তৃতীয় অধ্যায়
পুকুরের ধার দিয়ে অনেকক্ষণ পায়চারি করছিল পায়েল। মাঝে মাঝেই পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে নিচ্ছে। প্রায় সাড়ে ন’টা বেজেছে।
পুকুরের পাড়ে দাঁড়ালে ঝাঁকড়া গাছের মাথা থেকে পাতা উড়ে আসে গায়ে। পায়েলের সালওয়ারের উপরেও এসে পড়েছিল কয়েকটা। সেগুলোকে তুলে ফেলে দিল সে। কাঁধের ঝুলন্ত ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা রুমাল বের করে আনল। তারপর সেটা পাখার মতো নাড়তে লাগল মুখের সামনে। একটু ছায়ায় এসে দাঁড়াল।
পায়েলের চেহারাটা বেশ ধারালো। সবে চব্বিশে পা দিয়েছে। ছিপছিপে পাতলা গড়ন। সাধারণ মেয়েদের থেকে একটু বেশি লম্বা। গায়ের রং যতটা না ফর্সা তার থেকে বেশি রক্তাল্পতা আর লো ব্লাড প্রেশারে ভুগে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কাল রাতেই বোলপুর থেকে বর্ধমান হয়ে হুগলী ফিরেছে সে। রাতেই সুনন্দার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপটা সেরে এসেছে। আজ সকালে দু’জনের গ্রেভইয়ার্ড দেখতে যাবার কথা। কিন্তু সুনন্দা এখনও এসে পৌঁছায়নি।
খানিক পরে জমিদারবাড়ির সদর দরজায় দেখা গেল সুনন্দাকে। সেই সঙ্গে তুলিকেও। তার একটা হাত ধরে আছে সুনন্দা।
দূর থেকে পায়েলকে দেখতে পেয়ে একবার হাত তুলে ইশারা করল সে। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল সেই দিকে।
আজকের রোদটা বেশ চড়া। তাতে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ধরে যায়। শরীর শুকিয়ে আসে।
“অনেকক্ষণ এসেছ?” কাছে এসেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সুনন্দা।
“মিনিট দশেক হবে। হেঁটে যাবে?”
“এই রোদে! রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে তো…”
একটুখানি হাসল পায়েল। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বলল, “রানিমা কি কোলে বসতে রাজি হবেন?”
“একটুও না।” মাথা দুলিয়ে বলে তুলি।
“তাহলে বাঁদিক দিয়ে চল, ছায়া পড়ে আছে।”
রাস্তার বাঁদিকে সরে আসে তিনজনে। তারপর হাঁটতে থাকে। এখান থেকে গ্রেভইয়ার্ডটা বেশিদূরে না। মিনিট কুড়ি বড়জোর। তুলিকে একদম ধারে রাখে সুনন্দা। সে নিজে মাঝখানে আর পায়েল রাস্তা ঘেঁষে হাঁটতে থাকে।
“তুমি একা এলে! বাবা মা কেউ এলেন না!” সুনন্দা জিজ্ঞেস করে পায়েলের দিকে তাকিয়ে।
“বাবা আসতে চায় না খুব একটা এখানে। একটু পাঞ্জাবী পরা আঁতেল গোছের লোক। জমিদারি-টোমিদারি এড়িয়েই চলে। আর মায়ের একা এতদূর আসার ইচ্ছা নেই।”
“তোমার আগ্রহ আছে?”
পায়েল হাসে। হাসলে বেশ মিষ্টি দেখায় তাকে। সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো সরু ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একঝলক। তারপর বলে, “আমার সব পুরনো জিনিসপত্রতেই আগ্রহ। তবে এখানে আগে খুব একটা আসা হয়নি।
“কেন?”
“এসে কী করব? লোকজন যাদের চিনি তারা হয় আমার বাবার বয়সী নাহলে এতটাই গম্ভীর যে কথা বলতেও ভয় লাগে।”
‘তোমাকেও তো বেশ গম্ভীর মনে হয়। কাল তো তাই মনে হচ্ছিল।”
“আমাকে যা মনে হয় আমি আদৌ তা নই। ক’দিন যেতে দাও। বুঝবে।” অর্থপূর্ণ হাসি হেসে চুলে একটা ক্লিপ লাগায় পায়েল।
“আমি আইসক্রিম খাব।” রাস্তার ধারে একটা আইসক্রিমের গাড়ি দেখে আবদার করে তুলি। সুনন্দা তাকে আইসক্রিম কিনে দেয়। তারপর আবার হাঁটতে থাকে সামনে
কালকে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে তার। ব্যাপারটা নীলাদ্রিকেও ভাবিয়ে তুলেছে। এতক্ষণ ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ছটফট করছিল। এবার সে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “আমার যা মনে হয় তোমাদের বংশে কিছু একটা গোলমাল আছে।”
“গোলমাল বলতে?” পায়েল জিজ্ঞেস করে।
“মানে তোমাদের কোনো পূর্বপুরুষের অবর্তমানে শশিভূষণ সরকার বলে এক ভদ্রলোকের জমিদারির সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব পাবার কথা ছিল। ভদ্রলোক কাগজপত্র নিয়ে এসেওছিলেন কিন্তু তারপরেই কেউ খুন করে তাকে। “
পায়েল ব্যাপারটা একবার ভেবে নিয়ে বলে, “মানে বলছো যাতে তিনি দায়িত্ব না পান তার জন্যেই তাকে সরিয়ে দিয়েছে কেউ?”
“সেটা হতে পারে। তবে তার থেকেও বড় কথা হল সেই খুনটা হয়েছে ঠিক সেইভাবে যেভাবে এই বাড়ির শেষ খুনটা… আই মিন আত্মহত্যাটা হয়েছে।”
“কীভাবে?”
“বন্ধ ঘরের মধ্যে। মানে জানলা দরজা সব ভিতর থেকে ছিটকানি দিয়ে বন্ধ। সকালবেলা লোকে দরজা ভেঙে দেখে সিলিং থেকে ঝুলছে।”
“তাহলে খুন বলছ কী করে? আত্মহত্যাই তো মনে হচ্ছে।”
সুনন্দার বাঁকা কপালের রেখাগুলো এবার নরম হয়ে আসে, “আমি বলছি মানেই তো আর হয়ে যাবে না। তবে এখানে আসার পর থেকে মনটা সারাক্ষণ খারাপ হয়ে থাকে আমার।”
“কেন?”
“কি জানি, এতদিন আগে এত লোক এখানে থাকত। এখন তারা আর কেউ বেঁচে নেই। কত হাসিকান্না, মৃত্যু, হিংসা- প্রতিহিংসার ঝড় বয়ে গেছে। সেসব আজ আর কোথাও লেখা নেই।” কথাটা বলেই হাওয়ায় একবার হাত চালিয়ে সে বলল, “ছাড়ো এসব। বোলপুরে তুমি কী পড়ো বলতো?”
“ইংলিশ অনার্স।”
“তা কলকাতার বাড়ি ছেড়ে এতদূরে!”
“আর বলো কেন, সেই টুটাফুটা গল্প। বাবার ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। আমার কম্প্যারাটিভ লিটারেচার ভালো লাগত। তাই নিলাম একরকম জোর করেই। তারপর দেখলাম বাড়িতে থাকলে ওই এক জিনিস নিয়ে বক্বক্ শুনিয়ে মাথা হেজিয়ে দেবে। তাই ভাবলাম দূরে গিয়েই থাকি।”
“এখন হঠাৎ এলে যে…”
“কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিল একবার ঘুরে আসি। তাছাড়া…”
পায়েলের কথা শেষ হল না। দু’জনেই থেমে গেল। রাস্তাটা একটা বাঁক ঘোরার পরে অনেকটা খালি জায়গা দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে সোজা তাকালে একটা লোহার আর্চ চোখে পড়ে। তার ঠিক পাশেই বড়বড় হরফে লেখা— চকদীঘি ব্যাপটিস্ট চার্চ অ্যাণ্ড গ্রেভইয়ার্ড। লেখাটার গায়ে এখন লতাপাতা গজিয়েছে। সেই লতার ঝাক নেমে এসেছে দু’পাশের পাঁচিলের উপরে। এখানে এখনও যে ক’টি খ্রিস্টান পরিবার আছে তারাই যত্ন নেন চার্চটার। দু’জনে এগিয়ে গেল সেইদিকে।
গেটের মুখটায় একজন মাঝবয়সী লোক বসেছিলেন। ইনি সম্ভবত স্থানীয় লোক। চার্চের দেখাশোনা করেন। সুনন্দা একটু এগিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “একটু ভিতরে যাওয়া যাবে?”
“কোথা থেকে আসছেন আপনারা?” লোকটা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল!
“আমরা জমিদারবাড়িতে এসেছি। আর ও…“
“ওকে চিনি।” পায়েলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল লোকটা। পায়েল নিজেও অবাক হয়ে গেছিল। সে আগে কখনও গ্রেভইয়ার্ডে আসেনি! তাহলে লোকটা ওকে চিনল কী করে?
যাই হোক, লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে ভিতরটা দেখিয়ে দিল। ওরা দু’জনে ভিতরে ঢুকে এল।
গেট পেরিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চার্চের বড়সড় বিল্ডিংটা দেখা যায়। এখন তার উপরে দুপুরের রোদ এসে পড়েছে। লাল রঙের ক্যাথোলিক চার্চ। চূড়ার ঠিক নিচে একটা কাচের প্লেটে যিশুর প্রতিকৃতি। তার নিচে গোল, রোমান নিউমারে লেখা ঘড়ি। সামনে খানিকটা ঘাসের জমি। বড়সড় চেহারার দরজাটা খোলা। তার ভিতরে তাকালে প্রেয়ার রুমের কয়েকটা বেঞ্চ চোখে পড়ে। চার্চের পিছনের দিকে ছোটখাটো কয়েকটা স্তম্ভ। সেখান থেকেই গ্রেভইয়ার্ড শুরু।
চারপাশে তাকিয়ে আর কাউকে কিন্তু চোখে পড়ল না। ভিতরে হয়তো লোক থাকতে পারে। কিন্তু বাইরে থেকে তাদের দেখতে পাবার কথা নয়। দু’জনে চার্চটাকে পাশ কাটিয়ে সমাধিক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায়।
সমাধির দিকটায় গাছপালা একটু বেশি। বাইরে থেকে দেখলে পাতলা জঙ্গল বলে মনে হয়। মাটিতে শুকনো ডালপালা বিছিয়ে রয়েছে। ওদের পায়ের চাপে মড়মড় করে আওয়াজ উঠছে তাতে। ঠিক যেন মনে হয় পিছন পিছন হেঁটে আসছে কেউ। মাঝে মাঝে চমকে ফিরে তাকাচ্ছে দু’জনে।
কিছু সমাধির উপরে বেদি করা আছে। উঁচু বেদির সমস্ত গা জুড়ে শ্যাওলার ছোপ পড়েছে। কিছু জায়গায় আবার শ্বেতপাথরের গা খসে গিয়ে একটুখানি ফাঁক হয়ে আছে। তার ভিতরটা অন্ধকার। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় ভিতর থেকে কেউ চেয়ে আছে যেন।
দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকে দু’জনে। বিশেষ করে কিছু দেখার নেই। তবে সমাধির উপরে শ্বেতপাথরের ফলকে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্মতারিখ, কবে মারা গেছেন ও তার সম্পর্কে দু-একটা কথা খোদাই করা আছে ইংরাজিতে। সেগুলোর উপর চোখ রাখল ওরা। বেশিরভাগ ফলকই অস্পষ্ট। কয়েকটা আবার আশপাশের গাছের শিকড়ের জন্যে নিচের দিক থেকে ভাঙতে শুরু করেছে।
ফলকের উপর লেখা শালগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছিল পায়েল। এবার সে থেমে গেল, তারপর আসতে আসতে বলল, “একটা জিনিস লক্ষ্য করছি।”
“কী বলতো?” সুনন্দা তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“মোটামুটি সত্তর শতাংশ লোক এখানে সতেরোশো নব্বই থেকে আঠেরোশো পাঁচ— এই পনেরো বছরের মধ্যে মারা গেছে, এবং তাদের আবার সিংহভাগের বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে।”
“নতুন গরমের দেশে এসে ক্লাইমেটটা সহ্য করতে পারেনি। রোগটোগ হয়েছিল হয়তো।”
তুলির আইসক্রিম এতক্ষণে শেষ হয়েছে। সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সৌধগুলোর দিকে। এর আগে কোনো করবরস্থানে আসেনি সে। এতক্ষণে সুনন্দার হাত ছেড়ে সে পায়েলের দিকে সরে এসেছে।
আচমকা একটা এপিটাফ চোখে পড়তে থমকে গেল সুনন্দা। তারপর সেটার উপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, “দেখ, এখানে ওয়াও লেখা আছে। মানুষ মরে গেছে তাও এত খুশি হয়েছে কেন?”
পায়েল একবার সেদিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর বলল, “ওটা আসলে একটা এব্রিভিয়েশান। উডমেন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, একটা ইন্সিওরেন্স কোম্পানি কেউ মারা গেলে এরা সাধারণত মৃতের পরিবারকে মোটা টাকা দিয়ে সাহায্য করত। এমনকি এপিটাফটা পর্যন্ত এরা নিজেরা বানিয়ে দিত। শর্ত শুধু ওই একটাই। এপিটাফের উপরে ওদের লোগো খোদাই করতে দিতে হবে।”
“মজার ব্যাপার তো!” খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সুনন্দা, “এখানেও অ্যাডভেটাইজমেন্ট!
“হ্যাঁ, ইন্সিওরেন্সের বিজ্ঞাপন মরা লোকের থেকে ভালো আর কে করতে পারে?”
মূল রাস্তা ছেড়ে আর একটু ভিতরের দিকে ঢুকে আসে ওরা। এখানে আরও কিছু ছড়ানো ছিটানো বেদি চোখে পড়ছে। কোথাও বা বেশ বড়সড় বেদি বানিয়ে একটা গোটা পরিবারকে কবর দেওয়া হয়েছে। দুই ভাইয়ের কবর চোখে পড়ল। একজন মারা গেছে আঠেরোশো ছয়ে, আর একজন আঠেরোশো আটে।
পায়েল একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “দেখ, প্রথম কবরটা দেওয়ার সময় যেন লোকগুলো জানত পরের ভাইকেও কবর দিতে হবে। পাশে খানিকটা জায়গা ফাঁকা রেখেছিল।”
“আগে থেকে জানল কী করে?”
“হয়তো রোগে ভুগছিল।” ক্লান্ত গলায় জবাব দিল পায়েল।
এবারে একেবারের শেষের দিকে এসে পড়েছিল ওরা। এদিকটা প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। দু-একটা সমাধি এখানেও আছে বটে তবে গভীর গাছপালা এসে ঢেকে দিয়েছে তাদেরকে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একটা মসোলিয়াম। অর্থাৎ ছোট্ট ঘর। বাইরে থেকে লোহার চেন দিয়ে তালা লাগানো আছে।
“এটা কী বলতো?” কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল সুনন্দা।
“মৃতের ঘর বলতে পারো। যদি ভিতরে সমাধি থাকে তাহলে বলা হবে মসোলিয়াম আর মৃতদেহ ছাড়া শুধু স্মৃতির উদ্দেশ্যে যদি হয় তাহলে সেনোটাফ। তবে আয়তন দেখে তো মসোলিয়ামই মনে হচ্ছে। এসো তো দেখি।”
ঘরগুলো দেখে বেশ আগ্রহ পেয়েছিল তুলি। সে হাত ছাড়িয়ে ইচ্ছামতো এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে। একটা মাঝারি সাইজের মসোলিয়ামে চোখে আটকেছে তার।
দু’জনে ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে যায় শ্বেতপাথরের উপর সিমেন্টের আবরণ দেওয়া ঘরটার দিকে। তুলি যেদিকে গেছে সেখানে একটা সমাধিকক্ষ দেখা যাচ্ছে। আয়তনে প্রায় একটা কুঁড়েঘরের মতো হবে। তবে দরজাটা বেশ জমাকালো। বাইরে স্বাভাবিকের থেকে বেশ বড় এপিটাফে কিছু একটা খোদাই করা ছিল। আপাতত তার বেশিরভাগটাই ভেঙে পড়ে বেশ খানিকটা ইটের গাঁথনি বেরিয়ে পড়েছে।
কাছে গিয়ে ভালো করে সেটার উপরে চোখে রেখে, হাত দিয়ে খানিকটা শ্যাওলা সরিয়ে পায়েল বলল, “একটা নাম দেখা যাচ্ছে, মসক্রপ। তবে সেটা মনে হয় ফ্যামিলি নেম। মসোলিয়ামের ভিতরে এক পরিবারের সবাইকে সমাধি দেওয়া হত। তবে…”
“তবে কী?” মনের ইচ্ছা সত্বেও সামনে এগোতে পারে না সুনন্দা। তুলির হাতটা ধরা আছে তার হাতে। মেয়েটাকে নিয়ে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। জায়গাটা বেশ ভাঙাচোরা। ঝোপঝাড়ের আড়ালে সাপখোপ থাকতে পারে।
“চিহ্নগুলো একটু গোলমেলে লাগছে।”
“কীসের চিহ্ন?”
“জেনারেলি এইসব সমাধির গায়ে কিছু চিহ্ন আঁকা হয়। সমাধির ভিতরে যে বা যারা শুয়ে আছে তাদের সম্পর্কে কিছু বোঝানোর জন্যে। যেমন মিলিটারি বা আর্মির কেউ মারা গেলে তার কবরে ঈগল আঁকা হত। কোনো শিশু মারা গেলে আঁকা হত ভেড়া। এখানে যেটা আঁকা আছে তার মানে আমি জানি না। “
“কী আঁকা আছে।”
“একটা গোলের ভিতরে ছোট একটা চেয়ার। তাছাড়া একটা পদ্ম। এটার মানেটা জানতাম। সম্ভবত মহাকাশ… তবে এটুকু বুঝছি এগুলো আঁকা হয়েছে আগেরগুলোর থেকে বেশ দেরিতে।”
সুনন্দা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তার হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল তুলি। দৌড়ে তাকে ধরতে গেল সুনন্দা কিন্তু পারল না। প্ৰায় লাফাতে লাফাতে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে মসোলিয়ামের সামনে এসে দাঁড়াল। জায়গাটা দেখে ভারি অবাক হয়েছে সে। ছোট ছোট হাতগুলো একবার রাখল সিমেন্টের উপরে। তারপর দৌড়ে চলে গেল পিছনে। যেন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল গোটা সৌধটা।
এতক্ষণে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সুনন্দা। প্রথমেই লোহার চেনগুলো চোখে পড়ল। চেন দুটো যেখানে এসে মিলেছে সেখানে এখন একটা মোটাসোটা তালা ঝুলছে। একবার দেখেই বোঝা যায় বহুবছর খোলা হয়নি সেটা। দরজাটাও সিমেন্টের। তালাটা খোলা থাকলেও দরজাটা টেনে খোলা খুব একটা সহজ হবে না।
“তুলি… পিছনে যেও না… এসো এদিকে।” গলা তুলে ডেকে উঠল সুনন্দা। ওদিক থেকে কোনো সাড়া এল না। সুনন্দা তাকে ডাকতে যাচ্ছিল এমন সময় কবজিতে টান পড়তে থেমে গেল সে।
পায়েল একহাতে টেনে ধরেছে তার হাতটা। ফিসফিসে গলায় বলল, “একটা মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে। চেয়ারটার মানে এবার বুঝতে পারছি।”
পায়েলের দৃষ্টি লক্ষ্য করে পাথরের ফলকের দিকে তাকিয়ে সুনন্দা দেখল হাত দিয়ে আরও খানিকটা শ্যাওলা সরাতে ফলকের আর একটু বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। তার উপরে কিছু একটা লেখা আছে। একটা নাম– এলিজাবেথ এম মসক্রপ। তার পাশেই জন্ম আর মৃত্যুর তারিখ–১৭৯৯-১৮০৪।
“মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা গেছে।” বিড়বিড় করে বলল সুনন্দা।
ফলকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সুনন্দার দিকে তাকাল পায়েল। একটা মিহি হাসি খেলে গেল তার মুখে। গলাটা নিচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “একবার ডেকে দেখবে নাকি? সাড়া দেয় কিনা?”
“মানে?” অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।
“মানে ধর এই সিমেন্টের নিচেই সে শুয়ে আছে। ডেকে দেখব? ওপাশ থেকে কেউ সাড়া দেয় কিনা?”
“তুমি পাগল হয়েছ?”
সুনন্দার কথায় কান দেয় না পায়েল। সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মসোলিয়ামের সামনে। সিমেন্টের উপরে দুটো হাত রাখে। তারপর মাথাটা পিছনের দিকে ফিরিয়ে বলে, “কেমন দেখতে ছিল বলতো? ধর গায়ের রং ফর্সা। টুকটুকে লাল ঠোঁট। সোনালি চুল। হাইট… আমি এভাবে হাঁটু গেড়ে থাকলে তার মুখটা আমার মুখের সামনে থাকবে…”
“পাগলামি ছাড়ো পায়েল। কেউ দেখলে কি ভাববে?”
“বেথ… বেথ শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?” সিমেন্টের সৌধের একদম কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কথাগুলো বলে পায়েল। পুরনো সিমেন্টের খসা ধুলোয় তার হাতের উপরটা ভরে গেছে। ঝুঁকে থাকা গাছের থেকে টুপটাপ পাতা খসে পড়ছে চারিদিকে। একটু আগে কাছেই কোথাও একটা দাঁড়কাক ডাকছিল। এখন সে চুপ করে আছে।
পায়েলকে ডাকতে গিয়ে আচমকা একটা ধাক্কা লাগল সুনন্দার। মনে হল আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে ফিরে গেলে এই গ্রেভইয়ার্ডটাকে একদম অন্যরকম দেখাত। অনেকগুলো সৌধ হয়নি তখনও। চারপাশটা আর একটু ফাঁকা। গাছগুলো গজিয়ে ওঠেনি। এই ফলকটা সদ্য খোদাই করা হয়েছে। ফলকের সামনে বসে কাঁদছেন এক মহিলা। সদ্য মেয়ে মারা গেছে তার। এবার ফলকের উপর নাম খোদাই করা হচ্ছে, ঠং ঠং ঠং সাদা পাথরের উপরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হাতুড়ির আওয়াজ।
কতগুলো লোক মিলে ছোট স্ট্রেচারে করে নিয়ে এল একটা সাদা পাশবালিশের মতো কাপড়ে জড়ানো মৃতদেহ। কীভাবে মারা গেল সে? এইটুকু বয়সে? মারা যাওয়ার আগে কী ভাবছিল?
“বেথ…” পায়েলের কণ্ঠস্বর এখনও শোনা যাচ্ছে। আকুল কণ্ঠে ডেকে চলেছে সে। যেন সত্যি আর একটু পরেই কিছু একটা শোনা যাবে। একটা হাসির আওয়াজ… অথবা কান্না… অথবা…
হাওয়া দিতে শুরু করেছে জোরে। লম্বা খয়েরি গাছগুলো আর একটু জোরে মাথা দোলাচ্ছে এখন। আর একটু বেশি করে পাতা পড়ছে। কাকটা আবার ডাকতে শুরু করেছে। আগের মতো নয়। খানিকটা অন্য সুরে। শুধু ডাক নয়, এবার যেন দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলতে চাইছে সে।
খিল্ খিল্ করে একটা হাসির আওয়াজ। ভিতর থেকে না। ওপাশ থেকে শোনা গেছে। পিছিয়ে এল সুনন্দা। মসোলিয়ামের পিছন থেকে হাসছে তুলি। মাটি থেকে উঠে পড়ে দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সুনন্দা। আর গিয়েই সে থমকে গেল। সিমেন্টের গায়ে কান রেখে দাঁড়িয়ে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে তুলি। তার মুখে হাসির চিহ্ন নেই। একটু আগে হাসছিল হয়তো। সুনন্দা উঠে পিছনে আসতে আসতে সে থেমে গেছে।
“নিষেধ করলে শোন না কেন বলতো?” কড়া গলায় ধমক দিল সুনন্দা। তুলি মুখ তুলে তাকাল না। শুধু ঠোঁটের উপরে আঙুল রেখে চুপ করতে বলল সুনন্দাকে। দেওয়ালের ভিতরের কিছু যেন মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে সে।
“ওখানে কান দিয়ে আছ এবার কানের ভিতরে পোকা ঢুকে যাবে।” দ্রুত মেয়েটার দিকে এগিয়ে এল সুনন্দা, “সরে এসো।”
“কেউ কথা বলছে।” নিচু স্বরে বলল তুলি।
“অনেক হয়েছে। চলে এসো এবার।” তুলির হাত ধরে টানল সুনন্দা।
“কান রাখো। শুনতে পাবে।” তুলির মিহি গলায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সে ইয়ার্কি করছে না। মিথ্যে বলছে না। কিছু একটা ছিল তার মুখের ভয়ার্ত রেখাগুলোতে, সুনন্দা রেগে গেলেও উপেক্ষা করতে পারল না। সিমেন্টের গা থেকে ধুলো সরিয়ে একটু মসৃণ করে তার উপরে সাবধানে কান রাখল সে নিজে।
শনশন করে ভিতরের হাওয়ার আওয়াজ। দু’হাতে কান চেপে ধরলে যেমন শব্দ হয়। অনেকটা সেইরকম। আর কিছুতো…
মুহূর্তে সুনন্দার বুকের ভিতর হিমেল স্রোত বইতে থাকে। সেই শনশন্ হাওয়ার শব্দের ভিতরে আরও একটা ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যেন মাটির গভীরতম অংশ থেকে অস্পষ্ট কতগুলো শব্দ ভেসে আসছে। প্রায় শোনা যায় না, তাও এটুকু বোঝা যায় সেটা মানুষের গলার আওয়াজ। বাতাসের শব্দ নয় তুলির একটা হাত এতক্ষণ ধরা ছিল তার হাতে। এবার সেটা খসে পড়ল। মুখ থেকে আতঙ্কের মৃদু একটা শব্দ বেরিয়ে এল। কান সরিয়ে নিল সে।
পায়েল এসে দাঁড়িয়েছিল তুলির পাশে। সুনন্দা তাকে বলতে যাচ্ছিল কথাটা, পায়েল তার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলল, “জানি। আমিও শুনেছি।”
“আপনারা কি কিছু খুঁজছেন?” একটু দূর থেকে ভেসে আসা প্রশ্নটা শুনে ফিরে তাকাল দু’জনে। খানিকদূরে যেখানে সমাধিক্ষেত্রের সীমানাটা শেষ হচ্ছে সেখানে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছেন। উপর থেকে নিচ অবধি একটা সাদা আলখাল্লা। জামাকাপড় দেখে বোঝা যায় ইনিই সম্ভবত চার্চের ফাদার। তবে বয়স বছর তিরিশেকের বেশি হবে না। ভুরু কুঁচকে তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল সুনন্দা। তারা যে কাজটা করছিল সেটা অপরাধ কিছু না হলেও মোটেই অভিপ্রেত নয়। সে হাত দিয়ে একবার মুখ মুছে উঠে পাড়িয়ে বলল, “আসলে একটু কৌতূহল হল আর কি….”
ফাদার কিন্তু রাগলেন না। বরঞ্চ মুখটা নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “চলে আসুন।”
তুলির হাত ধরে বেরিয়ে এল সুনন্দা। পায়েল তাদের পিছনে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে জল বের করে একবার খেল সে। থাই-এর কাছে থাবড়ে হাতের ধুলোটা ঝেড়ে নিল।
“নতুন এসেছেন এখানে?” মিহি গলায় জিজ্ঞেস করলেন ফাদার।
“হ্যাঁ। রাজবাড়িতে আছি।”
“ওঃ।” আর কিছু না বলে পিছন ফিরে হাঁটতে লাগলেন ফাদার। কিছু বুঝতে না পেরে তাকে অনুসরণ করল বাকি তিনজন। এখান থেকে চাৰ্চটা সামনেই। নিজেদের মধ্যে আর কোনো কথা হল না। চার্চের সামনে এসে একবার ওদের দিকে তাকালেন ফাদার। তারপর চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, “চলুন, ভিতরে গিয়ে বসি। তারপর কথা হবে।”
কথা যে কি তা পায়েল ভেবে পেল না। লোকটার এতক্ষণে অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা। দু’কথা শুনিয়ে দিলেও প্রতিবাদ করার কিছু নেই।
প্রার্থনা ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে শরীরটা বেশ ঠান্ডা লাগল ওদের। এতক্ষণের জমাট গরমটা এখানে নেই। চারদিকে পাথরের উঁচু দেওয়াল হলঘর জুড়ে লম্বা লম্বা বেঞ্চ পাতা আছে। একদম সামনে ছোট একটা বেদি। তার অনেকটা উপরে ক্রস থেকে যিশু ঝুলছেন। তিনতলার সমান উঁচু সিলিং জুড়ে অনেকগুলো পেন্টিং লাগানো। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাটাও ঠান্ডা হয়ে এল পায়েলের। সে বেঞ্চের একপাশে বসেছে। মাঝে তুলি তার পাশে সুনন্দা উলটোদিকের বেঞ্চটায় এসে বসলেন ফাদার। একটা হাত তুলির মাথায় রেখে অল্প হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কী তোমার?”
“ঋত্বিকা নাথ।”
“বেশ। আর এই দু’জন?”
প্রথমে পায়েলের দিকে তাকাল তুলি, “এটা আমার দিদি…” সুনন্দার দিকে তাকিয়ে এক সেকেণ্ড কি যেন ভেবে নিল সে, “এটাও আমার দিদি।”
তুলির দিক থেকে চোখ সরিয়ে সুনন্দার দিকে তাকালেন ফাদার, “এবার বলুন, কী জানতে চান আপনারা।”
পায়েল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সুনন্দা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আসলে ওই মেয়েটা এত কম বয়সে মারা গেছে। ঠিক কী হয়েছিল জানতে ইচ্ছা করছিল।”
এতক্ষণে একটা খোলা হাসি ফুটে উঠল ফাদারের মুখে, “ওঃ, এই কথা তা এখন আর কেউ বলতে পারে না। একটা সময় হয়তো কিছু রেকর্ড রাখা হত। আমার দাদুর আমল থেকেই তার আর পাত্তা নেই।”
“আচ্ছা গেটের বাইরে যিনি ছিলেন তিনি আমাকে চিনলেন কেমন করে বলুন তো? আমি তো আগে আসিনি এখানে।” পায়েল জিজ্ঞেস করে।
“আপনি কি জমিদারবাড়ির এন্সেস্টারদের কেউ?”
অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়ে পায়েল, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনিও…”
আবার সেই নরম হাসিটা ছড়িয়ে যায় ফাদারের মুখে, “আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন হলেন সহদেব দত্তের বোন লীলাবতী। তিনি একসময় প্রচুর টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন চার্চকে। প্রতিদানস্বরূপ চার্চের পক্ষ থেকে কাউকে দিয়ে তার একটা প্রতিকৃতি এঁকে উপহার দেওয়া হয়। কিন্তু কেন জানি না সেটা নিতে চাননি তিনি। ফলে চার্চের জিম্মাতেই এখনও পড়ে আছে সেই প্রতিকৃতি। আমরা মাঝে মধ্যে পরিষ্কার করাই সেটা, সংরক্ষণ করি। তো আপনাকে অবিকল সেই লীলাবতী দেবীর মতো দেখতে।”
“উনি আমার ঠাকুমার ঠাকুমার ঠাকুমা সম্ভবত।”
“ব্যাস। তাহলে মিলে গেল হিসেব।” বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলেন ফাদার।
“একবার সেটা দেখাবেন আমাকে? মানে…”
“মানে কৌতূহল হচ্ছে, তাই তো?”
মাথা নাড়ল পায়েল। ফাদার তুলির গালটা একবার টিপে দিয়ে উঠে পড়ে বললেন, “আসুন আমার সঙ্গে।” তারপর প্রেয়ার রুমটা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন দোতলার সিঁড়িটার দিকে।
পায়েল তুলির কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “এতক্ষণ আমরা যে জায়গাটায় ছিলাম তাকে বলে নেভ। আর ঢোকার মুখে যে ফাঁকা জায়গাটা ছিল তাকে বলে নারথাক্স। মনে থাকবে?”
তুলি মাথা নেড়ে বলল, “ওখানে কী হয়?”
“চার্চে ঢোকার আগে একজন আরেকজনের সঙ্গে গল্প করে ওখানে দাড়িয়ে। আর ওইখানটা দেখছ, একটা ছোট ঘর।”
তুলি মুখ তুলে দেখে। যিশুর ক্রস যেখানে আছে সেখান থেকে একটু দূরে একটা পোডিয়াম। পোডিয়ামের পাশেই একটা পিয়ানো রাখা আছে। তার পিছনে একটা ছোট ঘর চোখে পড়ছে। যদিও মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে ঘরটা।
“ওটাকে বলে স্যংচুয়ারি।”
“ওখানে কী হয়?”
“পরে বলব। এখন এসো।”
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে চারজনে। উঠেই দু’দিকে দু’টো ছোট ছোট স্টোররুম। চার্চের পুরানো জিনিসপত্র এখানেই সংরক্ষণ করা হয়। চাবি দিয়ে প্রথম স্টোররুমের দরজাটা খুলে ফেললেন ফাদার।
নানারকম পুরনো জিনিসে ভর্তি হয়ে আছে ঘরটা। কোনো জানালা নেই ফলে দরজা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল সবার।
ঘরের ভিতরে ঢুকে এলেন ফাদার। সামনে কয়েকটা কাঠের লগ পড়েছিল। সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে ফেললেন। একটা চ্যালিশ, গোটা কতক পুরনো উইতে খাওয়া বই সরিয়ে কাপড়ে ঢাকা বড়সড় কিছু একটা বের করে আনলেন। পাশেই ঝুলতে থাকা একটা কাপড় দিয়ে ধুলো ঝেড়ে নিলেন। সুনন্দা বিড়বিড় করে বলল, “বেশ সংরক্ষণ করে দেখছি।”
পায়েল কিছু বলল না। কোনো একটা কারণে তার ভুরু দুটো আশ্চর্যরকম কুঁচকে গেছে। এক মনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে। উত্তর পাচ্ছে না। কাপড়টা সরিয়ে ভিতরের ফ্রেমটা বের করে আনলেন ফাদার। এখানে আলো খানিকটা কম। ছবিটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। প্যাসেজের কাছে বড় জানালা দিয়ে রোদের ফালি আসছে। কয়েকপা এগিয়ে সেদিকটায় চলে এলেন তিনি। তারপর একটা স্ট্যান্ড টেনে এনে তার উপরে রাখলেন ছবিটা।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল ওরা দু’জনে। যেন কেউ রংতুলিতে পায়েলকে আঁকার চেষ্টা করেছে। একই চোখ, নাক, এমনকি মাথার চুলটা পর্যন্ত একইভাবে আঁচড়ানো। শুধু চেহারায় ছবির মানুষটা একটু স্থূল। একটা ছোট টেবিলের উপরে হাত রেখে বসে আছেন বছর বাইশেকের এক মহিলা। একটু এগিয়ে গিয়ে ছবিটা ভালো করে দেখে পায়েল। গোটা ছবিটা জুড়ে কি যেন খুঁজতে থাকে সে। বিড়বিড় করে বলে, “টেবিলটা বেশ উঁচু… মহিলার হাত রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। কিছু একটা গণ্ডগোল আছে ছবিটায় সুনন্দাদি…
সুনন্দা হাঁ করে তাকিয়েছিল সেদিকে। পায়েলের কপালের ভাঁজটা এখন আরও একটু গভীর হয়ে উঠেছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ছবিটার কাছে। হাঁটু গেড়ে সেটার সামনে বসে পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু যেন দেখার চেষ্টা করল। ছবি নয় যেন আয়না। পায়েলের মুখেরই ছায়া পড়েছে।
কয়েক মিনিট পরে উঠে এল পায়েল। এতক্ষণে ছায়ায় ঢেকে গেছে তার মুখ। সুনন্দা অবাক গলায় প্রশ্ন করল, “তোমার কী হয়েছে বলতো? এটা দেখে তো খুশি হওয়ার কথা।”
মাথা নাড়ে পায়েল। একবার আড় চোখে ফাদারের দিকে দেখে নেয় সে। বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
“আমি বুঝতে পারছি কেন লীলাবতী দত্ত ছবিটা নেননি।”
“সেকি! দেখেই বুঝতে পারছ! কেন?”
“কারণ ছবিটা তার নয়।”
“তাহলে কার?”
“এলিজাবেথ মসক্রপ…” বিড়বিড় করে বলে ওঠে পায়েল।