বিঠ্ঠপুরে বিঠঠলজীর একটি মন্দির ছিল। এই বিগ্রহের নামানুসারে গ্রামের নাম বিঠ্ঠলপুর হইয়াছিল। বাসন্তী পূর্ণিমার তিথিতে এই বিঠঠলদেবের মন্দিরে কোথা হইতে এক তেজঃপুঞ্জতনু তপ্তাকাঞ্চনকান্তি ললনা-কুল-ললাম ভূতা মহাতেজস্বিনী ভৈরবী আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
প্রভাত হইতে হইতেই ভৈরবীর আগমন-সংবাদ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। দলে দলে নরনারী কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে এই নবীনা ভৈরবীকে দেখিবার জন্য সমবেত হইতে লাগিল। ভৈরবী অনেক পীড়িত ব্যক্তিকে ঔষধ দান করিয়া অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আরোগ্য করিলেন। ভৈরবীকে রূপে-গুণে-জ্ঞানে আকৃষ্ট হইয়া দলে দলে লোক চতুর্দিক হইতে উপস্থিত হইতে লাগিল।
বিঠ্ঠলপুর লোকের হলহলায় সজাগ হইয়া উঠিল। নানাপ্রকার উপহার দ্রব্য, নজর-নেয়াজ এবং মানতের ফল-ফুল, নানাপ্রাকার উপাদেয় ভোজ্য জাত, বস্ত্র এবং মুদ্রায় মন্দির পূর্ণ হইয়া উঠিল। সন্তান লাভ কামনায় নারীদিগের বিপুল জনতা হইতে লাগিল। ভৈরবী এই বিপুল খাদ্যসামগ্রী এবং অর্থরাশি প্রফুল্ল চিত্তে গরীব-দুঃখীদিগকে দান করিতে লাগিলেন।
ভৈরবীর রূপের ছটা, তেজস্বিনী মূর্তি, বিনয়নম্র ব্যবহার, সরল ধর্মোপদেশ এবং রোগ আরোগ্য-শক্তি অবলোকন করিয়া সকলেই বিমুগ্ধ হইতে লাগিল! চতুর্দিকে ভৈরবীর নামে ধন্য ধন্য রব পড়িয়া গেল।
ভৈরবীর প্রশংসায় আকৃষ্ট হইয়া একদিন স্বয়ং তারার মাতামহী অম্বুজা বাঈ তারাকে লইয়া ভৈরবী সন্দর্শনে বিঠ্ঠলজীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন। ভৈরবীর অনিন্দ্যসুন্দর কমনীয় মূর্তি এবং মধুর বাক্যালাপে অম্বুজা বাঈ এবং উভয়ের মোহিত হইয়া পড়িলেন। তারার অসুখের কথা উঠিলে ভৈরবী বলিলেন যে, তিনি একরাত্রি তারাকে নির্জনে নিজের কাছে রাখিয়া একটি মন্ত্র জপ করিয়া গভীর রাত্রে হোম করিবেন।
অম্বজা বাঈ আনন্দের সহিত তাহাতে অনুরাগপূর্ণ সম্মতি প্রকাশ করিলেন। অতঃপর নির্দিষ্ট রাত্রে তারাবাঈকে লইয়া ভৈরবী মন্ত্র জপ করিতে লাগিলেন। কিছু রাত্রি পর্যন্ত মন্ত্র জপ করিবার পরে, ভৈরবী তারাকে বলিলেন, “তোমার এ মানসিক বিকার প্রেমের জন্যই সংঘটিত হয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই কারও প্রেম-পাশে আবদ্ধ হয়েছে। তিনি কে আমাকে খুলে বল।”
তারাবাঈ ভৈরবীর কথা শুনিয়া লজ্জায় অধোবদন হইল, তাহার গণ্ড রক্তাক্ত হইয়া আবার মলিন হইয়া গেল। তারা নীরবে হতাশের দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।
ভৈরবী বলিলেন, “আমি গণনায় দেখছি যে, সেই নাগররাজ মুসলমান কুলোদ্ভব। তুমি মারাঠী-রাজকুমারী হয়ে কিরূপে মুসলমান নাগরের রূপে মুগ্ধ হলে, ইহা ত নিতান্তই আশ্চর্যের বিষয়! যা হ’বার তা’ ত হয়ে গিয়েছে। এক্ষণে তাতে ভুলে যাবার চেষ্টা করাই সঙ্গত। ভুলবার চেষ্টা করলে, ভুলে যাওয়াটা কঠিন নহে?”
তারা কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন “তা’ সম্পূণ অসম্ভব।
ভৈরবীঃ বটে! প্রেম কি এতই গভীর হয়েছে? এত ফাঁসিয়া গেলে ত মুশকিল! জাতি কুল মজাইয়া প্রেম করা ত ভাল নয়।
তারাঃ প্রেম কি জাতি-কুল বুঝিয়া চলে? তটিনী যেমন নিভৃত গিরিকন্দর হ’তে নির্গত হয়ে আপনার মনে আপনার ভাবে পথ কাটিয়ে সাগর-সঙ্গমে প্রবাহিত হয়, প্রেমও তেমনি উদ্দাম গতিতে আপনার মনের পথে ছুটে চলে। নদী যেমন পথে চলতে কা’কেও জিজ্ঞাসা সমুদ্রের সম্মিলন লাভ না করে কিছুতেই ক্ষান্ত হয় না, প্রেমও তেমনি আকাঙ্খিতকে প্রাপ্ত না হয়ে স্থির হতে পারে না।
ভৈরবীঃ তুমি দেখছি, প্রেম-রাজ্যের মস্ত দার্শনিক পন্ডিত হয়ে পড়েছে! তোমার সঙ্গে এটে উঠা কঠিন!
তারাঃ আপনার বিনয় প্রকাশের কায়দা অতি চমৎকার! এই অধীনা এবং অধমাকে আর লজ্জিত করবেন না। আপনার চেহারা দেখে এবং কথা শুনে আমি একরূপ অনির্বচনীয় শান্তি লাভ করেছি। আপনার স্বর যেন কত কালের পরিচিত! আর আপনাকে যেন কতই প্রাণের জন বলে বোধ হচ্ছে! কেন এরূপ হচ্ছে, তা’ ঠিক বুঝতে পারছি না!
ভৈরবীঃ আমিও সত্য সত্যই তোমার জন্য প্রাণের ভিতরে গভীর মমতা বোধ করছি। তোমাকে নিতান্তই আত্মীয়তম, মধুরতম এবং প্রিয়তম বলে বোধ হচ্ছে। এণে আমি তোমার অভীষ্ট সিন্ধ হবার কোনও আনুকূল্য করতে পারলেই কৃতার্থ এবং সুখী হতে পারি।- এই বলিয়া ভৈরবী গভীরভাবে ধ্যানমগ্না হইলেন। দীর্ঘ ধ্যানের পর সহসা ধীরে চুরুম্মিলন পূর্বক প্রভাত-প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় স্মিত হাস্যে বলিলেন, “তোমার ভাগ্যাকাশ ঊষালোক আলোকিত দেখে আশ্বস্ত হলাম!-এই বলিয়া ভৈরবী গম্ভীর মূর্তি ধারণ করিলেন।
তারাঃ কি দেখলেন? বিশদরূপে বুঝিয়ে বলুন।
ভৈরবীঃ আর কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না। অভীষ্ট সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হবে।
তারাঃ এখানে বসেই কি অভীষ্ট সিদ্ধ হবে?
ভৈরবীঃ নিশ্চয়ই না।
তারাঃ তবে কোথায় যেতে হবে?
ভৈরবীঃ তা’ আমি জানি। সমুদ্র-সঙ্গম ব্যতীত গতি আর কোথায়?
তারাঃ কে আমাকে নিয়ে যাবে?
ভৈরবীঃ যে তোমাকে নিতে এসেছে।
তারাঃ আপনি! আপনি!! আপনি আমাকে নিতে এসেছেন! বটে, প্রেমাস্পদের সহিত মিলনের জন্য, কিম্বা দেবতার মন্দিরে বলিদানের জন্য! ভৈরবীর প্রাণ যে অতি কঠোর। আমার জন্য আপনার এত গরজ কি? কে আপনি?
ভৈরবীঃ বেশী কথা বলো না। স্থির হও। আমি কে, এই দেখ।
ভৈরবী এই বলিয়া তাহার বাহুর উপরের অংশে একটি দাগ দেখাইল। এতক্ষণ ইহা বস্ত্রাবৃত ছিল।
তারা এই অস্ত্র লেখা দেখিয়া বিস্মিত এবং আনন্দিত হইল। ভৈরবীর কণ্ঠ আলিঙ্গন করিয়া তারার বক্ষে মুখ লুকাইয়া আনন্দাশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিল। ভৈরবী আনন্দোদ্বেলিত চিত্তে তারা পেলবগন্ডে দুইটি গাঢ় চুম্বন করিয়া স্নেহভরে বলিলেন, “আর অশ্রু বর্ষণ করো না। তোমার ক্রন্দনে আমার হৃদয় মথিত হচ্ছে। প্রস্তত হও। নদীর ঘাটেই নৌকা। এখনই এই স্থান ত্যাগ করে নৌকায় আরোহন করতে হবে।”
তারার মুখমন্ডল সহসা মেঘাবরণ মুক্ত শরচ্চন্দ্রের মত সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল! আনন্দোজ্জ্বাসে তারার হৃদয়ের স্তরে স্তরে এবং শোণিতের কণায় কণায় বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল!! নৈরাশ্যের গ্রীস্ম-জ্বালা পরিশুঙ্ক হৃদয়-তটিনীতে আশা ও আনন্দের বর্ষাকালীন জীমূত-ধারা মূষলধারে বর্ষিত হইতে লাগিল। সে বর্ষণে প্রেমের দু’কূল-প্লাবী বান ডাকিয়া যুবতীর হৃদয় তোলপাড় করিয়া দিল। ঝটিকা-সংক্ষুব্ধ-অম্বুধির ন্যায় তাহা চঞ্চল এবং উত্তাল হইয়া উঠিল।
অতি সত্বর ভৈরবীও বেশ পরিবর্তন করিয়া সাধারণ মারাঠী যুবকের ন্যায় সজ্জিত হইলেন। অতঃপর আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সহ নির্গত হইবার উপক্রম কালে তারা বিঠ্ঠলজীর প্রতিমাটি ভূপাতিত করিয়া পদাঘাতে তাহা ভগ্ন করিয়া ফেলিল! ভৈরবী বলিলেন, “তারা! ছি! ছি! এ করলে কেন? প্রতিমার সহিত প্রতিহিংসা কিসের?
তারাঃ প্রতিহিংসার জন্য নহে। মারাঠীদের ভ্রমাপনোদনের জন্য। তাহারা এই মূর্তিকে জাগ্রত এবং জীবিত বলিয়া জানে! আমার সঙ্গে মত দিন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আমি এই প্রমাণ করে গেলাম যে, ইহা প্রস্তর ব্যতীত আর কিছুই নহে। এতে তাদের অনেকের ভ্রান্তি দূর হবে।
ভৈরবীঃ দেখছি, তুমি মূর্তিপূজক কাফেরের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর ন্যায় প্রতিমা চূর্ণ করতে বিশেষ আনন্দ লাভ করে।
অতঃপর ভৈরবী এবং তারা নিশীথের গভীর অন্ধকারের মধ্যে যথাস্থানে যাইয়া নৌকায় আরোহন করিলেন। সুবাতাস বহিতেছিল। নৌকা পাল-ভরে তীরের মত ছুটিয়া চলিল। পাঠক-পাঠিকা! বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছেন যে, এই ভৈরবী আর কেহ নহে, ভৈরবী আমাদেরই অসাধারণ তেজঃস্বিনী বিচিত্রকর্মা মালেকা আমেনাবানু।