, আত্মহারা হয়ে সে ভিতরে ঢুকে একটা চড়াই রাস্তা ধরে উপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ শুনতে পেল পেছনে কে চেঁচাচ্ছে, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। এখানে ঢুকতে গেলে টিকিট কিনতে হয়; দাঁড়ান, টিকিটের দাম দিন, পাঁচ সলদি।’

পিছন ফিরে সে দেখল একটি বামন তার দিকে দৌড়ে আসছে। সে স্ত্রীলোক, এই পার্কের দরজায় পাহারায় থাকে। তার ইচ্ছে ছিল বাজে খরচ মোটেই করবে না, কিন্তু এই পাঁচ সলদি খুশি মনেই সে দিল। তারপর বনের ছায়া ঘেরা সুড়ঙ্গের মতো নির্জন রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল একা একা। তার মনে হল যেন সে এখানে এসেছে স্বপ্নে। বড় বড় সুন্দর গাছগুলোকে তার মনে হল যেন কোনও স্বপ্নজগতের— তারা মৌন, তারা ধ্যানমগ্ন। পাখির গানে যেন এই নীরবতা নষ্ট হচ্ছে না, বরং অস্পষ্ট স্বপ্নের রেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনেকে তাকে বলেছিল যে পার্কের যেসব জায়গায় লোক চলাচল কম, সেইসব জায়গায় গেলে নাইটিংগেলের দেখা মেলে; এখন তার মনে হল যেন অনেক দূরে একটা নাইটিংগেলের কণ্ঠ সে শুনতে পাচ্ছে। সেই শব্দের অনুসরণ করতে করতে অনেকখানি চলার পর ভারী সুন্দর এক পাইন বনের মধ্যে ও এসে পড়ল। গাছগুলোর লম্বা সোজা গুঁড়িগুলো যেন মস্ত বড় এক উপাসনা গৃহের সারি সারি থাম বলে মনে হচ্ছে; অনেক উঁচুতে গাছের পাতায় পাতায় এমন সুন্দরভাবে ছেয়ে গেছে যে নীচে থেকে আকাশের একটুও দেখা যাচ্ছে না। অপরূপ নিজস্ব একটি আবহাওয়া নিয়ে পাইন বনটি দাঁড়িয়ে— গির্জেগুলোর ভিতরে যেমন তামাটে একরকমের গন্ধ পাওয়া যায় এখানেও আভাস সেই গন্ধের।

আর হাঁটতে পারছে না প্রোফেসর। মাথা থেকে টুপিটা খুলে সে প্রথমে বসল তারপর শুয়ে পড়ে আরম্ভ করল ভাবতে।

বহু বছর ধরে একের পর এক বিরাট দুর্ভাগ্যের বোঝা ওর মনের চারপাশে অন্তহীন দুঃখের একটা ঘন আবরণ তৈরি করেছিল। দৈনন্দিন জীবনের দুশ্চিন্তায় পীড়িত হয়ে তার মন সাংসারিক চিন্তার বাইরে বেরুতে পারেনি। সেই ছেলেবেলায় তার মন সাধনার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কিন্তু তারপরই সে গেল পাগল হয়ে, ধর্মবিশ্বাস তার একেবারে খসে পড়ল। আজ যেন তার ভাগ্যের সঙ্গে হয়েছে সাময়িক সন্ধি— জীবন যে সত্যি-সত্যিই উপভোগ্য এই পরম সত্যের অস্পষ্ট আভাস আজ সে পাচ্ছে। অস্পষ্টভাবেই সে সত্যকে দেখতে পাচ্ছে,

কারণ তা না হলে, এতদিন যে দুর্বিষহ চিন্তায় ও নিপীড়িত ছিল, সেই চিন্তার শেষে আলোর সন্ধানে এখনও সে বোকার মতো ছুটে আসবে কেন? জীবনে সে কখনও জ্ঞাতসারে কারও কোনও ক্ষতি করেনি বরং উলটে তার সাধ্যমতো লোকের উপকারই করে এসেছে— তবু ভাগ্য তার তূণ খালি করে সমস্ত শর একলা তাকে লক্ষ করেই ছুড়ে মারছে কেন, এই কথাই সে ভাবতে লাগল। পুরোহিত হবার বাসনা ত্যাগ করে সে ঠিকই করেছিল— পুরোহিত-মণ্ডলীর মতের সঙ্গে তার বিচারশক্তির কোথাও কিছু মেলে না। বাপ-মা মরা অনাথ মেয়েটাকে বিয়ে করে আশ্রয় দিয়ে সে তো কিছু অন্যায় করেনি— আর মেয়েটার ইচ্ছামতোই তো সে তাকে বিয়ে করেছিল, সে তো খোলা মনে কোনওরকম সন্দেহের অবকাশ না রেখে বিয়ে না করেই তাকে আশ্রয় দিতে চেয়েছিল। সেই স্ত্রীই তার সঙ্গে নিষ্ঠুর প্রবঞ্চনা করে তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল— তার সমস্তটা জীবন দিল নষ্ট করে। আর এখন? এখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে তার একমাত্র সান্ত্বনা— খুব সামান্য হলেও সান্ত্বনা— এটুকুই যে তার ছেলেকে চোখের সামনে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাবার সাক্ষী হয়ে তাকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে! কেন? এই বিপর্যয় মানুষের জীবনে আসে কোথা থেকে? ভগবানের দান? না, ভগবানের কখনও এরকম ইচ্ছে হতে পারে না। যদি ভগবান থাকেন তা হলে তিনি অন্তত পৃথিবীর ভাল লোকদের প্রতি দয়াই করবেন। না, ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা মানে তাঁকে অপমান করা। তিনি নেই। তা হলে, তা হলে কে? পৃথিবীকে শাসন করছে কে? কার হাতের মুঠোয় দুর্ভাগা লোকদের জীবন?

একটা পাইন ফল… সত্যিই কি? একটা পাইন ফল? হ্যাঁ, সত্যি-সত্যিই একটা বড় পাইন ফল এই সময় গাছের ডাল থেকে খসে প্রোফেসরের মাথার উপরে পড়ে তার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেল।

বাজ পড়লে মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়ে যায় বেচারা প্রোফেসর তেমনি নিঃসাড় পড়ে রইল। জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখল যে রক্তে সমস্ত জায়গাটা একেবারে ভেসে গেছে। মাথার উপর থেকে কানের পাশ পর্যন্ত লম্বা একটা ক্ষত থেকে তখনও রক্ত পড়ছে প্রচুর। দুর্বল মস্তিষ্কে অনেক কষ্টে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর আস্তে আস্তে পার্কের গেটে এসে পৌঁছল। গেটের পাহারায় যে বেঁটে স্ত্রীলোকটি থাকে, সে তার রক্তাক্ত মুখ আর মাথা দেখে চিৎকার করে উঠল: ‘যিশু! কী হল তোমার? এত রক্ত কীসের?’

সে তার কম্পিত হাতটি একবার তুলল, ব্যথার বা আনন্দের হাসিতে মুখটা একটু বাঁকাল, তারপর আমতা আমতা করে জবাব দিল, ‘সেই… সেই পাইন ফল… যে পাইন ফল সারা পৃথিবীকে শাসন করে… সেই, সেই আমার এই দশা করেছে।’

স্ত্রীলোকটি ভাবল যে লোকটা একেবারে পাগল! পাশের ডেয়ারি থেকে একজন গোয়ালাকে ডাকতে সে ছুটল— পার্কের পাশেই রেল লাইনে যে মজুররা কাজ করছে তাদের মধ্যে একজনকে ডেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি দু’জনে মিলে আহত লোকটিকে কাছেই আর্সেনিগো হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে প্রোফেসরের মাথাটা প্রথমে কামিয়ে দেওয়া হল, তারপর পাঁচটা বড় বড় সেলাই দিয়ে ক্ষতটা দেয়া হল জুড়ে; সব শেষে লাগানো হল ব্যান্ডেজ। প্রোফেসরের একটু তাড়া ছিল, পাছে ট্রেন ফেল হয়। রোগীকে এখুনি ট্রেনে যেতে হবে শুনে ডাক্তার ঠিক করলেন মাথাটা সম্বন্ধে আরও ভাল ব্যবস্থা তিনি পরের দিন করবেন— আজ তাড়াতাড়ি তার মাথায় পাগড়ির মতো করে একটা কাপড় জড়িয়ে দিলেন। সব যখন হয়ে গেল, তখন টুপিটা মাথায় দিতে না পেরে হাতে নিয়ে কসমো আন্তনিও ঘাড়টাকে কুঁজো করে, আস্তে আস্তে গলাটা লম্বা করার চেষ্টা করে, চোখ দুটো অর্ধেক বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তা বেশ!’

‘প্রিয় বসন্ত,

মানুষ তাদের পঞ্জিকায় তোমার আসার দিন নির্দেশ করে দিয়েছে। এ বছর তুমি যে তার আগেই কেন এসেছ, তা আমি বুঝতে পারছি না। এ বছর খুব জোর শীত পড়েনি, চলে যাওয়ার আগে পৃথিবীর কিছু ক্ষতি সে করে যেতে চায়; সে অধিকারও তার আছে। দু’-একটা ছোটখাটো ঝড় নিয়ে সে এখন একটু ব্যস্ত। সে চায় যতক্ষণ না এই ঝড়গুলোর বোঝা সে ঝেড়ে ফেলতে পারছে, অন্তত ততক্ষণ তুমি একটু সরে দাঁড়াও। তার এই অনুরোধ হয়তো তোমার মনে নাও লাগতে পারে। তাই সে এও বলছে, তুমি যখন শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে, বিজয়ীর মতো প্রবেশ করবে তখন পথঘাট ভিজে থাকলে তোমার ছোট্ট লাল পা দু’টি কাদায় মাখামাখি হয়ে যেতে পারে। বয়স হয়ে গেলেও শীত এখনও বুড়ো হয়নি, তাই সে তোমাকে বলছে যে তার যৌবনের তেজটা বের করে দেবার সময়টুকু তুমি অন্তত দাও। সে শপথ করে বলছে যে হাওয়া থেকে সব হিম সে শুষে নিয়ে যাবে, পথঘাট সে নিজেই মেখেছে কাদায়, নিজেই দিয়ে যাবে সব সাফ করে। যদি তুমি তার ইচ্ছা পূরণ করো তা হলে শুধু যে সে-ই খুশি হবে তা নয়, আমিও হব না কম খুশি। প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে বলি একটি খুব ভাল লোককে তার জন্ম থেকেই আমি খুব যত্নের সঙ্গে দেখাশুনো করছি। তাকে কষ্ট দিয়ে কী আনন্দ যে আমি পাচ্ছি তা তোমায় কী বলব। এই তো কাল সে একটা খুব সুন্দর পার্কে পাইন বনের তলায় শুয়ে শুয়ে তোমার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিল। মজা করবার জন্যে আমি তার মাথায় একটা সুন্দর, বড় শক্ত, পাইন ফল ফেলে দিলাম। তাতেই লোকটা মরে যেতে পারত কিন্তু, উঁহু, মেরে তো আমি ফেলব না। তুমি তো জানো ভাই, আমার পতাকায় কী চিহ্ন আঁকা আছে। একটা বেড়াল একটা ইঁদুরকে না মেরে ফেলে তাকে নিয়ে খেলা করছে…’

অনেকদিন আগে একটা পুরনো বইয়ে এই রকম যেন কী একটা পড়েছিল— সেই ছাঁচে কসমো আন্তনিও বেশ ভাল একটা বক্তৃতা লিখে ফেলল। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা যে তার প্রতি কী দুঃসহ সেইটে দেখাবার জন্যে ওর লেখার এই প্রচেষ্টা, গেল পনেরো দিন ধরে সে নিজের মনের ভিতর কথাগুলো আলোচনা করছিল; তার স্থির বিশ্বাস যে তার ভাগ্যনিয়ন্তা বসন্ত দেবতার কাছে ঠিক এই ধরনেরই আবেদন জানিয়েছিলেন এবং দেবতাও প্রসন্ন মনে তথাস্তু বলে তাকে কৃতকার্য করে ছিলেন। মাথায় তখনও পাগড়ি এঁটে প্রোফেসর দলফিনোর বিছানার পাশে বসে ছিলেন। নেততুনো স্টেশনে নামবার পর থেকেই ওর জ্বর আসে, এখনও সে জ্বর ছাড়েনি; বেচারা একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে। রোমে থাকার সময় জ্বর আসত শুধু রাত্রে।

কিন্তু এই হাওয়া, এই হাওয়া, এই হাওয়া! গেল পনেরো দিন ধরে দিনে রাত্রে এক মুহূর্তের জন্যেও হাওয়ার বেগ কমেনি একটুও। সরগমের সবগুলো পরদায় সুর কাঁপিয়ে শিস দিয়েছে, চিৎকার করেছে, করেছে গর্জন। এক-এক সময় এমন এক-একটা দমকা এসেছে যে মনে হয়েছে বাড়িঘর বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে সব। বাড়িঘর ওড়াবার মতো ক্ষমতা হয়নি— শুধু কোথাও কোথাও উড়িয়েছে কয়েকটা টালি, টেলিগ্রাফের থাম ভেঙেছে কয়েকটা, শিকড়সুদ্ধ উপড়িয়ে ফেলেছে কয়েকটা গাছ। সমুদ্র আর-এক খেলা খেলে— বড় বড় ঢেউ তুলে ওদের ছোট্ট বাড়িটার দেয়ালে প্রচণ্ড আওয়াজ করে ভারী তার ফুর্তি। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রে জাহাজ থাকলে যে অবস্থা হয় প্রোফেসরের অবস্থা সেই রকম। দলফিনো বেচারা অসম্ভব ভয় পেয়ে গেছে— তার বাবা তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু ওই ভীষণ হাওয়ার গর্জন— ওর মনে হচ্ছে ওকে ভেদ করে ওর কথা বলার ক্ষমতা, এমনকী ওর নিশ্বাস ফেলার শক্তি পর্যন্ত যেন ওই বাতাসের গর্জন কেড়ে নিচ্ছে। নৈরাশ্যের অতল নীরবতায় প্রাণ যখন প্রায় হাঁফিয়ে ওঠে তখন মাঝে মাঝে ধাইয়ের গলায় ওষুধ দেবার জন্যে প্রোফেসর এক-একবার উঠে যায়— ওদের দুর্ভাগ্যের বোঝা আরও ভারী করবার প্রচেষ্টায় নার্সের গলায় অসুখ করেছে— সেও শুয়ে আছে বিছানায়।

কার্বলিক এসিডের বোতল এক হাতে, অন্য হাতে গলায় পেন্ট করার ব্রাশ দেখলেই ধাই আঁতকে উঠে বলে, ‘সাবধান হয়ে লাগাবেন কিন্তু, বেশি লাগাবেন না যেন।’

বিছানার উপর উঠে বসে সে হাঁ করে— গলার ভিতরটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। বেশি দেবার ইচ্ছে না থাকলেও জানালায় বাতাসের শব্দ প্রোফেসরের হাতটা কাঁপিয়ে দেয় আর তার ফলে চারদিকে খানিকটা ওষুধ ছড়িয়ে পড়ে— বহুভাগ্য ধাইয়ের যে চোখে এক ফোঁটা পড়ে চোখটা কানা হয়ে যায় না।

‘এবারে থুথু ফেলো, থুথু ফেলে দাও।’ বলতে বলতে সে দলফিনোর কাছে ফিরে আসে চোখ দুটো ওর হিংস্রভাবে জ্বলতে থাকে। কার্বলিক এসিড… বিষ… না, খুব কম, তা ছাড়া দলফিনোকে এই অবস্থায় ও কী করে ছেড়ে যাবে। নাঃ, যদিও খুব লোভ হচ্ছে তবুও এখন সে কিছুতেই পারবে না… ওঃ, এই বাতাসই ওকে পাগল করে তুলবে। ‘সমুদ্রের ধারে ছুটি উপভোগ!’ নিজের মনে বিড়বিড় করে সে বলল, একমাস ছুটির অর্ধেকটা তো কেটে গেল কিন্তু লাভ হল কী? দু’জায়গায় বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে, বিদেশে এসে বাড়ির সুখ পাওয়া যাচ্ছে না কিছুই, ঝিয়ের অসুখ, দলফিনোর অসুখ গেছে বেড়ে। শুধু তাই নয়, তাকে একলা তিনজনের সব কাজ করতে হচ্ছে, ঘরে ঘরে ধরাতে হচ্ছে আগুন, যেতে হচ্ছে বাজারে, তৈরি করতে হচ্ছে খাবার। এক মিনিটের জন্যেও ছেলেকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যেতে পারেনি, এই তিনটে ঘরের মধ্যে সমুদ্র আর বাতাসের অত্যাচারে নিজেও বন্দি হয়ে বসে আছে… অসহ্য, অসহ্য, ভাবতেও কান্না পায়।

দরজায় আস্তে আস্তে কে টোকা দিচ্ছে না?

‘কে?’ প্রোফেসর দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে গেল। ঝড়ের একটা দমকার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল সাতানিনা— সে মনস্থির করে এসেছে, মায়ের কর্তব্য সে করবেই। তার রোগা ছেলেকে সে একবার দেখবেই। উসকোখুসকো চুলে দৌড়ে এসে সে প্রোফেসরের পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। হতভম্ব হয়ে পেছিয়ে গেল প্রোফেসর। ওর কোটটা ধরে সাতানিনা বলে উঠল, ‘কসমো! কসমো! দোহাই তোমার! একবার দলফিনোর সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দাও, কসমো। আমাকে ক্ষমা করো, উদ্ধার করো, আমাকে দয়া করো।’

তারপর তার চোখে নেমে এল কান্নার বন্যা— সত্যিকার চোখের জল; মনে হল এ কান্না ওর আর কিছুতেই থামবে না। কান্নার দমকে ওর সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। মাটি ছেড়ে উঠতে কিছুতেই সে রাজি হল না, দু’হাতে মুখ ঢেকে জানাতে লাগল তার আবেদন, ‘কসমো, তুমি দেবতা, আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে উদ্ধার করো। আর তো দিন কাটে না আমার। এর পরে আমার দলফিনোকে ছাড়া আর কিছু আমি চাই না। আমি তোমার সব কাজ করে দেব, আমি ওর সেবা করব, তোমার পায়ে পড়ি কসমো’—

একটা চেয়ারে বসে পড়ে দু’হাতে প্রোফেসর মুখ ঢাকল। মুখ ঢাকার কোনও দরকারই ছিল না, এতক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে, ঘরের মধ্যে কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। সান্ধ্য উপাসনার ঘণ্টা বাজল। উচ্চস্বরে নার্স আভে মারিয়ার স্তোত্র পাঠ করতে লাগল— এ স্তোত্র কানে গেলেই তার মনিব সাতানিনার প্রলোভন কাটিয়ে উঠতে পারবে, এই তার আশা।

পিছনের ঘর থেকে দলফিনোর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। বাড়িতে কী যে হচ্ছে বুঝতে না পেরে ভয় পেয়ে সে ডাকছে, ‘বাবা, বাবা!’

ছেলের ডাক শুনে সাতানিনা লাফিয়ে উঠল, প্রোফেসরের অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই দৌড়ে গেল সে ছেলের ঘরে।

প্রোফেসর চুপ করে চেয়ারে বসে রইল— তার কানে আসতে লাগল দলফিনোর ঘর থেকে মায়ের ছেলেকে আদর করার ভাঙা-ভাঙা কথা, চুমু খাওয়ার শব্দ। বাইরেও যেন কী এক অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে— সমুদ্রের গর্জন গেছে থেমে, বাতাসের আর জোর নেই— শান্তিময় সারা পৃথিবী। মাথা তুলে অবাক হয়ে শুনতে লাগল। খুব আস্তে একটা জানলা তখনও খুট খুট করে নড়ছে। হ্যাঁ, সত্যিই তো… হাওয়া… থেমে গেছে হাওয়া! জানালার ধারে গিয়ে বাগানের ওপাশে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে দেখল— সেপাইদের ব্যারাকের সামনে পথের আলো জ্বলে উঠেছে, আর সত্যিই হাওয়াও থেমে গেছে হঠাৎ। কতগুলি সঙ্গী অফিসারের কণ্ঠস্বর ওর কানে ভেসে এল, খাওয়া দাওয়ার পর ফুর্তি করে ওরা বেড়াতে বেরিয়েছে।

এতক্ষণ ওর মনে ছিল না যে অন্ধকার ঘরে সাতানিনার কাছে দলফিনো একলা রয়েছে।

ও তাড়াতাড়ি আলো জ্বালতে ঘরে ঢুকল।

‘আমি জ্বালছি আলো, আমি জ্বালছি।’ সাতানিনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আলো কোথায়? ও ঘরে? আমি এখুনি খুঁজে আনছি।’

খুব ব্যস্ততার সঙ্গে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দলফিনো ফিসফিস করে বলল, ‘বাবা, বাবা, ওকে আমি চাই না… ওর গায়ে বিচ্ছিরি এসেন্সের গন্ধ…’

‘কিছু ভেবো না, খোকন, কিচ্ছু ভেবো না।’

‘কিন্তু বাবা, তুমি কোথায় ঘুমোবে? ও শুলে তোমার জায়গা হবে কোথায়? তুমি এখানে আমার কাছেই শুয়ো, শুনছ বাবা?’

‘হ্যাঁ, বাবা, তাই শোব, কিছু ভেবো না তুমি।’

চারদিকে সব চুপচাপ! কিন্তু সাতানিনা এখনও ফিরছে না কেন? বাতিগুলো কি খুঁজে পাচ্ছে না? কী করছে সে? প্রোফেসর কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ তার খেয়াল হল যে তার পায়ে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে। ওর মনে হল সাতানিনা নিশ্চয় একটা জানলা খুলেছে পাশের ঘরে। কিন্তু কেন?

সে উঠে দাঁড়াল, চুপিচুপি দলফিনের বিছানার কাছ থেকে সরে এসে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল পাশের ঘরের দরজার কাছে। ব্যারাকের দিকে নিচু জানলাটা এই ঘরেই। ঠিক ধরেছে, সাতানিনা জানলা খুলে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে, নীচেও দাঁড়িয়ে কে যেন, তার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে। কে সে? কার সঙ্গে বলছে কথা? এরই মধ্যে সাতানিনার শয়তানি আবার আরম্ভ হল? প্রোফেসর বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে, এতটুকুও শব্দ না করে ওর কাছে গিয়ে পৌঁছল। সে শুনতে পেল, সাতানিনা নীচের অফিসারটিকে বলছে, ‘না গিগি, লক্ষ্মীটি, আজ নয়, আজ রাতে অসম্ভব, কাল… আমি কথা দিচ্ছি, নিশ্চয়ই কাল।’

এই কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রোফেসর আরও নিচু হয়ে সাতানিনার পা দুটো ধরল, তারপর এক ঠেলায় জানলা দিয়ে তাকে বাইরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘ধরুন লেফটেনন্ট সাহেব, আজ রাতেই ভাল করে ধরে নিন।’

সাতানিনার চিৎকার আর অফিসারটির চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে সে জানালা থেকে সরে এল— হাত-পা তখনও ওর থরথর করে কাঁপছে। জানালাটা বন্ধ করবার চেষ্টা করল, কিন্তু বাইরে তখন সেপাই, অফিসার আর রাস্তার লোকের ভিড় জমে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে সে ছেলের ঘরে ঢুকতে গেল। তার আগেই ছুটে এসেছে ধাই শোবার পোশাকে, ওকে দাঁড় করিয়ে কী হয়েছে, এত গোলমাল কীসের— সব কথা শোনার চেষ্টা করল। প্রোফেসর ধাইকে একপাশে ঠেলে ফেলে দিয়ে ছেলের বিছানার কাছে গিয়ে তাকে আদর করতে লাগল। ছেলের প্রশ্নের উত্তরে উত্তেজিতভাবে ও শুধু বলতে লাগল, ‘কিছু না… কিছুই হয়নি, বাবা… সত্যি কিছু না… ভয় পেয়ো না লক্ষ্মী। একটা টালি… হাত থেকে একটা টালি খসে লেফটেনন্টের মাথায় পড়েছে। আর কিছু না।’

বাইরের দরজায় দুম দুম ধাক্কা। ধাই কোনওরকমে তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড় পরে নিয়ে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দু’জন পুলিশ, একজন পুলিশ সার্জেন্ট আর তাদের পিছনে সেপাই অফিসার, বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল রাস্তার লোকের ভিড়।

এত সব লোক দেখে ভয় পেয়ে ধাই তাড়াতাড়ি বলল, ‘একটু অপেক্ষা করুন… আমি আলোটা জ্বালি…’

দেখা গেল দলফিনো বিছানার উপর হাঁটু ভেঙে বসে আছে আর তার বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে দু’হাতে।

‘এই যে পেয়েছি।’ একজন পুলিশ চিৎকার করে উঠল, ‘শিগগির উঠে এসো আমাদের সঙ্গে।’

প্রোফেসর ওদের দিকে মুখ ফেরাল। পুলিশের পিছন পিছন যারা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, তারা ওই ব্যান্ডেজের পাগড়িপড়া মড়ার মতো ফ্যাকাসে মুখে বড় বড় চশমা দেখে অবাক হল, ভয়ও পেল। ‘কোথায় যেতে হবে?’ সে জিজ্ঞাসা করল।

পুলিশ সার্জেন্ট ওর কাঁধে হাত দিয়ে রুক্ষ স্বরে জবাব দিল, ‘আমার সঙ্গে। আর কোনও গুন্ডামি করার চেষ্টা কোরো না।’

প্রোফেসর বলল, ‘তা বেশ। কিন্তু আমার ছেলে? ওর যে বড় অসুখ! কার কাছে রেখে যাব ওকে? আমাকে সব খুলে বলতে দিন, স্যর…’

সার্জেন্ট রেগে উঠে বাধা দিয়ে বলল, ‘চুপ করো। তোমার ছেলেকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তুমি এসো আমার সঙ্গে।’

দলফিনো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। প্রোফেসর ওকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিল। অনেক কষ্টে চোখের জল চেপে রেখে বারবার ছেলের মুখে চুমু খেয়ে চুপিচুপি বলতে লাগল যে— এ কিছু না, কিছুই না, খুব শিগগিরই সে ফিরে আসবে…একজন পুলিশ অধৈর্য হয়ে ওর হাত ধরে টান লাগাল।

‘আমাকে হাতকড়াও পরতে হবে নাকি?’

হাতকড়া পরানো হয়ে গেলে সে আর-একবার ছেলের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘খোকন… বাবা, আমার চশমাটা…’

ছেলে তখনও ভয়ে কাঁপছে, জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বাবা, কী চাও?’

‘চশমাটা খুলে নাও বাবা… লক্ষ্মী ছেলে… এই… এইবার ঠিক হয়েছে… চমৎকার… এখন আর আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না…’

এবার সে জনতার দিকে ফিরে চোখ মিটমিট করতে করতে বিশ্রীভাবে একবার হাসবার চেষ্টা করল— ওর হলদে দাঁতগুলো সব একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। ঘাড়টা কুঁজো করে সে গলাটা লম্বা করল, কিন্তু আজ দুঃখের বেগে তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না— এই প্রথম সে তার অভ্যাসমতো বলতে পারল না, ‘তা বেশ, তা বেশ।’

—কমলা রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *