তারা বিবির মরদ পোলা
ভেতর থেকে তারাবিবির একটানা সংলাপ কানের ফুটো দিয়ে মাথায় ঢুকে এলোমেলোভাবে আঁচড়াতে শুরু করলে গোলজার আলির সাজানো গোছানো রাত্রিবেলাটা একেবারে তছনছ হয়ে গেলো।
অথচ সন্ধ্যা থেকেই চারদিকে সব ভালোই ঠেকছিলো। আজ তার দোকান বন্ধ। মাইক-টাইক যা আছে এক কলেজের কি একটা ফাংশনে সব ভাড়া করে নিয়ে গেছে। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ও গেলো ফকিরচাঁদের আজাদ রেস্টুরেন্টে। শীতের সন্ধ্যায় ঘুম-দিয়ে-ওঠা টাটকা চোখ-মুখ আবার কবে পাওয়া যায় কে জানে! ঘুমভাঙা মুখে কড়া সেঁকা দু’টো শিককাবাব খেয়ে বেশ আয়েস করে চা খাচ্ছে, দোকানে ঢুকলো আসাদুল্লা। পিরিচে চা ঢেলে ঠোঁটের কাছে পিরিচ তুলে আসাদুল্লা বলে, ‘জলদি খা, তরে আমি বিচরাইয়া মরি। চল মুন সিনেমায় যাই।’
মুন সিনেমা থেকে বেরোবার সময় গোলজার আলি একেবারে পূর্ণ শরীর নিয়ে পা ফেললো। এরকম ছবি সে অনেকদিন দ্যাখেনি। ইংরেজি ছবি—কথাবার্তা কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু মুখের ভাষায় কি এসে যায়? কথা যা হলো সব হাত দিয়ে। খালি ঘুষি আর হাতাহাতি। একেকটা ব্লো দ্যাখো, হাজার টাকা, লক্ষ টাকা দাম। নিজে সে মারামারিতে পটু নয়, কিন্তু যাদের সঙ্গে দিনরাত তার ওঠা-বসা তারা প্রায় সবাই ঐ লাইনের। আজকাল রিভলভার আর স্টেনগানের যুগে তাদের সেই দিনও নেই, সেই হাতও আছে কি-না সন্দেহ। কিন্তু এই ছবিতে মানুষের হাতের যে ওস্তাদি দ্যাখা গেলো তাতে সে একেবারে অভিভূত। হাঁটতে হাঁটতে বড়ো রাস্তায় পা দিয়ে আসাদুল্লা বলে, ‘ল, গঙ্গাজলিটার মইদ্যে একটা পাক দিয়া যাই। আউজকা তরে বউনি করাইয়া দেই।
‘না ওস্তাদ।’
‘তে চল, এ্যাম্বে বইয়া থাকবি, এক বোতল মাল টানবি, আমি কাম সাইরা বারাইয়া আহুম চল।’
‘না ওস্তাদ।
‘যা, ঘরে গিয়া বৌয়ের বুনি চোষ গিয়া।’ আসাদুল্লা চটে যায়, ‘তরে মানুষ করতে পারলাম না গোলজার!’
মানুষ হওয়ার তেমন ইচ্ছাও গোলজারের আছে কি-না সন্দেহ। আসাদুল্লা চলে গেলে সে সোজা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। সত্যি, এরকম ঘুষির দৃশ্য–সে এতোকাল ছবি দেখে আসছে তার বেশির ভাগই তো ফাইটিং খেল–কিন্তু না, এরকম কোনোদিন দ্যাখেনি। একটা রো আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খায়, ঘন ঘন সংঘর্ষ হচ্ছে, কেবল টক টক টক টক আওয়াজ। ঘরে গিয়ে সখিনার সামনে কি করে এই ঘুষিসমূহের একটা বায়বীয় প্রদর্শনী দ্যাখাবে সেই নিয়ে সে নানারকম ফন্দি আঁটে আর যতোবার একটু ওপরে তাকায় দ্যাখে সমস্ত আকাশ জুড়ে সিনেমাস্কোপের পর্দা টাঙানো, সেখানে শক্ত-সমর্থ সব জোড়া জোড়া হাত ঘুষির মুদ্রা করে নাচন দ্যাখায়। এমনি করে ঘুষির নৃত্য ও টকটকাটকটক সঙ্গীতে আপ্লুত হয়ে গোলজার তার বাড়ির সামনে চলে আসে। তাদের বাড়ির সামনে খসে খসে পড়া পাতলা ইটের ফ্রেমে মস্ত বড়ো কাঠের দরজা। এই দরজা খুব মোটা, খুব পুরনো ও ছিদ্রসমৃদ্ধ। একটি অন্যতম ছিদ্রে মুখ লাগিয়ে সে স্ত্রীকে ডাকতে যাবে, এমন সময় তার কানে আসে তারাবিবির দীর্ঘ ক্ষোভধ্বনি, তুমি তো একখান মরা মানুষ! তামামটা জিন্দেগী ভইরা খালি বিছানার মইদ্যেই পইড়া রইছো, একটা দিন বুঝবার পারলা না আমি ক্যামনে কি পেরেশানির মইদ্যে ঘরবাড়ি চালাই। কি একখান পোলারে প্যাটে ধরছিলাম, হায়রে আল্লা, হাসরের দিন আমি আল্লারে কি জবাব দিমু? রাইত হইছে বারোটা না একটা, ঘরের মইদ্যে অৱে পাইবা না। কৈ কৈ কার লগে রঙ কইরা বেড়ায়, আমি জানি না, না?’ এই সংলাপে গোলজার আলির সারাটা সন্ধ্যা, ব্লো-ফাটানো রঙিন চলচ্চিত্র, রাস্তায় নিয়নের আলোতে ঘুষির নাচন—সব একেবারে ঘোলা হয়ে যায়। নিজেকে আর নিজের দখলে রাখতে ইচ্ছা করে না, নিজের বিবেচনা ও সুখ-দুঃখের সমস্ত দায়িত্ব অন্ধকার ল্যাম্পোস্টের নিচে হলদে-কালো নালায় গড়িয়ে দেওয়ার জন্য সে আকুপাকু করে।
আলি হোসেনের বৌ―এক্কেরে বেশরম মাগীটা— অর লগে কিসের গুজুরগাজুর, ফুসুরফাসুর, আমি বুঝি না, না?’ অপরিসর উঁচু বারান্দায় বসে মা জননী তার ফের নতুন বাক্য গঠন করে, একেকটা বাক্য আরেকটার চেয়ে তীক্ষ্ণ, প্রত্যেকটি পরবর্তী-বাক্যে মায়ের সন্দেহ প্রবণতা প্রায় প্রমাণে পরিণত হয়।
‘কামের মাতারি রাখবা তো দিনরাইত খালি তার লগেই রঙ, তার লগেই কথা। ‘সুরুজের মাও, পানি লও; সুরুজের মাও, আমার গাঞ্জি কই? সুরুজের মাও, নাশতা দাও।’–ক্যান?—অর বৌ আছে না?’
আর কতো? বুকে হাত দিয়ে দরজার একটা ফুটোয় মুখ রেখে গোলজার তার স্ত্রীকে ডাকে, ‘সখিনা।’ একটু পর ‘কে?’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে সখিনা এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে সে একটুও দাঁড়ায় না। এই দরজার পর কয়েক হাত ঘাসগজানো কাঁচাপাকা জায়গা, তারপর উঁচু বারান্দা। বারান্দা একেবারে স্তব্ধ। গোলজার আলি এখন দরজা বন্ধ করছে বলে তার পিঠ বারান্দার দিকে ফেরানো। দরজা বন্ধ করতে যতোটা সময় নেওয়া যায় ততোই ভালো। খিল লাগিয়ে একবার খুলে ফের লাগাচ্ছে। সমস্ত বাড়িতে এখন কেবল দরজা বন্ধ করার আওয়াজ। এই কাজ শেষ হলে মুখ ঘুরিয়ে গোলজার দেখলো বারান্দা জনশূন্য। ভালোই। মায়ের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সময় আরো খানিকটা পিছিয়ে গেলো। কিন্তু বারান্দায় ওঠবার পাঁচটা ধাপ দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। এরপর একটা উঁচু দরজা দিয়ে ঘরটায় ঢুকে তারাবিবিকে অতিক্রম করে তাকে নিজের ঘরে যেতে হবে। তারাবিবির ঘর বেশ লম্বা। অন্ধকার বারান্দা থেকেও তার আলোকিত ঘর ঘোলাটে হলুদ মনে হয়। ঘরে ঢুকে প্রথমে চোখে পড়ে উঁচু ছাঁদের অনেক নিচে অন্ধকার বলে যে জায়গাটাকে বস্তুহীন খাদ বলে ভুল হয় সেখানে কাঠের ল্যাম্পোস্টের মতো এবড়োখেবড়ো ও বাঁকাচোরা শরীর কাঁপাতে কাঁপাতে পাশ ফিরছে রমজান আলি। পাশ ফিরতে ফিরতে তার আশি কি বিরাশি বছরের ঝরঝরে কাঠামোর ভেতর থেকে অপরিশোধিত কাশির একটা দমক বয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু হয় না। আলো তার সহ্য হয় না, তাই ঝুলন্ত বাল্বের একটা দিক কাগজ দিয়ে ঢাকা। ঘরের উল্টো কোণে জলচৌকিতে বসে পান সাজছে তারাবিবি। তার গা ঘেঁষেই গোলজার নিজের ঘরে যায়। ঘরের বিপরীত প্রান্তের তক্তপোষ থেকে রমজান আলির শ্লেষ্মার পরতে জড়ানো কণ্ঠস্বর সমস্ত ঘর জুড়ে ঘর্ঘর করে ওঠে, ‘খিড়কি- উড়কি লাগাইছো?’
‘তোমার কইতে হইবো?’ তারাবিবির এই জবাব শেষ হতে না হতে গোলজার নিজের ঘরে পৌঁছে যায়।
‘পালাঙের তলা দেখছো?’ রমজান আলীর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব শোনবার আগেই গোলজার আস্তে করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
গোলজারের ঘরের মেঝেতে লাল শালুর বর্ডার দেওয়া ছেঁড়া শীতলপাটিতে ভাতের গামলা, তরকারির বাটি ও একটা পিরিচে আলুভর্তা, কাঁচামরিচ ও নুন। শীতলপাটিতে বসে ভাত-তরকারি খেতে খেতে গোলজার বলে, ‘মায়ে খুব চালাইলো, না?’ জবাব না দিয়ে সখিনা বিছানার মশারি টাঙায়, বালিশ সাজায় এবং একই চাদর শতবার সোজা করে। সখিনার প্রায় ফর্সা ও গোল মুখ বড়ো থমথমে। সেই মুখে যদি একটু রোদ খেলানো যায় এই আশায় গোলজার আলি বলে, ‘তুমি আমার লগে এট্টু খাইবা?’ জবাবের আশা না করেই সে খলসে মাছের কাঁটা বাছে। বাছতে বাছতে বলে ‘মাছটা নরম হইয়া গেছিলো, না?’ কিন্তু নরম মাছে তার অরুচি দ্যাখা যায় না। সে অনেকক্ষণ ধরে খাচ্ছে। মাথা নিচু হতে হতে বুকের ওপর এসে ঠেকেছে, খাটের স্টাণ্ড ধরে দাঁড়িয়ে সখিনা আড়চোখে তাকায়, খেতে খেতে গোলজার কি ঘুমিয়েই পড়লো নাকি? মাগরেবের নামাজ পড়ে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে তারাবিবি সেই যে শুরু করেছিলো, আল্লারে আল্লা! সেই একটানা বকে যাওয়া শেষ হলো এই একটু আগে। বড়ো রাস্তায় বাস চলার ধ্বনি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে মোড়ের রেস্টুরেন্টে বাজতে থাকা গান আরো বিকট হয়, এগারো নম্বর বাড়ির খাদেম পাগলার বিরতিহীন চিৎকার এবং সর্বোপরি এই অঞ্চলের হৃৎস্পন্দন—কোনো কিছুই আর স্পষ্ট ও আলাদা করে ঠাহর করা যায় না।
গোলজার বলে, ‘মায়ে খুব প্যাচাল পাড়ছে, না?’
গোলজার আলি ফের বলে, ‘মায়ে তোমারেও কিছু কইছে?’
‘আমারে তুমি মীরকাদিম রাইখা আহো। নাইলে মিয়াভাইরে সোম্বাদ দাও, আইসা লইয়া যাইবো।’
খাওয়া হয়ে গেলেও ভাতের কয়েকটা দানা নিয়ে গোলজার আঙুলে আঙুলে নাড়াচাড়া করে। সখিনা বলে, ‘আমার আর ভালো লাগে না। আর কতো সইজ্য করুম?’
সখিনার এই কথায় এক ধরনের অভিমান গোলজারের বুকে পাতলা শ্লেষ্মার মতো জমে : তার মায়ের এই ব্যবহারে সবচেয়ে ভোগান্তি হওয়ার কথা তো তার নিজের, গোলজার আলির। তার নিজের বৌও তার কষ্টের ভাগ নিতে অস্বীকার করে। এই নতুন প্রতিক্রিয়ায় তার আড়ষ্টতা কাটে। খাটের তলা থেকে চিলমচি টেনে হাত-মুখ ধোয়, খক খক করে গলা পরিষ্কার করে, তারপর পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে সখিনার হাত থেকে পান নেয়। সখিনা এঁটো থালাবাসন নিয়ে জমা করছে ঘরের এককোনে
এই কাজের মধ্যেই নিচু ও তীব্র খাদে তার মুখ চলে, ‘আমরা গেরাইম্যা মাইয়্যা, ছোটো লোকগো ঘর থন আইছি, তোমাগো খান্দানী ঘরের জামাইরে বাইন্দা রাখি ক্যামনে?’
তার স্ত্রী যে গ্রামের মেয়ে এজন্য গোলজার আলির কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু তার মায়ের এই কথাটা বলার মধ্যেও সে আপত্তির কোনো কারণ দেখতে পায় না। তবে তার স্ত্রীকে বিরূপ করার একটু ইচ্ছাও তার কোনোদিন হয় না। চেষ্টাচরিত্র করলে সন্ধ্যাবেলাটা এখনো জোড়াতালি দিয়ে নিয়ে আসা যায়।
‘তোমার জামাইরে বান্দবা কেমুন? আমি কি তোমারে ছাইড়া দিছি? তুমি কইতে পারলা না?’
‘কি কই?’
সখিনা তার শাশুড়িকে কি বলতে পারে? গোলজার আলি সখিনাকে বহুদিন আগেই জানিয়ে দিয়েছে সে সন্দেহপ্রবণতা তার মায়ের অনেকদিনের অভ্যাস। সখিনার এই অভিজ্ঞতা প্রথম হয় বিয়ের মাস তিনেক পরই। একদিন এই ঘরে গোলজার, সখিনা এবং গোলজারের বন্ধু আলি হোসেন ও আলি হোসেনের বৌ রাবেয়া সারাটা বিকাল জুড়ে খুব গল্পগুজব করে। যেমন আলি হোসেন, তেমনি তার বৌ—দু’জনেই খুব জমাতে পারে। আলি হোসেন মানুষের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি নকল করতে ওস্তাদ–তোতলা মানুষের কথা, শিশুর কান্না, কুকুর-বিড়ালের ডাক এমন কি বোতলের ছিপি খোলার শব্দ, ঘড়া থেকে পানি গড়াবার আওয়াজ—সব দ্যাখাতে পারে। রাবেয়াও খুব সপ্রতিভ মেয়ে। একবার আলি হোসেনকে থামিয়ে সে গোলজারকে বলে, ‘অ গোলজার ভাই, অহন আপনের দোস্তের নাক ডাকাটা দ্যাখাইয়া দেন তো!’ তারপর সে নিজেই তার স্বামীর নাক ডাকা থেকে শুরু করে কলা খাওয়ার ভঙ্গি পর্যন্ত দেখিয়ে দিলো। সখিনা তার জীবনে এই প্রথম একনাগাড়ে এতক্ষণ ধরে হাসে। হাসতে হাসতেই সন্ধ্যা হয়, সন্ধ্যার পর রাবেয়া বোরখা পরে আলি হোসেনের সঙ্গে বাড়ি চলে গেলো। গোলজারও ওদের সঙ্গে বাইরে যায়। ওদের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাবিবি সখিনাকে ডাকে, ‘অ বৌ! এতো হাসি কিয়ের?’
আলি হোসেন ও রাবেয়ার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি মনে করে সখিনা মুখে আঁচল দিয়ে ফের হেসে ফেলে, ‘আম্মা ঐ বৌটায় যে কেমুন করে না! দেইখা হাইসা বাঁচি না!’
কিন্তু তারাবিবির মুখ খুব গম্ভীর। সে বেশ কালো, বেশ লম্বা ও মোটা। তার পরনে তখন কোনো জামা নেই, শাড়িটা বুকে পেঁচিয়ে পরা। গরমে সে হাঁসফাস করে। একটু পর সখিনা টের পায়, এই হাঁসফাঁসটা সম্পূর্ণ গরমের জন্য নয়, তারাবিবি খুব রেগে গেছে।
‘বৌ, খাল কাইটা কুমীর ডাইকা আইনো না, বুঝলা?’
‘জী?’
‘খাল চিনো না?’ তারাবিবি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে গেরাইম্যা মাইয়া তুমি খাল চিনো না? খালের ধারে হাগামোতা কইরা মানুষ হইছো, আউজকা খাল চিনবার পারো না?’
এরকম অপ্রাসঙ্গিকভাবে তাকে ছোটো করার পর তারাবিবি আসল কথা পাড়ে, ‘ঐ বেশরম মাইয়াটারে চিনো?’
‘আলি হোসেন ভায়ের বৌ।’
‘আরে আমারে চিনাইতে চাও? খাদেম পাগলার মাইয়ারে আমি চিনি না, না? আমার গোলজারের লগে লাগাইয়া দিবার লাইগা খাদেম পাগলার ভাই কতো তদবির করছে। গোলজারের নজরখানও তো আছিলো ঐদিকেই। দেইখো বৌ, নিজের লোকসান কইরো না। দেখলা না, বেগানা মরদের লগে কেমুন হাইসা হাইসা কথা কইলো, দেখলা না?’
সেই রাত্রি গোলজারের জন্য খুব খারাপ। সখিনা কোনো কথা বলে না, কোনো কথাতে তার কোনো সাড়া নেই। বিছানায় ফেলে অনেক কষ্টে গোলজার তাকে চুমুটুমু খাওয়ার পর সে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সখিনা তার বিবাহিত জীবনের প্রথম আঘাতের কথা বললো।
‘তুমি আমার কপালডা পুড়াইবা? আমার বাপজানে বহুত হাউস কইরা বিয়া দিছে, তুমি এইগুলি কি করো, এ্যা?’
সখিনার কথার ফাঁকে ফাঁকে গোলজার জিগ্যেস করে, ‘তোমারে আম্মায় কইছে?
‘হ।’
‘আম্মায় কি কইতে কি কইছে! তুমিও একটা পাগলি কি বুঝছো!’ কিন্তু এতে কোনো কাজ হয় না। অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে গোলজার দ্যাখে, বালিশে মুখ গুঁজে, কখনো খাটে বসে দুই হাঁটুতে মুখ ঢেকে সখিনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে জেগে উঠতে দেখে সখিনা অন্যদিকে মুখ করে শোয়। তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে, তার পিঠে শাড়ি নেই, ঘামে ব্লাউজ ভিজে চপচপে। সেদিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ অবিরাম একটা আওয়াজ কানে এলে সমস্ত শরীরকে একটিমাত্র অবিভাজ্য অঙ্গে পরিণত করে গোলজার লাফ দিয়ে উঠলো। তারাবিবির কান্নার শব্দ দেওয়াল ও দরজা ছুঁয়ে এই ঘরে এসে পড়ছে। পা টিপে টিপে গোলজার ঘরের আরেক মাথায় গিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুললে সেই শব্দ গলগল করে ঘরে ঢোকে। তারাবিবি গভীর ঘুমে অচেতন, তার নাক ডাকার শব্দ একটি নিয়মিত ধ্বনিপ্রবাহ হয়ে এই ঘরে আসতে আসতে একটি অবিচ্ছিন্ন বিলাপে পরিণত হয়েছে। দরজা বন্ধ করে গোলজার ফের শুয়ে পড়ে। তারাবিবির কান্নায় সমস্ত ঘরের শূন্যতা ফের লবণাক্ত হয়। গোলজারের একঘেয়ে জীবনের শৈশবের শেষ ভাগ, কৈশোরের পুরোটা, এমন কি যৌবনকালের প্রথম অংশ তো তারাবিবির কান্না দিয়েই বিরতিময় ছিলো। বাকিটা? পাশে-শোয়া সখিনার ফোঁপানি কমে এসেছে। গোলজারের ভয় করে, তার জীবনের বাকিটাও কি কান্নাকাটি দিয়েই চিহ্নিত হবে? সখিনার ভিজে পিঠে হাত রাখলে গোলজারের ভয় খানিকটা কমে। তার পাশে সুখদুঃখসমৃদ্ধ রক্ত-মাংসের একটা মেয়েমানুষ। এখানে আগে ছিলো পাতলা তোষকের ওপর ময়লা সবুজ চাদর। ওপরে মস্ত উঁচু ছাদ, ছাদের নিচে গভীর খাদের মতো বেঢপ আকারের বড়ো এই ঘর। ঐ ছাদের ওপর আগে আরো ঘর ছিলো। গোলজার আলি খুব ছেলেবেলায় সেখানে গেছে বলে আবছা আবছা মনে পড়ে। কিন্তু ওপরতলায় হাঁটলে মেঝে কাঁপে বলে গোলজার আলির জন্মের আগে থেকেই সেখানে কারো বসবাস নেই। দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির ওপরকার কয়েকটা ধাপ খসে পড়ায় ওঠার পথও বন্ধ। ওপরতলায় এখন পোকামাকড় ও ইঁদুর-ছুঁচোর একচ্ছত্র অধিকার। কোনো কোনো রাতে এইসব জীবজন্তুর ব্যস্ত ও দ্রুত চলাচলের সরসর শব্দ ছাদ বেয়ে বৃষ্টির ধারার মতো পড়তে থাকে। এই নির্জলা বৃষ্টিধারার সঙ্গে পাশের ঘরের তারাবিবির বিলাপ, কিছুক্ষণের জন্য রমজান আলির ধমক ও তারাবিবির গোঙানি একাকার হয়ে রূপলাভ করতো একটি অখণ্ড বস্তুতে এবং তার ধাক্কায় গোলজারের শরীরের নিচেকার খাট, তার চারপাশের দেওয়াল, শরীরের ওপরকার মশারি ও ছাদ কোথাও সরে গিয়ে গোলজারকে একেবারে নিরাশ্রয় করে দিতো। গোলজারের রক্ত ও মেদ শুকিয়ে তার শরীরটা পড়ে থাকতো একটি ছায়ার মতো। তার ছায়া-শরীরের চারপাশে কোনো বস্তু নেই, কেবল ছায়া। ওপরে মশারি, মশারির ওপর ছাদের ছায়া, পাশে দেওয়াল ও শূন্যতার ছায়া, রাত্রিকাল ও অন্ধকারে ছায়া — এই সমস্ত ছায়া তাকে সম্পূর্ণ কব্জা করে ফেললে গোলজার আলী ফের ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার কোনো কোনো রাত্রে তারাবিবির বিছুটি পাতার মতো খসখসে কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙে গেছে, অনেকক্ষণ জেগে থেকে সে বুঝতে পারে, তারাবিবি রমজান আলিকে জাগাবার চেষ্টা করছে, ‘অ গোলজারের বাপ! এক্কেরে লাশটা হইয়া রইছো, না? আরে বুইড়া মরদ, খাটিয়ার লাশটাভি লড়েচড়ে, তোমার লড়ন নাই? বিছানা জুইড়া ভ্যাটকাইয়া রইছো, অ গোলজারের বাপ!’ এরপর রমজান আলি হয় চুপ করে থাকবে, নইলে উঠে তার বালিশের কাছ থেকে হাতপাখাটা নিয়ে বৌকে পেটাতে শুরু করবে, খানকি মাগী, তর মরদানি দ্যাখনের খাউজানি উঠছে না? র। তরে মরদ দ্যাখাই। তর হাউস মিটাইয়া দেই, আয়।’ রমজানের দাঁত-পড়া, ঘুম ভাঙা মুখের বাক্য ভালো করে তেতে ওঠবার আগেই মিইয়ে পড়ে, তার হার্ডডিসার হাত দেখতে দেখতে ক্লান্তিতে নুয়ে আসে। তখনি তার বয়স পঁয়ষট্টির ওপর। সারাটা দিন তার অনেক খাটাখাটনি। তাদের ওপরতলায় আর ভাড়াটে বসানো যায় না; মেরামত করবে, সে পয়সাও নেই। তার একমাত্র ভাই মহরম আলি তাদের পৈতৃক আরজু ডেকোরেটার্স দখল করে বসেছে, একমাত্র সম্বল তার মাইকের দোকান—মাইক, রেকর্ড ভাড়া দিয়ে ভালোই চলছিলো, কিন্তু আজকাল এসব দোকানের লেখাজোকা নেই, ঘোরাঘুরি না করলে খদ্দের পাওয়া যায় না। রমজান আলির শরীর টেকে কি করে? কখনো কখনো গোলজারের রাগ হতো, বুড়ো বয়সে বৌ মরলে রমজান ফের বিয়েটা না করলেই পারতো। তারাবিবি রমজান আলির দ্বিতীয় স্ত্রী, আগে তার কি ধরনের শালী হতো। আগের পক্ষের মেয়েরা তারাবিবিকে এখনো খালা বলে ডাকে। গোলজারের ঐসব সৎ বোনদের ছেলেরা গোলজারের সামনে ঠাট্টা করে, ‘অ মামু,’ তাদের তিনজনই গোলজারের বড়ো, দুজনের জন্ম তারাবিবির বিয়ের আগে, মামুজান, নানায় হালায় এই বিয়া যহন করছে তহনই তো যাইট বছইরা বুইড়া। পঁচিশ বছরের ছেমরিটারে লইয়া বুইড়ার বহুত মুসিবত, না মামু? বহুত মেহনত হয়, না?’ এই বিয়েটা না করলে রমজানের এই রাত্রিবেলার ভোগান্তিটা হতো না। অনেক রাত্রে তারাবিবি যখন তার মাঝখান-দিয়ে-চেরা গলায় একাই কোরাস-স্বরে চিৎকার করতো, ‘আরে বুইয়া মড়াটা! এক্কেরে কব্বরের মইদ্যে ঢুকছো? আরে খাড়াও, জানাজাটা পইড়া লই, জানাজা না লইয়া কব্বরে যাইবা, আজাব হইবো না?’–গোলজারের হৃৎপিণ্ডটা তখন ছিটকে পড়তো চারিদিকে : বাপে হালায় বুইড়া হইয়া বিয়াটা না করতো তে জিন্দেগীতে দুনিয়ার মইদ্যে পয়দাই হইতাম না! — পৃথিবীতে কোনোদিন না আসবার সেই সুখ থেকে তাকে বঞ্চিত করাটাও বাপের পক্ষে খুব অন্যায় কাজ হয়েছে। সেই অজ্ঞাত অবস্থা সে কোনোদিন কল্পনাও করে দ্যাখেনি। কিন্তু তারই জন্য তার আক্ষেপ : হায়েরে সেই কপাল কি আর আমাগো হইবো? কিন্তু এখন স্ত্রীর পাশে শুয়ে কোনোদিন-না-জন্মাবার কপাল পাওয়ার জন্য গোলজার আলির কোনো আগ্রহ হয় না। বরং সখিনার ভিজে পিঠে হাত রাখলে তার হাতের রেখায় রেখায় মেয়েলী ঘাম রয়ে যাওয়ার কুলু কুলু ধ্বনি শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে দোকানে যাওয়ার আগে গোলজার তার মাকে বলে, ‘আম্মা, তুমি তোমার বৌরে কি কইছো, আর উই কি বুঝছে, রাইত ভইরা কাইন্দা মরে।’
‘কি কইছি?’ তারাবিবি বারান্দায় ঝোলানো দড়িতে কাচা-কাপড় মেলে দিচ্ছিলো, কাজে একটুও বিরতি না দিয়ে বলে, ‘কান্দনের কি হইছে?’
‘আলি হোসেনের বৌ-এর লগে,’ বলে গোলজার কি বলবে কি বলবে করতে করতে তারাবিবি একটা চাদর মেলে দিলো, তারপর নিজেই ছেলেকে উদ্ধার করে, কইছি, বৌটা এক্কেরে বেশরম। বেগানা মরদের লগে কেমুন ছিনালি করে, দ্যাহস না? অর লগে তর শাদীর কথা ভি কইছিলো।’
‘কৈ, আমারে কও নাই তো!’
‘ক্যান? তুই জানস না? খাদেম পাগলার ভাইয়ে তর বাপেরে বহুত ধরছিলো। পয়গাম পাঠাইবার কথা ভি হইছিলো।’
‘আমি জানি না তো!’
‘ক্যান? খাদেম পাগলার বাড়ির মইদ্যে না তর যাওয়া-আসা আছিলো।’
মায়ের মুখে এই কথাটা শুনে গোলজার লজ্জা পাবে কি, দরজার কপাট-ধরে-দাঁড়ানো সখিনাকে দেখে তার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একই গলিতে বাড়ি, ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলাধূলা করেছে—এ সবই সত্যি। কিন্তু একটু বড়ো হয়ে যাওয়ার পর ছ’মাসে দ্যাখা হতো কি না সন্দেহ। বরং সেলাই করাবার জন্য কি আচার দেওয়ার জন্য তারাবিবিই রাবেয়াকে ডেকে পাঠাতো এই গোলজারকে দিয়েই। বড়ো হবার পর গোলাজারের একটু লজ্জাই করতো, নিজে ওদের বাড়ির ভেতরে না গিয়ে ওর ভাইকে দিয়ে মায়ের কথাটা জানিয়ে দিতো। কিন্তু গোলজারের এই মেয়েসুলভ লজ্জা নিয়ে তারাবিবি কতোদিন রাগারাগি করছে। আর এখন তারাবিবি বলে, ‘আমরা কই, তুই অর চাচারে দিয়া তর বাপেরে কওয়াইছস।’
‘না আম্মা আমি কিছুই জানি না।’
‘অ।’ বলে তারাবিবি কলপাড়ে চলে যায়।
তবে সখিনাকে মেরামত করে নিতে গোলজারের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মেয়েটা তারাবিবির কথা যেমন অবলীলাক্রমে বিশ্বাস করে, স্বীমার ওপর আস্থাস্থাপনেও তেমনি তার দেরি হয় না। সখিনা প্রায় সর্বদাই হাসিখুশি, বাইরে বেরুলে তার কৌতূহলের সীমা নেই, সমস্ত শহরটাকে একদিনে চিনে নেওয়ার জন্য সে অস্থির।
কিন্তু মুখ ভার করতেও সময় লাগে না। এরপর দেড় মাসও যায়নি, একদিন বেলা আড়াইটে-তিনটের দিকে গোলজার ঘরে ফিরতেই সখিনা জিগ্যেস করে, ‘এতো বেলা করলা? রথখোলা গেছিলা, না?’ ‘হ, তোমারে কইলাম না? ঐ পাট্টি হালায় আউজকাও টাকা দিলো না। চুতমারানি বহুত খাচরামি করতাছে!’
কিন্তু সখিনা ফের বলে, ‘রথখোলা কৈ গেছিলা? বিনয়গো বাড়ি?’
‘কৈ?’
‘বিনয়গো বাড়ি! হ্যার বইনের লগে গল্প কইরা আইয়া, না? হিন্দুগো বাড়ি তোমার এতো যাওয়া-আসা কিয়ের লাইগা আমি বুঝি না, না?’
গোলজার খুব বিরক্ত হয়। রথখোলায় ঘন্টা দু’য়েক ঘুরেও তার বহু দিনের প্রাপ্য টাকাটা পাওয়া যায়নি। আর বিনয়দের বাড়ি সে যায় না সে বোধহয় আড়াই বছরেরও ওপর।
‘ছোটোলোকের লাহান কথা কইও না।’
এইবার সখিনার কান্না শুরু হলো। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলে, ‘আমি তো ছোটোলোকগো ঘরের মাইয়া। তোমার মায়েই না কইলো, ‘রথখোলা গেছে? বিনয়ের বইনের লগে বইছে, রাইত না কইরা উই আইবো না।’ –আমি কি করুম?’
গোলজার সেদিনই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে চায়। সোজা চলে গেলো তারাবিবির ঘরে। রমজান আলি তার বিছানায় বসে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি তুলে তার হাড়ডিসার পায়ে হাত বুলাচ্ছে। মেঝেতে বসে স্বামীর জন্য পান ছেঁচছে তারাবিবি।
গোলজার বলে, ‘আম্মা, বিনয়ের বইনরে লইয়া তুমি অরে কি কইছো?’
‘কি কইছি?’
‘কি কইছ, তুমিই জানো।
‘বৌরে কি কইছি, বৌ তরে গিয়া কি লাগাইছে, ক্যামনে জানুম?’ বলে হামান দিস্তা থেকে হাত উঠিয়ে নিলো তারাবিবি। রমজান আলি তার পোড়া বাঁশের মতো হাতটা সেদিকে বাড়াতেই তারাবিবি হামান দিস্তা সরিয়ে রাখলো, ‘দেরি আছে!’ মনে হয় তারাবিবি গোলজারকেও ধমক দিলো। গোলজার তবুও দমে না, ‘তুমি ঝুটামুটা কি কি বানাইয়া কইবা আর আমার জিন্দেগিটা এক্কেরে জ্বালাইয়া খাইবা, না?’
‘আমি কই ঝুটামুটা?’ তারাবিবি সোজা হয়ে বসে, বিনয়ের বইনের লগে তর কিয়ের খাতির?’
গ্র্যাজুয়েট স্কুলে গোলজারের সহপাঠি ছিলো বিনয়। বারদুয়েক ম্যাট্রিক ফেল করে গোলজার লেখাপড়া ছেড়ে দেয় আর দ্বিতীয়বার কোনোমতে পাস করে বিনয় চলে যায় কলকাতা। আগে বছর বছর ঢাকায় এলে গোলজারের সঙ্গে ওর দ্যাখা হতো। গোলজার ওদের বাসায় যেতো কেবল সেই সময়েই। কয়েক বছর থেকে বিনয়ের এদিকে আসা একরকম বন্ধই, গোলজারও আর ওদিকে যায় না। তবে বিনয়ের বাবা রাধাকৃষ্ণ বসাক লোকটা বেশ ভীতু, কোনোরকম গোলমালের আভাস পেলেও কাউকে দিয়ে গোলজারকে ডেকে পাঠায়, মিষ্টিটিষ্টি খাইয়ে বলে, ‘বাবা, তোমাগো মায়ায় পইড়া মাতৃভূমি ত্যাগ করতে পারি নাই। এট্টু দৃষ্টি রাইখো।’ কিন্তু আড়াই বছর, তিন বছর হতে চললো রাধাকৃষ্ণ বসাক ওকে ডেকে পাঠায় না, ওরও আর যাওয়া হয়নি।
তারাবিবির গোটা মনোযোগই এখন গোলজারের দিকে ন্যস্ত। মেঝেতে সে বসেছে পা ছড়িয়ে। তার দুই পায়ের পাতাই এপ্রিঠ ওপিঠ সম্পূর্ণ দ্যাখা যাচ্ছে। ডান পায়ের ওপরের পাতায় এগজিমার ঘা; এগজিমাটা মনে হয় তার পোষা, অবসর মতো চুলকায়, সেটা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। এখন তার বাড়ার ঋতু। ছড়ানো পায়ের পাতা থেকে মায়ের প্রিয় ঘায়ের একটি কি দু’টি পুঁজের বিন্দু গোলজারের দিকেই তাকিয়ে আছে। তারাবিবির মাথার কাপড় তার খোঁপার সঙ্গে আটকে গেছে, তার ছোটোখাটো গর্তে উঁচু-নিচু ভরাট লম্বা কালো মুখ, চওড়া ও রেখাহীন নির্বিকার কপালের ওপর সাদা কয়েক গোছা চুলের নিচে কালো চুলের রাশি এবং তার ছোটো আকারের চোখ জোড়া গোলজারের চোখের সামনে ঝালক দিয়ে উঠলে সে একেবারে নিভে গেলো। তার দোকানের পিচ্চি মেকানিকটা কোথায় কোন্ সুইচে হাত দিয়েছে, এ্যামপ্লিফায়ারের কোন পজিটিভ-নিগেটিভে গোলমাল হয়েছে যে মনে হয়, কথা বলেও কেনো লাভ নেই, কিছুই শোনা যাবে না। তবে রমজান আলির শরীরটা আজ একটু ভালো, বহুদিন পর শুকুর মাহমুদের দোকানের তেহারি দিয়ে সকালবেলার নাশতা হয়েছে, গোলজারের ওপর আজ সে বেশ প্রসন্ন, তারাবিবিকে আস্তে আস্তে বলে, ‘পোলায় বিয়াশাদী করছে, তোমার মুখ অহন ভি দস্তুর হইলো না। কহন কি কও, কথাবার্তা
বাক্য অসম্পূর্ণ থাকতেই তার বুক থেকে ঘর্ঘর শব্দ বেরিয়ে আসে এবং পেটে হাত দিয়ে সে কাশতে শুরু করে।
তুমি কব্বরের মড়া পইড়া রইছো, কব্বরের মইদ্যেই থাকো। তুমি কি বুঝবা? তিরিশ বছর হইলো তোমার ঘর করি, একদিন তোমারে সিধা হইয়া হাঁটবার ভি দ্যাখলাম না। আর এই জমানার জুয়ান পোলাগো বদ খাসলৎ তুমি কি বুঝো?’ রমজান আলির কাশির সঙ্গতে তারাবিবির সংলাপ বাপ ও ছেলের জন্য ধিক্কার বাজাতে থাকে। তারাবিবি তার অনেক দেখে-পাকা চোখজোড়া দিয়ে গোলজারকে বিঁধে ফেলতে চায়, ‘আমি কই ঝুটা কথা? তবে জিগাই, বিনয়ের বইনের বিয়া হইছে হিন্দুস্থান, আর বচ্ছরের আষ্টটা মাস উই পইড়া থাকে বাপের বাড়ি, ক্যালায়? তবে জিগাই, ক্যালায়?’
কয়েকবার ঢোঁক গিলে গলার তারটার পজিটিভ-নিগেটিভ সব ঠিক করে গোলজার বলে, ‘তুমি কার লগে কি লাগাও? হেইটা তো তিন-চাইর বছর পার হইয়া গেছে। পাসপোর্ট-উসপোর্টের কি ঘাপলা আছিলো, বহুতে দিন যাইতে পারে নাই।’
‘পাচকোট!’ দীপালীর পাসপোর্টের ব্যাপারটা তারাবিবি লুফে নেয়, আরে পাচকোট তো অছিলা! পাচকোটের নাম কইরা তর এই ঘরের মইদ্যে দুইটা ঘণ্টা বইসা গেছে না? এইগুলি বুঝি না, না?’
এই বাড়িতে দীপালী এসেছিলো একবারই। পাসপোর্টের ঝামেলা মেটাতে কার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য গোলজারকে তার দরকার হয়। সে তো চার বৎসর হতে চললো। দীপালী এখানে এলে তারাবিবিই তাকে সঙ্গে করে গোলজারের ঘরে পৌঁছে দেয়, ‘অ গোলজার, দ্যাখ বিনয়ের বইনে আইছে।’ নিজের ঘর থেকে সে একটা চেয়ার এনে দিলো। তারপর তোমরা কথা কও, আমি আহি।’ এই বলে সেই যে রান্নাঘরে ঢুকলো আর বেরোয় না। পনেরো-বিশ মিনিট পর চলে যাওয়ার জন্য দীপালী বারান্দায় পা দিয়েছে, রান্নাঘর থেকে দেখতে পেয়ে তারাবিবি বলে, ‘এট্টু বইসা যাও। আমি চা বানাই।’ গোলজারের ঘরে দীপালী আরো প্রায় আধঘণ্টা বসার পর গোলজারকে ডেকে তারাবিবি চা পাঠিয়ে দেয়। গোলজার এক ঘণ্টা ধরে দীপালীর সঙ্গে গল্প করে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু দীপালীর স্বামী, বিনয় এবং বিনয় ও গোলজারের শৈশবকাল। তার নির্জন ঘরে দীপালীর সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটাবার এই স্মৃতি মাঝে মাঝে চেয়ে দেখতে গোলজারের ভালোই লাগতো, কিন্তু এর ফলে তাকে কখনো বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়নি
নিজের রাগ দমাবার জন্যে কিম্বা বেছে বেছে ঠিক কথাটি প্রয়োগ করবে বলে তারাবিবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, ‘এই যে বেলা তিনটা পর্যন্ত বেজাত মাগীটার লগে বইয়া রইছস, তর বৌ আছে না? দুই দিন বাদে তর পোলা হইবো না? তর শরম নাই? তর শয়তানীর চোট এমুন–আমার ঘরে ফেরেস্তা আইবো কুনোদিন? পোলায় গুণা করলে বাপ-মায়ের এবাদত-বন্দেগী আল্লায় কবুল করে?’
তারাবিবির এই আপোষ-আপোষ স্বর গোলজারকে স্তিমিত করতে পারে না। বরং মায়ের শিথিল কণ্ঠ তাকে আরো বল দেয়। কিছুক্ষণ রমজানের মরচে-পড়া চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে সে সেই মাথা নোয়ানো বুড়োর নিঃশেষিত শরীরের ভিতরবাড়ি থেকে ভিটামিন শুষে নেয়। এইভাবে বাপের পুষ্টি ও মায়ের শিথিলতা থেকে শক্তি অর্জন করে গোলজার বলে, ‘আম্মা এই কথাগুলি কুনো মায়ে তার পোলারে কইতে পারে না। তোমরা আমার বিয়াশাদি দিছো, আমার খাসলতের মইদ্যে বুরাথুরা কিছু থাকলে উই দ্যাখবো। উই কিছু জানলো না, আর তুমি কৈ একটা রাডার ফিট কইরা রাখছো, মিনিটে মিনিটে তোমার রাডার কাঁইপা উঠবো আর তুমি খালি ফাল পাইড়া উঠবা!’
‘আল্লা রে আল্লা! আমার নসিব! পোলারে বিয়া করাইয়া আনছি, গেরাইম্যা মাইয়া, হাবাগোবা একখান, উই যুদিল বুঝবো তয় আমার এই হাল হইতে পারে?’ তারাবিবি ক্রমেই থিতিয়ে আসছিলো। একটু থেমে সে ফের নতুন উদ্যমে শুরু করে, ‘বৌয়ের যুদিল অতই বোধশোধ থাকবো তয় এই কামের মাতারির লগে তোমার রঙ করা উই বহুত আগেই ধইরা ফালাইতো। পারতো না??
এ কথার আর কি জবাব দেওয়া যায়?
সেদিন থেকে বাড়ির ঠিকা ঝিই হলো তারাবিবির মতে গোলজারের প্রধান আকর্ষণ। অথচ এই সুরুজের মায়ের সঙ্গে সারাদিন কতক্ষণের জন্যেই বা দ্যাখা হয়? সে আসে ভোর ছ’টার আগে, সকাল ন’টা-সাড়ে ন’টার চলে যায়। বেলা একটায় এসে ফের আড়াইটে-তিনটে পর্যন্ত কাজ করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোলজার তাকে ঘণ্টাখানেক দেখতে পায় এবং বিকালে আরেক ঘন্টা। সারাটা দিন খাটনির ওপর আছে বলে মেয়েটার শরীর বেশ আঁটোসাঁটো। তা এরকম ভালো শরীরের মেয়ে না রাখলেই হয়। রমজান একদিন এই প্রসঙ্গ তুলেও ছিলো, যদি সন্দ করো তো মাতারিরে বিদায় করলেই হয়।’
‘ক্যান? মাতারিরে বিদায় করুম ক্যান? আরেকটা রাখতে হইবো না? তোমার পোলায় কেউরে ছাড়বো?’
তবে আজকাল তারাবিবি গোলজারের সামনে এই সব কথা সচরাচর পাড়ে না। কিন্তু গোলজার বাইরে গেলেই শুরু করবে। এই আজ ছবি দেখে ফিরতে একটু রাত হচ্ছে, চান্স পেয়ে অমনি ধোলাই দিলো।
সখিনা এখন চুপচাপ বসে রয়েছে। একটু আগে তারাবিবির কল্যাণে গোলজারের বুকে যে কাঁটাগুলো বিধেছিলো, ভাত-তরকারি খাওয়ার পর সেগুলো পেটের কোথাও চাপা পড়ে গেছে। তার খুব ঘুম পায়। কিন্তু এখন ঘুমিয়ে পড়লে সখিনার অপমানের ভাগ নেওয়া হয় না। গোলজার আলি সুতরাং সখিনার পাশে বসে বলে, ‘তোমার মিয়াভাইরে একটা চিঠি লেইখা দেই, মিয়াভাই আইলে তুমি মীরকাদিম যাও গিয়া, আমিও দেখি, একটা ঘর বিচারাইয়া লই। ভাড়া উড়া ঠিক হইলে আমি গিয়া তোমারে লইয়া আসুম!’
এরকম প্রস্তাবে বরাবরই কাজ হয়।
বিছানায় শুয়ে গোলজারের ইচ্ছা হয় সমস্ত খাট জুড়ে শরীর বিছিয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু এই বিছানা তাকে আরেকজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়।
পরদিন বেলা আড়াইটের দিকে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে গোলজার শোনে তারাবিবি ও সখিনা দু’জনেই বাইরে। তার ফুফাতো ভাই বাদশার গায়ে হলুদ আজ দুপুরে, তার ফুপা নিজেই এসে দু’জনকে নিয়ে গেছে। রমজান বলে, ‘মাগরেবের বাদে তুই গিয়া লইয়া আহিস।’
রান্নাঘরে তারাবিবি নেই, তার নিজের ঘরে নেই সখিনা। — হ্যায় আপনা দিল’ গানটা পরিবর্তিত সুরে গুণগুণ করতে করতে জামাকাপড় না খুলেই গোলজার হাত-পা বেশ করে ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
ঘরে এসে ঢোকে সুরুজের মা, ‘অহন শুইলেন? ভাত দেই?’
‘ভাত দিবা?’ গুণগুণ করাটা থেমে গেলেও তার চোখে-মুখে গানের সুর সাঁটা।
‘এট্টু গড়াইয়া লই।’
‘না ওঠেন, আপনের খাওয়া অইলে আমারে বাসন মাইঞ্জা খাইতে হইবো না?’ কথা বলতে বলতে সুরুজের মা বুকের ওপর শাড়ির আঁচল গুছিয়ে রাখে। সেদিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ কি হয়, গোলজারের চোখ, মুখ ও গলার হাল্কা সুর ভাজা একেবারে উবে যায়। সেই সুরের জায়গায় তার ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বোঁবোবো ধ্বনির এলোমেলো চলাচলে ওর করোটির ভেতরটা একেবারে ঠাসা হয়ে যায় এবং সমস্ত শরীরের রক্ত সেদিকেই উজান বইতে বইতে বিপদসীমা অতিক্রম করে। খাটের স্ট্যাণ্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে সুরুজের মা। নিজের মাঝারি দৈর্ঘ্যের শ্যামবর্ণের শরীরটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে গোলজার প্রায় একটি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেঝের ওপর। সুরুজের মা কপালের একটুখানি ও ভ্রূর সবটা কুঁচকে তাকে দেখছে। তার কপাল ও ভ্রূ ফের সম্প্রসারিত হতে হতে গোলজার তার ডান হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে সামনে নিয়ে আসে। তার বুকের সঙ্গে লাগানো সুরুজের মার মাথা, মাথার লালচে কালো চুলে পুরনো পচা নারকেল তেলের গন্ধ। সুরুজের মা ফিস ফিস করে বলে, হাত ছাড়েন।’
সঙ্গে সঙ্গে গোলজার তার হাত ছেড়ে পেছনে সরে আসে। আরো এক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে সুরুজের মা হঠাৎ ভেতরের বারান্দা দিয়ে দ্রুত চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। বারান্দা থেকে এ্যালুমিনিয়মের বদনা গড়িয়ে পড়ায় টং আওয়াজে গোলজার আলির মাথায় বেলা তিনটে হওয়ার সময় সঙ্কেত বাজে, সে ফের তার ঘরের আরেক কোণে গিয়ে তার গামছা, লুঙি এইসব সংগ্রহ করে।
গোসল করে ফিরে এসে গোলজার দ্যাখে মেঝেতে ছেঁড়া শীতলপাটি পাতা, তার ওপর সরপোষে ঢাকা ভাত-তরকারি। খাওয়ার পর আলনা থেকে আণ্ডারওয়্যার ও প্যান্ট নিয়ে ফের রেখে দেয়।
প্রায় পনেরো মিনিট পর সুরুজের মা ঘরে ঢুকে বলে, ‘আমি যাই, আপনে দোকানে যাইবেন না?’
শুয়ে শুয়েই গোলজার জবাব দেয়, ‘তুমি যাও। আমি এট্টু পরে যাই।’ সুরুজের মায়ের হাত ধরে ফেলার ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলার জন্যে সে সপ্রতিভ হতে চায়, ‘এট্টু পরে গিয়া আম্মাগো লইয়া আসুম।’
‘তাগো আইতে দেরি আছে।’
‘অ!’
সুরুজের মা তার খাটের স্ট্যাণ্ড ধরে ফের দাঁড়িয়ে থাকে। পাশের ঘরে রমজান আলির ধীর লয়ে নাক ডাকার শব্দে গোলজার তার শরীরের দখল ফের হারাতে আরম্ভ করে।
‘আমারে দশটা টাকা দিবেন? আম্মারে কইয়েন না, আমার পোলারে ডাক্তার দ্যাখাইতে হইবো। দিবেন?’
গোলজার আলি নিঃশব্দে বালিশের নিচে রাখা পার্স থেকে পাঁচ টাকার দুটো নোট নিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরলো। সুরুজের মা এসে দাঁড়িয়েছে তার বিছানার ঠিক পাশেই। এখন এই টাকা ধরা হাত দিয়েই মেয়েটাকে টেনে একেবারে বিছানায় ফেলা। ঘরের আরেক প্রান্তে পাশের ঘরে যাবার দরজা। একবার সেদিকটা দ্যাখা দরকার। কিন্তু সুরুজের মা দরজা বন্ধ করেছে কখন? দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। গোলজার একেবারে নিভে গেলো। তার বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে সুরুজের মা, গোলজার সোজা তাকিয়ে রইলো নিজের পায়ের দিকে। তার নখগুলো কাটা দরকার। অনেকদিন তার নখ কাটা হয়নি। তার পায়ের পাতায় স্যান্ডেল পরার দাগ। আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে কালচে পুরু ময়লা। গোসল করার সময় কতো দিন সে পায়ের আঙুল ঘষে ঘষে ময়লা তোলেনি। তার পায়ের পাতার নিচেও ময়লা, হঠাৎ কিসের শব্দে সেই ময়লা ধূলো-বালি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়তে শুরু করে। পাশের ঘরে রমজান আলি কেশে উঠলো। কাশির ফাঁকে ফাঁকে সে যেন কাকে ডাকছে। গোলজারের উঁচু করে ধরা ডান হাতের বোঁটা থেকে পাঁচ টাকার নোট দুটো খসে পড়লো নিচে। হাত-জোড়া এখন তার দু’দিকে দু’টো মরা লতার মতো নেতানো।
‘আব্বায় ডাকে না?’ গোলজার আলি অনেকক্ষণ পর স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস ফেললো।
‘না, ঘুমায়। সুরুজের মার এই জবাব শেষ হতে না হতে বাইরের সদর দরজায় খুব জোরে কড়া নাড়া ও পাশের ঘরে রমজান আলির তীব্র চিৎকারে গোটা বাড়ি দুলে ওঠে। সেই দুলুনিতে সোজা-দাঁড়িয়ে-থাকা সুরুজের মাও ঝুঁকে পড়ে মেঝের ওপর। বিছানা থেকে একটা ও মেঝে থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট কুড়িয়ে নিয়ে সে একটু দাঁড়ালো। তারপর গোলজারের মণিছেঁড়া চোখের দিকে তার চোখ সঙ্কুচিত করে ধ্বনিতে হাসির খুব ছুঁচলো তাকালো এবং একটি খুচরাংশ ছুঁড়ে ফেলে দরজা খুললো। দরজার মস্ত ফোকর দিয়ে রমজানের ঘোলাকণ্ঠের চিৎকার ছলকে ছলকে এসে গোলজারের ঘর থিকথিক করতে থাকে, ‘কতোক্ষণ হয় তরে ডাইকা মরি। খানকি মাগী তুই ঘরের মইদ্যে খিল লাগাইয়া ঠাপ লাগাস?’
সুরুজের মার সদর দরজা খোলার শব্দ ও তারাবিবির আবির্ভাব টের পাওয়া যায়। তারাবিবি বলছে, ‘তরা ব্যাকটি মরছস? আমি চিল্লাইয়া মরি। হারামজাদী!’ তারপর সদর দরজা নিজেই বন্ধ করে সে বলে, ‘তুই যাস নাই অহনো? গোলজারে খাইয়া গেছে?’
সুরুজের মা বলে, ‘খাইছে।’
‘তুই যাস নাই ক্যান? চাইরটা বাইজা গেছে না? কি করস?’
‘যাই’ বলে সুরুজের মা চলে যেতে উদ্যত হলে তারাবিবি বলে, ‘ভাত লইয়া গেলি না?’
রমজান আলির উদ্দেশ্যে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে তারাবিবি ঘরে ঢোকে, তুমি মরছো তো এক্কেরে মইরাই রইছো? আমি তোমারে ডাইকা মরি, মহল্লার ব্যাকটি মাইনষে জড় হইল, তোমার হুস নাই।’
রমজান কেবল বলে, ‘বৌ কৈ?’
‘বৌ আইবো রাইতে। দোকান থাইকা গোলজারে গিয়া লইয়া আইবো। গোলজাররে কও নাই?’
রমজান আলি বিছানার ওপর উঠে বসে, পাশের ঘরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে, ‘গোলজার ঘরে।
‘দোকানে যায় নাই? ক্যান? আমি এতো চিল্লাই, উই ভি হুনবার পারে নাই?’
‘ক্যামনে হুনবো?’ রমজান আস্তে আস্তে জবাব দেয়, ‘ক্যামনে হোনে? উই তো এই দরজা বন্ধ কইরা খান্কিটারে লইয়া বইয়া আছিলো, উই হোনে ক্যামনে?’
তারাবিবি তার লম্বা-চওড়া কালো শরীরটা নিয়ে রমজান আলির বিছানার এক প্রান্তে বসে পড়ে।
‘আমি তো মইরাই রইছি! তোমরা তো আর আমারে জিন্দা দ্যাখবার চাও না!’ রমজান আলির ঘিঞ্জি চোখ দিয়ে ঘন অশ্রু বেরিয়ে আসে, মনে হয় ঘায়ের ওপর রস জমছে। সে আস্তে আস্তে বলে, ‘নিজের বাপেরে বগলের কামরায় রাইখা দুয়ার লাগাইয়া খানকি লইয়া বইয়া থাকে আমার নিজের পোলায়! আমারে তোমরা মাইরা ফালাও!’ তারাবিবি তার মস্ত কালো মুখে অজস্র রেখা-উপরেখা তৈরী করে বুইড়া মরদার কান্না দ্যাখে। রমজান আলির চিমসে মুখে এক ফোঁটা রক্ত নেই, তার মুখের চামড়া বোধহয় শুকনো ঘায়ের ওপরকার চটা, এককোণ ধরে একটু খুলে ফেললে গোটাটা আপনিই খসে পড়ে। উত্তেজনায় রমজানের মাথা ঘামে ভিজে গেছে। তার স্যাঁতসেতে মাথার ওপরকার লালচে শাদা কয়েক গাছা চুল আমের শুকনো আঁটির আঁশের মতো লেপ্টে আছে।
‘আমি যাই।’ মায়ের দিকেও না, বাপের দিকেও না, কোনো দিকে না তাকিয়ে গোলজার বলে, ‘আমি যাই, দরজা বন্ধ কইরা দাও।’
স্বামীর মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে তারাবিবি ছেলেকে দ্যাখে। গোলজারের চুল আঁচড়ানো নেই, মাথাটা নোয়ানো বলে কপাল বেয়ে, কানের ওপর দিয়ে চুলের গোছা ছড়ানো। তারাবিবি বলে, ‘লালবাগে তর ফুফুর বাড়ি গিয়া মাগরেবের বাদ বৌরে লইয়া আহিস।’
জবাব না দিয়ে বারান্দা পার হয়ে গোলজার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। সিঁড়ির একধাপ থেকে আরেক ধাপে নামবার সময় তার ঝাঁকড়া চুল বাতাসে-উতলা মগডালের পাতার স্তূপের মতো কাঁপে। কিন্তু সিঁড়ির পাঁচটা মোটে ধাপ। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। ছেলের কাঁপানো কেশরাশি দ্যাখার জন্য তারাবিবি তার মুখের সমস্ত রেখা কুঁচকে মাথা উঁচু করলো।
‘ঘরের মইদ্যে গুণা, ঘরের মইদ্যে শয়তানী। নামাজ-বন্দেগী আমাগো ক্যামনে কবুল হয়?’ চোপসানো গলায় রমজান আলী ফ্যাসফ্যাসে শব্দ করে, ‘আমাগো কুনো উন্নতি নাই, –ক্যান? ঘরের মইদ্যে আমাগো শয়তানের কারখানা। বারোটা মাস আমি বিছানের উপরে পইড়া থাকি,–ক্যান? হারামজাদা আহুক, আউজকা রাইতেই অর পাছার মইদ্যে লাথ মাইরা দিল খ্যাদাইয়া না দেই!’
‘হইছে!’ তারাবিবি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে স্বামীকে থামিয়ে দেয়, ‘এমুন চিল্লাচিল্লি করো ক্যালায়? গোলজারে কি করছে? পোলায় আমার জুয়ান মরদ না একখান? তুমি বুইড়া মড়াটা, হান্দাইয়া গেছো কব্বরের মইদ্যে, জুয়ান মরদের কাম তুমি বুঝবা ক্যামনে?’
১৯৭৭