তালতলার ডা: দূর্গাচরণ ব্যানার্জি
কুলীন ব্রাহ্মণ গোলকচন্দ্র ব্যানার্জির পুত্র প্রয়াত ডাঃ দূর্গাচরণ ব্যানার্জির জন্ম হয় ১৮১৯এ, ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের নিকটবর্তী গ্রাম মনিরামপুরে।
ছ’বছর বয়সে তিনি গুরুমশায়ের পাঠশালে বাংলা শিক্ষা আরম্ভ করেন। এর চার বছর পর তাঁর পিতা তাঁকে কলকাতা এনে হিন্দু কলেজে ভর্তি করে দেন। ১৫/১৬ বছর বয়সে তিনি একটি বৃত্তি পান এবং এই সময় থেকেই তিনি ইতিহাস ও গণিতে সহপাঠীদের ছাড়িয়ে ওঠেন। এরপর এক ব্রাহ্মণ বালিকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়; তখন তাঁর পিতা তাঁকে সল্ট বোর্ডের অধীনে চাকরি নিতে বাধ্য করেন। কিন্তু তিনি জ্ঞানপিপাসা এমন তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকেন যে একদিন বোর্ডের দেওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিবেদন রাখেন। তিনি বলেন ‘অজ্ঞতার রাজ্য থেকে তিনি সবে জ্ঞানের গিরিচূড়ার পথে অগ্রসর হচ্ছেন, এমন সময় শিক্ষাক্ষেত্র থেকে তাঁর সম্পর্ক চুকে যাওয়া মহাদুর্ভাগ্যের বিষয়।’ দ্বারকানাথ তাঁর পিতাকে ডেকে পাঠিয়ে ছেলেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করতে বাধ্য করেন। কিন্তু পিতার আর্থিক দুরবস্থার জন্য শিক্ষা সমাপ্তির দু’এক বছর পূর্বেই তাঁকে পুনরায় কলেজ ছাড়তে হয়। অবশ্য কলকাতায় পাওয়া যায় এমন ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বই ছাড়াও তিনি ইউরোপ থেকে আমদানি করা নতুন নতুন বই অধ্যয়নে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এই অভ্যাসের ফলে তখনকার ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজের শ্রেষ্ঠ ছাত্রগণ অপেক্ষা তিনি অনেক বেশি অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। ২১ বছর বয়সে তিনি ডেভিড হেয়ারের ইংলিশ স্কুলে দ্বিতীয় শিক্ষকের চাকরি পান। এবং মহান মানবপ্রেমিক ও এদেশীয়দের বন্ধু ডেভি হেয়ারের অনুমতি নিয়ে দৈনিক দু’ঘণ্টা করে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা করতে থাকেন। তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের কারণ নিম্নরূপ :
একদিন স্কুলে তিনি পড়াচ্ছেন এমন সময় একজন বেয়ারা মারফত খবর পেলেন, তাঁর স্ত্রী অসুস্থ। দ্রুত বাড়ি ফিরে দেখলেন, তাঁর স্ত্রী খুব বেশি অসুস্থ, অমনি তিনি ডাক্তারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু তিনি চিকিৎসক নিয়ে ফেরার আগেই তাঁর স্ত্রীর প্রাণ বিয়োগ হয়। উপযুক্ত সময়ে যোগ্য ডাক্তার না পাওয়ায়, এবং তাঁর স্ত্রী হাতুড়ে চিকিৎসকের চিকিৎসায় শিকার হওয়ায় তিনি চিকিৎসক হবার জন্য স্থির সঙ্কল্প করেন।
কালে তিনি প্রথমা স্ত্রীর বিয়োগব্যথা ভুলে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন সত্য, কিন্তু একথা তিনি ভুলতে পারেন নি, যে চিকিৎসা-বিজ্ঞানে তাঁর অজ্ঞতায় এবং যোগ্য চিকিৎসকের অভাবেই তাঁর প্রথমা স্ত্রী মারা যান; তাই পিতার শত আপত্তি ও বিরোধিতা সত্ত্বেও মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ডেভিড হেয়ারের স্কুলে মিঃ জোন্স সুপার্ইনটেনডেন্ট হয়ে এসে দূর্গাচরণকে জানিয়ে দিলেন, দৈনিক দুঘণ্টা করে তিনি স্কুল থেকে ছাড়া পাবেন না। দূর্গাচরণ তখন ডাক্তারি শেখবার জন্য শিক্ষকতা ত্যাগ করলেন। এই ভাবে পাঁচ বছর ডাক্তারি শেখার পর বিশেষ এক পরিস্থিতিতে তিনি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়লেন। পরিস্থতিটি এইরকম :
মেসার্স জার্ডিন স্কিনার অ্যান্ড কোম্পানির বেনিয়ান বাবু নীলকমল ব্যানার্জি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে, শহরের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারগণ তাঁকে পরীক্ষা করে সকল আশা ছেড়ে দিলে দুর্গাচরণের ডাক পড়ল। তিনি রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। সেই সময় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ রিচার্ডসন কলকাতা এলে তাঁকে রোগী ও দূর্গাচরণের ব্যবস্থাপত্র দেখান হয়। ব্যবস্থাপত্র দেখে রিচার্ডসন খুব খুশি হয়ে জানালেন, ওখানা সম্পূর্ণ ঠিক আছে। দূর্গাচরণের ব্যবস্থামত ওষুধ খাইয়ে দেখা গেল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রোগী ফল পেতে আরম্ভ করেছেন।
রিচার্ডসন নিজে উদ্যোগী হয়ে দূর্গাচরণের সঙ্গে পরিচয় করলেন। আলাপে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাঁর নাম দিলেন ‘দেশী রিচার্ডসন’।
এদিকে রামকমলবাবু সুস্থ হয়ে উঠলে দূর্গাচরণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে তাঁকে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়ামের খাজাঞ্চির চাকরি নেওয়ালেন : শর্ত রইল যে, তিনি (দূর্গাচরণ) সকাল, সন্ধ্যা, রবিবার ও ছুটির দিন প্র্যাকটিস করতে পারবেন। এই ভাবে চলার পর দূর্গাচরণ চাকরি ছেড়ে, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করলেন। তখন তাঁর বয়স ৩৪। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর পসার এত বেড়ে গেল যে, সকাল সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে রোগীর ভিড় লেগে থাকত। লোকের ধারণা হল, তাঁর কাছে চিকিৎসা করবার সুযোগলাভ মানে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরির আশীর্বাদলাভ। তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতিরও বৈশিষ্ট্য ছিল। রোগের নাম, সর্বোপরি রোগের লক্ষণ শুনেই স্বভাবসিদ্ধভাবে তিনি বুঝে নিতেন, রোগ কতখানি ছড়িয়েছে বা অবস্থা কেমন; সেই অনুযায়ী সঠিক ওষুধ দিতেন। অতি কঠিন রোগের অসংখ্য রোগীর সফল চিকিৎসা করায় তাঁর নাম আরও ছড়িয়ে পড়ল। অসুখ হলে সকলেই তখন দূর্গা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে উৎসুক হয়ে উঠত। দশ বছরের মধ্যে তিনি প্রায় লক্ষ টাকা উপার্জন করলেন।
অর্থ ও খ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন একান্তভাবে নিজ জ্ঞান ও পরিশ্রমে। ধর্মীয় ব্যাপারে পিতার আচার আচরণ তাঁর মনোমত ছিল না। তাছাড়া দেশবাসীর ধর্মবিশ্বাসকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন; ঝোঁক খ্রিস্ট ধর্মের দিকে; যাঁদের কাছে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন, তাঁদের ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্মকে তিনি শুধু শ্রদ্ধাই করতেন না, খ্রিস্ট ধর্মের জন্য তাঁর উৎসাহেরও অন্ত ছিল না। ফলে, বাবা ও ভাইদের সঙ্গে একত্রে একান্নে আর তার থাকা চলল না। দৃঢ়চেতা পিতাও ক্রমে পুত্রের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছিলেন। কাজেই পুত্রবিচ্ছেদ তাঁকে কাতর করতে পারল না।
দুর্গাচরণ বয়স্কা মহিলাদের মা এবং কম বয়সীদের বোন বলে সম্বোধন করতেন। রোগাক্রান্তদের প্রতি তাঁর সহানুভূমির সীমা পরিসীমা ছিল না। বাঙলার দূর দূরান্ত অঞ্চল থেকে আগত সকল রোগী ও তাঁদের সঙ্গীদের পথ্য ও আহারের ব্যবস্থা হত দূর্গাচরণের বাড়িতে– এইভাবে দৈনিক প্রায় পঞ্চাশ জন তাঁর বাড়িতে আহার করতেন। তাঁর মানবতাবোধও ছিল আদর্শস্থানীয়। দরিদ্রতম ব্যক্তির রোগাক্রান্ত-শিশুর চিকিৎসার জন্য তিনি আনন্দচিত্তে যেতেন– গভীর রাতেও তার ব্যতিক্রম হত না ৷ ধনীদের জাঁকজমক আর এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতি তাঁর ঘৃণাও ছিল প্রবাদ তুল্য। ইচ্ছে করেই তিনি সস্তা অতি সাধারণ পোশাক পরতেন, খেতেনও অতি সাধারণ খাদ্য। পানাভ্যাসও ছিল দুর্গাচরণের সুরা সম্পর্কে তিনি ছুঁৎমার্গী যেমন ছিলেন না, তেমনি মাতলামিও করতেন না। কখনও কখনও অত্যধিক পান করেও তিনি যে সব প্রেসক্রিপশন লিখতেন তার কোনটিতে কোন বিজ্ঞ চিকিৎসক কখনও কোন ভুল ত্রুটি পান নি। একথা ঠিক যে, অনেক সময় অন্যের ভুলত্রুটির বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপান হত।
শেষ দিকটায় স্বাস্থ্যহীনতার জন্য তিনি চিকিৎসা ব্যবসা ত্যাগ করেন। তার পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন আই সি এস পড়বার জন্য; কিন্তু সংবাদ পেলেন তাঁর পুত্রকে আই সি এস পড়ার অনুমতি দেওয়া হয় নিঃ এই দুঃখ ও হতাশায় তিনি প্রায় ভেঙে পড়েন। পরের ডাকে সংবাদ পেলেন, কমিশনারগণ সুরেন্দ্রনাথের আবেদন- পত্র পুনর্বিবেচনা করতে স্বীকৃত হয়েছেন। এতে তাঁর মনে আবার আশার আলো জ্বলে উঠল, শরীরেও অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেন; কিন্তু পুত্রের সাফল্য সংবাদ শোনার অবকাশ বা মহামান্যা মহারাণীর সিভিল সার্ভেন্ট হয়ে প্রত্যাগত পুত্রকে স্বাগত জানান তাঁর আর হল না; তার আগেই, ১৮৭০-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জ্বর হয়, জ্বর পরিণত হয় নিউমোনিয়ায় এবং এই রোগেই ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন। তখন তাঁর বয়স ৫২। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ পুত্র রেখে যান। এঁদের মধ্যে মধ্যম সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, আই সি এস, স্বদেশবাসীর উন্নতি ও প্রগতির জন্য প্রভূত চেষ্টা করেন। একদিকে তিনি যেমন মহান চরিত্রের অধিকারী, অপর দিকে তেমন তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক ও বাগ্মীদের অন্যতম।