তার চোখের তারায় – ১৩

ত্রয়োদশ অধ্যায়

দুপুরে আর ঘুমাবে না ঠিক করল সুনন্দা। একটু পরেই নীলাদ্রি এসে পৌঁছাবে। ট্রেন খানিক দেরি করছে সেটা আগেই ফোন করে জানিয়েছে। তাছাড়া তার নিজের মনটাও খুব একটা ভালো নেই। এখানে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না তার। ছোট ঘরে থাকতে থাকতে মনের ভিতরটা হীন হয়ে ওঠে বটে, তবে খুব বড় বাড়িতে থাকতে শুরু করলে মনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবনা চিন্তাও এতো ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে যে তার ভার সামলানো এক ঝক্কি হয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে সেই ভার সুনন্দার কাঁধ ঝুকিয়ে দিতে শুরু করেছে।

সকালে পুলিশ এসে নাকি মধুবাবুকে আলাদা করে ডেকে কীসব জেরা করেছে। সুনন্দাকেও জিজ্ঞেস করবে হয়তো। সেদিন রাতে সে কোথায় ছিল সেটা কোনোভাবে বের করার চেষ্টা করবে পেট থেকে।

বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে নিচের চাতালের দিকে তাকিয়ে মনটা খুশি হল সুনন্দার। চাতালের উপর ইট দিয়ে দাগ টেনে চু-কিতকিত খেলছে তুলি। সঙ্গে এ বাড়ির গোটাকতক বাচ্চাও আছে। খুরামকে চোখে পড়ল। তুলি এক পা তুলে মুখে একটা মজাদার আওয়াজ করতে করতে লাফিয়ে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল সুনন্দা। পিছন থেকে একটা আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাল

“বলেছিলাম না? ভারি চৌকশ মেয়ে?” পিছন ঘুরে শশাঙ্ককে দেখতে পেল সুনন্দা। মিহি একটা হাসি খেলে গেল তার মুখে। রেলিঙে সুনন্দার ঠিক পাশেই এসে দাঁড়ায় শশাঙ্ক। তারপর বলে, “আগে আর একটু হৃষ্টপুষ্ট ছিল, জানেন? এখন চেহারা পড়ে গেছে।”

“কার? তুলির?” জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।

শশাঙ্ক ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ায়। বিমর্ষ দেখায় তাকে, “ভগবান যে এইটুকু ফুটফুটে মেয়েকে কেন এমন শাস্তি দেয়….”

“শাস্তি! কীসের শাস্তি?” অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে সুনন্দা।

একটু যেন ঘাবড়ে যায় শশাঙ্ক। সুনন্দার দিকে ফিরে তাকিয়ে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করে কিন্তু বলা উচিৎ হবে কিনা ভেবে থেমে যায়। সুনন্দা আর আগ্রহ না দেখাতে বলেই ফেলে, “আসলে নাথবাবু কথাটা বলেছিলেন মধুদাকে। উনি আবার একটু পেট পাতলা। ফলে আমাদেরকে একদিন বলে ফেলেছিলেন আর কি।”

মনে মনে একটু হাসল সুনন্দা। মধুবাবুর সঙ্গে থাকতে থাকতে শশাঙ্করও রোগটা লেগে গেছে।

“সেরকম গোপন কিছু হলে বলতে হবে না।” আগুনে আর একটু ঘি দেয় সুনন্দা। অপেক্ষা করে।

“না সেরকম ভয়ানক কিছু না। তবে তুলিকে বা নাথবাবুকে কথাটা বলবেন না প্লিজ।”

“বেশ, মুখে কুলুপ দিলাম।” নেমে আসা রিমলেস চশমাটা আবার নাকের উপরে স্থাপন করে সুনন্দা।

“তুলি নাথবাবুর নিজের মেয়ে নয়।” চাপা খনখনে গলায় বলে শশাঙ্ক “তাই নাকি!” বিস্ময় প্রকাশ করে সুনন্দা। কথাটা সে আগেই ভেবেছিল। তার মানে পায়েলের অনুমান মিথ্যে নয়, “অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড?” সে আবার জিজ্ঞেস করে।

“আমরাও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে একদিন মদের ঘোরে নাথবাবু বলেন যে অ্যাডাপ্টেডটা বাজে কথা। ওকে কেউ নাথবাবুর বাড়িতে, রেখে গেছিল।”

“রেখে গেছিল বলতে?”

“মানে তুলি তখন সদ্যজাত শিশু। ওকে নাথবাবুর দরজার কাছে কেউ রেখে গেছিল। একদিন সকালে দরজা খুলে উনি দেখেন এইরকম একটা ফুটফুটে মেয়ে দরজার ঠিক সামনে পড়ে কাঁদছে। উনি আর ওঁর স্ত্রী নিঃসন্তান। ফলে মেয়েটিকে ওনারা নিজেরাই নিয়ে নেন। অ্যাডাপ্ট করতে সেরকম কোনো সমস্যা হয়নি।”

সুনন্দা মুখ নামিয়ে নিল। নাথবাবুর বাড়ির সামনেই মেয়েটিকে রেখে যাও।। হয়েছিল মানে কিছু একটা উদ্দেশ্য ছিল কারও। কিন্তু প্রশ্ন হল সবাইকে ছেড়ে নাথবাবুর কাছে কেন? নাথবাবু এই জমিদারবাড়ির মালিক বলে? এভাবেই কি কেউ তুলিকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল?

সকালের ভাবনাটা আবার ফিরে আসে সুনন্দার মাথায়। তাহলে সত্যি কি তুলি এ বংশের সন্তান? একটা প্রশ্ন ভেসে ওঠে সুনন্দার মাথায়, সে শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু আপনি তাহলে ভগবানকে দোষ দিচ্ছিলেন কেন? একটা বাপ-মা হারা মেয়ে ভালো বাবা-মা খুঁজে পেল… এটাও কি কম ভাগ্যের কথা?”

একটা করুণ হাসি ফুটে উঠল শশাঙ্কের মুখে, “সে ভাগ্যতো বেশিদিন টিকলো না। হাজারটা রোগ তুলির। হাঁপানিটাও দিনদিন বেড়ে উঠছে। আশ্চর্যের কথা কি জানেন? এই দত্তবংশেও হাঁপানির একটা ট্রেন্ড আছে। শুনেছি প্রায় দু’পুরুষ অন্তর কারও না কারও অ্যাজমা থাকে। আর…” আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল শশাঙ্ক, নিচ থেকে সনাতনের ডাক শোনা যায়। বাজার থেকে কিছু একটা আনতে ভুলে গেছে শশাঙ্ক। অথচ সেটা না হলে আজকের রান্নাটাই হবে না। মাথায় হাত দিয়ে দ্রুত সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল সে।

“বাকি কথা পরে বলব আপনাকে। তবে এগুলো বলবেন না কাউকে।”

“নাঃ পাগল নাকি? “

অন্যমনস্ক হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে উঠতে লাগল সুনন্দা। একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে তার ধারণাটা। তুলির এখানে আসার কোনো কারণ আছে। অতীনের মতো সেও এই বংশের উত্তরপুরুষ। তাহলে কি এরপর তার উপরেই খুনির দৃষ্টি পড়বে? যেভাবেই হোক তুলিকে আর একা ছাড়া যাবে না। রাতে দরজা ভিতর থেকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে শুতে হবে। গা’টা শিউড়ে উঠল সুনন্দার। চিন্তিত মনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল সে।

*****

শশাঙ্কের কাছ থেকে গোটা ব্যাপারটা শোনার পর কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না নীলাদ্রি। এই দিনতিনেকে বাড়িটা আমূল বদলে গেছে। এর আগে যেদিন এসেছিল সেদিনকার থেকে মানুষগুলোও আলাদা। এদের সবার মুখে কীসের যেন অন্ধকার ছায়া পড়েছে। অজানা কিছুর ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্থ হয়ে রয়েছে সবাই। শুধু মৃত্যু তো নয়। একটা অল্পবয়সী ছেলের এমন নির্মম পরিণতি। সে দৃশ্য এত সহজে মুছে যাওয়ার নয়।

আজ অনেকদিন পরে তুলির সঙ্গে দাবা খেলতে বসেছিল সুনন্দা। বেশ কয়েকটা ভুলভাল চাল দিয়েছে। মনটা কিছুতেই দাবার বোর্ডে বসছে না। তবে সব কথা নীলাদ্রিকে খুলে বলেনি সে। যেটুকু এ বাড়ির সবাই জানে তার বাইরে কিছুই জানায়নি। যথারীতি নীলাদ্রি ফেরার পর থেকে পায়েলকে আর এ প্রাসাদে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়েছে। সুনন্দার একবার ইচ্ছা করছিল তার সঙ্গে আবার কোথাও যেতে। কিন্তু তাহলেই আবার নীলাদ্রিকে একগাদা জবাব দিতে হবে।

অগত্যা বিকেলের দিকে নীলাদ্রি নিচে নেমে যেতে সে ছাদে চলে এসেছে। ছাদের মজাটা হল এই যে এখান থেকে রাস্তাঘাটে হেঁটে যাওয়া লোকজনদের গতিবিধি প্রায় সমস্তটাই দেখা যায় অথচ তারা কিছুই দেখতে পায় না। মানুষ যখন জানে যে কেউ তাকে দেখছে না তখন তার আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে।

আজ অবশ্য ছাদের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে তেমন কিছুই চোখে পড়ল না সুনন্দার। সবাই অত্যন্ত সিরিয়াস। সদ্য বিকেলের আলো গায়ে মেখে ডানদিক বাঁদিকে হেঁটে যাচ্ছে লোকগুলো। কারও হাতে ছোট চটের ব্যাগ, কেউ আবার সাইকেলে চেপে। মাঝে মধ্যে ক্রিং ক্রিং শব্দ ভেসে আসছে। সাইকেলের ঘণ্টির এই আওয়াজটা বেশ মনোরম। মাঝে মাঝে মন খারাপের মধ্যেও যেন এক টুকরো শান্তি দিয়ে যায়।

চুলটা বেঁধে নিয়ে ছাদের আরেক দিকে এসে দাঁড়াল সুনন্দা। এদিকটা বাড়ির সামনের দিক। সেখানে তাকিয়ে একটু অবাক হল সুনন্দা। নীলাদ্রিকে চোখে পড়ল। সেই সঙ্গে সেদিনের বয়স্ক পুলিশ অফিসারটি আর একজন কনস্টেবল। নীলাদ্রি তাদেরকে কিছু বোঝাতে চাইছে অথচ তারা বুঝছেন না। দেখে মনে হয় কোনো একটা ব্যাপারে চমকে গেছে নীলাদ্রি। এত হাত পা নেড়ে ভো সে কথা বলে না। আজ তাহলে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে কেন?

কৌতূহলটা বেড়ে উঠতে নিচে নেমে এল সুনন্দা। ইদানীং সিঁড়ি দিয়ে আর দেখে শুনে নামতে হয় না তাকে। ওঠানামা করতে করতে বেশ অভ্যাস হয়ে গেছে।

নিচে কিন্তু নামতে হল না। এতক্ষণে পুলিশ অফিসারটি নীলাদ্রিকে নিয়ে উপরে উঠে এসেছেন। সুনন্দা জিজ্ঞাসু চোখে তাদের দিকে তাকাতে একটা পেশাদার হাসি হেসে শর্মা বললেন, “এই যে আপনার সঙ্গেই একটু দরকার ছিল।”

“কীসের ব্যাপারে বলুন তো?”

“আপনাদের এই বারান্দায় বেশ হাওয়া দেয়। চলুন গিয়ে দাঁড়ানো যাক। কথাও বলে নেওয়া যাবে সেই ফাঁকে।”

দালানের উপরে ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তিনজনে। মিহি হাওয়ার ঢেউ ছাদ ডিঙিয়ে এখানেও এসে পড়েছে। নীলাদ্রি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল শর্মার দিকে। শর্মা দু’জনের মুখেই একবার চোখ বুলিয়ে আবার হেসে বললেন, “অত ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল শুধু।”

“হ্যাঁ, করুন না।”

“অতীনের ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের কী মতামত?”

নীলাদ্রি উত্তর দিল, “আমার তো এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না। বিশেষ করে এসে দেখার পর…”

“আর আপনার কী মনে হয়, মিসেস স্যান্যাল?”

সুনন্দা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকে, চশমাটা চোখের উপর ঠেলে দ্যায় সে, “আমার কী মনে হবে, একটা বারো বছর এর বাচ্চাকে ওই ভাবে খুন করতে পারে কেউ সেটা ভাবলেই এখনও চোখের পাতা এক করতে পারি না।”

“মানে আপনি খুনই বলছেন। আত্মহত্যা বলছেন না? অবশ্য ডেডবড়ি থেকে আমাদেরও তাই মনে হয়ছিল। কিন্তু… কেন হল বলুন তো খুনটা? “

“আ… আমি কী করে জানব?” আজ এই মুহূর্তে আচমকাই সুনন্দার আত্মবিশ্বাস একদম তলানিতে গিয়ে লেগেছে।

“খুনের কোনো রিজেনই থাকতে পারে না।” নীলাদ্রি পাশ থেকে বলল, “বিশেষ করে ওইভাবে গায়ের ঝাল মিটিয়ে।”

“সেই জন্যেই আমাদের মনে হচ্ছে খুনি হয়তো কোনো পুরনো রাগের কারণে করেছে খুনটা। মানে প্রতিহিংসা।”

“একটা কিশোরের উপর কার এত প্রতিহিংসা থাকতে পারে?”

বাইরের দিকে তাকিয়ে শর্মা বললেন, “এমনও হতে পারে রাগটা তার উপর ছিল না। ছিল তার বাবা-মায়ের উপরে। সন্তানের মৃত্যুর শোক ঠিক কেমন সেটা জানাতেই করা হয় খুনটা।”

“এসব আপনি আমাদের কেন বলছেন?” এক পা এগিয়ে আসে সুনন্দা। এতক্ষণে জোর এসেছে তার গলায়। তার শেষ কথাটায় একটা গনগনে ভাব লুকিয়ে ছিল। সেটা বুঝতে পেরেই প্রসঙ্গটা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন শৰ্মা, “নাথবাবুদের সঙ্গে আপনাদের আলাপ হয় ঠিক কীভাবে?”

“আমার এক ছাত্রের কাছ থেকে জানতে পারি।” আবার গলা স্বাভাবিক হয়ে যায় সুনন্দার।

“সেই স্টুডেন্টের মুখে ওনাদের কথা শুনেছিলেন আগে?”

“না, মেয়েটি নিজে থেকেই এসে জানায় যে এক দম্পতী তাদের মেয়েকে দিন দশেকের জন্যে কারও কাছে রেখে যেতে চান।”

“আপনারা ছাড়াও আরও লোকজন নিশ্চয়ই অ্যাপলাই করেছিল তার জন্যে, সেটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আপনাদেরই কেন পছন্দ করলেন বলুন তো তারা?”

“সেটা আমরা কী করে জানব?” মুখ তুলে বলল সুনন্দা।

“মানে ব্যাপারটা পিওরলি কো-ইন্সিডেন্টাল বলতে চাইছেন?”

“কীসের কো-ইন্সিডেন্স?” নীলাদ্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শর্মাকে। তিনি কিন্তু মুখ ঘোরান না। তীক্ষ্ণ চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সুনন্দার দিকে। সে মুখ নামিয়ে নিয়েছে। কপালের শিরাটাকে বাইরে থেকেও দপদপ করতে দেখা যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের আওয়াজ বুঝি শোনা যাচ্ছে এখন। ধীরে ধীরে মুখ তুলল সুনন্দা, “হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। নামটা মনে ছিল আমার। ভেবেছিলাম একই নামের অন্য কেউ। পরে যখন জানলা- ক্যাব সার্ভিসে ছিলেন…”

“তখনই আপনার মাথায় প্রতিহিংসার খেয়ালটা আসে?”

একটা থমথমে নীরবতা নেমে আসে সুনন্দার মুখে। এক পলকের জন্যে জ্বলে ওঠে চোখ দুটো। গালের দু’পাশে ঝুলে থাকা চুলগুলো সরিয়ে মুখ তোলে সে, পরিষ্কার নিটোল মুখ, একফোঁটা জল নেই চোখের কোণায়। বরঞ্চ একটা উজ্জ্বল ঝকমকে আগুন খেলা করছে যেন সেখানে, “অতীনকে আমি খুন করিনি। ও খুন হয়েছে বলে খুশিও হইনি। কিন্তু সেদিন সকালে ক্ষেত্রমোহন আর ওর বৌকে পুত্রশোকে কাঁদতে দেখে আমি খুশি হয়েছিলাম। ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে হেসেছিলাম। বেশ করেছি। তার জন্যে আমি এতটুকু অনুতপ্ত নই। আমার মেয়েকে আমি শনাক্ত করতে পারিনি। ওর মুখটা আর চোখ-নাক-মুখ-ঠোঁট বলে আলাদা করে কিছু ছিল না, সব একসঙ্গে মিশে গেছিল…”

কথাগুলো বলতে বলতে বারান্দার রেলিঙটা চেপে ধরেছিল সুনন্দা। আর সেখানে না দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে ভিতরে চলে গেল সে। নীলাদ্রি এতক্ষণে খানিকটা বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। সে একটু সরে এসে বলল, “দেখুন আমরা এখানে আসার আগে তো কিছুই জানতাম না। কারা এখানে থাকে না থাকে সেটা আসার পরে ও জেনেছে, আর আমি তো প্রায় কাউকেই চিনি না।”

শর্মার মুখের রেখাগুলো এতক্ষণে মিলিয়ে গেছে, তিনি ক্লান্ত স্বরে বললেন, “ব্যাপারটা কো ইন্সিডেন্স বলে মানতে পারছি না কিছুতেই। কেউ যেন ইচ্ছা করেই এ বাড়িতে পাঠিয়েছে আপনাদেরকে।”

“আপনি তাহলে নাথবাবুদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

“তেনারা তো আপাতত এদেশে নেই। ফলে ফোনে যোগাযোগ করাটা একটু মুশকিলের হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের কাছে তো ফোন করেন নিশ্চয়ই।”

“হ্যাঁ, আপনি শশাঙ্কবাবুর কাছেও পেয়ে যাবেন।”

মাথা নাড়ালেন শর্মা। তারপর কি যেন ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন বারান্দা দিয়ে। ব্যাপারটা আরও জট পাকিয়ে গেল। এই মোটিভটা ছাড়া আপাতত আর কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য সুনন্দা সান্যাল মিথ্যে বলে থাকতে পারেন। কিন্তু তার দীর্ঘ জীবনের অপরাধীদের নাড়াচাড়ার অভিজ্ঞতা বলছে সুনন্দা সান্যাল সত্যি বলছে। তাহলে কী হতে পারে?

*****

শশাঙ্ক দড়িটা ধরে দাঁড়িয়েছিল বাইরেটায়। একটু দুরে মালতী একটা বড় পাথরের থামের সঙ্গে দড়ির একটা প্রান্ত বেঁধেছে। তারপর এসে দাঁড়িয়েছে কুয়োর এককোণায়। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখছে ভিতরে। এর আগে বেশ কয়েকবার শশাঙ্কের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেছে তার। সমস্ত ব্যাপারটা দু’জনের কেউই বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটার কি মাথা খারাপ? সারাদিন দেখা পাওয়া যায়নি এদিকে রাতে এসেছে পুরনো কুয়োয় নেমে খোঁড়াখুঁড়ি করতে? কাজ নেই নাকি?

কুয়োর ভিতর থেকে মাঝে মাঝে টর্চের আলো উপরে ঝলক দিয়ে যাচ্ছে। ভিতর থেকে মানুষের পায়ের আওয়াজ আসছে। মাঝে মধ্যে কুয়োর টিনের গায়ে টোকা লেগে টুং টুং করে শব্দ হচ্ছে। সেটা ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক ছাপিয়ে মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে।

একটু পরে একটা হ্যারিকেন নিয়ে দু’জন মানুষকে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে একবার সেদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মালতী দেখতে পেল দু’জনকে— মধুবাবু আর পায়েল।

পায়েলকে আজ সারাদিন বাড়িতে দেখা যায়নি। দুপুরে স্নান করে কোমা। বেরিয়ে গেছিল সে। মিনিট দশেক আগে ফিরে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়েছিল। মধুবাবুর মুখে কুয়োর ভিতরে লোক নেমেছে খবর পেয়ে বিছানা থেকে উঠে এসেছে।

একটু অবাক লাগল মালতীর, সে টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি ে বললে শরীর ভালো লাগছে না। উঠে এলে কেন?”

পায়েল ধরা গলায় বলল, “আসলে কাল এই কুয়োর ধারে একটু দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সোনার আংটিটা আঙুল থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল। দেখি যদি পাওয়া যায়।”

“সোনার আংটি! পেলেও দেবে না।”

“সেকি! পুলিশের এত খারাপ দিন এসেছে বলছ?”

“হয়তো খেয়ালই করবে না।”

“কিন্তু কী খুঁজছে বলতো?”

উত্তরের আশা না করে কুয়োর ধার বরাবর এগিয়ে গেল পায়েল। ভিতরে ঝুঁকে উঁকি মারল একবার। তারপর শশাঙ্কের দিকে ফিরে বলল, “নাইন্টি ফোরে যে লোকটা মারা যায় তাকে তুমি দেখেছিলে?”

“দেখেছিলাম। তবে মুখটা আর ভালো মনে নেই। প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা, আমারও তখন বছর কুড়ি বয়স।”

“এই ঢাকনাটা তখন ছিল না?”

“থাকত। তবে মাসখানেক মনে হয় ছিল না, আগেরটা ভেঙে নিচে পড়েছিল। নতুন স্ল্যাবের লোক ডাকা হয়েছিল। সে গড়িমসি করছিল টাকাপয়সা পছন্দ হয়নি বলে।”

“তাহলে তো সেই সময়ে কুয়োটা কোথায় আছে না জানলে যে কেউ পড়ে যেতে পারত।”

“নাঃ তখন আলো জ্বালানো থাকত কুয়োর উপরে। সেটা দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবে নিচেই কুয়ো।”

আবার কুয়োর ভিতরে মুখ বাড়াল পায়েল। তারপর নিচু গলায় বলল, “কুয়োটা খুব একটা গভীর নয়, তাই না?”

“একেবারেই না। তাছাড়া এতকাল এখানে এন্তার মাটি ফেলে ফেলে আরও উঠে এসেছে।”

কুয়োর চারপাশে ঘুরে টর্চ জ্বেলে কিছু একটা খুঁজতে থাকে পায়েল। বাইরের বেড়ে হাত বুলাতে থাকে। কিছু একটা পাবে সে নিশ্চিত। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরেও কিছু না পেয়ে কয়েক মুহূর্ত মাথায় হাত দিয়ে কি যেন ভাবল পায়েল। তারপর যে ভয়ানক কাজটা করল সেটার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না।

দু’হাতে পাঁচিলের উপরটা ধরে তার উপরে উঠে দাঁড়াল। তারপর নিচু হয়ে দড়িটা হাতে তুলে নিয়ে সেটা ধরে ঝুলে পড়ল। মালতী আর শশাঙ্ক তাকে ধরতে আসার আগেই নাগালের বাইরে চলে গেল সে। ঘটনাটার জন্যে তৈরি ছিল না কেউ। দু’জনের বুকই আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল। নিচ থেকে পুলিশ অফিসার দু’জনও চমকে ফিরে তাকিয়েছিল উপরে। পায়েলের শরীরে উপরে এখন একজোড়া টর্চের আলো।

একটু দম নিয়ে কুয়োর ভিতরের একটা খাঁজে পা রাখল পায়েল। উপরের দিকে মুখ তুলে বলল, “দেখতো শশাঙ্কদা। তোমার পিছনের আকাশে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে?”

থতমত ভাবটা কেটে যেতে পিছনে ঘুরে চাঁদটাকে একবার দেখে নিয়ে আবার সামনে তাকাল শশাঙ্ক, “হ্যাঁ যাচ্ছে, কিন্তু তুমি…”

“এবারে কুয়োর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তোমার কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি কুয়োর গায়ে ভালো করে দেখ কোনো দাগ দেখা যাচ্ছে কিনা।”

এবার উত্তরটা আসতে সময় লাগল, লতাপাতার জঞ্জাল কুয়োর গা থেকে সরাল সে। উত্তরটা দেওয়ার সময় কেঁপে গেল গলাটা, “হ্যাঁ একটা গোল দাগ আছে। মনে হচ্ছে গোল করে ফেটে গেছে।”

“ফাটেনি। ওটা আসলে একটা ছোট ঢাকনা। একসময় ওতে একটা হাতলও লাগানো থাকত, সেটা এখন ভেঙে গেছে। এক কাজ করো, লাঠি বা কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে ওটা বাইরে বের করে নাও।

“কিন্তু কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শশাঙ্ক। “আঃ, কর না। ঝুলে আছি তো।”

মিনিট দশেকের চেষ্টায় শশাঙ্ক আর মালতী মিলে সরিয়ে ফেলল ঢাকনাটা। প্রায় গোল ইঞ্চি পাঁচেকের একটা বৃত্ত তৈরি হল কুয়োর গায়ে। ঢাকনার সামনের প্যাচে কুয়োর ভিতরের দেয়াল একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে সেটা খসে না পড়ে

সেটা সরে যেতে সেই ফাঁকা বৃত্তের ভিতর দিয়ে আকাশের গোল চাঁদটাকে দেখতে পেল পায়েল। চাঁদ, বৃত্ত আর পায়েলের মুখ এখন এক সরলরেখায় আছে।

সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সরলরেখা উলটোদিকের কুয়োর দেওয়ালে যেখানে গিয়ে পড়েছে সেখানে একটা হাত রাখল পায়েল। আগের খাঁজটা থেকে পা সরিয়ে অন্য একটা খাঁজে পা রাখল। দেওয়ালের গায়ে অনেকক্ষণ কিছু একটা খুঁজল, তারপর আচমকাই হাতের এক টানে দেওয়াল থেকে একটা টিনের তক্তা সরিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে অভাবনীয় একটা ঘটনা ঘটে গেল। কুয়োর দেওয়ালের অন্ধকারের ভিতরে ফুটে উঠল আর একটা চাঁদ।

ভালো করে তাকিয়ে উপর থেকে শশাঙ্ক বুঝতে পারল সেখানে একটা আয়না রাখা আছে।

দড়ি ধরে আর একটু নিচের দিকে নেমে গেল পায়েল। তারপর কুয়োর গা থেকে যেখানে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে আসছে সেখানে আর একটা তক্তা খুঁজে নিয়ে সরিয়ে ফেলল। আর একটা আয়নার গায়ে চাঁদ ফুটে উঠল সেখানে। তবে এটা উপর থেকে দেখা যায় না।

পুলিশ অফিসার দু’জন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তক্তাটা তাদের মাথা থেকে বেশ খানিকটা উপরে। ঘাড় উঁচু করে সরানো তক্তার জায়গাটা ভালো করে দেখতে লাগল তারা। সম্ভবত বহুদিন আগে বসানো আয়নাটা। এখন তার সামনে চাদরের ঝুল পড়ে গেছে। ফলে পাতাঝরা গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে দেখার মতো দেখা যাচ্ছে চাঁদটাকে। আয়নাটা কোনোভাবে বসানো আছে দেওয়ালের গায়ে। সেটাই মন দিয়ে দেখতে লাগল তারা।

দড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এল পায়েল। একটা ছোট লাফ মেরে বেরিয়ে এল কুয়োর বাইরে। শশাঙ্ক, মালতী আর মধুবাবু অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন ওর দিকে। মধুবাবু একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “এসব কী?”

গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে পায়েল বলল, “এ বাড়ি কে তৈরি করেছিল জানি না, কিন্তু যেই করুন না কেন তার আলো নিয়ে খেলার একটা বাই ছিল।”

মালতী এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। সে কুয়োর উপরের সরিয়ে ফেলা ঢাকনার ফাঁকটায় গিয়ে মুখ রেখে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে কুয়োর ভিতরের চাঁদটার উপর দেখা গেল তার নিজের মুখের ছায়াটা।

“এ টেকনিকটা মেনলি ব্যবহার হত জল কতটা নিচে আছে সেটা দেখার জন্যে। উপরে বালতি নামানোর কপিকলের সঙ্গে তক্তাগুলোর দড়ি বাঁধা থাকত। বালতি নামালেই ধীরে ধীরে সরে যেত তক্তাগুলো। তখন বাইরের আলো রিফ্লেক্টেড হয়ে ভিতরে এসে পড়ত। ভিতরে যদি জল থাকত তাহলে বারবার প্রতিফলিত হয়ে একসময় চাঁদের ছায়াটা জলের উপরে পড়ত। তবে আমার মনে হয় সেটা আসল কারণ নয়। কুয়োর ভিতরে চাঁদের আলোকে তেরচাভাবে আয়না দিয়ে প্রতিফলিত করে নৈসর্গিক দৃশ্য তৈরি করাই ছিল আর্টিস্টের প্রধান উদ্দেশ্য। আকাশে চাঁদ রাতের একটা বিশেষ সময়ে একটা বিশেষ জায়গায় থাকলে তবেই সম্ভব হত।”

“কিন্তু এর সঙ্গে সেই পড়ে যাওয়ার ঘটনার কী সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক থাকতে পারে আবার নাও পারে। যেমন ধরুন এও হতে পারে যে খুন করেছিল সে শারীরিক ভাবে ততটা সক্ষম নয়। তার পক্ষে একটা মানুষকে ঘর থেকে অজ্ঞান করে এতদূর বয়ে আনা সম্ভব ছিল না। কোনোভাবে সে লোকটাকে এ দৃশ্য দেখানোর লোভেই টেনে আনে। ভদ্রলোক কুয়োর উপরে চাঁদ নেই অথচ ভিতরে আলো যাচ্ছে দেখে অবাক হয়ে হয়তো ঝুঁকে পড়ে নিচটা দেখার চেষ্টা করেন। তার উপরে তিনি আবার মদ খেয়েছিলেন। ফলে পায়ের উপরে জোর ছিল না, এমন সময় কেউ পিছন থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়।”

“কিন্তু কে?” শশাঙ্ক প্রশ্ন করে।

“সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। হু ডান ইট। তবে এমন কেউ যে এই বাড়ির খুঁটিনাটি জানতো। যাই হোক সেকথা ভেবে আর কাজ নেই। চলুন আমরা বাড়ির দিকে যাই।”

পুলিশ দু’জন ভিতর থেকে উঠে এসেছিল। একটু অপ্রস্তুতে পড়েছে তারা। তাদের ছাড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল চারজন। মালতী এতক্ষণের হতবাক ভাবটা কাটিয়ে পায়েলের কাছে সরে এসে বলল, “আংটিটা মিথ্যে বলেছিলে না?”

“নাগো, সত্যি একটা আংটি পড়ে গেছিল। ওটা মনে হয় আর পাওয়া যাবে না। বাড়ি গেলে বাবার কাছে ঠ্যাঙানি খাব।”

*****

মধুবাবুর ঘরে এসেই বসল চারজনে। তিনি পাখাটা চালিয়ে দিলেন। মালতী চা করে আনল সবার জন্যে।

চায়ে চুমুক দিয়ে মধুবাবু বললেন, “তুমি বুঝলে কী করে বলতো জায়গাটায় ওটা আছে?”

“এটুকু মনে হচ্ছিল যে লোকটা মারা গেছে সে নিশ্চয়ই কিছু দেখতে গেছিল ওখানে। তারপর এ বাড়ির কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখলাম আলো ছায়ার খেলা বেশ কয়েক জায়গায় আছে। তাই গেস করলাম আর কি।”

“বেশ বুদ্ধি তো তোমার।” প্রশংসার হাসি হাসলেন মধুবাবু। পায়েল বিস্কুটে একটা কামড় দিয়ে বদলে ফেলল প্রসঙ্গটা, “আচ্ছা এ বাড়ি কে তৈরি করেছিল সেটা তো আমরা জানি না। কিন্তু কেন তৈরি হয়েছিল সেসব জানা যায় কিছু? মানে রিউমার বা যাই হোক না কেন।

মধুবাবুকে থামিয়ে দিয়ে শশাঙ্ক বলল, “জমিদারীর মোট যে চারটে বিল্ডিং আছে তার সব ক’টা একই সময় তৈরি হয়নি। যেমন আমাদের এদিকটা তৈরি হয়েছে সব শেষে। আর উত্তরের অন্দরমহলটা সবার আগে।”

“ভূপতি দত্তের বাবা নিলামে এ জমিদারীটা কিনে নেবার আগে, বা ধরুন ব্রিটিশ সরকারের থেকে কোনো কাজের জন্যে উপহার হিসেবে পাবার আগে নিশ্চয়ই অন্য কোনো জমিদাররা থাকতেন এখানে। কোম্পানি যাদেরকে উৎখাত করে। তাদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না?”

“না। ওই পিরিয়ডটা একেবারে ব্ল্যাঙ্ক।”

“ব্যাপারটা স্পুকি, তাই না?” চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে পায়েল বলে, “মাত্র পঞ্চাশ বছরের হয়তো ব্যাবধান কিন্তু একটা জমিদার বংশ সম্পর্কে – প্রায় কিছুই জানা গেল না। মনে হয় ঠিক যেন জোর করে কেউ নামটা ঢেকে দিয়েছে। এরকম ঘটনা কখন দেখা যায় মধুবাবু? ইতিহাস বই কী বলছে?” মধুবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কলোনিয়াল রুলে নতুন করে ইতিহাস লেখা হলে আগের জমানায় যা যা ভালো কিছু ছিল সবই ইতিহাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।”

“অথবা এমন কিছু তথ্য যা শাসকের বিপদ ডেকে আনতে পারে।”

“তুমি কি বলছ এ বাড়িতে তেমন কিছু ছিল বলেই সেটার কথা লোককে জানতে দেওয়া হয় না।”

“আমি সেটা বলছি না, আমি সেটা জানি। তবে যেটা অনেক ভেবেও কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না সেটা হল চাণক্য দত্তের সেই প্রেমিকার খুনটা। সেটার সঙ্গে এ ঘটনার কোথাও একটা যোগাযোগ আছে…”

পায়েল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় সনাতন ঘরে ঢুকল। সে একবার মালতীর দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়ে পায়েলকে বলল, “তোমাকে দিদিমণি ডাকচেন। বলচেন সারাদিন দেখা কর নাই।”

“এ বাবা!” মাথায় হাত দিয়ে জিভ কাটে পায়েল, “ভুলেই গেছিলাম একদম। আচ্ছা, ঘরে কে কে আছে গো?”

“দিদিমণি আছে। দাদা তুলিদিদিকে নিয়ে বেরিয়েছেন।”

পায়েল খুশি হল। বিবাহিত পুরুষদেরকে সে মোটেই পছন্দ করে না। এতদিন সুনন্দার সঙ্গে তার একটা গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ওই লোকটা এসে পড়াতে সব কিছুর বারোটা বেজে গেল।

ঘর থেকে বেরিয়ে মাঝের প্যাসেজ দিয়ে সুনন্দার ঘরে চলে এল সে। দরজা ঠেলতেই দেখল বিছানার উপর দুটো হাত ছড়িয়ে পড়ে আছে সুনন্দা। কাছে যেতেই চোখে পড়ল সুনন্দার চোখের কাজল ঘেঁটে আছে। একবিন্দু জমা জল টিউবের আলোয় চকচক করছে এখন সেখানে।

সুনন্দার কপালে একটা হাত রাখল পায়েল। চোখ মেলে তাকাল সে। তারপর তড়িঘড়ি চোখের জলটা মুছে নিয়ে বিছানার উপরে উঠে বসলা “ওঃ, তুমি! সেই কখন বলেছিলাম সনাতনদাকে।”

“কী হয়েছে বলতো তোমার?” বিছানার একপাশে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করে পায়েল, “জ্বর হয়েছে? কাল রাতেও তো এরকম খারাপ অবস্থা ছিল না চেহারার।”

“সেরকম কিছু না। সন্ধে থেকে একটু ইমোশানাল হয়ে পড়েছিলাম।”

“কেন বল তো?”

“পুলিশ এসেছিল। একটা ব্যাপার নিয়ে জিজ্ঞেস করল। আমিও ধরে রাখতে পারলাম না নিজেকে।”

“কী ব্যাপার? সেদিন রাতে যে আমরা বাইরে গেছিলাম…”

“ওসব না। আমার মেয়ের ব্যাপারে।”

“রিন্টি এসবের মধ্যে আসছে কী করে? লোকগুলো পাগল নাকি?” নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চাপা গলায় সুনন্দা বলে, “এখানে আসার ক’দিন পরেই জানতে পারি রিন্টিকে যিনি গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যান তিনিই মোহনবাবু। পুলিশ ভাবছে সেই রাগেই ওর ছেলেকে খুন করেছি আমি।” শেষ কথাগুলো বলতে বলতে সুনন্দার গলা বুজে আসে। আর একবার শাড়ির আঁচল দিয়ে জল মোছে সে।

“এটা… এটা তো বলোনি আমাকে…” একটু পিছিয়ে আসে পায়েল। প্রায় না শোনা যাবার মতো গলায় বলে কথাগুলো। তার মুখে সহানুভূতির রেখাগুলো মুহূর্তে মিলিয়ে যায়।

“কী করতাম বলে? কোনোভাবে যদি আর পাঁচটা লোকের কানে বেত সেটা আরও অস্বস্তিকর হত।”

“আমাকে বলতে পারতে অন্তত। ঘটনাটা যখন বলতে পেরেছিলে অপরাধীর নামটা জানাতে পারতে একবার।”

সুনন্দা আর কিছু বলে না। উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ফোঁপানোর আওয়াজ কানে আসে পায়েলের। সে গলাটা একটু নরম করে সুনন্দার কাঁধে হাত রেখে বলে, “ছাড় না এসব। আর দু-তিনদিনের তো ব্যাপার। তারপর এইসব লোকজন, পুলিশের মাঝে আর থাকতে হবে না। আজকে জানো ত তো সেই ফাদারকে ভালো মতো কড়কে দিয়েছি… শুনছো?”

“আমার জানার দরকার নেই।” ওপাশ থেকে ভেজা স্বর ভেসে আসে। পায়েল এবার জোর করে সুনন্দার পিঠের উপরে প্রায় ঝুঁকে পড়ে, “ও সুনন্দাদি। রাগ করলে সুনন্দাদি? আরে আমি বুঝেছি তুমি কেন বলোনি?”

“তুমিও সন্দেহ করছো আমাকে?”

“একটুও না। আরে তোমার মতো ভীতু মানুষের পক্ষে খুনটুন করা সম্ভব নয়। বড়োজোর লোকের কবর ভেঙে মরার পাঁজরে খোঁচা দিতে পারো।”

“তুমি এখন যাওতো, ফালতু বকে মেজাজ গরম করতে এসেছে।”

“আরে না না। শোন না। সেদিন যে মসোলিয়ামটা আমরা ভাঙলাম তার ভিতরে তিনটে ক্রিপ্ট ছিল। মনে আছে?”

কোনো উত্তর দিল না সুনন্দা। মুখ ঘোরাল না। পায়েল আর একটু ঝুঁকে পড়ে উৎসাহের সঙ্গে বাকিটা বলতে থাকল, “আসলে এলিজাবেথ মসক্রপের আর একটা বোন ছিল, জানো? যমজ বোন ছিল ওরা। ফাদারের কাছ থেকে একটা ফ্যামিলি রেকর্ড পেয়েছিলাম। তাতেই দেখলাম।”

“যমজ!” এই প্রথম কথা শোনা গেল সুনন্দার মুখে। ঘুরে বসতে গিয়েও বসল না সে।

“ইয়েস। যমজ। এর নাম পারসিলা মসক্রপ। দু’জনের বাবা জর্জ মসপ ব্রিটিশ আর্মিতে কমান্ডার ছিলেন।।”

“এসব জেনে আমি কী করব? ছিলেন তো ছিলেন।”

“উঁহু, আমার প্রশ্নটা তুমি বুঝতে পারছ না। বাবা, মা এবং দুই মেয়ে মিলে চারজনের সংসার, তাহলে ক্রিপ্ট তিনটে ছিল কেন? বাকি একজন গেলু কোথায়? কার জন্যে ক্রিপ্ট বানানো হল না?”

একটু ভেবে ঘটনাটা মেলানোর চেষ্টা করে সুনন্দা, “এমনও হতে পারে একজন দেশে ফিরে গেছিলেন। তাই তার মৃতদেহ আর রাখা হয়নি।”

“আমি মৃতদেহের কথা বলছি না। বলছি মৃতদেহের বাক্সের কথা। বিয়ে বাড়িতে ব্যাচ খেতে বসার আগে সব চেয়ারের সামনেই প্লেট রাখা হয়। কারণ কোন চেয়ারে লোক বসবে আর কোথায় বসবে না সেটা আগে থেকে জানা সম্ভব না।”

সুনন্দা আর কি বলবে ভেবে পায় না, তার পিঠের উপর দুলতে থাকে পায়েল। মন দিয়ে কিছু ভাবছে সে। সুনন্দা শরীরটা এপাশ ওপাশ করে তাকে কাঁধ থেকে নামানোর চেষ্টা করে, বিফল হয়ে বলে “আচ্ছা একটা কথা ভাবছি। ১৮২০ নাগাদ চার্চের পক্ষ থেকে একটা ছবি তোমার প্রণম্য গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডমাদারকে দেওয়া হল। আর তাতে ছলে বলে কৌশলে বলা হয় যে আমার ঠাকুমাই এলিজাবেথ মসক্রপের রিবার্থ। এদিকে তর্কের খাতিরে ধরে নাও এলিজাবেথ মসক্রপের রিবার্থ হবে বলেই কেউ তার ক্রিপ্টটা সমাধি থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু তাহলে আজ আমরা যার কফিন খুললাম সেটা তাহলে কে?”

“এলিজাবেথের যমজ বোন হতে পারে…” ধীরে ধীরে বলল পায়েল। উত্তরটা নিজেরই পছন্দ হল না। মাথা নাড়াতে নাড়াতে সুনন্দার পিঠ থেকে উঠে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মেঝের উপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসেছিল সুনন্দা। তার দুটো হাঁটুর উপরে হাত রাখল।

“একটা বড় মিস-কমিউনিকেশান হয়েছে, জানো? মানে ছবিতে সংকেত এঁকে লোকটা যা বোঝাতে চেয়েছিল আমরা তার থেকে উলটো কিছু বুঝেছি।”

এবার সুনন্দার গালে একটা চেরা হাসি ফুটে উঠল, “যাই বল। আমার কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে তুমিই এলিজাবেথ মসক্রপের পুনর্জন্ম। ওই জন্যেই তোমাকে তোমার গ্রেট গ্রেট গ্রেটের মতো দেখতে হয়েছে।”

পায়েল হা হা করে হেসে বলল, “বা ধর তুলিকে যদি অ্যাডাপ্ট করা হয়ে থাকে তাহলে তুলি মসক্রপের পুনর্জন্ম।”

“দাঁড়াও। আসলে জিজ্ঞেস করে দেখব কিছু মনে করতে পারে কিনা।”

গম্ভীরভাবে মুখ নামিয়ে পায়েল বলল, “দেখ, আমার মনে হয় এই পুনর্জন্ম কথাটা বুঝতে একটু ভুল হচ্ছে আমাদের। লোকটা যা বোঝাতে চেয়েছিল আমরা ঠিক সেইটার বদলে অন্য কিছু বুঝছি।”

সুনন্দা আর কিছু বলল না, একটা হাতে পায়েলের থুতনিটা তুলে ধরে। দৃঢ় গলায় বলল, “পায়েল। আমি খুনগুলো করিনি।”

পায়েলের লম্বা চোখের পাতা একবার নিচে নেমে এল, ধীরে ধীরে শে বলল, “আমি জানি।”

“না, তুমি শুধু বিশ্বাস কর হয়তো। জানো না।”

“জানি।” পায়েলের গলায় স্বর কঠিন শোনায়।

“কী করে জানলে আমি করিনি?”

“কারণ…” সুনন্দার কোলের উপর মাথা রাখে পায়েল, “আমি জানি কে করেছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *