চতুর্দশ অধ্যায়
বাদামতলা পেরিয়ে বস্তির দিকটায় আসতেই মালতী চিৎকারটা শুনতে পেল। একটা মেয়েলি গলার যন্ত্রণাকাতর চিৎকার। খুব একটা কান দিল না সে। আজকাল এটা গা সয়ে গেছে তার। ওষুধটা নেই আপাতত। ফলে আজ রাতটা কান ঝালাপালা হবে। কাল রাত অবধি খানিকটা টাকা ছিল তার পকেটে। কিন্তু আজ সকালে সমস্তটাই বাবার হাতে দিয়ে এসেছে। নিজের জন্যে প্রায় কিছু রাখে না, তার উপরে মায়ের ওষুধ। সনাতন বৌকে দেখে না। মরে গেলে হয়তো মুখে আগুন দিতেও আসবে না।
ঘরে ঢুকে মায়ের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মালতী। পেটের কাছে গুটিয়ে থাকা কাপড়টা একবার তুলে ধরল। এভাবে তাকাতে একটা সময় অবধি ঘো লাগত তার। এখন আর লাগে না। রাতটা তাকে এখানেই থাকতে হয়। মায়ের পাশেই শুতে হয়। যন্ত্রণা খুব বেশি বেড়ে উঠলে ঘায়ের উপরে একটা পুরনো মলম লাগিয়ে দেয়। সে মলমে আর কাজ হবার কথা নয়। তাও লাগানোর পরে মনের খেয়ালেই কিছুক্ষণ শান্ত থাকেন তিনি।
আজও সেটা লাগিয়ে দিতে কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করলেন মহিলা। তারপর আবার ঢলে পড়লেন একপাশে।
মালতীর ঘরের জানলায় একবার চোখ রাখল টুম্পা। তারপর জানালার খড়খড়িতে আঙুল ঠুকে শব্দ করে ডাকল তাকে। মালতী চোখ তুলে তাকিয়ে বিরক্ত হয়, “তুই? তোর এখন কী চাই?”
“একটু বাইরে আয় না।” হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল টুম্পা। মালতী খুব একটা খুশি হল না। কী চাইবে সে খুব ভালো করে জানে। টুম্পার স্বামী জোগাড়ের কাজ করে। ফলে বছরের বেশিরভাগ সময়টাই তার হাতটান যায়। সংসার একেবারেই না চললে তখন সে মালতীর কাছে এসে হাজির হয়। মালতী আগে বার দুয়েক ধার দিয়েও ছিল টাকাপয়সা। টুম্পা সামান্য কিছু ফেরত দিয়েছিল। বাকি টাকা আর শত চেষ্টা করেও উদ্ধার করতে পারেনি মালতী। আজও টুম্পাকে দেখেই তার মাথায় সেই পুরনো টাকার রাগটা চড়ে বসল। সে টাকাটা থাকলে আজ ওষুধটা কিনে আনতে পারত।
“টাকা নেই এখন। আর থাকলেও দেব না।” মুখ ঘুরিয়ে নেয় মালতী।
“টাকা চাই না রে, অন্য একটা দরকার আছে।”
দরকার যে আছে সেটা মালতী আগেও বুঝেছে। টুম্পার সঙ্গে তার ইস্কুল বেলা থেকে বন্ধুত্ব। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সংসার নিয়ে মেতে ওঠায় এক টাকাপয়সার দরকার না থাকলে টুম্পা নিজেই আর যোগাযোগ রাখেনি মালতীর সঙ্গে। আজ যখন যেচে পড়ে জানালায় এসেছে তখন কিছু যে একটা দরকার আছে সেটা না বোঝার কিছু নেই।
“একটিবার বাইরে আয় ভাই, পায়ে ধরছি।”
টুম্পার চোখ-মুখ বেশ অসহায় দেখায়। সত্যি অসুবিধায় পড়েছে হয়তো। খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে মালতী। টুম্পাও এসে দাঁড়ায় দরজার কাছে। সে কিছু বলার আগেই তার দুটো হাত চেপে ধরে বলে, “কটা টাকা আছে আমার কাছে সব দিয়ে দেব তোকে। একটিবার সাহায্য কর্।”
“চাইটা কী খোলসা করে বল না।” মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে মালতী।
“আমার বাড়িতে আসবি একবার?”
“কেন? কী করব গিয়ে?”
“আগে আয়, তারপর বলব।”
এইসব ফালতু ভণিতা মালতীর পছন্দ হয় না। টাকাপয়সা ছাড়া অন্য কোনোভাবে সাহায্য করতে হলে আপত্তি নেই তার। তাছাড়া খানিকটা টাকাপয়সারও টান পড়েছে। এখন টুম্পার থেকে টাকাটা উদ্ধার করতে পারলে কিছুটা উপকার হতে পারে।
আর বাক্যব্যয় না করে ঘরের ভিতর থেকে ওড়নাটা এনে গায়ে ফেলে সামনের দিকে পা বাড়াল সে।
বছর তিনেক হল মালতী নিজের খরচেই বাড়িটা পাকা করেছে। তার আগে দরমার বেড়া দেওয়া একচালা ছিল। নাথবাবু একবার ঘুরতে এসে নিজেই সনাতনকে বলেছিলেন মেয়ে-বৌ নিয়ে প্রাসাদের একটা ঘরে থাকতে কিন্তু সনাতন কিছুতেই রাজি হয়নি। লোকটার এই ব্যাপারে আশ্চর্য গোঁ। রাতে মালতীর কিছুতেই এখানে থাকা চলবে না। মালতী নিজেও খুব একটা জোর দেয়নি বাবাকে। জানে, দিয়েও লাভ হবে না।
জমিদারবাড়িতে মালতীর যাতায়াত প্রায় ছোট থেকেই। প্রথমে বাবার সঙ্গে যেত। সনাতনকে রান্নার কাজে সাহায্য করত, কখনও বাবুদের ঘর ঝাঁট দিয়ে দিত। পুজোর ফুল তুলে এনে দিত। শেষে বড় হতে আর মায়ের শরীর পড়ে যেতে একেবারে পাকাপাকি মাইনে নিয়ে কাজ শুরু করল।
তাকে দেখতে খুব একটা ভালো না হলেও মুখের মধ্যে রুক্ষ ভাব নেইল গায়ের রঙটা কালচে তবু মুখটা ভারি নরম। ছিপছিপে বেতের মতো চেহারা।
কমবয়সে আরও খানিকটা কালো ছিল মালতী। তখন একটা প্রিয় ঘের দেওয়া ঝিনুকমালা জামা ছিল। সেটা পরেই জমিদারবাড়িতে যেত। সনাতনের রান্নাঘরে কাজ কমে এলে মেয়েকে কিছুক্ষণের জন্যে ছুটি দিত। তখন জমিদারবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াত মালতী। বিশেষ করে বাড়ির বাগানে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো বারবার টানত তাকে।
লোকে আগে বলত জমিদারবাড়ির কোথায় নাকি একটা সুড়ঙ্গ আছে। বাইরে থেকে কেউ আক্রমণ করলে বাড়ির লোকেরা সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্য কোথায় পালিয়ে যেতে পারত। অবশ্য সেটা আজ অবধি খুঁজে পায়নি কেউ। মালতী মাঝে মাঝে সেই সুড়ঙ্গটা খুঁজে বেড়াত। রোজ অপেক্ষা করে থাকত কতক্ষণে বাবা রান্নাঘর থেকে ছুটি দেবে। ছুটি পেলেই এক দৌড়ে বেরিয়ে আসত।
টুম্পা মালতীর পিছে পিছে হাঁটছিল, একটু দ্রুত পা চালিয়ে কাছে এসে পড়ে বলল, “ও বাড়িতে নাকি পুলিশ এসেছিল।”
“তা মানুষ মরবে আর পুলিশ আসবে না?”
“তোকে কী জিজ্ঞেস করল?”
“কী আর করবে, বলল রাতে কী করছিলাম, কোথায় ছিলাম?”
একটু থেমে গেছিল টুম্পা, একটা কথা মনে করে সে বলল, “হ্যাঁরে তুই তো রাতে ওবাড়িতে থাকিস না। সেদিন ছিলি যে…”
“দিদিমণি আটকে দিল। বাপ কে বলতেই খ্যাঁক করে উঠল।”
“আটকে দিল কেন?”
“তুলিদিদিকে আমার কাছে রেখে কোথায় যেন গেছিল। রাতে ফিরে আমাকে জাগিয়ে নিয়ে গেল।”
“কোথায় গেছিল?” কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে টুম্পা।
“অত আমি কী করে জানব?” মুখ ফিরিয়ে বলে মালতী। তারপর আবার গটগট করে এগোতে থাকে সামনের দিকে।
টুম্পা তার সঙ্গে মিশতে চায় না তার একটা কারণ আছে। ছেলেবেলায় • সুড়ঙ্গের কথাটা টুম্পাকেও বলেছিল মালতী। দু’জনের বয়সই তখন বারো, কি তেরো হবে। টুম্পা তারপর থেকেই জমিদারবাড়ি যাবার জন্য মালতীর- কাছে ঝোলাঝুলি শুরু করে। মালতী প্রথমে অত গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটা। পরে একদিন নিয়ে যায় তাকে।
সেদিন টুম্পা তক্কে তক্কে ছিল। সদর দরজায় মতীন পাহারা দিত তখন তাকে সনাতন ডাকছে বলে মালতীই সরিয়ে দেয়। মতীন মালতীকে গেটে দাঁড়াতে বলে প্রাসাদে যায় সনাতনের সঙ্গে দেখা করতে। মিনিট দশেকের জন্যে গেটে কেউ নেই। সেই ফাঁকে টুম্পা ভিতরে ঢুকে পরে। কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকে পুরনো কুয়োটার পিছনে। হতভম্ব হয়ে মতীন ফিরে এলে মালতীও গেট ছেড়ে কুয়োর কাছে চলে যায়।
সেই একটা দিন দু’জনে একসঙ্গে কাটিয়েছিল জমিদারবাড়িতে। আর সেখান থেকেই যত সমস্যার শুরু।
মালতীর বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল মতীনকে বোঝাতে যে হয়তো সনাতন কী কারণে ডেকেছিল সেটা তার নিজেরই মনে নেই। এর মাঝে একা একাই দীঘির ধারে খেলছিল টুম্পা। খেলতে খেলতে আচমকাই দীঘির জলে পড়ে গিয়েছিল। সে সাঁতার জানত না। ফলে বেশ কিছুক্ষণ খাবি খেয়ে একপেট জল খেয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছিল। ফিরে এসে সেটা দেখে ভয় লেগে যায় মালতীর। সে একবার ভাবে ভিতরে গিয়ে কাউকে ডেকে আনবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় কাউকে ডাকলেই সে যে টুম্পাকে ভিতরে এনেছে সেটা বাবার কানে যাবে। আর রক্ষা থাকবে না।
অগত্যা মালতী নিজেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে এনেছিল টুম্পাকে। শরীরে সাড় ছিল না তার। অনেকক্ষণ চোখ খোলেনি। তাকে পাড়ের উপরে এনে শুইয়ে অনেকবার ডাকাডাকি করে মালতী। তাতেও জ্ঞান ফেরেনি টুম্পার। খানিক পরে পেটে কয়েকটা চাপ দিতে মুখ থেকে বগবগ করে জল বেরিয়ে এসেছিল তার। তারপর খানিকটা সুস্থ বোধ করে টুম্পাদ কিন্তু সুস্থ হয়ে আর সেখানে থাকতে চায়নি সে। মালতীর হাত ধরে টান দিয়েছিল বাইরে যাবার জন্যে।
কিন্তু ততক্ষণে মালতীর মাথায় এক আজব খেয়াল চেপে বসেছে। জলের ভিতর থাকতে থাকতে এক মজার ব্যাপার খেয়াল করেছে সে। এই জলটা ঠিক আর পাঁচটা পুকুরের জলের মতো নয়। এই দীঘির জলে অন্যরকম একটা টান আছে। কোমর অবধি নেমে দাঁড়ালে মনে হয় যেন বিশেষ একটা দিকে সে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে।
কাপের মধ্যে রাখা জলকে চামচ দিয়ে জোরে ঘোরালে ঘুরন্ত জলের যেমন একটা মাঝখান থাকে ঠিক সেইরকম এই দীঘিটারও কোথাও একটা মাঝখান আছে। দীঘির মাঝেও একটা লুকানো ঝড় আছে। তার যত কাছে যাওয়া যাবে তত কাছে টানতে থাকবে সেটা। কী যেন একটা টানে অন্য সব কিছু ভুলে যায় মালতী। টুম্পার হাত ছেড়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় জলের দিকে।
“কোথায় যাচ্ছিস?” পিছন থেকে ডেকে ওঠে টুম্পা। কিন্তু তার কথা মালতীর কানে যায় না। সে ততক্ষণে শান বাঁধানো পাড় দিয়ে একটু একটু করে জলের ভিতরে পা ডুবিয়ে দিয়েছে। জলের স্রোত এসে টেনে নিয়ে গেছে তাকে।
হাঁপাতে হাঁপাতেই ভিজে গায়ে জলের ধার অবধি দৌড়ে আসে টুম্পা। মালতীর শরীর ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে…
.
আরও মিনিট তিরিশেক হাঁটার পর টুম্পার ঘরের সামনে এসে পৌঁছাল দু’জনে।
বাদামতলার একদম শেষ প্রান্তে ঘরটা। আগে টুম্পার শ্বশুর-শাশুড়ি থাকতেন এখানে। এখন দু’জনেই মারা গেছেন। তারপর থেকে বার কয়েক সারানো হয়েছে ঘরটা। ঘর বলতে ইঁটের ছোট একটা একতলা ঘুপচি। এখন তার বাইরের দিকে কয়েকটা ছেঁড়া জামাকাপড় আর ন্যাকড়া ঝুলিয়ে ভিতরটা আড়াল করা হয়েছে।
বিশ্রী পচা গন্ধ আসছে ভিতর থেকে। ছোটবেলার পর আর এ বাড়িতে আসেনি মালতী। তখনও এতটা নোংরা ছিল না ঘরটা। এখন যেন সামনে এসে দাঁড়ালেই গা’টা গুলিয়ে ওঠে। একবার মালতীর মনে হল হাত দিয়ে নাক চাপা দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিল। নাথবাবু সনাতনকে জমিদারবাড়িতে ঠাঁই না দিলে তাকেও হয়তো এরকম একটা ঘরেই থাকতে হত। টুম্পা নিচু হয়ে তার ভিতরে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। মালতী আটকে দিল তাকে। বলল, “এবার বল তো কী করব আমি?”
“আগে তুই ভিতরে আয়।”
মালতীর মনে হল কিছু যেন একটা লুকাচ্ছে টুম্পা। কথাটা ঘরের বাইরে বললে কী এমন ক্ষতি হবে? সে আর কিছু না ভেবে ঘরের ভিতরে পা বাড়াল।
ভিতরে ঢুকেই ডানদিকে ঘরটা। ট্যাক থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুলতে লাগল টুম্পা। বাঁদিকের পাশটায় বস্তির অন্য বাসিন্দাদের চোখে পড়ল। দু একটা আধল্যাংটো নোংরা বাচ্চা উৎসুক মুখে মালতীর দিকে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। তাদেরকে উপেক্ষা করেই পরদার মতো করে ঝোলানো শাড়িটা সরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে এল দু’জনে।
ঘরের ভিতরে ঢুকে গন্ধটা বেড়ে উঠেছে আরও। এবার সত্যি হাত দিয়ে নাক চাপা দিল মালতী।
ঘরের ছাদের দিকে একটা পাখা লাগান আছে। সেটা এখন প্রায় ঘুরছে না। একদিকের মেঝেতে উলটে পড়ে আছে একটা স্টীলের জল খাবার গ্লাস। তার পাশেই ভাতের হাড়ি, ছোট টুল, বিছানাটার উলটোদিকে একটা ছেঁড়া মাদুর পাতা। তার উপর তুলো বের হয়ে আসা বালিশ রাখা আছে। টুম্পার এত হা-ঘরে দশা হয়েছে সেটা জানতো না মালতী। খানিকটা মায়া লাগল তার।
ঘরের চারিদিকে দড়ি টাঙিয়ে জামাকাপড় মেলে দেওয়া হয়েছে। তার কোনো কোনোটা থেকে জল পড়ছে এখনও। ঘরের সিমেন্টের মেঝে ভিজে আছে তাতে। কয়েক ফোঁটা ময়লা জল মালতীর গায়েও এসে পড়ল। সে সঙ্গে সঙ্গে সরে এসে একটু দূরে দাঁড়াল।
ঘরের ভিতরে ঢুকেই কিন্তু আবার দরজা বন্ধ করে দিল টুম্পা। জানালাগুলো বন্ধ করা আছে। বাইরের আলো আটকে দিনের বেলা একটা ক্যাটক্যাটে সাদা টিউবলাইট জ্বালা আছে। আশ্চর্য! এত লুকোচুরি কীসের? তার ঘরের ভিতরে আছেই বা কি যে এত তালাচাবি দিয়ে রাখা।
ঘরের ভিতরে আসল জিনিসটা এবার দেখতে পেল মালতী। একটা মানুব মুখটা দেখলে চেনা যায়। টুম্পার স্বামী বলাই। আপাতত মরার মতো চিত হয়ে শুয়ে আছে বিছানার ঠিক মাঝখানে। জামাকাপড় ওলটপালট। জটপাকানো, চ্যাটচ্যাটে ধুলোমাখা চুলগুলো কপাল থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। যেন একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা।
নাকে হাত চাপা দিয়েই টুম্পার দিকে ফিরল মালতী, তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কই, দে আমার টাকা।”
“টাকা নেই।” মাথা নিচু করে বলল টুম্পা। তার গলার বাইরেটা কয়েকবার ওঠানামা করে থেমে গেল।
“তো ডেকে এনেছিস কেন মাগী?” গনগনে রাগ ঝরে পড়ে মালতীর মুখ থেকে।
টুম্পা উত্তর দেয় না। উলটে সে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। একটু আগের কথাটা বেশ জোর গলায় বলেছে মালতী। গলার আওয়াজে লোকটা যদি ঘুমিয়েও থাকে সেই ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু বলাই-এর শরীরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সে একইভাবে বুকের কাছে হাত জড়ো করে শুয়ে আছে। টুম্পা গিয়ে দাঁড়ায় তার সামনে।
এতক্ষণে একটা সন্দেহ এসে দানা বাঁধতে শুরু করেছে মালতীর মনে বলাই-এর শুয়ে থাকা কেমন যেন অস্বাভাবিক। একটু ফুলেও যেন উঠেছে শরীরটা। চোখের পাতাদুটো একটু বেশি মোটা হয়ে গেছে মনে হয়। ঠোঁটদুটো শুকিয়ে কাঠ। গালের অনেকটা ভিতর অবধি ঢুকে এসেছে তারা।
বলাই-এর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে একটা হাত রাখে মালতী। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে আসে দূরে। হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা। কাল রাতে অথবা আজ সকালের মধ্যে মরে গেছে মানুষটা। ধরা গলায় মালতী টুম্পার দিকে মুখ তুলে তাকায়, “এত মরে গেছে রে।”
বিদ্যুৎ গতিতে মালতীর দিকে সরে আসে টুম্পা। একহাতে তার মুখ চেপে ধরে বলে, “খবরদার, ও কথা বলবিনি, কেউ শুনতে পেলে কী হবে?”
“শুনতে পেলে মানে?” অবাক হয়ে যায় মালতী। তার মাথা আচমকা সমস্ত কাজ বন্ধ করে স্থবির হয়েছে। কান গরম হয়ে উঠেছে। হাতের শিরায় রক্ত যেন দশগুণ বেশি গতিতে ছুটতে শুরু করেছে।
“কেউ শোনার আগেই তোকে শেষ করতে হবে কাজটা। গোপনে।”
“আমি কী করব?” একটু একটু করে পিছিয়ে আসে মালতী।
টুম্পার মুখ থেকে এতক্ষণের বিনয় এক নিমেষে মুছে যায়। সে একলাফে বুনো চিতার মতো মালতীর বুকের কাছে জামাটা খামচে ধরে, “ন্যাকামি করিস না আমার কাছে, সব জানি আমি। সব… সব…”
মিইয়ে আসে মালতী। হাত দিয়ে টুম্পার হাত দুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করে, “ওসব সবসময় হয় না তুই জানিস। হলে আমার মাকে ওইভাবে পড়ে থাকতে হত না।“
“ও আজ সকালে মরেছে। আমি ঘুম থেকে উঠেও ওর নাক দিয়ে নিঃশ্বাস পড়তে দেখছি।” গলার স্বর অনেকটা নিচে নেমে আসে টুম্পার, “তোকে এইটুকু করে দিতেই হবে। আমি কিছু জানি না ভাই, সারাজীবন আমি তোর দাসীবাদি হয়ে থাকব।” মালতীর গলা ছেড়ে টুম্পার হাত একটু একটু করে তার পায়ের দিকে নেমে আসতে থাকে। মালতী সরে আসে।
“না, আমি ঠাকুরের কাছে দিব্যি করেছিলাম আর ওপথে যাব না। আমি একটু একটু করে শেষ হয়ে যাব এরকম করলে।”
“আজ, আজকেই শেষ, আর বলব না তোকে কোনোদিন। আমার আর কিছু নেই। কোথায় যাব আমি ভাব একবার। করে দে ভাই। আর কিচ্ছু চাই না তোর কাছে।”
পা সরিয়ে নিতে গিয়েও পারল না মালতী। এ পৃথিবীতে মাত্র দু’জন জানে কথাটা। সনাতন আর টুম্পা। আর কাউকে কোনোদিন বলেনি মালতী। বললে কারও বাড়ি কাজ জুটত না। ডাইনি অপবাদটা জুটত হয়তো।
ম্যাজিক জানে না সে। না চাইলেই সবসময় মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না, তবে সেই ছোটবেলা থেকে কিছু একটা এসে বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। মাঝে মাঝে আধো ঘুমে একটা অজানা মন্ত্র শুনতে পায়। থেকে থেকে কানের মধ্যে বাজতে থাকে সেটা। মৃত্যুকে মানুষের ছায়ার মতো দেখতে পায় সে। তার উপস্থিতি কাছে পিঠে অনুভব করতে পারে। পাড়ার কারোর বাড়ি মৃত্যু এসে হানা দেওয়ার ঠিক আগে মালতী বুঝতে পারে ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
অনেক চেষ্টা করেও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি মালতী। শেষে একদিন বাবাকে বলে ফেলে। প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি সনাতন। শেষে হাতে নাতে প্রমাণ দেখার পর আর রাতে মেয়েকে ওবাড়িতে থাকতে দেয়নি সনাতন।
একটু একটু করে মৃতদেহের মাথার দিকে এগিয়ে আসে মালতী। কপালে একটা হাত রেখে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, “কখন শেষ দেখেছিস শ্বাস পড়ছে?”
‘দেড় ঘণ্টা আগে। মাছ কিনতে গেছিলাম বাজারে, এসে দেখি… তারপর তোর কথা মনে পড়ল।”
মুখ নামিয়ে আবার বলাইয়ের দিকে তাকাল মালতী। একটু একটু করে শক্ত হতে শুরু করছে শরীরটা। মৃত্যু এসে তাকে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। আর কি ফেরানো যায়?
আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে এইভাবে শক্ত হয়ে আসছিল টুম্পার শরীরটা। সমস্ত দৃশ্যগুলো মালতীর চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল …
টুম্পাকে জল থেকে তুলে আনার পরেই একটা অজানা আশংকায় মালতীর বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গেল। টুম্পার বুক ওঠানামা করছে না। নাকের সামনে একবার হাত রাখল সে। নাঃ নিঃশ্বাসও পড়ছে না। মালতীর ইচ্ছা করল এক্ষুনি এখান থেকে দৌড়ে পালাতে। সে জানে নিশ্বাস নিতে না পেরে মরে গেছে টুম্পা। এখন যেটা তার হাতে শুয়ে আছে সেটা টুম্পার মৃতদেহ। চিৎকার করতে গিয়েও পারল না মালতী। তার গলার ভিতরে স্বর আটকে গেছে। উঠতে গিয়ে মনে হল পা দুটোও আর নিজের আয়ত্তে নেই। আচমকাই এত অসহায় অবস্থাতেও মনটা একটু একটু করে শান্ত হয়ে আসে মালতীর। মনে হয় আশেপাশে ওরা দু’জন ছাড়া আরও কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে। একটু একটু করে টুম্পার বুকের ভিতর থেকে কিছু শুষে নিচ্ছে সে। একটা জীবন ধোঁয়া কচি মেয়েটার বুক থেকে টেনে বের করে নিচ্ছে প্রাণের স্পন্দন। সেই সঙ্গে আরও কেউ এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক মালতীর পিছনে।
টুম্পার কপালে একটা হাত রাখে মালতী। চারটে আঙুল তুলে নিয়ে শুধু তর্জনীটা রাখে মাঝবরাবর। তার নিজের মুখ আর চোখের মনি পুতুলের মতো স্থির।
ধীরে ধীরে তর্জনী দিয়ে টুম্পার কপালের মাঝখানটা গোল করে ঘষতে থাকে সে। খুব ক্ষীণ গতিতে, বারবার। নখে লেগে টুম্পার চামড়ার কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে যায়। সেই মন্ত্রটা কানে আসে মালতীর। অনেক দূরের কোনো মন্দির থেকে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ আসছে। কয়েক লক্ষ মানুষ চাপা স্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করে চলেছে অচেনা ভাষার কয়েকটা শব্দ
অনুভূতিটা একটু একটু করে কমতে থাকে। এতক্ষণে টুম্পার শরীরের ভিতরে একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দুটো বিপরীত শক্তির লড়াই। যে অন্ধকার ছায়াটা সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছিল বাচ্চা মেয়েটার শরীরটাকে এখন সে পিছিয়ে গিয়ে আলগা করছে নাগপাশ। ঠিক যেমন রক্তাত্ত নেউলের দাঁতের আঁচড়ে হার স্বীকার করে পিছু হটে কালনাগিনী।
মিনিট দশেক সেইভাবে যুদ্ধের পর আঙুল তুলে নিল মালতী। টুম্পার মাথাটা মাটির উপরে রেখে একটু পিছিয়ে এল। জলটা টানছে তাকে। জলের ভিতরে কোথায় থেকে যেন ডাক শুনতে পাচ্ছে সে। হ্যাঁ… একটা স্রোত… দীঘির জলের ভিতরে লুকানো একটা ঝড় উঠেছে… সেই ঝড়ের মধ্যে থেকে কেউ ডাকছে তাকে।
চোখ খুলেই মালতীকে দেখতে পেল টুম্পা। কয়েক সেকেন্ড পরে তার মাথাটা কাজ করতে শুরু করল। উঠে বসার চেষ্টা করেও সে পারল না! এইমাত্র যেন সাতদিনের জ্বর থেকে উঠছে। সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মালতীর স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় লাগল তার। তার নাক দিয়ে এখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। অথচ হাত বাড়িয়ে সেটা মুছে নিচ্ছে না মালতী। চোখদুটো দেখে মনে হয় কোনো অদৃশ্য ম্যাজিশিয়ান তার যাদুদন্ডের ছোঁয়ায় অবশ করে দিয়েছে তাকে।
এক-পা এক-পা করে জলের দিকে পিছিয়ে হাঁটছে মালতী। টুম্পা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকার চেষ্টা করল, “মালা, কী হয়েছে মালা তোর? ওদিকে যাচ্ছিস কেন? আমার কী হয়েছিল?”
সে কিছু বুঝে ওঠার আগে পাড়ের দিকে মিলিয়ে গেছে মালতীর শরীর। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিস্ময়মাখা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকল টুম্পা।
আজও সেইরকম ভাবেই তাকিয়েছিল সে মালতীর দিকে। একটা হাতের তর্জনী দিয়ে বলাইয়ের কপালের কাছটা ঘষছে মালতী। তার চোখমুখ এখন স্থির। শুধু নাক থেকে চুঁইয়ে নেমে আসছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। সেই রক্ত ঝরে পড়ছে বলাইয়ের মাথার নিচে থাকা বালিশের উপরে। পনেরো বছর আগের স্মৃতি মনে পড়তে থাকে টুম্পার। সত্যি কি মারা গেছিল সে? যতক্ষণ তার জ্ঞান ছিল না কী দেখেছিল ততক্ষণ? কিছু মনে পড়ে না। সাদা পাতার উপর থেকে হালকা পেনসিলের দাগ কেউ যেন ধুয়ে মুছে দিয়েছে।
একটু পরে আঙুলটা বলাই-এর কপাল থেকে তুলে নিয়ে পিছিয়ে আসে মালতী। এখন তার গোটা থুতনি রক্তের রঙে ঢেকে গেছে।
টুম্পা দ্রুত হাত চালিয়ে একটা কেচে রাখা রুমাল এগিয়ে দেয় তার দিকে। সেটা দিয়ে রক্তটা মুছে ফেলে মালতী। তারপর দু’জনে বিছানার উপরে ঝুঁকে পরে।
হালকা একটা কাশির আওয়াজ শোনা যায়। ভিতর থেকে একটা দমক এসে ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে যায় বলাইয়ের নিথর দেহে। সেই স্রোতের ধাক্কাতেই কয়েকবার কেঁপে চোখের পাতাদুটো খুলে যায়।
এই প্রথম হাহাকার শোনা যায় ঘর থেকে। বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা একটা আকাশ ফাটানো কান্নায় ডুকরে উঠে বলাইয়ের বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুম্পা। তার নখের আঁচড়ে মানুষটার বুকের কাছটা চিরে যায়।
ঘরে আর একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু হতবাক হয় বলাই। স্ত্রীর পিঠে হাত দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলে, “কী হয়েছিল বলো তো? হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?”
মাথা নিচু করে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল মালতী। বাইরে দরজার পাশে রাখা ভাঙা সিমেন্টের স্ল্যাবের উপরে বসে পড়ল। এক্ষুনি হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবে না। অসম্ভব দুর্বল লাগছে শরীর। চোখদুটোও বিশ্বাসঘাতকতা করছে। মনে হচ্ছে যেন এই মাত্র অনেকটা মদ খালি পেটে ঢেলে নিয়েছে গলায়।
একটু পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল টুম্পা। তার চিৎকারে বস্তির আশপাশের ঘর থেকে ছেলেবুড়ো বেরিয়ে এসেছিল। তাদেরকে কিছু একটা বলে সামলে বাইরে বেরিয়ে মালতীর ঠিক পাশটায় এসে বসল সে। মাথাটা কাঁধের উপরে রেখে দুটো হাত দিয়ে মালতীকে জড়িয়ে ধরল। চোখে থেকে অবিশ্রান্ত জলের ধারা নামল।
“ঠিক করলি না তুই…” কাঁধে একটা ঝাঁকা দিয়ে বলে মালতী, “ভগবানের সঙ্গে বারবার লড়াই করতে নেই। মরণ ভগবানের হাতে, আমাদের তা নিয়ে খেলা করা পাপ। “
“আমার যে আর কেউ নেই মালা, আমি যে পথে বসতাম।” কান্নার দমক টুম্পার শেষ কথাগুলো ভিজিয়ে দেয়।
অন্যদিকে তাকিয়ে মালতী বলে, “আমারও ক’দিন হল কী হয়েছে। সারাক্ষণ মনে হয় কিছু একটা হবে। সেদিনও মনে হচ্ছিল।”
“কোন্ দিন? যেদিন ছেলেটা মরে গেল?”
উপরে নিচে মাথা নাড়ায় মালতী, তারপর বলে, “সন্ধে থেকেই মনটা ভালো লাগছিল না। দিদিরা মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে গেল, ওকে নিয়ে একটু ভুলে ছিলাম। তারপর ও ঘুমিয়ে পড়তেই চারদিক এত শুনশান হয়ে গেল যে মনে হল এক্ষনি কিছু একটা হবে। এই বাড়িতেই…”
“তারপর?” মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে টুম্পা।
“মনে হল একবার বাইরেটা গিয়ে দেখি। তারপর ভাবলাম আমার মনের ভুল। অনেক বছর তো হয়নি।”
কয়েক সেকেণ্ড থেমে আবার বলতে লাগল মালতী, “দিদিরা তুলিকে নিয়ে চলে যেতে আমি আবার একা শুয়েছিলাম ঘরে। বারবার মনে হচ্ছিল সিঁড়ি দিয়ে কেউ যেন যাওয়া আসা করছে। একটা ছায়া। ওই ছায়াটা আসলেই খারাপ কিছু হয়… বারবার… ভোর রাতের দিকে আর থাকতে পারলাম না। উঠে পড়ে বাইরেটা দেখে এলাম। কেউ নেই। মনে পড়ল বাবা আজ শশাঙ্কদার ঘরে শুয়েছে। বাবার জন্যে চিন্তা হল। তবে কি বাবাকে নিতেই এসেছে ছায়াটা? আমি শশাঙ্কদার ঘরে গিয়ে টোকা দিলাম। যদি বাবা বেরোয়
তাহলে বলে দেব আমার সঙ্গে এসে শুতে। শশাঙ্কদার গলা শুনে বুঝলাম জেগে আছে। চিন্তাটা একটু কমতে আমি আবার ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। সেদিন রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল ছায়াটা ঠিক পাশেই আছে। সকালে উঠে দেখলাম…”
মাথাটা আবার মালতীর কাঁধে রাখল টুম্পা। বিড়বিড় করে বলল, “ভাগ্যিস এসব কথা কারও কাছে ফাঁস হয়ে যায়নি। হয়ে গেলে তোকে ডাইনি বলতো, এতদিনে।”
“আমি তো তাইই।” টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলে মালতী, “শুধু ওরকম নাক, নখ, চুল নেই।”
কথাটা বলে মালতী উঠে পড়ল। কি যেন মনে পড়তে টুম্পা তার হাত চেপে ধরল, তারপর শাড়ির গিট খুলে হাসিমুখে কয়েকটা একশো টাকার নোট আর খুচরো এগিয়ে দিয়ে বলল, “যতটা আছে সব ঝেড়ে দিলুম, তুই না থাকলে ও টাকাগুলো শ্মশানযাত্রীরা নিতো।”
আর একটু বেশি করে মালতীকে জড়িয়ে ধরে টুম্পা। মনটা খুশি হয়ে গেল মালতীর। আজ বুড়ির ওষুধ জুটে যাবে। আপাতত ক’দিন চিৎকার শুনতে হবে না। মালতী হাঁটতে যাচ্ছিল, টুম্পা তাকে পিছু ডেকে বলল, “আর শোন মালা, তোকে আর যেতে হবে না ও বাড়িতে। আমার কাছেই থেকে যা…
মালতী অল্প হেসে মাথা দোলায়, “না যেতে হবে আমাকে। এতগুলো লোক, এতগুলো টাকার কাজ।”
“বেশ, কিন্তু আমার মন বলছে ছায়াটাকে আর দেখতে পাবি না তুই।” মালতীর মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল সে, “ছায়াটাকে আমি এখনও ওবাড়িতে দেখতে পাই… কিছু একটা হবে… আরও খারাপ কিছু একটা হবে…”