তার চোখের তারায় – ১৫

পঞ্চদশ অধ্যায়

রেশারেকশান…” প্রফেসর ঘোষাল একটু ভুরু কুঁচকালেন, “মিনিং হ্যাস বিন চেঞ্জড ওভার টাইম। মানে এখন আমরা যা বুঝি আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে মানেটা আলাদা ছিল।

দেখো, পৃথিবীর যেকোনো ধর্মকেই নাম কিনতে গেলে কিছু ম্যাজিক দেখাতে হয়। নইলে মানুষ তাকে স্বাভাবিকের থেকে আলাদা করে ভাববে কেন? আর সেভাবে দেখতে গেলে মানুষের জীবনে সব থেকে বড় শোক হল মৃত্যু, নিজের আসন্ন মৃত্যু, কিংবা ধরো প্রিয়জনের মৃত্যু, এইসব মানুষ কোনোকালেই মানিয়ে নিতে পারেনি। ফলে বিভিন্ন উঠতি ধর্মের প্রচারকরা নানাভাবে এই খেলাটাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি যা বললাম সেটা হিস্টোরিকাল ফ্যাক্ট। মিনিং হ্যাজ বিন চেঞ্জড।”

স্কাইপে ভিডিও চ্যাটের স্ক্রিনটা এতক্ষণ অর্ধেক করা ছিল। এবার সেটাকে ফুলস্ক্রিন করে নিল পায়েল। আজ সকালে সুনন্দার থেকে জোগাড় করেছে ল্যপটপটা। তার নিজেরটা নিয়ে আসা হয়নি। অথচ প্রোফেসর ঘোষালকে আজ পাকড়াও না করতে পারলেই নয়। যেটুকু তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায় সেটা আজই জোগাড় করে নিতে হবে।

প্রোফেসর অনন্ত ঘোষাল কানপুর ইউনিভার্সিটিতে নৃতত্ত্ব পড়াচ্ছেন প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল। একটা সেমিনারে ভাষার সঙ্গে নৃতত্ত্বর যোগাযোগ নিয়ে লেকচার দিতে এসে পায়েলের সঙ্গে আলাপ হয় তার। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় পঁয়ষট্টির কাছকাছি, তাও হাবেভাবে একটুও বুড়ো হয়ে যাননি তিনি। নৃতত্ত্বর ব্যাপারে কিছু জানার থাকলেই পায়েল তার সাহায্য নেয়। তবে আজকের আবদারটা একটু অন্যরকম। রিসারেকশান মানে পুনর্জন্ম নিয়ে জানতে চায় পায়েল। ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে তার মানে বদলে গেছে।

পায়েল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতে অনন্ত ঘোষাল আবার শুরু করলেন, “রেসারেকশান বলতে আমরা যা বুঝি সেটা মূলত ক্রিশ্চান মিশনারিদের দান যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুর তিনদিন পর তার আবার বেঁচে ওঠা অর্থাৎ মরা মানুষের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আবার উঠে দাঁড়ানো, আরও বেশি শক্তিশালী, আরও ডিভাইন কিছু হয়ে। তবে ক্রিশ্চানিটির থেকে প্রাচীন যে ধর্মগুলো আছে সেখানে এই রেসারেকশানের অর্থ আলাদা। সেখানে মানুষের মৃতদেহে আবার প্রাণসঞ্চারের কথা বলা নেই। বরঞ্চ সেখানে রেসারেকশান হল আ কাইভ অফ এনার্জি, এমন এক এনার্জি যার কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না।” অনেকক্ষণ পরে এই প্রথম কথা বলে পায়েল। হেডফোনটাকে মাথায় আর একটু চেপে বসিয়ে বলে, “এনার্জির কী করে উদ্দেশ্য থাকবে?”

স্ক্রিনটা একটু ঝাপসা হয়ে উঠল। প্রোফেসর ভিডিও কলিং-এ খুব একটা “ সড়গড় নয়। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা আউট অফ ফোকাস হয়ে যাচ্ছে।

“উই আর ডিলিং ইন থিওলজি হিয়ার। এখানে শুধু এনার্জির কেন? গোটা মহাজগতেরই একটা উদ্দেশ্য আছে। কোনো একটা দিকে এগিয়ে চলেছে সবকিছু, কোনো কিছুই র‍্যান্ডাম নয়। সব কিছুর একটা নিজস্ব ধারা বা গি আছে, এমনি এমনি কিছুই ঘটে না।”

“বেশ, সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু পুনঃজাগরেণের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক বলুন তো?”

একটু গলা খাঁকারি দিয়ে প্রোফেসর বলে, “হ্যাঁ সেটাই বলছি। আমাদের হিন্দু ধর্মে মোক্ষ বলে একটা কথা আছে। বোঝো?”

পায়েল মাথা নাড়তে ঘোষাল বললে, “হিন্দু ধর্মে রেজারেকশানের বদলে যেটা আছে সেটা হল রিইনকারনেশান। মানে এক জন্ম থেকে আর এক জন্মে আত্মার পার হয়ে যাওয়া। মানুষের আত্মা এভাবে কোটি কোটিবার আত্মা বদল করে। এই কোটি কোটি জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার আত্মার উন্নতি ঘটে। শেষে একটা সময় গিয়ে তার আত্মা ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। এই বারবার জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দুলতে দুলতে আত্মার ঈশ্বরের সমকক্ষ হওয়াকেই মোক্ষ বলা হয়। রিইনকারনেশান একরকমভাবে বলতে গেলে ঈশ্বরের জাগরণ। মানুষের নয়… ইজিপ্সিয়ান মিথলজিতে গল্পটা রূপকথার আড়ালে আছে, সে গল্পটা অনেকটা এইরকম–

কথিত আছে মিশরের রাজা ওসাইরিসকে তার ভাই সেথ খুন করে দেহ বিয়াল্লিশটি খণ্ডে ভাগ করে নাইল নদীতে ভাসিয়ে দেয়। শরীরের খণ্ডগুলো নাইল নদীতে ভেসে এদিক-ওদিক চলে গিয়ে হারিয়ে যায়।

ওসাইরিস ছিল মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দেবতা। এদিকে ওসাইরিসের স্ত্রী ইসিস ছিল ম্যাজিক আর ফারটিলিটির ডেইটি। ফলে সে কাঁদতে কাঁদতে গোটা নাইল জুড়ে স্বামীর দেহ খুঁজতে বের হয়। তার চোখের জলেই নাইল নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। এবং সেই ফুঁসতে থাকা নদী থেকেই বিয়াল্লিশটির মধ্যে একচল্লিশটি খণ্ড উদ্ধার করে ইসিস। তারপর সেই খণ্ডগুলোকে একত্র করে মন্ত্রবলে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু মজার কথা হল প্রাচীন ইজিপ্সিওরা এই ঘটনাটাকে রেসারেকশান বলে না। রেসারেকশান আসে এর অনেক পরে।

যাই হোক, খণ্ডগুলো একত্র করে তার গোটা দেহে কাপড় জড়িয়ে এক বিশেষ রিচুয়াল পালন করে ইসিস। মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মামিফিকেশান হয়। এর পর থেকেই চালু হয় ট্রাডিশানটা। ওসাইরিসের প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরে স্বর্গ থেকে ইসিসের দেহের উপর এক ভয়ানক বজ্রপাত হয়। এবং তাতেই ইসিসের ছেলে হোরাসের জন্ম হয়।

এর পরে কোনো এক ছলে আবার ওসাইরিসকে হত্যা করে সেথ। মিশরিওরা বিশ্বাস করে কোনো ঘটনার লিখিত বিবরণ সেই ঘটনাকে প্রভাবিত করে। ফলে ঠিক কীভাবে ওসাইরিসকে হত্যা করা হয় সেকথা কোথাও ডিটেলে লেখা নেই। তবে এটুকু জানা যায় যে একদম ওসাইরিসের মাপে একটি কফিন বানায় সেথ। তারপর ঘোষণা করে যার দেহ ওই কফিনের মধ্যে একদম ফিট করে যাবে তার বশ্যতা স্বীকার করবে সেথ। যেহেতু ওসাইরিসের দেহের মাপেই কফিনটা তৈরি তাই সে ভিতরে গিয়ে ঢুকতেই কফিনের ডালা আঁটসাঁট করে আটকে গেল। সেথও সেই সুযোগে সেই বন্ধ কফিন নাইলের জলে ভাসিয়ে দিল। সেই কফিন ভাসতে ভাসতে গিয়ে লাগল একটা বিবলস গাছের গুঁড়িতে। বহুদিন সেভাবে থাকার পর গাছের গুঁড়ি বাড়তে বাড়তে চারিদিক থেকে ঢেকে ফেলল কফিনটাকে।

এদিকে ইসিস দ্বিতীয়বারের মতো খুঁজতে বেরোয় ওসাইরিসকে। এবং ঘটনাচক্রে খুঁজেও পেয়ে যায় কফিনটা। এরপর সে বুদ্ধি করে ওসাইরিসের দেহতে আর প্রাণ প্রতিষ্ঠা না করে তাকে লুকিয়ে ফেলে এমন কোনো জায়গায় যেখান থেকে খুঁজে বের করা অসম্ভব।”

“কিন্তু কেন?” পায়েল জিজ্ঞেস করে, “মানে একসময় না একসময় তো তাকে জাগতেই হবে। নাহলে তাকে খামোখা বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী?”

ওপাশ থেকে টেবিলের উপর একটা চাপড় মারেন প্রোফেসর, “দ্যাট ইজ দ্য পয়েন্ট মাই ডিয়ার। সব কিছুর একটা উদ্দেশ্য আছে। একটা আল্টিমেট কারণ আছে। সেই কারণটা একটা মানুষের দেহের মৃত্যু থেকে জেগে ওঠার চেয়ে অনেক বড় আরমাগেডন।”

“আরমাগেডন! মানে সৃষ্টির সমস্ত ভালো ও মন্দের মধ্যের অন্তিম যুদ্ধ?”

“একদম তাই। সেই যুদ্ধের সময়ই জেগে উঠবে ওসাইরিস এবং শেষ বারের মতো তার যুদ্ধ হবে সেথের সঙ্গে। যেকোনো একপক্ষ জিতবে তাতে। এণ্ড রেসারেকশান নামে কোনো এক মন্ত্রবলেই জেগে উঠবে ওসাইরিস। তার জেগে ওঠাটা রেসারেকশান না। ঈশ্বরকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্রটা রেসারেকশান। ঠিক এই একই ধরনের গল্প তুমি যিশুর ক্রুসিফাইড হবার জায়গাতেও পাবে। কিন্তু যেহেতু তাদের পেগান মন্ত্রতন্ত্রের উপর ছুতমার্গ ছিল তাই মন্ত্রের অংশটুকু বাদ দেয় তারা। ক্রিশ্চানিটির জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে তাই রেসারেকশানের মানেটাও পালটে যায়।”

“তাহলে রিসারেকশান মানেটা কী দাঁড়াল?”

“মানেটা খুব সোজা। ধরে নাও আমাদের চারপাশে যা যা ঘটনা ঘটে সেই সমস্ত ঘটনা আসলে অন্য কোনো ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ড। আজ সকালে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তোমার আজকের গোটা দিনটার একটা ছোট অংশ। আবার আজকের দিনটা তোমার এই মাসের একটা ছোট অংশ, মাসটা বছরের, বছরটা যুগের, তোমার গোটা জীবনটাই আসলে অনেকগুলো জীবনের মধ্যেকার একটা ছোট অংশ। এদের একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, একটা হয়েছে বলেই পরেরটা ঘটেছে। যেমন ধরো আজ সকালে তুমি যদি দরকারে না পড়তে তাহলে আমাকে স্কাইপে ধরতে না। আবার আমি যদি আজ স্কাইপে না আসতাম তাহলে কলেজে যেতে দেরি হত না। এই বিরাটু চেন অফ ইভেন্টসে কোনো ঘটনা যদি চেন থেকে আলাদা হয়ে পড়ে, দলছুট হয়ে পড়ে, তাহলে যে এনার্জির কথা বললাম সে নিজেই ঘটনাটাকে আবার চেনের সঙ্গে জুড়ে দেয়। কোনো ধর্ম সেটাকে এনার্জি বলেছে, কেউ মন্ত্ৰ বলেছে, কেউ ঈশ্বরের হাত বলেছে। তবে ক্রিশ্চানিটি বল বা প্রাচীন ধর্ম, সব ধর্মের ভিতরেই প্রকারভেদে এই কথাটা বলা আছে।”

পায়েলের মাথায় পুরো ব্যাপারটা ঠিকঠাক ঢোকেনি। বিশেষ করে স্কাইপের গণ্ডগোলে প্রোফেসরের কয়েকটা কথা সে পরিষ্কার শুনতেও পায়নি। একটু ভেবে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “মানে ধরুন অতীতে যদি এমন কিছু ঘটে থাকে যার কনসিকোয়েন্সকে কোনোভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে এনার্জি?”

“এক্সাক্টলি। সব ঘটনার মাঝের একটা ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করে চলেছে সে। তবে…” একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রোফেসর, “আজকাল তেমনটা আর দেখি কোথায়? চোর ডাকাত খুনিরা সব বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো এসবই গল্প কথা।”

একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ পায়েলের গলার কাছে আটকে ছিল, এবার সেটাই করে বসল সে, “আচ্ছা স্যার, এই যে এনার্জির কথা বললেন এটাকে কি কেউ আয়ত্তে আনতে পারে?”

একটু সময় নিয়ে ডানদিকের ভুরু উপরে তুলে হাসলেন বৃদ্ধ প্রোফেসর, সামনে রাখা কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “তুমি ইংলিশ ছেড়ে তন্ত্রসাধনা নিয়ে মেতেছ নাকি?”

লাজুক হাসে পায়েল, “খানিকটা তাই বলতে পারেন। এক তন্ত্রসাধনা ছাড়া এবারের সেমিস্টারটা উতরাবে বলে মনে হচ্ছে না।”

এতক্ষণে পায়েলের চারপাশটা ঠাহর করেছেন প্রোফেসর, স্ক্রিনে যতদূর দেখা যায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “কোথাও বেড়াতে গেছো নাকি? রাজবাড়ি মনে হচ্ছে?”

“রাজবাড়ি না প্রোফেসর, জমিদারবাড়ি। আমার নিজেরই এন্সেস্ট্রাল হোম বলতে পারেন।”

“জমিদারের বংশধর তুমি! এতদিন তো জানতাম না।”

পায়েল প্রসঙ্গটাকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল, “আর একটা কথা জানার ছিল স্যার আমার।”

“তাড়াতাড়ি করো। আমার কিন্তু সত্যি দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“ইংরেজরা আসার আগে বাংলায় ট্রাডিশনাল ধর্মগুলো ছাড়া আর অন্য কোনো ধর্মের কথা কি জানা যায়? মানে অকাল্ট জাতীয় কিছু?”

“অকাল্ট!” আগের ভ্রুকুটিটা আবার ফিরে এল প্রোফেসরের কপালে, “নবাবী আমলে ধর্ম নিয়ে বাংলায় একটা টানাপোড়েন লেগেই থাকত। এর ফাঁকে কিছু জায়গায় লোকাল কিছু রিচুয়াল চালু থাকতে পারে। পরে সেগুলো মেজর রিলিজিয়ানগুলোর সঙ্গে গিয়ে মিশেছে, যেমন ধরো…”

মাঝপথে বাঁধা দিয়ে উঠল পায়েল। উদাহরণ না শুনেও ব্যাপারটা বুঝেছে সে। বলল, “এমনও তো হতে পারে এইসব রিচুয়ালের মধ্যে দু-একটা একেবারে ভাঁওতা ছিল না। সেগুলো দিয়ে সত্যি কিছু একটা করা যেত এবং যুগের অবহেলার সঙ্গে সেই রিচুয়ালটা একটু একটু করে হারিয়ে গেছে?”

“আমি অনেককাল আগে একটা বই পড়েছিলাম এই ব্যাপারে, বুঝলে? সেখানে লেখা ছিল একসময় বাংলার এই অঞ্চলের মানুষের জেনেটিক্স নিয়ে আগ্রহ ছিল।”

“জেনেটিক্স! সে তো অনেক পরে…” অবাক হয় পায়েল।

“আজ্ঞে না, অনেক পরে নয়। আঠেরোশো বাইশ নাগাদ মেন্ডেল মটরগাছ ঘাঁটাঘাঁটি করে প্রথম জিনের কথা বলেন। কিন্তু মজার কথা হল একটা প্রজন্মে ঘটে যাওয়া ঘটনার ফলাফল পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চার হতে পারে এ ধরনের একটা কথা আমরা পাই মেন্ডেলের প্রায় আটশো বছর আগে সেন রাজাদের আমলে। বল্লাল সেনের লেখা ‘অদ্ভুতসাগর’ বইতে। অদ্ভুতসাগরের প্রধান বিষয় ছিল জ্যোতিষ। তারই একফাঁকে তিনি লিখছেন যে এক রাজার রাজত্বকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ নাকি বিশেষ এক পদ্ধতিতে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে পারে। এখনকার বিজ্ঞানীর এর প্রায় কাছাকাছি একটা থিওরি দিয়েছেন যার পোশাকি নাম ‘এপিজেনেটিক মডিফিকেশন। তবে এর বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়নি এখনও।

“বিশেষ পদ্ধতি!” মুখের সামনে থেকে হাত দিয়ে চুল সরায় পায়েল, “কীরকম বিশেষ পদ্ধতি?”

“সেটা বলা ভারি শক্ত…” ঘাড় নাড়েন প্রোফেসর, ‘অদ্ভুতসাগর’-এর কোনো অরিজিনাল কপি পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকের দ্বারা অনুলিখিত হয়েছে, যে যেমন পেরেছে ভার্স বাদ দিয়েছে। কোথাও কেউ আবার নিজের ইচ্ছা মতো ভার্স ঢুকিয়েছে। ফলে আটশো বছর ধরে কপি হতে হতে সে পদ্ধতির কথা মূল বইতে লেখা থাকলেও আজ হারিয়ে গেছে।”

পায়েল আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। প্রোফেসরকে আরও কিছু জিজ্ঞেস করা মানে জেনে বুঝে তার দেরি করিয়ে দেওয়া।

ল্যাপটপটা বন্ধ করে সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। ঘরটা অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। এমনিতে পায়েল খুব একটা অগোছালো নয়, কিন্তু একবার কোনো চিন্তা মাথায় এসে ঢুকলে সেটা যতক্ষণ না যাচ্ছে ততক্ষণ অন্য কোনো কাজে মন বসাতে পারে না সে। আপাতত কয়েকদিন তাই ঘরটা গুছানো হয়নি।

ঘরে জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছু নেইও অবশ্য। একটা তার ট্রাভেলিং স্যুটকেস, কয়েকটা মোটাসোটা বই, হালকা সাজগোজের কিছু জিনিসপত্র, আইলাইনার, লিপস্টিক আর লিপ বাম। আজ সকালে একটু আঁকাঝোঁকা করতে বসেছিল। কিন্তু কিছুই হাতে আসতে চায়নি। কিছুক্ষণ সেই নিয়ে সময় কাটানোর পরে গান গেয়ে ফোনে রেকর্ড করার চেষ্টা করছিল কিন্তু নিজেরই ভালো লাগেনি বলে ডিলিট করে দিয়েছে। তার গলাটা বড্ড চাপা। খোলা গলায় গান তার আসে না।

সেগুলো বিছানা থেকে সরিয়ে একবার দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল পায়েল। আগের দিনের একজন পুলিশ অফিসারকে চোখে পড়ল। সুনন্দাদি বলছিলেন ওরা নাকি শশিভূষণ সরকারের খুনের তদন্ত করছে। শশিভূষণের ব্যাপারটা নিয়ে একটা আগ্রহ ছিল পায়েলের। পুলিশ অফিসারটিকে দেখেও খুব একটা তাড়া আছে বলে মনে হল না। সে দ্রুত পায়ে একটু এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। তারপর গলাটা একটু ভারি করার চেষ্টা করে বলল, “গুড আফটারনুন অফিসার।”

মুকেশ পিছন ঘুরে প্রাসাদের কয়েকটা ছবি তুলছিল। পিছন থেকে ভেসে আসা আওয়াজটা শুনে সেদিকে ঘুরে একটু অবাক হল সে। পায়েল হাতদুটো নমস্কারের ভঙ্গীতে জোড় করে বলল, “আমার আসলে আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।”

“হ্যাঁ, বলুন।” পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায় মুকেশ

“এখানে নয়…” পায়েল নিজের ঘরের দিকে দেখিয়ে বলে, “এসব কথা অন্য কেউ শুনে ফেলুক আমি চাই না।”

মুকেশ আজ ইন্টারোগেশানের জন্যে আসেনি। ক্ষেত্রমোহনকে কিছু পুলিশি কাগজপত্র দেওয়ার আছে তার। দু-এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, “বেশ। তবে মিস্টার সেনকে এই কাগজগুলো আপনি দিয়ে দেবেন তাহলে।”

“নো চিন্তা। দিয়ে দেব।”

কাগজগুলো ঘরে এসেই টেবিলের উপরে রেখে দিল মুকেশ। এ ঘরের দরজাটা খোলা আছে। বাইরের উঠোনের উপর দিয়ে যেতে আসতে দেখা যায় ঘরটা। একটু যেন অস্বস্তি লাগে মুকেশের। বাইরে দাঁড়িয়েই তো কথা বলা যেত। এত কীসের গোপনীয় কথা থাকতে পারে মেয়েটার।

“আমার নাম পায়েল রায়চৌধুরি।”

“হ্যাঁ, শুনেছি আপনার কথা… কাল ওই কুয়োটায় আমার লোক দু’জন….”

“শশীভূষণ সরকারের কেসটায় আপনি কতদূর এগোলেন বলুন তো।” সরাসরি প্রসঙ্গে চলে যায় পায়েল।

“তেমন কিছু নয়। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি তার কাছ থেকে জমিবাড়ি সংক্রান্ত কাগজপত্র হাতানোর জন্যে কেউ খুন করেছে তাকে এবং এই অতীন ছেলেটির সঙ্গে তার কিছু সম্পর্ক আছে।”

“আর কিছু জানতে পারেননি? খুনটা কী করে হল, কে করল?”

“খুন কথাটাই আগে প্রমাণ হয়নি, আর মোটিভ অনেকেরই থাকতে পারে। এমনকি নাথবাবুর…”

“এই ‘নাথ’ লোকটাকে পাকড়াও করতে পেরেছেন?”

“ফোনে যোগাযোগ করা গেছে। এটুকু নিশ্চিত ওর সঙ্গে এই খুনের কোনো যোগাযোগ নেই। ঘটনার সময় ভদ্রলোক দেশে ছিলেন না।“

“বাইরে থেকে অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে থাকতে পারেন।”

“হতে পারে, তবে সেখানেও তার কোনো মোটিভ নেই। শশিভূষণের কাছে যে কাগজ ছিল তাতে উনি খালি এই জমিদারীর কেয়ারটেকার হতে পারবেন। মালিকানা পাবেন না। সেটা যাই হোক না কেন নাথবাবুই থেকে যাবেন।”

“হু… জটিল ব্যাপার, সিগারেট খান আপনি?“

একটু থমকাল মুকেশ, তারপর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বলল, “এখন খাব না। অন ডিউটি খাই না।”

“আমি খেলে আপত্তি নেই তো?”

মাথা নেড়ে না জানায় মুকেশ। তারপর গলা শক্ত করে বলে, “আপনি কী একটা বলার আছে বলছিলেন…”

ঠোঁটের উপর সিগারেট রেখে তাতে লাইটার জ্বেলে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে সে বলে, “বলার তেমন কিছু নেই। একটা প্রস্তাব আছে।”

“কীরকম প্রস্তাব?” মুকেশের মনে হল এই মুহূর্তে পরিস্থিতির উপর একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে। মেয়েটা তার পুলিশি ব্যক্তিত্বের উপর খবরদারি করতে চাইছে।

“প্রস্তাবটা হল এরকম, আপনি জানেন না শশিভূষণের খুন কে করেছে। কিছুতেই ভেবে বের করতে পারছেন না। আমি আপনাকে বলে দেব কে করেছে খুনটা। আপনি তার বিরুদ্ধে যা হোক করবেন। তার বদলে আনি যা চাইব সেটা চোখ বন্ধ করে দিতে হবে আমাকে।”

কান গরম হয়ে ওঠে মুকেশের। মেয়েটা বলে কি! এত খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ যেটাকে খুন বলেই প্রমাণ করতে পারছে না সেখানে ঘটনাস্থলে একবারও না গিয়ে মেয়েটা খুনির নাম বলে দেবে। সে অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি জানেন খুনি কে?”

“ইয়েস।” বড়সড় একটা রিং হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় পায়েল, “যে ক’টা খুন হয়েছে তার সবকটা খুনিরই নাম জানি। তবে শশীবাবুর খুনটা কী কায়দায় হয়েছে সেটা বলতে পারব না। তার জন্যে জায়গাটা দেখা দরকার। আমার কাছে সময় নেই।”

“আপনি যে আন্দাজে বলছেন না সেটা কী করে জানব?” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে মুকেশ। প্রস্তাবটা এখনও তার ছেলেখেলাই মনে হচ্ছে।

“প্রমাণ দেওয়ার দায়িত্ব আমার। তবে সে প্রমাণ কোর্টে পেশ করতে পারবেন কিনা আমি জানি না।”

প্রায় এক মিনিট চুপ করে থাকল মুকেশ। একেবারে খুনির নাম না হোক কোনো একটা লিডও যদি দিতে পারে মেয়েটা তাহলেও তদন্তে লাভ হয়। মনঃস্থির করে নেয় সে।

“বেশ, বলুন বদলে কী চাই আপনার।”

“তেমন কিছু না…” একটু সময় নিয়ে পায়েল বলে, “এক শিশি ভালো ব্র্যান্ডেড বিষ।”

“বিষ! বিষ কী হবে?”

চোখ গোলগোল করে পায়েল, “সেটা বলব বলেছিলাম কি? আমি খুনির নাম বলব আর আপনি আমাকে এক শিশি ভালো ব্র্যান্ডেড বিষ জোগাড় করে দেবেন। আশা করি সেটা জোগাড় করা আপনার পক্ষে খুব একটা কঠিন হবে না।”

“আপনি কি ক্ষেপেছেন? লাইসেন্স ছাড়া কারও হাতে বিষ দেওয়া আইনবিরুদ্ধ, সেটা জানেন?”

“একটা চোদ্দো বছরের ছেলেকে খুন করাটা? আইনসিদ্ধ?”

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুকেশ, “খুন আপনি জানলেন কী করে?”

পায়েল উঠে দাঁড়ায়, “আপনি বারবার আমার মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছেন। অথচ আমি বলেছি সব বলব আপনাকে। শুধু আমার শর্ত মেনে নিন।”

“বেশ” রীতিমতো জোর গলাতেই বলল মুকেশ, “দেওয়া হবে আপনাকে। এবার বলুন।”

“উঁহু…” পায়েলের মুখে একটা চাপা হাসি খেলে যায়, “আদান-প্রদান একসঙ্গেই হবে না হয়। আপাতত শুধু চুক্তি হল। কাল আমি চলে যাচ্ছি এখান থেকে। তার আগে পেয়ে গেলে আমিও আমার শর্তের দিকটা পূরণ করব।”

মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে মুকেশ। তার মুখটা এখন লাল দেখাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে একটু মায়া লাগে পায়েলের। সে নরম গলায় বলে, “আচ্ছা, শশীবাবুর দোকানে সেদিন কী হয়েছিল একটু বলুন তো। মানে যেদিন উনি মারা যান তার আগের দিন।”

ধীরে ধীরে মুখ তোলে মুকেশ, “আলাদা কিছুই হয়নি। তবে দোকানে একটা ছিঁচকে চোর ঢুকে পড়ায় ভদ্রলোক সারাদিন একটু খাপ্পা হয়ে ছিলেন।”

“একটা মজার ব্যাপার হচ্ছিল জানেন।

“কী ব্যাপার?”

“আমার মন বারবার বলছিল শশীভূষণ সরকারের গয়নার ব্যাবসা। কেন বলুন তো?”

মাথা নাড়ে মুকেশ। পায়েল জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু মশলার দোকানে ছিঁচকে চোর ঢুকে কী করছিল?”

“টাকাপয়সা কিছু হাতানোর চেষ্টায় ছিল। তবে নিতে পারেনি কিছু। তার আগেই লোক এসে যাওয়ায় তাদের দেখে পালিয়ে যায়।”

“তারপর?”

“তারপর রাতে শশীবাবু দোকানেই থেকে যান। দু’জন কর্মচারী তাকে রেখে বাইরে থেকে শাটার নামিয়ে বেরিয়ে যায়। শাটারটা বাইরে থেকে টপকানো- যায়। ভিতরে একটা কাঠের দরজা ছিল। শশীবাবু ভিতর থেকে সেটার ছিটকিনি আটকে দেন। তবে এই দু’জন কর্মচারী রোজ একসঙ্গে ফিরতেন। কিন্তু সেদিন ফেরেনি।”

“কেন?”

“সেটা নাকি ভদ্রলোকের এখন আর মনে নেই। মনে পড়লে বলবে বলেছেন।”

“বেশ। তারপর কী হল?”

“সকালে কর্মচারীরা শাটার তুলে দরজা ধাক্কাতেও মিস্টার সরকার সাড়া দিলেন না। তারা তখন দরজা ভেঙে দেখল তিনি সিলিং থেকে ঝুলছেন!”

কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না পায়েল। থুতনিতে হাত দিয়ে বসে থাকল। ডান পায়ের উপর বাঁ পা দিয়ে বসেছিল, এবার বাঁ পায়ের উপর ডান পা দিয়ে বসল। কি যেন মনে হতে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “আচ্ছা আপনি কত বছর পুলিশে আছেন?”

“এই বছর পাঁচেক হবে।” অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল মুকেশ।

“এতদিনে নিশ্চয়ই সুইসাইড-খুন দুটোই অনেকগুলো দেখেছেন।” মুকেশ আগের মতোই মাথা নাড়তে পায়েল একটা প্রশ্ন করল, “এর আগেও নিশ্চয়ই এমন কেস ফেস করেছেন যেখানে খুনি কেসটাকে সুইসাইডের মতো সাজাতে চেয়েছে, কারণ মোটিভ দিয়ে সহজেই তাকে ধরা যায়।“

“হ্যাঁ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই হয়।”

একটু থেমে গমগমে গলায় পরের প্রশ্নটা করল পায়েল, “এই কেসটার সঙ্গে সেগুলোর কোনো বেসিক ডিফারেন্স আছে?”

প্রশ্নটা আশা করেনি মুকেশ। কথাটা তার নিজেরও মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক সে অনেক ভেবেও বুঝতে পারেনি। মাথা তুলে ে বলল, “জেনারেলি এসব ক্ষেত্রে খুনি ঘটনাটা সুইসাইডের মতো সাজায় যাতে তার দিকে সন্দেহ না পরে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে হয় খুনি শুধু চেয়েছিল ঘটনাটা মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার জন্যে সুইসাইড মনে হোক। তারপরে যেন খুন প্রমাণ হলেও তার কিছু যায় আসে না। স্ট্রেঞ্জ!”

“হুম… স্পুকি… কিন্তু এটা কী থেকে বলছেন?”

“খুনের ঠিক আগে সে ভিক্টিমের বাড়িতে ফোন করে। শশীবাবুর গলা নকল করার চেষ্টা করছিল অবশ্য কিন্তু সেটা কনভিন্সিং হবে না সে নিজেও জানতো। অন্তত একটা কাঁপাকাঁপা হাতে লেখা সুইসাইড নোট, খানিকটা ভাঙচুরের চিহ্ন রেখে যাওয়ার কথা, সেটাও রেখে যায়নি খুনি।”

বাইরে দিয়ে এতক্ষণে বেশ কয়েকজনকে আসা যাওয়া করতে দেখা গেছে। মালতীর হাত ধরে তুলি একবার উঁকি দিয়ে গেছে। পায়েল তাকে হাতের ইশারায় ডেকেছিল কিন্তু পুলিশ আছে দেখে সে ভিতরে আসতে চায়নি। পরে আসবে বলে চলে গেছে।

দরজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পায়েল বলল, “তার মানে যে লোকগুলো দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকবে শুধু তাদের কাছে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার ব্যাপারটা চালাতে চেয়েছিল খুনি। প্রথমেই খুন ভেবে তারা সতর্ক হয়ে যাক সেটা খুনি চায়নি। কিন্তু কেন… তাতেই বা কী লাভ … “

কথাটা ভাবতে ভাবতেই পায়েলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, “মাই গড! ঘরে এমন কিছু ছিল যেটা সেই মুহূর্তেই সরানোর দরকার ছিল তার। অর্থাৎ সেদিন ঘরে দরজা ভেঙে ঢোকা লোকগুলোর মধ্যে সেও ছিল।” এ কথাটা শেষ করার আগেই দ্বিতীয়বারের মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে পায়েল, “ছবি আছে? ঘটনার জাস্ট পরের কোনো ছবি আছে আপনাদের কাছে?”

হতবাক হয়ে মাথা নাড়ায় মুকেশ। ছবিটায় কিছু একটা আছে সেটা সে আগেই ভেবেছিল। কিন্তু অনেকবার দেখেও কিছুই বুঝতে পারেনি। ফলে কাজের ফাঁকে ভাবার জন্যে কাছেই রেখেছিল ছবিটা।

প্যান্টের পকেট থেকে ছবিটা বের করে পায়েলের দিকে এগিয়ে দেয় সে। দ্রুত হাতে সেটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে আলোর নিচে ধরে পায়েল।

ঘরে সত্যি কয়েকটা লোককে দেখা যাচ্ছে। তবে পুরো ঘরটা ওঠেনি ছবিতে। চেনা কাউকে চোখে পড়ে না। কেউ কেউ আবার ক্যামেরার দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। পায়েলের চোখের মনি বিদ্যুতগতিতে কিছু একটা খুঁজে বেড়াতে থাকে ছবিতে। কিছু একটা আছে ছবিতে, যেভাবে আছে ঠিক সেভাবে থাকার নয়।

একটা জায়গায় চোখ আটকে যায় পায়েলের। তার ঠোঁটের বাঁদিকে একটা চেরা হাসি খেলে যায়।

মুকেশের দিকে ঘুরে সে বলে, “সেই যে কর্মচারী, যে সেদিন একা বাড়ি ফিরেছিল, তার নম্বর আছে আপনার কাছে।”

“আছে কিন্তু কী হবে?”

“ফোন করুন তাকে। জিজ্ঞেস করুন, কেন একসঙ্গে ফেরেনি?”

“কিন্তু মনে পড়লে সে তো নিজে ফোন করবে বলেছিল।”

“জাস্ট ডু ইট।”

মুকেশের মনে হল এই মুহূর্তে তার নিজের ইচ্ছায় কিছুই হচ্ছে না। বছর বাইশের মেয়েটার কাছে তার সমস্ত বিচারবুদ্ধি স্যারেন্ডার করেছে।

ফোনের কন্ট্যাক্টে গিয়ে সুধাংশুর নম্বরটা বের করে মুকেশ। পায়েল বিছানার উপর বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। তার কপালের শিরা দপদপ করছে। মুঠো করা হাত লাল হয়ে উঠেছে।

ওপাশ থেকে রিং হতে ফোনটা রিসিভ করে সুধাংশু। প্রথমে মুকেশকে চিনতে পারে না সে। পরিচয় দিতে তার গলার স্বর নেমে আসে নিচে, মিনমিনে গলা শোনা যায় ওপাশ থেকে

-হ্যাঁ স্যার, বলুন।

-সেদিন আপনি কেন একা ফিরেছিলেন মনে পড়েছে?

কয়েকবার ওপাশ থেকে ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যায়। তারপরেই সুধাংশুর উত্তেজিত গলা শোনা যায়-

-হ্যাঁ স্যার। মনে পড়েছে। সেদিন আমরা শাটার বন্ধ করার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই কারেন্ট চলে গেছিল।

-লোড শেডিং! তাতে দেরি হল কেন?

-ভিতরে মোমবাতি ছিল না। আমরাও শাটার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। খালি আমাদের দোকানের ফেজটাই গিয়েছিল। শশীদা ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলেন মোমবাতি কিনে জানালা দিয়ে গলিয়ে দিতে। আমি তাই মোমবাতি খোঁজে গিয়েছিলাম। বদ্রির দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে একাই চলে গেছিল।

-তারপর মোমবাতি দিয়েছিলেন?

একটু ভেবেচিন্তে পরের উত্তরটা দিল সুধাংশু, “না স্যার। আমি মোমবাতি কিনে ফিরতে ফিরতেই কারেন্ট চলে এসেছিল। ফলে আর দিতে হয়নি। আমি যদিও জানালার ঠিক বাইরেই রেখে এসেছিলাম।”

একটা বড়সড় নিশ্বাস নিয়ে মুকেশ বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে সুধাংশুবাবু। দরকার পড়লে আবার ফোন করব।”

ফোনটা রেখে পায়েলের দিকে তাকাল মুকেশ। সে এখনও মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে এগিয়ে আসা চুলে গোটা মুখটাই ঢেকে গেছে।

“কারেন্ট চলে গেছিল।” গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল মুকেশ, “কর্মচারী মোমবাতি কিনতে গেছিল। কিন্তু ফিরতে ফিরতে কারেন্ট চলে আসায় বাইরে রেখে চলে যায়।”

পায়েলের দিক থেকে আর কোনো উত্তর আসছে না দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল মুকেশ। আচমকা পিছন থেকে ডাক শুনে সে আবার মুখ ঘোরায়। পায়েলের পাথর হয়ে যাওয়া শরীরে আবার প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছে। মুখ নামিয়েই সে বলে, “অফিসার, আমি আমার প্রস্তাবটা একটু পালটাতে চাই। লেটস বিড ফর সামথিং মোর।”

“মানে?” মুকেশ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে।

“মানে আমি আগে যা চেয়েছিলাম তার থেকে বেশি কিছু চাই। আপনারা সুনন্দাদি, তুলি আর ওঁর স্বামীকে কোনোভাবে বিরক্ত করবেন না। ওদের কোনো দোষ নেই। তার বদলে আমি আমার দিকের বিডটাও বাড়াচ্ছি।”

“কীরকম?”

এতক্ষণে প্রথম মুখ তোলে পায়েল, চেরা হাসিটা এখনও লেগে আছে তার মুখে, সেইভাবেই পরের কথাগুলো উচ্চারণ করে সে, “শশিভূষণ সরকারের খুনির নাম আপনাদের বলব আগেই বলেছিলাম। সেই সঙ্গে খুনটা কীভাবে হয়েছিল সেটাও বলে দেব না হয়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *