তার চোখের তারায় – ২

দ্বিতীয় অধ্যায়

ট্রেনটা ক্ষেপে উঠেছে আজ। বারবার ভয়ানকভাবে দুলে উঠছে। সুরেনবাবু একবার চোখ খুলে পাশের সিটে বসে থাকা অনিলাদেবীর দিকে তাকালেন। তিনিও ঢুলছেন। সামনের সিটে একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে, মুখ নামিয়ে কিছু একটা বই পড়ছে সে, নামটা চোখে পড়ল না সুরেনবাবুর। গলার দু’পাশ থেকে নেমে আসা একটা সোনালি চেন বুকের উপর লাফিয়ে খেলা করছে ট্রেনের দুলুনিতে। তার পাশে দু’জন প্রৌঢ়। জানালা দিয়ে বাইরের ছুটন্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

সুরেনবাবু সব দেখে চোখ বুজতে যাবেন এমন সময় আবার প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে উঠল ট্রেনটা। তিনি নিজে কোনোরকমে সামলে নিলেন কিন্তু অনিলাদেবী সিট ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়লেন সামনে। আর একটু হলেই মাথাটা ঠুকে যাচ্ছিল সামনের ফাঁকা সিটে কিন্তু সেটা ঘটার আগেই সামনের সিটের সেই পড়ুয়া মেয়েটা হাত বাড়িয়ে তার কাঁধের কাছটা ধরে নিয়েছে একটুর জন্যে রেহাই পেলেন অনিলাদেবী।

“লাগেনি তো মাসিমা?” মেয়েটা অনিলাদেবীর মাথাটা ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“একটু ব্যালেন্স রাখতে পারো না? আশ্চর্য মানুষ বটে তুমি!” সুরেনবার স্ত্রীকে বেশ জোর গলায় ধমক দিলেন, “সামলাতে না পারলে ট্রেনে ওঠে; কেন?”

“আহা, ওঁর তো বয়স হয়েছে। লেগেছে কিনা দেখুন আগে।” মেয়েটা অনিলাদেবীর পিঠে একটা হাত রেখে তার মুখটা দেখার চেষ্টা করল।

“সত্যিই তো, আপনি অত রেগে যাচ্ছেন কেন?” পাশ থেকে এক প্রৌঢ় সমর্থন করলেন।

মেয়েটার থাইয়ের উপরে দুটো হাত রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সিটে বসে পড়লেন অনিলাদেবী, তারপর মিনমিনে গলায় বললেন, “আসলে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হাওড়া আর কতদূর?”

“সে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি।” ঘড়ি দেখে কথাটা বলে সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন সুরেনবাবু। মেয়েটার বয়স তার নিজের মেয়ের মতোই। ফ্যাকাসে ফর্সা রং, চোখ দুটো ভারি উজ্জ্বল। গায়ে একটা খয়েরি রঙের সালওয়ার, তার নিচে ডেনিম জিনস। পিঠের মাঝখান অবধি চুল একটা মাত্র ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। এক কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। জামাকাপড় আর হাবভাব দেখে সুরেনবাবুর মনে হল মেয়েটা সম্ভবত বোলপুর স্টেশান থেকে উঠেছে।

“কদ্দুর যাবে তুমি?” নরম গলায় তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অনিলাদেবী।

“এইতো, বর্ধমান নেমে যাব।” মেয়েটা বই থেকে মুখ তুলল। এর ফাঁকে সুরেনবাবু দেখে নিয়েছেন মেয়েটা বাইবেল পড়ছে। আশ্চর্য! এতক্ষণ তো তিনি গল্পের বই ভেবেছিলেন। একটা বছর বাইশের মেয়ে ট্রেনে যেতে যেতে বাইবেল পড়ছে কেন খামোখা?

“কলেজে পড়ো ওখানে?” আবার প্রশ্ন করেছেন অনিলাদেবী। মেয়েটা এবার মুখ তুলে বইটা রেখে দিল পাশে। হাসি মুখে বলল, “নাঃ, আমার এন্সেস্ট্রাল হোম আছে ওখানে, আমি মাঝে সাঝে যাই।”

“হ্যাঁ, এখনকার ছেলেমেয়েদের আর দেশের বাড়ির টান নেই…” হাসতে হাসতেই কথাটা বললেন সুরেনবাবু।

“আমার দেশের বাড়িটা ঠিক সুবিধের নয় স্যার, মা খুব একটা ঘেঁষতে দেয় না ওখানে।“

“সুবিধের নয় কীরকম?”

একটা বাঁকা হাসি হেসে মেয়েটা বলে “সেখানে নাকি এখনও রাতবিরেতে কাকে যেন দেখা যায়। খুনটুনও হয়েছে কয়েকটা।”

কথাটা শুনে হেসে ওঠেন সুরেনবাবু, “ভূতুড়ে ব্যাপার?”

“তাই বলতে পারেন।” লাজুক হাসে মেয়েটা।

“দেখার চেষ্টা করেছি কয়েকবার। তিনি দেখা দেননি। ভূতপ্রেত কিনা জানি না। তবে কিছু একটা ব্যাপার আছে বাড়িটায়। এতদিনের পুরনো বাড়ি তো। একটু গা ছমছম করবেই। আমি এখনও গেলেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই।”

“পুরনো ইতিহাসের দিকে আগ্রহ আছে তার মানে। তা হঠাৎ বাইবেল পড়ছিলে কেন বলতো?” মনের ভিতরে খচখচ্ করতে থাকা প্রশ্নটা করে ফেললেন সুরেনবাবু, “মানে… আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো ধর্মের দিকে অতটা..”

“ওই যে ইতিহাসের উপরে আগ্রহ…”

“তাহলে তো ইতিহাস বই পড়ার কথা।” মজার ছলে কথাটা বললেন সুরেনবাবু।

বাইরে থেকে ভিতরে মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটা বলল, “উঁহু… আমার তো মনে হয় ইতিহাস বইতে শুধু সেটা লেখা হয় যেটা হোমরা-চোমড়ারা মিলে লেখা যায় বলে ঠিক করেন। আসল খাঁটি ইতিহাস আপনি এই থিওলজির ছাড়া আর কোথাও পাবেন না। এই যেমন ধরুন জেনেসিস, বাইবেলের প্রথম অধ্যায়…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি… সেই অ্যাডাম আর ইভ… যারা একটা ফল খেয়েছিল বলে ভগবান তাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন…”

“উঁহু… ওটা ভুল ধারণা।” মুখ বাড়িয়ে মেয়েটা আবার জানলার বাইরে কিছু দেখার চেষ্টা করে, “ফল খাওয়ার জন্যে অ্যাডামকে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেননি ভগবান। দিয়েছিলেন অন্য কারণে।”

“সেকি! আমি তো তাই জানতাম। যাই হোক, কী কারণে?” খোশ গল্পের মেজাজ জেগে ওঠে সুরেনবাবুর।

পাশ থেকে বাইবেলটা তুলে নিয়ে একটা বিশেষ পাতা খুলে এগিয়ে দেয় মেয়েটা, “এই যে এইখানটা দেখুন… যে ফলের কথা আপনি বলেছেন তার ঠিক পরেই ভগবানের উক্তি…”

পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে গলিয়ে নেন সুরেনবাবু, জায়গাটা মন দিয়ে পড়তে থাকেন,

Genesis 3-22 And the LORD God said- ‘The man has now become like one of us- knowing good and evil. He must not be allowed to reach out his hand and take also from the tree of life and eat- and live forever.’

Genesis 3-23 So the LORD God banished him from the Garden of Eden to work the ground from which he had been taken.

চশমা খুলতে খুলতে সুরেনবাবু বললেন, “মানে বলছ নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর অ্যাডাম যে জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়েই সে অন্য একটি বিশেষ গাছের ফল খাবে— এই ভয়েই ঈশ্বর তাকে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন?”

“আর সেই গাছের ফল খেলে একটা বিশেষ ক্ষমতা লাভ করবে অ্যাডাম, সেটা লক্ষ করেছেন?”

“হ্যাঁ, অমরত্ব।” বিড়বিড় করেন তিনি।

“এবার ওর পরের জায়গাটা দেখুন…”

আবার বইতে মন দেন সুরেনবাবু,

After he drove the man out- he placed on the east side of the Garden of Eden cherubim and a flaming sword flashing back and forth to guard the way to the tree of life.

“অর্থাৎ ঈশ্বর সেই ট্রী অফ লাইফের সামনে চেরুবিম রাখলেন এবং একটি জ্বলন্ত তরোয়াল স্থাপন করলেন যেটি ক্রমাগত সামনে পিছনে দুলে চলেছে। চেরুব হলো সিংহ বা মানুষের মতো দেখতে একধরনের জীব, চেরুবিম তার প্লুরাল। এবার ভেবে দেখুন একটা গাছকে গোল করে ঘিরে ধরেছে কিছু সিংহ বা মানুষ, তাদের মাঝে একটা দুলন্ত আগুনের তলোয়ার। তারা রক্ষা করছে মানুষের অমর হওয়ার ফলকে।

আজ থেকে দেড় কি দু’হাজার বছর আগের মানুষকে যেন প্রকারান্তরে কেউ বলতে চাইছে যে দুটো জিনিস পাপ, কিন্তু ইনেভিটেবল। করলে পাপ হবে, কিন্তু করতেই হবে। প্রথমটা সেক্স, দ্বিতীয়টা ইম্মরটালিটি। এই দুটোর ক্ষেত্রেই ঈশ্বর চোখ বুজে নেন। একটু ডিপ্লোম্যাটিক পোজিশান মেন্টেন করেন।”

“তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?” সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করেন তিনি।

এবার একটু চাপা গলায় মেয়েটা বলে, “আমি বলছি না, আধুনিক ইতিহাসবিদরা বলেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলো আসলে ছিল সেকালের রাজাদের নিজের পাপকে স্খলন করিয়ে নেওয়ার একটা উপায়। রাজা অমুক পাপটি করেছেন কিন্তু ধর্মগ্রন্থ বলছে ওটি পাপ নয়। ফলে জনতাও রাজাকে মাফ করে দেবে। এখন কথা হচ্ছে অমরত্বের অন্বেষণকে পাপ পুণ্যের মাঝে এমন কমপ্লিকেটেড পজিশানে রেখে দিয়ে রাজা বা রাজপরিবার কোন পাপ স্খলন করতে চাইছিলেন বলুন তো?”

“মানে বলছ সেকালের রাজারা…” সুরেনবাবুর কথা শেষ হল না। জানালা দিয়ে কি যেন খেয়াল করে মেয়েটা বলে, “বর্ধমান ঢুকবে মনে হয়। উঠতে হবে আমাকে।”

সুরেনবাবু ঘাড় নাড়লেন। মেয়েটার চোখে মুখে একটা আলগা ঝকঝকে ভাব আছে। তবে সেটা ভালো করে লক্ষ না করলে ঠিক কোথা থেকে আসছে বোঝা যায় না। বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে চারপাশটা দেখে উঠে পড়ে মেয়েটা। তারপর আইল ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে। সুরেনবাবু তাকে এগিয়ে দিতে গেটের কাছে এসে দাঁড়ান।

দরজার একটু বেশি কাছে এগিয়ে গেছে মেয়েটা। অন্ধকারের বুক চিরে হাওয়ার ঝাপটা এসে তার চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। ক্লিপটা এখন খুলে ফেলেছে সে।

বর্ধমান আসতে এখনও মিনিট দশেক দেরি আছে। মেয়েটা সম্ভবত একটু হাওয়া খাওয়ার জন্যেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ট্রেনের দরজার পিছনে রাখা আয়নাটায় মুখ দেখতে দেখতে সে আচমকাই বলে, “রোগটার কোনো চিকিৎসা করিয়েছেন? “

“কোন্ রোগ?” অবাক চোখে তাকান সুরেনবাবু।

“ক্লেপ্টোম্যানিয়া” মুখে জল দিতে দিতে বলে মেয়েটা, “ট্রেনে ওঠার সময় আমার গলায় একটা চেন ছিল। এখন সেটা নেই। আপনি তখন আপনার স্ত্রীয়ের উপরে অতটা ক্ষেপে গেছিলেন কেন এবার বুঝতে পারছি।”

সুরেনবাবুর মাথা বুকের উপর ঝুঁকে এল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তিনি বললেন, “আপনি এক সেকেণ্ড দাঁড়ান, আসলে এতগুলো লোকের সামনে…”

“দরকার নেই” হাসিমুখে তাকে থামিয়ে দেয় মেয়েটা, “all that glitters is not gold। ট্রেনে ওঠার আগে চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। আপনার স্ত্রীয়ের সম্মানের দাম তার থেকে বেশি। তবে ভালো করে ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন। লজ্জার কিছু নেই।”

মেয়েটার মাথায় একটা হাত রাখলেন সুরেনবাবু। বুকের ভিতর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে তার।

ট্রেনটা ঢুকে পড়েছে বর্ধমান স্টেশনে। অন্ধকার স্টেশনের বুক ছোট স্টল আর সাদা আলোর ছটায় ভরে আছে। কাঁধের ব্যাগটা ভালো করে চাপিয়ে হাতের ব্যাগটা মাটিতে রেখে নেমে দাঁড়ালো মেয়েটা। সুরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি হাসল। কী মনে পড়তে তিনি গলা তুলে বললেন, “এই দেখ, এতক্ষণ কথা হল, তোমার নামটাই জানা হল না।”

“পায়েল… পায়েল রায়চৌধুরী।” নামটা বলে আর একবার হেসে দ্রুত পা চালাল মেয়েটা।

*****

“গণ্ডগোলটা কোথায় কিছু বুঝতে পারলে?”

“গণ্ডগোলটা যে আছেই সেটা তুমি ধরে নিচ্ছো কী করে?”

প্লেট থেকে কাঁটাটা তুলে নিয়ে একবার ঠোঁটে ঠেকাল সুনন্দা। তারপর কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, “ব্যাপারটা এতই সহজ আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।”

“বিশ্বাস করতে। যদি ওই অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলোর কথা না জানতে ওগুলোই তোমার মাথাটা খেয়েছে।”

“আচ্ছা নলিনী ঘোষ লোকটা সুইসাইড করল কেন বলতো?”

“সেটা আমাকে জানিয়ে তো করেনি।”

“সুইসাইড নোট লিখে যেতে পারে কিছু। তাতে নিশ্চয়ই কারণ লেখা ছিল। বাট দ্যাটস অ্যাবসারড…”

“অ্যাবসারডের কী আছে?”

“নাঃ, লোকটা এখানে ঘুরতে আসেনি।” সুনন্দা চিন্তিত গলায় বলে, “এসেছিল সরকারি কাজে। মানুষ দরকারি কাজে অন্যের বাড়িতে এসে সুইসাইড নোট লিখে সিলিঙে ঝুলে পড়ে এমন কথা আমি আগে শুনিনি।”

“হতে পারে কোনো খবর পেয়েছিল ফোনে। তাতেই ডিপ্রেসড হয়ে….”

“সুইসাইড করল?” এবার বেশ জোরে জোরে মাথা নাড়ে সুনন্দা, “একেবারেই গোঁজামিলে মেলাতে হচ্ছে উত্তরটা, তারপর ধরো সেই প্রথম লোকটা যে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেছিল, প্রশ্ন হল অত রাতে ওই শ্যাওলা ধরা ভিজে সিঁড়িতে কী করছিল সে? সিঁড়িতে যে শ্যাওলা জমেছে হোপফুলি সে নিজেও জানত।”

“তুমি অন্তত ওই কাজটি করতে যেও না। যা কাজকর্ম বা ঘোরাঘুরি করার সব দিনের বেলাই মিটিয়ে ফেল। রাতে বাহাদুরি দেখিও না।” কাঁটা চামচ তুলে হুমকি দেয় নীলাদ্রি।

দু’জনেই খাওয়াতে মন দিল। গোটা চকদীঘিতে এই একটা জায়গাতেই একটু দোকানপাট আছে – নতুনপল্লী। তবে জায়গাটা শহরের মতো ঘিঞ্জি না। বেশি রাত অবধি খোলাও থাকে না। ছাপোষা কিছু খাবার দাবারের দোকান আছে। তারই একটাতে এসে বসেছিল ওরা। একটু সন্ধের দিক বলে লোকজন তেমন নেই। আর একটু পরেই হয়তো দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। বাইরের দোকানগুলোও একটা একটা করে ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করেছে। থেকে থেকে সাটার নামানোর আওয়াজ আসছে।

খাওয়া শেষ করে বিল চাইল নীলাদ্রি। দোকানের ম্যানেজার এতক্ষণ কাউন্টারে বসে ঢুলছিলেন। তিনি আচমকা জেগে উঠে একটা ছোট কাগজে কীসব যেন হিসেব করে বললেন, “ছেষট্টি।”

ম্যনেজারের টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ল নীলাদ্রি। টেবিলের উপরে একটা ছোটো ফলকে নিজের নাম লিখে রেখেছেন ম্যানেজার-মাধব চৌধুরী। ড্রয়ারে খানিক খোঁজাখুঁজি চলল – খুচরো নেই। উঁচু গলায় ডাকলেন ম্যানেজার, “কিস, এ কিস…”

একটা মাঝবয়সী ছিপছিপে চেহারার ছোকরা এসে দাঁড়াল। সম্ভবত দোকানের রান্নাঘরে কাজ করে। একশো টাকার নোটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দিলেন মাধব চৌধুরী, “এটা ভাঙিয়ে নিয়ে আয়। যদুবাবুর দোকান খোলা আছে এখনও। জলদি যা।” তারপর নীলাদ্রিদের দিকে ফিরে বলল, “আপনারা একটু বসুন, ও এক্ষুনি চলে আসবে।”

“দোকান বন্ধ করতে চললেন, এখনও ক্যাশবাক্সে নোট নেই!” কথাটা বলে একটা সিগারেট ধরাল নীলাদ্রি।

“আধাঘণ্টা আগেও ছিল, এক্ষুনি মহাজনকে পাওনা মেটালাম, সব শেষ। আপনারা বেশি দূর যাবেন নাতো?”

“না। কাছেই। জমিদারবাড়ি।”

চোখ ফিরিয়ে একবার দু’জনকে দেখে নিল ম্যানেজার। তারপর হালকা হেসে বলল, “ওখানে এসেছেন? সরকারি কাজে, নাকি?”

“না আমাদের মালিক পাঠিয়েছেন। আপনি গেছেন?”

এবার ম্যানেজার হো হো করে হেসে উঠল। তারপর মৌরির বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, “সে ছেলেবেলায় কতবার গেছি। বাপ-মার চোখের আড়ালে হুড়োহুড়ি করার ওর থেকে ভালো জায়গা আর নেই। তখন সীমানার পাঁচিলে একটা ফাটল ছিল। আমরা তার মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়তাম।” ম্যানেজারের চোখে মুখে স্মৃতি রোমন্থনের বিষণ্ণতা খেলে যায়।

“তারপর?”

“তারপর আর কি, অতবড় বাড়ি আর আমরা জনা ছয়েক কচি-কাঁচা। সব থেকে মজার ছিল ওখানে লুকোচুরি খেলা। একবার যে চোর হল তার কপাল পুড়ল। তবে…” একটু থেমে ম্যানেজার আবার বললেন, “অনেকদিন আর যাওয়া হয়নি। বিশেষ করে ওই দীঘিতে লাশটা ভেসে ওঠার পর থেকে বড্ড কড়াকড়ি হয়ে গেছে, তাছাড়া সাপখোপ …”

ম্যানেজার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই কিস বলে ছেলেটা এসে পড়েছে। এর আসল নাম হয়ত কৃষ্ণ, অপভ্রংশে বদলে গেছে। দর্শ আর কুড়ি মিলিয়ে কয়েকটা নোট সে ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিল। ম্যানেজার তিনটে দশটাকা আর ক্যাশবাক্স থেকে চারটে একটাকার কয়েন বের করে এগিয়ে দিল। নীলাদ্রি কয়েনগুলো নিল না। টাকাগুলো মানিব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “একদিন আসবেন না হয়। আমরা ব্যবস্থা করে দেব।”

ম্যানেজার বিনীত মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। ওরা দু’জন নতুনপল্লির রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে এল।

এখানকার রাস্তাঘাট সবই পাকা। তবে যত্নের অভাবে কিছু জায়গায় খয়ে গিয়ে গর্ত হয়ে আছে। রাস্তার ধারে সোডিয়ামের উঁচু ল্যাম্পপোস্ট লাগানো আছে। তার আলোয় উলটোদিক থেকে দুলকি চালে এগিয়ে আসা ছোট ভ্যানরিক্সা আর সাইকেল চোখে পড়ে। বাস এদিকে প্রায় নেই বললেই চলে। রাস্তার দু’পাশে পাতলা হয়ে আসা গাছের সার আর তার ভিতরে গজিয়ে ওঠা দু-একখানা পাকা বাড়ি। একটু ভিতরের দিকে ঢুকতে দরমার ঘরও দেখা যায়। আর বছর খানেক পরেই গোটা এলাকা জুড়ে আস্ত শহর নামবে। আপাতত সেই গাছপালা আর ঘরবাড়ির প্যারেড থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুনন্দা বলল, “লোকটার বয়স কত মনে হল তোমার?”

“কার? ম্যানেজারের?”

“হুম।”

“কত হবে, এই বছর পঞ্চাশেক।”

“তাহলে দীঘির ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন তার বয়স দশের কাছাকাছি।”

“অংক করলে তাই দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু কেন বলতো?”

“ভদ্রলোক এমনিতে বেশ দ্রুত কথা বলেন। কিন্তু লুকোচুরি খেলার কথা যখন বলছিলেন তখন থেমে থেমে বলছিলেন। মানুষ কখন থেমে থেমে কথা বলে?”

“এতদিন আগের ঘটনা মনে করে করে বলতে কষ্ট হয় হয়তো।”

“বা এমন কোন ঘটনা যা মনে রাখতে চান না, বা এড়িয়ে যেতে চান আমরা ছোটোবেলায় পুলিনদের দোতলার ঘরে আলো নিভিয়ে লুকোচুরি খেলতাম। কই গলা কাঁপল?”

এবার হেসে ওঠে নীলাদ্রি। তারপর সুনন্দার কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, “তুমি দেখচি একেবারে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছো। সেটা একদিক থেকে ভালো। এখানে টিভি নেই যখন… ওঃ, একটা কথা তো তোমায় বলাই হয়নি। বললে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বে।”

“কী কথা?” নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।

“মোড় থেকে বাঁদিকে গেলে তো জমিদারবাড়ি, সেদিকটা ছেড়ে একটু এগিয়ে ডানদিকে ঘণ্টাখানেক হেঁটে গেলে কি পড়বে জানো?”

“কী?”

“সেমেটারি। সেই সঙ্গে লাগোয়া প্রাচীন ক্যাথোলিক চার্চ।”

“তাহলে গ্রেভইয়ার্ড বল।”

“মানে?”

“মানে যেখানে শুধু কবরস্থান থাকে তাকে বলে সেমেটারি, আর চার্চের লাগোয়া হলে গ্রেভইয়ার্ড। দুটো একদম আলাদা জিনিস।”

“ওঃ, আমি ভাবলাম তুমি এক্সাইটেড হবে, উলটে জ্ঞান দিচ্ছো।” সিগারেট ফেলে মুখ বাঁকাল নীলাদ্রি।

সুনন্দা কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, “কবরস্থানটা কোনো বড় কথা না। আমার মাথায় বারবার উত্তরের অন্দরমহলটা ফিরে আসছে, জানো? আচ্ছা তুলিকে ওখান থেকে কে ডাকল বলতো?”

“যে কেউ হতে পারে। তাছাড়া বাচ্চা মেয়ে, নিজের খেয়ালে ভুল শুনেও থাকতে পারে। আবার এও হতে পারে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।”

আর কিছু বলল না সুনন্দা। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে পৌঁছে গেল দু’জনে। আগে এদিকটা ছিল দেউড়ি। পাঁচিলের গায়ে লাগোয়া বড় সদর দরজা। এখানে সিংহ দরজা ছিল একসময়। এখন সেসব ভেঙে পড়ায় কলাপ্সিবেল গেট লাগানো হয়েছে। তার সামনে সারাক্ষণ সিকিউরিটি গার্ড বসে থাকে। বাইরের লোকের প্রাসাদে ঢোকা বিকেল ছ’টা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়।

সুনন্দা আর নীলাদ্রিকে দেখে মাড়োয়ারি গার্ড দরজা খুলে দিল। ওরা ভিতরে ঢুকে এল।

বাইরের কম্পাউন্ডে দাঁড়ালে দুটো প্রাসাদই পুরোপুরি চোখে পড়ে। পাশাপাশি দুটো অট্টালিকার মতো দাঁড়িয়ে। তবে ফ্লোরগুলোকে বাইরে থেকে দেখা যায় না। আকাশছোঁয়া লম্বা লম্বা থামগুলো পথ আটকে দাঁড়ায়।

থাম যেখানে শেষ হয়েছে তার উপরেই ছাদের পাঁচিল। পাঁচিলের ঠিক উপরেই গোল চাঁদটাকে চোখে পড়ছে। মাঝে মাঝে সোনালি মেঘের চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সেটা। পরক্ষণেই খানিক দূর ভেসে গিয়ে আবার দেখা দিচ্ছে। থামের ভিতরে এখন তিনটে মশাল জ্বলছে। এটা হয়তো বাড়ির ট্রাডিশান! গার্ডই সন্ধে হলে জ্বালিয়ে দিয়ে আসে মশালগুলো।

সেই আলোর দিকে তাকিয়ে একটু থমকে দাঁড়ায় দু’জনে, সুনন্দা অস্ফুট ধরে বলে, “এরকম কখনও ভাবিনি, জানো?”

“কী ভাবোনি?”

“পরশু অবধি ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। ভাবতাম কবে নিজেদের বড়সড় কিছু একটা হবে। আর আজ প্রায় রাজবাড়ি।”

“এটাও একরকম ভাড়াবাড়িই বলতে পার। মেয়েটা যতদিন থাকবে ততদিন।”

“সেটাও কি ভেবেছিলে কোনোদিন?”

নীলাদ্রি উত্তর দেয় না। বাড়ির আশপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে সে। তারপর খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে ঘাসের জমির উপরে বসে পড়ে বলে, “ধরে নাও আমি হলাম জমিদার ভূপতি দত্ত।”

“যিনি ব্রিটিশদের চামচা ছিলেন।” ফুট কাটে সুনন্দা।

“সে যাই হোক, এই হল আমার প্রাসাদ, আর তুমি হলে….”

কথাটা বলতে গিয়ে আটকে যায় নীলাদ্রি। ভুরু কুঁচকে বলে, “সনাতন বলছিল এই দত্তবাবুর স্ত্রী নাকি অল্পবয়সে মারা জান। ছেলেপুলে হয়নি কিছু। দত্তবাবু তো স্ত্রী-বিয়োগের পর তুরন্ত আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। এই নতুন বিয়েতে তার একটি ফুটফুটে ছেলে হয়… কন্দৰ্প দত্ত।”

“ফুটফুটে কি না জানলে কী করে?”

“আহা, জমিদারবাড়ির ছেলে সে কি আর খ্যাদাপেঁচা হবে?”

“ব্যাস…” হাত তুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুনন্দা। এমন সময় বাগানের একপাশ থেকে একটা পায়ের আওয়াজ শুনে চমকে উঠল দু’জনে

সকালের রোদ বাড়ির উপরে পড়লে বিরাট থামগুলোর ছায়া বাড়ির দেওয়ালের উপরে লম্বা লম্বা নকশা এঁকে যায়। রাত হলে বাড়ির চাতালে মশাল জ্বলে বলে ছায়া পড়ে ঠিক উলটোদিকে। সূর্যের সঙ্গে মশালের আলোর এই ছায়াযুদ্ধ চলতে থাকে সারাদিন। এখন বাগানের উপর এসে পড়া ছায়াগুলোর মাঝে একটা মাঝবয়সী তরুণীর ছায়া পড়েছে। দু’জনে চোখ তুলে তাকাতেই মূর্তি এগিয়ে এল। একটা বছর পঁচিশের মেয়ে। দুটো হাত জড়ো করে কপালের কাছে ঠেকিয়ে বলল, “আমি মালতী, মধুবাবু পাঠালেন।”

“পাঠালেন! কেন বলতো?”

তেমনই আধো গলায় মালতী বলল, “তুলিদিদির যদি দরকারে লাগে তাই। রাতের দিকটা থাকব আমি। দিনে মধুবাবু থাকবেন।”

নীলাদ্রি নিচু গলায় বলল, “দরকার-টরকার বাজে কথা, মধুবাবু বুঝেছেন রাতে গল্পগুজব করার লোক দরকার তোমার।”

তারপর সামনে ঘুরে বলল, “বেশ মালতী, উপরে চল।”

ঘাটের সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে এল তিনজনে। সিঁড়ির কাছে আলোটা একটু বেশি জোরালো করে রাখা আছে। সকালের মতো সেই পায়ের আওয়াজটা কানে যেতেই আবার একটা বিষণ্ণভাব চেপে ধরল সুনন্দাকে! ভালো করে শুনলে মনে হয় যেন আওয়াজটা পায়ের না। দোতলা থেকে

অনেক মানুষের গুনগুন কথা বলার আওয়াজ আসছে। দূর থেকে আসছে বলে একসঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে শোনা যাচ্ছে না কথাগুলো।

“তুমিও কি এ বাড়িতেই থাকো?” মালতীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সুনন্দা।

“না দিদি, আমার বাবা থাকে। আমি আর মা বাদামতলায় ঘর নিয়ে থাকি। দিনটা এখানে থাকি, রাতে বাড়ি চলে যাই।”

“তোমার বাবার নাম কী?”

“সনাতন কবিরাজ।”

“ওঃ, সনাতনদার মেয়ে তুমি।” নীলাদ্রি বলল কথাটা, তারপর একদম উপরের ধাপে পা রেখে বলল, “তোমরাও এখানে থাক না কেন?”

মালতী শাড়ির আঁচলটা একবার মুখে বুলিয়ে নিয়ে বলল, “থাকতে দিলে তো…”

আর কিছু বলল না ওরা। বুঝল মালতীর বাপ-মায়ে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। সনাতনই তার মেয়ে-বৌকে এখানে থাকতে দেয় না। এ নিয়ে আর প্রশ্ন করা উচিত হবে না।

বারান্দাটা ঘুরে এদিকের ঘরে ঢুকে এল তিনজনে। আপাতত ঘরের বিছানার উপরে তুলি আর মধুবাবু বসে আছেন। মাঝে একটা দাবার বোর্ড রাখা। তুলি দাবা খেলতে ভালোবাসে। এখানে আসার আগে তাই একটা বোর্ড কিনেই এনেছে সুনন্দা। সে নিজেও খেলতে পারবে মাঝে মাঝে। আর কিছু তো তেমন করার নেই।

ঘরে ঢুকেই জলের বোতলগুলো তুলে নিল মালতী। সেগুলো প্রায় খালি- হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে অ্যাসট্রেটা। সেটা ভর্তি হয়ে এসেছে। বাইরে গিয়ে ফেলে আসা দরকার।

“তুমি তো বেশ পাকা খেলোয়াড় হয়েছ দিদি।” হাসতে হাসতে তুলির মাথায় একটা হাত রাখলেন মধুবাবু। তার রাজা এতক্ষণে সাদা গজের প্যাঁচে পড়ে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়েছে, “কে শিখিয়েছে বল তো?”

“কেউ না। আমি নিজে শিখেছি।”

“নিজে শিখে মধু মোক্তারকে তিনবারে দু’বার হারিয়ে দিলে? যাঃ, সত্যি করে বল কে শিখিয়েছে।”

“ওমা, বলছি তো রে বাবা নিজে নিজে খেলি। বাপি তো সময়ই পায় না। আর মা পারেই না।”

সুনন্দা এগিয়ে গিয়ে মধুবাবুর পাশে বসে পড়ে বলে, “বেশ, মিস গ্র্যান্ডমাস্টার, আমাকে একবার হারিয়ে দেখাও দেখি।”

“তুমি পার খেলতে?” তুলির চোখমুখ খুশিতে ভরে ওঠে। সে দ্রুত হাতে দাবার বোর্ড সাজাতে থাকে।

মধুবাবু একটু পেছনে সরে এসে নিচু গলায় বলেন, “ভারী মজার মেয়ে। বাবা-মাকে ছেড়ে এতদূরে দিব্যি অচেনা লোকেদের সঙ্গে মিলে গেল।”

“আপনার তো অচেনা না। আগেও তো এসেছে এখানে।” সুনন্দা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলে।

“সে আর ক’বার। সবমিলে হয়তো বার চারেক। তার মধ্যে দু’বার এত ছোটবেলায় যে মনে থাকার কথা নয়।”

“হুম…” কয়েক সেকেন্ড থেমে কি যেন ভেবে নেয় সুনন্দা। তারপর আরও চাপা স্বরে বলে, “আপনি, মালতী, সনাতনদা আর শশাঙ্কদা ছাড়া আর যারা এখানে থাকে তাদের মধ্যে কে কে চেনে তুলিকে?”

“আর কারও তো চেনার কথা না। মালতীর সঙ্গেও ওর খুব একটা আলাপ নেই।”

“আপনারা কেউ আজ বিকেলের দিকে অন্দরমহলের দরজার কাছটায় গিয়ে ওকে ডাকাডাকি করছিলেন?”

“না তো!” অবাক হয়ে যান মধুবাবু, “দিনের বেলাতেই সাপের ভয়ে কেউ যেতে চায় না।”

একটু থেমে পরের কথাগুলো বলে সুনন্দা, “তাহলে আপনার ছাড়াও এখানে আরও কেউ আছে যে তুলিকে চেনে এবং সে সাপের ভয় পায় না।”

“কে?”

“জানি না।” মাথা নেড়ে সুনন্দা বলে।

এতক্ষণে তুলি দাবার বোর্ড সাজিয়ে ফেলেছে। সে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সাদা নেবে না কালো?”

“কালো। তাহলে আগে তুমি চাল দেবে।”

দু’জনে খেলায় মেতে ওঠে। নীলাদ্রি ওদের দিকে একবার দেখে নিয়ে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে আসে। তারপর গলা তুলে ভিতরে ডাক দেয়, “আসুন মধুবাবু, আমরা পাশের ঘরটা ঘুরে আসি।”

মধুবাবুর চেহারাটা বেশ সাদামাটা। মাঝবয়সী অফিসযাত্রীদের মতো সারাক্ষণ হাফ শার্ট আর ছিটের প্যান্ট পরে থাকেন। মাথা জোড়া চকচকে টাক। কাঠের বাক্সের মতো চৌকো মুখ। বয়স বছর ষাটেকের খানিক নিচে, কিন্তু এই বয়সেও ভিতরে ভিতরে বেশ শক্তি ধরেন বোঝা যায়।

মধুবাবু বাইরে আসতে তার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল নীলাদ্রি। তারপর ঘরের দরজায় একটা ঠেলা দিতে দিতে বলল, “বাচ্চাকাচ্চার সামনে সিগারেট খেতে খারাপ লাগে। বুঝলেন তো? তাই এ ঘরে…”

“হ্যাঁ… আজকাল তো আর এসবের তেমন চল নেই। উলটে বাচ্চারাই খাচ্ছে বড়দের সামনে। আমাদের ছোটবেলায় আমরা ভাবতেই পারতাম না।” লাইটার দিয়ে নিজেরটা জ্বালিয়ে মধুবাবুরটার মুখে সেটা ঠেকাতে ঠেকাতে নীলাদ্রি বলে, “আপনি ছোটোবেলা থেকেই আছেন এখানে?”

“না না।” মাথা নাড়েন মধুবাবু, “আমাকে নাথ স্যার রেখেছেন। আগে ওঁর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। এখন এই জমিদারবাড়ি দেখাশোনা করি। তা নয় নয় করে বছর কুড়ি হয়ে গেল।”

লাইটারটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। দুটো ধোঁয়ার রেখা জানালা বেয়ে হাত বাড়াতে থাকে বাইরে।

“আপনার নিজের বাড়ি কোথায়?”

“বারুইপুর। ওখানেই বৌ-বাচ্চা থাকে।”

“তাদের ছেড়ে এতদূরে থাকতে খারাপ লাগে না?”

ফিকফিক করে হাসলেন মধুবাবু, বললেন, “লাগলেই কি আর উপায় আছে? আপনিও তো…

কথাটা শেষ করলেন না মধুবাবু।

“আমিও কি?” মুখ থেকে সিগারেট সরিয়ে জিজ্ঞেস করল নীলাদ্রি। “না, মানে আপনিও তো থাকছেন এখানে।”

“ওঃ…..”

নীলাদ্রি বুঝতে পারল আরও কিছু বলতে চাইছিল লোকটা। কিন্তু কি? সে যে নিতান্ত টাকার দায়ে পড়েই প্রস্তাবটায় রাজি হয়েছে সেটা কি জানে লোকটা? কিন্তু কীভাবে? নাকি অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছিল? যাই হোক, আর তাকে দিয়ে মুখ খোলানো যাবে না। জানালা থেকে সরে এসে ঘরের চারিদিকে তাকাল নীলাদ্রি।

আগের ঘরটার থেকে এটার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধু এ ঘরের জানালায় নেট লাগানো হয়েছে নতুন। ক্ষীণ হয়ে আসা গন্ধে বোঝা যায় নতুন রঙও করা হয়েছে হয়তো।

“বাকি ঘরগুলোর চাবি কার কাছে থাকে?”

“আমার কাছে।” সিগারেটে একটা বড়সড় টান দিয়ে বলেন মধুবাবু “কাল দেখাব আপনাদের।”

“কাল আমি থাকব না। ওকে দেখাতে পারেন। ওর এসব দিকে যথেষ্ট

আগ্রহ আছে।”

“এসব দিকে বলতে?”

“মানে এসব পুরনো ঘরটর। তার উপরে একটা সুইসাইড হয়ে গেছে আবার।”

“সে তো আমার চোখের সামনেই। আমিই উদ্ধার করেছিলেম বডিটা সিলিং থেকে কাপড় বেঁধে ঝুলছিল। উউফ সে কি দৃশ্য!”

“কোনো সুইসাইড নোট পাননি?”

“উঁহু… নাথিং। আশ্চর্যের কথা হল লোকটা সেদিন রাতেই সরকারি দফতরে ফোন করে মাইনে ঢুকছে না বলে তাগাদা দিয়েছিল। যে লোক রাতে আত্মহত্যা করবে, সে সন্ধেবেলা মাইনের জন্যে কেন ফোন করবে!”

“তাহলে আত্মহত্যা নয় বলছেন?”

“তাই বা কী করে বলি? দরজা জানলা ভিতর থেকে তালা দিয়ে বন্ধ। আমি আর মতীন গভীর রাত অবধি দরজায় বাইরে সিংহ দরজার কাছে বসেছিলাম।”

“মতীন কে? সিকিউরিটি গার্ড?”

“হ্যাঁ, তখন ছিল। এখন সে আর নেই। “

দু’পা এগিয়ে এসে বিছানার উপর বসে পড়ে নীলাদ্রি। তারপর সিগারেটে একটা মোক্ষম টান দিয়ে বলে, “এই দত্তদের কোনো উত্তর-পুরুষ থাকেনা এখানে?”

“উত্তর-পুরুষ বলতে যা বোঝায় তা ঠিক নয়। তবে ওই লতায় পাতায় জ্ঞাতিরা এখনও কেউ কেউ টিকে আছেন। আমাদের সঙ্গে থাকেন মোহনদা। মানে ক্ষেত্রমোহন সেন। আর অনাদি রায়চৌধুরী বলেও একজন আছেন। তবে তিনি এদিকে প্রায় আসেননি বললেই চলে। তবে তার মেয়ে আসে কালে ভদ্রে – পায়েল। ভারি ভালো মেয়ে। আজ রাতেই আসার কথা আছে শুনেছি।”

“ব্যাপারটা অদ্ভুত। জমিদারি মানে তার লতায়-পাতায় অনেকদূর জ্ঞাতিগোষ্ঠি থাকে। তাদের থেকে মাত্র দুটো পরিবার পড়ে আছে? বাকিরা কি উবে গেল নাকি?”

“দুটো আমরা জানি। বাকিরা হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব পুরানো বাড়ি নিয়ে তাদের আর আগ্রহ নেই। তবে একবার এক ভদ্রলোক এসেছিলেন।”

“কীরকম ভদ্রলোক? “

“খুব একটা ভক্তি হয় না তাকে দেখে। ছাপোষা মধ্যবিত্ত টাইপের। বলেছিল তার ঠাকুরদার বাবাকে নাকি বাড়ির ওয়ারিশন করে গেছিলেন তৎকালীন জমিদারবাবু।”

“মানে?”

“মানে সোজা কথায় বলে গেছিলেন যদি আমার কোনো উত্তরপুরুষ সন্তান না রেখে মারা যায় তাহলে অমুক ব্যক্তি, অমুক কাল অবধি সম্পত্তির দেখাশোনা করবেন। সেই ব্যক্তি নাকি ওই ভদ্রলোকের ঠাকুরদা, ফলত এই মুহূর্তে ওয়ারিশন তিনি নিজে।”

“ইন্টারেস্টিং। তা এমনি এমনি দাবি করেছিলেন নাকি কিছু কাগজপত্র ছিল?”

“কাগজ কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমরা অতটা পাত্তা দিইনি। এত বড় সম্পত্তি দেখাশোনার মোহে যে কেউ ওরকম কাগজ নিয়ে হাজির হতে পারে। বলে গেছিলেন উকিল-টুকিল নিয়ে নাকি আবার আসবেন।”

“তারপরে আর আসেননি?”

“উঁহু… সেখান থেকেই আরও পরিষ্কার করে বোঝা গেল লোকটা ফ্রড।”

“বটে… নামটা মনে আছে?”

গালে একটা হাত রেখে ভাবার চেষ্টা করেন মধুবাবু। তারপর থেমে থেমে বলেন, “তাও বছর দশেক আগের কথা। নাম যতদূর মনে পড়ছে শশিভূষণ সরকার। বড়বাজারে মশলাপাতির দোকান ছিল। আমার সঙ্গেই কথা বলেছিলেন তো, তাই এটুকু মনে আছে।”

“বছর দশেক আগে? মানে শেষ আত্মহত্যাটা হওয়ার সময়ে প্রায়।” মনে মনে বলে নীলাদ্রি।

সিগারেট এতক্ষণে ছোট হয়ে এসেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এল দু’জনেই ঘেরা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগল। এখান থেকে নিচের ঠাকুরদালানটা দেখা যায়। সেখানে এখন ভাঙা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। কিছু পুরানো কাঠের আলমারির পাল্লা, ঝুলে ভরা একটা সাইকেল। পুরনো তোষক।

হাতের সিগারেটটা তার উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিল নীলাদ্রি। ভাঙাচোরা আসবাবের ফাঁকে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল সেটা।

এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার উপরে হাত রাখল। কাঠের শক্ত দরজা। তার উপরে ছেনি দিয়ে কেটে নকশা করা। বাইরে তালা লাগানো। তাও ঠেলা দিলে একটুখানি ফাঁক হয়ে ভিতরটা দেখা যায়। এখন বাইরে চাঁদের আলো আছে বলে হালকা উদ্ভাসিত হয়ে আছে ভিতরটা। দেওয়ালের গায়ে বড়সড় কয়েকটা খোপ কাটা। দেখে মনে হয় পুরানো বাতিদান। আগে এখানে আলো রাখা হত। এখন আর দরকার পড়ে না।

“আপনি এত কী ভাবছেন বলুন তো?” নীলাদ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছেন মধুবাবু। নীলাদ্রি মাথা নামিয়ে কপালের ভাঁজগুলো কমিয়ে এনে বলে, “আপনি যে নামটা বললেন সেটা আগে কোনোভাবে শুনেছি আমি।”

“কোন্ নাম? সেই ফ্রড শশিভূষণ সরকার?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু কোথায় শুনেছি মনে পড়ছে না।”

“কমন নাম। না শোনার কিছু নেই।”

নীলাদ্রি আর কিছু বলল না। বহুদূর থেকে রেলের শব্দ ভেসে আসছে। সামনে গাছপালার মাথায় হাওয়া লেগে শন্‌শন করে আওয়াজ উঠছে একটা।

.

তুলি আর সুনন্দা এতক্ষণে খেলার মাঝামাঝি এগিয়ে গেছে। সুনন্দার ইতিমধ্যে দুটো নৌকা আর মন্ত্রী খোয়া গেছে। সাদা সৈন্য কালো রাজাকে প্রায় কোণঠাসা করে দিয়েছে। মালতী একপাশে বসে খেলা দেখছে। তার ঠোঁটের কোণে ঝুলছে একটা সরু হাসি।

এবারের চালটা দিয়ে একটু সময় নিচ্ছে তুলি। তার মাথার চুলগুলো বারবার মুখের সামনে এসে পড়ে বিরক্ত করছে। সুনন্দা সেগুলো একবার ঠিক করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তুলি হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে শত্রুপক্ষের সাহায্য নেবে না সে।

সুনন্দা একবার মালতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, এখানে দেখার জায়গা কি আছে গো? কাল ভাবছি তুলিকে নিয়ে যাব।”

‘দেখার জায়গা এই জমিদারবাড়িই, কাল না হয় ওদিকের প্রাসাদটা দেখে এসো।”

“উঁহু,” মাথা নাড়ে সুনন্দা, “সে পড়ে হবে খন। শুনছিলাম কাছেই নাকি একটা কবরস্থান আছে।”

“তা আছে, কিন্তু কবরস্থান একটা দেখার জায়গা হল?”

“কেন?” মুচকি হাসল সুনন্দা, “আমার তো বেশ লাগে।”

“রক্ষে করো। কি না কি উঠে আসবে। তার উপরে আবার সব সাহেব।” কথাগুলো বলতে গিয়ে মালতী নিজেও হেসে ফেলে। ঝকঝকে দাঁতগুলো টিউবের আলোতেও ঝকমকিয়ে ওঠে।

“তুমি দেখছি ভারী ভীতু…” কথাটা শেষ করে না সুনন্দা। তুলি এতক্ষণে একটা চাল দিয়ে ফেলছে। সেদিকে তাকিয়ে মন দিয়ে পরের চাল ভাবতে থাকে সে।

ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে নীলাদ্রি। তারপর আবার চেয়ারের উপরে বসে। জানালার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে। গজ এগিয়ে দেয় সুনন্দা, “উনি চলে গেলেন?”

“হ্যাঁ…” অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয় নীলাদ্রি। খেলা আরও খানিকদূর এগোয়। এর মাঝে উঠে একবার বাথরুমে যায় তুলি। যাবার আগে শাসিয়ে যায়, তার অনুপস্থিতিতে বোর্ডের একটাও ঘুঁটি এদিক থেকে ওদিক হলেই সে বুঝতে পারবে। অমনি সে খেলা ভণ্ডুল করে দিয়ে নিজে জিতে যাবে।

সে চলে যেতে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয় সুনন্দা। চুল ঠিক করতে করতে বলে, “তুমি কি কিছু ভাবছ?”

“একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় আসছে না।”

“কী ব্যাপার?”

বাথরুম করে মালতীর সঙ্গে ফিরে আসে তুলি। আবার গিয়ে বসে দাবার বোর্ডের সামনে!

“একটা নাম। আগে শুনেছি। কিন্তু মনে পড়ছে না কোথায় শুনেছি।”

“কী নাম?”

“শশিভূষণ সরকার। বড়বাজারে মশলার দোকান ছিল।”

সুনন্দার চোখে একটা ঝিলিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। ফিরে এসে চাল দিয়েছে তুলি। সে অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। সুনন্দা চাল দিতে দিতে বলে, “আরে দাঁড়া বাবা, অত তাড়াহুড়ো করলে হয়?”

কোনোরকমে একটা চাল দিয়ে বলে, “আমরা বাজার করতে গেছিলাম কিন্তু কিছু একটা গণ্ডগোলে বড়বাজার বন্ধ ছিল। আমার ফোনটা কোথায় গেল?” ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে গুগলে নামটা দিয়ে সার্চ করে সুনন্দা। একটা অন্যমনস্ক চাল দেয় আরেকবার।

খবরটা স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠতেই সেটা নীলাদ্রির দিকে এগিয়ে দেয় সুনন্দা। তারপর বলে, “শশিভূষণ সরকারের বড়বাজারে দোকান ছিল। তার মৃত্যুতেই একদিন গণ্ডগোল হয়েছিল ওখানে। বছর দশেক আগে। আমরা মনে হয় তখনই গেছিলাম বড়বাজারে কিছু কেনাকাটি করতে।” ফোনটা বিছানার উপর রেখে দেয় সুনন্দা। রিমলেস চশমাটা শাড়ির আঁচলে মুছে নেয়।

“মারা গেছে? মানে এখান থেকে ফেরার পরপরই।” বিড়বিড় করে নীলাদ্রি, কি মনে পড়তে আচমকা বলে, “সে তো কতলোক মরছে। তাতে বন্ধ ছিল কেন?”

প্রশ্নটা শুনে ফোনটা তুলে নিয়ে আর্টিকেলটা আর একটু পড়ে সুনন্দা, বলে, “উঁহু, মৃত্যু না। ভদ্রলোক রাতে দোকানেই ঘুমাতেন। সেদিন সকালে দোকানের ভিতর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। পুলিশে বলছিল সুইসাইড… কিন্তু ওখানকার লোকজন বলছিল … খুন।”

উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে নীলাদ্রি।

“চেকমেট।” রাজার সামনে মন্ত্রী এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে তুলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *