তারা-রহস্য

তারা-রহস্য 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

তারা বড় মানুষের ঘরের পরিচারিকা। বাসস্থান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল মহকুমার অধীন কোন একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে। তারা অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল, কি তাহার স্বামী কর্তৃক তাড়িতা হইয়াছিল, তাহার ঠিক সংবাদ পাওয়া যায় নাই। 

মধুসূদন দত্ত কলিকাতার একজন বড়লোক। কলিকাতার ভিতর কয়েকখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী, মফঃস্বলে একটু জমিদারী ও তদ্ব্যতীত কারবারও ছিল। নিজে একখানি বেশ বড় গোছের বাড়ীতেই বাস করিতেন। মধু বাবুর অর্থ যথেষ্টই ছিল; কিন্তু তাহা ভোগ করিবার লোক অধিক ছিল না। মধুসূদনের বয়ঃক্রম এখন প্রায় ৪৫ বৎসর। তাঁহার স্ত্রী নাই। প্রায় ছয় বৎসর পূর্ব্বে তাঁহার স্ত্রী ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যু হওয়ার পর মধুবাবু আর বিবাহ করেন নাই। মধুবাবুর একটি মাত্র পুত্র, নাম কৃষ্ণচন্দ্র। কৃষ্ণচন্দ্রের বয়ঃক্রম ২০।২২ বৎসর হইবে। কৃষ্ণচন্দ্রের বিবাহও অল্প দিন হইয়াছে। তাঁহার স্ত্রী কিরণকে এখন বালিকা বলিলেও চলে, বয়ঃক্রম ১৩ বৎসরের অধিক নহে। 

মধুসূদন, কৃষ্ণচন্দ্র ও কিরণ ব্যতীত সেই বাড়ীতে আর কেহই থাকিতেন না। আত্মীয়স্বজন বা অপর কোন পরিচিত ব্যক্তিকে মধুবাবু বাড়ীতে স্থান প্রদান করিতেন না। অপরকে ভরণ পোষণ করিতে যে ব্যয় হইবে, সেই ব্যয়কে তিনি অপব্যয় বলিয়া মনে করিতেন। বাড়ীতে একটি কায়স্থের ছেলে ছিল; সেই রন্ধনাদি করিত। তদ্ব্যতীত, একটি পরিচারক ও একটি পরিচারিকা ভিন্ন বাড়ীতে চাকর চাকরাণী আর কেহ ছিল না। পরিচারিকার নাম অমৃত। অমৃতের বাসস্থান ও মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল মহকুমার অধীন একটি পল্লীগ্রাম। অমৃত অনেক দিবস ওই দত্ত বাড়ীতে কাৰ্য্য করিয়া আসিতেছিল। কৃষ্ণচন্দ্র তাহারই সম্মুখে জন্মগ্রহণ করেন, ও তাহা কর্তৃকই লালিত-পালিত হন। অমৃত এখন প্রবীণা হইয়া পড়িয়াছেন। পুরাতন ঝি বলিয়া সেই বাড়ীর একরূপ সমস্ত ভারই গ্রহণ করিয়াছে। রন্ধনাদির ব্যবস্থা ও খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত এখন তাহারই দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে। অমৃত অনেক দিবস পর্য্যন্ত কলিকাতায় থাকিলেও বৎসরের মধ্যে একবার করিয়া সে আপন দেশে গমন করিত ও সেই স্থানে দশ পনর দিবস অতিবাহিত করিয়া পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিত। 

প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, অমৃত নিয়মিত রূপ দেশে গমন করিয়াছিল। সেবার মাসাবধি কাল আপন দেশে থাকিয়া কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হয়। অন্যান্য বার সে যেমন একাকীই আগমন করিত, এবার কিন্তু সেইরূপ আসে না। এবার তারাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসে। 

তারা যখন কলিকাতায় আইবে, তখন তাহার বয়ঃক্রম ২৫ বৎসরের অধিক ছিল না। সেই হিসাবে এখন তাহার বয়ঃক্রম ২৭ বৎসর। তারা গৌরাঙ্গী ও সুশ্রী, কিন্তু সধবা কি বিধবা, তাহা তাহাকে দেখিয়া সহজে অনুমান করা কাহারও সাধ্য নহে। তারা সিন্দুর পরে না, কিন্তু দুই হাতে রূপার চুড়ি পরিয়া থাকে। পরিধানেও কখনও পাড়ওয়ালা ও কখনও বা সাদা থান দেখিতে পাওয়া যায়; ও সদাসর্বদা সে যেন একটু ফিট ফাটে থাকে বলিয়া অনুমান হয়। সে যাহা হউক, তারা সধবা কি বিধবা, তাহা লইয়া তর্কবিতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন। তাহার স্বভাব চরিত্র যে ভাল, তাহা তাহার কথাবার্তা শুনিয়া, তাহার চলন ও চাহনি দেখিয়া, কিন্তু অনুমান হয় না। 

মধুবাবু অমৃতের সহিত তারাকে আসিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “এটি তোমার কে হয়?” উত্তরে অমৃত কহিল “এটি আমার কেহ হয় না, আমার স্বদেশীয়, ইহার কেহই নাই। দেশে থাকিয়া অন্ন বস্ত্রের কষ্ট পায়, তাই আমার সহিত আসিয়াছে। এখানে অনেক বড়লোক আছেন, কাহারও বাড়ীতে একটি কর্ম্মের যোগাড় করিয়া দিতে পারিলেই ইহার কষ্ট দূর হইবে; তাই আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। যে দুই চারি দিবস কোন স্থানে ইহার থাকিবার যোগাড় না করিয়া উঠিতে পারি, সে কয়দিবস এ আমারই নিকট থাকিবে।” 

চাকরাণী অমৃতের কথা শুনিয়া মধুবাবু দুই একবার তারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন ও তাহার আপাদ মস্তক উত্তম রূপে দেখিয়া, পরিশেষে অমৃতকে কহিলেন, “উহার স্বভাব চরিত্র যদি ভাল হয় ও আমাদিগের সেবা শুশ্রূষা করিতে পারে, তাহা হইলে অপর কোন স্থানে ইহার আর থাকিবার চেষ্টা দেখিতে হইবে না। যেমন তুমি এতদিবস আমার বাড়ীতে কাটাইতে সমর্থ হইলে, এও সেইরূপ অনায়াসেই আমার আশ্রয়ে দিন যাপন করিতে পারিবে।” 

মধুবাবুর কথা শুনিয়া অমৃত তাহাকে সঙ্গে লইয়া অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

মধুবাবুর কথার আভাষ পাইয়া অমৃত বুঝিতে পারিল যে, তাহার জন্য অপর কোন স্থানে আর চাকরীর যোগাড় করিতে হইবে না। সেইদিন হইতেই অমৃত তারাকে তাহার মনিব বাড়ীর সমস্ত কার্য্য দেখাইয়া দিতে লাগিল। তারা সেইদিন হইতেই গৃহ-কাৰ্যে নিযুক্ত হইল। প্রথমতঃ তারা খুব মনোযোগের সহিত তাহার কর্ম্মকার্য্য করিতে আরম্ভ করিল। তাহাকে কোন কাৰ্য্য বলিতে হয় না, বা তাহার নিকট কোন দ্রব্য চাহিতে হয় না। তাহার কার্য্য সে পূর্ব্ব হইতেই শেষ করিয়া রাখিয়া দেয়। আবশ্যকীয় দ্রব্য চাহিবার পূর্ব্বেই সে তাহা সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করে। তাহার কাৰ্য্য দেখিয়া, মধুবাবু তাহার উপর দিন দিন বিশেষরূপ সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রও ক্রমে ক্রমে তাহার পক্ষপাতী হইয়া পড়িতে লাগিলেন। 

পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন যে, মধুবাবুর বাড়ীতে কেবলমাত্র একজন পরিচারক। মধুবাবুর ও কৃষ্ণচন্দ্রের কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ ব্যতীত তাহার আর কোন কাৰ্য্য ছিল না। তাঁহাদিগের পরিধেয় বস্ত্রাদি ঠিক করা, স্নানের আয়োজন করা ও সম্মুখে উপস্থিত থাকিয়া উপস্থিতমত আদেশ সকল প্রতিপালন করা তাহার কার্য্য ছিল। তদ্ব্যতীত, স্নানের পূৰ্ব্বে উভয়কেই উত্তমরূপে তৈল মাখান, ও বিশ্রাম করিবার কালীন হস্ত পদাদি টিপিয়া দেওয়াও তাহার প্রধান কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত ছিল। পিতা পুত্রের মধ্যে কেহই ধূমপান করিতেন না; সুতরাং, তামাকু প্রায় তাহাকে সাজিতে হইত না। ওই পরিচারক মধুবাবুর ও কৃষ্ণচন্দ্রের যে সকল কার্য্য করিত, তারা বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া সেই সমস্ত দেখিত ও হঠাৎ কোন কার্য্যের আবশ্যক হইলে, সে তাহা নিজেই সম্পন্ন করিত। এইরূপে দশ পনর দিবস অতীত হইতে না হইতেই ওই পরিচারক পীড়িত হইয়া পড়ে। তারাকে না বলিলেও তারা সেই পরিচারকের সমস্ত কার্য নিজ হস্তেই গ্রহণ করে। পরিচালক যেরূপে তাহার কার্য নির্ব্বাহ করিত, তারা তদপেক্ষা উত্তমরূপে সেই সকল কাৰ্য্য সমাপন করিতে থাকে। তৈল মাখান ও হস্ত পদ টেপা প্রভৃতি কার্য্য সে এরূপ দক্ষতার সহিত করিতে আরম্ভ করে যে, পিতা পুত্র উভয়েই তাহার উপর বিশেষরূপ সন্তুষ্ট হন। উভয়েই মনে মনে স্থির করেন, সেই পরিচারক নিজ কার্য্যে প্রত্যাবর্তন করিলেও তাহার উপর ওই সকল কার্য্যের আর ভারার্পণ করিবেন না, তারাই সেই সমস্ত কার্য নির্ব্বাহ করিবে। পিতাপুত্র মনে মনে যাহা ভাবিলেন, আপনা হইতেই কার্য্যে তাহা পরিণত হইল। পরিচারক পীড়িত হইয়া দেশে গমন করিল, আর প্রত্যাগমন করিল না; অথচ তাহার স্থানে আর কোন পরিচারকও নিযুক্ত হইল না; সুতরাং তারার উপর যে সকল কার্য্যের ভারাপিত হইয়াছিল, তাহা তাহার উপর ন্যস্ত রহিল। 

এ দিকে দিন দিন তারার অবস্থারও পরিবর্ত্তন আরম্ভ হইল। যে তারার পরিধানে সর্ব্বদাই প্রায় মলিন বস্ত্র থাকিত, সেই তারার অঙ্গে এখন মলিন বস্ত্র আর একেবারেই দেখিতে পাওয়া যাইত না। পূর্ব্বে মধ্যে মধ্যে তাহার অঙ্গে সাদা মোটা থান দেখিতে পাওয়া যাইত। এখন তাহার পরিধানে পাতলা ও নানারূপ পাড়ওয়ালা কাপড় নয়ন গোচর হইত। পূর্ব্বে তাহার হস্তে কয়েকগাছি রূপার চুড়ি ছিল মাত্র। এখন তাহার পরিবর্তে সুবর্ণ তাহার অঙ্গ শোভা বর্দ্ধন করিতে সমর্থ হইল। একগাছি একগাছি করিয়া ক্রমে তাহার দুইগাছি সোণার অনন্ত হইল। দুইগাছি পেটা সোণার বালা ক্রমে তাহার সেই রৌপ্য নির্ম্মিত চুড়ির স্থান অধিকার করিল। সোণার দানার ক্রমে তাহার কণ্ঠও ভূষিত হইতে লাগিল। এই সকল অলঙ্কার মধুবাবু বা তাঁহার পুত্র যে প্রস্তুত করিয়া দিলেন, তাহা নহে। তারা নিজে অর্থ দিয়া ক্রমে ক্রমে ওই সকল অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া লইতে আরম্ভ করিল। কিন্তু ওই সকল অর্থ যে সে কোথা হইতে পাইতে লাগিল, তাহা আমরা অবগত নহি। পিতা ও পুত্র তাহা অবগত ছিলেন কি না, জানি না কিন্তু, তাঁহারা সে বিষয়ে কিছুমাত্র অনুসন্ধান করিতেন না, এ সংবাদ কিন্তু আমরা রাখি। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

মধুসূদন দত্তের অন্দরের ভিতর এক দিবস ভয়ানক গোলযোগ উত্থিত হইল। সেই গোলমালের বিষয় ক্রমে অন্দর হইতে সদরে আসিল, সদর হইতে ক্রমে লোকমুখে প্রচারিত হইতে আরম্ভ হইল, ও পরিশেষে সেই সংবাদ ক্রমে থানায় আসিয়া উপস্থিত হইল। সংবাদ পাইবামাত্রই স্থানীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারী তৎক্ষণাৎ মধুসূদন দত্তের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। আমাদিগেরও পদধূলি ক্রমে সেই স্থানে পড়িল। 

সেই স্থানে গমন করিয়া যাহা দেখিলাম ও যাহা কিছু শ্রবণ করিলাম, তাহাতে বিশেষরূপ বিস্মিত হইয়া পড়িলাম। দেখিলাম, মধুসূদনবাবুর বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে অনেকগুলি দেশীয় ভদ্রলোক ও একজন ইংরাজ বসিয়া আছেন। সেই স্থানে উপস্থিত হইবার একটু পরেই জানিতে পারিলাম, যে সকল দেশীয় ভদ্রলোক সেই স্থানে বসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে দুইজন ডাক্তার, ইংরাজও তাহাই। তাঁহাদিগের নিকট হইতে যতদূর অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতে কেবল এইমাত্র বুঝিতে পারিলাম যে, মধুসূদনের পুত্রবধূ বা কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রী কিরণের জীবন বিষপানে নষ্ট হইয়াছে। কিরূপে কিরণ বিষপান করিলেন, ও কি রূপেই বা তাঁহার মৃত্যু হইল, তাহার কিছুই আমরা সেই সময় অবগত হইতে পারিলাম না, বা কিরণের মৃতদেহও সেই সময় আমরা দেখিতে সমর্থ হইলাম না। অথচ সেই সময় কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার সময়ও পাইলাম না। যাহাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া মনস্থ করি, তাহারই নিকট গমন করিয়া দেখি যে, আমাদিগের উপরিতন কর্ম্মচারিগণের মধ্যে কেহ না কেহ তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। 

আমরা এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেও, প্রথম অবস্থায় এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইলাম না। আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী হইতে আরম্ভ করিয়া, উপরিতন কর্মচারিগণ পর্যন্ত সকলে আসিয়া প্রথম অবস্থায় ইহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন; সুতরাং, প্রধান প্রধান কর্মচারিগণের কার্য্যের মধ্যে কোনরূপে হস্তক্ষেপ না করিয়া আমরা দূরে থাকিয়া যে সকল বিষয় আপনা হইতেই কর্ণগোচর হইতে লাগিল, তাহাই কেবল শ্রবণ করিতে লাগিলাম। 

মধুবাবু নিজে খুব বড়লোক না হইলেও কলিকাতার প্রধান প্রধান বড়লোকের সহিত তাঁহার কুটুম্বিতা এবং বন্ধুত্ব ছিল; সুতরাং, তাঁহার বিপদের কথা শুনিয়া সকলেই আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর সেই স্থানে উপস্থিত হইবার কারণও সেই বড়লোক-মণ্ডলী। কারণ তাঁহাদিগের ইচ্ছা, ওই মৃতদেহের অঙ্গ ছেদন করিয়া যাহাতে ডাক্তারের পরীক্ষা না হয়। একে ত অন্তঃপুর মধ্যে এক কাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহাতে ওই মৃতদেহ কলেজে লইয়া গিয়া সেই স্থানে ছেদন করিয়া পরীক্ষা করা হইলে মধুবাবুর অবমাননার আর অপরিসীমা থাকিবে না। এই নিমিত্তই সাহেব ও বাঙ্গালী ডাক্তারগণের সমাবেশ। 

আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী এই অবস্থায় বিষম বিপদে পতিত হইলেন। তাঁহার ইচ্ছা নহে যে, যাহাতে একজন গণনীয় ব্যক্তি অবমানিত হন। অথচ কর্তব্যকর্ম্মের অনুরোধে ওই মৃতদেহের পরীক্ষা না হইলেও উহার সৎকার করিবার নিমিত্ত তিনি আদেশ প্রদান করিতে পারেন না। কারণ সেই সময় যতদূর পর্য্যন্ত তিনি অবগত হইতে পারিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার মনে এই ভাবনা উপস্থিত হইয়াছিল, যে কিরণ নিজে বিষপান করিয়া আত্মহত্যা করেন নাই। কোন ব্যক্তি তাঁহাকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তাঁহাকে বিষপান করাইয়াছে। যদি তাঁহার এই ধারণা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে ইহা আত্মহত্যা নহে—হত্যা; সুতরাং, হত্যা-মোকদ্দমায় মৃত ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষা না হইলে সেই মৃতদেহের সৎকার কোনরূপেই হইতে পারে না; সুতরাং, তিনিও বিশেষ বিপদে পতিত হইলেন। 

পরিশেষে অনেক তর্ক বিতর্ক ও বিবেচনার পর ইহাই স্থিরীকৃত হইল যে, মৃতদেহ পরীক্ষার্থ কলেজে পাঠাইবার প্রয়োজন নাই। যে ডাক্তার সাহেব মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া থাকেন, তিনি মধুবাবুর বাড়ীতে আসিয়া ওই মৃতদেহ পরীক্ষা করিবেন। 

যাহা স্থির হইল, কার্য্যেও তাহাই হইল। লাস-ছেদনকারী ডাক্তার সাহেব সেই স্থানে আগমন করিয়া ওই মৃতদেহ ছেদন পূর্ব্বক পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, ও তাঁহার পরীক্ষায় ইহাই স্থিরীকৃত হইল যে, বিষপানই কিরণের মৃত্যুর কারণ। 

মৃতদেহের পরীক্ষা হইয়া গেলে, প্রধান কৰ্ম্মচারিবর্গ এক এক করিয়া সকলেই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। মৃতদেহেরও সৎকার হইয়া গেল। আমরাও তখন সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের পথ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

বাড়ীর ভিতর অপর লোকজন কেহই ছিল না। মধুবাবু, কৃষ্ণচন্দ্র, যে ব্যক্তি রন্ধন করিত সেই, ব্যক্তি, ও পুরাতন ঝি অমৃত ভিন্ন সেই সময় বাড়ীতে আর কেহই ছিল না। কিরণ মরিয়া গিয়াছে, ও তারা ঝি তাহার পূর্ব্বদিবস আপন দেশে গমন করিয়াছে। ঘরের কথা মধুবাবু ও কৃষ্ণচন্দ্রের নিকট হইতে কোন রূপে পাইবার আশা নাই। যদি কিছু পাওয়া যায়, সেই পাচক ও অমৃত ঝির নিকট হইতে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, আমরা উভয়কে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে অন্যস্থানে গমন করিতে মনস্থ করিলাম। কিন্তু আমাদিগের ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করিবার পূর্ব্বে, মধুবাবু ও কৃষ্ণচন্দ্র যতদূর অবগত আছেন বা যতদূর তাঁহারা আমাদিগের নিকট প্রকাশিত করিতে সঙ্কুচিত হন না, তাহা অবগত হইবার নিমিত্ত আমি তাঁহাদিগকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তদুত্তরে তাঁহাদিগের নিকট হইতে যাহা কিছু জানিতে পারিলাম, তাহার সার মৰ্ম্ম এইরূপ:- 

কিরণ বালিকা, সংসারের কোন বিষয়ের দিকে তাহার লক্ষ্য ছিল না। কৃষ্ণচন্দ্র বা মধুবাবু যাহা বলিতেন, কিরণ হাসিতে হাসিতে তখনই তাহা সম্পন্ন করিত। সাংসারিক কোন বিষয় লইয়া কখনও কিরণ তাহার মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ করে নাই। সৰ্ব্বদাই তাহাকে হাস্যবদনে দেখিতে পাওয়া যাইত। অমৃতের সহিত উহার প্রণয় কিছু অধিক ছিল। অমৃত তাহাকে আপন মনিব বলিয়া জানিত না। আপন কন্যার ন্যায় ভালবাসিত ও সদাসর্ব্বদা কিরণের নিকট থাকিয়াই সে দিন নির্ব্বাহ করিত। 

কি কারণে কিরণ বিষপান করিলেন, এখন তাহা জানিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু তাহা এখন কিরূপ জানা যাইতে পারে? কিরণ নাই; সুতরাং, প্রকৃত কথা এখন কাহার নিকট হইতে অবগত হইতে পারা যাইবে? তবে যদি বিষের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া কিরণ তাঁহার মনের কথা অমৃতকে কহিয়া থাকেন, ও অমৃত যদি ঠিক সেই কথাগুলি মনে করিয়া এখন বলিতে পারে, তাহা হইলেই এই ঘটনার প্রকৃত অবস্থা কিয়ৎপরিমাণে অবগত হইতে পারিবার সম্ভাবনা; নতুবা এই অমানুষী ঘটনা তিমির অন্ধকারের মধ্যেই রহিয়া যাইবে। মধুবাবু ও কৃষ্ণচন্দ্র এখন যেরূপ শোকাক্রান্ত হইয়াছেন, তাহাতে এখন তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাহার যথাযথ উত্তর পাইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। বিশেষ ভিতরের অবস্থা অগ্রে কিয়ৎপরিমাণে অবগত হইতে না পারিলে, তাঁহাদিগকে কোন কথা বিশেষরূপে জিজ্ঞাসা করাও অসম্ভব। পূর্ব্বে অমৃতের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দেখি, তাহার নিকট হইতে কোন আবশ্যকীয় কথা পাওয়া যাইতে পারে কি না। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমাদিগের মনের কথা মধুবাবুকে কহিলাম। তিনি আমাদিগের প্রস্তাবের কোনরূপ প্রতিবন্ধকতাচরণ না করিয়া, অমৃতকে আমাদিগের সম্মুখে ডাকাইয়া আনিলেন। যে সময় আমরা সেই স্থানে ছিলাম, বা যেস্থানে অমৃত আসিয়া উপস্থিত হইল, সেইস্থ। লোকজনে তখন প্রায় পূর্ণ ছিল; সুতরাং, সেই স্থানে অমৃতকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া তাহাকে একটু নিৰ্জ্জন স্থানে লইয়া গেলাম, ও সেই স্থানে উপবেশন করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে আরম্ভ করিলাম 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

অমৃতের সহিত আমাদিগের যে সকল কথাবার্তা হইয়া ছিল, তাহার আনুপূর্বিক বিবরণ পাঠকগণের মধ্যে ভাল না লাগিলেও তাহার একটু বিবরণ এই স্থানে প্রদান না করিলে, প্রকৃত কথার কিছুই পাঠকগণ অবগত হইতে পারিবেন না বলিয়া, যতদূর সম্ভব, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে লিপিবদ্ধ হইল। 

আমি অমৃতকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “অমৃত, তুমি পুরাতন লোক ও এই বাড়ীর সমস্ত অবস্থা তুমি যেরূপ অবগত আছ, তাহা যাহাদিগের বাড়ী তাহারাও ততদূর অবগত নহে। এ বাড়ীতে এরূপ সৰ্ব্বনাশ ঘটিল কি প্রকারে?” 

অমৃত। আমিও ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কিন্তু মহাশয়, সে সংসারে একবার পাপ প্রবিষ্ট হয়, সেই সংসারের অবস্থা প্রায়ই এইরূপ হইয়া থাকে। 

আমি। আমার এই সংসার নিষ্পাপ সংসার বলিয়া জানি; তবে, এখন এই সংসারে এমন কি ভয়ানক পাপ প্রবিষ্ট হইল? 

অমৃত। মহাশয় আমি এই বাড়ীর নিতান্ত পুরাতন লোক হইলেও আমি চাকরাণী; সমস্ত কর্তৃত্বভার আমার হস্তে অর্পিত থাকিলেও আমি সামান্য পরিচারিকা। ইহাদিগের ভাল মন্দ, কল্যাণ অকল্যাণের দিকে যতই আমি কেন দৃষ্টি রাখি না, সামান্য পরিচারিকার দৃষ্টিতে তাহার আর কি হইতে পারে? তা যাক্ সে সব কথায় কাজ নাই। আমি যেমন চাকরাণী সেইরূপ চাকরাণীর মতনই আমার থাকা কর্তব্য। আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতেছেন, করুন। 

আমি। তোমাকে এই জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, কিরণের এরূপ অবস্থা ঘটিল কেন? 

অমৃত। তাহাই যদি আমি জানিতে পারিব, তাহা হইলে উহার ওইরূপ অবস্থাই বা ঘটিতে পারিবে কেন? কিরণকে কেবলমাত্র আমি মনিব-পত্নী বলিয়া জানিতাম না। তাহাকে আমি আমার কন্যা বলিয়া জানিতাম, ও কন্যার ন্যায় তাহাকে আমি লালন পালন করিতাম। তাহাকে হারাইয়া আমি আমার একমাত্র কন্যাটিকে হারাইয়াছি। 

আমি। যে পর্য্যন্ত কিরণ অসুস্থ ছিল, তুমি সেই পর্য্যন্ত সর্ব্বদাই তাহার নিকট ছিলে? 

অমৃত। কিরণের অসুখ হওয়ার পর হইতে একবারের নিমিত্তও আমি তাহার শয্যা পরিত্যাগ করি নাই।

আমি। কোন সময় হইতে তুমি জানিতে পার যে, কিরণের অসুখ হইয়াছে। 

অমৃত। কল্য বৈকাল হইতেই আমি জানিতে পারি। কিরণ আমাকে মা বলিয়া ডাকিত, বৈকালেই সে আমাকে কহে, “মা আমার বুক জ্বলিয়া গেল, আমার ভয়ানক যন্ত্রণা হইতেছে; বোধ হয়, কেহ আমাকে বিষ খাওয়াইয়াছে। কারণ বিষের যন্ত্রণা ভিন্ন এরূপ যন্ত্রণা আর যে কিছু হইতে পারে, তাহা আমি কখনও শুনি নাই। কিরণের এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে সান্ত্বনা করিতে চেষ্টা করিলাম; কিন্তু দেখিলাম; যখন মা আমার কিছুতেই সুস্থ হইতে পারিতেছেন না, তখন আমি কর্তা ও কৃষ্ণচন্দ্র উভয়কেই এই সংবাদ প্রদান করিলাম। তাঁহারা উভয়েই বাড়ীর ভিতর আসিয়া কিরণকে দেখিলেন; কিন্তু কিছু স্থির করিতে না পরিয়া তৎক্ষণাৎ একজন ডাক্তারকে আনাইলেন। ডাক্তার আসিয়া কিরণকে উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, ‘প্রবল বিষে ইহার শরীর আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। ইনি বিষপান করিয়াছেন।” কিরণ নিজেই যাহা বলিয়াছেন, ডাক্তারও যখন তাহাই কহিলেন, তখন আমাদিগের মনে অপর কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। তাঁহার শরীরে যে বিষ প্রবিষ্ট হইয়াছে, তাহা আমাদিগের তখন বিশ্বাস হইল। 

আমি। বিষ কোথা থেকে আসিল? 

অমৃত। তাহার ত কিছুই আমি জানি না। ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

আমি। কল্য কিরণ আহার করিয়াছিলেন কখন? 

অমৃত। বেলা আন্দাজ ১০টা কি ১১টার সময় তিনি আহার করিয়াছিলেন। 

আমি। আহারের পর তাঁহার শরীর কিরূপ ছিল? 

অমৃত। খুব ভাল ছিল, কোনরূপ অসুখ হয় নাই। 

আমি। তাহা হইলে কি আহার করিবার পর হইতে তাঁহার শরীর অসুস্থ হইতে আরম্ভ হয়? 

অমৃত। বৈকালে জলযোগের পর হইতেই তাঁহার অসুখ হয়। 

আমি। বৈকালে তিনি কি জলযোগ করিয়াছিলেন? 

অমৃত। বিশেষ কিছুই খান নাই, একটি সন্দেশ, একটি কি দুইটি রসগোল্লা ও একটু সরবত। 

আমি। সন্দেশ ও রসগোল্লা কোথা হইতে আসিয়াছিল? 

অমৃত। বাজার হইতে যেমন আসিয়া থাকে, সেইরূপই আসিয়াছিল 

আমি। কে আনিয়াছিল? 

অমৃত। আমাদিগের বাড়ীর কেহ আনে নাই। যে ময়রা প্রত্যয় যোগান দিয়া থাকে, সেই দিয়া গিয়াছিল। 

আমি। সেই সন্দেশ বা রসগোল্লার অবশিষ্ট আছে কি? 

অমৃত। না, তাহার আর কিছুই নাই, সমস্তই খাওয়া হইয়া গিয়াছে। 

আমি। ওই সন্দেশ ও রসগোল্লা কিরণ ব্যতীত আর কে খাইয়াছিল? 

আমি। সকলেই খাইয়াছিল। কৰ্ত্তাবাবু, কৃষ্ণচন্দ্র প্রভৃতি সকলেই তাহা আহার করিয়াছিলেন। আমিও খাইয়াছিলাম।

আমি। উহা খাওয়ার পর তোমাদিগের কোনরূপ অসুখ হয় নাই? 

অমৃত। না, আমি ত কোনরূপ অসুখ বুঝিতে পারি নাই। 

আমি। কিরণ সরবত খাইয়াছিলেন, বলিলে না? 

অমৃত। হাঁ। 

আমি। সে সরবত আর কে কে খাইয়াছিল? 

অমৃত। আর কেহ খায় নাই, কেবল কিরণই উহা পান করিয়াছিল। 

আমি। কিসের সরবত? 

অমৃত। ওলার সরবত। 

আমি। সে সরবত কে প্রস্তুত করিয়াছিল? 

অমৃত। আমিই প্ৰস্তুত করিয়াছিলাম। 

আমি। ওলা পাইলে কোথা হইতে? উহাও কি বাজার হইতে আনা হইয়াছিল? 

অমৃত। না, কিরণ ওলার সরবত খাইতে ভালবাসে ও বাল্যকাল হইতে তাহার সেই অভ্যাস আছে। তাই তাহার মা মধ্যে মধ্যে কতকগুলি করিয়া ওলা পাঠাইয়া দিয়া থাকেন। প্রত্যহ উহার একটি করিয়া ভিজাইয়া রাখি ও জলযোগের সময় আমি উহা কিরণকে দিয়া থাকি। 

আমি। কল্য সেই ওলা কে ভিজাইয়াছিল? 

অমৃত। আমি। 

আমি। জল পাইয়াছিলে কোথা? 

অমৃত। আমি কল হইতে জল ধরিয়া, সেই জলে উহা ভিজাইয়া রাখিয়াছিলাম। 

আমি। ওই ওলা কোথায় থাকে? 

অমৃত। একটি হাঁড়ির মধ্যে। 

আমি। সেই হাঁড়ি থাকে কোথায়? 

অমৃত। কিরণের ঘরের মধ্যেই উহা থাকে। 

আমি। ওই হাঁড়ি হইতে ওলা লইয়া আর কেহ খাইয়া থাকে কি? 

অমৃত। বাড়ীর আর কেহই উহা খায় না, কেবল কিরণই খাইয়া থাকে। 

আমি। উহাতে আর কতগুলি ওলা আছে? 

অমৃত। অধিক নাই, যাহা ছিল তাহা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। বোধ হয়, কেবল ২। ৪টি আছে মাত্র। 

আমি। ওই হাঁড়িতে যে ওলা থাকে, তাহা কে কে জানে? 

অমৃত। আমি জানি, তারা জানিত ও কিরণ জানিত। আমরা এই তিনজন ব্যতীত আর কেহ অবগত আছে কি না, তাহা আমি জানি না। 

আমি। কিসে করিয়া কল্য ওলা ভিজাইয়া রাখা হইয়াছিল? 

অমৃত। যাহাতে প্রত্যহ ভিজাইয়া রাখা হয়, তাহাতেই উহা ভিজান হইয়াছিল। উহা একটি কাঁচের বাটী।

আমি। ওলার সরবত পান করার পর, ওই বাটী কি সেইরূপ অবস্থায় আছে, না, পরিষ্কার করিয়া রাখা হইয়াছে?

অমৃত। আমি উহা উত্তমরূপে ধুইয়া বেশ পরিষ্কার করিয়া রাখিয়া দিয়াছি। 

আমি। যে পাত্রে ওলা আছে, সেই পাত্র সহিত যে কয়েকটি ওলা আছে, তাহা আমাদিগকে দেখাইতে পার?

অমৃত। পারিব না কে? 

এই বলিয়া অমৃত অন্তঃপুরের মধ্যে গমন করিল ও অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই হাঁড়ি সহিত প্রত্যাগমন করিল। দেখিলাম, উহার মধ্যে ৩টি মাত্র ওলা আছে ও কতকগুলি ওলা চূর্ণ রহিয়াছে। 

অমৃতের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া একজন কর্মচারীর দ্বারা উহা তৎক্ষণাৎ রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট প্রেরণ করিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

হাঁড়ি সহিত ওলা সকল সরকারী রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট প্রেরণ করিয়া পুনরায় অমৃতকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি যে বলিতেছিলে, যে সংসারে পাপ প্রবেশ করে সেই সংসারের অবস্থা প্রায় এইরূপই ঘটিয়া থাকে। তোমার ও কথার অর্থ কি? তুমি সমস্ত কথা আমাদিগকে পরিষ্কার করিয়া বল এখানে অপর কেহই নাই ও তুমি যাহা আমাদিগকে কহিবে, তাহা তোমার মনিব বা অপর কাহারও কর্ণ গোচর হইবার সম্ভাবনা নাই। আমরা সমস্তই গোপন করিয়া রাখিব। তোমার নিকট হইতে যদি সমস্ত অবস্থা আমরা অবগত হইতে না পারি, তাহা হইলে কে কিরূপে এইরূপ সর্ব্বনাশ করিল, তাহা আমরা কিরূপে বুঝিতে পারিব?” 

আমার কথা শুনিয়া অমৃতের চক্ষু হইতে দুই একবিন্দু জল ঝরিল ও পরিবেশনে সে কহিল “যেদিন হইতে আমি তারাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া এই সংসারে ভিতর প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়াছি, সেইদিবস হইতেই এই সংসারের সর্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে। তারা রাক্ষসী যে কিরূপে অগ্রে মধুবাবুকে ভুলাইয়াছে, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না। কৃষ্ণচন্দ্রও যে কি নিমিত্ত সদাসর্বদা তাহার বিশেষরূপ পক্ষপাতী, তাহারও কিছুই আমি স্থির করিয়া উঠিতে পারি না। তারা যে কোন কাৰ্য্যই করুক না কেন; যে কোনরূপ অপরাধই করুন না কেন, তাহার দোষ কেহই দেখেন না; তারা যা করে তাই ঠিক। তারা উঠিতে বলিলে বাপ বেটায় উঠেন, চলিতে বলিলে বাপ বেটায় চলেন। কৃষ্ণচন্দ্ৰ সময় সময় তাহার কোন কোন কার্য্যের প্রতিবাদ করেন বটে, কিন্তু মধুবাবু তাহাকে একেবারে কোন কথাই বলেন না। তারা চাকরাণী, কিন্তু তাহাকে চাকরাণী বলিয়া বোধ হয় না। বোধ হয়, সে যেন এই বাড়ীর সর্ব্বময়কর্ত্রী। কিরণকে তারা একেবারেই দেখিতে পারিত না; কিন্তু সে এরূপ চতুরা, তাহা কোনরূপে প্রকাশ পাইতে দিত না। আমি পুরাতন বলিয়াই তাহার মনের ভাব কিছু কিছু বুঝিতে পারিতাম; কিন্তু মধুবাবু ও কৃষ্ণচন্দ্র তাহার বিন্দুমাত্রও বুঝিয়া উঠিতে পারিতেন না। কিরণ কিন্তু তাহা বেশ বুঝিতে পারিত, বুঝিয়াও সে তারার বিপক্ষে কোন কথা তাহার স্বামী বা শ্বশুরের কর্ণ গোচর করিতে সাহসী হইত না। মনের কথা কেবল আমাকেই কহিত ও মনের দুঃখে সময় সময় আমার নিকট কাঁদিত। আমি তাহাকে কত বুঝাইতাম ও কত সান্ত্বনা করিতাম। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া ও আমার সান্ত্বনায় শান্ত হইয়া সে দিনযাপন করিত। তারার যেরূপ চরিত্র, ক্রমে তাহা আমার নিকট প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল, তারা ও আমি ভিন্ন আর কেহই তাহা অবগত নহে। আজ যদি তারা এ বাটীতে থাকিত, তাহা হইলে আমি মুক্তকণ্ঠে সকলের নিকট কহিতাম, কিরণকে তারা ব্যতীত অপর কেহই বিষ খাওয়ায় নাই। তারা কিরণকে হত্যা করিয়াছে। তাহার নিজের কোন অভিসন্ধি পূর্ণ করিবার মানসে সে এই সোণার সংসারকে একেবারে মজাইয়াছে; কিন্তু যখন একদিবস পূৰ্ব্ব হইতে তারা নাই, সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া একদিবস পূর্ব্বে সে আপন দেশে গমন করিয়াছে, তখন যে এই ভয়ানক কার্য্য তাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, এ কথা আমি বলিতে পারি না। বলাও যুক্তি সঙ্গত নহে; কারণ, তার বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার প্রায় দুইদিবস পরে কিরণের শরীরে বিয়ের লক্ষণ প্রকাশিত হইয়াছে। আমি যাহা অবগত আছি, তাহার প্রায় সমস্তই আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলাম। আপনারা এখন বিবেচনা করিয়া দেখুন। এরূপ মহাপাপ কোন সংসারে প্রবিষ্ট হইলে, পরিণামে যে কি দশা হয়, তাহা আপনারা অনুমান বা বিশ্বাস করিতে পারেন কি? বোধ হয় পারিবেন না।” 

অমৃতের কথা শুনিয়া তাহার মনের কথা আমরা সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু, অনুমান হইল, তারা মহাপাতকী। তাহার নিমিত্তই এই সোণার সংসার বিনষ্ট হইতে বসিয়াছে। 

অমৃতের কথায় আরও একটি সন্দেহ আসিয়া আমাদিগের মনে উদিত হইল। সে সন্দেহ কি, তাহা পাঠকগণ কিছু অনুমান করিতে পারিয়াছেন কি? আমাদিগের মনে হইল, কোনরূপ বিষপান করিয়া কিরণ আত্মহত্যা করেন নাই তো? যে তারার উপর কিরণ সর্ব্বদা অসন্তুষ্টা থাকিতেন, যাহার অত্যাচারের কথা তিনি আপন স্বামীকে পর্যন্ত বলিতেও সাহসী হইতেন না, অথচ কোন কথা বলিলেও কৃষ্ণচন্দ্র তাহার দণ্ডবিধানের চেষ্টা না করিয়া, বরং তারার পক্ষ সমর্থন করিতেন ও কিরণকে অনর্থক তিরস্কার করিতেন, এরূপ অবস্থায় মনের জ্বালায় কিরণ আত্মহত্যা করিতে পারে না কি? এ দিকে বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিতে গেলে, কিরণকে বালিকা ভিন্ন আর কিছু বলা যাইতে পারে না। সে যদি নিজের দেহ নষ্ট করিবার নিমিত্ত নিজেই বিষপান করিবে, তাহা হইলে যে সময় সে বিষের জ্বালায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছিল, সেই সময় ‘কেহ আমাকে বিষপান করাইয়াছে’ এরূপ কথা প্রকাশ করিবে কেন? বিশেষ সে বালিকা ও কুলবধূ। সে বিষ পাইবে কোথা? এদিকে সেই বাড়ীর ভিতর এরূপ কাহাকেও দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না যে, সে কিরণকে বিষ প্রয়োগ করিতে সমর্থ হয়। মধু বাবুর দ্বারা এ কার্য্য হইতে পারে না। এরূপে কোন কারণ দেখিতেছি না, যাহাতে কৃষ্ণচন্দ্র এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারেন। অমৃত কিরণকে আপন কন্যার অপেক্ষাও অধিক ভালবাসিত; সুতরাং, অমৃতের দ্বারা এই ঘটনা সম্পন্ন হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তারা এখানে নাই; সুতরাং, এই কার্য্যে যে সে করিয়াছে, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? অপর লোকের মধ্যে কেবল যে ব্যক্তি রন্ধন করিয়া থাকে। সেই বা এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবে কেন? বিশেষ তাহার প্রদত্ত দ্রব্যাদি আহার করিবার পর কিরণের কোনরূপ অসুখই বোধ হয় নাই। বিশেষ তাহার বিপক্ষে এরূপ কোন কারণই অনুমিত হইতেছে না, যাহার দ্বারা সে এই মহাপাপে হস্তক্ষেপ করিতে পারে। অধিকন্তু, তাহাকে দেখিয়া ইহাও অনুমিত হইতেছে যে, কিরণের মৃত্যুতে সে শোক-সন্তাপিত হইয়াছে। তাহার হৃদয়ে আঘাত লাগিয়াছে। সে কোনরূপেই তাহার চক্ষুজল সংবরণ করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। 

কিরণের বিষ প্রয়োগ সম্বন্ধে এরূপ নানা কথা মনে আসিয়া উদিত হইতে লাগিল। কিন্তু অনেক ভাবিয়া চিন্তায় ইহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পরিলাম না। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে নিরর্থক দুই দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু, কোন ফলই হইল না। তৃতীয় দিবস সরকারী রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট হইতে অবগত হইতে পারা গেল যে, আমরা পরীক্ষার নিমিত্ত যে সকল ওলা তাঁহার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই বিষ মিশ্রিত ও উহার প্রত্যেকটির মধ্যে এরূপ পরিমাণে বিষ সংযুক্ত আছে যে, তাহার কোনটি কোনরূপে কাহারও গলাধঃকরণ হইলেই তাহার মৃত্যু নিশ্চয়। 

রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট হইতে এই কথা অবগত হইতে পারিয়া, আমাদিগের অনুসন্ধানের একটু পথ উন্মুক্ত হইল; ওলা ভিজা খাইয়াই যে কিরণ মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন, তাহা এখন আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম। এখন আমাদিগের অনুসন্ধানের প্রধান অবলম্বন —ওলার সহিত কিরূপে বিষ সংমিলিত হইল? এই সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবার পূর্ব্বে ওলা সম্বন্ধে আরও দুই চারিটি কথা অমৃতকে জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। তাহাকে আবার ডাকাইলাম। সে আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাকে কহিলাম, “কি কারণে যে কিরণের মৃত্যু হইয়াছে, তাহা আমরা এখন জানিতে পারিয়াছি।” 

অমৃত। কি জানিতে পারিয়াছেন? কি কারণে আমার কিরণের মৃত্যু হইয়াছে? 

আমি। বিষ খাইয়াই তাহার মৃত্যু ঘটিয়াছে। 

অমৃত। এ কথা ত আমরা পূর্ব্ব হইতেই জানি। বিষ খাওয়াইল কে? 

আমি। তুমি। 

অমৃত। আমি কিরণকে বিষ খাওয়াইয়াছি? 

আমি। হাঁ। 

অমৃত। তাহা হইলে তো আপনাদিগের কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে। এখন আমাকে যেরূপ দণ্ড বিধান করিতে চাহেন সেইরূপ দণ্ড প্রদান করিতে পারেন। আমিও কিরণের শোক কোনরূপই নিবৃত্তি করিতে পারিতেছি না। 

আপনাদিগের অনুগ্রহে কোন গতিকে যদি তাহার শোক হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারি, তাহা হইলে আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ করিব ও ঈশ্বরের নিকট আপনাদিগের দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করিব। 

আমি। দেখ অমৃত, আমরা তোমাকে মিথ্যা কথা কহিতেছি না; প্রকৃতই তুমি কিরণকে হাতে করিয়া বিষ পান করাইয়াছ। 

অমৃত। আমি? 

আমি। হাঁ। 

অমৃত। আমি কিরূপে তাহাকে বিষ খাওয়াইলাম? 

আমি। ওলার সরবত কিরণকে কে পান করিতে দিয়াছিল? 

অমৃত। আমি। 

আমি। উহার ভিতর বিষ ছিল। 

অমৃত। তাহা হইবে কি প্রকারে? ওই ওলাত আমি প্রত্যহই কিরণকে দিয়া থাকি। তাহা হইলে এতদিন জানিতে পারিতাম না কি, যে উহার ভিতর বিষ আছে? 

আমি। উহাতেই বিষ ছিল। ও যে সকল ওলা এখনও আছে, তাহার মধ্যেও বিষ আছ। 

অমৃত। ও কথা আমি বিশ্বাস করি না। আচ্ছা, ওই ওলা একটি আমাকে দেও দেখি, আমি খাইয়া দেখি উহার ভিতর প্রকৃত বিষ আছে কি না। 

আমি। ওই ওলা খাইলে তোমার অবস্থা কিরণের দশাই হইবে, তুমিও মরিয়া যাইবে। 

অমৃত। তাহা হইলে তো ভালই হয়। আমি যদি কোনরূপে কিরণের নিকট গমন করিতে পারি, তাহা হইলেই আমার মঙ্গল, তাহা হইলেই আমি সমস্ত দুঃখ ভুলিতে পারিব। 

আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে। এখন আমি তোমাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান কর। 

অমৃত। করুন। 

আমি। এ ওলা কোথা হইতে আসিয়াছিল? 

অমৃত। তাহা আমি পূর্বেই আপনাদিগের বলিয়াছি। কিরণের মাতা ওই ওলা তাঁহার বাড়ী হইতে পাঠাইয়া দিয়া ছিলেন। 

আমি। কত দিবস হইল, তিনি ওলা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন? 

অমৃত। প্রায় একমাস হইবে। 

আমি। যে হাঁড়িতে ওলা থাকিত, সেই হাঁড়ি সহিত তিনি উহা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন কি? 

অমৃত। একখানি থালায় করিয়া তিনি পাঠাইয়া দেন। ওই থাল হইতে উঠাইয়া একটি নূতন হাঁড়িতে আমি উহা রাখিয়া দি। 

আমি। যে নূতন হাঁড়িতে করিয়া তুমি উহা রাখিয়াছিলে, সেই হাঁড়িটি বেশ পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিলে কি?

অমৃত। আমি উত্তমরূপে উহা পরিষ্কার করিয়া রাখিয়া ছিলাম। ওই হাঁড়িটা বেশ করিয়া প্রথমে ধুইয়া ফেলি, 13 রৌদ্রে শুখাইয়া তাহার মধ্যে ওই সকল ওলা আমি রাখিয়া দি। 

আমি। যেস্থানে ওলা রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে কাহার কাহার যাতায়াত ছিল? 

অমৃত। উহা কৃষ্ণচন্দ্রের শয়নের ঘর; সুতরাং, কৃষ্ণচন্দ্র ও কিরণ উহা জানিতেন; তদ্ব্যতীত, আমার ও তারার সেই স্থানে যাতায়াত ছিল। 

আমি। যে ব্যক্তি তোমাদিগের রন্ধনাদি করে? 

অমৃত। তাহাকে কখনও ওই ঘরের মধ্যে যাইতে দেখি নাই। 

আমি। ওলার সরবত প্রস্তুত করার কার্য্য তোমারই ছিল? 

অমৃত। আমিই উহা প্রস্তুত করিতাম। 

আমি। তারা? 

অমৃত। তারাকে কখন আমি এ কার্য্য করিতে দেখি নাই। 

আমি। যে দিবস তারা দেশে গমন করে, সেই দিবস সে কোন্ সময় এই স্থান হইতে গমন করিয়াছিল? 

অমৃত। খুব প্রত্যূষে সে গমন করিয়াছিল। 

আমি। তাহার আর কেহ গিয়াছিল? 

অমৃত। কর্তাবাবুর গাড়ির সহিস তাহার সহিত গমন করিয়াছিল। 

আমি। সে কতদূর গিয়াছিল বলিতে পার? 

অমৃত। সে আম্মানি ঘাট পর্যন্ত গমন করিয়া তাহাকে ষ্টীমারে উঠাইয়া দিয়া আসে। যতক্ষণ ষ্টীমার না ছাড়িয়া দেয়, ততক্ষণ সে সেইস্থান হইতে চলিয়া আসে নাই। 

আমি। যে দিবস তারা চলিয়া যায়, সেই দিবসও নিয়মিত রূপে কিরণ সরবত পান করিয়াছিল? 

অমৃত। না, সে দিবস কিরণ সরবত পান করে নাই। 

আমি। কেন, সে দিবস তুমি কি সরবত প্রস্তুত কর নাই? 

অমৃত। প্রস্তুত করিয়াছিলাম, প্রস্তুত হইবার পর উহা একটি বাটীতে করিয়া কিরণকে পান করিতে দি। সেই সময় কিরণ কি একটু কার্য্যে ব্যস্ত ছিলেন বলিয়া, তিনি উহা তাঁহার নিকট রাখিয়া দেন। সেই সাবকাশে একটি বিড়াল আসিয়া উহার কতক অংশ পান করিয়া ফেলে; সুতরাং বিড়ালের উচ্ছিষ্ট আর আমি তাহাকে পান করিতে না দিয়া উহা ফেলিয়া দি, ও পুনরায় সরবত প্রস্তুত করিয়া দিতে চাহি; কিন্তু, কিরণ বারণ করেন; সুতরাং, আমিও আর প্রস্তুত করি না, তিনিও উহা পান করেন না। 

আমি। যে বিড়ালটি সেই দিবস ওই সরবত পান করিয়াছিল, সেই বিড়ালটি এখন কোথায়? 

অমৃত। সেই দিন হইতে আর আমি ওই বিড়ালটিকে দেখিতে পাই নাই। 

আমি। যে বিড়ালটি ওই সরবত পান করিয়াছিল, সে কি কেবল সেই দিবসই তোমাদিগের বাড়ীতে আসিয়াছিল, না ইহার পূর্ব্বেও তাহাকে মধ্যে মধ্যে দেখিতে পাইতে? 

অমৃত। সেই বিড়ালটিকে সদাসৰ্ব্বদাই দেখিতে পাইতাম। সে সৰ্ব্বদা এই বাড়ীর ভিতরই ঘুরিয়া বেড়াইত। কিন্তু সরবত পান করার পর হইতে আর তাহাকে একবারও দেখিতে পাই নাই। 

আমি। তাহা হইলে সেও বোধ হয় মরিয়া গিয়াছে। 

অমৃত। তাহা ত কিছুই জানিতে পারি নাই। 

যে সময় আমি অমৃতকে সেই বিড়ালের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, সেই সময় সেই স্থান দিয়া সেই বাড়ীর পাচকটি গমন করিতেছিল। সে আমাদিগের কথা শুনিয়া সেই স্থানে একটু দাঁড়াইল, ও অমৃতকে জিজ্ঞাসা করিল “বিড়ালের কথা কি বলিতেছ?” 

অমৃত। আমাদিগের বাড়ীতে যে বিড়ালটি সদা সর্ব্বদা ঘুরিয়া বেড়াইত, তাহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহাই বলিতেছিলাম। 

পাচক। কোন্ বিড়ালটি? সেই সাদা বিড়াল? 

অমৃত। হাঁ। 

পাচক। সে মরিয়া গিয়াছে। 

অমৃত। সে কবে মরিল? 

পাচক। যে দিবস বউ-দিদির এই অবস্থা ঘটে, সেই দিবস অতি প্রত্যুষে তাহাকে মৃত অবস্থায় পায়খানার ভিতর পাওয়া যায়। সেই স্থান হইতে তাহাকে বাহির করিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দেওয়া হয়। তথা হইতে বোধ হয়, ডোমেরা উহা উঠাইয়া লইয়া গিয়া থাকিবে। কারণ, কিছু পরে সেই স্থানে উহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায় নাই। 

অমৃত। ইহার কিছুই আমি পূৰ্ব্বে শুনি নাই। 

ইহাদিগের কথা শুনিয়া সেই সময় আমার প্রতীতি জন্মিল যে, সেই বিড়ালের মৃত্যুর কারণও বিষপান। তাহা ওই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া দেশে গমন করিবার পর ওলার হাঁড়িতে যে কয়েকটি ওলা ছিল, তাহার সমস্তই বিষাক্ত। সেই দিবস কিরণের নিমিত্ত যে সরবত প্রস্তুত করা হইয়াছিল, তাহাতেও বিষ ছিল। উহা পান করিয়া সেই দিবসেই কিরণের প্রাণবায়ু শেষ হইত, কিন্তু সেই দিবস ওই বিড়াল কর্তৃক তাহার জীবনরক্ষা হয়। ওই সরবত পান করিতে কিরণের একটু বিলম্ব হয়। সেই সুযোগে ওই বিড়ালটী আসিয়া উহা পান করে। বিড়ালের উচ্ছিষ্ট সরবত অমৃত আর কিরণকে পান করিতে দেয় নাই বলিয়াই, কিরণ সে দিবস রক্ষা পান; নতুবা আর এক দিবস পূর্ব্বেই কিরণকে মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিতে হইত। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

অমৃতের নিকট হইতে এই সকল সমাচার অবগত হইবার পর হইতে আমাদিগের মনের গতি হঠাৎ পরিবর্তিত হইয়া গেল। সেই সময় কে যেন আসিয়া আমাদিগের কাণে কাণে বলিয়া দিল “তোমরা এখন তারারই অনুসন্ধান কর। তারা ব্যতীত এ কার্য্য আর কাহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। কোন গভীর দুরভিসন্ধি সাধন করিবার মানসে তারা বাড়ী যাইবার পূর্ব্বে অবশিষ্ট সমস্ত ওলায় বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়া আপন দেশে চলিয়া গিয়াছে। কারণ সে বিশেষরূপে অবগত আছে যে, কিরণ ব্যতীত এই ওলা আর কেহই খায় না; সুতরাং, কিরণ ভিন্ন উহাতে আর কাহারও জীবননাশের সম্ভাবনা নাই। সে আরও স্থির করিয়া গিয়াছে যে, কিরণের জীবিতাবস্থায় যখন সে আপন দেশে গমন করিতেছে, তখন কিরণের মৃত্যুর পর তাহার উপর কোনরূপেই সন্দেহ হইতে পারিবে না; সুতরাং, তাহার অনিষ্টের আর কোনরূপ সম্ভাবনাই থাকিবে না; অথচ তাহার গূঢ় অভিসন্ধি অনায়াসেই সম্পন্ন হইয়া যাইবে।” 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তাহার অনুসন্ধান করা সর্ব্বতোভাবে কর্তব্য, ইহাই এখন সম্পূর্ণরূপে স্থির করিয়া লইলাম। ও পরদিবস অমৃতকে সঙ্গে লইয়া তারার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম, এবং আম্মানি ঘাটে গমন করিয়া, ষ্টীমারে আরোহণ পূর্ব্বক, মেদিনীপুর অভিমুখে গমন করিলাম। তারা অমৃতের স্বদেশীয়া; সুতরাং অমৃতের সাহায্যে তাহার বাড়ীর অনুসন্ধান করিতে আমাদিগের কোনরূপ কষ্টই হইল না। যেমন অনায়াসেই তারার বাড়ী পাইলাম, তারাকেও সেইরূপ সহজে প্রাপ্ত হইলাম। আরও দুই তিনটি স্ত্রীলোকের সহিত একত্রে বসিয়া সেই সময় তারা নানারূপ খোস গল্পে নিযুক্ত ছিল। হঠাৎ অমৃত ও আমাকে দেখিয়া সে যেন একেবারে চমকিত হইল ও কহিল, “ইনি কে? আর হঠাৎই বা তুমি এখানে আসিলে কেন?” 

এই কথার উত্তর আমি আর অমৃতকে প্রদান করিতে দিলাম না। তাহার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতেই আমি কহিলাম “আমরা যে কেন হঠাৎ তোমার নিকট আগমন করিলাম, তাহা আর তুমি আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন? নিজের মনকেই কেন জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ না। যে ধীবর মৎস্য ধরিবার আশায় জাল ঠিক রাখিয়া একটু দূরে আসিয়া দণ্ডায়মান হয়, সেই জালে মৎস্য পড়িলে কি সে বুঝিতে পারে না, যে তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে। তুমিও যে ভয়ানক আশা-মৎস্য ধরিবার মানসে সর্ব্বনাশকারী জাল বিকীর্ণ রাখিয়া সুদূরে আসিয়া বসিয়া আছ, এখন যাইয়া দেখ, তোমারও সেই অভেদ্য জালে তোমার অভীপ্সিত মৎস্য পতিত হইয়াছে। কিন্তু যে সাধের আশা করিয়া ওই মৎস্য ধরিতে বসিয়াছ, তোমার সেই আশা পূর্ণ হইবার পূর্ব্বেই তোমারও সর্ব্বনাশ সাধিত হইবে। ওই সাধের মৎস্য ভক্ষণ করিবার পূর্ব্বেই উহার প্রবল কাঁটা তোমার গলায় বিদ্ধ হইয়া তোমাকেও সেই মৎস্যের সহগামিনী করিবে। এখন বুঝিতে পারিলে যে, আমরা কেন হঠাৎ এখানে আগমন করিলাম।” 

তারা। আপনার কথা ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন?

আমি। তুমি আমার অপেক্ষা আমার কথা অধিক বুঝিতে পারিতেছ। এখন আমার সহিত চল; কলিকাতায় গিয়া তোমার সাধের মৎস্য ভক্ষণ করিয়া আইস। 

তারা। কিসের সাধ? 

আমি। কিসের সাধ তাহা জান না? তোমার নিজের সাধ তুমি জান না? সে সাধের আশায় মধুবাবুর সোণার সংসার ভস্মে পরিণত করিতে বসিয়াছ, যে সাধের আশায় কৃষ্ণচন্দ্রের কপালে প্রজ্বলিত বহ্নি সংস্থাপিত করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে, সেই সাধ কি তাহা তুমি জান না? জান, খুব জান। যে কার্য্য স্বহস্তে সাধিত করিয়াছ, তাহা তুমি অবগত নহ বলিয়া কাহার নিকট ভাণ করিতে বসিয়াছ? চল, আমার সহিত এখনই তোমাকে গমন করিতে হইবে। আমারই হস্তে তোমার সাধ পূর্ণ হইবে! 

তারা। কোথায় যাইব? আপনি কে? আপনার সহিত আমাকে এখনই কোথা যাইতে হইবে? 

আমি। আমি যে হই, তাহা তুমি জানিতে পারিবে। এখন আমার সহিত তোমাকে কলিকাতায় গমন করিতে হইবে। মধুবাবুর বাড়ীতে তোমাকে গমন করিতে হইবে। 

তারা। মধুবাবু আমার মনিব। তাঁহারই অন্নে আমি প্রতিপালিতা হইতেছি। তাঁহার নিকট গমন করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। চলুন, আমি এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি। আমার মনিবের সংবাদ ভাল ত? তিনি ভাল আছেন ত? কৃষ্ণচন্দ্রবাবুর কোনরূপ বিপদ ঘটে নাই ত? কারণ তাঁহাদিগের মঙ্গলেই আমাদিগের মঙ্গল। অমৃত, তুই কোন কথা কহিতেছিস না কেন? আমাকে হঠাৎ কলিকাতায় যাইতে হইবে কেন? আর তুই বা এখানে আসিলি কেন? 

অমৃত। তুই কি আর কথা কহিবার মুখ রাখিয়াছিস যে কথা কহিব! তোর কষ্ট দূর করিবার নিমিত্ত যেমন তোকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া বিশ্বাস করিয়া একটি বড় লোকের বাড়ীতে রাখিয়া দিয়াছিলাম, তুই সেইরূপ বিশ্বাসঘাতকতার কার্য্য করিয়া তোর ত সর্ব্বনাশ সাধন করিচিস্, সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্ব্বনাশ করিতেও তুই কিছু বাকী রাখিলি নে। ইহাতে আমি তোর দোষ দিব কি আমার অদৃষ্টের দোষ। 

তারা। আমি ত তোমাদিগের কথার বিন্দুমাত্রও বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কি হইয়াছে, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতেছ না কেন? 

অমৃত। স্পষ্ট করিয়া আর কি বলিব। আমার মাথা মুণ্ড যাহা কিছু বাকী ছিল, তাহার সমস্তই হইয়াছে। তোর হইতে যে এইরূপ হইবে, তাহা আমি একদিবসের নিমিত্তও কখনও মনে করি নাই। 

অমৃতের সহিত তারার এইরূপ দুই চারিটি কথা হইবার পর, আমি অমৃতকে আর অধিক কথা বলিতে দিলাম না। উভয়কেই সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। সেই দিবস কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিবার কোনরূপ সুযোগ না থাকায়, নিকটবর্ত্তী একটি থানায় গিয়া আমরা উপস্থিত হইলাম ও সেই স্থানেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ 

থানায় উপস্থিত হইয়া সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে সমস্ত কথা কহিলাম। সেই সময় ওই থানার যিনি ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহাকে আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। ইনি মুসলমান, কিন্তু একজন বিশেষ উপযুক্ত ও বুদ্ধিমান কর্ম্মচারী ছিলেন। তাঁহার নিজের কয়েকটি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে তিনি কয়েকবার কলিকাতায় আগমন করেন। আমি বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া তাঁহার সেই সকল কার্য্য উদ্ধার করিয়া দি। সেই সময় হইতেই তাঁহার সহিত আমার উত্তমরূপ পরিচয় হয়। হঠাৎ আমাকে তিনি তাঁহার থানায় দেখিতে পাইয়া বিশেষ আনন্দিত হন, ও আমাকে তাঁহার সাধ্যমত সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হন; সুতরাং, আমিও তাঁহার নিকট আনুপূর্বিক সমস্ত কথা বর্ণন করি। আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন “আপনারা কলিকাতার কর্ম্মচারী। মেদিনীপুরের স্ত্রীলোকদিগের নিকট হইতে প্রকৃত কথা বাহির করিয়া লওয়া আপনার কার্য্য নহে। আমি এই মেদিনীপুর জেলার মধ্যে দারোগাগিরি কার্য্য করিতে করিতে বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি; কিন্তু মেদিনীপুরের স্ত্রীলোকগণের নিকট হইতে সকল সময় কথা বাহির করিয়া লইতে আমি ও অপারক। যে যাহা হউক, এদেশে এতদিবস থাকিয়া আমার যেরূপ বহুদর্শিতা জন্মিয়াছে, তাহাতে আপনারা কোনরূপে ইহার নিকট কথা বাহির করিয়া লইতে সমর্থ হইবেন না। আমি যদি বিশেষরূপে চেষ্টা করি, তাহা হইলে অভাবপক্ষে দুই তিন দিবস অপর কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া বিধিমতে পরিশ্রম ও চেষ্টা করিলে, যদি কিয়ৎ পরিমাণে কৃতকার্য হইতে পারি। যে যাহা হউক, আপনি যখন এখানে আসিয়াছেন, তখন আপনার কার্য্য যে পর্য্যন্ত উদ্ধার না হইবে, সে পৰ্য্যন্ত আমি আপনাকে এস্থান হইতে প্রস্থান করিতে দিতেছি না।” 

দারোগার কথা শুনিয়া আমিও তাঁহার কথায় সম্মত হইলাম। তিনি আমাকে কহিলেন, যে পর্য্যন্ত তিনি না বলেন, সেই পর্য্যন্ত তারাকে যেন কোন কথা জিজ্ঞাসা করা না হয়। কারণ, এরূপ অবস্থায় তাহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করা যাইবে সে তাহারই উত্তর করিবে, “আমি এটা জানি না, বা আমি করি নাই।” একবার “না” বলিলে তাহাকে পুনরায় “হাঁ” বলান একেবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িবে। দারোগার কথা কতকটা যুক্তিসঙ্গত জ্ঞান করিয়া আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। সে দিবস তারাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা হইল না। রাত্রিকালে আহারাদির পর তিনি তারাকে তাঁহার নিকট ডাকাইলেন ও তাহাকে লইয়া একটু নির্জ্জনে উপবেশন করিলেন। আমরা কেহই সেই স্থানে গমন করিলাম না; কিন্তু দূর হইতে দেখিতে পাইলাম যে, তিনি তারার সহিত নানারূপ বাক্য ব্যয় করিতেছেন; কিন্তু, তিনি যে কি বলিতেছেন, বা তাঁহার কথার উত্তরে তারাই বা কি বলিতেছে, তাহার কিছুই আমরা সেই স্থান হইতে বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। এইরূপে ক্রমে অনেক রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। দেখিয়া শুনিয়া আমি শয়ন করিলাম ও ক্রমে নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম। দারোগা সাহেব তাহার পর তাহাকে লইয়া যে কি করিলেন, তাহার কিছুই আমি অবগত হইতে পরিলাম না, বা সেই রাত্রিতে কেহই আমার নিদ্রা ভঙ্গ করিল না। পর দিবস আপনা হইতেই আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। যখন আমি শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, তখন বেলা প্রায় ৭টা। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, দারোগা সাহেব থানায় নাই। তারাকে সঙ্গে লইয়া রাত্রিতেই তিনি থানা হইতে বহির্গত হইয়া চলিয়া গিয়াছেন, এখন পৰ্য্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই। তিনি যে কোথায় গিয়াছেন, তাহা কেহ আমাকে বলিতে পারিল না, বা ইচ্ছা করিয়া বলিল না।আমি প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করিয়া দারোগা সাহেবের প্রত্যাশায় বসিয়া রইলাম। দিবা আন্দাজ ৯টার সময় দারোগা সাহেব থানার ভিতর আগমন করিলেন; কিন্তু, তারাকে তাঁহার সহিত আসিতে দেখিলাম না। তিনি আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিলেন ও আমাকে যাহা কহিলেন, তাহাতে আমার বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল। তারা যে কিরূপ ভয়ানক রাক্ষসী তাহা জানিতে পারিয়া, আমি প্রথমে তাহা বিশ্বাস করিতেই চাহিলাম না। এরূপ কার্য্যসকল যে মানুষের মধ্যে, বিশেষ হিন্দু দিগের মধ্যে ঘটিতে পারে, তাহা সেই সময় কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কিন্তু পরিশেষে তাহার মুখ হইতে নিজ কর্ণে যখন তাহা শুনিয়াছিলাম, তখন তাহা বিশ্বাস করিতেই হইয়াছিল; কিন্তু, সে সকল কথা আমি পাঠক পাঠিকাগণকে স্পষ্ট করিয়া জানিতে দিব না, বা স্পষ্টরূপে লিপিবদ্ধ করিয়া লেখনীকে অপবিত্র করিব না। আভাসে যাঁহারা যাহা বুঝিয়া লইতে পারেন, তাঁহারা তাহাই বুঝিয়া লইবেন। সে যাহা হউক, দারোগা সাহেব কহিলেন, “আমি যে সকল কথা তারার নিকট হইতে বহুকষ্টে বহির্গত করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছি, তাহা আপনি তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিয়া পুনরায় তাহার নিকট হইতে অবগত হউন। আমার সম্মুখে একে একে তাহাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলে এখন বোধ হয়, সে কোন কথা আর গোপন করিবে না। তাহা হইলেই আপনি সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিবেন ও আপনার মোকদ্দমার কিনারা হইয়া যাইবে।” এই বলিয়া দারোগা সাহেব তারাকে আনিবার নিমিত্ত জনৈক প্রহরীকে প্রেরণ করিলেন। প্রহরী তারাকে আনিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিল। 

তারা আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলে দারোগা সাহেব তাহাকে সেই স্থানে বসিতে কহিলেন। তারা সেই স্থানে উপবেশন করিল। দারোগা সাহেব আমাকে কহিলেন, “তারা এই দেশীয় স্ত্রীলোক; সুতরাং, আমি তাহাকে বাল্যকাল হইতেই অবগত আছি। আপনি তাহাকে যাহা ইচ্ছা তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন; কিন্তু, সে কিছুতেই মিথ্যা কথা কহিবে না। কলিকাতা অতিশয় মন্দ স্থান। তাহা মন্দ নহে, মন্দ স্থানের গুণে সে মন্দ হইয়া পড়িয়াছে। নিজের অবস্থা ভুলিয়া গিয়া পরের অবস্থায় তাহার লোলুপ জন্মিয়াছে; তাই সে বুঝিতে না পারিয়া এই কার্য্য করিয়া ফেলিয়াছে; ইচ্ছা করিয়া সে এই কার্য্য করে নাই। তাহার হৃদয়ে প্রবল লোভ উদ্দীপ্ত হওয়ায় সেই লোভ সে কোনরূপেই সম্বরণ করিতে না পারিয়া এই বিষম ব্যাপার ঘটাইয়াছে। সে যাহা হউক, আপনি অগ্রে ইহার নিকট হইতে সমস্ত কথা অবগত হইয়া পরিশেষে বিবেচনা মত কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবেন।” এই বলিয়া দারোগা সাহেবও সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন। 

আমি। তারা তুমি প্রকৃত কথা কহিবে কি? 

দশম পরিচ্ছেদ 

তারা। কেন কহিব না? যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, তাহা বলিয়া এখন আর মিথ্যা কথা কহিব কেন? 

আমি। তুমি মধুবাবুর বাড়ীতে কার্য্য করিতে? 

তারা। হাঁ মহাশয়, আমি তাঁহারই বাড়ীতে চাকরাণীগিরি কার্য্য করিয়া দিন যাপন করিতাম। 

আমি। তুমি এখন হঠাৎ দেশে আসিলে কেন? 

তারা। অনেক দিন আসি নাই বলিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া এখানে আসিয়াছি। 

আমি। তুমি কাহার চাক্রাণী ছিলে? মধুবাবুর না কৃষ্ণচন্দ্রের? 

তারা। আমি উভয়েরই কার্য্য করিতাম, উভয়েই আমার মনিব।

আমি। কিরণ? 

তারা। তিনিও আমার মনিব। 

আমি। তাহা হইলে দেখিতেছি তিনজনেই তোমার মনিব। 

তারা। হ্যাঁ। 

আমি। ওই তিনজনের মধ্যে তোমাকে কে অধিক ভালবাসিত? 

তারা। মধুবাবু ও কৃষ্ণচন্দ্র উভয়েই আমাকে ভালবাসিতেন; কারণ, আমি উভয়ের কার্য্যই সমানভাবে সম্পন্ন করিতাম। 

আমি। কিরণ? 

তারা। কিরণ আমাকে দেখিতে পারিতেন না। 

আমি। কেন? 

তারা। কৃষ্ণচন্দ্র আমাকে একটু অনুগ্রহ করিতেন বলিয়া তিনি আমাকে দেখিতে পারিতেন না। 

আমি। তোমাকে তো উভয়েই ভালবাসিতেন; কিন্তু তুমি কাহাকে আন্তরিক ভালবাসিতে? 

তারা। উভয়েই আমার মনিব; সুতরাং, আমার আবার ভালবাসা কি? 

আমি। তাহাত সত্য, কিন্তু কাহাকে অধিক যত্ন করিতে তোমার সর্ব্বদা ইচ্ছা হইত? 

তারা। কৃষ্ণচন্দ্রের কাৰ্য্যসকল আমি সর্ব্বাগ্রেই সম্পন্ন করিয়া দিতাম। 

আমি। তুমি বেতন পাইতে কত? 

তারা। আমি ২ টাকা করিয়া বেতন পাইতাম। 

আমি। ওই বেতন তুমি মাসে মাসে পাইতে, কি দুই চারি মাসের বেতন একত্রে গ্রহণ করিতে? 

তারা। আমি মাসে মাসেই আমার বেতন প্রাপ্ত হইতাম। 

আমি। ওই বেতনের টাকা তুমি কি করিতে? 

তারা। ওই টাকা একত্র করিয়া আমি গহনা গড়াইতাম। 

আমি। ওই বাড়ীতে তোমার কর্ম্ম এখনও দুই বৎসর হয় নাই। দুই বৎসরের বেতন একত্রিত করিলে ৪৮ টাকার অধিক হয় না। ওই টাকা দিয়া তুমি কি গহনা গড়াইয়াছ? 

তারা। আমার গলার এই সোণার দানা। 

আমি। তাহা হইলে তোমার হাতের এই সোণার বালা কোথা হইতে আসিল? 

তারা। মধুবাবু আমাকে উহা গড়াইয়া দিয়াছেন। 

আমি। এ কথা কৃষ্ণচন্দ্র বা অপর কেহ অবগত আছেন? 

তারা। না। 

আমি। তাগা গড়াইয়া কে দিল? 

তারা। ইহা কৃষ্ণচন্দ্র দিয়াছেন। 

আমি। মধুবাবু ইহা জানেন? 

তারা। না। 

আমি। কেন? 

তারা। আমি কাহারও কথা কাহারও নিকট বলিতাম না বলিয়া, কেহই অপরের কোন কথা আমার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিতেন না। 

আমি। সে যাহা হউক, যে ওলার সরবত কিরণ প্রত্যহ পান করিয়া থাকে, সেই ওলার সহিত তুমি বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলে কেন? 

তারা। কিরণকে হত্যা করিবার মানসে। 

আমি। এরূপ ভয়ানক ইচ্ছা তোমার হৃদয়ে কেন আসিয়া উপস্থিত হইল? 

তারা। মহাশয়, এ কথার উত্তর আর আমি আপনাকে কি দিব! মধুবাবু আমাকে ভাল বাসিলেও আমি কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতাম। যাহাতে আমি সৰ্ব্বদা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মুখে উপস্থিত থাকিতে পারি, যাহাতে আমি সদাসর্বদা তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিতে সমর্থ হই, তাহার নিমিত্তই আমার মন সর্ব্বদা অস্থির থাকিত; কিন্তু, কিরণের নিমিত্ত আমি আমার মনোবাঞ্ছা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করিয়া উঠিতে পারিতাম না। কৃষ্ণচন্দ্রের যে কার্য্য করিবার নিমিত্ত যখন আমি প্রবৃত্ত হইতাম, কোথা হইতে তখনই তাহার প্রতিবন্ধকতা জন্মাইত। সুতরাং তাহারই নিমিত্ত আমি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইতাম না। কাযে কার্যেই অন্তরে অন্তরে আমার ক্রোধ প্রজ্বলিত হইত; কিন্তু, প্রকাশ্যে আমার মনের ভাব প্রকাশ করিতে সাহসী হইতাম না। কিরণ আমার মনিবপত্নী হইলেও, আমি কিন্তু তাহার দৃশ্য কোনরূপেই সহ্য করিতে পারিতাম না। প্রকাশ্য ভয়ে তাঁহার আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হইত বটে, কিন্তু আমার অন্তর বিষম বিষে সর্ব্বদা জর্জরিত হইত। এইরূপে কিছুদিবস বিষের যন্ত্রণাভোগ করিলাম সত্য, কিন্তু কোনোরূপেই আর ওই যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারিলাম না। কিরণ বর্ত্তমান থাকিলে আমার ওই যন্ত্রণার কোনরূপেই নিবৃত্তি নাই ভাবিয়া, মনে মনে আমি তাহার সর্ব্বনাশ সাধন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলাম। কারণ, সেই সময় আমার মনে মনে এই আশা জন্মিয়াছিল যে, যদি কোন গতিকে কিরণকে আমি লোকান্তরিত করিতে পারি, তাহা হইলে আমার কণ্টক দূর হইবে; সুতরাং, বিনা বাধা বিপত্তিতে আমি মনের সুখে দিন যাপন করিতে সমর্থ হইব। কিরূপে আমি আমার সুখের রাস্তা পরিসর করিতে সমর্থ হইব, তাহাও ভাবিয়া চিন্তিয়া অনেক দিন হইতে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম। কোনরূপে তাহাকে বিষপান করাইতে হইবে মনে মনে ইহা স্থির করিয়া, আমি প্রবল হলাহলের সংগ্রহও করিয়া রাখিয়াছিলাম। কিন্তু সুবিধামত সুযোগ না ঘটায়, সেই কাৰ্য্য আমি এতদিবস সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারি নাই। আমি দেশে আসিবার ভাণে মধুবাবুর নিকট হইতে গত ছয় মাস পর্যন্ত বিদায় প্রার্থনা করিতেছি; কিন্তু, অভাবপক্ষে ৫।৭ দিবসের নিমিত্ত তিনি আমাকে ছাড়িয়া দিতে চাহেন নাই বলিয়া, এই কার্য্য করিতে এত বিলম্ব হইয়া পড়িয়াছে। নতুবা, আমি আমার মনোবাঞ্ছা ইহার অনেক পূর্ব্বেই সম্পন্ন করিয়া ফেলিতাম। অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া আজ কয়েক দিবস হইল, আমি কোনরূপে মধুবাবুর নিকট হইতে ১০ দিবসের নিমিত্ত বিদায় পাইয়াই, আমি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবার পন্থা করিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলাম। এখন দেখিতেছি আমার এই পন্থা পরিষ্কার হইয়াছে; কিন্তু, ভাবিয়া চিন্তিয়া নিজের বাঁচিবার যে পন্থা স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, তাহা আপনারা জানিতে পারিয়াছেন; সুতরাং, আমার জীবনের আশাও আর নাই। আমার মনের কথা আমি একাগ্রচিত্তে আপনাদিগের নিকট বলিলাম; এখন যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই আপনারা করিতে পারেন। 

আমি। তুমি কি অভিপ্রায়ে ওলার সহিত বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলেও কিরূপ উপায় করিয়া নিজের বাঁচিবার রাস্তা পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিলে? 

তারা। মহাশয়। মধুবাবুর বাড়ীতে যতগুলি লোক আছে, তাহাদিগের কেহই ওলার সরবত পান করে না। ওলা কেবলমাত্র কিরণের নিমিত্তই সংগৃহীত থাকে ও তিনিই উহার সরবত পান করিয়া থাকেন। ওই সরবত প্রস্তুত করিবার ভার অমৃত ভিন্ন আর কাহারও উপর ন্যস্ত নাই; সুতরাং, আমি মনে মনে ইহাই স্থির করি যে, ওই ওলার সহিত যদি কোনরূপে বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিতে পারি, তাহা হইলেই আমার অভীষ্ট সিদ্ধি হইতে পারে; কারণ, ওই ওলার সরবতের সহিত আমার কোনরূপ সংশ্রব নাই। যদি উহা লইয়া কোনরূপ গোলযোগ উপস্থিত হয়, তাহা হইলে অমৃতই টানাটানিতে পড়িবে। তাহার উপর এইরূপ গোলযোগের পূৰ্ব্ব হইতেই যদি আমি আপন দেশে গমন করিতে পারি, অর্থাৎ গোলযোগের সময় যদি আমি একেবারে কলিকতায় না থাকি, তাহা হইলে আমার উপর কোনরূপেই সন্দেহ হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। মনে মনে এই ভাবিয়া আমি পূৰ্ব্ব হইতেই বিষ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম। যে দিবস আমি বাড়ী যাইবার অনুমতি পাইলাম, সেই দিবস রাত্রিতে সুযোগ মত ওই বিষ আমি একটি ওলার সহিত মিশ্রিত করিয়া রাখিয়া দিলাম। কারণ, আমি বেশ জাতিাম, আমি দেশ হইতে প্রত্যাগমন করিবার পূর্ব্বেই ওই ওলার সরবত কিরণ পান করিবে, এবং তাহা হইলেই আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। 

আমি। যে ওলাতে তুমি বিষ মিশ্রত করিয়া রাখিয়া ছিলে, সেই ওলা কোথায় ছিল? 

তারা। সে হাঁড়িতে ওলা রক্ষিত থাকিত, সেই হাঁড়ির মধ্যেই উহা ছিল। 

আমি। তুমি কয়টি ওলাতে এইরূপ বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলে? 

তারা। ওই হাঁড়িতে সেই সময় তিন চারটি ব্যতীত ওলা ছিল না। আমি উহার একটিতে বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। 

আমি। যে কয়টি ওলা ছিল, তাহার সমস্তগুলিতে বিষ মিশ্রিত না করিয়া, একটিতে বিষ মিশ্রিত করিবার কারণ কি? 

তারা। আমার ঠিক স্মরণ হয় না, একটিতে কি দুইটিতে আমি বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। বোধ হয় দুইটিতে, আর ওই দুইটি ওলা অপর ওলার নিম্নে রাখিয়া দিয়াছিলাম; কারণ, আমি ভাবিয়াছিলাম, হাঁড়িতে যে সকল ওলা আছে, তাহার উপর হইতেই লইয়া ভিজান হয়; সুতরাং, আমি দেশে গমন করিবার পর দুই একদিবস পৰ্য্যন্ত উপরের ওলার সরবত প্রস্তুত হইলে কিরণের বিপদের সম্ভাবনা থাকিবে না। তাহার পর যখন বিষ-মিশ্রিত ওলায় হাত পড়িবে, তখন আর আমার উপর কোনরূপেই সন্দেহ হইতে পারিবে না; কারণ, তাহার অনেক পূর্ব্ব হইতেই আমি সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছি। 

আমি। দুইটি ওলাতে বিষ মিশ্রিত করিবার কারণ কি? 

তারা। একটির সরবত যদি কোন গতিকে নষ্ট হইয়া যায়, তাহা হইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না বলিয়া দুইটিতে বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলাম। কারণ, দুইটিই একেবারে নষ্ট হইবার সম্ভাবনা ছিল না। 

আমি। তুমি কহিতেছ যে, দুইটি ওলার বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলে; কিন্তু, আমরা দেখিতেছি, ওই হাঁড়ির মধ্যে যতগুলি ওলা ছিল, তাহার সমস্তগুলিতেই বিষ মিশ্রিত ছিল। 

তারা। তাহা আমার মনে নাই। আমি অন্ধকারের মধ্যে ওই কার্য্য সম্পন্ন করি। বিশেষ সেই সময় আমার বুদ্ধির ঠিক স্থিরতা ছিল না। হইতে পারে দুইটির পরিবর্ত্তে ভুল করিয়া আমি সকলগুলিতেই বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়া দিয়া থাকিব। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

তারার কথা শুনিয়া আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম, জগতে কত প্রকার রাক্ষস রাক্ষসী বিরাজ করিতেছে। আমরা পুলিস-কৰ্ম্মচারী, অনেক দিবস পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিয়া অনেকের অনেক রূপ দেখিয়াছি, অনেকের অনেক গুপ্ত রহস্য অবগত হইয়াছি, অনেক জনসমাজে সুপরিচিত ও সুবাস-ফলান্বিত ব্যক্তিগণের বাহ্যিক পরদার অন্তরালে প্রবিষ্ট হইয়া তাহার আভ্যন্তরিক অবস্থা সকল পরিদর্শন পূর্ব্বক মনে মনে হাসিয়াছি; কিন্তু, এরূপ রাক্ষস রাক্ষসীর কথা কখনও শুনি নাই, দেখা ত দূরের কথা! বড়লোকগণকে সচরাচর লোকে হাস্যচ্ছলে ‘জানোয়ার’ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকে, এ কথা প্রায় সকলেই অবগত আছেন। আমরা কিন্তু সে কথা, সকল সময় বিশ্বাস করিতে সাহসী হইতাম না; কিন্তু, তারার কথা শুনিয়া আমাদিগের চক্ষু উত্তমরূপে প্রস্ফুটিত হইল। দেখিতে পাইলাম, বড়লোকগণের মধ্যে পশু-প্রকৃতির লোক যত দেখিতে পাওয়া যায়, অপর লোকের মধ্যে প্রায় সেইরূপ দেখিতে পাওয়া যায় না। বড়লোকগণ বাহ্যিক সৎকাৰ্য্য দেখাইয়া জনসমাজে বা রাজসরকারে সুনাম অর্জ্জন করিতে যে চেষ্টিত হইয়া থাকেন, আভ্যন্তরীণ বিষয় সকলের মধ্যে তাঁহাদিগকে তদপেক্ষায় অধঃপতিত অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। অশ্রাব্য প্রবৃত্তি সকলকে বড়লোকগণ যেমন বিশেষ যত্নের সহিত স্থান প্রদান করিয়া রাত্রিদিন তাহারই অর্চ্চনা করিয়া থাকেন, এইরূপ দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত লোকের মধ্যে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। সে যাহা হউক, তারা, মধুবাবু ও কৃষ্ণচন্দ্রের সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া, ও কিরণের ভয়ানক পরিণাম অবলোকন করিয়া, আমাদিগেরও প্রকৃত প্রস্তাবে জ্ঞানের উদয় হইল। ভাবিলাম, এখনও জগতের মধ্যে যত প্রকার পাপ-স্রোত প্রবাহিত হইতেছে, তাহার অনেক বিষয় এখনও আমরা সম্পূর্ণরূপে অবগত হইতে পারি নাই। 

তারার নিকট হইতে আমরা সমস্ত বিষয় অবগত হইলাম, ও এই খুনী মোকদ্দমার কিনারা হইয়া গেল জানিতে পারিয়া, মনে মনে অতিশয় আনন্দিত হইলাম সত্য, কিন্তু কি তারাকে প্রকৃত দণ্ডে দণ্ডিত করিতে সমর্থ হইব, তখন সেই ভাবনা আমাদিগের অন্তরে প্রবিষ্ট হইল। এই ভয়ানক কাৰ্য্য সমাপন করিতে তারাকে কেহ দেখে নাই, বা বিষয়ের কোন আনুষঙ্গিক প্রমাণও নাই যে, তাহার উপর নির্ভর করিয়া তারাকে উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত করিতে সমর্থ হইব। তারা এখন নিজে সমস্ত কথা স্বীকার করিয়াছে, তাহাতেই আমরা সকল অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছি, ও সে যে কতদূর দোষী, তাহাও বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। কিন্তু বিচারকের নিকট যদি সে ইহার সমস্তই অস্বীকার করিয়া বসে, তাহা হইলে তাহাকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিতে কেহই সমর্থ হইবেন না। আর এরূপ অবস্থায় যদি তারাকে কলিকাতায় লইয়া যাই, তাহা হইলে সেই স্থানে সে নিশ্চয়ই আইনজীবীর পরামর্শ পাইবে, ও সমস্ত কথা একেবারে অস্বীকার করিয়া বসিবে, তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ও দারোগা সাহেবের সহিত পরামর্শ করিয়া, পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল, তারা এখন যাহা বলিতেছে, তাহা এখনই একেবারে অস্বীকার করিবে বলিয়া বোধ হইতেছে না; সুতরাং, তাহাকে নিকটবর্ত্তী কোন বিচারকের নিকট লইয়া গিয়া, সে যে সমস্ত বিষয় স্বীকার করিতেছে, তাহা তাঁহার দ্বারা ‘কলমবন্ধ’ করিয়া লওয়াই কর্ত্তব্য। কারণ, ইহার পর কলিকাতায় গিয়া তারা সমস্ত কথা অস্বীকার করিলেও, এখন বিচারকের নিকট যাহা বলিবে, তাহা হইতে তাহার বহির্গত হইবার আর কোন উপায় থাকিবে না। তাহার উপর আনুষঙ্গিক যে সকল সামান্য প্রমাণ আছে, তাহার দ্বারাই তাহাকে উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত করিতে সমর্থ হইব। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, তারাকে সঙ্গে লইয়া আমি ও দারোগা সাহেব তখনই সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম। যে থানায় আমরা গমন করিয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে যে স্থানে সেই প্রদেশীয় বিচারক থাকেন, তাহা প্রায় দশ ক্রোশ ব্যবধান। একখানি শকট আনাইয়া তাহাতে আমরা আরোহণ পূর্ব্বক সেই বিচারকের সমীপবর্ত্তী হইবার মানসে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। সন্ধ্যার পর আমরা সেই বিচারক সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সমস্ত কথা কহিলাম। তিনি আমাদিগের নিকট হইতে সমস্ত কথা অবগত হইয় আমাদিগের দুইজনকে দূরে গিয়া অপেক্ষা করিতে বলিলেন, ও তারাকে তাহার সন্নিকটে রাখিলেন। এইরূপে প্রায় দুই তিনঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইবার পর, সেই বিচারক আমাদিগকে ডাকাইলেন। আমরা তাঁহার নিকট পুনরায় উপস্থিত হইলে, তিনি তারাকে আমাদিগের হস্তে সমৰ্পণ করিয়া কহিলেন “আমার বোধ হয়, তারা সমস্ত প্রকৃত কথা বলিয়াছে। সে যাহা বলিয়াছে, তাহাও আমি লিখিয়া লইয়াছি। ইহাও আপনারা লইয়া যাউন।” এই বলিয়া কতকগুলি কাগজও আমাদিগের হস্তে প্রদান করিলেন। আমরা সকল কাগজ ও তারাকে লইয়া বাহিরে আসিলাম; ও পরিশেষে ওই কাগজগুলি পাঠ করিয়া দেখিলাম, তিনি তাহার সমস্ত কথা বাঙ্গালা ভাষায় উত্তমরূপে লিখিয়া লইয়াছেন। মধুবাবুর বাড়ী তারার চাকরী হইবার সময় হইতে বর্তমান সময় পৰ্য্যন্ত যে যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহার সমস্তই তিনি তন্ন তন্ন করিয়া লিখিয়া লইয়াছেন। যে সকল সামান্য সামান্য বিষয় আমরাও ইতিপূর্ব্বে অবগত হইতে পারিয়াছিলাম না, তাহাও তিনি তারার নিকট হইতে জানিতে পারিয়া লিপিবদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। সেই বিচারক বাঙ্গালী। তাঁহার সহিত আমার পূর্ব্ব হইতে পরিচয় ছিল না, কিন্তু তারার জবানবন্দী পড়িয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, এরূপ চতুর বহুদর্শী ও বিচক্ষণ কর্ম্মচারী অতি অল্পেই দেখিতে পাওয়া যায়। 

তারাকে লইয়া আমি কলিকাতায় আসিয়া, আমার উপরিতন কর্মচারীর নিকট সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিলাম। এই মোকদ্দমার এইরূপ সহজে কিনারা হইয়া গেল দেখিয়া সকলেই অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইলেন। তারা বিচারার্থ মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইল। তাহার বিপক্ষে যে সকল আনুষঙ্গিক প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছিল, তাহার সমস্তই প্রমাণিত হইল। মাজিষ্ট্রেট সাহেব বিচারার্থ তারাকে উচ্চ আদালতে প্রেরণ করিলেন। তারা যাহা স্বীকার করিয়াছিল, তাহা আর গোপন করিল না; সুতরাং, বিচারে তারা চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইল। 

সম্পূর্ণ 

[ চৈত্র, ১৩০৭ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *