শেষ অধ্যায়
জমিদারবাড়ির সদরের ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়েছিল ট্যাক্সিটা। এতক্ষণে বেশ কয়েকবার হর্ণ বাজিয়েছে সে। এমনিতেই এদিকে সন্ধে হলেই গাড়ি-ঘোড়া উধাও হয়ে যায়। এখন ঘড়িতে রাত সাতটা বেজেছে প্রায়।
চতুর্থবার হর্ণের আওয়াজ শুনতেই জমিদারবাড়ির সদর দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল শশাঙ্ক। তার হাতে একটা বড়সড় স্যুটকেস। চাকা লাগান স্যুটকেসটা টেনে এনে ট্যাক্সির খোলা ডিকিতে তুলে দিল সে।
মিনিট খানেকের মধ্যেই মালতী আর সুনন্দাকে দেখা গেল দরজায়। ভিতরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখাদেখি করল তারা। কাকে যেন ডাকল। তারপর বেরিয়ে এসে দাঁড়াল শশাঙ্কের ঠিক পাশে।
“আপলোগ যাইয়েগা?” ট্যাক্সিওয়ালা মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
“হামলোগ ছোড়নে যায়েঙ্গে।” শশাঙ্ক উত্তর দেয়।
“জলদি কিজিয়ে যারা।”
একটু পরে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল পায়েল। কাঁধে সবসময়ের মতো কাপড়ের ব্যাগ। বেশ রংচঙে একটা জামা পরেছে আজ। সঙ্গে কালো জিনসা খোলা চুলের ঢল নেমেছে পিঠের উপরে। একবার চোখ তুলে ট্যাক্সিটা দেখে নিয়ে দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে এল সে। শশাঙ্ক উঠে বসেছিল গাড়ির সামনের সিটে। মালতী আর সুনন্দা উঠে বসতে পায়েলও বসে পড়ল পিছনের সিটে। দরজা বন্ধ হয়ে যেতে ট্যাক্সিওয়ালা গাড়িতে স্টার্ট দিল।
মালতী পায়েলের দিকে তাকাল, “আবার কবে আসবে দিদি?”
“এবছর ফেল করলে বাবা যদি ঠেঙিয়ে না মেরে ফেলে তাহলে সামনের বছর নিশ্চয়ই।”
“আর আমার বাড়ি?” সুনন্দা জিজ্ঞেস করে।
“চিলি চিকেনে যা ঝাল দিয়েছিলে! এত রাগ আমার উপর আগে বললেই পারতে, বাপ রে বাপ! আর ওমুখো হচ্ছি না আমি।”
হেসে ওঠে সুনন্দা, বলে, “আমাকে যে বলেছিলে ফ্রাইড রাইস খাওয়ালে আশীর্বাদ করবে?”
“ওঃ হ্যাঁ, একদম ভুলেই গেছিলাম।” পায়েল আঁতকে উঠে ব্যাগের ভিতরে হাত চালিয়ে খোঁজাখুঁজি করে কিছু একটা বের করে আনে। কাগজে মোড়া জিনিসটা সুনন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই যে এটা তোমার জন্যে…”
“কী এটা?” জিনিসটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।
“খুলেই দেখো না।”
কাগজের মোড়কটা খুলেই কিন্তু অবাক হয়ে যায় সুনন্দা –একটা মেডেলের মতো দেখতে ধাতব রিং। বেশ পুরনো হয়ে গেছে। মেডেলের উপরে কিছু একটা খোদাই করা আছে। সম্ভবত একটা মানুষের মুখ, তবে সময়ের ছাপ লেগে আর কিছুই আলাদা করে বোঝা যায় না।
“কোথায় পেলে?” মালতী আর সুনন্দা প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে।
“এলিজাবেথ মসক্রপের ফেট রিং।”
“তার মানে তুমি ওখান থেকে এটা…”
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় পায়েল, “আহা! এলিজাবেথ মসক্রপের ফেট রিং দিয়ে আর কী হবে। ও বরঞ্চ পুতুলগুলো নিয়ে খেলুক।”
“কিন্তু কী হয় এটা দিয়ে?”
‘সেকালের বাচ্চাদের বিছানার নিচে রেখে দিতো বাবা-মায়েরা। এই ফেট রিং তাদের দুঃস্বপ্ন শুষে নিত। আপাতত তোমার কাজে লাগবে। যতদিন না ঠিকঠাক হচ্ছো ততদিন তোমার সব খারাপ স্মৃতি শুষে নেবে এটা। তবে আমি জানি একদিন আর এটার দরকারই হবে না তোমার। তখন না হয় অন্য কাউকে দিয়ে দিও।”
আর কিছু না বলে সেটাকে মালতীর হাতে দিল সুনন্দা। মালতী কিছুক্ষণ সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখে আবার ফেরত দিয়ে দিল।
স্টেশানে এসে দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটা। পায়েল টিকিট দেখে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। স্যুটকেসটা উপরের বাঙ্কে তুলে দিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বেরিয়ে এল ট্রেনের দরজায়। সুনন্দা আর মালতী এখনও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। ট্রেন ছাড়ার আগে যাবে না তারা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে শশাঙ্ক সে একটু চেঁচিয়ে বলল, “বাড়ি পৌঁছে একবার জানিয়ে দিও আমাদের।”
পায়েল হাত তুলে আশ্বস্ত করল তাকে। ট্রেনের বেসিনের উপরের আয়নাটায় নিজের মুখটা একবার ভালো করে দেখে নিল। সুনন্দা একটু এগিয়ে এসে বলল, “চলন্ত ট্রেনের দরজায় ঝুলে বীরত্ব দেখিও না। রিজারভেশানটা এমনি এমনি করা হয়নি।”
“ভিতরে বসলে হাওয়া পাওয়া যায় না।”
“এই চেহারায় বেশি হাওয়া দিলে উড়ে যাবে…” ভুরু কুঁচকে বলল সুনন্দা। চশমাটা নাকের উপর থেকে চোখে তুলে আনল।
একটু একটু করে চলতে শুরু করেছে ট্রেনটা। কামরাটা সুনন্দা আর মালতীকে ছেড়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গেছে। পায়েল দু’জনের উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে গলা তুলে বলল, “আমি চললাম…”
সুনন্দাও হাত নাড়ল। স্টেশানের শেড ছাড়িয়ে সন্ধের ফিকে অন্ধকারের বুকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল ট্রেনটা…
-: সমাপ্ত :-