ষোড়শ অধ্যায়
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল থেকে। ঈশানী মেঘে আকাশ কাল রাত থেকেই হয়তো মেঘলা ছিল কিন্তু অন্ধকারে বোঝা যায়নি। আজ জমিদারবাড়ির চত্তরের উপর মিহি কুয়াশার দানার মতো বৃষ্টির ফোঁটা নেমে আসছে অবিশ্রান্ত ধারায়। একটু আগে তেজটা বেড়ে উঠেছিল বলে জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল সুনন্দা। এখন খুলে দিতেই তুলি জানালা ধরে বাইরেটা দেখতে লাগল। বাইরে দীঘির যেটুকু জল চোখে পড়ে তার উপরে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ে এক আশ্চর্য জলছবি আঁকছে। সেদিকেই চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিল তুলি। বেশ উদাস দেখাচ্ছে তাকে।
সেটা লক্ষ করে তার পাশের মেঝেতে বসে পড়ল সুনন্দা, পিঠে একটা হাত রেখে বলল, “কী ভাবছ তুলি?”
“আমার একটা পুতুল ছিল। সোনিয়া। বাবা কিনে দিয়েছিল।”
“তারপর? কোথায় গেল সেটা?”
“জানি না। বাবা নিয়ে নিয়েছে।”
শেষ কথাটা বলে আবার সেইভাবেই বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল তুলি। আচমকা সুনন্দার মাথায় একটা পুরনো খেয়াল এসে বাসা বাঁধল। এমনও তো হতে পারে তুলির সঙ্গে এ বংশের কোনো সম্পর্ক আছে এবং সেই কারণেই নাথবাবু তাকে পাঠিয়েছেন এখানে। সুনন্দা আর একটু তার দিকে সরে এসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, ছোটবেলার আর কি কি কথা মনে পড়ে তোমার?”
প্রশ্নটায় বেশ খুশি হল তুলি। জানালার দিক থেক মুখ ফিরিয়ে বলল, “আগের জন্মদিনে বাবা আমাকে একটা গাড়ি কিনে দিয়েছিল জানো? সেটায় ভিতরে বসে চালানোও যেত। কিন্তু শুধু বাড়ির ভিতরে।” তুলি ঠোঁট ওলটাল।
“সে তো আগের জন্মদিন। তার আগের কথা মনে নেই?“
এবারে তুলিকে একটু চিন্তিত দেখাল। কিছুক্ষণের জন্যে তার ঠোঁটের কোণে সর্বক্ষণ লেগে থাকা হাসিটা উধাও হল, “জানো, একবার আমার খুব অসুখ হয়েছিল। তখন মা আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেছিল। সেবার কী হয়েছিল আমার মনে নেই।“
“কীরকম অসুখ?”
কাঁধ নাচাল তুলি, “আমার ঠিক মনে নেই। কিন্তু পেটে ব্যথা হত খুব।”
সুনন্দা বুঝল খুব বেশি অতীতে যেতে চাইছে না তুলি। সে পরের প্রশ্নটা করল, “একদম প্রথমের কথা মনে পড়ে না কিছু? মানে যখন তুমি বাড়িতে থাকতে না?”
অবাক হয় তুলি। গোলগোল চোখে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলে, “বাড়িতে কেন থাকব না? বাড়িতেই তো থাকতাম।”
অর্থাৎ হয় মনে নেই। নাহলে মিথ্যে বলছে। সুনন্দা মুখ নামিয়ে নিল। এতটুকু বাচ্চার মিথ্যে বলে লাভ নেই। অ্যাডাপ্টেশানের ব্যাপারটা বোঝার বয়সও হয়নি তার। বা যদি বুঝে থাকে তাহলে সে যে অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড সেটা লুকানোর জন্যেই মিথ্যে বলছে।
“চল, আমরা বাইরে গিয়ে বৃষ্টি দেখি।”
খুশি হয়ে সুনন্দার একটা হাত ধরল তুলি। দু’জনে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। একবার পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখল সেখানে নীলাদ্রি মধুবাবু আর শশাঙ্ক তাস খেলছে। নীলাদ্রি সুনন্দাকে দেখতে পেয়ে একবার হাঁক দিল, “বলছি একটু সনাতনদাকে দেখতে পেলে ডাক দিও তো। চারজন না হলে টোয়েন্টি নাইনটা শুরু করতে পারছি না।”
সুনন্দা তুলিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। তুলি একবার বিছানার উপরে পড়ে থাকা কার্ডগুলোর দিকে দেখল। উলটো করে ফেলে রাখা দুটো ছয় দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। সেগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওগুলো উলটে• রেখেছ কেন?”
তুলির মাথায় একটা হাত রেখে শশাঙ্ক বলল, “ওগুলো হল স্কোরবোর্ড। যাদের সামনে লাল ছয় তারা এগিয়ে আছে, যাদের সামনে কালো ছয় তারা পিছিয়ে আছে।”
তুলি দেখল নীলাদ্রির সামনে লাল ছয় পড়ে আছে, সে ভেবে চিনতে বলল, “দাদা জিতে গেছে তার মানে।“
মধুবাবু মজা করে মুখ বেকিয়ে বললেন, “ওরে স্বার্থপর মেয়ে। আমাদের এতদিন ধরে চিনিস আর একসপ্তা থেকেই আজকে দাদা জিতে গেছে বলে আনন্দ করা হচ্ছে?”
খিকখিক করে হেসে উঠল তুলি। নীলাদ্রি তার গাল টিপে দিয়ে বলল, “চল তো, তোর দিদি যখন যাবে না আমরাই সনাতনদাকে ডেকে আনি।” তুলি রাজি হতে তাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নীলাদ্রি। আপাতত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা তাসগুলো গুছিয়ে একদিকে সরিয়ে রাখল শশাঙ্ক। মধুবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “বাড়িটা এইবারে আবার ফাঁকা হয়ে যাবে।”
শশাঙ্ক একটা করুণ হাসি হেসে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, “আজ পায়েল চলে যাবে, কাল আপনি চলে যাবেন, মোহনদা কয়েকদিনের মধ্যেই যাবেন বললেন আর ছেলেটাও নেই।”
“তাতে কি?” সুনন্দা বলে, “বাড়ির বাকি ভাড়াটেরা তো আছে।”
“তাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সম্পর্ক। কালেভদ্রে কথা হয় কি হয় না।”
শশাঙ্কের রেখে দেওয়া তাসগুলো হাতে তুলে নেয় সুনন্দা। তারপর সেগুলো সাফেল করতে করতে বলে, “কেন জানি না। এখানে আর তুলিকে রাখতে ভরসা হচ্ছে না আমার।”
“সত্যি, বিশেষ করে অতীনের ঘটনাটার পরে…” মধুবাবুকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয় সুনন্দা, “শুধু সেটা না। এর মধ্যে কেউ তুলির ইনহেলারটা সরিয়ে নিয়েছিল।”
“সরিয়ে নিয়েছে!” প্রায় আঁতকে ওঠে শশাঙ্ক, “কিন্তু কেন?”
কাঁধ ঝাঁকায় সুনন্দা, “কেন? কে? এসব কিছুর উত্তরই জানা নেই আমার এটুকু জানি ওকে আর এখানে রাখা ঠিক হবে না। কিন্তু পায়েল এত তড়িঘড়ি ব্যাগ গোছাচ্ছে কেন বলুন তো? হঠাৎ করে হলটা কী?”
শশাঙ্ক বলল, “বাড়ি থেকে নাকি ডাকছে। তবে সেটা মনে হয় সত্যি কথা নয়।”
“কেন বলুন তো?”
“ক’দিন কেমন অন্যরকম লাগছে মেয়েটাকে। এমনিতে খুব জলি, হাসিখুশি, এদিকে এই ক’দিন কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলছে না। কাল দেখলাম পুলিশ অফিসারটিকে ঘরে ডেকে কীসব যেন কথাবার্তা বলছে।”
নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার তিনিও মাথা নাড়লেন, “আজ সকাল থেকে দরজা আটকে বসে আছে। আমি একবার ডাকাডাকি করতে খালি ভিতর থেকে বলল সুনন্দাদিকে বলে দিন রান্না চাপাতে।”
‘মেয়েটা একেবারে ছিটিয়াল।”
জানালার নেট দিয়ে এতক্ষণে বৃষ্টির ফোঁটা চুইয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই জমিদারবাড়ির বাইরেটায় জল দাঁড়িয়ে যায়। তারপরে বাইরে থেকে কেউ এলে চাতালটা পায়ে পায়ে কাদায় ভরে থাকে। সেইসব পরিষ্কার করতে হয় মালতীকে।
আজ আবার সনাতনকে রাতের জন্যে ছুটি দিয়েছে সুনন্দা। সবার রান্না সে একাই করে রাখবে। পায়েলের ট্রেন রাত আটটা নাগাদ। তাকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। তার আগেই সব রান্না সেরে
ফেলতে হবে।
“নাথবাবুরা আজ আসছেন নাকি কাল?” সুনন্দা মধুবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“আজই তো বাড়ি ফিরছেন। কাল আসবেন হয়তো। তুলিকেও নিয়ে যেতে হবে তো।”
কথাটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল সুনন্দার। এই ক’দিনে তুলি যেন তার খুব কাছের কেউ হয়ে পড়েছিল। কাল দুপুর থেকে আর তাকে দেখা যাবে না ভেবেই মনটা কেঁদে উঠছে তার।
তুলিকে নিয়ে ঢুকল নীলাদ্রি। তার পিছনে পিছনে সনাতন। তাকে দেখে শশাঙ্ক গলা তুলে বলল, “আরে! আজ ছুটি তাও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না যে দাদা।”
“আপনারা খেলেন না, আমি তো ভালো পারি না।”
“বলো কি! এই এক সপ্তা আগেই তো আমাদের ডবলে সেট দিলে। অত বিনয় দেখাতে হবে না। বসো বসো।”
কথাটা না বাড়িয়ে বসে পড়ল চারজনে। ডাকাডাকি শুরু হল, ষোল-সতেরো-আঠেরো… সুনন্দা বুঝল আপাতত আর কেউ কথা বলার অবস্থায় থাকবে না। যে যার নিজের মতো খেলায় মেতে উঠেছে।
ক্ষেত্রমোহন এই ক’দিন প্রায় কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না। পায়েল সারাদিন দরজা বন্ধ করে আছে। এ অবস্থায় মালতী ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই।
সুনন্দা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। নামতে নামতে প্রথম দিনের কথা মনে পড়ল তার। প্রথমবার যখন এই সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল। কি আশ্চর্য রহস্যময় লেগেছিল জায়গাটা। একদিন রাতে এই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মারা যান একটা মানুষ। ঠিক কীসের জন্যে অত রাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন তিনি? কেউ কি ডাকছিল তাকে? নাকি কোনো শব্দ শুনেছিলেন? ঠিক যেমন শব্দ শুনেছিল অতীন?
বারণ করা সত্বেও লাফিয়ে লাফিয়েই সিঁড়ি দিয়ে নামল তুলি। তারপর নিচে নেমেই দক্ষিণের প্রাসাদের দিকে দৌড়ে গেল। সুনন্দা আর তাকে ধরার চেষ্টা করল না। কাল থেকে ওর মা-বাবা চলেই আসছে, তারপর আবার হয়তো কড়া শাসনে থাকবে। তাছাড়া দিনের বেলা এতগুলো মানুষের চোখের সামনে কিই বা হবে।
অন্যদিকের প্রাসাদে খানিক খোঁজাখুঁজির পর মালতীকে পাওয়া গেল। বাইরের গাছে জল দিচ্ছিল সে। জল দেওয়া শেষ করে কোথাও একটা যাচ্ছিল। সুনন্দা ডাকতে জল দেওয়ার পাইপটা গোটাতে গোটাতে সুনন্দার দিকে এগিয়ে এল সে। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “তুমি এখন এলে, আমাকেও যেতে হবে।”
“সে যাও, আমার রান্না চাপাতে একটু দেরি আছে। কিন্তু যাবে কোথায়?“
“পায়েল দিদি ডেকেছে। বলল এক্ষুনি না গেলেই নয়।”
সেকি!” কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হয় সুনন্দার, “তিনি তো নাকি সকাল থেকে দরজা দিয়েছেন। তোমাকে হঠাৎ ডাকল যে।”
“কি জানি।”
“বেশ, চল আমিও যাব তোমার সঙ্গে। দেখি কি এমন মহান কাজ করছে। তুলিটা যে কোথায় গেল…”
তুলিকে আশেপাশে আর দেখা গেল না। সুনন্দা আর মালতী পায়েলের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
দরজাটায় বার তিনেক টোকা দেওয়ার পর দরজা খুলল পায়েল। তাকে দেখে একটা ছোটোখাটো ধাক্কা খেল সুনন্দা। এই দু’দিনে মেয়েটা যেন অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চুল ঠিক করে আঁচড়ায়নি। চোখের কোণে যে সারাক্ষণ আই লাইনার দিয়ে রাখে এখন সেটাও উধাও। সেদিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় রাতে তার ঘুম হয়নি ভালো মতো।
“তোমার কী ব্যাপার বল তো? গাঁজা ধরেছ নাকি?” সুনন্দা তার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তোমরা দু’জনেই এখানে। তুলি কই?”
“কোথায় ঘুরতে গেল তো। আজকের দিনটা ছাড়া থাকুক না হয়।”
“আক্কেল নেই একটু তোমাদের!” রাগে লাল হয়ে ওঠে পায়েল, “এক্ষুনি নিয়ে এসো, যেখান থেকে হোক। যেকোনো সময় একটা কিছু বিপদ হতে পারে ওর… মালতী।”
মালতী আর সেখানে দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে দৌড় দেয় চাতালের দিকে। সেদিকেই হেঁটে গেছে তুলি। সুনন্দা নিজেই যাবার উপক্রম করেছিল, এবার সে পায়েলের ঘরে ঢুকে আসে। তারপর টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটার উপরে বসে চারিদিকে তাকিয়ে বলে, “বেশ তো সাজিয়েছো ঘরটা। চেক আউট করছো বলে?”
টেবিলের উপর উঠে বসতে বসতে পায়েল বলে, “উঁহু… আমার মাথাটা ঘেঁটে থাকলে ঘরও ঘেঁটে থাকে।”
“মানে এখন আর ঘেঁটে নেই।” টেবিলের উপর থেকে অ্যাসট্রেটা হাতে তুলতে তুলতে সুনন্দা বলে।
“আছে। আজ ফেরার রিসারভেশনটা কাটা হয়নি। আদৌ বসে যেতে পারব কিনা সেই নিয়ে চিন্তায় আছি।”
“শুধু এটুকু? আর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছো?”
এই কথাটার উত্তর দেয় পায়েল। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে, “সেই স্কুল লাইফে পাটিগণিতের অঙ্কে শিখেছিলাম জানো? অঙ্কের উত্তর নাকি অঙ্কের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। শুধু কোন জায়গাটা গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে সেটা বুঝতে পারলে কেল্লা ফতে। তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খানিকটা উত্তর দেখে গোঁজামিলে মিলিয়েছি বলতে পারো। ভালো কথা, দু’জন পুলিশ আসছেন দুপুরে। তাদের জন্যেও রান্না করো। বুড়োটার মনে হয় ডায়াবেটিস আছে তাও আমি সিওর সাটিয়ে গিলবে।”
“পুলিশ আসছে! কেন? কাউকে অ্যারেস্ট করবে নাকি?”
টেবিলের পিছনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়েল, “তার আর উপায় নেই গো। খুনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওনারা কেসটা নিয়ে এতটা মাথা ঘামিয়েছেন তাই সৌজন্যের জন্যেই নেমন্তন্ন করলাম।”
“সে ভালো করেছ। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না কিছুতেই।”
“এই ক’দিন আমার সঙ্গে ঘুরলে বুঝতে পারতে। এই জন্যে বলেছিলাম সংসারী মানুষদের কিছু হয় না।”
“আচ্ছা এবার নিজের এই নাগা সন্ন্যাসী রূপটা ছেড়ে একটু পরিষ্কার হওা উপরে চল, সিলিন্ডারটাকে একটু সরাতে হবে। আমি একা করতে পারব না।”
“কেন? মালতীদি আছে তো।”
“ওর গায়ে অত জোর নেই।”
পায়েল একটা বাঁকা হাসি হেসে বলে, “তুমি জানো, মালতী এপিজেনেটিক মডিফিকেশানের ফলে অমানুষিক এক শক্তির অধিকারী।”
“শক্তি! কীরকম শক্তি?”
“গোদা বাংলায় যাকে বলে রেসারেকশান। তাছাড়া কিছুটা প্রিমোনিশান ও পারে। আই মিন খারাপ কিছু ঘটার আগে থেকে ও বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।”
“যাঃ… গুল মারছ তুমি।” বিশ্বাস করতে চায় না সুনন্দা, “আমাকে কি তুলি পেয়েছ যে যা বলবে বিশ্বাস করে নেব?”
“আমিও বিশ্বাস করতাম না।” সুনন্দার দিকে ঝুঁকে পড়ে চাপা গলায় বলে পায়েল, “কিন্তু মালতী নিজে হাতে এর আগে করেছে ব্যাপারটা। সনাতনদাও জানে। ওরা ভয় পায় ব্যাপারটা লোকে জানলে ওকে উইচ বলে লিঞ্চিং করতে পারে ভেবে।”
“কিন্তু এটা সম্ভব কী করে? একটা সাধারণ মানুষের পক্ষে…”
টেবিল থেকে নেমে পড়ে পায়েল। না দেখেই আয়নার সামনে থেকে একটা চিরুনি তুলে নেয়। তারপর একপাশ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, “অল্প বিস্তর প্রিমোনিশান মানুষ মাত্রই পারে। আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয় খারাপ কিছু ঘটবে। তার পরেই খারাপ খবর আসে কিছু। কিন্তু মালতীর ক্ষেত্রে সেটা বেশি মাত্রায় আছে।”
“আর রেসারেকশান?” সুনন্দা দরজার দিকটা একবার দেখে নেয়। “ঐ যে বললাম এপিজেনেটিক মডিফিকেশান। আমার মন বলছে দত্ত বংশের আগে এই চকদীঘি জমিদারবাড়িতে যারা থাকত তারা বিশেষ একটা শক্তির সন্ধান করত। বা বলতে পার গোপন কোনো ধর্মের উপাসক ছিল তারা। কোনো এক আদিশক্তির উপাসক। সে ব্যাপারটা ঠিক কি তা আমিও বলতে পারব না। তবে এটুকু আন্দাজ করা যায় যে তাদের ধর্মে এই রেসারেকশানের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
বেশ কিছুদূর হয়তো এগিয়েও গেছিলও তারা কিন্তু মাঝপথে ইংরেজ আগ্রাসনের ফলে তাদের গুপ্তহত্যা করা হয়। ইতিহাস থেকে তাদের নাম মুছে ফেলা হয়। মালতী সম্ভবত তাদেরই বংশধর।”
“কিন্তু তাহলে তো সনাতনেরও…“
“হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। অন্তত জেনেটিকস তো তাই বলছে। কখনও কখনও মেয়েকে বাবা মায়ের থেকে দাদু ঠাকুমার কিংবা পিসির মতো বেশি দেখতে হয়। একটা জিন কোনো বংশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসে থাকতে পারে। কাজ না করে…”
সুনন্দা বেশ জোরে জোরে মাথা নাড়ায়, “আমি এইসব কিছুই বিশ্বাস করছি না। কিন্তু তুমি এত জানলে কী করে?”
লম্বা চুলে চিরুনি টানতে টানতে পায়েল বলল, “কাল সন্ধ্যের দিকে মালতী নিজেই এসে বলল আমাকে। ওর নাকি মনে হচ্ছে এ বাড়িতে খারাপ কিছু হবে। আমি বললাম ক’দিন আগে একটা বাচ্চা মারা গেছে ওরকম মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তখন আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা স্বীকার করল সে। এমনকি প্রথমে কী করে নিজের ক্ষমতাটার কথা জানতে পারল সেটাও।”
“কী করে?”
“ছোটোবেলায় এক বান্ধবীকে নিয়ে এই দীঘির পাশটায় খেলছিল। খেলতে খেলতে বান্ধবীটি জলে পড়ে গিয়ে মারা যায়। সেই সময়েই মেয়েটিকে আবার বাঁচিয়ে তোলে মালতী। ওর নাকি বারবার মনে হচ্ছিল একটা ছায়া সরে যাচ্ছে মেয়েটির শরীর থেকে। আর ওকে কেউ জলের তলা থেকে ডাকছে। তারপর ও জলে নাবে আবার।”
“বাবা!” ভুরু উপরে তুলে বিস্ময় প্রকাশ করে সুনন্দা, “এত রীতিমতো ভূতের গল্প। তা জলের তলায় কী দেখল?”
“দেখেনি কিছু। তবে একটা বিশেষ জায়গায় গিয়ে ওর মনে হচ্ছিল জলের তলাটা সেই জায়গায় অনেকটা গভীর। সেখান থেকেই কেউ ডাকছিল ওকে। একজন না, অনেকজন। তারা কারা হতে পারে বুঝতে পারছ?”
“ওর পূর্বপুরুষ?”
“আমারও তাই মনে হয়।” চুলের বোঝা সামলাতে সামলাতে পায়েল বলল, “হয়তো সেই সময়ে দীঘিতে জল থাকত না। ওখানেই একটা হাইড আউট ছিল। মাটির তলার একচিলতে লুকানোর জায়গা। শত্রুপক্ষ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলেও বেঁচে থাকা যাবে। এই ভেবেই হয়তো বানানো হয়েছিল সেটা। ইংরেজ সৈন্য বা সাধারণ গ্রামবাসীরা বাড়ি আক্রমণ করার পর ওই হাইভ আউটেই লুকানোর চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু আগে থেকে বুঝতে পেরে গিয়ে সুড়ঙ্গের দুটো মুখই বন্ধ করে দেয় শত্রুপক্ষ। ফলে মালতীর বেশিরভাগ পূর্বপুরুষ সুড়ঙ্গে আটকা পড়ে মারা যায়। পরে পুকুরটুকুর খনন করে ঢাকা দেওয়া হয় ব্যাপারটা। যে দু-একজন বেঁচে যায় তাদেরও গা ঢাকা দিতে হয়। তাদেরই কোনো বংশধর হয়তো সনাতন আর মালতী।”
“কিন্তু সুড়ঙ্গ মানে তো…” সুনন্দা বলতে শুরু করতেই পায়েল বিছানার উপরে একটা চাপড় মারে, “এলিজাবেথ মসগ্রুপের স্বপ্নের সেই সুড়ঙ্গটা। কোনো কারণে মালতীর উপাসক পূর্বপুরুষের সমাধিটা মসক্রপ বোনেদের স্বপ্নে আসত… অথচ দু’জনের কোনো অ্যাপারেন্ট যোগাযোগ নেই। ইটস গেটিং স্পুকিয়ার…”
“আর সেই লুকানো ঘরটা?” সুনন্দা চেয়ার থেকে উঠে বিছানার উপর বসতে বসতে প্রশ্ন করে।
“ওটা যতদূর মনে হয় ছিল তাদের উপাসনাগৃহ। যেহেতু তাদের উপাসনাটা পরিচিত সমাজগ্রাহ্য কোনো দেবতার ছিল না তাই সেটা বাড়ির ভিতরেই লুকাতে হয়েছিল তাদের। ঘরটা যতদূর সম্ভব কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। দত্তবংশের একজন ছাড়া। এবং সে আবিষ্কার করতে পেরেছিল বলেই এত বড় ঘটনার সূত্রপাত।”
সুনন্দা আবার কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। এইসময় তুলিকে নিয়ে ঘরে ঢোকে মালতী। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “বাঁদর মেয়ে, ছাদের পাঁচিলে ওঠার চেষ্টা করছিল।”
সুনন্দা বকা দিতে যাচ্ছিল তুলিকে। পায়েল আচমকাই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়। তারপর তার সামনে গিয়ে বসে পড়ে বলে, “তুমি তো এত দুষ্টু নও তুলি। তাহলে ছাদের পাঁচিলে উঠলে কেন?”
তুলি একটু ভেবে বলল, “আমি উঠিনি। আমাকে উঠতে বলল যে…“
“কে?” সুনন্দা প্রশ্নটা করে ফেলেই পায়েলের দিকে তাকাল। তার চোখ এখন আবার মাটির দিকে নেমেছে। চোয়াল দুটো আগের থেকে যেন শক্ত হয়ে উঠেছে। মেয়েটা কি নিশ্বাস বন্ধ করে আছে, “আমি জানি কে। তোমরা আর ওকে হাতছাড়া করো না। অন্তত আমি যতক্ষণ আছি। আজ বিকেলের মধ্যেই আমি এর ফয়শালা করে যাব।”
তুলিকে নিয়ে বিছানার উপর উঠে বসল মালতী। তার দিকে একবার ভালো করে তাকাল সুনন্দা। এতক্ষণ পায়েলের মুখে যা শুনল তার বেশিরভাগটাই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এও কি হতে পারে? একটা দীনদরিদ্র মেয়ে, কয়েকটা টাকার জন্যে অন্যের বাড়িতে কাজ করে খায়, তার এত ক্ষমতা যে একটা মরা মানুষকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারে?
বাইরে বৃষ্টিটা এতক্ষণে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। দরজা পেরিয়ে কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে ঢুকছে ভিতরে। পায়েল টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপটা সুনন্দার সামনে রাখল, “যাবার সময় এটা নিয়ে যেও। এটা ছাড়া আমার কোনো কাজই হত না।”
“কী করলে এতে?”
“খোঁজখবর নিলাম। কিছু জবানবন্দির রেকর্ডিং শুনলাম। একটা লকড রুম মিস্ট্রি সল্ভ করলাম।” গর্বের সঙ্গে বলে পায়েল।
“তাহলে ইংরেজি ছেড়ে এবার সত্যি গোয়েন্দাগিরি শুরু করছো?”
মুচকি হাসি হাসে পায়েল। তারপর সুনন্দার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলে, “চল সুনন্দাদি। একটু বাড়িটা ঘুরে আসি। তুমিও কাল চলে যাবে, আমি তো আজই চলে যাব। আর এবাড়িতে দেখা হবে কিনা কে যানে। মালতীদি তো থাকল তুলির কাছে।”
প্রস্তাবটায় রাজি হল সুনন্দা। দু’জনে একতলার ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। পায়েল একতলার প্যাসেজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তোমার ঠিকানাটা দিয়ে যেও কিন্তু। কলকাতায় গেলে দেখা করে আসব মাঝে মাঝে।“
“বেশ। দেব। তবে আমার বাড়িতে কিন্তু সিগারেট নট অ্যালাউড। নীলাদ্রিও খেলে বাইরে খায়। সেটা মনে করে এসো।”
“বেশ। ক’দিন একটু কৃচ্ছসাধনা করব না হয়। আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”
সিঁড়িতে উঠতে উঠতে সুনন্দা হাসল, “নাহলে ঘর থেকে বের করে আনতে না। তোমাকে চিনি আমি।”
কৌতুকটা গায়ে মাখল না পায়েল। সিঁড়িতে পা চালাতে চালাতে বলল, “রিন্টি মারা যাওয়ার পর আর সন্তান নিলে না কেন বলতো? সমস্যাটা কার দিক থেকে ছিল?”
সুনন্দার মাথা নেমে এল। এ প্রশ্নটা আশা করেনি সে। কয়েকটা সিঁড়ি নিঃশব্দে উঠে আস্তে আস্তে বলল, “আমিই চাইনি।”
“কেন?” পায়েল ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে এতটুকু সংকোচ বোধ করছে না। সেটা আরও অস্বস্তিকর লাগছে সুনন্দার।
“আমি অপরাধবোধে ভুগি। রিন্টির মৃত্যুর জন্যে খানিকটা হলেও আমি দায়ি। আমি কী করে ওকে ভুলে গিয়ে…’
“তুমি নিজেই বললে তুমি অপরাধবোধে ভোগো। আমরা তো রোগে ভুগি সুনন্দাদি। আনপ্রেডিক্টেবল ঘটনাকে নিজের উপরে নিয়ে নেওয়ার প্রবণতাটাও তো একটা মানসিক রোগ। সেটা যখন বুঝতে পারছো তখন সারানোর চেষ্টা করছো না কেন বলতো?”
“চেষ্টা করেছি। পারিনি। আমার বারবার সেদিনের কথা মনে পড়ে যায় …” সুনন্দার দিকে এবার বেশ কিছুটা সরে আসে পায়েল। দেওয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়েছে সুনন্দা। দু’হাতে তার একটা হাতের কবজি চেপে ধরে পায়েল বলে, “তুমিও এই জমিদারবাড়ির মতোই হয়ে আছ সুনন্দাদি। কিছু অতীতের রক্তাক্ত স্মৃতি, মানুষ আর ঘটনা আগলে পড়ে আছ। কিছুতেই সামনে এগোতে চাইছো না। তাই আজও একটার পর একটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে শরীরে। তুমি বারবার সেগুলো আত্মহত্যা বলে সাজাতে চাইছো, অথচ সেগুলো খুন। নিজে হাতে নিজেকে খুন করছো তুমি।”
চোখ তুলে একবার তাকাল সুনন্দা, বলল, “এটা বলার জন্যে এখানে এনেছো আমাকে? নাকি এসব বলে আমার পেট থেকে কিছু বের করতে চাইছো?”
“এমন কিছু আছে নাকি যেটা বের করতে পারি?”
কথাটা বলে একটু পিছিয়ে আসে পায়েল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সুনন্দার দিকে। এদিকের অন্দরমহলে দোতলার ভাড়াটেদের দু-একজন চোখ মেলে তাকিয়েছে ওদের দিকে। কয়েকটা নিস্তরঙ্গ মুহূর্ত কেটে যায়। সিঁড়ির নিচে থেকে দুটো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকায় ওরা। কেশব শর্মা আর মুকেশ খাসনবীশকে দেখা যায় সেখানে। সুনন্দাকে দেখে হাত নাড়ান শৰ্মা। সুনন্দা দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একবার হাসে। তারপর ধীরে পায়ে নেমে আসতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে।
“আমি পরে আসব, রান্না চাপাতে হবে।” কথাটা পায়েলকে বলে মালতীর ঘরের দিকে পা বাড়ায় সুনন্দা। অফিসার দু’জনকে চোখের ইশারায় সেদিকেই আসতে বলে পায়েল। আজ দু’জনের কেউই সিভিল ড্রেসে আসেননি। বন্দুকও নেই কারও কাছে। পায়েল আগেই বলে দিয়েছে সেসবের দরকার পড়বে না।
সুনন্দাকে দরজা খুলে দিয়ে একটু অবাক হল মালতী। বাইরে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার দু’জনকে দেখে নিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সে। সুনন্দা তুলিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মালতীও যাচ্ছিল তার সঙ্গে, পায়েল তাকে আটকে দিয়ে বলল, “তুমি একটু পরে যেও। সুনন্দাদি কাটাকাটি করে নিক, আমি গিয়ে সিলিন্ডার বদলে দিয়ে আসব।”
কথাটা শুনে আর সেখানে দাঁড়াল না সুনন্দা। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
শর্মা বিছানার উপরে বসতে বসতে বললেন, “আপনি শুনলাম নাকি প্যারালালি খুনের একটা তদন্ত করে কিনারা করে ফেলেছেন।”
ব্যঙ্গটা গায়ে মাখল না পায়েল। সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে বলল, “খুন একটা নয়। সব মিলিয়ে মোট ছ’টা। এবং তার আগে আমাদের অজ্ঞাতে আরও বেশ কয়েকটা। তার প্রত্যেকটা খুন একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য সব ক’টা খুন একরকমভাবে করা হয়নি।”
“বেশ, তাহলে আপনি ডিব্রিফ করুন। আমরা এফ.আই.আর লিখে নিচ্ছি।” বিরক্ত হয়ে জিভে একটা আওয়াজ করল পায়েল, “এফ.আই.আর করার কিছু নেই। এই খুনের আসামী আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আপনাদের দু’জনের কাছে আমার শুধু একটা রিকোয়েস্ট আছে। এ বাড়ির সবার তরফ থেকে।”
“বলুন না, আমরা তো শুনছিই।”
চারপাশটা আর একবার দেখে নিয়ে মাটি থেকে উঠে একটু এগিয়ে এল পায়েল, তারপর অদ্ভুতরকম নিচু গলায় বলল, “আজ সন্ধের মধ্যে এবাড়িতে খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। সামথিং মাচ ডেঞ্জারাস দ্যান এনিথিং বিফোর। সমস্ত কৃতকর্মে পরদা ওঠার আগে খুনি শেষবারের মতো আঘাত হানবেই। আপনারা শুধু এটুকু দেখবেন প্লিজ যেন কেউ এক মুহূর্তের জন্যেও আলাদা না হয়ে পড়ে।”
“বাড়ির বাকিরা কই?” জিজ্ঞেস করে খাসনবীশ।
“দাদারা সব উপরের ঘরে তাস খেলছেন।” মালতী বলে।
“বেশ। ব্রিং দেম টুগেদার। খাওয়া দাওয়ার পরেই আমরা উত্তরের বড় গেস্টরুমে সবাইকে চাই। সবাই যাতে আসে সেটা আপনারা নিশ্চিত করুন।” একটা বাচ্চা মেয়ের কাছে আগে এভাবে শাসিত হননি কেশব শর্মা। কিছু একটা প্রতিবাদ করে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। মুকেশ থামিয়ে দেয় তাকে। সে এটুকু বুঝেছে মেয়েটার থেকে এই কেসের ব্যাপারে অন্তত কিছু তথ্য, পাওয়া যেতে পারে।
“উত্তরের গেস্টরুম মানে যেখানে…”
“হ্যাঁ, যেখানে নলিনী ঘোষ স্যুইসাইড করেছিলেন। এবং শশিভূষণ সরকার সেই ঘরেই তাকে সতর্ক করে গেছিলেন। যার তিনমাস পরে তিনি নিজে খুন হন।”
“আপনি কি সেটারও কিনারা করে ফেলেছেন?” কেশব শৰ্মা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন।
এতক্ষণ পর ব্যঙ্গটা গায়ে মাখে পায়েল, হালকা গলায় বলে, “আপনারা যে কী করে এত সহজ ব্যাপারটা বুঝলেন না সেটাই আমার কাছে রহস্য। খুনি একবারও কিছু গোপন করতে চায়নি। উলটে বেশ খোলামেলা ভাবেই বলতে চেয়েছে নিজের নামটা। কারণ সে জানতো সব কিছু জানলেও তাকে ধরতে পারবেন না আপনারা।”
শর্মা আর কিছু বললেন না। সব কিছু শোনার আগে অবধি তর্ক করে বিশেষ লাভ হবে না।
মুকেশ খাসনবীশ এতক্ষণ চুপ করে বসে সব শুনছিল। এবার সে একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আপনি বলছিলেন যে আজ এ বাড়িতে কারও উপর অ্যাটাক হতে পারে। স্পেসিফিক করে যদি বলেন তাহলে নজর রাখতে সুবিধে হতে পারে আমাদের।”
পায়েল মাথা নামিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “সেভাবে বলা মুশকিল। তবে আপাতত দু’জন মেইন টার্গেট বলে মনে হচ্ছে। প্রথমজন তুলি, আই মিন বাচ্চা মেয়েটা।”
“আর দ্বিতীয়জন?”
ঘরে বসে থাকা বাকি তিনজনের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে পায়েল বলে, “অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি… পায়েল রায়চৌধুরী।”