তাল্লাক
এই শ্রীঁশ্রী বাটিতে কেহ পাদুকা পায়ে দিয়া জাইবেন নাই, যে জাইবেন তাহাকে তাল্লাক॥ সন মুরারি মুরলী ছিদ্র কুমারবদন রত্নাকর সুধাকর এরূপ গনন।
রমাপদ মিত্র পি. জি. হাসপাতালের ইজিচেয়ারে শুয়ে শোলক ভাঙাচ্ছেন। বাঁ হাতের শিরার উপর সেঁটে থাকা তুলোর পুঁটুলিটা ওষুধ ওষুধ গন্ধমাখা বিকেল বাতাসে এই মাত্র পড়ে গেল। এই অবসন্তেও একটা একা কোকিল ডাকছে। উডল্যান্ড ওয়ার্ডের সাদা বারান্দা বেয়ে সাদা নার্সটি হেঁটে গেল। হাঁটার শব্দে হাসপাতাল বাজে। আকাশে মেঘ। বৃষ্টি আসবে?
রমাপদ মিত্রর বুকের উপর উলটে রয়েছে একটা নীল রঙের বাঁধানো খাতা। ওই খাতাটা খুললেই কেমন যেন ঘুঙুরের শব্দ পান। একদিন অমরায় গিয়ে বেহুলাও নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়। বাংলার মাঠ ঘাট ভাট ফুল ঘুঙুরের মতো বেজেছিল বেহুলার দু’ পায়।
এই যে খাতাটা, এতে আছে কত লোকশিল্পীদের নাম, গ্রাম কথা, লোকাচার। মন্দির বিবরণ, মেলা বর্ণনা…। গ্রাম বাংলা ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করা এরকম হাজারো তথ্যে ভরা রয়েছে এই জীবনখাতার প্রতি পাতা।
হাসপাতালে যখন ভরতি হতে হল, এরকম কয়েকটা খাতা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন রমাপদ। একটা নতুন কাজ করার পরিকল্পনা মাথায় এসেছে কিছুদিন হল। মন্দিরের গায়ে যেসব লিপি আছে সেগুলি বিশ্লেষণ করে কিছু সমাজ-ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হয়েছে। মন্দির-লিপিগুলিকে আলাদা করেছেন, বর্গীকরণও করতে হবে। কিছু কিছু মন্দিরে আবার যাওয়া দরকার। লিপিগুলিকে বুঝতে হলে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আর স্থানীয় ইতিহাসটাও মাথায় রাখা দরকার। যেতে হবে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই যেতে হবে বহু জায়গায়। প্রথমেই যেতে হবে আলমণিপুর।
আলমণিপুর হল হুগলি জেলার বলাগড়ের কাছে একটি গ্রাম। ওই গ্রামের একটি বিগ্রহহীন পরিত্যক্ত মন্দিরের বাইরের দেয়ালে পাথরে খোদাই করা ছিল এই সাবধান বাণী। “কেহ পাদুকা পায়ে দিয়া জাইবেন নাই। যে জাইবেন তাহাকে তাল্লাক।”
তাল্লাক শব্দটি কেন উৎকীর্ণ হল হিন্দু মন্দিরে? কীসের কারণে?
তাল্লাক শব্দটির পরে বেশ মজার দুটি লাইন। এটা হল প্রতিষ্ঠা লিপি। এখানে ছদ্মবেশে প্রতিষ্ঠার দিনটি রয়েছে। কেন যে এই ছদ্মবেশ ধারণ। মুরারি মুরলী ছিদ্র কুমারবদন। মুরারি মুরলী মানে কৃষ্ণের বাঁশি। তাঁর সাতটি ফুটো। তা হলে মুরারি মুরলীছিদ্র মানে সাত। কুমারবদন মানে কার্তিক মানে ছয়। রত্নাকর সুধাকর এরূপ গনন। রত্নাকর মানে তো সোজা, রত্নাকর ইজিকাল্টু সমুদ্র ইজিকাল্টু সাত। সাত সমুদ্র। আর সুধাকর মানে এক। একশ্চন্দ্র তমোহন্তি। অঙ্কস্য বামাগতি। ৭, ৬, ৭, ১ কে বাম দিক থেকে সাজালে ১৭৬৭। সন বলতে শকাব্দই ব্যবহৃত হত মন্দিরের গায়ে। তা হলে ১৭৬৭ শকাব্দ। দেড়শো বছরেরও বেশি পুরোনো। পুরনো না বলে প্রাচীন বলাই ভাল। ‘প্রাচীন’ শব্দটার গায়ে কীরকম যেন ভাঙা-মন্দিরের চারা বটগাছ আটকে থাকে।
কিন্তু ওটা যে প্রতিষ্ঠা লিপিই, সেটা কে বলল? এটা তো সাবধান লিপি৷ জুতো পায়ে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধ রয়েছে। ওই সাবধান বাণীটি লেখার অনেক আগেই হয়তো মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সাবধান বাণী পরে যুক্ত হয়েছে হয়তো। কিন্তু সাবধান বাণী কেন? বিশেষত ওই গ্রাম্য মন্দিরে? শহর এলাকার কোনও কোনও আধুনিক মন্দিরে আজকাল লেখা থাকে ‘জুতা পায়ে প্রবেশ নিষেধ।’ কিন্তু কোনও গ্রামের মন্দিরে জুতা পায়ে মন্দিরে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার নোটিস দেবার দরকার হয় না,কারণ সবাই জানে জুতো পায়ে মন্দিরে ঢুকতে নেই। তা হলে? আর কেনই বা তাল্লাক শব্দটি?
ভাঙা মন্দিরটা ভেসে ওঠে চোখে। যখন এটা নোট করেছিলেন তখন এত কিছু মনে হয়নি৷ তাল্লাক শব্দটায় একটু খটকা লাগলেও লিখে রেখেছিলেন। আসলে রমাপদবাবু সেবার বলাগড় গিয়েছিলেন অন্য কাজে। ওখানে আজও নৌকো তৈরি হয়। এককালে জাহাজও তৈরি হত। খোদ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানকার পালতোলা জাহাজ কিনত। আবার ‘বলাগড়’ নাম হয়েছিল বলরাম ঠাকুরের গড় থেকে। ওই গড়ের সন্ধানেই ওধারে গিয়েছিলেন রমাপদ মিত্র। বলাগড় থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে বট-অশ্বত্থ-ডুমুর কবলিত মন্দিরটির সন্ধান পান। রেখদেউল রীতির মন্দির। কুড়ি ফিটের মতো উচ্চতা হবে। শিখর-কলসটি ভেঙে পড়েছে। ভেঙে যাওয়া ইটগুলিকে আগলে রেখেছে বট-অশ্বত্থের শিকড় সমাবেশ। মন্দিরে কোনও পোড়ামাটির অলংকরণ আছে কি না দেখতে গিয়েই মন্দিরে প্রবেশ পথের বাঁ দিকে ওই পাথরলেখাটি দেখতে পেয়েছিলেন। সবুজ ক্লোরাইট পাথর। এই পাথর এখানে পাওয়া যায় না। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ছবিও তুলেছিলেন ক্লিক থ্রি ক্যামেরায়। তখন ওই ক্যামেরাটাই ছিল। ফ্ল্যাশ ছিল না। বছর তিরিশ আগেকার কথা। মন্দিরের ছবিটা উঠেছিল অন্ধকারমাখা, প্রস্তর লিপিটা ওঠেনি। ওটা শুধুই কালো। ভাগ্যিস খাতায় টুকে নিয়েছিলেন লেখাটা।
আজ বিকেল থেকে মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাস একা আসে না। কিছু বয়ে নিয়ে আসে। গন্ধ, শব্দ, কিংবা স্মৃতি। স্মৃতি মানে তো ইতিহাস কথা। ওই তো, সামনের বাড়িটায় লেখা রোনাল্ড রস এর নাম। এই পি জি হাসপাতালেই ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন রস সাহেব। কিন্তু দিগম্বর মিত্র? উত্তরপাড়ার দিগম্বর মিত্রের নাম কে জানে আজ আর? ম্যালেরিয়া অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে বদ্ধ জলের সঙ্গে ম্যালেরিয়ার একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করেছিলেন। দিগম্বর মিত্রের রিপোর্টটা না পেলে রস সাহেব কি মশার কথা ভাবতে পারতেন? এ নিয়ে একটা লিখলে হয় না? এ লেখার অধিকারী হয়তো তিনি নন, তবু একটু অনুসন্ধান করার লোভ সামলানো যায় না। এসব পরে হবে।…পরে? হবে? হবে তো? উঃ জীবন এত ছোট কেনে?
সামনের বড় বকুল গাছের পাতায় পড়া রোদ্দুরে ভিজিটিং আওয়ার্সের রং লেগেছে। এবারই একজন একজন করে আপন জন আসবে। সুদেষ্ণাটা আসছে না ক’দিন। ওর ছেলেটা নাকি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। কী মুশকিল বল দিনি! গৌরের কাছ থেকে ওই খবরটা পেয়েছেন রমাপদবাবু। গৌর দমদম এলাকা নিয়ে কাজ করছে। ক্লাইভ হাউসটা যেখানে সেখানেই নাকি মুর্শিদাবাদের নবাবদের হান্টিং হাউস ছিল। গৌরের তাই মত। রমাপদরও এরকমই মনে হচ্ছে। দমদমে একটা ঝিল আছে, ওর নাম মতিঝিল। মুর্শিদাবাদেও মতিঝিল আছে। সুদেষ্ণা কাজ করছে। পিঠে-পুলি-মিষ্টান্ন শিল্প নিয়ে। প্রদীপ মেতে আছে নীলকুঠি নিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নীলকুঠিগুলির একটা তালিকা তৈরি করছে ও। বেশির ভাগ নীলকুঠিই আজ লুপ্ত হয়ে গেছে, তবু বেঁচে আছে নীলদর্পণ। তপন পুতুল নিয়ে, ইন্দ্রজিৎ, দেবাশিস ওরা সমাধি সৌধ, মনুমেন্ট নিয়ে কাজ করছে। রোজই এদের কেউ না কেউ আসে। ওদের সঙ্গে কথা হয়। ওরা এলে ঘর ভরে ওঠে। ঘরই তো। এই হাসপাতালটা তো ঘরবাড়িই হয়ে গেছে। এর আগে দু’বার এসে এক মাস এক মাস করে থেকে গেছেন। এ যাত্রাতেও অলরেডি দশ দিন হয়েই গেল। অনেকে বলেন-টলেন ও রমাপদবাবু, এতদিন ধরে মাঠেঘাটে ঘুরে ঘুরে এই সব যে করে বেড়ালেন, কী পেলেন জীবনে? না পেলেন বই বিক্রির তেমন রয়্যালটি, না পেলেন তেমন কোনও পুরস্কার-টুরস্কার। রমাপদ মিত্র বলেন, কে বললে পুরস্কার পাইনি? কতগুলো শাবক পেলুম যে। ওদের বেশ লাগে। তা ছাড়া ম্যাটিরিয়াল গেইনের কথা যদি বলো, তা হলে বলি এই যে পি জি হসপিটালের উডবার্ন ওয়ার্ডের মতো জায়গায় চিকিচ্ছে করাতে পারছি, গভরমেন্ট সুবিধে করে দিয়েছে, ডাক্তাররা যত্ন নিচ্ছেন, এই বা ক’জন পায় বলো? কাজ করে মনের আরাম তো কম পাইনিকো, ওসব করলে আরাম ফ্রি।
এমন সময় ওই মেয়েটা এল। রেডিয়ো অফিসের। গতকালই বলে গিয়েছিল আসবে। একটা ইন্টারভিউ নেবে। মেয়েটির সঙ্গে বৃষ্টিও এল। তুমি এলে, অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল। মনে এল। ছিঃ।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বীণাপাণি এল ঘর থেকে। বীণাপাণি হল আয়া। আজকাল আবার হাসপাতাল থেকে আয়া সিসটেম উঠে গেছে, তবু নিজেদের আত্মীয় বলে লোক রাখা যায়। ওই গৌর-তপন-প্রদীপরা জোর করে আয়ার ব্যবস্থা করে গেছে। কোনও দরকার নেই, তবুও। ভালবাসার অত্যাচার আর কী।
বীণাপাণি এতক্ষণ ঘরের ভিতরের নিচু চেয়ারটাতে বসে ঝিমুচ্ছিল। বলল, কী গো দাদা, এতক্ষণ বাইরে বসে আছেন, জলের ছাট আসছে যে, ভিতরে চলুন।
ভিতরে নিয়ে যায় বীণাপাণি। রেডিয়োর মেয়েটিও ভিতরে যায়। বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েটি।
‘রেডিয়ো আপিসে দু-তিন বার গেসলুম, বুঝলে, কবিতা সিংহ ডেকেছিলেন। তা অনেক দিন হয়ে গেল। তো এখন কী করতে হবে আমায় বলো।’
ব্যাগ থেকে একটা টেপ রেকর্ডার বের করল মেয়েটি। মাইকে ফুঁ দিল। তারপর মাইকের সামনে মুখ রেখে বলতে লাগল—আমরা জানি আপনি একজন লোক সংস্কৃতি এবং পুরাতত্ত্বের অক্লান্ত গবেষক। এ বিষয়ে আপনার দশ-বারোটি গ্রন্থ আছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপনি এ কাজে উৎসাহী হলেন কী ভাবে।
রমাপদবাবু মাথা চুলকোলেন।
তা হলে তো অনেক পুরনো কথা বলতে হয়। তখন আমার বয়েস কত হবে, সাতাশ-আঠাশ, কম্যুনিস্ট পার্টি করি, হোল টাইমার। একবার পার্টি থেকে আমায় খুব বকাবকি করল। রূপনারান নদীর জেলেদের একটা সংগঠন নিয়ে ঝামেলা, আমার বিচার-বিবেচনায় আমি কোনও অন্যায় করিনি, অথচ পার্টি আমাকে যা-তা বলল। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু তাইতে আমার মন খুব খারাপ। আমি আমাদের গ্রামের আড়াইশো বছরের প্রাচীন রাধামাধব মন্দিরের চাতালে গালে হাত দিয়ে বসে আছি, হঠাৎই মন্দিরের টেরাকোটা ফলকের দিকে চোখ পড়ল। দেখি, একটা মেয়েছেলে, সরি, মহিলা, একটা ব্যাটাছেলের চুল ধরে টানছে। ব্যাটাছেলেটার পরনে কেঁচাওলা ধুতি, মুখে বেশ কায়দা করা গোঁপ, চুলটাও বেশ বাবড়ি, যেন কার্তিক। মহিলাটির বেশ দশাসই চেহারা। খুব অবাক হয়ে গেলাম। এরকমটা তো হবার কথা নয়, ব্যাটাছেলেরই তো মেয়েদের চুল ধরে টানার কথা। আমার এটা তাজ্জব লাগল। আমি আরও সব কারুকার্যগুলি দেখতে লাগলাম। আমার চেনা মন্দিরের গায়ের দিকে তাকাইনি এর আগে। দেখি, পালকি চেপে যাচ্ছে নববধূ, পালকি বাহকদের হাঁটুর উপর কাপড়। সঙ্গে চলেছে একটি কুকুর। সেই নববধূটির বাপের বাড়ির পোষা কুকুরটি বোধহয়, সঙ্গে সঙ্গে চলেছে, আহা। দেখি তিনজন সাধু বসে বসে কী সব ভাবছে। আমার যেন মনে হল শিল্পী সাধুদের দিয়ে ভাবাচ্ছেন—পরকালের চিন্তা করে ইহলোকটা তো গেল। মনে হল কী আশ্চর্য কথা আমি এ গায়ের ছেলে, আমাদের গাঁয়ের মন্দিরে যে আমাদের জীবনের কথাও লেখা থাকতে পারে, বুঝতেই পারিনি এতদিন? আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি হরিণের পাল, পেখম তোলা ময়ূর, পালতোলা জাহাজ, হুঁকো হাতে সাহেব, প্রসাধনরতা নারী, কত কী। দেখি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পায়ের গোড়ালিতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটি রমণী মূর্তি। সেই যে কৌতূহল হল, সেটাই রয়ে গেল। এখনও দেখি। এখনও নতুন নতুন ব্যাখ্যা পাই। ওই যে নারী মূর্তিটির কথা বললাম, গোড়ালি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক পরে বুঝেছিলাম ওটা অভিসারিকা মূর্তি। কী করে বুঝলাম জানো? মান্না দের একটা গান শুনে। ‘পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে।’ মেয়েটি কাঁটা তুলছে পায়ের গোড়ালি থেকে। অভিসারে যেতে গিয়ে পায়ে কাঁটা ফোটার বর্ণনা আছে বৈষ্ণব পদাবলীতে। কণ্টক গাড়ি কমলসম মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি… তারপর কী সব যেন আছে। দ্যাখো, একটা আইডিয়া কী ভাবে বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে ট্রানসফারড হয়। তা, যা বলছিলাম, আমাদের গ্রামের মন্দিরটাকে ভালভাবে দেখে, পাশের গাঁয়ের মন্দিরটাকে দেখি। মিল আর অমিল খোঁজার চেষ্টা করি। সেই সময় বিনয় ঘোষের কালপেঁচার নকশা বইটা পড়েছিলাম। খুব ভাল লেগেছিল বইটা। আমি বিনয়বাবুর সঙ্গে দেখা করি। উনি বললেন, মন্দিরের গঠন, অলংকরণ, বিগ্রহ, পূজা পদ্ধতি এই সব কিছুর মধ্যেই সমাজ-ইতিহাসের উপাদান পাবে। ওটাও তো দেশ সেবা। তুমি মন্দির করো। লেগে গেলাম।
কিন্তু রুজি রোজগার? মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে।
সেটাই ছিল আসল সমস্যা। অভিমান করে পার্টির হোলটাইমারগিরি ছেড়ে দিলুম। পার্টি থেকে একটা ভাতা পেতুম, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তার উপর আবার ভাব-ভালবাসা করে একটা বিয়েও করে ফেলেছিলুম, তার উপর আবার বিড়ি। বিড়ি খাওয়া অভ্যেস করে ফেলেছিলুম। জেলে-চাষিবাসিদের সঙ্গে মিশতে হত কিনা। পয়সা পাই কোথায়? বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলুম। দু-একটা টিউশনিও ধরলুম। কিন্তু টিউশনি টিকবে কেন। যাওয়া আসার ঠিক নেই কো। এদিকে তো নেশা ধরে গেছে। মন্দিরের নেশা। আমি, জানলে, কোনও ধর্ম মানি না। নাস্তিক লোক, কিন্তু ধর্মচর্চা করতে থাকলাম। আমার একটা নিজস্ব থিয়োরি আছে। সেটা হল নাস্তিকরাই সব চেয়ে ভালভাবে ধর্মচর্চা করতে পারে। কত কিছু শিখলাম। সুফি, সহজিয়া, বজ্রযান…। এসব কিছু জানতাম না আগে। দেখি কী বিচিত্র উপায়ে মানুষ সৃষ্টি রহস্য খুঁজে চলেছে। হিন্দুর ধর্মবিশ্বাস, বৌদ্ধর আচার, মুসলমানের প্রার্থনা একাকার হয়ে গেছে। এক মুসলমান ফকিরের গান শুনলাম ও রামচন্দ্রকে বলছে নবী, আর রাবণকে ইবলিশ শয়তান বলে গান বেঁধেছে। কংসকে বলছে মালাউল, কৃষ্ণকে বলছে মোমেন। চিত্রকর সম্প্রদায়ের লোকরা নমাজও পড়ছে আবার হিন্দু দেব দেবীদের নিয়ে গানও গাইছে। জগতটা কীরকম খুলে যেতে লাগল, জানলে। এদিকে আবার ডেভিডের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ন। ফুল প্যান্টালুনের উপর পাঞ্জাবি ফেলে দিয়ে, পায়ে একটা চটি গলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে আমি আমাদের গাঁয়ের রাধামাধব মন্দিরের টেরাকোটার কথা বলি, বিশেষ করে ওই ব্লকটির কথা। নারী কর্তৃক নর নির্যাতন। ও একদিন দেখতে এল। দেখে টেখে ডেভিড বলল, এ তো খুব চেনা চেনা লাগছে। এরকম কিছু পেইনটিংস, কিছুদিন আগেই দেখেছি। ইয়েস। কালীঘাটের পট। কালীঘাটের পটে এরকম ব্যঙ্গাত্মক ছবি আঁকা হত। এটা বোধহয় কলিকাল সিরিজ। কলি এলে সব উলটে যাবে, ব্যাং সাপকে ধরে খাবে, নারকোলগাছে আম হবে, স্ত্রী স্বামীকে মারবে। এরকম সব ছবি। এই টেরাকোটাটা বোধহয় কালীঘাটের পটের কলিকাল সিরিজের ইনফ্লুয়েন্স।
কী অবাক কাণ্ড! সাহেব বলে কী। কোথায় কালীঘাটের পট কোথায় নবাসনের মন্দির। কালীঘাটের পটের প্রভাব মন্দিরের গায়ে? ডেভিড বলল, হতেই পারে। কলকাতার কালী মন্দিরে তীর্থযাত্রীরা গেলে, ফেরার সময় পট কিনে নিয়ে যেত। আমি বললুম, ডেভিড, তা কী করে হবে? আমাদের এই মন্দির তো কালীঘাটের পটের যুগের চেয়েও পুরনো। সবাই বলে। মন্দিরের গায়ে একটা প্রতিষ্ঠালিপি আছে ওটা হিসেব করলে দাঁড়ায় ইংরেজি ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তখন তো কালীঘাটের পটের যুগই শুরু হয়নি। তুমি উলটে কেন ভাবছ না ডেভিড, আমাদের এই মন্দিরই কালীঘাটের পটকে প্রভাবিত করেছিল?
হো হো করে হেসে উঠল ডেভিড। বলল, সরি মিট্র, ওই দ্যাখো টেরাকোটাটা কী বলছে। ডেভিডের হাতের আঙুলটা হুঁকো খাওয়া সাহেবকে ছুঁয়েছে। ইতিহাস বইতে ক্লাইভ-টাইভের যেমন পোশাক থাকে, টেরাকোটায় ওই রকমই পোশাক করা হয়েছে। ডেভিড বলল, দ্যাখো মিট্র, বাবুদের সঙ্গে মিশে হুঁকো খাওয়া শিখতে সাহেবদের বেশ কিছু সময় লেগেছে। ১৭৭০/৮০ সালের আগে শিল্পীর ভাবনায় হুঁকো খাওয়া সাহেব আসতে পারে না। সুতরাং, ওই টেরাকোটা ব্লকটা মন্দির প্রতিষ্ঠার বেশ কিছু পরেই লাগানো হয়েছে। প্রথমে ওই মন্দিরটা ন্যাড়া মন্দিরই ছিল। গ্রামটা যখন নতুন করে তৈরি হল তখনই বোধহয় মন্দিরে অলংকরণ হয়েছিল। গ্রামের নাম তো নবাসন, তাই না? মিনস নিউ কলোনি! খোঁজ করে দ্যাখো তো গ্রামটাকে নতুন করে বিল্ড আপ করতে হয়েছিল কেন?
একটা মন্দিরের অলংকরণের পিছনে এত কিছু থাকে? এত গল্প কথা? ইতিহাস-ভূগোল-নৃতত্ত্ব। তখন মনে হল অনেক পড়াশুনো করতে হবে। অনেক।
আমাদের গ্রামে লাইব্রেরি কোথায়? বাগনানে একটা আছে বটে, তাতে চলবে না। কলকাতা যেতে হবে। কলকাতা যাওয়া আসার খরচ কম? ইনকাম নেই মোটে। তখন এক বুদ্ধি করলাম। আমাদের গাঁয়ে একটা মুদি দোকান ছিল। ওর মালিক ছিলেন ষষ্ঠী গাঁতাইত। উনি করতেন কী ছেলেকে দু’দিন অন্তর দোকানে বসিয়ে কলকাতা যেতেন মাল কিনতে। ওর ছেলে তখন দোকানে বসে মুনি মুনী মুনয়ঃ। মুনিম মুনী মুনিন করত। আমি ষষ্ঠীদাকে বললুম, দাদা, আপনার বড় অসুবিধে দেখতে পাচ্ছি, আমায় বরং আপনি একটা মান্থলি করে দিন, আমি কলকাতা গিয়ে আপনার মালপত্র নিয়ে আসব খনে।
ষষ্ঠীদা দাঁতে জিভ কেটে বললে, ও কী কথা? কায়েতের ঘরের বড় মানুষকে দিয়ে মাল বয়াব? আমি বললুম, মাল বইলে মান যায় না। বিদ্যাসাগরের গল্প জানেন তো, সে আমার কোনও অসুবিধে হবে না, কম্যুনিস্ট পার্টি করা লোক কিনা…
শেষ অব্দি রাজি করালুম। একটা মান্থলি করিয়ে দিলে, আর রোজ দু’ আনা করে পয়সা। সকালবেলা বেরতুম, হাওড়া ইস্টিশনে নেবে একটা ফিরপোর রুটি কিনতুম, এরপর হেঁটে কখনও ন্যাশনাল লাইব্রেরি কখনও বিডন স্ট্রিটের চৈতন্য লাইব্রেরি, সারা দিন পড়াশুনো করে এটা ওটা নোট নিয়ে বিকেলবেলা পোস্তাবাজারের পাইকিরি দোকান থেকে মাল কিনে দু’ হাতে দু’ ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে উঠতুম…।
গলা ধরে উঠেছিল আগেই, এবার চোখ ফেটে জল বেরুল রমাপদর। দু’ হাতে মুখ ঢাকলেন।
বীণাপাণি ওই মেয়েটিকে বললেন, থাক, ওনাকে এখন আর বকাবেন না। মেয়েটি টেপ রেকর্ডার অফ করল। বলল, থাক। আর কিছু জিজ্ঞাসা করব না এখন। কিন্তু কাঁদছেন কেন?
রমাপদ মিত্র কিছু বললেন না। চোখ মুছলেন হাতের চেটোয়। শুয়ে পড়লেন। আবহাওয়াটা কী রকম গম্ভীর হয়ে গেল।
মেয়েটি আবার বলল, আপনি বোধহয় ভাবছিলেন এত কষ্ট করলেন জীবনে অথচ কী-ই বা তেমন পেলেন।
রমাপদ বললেন, না গো, ছিঃ, ওসব নয়। কী মনে হয়েছিল জানো, এত কষ্ট করে কাজ শুরু করেছিলুম তো, শেষ কাজটা করে যেতে পারব না, চার হাজার ইনসক্রিপশন কালেক্ট করেছিলুম, ওগুলোকে ক্লাসিফাই করে অ্যানলিসিস করব ভেবেছিলুম। কিন্তু ইতিমধ্যে মরণ আমাকে অলরেডি দুই তালাক দিয়ে দিয়েছে। থার্ড তালাকটির অপেক্ষায় আছি। আমার শেষ না হওয়া কাজগুলোর কথা ভেবে হঠাৎ দমক মেরে কান্না এসে গিয়েছিল। ও কিছু নয়। সরি। আর কী জিজ্ঞাসা করবে বলো। মেয়েটি একটু অবাক চোখে তাকায়, তারপর চলে যায়, যাবার আগে একটু মিষ্টি হাসে।
এবার সুদেষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে গৌর আর পরিমল। সুদেষ্ণার মুখে হাসি। বোধ হয় খবর ভাল।
রমাপদ জিজ্ঞাসা করেন, কীরে, ছেলের খবর কী?
সুদেষ্ণা বলল, আর বলবেন না দাদা। গুজরাত যাচ্ছিল ছেলে, দাঙ্গা থামাবে বলে।
বলিস কী?
উঠে বসলেন রমাপদবাবু।
কী আর বলব। ট্রেনে উঠে বসেছিল। শুভ আর ওর এক বন্ধু। ওদের একটা কমন পেন ফ্রেন্ড থাকে আমেদাবাদে। ছেলেটা মুসলিম। দাঙ্গায় কেমন আছে জানতে ফোন করেছিল ওকে। ও জানিয়েছিল ওর এক বোন মারা গেছে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে। ওরা তখনই নাকি ঠিক করে ফেলে দাঙ্গা থামাতে গুজরাত যাবে। কোত্থেকে টিকিটের টাকা জোগাড় করেছে কে জানে, আমেদাবাদ এক্সপ্রেসে চেপে বসল। বিলাসপুরে উঠেছিল এক বাঙালি পরিবার, ওরা নাকি রায়পুর যাচ্ছিল। ছেলে দুটোর সঙ্গে কথা বলে ওদের গণ্ডগোল মনে হল। ওরা রায়পুরে নামিয়ে নিয়ে কলকাতায় ফোন করেছিল। ভাগ্যিস। তারপর আমরা রায়পুর গিয়ে ওদের নিয়ে আসি।
কোন ক্লাস যেন তোর ছেলের?
ইলেভেন।
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ স্পর্দ্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি।
দুঃসহ নয়, দুঃসাহস। গুজরাত গিয়ে পড়লে কী বিপদটাই না হতে পারত ভাবুন রমাদা। ভাগ্যিস লোকগুলো খবর দিয়েছিল। ভাল লোক এখনও আছে, বলুন…
তাই তো। আছেই তো। ভাল লোক হয়। তোর ছেলেটা যেমন হবে। সবাই বলছে এ প্রজন্ম গোল্লায় গেছে। অথচ তোর ছেলে, ছেলের বন্ধু ওরাও তো এ প্রজন্মেরই ছেলে।
গৌর তখন বলল, আমাদের বাড়ির এক গল্প বলি শুনুন, ওই যে, বাসনউলিগুলো আসে, পুরনো শাড়ি কাপড় নিয়ে স্টিলের বাসন দেয়, ওরকম একটা বাসনউলি এসে বাসন নেবার জন্য বসেছিল। মা বলছিলেন এখন বাসন দরকার নেই। তবু খুব জোরাজোরি করছিল। শেষকালে বলল ওর এক বচপনের সহেলি বাচ্চাদের নিয়ে ওর ডেরায় এসে উঠেছে কারণ ওদের ঘর নেই, আগুনে শেষ, জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ঘর কোথায়? কী একটা জায়গার নাম বলল, গুজরাতের। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কী? বলল অন্নপূর্ণা। আর সহেলির নাম? বলল, রেহেনা। উসকি তাল্লাক হুয়ী।
একটু নিস্তব্ধতা। গৌর বলল, ঠিক যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা বানানো গল্প। তাই না?
সুদেষ্ণা কিছু বলতে পারছিল না। আসলে ওর বুকের মধ্যে তখন মন্দির কারুকার্য তৈরি হচ্ছিল।
রমাপদ বললেন, আচ্ছা, তোমরা কেউ তাল্লাক কথাটার প্রচলিত অর্থ ছাড়া অন্য কোনও মানে জানো?
প্রচলিত অর্থ বলতে?
ওই তো, মুসলমানি মতে যেটা ত্যাগ করা। বউকে তালাক দেয় না, সেই। ওই রেহেনার যা হয়েছিল।
না, অন্য কোনও মানে?
না। জানি না তো। আছে নাকি? হঠাৎ তাল্লাক নিয়ে পড়লেন কেন?
রমাপদ তখন বললেন সেই মন্দির গাত্রের শিলালিপির কথা। যেখানে তালাক শব্দটি রয়েছে। এটা কোন মন্দিরে দেখেছেন?
আলমণিপুর। হুগলি জেলা। অদ্ভুত নাম তো, সুদেষ্ণা বলে। জানেন তো, অ্যালুমনিয়ামের বাসনকে গ্রামেগঞ্জে আলমনি বলে।
অ্যালুমনিয়াম থেকে নিশ্চয়ই আলমণিপুর হয়নি। গৌর বলল।
আশেপাশে মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম আছে বোধহয়, সুদেষ্ণা বলল।
না গো, চারিপাশে হিন্দু গ্রামই তো দেখেছিলুম মনে হচ্ছে। সন্ধেবেলায় আজানের শব্দও শুনিনি।
বীণাপাণি দেখল কী যে ব্যাপার, তালাক কথাটাকে নিয়ে সবাই গালে হাত দিয়ে চিন্তা করছে।
একটু পরেই ঘণ্টা বাজল। আলোগুলো সব বরিক পাউডার মাখা হয়ে গেল। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। বিছানাটা আবার হয়ে গেল বেড। সবাই ধীরে ধীরে চলে গেল। আবার প্রতীক্ষা। আগামীকালের জন্য। বাতাসে ওষুধ গন্ধ ফিরে এল ফের। সাদা নার্সটি এসে নীরবে ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল। গলায় রবারের নলে জিজ্ঞাসা জড়িয়ে ডাক্তারবাবু এলেন। কী ব্যাপার? পা-টা ফুলেছে দেখছি। কাল আবার একটু ডায়ালিসিস, জানেন তো?
হ্যাঁ। জানি। কালকের ডায়ালিসিস হয়ে গেলে ছেড়ে দেবেন তো? একটু কাজ ছিল।
ছেড়ে দেব কী বলছেন? সাত দিন বাদেই—আবার একটা ডায়ালিসিস করতে হবে যে।
রমাপদ বুঝতে পারেন ওর আর মুক্তি নেই। আর কয়েকবার হয়তো ডায়ালিসিস করা যাবে, তারপর আর তাতেও কাজ হবে না।
নার্সটি এল। হাতে একটা টুকরো কাগজ। বলল, একটা ফোন এসেছিল। গৌর মৌলিক নামে একজন ভবানীপুরের একটা বইয়ের দোকান থেকে জানালেন সুবল মিত্রের অভিধানে আছে তালাক মানে হল—
এবার কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে বলল, দিব্যি দেয়া, শপথ, প্রতিজ্ঞা।
ও। আচ্ছা, আচ্ছা।
নীল খাতাটা খুললেন, রমাপদ। ‘নিষেধ’ বোঝাতে গিয়ে ‘শপথ’ শব্দটার ব্যবহার কোথায় যেন দেখেছেন উনি। ৯৩ নম্বর টালিগঞ্জ রোডে হরিহর ধাম মন্দিরের প্রবেশ পথে পাথুরে লেখা: সকলের চরণে আমার এই নিবেদন
দেবালয়ে যাইবে না করিয়া আরোহন
নিষেধ বিধি কহি কিছু সবার অগ্রভাগে
গাড়ি পালকি ঘোড়া গজাদি নিষেধ আগে
পাদুকা পাদেতে আর শিরে ছত্রধরে
না যাইবে গঙ্গাস্নানে দেবের মন্দিরে
মুনিবাক্য হেলন করে যাইতে হাজার মন
শপথ আছয়ে প্রবেশ করিতে অঙ্গন।
ডাক্তার তরফদার ওয়ান টিস্পুন ফুল মতো হেসে বললেন, কাল সকালে আবার দেখা হচ্ছে, ভাল থাকবেন!
ভাল থাকবেন শুনলেই রাগ ধরে রমাপদর। ভাল থাকাটা যেন নিজের ইচ্ছেতে হয়। তবে আজ কিন্তু ভাল থাকা যেতেই পারে। কী শুভ দুটো ঘটনা শোনা গেল। শুভ আর বাসনউলি।
বীণাপাণির কাজ নেই তেমন। বেডটা ঝেড়ে দিল। গ্লাসে জল ভরে দিল। একটু পরেই খাবার আসবে। রাত আটটায় ওর ছুটি। রমাপদ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এর পরই সুদেষ্ণা গৌর তপনরা মিলে বীণাপাণিকে রাখার ব্যবস্থা করেছে। রমাপদর দুই ছেলে। মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। ওরা কমই আসে। ব্যস্ত। বীণাপাণি বলে বউদিকে অনেক দিন দেখছি না। ভাল আছেন তো উনি?
আসতে কত কষ্ট বলল, বাত ব্যাধিতে ধরেছে কিনা…। তা ছাড়া নতুন নাতনিটাকে নিয়ে কত ব্যস্ত থাকতে হয়, বলো…
বীণাপাণি খুঁচিয়েও স্ত্রী-পুত্র সম্পর্কে কোনও কটু বাক্য বার করাতে পারে না। পরচর্চা কে না ভালবাসে।
নার্সটি আবার এল। হাতে টুকরো কাগজ। কপালে ডবল দাঁড়ির মতো দুটো রেখা। বিরক্তির। বলল, আবার ফোন সুদেষ্ণা নাগ। ফোনে যা বলেছেন, আমি লিখে নিয়েছি। এই যে। টুকরো কাগজটায় লেখা—চৈতন্য চরিতামৃতে আছে ‘বীর বলে তো, তোকে তালাক ভেড়ের ভেড়ে স্ত্রী।’
তবে কি তালাক শব্দটি হিন্দুদের বাংলাতেও প্রচলিত ছিল!
নার্সটি যাবার সময় বলে গেল, ‘আরও ফোন আসবে নাকি!’
রমাপদ বীণাপাণির দিকে তাকালেন।
বলো তো বীণাপাণি, তোমাদের দেশের হিন্দুরা তালাক শব্দটা নিজেদের কথায় ব্যবহার করে?
বীণাপাণি বলে, কে জানে, শুনিনি তো।
তোমার গাঁয়ের নাম কী?
আলমণিপুর।
বলো কী? রমাপদ নড়েচড়ে বসলেন। ওর দেশ হুগলি জেলায়। এটা জানতেন কিন্তু গাঁয়ের নামই জিজ্ঞাসা করেননি আগে? ছিঃ। এমন তো হবার কথা ছিল না।
তোমাদের গাঁয়ে একটা পুরনো মন্দির আছে, বীণাপাণি?
আছে। উচেষ্ট শিবের মন্দির। কেউ যায় না, ঠাকুর নেই, তবু শিবরাত্তিরে মেলা হয়।
কেউ যায় না কেন?
কেন যাবে? ঠাকুর নেই তো।
বিগ্রহ কোথায়।
শুনিচি গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে।
কেন?
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মন্দিরের ভিতরে কোনও ঠাকুর নেই। বাইরে একটা বটগাছ আছে, ওখানে এখনও লোকে মানসিকের ঢেলা বাঁধে, আর গাছতলায় শীতলা মনসা রেখে যায়। তবে শুনেছি অনেক আগে ওখানে শিবপুজো হত, আর ওই শিব নাকি খুব জাগ্রত ছিল। তারপর নাকি একজন মোসলমান ওই শিবকে পুজো করতে লাগল। সে অনেক দিনের কথা। সেই মোসলমান নাকি একজন পির ছিল। একদিন শিব মন্দিরের ভিতরে ওই পিরের ডেড বডি পাওয়া যায়। তারপর থেকেই ওই মন্দিরে কেউ যায় না। ছোটবেলায় একটা গান শুনতাম, কালো কাপড়পরা এক মোসলমান গান গাইত। আমানুল্লার কিসসা। তাতে ওই মন্দিরের কথা কিছু ছিল। এখন আর মনে নেই।
মনে করার একটু চেষ্টা করো না, প্লিজ…বীণাপাণি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করে। কিছু বিড়বিড় করে। রমাপদ ব্যাকুল তাকিয়ে থাকে বীণাপাণির মুখের দিকে।
…ওরে। আমানুল্লা বলে আল্লাতালা সর্বত্র রয়েছে।
পানিতে আসমানে গাছে পাথরেও আছে
আল্লার হুকুমে পির মন্দির রচিল
আল্লা শিব বলি পির সেজদা করিল…
তারপরে?
মনে পড়ে না।
প্লিজ বীণাপাণি, চেষ্টা করো…
নাঃ।
উঃ।
রমাপদ মাথায় হাত দেন। বলেন, মুছে গেল?
একটুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, বীণাপাণি, ও বোধ হয় আল্লাশিব বলেনি। জাননা, ওটা বোধহয়— আল-হাসিব। মানে হিসেব নেবেন যিনি, মানে ঈশ্বর। মানুষের মুখে ওই আল হাসিব-ই আল্লাশিব হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ মেলায়। মেলায় মেলায়।
একটা জায়গা মনে পড়ছে একটু। বীণাপাণি বলে। আমার নাম ছিল বলে।
বিনা হাওয়া বিনা পানি হল ইন্তেকাল
আখিরাতে কেয়ামতে…
কী যেন ছিল, মনে পড়ে না আর।…
বীণাপাণি, ওটা বোধ হয় আখের রাত হবে। শেষ বিচারের রাত। আমানুল্লার শেষের কথাটা। জল ছাড়া, বাতাস ছাড়া আমানুল্লাকে মরতে হয়েছিল।
আটটা বাজে। দুধ পাউরুটি খেয়ে নেন। আমার ডিউটি শেষ। খাওয়া শেষ করে আপনি ভাবুন আবার।
বীণাপাণি, দরজা খুলে যাচ্ছে। দ্যাখো, মন্দিরটার নাম বলেছিলে উচেষ্ট শিবের মন্দির। আসলে ওটা উচ্ছিষ্ট শিব। ওই শিব উচ্ছিষ্ট হয়ে গেল বলেই গঙ্গায় বিসর্জন দেয়া হল, তাই না?
তাই হবে। দুধরুটি খেয়ে নেন।
গ্রামটার নাম আলমণিপুর। ওটা আল মোমিন থেকে আসেনি তো? আরবিতে আলমোমিন মানে নিরাপত্তা দাতা। বুঝলে সুদেষ্ণা।
আমি বীণাপাণি।
ও, সরি। ঠিক আছে। মোমিনপুর আছে না, কলকাতায়, থাকগে। কিন্তু ওটা আল মোমিন থেকেই আলমণি।
রমাপদ চোখ বোজেন। দেখতে পান হুগলি নদীতে পর্তুগিজ আর ডাচ বণিকদের জাহাজের পাল সপ্তদশ শতাব্দীর লবঙ্গ গন্ধমাখা হাওয়ায় দুলছে। মুর্শিদাবাদের তখত এ বসে আছেন আলিবর্দি। বাংলার ফৌজদার তখন কে? সুজা খাঁ? মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়েছে। মারাঠারা হুগলি ছেড়ে চলে গেল, আর প্রচুর মুসলিম সেনা বসে গেল হুগলি জেলায়। গঙ্গার কাছাকাছি। ধর্মান্তকরণও হল। ওই যে গ্রামটা, যে গ্রামে একটা প্রাচীন শিব মন্দির ছিল, আর ওই গ্রামটারও অন্য কিছু নাম ছিল হয়তো। সেই নামটা বদলে গেল। নতুন নাম হল আলমোমিনপুর। হাজি-মৌলভিরা যেমন এসেছিল ফকির দরবেশ সুফিরাও এসেছিল। শ্বেত শুভ্র দাড়ি শোভিত আমানুল্লাকে যেন দেখতে পান রমাপদ। দেখেন তাঁর নিষেধের হাত। মন্দির ভাঙতে দেয়নি আমানুল্লা। সে নিজে রক্ষা করেছিল। হয়তো সেই অঞ্চলে ওর প্রতিপত্তি ছিল, সে আগলে রেখেছিল ওই মন্দির, অপবিত্র হতে দেয়নি। সে পাথরে লিখিয়ে রেখেছিল, “শ্রীশ্রী বাটিতে কেহ পাদুকা পায় দিয়া জাইবেন নাই যে জাইবেন তাহাকে তাল্লাক।” এ জন্য ওকে হয়তো লড়তে হয়েছিল, কষ্ট পেতে হয়েছিল। সে সময়ের মৌলবাদীরা ওকে তাল্লাক দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কি মৌলবাদীদের হাতে খুন হতে হয়েছিল ওকে, মন্দিরের ভিতরে? “বিনা হাওয়া বিনা পানি হল ইন্তেকাল।”
তারপর হয়তো ইতিহাসের চাকা ঘুরেছিল, পালাবদল, আবার নতুন জনবিন্যাস, নবাসন। হিন্দুরা ফিরল আবার। কিন্তু ওই মন্দিরটি কি গ্রহণ করেনি আর, ম্লেচ্ছ স্পর্শে অপবিত্র শিবলিঙ্গটি, উচ্ছিষ্ট, শিবলিঙ্গটি গঙ্গায় বিসর্জিত হল। কিন্তু মন্দিরটি বেঁচে রইল উচেষ্ট শিবমন্দির হয়ে। বেঁচে আছে শিবরাত্রির মেলা, প্রাচীন বটবৃক্ষটিও বেঁচে আছে। যার শাখায় শাখায় ঝুলন্ত পাথরে আছে কামনা বাসনা, আল্লা শিব। নাকি আল-হাসিব!
নিজে নিজে কত কথা বলছেন। খেয়ে নেন। আটটা বেজে গেল, এবার পালাব।
চলো বীণাপাণি। পালাই।
ভুল বকছেন। দেখি, আবার জ্বর এলো কি না। কপালে হাত দিল বীণাপাণি।
জ্বর তো হয়নি, তবে?
তুমি তবে চলে যাও বীণাপাণি।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবেন। রাত করবেন না। কাল আবার ডাইলিসিস আছে।
হ্যাঁ। ডায়ালিসিস। আর ক’টাই বা? আর দু-চারটে, ব্যাস।
চোখ বুজে থাকেন রমাপদ মিত্র। বীণাপাণি কপালটি ছোঁয়। চুলেও একটু হাত বুলিয়ে দিল যেন। মায়া হাত। বলল, যাই।
রমাপদ চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। কত কাজ ছড়ানো-ছিটোনো। কত কাজ বাকি। কত কাজ করতে ইচ্ছে করে, ওরা তো রইল। ওরা করুক, গড়ুক।
আমানুল্লাকে দেখতে পান রমাপদ। তারপর সেই আমানুল্লা টেরাকোটার ফলকে বসে যায়। টেরাকোটা ফলকে বসে যায় সুদেষ্ণার আঠারো বছরের ছেলেটা, বাসনউলি বউ। নিজেরই গায়ে। রমাপদ তখন নিজেই মন্দির হয়ে উঠছেন ক্রমশ, সারা গায়ে টেরাকোটা।
এই শ্রীশ্রী বাটিতে হে মরণ তুমি আসিবে নাই। যদি আসিবে তবে তাল্লাক, তাল্লাক, তাল্লাক।
শারদীয় বর্তমান, ২০০২