তারুণ্য ধর্ম
রোজ সকালে উঠে আমাদের এই অতি পুরাতন প্রকৃতি সুন্দরীর সজ্জাটা যখন দেখি তখন এক বারও কি মনে হয় ইনি আমাদের বড়ো প্রাচীনা বড়ো প্রবীণা বড়ো মাননীয়া ঠাকুমাটি? চুপি চুপি বলছি, বরং মনে হয় ইনি ঠাকুমার নাতবউ বুঝি-বা! এই প্রথম এঁর সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল, শ্রীঅঙ্গে এঁর নববধূর সাজ।
আজকের এই ষোড়শী প্রকৃতির দিকে চেয়ে চোখে আর পলক পড়ে না। চোখের অপরাধ কী বলো? চোখ তো নিত্যনূতনের প্রেমিক। যে তার প্রেমের মূল্য বোঝে সে আপনাকে নিত্যনূতন করে দেখায়। আমাদের এই প্রকৃতি ঠাকুরুন সেই সংকেতটি জানেন বলে এঁর কোটি মন্বন্তরের বয়সটাকে এমন বেমালুম কাঁচাতে পারেন যে আমাদের তো কিছুতেই বিশ্বাস হয় না ইনি আমাদের চেয়ে একটা দিনেরও বড়ো। এই চিরযৌবনা উর্বশী একদিন বিক্রমের সমবয়সিনি ছিল, আজ অর্জুনের সমবয়সিনি। এর কাছে পূর্বপুরুষ উত্তরপুরুষ সমানই, চিরকাল এ পুরুষের প্রেয়সী।
যা সনাতন তা যুগে যুগে নূতন। পুরাতনত্বের জাঁক সে করে না। তার বয়স কত সে-পরিচয় তার মুখে লেখা নেই; সে-পরিচয়ের জন্যে মাটি খুঁড়তে হয়, পাথর মাপতে হয়, ভূতত্ত্ব খ-তত্ত্বের পাঁজি পুরাণ ঘাঁটতে হয়। এত করেও প্রমাণ হয় না এই অনাদিকালের অসীমা প্রকৃতির বয়স কত, যার বয়সের হিসাব চলে সে এর এক এক প্রস্থ সাজ, এক-একটা দিনের বহির্বাস। কোটি গ্রহ-তারার কোটি বৎসর পরমায়ু অখন্ড সৃষ্টির অনাদ্যন্ত আয়ুর তুলনায় তুচ্ছ।
যা সনাতন তা নূতনের মধ্যে ফিরে ফিরে সত্য, ফিরে ফিরে স্বপ্রকাশ। মিথ্যা কেবল ওই পুরাতনটা, ওই ছাড়া শাড়িখানা, ওই ঝরাপাতা মরা পাতার রাশ। ও যখন নূতন ছিল তখন সত্য ছিল, তখন সনাতন ছিল। ওর দিন ও নিঃশেষে ভোগ করেছে, ওর জীবনের একটাও দিন ও বাদ দেয়নি। এখন তবে ও কীসের অধিকারে ভূত হয়ে চেপে বসতে চায়, চিরদিনের হতে চায়? যে বারে বারে নূতন হয়, জন্মে জন্মে বাঁচে সে তো পুরাতন পাতা নয়, সনাতন সজ্জা, সে তো যৌবনান্তিম জরা নয়, যৌবনায়মান প্রাণ। প্রকৃতিরই ষোড়শী হবার অধিকার আছে, আমাদের ঠাকুমার নেই। তবু যখন ঠাকুমা অবুঝের মতন আবদার ধরেন, ‘নাতির মধ্যে আমি বাঁচব’, তখন সে-আবদারকে আমরা অধিকার বলিনে, সে অনধিকারচর্চাকে আমরা উৎপাত বলি। আমরা বলি, ‘বড়ো দুঃখিত হলুম ঠাকুমা। কিন্তু নিজেদের জীবনটাকে আমরা নিজেরাই বাঁচাব ঠিক করেছি। আমরা চিরপুরুষের নব অবতার, আমরা পূর্বপুরুষের পুনর্মুদ্রণ নই ঠাকুমা।’
অনাদি অনন্তকালের শাখায় যে পাতাগুলি এক বসন্তে ধরেছিল তারা যখন বলে, ‘আর বসন্তের পাতাগুলোর আমরা পূর্বপুরুষ, তাদের মধ্যে আমরা নিজেদের দেখব; ‘‘ন হি পুত্রস্য কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি আত্মনস্তু কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি;’’ তাদের আর কোনো কর্ম নেই; কেবল আমাদেরই প্রীত্যর্থে প্রাণধারণ; তাদের আর কোনো ধর্ম নেই, কেবল পিতা স্বর্গঃ আর জননী স্বর্গাদপি’ তখন নূতন পাতাদের হাসি পায়। তারা বলে, ‘তোমাদের সঙ্গে আমাদের কীসের সম্বন্ধ? শুধু পরম্পরাগত সম্বন্ধ বই তো নয়! তোমরা আগে বেঁচেছ, আমরা পরে বাঁচছি। অনাদিকালের অনুপাতে আগে বাঁচার মূল্য যা অনন্তকালের অনুপাতে পরে বাঁচার মূল্য তাই। তোমাদের মধ্যে যদি আমরা না বেঁচে থাকি তো আমাদের মধ্যে কেন তোমরা বাঁচবে? আমাদের ফরমাশ যদি তোমরা না খেটে থাক, আমাদের প্রত্যাশা যদি তোমরা না পুরিয়ে থাক, আমাদের সাধ যদি তোমরা না মিটিয়ে থাক তবে তোমাদের ফরমাশ কেন আমরা খাটতে যাব, তোমাদের প্রত্যাশা কেন আমরা পুরাতে যাব, তোমাদের সাধ কেন আমরা মেটাতে যাব? আমাদের হাতে মাত্র একটি বসন্ত, একটু বর্তমান। এটুকু জীবনক্ষণ আমরা নিজেদেরই ইচ্ছামতো নিজেদেরই সাধ্যমতো বাঁচতে চাই, আমরাই আমাদের কাছে সকলের চেয়ে সত্য। যা যায় তা পুরাতন, তা প্রাণ-নিঃস্ব। যা রয় তা সনাতন, তা চিরপ্রাণ। আমাদের মধ্যে পূর্বপুরুষের কিছুই রইলো না, চিরপুরুষের সকলই রইলো।’
‘কিন্তু আমরা যে তোমাদের প্রাণ দিয়েছি, জ্ঞান দিয়েছি, সমাজে স্থান দিয়েছি!—’
‘দিয়ে দেবার আনন্দ উপলব্ধি করছ। পিতা হবার, গুরু হবার, সমাজসেবী হবার সুযোগ সৌভাগ্য লাভ করছ। সে-উপলব্ধি ও সে-লাভ আমাদের কাছ থেকে লব্ধ। ঋণগ্রহণ করেই আমরা ঋণশোধ করেছি, পিতৃঋণ ঋষিঋণ দেবঋণ থেকে আমরা মুক্ত।’
‘তোমাদের যে আমরা ভালোবাসি, সে ঋণ থেকে!’
‘সে-ঋণ দুই তরফা। তা বলে ভালোবাসার নামে অনধিকারচর্চা চলবে না। আগে স্বাধীনতা, তারপরে প্রেম।’
নূতন পাতারা বলে বটে একথা, কিন্তু বৎসর না ঘুরতেই ভুলে যায়। পরের বসন্তে তাদেরও মুখে সেই প্রাচীনতম বুলি। এমনি করে যুগের পর যুগ যায়, যুগের আগে যুগ আসে। কিন্তু জরা-যৌবনের সেই অনাদিকালের দ্বন্দ্বটা অনন্তকালেও থামবার নয়। সেটাও নিত্য সনাতন।
মৃত্যুর চেয়ে জরা ভীষণ। অনবচ্ছিন্ন যৌবনপ্রবাহের মৃত্যু একটা বাঁক, জন্ম তার উলটোপিঠ। কিন্তু জরা তার চড়া, তাকে তিলে তিলে শোষণ করে, নিঃস্বত্ব করে। মৃত্যুর পরেও যৌবন আছে, কিন্তু জরার মধ্যে যৌবন নেই। যৌবন যেন ঠাসবুনন, মৃত্যু তাকে যেখান থেকেই ছিঁড়ে নিক সে অল্পের মধ্যে সম্পূর্ণ। আর জরা যেন জাল-বুনন, যত দীর্ঘই হোক ফাঁকা ফাঁকা। ‘One crowded hour of glorious life’ হচ্ছে যৌবন, ‘an age without a name’ হচ্ছে জরা।
সেইজন্যে যৌবনের সত্যিকার বিপদ মরা নয়
জরা, বদলানো নয় বন্ধ হওয়া, ভাঙা নয় বাঁকা, নষ্ট হওয়া নয় স্বভাবভ্রষ্ট হওয়া। প্রতি বৎসর বিশ্বজরার সঙ্গে বিশ্বযৌবনের দ্বন্দ্ব বাঁধে, যৌবন আক্রমণ করার দ্বারা আত্মরক্ষা করে, জরা আত্মরক্ষার আশায় হটতে হটতে যায়; যৌবন আপনাকে বাড়াতে গিয়ে বাঁচে, জরা আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে মরে। শীতের শুষ্কপাতা ঝরিয়ে দিয়ে বসন্তের কিশলয় দেখা দেয়, জ্যৈষ্ঠের জীর্ণ মাটি ভাসিয়ে নিয়ে শ্রাবণের বন্যা তাজা মাটি বিছিয়ে যায়। একের মরণ, অপরের জন্ম। কিন্তু উভয়ের ভিতর দিয়ে একই যৌবনের উষ্ণ রক্তপ্রবাহ।
এই উষ্ণ রক্তপ্রবাহ না হলে যৌবন বাঁচে না। তার বাঁচা তো কায়ক্লেশে বেঁচেবর্তে থাকা নয়, ক্ষীণজীবীদের পিন্ডার্থে ক্ষীণতরজীবীদের বংশান্বয় রক্ষা নয়, বালুকাগ্রস্ত ফল্গুপ্রবাহের মতো জরাগ্রস্ত অস্তিত্বটুকুকে অতি সন্তর্পণে টিকিয়ে রাখা নয়। তার বাঁচা আপনাকে প্রবলভাবে জাহির করা দিকে দিকে, প্রগাঢ়ভাবে বইয়ে দেওয়া স্রোতে স্রোতে। তার প্রতিভার আত্মপ্রকাশ সর্বতোমুখী, তার প্রেমের আত্মোপলব্ধি সর্বরসে। এমন বাঁচায় বিঘ্ন আছে, বিপদ আছে, মরণ আছে; কিন্তু পরোয়া নেই, হিসাব নেই, আপশোস নেই। যার প্রচুর আছে সে প্রচুর উড়িয়ে দিতে পারে, জীবন খোয়ালেও তার জীবনের অভাব হয় না। প্রাণহানি নয়, প্রাচুর্যহানিই তার মৃত্যু; প্রাণরক্ষা নয়, প্রাচুর্যরক্ষাই তার সমস্যা।
Struggle for existence যার সমস্যা সে নিছক প্রাণী, প্রাণের ওপরে উদ্বৃত্ত তার নেই। সে বৃদ্ধ, তার বৃদ্ধি পরিমিত, তার ভাবনা অভাবাত্মক। সে নিজেকে বাঁচাবে বলে নিজেকে ত্যাগ করতে করতে চলে, কচ্ছপের মতো আকাশকে ছাড়ে আপনাকে ঢাকে, অর্জনের ওপরে নয় সঞ্চয়ের ওপরে বাস করে। সে যতটুকু চলে তার বেশি দ্বিধা করে, যতটা দ্বিধা করে তার বেশি সন্দেহ করে, যতটা সন্দেহ করে তার বেশি ভয় করে। জীবনের জারকরস তার ফুরিয়ে এসেছে, সে গ্রহণ করতে পরিপাক করতে পারে না; আত্মসাৎ করতে, বৃদ্ধি পেতে পারে না। সন্ধান করবার অক্লান্ত উৎসাহ তার নেই, জয় করবার উন্মাদ সংকল্প তার নেই। সে শেখানো মন্ত্র নিষ্ঠার সঙ্গে জপ করে, পায়ের চেয়ে লাঠির ওপরে ভর করে বেশি।
তার সত্য নিরুপদ্রব নিশ্চিন্ত সত্য, যে সত্য মায়ামৃগের মতো ধরাছোঁয়ার নিত্য অতীত নয়, যে সত্যে নিত্য অভিসারের অসহ্য শ্রম, অসহ্য ব্যর্থতা ও অসহ্য কলঙ্ক নেই, যে সত্য সদ্যফলপ্রদ স্বপ্নাদ্য মাদুলির মতো সস্তা এবং বুড়ো-ভোলানো। তার প্রেমের আদর্শে প্রেমাস্পদকে অর্জন করবার জন্যে তপস্যার দরকার করে না, রক্ষা করবার জন্যে পুনর্তপস্যার তাগিদ নেই, সমৃদ্ধ করবার জন্যে তপস্যারও যা অধিক সেই সৃষ্টিশীল প্রতিভার নব-নবোন্মেষ নেই। সর্বাগ্রে জাতি-কুল-বিত্ত-প্রতিপত্তি, তারপরে কর্তৃজনের সুখ-সম্মান-সুবিধা, তারপরে নিজের রূপগুণের পছন্দ। তারপরেও যদি এতটুকু ফাঁক থাকে তবে অত্যন্ত নিরাপদ একান্ত ভ্রমপ্রমাদহীন সম্পূর্ণ টেকসই বেড়া-দেওয়া চিহ্নিত-করা সাধুসম্মত প্রেম! সতর্কতার আর অন্ত নেই! পৃথিবীসুদ্ধ তার প্রতিকূল। গায়ে একটু বাতাস লাগলে হাড় ক-খানা পর্যন্ত এমন খটাখট আওয়াজ করে ওঠে যে চৌচির হয়ে খুলে পড়বে বুঝি-বা! গেল গেল গেল! প্রাণ গেল, মান গেল, ধর্ম গেল, সমাজ গেল! এবং ইদানীং শোনা যাচ্ছে, সাহিত্য গেল! যদি বলি, গেল তো আপদ গেল, ‘কালোহ্যয়ং নিরবধি:’, আবার আসবে, তবে অক্ষমের না আছে ক্ষমতা, না আছে বিশ্বাস, না আছে আশা, আছে কেবল হা-হুতাশ আর অভিশাপ।
Struggle for intense living তার সমস্যা যে প্রাণী নয় প্রাণবান, জীব নয় যুবা। দুই হাতে বিলিয়ে দেবার মতো ঐশ্বর্য, দুই ধারে ছড়িয়ে দেবার মতো বীর্য, দশদিক আলো করবার মতো আভা, এরই জন্যে তার ভাবনা; এ ভাবনা অভাবাত্মক নয়, ভাবাত্মক। সে চায় ঘনীভূত জীবন, আরও আরও আরও প্রাণ। সে চায় প্রাচুর্যান্বিত বৈচিত্র্যান্বিত সাহসান্বিত জীবন, যার অপর নাম যৌবন। সে চায় অজরত্ব, নিছক অমরত্ব তার কাছে তুচ্ছ।
পরের হাত থেকে অমনি সে কিছু নেয় না। সেইজন্যে পিতৃজনের দেওয়া জীবনটাকে হাজারো বার বিপন্ন করে সে আপনার করে নেয়, পিতৃগণের দেওয়া সত্যকে সে ভেঙেচুরে পুড়িয়ে গলিয়ে পুনর্সৃষ্টি করে। কিছুই তার কাছে অতি প্রাচীন বলে অতি পবিত্র নয়, লক্ষ বার পরীক্ষিত সত্যকেও সে লক্ষ বার পরীক্ষা না করে মানে না, বিনা যুদ্ধে সে সূচ্যগ্র পরিমাণ প্রতীতি দেয় না; প্রতিভার ক্ষুধায় সে যেখানে যা পায় তাই কাজে লাগায় আর সৃষ্টির সুধায় তাকে অনির্বচনীয় রূপ দেয়। প্রেমের বাহু বাড়িয়ে সে আকাশের চাঁদ পেড়ে আনে আর হৃদয়ের শক্ত মুঠোয় তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত থেকে ছিনিয়ে রাখতে থাকে।
তবু আসক্তিতে তার সুখ নেই। একদিন যা প্রাণভরে কামনা করে, অন্যদিন তা হাতে পেয়েও রাখে না। হারাতে হারাতে কী যায় কী থাকে সেদিকে তার খেয়াল নেই, তার খেলা খেলনাভোলার খেলা, খেলা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেই তার তপস্যা। নিজের জন্যে সে চরম সৌভাগ্যকেও চরম মনে করে না, দেশের জন্যে সে উজ্জ্বলতম ভবিষ্যৎকেও যথেষ্ট উজ্জ্বল জ্ঞান করে না, জগতের জন্য সে যে আনন্দ আকাঙ্ক্ষা করে সে-আনন্দের সংজ্ঞা হয় না। ক্রমাগত সীমা ছেড়ে চলাই তার দেহ-মনের ধর্ম, কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরলেই তার মনে মরচে ধরে, দেহে কুঁড়েমি বাসা বাঁধে। কতদূর যে তার অধিকার, কত প্রশস্ত তার পরিধি আগে হতে কেউ তা ঠিক করে রাখেনি, নির্ভুলভাবে কোনো গুরুই তা ঠিক করে দিতে পারে না। নিজেকে কেবলই বিস্তীর্ণ, কেবলই বিচিত্র করতে করতে তার কতজনের সঙ্গে কত প্রথার সঙ্গে বিরোধ বাঁধে, সন্ধি হয়, পুনরায় বিরোধ বাঁধে; মরার আগে শেষ মীমাংসা হয় না, মরার পরেও শেষ মীমাংসা নেই।
এহেন যে যুবা তার প্রতি বৃদ্ধের সহানুভূতি অসম্ভব। একের সমস্যা অপরের অবোধ্য। বৃদ্ধ কখনো ধারণা করতে পারে না যুবা কী চায়, বিশ্বাস করতে পারে না সে-চাওয়া ভালো, স্বীকার করতে পারে না সে চাওয়া সত্য। বৃদ্ধ এসে সীমায় ঠেকেছে, তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, চলৎশক্তি আড়ষ্ট, কল্পনাশক্তি ক্লান্ত, কেবল আতঙ্কবোধ তীব্র। ভালো মনে কিন্তু ভীতু মনে কখনো তার পায়ে শিকল পরিয়ে কখনো তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে কখনো তার মনে সংস্কার প্রবেশ করিয়ে বৃদ্ধ যুবাকে বাধাই দিতে ব্যগ্র, অনুগত করতে ব্যস্ত, মনোমতো করতে উৎকন্ঠিত। পাঠশালায় বৃদ্ধই শিক্ষা দেয়, যুবা শিক্ষা পায়। সমাজে বৃদ্ধই শাসন করে, যুবা শাসিত হয়। শিক্ষা ও শাসন ধাতুগতভাবে একই; তাকে ভালোবেসে নিতে হয় না, মেনে নিতে হয়; তারমধ্যে এক পক্ষের আত্মসম্মানের চেয়ে অপর পক্ষের আত্মপ্রেস্টিজ বেশি। Superiority complex-এ গর্বান্ধ হয়ে অবশেষে আর্টকেও শিক্ষার বাহন শাসনের যন্ত্র বানাতে চায় স্কুলমাস্টার, পাহারাওয়ালার দল। প্রতিভাকে ভারাক্রান্ত ও প্রেমকে পাশবদ্ধ করে তাদের শঙ্কা কমেনি, সৃষ্টিতেও তারা ফরমাশ খাটাবে; মানবাত্মাকে তার শেষ আনন্দ থেকে, স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ থেকে, art for art’s sake থেকে নিরস্ত করবে; নিরুদ্দেশ্য লীলার ওপরে আর্টে তাদের কৃপণ মনের উদ্দেশ্য চাপাবে। এই তাদের মনস্কামনা।
বৃদ্ধ হচ্ছে ভূতের চেয়ে ভয়াবহ। ভূত তবু আপন জীবনটুকুর ভূত, পরের জীবনটুকুর উপরে তার লোভ। বৃদ্ধ কিন্তু আপন যৌবনটার ভূত, পরের যৌবনটার সঙ্গে তার বাদ। জীবনের চেয়ে যৌবনের মূল্য বেশি। জীবনকে যে হরণ করে, সে সামান্যই হরণ করে, যৌবনকে যে হরণ করে সে সর্বস্ব হরণ করে। কাঁচা চুলকে উপড়ে দিলে বাজে কিন্তু বাধে না, কাঁচা চুলকে পাকিয়ে দিলে সর্বনাশ। মরার বাড়া গাল নেই, কিন্তু মরার বাড়া দুর্গতি আছে, সে-দুর্গতি জরা। এ দুর্গতির অনেক ছদ্মবেশ, অনেক ছদ্মনাম, অনেক ছদ্মলক্ষণ। যৌবনের তপোভঙ্গের জন্যে জরা যেসব চর পাঠায় তারা শনির মতো কোন ছিদ্রে যে ভিতরে প্রবেশ করে আর ভিতর থেকে মেরুদন্ডটিকে ক্ষয় করে আনে, প্রথম থেকে তা বোঝা যায় না এবং অনেক পরে যখন বোঝা যায় তখনও আসল ব্যাধিটার চিকিৎসা না করে চিকিৎসা করা হয় আনুষঙ্গিক উপসর্গগুলোর। এবং ভিতর থেকে বলাধান না করে বাইরে থেকে করা হয় উত্তেজক প্রয়োগ। ফলে হয়তো রোগী বাঁচে, কিন্তু সে-বাঁচা রোগকে নিয়ে বাঁচা, একটার পর একটা উপসর্গকে নিয়ে চিকিৎসকের মুখ চেয়ে টিকে থাকা, দৈবের দেওয়া মুষ্টিভিক্ষার প্রত্যাশায় কাঙালের মতো ধন্না দিয়ে পড়ে থাকা। এর মতো মরণ আর নেই, এ কেবল শ্বাসটুকু ছাড়া বাকি সমস্তটার পলে পলে মরণ।