তার চোখের তারায় – ৬

ষষ্ঠ অধ্যায়

সন্ধেবেলার দিকটায় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। রাত দশটা পার হতে সেটা একটু থেমেছে। তবে এখনও একবারে বিদায় নেয়নি। আকাশে চাঁদ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ লালচে আভা ছড়িয়ে আছে আকাশ জুড়ে। জলের ছোঁয়া পেয়ে কাঁটাঝোপের ভিতর থেকে একটানা ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মিটমিট করে জ্বলছে জোনাকি। জমিদারবাড়ির থাম, দেওয়াল আর ছাদ রাতের বুকে শুয়ে আছে জোনাকির আলো মেখে। সব কিছু আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ। গোটা এস্টেটটা গভীর ক্লান্তির ঘুমে ঢলে পড়েছে।

হঠাৎ জমিদারবাড়ির দিক থেকে ভেসে আসা একটা শব্দে এই নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। চাতালের মাঝে জমে থাকা জলের উপর পায়ের আওয়াজ। একটা নয় দুটো।

অন্ধকারের মধ্যে একটা নারীমূর্তিকে দেখা গেল। তার মাথা থেকে পা অবধি কাপড়ে ঢাকা। সন্তর্পণে মাথা থেকে ঢাকাটা সরিয়ে ফেলল সে। চোখের মণি দুটো সাদা হয়ে জ্বলছে। না মণি নয়, জ্যোৎস্না এসে পড়েছে তার রিমলেশ চশমার কাচে। সেই আলোই প্রতিফলিত হচ্ছে। পিছন ফিরে সে বলে, “আজ কি না হলেই নয়? কাদার উপরে আছাড় খেলে আর রক্ষে থাকবে না।”

এবারে পিছন থেকে আর একটি নারীমূর্তিকে দেখা গেল। একটা জ্বলন্ত সিগারেট ধরা আছে তার ঠোঁটে। সেই আলোতেই মুখের একটুখানি অংশ চোখে পড়ছে। ধীর পায়ে জল পাড়িয়ে এগিয়ে এল সে, “আজ বৃষ্টি হওয়ায় একটু ঠান্ডা পড়েছে। সহজে লোকের ঘুম ভাঙবে না। দিস ইজ আইডিয়াল।”

“আর জামাকাপড়ে কাদা লাগলে কাল তুমি পরিষ্কার করবে।”

“বেশ করে দেব। চল এখন। এই জায়গাটা সেফ না।”

আর আপত্তি করে না সুনন্দা। দেখে শুনে পা চালায়। মনটা মোটেই ভালো নেই তার। একে সারাদিন ধকল গেছে, তার উপরে এই রাতবিরেতে অচেনা জায়গায় চোরের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে কবর খুঁড়ে বের করা। এসব করতে হবে জানলে সে এ বাড়িতে থাকতেই আসত না। নীলাদ্রিকে এসব কথা জানানো হয়নি। জানালে লাভের থেকে ঝামেলা হবে বেশি। পরশুর আগে সে ফিরছে না। ফিরলে একেবারে সামনা-সামনি না হয় বলা যাবে সব।

পায়েল আজ রাতের আগে দেখা দেয়নি। নিজের ঘরে গিয়ে নাকি পড়াশোনায় মন দিয়েছিল। অন্যবার এখানে এসে নিরিবিলিতে তার পড়াশোনা ভালো হয়। এবার কিছুই হয়নি।

আজ তুলির সঙ্গে দাবা খেলতে খেলতে অনেকগুলো নতুন ভাবনা খোঁচা দিচ্ছিল সুনন্দার মাথায়। বেশ কয়েকটা নতুন সম্ভাবনা। এমনও তো হতে পারে যে চারটে লোক এ বাড়িতে মারা গেছে তাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে অবশ্য সেটা থাকার কথা নয়, কারণ চারজন চার

রকমভাবে চার জায়গায় মারা গেছে। প্রথমজন যখন মরেছে তখন শেষ জনের জন্মই হয়নি। সমস্ত ঘটনাটা একেবারে শুনলে মনে হয় আড়াল থেকে যেন একজন মানুষই কলকাঠি নাড়ছেন। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে সেই লোকটার বয়সও অন্তত আশি-পঁচাশির কম হওয়ার কথা হয়। তেমন বৃদ্ধ কেউ তো এ বাড়িতে নেই। তাহলে কে?

“আরে, দেখে চলো। পড়বে তো।”

এইসব ভাবতে ভাবতে অসাবধানে একটা গর্তে পা রেখে হোঁচট খেয়ে টলে গেছিল সুনন্দা। পায়েল হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে নিল তাকে।

সামনেই সিকিউরিটি গার্ডের ঘর। তার পাশেই সদর দরজা। তার উপরে এখন একটা বড় তালা ঝুলছে। সেটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে সুনন্দা বলল, “ওই চাবি তো জোগাড় করেছ। এটার কী হবে?”

পায়েলকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চিন্তিত দেখাল। তারপর সেইরকম ভাবুক মুখেই বলল, “একটাই প্ল্যান মাথায় আছে।”

“কী প্ল্যান?”

“উঁহু, আমার না, তোমার মাথায়। ক্লিপটা দাও তো।”

“ক্লিপ!” মুহূর্তে অবাক ভাবটা কমে যায় সুনন্দার, “বুঝেছি। ওইটা বেঁকিয়েই চাবি বানিয়ে তালা খুলবে?”

“হ্যাঁ, দাও তাড়াতাড়ি। আর লক্ষ রাখো ভোঁদড়টার ঘুম যেন না ভাঙে।”

“আর ভেঙে গেলে?”

“ভাঙবে না। এমনি কি আর বৃষ্টির দিনে বের হয়েছি?”

অগত্যা মাথা থেকে একটা ক্লিপ খুলে পায়েলের হাতে দিল সুনন্দা। বেশ খানিকটা চুল মাথার উপর থেকে কানের পাশে চলে এল তাতে। সে সাবধানে এগিয়ে এসে গার্ডটার মুখটা একবার ভালো করে দেখল। ঘড়ঘড় করে নাক ডাকার শব্দ আসছে। মুখটা হাঁ করে ঘুমাচ্ছে লোকটা। হাতের পাশেই একটা বড়সড় লাঠি পড়ে আছে।

ওদিকে পায়েল ক্লিপটাকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে তালার ভিতরে ঢুকিয়ে কসরত শুরু করেছে। দরজার ঠিক উপরেই একটা নীলচে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। তাতে ভালো করে তালাটা দেখতে পাচ্ছে না সে।

“তোমার মোবাইলে টর্চ নেই?” সুনন্দা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আছে, কিন্তু সাইলেন্ট করা নেই। লক খুলতে গেলে আওয়াজ হবে জোরে। ভোঁদর উঠে পড়বে।”

আর কিছু না বলে চশমাটা ভালো করে চোখের উপরে বসিয়ে নিল সুনন্দা এবারে মেয়েটা হতাশ হয়ে ফিরে গেলেই ভালো।

ক্লিপটা মুঠো করে ধরে উঠে পড়ল পায়েল। চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা আলো খুঁজতে লাগল। চোখে পড়ল থামের ভিতরে জ্বলতে থাকা মশালটা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে আংটা থেকে সেটা খুলে নিল পায়েল। তার শিখাটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। আগের মতোই সাবধানে ফিরে এসে সেটা সুনন্দার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা দেখাও এদিকে। আর গার্ডের দিকটা আড়াল করে দাঁড়াও। ওর মুখে যেন আলো না পড়ে।”

“একটা টর্চ আনতে পারলে না?” বিরক্ত হয়ে বলে সুনন্দা।

“টর্চ আমার কাছে নেই। মধুদার কাছে ছিল কিন্তু চাইতে গেলে কিছু একটা সন্দেহ করবে।”

“আমাকে আগে বলতে পারতে মোমবাতি ছিল আমার কাছে?”

পায়েল দাঁত দিয়ে ক্লিপ কামড়াতে কামড়াতে বলে, “বছর পঁয়তিরিশের মহিলা। মাঝরাতে মোমবাতি হাতে পুরনো কবরস্থানে ঘোরাঘুরি করছে। তোমার প্রোফাইলটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত বুঝতে পারছ?”

“সব তোমার পাল্লায় পড়ে।”

“অন দ্যা কন্ট্রারি তুমি আমাকে কবরস্থানে নিয়ে গেছিলে। আমি আগে যাইনি।”

“আমি কবরস্থানে যেতে বলেছিলাম, তালা খুলে একেবারের সমাধির ভিতরে ঢুকতে বলিনি।”

খুট করে একটা শব্দ করে খুলে যায় তালাটা। পায়েল সেটা আংটা থেকে সরাতে সরাতে বলে, “সেটা যে করতে বলেছে তার নামটাই জানতে ইচ্ছা করছে খুব।”

মশালটা আবার আংটায় রেখে গেটে তালাটা আলতো করে ঝুলিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে দু’জনে। সুনন্দা পা চালাতে চালাতে বলে, “তা বিদ্যেটা শিখলে কোথা থেকে?”

“কোন বিদ্যে? তালা খোলা?”

“হ্যাঁ।”

“ইউটিউব দেখে।”

“তাহলে এই চাবিটা এত কষ্ট করে জোগাড় করার কী ছিল?”

“মসোলিয়ামের সামনে যেটা ঝুলছে সেটা মামুলি তালা নয়। শতাব্দী প্রাচীন প্যাডলক। সেটা খুলে ফেলা চুলের ক্লিপ দিয়ে সম্ভব নয়। তাছাড়া…”

“তাছাড়া কী?”

“চাবিটা শুধু তালাটা খোলার জন্যে না। এটা সম্ভবত একটা সংকেত আমাদের চাবিটা দিয়ে বলতে চাওয়া হয়েছে যে মসোলিয়ামটা খুললে কিছু একটা পাওয়া যাবে।”

দু’জনে বেশ কিছুদূর হেঁটে আসে। রাস্তার পাশের লাইটপোস্টগুলো তেমন জোরালো নয়। সরু ফুটপাথ আলোছায়ায় ঢেকে আছে। রাস্তা দিয়ে দ্রুত গাড়ি ছুটে গেলেও দুটি নারীমূর্তিকে দেখতে পাবার কথা নয়। হাঁটতে আরামই লাগে সুনন্দার। পথ বেশ নরম। ক’দিন গরম পড়ার পড়ে আজ রাতের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লেগে জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীরটা।

আবার হোঁচট খেতে যাচ্ছিল সুনন্দা। পায়েল তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “তুমি আজ এত কী ভাবছ বল তো?”

“ভাবছি এই চারজনের আগেও হয়তো এ বাড়িতে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।”

“মধুবাবু সেদিন একটা কথা চেপে গেছিলেন আমাদের কাছে। হয়তো একটু বেশি ভায়োলেন্ট বলেই আমাদের মন ভারাক্রান্ত করতে চাননি।”

“কী কথা?”

“ভূপতি দত্ত বিছানায় শুয়ে মারা যাননি। ভূপতির শেষ বয়সে টিবি হয়। তাতেই মৃত্যু হয় তার। ফলে জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়ে নৃপতির ঘাড়ে। তিনি খুব একটা সুবিধের লোক ছিলেন না। খাজনার জন্যে লুটপাট, জেনোসাইড এসবের জন্যে কৃষকরা এমনিতেই ক্ষেপে ছিল। শেষে একদিন মাঝরাতে একদল গ্রামবাসী চড়াও হয়ে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ ও নৃপতি দত্তকে, সাদা বাংলায় যাকে বলে জবাই করে। জবাই বোঝো?”

মাথা নাড়ে সুনন্দা, তারপর বলে, “ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন?”

“উঁহু, সে তো তাৎক্ষণিক ব্যাপার। জবাই করা হয় অনেকটা ধীরে

সুস্থে। হয় বাঁধা থাকে, নাহলে কেউ হাত চেপে ধরে, কেউ পা চেপে ধরে। তারপর একজন ছুরি বা চপার নিয়ে এসে একটু একটু করে কাটে। সোজা কথায় জবাইয়ের একটা বিল্ড-আপ আছে।”

“মানুষ কত নৃশংস ছিল তখন।” থমথমে গলায় বলে সুনন্দা।

“ভূপতির জেনারেশানকে যতটা ব্যাকডেটেড ভাবছ ততটা নয়। ভূপতি দত্ত রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের কনটেম্পোরারি। আর আমাদের কন্দর্প দত্ত যদি আর একটু দক্ষিণে জন্মাতেন তাহলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে চা খাবার একটা সুযোগ ছিল তার।”

“তুমি এত কিছু জানলে কী করে? ইউটিউব দেখে?”

“আজ সন্ধ্যেয় পড়ছিলাম এসব।”

“ও হরি! ইংরাজি পড়ার নাম করে আসলে এইসব পড়ছিলে তার মানে?”

“ভাষাও তো ইতিহাসেরই একটা অংশ।”

খানিক দূর হেঁটে এসে চার্চের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনে। এখানে একটা দরজা আছে বটে তবে তালা নেই। চার্চের দরজায় তালা ঝোলানো বেআইনি। পায়েল ফিসফিস করে বলল, “ডাক্তার, ডোম আর ভগবান এদের অফিস বন্ধ করার জো নেই। কার যে কখন দরকার পড়ে।”

“অফিসে লোক থাকলেই মুশকিল।”

নেই বলেই তো মনে হচ্ছে। অন্তত এত রাতে ‘লোক’ থাকাটা অফচান্স। তাও ধরা পড়ে গেলে কিছু একটা বাহানা রেডি রেখো।”

“রাত-বিরেতে লোকের কবর খুঁড়তে আসার কোনো বাহানা হয় না পায়েল। এসাইলাম থেকে কী করে পালালাম সেটার একটা গল্প শোনাতে হতে পারে বরং।”

“তাই শুনিও না হয়।” কথাটা বলে দরজাটা একটু ফাঁক করে ভিতরের দিকে পা বাড়ায় পায়েল। ক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজ হয় একটা। পায়েল নিচু হয়ে ভালো করে চারপাশটা একবার দেখে নেয়। না কাউকে চোখে পড়ছে না। চার্চের কম্পাউন্ডের সামনেটায় একটা টিউব জ্বালানো আছে। তাতে আলোকিত হয়ে উঠেছে চার্চের সামনেটা। এতদূর আসার প্রশ্নই ওঠে না।

সুনন্দাও ঢুকে আসে পায়েলের সঙ্গে সঙ্গে। এতক্ষণে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেরিয়ে এসেছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পায়েল বলল, “আঙ্গ ফুলমুন দেখছি। ভালোই হল।”

“এবার তো মোবাইল জ্বালাতে পারবে। ফুলমুনের কী দরকার?”

“উঁহু, আলোর জন্যে নয়। পূর্ণিমা রাতে ওয়্যার-উলফ্রা শিকার ধরতে বেরোয়। কিন্তু ঈশ্বরের এলাকা বলে তারা চার্চের ভিতর ঢুকতে পারে না। আমরা চার্চের আশেপাশে আছি মানে বিপদ নেই।”

“যত্তসব, কাজ নেই আর খেয়েদেয়ে…” মুখ বেঁকায় সুনন্দা।

ছপছপ করে কাদার উপরে পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। একটু দূরে ফণীমনসার ঝোঁপ থেকে ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে একটানা। কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়ল সুনন্দার গায়ে। গায়ের রেনকোটটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সে। এই বিরাট কবরস্থানে বৃষ্টি এলে দাঁড়িয়ে যেতে সমস্যা হবে না কিন্তু তেমন বৃষ্টি হলে এদিকটায় জল দাঁড়িয়ে যেতে পারে। বাড়ি ফেরাটা মুশকিল হবে। কেন যে পায়েলের পাল্লায় পড়ল…

চার্চটাকে পাশ কাটিয়ে জমির উপর দিয়ে এগিয়ে এল দু’জনে। এদিকটায় আলো অপেক্ষাকৃত কম। সামান্য আলোর হেরফেরে কবরস্থানের চেহারা কতটা পালটে যেতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারত না সুনন্দা

মোবাইলের আলোটা জ্বেলে সেটা নিচু করে ধরে সমাধিগুলোকে পাশে ফেলে কবরস্থানের শেষের দিকে হেঁটে গেল ওরা। মাটিতে দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে। একে জায়গাটা কাদায় পিছল হয়ে আছে তার উপরে মাটিতে পড়ে থাকা ডালপালা যে কোনো সময় পায়ের উপর আঁচড় কাটতে পারে। চাঁদ আর মোবাইলের সাদা স্তিমিত আলোই একমাত্র ভরসা।

বেশ কসরত করে মসগ্রুপ পরিবারের মসোলিয়ামের সামনে আসতে আধঘণ্টা লেগে গেল ওদের। রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িতে সময় দেখল পায়েল। রাত সাড়ে এগারোটা হয়েছে সবে। এর মধ্যেই গোটা এলাকাটা মরার মতো ঘুমে ডুবে গেছে।

এক’পা এক’পা করে কাদার উপরে পা দিয়ে মসোলিয়ামের দরজার সামনে চলে এল পায়েল। একটু ইতস্তত করে সুনন্দাও পা বাড়াল।

ছোট গ্রানাইটের ঘরটাও যেন গোটা চকদীঘি গ্রামের মতোই ঘুমিয়ে আছে। শুধু তার ঘুমটা একটু দীর্ঘ। অন্তত দু’শো বছর ধরে ঘুমের আড়ালে কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে রেখেছে সে।

“ভয় লাগছে নাকি?” সুনন্দার দিকে তাকিয়ে সরু গলায় জিজ্ঞেস করে পায়েল।

“হুঁ, তবে ভূতের না। কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে সেই ভয়।” পকেট থেকে চাবিটা বের করে পায়েল। সেই সঙ্গে একটা সাঁড়াশির মতো দেখতে যন্ত্র। সুনন্দা অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে বলে, “ওটা কী হবে?”

“মসোলিয়াম সাধারণত সিল করে দেওয়া হত। সেটা হাত দিয়ে খোলা যাবে বলে তো মনে হয় না। আলোটা ধরো তো দেখি।”

সুনন্দা আবার আলোটা জ্বেলে তালাটার উপরে ধরে। চারপাশটা আর একবার দেখে নেয়। যদিও আলোটা জোরালো নয় আর চার্চের এদিকটায় কোনো জানালা নেই। তাও কেউ দূর থেকে তাকালে দেখতে পাবে আলোটা। মোটা চেনগুলোর সঙ্গে জড়ানো আছে তালাটা। যেন দু’টো মানুষেরই হাত মসোলিয়ামের দু’পাশ থেকে বেরিয়ে এসে ঘিরে রাখতে চাইছে দরজাটাকে।

তালার ভিতরে চাবি ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ খুটখুট করল পায়েল। তালা এত সহজে খোলার নয়। হঠাৎ সুনন্দার মনে হয় তাদের ঠিক পিছনেই যেন কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। গাছের ডালপালার উপরে পায়ের আওয়াজ হতেই সে ফিরে তাকালো। আলোটা ঘুরে গেল সেদিকে।

নাঃ কেউ তো নেই। আগের মতোই খাঁখাঁ করছে কবরস্থানটা। দূরে চার্চের আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না এখানে থেকে। একটু দূরে পাশের সমাধির পিলারটা এখনও আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। তাহলে কার পায়ের আওয়াজ শুনলো এক্ষুনি? মনের ভুল?

আলোটা ঘুরে যেতে একটু বিরক্ত হল পায়েল, “আরে কী হল? প্রায় কায়দা করেই ফেলেছি।

আরও মিনিট তিনেকের চেষ্টার পরে বেশ জোরে ঘড়াং করে একটা আওয়াজ করে খুলে গেল তালাটা। পায়েল হাত দিয়ে টেনে চেনগুলো দু’পাশে সরিয়ে দিতে দরজাটা চোখে পড়ল। যেখানে চেনগুলো ঝুলে ছিল তার চারপাশে বেশিরভাগটা ধুলো আর শ্যাওলায় ঢেকে গেছে। তার নিচে আবার এলিজাবেথ মসত্রুপের নামটা লেখা। পায়েল কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “একলা মানুষের জন্যে মসোলিয়াম বানানো হয় না। মেয়েটার বাবা মা কীভাবে মারা গেল কে জানে।”

তালাটা যেখানে ঝুলছিল তার ঠিক নিচেই একটা লোহার কড়া লাগানো। দরজার দুটো পাল্লাকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে সেটা। হাতের যন্ত্রটা বের করে সেটার নিচে একবার ধরল পায়েল। তারপর একটা বড়সড় নিশ্বাস নিয়ে চাপ দিল তাতে। কোনো নড়চড় হল না। জং ধরে শক্ত হয়ে এঁটে গেছে সেটা।

সুনন্দা একটু নিচু স্বরে বলল, “পায়েল, পরে একদিন আসা যাবে না হয় আজ ফিরে চল।”

“তুমি এত বেকুবের মতো ভয় পাচ্ছ কেন বলতো?” পায়েল আংটায় চাপ দিতে দিতে দম ধরা গলায় বলল।

“কি জানি, মন বলছে যা হচ্ছে তাতে কারও ভালো হবে না। এতদিন আগের একটা ব্যাপার। সেটা নিয়ে আমরা নাই বা টানা হেঁচড়া করলাম। সেই সময় যা ঘটেছিল তাতে যেই দায়ি থাক না কেন সে আজ বেঁচে নেই।”

“আর শশিভূষণ সরকার? তার খুনটা তাহলে হল কী করে?”

“খুন যে হয়েছে সেটা আমাদের ধারণা। এমনও হতে পারে ভদ্রলোক সত্যি সুইসাইড করেছিলেন। আমরা অকারণেই অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছি।”

“মানে তুমিও স্বীকার করছ আমাদের চারপাশে এমন একটা কিছু আছে যেটা অন্ধকার। এই জমিদারবাড়িকে জড়িয়ে কিছু একটা লুকিয়ে রাখা আছে। সেটা যদি থাকতে পারে ঢিল ছুঁড়তে অসুবিধা কোথায়?”

সুনন্দা আর কিছু না বলে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। একটা হেঁচকা টানে আংটাটা তুলে আনল পায়েল। তারপর একটা পায়ে ভর দিয়ে আর একটা পা সামনে রেখে দু’হাতে ঠেলা দিল শ্বেতপাথরের ফলক করা দরজাটায়। সুনন্দা এসে হাত লাগালো।

খানিক ঠেলাঠেলির পর একদিকের পাল্লাটা আড় হয়ে খুলে গেল। বাইরে থেকে মোবাইলটা দিয়ে ভিতরে আলো ফেলল সুনন্দা। প্রথমটা প্রায় কিছুই দেখা গেল না। তারপর একটু একটু করে ভিতরের খানিকটা পরিষ্কার হল তাদের চোখের সামনে।

ভিতরের সব জায়গাটা মিলিয়ে তিন স্কোয়ার মিটারের মতো একটা ঘর। তার সমস্তটাই শ্বেতপাথরে বাধানো। মাকড়সার ঝুল উপর থেকে নিচ অবধি মশারির মতো ছেয়ে রয়েছে। ভিতরে একসঙ্গে দু’জনের বেশি মানুষের দাঁড়াবার জায়গা নেই।

মুখ বাড়িয়ে একবার ভিতরটা দেখে নিয়ে পাল্লাটা পেরিয়ে এল পায়েল। সুনন্দার হাত থেকে আলোটা নিয়ে সেটা মেঝের দিকে ফেলল। পুরু ধুলোর আস্তরণে ঢেকে আছে মেঝেটা।

দু’ধারে মেঝে যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকে কফিন ঢোকানোর জন্যে ছোট ছোট থাক করা আছে। মোট তিনটে থাক। দুটো বাঁদিকের দেওয়ালে একটা ডানদিকের দেওয়ালে। থাকগুলো শেষ হতেই দু’দিকের দেওয়ালে তিনটে করে মোট ছ’টা খুপরি করা আছে। পায়েলের হাতের আলো গিয়ে পড়তে দেখা গেল সেই খুপরির ভিতরে কতগুলো দলা পাকানো নষ্ট হয়ে যাওয়া হাত-পা ভাঙা পুতুল।

“এগুলো সম্ভবত এলিজাবেথ মসক্রপের খেলনা। বাচ্চা মরে গেলে তার প্রিয় খেলনাগুলো রেখে দেওয়া হত মসোলিয়ামের ভিতরে। পিরামিডের ইনফ্লুয়েনস বলতে পারো।”

পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল সুনন্দার একসময় একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চামেয়ের খেলার সাথী ছিল সেগুলো। কয়েকশো বছর ধরে ওভাবেই পড়ে আছে অন্ধকারে। কেউ খেলে না তাদের নিয়ে। এলোমেলো চুল, স্থির ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছে সুনন্দার দিকে।

উবু হয়ে নিচের একটা থাকের সামনে বসে পড়ল পায়েল। তারপর গলাটা অনেকখানি নিচে নামিয়ে বলল, “এগুলো হল ক্রিপ্ট। এর ভিতরে ঢোকানো হয় কফিনগুলো। আজীবন ধরে এই ক্রিপ্টের মধ্যেই থেকে যায় তারা।”

“তার মানে এখানে তিনটে মৃতদেহ আছে?”

“উঁহু, তার মানে মসক্রপ পরিবারের মোট সদস্য তিনজন। বাবা মা আর একটি মেয়ে।”

“কিন্তু মেয়ে মসক্রপ তো…”

“আপাতত ধরে নাও পুনর্জন্ম হয়েছে অ্যাজ লীলাবতী দত্ত। আমার গ্রেট গ্র্যান্ড মাদারের গ্রেট গ্র্যান্ড মাদারের উত্তরজন্ম আমার সামনে। ইটস গেটিং স্পুকি।”

কথাটা বলে একটু হাসল পায়েল। তারপর আলোটা একবার ঘোরালো চারিদিকে। দরজার ঠিক উলটোদিকে একটা মিটার দুয়েকের দেওয়াল। দু’পাশে ক্রিপ্ট থাকায় তার অল্প খানিকটা চোখে পড়ে। সেখানে শ্বেতপাথরের উপরে রঙিন পাথরের কাজ করা আছে। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ চোখ মেলে, কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। শেষে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “ক্রিশ্চানদের রীতি অনুযায়ী যেখানে একটা বাচ্চামেয়ের সমাধি আছে সেখানে বিশেষ কিছু সিমবল্ থাকার কথা। ভেড়া, ক্রস, হার্ট কিন্তু তার বদলে এখানে যা দেখতে পাচ্ছি সেগুলো খুব একটা সুবিধের নয়।”

“কী দেখতে পাচ্ছ?”

দেওয়ালের দিকটায় সরে আসে সুনন্দা। তার নিঃশ্বাস পড়ছে এখন পায়েলের কাঁধে।

দেওয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা বড় গোল করা। তার ভিতরেই খোদাই করা আছে চিহ্নগুলো। কয়েকটা পাখির মুখ, গুল্মলতা, ভালো করে তাকিয়ে একটা চিহ্ন দেখে একটু অবাক হল সুনন্দা। বিড়বিড় করে বলল, “একটা ড্রাগনও আছে দেখছি।”

পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “চল, এবার ফেরা যাক।”

“ফিরব!” বিস্ময়মাখা গলায় বলল পায়েল, “এখনও তো আসল কাজই করা হয়নি।”

“কী কাজ?”

আর উত্তর না দিয়ে মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল পায়েল। তারপর আবার আলোটা সামনে ধরে ক্রিপ্টগুলোর উপরে কিছু একটা খুঁজতে লাগল।

“কী খুঁজছ বলতো তুমি?”

“একটা চিহ্ন। বাইরে যেটা ছিল। লোটাস উইথ থ্রি পেটালস।”

কথাটা বলেই হাতের আলোটা একটা ডানদিকের ক্রিপ্টটার একদম নিচের দিকে নিয়ে গেল সে। তার মুখে একটা হাসির রেখা খেলে গেল।

“অ্যাণ্ড হিয়ার ইট ইজ।”

সুনন্দাও মাটির উপরে বসে পড়ে দেখল ক্রিপ্টের গায়ে সত্যি খোদাই করা আছে চিহ্নটা। একটা ছোট গোলের ভিতরে একটা তিন পাপড়ির পদ্ম।

“খুলতে হবে এটা!”

“কী খুলবে?” অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।

“কী আবার, এই ক্রিপ্টটা। এর জন্যেই এত ঝামেলা করে এখানে আসা।”

“তুমি কি খেপেছ? আর কিছু না মানো অন্তত মৃত মানুষের প্রতি একটু তো সম্মান দেখাও।”

“এর ভিতরে কোনো মৃত মানুষ নেই সুনন্দাদি। ভিতরে যা আছে সেটাকে রক্ষা করার জন্যেই কেউ বানিয়েছিল এই ক্রিপ্টটা।”

“যদি থাকে? তাহলে কী হবে?”

“অন্তত গ্রেভ ডিগিং-র জন্যে তোমাকে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দেবে না।”

রাগ মাথায় উঠে গেল সুনন্দার, সে হিসহিসে স্বরে বলল, “সমস্ত ব্যাপারটা তোমার কাছে মজার? তাই না? দেখ, এসব তোমাদের বংশের ব্যাপার তুমি বুঝবে। আমাকে একটা বাচ্চামেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার বেশি কিছুতে জড়াতে চাই না আমি।”

“বেশ, জড়িও না। আমি তো জোর করিনি তোমাকে।”

শান্ত গলায় কথাটা বলে আবার ক্রিপ্টের দিকে মন দিল পায়েল। সুনন্দা কী করবে বুঝতে পারল না। এই অবস্থায় পায়েলকে এখানে ফেলে ফিরতে ভয় করছে তার। একটু আগে যেভাবে জোর গলাতে কথাটা বলেছে তাতে খানিকটা ভয় তার নিজেরও লাগছে। কয়েক সেকেন্ড সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে একটুখানি বাইরের দিকে সরে এল সুনন্দা। মুখে বলল, “বেশ, তোমার যা করার আছে করে নাও। একসঙ্গেই ফিরব।”

আর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। মসোলিয়ামের ভিতরটা ঘুপচি। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে শ্বাস আটকে আসে। একটু আগের লোহার যন্ত্রটা নিয়ে চাড় দিয়ে ক্রিপ্টের শ্বেতপাথরের আবরণটা সরিয়ে ফেলে পায়েল। ভিতরে কোনো নাম লেখা নেই। একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগে তার নাকে। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে সে।

একেই নিঃশ্বাসের অসুবিধা তার উপরে বিশ্রী গন্ধ। কপালের জমা ঘাম রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। বড় কয়েকটা নিশ্বাস নেয়। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সুনন্দা। মাঝে মাঝে পায়চারি করছে। তার শরীর জুড়ে একটা ছটফটানি ভাব। পায়েল তার থেকে অনেকটা শান্ত।

কিছুক্ষণ পরে ঘড়িতে সময় দেখে আবার ভিতরে ঢুকে আসে পায়েল। গন্ধটা এতক্ষণে একটুখানি কমে এসেছে। আবরণটা সরিয়ে রাখা আছে একপাশে।

আবার মেঝের উপরে বসে পড়ে সে। আলোটা ভিতরের দিকে ফেলে• দেখতে পায় কফিনটা। তার গায়ে কোনো হাতল নেই। সাবধানে সেটাকে চেপে ধরে একটু একটু করে টেনে বাইরে আনে পায়েল। ধুলোর উপর দিয়ে ঘসঘস্ করে আওয়াজ হয় একটা। কফিনটা খুব একটা ভারী নয়। ভিতরে তেমন কিছু নেই তা বোঝা যায়। মৃতদেহও যদি রাখা হয়ে থাকে এত বছর পরে তার আর ওজন থাকার কথা নয়।

একটা ক্ষীণ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে পায়েলের মাথায়। যেন বহু দূর থেকে কেউ বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে। বাজিয়েই চলেছে একটানা। সুরের মধ্যে কিছু কথা লুকিয়ে আছে যেন। কেউ কি কিছু বলতে চায়?

মাথায় একবার হাত রেখে যন্ত্রণাটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করে পায়েল। মনে হয় আর একটু পরেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। ইচ্ছা করে গলা তুলে একবার সুনন্দাকে ডাকতে কিন্তু পরমুহূর্তেই সংবরণ করে নিজেকে

কফিনের ডালাটা একটা আংটায় আটকানো ছিল। সেটায় জং ধরে গেছে। হাতের যন্ত্রটা সেখানে গলিয়ে জোরে চাপ দেয় পায়েল। সেটা খোলে না। চড়চড় করে একটা আওয়াজ শোনা যায় শুধু। অদম্য জেদ পায়েলের ক্লান্ত শিরায় আচমকাই অমানুষিক শক্তি এনে দেয়। আবার আংটায় জোরে চাপ দেয় সে। এবার অন্য একটা আওয়াজ। জং ধরা হুকটা খুলে গেছে। সেটা ভেঙে নিচে পরে যায়। ডান হাত দিয়ে ডালাটা ধরে সেটা খুলে ফেলে। আলোটা এখনও পড়েনি কফিনের ভিতরে। কিছু দেখা যায় না সেখানে।

মোবাইলটা তুলে ধরে কফিনের ভিতরে আলো ফেলে পায়েল। সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে ওঠে।

না। তার আন্দাজ মেলেনি। কফিনের ভিতরে শোয়ানো আছে একটা শেষ হয়ে প্রায় মিলিয়ে আসা ফুট চারেক হাড়ের কাঠামো।

যেহেতু সেটা কফিনের মধ্যে ছিল তাই মানুষ বলে ধরে নেওয়া যায় তাকে তবে আকৃতি দেখে এও বোঝা যায় সেটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের না। কোনো বাচ্চার। একটা খুলি, মাটিতে নুয়ে পড়া পাঁজরা আর হাঁটু অবধি পা

পায়েলের মাথার যন্ত্রণাটা এখন তীব্রভাবে বেড়ে উঠেছে। আর দূরে নয়, খুব কাছ থেকেই যেন কেউ ডাকছে তাকে। মসোলিয়ামের ভিতরের অন্ধকার চিরে ক্রমে ফুটে উঠছে একটা লাল আলো। মিলিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই।

কোমর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবার আগেই কফিনের ভিতরে আর একটা জিনিস চোখে পড়ে পায়েলের। তার মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে। প্রাণপণে শব্দ করে সুনন্দাকে ডাকতে চায় সে।

চিৎকারটা শুনেই সুনন্দার শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায়। সে প্রায় এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে এসে দাঁড়ায় ছোট ঘরটার ভিতরে।

পুতুলগুলো যেন ভয়ার্ত চোখে এখন চেয়ে আছে মাটির দিকে। সেদিকে তাকিয়েই পায়েলকে মেঝের উপরে পড়ে থাকতে দেখল সুনন্দা। সামনেই পড়ে থাকা কফিনটার ডালা খোলা। সুনন্দার নার্ভগুলো শিথিল হয়ে আসছিল। তাও কোনোরকমে কফিনের ভিতরে চোখ দেয় সে।

বাচ্চার দেহাবশেষটা চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে অন্য জিনিসটাও। নিচু হয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে সেটা তুলে নিয়ে আলোর কাছে ধরে সুনন্দা। একটা খাতা খুব সম্ভবত একটা ডায়েরি।

সাবধানে দু-একটা পাতা উলটেই বুঝতে পারে সুনন্দা। পুতুলের সঙ্গে সঙ্গে এটাকেও কবর দেওয়া হয়েছিল মৃত মেয়েটার সঙ্গে। তবে আলাদা করে নয়। কফিনের ভিতর, মালকিনের সঙ্গেই এলিজাবেথ মসগ্রুপের ডায়েরি।

1 Comment
Collapse Comments

Anish dev er “kichu megh,kichu kuasha” boi upload din pls.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *