বিজাপুরের সোলতানের পক্ষ হইতে পঞ্চদশ সহস্র, পদাতিক, দুই সহস্র অশ্বারোহী, সাতশত গোলন্দাজ সৈন্য কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইয়াছে। শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংস ব্যবহারের সংবাদ শ্রবণে ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হইয়া বিজাপুর দরবার শিবাজীকে সমস্ত দস্যু-সৈন্যসহ ধ্বংস করিতে এই সৈন্যদল প্রেরণ করেন।
আফজাল খাঁ কৃষ্ণগড়ে রাজকীয় বাহিনীর আগমন আশায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। যথাসময়ে এই নূতন বাহিনী কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইলে, মহাবীর আফজাল খাঁ শিবাজীর সহিত যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীর প্রতি নিতান্ত রুষ্ট এবং বিরক্ত হইয়া মালেকা আমেনা বানুও ইসলামের মহাশক্র শিবাজীর ধ্বংস সাধন মানসে মহাবীর আফজাল খাঁর সহিত যোগদান করিলেন।
ক্রমাগত যুদ্ধ চলিতে লাগিল। শিবাজী সন্মুখ-সমরে অক্ষম হইয়া ক্রমাগত পশ্চাদবর্তন করিতে করিতে সহ্যাদ্রি পর্বতের দুর্গম অরণ্য এবং গিরিগহবর পরিপূর্ণ স্থানে যাইয়া আশ্রয় লইলেন। হঠাৎ আক্রমণ, গুপ্ত আক্রমণ এবং নৈশ আক্রমণ এই তিন আক্রমণ দ্বারা মধ্যে মধ্যে মোসলেম বাহিনীকে বিপদাপন্ন এবং চঞ্চল করিতে লাগিলেন। মোসলেম সৈন্য তাহার দস্যুসৈন্যের অনুসরণ করিলে তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া নিবিড় অরণ্যানী এবং পর্বতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ফেরুপালের ন্যায় লুক্কায়িত হইয়া পড়িত। ফলতঃ শিবাজীর মাওয়ালী দস্যুগণ পলায়নে এবং হঠাৎ আক্রমণে যার-পর-নাই অভ্যস্ত হইয়াছিল!
তাহাদের পলায়ন এবং আক্রমণ বস্ততঃই শৃগালের ন্যায় দ্রুত এবং কৌশলপূর্ণ ছিল। ফলতঃ শিবাজীর নামের অর্থ তাঁহার কার্যের সঙ্গে বেশ সার্থক হইয়াছিল। তখনকার দিনে “শিবাজী দরহকিকত শিবাজী আস্ত।” অর্থাৎ শিবাজী কার্যতঃ যথার্থ “শৃগাল,” একথা দাক্ষিণাত্যের সর্বত্রই প্রবাদবাক্যের ন্যায় প্রচলিত হইয়াছিল।
শিবাজীর ধূর্ততা, ছলনা এবং মিথ্যাবাদিতার কিছু ইয়ত্তা ছিল না। স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের আকাঙা তাঁহাকে এমনি অধীর ও আকুল করিয়া তুলিয়াছিল যে, তিনি তাঁহার অভীষ্ট সাধন মানসে কোনও প্রকার পাপ ও অন্যায়কে বিন্দুমাত্রও পরওয়া করিতেন না।
খুন, জখম, চৌর্য, প্রবঞ্চনা তাঁহার জীবনের নিত্য কর্তব্যকর্ম মধ্যে পরিগণিত ছিল। এহেন ধূর্ত শিবাজীর সহিত পুনঃ পুনঃ সন্মুখ-সমরে চেষ্টা করিয়াও আফজাল খাঁ কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। তরঙ্গায়িত উচ্চাবাস ভূমি, নিবিড় অরণ্য, পর্বতের অসংখ্য গুহা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্বত্য-নদীর গর্ভ ও উচ্চপাড়ের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া শিবাজী মধ্যে মধ্যে ‘রাতহানা’ দিয়া বিজাপুরের সুশিতি বাহিনীকে যার-পর-নাই ত্যক্ত-বিরক্ত করিতে লাগিলেন।
পার্বত্য প্রদেশে দস্যুদলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করা বহু বিলম্ব এবং ক্ষতি সাপেক্ষ দেখিয়া, বীরাঙ্গনা মালেকা আমেনা বানু শিবাজীর জন্মভূমি রায়গড় আক্রমণ করাই ন্যায়সঙ্গত মনে করিলেন। রায়গড় আক্রমণ করিলে, শিবাজী বাধ্য হইয়া সন্মুখ-যুদ্ধ দান করিতে বাধ্য হইবেন বলিয়া, মালেকা আমেনা বানু আফজাল খাঁকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন।
কিন্তু আফজাল খাঁ এই পার্বত্য প্রদেশেই শিবাজীকে হীনবল এবং ধৃত করিবার জন্য নানা প্রকার কায়দা-কৌশল এবং ফন্দী খাটাইতে লাগিলেন। মাওয়ালী ও মারাঠী দস্যুগণ ছদ্মবেশ ধারণ এবং চৌর্যকার্যেও বিলক্ষণ পটু ছিল। রাত্রিতে তাহারা নানা প্রকার পশু, বিশেষতঃ গরু-ঘোড়ার কৃত্রিম বেশে আসিয়া মুসলমান শিবিরের খোঁজ-খবর লইয়া যাইত। পার্বত্য রমণীদিগের রূপ ধারণ করিয়া দিবসে তাহারা নানা প্রকার ফলমূল এবং তরিতরকারীও বিক্রয় করিতে আসিত।
মধ্যে মধ্যে সন্দেহবশে কয়েকজনকে ধৃত করায়, তাহার মারাঠী গুপ্তচর বলিয়া প্রকাশ পাওয়ায় পাহারা আরও কড়াকড়ি করা হইল। মালেকা আমেনা বানু বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহাকে এবং শিবাজী-নন্দিনী তারাবাঈকে কোনও রূপে বন্দী বা নিদ্রিতাবস্থায় চুরি করিয়া লইবার জন্য শিবাজীর দলপতিগণ বিশেষ তদবির করিতেছেন।
মালেকা এবং তারাবাঈ সাবধানতার জন্য অস্ত্র-পাণি হইয়া শয়ন করিতেন। মারাঠীরা যে-কোনওরূপে এই সুন্দরীদ্বয়ের কাহাকেও অপহরণ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা কেহ স্বপ্নেও চিন্তা করিলেন না। মোতামদ খান স্বয়ং রাত্রিতে মালেকা এবং তাঁহার শিবিরের প্রহরীদিগের সতর্কতার জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিলেন।
কিন্তু মানুষ যখন যে-বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধান হয়, অনেক সময় যেমন তাহাতেই অসম্ভাবিতরূপে বিপদ ঘটিয়া থাকে; তেমনি এই সাবধানতার মধ্যেও গুরুতর বিপদ সংঘটিত হইল।
সহসা এক দিন প্রভাতে দেখা গেল যে মালেকার শিবিরে মালেকা নাই। তাঁহার শিবিরের মধ্যে একটি গর্ত রহিয়াছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল, তাহা গর্ত নহে সুড়ঙ্গ। অশ্রু বক্র পথে পনর শত হস্ত পরিমিত সুড়ঙ্গ কাটিয়া মালেকাকে গভীর নিশীথে নিদ্রিয়বস্থায় বেহুঁশ করিয়া অপহরণ করিয়াছে।
অতঃপর সেই সুড়ঙ্গ পথে নামিয়া ধীরে ধীরে সকলে এক বনের মধ্যদেশে একখন্ড পরিস্কৃত ভূমি দেখিতে পাইলেন। সেখানে কিছু পূর্বেও লোক ছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা গেল। সুড়ঙ্গের মাটিগুলি একস্থানে রাশীকৃত না করিয়া ক্রমশঃ নদীর জলে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
সুড়ঙ্গের মুখে একটি লতাগুল্মের ঝোপ রহিয়াছে। এমন কৌশলপূর্ণ স্থান যে, দেখিয়াও সহসা কেহ কিছু নির্ধারণ করিতে পারে না।
মালেকা আমেনা বানুকে যে মারাঠীরা অচিন্ত্যভাবে সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করিয়া অপহরণ করিয়া লইয়াছে, সে-বিষয়ে কাহারও আর কোনও সন্দেহ রহিল না। মালেকার জন্য মোসলেম শিবিরে ভীষণ হাহাকার পড়িয়া গেল! আফজাল খাঁ যার-পর-নাই শোকার্ত হইয়া পড়িলেন। সৈন্য-সামন্ত সকলেই বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইল!
তারাবাঈ তাঁহার আশ্রয়দাত্রী এবং পরম হিতৈষিণী মালেকার অপহরণে যার-পর-নাই ক্ষুণ্নমনা এবং বিষাদের বিমলিন হইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
আমেনা বানুর মাতা শোকে পাগলিনী হইয়া উঠিলেন। পাছে বা ধর্মাধর্ম জ্ঞানশূন্য পাষন্ড কাফেরগণ এই মোসলেম সুন্দরীকে কলঙ্কিত অথবা নিহত করে, ইহা ভাবিয়া সকলেই পেরেশান ও লবেজান হইয়া উঠিলেন।
দরী-গিরি, বন-জঙ্গল, নদ-নালা, সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করা হইল। মারাঠীদিগকে ভীষণভাবে যত্র তত্র আক্রমণ করিয়া বিপর্যস্ত ও বিধ্বত করতঃ বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা হইল! কিন্তু কোথায়ও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
অনেক মারাঠীকে বন্দী করিয়া বিশেষ প্রলোভন এবং প্রাণদণ্ডের ভয় দেখাইয়াও তাহাদের নিকট হইতে কোনও তত্ত্ব পাওয়া গেল না। চতুর্দিকে বহু গুপ্তচর প্রেরণ করিয়াও কোনও সূত্র আবিস্কার করা গেল না। সকলেই যার-পর-নাই নিমর্ষ ও শোকাকুল চিত্তে দিন-যাপন করিতে লাগিলেন।
মহাবীর আফজাল খাঁ এবং বীরবর মোতামদ খান নানা প্রকার নূতন নূতন পন্থা এবং কৌশল অবলম্বন করিয়া মালেকার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শিবাজীকে বন্দী করিতে পারিলে, সমস্ত উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হইবে বুঝিয়া, শিবাজীকে বন্দী করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিতে লাগলেন।
কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেল যে, শিবাজী তখন আবহক্ষেত্রে উপস্থিত নাই। সেনাপতি আবাজী তখন শিবাজীর প্রতিনিধি যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করিতেছেন। অতঃপর শিবাজীর অবস্থান নিরূপণের জন্য বিশেষ চেষ্টা হইতে লাগিল।
মনে হচ্ছে ভালই হবে । শুরুটা সুন্দর হয়েছে । বাকিটা তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্য চেষ্টা করবেন ।