চৈত্র মাসের শেষ। বসন্তের পূর্ণ বিকাশ এবং গ্রীস্মের সমাগমে শিবাজী ক্রমশঃ পরাস্ত হইয়া নিবিড় কাননে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহার সৈন্যদল ছিন্নভিন্ন হইয়া ঝাড়ে জঙ্গলে এবং পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মালোজী বন্দী হওয়ায় শিবাজী যার-পর-নাই হতাশ এবং বিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। রামদাস স্বামী, আবাজী প্রভৃতি তখন সন্ধি করিবার জন্য শিবাজীকে বিশেষভাবে উপদেশ দিতে লাগিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ শিবাজীকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করিয়া সন্ধি করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সন্ধির জন্য পুনঃ পুনঃ আবেদন-নিবেদন এবং প্রার্থনা ও মিনতি চলিতে লাগিল। অবশেষে শিবাজী এক দিন মালেকা আমেনাবানুর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া তাঁহার কৃপাভিখারী হইলেন।
মালেকা আমেনাবানু তখন আফজাল খাঁকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন। পরামর্শ হইল যে, শিবাজী স্বেচ্ছায় আনন্দ-উল্লাসে তারাবাঈকে রাজেচিত আড়ম্বরে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করিবেন। আর আফজাল খাঁ শিবাজীকে তাঁহার অধিকৃত পরগণা এবং কেল্লাগুলির মাত্র এক চর্তুথাংশ ছাড়িয়া দিবেন। শিবাজী বিজাপুর সোলতানের আধিপত্য ধর্মতঃ এক কার্যতঃ স্বীকার করিবেন।
শিবাজী মুসলমানদের যে-সমস্ত মসজিদ ভগ্ন করিয়াছেন, তাহা সমস্তই যথাযথরূপে প্রস্তত করিয়া দিলেন। শিবাজী রণতরী রাখিতে পারিবেন না। এই সমস্ত শর্ত যথারীতি লিখিয়া বিজাপুর দরবারে প্রেরণ করা হইল। বিজাপুর দরবার একেবারেই শিবাজীর উৎসাদনের পপাতী ছিলেন; কিন্তু আফজাল খাঁর অনুরোধে এই সমস্ত শর্ত স্বীকার করিয়া সন্ধি স্থাপনের জন্য অনুমতি প্রদান করিলেন।
আফজাল খাঁর সহিত তারাবাঈয়ের বিবাহ সম্বন্ধে বিজাপুরের সোলতান প্রথমতঃ আপত্তি তুলিলেন। কিন্তু তারাবাঈ-এর করুণ প্রার্থনা এবং গভীর ব্যাকুলতাপূর্ণ পত্র পাইয়া পরে অনুমোদন করিলেন।
অতঃপর ২১শে চৈত্র শুক্রবার উভয় পরে প্রধান প্রধান সামন্তদিগের সম্মুখে যথারীতি সন্ধিপত্র স্বারিত হইল। শিবাজীর প্রার্থনানুযায়ী মালোজীকে আমেনাবানু বিনা নিষ্ক্রয়ে মুক্তি প্রদান করিলেন। মালেকা বলিলেন, “মালোজী আপনি তারাকে বেহুঁস করে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সচেতন এবং সশস্ত্রাবস্থায় আপনাকে বন্দী করেছি। সুতরাং আশা করি, আমাতে কোনও হীনতা দর্শন করবেন না।
মালোজী লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিলেন, “আপনার সাহস যেমন অপরিসীম, দয়াও তেমনি তুলনাহীন! আপনি আমাকে চিরকৃজ্ঞপাশে আবদ্ধ করলেন।” অনন্তর যথাসময়ে বৈশাখী পূর্ণিমাতে বিবাহের দিন নির্ধারিত হইল।
শিবাজী তারাকে লইয়া বাড়ী ফিরিলেন। তারার প্রতি যাহাতে কোনও উৎপড়ীন না হয়, সেজন্য মালেকা শিবাজীকে বিশেষভাবে সাবধান করিয়া দিলেন। তারার প্রতি অন্যায় ব্যবহার হইলে শিবাজীকে যে সকল-হারা হইতে হইবে, তাহা বিশেষরূপে বুঝাইয়া দেওয়া হইল।