তা তা থৈ থৈ

তা তা থৈ থৈ

ভোম্বলদা’র সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় নাই। তিনি আমাকে ভালবাসেন, কিন্তু পছন্দ করেন না। অপছন্দর কারণ, তিনি সঙ্গীতবিদ্যার উপর হাড়ে চটা এবং আমি সুরধুনী গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানির প্রচারসচিব। সুরধুনীর নাম অবশ্য আপনারা সকলেই জানেন।

ভোম্বলদা’র বয়স চল্লিশ, সুবিপুল দেহ। ছেলেবেলা হইতে মোটা বলিয়া তিনি লজ্জায় বিবাহ করেন নাই। গ্রামোফোন এবং রেডিওর ভয়ে তিনি শহর ছাড়িয়া এমন একটি রাস্তার উপর বাড়ি করিয়াছেন যেখানে দু’মাইলের মধ্যে লোকালয় নাই। কিন্তু ভোম্বলদা খাইতে এবং খাওয়াইতে ভালবাসেন। তাই মাঝে মাঝে তাঁহার জন্য আমার মন কেমন করে।

শনিবার বিকালবেলা আমার পাঁচ ঘোড়ার গাড়িতে (ফিয়াট ৫) চড়িয়া বাহির হইয়া পড়িলাম; ইচ্ছা ছিল হপ্তান্ত কাটাইয়া একেবারে সোমবার সকালে কলিকাতায় ফিরিব।

নির্জন রাস্তার ধারে পাঁচিল-ঘেরা জমির মাঝখানে ছোটখাটো দোতলা বাড়ি। ফটকের সামনে ছিরু অত্যন্ত বিমর্ষভাবে বসিয়া আছে। ছিরু একাধারে ভোম্বলদা’র ভৃত্য পাচক গৃহিণী সচিব। আমাকে দেখিয়া ছিরুর শ্রীহীন মুখ একটু উজ্জ্বল হইল, সে তাড়াতাড়ি ফটক খুলিয়া দিতে দিতে বলিল, ‘বাবু এসেছেন—বাঁচলাম।’

‘কি খবর ছিরু? ’

‘আজ্ঞে খবর ভাল নয়।’

গাড়ি থামাইয়া বাহির হইলাম, ‘ভাল না। দাদার কি শরীর খারাপ নাকি? জ্বরজ্বারি?’

ছিরু বল্‌লে, ‘আজ্ঞে জ্বরজ্বারি নয়। বাবু নাচ্‌ছেন!’

চমকিয়া গেলাম। ভোম্বলদা নাচিতেছেন! চল্লিশ বছর বয়সে ওই জলহস্তীর ন্যায় শরীর লইয়া নাচিতেছেন! কিন্তু কেন?

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘নাচছেন কেন? কোনও সুখবর পেয়েছেন নাকি?’

ছিরু বলিল, ‘সুখবর কোথায় বাবু? পরশু সন্ধ্যাবেলা পায়ে হেঁটে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, ফিরে এসে নাচ্‌তে শুরু করেছেন। এখনও চলছে।’

‘বল কি! এ তো ভাল কথা নয়।’

হঠাৎ মনে হইল, বুড়া বয়সে ভোম্বলদা প্রেমে পড়েন নাই তো! প্রেমে পড়িলে নাকি নানা প্রকার স্নায়বিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। দাদা পায়ে হাঁটিয়া বেড়াইতে গিয়াছিলেন, কোনও আধুনিকা তরুণীকে দেখিয়া ফেলা বিচিত্র নয়। কিন্তু দাদার মতো নর-পুঙ্গবকে বিবাহ করিতে সম্মত হইবে এমন তরুণী বাংলাদেশে আছে কি? দাদার দেহে যে ওজনের মেদ-মাংস আছে তাহাতে স্বচ্ছন্দে দু’টা মানুষ হয়, সুতরাং দাদাকে বিবাহ করিলে দ্বিচারিণী হওয়ার আশঙ্কা। এইরূপ কলঙ্ক কোনও বাঙ্গালীর মেয়ে বরণ করিয়া লইবে না! তবে দাদার এত নাচ কিসের জন্য?

যাহোক চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করা প্রয়োজন। দোতলায় উঠিয়া দাদার ঘরে প্রবেশ করিলাম। যাহা দেখিলাম তাহার জন্য মনকে প্রস্তুত করিয়া রাখা সত্ত্বেও তাক্ লাগিয়া গেল।

দাদা নাচিতেছেন। দাপাদাপি লাফালাফি নাই, থুপ্‌ থুপ্‌ করিয়া কুমড়ো পটাশের মত নাচিতেছেন। নৃত্যের তালে তালে চিবুক হইতে নিতম্ব পর্যন্ত মেদ-তরঙ্গ হিল্লোলিত হইতেছে; হাতদুটি ভঙ্গিমাভরে একটু লীলায়িত হইতেছে—

কিন্তু দাদার মুখে আনন্দ নাই। নিতান্তই যেন অনিচ্ছাভরে নাচিতেছেন, না নাচিয়া উপায় নাই তাই নাচিতেছেন। আমাকে দেখিয়া তাঁহার মুখের গাম্ভীর্য গাঢ় হইল। তিনি আমার দিকে পিছন ফিরিয়া নাচিতে লাগিলেন।

ভাবনার কথা। দুশ্চিন্তার কথা। ইহা নিশ্চয়ই কোনও প্রকার রোগ। কিন্তু প্রেম-রোগ নয়; প্রেম-রোগ হইলে মুখে হাসি থাকিত, চোখে চটুল কটাক্ষ থাকিত। কিন্তু রোগটা কী?

আমি সতর্কভাবে দুই চারিটা প্রশ্ন করিলাম, দাদা কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করিলেন না। নাচিয়া চলিলেন। লক্ষ্য করিলাম, তিনি তালে নাচিতেছেন। তাললয়ের সহিত তাঁহার সুবাদ ছিল না, অথচ অবলীলাক্রমে খেমটা তালে কী করিয়া নাচিতেছেন বুঝিতে পারিলাম না। ভূত-প্রেত স্কন্ধে ভর করে নাই তো!

এই সময় ছিরু আমাদের জন্য চা-জলখাবার লইয়া প্রবেশ করিল। দেখিলাম দাদা নৃত্যের বিরাম না দিয়া কচুরি-সিঙ্গাড়া উদরসাৎ করিলেন, এক চুমুকে চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া ফেলিলেন। আর যাহাই হোক, ক্ষুধার কোনও অপ্রতুল নাই। এটা ভাল লক্ষণ বলিতে হইবে।

আমি আরও কয়েকবার তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিবার চেষ্টা করিলাম; তিনি উত্তর তো দিলেনই না, শেষে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া আমাকে দরজা দেখাইয়া দিলেন।

নীচে নামিয়া আসিতে আসিতে ভাবিতে লাগিলাম, কী করা যায়! একটা লোক অকারণে ক্রমাগত নাচিয়া চলিয়াছে, চোখে দেখিয়া চুপ করিয়া থাকা যায় না। পক্ষাঘাতের পূর্বলক্ষণ কি না কে বলিতে পারে? স্থির করিলাম ডাক্তার ডাকিয়া আনিব।

কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া এক ডাক্তার বন্ধুকে ধরিয়া আনিলাম। ডাক্তার দেখিয়া ভোম্বলদা আরও বিরক্ত হইলেন কিন্তু নাচ থামাইলেন না। ডাক্তার সেই অবস্থাতেই তাঁহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিল, নাড়ী দেখা ও বুকে স্টেথোস্কোপ লাগাইবার সময় ডাক্তারকেও দাদার সঙ্গে সঙ্গে নাচিতে হইল।

পরীক্ষা শেষ করিয়া গলদ্‌ঘর্ম অবস্থায় ডাক্তার বাহিরে আসিয়া বলিল, ‘রোগ তো কিছু দেখলাম না। নার্ভাস ব্রেকডাউন নয়। নাড়ী চমৎকার চলছে। হৃদ্‌যন্ত্র ইঞ্জিনের মতো মজবুত।’

‘তবে নাচছেন কেন?’

‘ভগবান জানেন। তুমি বরং মনোবিৎ ডাক্তার এনে দেখাও, ওরা হয়তো হদিস দিতে পারবে।’

রাত্রি হইয়া গিয়াছিল, ডাক্তার বন্ধুকে লইয়া ফিরিয়া যাইতে হইল। পরদিন সকালে একজন মনোবিৎ ডাক্তার লইয়া আসিলাম। ভোম্বলদা অনেক মুর্গী মটন খাওয়াইয়াছেন, তাঁহার জন্য এটুকু না করিলে মনুষ্যত্ব থাকে না।

মনোবিৎ দাদার ঘরে ঢুকিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। তারপর ঘন্টাখানেক আর তাঁহাদের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আমি নীচে বসিয়া ছিরুর তৈরি গরম গরম নিম্‌কি ও পান্তুয়া খাইয়া সময় কাটাইলাম।

মনোবিৎ যখন নামিয়া আসিলেন তখন তাঁহার মুখ গম্ভীর। বলিলেন, ‘মনের অসুখই বটে। গভীর একটা কম্‌প্লেক্স তৈরি হয়েছে। সারাতে সময় লাগবে।’

‘তাই নাকি? কি রকম কম্‌প্লেক্স?’

‘একেবারে আদিম কম্‌প্লেক্স। অনেক কষ্টে ওঁর মুখ থেকে একটি কথা বার করেছি। তা থেকে মনে হয়—’

‘কী কথা বার করেছেন?’

‘ঠমকি ঠমকি নাচে রাই।’

‘ঠমকি ঠমকি নাচে রাই।’

‘হ্যাঁ। যে প্রশ্নই করি, একমাত্র উত্তর—“ঠমকি ঠমকি নাচে রাই”।’

আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। ডাক্তার বলিয়া চলিলেন, ‘আসল কথা উনি নিজেকে স্ত্রীলোক মনে করছেন। মগ্নচৈতন্যে অবরুদ্ধ বাসনা যখন গভীরভাবে আলোড়িত হয়—’

বলিলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আর বলতে হবে না। —আচ্ছা, মনে করুন, কেউ গান-বাজানা পছন্দ করে না; সে যদি হঠাৎ এমন একটা গান শোনে যা তার কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে—সে তখন কী করবে?’

মনোবিৎ বলিলেন, ‘নিজের মনকে নিগৃহীত করবার চেষ্টা করবে।’

‘এবং—?’

‘এবং তার ফলে গুরুতর স্নায়বিক রোগ হতে পারে।’

‘ব্যস্—বুঝেছি। চলুন এবার আপনার চিকিৎসার দরকার নেই, আমিই দাদার রোগ সারাব।’

মনঃক্ষুণ্ণ মনোবিৎকে ফিরাইয়া লইয়া গেলাম। তারপর একটি গ্রামোফোন ও একটি রেকর্ড লইয়া দাদার কাছে ফিরিয়া আসিলাম।

দাদার ঘরের বন্ধ দরজায় কান পাতিয়া শুনিলাম ভিতরে থুপ থুপ শব্দ হইতেছে। তখন দরজার বাহিরে গ্রামোফোন রাখিয়া দম দিয়া রেকর্ড বাজাইয়া দিলাম। নৃত্য-লীলায়িত সুর বাজিয়া উঠিল—

ঠমকি ঠমকি নাচে রাই—

কিছুক্ষণ পরে দরজা একটু ফাঁক করিয়া দাদা উঁকি মারিলেন। তাঁহার মুখে বিস্ময়াহত উত্তেজনা; নাচ থামিয়াছে। রেকর্ড শেষ হইল, তিনি বাহির হইয়া আসিলেন। বলিলেন, ‘আবার বাজাও।’

আবার বাজাইলাম। দাদা গ্রামোফোনের কাছে চ্যাপ্‌টালি খাইয়া বসিয়া দু’হাতে তাল দিতে লাগিলেন। মুখে তন্ময় ভাব।

আরও তিন চারিবার রেকর্ড শুনবার পর দাদা ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন; আমাকে জাপ্‌টাইয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘ভাইরে, তুই আমায় রক্ষে করেছিস।’

আলিঙ্গনের নিগড় হইতে মুক্ত হইয়া বলিলাম, ‘কী হয়েছিল দাদা?’

দাদা বলিলেন, ‘শেক্সপীয়র ঠিকই বলেছেন, যে-লোক গান ভালবাসে না সে মহাপাষণ্ড। আমার এবার আক্কেল হয়েছে।’

‘কিন্তু কি করে আক্কেল হল?’

দাদা তখন আক্কেল হওয়ার কাহিনী বলিলেন। সেদিন হজম বাড়াইবার জন্য দাদা বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলেন। বেড়াইতে বেড়াইতে তিনি স্টেশনের কাছে উপস্থিত হন। হঠাৎ একটা রেস্তোরাঁ হইতে রেকর্ডের গান তাঁহার কর্ণপটাহ বিদ্ধ করিল। গান-বাজনায় তাঁহার দারুণ অরুচি, তিনি তৎক্ষণাৎ বাড়ির দিকে ফিরিলেন।

কিন্তু সুরটা তাঁহার কানে লাগিয়া রহিল—ঠমকি ঠমকি নাচে রাই। তিনি উত্যক্ত হইয়া উঠিলেন এবং জোর করিয়া সুরটাকে মন হইতে তাড়াইয়া দিলেন।

বাড়ি ফিরিবার পর তাঁহার মাথার মধ্যে কি যেন একটা ঘটিয়া গেল। অদম্য নৃত্যস্পৃহা তাঁহার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হইল। তিনি নাচিতে লাগিলেন, কিন্তু কেন যে নাচিতেছেন তাহা বুঝিতে পারিলেন না।

তারপর এখন রেকর্ড শুনিয়া সব রহস্য তাঁহার কাছে পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। গানের তুল্য জিনিস নাই, ফ্রেঞ্চ্ ফাউল কাটলেট্‌ ইহার কাছে তুচ্ছ।

কাহিনী শেষ করিয়া ভোম্বলদা আবেগভরে বলিলেন, ‘ভাইরে, এতদিন যে পাপ করেছি এবার তার প্রায়শ্চিত্ত করব। এমন রেকর্ড যে তৈরি হয় আমি জানতাম না। তোর গ্রামোফোন আর রেকর্ড রেখে যা। আমি বাজাব।’

উপরের কাহিনী কেহ যদি বিশ্বাস না করেন তাঁহাকে একখানি ‘ঠমকি ঠমকি রেকর্ড’ কিনিতে অনুরোধে করি। গানের নম্বর—পি ০০০১৫, বলা বাহুল্য, ইহা স্বনামধন্য সুরধুনী রেকর্ড কোম্পানীর নবতম অবদান। যদি এ গান শুনিয়া নেশা না হয়, নেশায় মাতোয়ারা হইয়া নাচিতে ইচ্ছা না করে, তবে যা লিখিলাম সব মিথ্যা।

প্র. ১৩৬০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *