তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ‘কবি’-উপন্যাস
১
শ্রীযুক্ত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই রচনাটির একটু বিশেষ পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিয়াছি—আমার এই আলোচনা হইতে সকলে তাহার কারণ বুঝিতে পারিবেন। কিন্তু তৎপূর্ব্বে সাধারণভাবে তারাশঙ্করের সাহিত্যিক প্রতিভা সম্বন্ধে একটু ভূমিকা করিতে হইবে, এবং তাহা একটু সবিস্তার হইলেই ভাল হয়।
তারাশঙ্কর বাংলা গল্প-সাহিত্যে, একটি সম্পূর্ণ নূতন দৃষ্টি এবং রসসৃষ্টির একটি নূতন ক্ষেত্র যোজনা করিয়াছেন, আমার মনে হয়, ইহার সম্যক সজ্ঞানতা আমাদের সাহিত্য-রসিকগণের চিত্তে এখনও ঘটে নাই। আমিও কিছুদিন পূর্ব্বে একটি প্রবন্ধে বৰ্ত্তমান বাংলা গল্পসাহিত্যের যে একটা মোটামুটি পরিচয় দিয়াছিলাম, তাহাতে তারাশঙ্করের সাহিত্যিক প্রতিভার দুই একটি লক্ষণ নির্দ্দেশ করিয়াছিলাম, তাঁহার দৃষ্টি বা কল্পনাভঙ্গির গভীরতার উল্লেখ করিয়াছিলাম। কিন্তু বাংলাসাহিত্যের পক্ষেই তাঁহার ঐ প্রতিভার যে একটি অতিশয় মৌলিক, এবং বোধ হয়, গূঢ়তর দিক প্রথম হইতেই দেখা দিয়াছে, সে সম্বন্ধে তখনও আমি স্পষ্ট করিয়া কিছু বলিতে সাহস করি নাই। তারপর, ‘কবি’ নামে এই বড় গল্পটি পাঠ করিয়া আমি তারাশঙ্করের কবিশক্তির মূলপ্রেরণা, বা প্রধান লক্ষণটির সম্বন্ধে নিঃসংশয় হইতে পারিয়াছি।
ইতিপূর্ব্বে (অর্থাৎ, ‘কবি’-রচনার পূর্ব্বে) তারাশঙ্কর অনেকগুলি গল্প এবং বৃহত্তর কাহিনী বা উপন্যাস রচনা করিয়া তাঁহার শক্তির যে পরিচয় দিয়াছেন, তাহা বাঙালী পাঠক সমাজ, অন্ততঃ তাহাদের সদ্য-রসপিপাসা তৃপ্তির প্রমাণে, স্বীকার করিয়াছে। তাঁহার গল্পগুলির অভিনবত্বের একটা কারণ এই যে, বাংলার একটা অঞ্চলের একেবারে মাটির গন্ধ তাহাতে লাগিয়া আছে—সেই মাটির নদী মাঠ বন জঙ্গলের সঙ্গে একেবারে অবিচ্ছিন্নভাবে মিশিয়া আছে যে মানুষের সমাজ—সেই সমাজও যেন বাংলার প্রকৃতিরই একটা অংশ; সেই সমাজের উপরকার স্তর হইতে নিম্নতম স্তর পর্য্যন্ত, সব যেন তাঁহার ঐ গল্পগুলিতে মুখর হইয়া উঠিয়াছে। ‘জলসাঘরের জমিদার হইতে ডোম, বাগদি, বেদে পর্য্যন্ত—সমাজের সকল স্তরের সকল চরিত্র যেন নিপুণ মৃৎশিল্পীর হাতে, তাহাদের সেই মাটিতে-গড়া মূর্ত্তি লইয়া আমাদের এই শহুরে সভ্য-দৃষ্টির সম্মুখে হাজির হইয়াছে; সহসা চোখ আড়াল করা একটা পর্দ্দা যেন কে সরাইয়া দিল—জীবন-রঙ্গমঞ্চের একটা যবনিকা উঠিয়া গেল; একটা ভূদৃশ্য ও তাহার পটভূমিকায় যে জীবন-নাট্যের অভিনয় দেখিতে লাগিলাম, তাহা যেমন বাস্তব, তেমনই অপরিচিত! মুগ্ধ হইয়াছিলাম এই দেখিয়া যে, এইসকল চিত্রে ও কাহিনীতে লেখক সেই তন্ময়তা আয়ত্ত করিয়াছেন, যাহার বলে প্রত্যেক চরিত্র লেখকের আত্ম-সংস্কার-বর্জ্জিত হইয়া অতিশয় স্বতন্ত্র স্বাধীন রূপে আত্ম-প্রকাশ করিতে পারিয়াছে। অর্থাৎ, জীবন সম্বন্ধে কোন থিয়োরী বা মতবাদ, কোন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক ধমক বা চমক তাহাতে নাই। ইহা ঠিক বাস্তবনিষ্ঠা নয়, অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টিহীন বহিরঙ্গের ফোটোগ্রাফ নয়; ইহাদের প্রত্যেকের মধ্যে জীবনেরই এক একটা পৃথক ও বিচিত্র সুর বিভিন্ন দেহতন্ত্রীতে বাজিতেছে; লেখক সেই তন্ত্রী কোথাও নিজে এতটুকু স্পর্শ করেন নাই, তিনি যেন জীবনের সহিত যোগযুক্ত হইয়া—আপনার লেখনীটিকে সেই সুরের মুখে ছাড়িয়া দিয়াছেন। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তিনি প্রত্যেক চরিত্রের মর্ম্মস্থানটিতে প্রবেশ করিয়াছেন, তাই তাহারা এমন জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। এই দৃষ্টিই প্রাতিভ দৃষ্টি, ইহাকেও একরূপ পূর্ণ-দৃষ্টি বলা যাইতে পারে।
তখন ইহাও বুঝিতে পারা গিয়াছিল যে, এই লেখক যে অঞ্চলের, যে সমাজের জীবনকে তাঁহার রসসৃষ্টির উপাদান করিয়াছেন, তাহার সেই মাটি তিনি দুইহাতে ছানিয়াছেন; তাহার কঠিন ও কোমল অংশ, তাহার বালি ও কাঁকর তিনি তাঁহার অঙ্গুলিদ্বারা স্পর্শ করিয়াছেন; অর্থাৎ, তাঁহার গল্পসৃষ্টির সেই উপাদান, তিনি বই পড়িয়া, নানা তথ্য, তত্ত্ব ও কল্পনাবস্তু সঙ্কলন করিয়া, পাণ্ডিত্য বা ভাবুকতার উগ্রগন্ধী মসলা মিশ্রিত করিয়া, তৈয়ার করিয়া লন নাই; ওই মাটিকেই তিনি চিনিয়াছেন—সেই মাটির ধর্ম্মকে, তাহারই তলদেশের নিগূঢ় রসধারাকে নিজহৃদয়ে পূর্ণ-অনুভব করিয়াছেন; তাই তাঁহার গল্প, গল্পের চরিত্র, এবং তাহার পটভূমি ও মৃতবেদিকা—প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষ—এমনই এক ধাতুময় হইয়া উঠে যে, সকলকেই সেই এক জীবনের অঙ্গাঙ্গী বলিয়া বোধ হয়। সে সৃষ্টির কোন অংশ যে বিচ্ছিন্ন নয়, সকলই এক কার্য্যকারণসূত্রে পরস্পর-সাপেক্ষ হইয়া রহস্যকে গভীর করিয়া তুলিয়াছে, এমনই একটা প্রত্যয় সেই রসাস্বাদের কালেও অলক্ষ্যে জাগিয়া ওঠে। এই সকল কারণে, তারাশঙ্করের গল্পগুলিতে জীবনের একটা নূতন রূপ ও নূতন রসাস্বাদ আছে; উহা বাস্তব বটে, কিন্তু তাহা বাস্তবভেদী গভীরতর বাস্তব—জীবনের রস-রহস্যের বাস্তব।
উপরের কথাগুলা একটু তত্ত্ব-ঘেঁষা হইয়া গেল, কিন্তু তারাশঙ্করের গল্পগুলির অধিকাংশ স্মরণ করিলে এবং সবগুলিকে একসঙ্গে ধরিলে, পাঠক-পাঠিকারা সম্ভবতঃ আমার ঐ কথাগুলার একটা মোটামুটি অর্থ বুঝিয়া লইতে পারিবেন। একটা বিষয় তাঁহারাও লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন, তাহা এই যে, তারাশঙ্করের গল্পের কথাবস্তু ও চরিত্র-চিত্র এ দুইয়ের যোগ অতিশয় ঘনিষ্ঠ। ঐ চরিত্রকেই কেন্দ্র বা ভিত্তি করিয়া গল্পগুলি গড়িয়া উঠিয়াছে; অথচ গল্পগুলি নিছক চরিত্র-চিত্রণ নয়, অধিকাংশের মধ্যে একটা নাটকীয় ঘটনা-পরিণাম আছে। এইখানেই তাঁহার কল্পনার গভীরতা ও সম্পূর্ণতার নিঃসংশয় প্রমাণ রহিয়াছে। তাঁহার সৃষ্ট চরিত্রগুলি স্থির-চিত্র নয়, তাহাদের ক্ষয়-বৃদ্ধি আছে, বিকাশ আছে, পরিণতি আছে—অর্থাৎ তাহারা খাঁটি জীবন-ধর্মী, তাহাদের মধ্যে সেই শক্তির ক্রিয়া আছে যাহার সাধারণ অতিস্থূল নাম প্রবৃত্তি,—আরও সূক্ষ্ম দার্শনিক নামও আছে, যাহা নানা গুণে নানা অবস্থায় ও নানা কারণে মানুষকে এক একটি চরিত্ররূপে বিকশিত করে; সেই রহস্যময় শক্তির আগুনে গলিয়াই এক একটি চরিত্রের ছাঁচে প্রত্যেক মানুষের মুখ পৃথক হইয়া উঠে। মন-গড়া—কিম্বা সাইকোলজি, বায়োলজি, জুওলজি, অ্যানথ্রাপোলজি, সোসিওলজি প্রভৃতি বিজ্ঞান—বিদ্যার ল্যাবরেটরীতে তৈয়ারী করা চরিত্র তাহারা নয়, কাব্য-পুরাণ-ইতিহাসের ত’ নহেই। ঐরূপ চরিত্রসৃষ্টি করিবার জন্য জীবন-কর্মকারের কামারশালায়, হাপরের পাশে দাঁড়াইয়া যাঁতার দড়ি টানিবার ছলে সেই কর্ম্মকারের হাতের কৌশল, তাহার হাতুড়ির ছন্দ চোখে কানে ও বুকে নোট করিয়া লইতে হয়; ইহার জন্য মেধ্য-অমেধ্য, শুচি—অশুচি-বিচার ত্যাগ করিতে হয়; ঐ জীবন যেন একই প্রবাহ, মানুষগুলা এক একটা তরঙ্গ মাত্র—একই স্রোত, একই জল, উহার আবার শুচি-অশুচি, সুন্দর-অসুন্দর, উচ্চ—নীচ-ভেদ কি? আসলে, উহা সেই এক শক্তির লীলা—যে-শক্তি মানুষের প্রবৃত্তিরূপে কত রঙ-বেরঙের খেলা খেলিতেছে। উহাকে প্রেম বলিলে হইবে না, জ্ঞান বলিলে হইবে না, সৌন্দর্য্য বলিলেও হইবে না, উহা নিছক শক্তিমাত্র। সেই স্বতঃস্ফূর্ত্ত, আত্ম—মুগ্ধ, নিশ্চিন্ত, নির্বিকার শক্তির লীলা বুঝিতে না পারিয়া আমরা, ভাল-মন্দ, সুন্দর—কুৎসিত, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি নানা বিরোধাভাস স্বীকার করি। তাহাকে বুদ্ধির দ্বারা ধরিতে পারা যায় না, দূরে ধরিয়াও দেখা যাইবে না; তাহার সহিত চিত্তকে যোগযুক্ত করিতে পারিলে যে-রসের অবস্থা হয়, তাহাতেই কবি-শিল্পীগণ তাহার সেই অনর্থকে একটা অর্থের ছন্দে বাঁধিয়া দেন,—অর্থহীন, নিয়তিনিয়মহীন, পূর্ব্বাপর—সঙ্গতিহীন, খণ্ড, অসম্পূর্ণ, বিরূপ ও বিসদৃশ ব্যাপারগুলিকে একটা রসরূপ দান করেন। ইহাই সকল শ্রেষ্ঠ কবিকর্ম্মের লক্ষণ। কিন্তু তারাশঙ্কর, অন্ততঃ বাংলা সাহিত্যের এই কাহিনীকাব্যবিভাগে, সেই শক্তিকে যেদিক দিয়া তাঁহার কবিচিত্তগোচর করিয়াছেন—তাহার যে-রূপকে তিনি রসবৎ করিয়াছেন, তাহাতে মৌলিকতার একটি বিশেষ লক্ষণ আছে। এইজন্যই তাঁহার প্রায় সকল গল্পই চরিত্রকে মুখ্য করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। এই চরিত্র বলিতে কি বুঝি তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি—আমি, বাংলা গল্প-উপন্যাসের চরিত্র বলিতে সাধারণতঃ যাহা বুঝায়, সেই চরিত্রের কথা বলিতেছি না। তারাশঙ্করের গল্পের ঐ চরিত্রগুলি জীবনের সেই কামারশালার অগ্নিকুণ্ড হইতে এক রহস্যময়ী শক্তির লীলাচ্ছন্দে উৎক্ষিপ্ত বা উৎসারিত স্ফুলিঙ্গবিন্দুর মত। ইহাদের মধ্যে একটা প্রবল গতিবেগ আছে—ইহারা স্থির নয়, অন্তরস্থ গতিবেগে ইহারা যে চরিত্ররূপে প্রকাশ পাইয়া থাকে, সেই চরিত্রও চলিষ্ণু, গতিমান, ক্ষয়োদয়শীল, পরিণাম-মুখী; তাহার সেই যে গতি, সেই পরিণামশীলতা তাহাই গল্প হইয়া উঠে। প্রশ্ন উঠিতে পারে, গল্প ত’ সকল রকমের চরিত্র লইয়াই রচিত হইতে পারে; তাহার উত্তরে বলা যায়, গল্প ত’ একরকম নয়—একটা বর্ণনাও ত’ গল্প, কোন একটি ঘটনার চিত্তাকর্ষক বিবৃতিও গল্প; আবার, চরিত্রবিশ্লেষণমূলক কতকগুলি অবস্থার দৈনন্দিন লিপিও ত’ গল্প। এ গল্প তাহা হইতে স্বতন্ত্র; চরিত্রের বর্ণনা, বিবৃতি বা বিশ্লেষণ নয়, চরিত্রের বিকাশ বা রূপান্তর—যাহাকে ইংরেজীতে growth বা development বলে—এ সকল গল্প তাহারই গল্প; অর্থাৎ সেই যে শক্তির কথা বলিয়াছি, ইহা যেন তাহারই বিচিত্র ব্যক্তি-রূপের স্ফুরণ—কাহিনী—সেই গতির, পরিণতির সেই গতিবেগের মাত্রা ও পরিমাণ স্থির করিয়া লইয়া পরে তাহার গতিপথ নির্ভুলভাবে অঙ্কিত করা হইয়াছে। গল্পের সেই গতি-প্রেরণা চরিত্রের মধ্যেই আছে—সেখানে যদি একটুও হিসাব ভুল হয়, তবে গল্পটিই মাটি হইয়া যাইবে। কারণ, ঐ চরিত্র নিজের গল্প নিজে সৃষ্টি করিতেছে—তারাশঙ্কর সেই চরিত্রের মধ্যেই সমগ্র গল্পটি সম্পূর্ণ আকারে দেখিয়া লইয়াছেন।
সত্য বটে, তাঁহার সকল গল্পেই চরিত্রের সহিত একটি নাটকীয় ঘটনা-চক্র যুক্ত হয় নাই, অর্থাৎ সকল চরিত্রই গল্পের আকারে পূর্ণবিকশিত হয় নাই, তথাপি চরিত্রান্তর্গত সেই শক্তির ক্রিয়া প্রায় সর্ব্বত্রই লক্ষিত হইবে। ‘রসকলি’র ‘রসকলি’ নামক গল্পটিতেও তাহা যেমন আছে, তেমনি ‘বেদিনী’র ‘বেদিনী’তেও আছে। কিন্তু ঐ যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলিয়াছি, তাহার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘বেদিনী’র ‘না’ গল্পটি। এই গল্পের গল্পবস্তু যেমন নাটকীয় লক্ষণযুক্ত, ইহার গল্পরসও যেমন উজ্জ্বল, তেমনই গোড়ায় যে দুইটি চরিত্র অতিশয় দৃঢ় অথচ সরল রেখায় চিত্রিত হইয়াছে—গল্পটির ঘটনাধারাকে সেই দুই চরিত্রের অবশ্যম্ভাবী বিকাশধারা বলিতেই হয়; ‘character is fate’ বা ‘স্বকৰ্ম্মফলভুক্ পুমান্,’—এই পরম তত্ত্বটিই যেন এখানে তথ্যরূপ ধারণ করিয়াছে
আমি তারাশঙ্করের প্রতিভার বৈশিষ্ট্য বা মৌলিকতার আলোচনায় এই যে কথাগুলি লিপিবদ্ধ করিলাম, ইহাতেও হয়ত আসল কথাটা স্পষ্ট করিয়া তুলিতে পারি নাই। জীবন বলিতে আমি কি বুঝি তাহা বলিয়াছি, বলিয়াছি—মূলে সে একটা শক্তি; আমাদের জ্ঞানে তাহা অন্ধ। সেই শক্তি মানুষের দেহ-জীবন আশ্রয় করিয়া, তাহার নিজেরই সেই দুয়ে লীলায় যেন এক একটি চরিত্ররূপে ফুটিয়া ঝরিয়া যাইতেছে। আর কিছু নয়, কেবল তাহারই রস তারাশঙ্করের গল্পগুলিতে যে ভাবে ও ভঙ্গিতে সঞ্চারিত হইয়াছে, ঠিক তেমনটি আমাদের সাহিত্যে পূর্ব্বে ছিল না। তারাশঙ্করের সাহিত্য—সৃষ্টি আকারে বা আয়তনে—এমন কি পরিমাণেও বড় নয়; তাঁহার সৃষ্টিশক্তির ঐশ্বর্য্যও শীঘ্র নিঃশেষিত হইয়াছে। তার একটা কারণ, বাঙালীর জীবনে তাহার বিস্তারের ক্ষেত্র বড় সঙ্কীর্ণ, সেরূপ শক্তির অবাধ লীলার স্থান বা পরিবেশ অতিশয় সীমাবদ্ধ। কিন্তু সেই সীমার, সেই সঙ্কীর্ণ পরিসরের মধ্যে তারাশঙ্কর জীবনের একটি সম্পূর্ণ নূতন রসরূপ আবিষ্কার করিয়াছেন। পূর্ব্বে বলিয়াছি, সে দৃষ্টি অতিশয় বাস্তবনিষ্ঠ হইলেও বাস্তবভেদী; বাস্তবের ভিতর দিয়াই একটা রস-রহস্যের সন্ধান তাহাতে আছে। তিনি যেন অতিশয় দৃঢ়চিত্তে ও স্থিরদৃষ্টিতে মানুষরূপী এই জীবকে এক বিরাট পুতুলনাচের মঞ্চে কোন্ অদৃশ্য বাজীকরের হস্তধৃত রজ্জুর আকর্ষণে নৃত্য করিতে দেখিয়াছেন; সেই বাজীকরের মতই নির্বিকারভাবে জীবনের সর্বত্র তাঁহার দৃষ্টি বিচরণ করিয়াছে—বীভৎসকেও যেমন, ভীষণকেও তেমনই, মধুরকে যেমন করুণকেও তেমনই, এক পংক্তিতে বসাইয়াছে।
এই দৃষ্টির মূলে আছে একরূপ বৈজ্ঞানিক পিপাসা; শুনিতে একটু অদ্ভুত বটে, কিন্তু সকল বাস্তব-জিজ্ঞাসাই বৈজ্ঞানিক। তারাশঙ্করের ঐ রসজ্ঞতা ও সৃষ্টিপ্রতিভাও যেমন দৈবী, তেমনই তাঁহার সেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও কারণ জিজ্ঞাসা ঐ প্রতিভারই আনুষঙ্গিক। আমরা তাঁহার শিল্পকর্মগুলির নৈপুণ্য দেখিয়া বিস্মিত হই, কিন্তু তাঁহার শিল্পশালায় প্রবেশ করিলে উপকরণ-আয়োজনের প্রাচুর্য্য দেখিয়াও কম বিস্মিত হইব না। জীবনের রূপকার হইতে হইলে, জীবনের গ্রন্থই পাঠ করিতে হয়; সকল রূপকারই অল্পবিস্তর তাহা পাঠ করিয়াছেন বটে, কিন্তু সকলেই আপনাপন রুচি ও রসবোধের গণ্ডির মধ্যে তাহা করিয়া থাকেন; অর্থাৎ, নিজ নিজ পিপাসার-নিজ নিজ রসকল্পনার দৃষ্টিতে যেটুকু দেখিবার তাহাই দেখিয়া থাকেন। কিন্তু তারাশঙ্কর যেন জীবনকে, আদৌ একটা ভিন্নতর পিপাসার বশে রসাস্বাদনের জন্য বা রসকল্পনার বশে নয়—তাহার কলকব্জা, তাহার জটিল জাল গ্রন্থি খুলিয়া দেখিবার একটা দুর্দমনীয় কৌতূহলে—কেবল দেখিবার ও জানিবার আকুল ইচ্ছায়—বহু পরিশ্রম করিয়াছেন। গল্পের প্লট সংগ্রহ করিবার জন্য নয়, জীবনকে চায়ে চুমুক দিবার মত সৌখীনভাবে একটু আস্বাদন করিবার জন্য নয়, আমেরিকান টুরিষ্টের ভারতভ্রমণ এবং ভ্রমণ-শেষে ভারত সম্বন্ধে মহা—বিজ্ঞতাপূর্ণ গ্রন্থরচনার জন্য নয়, জীবনকে এক পলকমাত্র আধাচোখে দেখিয়া, সেই দেখার অভিমানে গর-গর হইয়া জীবন-রহস্যের মহারসিক বা জীবন-তত্ত্বের মহা-আচার্য্য বনিবার জন্যও নয়,—কেবল জীবনকে দেখার জন্যই তাহাকে দেখার এই পিপাসা তারাশঙ্করের যেমন আছে, বা ছিল বলিয়া মনে হয়, ঠিক তেমনটি আমাদের আর কোন ঔপন্যাসিক বা গল্পলেখকের ছিল বা আছে বলিয়া মনে হয় না। ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইবে তাঁহার সদ্যপ্রকাশিত একটি বিচিত্র রচনায়—যাহার নাম দিয়াছেন “হাঁসুলীর বাঁকের উপকথা”। এই রচনাটিকে কি নাম দিব? ইহা ঠিক গল্প না উপন্যাস নয়, ইহা তারাশঙ্করের সেই অপর ক্ষুধার—সেই মানুষ ও মানুষের সমাজকে জানিবার দেখিবার, সেই বৈজ্ঞানিক কৌতূহলনিবৃত্তির একটি চমৎকার দলিল। একটি বিশিষ্ট উপজাতির জীবন-যাত্রা, তাহাদের সমাজ-ব্যবস্থা, ধর্ম্ম-বিশ্বাস, চরিত্র-নীতি,—তাহাদের সুখ-দুঃখ, আত্ম-নিগ্রহ ও পর-পীড়ন, তাহাদের জীবিকা এবং তাহাদের বাসভূমির ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক রূপ, এবং সর্ব্বশেষে ঐ জাতিটার পুরাতন ও আধুনিক ইতিবৃত্ত—এই সকলই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এই বিবরণীতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে; কোন গভর্ণমেন্ট তাঁহাদের জরিপ-বিভাগের তত্ত্ব-সংগ্রহ-পুস্তকে ইহা অপেক্ষা সম্পূর্ণতর সংবাদ দপ্তরভুক্ত করিতে পারিতেন না। কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটি মন এবং আরেকটি চক্ষুও ইহাতে সজাগ হইয়া আছে। সেই যে জীবনের কথা বলিয়াছি, এই সকল, নর-নারীর মধ্যে তাহাদের প্রাণের গঠনে, তাহাদের সাধারণ ও ব্যক্তিগত চরিত্রে—সেই জীবন বা সেই রহস্যময় শক্তির লীলা কোন্ ভঙ্গিতে কোন্ ছন্দে প্রকাশ পাইতেছে, তারাশঙ্করের দৃষ্টি সে দিকেও নিবদ্ধ আছে। এ দৃষ্টি মুখ্যতঃ কবি-দৃষ্টি নয়; এ দৃষ্টি হৃদয়াবেগবর্জ্জিত, বৈজ্ঞানিক তান্ত্রিকের দৃষ্টি; এই দৃষ্টিই তারাশঙ্করের সকল রচনার আদি-প্রেরণা। এইখানে, এই বিবরণী-রচনায় তাঁহার সেই স্ব-ধর্ম্মই আর সকল প্রবৃত্তিকে পরাভূত করিয়াছে। এই রচনাটি পাঠ করিলে আমরা কোন গল্প বা কাহিনী-রস আস্বাদন করি না, কোন ব্যক্তি বা বিশেষ-চরিত্রই ইহাতে প্রধান হইয়া উঠে নাই—চরিত্রগুলি একটা বিশিষ্ট জীবন—ধারার গতি বা আবর্তের নিশানা মাত্র। এ মনোভাব শিল্পীর মনোভাব নয়—একরূপ সমাজবিজ্ঞানীর মনোভাব; তফাৎ এই যে, তাহাতে কেবল জড়বিজ্ঞান নয়, চিৎ—বিজ্ঞানেরও প্রলেপ আছে।
এই যে তারাশঙ্কর, ইনিই যখন জীবনের শিল্পরূপ নির্ম্মাণ করেন—যেমন তাঁহার গল্পগুলিতে করিয়াছেন—তখন যে তাহাতে একটা সম্পূর্ণ নূতন ধরণের রসসৃষ্টি হইবে, ইহাই তো স্বাভাবিক। সে রস বাস্তবের রসই বটে, কিন্তু তাহার অন্তরালে একটা নিৰ্ম্মম অনাসক্ত তান্ত্রিক-দৃষ্টি আছে; সেই দৃষ্টি যখন নর-নারীর হৃদয়মধ্যেও উঁকি দিয়াছে তখন তাহা খাঁটি আর্টিষ্টের নির্মমতায় পরিণত হইয়া, সর্ব্বসংস্কারমুক্তির যে—আনন্দ সেই আনন্দের রস সৃষ্টি করিয়াছে। ইহাই তারাশঙ্করের আর্ট, আমি তাহাকে একরূপ তান্ত্রিক রস-প্রেরণা বলিয়াছি; ইহার স্থূল দৃষ্টান্ত হিসাবে, তাঁহার গল্পে নর—নারীর প্রেম ও প্রেম-বিকারগুলি স্মরণ করিতে বলি। সেই প্রেমে নীতি-দুর্নীতির সংস্কার নাই—আছে কেবল প্রত্যেক চরিত্রে সেই প্রবৃত্তির রক্তগত সংস্কার।
‘জলসাঘরে’র জমিদার বিশ্বন্তর রায়ের প্রেম—দেহ বা প্রাণের পিপাসা নয়, সে একটা সৌখীন মানস-ব্যাধি; তাহার বেদনাও আমাদের সম্ভ্রম উদ্রেক করে, নীতি—দুর্নীতির সংস্কারকে জয় করিয়া আমাদের প্রাণে যে রসোদ্রেক করে, তাহারও মূলে আছে ঐ চরিত্রের পৌরুষ-বীর্য্যের ট্র্যাজেডি-মহিমা। আবার, ঐ প্রেম কুষ্ঠব্যাধিকেও ঘৃণা করে না, কারণ তাহাও elemental বা প্রকৃতিসুলভ প্রবৃত্তি। কোথাও বা একটা সাপিনীর অপূর্ব্ব রূপে মুগ্ধ হইয়া একটা পুরুষ তাহাকে চুম্বন না করিয়া পারে না, এই সাংঘাতিক রূপ-মোহের মধ্যে যৌনপ্রবৃত্তির কোন্ সূক্ষ্ম চেতনা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে? আমি কয়েকটি স্কুল দৃষ্টান্ত দিলাম; তারাশঙ্করের ঐ দৃষ্টিও কিরূপ রস-দৃষ্টি হইয়া উঠিয়াছে—এই সঙ্কেতটি অবলম্বন করিয়া পাঠক-পাঠিকাগণ তাঁহার গল্পগুলি আর একবার মনোযোগ সহকারে পাঠ করিলেই বুঝিতে পারিবেন। ঐ সকল চরিত্র, যে এমন authentic বা অসংশয় হইয়া উঠিয়াছে, তাহার কারণ, তিনি কেবল উপরকার আবরণটাই দেখেন নাই; সর্ব্বত্র সেই রহস্যময়ী শক্তির, সেই জীবনরূপিণী মোহিনী নর্তকীর—সেই বেদ—পুরাণ-নীতিশাস্ত্র-লঙ্ঘন-কারিণী বেদিনীর “আত্মমুগ্ধা স্বয়ংস্থিতা—উপচয়ে দশহস্তা, অপচয়ে ছিন্নমস্তা”-মূর্তি চোখের সম্মুখে রাখিয়াছেন।
পূর্ব্বে বলিয়াছি, তারাশঙ্করের সাহিত্যকীৰ্ত্তি বড় বা বিশাল নহে, তাহার পরিমাণ বা বিস্তার কোনটাই সৃষ্টি-শক্তির প্রাচুর্য্যের পরিচায়ক নহে। তথাপি বাংলা সাহিত্যে, বা আরও ঠিক করিয়া বলিতে হইলে, বাঙালী-জীবনের কাব্য-কাহিনী-রচনায়, তারাশঙ্কর যে একটি বিশিষ্ট প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। রচনার পরিমাণ এবং গঠন-রীতি যেমনই হৌক, একটা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি যে একটি গভীরতর রস-ধারা আমাদের সাহিত্যে, আমাদেরই জীবনের মৃত্তিকা-তল হইতে উৎসারিত করিয়াছেন, আমি এতক্ষণ তাহারই একটা দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিবার চেষ্টা করিয়াছি। এইবার, আমি যে-জন্য এই ভূমিকাটুকু আবশ্যক বোধ করিয়াছিলাম—সেই কাব্যখানির আলোচনা করিব, তারাশঙ্করের আর সকল গল্প উপন্যাস বাদ দিয়া আমি এক্ষণে কেবল ঐ একটি রচনার সম্বন্ধে আমার মনে যে-চিন্তাগুলির উদয় হইয়াছে, তাহাই একটু বিশদভাবে বলিবার চেষ্টা করিব।
২
তারাশঙ্করের পূর্ব্ব-লিখিত গল্প ও উপন্যাস পাঠ করিয়া তাহাদের সেই রস-রূপের বৈশিষ্ট্য দেখিয়া যেমন মুগ্ধ হইতাম, তেমনই তাহার অন্তরালে যে একটি অতি গভীর ও অতিশয় তীক্ষ্ণ ভাব-দৃষ্টির আভাস পাইতাম—আমি উপরে তাহার একটু আলোচনা করিয়াছি। প্রথম হইতেই এই ধারণা জন্মিয়াছিল যে, বাঙালী-সমাজ ও বাঙালী—জাতির জাতিগত জীবন, বাংলাদেশের একটা প্রাচীন ভূমিখণ্ডে—গত দুইশত বৎসরের শিক্ষাবিপ্লব, রাষ্ট্রবিপ্লব এবং ধর্মবিপ্লবের আঘাত সত্ত্বেও, সেই যজ্ঞকুণ্ড হইতে দূরে অবস্থিত বলিয়া—বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি যেটুকু যে-অবস্থায় এখনও বিদ্যমান আছে, বা বহু বিকৃতি সত্ত্বেও এখনও তাহার প্রাণধর্ম্মের সেই প্রাক্তন প্রবৃত্তিগুলা যতটুকু সক্রিয় আছে—তারাশঙ্কর জাতির সেই প্রায়-প্রাকৃতিক জীবনকাহিনীর কথক বা কাহিনীকাররূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। শুধু সেই প্রাকৃতিক জীবনই নয়—সেই সমাজের উচ্চ, মধ্য ও নিম্নস্তরের বালুসৈকতে কালের যত চিহ্ন রহিয়া গিয়াছে, বাংলার মধ্যযুগের—সেই নবাবী আমলের—যে আভিজাত্য-গৌরব উচ্চবর্ণের শাক্ত হিন্দুর জীবন—স্রোতকে বিক্ষুব্ধ করিয়াছিল, এবং সেই একই সমাজের নিম্নশ্রেণীর প্রকৃতিপুঞ্জকে শ্রীচৈতন্যের নববৈষ্ণব-ধর্ম্মের যে বন্যা ডুবাইয়া ভাসাইয়া, শেষে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত এখনও তাহার জীবনকে সরস করিয়া রাখিয়াছে— কালস্রোতের সেই যুগ্ম তরঙ্গরেখাও তিনি গণিয়া দেখিয়াছেন, কোথাও তাহার অস্পষ্ট, কোথাও বা গভীরাঙ্কিত চিহ্ন তিনি দৃঢ়চিত্তে ও তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন। এ সকলই আমি লক্ষ্য করিয়াছিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা জিজ্ঞাসা বা রহস্যভেদের প্রয়াসও অনুভব করিয়াছিলাম। আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি, তারাশঙ্কর তাঁহার গল্পগুলিতে যে-সমাজের যে জীবন-চিত্র—যে চরিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহা যেন সেই স্থানের মাটিতে গড়া, ঐ মাটিতে তিনি যেন তাঁহার দ্বারা চিত্ত মিলাইয়া দিয়াছেন। এজন্য পূর্ব্ব হইতেই আমার একটু সন্দেহ ছিল, তাঁহার সচেতন কবিবুদ্ধি যেমনই হোক, তাঁহার রস-দৃষ্টি ও সাহিত্যিক প্রতিভা যতই ব্যক্তিগত হোক, একটা গভীরতর জাতিগত চেতনা (race-experience) তাঁহারও অজ্ঞাতসারে তাঁহাকে আবিষ্ট করিয়াছে। যে সমষ্টিগত চেতনা একটা জাতির বিশিষ্ট জীবন-ধারায়—নানা যুগের নানা ভাব ও প্রভাবকে আত্মসাৎ করিয়াও নিজের সেই আদিম প্রাণধৰ্ম্মকে পুষ্ট অথচ অবিচলিত রাখে—ইতিহাস যাহার বিবর্তনটাই বড় করিয়া দেখে, জীবিতের মধ্যে মৃতের সন্ধান করে, মৃতের জীবিত-রূপকে দেখে না—তারাশঙ্কর তাহাকেই গভীরভাবে অনুভব করিয়াছেন এই বাংলাদেশের এমন একখণ্ড মাটিতে, যেখানে এই জাতির সেই আদি-প্রকৃতি, তাহার রক্তগত প্রবৃত্তি, এক কথায়, তাহার মানবতারই একটা অক্ষত এবং বিশিষ্ট রূপ বহু পলিস্তর ভেদ করিয়া, এখনও এই বিংশ শতাব্দীতে নিজের পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছে। এই ‘কবি’ নামক কাব্যখানিতে তারাশঙ্কর একটা জাতির সেই মর্ম্মস্থল উদ্ঘাটিত করিয়াছেন—ঐ ক্ষুদ্র-কাহিনীটিতে তিনি তাহার সেই সহস্র বৎসরের হৃদয়স্পন্দন ধরিয়া দিয়াছেন। এই কথাটি বুঝাইবার জন্যই আমি এই কাব্যখানির পরিচয়দানে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এ কাহিনীর নায়ক হইয়াছে একজন অন্ত্যজ-জাতীয় অশিক্ষিত যুবা—ইহার নায়িকা হইয়াছে যে-নারী সে সমাজ—বহির্ভূতা স্বৈরিণী। আমরা একেবারে বাংলার সেই প্রায়-প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগের সমাজে উত্তীর্ণ হই—যে-সমাজে বৌদ্ধবিপ্লবের ফলে আর্য্য বা ব্রাহ্মণ্য-শাসন শিথিল হইয়া গিয়াছে। প্রায় প্রাক্-ঐতিহাসিক বলিলাম এইজন্য যে, তৎপূর্ব্বের বাঙালী-জীবন ও বাঙালী-সমাজ কি ছিল—আমরা এক্ষণে যাহাকে বাঙালী বলি, ঠিক তাহাই ছিল কিনা—তাহা কোন ঐতিহাসিক এখনও স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন নাই। এ যেন সেই বৌদ্ধগান ও দোঁহার যুগ, যখন বাঙালীর সেই অনার্য্য রক্তের প্রকৃতি-প্রেম একটা নূতন তন্ত্রের প্রশ্রয় পাইয়া উচ্ছল ও কৃতার্থ হইয়াছে। কোন বর্ণভেদ—কোন কঠিন আচার-সংযমের শাসন নাই, দেহ হইতে পৃথক কোন আত্মার অভিমান নাই; আছে কেবল একটা অতিগভীর উৎকণ্ঠা; সে উৎকণ্ঠা একরূপ বিষামৃতের রসাবেশে সারা প্রাণকে এমনি বিভোর করে যে, আর সকলই মিথ্যা মনে হয়। এ জগৎ খাঁটি রূপ—রসের জগৎ; সেই রূপ-রসের রহস্যে রহস্যময় নরনারীর যে-জীবন তাহাই মহা-মহার্ঘ ও পরম পবিত্র বলিয়া মনে হয়। ইহাই এই জাতিকে চিরদিন আবিষ্ট, মুগ্ধ ও উৎকণ্ঠিত করিয়াছে—ইহাই তাহার ধাতুগত সংস্কৃতি। বাহিরে যত-কিছু ভাঙা-গড়া, যত বিপ্লব, যত নিত্য-নূতনের হুঙ্কার ও মাতামাতি চলুক না কেন, ইহার মাটিতে এবং ইহার সেই একান্ত প্রকৃতি-পরবশ দেহ-চেতনায়-ঐ এক বীজ চিরদিন অঙ্কুরোন্মুখ হইয়া আছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্য্যগণও যে-মন্ত্রের সাধনা করিয়াছিলেন, সহজিয়া-সাধক চণ্ডীদাসও তাহাই করিয়াছিলেন; আবার এই অতি-আধুনিক যুগের সাধক কবি বিহারীলাল নূতন সুরে, সেই এক মন্ত্র জপ করিয়াছিলেন। এ যুগের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ অভিজাত কবি রবীন্দ্রনাথও ইহার প্রভাব হইতে নিস্তার পান নাই; আর্য্য-সাধনার—উপনিষদের—দীক্ষা লাভ করিয়াও, বাঙালী-স্বভাবের সেই প্রাণগত উৎকণ্ঠা দমন করিতে পারেন নাই, তিনিও আর্য্য-শাস্ত্রের নূতন ভাষ্য-রচনা করিয়া, ব্রহ্মকে প্রকৃতির রূপে ধ্যান করিয়া রূপরসের ব্রহ্মাস্বাদ করিয়াছেন। তাঁহারও কবি-জীবনে, ঐ আর্য্য-আধ্যাত্মিকতা এবং অনার্য্য বাঙালীর প্রকৃতি-প্রেম-বিভোরতা—একদিকে আত্মাভিমানের উচ্চ-আদর্শ ও অপরদিকে সকল নীতি ও নিয়ম-নিষ্ঠার বিরুদ্ধে সেই সহজিয়া স্বৈরতন্ত্রের রসাবেশ—এই দুয়ের দ্বন্দ্বে, শেষ পর্য্যন্ত জাতিগত প্রবৃত্তিই জয়ী হইয়াছে। বারবার তাঁহাকেও বলিতে হইয়াছে, এই জীবনের মত পরমসুন্দর আর কিছুই নাই, মানুষে মানুষে কোন ভেদ নাই, আত্মপ্রতিষ্ঠায় সুখ নাই; প্রাণের পিপাসাই একমাত্র সত্য, এবং সে পিপাসা মিটাইতে হইলে সব ত্যাগ করিয়া বাউলের একতারায়—বাঁশের বাঁশীতে মাধুরীর সাধনা করিতে হইবে। তারাশঙ্করের ঐ ‘কবি’ সেই একই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে; কিন্তু সে সিদ্ধিলাভ হইয়াছে জীবনের ধূলা-মাটির আসনে, একেবারে প্রকৃতির নগ্নবক্ষে, সেই তান্ত্রিক পদ্ধতিতে—যে তন্ত্র বাঙালীরই জীবন-তন্ত্র, যাহার নাম প্রকৃতি-উপাসনা।
এই গল্পে আমরা সেই প্রকৃতিকে—বাংলার ও বাঙালীর প্রকৃতিকে—যে রূপে ও রসে এবং যে নগ্নতায় উদ্ঘাটিত ও উদ্ভাসিত হইতে দেখি, তেমনটি বাংলা সাহিত্যে আর কোথাও দেখি নাই। ঐ কবি যে-সমাজের সর্বনিম্ন তলদেশ হইতে উদ্ভূত হইয়াছে সেই সমাজ উপরকার সভ্যতায়, বহিরাগত বহু ধর্ম্ম ও সংস্কৃতির চাপে, পতিত-মৃত্তিকা—প্রোথিত বটে। উহার উপরে জমিদার আছে, ব্রাহ্মণ আছে, সৎশূদ্র আছে, এবং আজিকার বাবু অর্থাৎ ইংরাজী-পড়া চাকুরিয়া বাঙালী আছে; কিন্তু উহারই মধ্য হইতে, এবং উহারই প্রকৃতি-সুলভ ভঙ্গিতে ও সুরে, যে জীবন-গীতি উৎসারিত হইয়াছে, তারাশঙ্কর যাহার মূল সুরটি ঐ ‘কবি’র চরিত্রে এমন নিখুঁত করিয়া প্রাণ-মন ও দেহ-ময় করিয়া দেখাইয়াছেন, বাঙালীর সমগ্র সাধনা ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কি উহাতেই ধরা দেয় নাই? সে বৈশিষ্ট্য কি? এই কাহিনীতে তাহার সবটাই পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশ পাইয়াছে।
প্রথমতঃ, এ জাতির আভিজাত্য-গৌরব বলিয়া প্রকৃত কোন গৌরব নাই; ইহার গৌরব—সর্ব্ববিশেষণবর্জ্জিত, উচ্চ-নীচ-অভিমানহীন, ঐ ভূমির মতই সমতল-বাহিনী একটি অতি সরল অকৃত্রিম মানবতায়। সেই মানবতার মূল মন্ত্র—জীবনকে যতদূর সম্ভব জটিলতামুক্ত করিয়া, বিলাস-ব্যসনের উপকরণবাহুল্য, ঐশ্বর্য্যের দুরাকাঙ্ক্ষা, এবং লোকব্যবহারের সর্ব্বপ্রকার কৃত্রিম বন্ধনজাল অগ্রাহ্য করিয়া, ব্যক্তি-মানুষকে যতদূর সম্ভব মুক্তিদান করা। সে মুক্তিও একরূপ জীবন্মুক্তি, অর্থাৎ এই মনুষ্য-জন্মেই, দেহের এই পিপাসাকেই নির্বিষ করিয়া—দেহের অতলে যিনি আছেন তাঁহার ভোগের নৈবেদ্য প্রস্তুত করিয়া—মৃত্যুকেই অমৃত করিয়া তোলা। কথাটা ভাষায় বুঝাইতে গিয়া এইরূপ তত্ত্বগন্ধী হইয়া পড়িল; কিন্তু পাঠক-পাঠিকাগণ ঐ গল্পটি পড়িলেই ইহার মর্ম্ম হৃদয়ে উপলব্ধি করিতে পারিবেন।
দ্বিতীয়তঃ, বাঙালীর ঐ যে নিজস্ব জাতিগত বা রক্তগত আকৃতি, তাহা সমাজের উপরের স্তরে শাস্ত্র-শাসনের ও সমাজ-বন্ধনের কঠিন কবচে অবরুদ্ধ হইয়া থাকিলেও, ব্রাহ্মণ হইতে নিম্নতম শ্রেণীর মানুষ পর্যন্ত সকলের চিত্তে উহা সমান; সমাজের ঐ কৃত্রিম শ্রেণীবিভাগ সত্ত্বেও, ভাবের বা রসের ক্ষেত্রে একটি আশ্চর্য্য সমানুভূতি সমগ্র জাতিকে সমপ্রাণ করিয়া রাখিয়াছে—এমন দুই একটি তন্ত্রী আছে, যাহাতে ঝঙ্কার দিলে আর সকল তন্ত্রী ঐকতানে বাজিয়া ওঠে,—ইহাও দেখিতে পাই। এমন তন্ত্রী হয়ত আর সকল জাতিরও ঐরূপ দুই একটা আছে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেখানে শ্রেণীগত পৃথক সংস্কারও প্রবল। এই শ্রেণীর সৃষ্টি এ যুগের বাঙালী-সমাজেও হইয়াছে—শহর ও শহর-সন্নিহিত অঞ্চলগুলিতে ঐরূপ শ্রেণীর অভ্যুদয় হইয়াছে। কিন্তু সেই শ্রেণী বিশালতর বাঙালী-সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন বা বিশ্লিষ্ট হইয়াই আছে; আমরা শহরবাসীরা ঐ শ্রেণীকেই জানি ও চিনি, তাই তাহাদেরই মন দিয়া বাঙালীকে বেশী বুঝি বলিয়া দম্ভ করিয়া থাকি। আসলে, আমরা, অর্থাৎ এই নূতন পরগাছা-শ্রেণীর বাঙালী—পরধর্ম্ম ও পরবিদ্যা-গর্বিত বাঙালী—জাতির সেই চেতনা হইতেই ভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছি। শ্রেণী—কথাটির উপরে জোর দিবারও আবশ্যক আছে, কারণ, খাঁটি বাঙালী-সমাজে বৃত্তিগত জাতি-উপজাতি-ভেদ ছিল বটে, ঐরূপ শ্রেণীভেদ ছিল না; তার কারণ, তাহার ঐ মানবতা—ভাব ও রস-জীবনে স্বাধাবিক সাম্য-প্রবণতা। এই ‘কবি’ও জাতিতে ডোম বটে, কিন্তু তাহার ঐ ভাবসাধনায়, ব্রাহ্মণে ও তাহাতে কিছুমাত্র ভেদ নাই। সেই ভাব, আমরা যাহাকে সভ্যতা বা সংস্কৃতি বলি তাহা নয়; অর্থাৎ, কোন জাতির জীবনভাণ্ডের উপরে ভাসমান একটা তৈল-পদার্থের সূক্ষ্ম আস্তরণ মাত্র নয়; উহা তাহার জীবনের সর্বত্র-সঞ্চারী প্রাণ-বস্তু, উহাই তাহার জীবনী-শক্তি—উহাতেই সে বাঁচিয়া আছে; ঐ ‘কবির মধ্যে সেই প্রাণধর্মেরই গভীরতম ও বিশুদ্ধতম বিকাশ হইয়াছে
তৃতীয়তঃ, সেই ভাব—যাহা বাঙালীর ঐ সমাজ-জীবনের নানা বন্ধন ও নানা অস্বাস্থ্যকর সংস্কার-জঞ্জালের তলায় পড়িয়া জীবনের গতিধারায় বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত হইয়া থাকে—তাহারও সাধনমার্গ আছে; অর্থাৎ, যাহা রক্তগত, তাহাকেই বীজরূপে আশ্রয় করিয়া সেই বীজের পূর্ণবিকাশ সাধনের একটা নিজস্ব পন্থাও আছে। এই পন্থাও প্রকৃতির পন্থা; ইহা শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট নয়, ইহার পথ বাঙালী আপনার অনুভূতি—অর্থাৎ নিজ অন্তরের ক্ষুধা-অনুযায়ী আপনি খুঁজিয়া লয়। ইহারই নাম “সহজিয়া”—বাঙালীই এই মন্ত্রের আদি-সাধক। সে কেমন সাধনা, এ গল্পের ঐ ‘কবিয়াল’ নায়ক তাহার একটি চমৎকৃত দৃষ্টান্ত। ইহাও এক অর্থে প্রকৃতি-সাধনা, অর্থাৎ ইহাও তান্ত্রিক। কিন্তু বাঙালী শ্মশানে বা ভৈরবী-চক্রে বসিয়া এ সাধনা করে না—তাহার কারণ পূর্ব্বেই বলিয়াছি; সে জীবনের পাত্রেই জীবনের রসমাধুরী পান করিতে চায়—সুস্থ ইন্দ্রিয়—পিপাসাকে রুদ্ধ করিয়া নয়, তাহাকেই শোধন করিয়া, নির্বিষ করিয়া; সকল কামনা—বাসনা-বেদনাকে—স্নেহ-প্রীতির সহজাত ক্ষুধাকে—একরূপ রসে পরিণত করিবার যে শক্তি, তাহারই সাধনা করে। সত্য বটে, এই প্রবৃত্তি অধ্যাত্ম-গম্ভীর হইয়া বিভিন্ন যোগ—মার্গে বা গুহ্য-সাধন-মার্গেও প্রয়াণ করিয়াছে; কিন্তু তাহা জাতিহিসাবে নয়—সে সকল সাধনা সাধারণ জীবন-ধারার বাহিরেই বহিয়া গেছে। তাই বাঙালী শাক্তই হোক, বৈষ্ণবই হোক, সে যে-তন্ত্রেরই দীক্ষিত শিষ্য হোক—আসলে সে ঐ সহজিয়া। মহাশক্তিকেও মা বা কন্যা রূপে ভজনা করিয়া সে তাহার সেই সহজ-পিপাসা না মিটাইয়া পারে না; শাক্ত বাঙালী ও বৈষ্ণব বাঙালীতে এইমাত্র ভেদ যে, একজনের বাস্তব-বিষয়াসক্তি কিছু বেশি, অপরে সেই বাস্তবকেই গূঢ়তর রসরূপে ভোগ করিতে চায়। আমি এমনও বলিতে পারি যে, ঐ সকল ভেদও উপরকার সেই সমাজবন্ধনের মতই কৃত্রিম; বাঙালী আসলে শাক্তও নয়, বৈষ্ণবও নয়, বৌদ্ধও নয়, বেদান্তীও নয়; সে সকলই কতকগুলা বাহিরের ছাঁচ মাত্র; সে ছাঁচ সে যেমন গড়ে তেমনি ভাঙে; তাহার ভিতরকার সেই তরল বস্তুটা চিরদিন তরলই আছে। ছাঁচগুলা ভাঙিয়া তাহা দেখিবার সুবিধা হইবে না, তাই তারাশঙ্কর, যেখানে ছাঁচের বালাই নাই, সেইখান হইতেই এই মূৰ্ত্তিটি তুলিয়া লইয়া, সেই তরলকে আমাদের চোখের সম্মুখে পৰ্দ্দায় পর্দ্দায় দানা বাঁধিতে দেখাইয়াছেন।
সেই সহজের এমন কাহিনী বাংলাসাহিত্যে ইতিপূর্ব্বে পাই নাই। সহজকে ভাবে-ভাষায় বাক্যে-চিত্রে এমন নিষ্কলঙ্ক সহজ করিয়া তোলা যে কিরূপ কাব্যপ্রেরণা-সাপেক্ষ তাহা বুঝি বলিয়াই এমন বিস্ময় বোধ করিয়াছি। ইহাও মনে হয় যে, এই কাহিনী—রচনায় তারাশঙ্করের অন্তর-পুরুষ আপন বাণী-রূপটি আবিষ্কার করিয়াছে। এই যে পরিপূর্ণ আত্ম-প্রকাশ ইহারই বেদনা সকল কবিশিল্পীকে, তাঁহাদের সাহিত্যিক জীবনের প্রারম্ভ হইতেই, নিরন্তর ব্যাকুল করিয়া থাকে; উহারই তাড়নায় “আপন গন্ধে কস্তুরী—মৃগসম” তাঁহার বাণীর অরণ্যে বিচরণ করিয়া থাকেন; কত কাব্যই রচনা করেন, কিন্তু কোনটাতেই সেই বেদনার পূর্ণ-নিবেদন হয় না। পরে একবার সহসা —“by the magic hand of chance”—সেই বাণী-রূপটি তাঁহারা খুঁজিয়া পান, তখন বেদনা হইতে মুক্তিলাভ করেন, রসসৃষ্টির সেই আকুলি-বিকুলিও আপনা হইতেই নিবৃত্ত হয়। সাহিত্যিক প্রতিভা ও সাহিত্যসৃষ্টির যে তত্ত্ব অধুনা কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্য হইয়াছে তদ্দ্বারা ইহাও বলা যাইতে পারে যে, তারাশঙ্করের সেই খাঁটি রসসৃষ্টির উৎকণ্ঠা ঐখানেই শেষ হইয়াছে; ইহার পর তাঁহার রচিত কোন কাহিনীতে শিল্পীর আত্মপ্রকাশের সেই আধ্যাত্মিক আকৃতি না থাকাই সম্ভব। আমি পূর্ব্বে তারাশঙ্করের যে বৈজ্ঞানিক পিপাসার উল্লেখ করিয়াছি, অতঃপর সেই প্রবৃত্তিই নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘ্ন হইয়া-রসকল্পনার ভাবঘোরে আবিষ্ট না হইয়া, জীবনকে যে অতিশয় সাদা চোখে দেখিবে, সমস্যা ও সংশয়ের সমাধানে জাগ্রত মনে বুদ্ধির অভিমানকেই তৃপ্ত করিতে চাহিবে, ইহাই স্বাভাবিক। ঐ সাহিত্যসৃষ্টির তত্ত্ব সেই কথাই বলে। কিন্তু এখানে তাহার বিস্তারিত আলোচনা অনাবশ্যক ও অপ্রাসঙ্গিক।
৩
এইবার উপন্যাসখানির কাব্য-সমালোচনা করিব। ইহার কল্পনা-মূলে কবিমানসের যে জাতিগত প্রেরণার আলোচনা পূর্ব্বে করিয়াছি, কাব্য-সমালোচনার পক্ষে তাহার সাক্ষাৎ প্রয়োজন না থাকিলেও সেরূপ আলোচনা অবান্তর নহে; কারণ, মানব-জীবন—কাহিনীতেও কবিদৃষ্টির ঐ বৈশিষ্ট্যই জগৎ-সাহিত্যকে অনন্ত রস-রূপে সমৃদ্ধ করিয়াছে। বাংলার একটা বিশিষ্ট কালচার, বা জীবন-সাধনার একটি বিশিষ্ট ভঙ্গিই শুধু নয়—সেই কালচারের রাসায়নিক ক্রিয়ার মানবচরিত্রেরও যে একটা গভীরতর দিক ইহাতে উদ্ঘাটিত হইয়াছে, তাহা নিখিলমানব প্রকৃতিরই আরেক রূপ। য়ুরোপীয় কথাসাহিত্যে ও নাটকে আমরা যে অত্যুগ্র ভোগ-পিপাসু, অস্থির, সংগ্রামশীল মানুষকে দেখি, সেই মানুষকেই আমাদের সাহিত্যে আরেক রূপে দেখিতে পাই। এখানে সে-রূপ শান্ত স্থির, ভোগবিমুখ, আত্ম-সমাহিত; আমি উভয় সাহিত্যের আদর্শগত জীবনের কথাই বলিতেছি। এইজন্যই আমাদের সাহিত্যে, বিশেষ করিয়া বাংলাসাহিত্যে, য়ুরোপীয় সাহিত্যের মত প্লটের ঘনঘটা বা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষজনিত চরিত্র-বিকাশের অবকাশ নাই; এইজন্যই আমাদের জীবনযাত্রার নিস্তরঙ্গ প্রবাহ হইতে পঞ্চাঙ্ক ট্র্যাজিডি বা বৃহদায়তন উপন্যাস সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু সাহিত্যের ঐ আকৃতি বা আয়তনই যেমন মনুষ্যজীবনের একমাত্র দর্পণ নয়, এবং জীবনের বহির্গত আয়তনটাই তাহার একমাত্র বিস্তারক্ষেত্র নয়, তেমনই মানবচরিত্রের ঐ একটা দিক্—মানুষের ভোগপিপাসার অসীমতা ও দুর্দমনীয়তা, এবং তাহাতেই তাহার যে শক্তি প্রকাশ পায়—তাহাই মানুষের একমাত্র পরিচয়, অন্য পরিচয়ও আছে; য়ুরোপীয় সাহিত্যে তাহা তেমন ফুটিয়া উঠিতে পারে নাই। ঐ কামনা-বাসনাই মানুষের মনুষ্যত্বের নিদান বটে, কিন্তু উহারও একটা উল্টা মুখ আছে, তাহাও সেই শক্তিরই আর এক দিক্। বাঙালীর জীবনে এই দিকটার বিকাশ চিরদিন হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু সাহিত্যে তাহার প্রকাশ তেমন করিয়া হয় নাই। তার একটা কারণ আত্মসচেতনতার অভাব; অপর কারণ, ঐরূপ প্রকাশের কোন পূর্ব্ব-প্রতিষ্ঠিত শিল্পরীতি ছিল না। ভারতীয় কলাশিল্প বা কাব্যরীতি ইহার উপযোগী নয়, কারণ, বাঙালীর রস-জীবন ততখানি আধ্যাত্মিক বা অরূপতান্ত্রিক নয়; তাহা আত্ম-সমাহিত হইলেও রূপাশ্রয়ী, ইন্দ্রিয়সৰ্ব্বস্ব না হইলেও দেহতাত্ত্বিক। এক কথায় বাঙালী দেহাত্মবাদী, অর্থাৎ দেহ ও আত্মার অভেদ-সাধনার পক্ষপাতী। ইহার ফলে, সে ঐ কামনা বাসনাগুলাকে দেহের ক্ষেত্রেই আত্মার সেবায় নিযুক্ত করিয়াছে, দেহেরই জবানীতে দেহাতীতের ক্রন্দনকে এক অপূর্ব্ব গীতিঝঙ্কারে অমৃতনিঃস্যন্দী করিয়া তুলিয়াছে। বৈষ্ণব পদকর্তাদের গানে সে একবার তাহার সেই রস-জীবনকে সাহিত্যে একটা বাণীরূপ দিয়াছিল—ঐ একরূপ, ঐ গীতিকবিতার রূপ ছাড়া, আর কোন রূপ সে উদ্ভাবন করিতে পারে নাই; তাহাতেও সে কেবল ভাবকেই রূপ দিয়াছিল, ভাবময় দেহটাকে রূপ দিতে পারে নাই; সে—জীবন হইতে ঐ ভাবের উৎপত্তি, সেই জীবনকে—নরনারীর মূর্ত্তি গড়িয়া, সাকার করিয়া তুলিতে পারে নাই। ইহার জন্য যে আর্ট—সেই মূর্তি খোদাই করিবার জন্য যে যন্ত্রপাতি—তাহাই য়ুরোপ হইতে আমদানি করিয়া, আমাদের ভাষার মাটিতে সেই শিল্পরীতির কর্ষণ ইতিপূৰ্ব্বে চূড়ান্ত হইয়া গিয়াছে; বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে তারাশঙ্করকে সে বিষয়ে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই। বাংলাসাহিত্যের এই যে অঙ্গটি পূরণ করিবার ছিল তাহাই তিনি করিয়াছেন, তিনি বাঙালীর সেই সহজ—জীবনের গীতি-সুরটিকে ভাবের নিরাকার হইতে মূর্ত্তির সাকারে—জীবন-কাহিনী—রূপে—রূপময় করিয়াছেন।
এই কাহিনীও একটি বড় গল্প অপেক্ষা দীর্ঘ হইতে পারে নাই, অর্থাৎ রীতিমত উপন্যাসের কলেবর প্রাপ্ত হয় নাই। তথাপি ইহা ছোট-গল্প নহে। ছোট-গল্প হইলে ইহা মানব-জীবনেরই একটা কাহিনী হইতে পারিত না—সেই ঘটনা-মণ্ডল বা প্লট আশ্রয় করিতে পারিত না, যাহা নহিলে জীবনের কোন একটা দিক সম্পূর্ণ আকারে দেখিতে পাওয়া যায় না। ছোট গল্পে তাহা আবশ্যক হয় না, তাহাতে জীবনকে তেমন করিয়া দেখিবার, দেখাইবার অভিপ্রায় নাই; সে যেন ক্যামেরার ক্ষুদ্র প্রেক্ষণ-পরিধির মধ্যে যেটুকু চকিতে দেখিয়া লওয়া যায় তাহারই একটা চিত্র; সে চিত্রকে বিশালতর পটভূমিকায় সন্নিবিষ্ট করিয়া তাহার পারিপার্শ্বিকের বিস্তার বা খণ্ড-আকার হইতেই তাহার মণ্ডলাকার আমরাই কল্পনায় পূর্ণ করিয়া লই—তাহাই তাহার রস। কিন্তু কাহিনী বলিতে (বড় গল্প ও উপন্যাস) আমরা রীতিমত প্লটের উপরে গাঁথা এবং আদি ও অন্তের গ্রন্থিযুক্ত, একটা জীবন-কাহিনীই বুঝি। কাব্যে (এবং কাব্যপ্রধান উপন্যাসে) ও নাটকে, সেই পরিচয় ততটা বস্তুগত হয় না যতটা ভাবগত হইয়া থাকে। ঐরূপ খাঁটি বস্তুগত কাহিনী-রচনাই আধুনিক সাহিত্যে একটা বড় আর্ট হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ইহাকেই সাধারণ অর্থে ‘নভেল’ বলা হয়। ইংরাজী শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ আমরা তৈয়ারী করিয়া লইতে পারি নাই, তাই রসবিচারেও আমরা অনেক ভুল করিয়া থাকি। আজকাল আমরা যে-কোন বড় কাহিনীকে উপন্যাস নাম দিই। তাহার একটা কারণ এই যে, অতি আধুনিক য়ুরোপীয় সাহিত্যের দেখাদেখি আমরা উপন্যাসের কোন form বা বাঁধুনিকে গ্রাহ্য করি না, প্লট বা গল্পবস্তু অনাবশ্যক মনে করি। বাস্তব জীবনযাত্রাঘটিত যে-কোন ধরণের কতকগুলা খন্ডচিত্রের সমষ্টি—তাহার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা, এমন কি মতপ্রচারমূলক জল্পনাও উপন্যাস নামে চলিয়া যাইতেছে। ঐ যে প্লটের কথা বলিয়াছি, উহাই মানবজীবনকাহিনীর রসরূপত্বের অবিচ্ছেদ্য উপকরণ, উহারই মূলে আছে একটা সম্পূর্ণ অখণ্ড দৃষ্টি। উপন্যাসের ঐ প্লট বলিতে শুধুই গল্পের শেষ-হওয়া বুঝাইবে না; গল্পহিসাবে সেইরূপ আদি-অন্তের মিল থাকা ত’ চাই-ই, কিন্তু তাহার অভিপ্রায় আরও গূঢ়—ঐ প্লটই কাহিনীগত জীবনকে যে একটি অর্থ—সঙ্গতি দান করে, তাহাই রসরূপে আমাদের চিত্তে প্রতিভাত হয়; ঐ প্লটই সেই form—এর—সেই অন্তর্নিহিত রসরূপের একমাত্র আশ্রয়; উহা যে উপন্যাসে নাই, তাহা আর সবকিছু লইতে পারে, কিন্তু তাহা সাহিত্যিক রূপকর্ম্ম—জীবনের রস-রূপ-সৃষ্টি নয়।
এই কথা এইখানে বলিবার তাৎপর্য এই যে, বাংলার প্রায় সকল শক্তিমান কথাশিল্পীই উপন্যাস রচনায় তেমন সাফল্য লাভ করিতে পারেন নাই—অন্ততঃ আমি যাহাকে খাঁটি উপন্যাস বলিয়াছি, সেইরূপ কথাকাব্য-রচনায়। তাহাতে বাঙালী কথাশিল্পীর লজ্জা পাইবার হেতু নাই, শালগাছ যদি আমাদের মাটিতে না হয় তবে তাহাতে বোটানি—বিদ্যার যতই অসুবিধা হউক, বাংলার প্রকৃতিশোভার কোন হানি হয় না। গীতিকবিতায় যেমন, ছোট-গল্প-রচনাতেও তেমনই, বাঙালী লেখকগণ যে প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, তাহাতেই বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে আমরা একটা বড় আসন দাবী করিতে পারি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের গীতিকাব্যসুলভ রসকল্পনা যাহাদের অস্থিচর্ব্বণপটু দন্তে রসের স্বাদ জাগাইতে পারে না, তাহারাও তারাশঙ্করের ছোটগল্পের অন্ততঃ কতকগুলিতে, তাহাদের দত্ত ও রসনা দুইয়েরই তৃপ্তিসাধন করিতে পারিবে, তেমন তৃপ্তি তাহারা য়ুরোপীয় সাহিত্যের কোন ছোটগল্পে পাইবে না; কারণ, মানুষের বাস্তব-মানবতাই একাধারে এমন কঠিন ও রসকোমল হইয়া সেখানেও ফুটিয়া উঠে নাই—সেখানকার সাহিত্যে, ছোটগল্পের অতি সংকীর্ণ পরিসরে মানবচরিত্রের শুধুই আদিম বাস্তবরূপটাই নয়, তাহার রহস্য-গভীর রূপও আমাদের চিত্তকে এমন উৎকণ্ঠিত করিয়া তোলে না।
কিন্তু তারাশঙ্কর এই বড় গল্পটিতেই—এই একখানি ছোট উপন্যাসে বাঙালী-জীবনের সেই লিরিক কাহিনী-বস্তুকে একটা সৰ্ব্বাঙ্গসম্পূর্ণ প্লট ও সুডৌল form-এর আকারে বিস্তারিত ও সুগ্রথিত করিতে পারিয়াছেন। ইহাতে যেমন প্লট আছে, তেমনই চরিত্র ও ঘটনা-সংস্থিতি (situation) আছে, একটি মূল সুর যেমন অব্যাহত আছে, তেমনই তাহাতে নানা বিচিত্র সুর—নানা রং ও রূপের নরনারীচিত্র—একটি ঐকতানে সমাহিত হইয়াছে। ইহা একটি বড় গল্প, না উপন্যাস? —আধুনিক সমালোচনা-শাস্ত্রে সে প্রশ্নও অবান্তর। প্রত্যেক উৎকৃষ্ট কবিকৰ্ম্মই স্বতন্ত্র, তাহার যতকিছু লক্ষণ তাহার নিজেরই; সেগুলি সাধারণ লক্ষণ হইলে কোন একটা শ্রেণীতে তাহাকে ফেলিয়া অলঙ্কারশাস্ত্রের সম্মান রক্ষা করা সম্ভব হইত বটে, কিন্তু তাহা হইলে সেই কাব্য খাঁটি সৃষ্টিকৰ্ম্ম হইত না। তথাপি, আমি এই কাহিনীকে সাধারণ অর্থেই উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত করিয়াছি, তার কারণ, ঐ ক্ষুদ্র কলেবরেই উহা ছোট গল্পের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া এমন একটা বৃহত্তর ও জটিলতর আখ্যান-ভঙ্গিতে পৌঁছিয়াছে যাহা উপন্যাসের পক্ষেই সম্ভব; উপরন্তু, একটা লিরিক কাব্যবস্তু, কথার আকারে, খাঁটি নাটকীয় কল্পনার লীলাভূমি হইয়াছে। ইহাও একরূপ মৌলিক সৃষ্টি।
এ কাহিনীতে মানুষের জীবনকে কোন্ রূপে, কোন্ ভঙ্গিতে দেখা ও দেখানো হইয়াছে? আমি পূৰ্ব্বে বলিয়াছি, এই কাব্যকল্পনার মূলে একটা জাতির বিশিষ্ট সাধনা ও ইতিহাসগত সংস্কৃতির প্রেরণা আছে; এক্ষণে তাহাও ভুলিতে হইবে, কারণ জীবনের রূপরস সন্ধানে, উপাদানের কথা বড় নয়, রূপের কথাটাই বড়; মাটি ও সারের বিচার একটা বড় বিচার বটে, কিন্তু ফুলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করিবার কালে মাটি বা মালীর কথা আমরা নিশ্চয় ভাবি না। আবার, যে-সমাজের যে-অবস্থায় ঐ জীবন—তাহার যতকিছু পাপপুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, লাঞ্ছনা-নির্যাতনের অগ্নিমন্থনে একটা রস-রূপ ধারণ করে, আমরা তাহার সেই অবস্থাকে একটা মন্থনোপায় বলিয়াই মনে করি,—আসলে চাহিয়া থাকি জীবনের সেই মন্থিত রূপটার দিকে, সেটা ভিতরের দিক। কিন্তু বাহিরে, ঐ মন্থনের ফলে, যে ফেনরাশি উৎপন্ন হয় তাহার বুদ্বুদজালের অন্ত নাই; সেই জাল ছিন্ন করিয়া তাহার তলদেশের স্বচ্ছ শান্ত নীল-শোভা যিনি দেখিতে ও দেখাইতে পারেন তিনিই জীবনের শ্রেষ্ঠ রূপকার। ঐ ফেন-বুদ্বুদের জালই সেই অতিপ্রবৃদ্ধ মানস-চেতনা, যাহা জীবনের স্বচ্ছ রূপটি আচ্ছন্ন করিয়াছে; য়ুরোপীয় কথাসাহিত্যে এই জালটি ছিন্ন না করিয়া, সেই জালেরই সূক্ষ্মতম জটিল তন্তুগুলিকে নূতন নূতন অণুবীক্ষণের সাহায্যে আবিষ্কার করা, অর্থাৎ মানুষের সেই অতিপ্রবৃদ্ধ মানস-চেতনার জটিলতা প্রদর্শন করাই শ্রেষ্ঠ কবিকীর্তির নিদর্শন বলিয়া গণ্য হইয়াছে; মানুষ যাহা নয়, যে-আবরণটা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া তাহার প্রকৃত সত্তাকে দুদশ্য করিয়াছে, তাহারই জয়গানে অতি-আধুনিক য়ুরোপীয় সাহিত্য মুখর হইয়া উঠিয়াছে। এইরূপ কোন একখানি উপন্যাসের পার্শ্বে ‘কবি’-গল্পটিকে বসাইলে, মনে হইবে, উহাতে আছে কি? উহাতে মানব-মানসের সেই দুর্ভেদ্য জটিলতা, সেই উচ্চ জ্ঞানবুদ্ধি-সুলভ সমস্যারাজির দুরন্ত সংগ্রাম কোথায়? না, সে সব কিছুই ইহাতে নাই। ইদানীং ‘Life’ নামক যে আর একটি হিংস্র, ক্ষুধার্ত্ত পশু-জীবনকে গৌরবান্বিত করা হইতেছে, যাহাতে দেহের প্রবৃত্তিগুলাকে অতিশয় প্রখর করিয়া—সেই দুৰ্ব্বলতাকেই শক্তি-নাম দেওয়া হইতেছে, ইহার জীবন সেই ‘জীবন’ নয়। ঐ কবিয়াল নায়কটির জীবন তাহার চতুর্দ্দিকে যে পরিমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহাতেও দেহের স্থান অল্প নহে; তথাপি তাহাতে ক্ষুধার প্রচণ্ডতাও যেমন নাই, তেমনই সমস্যার তরবারি -ঝঞ্ঝনাও নাই। ইহাতে আধুনিক কালের অতি-বিরাট মানস-যন্ত্রাগারে প্রস্তুত কোন শিল্পদ্রব্যের দুর্মূল্য শোভা নাই; মানুষকে মানুষই তাহার শিল্পশালায় যেমন গড়িয়া তুলিয়াছে ইহার জীবন তেমন মানুষের জীবন নয়। তাই মনে হইতে পারে, এ কাহিনী নিতান্তই তুচ্ছ—যেমন সরল, তেমনই গ্রাম্য। কিন্তু কবি যে বলিয়াছেন—
To me the meanest flower that
blows can give
Thoughts that do often lie too
deep for tears.
—ইহাও তেমনই গভীর, ইহার সত্যও তেমনই চিরন্তন। আবার ইহার শক্তিও পূর্ণ-শক্তি। কবিয়ালের জীবনে যে ঝড় বহিয়াছে তাহা অপেক্ষা বৃহত্তর ঝড় মানুষের জীবনে বহিতে পারে না; সেই ঝড়ের শেষে যে ধীর প্রশান্ত অবস্থার ইঙ্গিত করিয়া সে জীবনের পরিণাম সূচিত হইয়াছে, তাহাই জীবনের শক্তিলীলার পূর্ণতম পরিণতি। ঐ শান্তি পরাজয়ের শান্তি নয়, সকল বাসনা কামনাকে বুক পাতিয়া লইয়া, তাহার গভীরতম বিক্ষোভকে জয় করার শান্তি। এ জীবন স্বচ্ছন্দ-বনজাত ফুলের জীবনই বটে; সমাজের হলচালনায়—তাহার তীক্ষ্ণ কর্ত্তনীর আঘাতে সে ফুল উন্মুলিত বা বৃন্তচ্যুত হয় বটে, তথাপি সেই ফুলই অমর, তাহা চিরদিন ফুটিয়াছে ও ফুটিবে। হয়তো সমাজেরই কোন একটা ভাব-রসে তাহা পুষ্ট হইয়াছে, আবার সমাজেরই রূঢ় নিষ্পেষণে তাহার জীবন-ধৰ্ম্মও বিচলিত হইয়াছে; তথাপি, এবং সেই কারণেও, মানবাত্মার সেই আদি অকৃত্রিম রূপ আরও বেশি করিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়; একটির জন্য, তাহার বুকে যে রং লাগিয়াছে সেই রং অন্তরের মধুকে আরও মধুর করিয়া তোলে; অপরটির জন্য, তাহাতে যে কণ্টকগুলি দেখা দিয়াছে তাহাও সেই ফুলের বৃন্তকে আরও দৃঢ় করিয়াছে। ইহাও যে একটা বিশিষ্ট সাধনার ফল, পূর্ব্বে তাহা বলিয়াছি, কিন্তু এখানে তাহা ভুলিতে হইবে, নতুবা ফুলগুলির সেই অতি—সহজ মানবত্ব-মহিমা উপলব্ধি করা যাইবে না।
সে-জীবনের রূপ ও রস হৃদয়ঙ্গম করিবার পক্ষে, ঐ নায়ক কবিয়ালের চরিত্র ও তাহার জীবনের গতি-নিয়তি লক্ষ্য করিলেই চলিবে। এখানেও মানবজীবনের মূল গ্রন্থিটি—যে গ্রন্থিতে দেহের সঙ্গে আত্মার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন ঘটিয়া থাকে—সেই গ্রন্থিই কাহিনীর সূত্রগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়াছে; সেই গ্রন্থির নাম—নর-নারীর প্রেম। ঐ এক গ্রন্থি—হয় বন্ধন, নয় উন্মোচন করিবার প্রয়াসে, মানুষ আপনাকে চিনিয়াছে ও চিনাইয়াছে। এই উপন্যাসে সেই প্রেম ভাবে ও অভাবে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করিয়াছে, তাহাতে, একদিকে যেমন দেহের বাস্তব, অপরদিকে তেমনই আত্মার অতি-বাস্তব পরস্পরের সহিত সমান যুঝিতেছে; একের পরাজয় ও অপরের জয় দুইই এক রসের সঞ্চার করে—যেন জয় ও পরাজয়ে কোন প্রভেদ নাই। দেহের সহিত আত্মার যে বিরোধ তাহাকে স্বীকার করিয়াও ঐ প্রেম দেহের অসম্মান করে না; দেহের যতকিছু জ্বালা ও বীভৎসতা, তাহার অপেক্ষা ও আক্রোশকে সে প্রাণ পাতিয়া গ্রহণ করে, এবং সেই সঙ্গে দেহের গায়ে পরম স্নেহে হাত বুলাইয়া দেয়। আমি যে মূল-গ্রন্থির কথা বলিয়াছি, তাহা এইরূপ প্রেম; ইহা নর-নারীর যৌন-পিপাসাঘটিত বটে, কিন্তু তাহা যেমন কবিকল্পনার মন্দারকুসুম নয়, তেমনই একটা পরিশুদ্ধ পাশব-বৃত্তিও নয়। মানুষের দেহের মধ্যেই তাহার বাস বটে, কিন্তু তাহা জাগে ঐ দেহেরই মর্যাদাবোধ হইতে, এবং মনে নয়—প্রাণে। এই প্রাণ-ধর্ম্ম স্বভাবের নিয়মে, এমন এক জনের মধ্যে স্ফুরিত হইয়াছে—যাহার চারিদিকে দেহের ক্ষুধা, রক্তের পশুবৎ উত্তেজনাই প্রবল; অর্থাৎ, সেই সকলের মধ্যে—যাহাদের মানস-বৃত্তি অতিশয় অকর্ষিত, অতি নিম্নস্তরের প্রাণ-ধর্ম্মই যাহাদের একমাত্র সম্বল। ঐ দুর্ব্বার ক্ষুধা কবিয়ালের ধাতুতেও বিদ্যমান, সেই ধাতুর কঠিন আবরণ ভেদ করিয়া কোন্ ছিদ্রমুখে কখন যে স্বাতীনক্ষত্রের জল প্রবেশ করিল, দেহের পিপাসাই প্রাণের গভীরতর পিপাসায় পরিণত হইল—তাহা প্রকৃতিঠাকুরাণীই জানেন, ঐ দেহ-ধর্ম্মের বশেই তাহা ঘটিয়াছে। মানব-সভ্যতার আদি—ইতিহাসও ইহার সাক্ষ্য দিবে। যজ্ঞের নাম পশুহননকারী অতিবলিষ্ঠ, দুম্মদ আর্য্যগণের মধ্যেই আদি ঋষি-কবির উদ্ভব হইয়াছিল। সেই দেহের শক্তি হইতেই প্রাণ-শক্তি এবং প্রাণ-শক্তি হইতে দিব্য-জ্ঞানের দৃষ্টিশক্তি লাভ হইয়াছিল। তারাশঙ্কর বাংলার সেইরূপ সমাজ হইতেই একটি মানুষকে তুলিয়া লইয়াছেন; এ পুরুষ এক হিসাবে আদিম বটে, কিন্তু তাহার প্রকৃতি জ্ঞানপ্রবণ নয়, অনুভূতি-প্রধান; তার কারণ, এ মানুষের জাতি ভিন্ন, ইহার দেশের জল-মাটিও ভিন্ন।
এ কাহিনীর নায়ক কবি হইলেও স্বভাব-কবি, শিল্প-কবি নয়—মানুষ-কবি; অর্থাৎ সে অবসরমত কাব্যচর্চ্চা করে না, কাব্যপ্রেরণার জন্য বাস্তবকে ছাড়িয়া কল্পনার আরাধনা করে না,—ঐ কবিত্ব তাহার বাস্তবজীবনেরই অভিব্যক্তি। তাহার জীবন দুইটা নয়, জগত্ত দুই নয়; এক জগৎ হইতে অপর জগতে পৌঁছিবার কৌশল তাহাকে শিখিতে হয় না। এই মানুষ-কবির সব চেয়ে বড় প্রেরণা-আত্মার মর্য্যাদাবোধ; সকল দুৰ্ব্বলতা, দৈন্য ও হীনতাকে জয় করিবার আকাঙ্ক্ষা। অতএব, এই কবি-চরিত্র জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করিবার মত একটি শক্তিমান পুরুষ-চরিত্রই বটে। উহার ঐ কবিশক্তি—প্রবুদ্ধ প্রাণশক্তি বা প্রেমশক্তিরই অপর নাম।
এই প্রেমে সকলই সহজ। যদি বলি, ইহাতে ত্যাগের কৃচ্ছ্রসাধন—আত্মনিগ্রহ আছে, তবে তাহা ঠিক হইবে না, কারণ, ইহার ত্যাগেও শূন্যতা নয়—পূর্ণতাবোধ আছে; সেই ত্যাগের বেদনায় একটা রসের অনুভূতি আছে, তাহাতেও একটা আনন্দ আছে, একটা চরিতার্থতা আছে; তাহাতে ব্যথা আছে, কিন্তু দুঃখ নাই। নিজে নিষ্পাপ বলিয়া সে মানুষকে ঘৃণা করে না; ঘৃণা নাই বলিয়াই বেদনা আছে, যাতনা নাই; সেই বেদনার তীব্রতাই তাহার প্রাণে একটি অপূর্ব্ব রসের সঞ্চার করে—মৃত্যুকেও অমৃত করিয়া তোলে। ইহাই দেহ-সাধনা, ইহাই সহজিয়া। এই সাধনাতেও, তারাশঙ্কর খাঁটি তান্ত্রিকের মত—প্রায় অঘোরপন্থীর মত—তাঁহার কাহিনীর ঐ নায়ককে, দেহের চরম দুর্গতি ও বীভৎস-লীলার মধ্যেই, শবসাধকের মত জয়ী করিয়াছেন, কৃমিকীটসঙ্কুল গলিত লালাপঙ্কে পঙ্ক-স্নান করাইয়া তাহাকে শুচি ও সুন্দর করিয়াছেন।
ঐ প্রেম মূলে প্রকৃতি-প্রেমও বটে; শুধু মানুষের প্রতিই নয়, জল-স্থল-আকাশ—বিহারিণী ধাত্রীরূপিণী যে প্রকৃতি, জননী-জন্মভূমির রূপে, নিদ্রায় ও জাগরণে মানুষের প্রাণে স্নেহস্পর্শ বুলাইয়া দেয়—সেই প্রকৃতির একটি অ-রূপ চিন্ময় সত্তার প্রতি যে গভীর আকর্ণ, তাহাও এই প্রেমের পুষ্টিসাধন করিয়াছে। ইহাও মানবতার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ইহার বিহনে মানবতার পূর্ণ বিকাশ হয় না। কিন্তু ইহা যে কেমন প্রেম, তাহা এই কাহিনীর ঐ নায়কটিকে না দেখিলে বুঝিতে পারা যাইবে না। ইহাও কবির প্রেম, না মানুষের প্রেম? খাঁটি মানুষের প্রেম বলিয়াই সেই প্রেমে মানুষ ঐরূপ কবি হইয়া উঠিয়াছে। গল্পটি ভাল করিয়া পড়িলে মনে হয়, লেখকের কল্পনা—মূলে এই তত্ত্বটি অলক্ষিতে বিদ্যমান ছিল, তিনি এই প্রেমকেও তাঁহার নায়কের জীবনধারায় গূঢ়-সঞ্চারী করিয়াছেন, উহাই শেষ পর্য্যন্ত মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করিয়াছে। মানুষের প্রতি মানুষের যে প্রেম তাহাতে মানুষের হৃদয় মথিত হয়, সেই মন্থন—বিষ হজম করিতে না পারিলে মৃত্যু অনিবার্য্য। হৃদয়-সংগ্রামের সেই যে রণস্থল, তাহার পশ্চাতে ঐ প্রকৃতি মূক-মৌনী শুশ্রূষাকারিণীর রূপে দাঁড়াইয়া আছে— অবস্থাবিশেষে ঐ শুশ্রূষাকারিণীর শুশ্রূষা মানুষ চায় এবং পায়ও। এই তত্ত্বটিও ঐ কবিয়ালের জীবন—কাহিনীতে বড় সত্য হইয়া উঠিয়াছে; তাহার সমগ্র সত্তা, তাহার সারাজীবন যে প্রেমে ভরপুর, তাহার উপাদান তিনটি—করুণা, সৌন্দর্য্য ও শান্তি। ইহার মধ্যে শেষ দুইটি পুষ্ট হয় প্রকৃতির অলক্ষ্য প্রভাবে; প্রথমটি মানুষের নিজ-প্রকৃতি-সম্ভব। আদিকাল হইতেই উহার বীজ মানুষের প্রকৃতিতে আছে, কালে তাহা অঙ্কুরিত হয়, এবং ব্যক্তি—জীবনের কোন শুভলগ্নে তাহা পুষ্পিত হইয়া উঠে। এই প্রেমকে ঐ সৌন্দর্য্য ও শান্তিই অলক্ষ্যে লালন করে, সকল আঘাত হইতে তাহাকে রক্ষা করে। এ কাজ প্রকৃতিই করিয়া থাকে। এখানেও উহা নায়কের প্রেমকে যেমন পুষ্ট করিয়াছে, তেমনই উহাই তাহাকে বাঁচাইয়াছে—সংগ্রামশেষে সে-ও সেই মহা-শুশ্রূষাকারিণীর অঙ্কে মাথা রাখিয়া তাহার সকল বেদনা জুড়াইয়াছে।
ইহার পর, উপন্যাসের কাহিনী-অংশে, চরিত্র, ঘটনা, ও নাটকীয় সংস্থিতির যে প্রয়োগ-নৈপুণ্য আছে তাহার বিস্তৃত পরিচয় না দিয়া, আমি কেবল সংক্ষেপে তাহার একটু আভাস দিব। প্রথমে, নায়ক চরিত্রের বিকাশ ও তাহার সেই প্রেম-সাধনার একটু পরিচয় দিবার চেষ্টা করিব। দুর্দান্ত খুনে-ডাকাতের বংশে তাহার জন্ম, তাহার সমাজ এবং সংসার দুইই আদিম প্রকৃতির। নিতাই-এর রক্তে তাহারই প্রতিক্রিয়া ঘটিয়াছে, দৈত্যবংশে প্রহ্লাদ জন্মিয়াছে। কিন্তু দেহের ঐ দুর্দান্ত আগুনই যে প্রেমের দীপ্তিতে পরিণত হইয়াছে, ঐ বংশধারার রূপান্তরিত প্রভাবই যে তাহার সেই প্রেম-শক্তির কারণ, লেখক সেই ইঙ্গিতই করিয়াছেন; অথবা, তাঁহার তেমন কোন সজ্ঞান অভিপ্রায় না থাকাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক, কারণ সৃষ্টির দৃষ্টিই অব্যর্থ; তাই সৃষ্টিকালে চরিত্রের যতকিছু নিমিত্ত-উপাদান আপনা হইতেই আসিয়া মিলিয়াছে। একদিন নিতাই সহসা একটা ঘটনায় আপনাকে চিনিল, নিঃসংশয়ে উপলব্ধি করিল যে, সে সকল সামাজিক উপাধিবর্জ্জিত, দৈবানুগ্রহধন্য এক ভিন্নশ্রেণীর মানুষ—সে কবি, অর্থাৎ সত্য-সুন্দরের পূজারী; যাহাকিছু মহৎ, মঙ্গলময় ও পবিত্র, সে তাহারই গান গাহিবার জন্য, রসনায় বাণীর প্রসাদ লাভ করিয়াছে; তাহার মুখে মিলযুক্ত ছন্দোবদ্ধ কাব্য আপনা হইতে আসিয়া পড়ে, প্রাণ ভাববিদ্ধ হইলেই ঐরূপ শ্লোকে তাহা উৎসারিত হয়। নিজের এই আশ্চৰ্য্য শক্তি দেখিয়া সে বিস্মিত হইল; তাহার ঐ দেহটার মধ্যে, ঐ ডোম—জাতীয় মানুষটার মধ্যে, এ কোন্ দেবতা বাস করিতেছে! এই দেবতাকে সকল অমর্য্যাদা হইতে রক্ষা করিতে হইবে। তাহার প্রাণের পিপাসা ঐ দেবতারই পিপাসা : সে পিপাসা বড় মধুর, বড় পবিত্র, বড় সরল। সেই পিপাসা মিটাইবার জন্য সে গান রচনা করিতে লাগিল। সেই গানেরই গায়ক কবিয়াল হইয়া, সে বাংলার পল্লীসমাজে—তাহারই পরিচিত মানবসমাজে—অমৃত বিতরণ করিবে, মানুষের প্রাণ তাহাতে সাড়া দিবে, তাহার যশ-লাভ হইবে; তাহাতেই তাহার প্রাণের ঠাকুর পরিতৃপ্ত হইবেন। এই কবির জীবন-চিত্র যে বাস্তব পরিবেশে, এবং যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখায় প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতেও তারাশঙ্কর একটা বড় কাজ করিয়াছেন; তিনি এই কাহিনীতে বিগতযুগের বাংলা কবি-গান ও কবিওয়ালাকে আমাদের চোখের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়াছেন—কোন ঐতিহাসিক শত চেষ্টাতেও তাহা পারিতেন না।
.
অতঃপর এই ‘কবিয়াল’ একটি মেয়েকে ভালবাসিল। পাখী যেমন প্রভাতের আলো—কে ভালবাসে, মরু-পর্যটক যেমন ঝরণা-শীতল শ্যামল পাদপচ্ছায়াকে ভালবাসে, হয়তো বা নির্জ্জনবাসী নিঃসঙ্গ পুরুষ যেমন দৈবাগত অতিথিকে ভালবাসে, এ ভালবাসা তেমনই; ভ্রমর যেমন ফুলকে ভালবাসে, অথবা পতঙ্গ যেমন বহ্নিকে ভালবাসে— তেমন ভালবাসা নয়। মেয়েটির নাম ঠাকুরঝি’, ঐ নামেই সকলে তাহাকে ডাকিত। এই মেয়েটিকেও ‘কবি’র কবি যে তুলিকায় অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহাও ওস্তাদ-শিল্পীর উপযুক্ত, বাংলার পল্লী-যুবতীর চিত্রহিসাবে এ চিত্র অনবদ্য। কিন্তু এ ভালবাসা—এই lyric love—ঐ চরিত্রের পূর্ণবিকাশের উপযোগী নয়; তাহার অদম্য প্রাণ-শক্তিকে, তাহার রক্তের সেই নিপীড়িত উগ্র কামনাকে অগ্নিশুদ্ধ হইতে হইবে, প্রেমেও তাহাকে শক্তি-সাধনা করিতে হইবে; সে-সাধনার প্রতীক মৃদুগন্ধী ভূঁই-শেফালি নয়—উগ্রগন্ধী চাঁপা, রক্তরাঙা জবা। তাহার প্রেম পরস্পরের পিপাসাতৃপ্তির প্রেম নয়—সকল পিপাসা জয় করার প্রেম। তাই সে ঠাকুরঝির প্রতি একটি অতিমধুর প্রীতির ব্যথায় উন্মনা হইয়া উঠিলেও তাহার কল্যাণকামনা করিয়া সে তাহাকে ফিরাইয়া দিল। সে বুঝিল, এ প্রেমের পরিণাম কি; সরল হৃদয়া অবোধ নারীর এই আত্ম-নিবেদন যতই অকপট হউক, তাহার শক্তি কতটুকু? অতিশয় সরল অকপট হইলেও তাহা দুর্ব্বল, তাহা জীবনের সঙ্গে বেশিদূর যুঝিতে পারে না, সে আগুন শীঘ্রই এক মুঠা ছাই হইয়া যায়। আবার, যাহা রিপুমাত্র, তাহা ব্যাধির মতই জীর্ণ ও জর্জরিত করে, একদিন আরোগ্য হইয়াও যায়! অতএব, ঐরূপ প্রেমের তুলনায় ধর্মই বড়; ঠাকুরঝির পক্ষে ঐরূপ প্রেমের পরিবর্তে গৃহধর্ম্মচারিণীর ব্রতই কল্যাণকর। ঠাকুরঝিকে সে তাহার নিজের প্রেম-শক্তির বলেই ত্যাগ করিল; সেই ত্যাগের যে দুঃখ তাহাও করুণার সন্ধ্যাতারার মত তাহার হৃদয়াকাশে রশ্মি বিকিরণ করিতে লাগিল। ইহাই তাহার প্রথম পরীক্ষা। তাহার দেহবাসী সেই দেবতার মর্যাদা রক্ষার জন্য, সে অতঃপর সকল বন্ধন ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া পড়িল; ইহার পর সে যে-অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ না দিয়া পারিল না, তাহাতেই এই কাহিনী জটিলতর ও গভীরতর হইতে পারিয়াছে—ছোট গল্পের নদীটি উপন্যাসের সাগরাভিমুখিনী হইয়াছে।
নিতাই রীতিমত কবিয়াল হইল। সে একটি ঝুমুরের দলের প্রধান কবির পদে প্রতিষ্ঠিত হইল। যে মেয়েগুলিকে লইয়া এই দল, তাহারা রূপোপজীবিনী—অতিশয় নিম্নশ্রেণীর বারাঙ্গনা। ইহাদের ঐ সমাজই কবির সাধন-ক্ষেত্র হইল, উহাদেরই একজন হইল তাহার সেই সাধনার উত্তরসাধিকা। এই যে সমাজ এ কাহিনীর প্রধান পটভূমিকা হইয়াছে, ইহার চিত্র-রচনায় তারাশঙ্করের কবিপ্রতিভা— তাঁহার সেই বাস্তবভেদী তান্ত্রিক রস-দৃষ্টি—সেই সীমায় পৌঁছিয়াছে, যাহার পরে কোন কবিদৃষ্টি পৌঁছিতে পারে না। এখানে নারীজীবন ট্র্যাজেডির নায়িকা হইয়াছে এক ঘৃণ্যতমা স্বৈরিণী। একমাত্র রুশ—সাহিত্যিক ডয়েস্কি ছাড়া আর কোন পাশ্চাত্ত্য ঔপন্যাসিকের বাস্তবনিষ্ঠ কল্পনা নারীদেহের এতখানি দুর্গতি ও সেই সঙ্গে নারী-আত্মার এতখানি শক্তি এমন গভীর বর্ণে চিত্রিত করিতে পারেন নাই। কিন্তু এ কাহিনীর কবিশক্তি এই কারণে আরও বিস্ময়কর যে, এখানে নারী-জীবনের সেই এক ট্র্যাজেডি, একই মাত্রায় ও প্রায় একই আকারে সংঘটিত হইয়াছে— অতি সাধারণ প্রতিবেশে, অতি সামান্য আয়োজন—উপকরণে; ইহা আভিজাত্যের সকল আভরণবর্জিত। কিন্তু তাহাতেই, ক্রুশবিদ্ধ মহাপুরুষের মত, ঐ ক্রুশবিদ্ধ নারীর অন্তরাত্মার—তাহার নিঃসঙ্গ নৈরাশ্য-যাতনার—মর্ম্মভেদী রব আরও সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই চরিত্রটি গড়িয়া তুলিতে লেখক যে নাটকীয় কলাকৌশল প্রয়োগ করিয়াছেন তাহা কোন শ্রেষ্ঠ নাট্যশিল্পীর তুলনায় ন্যূন নহে।
মেয়েটির নাম—বসন বা বসন্ত। প্রথম হইতেই তাহার দেহে ও মনে একটা জ্বরতাপ, এবং তাহারই কারণে তাহার রূপেও একটা রক্তিমতা ফুটিয়া উঠিয়াছে, দেখা যায়। সে প্রেমকে—নরনারীর সহজ ধর্ম্মকে—হত্যা করিয়াছে, করিতে বাধ্য হইয়াছে; তার পর সে আর কিছুকে, কাহাকে বিশ্বাস করে না, শ্রদ্ধা করে না। তাহার নারীজীবন সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছে—সে কথা সে কিছুতেই ভুলিবে না; সে নিজের প্রতিও যেমন নিষ্ঠুর, মনুষ্যজীবনের প্রতিও তেমনই উদাসীন। কিন্তু এ চরিত্রে আহত হৃদয়ের একটা মর্মান্তিক আক্রোশ—লাঞ্ছিত নারী-মর্য্যাদার একটা দুৰ্জ্জয় অভিমান আছে, তাহাই তাহাকে অন্তরের অন্তরে এমন নিঃসঙ্গ করিয়া তুলিয়াছে। সে বাহিরে একটুও আত্মপ্রকাশ করে না; বরং যাহাতে কেহ তাহার অন্তরের পরিচয় না পায়, তজ্জন্য সে এমন ব্যবহার করে যে, সে যেন একটা ঘূর্ণিত—বারাঙ্গনা ভিন্ন আর কিছুই নয়। আত্মবিস্মৃতির জন্য সে দেহের লালসাকেও জীয়াইয়া রাখে। এই অন্তর-রুদ্ধ, আত্ম-স্তব্ধ নারীকে লেখক যে কৌশলে, চকিত ইঙ্গিত ও ঘটনার অতর্কিত বিস্ফুরণে, আমাদের চিত্তগোচর করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার নাটকীয় রস-দৃষ্টির পূর্ণ পরিচয় আছে। এই নারীর ঐ জীবনের পরিণামে, তাহার অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার নিদারুণ বেদনা তিনি যে ঘটনায় ও যে দৃশ্যে নাট্টীকৃত করিয়াছেন, তাহাও শ্রেষ্ঠ কবি-শিল্পীর উপযুক্ত। ঐ নারী যে-প্রেমকে হৃদয় হইতে চিরতরে নির্বাসিত করিয়াছিল, যে অমৃতের স্বাদ সে জীবনে কখনো পায় নাই, তাহাই যখন ধরা দিয়া তাহার প্রাণকে পিপাসার্ত করিয়াছে, তখনই,—যে—মৃত্যুকে সে এতদিন নির্ভয়ে তাহার দেহে বাসা বাঁধিতে দিয়াছিল, সেই মৃত্যু আর তর সহিল না, করাল মূর্ত্তিতে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই অন্তিম কালে, এক দিকে প্রেম, অপর দিকে মৃত্যু—এই দুইয়ের মধ্যে পড়িয়া হতভাগিনীর সেই আর্ত্ত-চীৎকার—এবং মৃত্যু অপেক্ষা প্রেমই অসহ্য হইয়া উঠার যে অনিবাৰ্য্য চেতনা—তাহাতে জীবনের বাস্তবই চিরন্তন কাব্য হইয়া উঠিয়াছে; লেখকের দৃষ্টি যে কিরূপ অভ্রান্ত, এই কাহিনী-নাটকের ঐ দৃশ্যে তাহারই কঠিন পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে।
আরও বিস্তারিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইব না, যদিও হইতে পারিলে ভাল হইত, কারণ এই ক্ষুদ্র উপন্যাসখানির প্রতি অঙ্গ কবিকল্পনার পূর্ণ-রসদৃষ্টিতে সমুজ্জ্বল। কেবল একটি চরিত্র সম্বন্ধে কিছু বলিব, এ চরিত্র আমাদের সমালোচনা-বুদ্ধিকেও স্তম্ভিত করে—সে ঐ ঝুমুরের দলের কর্ত্রী, তাহার নাম ‘মাসী’। এই ‘মাসী’টির জীবনে মানবভাগ্য—বিধাতার যে ক্রূর পরিহাস প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে তাহার মত দুর্জ্ঞেয়-ভীষণ আর কিছু কল্পনা করাও যায় না। সে তাহার হৃদয়কে শ্মশান করিয়া, সেই শ্মশানে, তাহারই মত কয়েকটি নারীর আত্ম-হত দেহে শবাসন রচনা করিয়া শবসাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে; সকল হৃদয়াবেগ রুদ্ধ করিয়া-স্নেহ-দয়াকে দূর না করিয়া, দাসত্বে নিযুক্ত করিয়াছে। সংসারের যে দিকটা তাহার ভাগে পড়িয়াছে সে দিকটার দেনা-পাওনা সে এমন পাকা করিয়া লইয়াছে যে, কোন তন্ত্রসিদ্ধা ভৈরবীও তাহার মত নিশ্চিন্ত নির্ব্বিকার নহে। কিন্তু সেই নির্ম্মমতারও কোন্ অতল তলে তাহার দুই চক্ষের অশ্রুধারা জমাট হইয়া আছে—সে অশ্রু গলিয়া উপরের দিকে প্রবাহিত হয় না কেন—বসনের চিতা সাজাইবার কালে, কথায় ও কাজে, সে তাহার একটা চকিত আভাসমাত্র দিয়াছে। এ চরিত্র যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন, তাঁহার শুধুই দৃষ্টিতে নয়— দেহ-চেতনারও মূলে-বাংলার সেই তান্ত্রিক ভাব—সংস্কার অন্তর্গঢ় হইয়া আছে। পৃথিবীর আর কোন সাহিত্যে ইহার সদৃশ চরিত্র মিলিতে পারে—কিন্তু তাহাতে মানব-জীবনেরই জবানীতে সৃষ্টির গভীরতম রহস্যের এমন ইঙ্গিত মিলিবে না, সেই দুয়ে শক্তির নিদারুণ লীলা এমন ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে ধরা দিবে না।
কথাবস্তুর পরিচয় এই পর্য্যন্ত। তাহার আয়োজন-উপকরণের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়াছি; জীবনকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখা হইয়াছে—এবং সে দৃষ্টি কেমন সহজ অথচ কত গভীর এবং সত্য, তাহার বিস্তারিত আলোচনাও করিয়াছি। এই জীবন নিখিল—মানবজীবনের মানবতায় সমুজ্জ্বল হইলেও, তাহা যে একটি বিশেষ জাতির বিশিষ্ট সংস্কৃতির রঙ্গে রঙ্গীন, সে কথাও বলিয়াছি; কাব্যখানির রচনায়, কবিকল্পনা বা কবিদৃষ্টির অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয়ও কিছু কিছু দিয়াছি। এখন সৰ্ব্বশেষে, এ কাব্যের বাণী-রূপ বা ভাষার কিছু পরিচয় দিলেই আমার কর্ত্তব্য শেষ হয়। কারণ, একটা কথা কখনো বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে-ভাব নয়, অর্থ নয়, তত্ত্ব নয়, এমন কি ঘটনা বা কথাবস্তুও নয়—সেই ভাবনা-কল্পনা তখনই কাব্য হইয়া উঠে, যখন তাহা একটি বাণী-দেহ ধারণ করে; সেই দেহের অন্তরালে, বাণীর অগোচরে যাহা থাকে তাহার কোন মূল্যই নাই, যতক্ষণ না একটা সুঠাম, সুপরিচ্ছন্ন, সুসম্বদ্ধ বাণীমূর্তিতে তাহা প্রকাশ পায়। সেই প্রকাশের প্রেরণা যদি সুনিশ্চিত বা সত্যকার প্রেরণা হয়, তবে প্রথম হইতেই রচনার ভাষা সেই ছাঁচে ঢালাই হইতে থাকে, প্রতি শব্দ প্রতি বর্ণ সেই ভাবের ধ্বনি মূর্ত্তিটিকে সাকার করিয়া তোলে। ভাষা বলিতে শব্দযোজনারীতিই নয়—শব্দরস-প্রবাহ বুঝিতে হইবে। এই প্রবাহ যতক্ষণ ঠিক আছে, ততক্ষণ রচনার অন্য লক্ষণগুলির ভাবনা করিতে হয় না, তাহারা আপনা-আপনি রচনায় আবির্ভূত হইয়া থাকে। আমি সেই ষ্টাইলের কথা বলিতেছি। তারাশঙ্করের এ গল্পটিতে রচনার সেই গুণ যেরূপ লক্ষণীয় হইয়াছে, আমার মনে হয়, তাঁহার আর কোন উপন্যাসে তেমনটি হয় নাই। চরিত্রগুলির কথোপকথনের ভাষাও যেমন, লেখকের বিবৃতি বর্ণনার ভাষাও তেমনই, একটি অখণ্ড ভাবমণ্ডল সৃষ্টি করিয়াছে; একটিতে ঐ মূৰ্ত্তিগুলি গড়িয়া উঠিয়াছে, অপরটিতে সেই মূর্ত্তিরই উপযোগী অধিষ্ঠানভূমি প্রস্তুত হইয়াছে— যাহাতে ছায়া-আলোকের স্বচ্ছন্দ সম্পাত আমাদের দৃষ্টিকে সাহায্য করে। উপন্যাসখানি পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেই বুঝিতে পারি, আমরা একটা নূতন ভাবমণ্ডলে প্রবেশ করিতেছি; সেই ভাবমণ্ডল সৃষ্টি করিয়াছে কবিয়াল নিতাইয়ের ঐ গানগুলি; সেই গানের অন্তর্নিহিত সুরই যেন সর্ব্বত্র অন্তঃশীলা হইয়া বহিতেছে। নিতাই কবিয়ালের প্রাণে প্রেমের সঙ্গে সঙ্গেই যে কাব্য-প্রেরণার সঞ্চার হইয়াছে এই দুইপংক্তিই তাহার নিশ্চিত প্রমাণ—
“কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে।
কালোকেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে।”
—এ যেন আদি কবির কণ্ঠোচ্চারিত সেই প্রথম শ্লোক, যাহার ছন্দে ও সুরে সমগ্র রামায়ণ গানের আকারে ধরা দিয়াছিল। তারাশঙ্করও যেন ঐ দুইটি পংক্তির মন্ত্রবলে, নিতাই-কবিয়ালের দেহটার ভিতরে প্রবেশ করিয়াছেন, এবং তাহারই সাহায্যে সমগ্র কাব্যখানিকে একমুহূর্ত্তে দৃষ্টিগত করিয়াছেন—তাঁহাকে আর ভাবিতে হয় নাই, ঐ একটি রসগ্রন্থি হইতে পুরা-কাহিনীটি আপনিই আপনাকে বুনিয়া তুলিয়াছে। এ কাব্যের ভাষা যেখানে যেমন হৌক—ঐ এক সুরের ভাষা! ভাষার সেই মূর্ত্তি খণ্ড খণ্ড ভাবে দেখানো যাইবে না, কেবল সেই ভাবমণ্ডলটির আভাস দিবার জন্য, লেখকের জবানীতে, ইহার কিছু পরিচয় করাইব।-—
“ঠিক এই সময়ে উপস্থিত হইয়াছিল আর এক জন। পনের-ষোল বছরের একটি কিশোরী মেয়ে। মেয়েটির রং কালো, কিন্তু দীঘল দেহ-ভঙ্গিতে ভুঁইচাঁপার সবুজ সরল ডাঁটার মত একটি অপরূপ শ্রী। মেয়েটির মাথায় কাপড়ের বিড়ার উপর তকতকে মাজা একটি বড় ঘটী, হাতে ছোট গেলাস; পরনে দেশী তাঁতের মোটা সুতার খাটো কাপড়।….সে এই বর্ধিষ্ণু গ্রামখানিতে প্রত্যহ দুধের যোগান দিতে আসে।….. মেয়েটির সরল ভীরু দৃষ্টিতে বিস্ময় যেন কালো জলের স্বচ্ছতার মত সহজাত।…. সবিস্ময়ে কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখিয়া অকস্মাৎ মেয়েটি হাসিতে আরম্ভ করিয়া দিল—অসঙ্কোচে খিল—খিল হাসি।” [পূঃ ১৭]
* * * *
“মেয়ে পুরুষের একটি দল আসিতেছে। মেয়েদের বেশভূষা বিচিত্র, পুরুষগুলির চেহারাও বিশিষ্ট একটা ছাপমারা চেহারা। এ ছাপ নিতাই চেনে।
— চা দাও ভাই, মরে গেলাম মাইরি!’ কথাটা যে বলিল সে ছিল দলের পিছনে, দলটি দাঁড়াইতেই সে আসিয়া সর্ব্বাগ্রে দাঁড়াইল। একটি দীর্ঘ কৃশতনু গৌরাঙ্গী মেয়ে। অদ্ভুত দুইটি চোখ। বড় বড় চোখ দুইটার সাদা ক্ষেতে যেন ছুরির ধার—সেই শাণিত দীপ্তির মধ্যে কালো তারা-দুইটা কৌতূকে অহরহ চঞ্চল। সাদা আগুনের শিখার মধ্যে নাচিয়া ফিরিতেছে যেন দুইটা কালো পতঙ্গ—মরণজয়ী কালো ভ্রমর দুইটা!
“….মেয়েটা ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিয়া উঠিল—
‘এই তুমারা ওস্তাদ নাকি? অ-মা-গ!’ বলিয়াই সে খিল-খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; সে হাসির আবেগে তাহার দীর্ঘ কৃশতনু থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। মেয়েটা শুধু মুখ ভরিয়া হাসে না, সর্বাঙ্গ ভরিয়া হাসে। আর সে হাসির কি ধার! মানুষের মনের মনকে কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ধূলায় লুটাইয়া দেয়।” [পঃ ৫৮]
* * * *
“রাত্রির শেষ প্রহর অদ্ভুত কাল। …. ধীর-সঞ্চারিত নৈঃশব্দের মধ্য দিয়া একটা হিম—রহস্য সমস্ত সৃষ্টিকে আছন্ন করিয়া ফেলে। …. মাটির বুকের মধ্যে, গাছে-পাতায় থাকিয়া যে সংখ্যক কোটী কীটপতঙ্গ অবিরাম ধ্বনি তুলিয়া থাকে, তাহারা পর্যন্ত অভিভূত হইয়া পড়ে, আচ্ছন্নের মত।…. আকাশে জ্যোতির্লোক হয় পান্ডুর, সে লোকেও যেন হিমতমসার স্পর্শ লাগে। কেবল অগ্নিকোণে ধক্থক করিয়া জ্বলে শুকতারা—অন্ধ রাত্রি—দেবতার ললাট চক্ষুর মত। সকল ইন্দ্রিয় আচ্ছন্নকরা রহস্যময় এই গভীর শীতলতার স্পর্শে নিতাই শতচেষ্টা সত্ত্বেও জাগিয়া থাকিতে পারে নাই, আচ্ছন্নের মত দেওয়ালের গায়ে কখন ঢলিয়া পড়িয়াছিল।” [পঃ ১৩৯]
* * * *
“চিতার উপর শবদেহ চাপাইবার পূর্বে প্রৌঢ়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—’আঃ বসন, আমার সোনার বসন!’ দুইফোঁটা জলও তাহার চোখ হইতে ঝরিয়া পড়িল।…. “নিতাই দেহটা চিতার উপর চাপাইবার উদ্যোগ করিল, প্রৌঢ়া বলিল, দাঁড়াও, বাবা, দাঁড়াও।’ সে আসিয়া বসন্তের আভরণ খুলিতে বলিল ….. কিই বা আভরণ! কানে দুইটা ফুল, নাকে একটা নাকছাবি, হাতে দুইগাছা শাঁখাবাঁধা, তাহার উপর বসন্তের ছিল একছড়া হালকা বিছা হার।
“নিতাই হাসিল। বলিল, ‘খুলে নিচ্ছ, মাসী? ‘
মাসী তাহার মুখের দিকে একবার চাহিল, তারপর আপনার কাজে মন দিল। গহনাগুলি আঁচলে বাঁধিয়া সে বলিল—’বুকের নিধি চলে যায় বাবা, মনে হয়, দুনিয়া আঁধার, খাদ্যি বিষ, আর কিছু ছোঁব না—কখন কিছু খাব না। আবার একবেলা যেতে না যেতে চোখ মেলে চাইতে হয়, উঠতে হয়; পোড়া পেটে দুটো দিতেও হয়…..বাঁচতেও হবে, খেতে পরতেও হবে, এগুলো চিতেয় দিয়ে ফল কি বল?’ বক্তব্য শেষ করিয়া সে বলিল, ‘এগুলি আমার পাওনা, বাবা।’….প্রৌঢ়া আবার বলিল, কপালে হাত দিয়া আক্ষেপ করিয়াই বলিল—’আমার অদেষ্ট দেখ বাবা! আমিই হ’লাম ওদের ওয়ারিশান।’ প্রৌঢ়ার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।” [পূঃ ১৪১-৪২]
* * * *
“বিশ্বনাথের মন্দির প্রাঙ্গণে সে সন্ধ্যায় আসিয়া বসিল। ডোমের ছেলে সে, মন্দির—প্রবেশের অধিকার নাই—সেজন্য তার আক্ষেপও নাই। প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে বসিয়া মন্দির-শীর্ষের ধ্বজার দিকে চাহিয়াই সে ধন্য হইয়া গেল। তার পর সে গান রচনা আরম্ভ করিল—
ভিখারী হয়েছে রাজা দেখরে নয়ন মেলে।
সাতমহলা সোনার দেউল গড়েছে সে শ্মশান ফেলে।
গুনগুন করিয়া সুর ভাঁজিয়া গানখানি রচনা শেষ করিয়া সে গলা চড়াইয়া গান আরম্ভ করিল। ….
‘এখানে ওখানে আরও কত জনে গান গাহিতেছে। হিন্দী গান। সেও উঠিয়া আসিয়া একটা জনতার পাশে দাঁড়াইল। সুর তাহার মন্দ লাগিল না; মন্দ কেন, ভালই লাগিল। কিন্তু গান সে বুঝিতে পারিল না, ভালও লাগিল না। তাহার মনে গুঞ্জরণ করিয়া উঠিল রামপ্রাসাদের পদ—
আমার কাশীতে যেতে মন কই সরে।
সৰ্ব্বনাশী এলোকেশী—সে যে সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।
আহা রে! ইহার চেয়ে কি ভাল গান হয়? তাহার সমস্ত অন্তরটা একটা গভীর বেদনার উদাসীনতায় ভরিয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িল গ্রামের মা-চণ্ডীকে। রামপ্রসাদের এলোকেশীর মত মা-চণ্ডী আজ এই কাশীতে আসিয়া তাহার আশেপাশে ফিরিতেছে।” [পূঃ ১৫৭-৫৮]
****
যেখান সেখান হইতে এই যে কয়েক টুকরা উদ্ধৃত করিলাম, ইহাতে কাহিনীর কোন পরিচয় পাওয়া যাইবে না, কেবল ভাবকল্পনার ভঙ্গি এবং তাহার ভাষা কেমন, তাহারই একটা ইঙ্গিত মিলিবে। নাটকীয় চরিত্র-চিত্রণ, বা ঘটনাবস্তুকে পাত্র-পাত্রীর হৃদয়ের রঙে রঞ্জিত করিবার জন্য, লেখক যে মুখের ভাষা আশ্রয় করিয়াছেন, তাহাও ঐ কবি-গানের যেমন সমগোত্রীয়, তেমনই তাঁহার সাহিত্যিক ভাষার সহিত কোথাও তাহার তাল কাটে নাই। ইহার কারণ দুইটি, প্রথম, লেখকের নিজের ভাষাও ঐ ভাবমণ্ডলের রসেই অভিষিক্ত; দ্বিতীয়, বাংলা সাহিত্যিক ভাষার যে রস তাহাও ঐ সমাজের ঐ ভাষা হইতেই সঞ্চারিত হইয়াছে। সে ভাষাতেও উচ্চ ও নিম্ন—সমাজ-ভেদে যে স্তর আছে, তাহা কৃত্রিম; ঐ ভাষার রস একই মাতৃভাষার রস; বরং যাহাকে আমরা খাঁটি কথ্য-বুলি বলি, অর্থাৎ যাহা ‘সাধু’ বা মার্জ্জিত নয়, তাহাই আরও রস-ঘন। ঐ মাতৃভাষাই আধুনিক পিতৃভাষাকে প্রাণের দীপ্তি দান করিয়াছে। বৈষ্ণব পদাবলীতেও যেমন, কবিগান, পাঁচালী, রামপ্রসাদের গানেও তেমনই, বাঙালীর অন্তর্জীবনের সেই কালচার ভাষাকে যে ছাঁচে গড়িয়া দিয়াছে, বঙ্কিমচন্দ্র তাহাকেই নব্যসাহিত্যের ভাষায় ধরিয়া বাঙালীর রস জীবন উদ্ধার এবং উন্নত করিয়াছিলেন। তারাশঙ্করও সেই রসের রসায়ন-চাতুর্য্যে, এবং অব্যভিচারী কাব্য কল্পনার অমোঘ নিয়মে—এই কাহিনীর ভাষায়, রূপের বাস্তবকেও যেমন, রূপের অনুষঙ্গী ভাবকেও তেমনই এক বাণীচ্ছন্দে মিলাইতে পারিয়াছেন। ইহার প্রমাণ এই কাহিনীর ভাষায় সমগ্রভাবে আছে—বিচ্ছিন্ন পংক্তি-সমষ্টিতে তাহা পাওয়া যাইবে না। তাই আমি তেমন ভাষার দৃষ্টান্ত বেশি উদ্ধৃত করিলাম না। এই প্রসঙ্গে আরও একটি তত্ত্ব স্মরণীয়। ঐ যে প্রাদেশিক বুলি (dialect), উহাও যে-সংস্কৃতির ফল, সে সংস্কৃতি যেমন প্রাচীন তেমনই গভীর—বাঙালীর ভাব-জীবনের একটি বিশিষ্ট রূপ উহাতেই প্রতিফলিত হইয়াছে—প্রাদেশিক হইলেও ঐ প্রাদেশিকতার একটি বিশেষ মূল্য আছে। ভাষার ঐ ছাঁচটিতেই এ পর্যন্ত বাংলার প্রাচীন ও আধুনিক শ্রেষ্ঠ রস-সাহিত্য রচিত হইয়াছে। সেকালের শ্রেষ্ঠ নাগরিক সভা-কবি ভারতচন্দ্রও যেমন, একালের শেষ ও শ্রেষ্ঠ অভিজাত কবি রবীন্দ্রনাথও তেমনই, ঐ ভাষাকেই আপন আপন ভঙ্গিতে ভাঙ্গাইয়া, বাংলাসাহিত্যে আর্ট বা রসের চরমোৎকর্ষ সম্পাদন করিয়াছেন; একজনের বৈদগ্ধ্য এবং অপর জনের পরম-সুন্দর-পিপাসা ভাষায় ঐ কুলধর্ম্মকেই আশ্রয় করিয়াছে, না করিয়া পারে নাই। অতি আধুনিক-বাংলাসাহিত্য যে সেই প্রাণ-রস-বর্জ্জিত হইয়া উঠিতেছে—অতিশয় কুসত কৃত্রিম রূপ ধারণ করিতেছে, তাহার একমাত্র কারণ, ভাষার সেই রস-সূত্র ছিন্ন হইয়াছে, বাঙালীর মুখের বুলিও বিজাতীয় হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু এই মুখের বুলিই সাহিত্যের ভাষা নয়। ইদানীং সাধুরীতি ও কথ্যরীতি নামে ভাষার যে দুই রীতির চলন হইয়াছে, তাহাতে এই বুলির কোন তারতম্য নাই—বরং ঐ কথ্যরীতিই আরও স্বেচ্ছাচারী; অতএব উহা রীতিভেদ মাত্র। রচনাবিশেষে, ভাবকল্পনার প্রকৃতিভেদে, ঐ দুই রীতির পৃথক উপযোগিতাও আছে। তারাশঙ্করের আধুনিক রচনাগুলিতে ভাষার ঐ কথ্যরীতির প্রতি যে পক্ষপাত দৃষ্ট হয় তাহাও অকারণ নহে, আমি পূর্ব্বে তাঁহার কবি-দৃষ্টির যে ভাবান্তরের কথা উল্লেখ করিয়াছি এ প্রসঙ্গে তাহাই স্মরণীয়
অপ্রাসঙ্গিক হইলেও, এইখানেই আমি একটা কথা বলিবার সুযোগ লইব। যাঁহারা বলেন, সাহিত্যের ভাষায় জাতিভেদ নাই, অর্থাৎ যে-কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করিতে আপত্তি নাই—তাঁহারা একটা অর্দ্ধ-সত্যকে সত্যের গৌরব দান করেন। ভাষাই জাতিত্বের নিদান, এবং সে “জাতি” সমাজ, রাষ্ট্র এমন কি ধর্ম্মঘটিত জাতি নয়—একেবারে মানুষের অন্তরস্থ ভাব-পুরুষের ‘জাতি’—ভাষা সেই জাতিত্বের অভিব্যক্তি। ঐ ‘জাতি’র প্রতিষ্ঠায় ‘প্রকৃতি’ ও ‘পুরুষের সমান সহযোগিতা আছে। ইংরেজের সাম্রাজ্য লোপ পাইলেও ইংরেজ মরিবে না; কিন্তু তাহার ভাষার স্বাতন্ত্র্য অর্থাৎ স্বধৰ্ম্ম যদি লোপ পায়, তবে ইংরেজ-নামীয় মানুষটা লোপ পাইবে—মহামানবের একাকারে মিশিয়া যাঁইবে। সেই ‘মহামানব’ বস্তুটি কি, তাহার চেহারা কেমন, ভাষা কেমন, তাহা এখনও পুঁথিগত হইয়াই আছে। মৃত্যুই যদি মোক্ষ বা নির্ব্বাণলাভ হয়, তাহা হইলে ঐ ‘মহামানবে’ লীন হওয়া সেইরূপ উচ্চ অবস্থা বটে। যাহাদের সেই মোক্ষলাভ আসন্ন হইয়াছে, তাহারা ঐ মহামানবের ‘তারকব্রহ্ম নাম’ জপিয়া থাকে; তদ্দর্শনে আর সকল জাতির বড় জোর একটু শ্মশান-বৈরাগ্য উপস্থিত হয়, তাই তাহারাও মাঝে মাঝে ‘হরিধ্বনি’ করে। যাক, উপস্থিত সে কথায় কাজ নাই। আমি বলিতেছিলাম, ঐরূপ উক্তি একটা অর্দ্ধসত্য মাত্র। সাহিত্যের ভাষায় বিজাতীয় শব্দের ব্যবহারে ছুঁৎমার্গ নিন্দনীয়; তাহার অর্থ এই নয় যে, এক ভাষায় অপর কোন ভাষার শব্দরাশি অবাধে প্রবেশ করিতে না দেওয়া অন্যায়। ভাষার নিজস্ব প্রয়োজনে, তাহার অভাব পূরণার্থে—অর্থাৎ সৰ্ব্বাঙ্গীণ পুষ্টিসাধনে—নূতন ভাব ও নূতন বস্তুবাচক শব্দ বিভাষা হইতেও আহরণ করিতে হইবে বটে, কিন্তু সেইরূপ আহরণের একটা মাত্রা বা সীমা আছে; অনাবশ্যক আহরণ ত’ নহেই—মূল ভাষার শব্দের পরিবর্তে অপকৃষ্ট বিজাতীয় শব্দ সর্ব্বদা বর্জ্জনীয়। তারপর, সেইরূপ শব্দের দ্বারা মূলভাষার প্রকৃতি পীড়িত না হয়, ইহাও দেখিতে হইবে-আর কিছু না হোক্, ধ্বনিপ্রকৃতি যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। তাহা না হইলে, সেই সকল শব্দ কালে আপনা হইতেই বহিষ্কৃত হইয়া যায়। বিভাষার নাম শব্দগুলি অগত্যা সহ্য করিতেই হয়—কিন্তু ভাবার্থমূলক শব্দ সম্বন্ধে সূক্ষ্ম ভাষা—রসবোধের প্রয়োজন আছে; শক্তিমান শিল্পী ভিন্ন আর কেহ সেইরূপ শব্দ স্ব-ভাষায় আত্মসাৎ করিতে পারে না। যাঁহার সেই সহজ-রসজ্ঞান আছে তিনিই বুঝিতে পারেন, কোন্ শব্দটি কেমন আকারে ও কেমন ভঙ্গিতে গ্রাহ্য হইতে পারে। প্রত্যেক ভাষার মত, বাংলা ভাষারও একটি বিশেষ প্রকৃতি আছে; একটা অপেক্ষাকৃত নিকট ভাষার যেমন, হিন্দীর—সহিত তুলনায় তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যাইবে। মূল একই সংস্কৃত হইতে যে সকল শব্দ উভয় ভাষায় প্রবর্ত্তিত হইয়াছে (হিন্দীর ঐরূপ শব্দাভিধান বাংলার তুলনায় অতিশয় অপর্যাপ্ত এবং অপরিপুষ্ট, তার কারণ, ঐ ভাষা এখনও উৎকৃষ্ট সাহিত্যের ভাষা হইতে পারে নাই), সেইগুলিরও যথেচ্ছ আদানপ্রদান চলে না। ইহার বহু দৃষ্টান্ত আছে, একটা সাক্ষাৎ দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘সন্মতি দে ভগবান্’–ভারতের নবধর্ম্মের এই ‘কমা’-গীতি হইতে ঐ ‘সন্মতি’ শব্দটি লওয়া যাইতে পারে। ঐ শব্দটি আদৌ বাংলা নয়; ‘সৎ+মতি’–সংস্কৃতও বটে, অর্থও খুব স্পষ্ট এবং পরিষ্কার, উহার ভাবও নূতন নহে; তথাপি বাংলাভাষায়—সংস্কৃতের দারুণ দাপটের দিনেও—এমন শব্দ তৈয়ারী হয় নাই। আমরা ‘সুমতি’, ‘সুবুদ্ধি’, এমন কি ‘সদ্বুদ্ধি’ ও ‘শুভবুদ্ধি’-ও বলি, কিন্তু ‘সন্মতি’ বলি না। কেন বলি না? আমাদের নিজস্ব ভাষা-রস-বোধে (instinct ) বাধে বলিয়াই বলি না। এরূপ শব্দ-নিৰ্ম্মাণ নিশ্চয়ই দুরূহ নয়, অভিধান-ব্যাকরণের পাণ্ডিত্য আবশ্যক হয় না; আবার, বাঙালী বহুকাল সংস্কৃত চর্চ্চা করিতেছে, বাংলাভাষা সংস্কৃতের শব্দরাশি যে পরিমাণ আত্মসাৎ করিয়াছে, এমন আর কোন ভারতীয় ভাষা করে নাই, তথাপি আমরা কখনো ‘সন্মতি’ শব্দ ব্যবহার করি নাই, শুনিলেই মনে হইবে, উহা অ-বাংলা; যে বাঙালীর কিছুমাত্র নিজভাষার ‘সংস্কার’ আছে, তাহারই ঐ শব্দটি কেমন-যেন অদ্ভুত ঠেকিবে। ইহা একটা ‘প্রেজুডিস’ নয়; ইহাই জাতীয় ভাব—দেহী সেই অন্তর-পুরুষের প্রতিবাদ। খাঁটি বিদেশী-শব্দ হইলে এমন বোধ হইত না, কারণ, তাহা বাংলার এমন সদৃশ নয়; ঐ যে সদৃশ হইয়াও বিসদৃশ, ইহাই ঐরূপ অ-রুচির কারণ। আমি জানি, ঐ গানের ঐ শব্দটির সম্বন্ধে আমার এই মন্তব্য নবধর্ম্ম—বিলাসী বাঙালীর ভাল লাগিবে না; কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, আমি এখানে ধৰ্ম্মমন্ত্র বা ভক্তিরসের আলোচনা করিতেছি না,—সাহিত্য ও ভাষার কথাই বলিতেছি। যাঁহারা খৃষ্টান বা মুসলমান তাঁহারাও তাঁহাদের মাতৃভাষায় উৎকট বিদেশী শব্দ ব্যবহার করিয়া ধর্ম্মভাবের গভীরতা অনুভব করিয়া থাকেন—সেখানে ভাষার কথাটাই বড় নয়, এবং সেই সকল শব্দের প্রয়োজনীয়তাও অন্যরূপ। তথাপি ইহাও সত্য যে, সেই সব বিদেশী শব্দ বাংলার প্রকৃতি-সহ না হইলে, তাহারা চিরদিন ভাষার বহিরঙ্গেই থাকিয়া যায়।
এইবার ‘কবি’র সমালোচনা শেষ করি। আমি পূর্ব্বে একাধিকবার বলিয়াছি, এ কাহিনীর মূল-সুর গীতি-সুর হইলেও, সেই গীতি-সুরেই বাস্তবের কাহিনীরূপ ধরা দিয়াছে। সেই বাস্তবতা (Realism) কোন তত্ত্ববাদ বা মতবাদের মত, রস-বাদের বিরোধী নয়। সে-বাস্তব মানুষের মনুষ্যত্বের বাস্তব, তাহার মূলে আছে খাঁটি humanity বা মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা,—অর্থাৎ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই ঋষিবাক্যের সাক্ষাৎ উপলব্ধি। এ কাব্যে পঙ্কজের পঙ্কও পবিত্র হইয়া উঠিয়াছে—সেজন্য পঙ্কের পঙ্কত্বকে অস্বীকার করিতে হয় নাই। এ যুগের বাংলা কাব্যে কবির দৃষ্টি সতীর অসতী-অপবাদ মোচন করিয়াছে; তাহাতেও দেহ হইতে আত্মার পৃথক শুচিতা রক্ষা করিয়াই পতিতা নারী সতীশিরোমণি হইতে পারিয়াছে। ঐ শুচিতার সংস্কারই চিরন্তন আধ্যাত্মিক সংস্কার—সে সংস্কার খাঁটি ‘humanity’র বিরোধী। বাঙালীর যে বিশিষ্ট সাধনার কথা বলিয়াছি, তাহার নাম দিতে হইলে, এই humanity-তত্ত্বকেই সহজের তত্ত্ব বলিতে হইবে—উহাও প্রকৃতপন্থী, তান্ত্রিক। সাধারণ ভাষায় আমরা যাহাকে শক্তি ও বৈষ্ণব বলি, কবিয়ালের চরিত্রে সেই দুই ভাবেরই আশ্চর্য্য লুকাচুরি রহিয়াছে, তাহার রক্তে যেন দুই বিপরীত ধারা একসঙ্গে প্রবাহিত হইতেছে। যে পরিপূর্ণ প্রীতির বলে তাহার প্রাণের প্রসার ঘটিয়াছে, সেই প্রীতি অগ্নিশিখার স্পর্শে দগ্ধ হইয়া যায় নাই; তাহার রক্তের উগ্রতা সেই অগ্নির উগ্রতাকেও পরাস্ত করিয়াছে—উহাই তাহার শক্তিসাধনা। কিন্তু তাহার বৈষ্ণব-সাধনাই ঐ শাক্ত-সাধনায় যুক্ত হইয়া এমন সিদ্ধি লাভ করিয়াছে। ইহাও কোন বিশেষ মন্ত্রের সাধনা বা আশ্রমচর্য্যার ফলে হয় নাই। বাঙালীর জাতিগত প্রতিভায় যাহা বহুদিন অঙ্কুরিত হইয়াছে—যাহাকে একদা এক মহা-প্রতিভা আপন ভাবে উদ্বুদ্ধ করিয়া, একটা বিশেষ সাধন-পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল—ইহা সেই আদিম বাঙালী-সংস্কার। এ সাধনা বৈষ্ণব না শাক্ত?—সে প্রশ্নের উত্তর ঐ কবিয়ালের জীবন—সাধনা হইতেই পাওয়া যাইবে, কোন শাস্ত্রের সাক্ষ্য নিষ্প্রয়োজন। উহা একাধারে শক্তি ও বৈষ্ণব—উহাই তান্ত্রিক।
এই উপন্যাসের সম্পর্কে আরও একটি কথা আমার মনে হইয়াছে—আমাদের কথা—সাহিত্যে পুরুষ-চরিত্র তেমন উজ্জ্বল হইয়া উঠে না, এমনই একটা অপবাদ আছে। কিন্তু এই উপন্যাসে সেই ধারণা বিচলিত হয়। আমার মনে হয়, ঐ অপবাদ সম্পূর্ণ সত্য না হইতেও পারে। একালে আমাদের পৌরুষের ধারণাই য়ুরোপীয় আদর্শের দ্বারা একটু বেশিমাত্রায় প্রভাবিত হইয়াছে। একথা সত্য যে, সাধারণ জীবনে, আমাদের সমাজে ও সংসারে, পুরুষের যে-চরিত্র সর্ব্বাপেক্ষা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহা একরূপ অ-পুরুষই বটে। কিন্তু পৌরুষের যে আর একটি আদর্শ আছে তাহা আমাদের কথাকাহিনীতে ফুটিয়া উঠিবার অবকাশ পায় নাই, ইহার একটা কারণ, একটি বিশেষ রসের প্রতি আমাদের পক্ষপাত : দ্বিতীয় কারণ—ঐ পাশ্চাত্ত্য আদর্শের গৌণ প্রভাব। পৌরুষের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন যদি ইহাও হয় যে, সকল অপরাধ সকল পাপকে সে ক্ষমা করিতে পারে; নীলকণ্ঠের মত সকল বিষ কণ্ঠে ধারণ করিয়াও ওষ্ঠে করুণার সুধা—হাস্য কখনো হারায় না; ঝড়কে বক্ষ-কপাট উন্মুক্ত করিয়া দেয়—তাহার পূর্ণবেগে আপনাকে ছাড়িয়া দিয়াও অটল ও অবিচলিত থাকে; সে এমনই একটি জ্ঞান বা বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, তাহা শক্তিরই আরেক রূপ;তবে ঐ নিতাই-কবিয়ালের চেয়ে কাহারও পৌরুষ বড় নয়। সে পৌরুষ একটা পূর্ণতর শক্তির পৌরুষ বলিয়াই তাহা এমন স্তব্ধ; তাহার কোন কীৰ্ত্তি নাই, কোন দুরন্তপনা নাই। আবার, রাজা—মহারাজা, বীর বা রাষ্ট্রনায়ক নয় বলিয়া তাহার পৌরুষ যদি তুচ্ছ হয়, তবে মানুষ বলিয়াই মানুষের কোন মূল্য নাই—’সবার উপরে মানুষ সত্য’, একথাও মিথ্যা।
‘কবি’-উপন্যাসখানির এই যে বিস্তৃত পরিচয় লিপিবদ্ধ করিলাম, তাহার কারণ, তারাশঙ্করের এই রচনাটি তাঁহার শ্রেষ্ঠ রচনা বলিয়া মনে করি কেন, আমার পক্ষ হইতে তাহার একটা কৈফিয়তের প্রয়োজন ছিল। আমি জানি, বাংলার পাঠক-পাঠিকাগণ যেমনই মনে করুন—’বড়-বড়’ সাহিত্যিক, তথা সমালোচকেরা আমার এ কথায় সায় দিবেন না। কিন্তু এই সমালোচনা উপলক্ষ্যে, আমি কেবল ঐ একখানি উপন্যাসেরই আলোচনা করি নাই, বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার একটি ধারা নির্দ্দেশ করাও আমার অভিপ্রায়। বাংলাসাহিত্যও যেমন ‘সাহিত্য’, তেমনই বাঙালীর সাহিত্যও বটে; ইহার মূল্যনির্ণয়ে কেবল আর্টের মাপকাঠি ধরিয়া থাকিলেই চলিবে না, জাতির আত্মার যে অভিব্যক্তি সাহিত্যেও অনিবার্য্য তাহার দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতে হইবে। কারণ, ইহা একটি স্বীকৃত সত্য যে, আর সকল কলাশিল্পের মত, সাহিত্যও —’ expressive of the soul of the country’; যে সমালোচকের সে দৃষ্টি নাই তাঁহার সকল পাণ্ডিত্যই নিষ্ফল; ঐ দুইয়েরই একত্র প্রয়োগের অভাবে বাংলাসাহিত্যের সমালোচনা পঙ্গু হইয়া আছে।